অভয় চক্রবর্তী
অধ্যায় ১: পথের শুরু
ট্রেনের জানালা দিয়ে তাকিয়েই প্রথম যে দৃশ্যটা ধরা দিল, তা হলো লালচে মাটির বিস্তার আর শালমহুয়ার গাছের সারি। কোলাহলমুক্ত ছোট্ট স্টেশন, যাত্রীদের ভিড়ও অদ্ভুতভাবে শান্ত—মনে হচ্ছিল কেউই তাড়াহুড়ো করছে না, যেন এখানে সময়ের গতি খানিকটা থেমে গেছে। ট্রেন থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গেই এক অনন্য আবহ আমাকে ঘিরে ধরল। শহরের দমচাপা পরিবেশ থেকে মুক্ত হয়ে প্রথম নিঃশ্বাসেই বুঝলাম—এই জায়গার বাতাসেই অন্যরকম স্বাদ। রেলস্টেশন থেকে মাটির পথ ধরে হাঁটা শুরু করলাম। চারপাশের দৃশ্য যেন আমাকে বলছে, “তুমি এসে গেছো এক নতুন দুনিয়ায়।” পথের দুই পাশে পল্লীগ্রামের ছোঁয়া, কাঁচা ঘর, উঠোনে শীতলপাটি শুকোচ্ছে, কোথাও আবার মাটির কলসি সাজানো। দূরে কয়েকজন বালক খেলছে, তাদের হাসির শব্দ বাতাসে ভেসে এসে মনে করিয়ে দিচ্ছে শৈশবের দিনগুলো। এই হাঁটাপথের প্রতিটি ধুলো যেন কবিতার মতো—একেকটি পদক্ষেপে মনে হচ্ছিল, আমি শুধু ভ্রমণ করছি না, বরং সময়ের ভেতর দিয়ে এক যাত্রা শুরু করেছি।
শান্তিনিকেতনের পথে যত এগোতে লাগলাম, ততই দৃশ্যপটে ফুটে উঠতে লাগল প্রকৃতির সৌন্দর্য। সূর্যের আলো গাছের পাতার ফাঁক গলে ছায়া-আলোয় সাজিয়ে তুলছে পথকে। মাটির ধুলোয় পায়ের শব্দ যেন নিজেই এক ধরনের সঙ্গীত, যা মিলেমিশে যাচ্ছে পাখির ডাক আর বাতাসের মৃদু শিসের সঙ্গে। দূরে কোথাও একজন বাউল গাইছিলেন, সুর ভেসে আসছিল—অস্পষ্ট অথচ হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া। মনে হচ্ছিল এ পথের প্রতিটি ধাপে রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতি আছে, তাঁর কবিতার ছন্দ যেন পাতায় পাতায় ভেসে বেড়াচ্ছে। বিশ্বভারতীর অন্দরমহল এখনো দূরে, তবু পথের আবহেই বোঝা যাচ্ছিল এটি কেবল একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়, বরং এক দর্শনের প্রতীক। হঠাৎই চোখে পড়ল এক বৃদ্ধ কৃষক, কাঁধে লাঙল নিয়ে তিনি ফিরছেন মাঠ থেকে। তার চোখে-মুখে ক্লান্তি থাকলেও শান্তির ছাপ স্পষ্ট—যেন এই মাটিই তাকে দিয়েছে জীবনের সম্পদ। আমি থেমে দাঁড়ালাম, মাটির গন্ধ শ্বাসে টেনে নিলাম, আর মনে হল—এই গন্ধই তো বাংলার আসল চিহ্ন, শহরে যা অনেক আগেই হারিয়ে ফেলেছি।
এই পথচলার মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল, আমি যেন এক অদ্ভুত স্বপ্নে হাঁটছি। গ্রামের উঠোনে কাক ডাকছে, কোথাও মাটির চুলায় ধোঁয়া উঠছে, শিশুরা দৌড়ে যাচ্ছে স্কুলের দিকে। এইসব সাধারণ দৃশ্যেই লুকিয়ে আছে অসাধারণ সৌন্দর্য। পথের একপাশে ছোট্ট দোকান—সেখানে কচি ডাব, হাতের তৈরি ঝুড়ি, মাটির হাঁড়ি সাজানো। দোকানদার হাসিমুখে আমাকে ডেকেছিলেন, যেন অতিথির প্রতি প্রাচীন বাংলার আতিথেয়তার প্রতিচ্ছবি। আমি কিছু কিনিনি, তবু তার হাসি আমাকে ভরিয়ে দিল। এই গ্রাম্য সরলতার মধ্যেই শান্তিনিকেতনের মূল সত্তা লুকিয়ে আছে—যেখানে মানুষের মধ্যে নেই ভেদাভেদ, নেই তাড়া বা প্রতিযোগিতা। মাটির পথ যত দীর্ঘ হচ্ছিল, ততই আমার ভেতরে জমছিল এক অদ্ভুত প্রশান্তি, যেন প্রতিটি পদক্ষেপে আমি খুঁজে পাচ্ছি নিজেকে। এই প্রথম অধ্যায়ে পথের শুরুতেই বুঝলাম—এই ভ্রমণ শুধু প্রকৃতি দেখার নয়, বরং অন্তরের ভেতর এক গভীর যাত্রা। শান্তিনিকেতনের মাটির পথ আমাকে ডাকছিল—আর আমি নিঃশব্দে, বিনম্রভাবে তার আহ্বান গ্রহণ করলাম।
অধ্যায় ২: রবীন্দ্রনাথের ছায়া
