প্রসুন পাল
অনিকেত দে, বয়স আঠাশ, পেশায় ফটোজার্নালিস্ট, কিন্তু তার জীবন অনেকটাই শহরের অলি-গলিতে ছড়িয়ে থাকা কোলাহল আর নীরবতার মাঝে আটকে থাকে। প্রতিদিন সকালে ক্যামেরা হাতে বেরিয়ে পড়ে সে, আর রাতের বেলায় অনলাইনে বসে নিজের তোলা ছবি সাজায়, ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করে। সেদিনও তার ব্যতিক্রম হয়নি। রাত তখন এগারোটা বাজে, অনিকেত ল্যাপটপ খুলে ফেসবুক স্ক্রোল করছিল। হঠাৎই থমকে গেল তার দৃষ্টি—তার কলেজজীবনের পুরোনো বন্ধু অরিন্দমের আপলোড করা একটি সেলফিতে অদ্ভুত কিছু ধরা দিল। ছবিটিতে অরিন্দম দাঁড়িয়ে আছে ভিড়ের মধ্যে, চারপাশে আরও কয়েকজন বন্ধুরা হাসিমুখে পোজ দিচ্ছে, কিন্তু অরিন্দমের মুখটাই নেই। চোখ নেই, ঠোঁট নেই, নাক নেই—শুধুই একটা ফাঁকা, মসৃণ অবয়ব। প্রথমে অনিকেত ভেবেছিল হয়তো ফটোশপের দুষ্টুমি, কারও তৈরি কোনো এডিটেড ছবি। তবুও কিছু একটা অস্বাভাবিক মনে হচ্ছিল তার। কারণ অরিন্দমের স্বভাব হাসিখুশি, নির্ভার, কিন্তু এরকম অদ্ভুত ছবি পোস্ট করার কোনো কারণ সে দেখছিল না। তবুও বিষয়টাকে খুব একটা গুরুত্ব না দিয়ে সে পরের ছবিতে চলে গেল, ভাবল হয়তো এটা প্রযুক্তিগত কোনো গ্লিচ।
পরের দিন সকালে অনিকেত আবার সোশ্যাল মিডিয়ায় ঢুকে অবাক হয়ে গেল। শুধু অরিন্দম নয়, আরও তিন-চারজনের ছবিতে একই ঘটনা। তাদের মুখ নেই, ফাঁকা অবয়ব যেন এক ধরনের ভূতুড়ে মুখোশ। প্রতিটি ছবিতেই মানুষগুলো স্বাভাবিক ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে, কেউ পার্কে, কেউ রেস্তোরাঁয়, কেউ আবার রাস্তায়, কিন্তু তাদের মুখ মুছে গেছে যেন কোনো অদৃশ্য হাত। একসাথে এতগুলো ছবিতে একই রকম ত্রুটি সম্ভব নয়—এবার অনিকেতের সাংবাদিকসুলভ কৌতূহল জেগে উঠল। সে নোটপ্যাডে নামগুলো লিখে রাখল, ছবির লিঙ্ক কপি করল, আর একটা আলাদা ফোল্ডারে সেগুলো সেভ করতে লাগল। ধীরে ধীরে মনে হচ্ছিল, এটা শুধুই প্রযুক্তিগত সমস্যা নয়, এর মধ্যে লুকিয়ে আছে কোনো বড়ো রহস্য। আর সেই রহস্যই তার নতুন গল্পের সূত্র হতে পারে। তবে সাংবাদিক মন খুঁজে পেতে চাইছে তথ্য, কিন্তু ফটোগ্রাফারের চোখ খুঁজে পাচ্ছিল এক অদ্ভুত অস্বস্তি।
এই অস্বস্তি আরও ঘনীভূত হল যখন সে রিহানাকে ফোন করল। রিহানা ঘোষ, বয়স ছাব্বিশ, তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং শহরের নামকরা এক সফটওয়্যার ফার্মের ডাটা অ্যানালিস্ট। অনিকেত তাকে যখন ঘটনার কথা জানাল, প্রথমে রিহানা হাসি চাপল। সে বলল, “দেখ, ফেসবুকের অ্যালগরিদম কতবার যে গন্ডগোল করে, এসব নতুন কিছু নয়।” কিন্তু অনিকেত ছবি পাঠাতেই রিহানার কপালে ভাঁজ পড়ল। চোখের সামনে একের পর এক ফাঁকা মুখ দেখে সে চুপ করে গেল। কিছুক্ষণ পর ধীরে স্বর নামিয়ে বলল, “এটা সাধারণ ত্রুটি নয়। এগুলো খুব পরিকল্পিতভাবে ঘটছে। দেখ, প্রতিটা ছবিতে যে লোকের মুখ নেই, তাদের প্রোফাইলের অ্যাক্টিভিটি হঠাৎ কমে গেছে। কেউ নতুন পোস্ট দিচ্ছে না, কেউ কোনো রিপ্লাই দিচ্ছে না। যেন তারা নিজেরাই ফেসবুক থেকে সরে যাচ্ছে, অথবা কেউ তাদের সরিয়ে দিচ্ছে।” অনিকেত হেসে বলল, “তাহলে শুরু হচ্ছে আমাদের নতুন গল্প। ডিজিটাল রহস্য।” কিন্তু ভেতরে ভেতরে সে বুঝছিল, এই রহস্যের শিকড় হয়তো অনেক গভীরে।
সেদিন রাত অবধি অনিকেত ছবি গুলো দেখে যেতে লাগল। ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামের স্ক্রোলিং যেন এক মায়ার জালে তাকে বেঁধে ফেলল। শহরের নানা মুখ, চেনা-অচেনা মানুষ, হঠাৎ করে তারা ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। চোখের দৃষ্টি হারিয়ে যাচ্ছে, ঠোঁটের হাসি নিভে যাচ্ছে, মানুষের পরিচয় যেন মুছে যাচ্ছে এক অদৃশ্য হাতের ছোঁয়ায়। জানলার বাইরে কলকাতার গলি-ঘুপচি তখন অন্ধকারে ডুবে গেছে, কিন্তু অনিকেতের ঘরে জ্বলছে শুধু ল্যাপটপের আলো। সে মনে মনে ভাবছিল—কেউ কি ইচ্ছে করে এসব করছে? নাকি প্রযুক্তির মধ্যে লুকানো কোনো শক্তি নিজেকে প্রকাশ করছে? তার মনে হচ্ছিল যেন ডিজিটাল পর্দার ওপারে এক অজানা ছায়া তাকিয়ে আছে, যে শহরের মানুষদের মুখ একে একে মুছে দিচ্ছে। আর সেই মুহূর্তেই, তার মেইলবক্সে হঠাৎ ভেসে এল এক অচেনা ইমেল, সাবজেক্টে লেখা—“তুমি কি পরের হারানো মুখ?”—অনিকেতের শরীর ঠাণ্ডা হয়ে গেল। তার তদন্তের যাত্রা সত্যিই শুরু হয়ে গেছে।
–