মাটির পথ ধরে এগোতে এগোতেই হঠাৎ যেন পরিবেশে ভেসে উঠল এক অদৃশ্য কণ্ঠস্বর, যা কেবল অনুভব করা যায়, শোনা যায় না। সেটি ছিল রবীন্দ্রনাথের ছায়ার উপস্থিতি, এক অদৃশ্য অথচ সর্বব্যাপী অনুভূতি। শান্তিনিকেতনের প্রতিটি গাছ, প্রতিটি ঘাস, প্রতিটি ধুলিকণাতেই যেন কবিগুরুর ছোঁয়া লেগে আছে। যখন প্রথম বিশ্বভারতীর মূল প্রাঙ্গণের কাছে পৌঁছালাম, তখনই মনে হলো—আমি প্রবেশ করছি এক কবির স্বপ্নলোকে, যেখানে শিক্ষা আর প্রকৃতি মিলেমিশে একাকার হয়েছে। খোলা মাঠের ধারে গাছের তলায় ছেলেমেয়েরা বই নিয়ে বসে পড়ছে—শিক্ষার এমন এক মাধুর্যপূর্ণ পরিবেশ, যা রবীন্দ্রনাথ কল্পনা করেছিলেন বহু বছর আগে। মাটির পথ পেরিয়ে হেঁটে চলতে চলতে বারবার মনে হচ্ছিল, আমি যেন তাঁর কবিতা আর গানের ভেতর দিয়ে হেঁটে চলেছি। গাছের পাতায় ভেসে আসা হাওয়ার মৃদু শব্দ যেন বলছে—“যেখানে সীমারেখা মিলেছে অনন্তের সীমানায়, সেখানেই আমি।”
বিশ্বভারতীর চত্বরে ঢুকে মনে হলো, এটি কেবল একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়, বরং একটি পূর্ণাঙ্গ দর্শনের রূপায়ণ। লাল মাটির প্রান্তর জুড়ে সাদামাটা ভবন, কোনো বিলাসিতা নেই, নেই আড়ম্বর—বরং সরলতার মধ্যেই লুকিয়ে আছে গভীর সৌন্দর্য। মাটির পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে চোখে পড়ল গাছতলায় রাখা কাঠের বেঞ্চ, যেখানে শিক্ষকরা ছাত্রদের সঙ্গে আলোচনায় মগ্ন। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন, প্রকৃতির সঙ্গে মিশে শিক্ষালাভই সত্যিকার শিক্ষার মূল। আর সেটাই এখানে চোখের সামনে ফুটে উঠছিল। তাঁর স্বপ্ন ছিল এমন একটি জায়গা, যেখানে শিক্ষার্থীরা বইয়ের বাইরেও প্রকৃতির কাছ থেকে শিখবে জীবনকে। চারদিকে যতই তাকাই, তাঁর সেই স্বপ্ন বাস্তব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কোনো ছাত্র গাছের ছায়ায় বসে গান গাইছে, কেউবা আবার চিত্রাঙ্কনে ব্যস্ত—সবকিছুতেই যেন এক মুক্তির ছাপ। মনে হচ্ছিল, এ এক অদ্ভুত সুরের রাজ্য, যেখানে প্রতিটি ধ্বনি আর প্রতিটি দৃশ্যই রবীন্দ্রনাথের স্পর্শে পবিত্র হয়ে আছে।
এই আবহে দাঁড়িয়ে আমি অনুভব করলাম, রবীন্দ্রনাথ শুধু একজন কবি নন, তিনি ছিলেন এক দার্শনিক, এক সমাজ-সংস্কারক, যিনি মানুষকে মুক্তির পথে আহ্বান জানিয়েছিলেন। তাঁর গান, তাঁর কবিতা, তাঁর নাটক, এমনকি তাঁর প্রতিটি রচনায় যে মুক্তচিন্তার সুর বাজে, সেই একই সুর এখানে মাটির পথের প্রতিটি বাঁকে শোনা যায়। যেন তিনি এখনো হেঁটে বেড়াচ্ছেন এই পথেই, ছাত্রদের সঙ্গে কথা বলছেন, তাঁদের উৎসাহিত করছেন নতুন স্বপ্ন দেখার জন্য। আমি এক মুহূর্তের জন্য চোখ বন্ধ করলাম—মনে হলো, লাল মাটির ধুলোয় ভেসে আসছে তাঁর পদচিহ্ন, গাছের পাতায় বাজছে তাঁর কবিতার ছন্দ। এই ভ্রমণ কেবল স্থান দেখার নয়, এটি এক অদ্ভুত আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা, যেখানে রবীন্দ্রনাথের ছায়া প্রতিনিয়ত সঙ্গী হয়ে আছে। সেই ছায়া আমাকে শিখিয়ে দিল, জীবনের আসল সৌন্দর্য খুঁজে নিতে হলে প্রকৃতির কাছে ফিরে আসতে হবে, সরলতার কাছে ফিরে আসতে হবে। আর এই শিক্ষা আমার ভ্রমণের দ্বিতীয় অধ্যায়কে এক অমলিন স্মৃতিতে পরিণত করল।
অধ্যায় ৩: শান্তির আবেশ
শান্তিনিকেতনের মাটির পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎই যেন সময় থেমে গেল। শহরের কোলাহল, যানবাহনের হর্ন, মানুষের হইচই সবকিছু যেন মুছে গেল এক নিমেষে। চারদিকে শুধু নীরবতা, আর সেই নীরবতার ভেতর প্রকৃতির সুরের এক অপার্থিব মেলবন্ধন। পাখির ডাক ভেসে আসছিল গাছের ডাল থেকে, দূরে কোথাও শালিকের ঝাঁক উড়ে যাচ্ছিল, আর হাওয়া যখন শাল-মহুয়ার পাতার সঙ্গে মিশে যেত, তখন এক অদ্ভুত শব্দ তৈরি হতো, যা কানে আসত যেন সুরের মতো। মাটির ধুলোয় হাঁটতে হাঁটতে অনুভব করছিলাম এক গভীর প্রশান্তি, এমন প্রশান্তি যা কোনো শহরের কংক্রিটের ভেতর খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে যখন আমি চারপাশে তাকালাম, তখন দেখলাম, ছোট্ট ছোট্ট দৃশ্য কত বড়ো আনন্দ বয়ে আনে। কোথাও গরুর গাড়ি ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে, কোথাও বা দুই শিশু হাতে হাত ধরে মাঠের দিকে দৌড়াচ্ছে। এই সহজ-সরল দৃশ্যগুলো মনে এমন শান্তি এনে দিল, যেন মনের সমস্ত ক্লান্তি একে একে মুছে যাচ্ছে।
এই শান্তির আবেশ কেবল বাইরের পরিবেশেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং আমার ভেতরেও তার প্রভাব পড়ছিল। মনে হচ্ছিল, এতদিন ধরে অজান্তে আমি যে এক দমচাপা জীবনযাপন করেছি, তা এই মাটির পথে হেঁটে হেঁটে ধীরে ধীরে ঝরে যাচ্ছে। প্রতিটি পদক্ষেপ আমাকে এক নতুন মুক্তির দিকে নিয়ে যাচ্ছিল। আমি যেন ভুলে যাচ্ছিলাম দৈনন্দিন জীবনের ব্যস্ততা, কাজের চাপ, শহরের হট্টগোল। এখানে সময়ের কোনো তাড়া নেই, নেই প্রতিযোগিতা। সকালের সূর্যের আলো যখন ধীরে ধীরে গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে এসে পড়ছিল পথের উপর, তখন মনে হচ্ছিল যেন প্রকৃতি নিজেই আলোর হাত ধরে আমাকে ছুঁয়ে দিচ্ছে। এই আলোর সঙ্গে মিশে ছিল বাতাসে উড়ে আসা মাটির গন্ধ, যা অদ্ভুতভাবে মনে করিয়ে দিচ্ছিল শৈশবের স্মৃতি। যেন অনেক বছর আগের গ্রামে ফেরা, যেখানে জীবন ছিল অতি সরল, অথচ গভীরভাবে পরিপূর্ণ। শান্তিনিকেতনের এই শান্ত পরিবেশ আমাকে ভেতর থেকে বদলে দিতে শুরু করেছিল।
এখানে শান্তি মানে কোনো শূন্যতা নয়, বরং পূর্ণতার অনুভূতি। এই পূর্ণতা আসে প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হওয়ার মধ্যে দিয়ে। একটি পাখির ডাক, একটি গাছের ছায়া, এমনকি একটি শিশুর হাসি—সবকিছুই এখানে জীবনের আনন্দ হয়ে ওঠে। মনে হচ্ছিল, আমি যদি এখানে দীর্ঘদিন থাকতে পারতাম, তবে হয়তো আমার ভেতরের সমস্ত অস্থিরতা গলে যেত। রবীন্দ্রনাথ নিশ্চয়ই এই কারণেই শান্তিনিকেতনকে বেছে নিয়েছিলেন, তাঁর সৃষ্টির কেন্দ্র করেছিলেন। কারণ এই আবেশ মানুষকে ভেতর থেকে গড়ে তোলে, জীবনের সৌন্দর্যকে নতুনভাবে চিনতে শেখায়। শহরে আমরা যা হারিয়ে ফেলেছি—সেই প্রকৃতির মায়া, মানুষের সরলতা আর সময়ের ধীর ছন্দ—সবকিছুই এখানে ফিরে আসে। এই অধ্যায় শেষে আমি বুঝলাম, শান্তিনিকেতনের মাটির পথ শুধু এক ভ্রমণের রাস্তা নয়, এটি এক আধ্যাত্মিক যাত্রার সূচনা, যেখানে প্রতিটি পদক্ষেপে লুকিয়ে আছে শান্তির আবেশ।
অধ্যায় ৪: হাটে-বাজারে হাঁটাহাঁটি
শান্তিনিকেতনের মাটির পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎই একসময় পৌঁছে গেলাম স্থানীয় হাটের সামনে। গ্রামীণ হাটের চেহারা সব জায়গায় প্রায় একই রকম হলেও শান্তিনিকেতনের হাটের ভেতর একটা বিশেষত্ব আছে—এখানে কেবল কেনাবেচা হয় না, বরং এক ধরনের সংস্কৃতি বিনিময়েরও আয়োজন চলে। দূর থেকেই চোখে পড়ল বাঁশের খুঁটি আর পাটখড়ির ছাউনিতে সাজানো দোকানপাট। কেউ বিক্রি করছে হাতে তৈরি মাটির হাঁড়ি, কেউ রঙিন কাঁথা, আবার কেউ বা বাঁশের ঝুড়ি। সবকিছুর মধ্যে একটা মাটির ছোঁয়া, একটা গ্রামীণ স্পর্শ, যা একেবারে আলাদা। বাজারের ভেতরে ঢুকতেই বাতাসে ভেসে এল সরষে তেলের গন্ধ, মিষ্টির দোকান থেকে ছড়িয়ে পড়ল নলেন গুড়ের সন্দেশ আর পাটিসাপটার ঘ্রাণ। এই হাটের ভিড়ে দাঁড়িয়েই বুঝলাম, এখানকার মানুষ কেবল বেচাকেনার জন্য আসেন না, বরং মেলামেশা, আলাপচারিতা আর আনন্দ ভাগ করে নেওয়ার জন্যও এখানে জড়ো হন। প্রতিটি মুখে এক আন্তরিক হাসি, প্রতিটি কণ্ঠে সরল সুর—এমন আবহে আমি নিজেকে আর ভ্রমণকারী মনে করছিলাম না, মনে হচ্ছিল আমি নিজেই এই পরিবেশের অংশ।