শহরের সকালটা সেদিন এক অদ্ভুত ভারী অস্বস্তি নিয়ে শুরু হল। কলকাতার দৈনন্দিন কোলাহল যেন হঠাৎ থমকে গিয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহারকারীরা আতঙ্কে ভুগছে—কারণ আগের দিন রাত থেকে ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামে যাদের ছবিতে মুখ মুছে গিয়েছিল, তাদের মধ্যে একজন বাস্তবেও হদিসহীন হয়ে গেছে। নাম—সায়ন মিত্র, বয়স তিরিশ, পেশায় বিজ্ঞাপন সংস্থার ক্রিয়েটিভ ডিজাইনার। সায়ন ছিলেন শহরের পরিচিত মুখ, সোশ্যাল মিডিয়ায় তার বিশাল ফলোয়ার বেস ছিল, প্রতিদিন সকাল-বিকাল নানা ছবি ও ভিডিও আপলোড করতেন। কিন্তু হঠাৎই তার ফোন সুইচ অফ, অফিসে না যাওয়া, এমনকি বাড়িতেও আর দেখা যায়নি তাকে। প্রথমে পরিবার ভেবেছিল হয়তো কোথাও বেড়াতে গেছে, কিন্তু সময় গড়াতেই সন্দেহ গভীরতর হল। পুলিশে অভিযোগ দায়ের করা হল, আর সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটা ছড়িয়ে পড়তেই আতঙ্ক চারপাশে ছড়িয়ে গেল। “ডিজিটাল ছবির ফাঁকা মুখ আর বাস্তব নিখোঁজ কি তবে সম্পর্কিত?”—এই প্রশ্ন শহরের রাস্তাঘাট থেকে শুরু করে অফিসক্যান্টিন, চায়ের দোকান থেকে লেকপাড় পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ল। মানুষ হঠাৎ করে নিজের প্রোফাইল ছবি পরীক্ষা করতে লাগল, কেউ আবার আতঙ্কে ছবি মুছে ফেলতে শুরু করল।
অনিকেত দে সকালবেলায় কাগজ হাতে নিয়েই খবরটা পেল। পুলিশি রিপোর্ট, সোশ্যাল মিডিয়ার পোস্ট আর আতঙ্কিত বন্ধুদের মেসেজে সায়নের নিখোঁজ হওয়ার খবর প্রায় দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। অনিকেতের বুক কেঁপে উঠল, কারণ গত রাতেই সে সায়নের সেই ফাঁকা ছবিটা সেভ করেছিল। সাংবাদিকের মতো ঠাণ্ডা মাথায় ভাবতে শুরু করল—যদি এ ঘটনা সত্যি হয়, তবে সে হাতে পেয়েছে সবচেয়ে অদ্ভুত আর ভয়ংকর একটি গল্পের সূচনা। সে সঙ্গে সঙ্গে রিহানাকে ফোন করল। ঘুমজড়ানো গলায় রিহানা প্রথমে গুরুত্ব দিল না, কিন্তু অনিকেত যখন সায়নের নিখোঁজ হওয়ার খবর জানাল, তখন তার কণ্ঠ কেঁপে উঠল। “মানে কী! যার মুখ ছবিতে নেই, সে বাস্তবেও নেই? এটা কীভাবে সম্ভব?”—রিহানা ফিসফিস করে বলল। অনিকেত শান্ত গলায় বলল, “তাই তো খুঁজে বের করতে হবে। আমি ছবিটা আর সায়নের প্রোফাইলের তথ্য নিয়ে বসছি। তুই ডাটাবেস ঘেঁটে দেখ, কোনো ক্লু মেলে কি না।”
অনিকেত নিজের ছোট্ট ঘরে বসে সায়নের প্রোফাইল খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। টানা কয়েক বছর ধরে আপলোড করা ছবিগুলো একে একে খুলতে লাগল। প্রথমে সবকিছুই স্বাভাবিক—সায়নের হাসিমুখ, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা, ভ্রমণের স্মৃতি। কিন্তু গত সপ্তাহ থেকেই ছবিগুলোর মধ্যে অদ্ভুত পরিবর্তন চোখে পড়ল। ধীরে ধীরে তার মুখ ঝাপসা হতে শুরু করেছে, আর শেষ ছবিটিতে একেবারে ফাঁকা অবয়ব। এটা যেন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এক অদৃশ্য শক্তি তার পরিচয় মুছে দিচ্ছিল। অনিকেত প্রতিটি ছবির মেটাডেটা নোট করতে লাগল—কখন আপলোড হয়েছে, কোথা থেকে হয়েছে। আশ্চর্যজনকভাবে, শেষ ছবির লোকেশন ট্যাগে লেখা আছে—“বাসন্তী হাইওয়ে”। অথচ সেই রাতে সায়নের কোথাও যাওয়ার কথা ছিল না। সে এই তথ্য রিহানাকে পাঠাল। রিহানা ততক্ষণে সায়নের আইডি ট্র্যাক করার চেষ্টা করছে, কিন্তু হ্যাকিং দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও এক অদ্ভুত ব্লকেজে আটকে যাচ্ছে। তার মুখ গম্ভীর হয়ে উঠল, “কেউ ইচ্ছে করে সব ডেটা ঢেকে দিচ্ছে, অনি। এটার পেছনে একজন মানুষ আছে, শুধু প্রযুক্তিগত গ্লিচ নয়।”
দিন গড়াতে গড়াতে আতঙ্ক আরও ঘনীভূত হতে লাগল। টেলিভিশনে নিউজ ব্রেকিং চলতে লাগল—“ডিজিটাল রহস্যে শহরের প্রথম নিখোঁজ”—শিরোনামে সায়নের ছবি দেখানো হচ্ছে। তার ফাঁকা মুখও পাশে তুলে ধরা হচ্ছে। মানুষ ভয় পাচ্ছে, নিজেদের ছবি বারবার খুঁজে দেখছে। কেউ বলছে এটা নতুন কোনো হ্যাকিং ভাইরাস, কেউ আবার বলছে অতিপ্রাকৃত শক্তির খেলা। কিন্তু অনিকেত জানে, সাংবাদিক হিসেবে তাকে শুধু আতঙ্ক নয়, সত্যি খুঁজে বের করতে হবে। রাতে জানলার পাশে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানতে টানতে সে মনে মনে বলল, “ডিজিটাল অদৃশ্যতা বাস্তবেও মানুষ গিলে খাচ্ছে। সায়ন মিত্র শুধু শুরু… এবার হয়তো আরও অনেকে হারিয়ে যাবে।” তার মনে হচ্ছিল যেন শহরটা অচেনা হয়ে যাচ্ছে, যেন রাস্তায় হাঁটছে অসংখ্য মানুষ কিন্তু তাদের মুখই আর নেই। সেই আতঙ্কই অনিকেতকে আরও তাড়িত করল। সে বুঝল, রহস্যের প্রথম সুতো হাতে এসেছে, আর এবার তাকে যেকোনো মূল্যে এর আসল রূপ উন্মোচন করতে হবে। সিগারেটের ধোঁয়া ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল অন্ধকার আকাশে, কিন্তু অনিকেতের চোখে জ্বলতে লাগল এক নতুন সংকল্পের আগুন।
–
রাত তখন প্রায় একটা বাজে। অনিকেতের ঘরের আলো জ্বলছে, ল্যাপটপের স্ক্রিনে ভেসে উঠছে একের পর এক ফাঁকা মুখের ছবি। কিন্তু তদন্তের মূল ভার এখন রিহানার কাঁধে। নিজের ফ্ল্যাটের অন্ধকার ঘরে বসে আছে সে, সামনে তিনটা মনিটর একসাথে জ্বলছে। তার আঙুলের স্পর্শে কীবোর্ড থেকে বেরোচ্ছে টকটক শব্দ, পর্দায় ভেসে উঠছে অসংখ্য কোড আর ডেটা স্ট্রিম। রিহানা ছোটবেলা থেকেই টেক-গীক, কিন্তু তার আসল শক্তি হলো ডাটার ভেতর লুকিয়ে থাকা অস্বাভাবিকতাগুলো চিনে নেওয়া। সেদিন রাতেও সে ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামের সার্ভার থেকে ডেটা টেনে বের করার চেষ্টা করছিল। সাধারণ হ্যাকিং নয়, বরং ডিপ-ডাটা স্ক্যান করে বোঝার চেষ্টা করছিল কেন হঠাৎ করে কিছু প্রোফাইলের ছবি ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। ঘর নিস্তব্ধ, কেবল মনিটরের আলোয় তার মুখে পড়ছে নীলচে আভা, আর চোখের কোণে ক্লান্তির ছাপ জমলেও মন ছিল একদম তীক্ষ্ণ। সে নিজেকে বলল, “কোথাও না কোথাও একটা ছায়া আছে, আর সেই ছায়াকেই খুঁজে বের করতে হবে।”