হাটে হাঁটতে হাঁটতে খেয়াল করলাম, কত বৈচিত্র্যের মধ্যে দিয়ে গড়ে উঠেছে শান্তিনিকেতনের এই সংস্কৃতি। একপাশে বসে আছে সাঁওতাল মহিলারা, হাতে তৈরি মালা, কাঠের অলংকার সাজিয়ে বিক্রি করছে। তাদের হাসির শব্দ আর রঙিন শাড়ির ঝলক পুরো পরিবেশকে করে তুলছিল উৎসবমুখর। আবার অন্য এক কোণে বাউলরা বসে গেয়ে চলেছেন তাদের প্রিয় গান। একতারা হাতে তাঁদের সুর যেন ভিড়ের কোলাহল কেটে হৃদয়ে এসে পৌঁছাচ্ছিল। বাউলের গান শুধুই বিনোদন নয়, বরং দর্শন; তারা গান গাইছে মানুষ খোঁজার, নিজের ভিতরকার সত্য খোঁজার কথা। হাটের মানুষেরা থেমে দাঁড়িয়ে শুনছিল, কেউ কেউ মুগ্ধ হয়ে মাথা দুলিয়ে দিচ্ছিল। আমি থেমে দাঁড়িয়ে শুনলাম সেই গান—কত সহজ কথায় তারা বলে গেল জীবনের গভীরতম সত্য। বাজারের ভেতরেই যেন অদৃশ্যভাবে মিলেমিশে যাচ্ছিল ব্যবসা, শিল্প, সঙ্গীত আর দর্শনের স্রোত।
এই হাটে-বাজারের হাঁটাহাঁটি আমার ভ্রমণকে এক নতুন মাত্রা দিল। এখানে এসে বুঝলাম, শান্তিনিকেতনের মাটির পথ কেবল প্রকৃতির দিকে নিয়ে যায় না, বরং মানুষের দিকে, তাঁদের জীবনযাপন, তাঁদের সংস্কৃতির দিকে। প্রতিটি দোকান, প্রতিটি মুখ, প্রতিটি সুর একেকটি গল্প বলে। শিশুদের খেলা, মহিলাদের আলাপ, বৃদ্ধদের শান্ত বসে থাকা—সবকিছুর ভেতর এক শান্ত সৌন্দর্য। শহরের বাজারে যেখানে ভিড় মানেই হট্টগোল আর ঠেলাঠেলি, এখানে ভিড় মানেই মিলন, ভ্রাতৃত্ব আর আনন্দ। হাটে-বাজারের এই অভিজ্ঞতা আমাকে মনে করিয়ে দিল, জীবন আসলে কত সরল হতে পারে যদি আমরা সেটিকে জটিল না করি। দিনের শেষে মাটির পথে ফিরে আসতে আসতে মনে হচ্ছিল, এই হাট কেবল একটি বাজার নয়, বরং জীবনের পাঠশালা, যেখানে শিখে নেওয়া যায় মানুষের আসল পরিচয় আর সুখের সহজ সূত্র।
অধ্যায় ৫: বাউলের সুর
মাটির পথ ধরে হাঁটার সময়ই কানে এলো এক অদ্ভুত মায়াবী সুর, যা প্রথমে দূর থেকে অস্পষ্ট শোনালেও ধীরে ধীরে পরিষ্কার হতে লাগল। কাছে যেতেই দেখলাম এক বাউল গায়ক, হাতে একতারা, চোখে স্বপ্নমাখা দৃষ্টি। তার চারপাশে জটলা করে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকজন পথচারী, আর বাতাস ভরে যাচ্ছে তার কণ্ঠের সুরে। সে গাইছিল মানুষের ভেতরের মানুষকে খুঁজে পাওয়ার গান—এক দর্শন, যা বাহ্যিকতার সীমা ছাড়িয়ে গিয়ে আত্মার গভীরে পৌঁছায়। শান্তিনিকেতনের মাটির পথের ধুলোয় দাঁড়িয়ে আমি বুঝলাম, এই সুর শুধুই একটি গান নয়, বরং এক আধ্যাত্মিক আহ্বান। একতারা বাজানোর তালে তালে তার কণ্ঠ যখন আকাশে ভেসে যাচ্ছিল, তখন মনে হচ্ছিল গোটা পরিবেশ যেন এক অপার্থিব শক্তিতে ভরে উঠছে। বাউলের চোখে-মুখে ছিল অদ্ভুত শান্তি, যেন পৃথিবীর কোনো দুঃখ তাকে স্পর্শ করতে পারে না। তার গান শুনে আমার ভেতরেও এক অজানা আবেগ জন্ম নিল, মনে হচ্ছিল, আমি যেন নিজের ভিতরের অচেনা মানুষটিকে খুঁজে পাচ্ছি।
বাউলদের গান কেবল সুর বা ছন্দে সীমাবদ্ধ নয়, বরং তাদের প্রতিটি শব্দে লুকিয়ে থাকে গভীর দার্শনিক তাৎপর্য। তারা গায় মানুষের সঙ্গে মানুষের মিলনের কথা, গায় ভেদাভেদ ভেঙে ভালোবাসার বন্ধন গড়ে তোলার আহ্বান। যখন সেই বাউল বলছিল “মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি”, তখন মনে হচ্ছিল—এই কয়েকটি শব্দেই লুকিয়ে আছে সমগ্র জীবনের পাঠ। শহরের বিলাসিতার ভিড়ে আমরা যেখানে সত্যকে হারিয়ে ফেলি, সেখানে এই বাউল গানের সরল সুরেই লুকিয়ে আছে মুক্তির চাবিকাঠি। তার চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকা কৃষক, ছাত্র, গ্রামবাসী সবাই মুগ্ধ হয়ে শুনছিল, আর কেউ কেউ তাল মিলিয়ে হাততালি দিচ্ছিল। আমার মনে হলো, এ এক অদ্ভুত মিলনক্ষেত্র, যেখানে ধর্ম, জাতি, বয়স কিংবা পেশার ভেদাভেদ গলে মিশে যাচ্ছে একই স্রোতে। এই স্রোতের নাম সঙ্গীত, আর সেই সঙ্গীতেরই নাম বাউল।
সেই মুহূর্তে আমি অনুভব করলাম, শান্তিনিকেতনের মাটির পথ কেন এত বিশেষ। কারণ এই পথ শুধু মানুষকে প্রকৃতির সান্নিধ্যে আনে না, বরং মানুষকে তার আত্মার কাছেও পৌঁছে দেয়। বাউলের সুর আমাকে ভেতর থেকে নাড়িয়ে দিল। মনে হচ্ছিল, জীবন এতদিন ধরে আমি যেভাবে ভেবেছি, আসলে তা নয়—জীবনের আসল সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে সরলতায়, ভালোবাসায় আর অন্তরের মানুষকে খুঁজে পাওয়ায়। যখন বাউলের গান শেষ হলো, তখন চারপাশে নেমে এল এক অদ্ভুত নীরবতা। সবাই যেন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল। আমি আবার মাটির পথে হাঁটা শুরু করলাম, কিন্তু এবার আমার পদক্ষেপ ছিল ভিন্ন—আরও শান্ত, আরও গভীর। কারণ সেই সুর আমার ভেতরে থেকে গেছে, আমাকে শিখিয়েছে কীভাবে মানুষকে ভালোবাসতে হয়, কীভাবে নিজের ভেতরের মানুষটিকে খুঁজে নিতে হয়।
অধ্যায় ৬: ঋতুর রঙ
শান্তিনিকেতনের মাটির পথের সৌন্দর্য শুধু তার লালচে মাটির জন্যই নয়, বরং বছরের প্রতিটি ঋতুতে সে নিজের রূপ পাল্টে নেয়। বসন্তে যখন পলাশ ফুল ফোটে, তখন পুরো পরিবেশ যেন আগুনে রাঙা হয়ে ওঠে। লাল-কমলা রঙের ঝলকানিতে পথের দু’পাশ ভরে যায়, আর সেই দৃশ্য এমন এক মায়া তৈরি করে, যা চোখ সরাতে দেয় না। বসন্ত উৎসবের দিনগুলোতে চারদিকে রঙের খেলা চলে—হলুদ, সবুজ, লাল রঙে ভরে ওঠে মানুষ আর প্রকৃতি। ছাত্ররা গেয়ে ওঠে রবীন্দ্রসঙ্গীত, নাচে মেতে ওঠে সবাই, আর মাটির পথ হয়ে ওঠে এক জীবন্ত উৎসবের আসর। গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে মনে হয়, বসন্ত এখানে কেবল ঋতুর পালাবদল নয়, বরং জীবনের উচ্ছ্বাস, আনন্দ আর মিলনের প্রতীক। শান্তিনিকেতনের মাটির পথ এই ঋতুতে যেন হাসে, গান গায়, আর রঙে ভরে ওঠে মানুষের হৃদয়।
বর্ষার সময় সেই একই পথ অন্য এক আবহে সেজে ওঠে। আকাশ কালো মেঘে ভরে যায়, বজ্রধ্বনি দূরে দূরে শোনা যায়, আর হঠাৎই নেমে আসে বৃষ্টি। লাল মাটির পথ তখন ভিজে চকচকে হয়ে ওঠে, পায়ের ছাপ সহজেই বসে যায় নরম কাদায়। বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে ভেজা মাটির গন্ধ, যা অদ্ভুতভাবে মনকে ভরিয়ে তোলে। গাছপালার পাতায় জমে থাকা বৃষ্টির ফোঁটা টুপটাপ ঝরে পড়ে, আর গ্রামের ছেলেমেয়েরা ভিজতে ভিজতে হাসতে থাকে। এই দৃশ্য যেন এক অদ্ভুত মুক্তির অনুভূতি দেয়—শহরের জীবন যেখানে বৃষ্টিকে অসুবিধা মনে করে, এখানে তা আনন্দের উৎসব। বর্ষায় শান্তিনিকেতনের মাটির পথ যেন অন্য এক কবিতা হয়ে ওঠে, যেখানে প্রতিটি ফোঁটা সুরের মতো নেমে আসে, আর প্রকৃতিকে করে তোলে সজীব।