ডেটা ফিল্টার করতে করতে রিহানা এক চমকপ্রদ জিনিস আবিষ্কার করল। যাদের ছবিতে মুখ ফাঁকা হয়েছে, তাদের ফেসবুক আইডি বা ইনস্টাগ্রাম হ্যান্ডল হঠাৎ করেই “Inactive” হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যাচ্ছে। অথচ তারা নিজেরা কোনোদিন আইডি ডিলিট বা ডিএক্টিভেট করেনি। এমনকি পরিবারের অভিযোগ অনুযায়ী, সায়ন বা অন্যরা নিখোঁজ হওয়ার আগে পর্যন্ত একদম স্বাভাবিক ছিল। রিহানা লগ টেনে দেখল, সেসব আইডির লাস্ট অ্যাক্টিভিটি টাইমের পরই হঠাৎ করে সার্ভারের এক অদ্ভুত কোডিং সিগনেচার ভেসে উঠছে। সেটা এক ধরনের ডিজিটাল ছায়ার মতো—কোনো সাধারণ ভাইরাস বা বাগ নয়, বরং পরিকল্পিতভাবে তৈরি কোনো অ্যালগরিদম। সে ফিসফিস করে বলল, “এটা মানুষ বানিয়েছে। এটা প্রকৃতির খেলা নয়।” তার আঙুল দ্রুত গতিতে কীবোর্ডে নেচে উঠল। প্রতিটি লাইনে সে যাচাই করতে লাগল, সেই সিগনেচার কোথা থেকে এসেছে। কিন্তু যতই সে গভীরে ঢুকতে লাগল, ততই মনে হচ্ছিল যেন কেউ ইচ্ছে করে তাকে থামিয়ে দিচ্ছে। হঠাৎ এক মনিটরে লাল অক্ষরে ভেসে উঠল—ACCESS DENIED। রিহানা হতভম্ব হয়ে গেল। এর মানে, যে বা যারা এই অ্যালগরিদম তৈরি করেছে, তারা রিয়েল-টাইমে তার কাজ নজরদারি করছে।
অনিকেত ফোনে লাইভ আপডেট নিচ্ছিল। রিহানার আবিষ্কারের কথা শুনে তার বুকের ভেতর চাপা উত্তেজনা আর ভয়ের ঢেউ একসাথে আছড়ে পড়ল। সে বলল, “মানে দাঁড়ালো, যাদের ছবি ফাঁকা হয়েছে তারা আসলে ডিজিটাল ডাটাবেস থেকেই মুছে যাচ্ছে? আর বাস্তবেও অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে?” রিহানা গম্ভীর গলায় উত্তর দিল, “হ্যাঁ। এখানে ‘বাস্তব’ আর ‘ভার্চুয়াল’-এর সীমারেখা ভেঙে গেছে। বুঝতে পারছিস, কেউ মানুষের ডেটা প্রথমে ডিজিটালি মুছে দিচ্ছে, তারপর সেই ডেটার ছায়া বাস্তব অস্তিত্বটাকেও গ্রাস করছে।” অনিকেত জানলার দিকে তাকিয়ে দেখল, রাস্তা জুড়ে এখনো অল্প কিছু মানুষের আনাগোনা। কিন্তু তার চোখে যেন প্রতিটি মুখই ফিকে হয়ে আসছিল। সে মনে মনে ভাবল—যদি সত্যিই এই প্রক্রিয়া চলতে থাকে, তবে একদিন হয়তো গোটা শহরই মুখহীন হয়ে যাবে।
রিহানা আবার মনিটরের দিকে ঝুঁকল। সে এক অদ্ভুত প্যাটার্ন খুঁজে পেল। প্রতিটি ফাঁকা মুখের আইডির মেটাডেটা চেক করতে গিয়ে দেখা গেল, নিখোঁজ হওয়ার আগে তাদের সবাইকে এক রহস্যময় অ্যাকাউন্ট থেকে মেসেজ পাঠানো হয়েছিল। সেই অ্যাকাউন্টের নাম—Shadow_13। মেসেজগুলো ছিল অবিশ্বাস্যরকম সাধারণ, যেমন “তুমি কি সত্যিই আছো?” বা “তুমি কি তোমার মুখ চিনতে পারো?”—কিন্তু এর পরেই তাদের ছবিতে ফাঁকা অবয়ব দেখা দিচ্ছিল। রিহানার চোখে উত্তেজনার ঝিলিক ফুটে উঠল। সে দ্রুত ডেটা কপি করে অনিকেতকে পাঠাল। অনিকেত ফিসফিস করে বলল, “এটাই প্রথম সূত্র।” তার গলা শুষ্ক হয়ে এল, কিন্তু চোখে ফুটে উঠল দৃঢ় সংকল্প। শহরের ছায়ার ভেতর যে অন্ধকার হাত কাজ করছে, তার মুখোশ টেনে নামানোর প্রথম ধাপ তারা পেরিয়ে গেছে।
–
অনিকেতের কৌতূহল আর সাংবাদিক প্রবৃত্তি তাকে চুপচাপ বসে থাকতে দিল না। রিহানার পাঠানো ডেটার ভেতর থেকে সে একটা নির্দিষ্ট লোকেশন বার করতে পেরেছিল—শহরের উত্তর দিকের পুরনো অংশে, যেখানে ঔপনিবেশিক আমলের ভগ্নদশা বাড়ি আর আঁকাবাঁকা অলি-গলি এখনো সময়ের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একরকম অচেনা টানে সেদিকেই রওনা হল সে। রাত তখন প্রায় সাড়ে দশটা, চারপাশে রাস্তাগুলো ফাঁকা হয়ে আসছে। ম্লান স্ট্রিটলাইটে ভিজে উঠছিল কাঁচা রাস্তার ধুলো, মাঝে মাঝে ভেসে আসছিল কুকুরের ডাকে শহরের নিস্তব্ধতা। অনিকেত ট্যাক্সি থেকে নেমে অলি-গলির ভেতর পা বাড়াল। জায়গাটা অদ্ভুত রকমের অন্ধকার, বাতাসে শ্যাওলা আর পুরনো দেওয়ালের গন্ধ। তার মনে হচ্ছিল সে যেন শহরের শরীরের ভেতরে ঢুকে পড়েছে, যেখানে প্রতিটি ইটের ফাঁকে ফাঁকে লুকিয়ে আছে ভুলে যাওয়া ইতিহাস আর অদৃশ্য আতঙ্ক। ক্যামেরাটা গলায় ঝুলিয়ে সে এক এক করে ছবি তুলতে লাগল, মনে মনে বলল—“এখানেই হয়তো শহরের হারানো মুখেরা একসাথে মিলিত হয়।”
ধীরে ধীরে গলির ভেতর এগোতেই তার চোখে পড়ল কিছু অস্বাভাবিক দৃশ্য। এক ভগ্নদশা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটা অবয়ব। প্রথমে মনে হল সাধারণ মানুষ, হয়তো গৃহহীন বা রাত কাটানোর জায়গা খুঁজছে। কিন্তু যখন অনিকেত আরও কাছে গেল, বুকের ভেতর হঠাৎ শীতল স্রোত বয়ে গেল—ওরা দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু কারও মুখ নেই। ফাঁকা মাথা, শুধু শরীরের অবয়ব। ম্লান আলোতে তাদের উপস্থিতি একেবারে অস্বাভাবিক লাগছিল। তারা কথা বলছে না, শুধু নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে, যেন কোনো অদৃশ্য সংকেতের অপেক্ষায়। অনিকেত চোখ কচলাল, ভাবল হয়তো আলো-আঁধারির খেলা, কিন্তু ক্যামেরার লেন্সে জুম করতেই পরিষ্কার বোঝা গেল—হ্যাঁ, তারা সেইসব নিখোঁজ মানুষ, যাদের ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল। তার শরীর কেঁপে উঠল। এতদিন পর্যন্ত ঘটনা ছিল শুধু ডিজিটাল স্ক্রিনে, আজ প্রথমবার সে বাস্তব জগতে সেই আতঙ্ককে ছুঁয়ে ফেলল।
অনিকেত লুকিয়ে দাঁড়াল একপাশে, দেওয়ালের আড়ালে থেকে। তার চোখের সামনে অবিশ্বাস্য দৃশ্য উন্মোচিত হতে লাগল। সেই ফাঁকা মুখওয়ালা মানুষগুলো একে একে ভগ্ন ইমারতের ভেতরে প্রবেশ করতে শুরু করল। আশ্চর্যজনকভাবে, ভেতরে ঢোকার সময় তারা যেন আলোয় মিলিয়ে যাচ্ছিল—স্ট্রিটলাইটের আলো তাদের শরীর ভেদ করে চলে যাচ্ছে, অথচ ছায়া ফেলছে না। অনিকেত ক্যামেরার শাটার চেপে ধরল, কিন্তু অবাক হয়ে দেখল ছবিগুলো ফাঁকা আসছে। শুধু বাড়ির দেওয়াল আছে, আলো আছে, কিন্তু মানুষ নেই। তার মনে হল যেন তারা আলোতে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে, আবার অন্ধকারে ফিরে আসছে। বুক ধড়ফড় করতে লাগল, কিন্তু সাংবাদিকতার প্রবৃত্তি তাকে এগিয়ে নিয়ে গেল। ভগ্ন ইমারতের ভেতর থেকে ভেসে আসছিল চাপা শব্দ—না গান, না কান্না, বরং এক অদ্ভুত মিশ্র সুর যা মানুষের মস্তিষ্কে শীতল অস্বস্তি তৈরি করে। অনিকেতের মনে হল, এ যেন শহরের গোপন কোণ, যেখানে হারানো মুখেরা নতুন কোনো অস্তিত্ব খুঁজে নিচ্ছে।
হঠাৎই এক মুহূর্তে সেই সব অবয়ব থমকে দাঁড়াল। যেন তারা একসাথে কিছু অনুভব করেছে। ধীরে ধীরে তাদের মাথা ঘুরল, ফাঁকা মুখগুলো সোজা তাকাল অনিকেতের লুকিয়ে থাকার দিকে। অনিকেতের বুকের ভেতর কাঁপুনি শুরু হল। সে অনুভব করল, যদিও তাদের চোখ নেই, তবুও তারা তাকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। নিস্তব্ধতার ভেতর হঠাৎ শিরশিরে ঠান্ডা নেমে এল, বাতাসে ভেসে উঠল এক অদৃশ্য চাপ। অনিকেত দৌড়ে পালাতে চাইল, কিন্তু তার পা যেন জমে গেল মাটিতে। অবশেষে প্রচণ্ড চেষ্টা করে সে পিছিয়ে এল আর গলির অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। কাঁপতে কাঁপতে সে ফোন বের করে রিহানাকে খবর দিল, “আমি দেখেছি ওদের… ওরা আলোয় নেই, কিন্তু অন্ধকারে আছে… শহরের পুরনো ইমারতের ভেতর ওরা একসাথে জড়ো হচ্ছে।” ফোনের অপর প্রান্তে নিস্তব্ধতা নেমে এল। রিহানা ধীরে বলল, “মানে, আমাদের সবচেয়ে খারাপ আশঙ্কাই সত্যি হচ্ছে। ফাঁকা মুখগুলো শুধু ডিজিটাল নয়, বাস্তবের অন্ধকারেও বাসা বাঁধছে।” অনিকেত জানল, আজ সে এমন এক গোপন কোণের দেখা পেল, যা শুধু শহরের রহস্য উন্মোচন করবে না, বরং আসন্ন ভয়াবহতার দিকেও ইঙ্গিত করছে।
–
অনিকেতের ভেতর সেই রাতের আতঙ্ক এখনো তাজা। শহরের পুরনো গলির ভগ্ন ইমারতের সামনে ফাঁকা মুখওয়ালা মানুষগুলোকে দেখার পর থেকে তার মন শান্ত থাকতে পারছিল না। রিহানাও ঘুমাতে পারেনি। ডেটার ভেতরে Shadow_13 নামের অদ্ভুত অ্যাকাউন্ট আর নিখোঁজ মানুষের অদৃশ্য অবয়ব—সবকিছু মিলিয়ে তারা যখন ভেবেছিল আর কোনো সূত্র নেই, তখন হঠাৎই তাদের সামনে উপস্থিত হল এক অচেনা মানুষ। সকালবেলা অনিকেত নিজের অফিসে বসে ডকুমেন্ট গুছিয়ে নিচ্ছিল, তখন দরজার কাছে ধাতব কড়া নড়ার শব্দ শোনা গেল। দরজা খুলতেই দেখা গেল, ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি-পাজামা পরা, লম্বা-চওড়া চশমা চোখে, প্রায় পঞ্চাশোর্ধ্ব একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছেন। ভদ্রলোকের চোখে ছিল তীব্র বুদ্ধির ঝিলিক, মুখে শান্ত অথচ অস্বস্তিকর একটা হাসি। তিনি পরিচয় দিলেন—“আমার নাম শ্রেয়স ভট্টাচার্য। তোমরা যেটাকে রহস্য ভাবছ, সেটা আসলে বিজ্ঞানের নিয়ম ভেঙে যাওয়ার ফল।” অনিকেত ও রিহানা বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল, কারণ এভাবে কেউ হঠাৎ এসে এত বড় দাবি করে না।
শ্রেয়স ধীরে ধীরে ভেতরে ঢুকে চেয়ারে বসলেন। তার কণ্ঠে ছিল এক অদ্ভুত শান্তি, যেন অনেকটা সময় ধরে জমা রাখা সত্য অবশেষে প্রকাশ পাচ্ছে। তিনি বলতে শুরু করলেন, “মানুষের অস্তিত্ব শুধু রক্ত-মাংসের শরীরে নয়। প্রতিটি মানুষের একটি ডেটা-রূপ আছে। সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে আমরা প্রতিদিন ছবি, ভিডিও, টেক্সট আপলোড করি। এসব মিলে তৈরি হয় একধরনের ডিজিটাল প্রতিরূপ, যাকে আমি বলি মেটা-আইডেন্টিটি। কিন্তু এরও বাইরে আছে আরও গভীর স্তর—প্রতিটি মুখ, প্রতিটি চোখ, প্রতিটি হাসির ছাপ মস্তিষ্কে নয় শুধু, ডিজিটাল ক্লাউডেও জমা থাকে। প্রযুক্তি অদ্ভুতভাবে বাস্তব ও ভার্চুয়ালের মাঝে সেতুবন্ধন করেছে।” অনিকেত ও রিহানা পরস্পরের দিকে তাকাল। অনিকেত ফিসফিস করে বলল, “মানে… ফেসবুক বা ইনস্টাগ্রামের ছবিগুলো শুধু ভার্চুয়াল রেকর্ড নয়, আমাদের অস্তিত্বেরও একটা অংশ হয়ে গেছে?” শ্রেয়স গম্ভীরভাবে মাথা নাড়লেন।