আবার যখন শরৎ আসে, তখন সাদা কাশফুলের দোলা পথের দুই পাশে তৈরি করে এক রূপকথার দৃশ্য। আকাশ নীল, মেঘ সাদা, আর মাঠে ভেসে ওঠে সোনালি আলো। হেমন্তে ধানের ক্ষেত যখন সোনালি হয়ে ওঠে, তখন দূর থেকে হাওয়ায় ভেসে আসে ধানের গন্ধ। গ্রামবাসীর মুখে হাসি ফুটে ওঠে, কারণ এ সময়ই ফসল কাটার আনন্দে সবাই মেতে ওঠে। শীতে কুয়াশায় ঢাকা মাটির পথ এক অন্যরকম রহস্যময় রূপ নেয়। সকালের আলো কুয়াশা ভেদ করে আসতে চায়, আর মানুষের শ্বাস থেকে ভেসে ওঠা ধোঁয়া মিশে যায় সেই কুয়াশার সঙ্গে। চারদিকে নিস্তব্ধতা, শুধু পায়ের শব্দ শুনতে পাওয়া যায় ভোরবেলার নির্জনতায়। প্রতিটি ঋতুই শান্তিনিকেতনের মাটির পথকে নতুনভাবে সাজায়, নতুন করে জীবন্ত করে তোলে। আর আমি প্রতিবার সেই পথ ধরে হেঁটে অনুভব করি—প্রকৃতির এই ঋতুচক্রই জীবনের সবচেয়ে বড়ো শিল্পকর্ম, যা প্রতিনিয়ত রঙ বদলে আমাদের নতুন আনন্দ দেয়।
অধ্যায় ৭: উৎসবের আবেশ
শান্তিনিকেতনের মাটির পথ শুধু প্রকৃতির সৌন্দর্য বা গ্রামের শান্তির জন্য নয়, বরং উৎসবের দিনগুলোতে সে যেন নিজের ভেতরে নতুন প্রাণ খুঁজে পায়। পৌষ মেলার সময় যখন এই পথ ধরে হাঁটা শুরু করি, তখনই অনুভব করলাম চারপাশে যেন এক আলাদা স্রোত বইছে। গ্রামের মানুষ, দূর-দূরান্ত থেকে আসা পর্যটক, শিল্পী, কারিগর—সবাই মিলে যেন এক মিলনমেলা তৈরি করেছে। বাঁশের খুঁটিতে টাঙানো রঙিন আলপনা, দোকানের সামনে সাজানো হস্তশিল্প আর পিঠেপুলির গন্ধ মিলে এক অসাধারণ আবহ তৈরি করে। কচিকাঁচা থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত সকলে মেতে ওঠে উৎসবের আনন্দে। পথের ধুলোয় তখন শুধু হাঁটার শব্দ থাকে না, থাকে নাচের তালে তালে পায়ের আওয়াজ, গানের সুর, আর মানুষের হাসির ঝরনাধ্বনি। এই আবেশে দাঁড়িয়ে মনে হলো, শান্তিনিকেতন আসলে এক উৎসবমুখর হৃদয়ের নাম, যেখানে মানুষ মিলেমিশে জীবনকে উদযাপন করে।
পৌষ মেলায় যেমন হস্তশিল্পের প্রদর্শনী হয়, তেমনি বসন্ত উৎসবও শান্তিনিকেতনের পরিচয়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ। বসন্তের সকালে যখন ছাত্রছাত্রীরা রঙিন পোশাকে, গলায় ফুলের মালা পরে, হাতে আবির নিয়ে মাটির পথে নেমে আসে, তখন পুরো পরিবেশ রঙে ভরে ওঠে। তারা গেয়ে ওঠে রবীন্দ্রসঙ্গীত, নাচে মেতে ওঠে ফুলঝরার মতো। সেদিন শান্তিনিকেতনের আকাশ-মাটি সবকিছু রঙে ভিজে যায়। রঙের আবেশে মানুষ ভুলে যায় সব বিভেদ, সব দুঃখ—শুধু থেকে যায় মিলনের আনন্দ। উৎসবের ভিড়ে দাঁড়িয়ে আমি অনুভব করলাম, এই জায়গার প্রতিটি মানুষ কতটা আন্তরিকভাবে জীবনকে উদযাপন করে। তারা ছোটো ছোটো জিনিসে আনন্দ খুঁজে পায়, আর সেই আনন্দ ভাগ করে নেয় অন্যদের সঙ্গে। শহরের যান্ত্রিক জীবনে যেখানে উৎসব মানেই কেবল আনুষ্ঠানিকতা, এখানে উৎসব মানে জীবনের সঙ্গে প্রকৃতির সরাসরি সম্পর্ক।
এই উৎসবগুলো শুধু আনন্দের জন্য নয়, বরং শিক্ষা দেয় মিলনের, ভ্রাতৃত্বের, ভালোবাসার। যখন দেখি হিন্দু, মুসলমান, সাঁওতাল, বাঙালি—সবাই একসঙ্গে নাচছে, গান গাইছে, তখন বুঝি শান্তিনিকেতনের আসল দর্শন। এখানে কোনো ভেদাভেদ নেই, নেই বিভাজনের দেয়াল। উৎসবের দিনগুলোতে মাটির পথ যেন আরও বিস্তৃত হয়ে ওঠে, আরও গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। আমি হাঁটছিলাম সেই ভিড়ের ভেতর দিয়ে, হাতে রঙের ছোঁয়া নিয়ে, মনে হচ্ছিল আমি এক অদ্ভুত মহাযাত্রার অংশ হয়ে গেছি। এ শুধু একটি উৎসব নয়, বরং মানবতার জয়গান। শান্তিনিকেতনের মাটির পথ তাই উৎসবের আবেশে প্রতিবার নতুন করে জন্ম নেয়, নতুন করে মানুষকে শিখিয়ে দেয় একসাথে বাঁচার আনন্দ।
অধ্যায় ৮: বাউলদের সুর