“হ্যাঁ,” তিনি বললেন। “তোমরা যাদের ফাঁকা মুখ দেখছ, তাদের মেটা-আইডেন্টিটি আর বডি-আইডেন্টিটি—এই দুইয়ের মধ্যে সংযোগ ভেঙে যাচ্ছে। একটা সফটওয়্যার বা অ্যালগরিদম মানুষের ডিজিটাল মুখ মুছে দিচ্ছে। এর ফলে বাস্তব জগতের স্নায়বিক প্রতিক্রিয়াও ভেঙে পড়ছে। সহজভাবে বললে—যখন তোমার ডিজিটাল প্রতিচ্ছবি হারিয়ে যায়, তখন বাস্তব দেহও ধীরে ধীরে সেই প্রতিচ্ছবির অনুপস্থিতি অনুসরণ করে।” রিহানা হতভম্ব হয়ে বলল, “মানে, ডিজিটাল ডেটা আর মানুষের শরীর এখন পরস্পরের সাথে এমনভাবে যুক্ত যে, একটিকে মুছে দিলে অন্যটাও ভেঙে পড়ে?” শ্রেয়স বললেন, “ঠিক তাই। মানুষের চেহারা আসলে দুই জগতে একসাথে সংরক্ষিত—বাস্তবের নিউরোন আর ভার্চুয়ালের কোডে। যদি কোড ভেঙে যায়, তখন নিউরোনেও সংকেত হারিয়ে যায়।” তার কথা শুনে অনিকেতের গায়ে কাঁটা দিল। সে যেন ধীরে ধীরে বুঝতে পারছিল যে শহরের রহস্যটা শুধুই অদৃশ্য হওয়ার নয়, বরং অস্তিত্বের এক মৌলিক ভাঙন।
শ্রেয়স হালকা নিঃশ্বাস ফেলে চুপ করলেন এক মুহূর্ত। তারপর নরম গলায় যোগ করলেন, “তবে আমি নিশ্চিত, এই দুর্ঘটনা কোনো প্রাকৃতিক ত্রুটি নয়। কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে এই অ্যালগরিদম ব্যবহার করছে। আমি একসময় এক গবেষণা প্রকল্পের অংশ ছিলাম, যেখানে মানুষের মুখের ডিজিটাল প্রতিলিপি তৈরি করার কাজ চলছিল। লক্ষ্য ছিল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে মানুষের মতো করে শেখানো। কিন্তু প্রকল্পে কাজ করা কিছু ডেভেলপার ভিন্ন উদ্দেশ্যে গবেষণার ফলাফল চুরি করে নিয়েছিল। তখনই Shadow_13 নামের এক রহস্যময় পরিচয় তৈরি হয়। সে-ই আজ মানুষের মুখ মুছে দিচ্ছে।” তার চোখে কঠিন ছায়া নেমে এল। “তোমরা ভেবো না, এটা শুধুই সাইবার অপরাধ। এটা এক ভয়াবহ অস্ত্র, যা শহরের স্মৃতি, মানুষের পরিচয় আর শেষ পর্যন্ত সভ্যতাকেও মুছে দিতে পারে।” অনিকেত গলা শুকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তাহলে আমরা কী করব?” শ্রেয়স উঠে দাঁড়ালেন। তার চশমার ভেতর দিয়ে তীক্ষ্ণ আলো ঝলসে উঠল। তিনি বললেন, “প্রথমে জানতে হবে Shadow_13 কোথায় আছে। তারপর বুঝতে হবে, কীভাবে মেটা-আইডেন্টিটি ও বাস্তব দেহের বন্ধনকে আবার ফিরিয়ে আনা যায়। নইলে একদিন তোমরা নিজেরাই মুখ হারিয়ে ফেলবে।”
–
রাতের নীরবতা ভেঙে অনিকেত ও রিহানা একসাথে বসেছিল অনিকেতের ছোট্ট ফ্ল্যাটের ডেস্কে। টেবিল ভরে গেছে নোটবুক, ল্যাপটপ আর ছড়ানো প্রিন্টআউটে। শ্রেয়স ভট্টাচার্যের কথা শোনার পর তাদের মাথায় নতুন এক দায়িত্ব এসে পড়েছে—শহরের হারানো মুখগুলোর গতিপথ খুঁজে বের করা। অনিকেত ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রাম থেকে যত ছবি পেয়েছে, যেখানে মুখগুলো ফাঁকা হয়ে গেছে, সেগুলো একে একে ল্যাপটপের স্ক্রিনে সাজিয়ে দিচ্ছিল। রিহানা তার পাশে বসে প্রতিটি প্রোফাইলের তথ্য টেনে আনছিল হ্যাকিং টুল দিয়ে। তাদের লক্ষ্য ছিল সহজ—যারা নিখোঁজ হয়েছে, তাদের শেষবার কোথায় দেখা গিয়েছিল সেটা বের করা। রাত যত গভীর হচ্ছিল, টেবিলের বাতি ততই গরম হয়ে উঠছিল, আর ঘরের ভেতর জমছিল চাপা উত্তেজনা। অনিকেত একটা ফাইল খুলে বলল, “দেখো, এরা সবাই আলাদা আলাদা সময়ে নিখোঁজ হয়েছে, কিন্তু তাদের শেষ অবস্থান প্রায় একই এলাকায়।” রিহানা চোখ ছোট করে স্ক্রিনের দিকে তাকাল। ধীরে ধীরে ছবির ওপর লাল বিন্দু আঁকতে আঁকতে সে ফিসফিস করে বলল, “শহরটা যেন নিজেই একটা মানচিত্র তৈরি করছে।”
তাদের তৈরি করা মানচিত্রে একটা অদ্ভুত প্যাটার্ন ভেসে উঠতে লাগল। হারানো মানুষগুলো শহরের পুরনো উত্তর দিক, ভগ্ন ইমারত আর অন্ধকার অলিগলির কাছাকাছি কেন্দ্রীভূত হচ্ছিল। কিন্তু শুধু তাই নয়—প্রতিটি অবস্থানকে লাল দাগে চিহ্নিত করলে দেখা গেল, বিন্দুগুলো মিলিয়ে যাচ্ছে এক অদ্ভুত জ্যামিতিক আকারে। সেটা ছিল না স্রেফ কোনো বৃত্ত বা ত্রিভুজ, বরং শহরের ভেতরে লুকানো এক জটিল চিহ্ন, অনেকটা পুরনো কোনো মন্ডলের মতো। রিহানা চমকে উঠে বলল, “এটা কেবল ঘটনাচক্র হতে পারে না। Shadow_13 ইচ্ছা করেই মানুষগুলোকে এই বিশেষ জায়গায় কেন্দ্রীভূত করছে।” অনিকেত দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নাড়ল। তার মনে পড়ল পুরনো ইমারতের সামনে দেখা ফাঁকা মুখগুলো—তারা হয়তো কোনো অদৃশ্য পরিকল্পনার অংশ, যেখানে শহরটাই এক বিশাল ক্যানভাস, আর মানুষগুলো কেবল বিন্দু, যাদের হারিয়ে যাওয়া দিয়ে আঁকা হচ্ছে এক ভয়ঙ্কর নকশা।
ঘড়ির কাঁটা তখন রাত দুই পেরিয়ে গেছে। রিহানার চোখ লাল হয়ে উঠছে পরিশ্রমে, তবু তার আঙুল দ্রুত কিবোর্ডের ওপর চলছিল। সে বলল, “আমি স্যাটেলাইট ম্যাপের ডেটার সাথে মিলিয়ে দেখছি। প্রতিটি পয়েন্ট আসলে শহরের পুরনো বিদ্যুৎ লাইন আর যোগাযোগ টাওয়ারের কাছাকাছি। মানে, শুধু জ্যামিতিক আকার নয়, এর ভেতরে প্রযুক্তিরও ব্যবহার আছে।” অনিকেত কাগজে দ্রুত নোট নিতে নিতে বলল, “মানে Shadow_13 শহরের পুরনো অবকাঠামোকে কাজে লাগাচ্ছে? হয়তো এই লাইনগুলো মানুষের মেটা-আইডেন্টিটির সাথে যুক্ত কোনো সংকেতকে টেনে নিচ্ছে।” রিহানা মাথা নাড়ল। তার চোখে দৃঢ়তার ঝিলিক। “আমাদের দ্রুত বের করতে হবে, পরের মানুষগুলো কোথায় হারাবে। মানচিত্রই একমাত্র উপায়।” ঘরের বাইরে ভোরের আলো আস্তে আস্তে ঢুকছিল, কিন্তু অনিকেত আর রিহানার কাছে সময় যেন থমকে গিয়েছিল। তারা জানত, এই মানচিত্র তাদের হাতে শুধু সূত্র নয়, বরং শহরের অন্ধকারে ঢোকার চাবিকাঠি।
অবশেষে মানচিত্রে শেষ লাল বিন্দুটি আঁকা হলো। পুরো ছবিটা সামনে আসতেই তারা দুজনেই স্তব্ধ হয়ে গেল। বিন্দুগুলো মিলে তৈরি হয়েছে এক বিশাল বৃত্তাকার আকার, যার ভেতর ফাঁপা রেখা টেনে রেখেছে নিখোঁজ মানুষের অবস্থান। শহরের উপরিভাগে সেটা কেবল সাধারণ জায়গা, কিন্তু মানচিত্রে সেটা এক ভয়ঙ্কর প্রতীক, যেন শহরের হৃদয়ে কেটে বসানো এক ক্ষত। অনিকেত ফিসফিস করে বলল, “এটা যদি শেষ হয়, পুরো শহরটাই হয়তো হারিয়ে যাবে।” রিহানা ঠোঁট কামড়ে চুপ করে রইল। সে জানত, তারা এখন এমন এক রহস্যে ঢুকে পড়েছে যেখান থেকে ফিরে আসা কঠিন। কিন্তু সাংবাদিক আর হ্যাকার—দুজনেই জানত, সত্যকে থামানো যায় না। তারা মানচিত্রটা সযত্নে গুছিয়ে রাখল। রিহানা ধীরে বলল, “আগামীকালই আমাদের মাঠে নামতে হবে। মানচিত্রের প্রতিটি বিন্দুতে গিয়ে দেখতে হবে কী ঘটছে।” আর অনিকেতের চোখে ভেসে উঠল সেই ফাঁকা মুখওয়ালা মানুষগুলো, যারা আলোয় অদৃশ্য হয়ে ভগ্ন ইমারতে মিলিয়ে যাচ্ছিল। এবার তারা জানত, এ রহস্যের পরবর্তী ধাপ আরও অন্ধকার, আরও ভয়ঙ্কর।
–
রাত গভীর হলে শহরের ভেতরে অদ্ভুত নীরবতা নেমে আসে। অনিকেতের ডেস্কের ওপরে ল্যাপটপের স্ক্রিনে তখন কেবল ঝলমল করছে কোডের লাইন আর অসংখ্য নোটিফিকেশন। রিহানা চোখের নিচে কালো ছায়া নিয়ে বসে ছিল, কিন্তু তার মন ছিল তীক্ষ্ণ, মনোযোগী। দিনের পর দিন হ্যাকিং টুল দিয়ে ডেটার স্তূপ ঘেঁটে অবশেষে সে এমন কিছু খুঁজে পেল যা তাকে চমকে দিল। হঠাৎ সে বলল, “অনিকেত, দেখো! এটা কেবল সাধারণ বাগ নয়। কেউ ইচ্ছা করে মানুষের আইডি হ্যাক করছে।” অনিকেত তাড়াতাড়ি স্ক্রিনের দিকে ঝুঁকে এল। দেখা গেল, যেসব মানুষের ছবি থেকে মুখ অদৃশ্য হয়েছে, তাদের ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টের সিকিউরিটি লগে এক রহস্যময় সিগন্যাল ঢুকছে। সেটা সাধারণ কোনো হ্যাকারদের কোড নয়—বরং এমন এক ধরনের অ্যালগরিদম, যা প্রথমে ছবির মেটাডাটা বদলে দেয়, তারপর মুখ শনাক্তকরণের ডাটাবেস থেকে সেই মুখটিকে মুছে দেয়। রিহানা ফিসফিস করে বলল, “মানে, কেউ প্রযুক্তি ব্যবহার করে মানুষের পরিচয় কেটে ফেলছে।” তার কণ্ঠে আতঙ্ক আর ক্রোধের মিশ্রণ শোনা গেল।
রিহানা কোডগুলো একে একে বিশ্লেষণ করতে লাগল। সে দেখল, হ্যাক হওয়া প্রতিটি আইডি থেকে একই ধরনের এক্সটার্নাল রিকোয়েস্ট এসেছে—কোনো অজানা সার্ভার থেকে। সার্ভারের নামের মধ্যে এক অদ্ভুত চিহ্ন লুকানো ছিল: “Ω-13।” অনিকেত চমকে উঠল, “এটা কি Shadow_13-এর কাজ?” রিহানা মাথা নাড়ল। “হ্যাঁ, আমি নিশ্চিত। এটাই তার স্বাক্ষর।” কিন্তু আরও ভয়ঙ্কর ব্যাপার হলো, একবার কোনো আইডি হ্যাক হয়ে গেলে সেই প্রোফাইল স্থায়ীভাবে “নিষ্ক্রিয়” হয়ে যায়। যেন ভার্চুয়াল দুনিয়ার ভেতরে সেই মানুষটির অস্তিত্ব চিরতরে কেটে ফেলা হয়। অনিকেতের শরীর শীতল হয়ে এল। সে মনে মনে ভাবছিল, যদি কারো ভার্চুয়াল অস্তিত্ব হারিয়ে যায় আর শ্রেয়সের কথামতো সেটা বাস্তব শরীরেও প্রভাব ফেলে—তাহলে তো প্রতিটি হ্যাক করা অ্যাকাউন্টই ভবিষ্যতের এক নিখোঁজ মানুষ। রিহানা এবার আরও দ্রুত টাইপ করতে লাগল। তার চোখ লাল হয়ে উঠেছে, কিন্তু তবু সে থামল না।
ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যাওয়ার পর অবশেষে রিহানা একটা ব্রেকথ্রু পেল। সে অনিকেতকে দেখাল, কীভাবে Shadow_13-এর কোড মানুষকে ফাঁদে ফেলছে। প্রথমে সোশ্যাল মিডিয়ায় নিস্পাপ কোনো মেসেজ বা লিংক পাঠানো হয়। সেই লিংকে ক্লিক করলেই কোড ব্যবহারকারীর ফটো গ্যালারিতে ঢুকে পড়ে। তারপর ধাপে ধাপে ফেস-রিকগনিশন সিস্টেমকে রিসেট করে দেয়। একবার মুখের ডেটা মুছে গেলে ছবিগুলোতে ফাঁকা অবয়ব তৈরি হয়। রিহানা শিউরে উঠে বলল, “এটা নিছক হ্যাকিং নয়, এটা ডিজিটাল খুন।” অনিকেত নীরবে বসে ছিল, তার সাংবাদিকসুলভ কৌতূহল আর মানুষের প্রতি দায়িত্ববোধ একসাথে তোলপাড় করছিল তাকে। সে বলল, “তাহলে আমাদের কাছে মাত্র অল্প কিছু সময় আছে। যদি Shadow_13 আরও অনেক মানুষের আইডি হ্যাক করে, পুরো শহরটাই ফাঁকা হয়ে যাবে।” ঘরের ভেতর বাতাস যেন ভারী হয়ে উঠল। বাইরের আলো নিভে আসছিল, কিন্তু ল্যাপটপের স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছিল Shadow_13-এর চিহ্ন—Ω-13, এক অদৃশ্য আতঙ্কের প্রতীক।