শান্তিনিকেতনের মাটির পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে যেদিন প্রথম বাউলদের গান শুনেছিলাম, সেদিন মনে হয়েছিল এ সুর কেবল কান দিয়ে শোনা যায় না, হৃদয়ে ঢুকে যায়। দূরে কোনো পুকুরপাড়ে, তালগাছের ছায়ায় বসে এক বাউল তার একতারা বাজাচ্ছে। তার কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে হাওয়ার সঙ্গে, কখনো উঁচু, কখনো নিচু, কিন্তু সবসময় ভরপুর অনুভূতিতে। গানের কথায় কোনো জটিলতা নেই, কিন্তু তাতে যে গভীরতা আছে, তা সহজে ভুলে যাওয়া যায় না। সে গাইছিল—জীবনের অর্থ খুঁজে পাওয়া, মনের মানুষকে খুঁজে নেওয়া, আর প্রকৃতির সঙ্গে মিশে থাকার কথা। আমি দাঁড়িয়ে শুনছিলাম, আর হঠাৎ মনে হলো এই গানের ভেতরেই লুকিয়ে আছে শান্তিনিকেতনের আসল আত্মা। এখানকার মানুষ যেমন সরল, প্রকৃতি যেমন নিরাভরণ, তেমনি বাউলের গানও সাদামাটা অথচ হৃদয়গ্রাহী।
গ্রামের হাটে গেলে আরও পরিষ্কারভাবে বোঝা যায় বাউলদের গুরুত্ব। মাটির পথের ধুলোয় বসে তারা গাইছে, চারপাশে জড়ো হয়েছে মানুষ। কেউ দাঁড়িয়ে শুনছে, কেউ হাততালি দিচ্ছে, আবার কেউবা নিজের সুরে মেতে উঠছে। বাউলের সঙ্গীত আসলে এক ধরনের দর্শন—যেখানে জীবনের ক্ষুদ্র সুখ, দুঃখ, ভালোবাসা আর ভগবানের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক সব একসঙ্গে মিশে যায়। এই গানের ভেতর নেই কোনো আড়ম্বর, নেই কোনো প্রাচুর্যের দাবি, আছে কেবল সহজ আনন্দ আর ভক্তি। শহরের মানুষও যখন এ গান শুনতে আসে, তারা বিস্মিত হয়ে যায়, কারণ এত কম যন্ত্র আর এত সাধারণ কথার ভেতরেও কত গভীর সত্যি লুকিয়ে থাকে। বাউলের একতারা যেন শুধু তার হাতে বাজে না, বাজে শ্রোতার হৃদয়েও।
আমি হাঁটছিলাম সেই হাটের ভেতর দিয়ে, চারদিকে বাউলের সুর ভেসে আসছিল। মনে হচ্ছিল প্রতিটি বাঁক, প্রতিটি মোড়ে এই গান আমার পিছু নিচ্ছে। এক বাউল গাইছিল মাটির সঙ্গে মানুষের মিলনের কথা, আরেকজন গাইছিল ভালোবাসার সারল্যের গান। সেই মুহূর্তে আমি বুঝলাম, শান্তিনিকেতনের মাটির পথ শুধু গাছ-গাছালি আর নীরবতার পথ নয়, বরং এক জীবন্ত সঙ্গীতের মঞ্চ। এখানে প্রতিদিন গান জন্ম নেয়, প্রতিদিন সুর ভেসে বেড়ায় বাতাসে। এই গান শুধু কানে বাজে না, জীবনের পথেও বাজে, প্রতিটি মানুষের অন্তরে ছুঁয়ে যায়। শান্তিনিকেতনের মাটির পথ তাই বাউলের সুরের মতো—অমলিন, নির্ভার, আর চিরন্তন।
অধ্যায় ৯: গ্রামীণ জীবনের ছোঁয়া
শান্তিনিকেতনের মাটির পথে হাঁটলে চারপাশে ছড়িয়ে থাকা গ্রামীণ জীবনের টান সহজেই অনুভব করা যায়। ভোরের আলো ফুটতেই গ্রামের মহিলারা কলস হাতে পুকুরে জল তুলতে যায়, কারও আঁচলে ধানের শিষ, কারও হাতে লাউ বা কুমড়ো। গরুর গাড়ির ঘণ্টাধ্বনি ভেসে আসে দূর থেকে, আর সেই ধীর লয়ে চলা গাড়ির চাকায় গেঁথে থাকে মাটির গন্ধ। শিশুদের হাসি, মাঠে দৌড়ঝাঁপ, কুয়াশার ভেতর দিয়ে উঠোনে বসে ধূপের গন্ধ ছড়ানো—সবকিছু মিলে গ্রামের সকাল হয়ে ওঠে এক অপূর্ব দৃশ্যপট। শহরে যেখানে সকাল মানেই তাড়াহুড়ো আর যান্ত্রিক জীবন, এখানে সকাল মানেই প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের অটুট বন্ধন। মাটির পথ যেন প্রতিটি সকালের সেই নিস্তব্ধ সৌন্দর্যের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