রিহানা এবার চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়াল। তার চোখে জ্বলছিল অদ্ভুত দৃঢ়তা। সে বলল, “আমাদের এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে। Shadow_13 শুধু কোড নয়, সে এক খলনায়ক, যে মানুষকে তার নিজের পরিচয় থেকে বঞ্চিত করছে। এটা ব্যক্তিগত নয়, এটা পুরো সভ্যতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ।” অনিকেত তার দিকে তাকাল। তার ভেতর ভয় ছিল, কিন্তু একইসাথে ছিল এক ধরনের অদম্য সাহস। সাংবাদিক হিসেবে সে জানত, সত্য প্রকাশ করাই তার কাজ। কিন্তু এবার সত্য শুধু কাগজে ছাপার জন্য নয়—এটা ছিল মানুষের মুখ রক্ষা করার লড়াই। তারা সিদ্ধান্ত নিল, মানচিত্রে চিহ্নিত প্রতিটি জায়গা ঘুরে দেখা দরকার, এবং একইসাথে রিহানার হ্যাকিং দক্ষতা ব্যবহার করে Shadow_13-এর সার্ভারের উৎস খুঁজে বের করতে হবে। তারা জানত, এই পথে গেলে জীবনও ঝুঁকিতে পড়তে পারে, কিন্তু অন্য কোনো পথ খোলা নেই। সেই রাতে অনিকেত ও রিহানা প্রথমবার সত্যিকার অর্থে অনুভব করল, তারা এখন এক ডিজিটাল ফাঁদের ভেতরে আটকা পড়েছে—যেখানে প্রতিটি ক্লিক, প্রতিটি ছবি, প্রতিটি অ্যাকাউন্ট হতে পারে শেষ নিশ্বাসের প্রতিধ্বনি।
–
শহরের বাতাসে তখন আতঙ্ক জমে উঠেছে। প্রতিদিন খবরের কাগজে নতুন নতুন নিখোঁজ বিজ্ঞাপন ছাপা হচ্ছে, আর সোশ্যাল মিডিয়ায় বাড়ছে ফাঁকা মুখওয়ালা ছবির সংখ্যা। গলিপথে, বাসস্টপে, এমনকি বাজারেও ফিসফাস শোনা যায়—“ওই ছেলেটা কাল রাতে হঠাৎ উধাও হয়ে গেছে” কিংবা “ওই মহিলার ছবিতে আর মুখ দেখা যায় না।” অনিকেত প্রতিদিন তার সাংবাদিক পরিচয়ে নতুন খবর সংগ্রহ করছিল, কিন্তু একসময় সে বুঝল, খবর নয়—এটা আসলে শহরের আত্মা হারিয়ে ফেলার গল্প। রিহানা পাশে বসে ল্যাপটপে ডেটা টানছিল। তার আঙুল দ্রুত কীবোর্ডে নাচছিল, আর সে বলল, “অনিকেত, হিসেবটা পরিষ্কার। যার ছবি ফাঁকা হচ্ছে, সে তিন দিনের মধ্যে বাস্তব থেকেও নিখোঁজ হয়ে যাচ্ছে।” অনিকেত ভেতরে শিহরন অনুভব করল। মানে, শহর আসলে দুই ভাগে ভেঙে গেছে—একটা বাস্তব, একটা ভার্চুয়াল, আর দুটোই একে অপরের প্রতিচ্ছবি। যদি একটাতে কেউ হারায়, অন্যটাতেও তার অস্তিত্ব মুছে যায়।
ঠিক তখনই শ্রেয়স আবার তাদের সাথে যোগাযোগ করল। অন্ধকার আলোতে ভরা তার অফিসঘরে, দেয়ালে টাঙানো পুরনো গবেষণাপত্র ও মেশিনের ব্লুপ্রিন্টের মাঝে দাঁড়িয়ে সে বলল, “আমি অনেকদিন ধরে এ নিয়ে গবেষণা করছি। মানুষের পরিচয় শুধু দেহে থাকে না, থাকে তার তথ্যেও। এই শহরের প্রতিটি নাগরিকের মুখ, প্রতিটি অভিব্যক্তি সোশ্যাল মিডিয়ার সার্ভারে জমা আছে। Shadow_13 সেই তথ্য চুরি করছে আর একে বাস্তবের সাথে মেলাচ্ছে। ফলাফল—মানুষ গায়েব।” রিহানা ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, “তাহলে তাদের ফেরানো সম্ভব কি?” শ্রেয়স এক মুহূর্ত চুপ করে থাকল, তারপর বলল, “সম্ভব, কিন্তু সহজ নয়। আমাদের বাস্তবের ডেটা আর ভার্চুয়ালের ডেটাকে একত্র করতে হবে। একটা সেতু বানাতে হবে, যেখানে মানুষ দুটো দুনিয়ার মাঝখানে আটকে না থেকে ফিরে আসতে পারে।” অনিকেত এক নিঃশ্বাসে বলল, “মানে আমাদের শহরটাকে ডিজিটাল আয়না বানাতে হবে।”
রাতভর তারা পরিকল্পনা করল। রিহানা কোড লিখছিল, শ্রেয়স পুরনো আর্কাইভ থেকে সিগন্যাল টাওয়ার আর বিদ্যুৎ লাইনগুলোর মানচিত্র বের করছিল, আর অনিকেত তার নোটে প্রতিটি ঘটনার প্যাটার্ন লিপিবদ্ধ করছিল। তাদের তিনজনের কাজ আলাদা, কিন্তু উদ্দেশ্য ছিল এক—মানুষকে ফেরানো। রিহানা বারবার বলছিল, “এটা শুধু প্রযুক্তি নয়, এটা বিশ্বাসের লড়াইও। মানুষ যদি ভাবে সে হারিয়ে যাবে, তাহলে তার অস্তিত্বও মুছে যাবে। আমাদের সেই মানসিক শক্তিটাকেও ফিরিয়ে আনতে হবে।” শ্রেয়স যুক্তি দিয়ে বলছিল, “আমরা যদি Shadow_13-এর তৈরি করা ডিজিটাল ফাঁদে পাল্টা নেটওয়ার্ক বসাতে পারি, তাহলে ফাঁকা মুখগুলো আবার পূর্ণ হবে। তবে এক্ষেত্রে শহরের নির্দিষ্ট কিছু পয়েন্টে যন্ত্র বসাতে হবে।” অনিকেত মাথা নেড়ে বলল, “আমার কাজ হবে সেই জায়গাগুলো ঘুরে দেখা আর মানুষের সাথে কথা বলা। কারণ তারা বুঝতে হবে, আমরা তাদের জন্য লড়ছি।” ঘরের মধ্যে আলো কমছিল, কিন্তু তাদের কথোপকথনে জ্বলছিল এক নতুন আশা।