দিনের বেলায় দেখা যায় গ্রামের পুরুষেরা মাঠে যাচ্ছে লাঙল কাঁধে, আবার কেউ গরুর পাল চরাচ্ছে নদীর ধারে। নারীরা উঠোনে পাট কেটে শুকোচ্ছে, কেউবা খড় বিছিয়ে দিচ্ছে গরুর খাবারের জন্য। দুপুরে কড়া রোদ পড়লে গাছতলায় বসে সবাই গল্প করে, কেউ বাঁশি বাজায়, কেউবা কীর্তন গেয়ে ওঠে। এ জীবন সরল, তবুও ভীষণ সমৃদ্ধ। মাটির পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে আমি বারবার থেমে গিয়েছিলাম এই দৃশ্যগুলো দেখার জন্য। মনে হচ্ছিল যেন চিত্রশিল্পীর তুলি দিয়ে আঁকা কোনো ক্যানভাসে হেঁটে যাচ্ছি। প্রতিটি রঙ, প্রতিটি আলো, প্রতিটি হাসি এখানে প্রকৃতির সঙ্গে মিলে একাকার হয়ে গেছে।
সন্ধ্যা নামলেই সেই মাটির পথ আবার অন্যরকম হয়ে ওঠে। হাট থেকে ফিরে আসা মানুষদের ভিড়ে পথ ভরে যায়, কেউ কাঁধে ঝুড়ি নিয়ে ফিরছে, কেউ হাতে বাঁশের তৈরি খেলনা। মাঠ থেকে গরু ফেরার ঘণ্টাধ্বনি মিলেমিশে যায় রাতের আকাশে ওঠা তারা ঝিকিমিকির সঙ্গে। ঘরে ঘরে প্রদীপ জ্বলে ওঠে, ধূপকাঠির ধোঁয়া মিশে যায় কুয়াশার সঙ্গে। গ্রামীণ জীবনের এই সাদামাটা রূপে যে শান্তি লুকিয়ে আছে, তা শহরের প্রাচুর্যের ভেতরে খুঁজে পাওয়া যায় না। শান্তিনিকেতনের মাটির পথ তাই শুধু একটি রাস্তা নয়, এটি এক জীবন্ত গ্রন্থ, যেখানে প্রতিদিন লেখা হয় মানুষের শ্রম, ভালোবাসা আর আনন্দের গল্প।
অধ্যায় ১০: স্মৃতির পথচলা
শান্তিনিকেতনের মাটির পথের সঙ্গে আমার যে যাত্রা শুরু হয়েছিল, তার শেষ অধ্যায়ও যেন এই পথের মতোই—নীরব অথচ গভীর। প্রতিটি পদক্ষেপে এখানে জমে আছে অসংখ্য স্মৃতি, যেন মাটির ভেতর গেঁথে রাখা অমূল্য ধন। কখনও পলাশফুলের রঙিন আভায় রাঙা সেই পথ, কখনও বর্ষার ভেজা কাদায় ভরপুর, আবার কখনও শীতের সকালের কুয়াশায় মোড়া—প্রতিটি রূপই আমার ভেতরে এক একটি গল্প লিখে গেছে। এই পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে আমি শিখেছি ধৈর্য, অনুভব করেছি নিস্তব্ধতার সৌন্দর্য, পেয়েছি সঙ্গীতের সুর আর উৎসবের রঙ। এখানে প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের যে অটুট সম্পর্ক গড়ে ওঠে, তা শহরের কোলাহলে সহজে খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই মাটির পথ আমার কাছে কেবল ভ্রমণ নয়, বরং আত্মার সঙ্গে কথোপকথনের এক বিশেষ অধ্যায়।
এখানে প্রতিটি বাঁকে আমি খুঁজে পেয়েছি রবীন্দ্রনাথের ছোঁয়া। তাঁর গানের সুর, কবিতার ছন্দ যেন বাতাসে মিশে আছে। যখনই শান্তিনিকেতনের আকাশের দিকে তাকিয়েছি, মনে হয়েছে তিনি এখনও এই মাটির ভেতর দিয়ে হেঁটে চলেছেন, প্রতিটি গাছে, প্রতিটি গানে তাঁর স্পর্শ রয়েছে। ছাত্রছাত্রীদের হাসির শব্দ, বাউলের একতারার সুর, গ্রামের মানুষের সরল জীবন—সবকিছু মিলেমিশে রবীন্দ্র-দর্শনেরই প্রতিচ্ছবি। এই পথ তাই শুধুমাত্র একটি রাস্তা নয়, এটি কবির স্মৃতির আঙিনা, যেখানে প্রতিটি ভ্রমণকারীর মন তাঁর সৃষ্টির সঙ্গে জড়িয়ে যায়। শান্তিনিকেতনের মাটির পথ যেন তাঁরই রেখে যাওয়া এক জীবন্ত কবিতা, যা প্রতিদিন নতুন করে লেখা হয় প্রকৃতি আর মানুষের হাতে।
আমি যখন শেষবারের মতো সেই পথ ধরে হাঁটছিলাম, মনে হচ্ছিল বিদায়ের মতো নয়, বরং নতুন যাত্রার মতো। মাটির ধুলো পায়ে লেগে থাকল, বাতাসে ভেসে আসা গানের সুর মনে গেঁথে গেল। আমি বুঝলাম, এই জায়গার আসল সৌন্দর্য কেবল চোখে দেখা নয়, বরং মনে অনুভব করা। মাটির পথ আমাকে শিখিয়েছে সরলতার আনন্দ, মিলনের শক্তি, আর প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হওয়ার গভীর তাৎপর্য। শান্তিনিকেতন ছেড়ে গেলেও সেই পথ আমার ভেতরে রয়ে গেল চিরকাল, যেন এক অনন্ত যাত্রার সঙ্গী হয়ে। জীবনের ভিড়ে, শহরের কোলাহলে যখনই হারিয়ে যাই, মনে মনে ফিরে আসি সেই পথের ধুলোয়, যেখানে প্রতিটি পদক্ষেপে আছে শান্তি, ভালোবাসা আর চিরন্তন স্মৃতির ছায়া।
শেষ