পরের দিন সকালেই তারা কাজে নেমে গেল। শহরের ব্যস্ত রাস্তায় চলতে চলতে অনিকেত অনুভব করছিল, প্রতিটি মানুষের চোখে লুকিয়ে আছে আতঙ্ক। রিহানা ব্যাকপ্যাকে লুকানো যন্ত্রপাতি নিয়ে তার পাশে হাঁটছিল। শ্রেয়স এক পুরনো নোটবুকে লাল কালি দিয়ে চিহ্নিত জায়গাগুলো দেখাচ্ছিল। প্রতিটি স্থানই ছিল মানচিত্রে সেই ফাঁকা মুখওয়ালা মানুষের বিন্দুর সাথে মিলে যাওয়া। তাদের তিনজনের ভেতরে ভয় ছিল, কিন্তু দৃঢ়তাও ছিল সমান শক্ত। কারণ তারা বুঝেছিল, শহরটাকে বাঁচাতে হলে বাস্তব আর ভার্চুয়ালের সীমানা ভেঙে ফেলতে হবে। আর এই লড়াই শুধু Shadow_13-এর বিরুদ্ধে নয়—এটা পুরো মানবজাতির অস্তিত্ব রক্ষার জন্য। অনিকেত মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল, সত্যকে আর নিছক কাগজে বন্দি রাখা যাবে না। এবার সত্যকে শহরের রাস্তায়, মানুষের মুখে ফিরিয়ে আনতে হবে।
–
শহরের আকাশে তখন এক অদ্ভুত অস্থিরতা জমে উঠেছে। রাত গভীর, রাস্তাঘাট প্রায় ফাঁকা, কেবলমাত্র হলুদ আলোয় ভেজা বাতিস্তম্ভগুলো দীর্ঘ ছায়া ফেলছে। অনিকেত, রিহানা এবং শ্রেয়স একটি পুরনো বিদ্যুত্ ভবনের ভেতরে বসে আছে। চারদিকে ছড়িয়ে আছে তার, সিগন্যাল বুস্টার, ল্যাপটপ আর যন্ত্রপাতি। শ্রেয়স নিঃশব্দে কাজ করছে, তার আঙুল সঠিক তারগুলো জুড়ে দিচ্ছে। রিহানা কোড আপডেট করছে, চোখে তার অদ্ভুত দৃঢ়তা। অনিকেত হাতে নোটবুক নিয়ে দাঁড়িয়ে, প্রতিটি মুহূর্ত লিখে রাখছে যেন একদিন প্রমাণ হিসেবে তা ব্যবহার করা যায়। শ্রেয়স ফিসফিস করে বলল, “যদি এই সিগন্যালটা কাজ করে, তাহলে ফেসবুক আর ইনস্টাগ্রামের ডেটাবেসে ফাঁকা মুখগুলো আবার পুনঃস্থাপন হবে। আর এর সাথে বাস্তবের মানুষও ফিরে আসবে।” রিহানা এক মুহূর্ত চোখ বন্ধ করল, যেন নিজেকে দৃঢ় করল, তারপর কোডে শেষ লাইনটা লিখে এন্টার চাপল। হঠাৎ করে ঘরজুড়ে মৃদু গুঞ্জন শোনা গেল, যেন বিদ্যুতের ঢেউ ছুটে যাচ্ছে শহর জুড়ে।
প্রথমে কিছুই হলো না। শুধু স্ক্রিনে কোডের লাইনগুলো অদ্ভুতভাবে নড়াচড়া করছিল। অনিকেতের বুক ধকধক করতে লাগল—যদি সব ব্যর্থ হয়? কিন্তু কয়েক মুহূর্ত পরই হঠাৎ ফেসবুকের একটি লাইভ ফিডে দেখা গেল, একটি ফাঁকা মুখওয়ালা ছবিতে চোখ-মুখ ধীরে ধীরে ফিরে আসছে। চুল, চোখ, ঠোঁট—সব যেন মেঘ থেকে বেরিয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। রিহানার চোখ ভিজে গেল আনন্দে। “কাজ করছে!” সে চিৎকার করে উঠল। এরপর একে একে আরও শত শত ছবি পুনরুদ্ধার হতে লাগল। যারা দিনের পর দিন নিখোঁজ ছিল, তাদের মুখ আবার ছবিতে ফুটে উঠল। শহরের বিভিন্ন প্রান্তে অদ্ভুত ঘটনা ঘটতে লাগল। যে বাড়িগুলোতে নিখোঁজ মানুষদের জন্য দরজা খোলা রাখা হয়েছিল, হঠাৎ করেই দরজার সামনে তারা বাস্তব রূপে দাঁড়িয়ে গেল—অবাক, বিভ্রান্ত, কিন্তু জীবিত। মানুষ ছুটে এসে তাদের বুকে জড়িয়ে ধরল। কান্না, হাসি আর অবিশ্বাসে ভরে উঠল রাত।
শ্রেয়স যন্ত্রপাতির দিকে তাকিয়ে রইল। তার চোখে ছিল একধরনের শান্তি। সে বলল, “আমি জানতাম, তথ্য আর বাস্তব আলাদা নয়। ওরা একই দেহের দুই দিক। আমরা কেবল সেই দিকগুলোর মধ্যে সেতুটা মেরামত করেছি।” অনিকেত পাশে দাঁড়িয়ে সেই মুহূর্তের ছবি তুলছিল। তার সাংবাদিকসুলভ দায়িত্ব মনে করাচ্ছিল, এ এক নতুন ইতিহাস—যেখানে মানুষ প্রযুক্তি আর বাস্তবতাকে মিলিয়ে মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে আসছে। রিহানা নীরবে বসেছিল, তার ঠোঁটে ক্লান্তির হাসি। সে বলল, “এখন মানুষ বুঝবে, ডেটা শুধু সংখ্যা নয়। এটা আমাদের অস্তিত্বের ছায়া।” বাইরে শহরের রাস্তায় তখন মানুষের ভিড় জমে গেছে। যারা নিখোঁজ হয়েছিল, তারা ধীরে ধীরে ফিরে আসছে। কেউ বাবা-মাকে জড়িয়ে ধরছে, কেউ সন্তানকে বুকে টেনে নিচ্ছে। এই শহরে কয়েক সপ্তাহের যে অন্ধকার নেমে এসেছিল, তা যেন হঠাৎ আলোর ঢেউয়ে মুছে গেল।
তবে এই আনন্দের মাঝেও অনিকেত, রিহানা আর শ্রেয়স জানত, যুদ্ধ এখনও শেষ হয়নি। Shadow_13-এর আসল পরিচয় তারা খুঁজে পায়নি। আজ তারা সেতু মেরামত করেছে, মানুষ ফিরিয়ে এনেছে, কিন্তু খলনায়ক যে যেকোনো সময় আবার আঘাত হানতে পারে সে সম্ভাবনাও অস্বীকার করা যায় না। তবু সেই রাতে শহর এক নতুন ভোরের স্বপ্ন দেখল। রাস্তায় ছড়িয়ে পড়ল বাজি, ছাদে উড়ল রঙিন ফানুস, মানুষ গাইল ফিরে পাওয়ার গান। অনিকেত তার ডায়েরির শেষ পাতায় লিখল—“আজ শহরের মুখ আবার ফিরেছে। আমরা জিতিনি, কিন্তু আমরা হেরে যাইনি। আগামী যুদ্ধ হয়তো আরও কঠিন হবে, তবে আজ রাত আমাদের।” রিহানা মৃদু হেসে তার দিকে তাকাল, আর শ্রেয়স জানালার বাইরে তাকিয়ে নিঃশব্দে বলল, “এই শহরকে এখন একটাই জিনিস শিখতে হবে—বাস্তব আর ভার্চুয়াল আলাদা নয়, তারা একে অপরের প্রতিবিম্ব।” রাত ভোরে রূপ নিল, আর শহর আবার তার মুখ ফিরে পেল।
–
শহরে যেন নতুন এক ভোর নেমে এলো। যাদের মুখ হারিয়েছিল, যাদের অস্তিত্ব ফুরিয়ে যাচ্ছিল, তারা আবার ফিরে এসেছে। মফস্বলের ছোট ছোট ঘরে, নগরীর কোলাহলে, প্রত্যেকের ঘরে ফিরল হারানো মানুষরা। শিশুরা বাবাকে আঁকড়ে ধরল, মায়েরা অশ্রুসিক্ত চোখে সন্তানদের বুকে নিল। কিন্তু এই আনন্দের মাঝেই শহরের বাতাসে রয়ে গেল এক অদ্ভুত নীরবতা, যেন সবার মনে অজানা ভয়। এই অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে দিয়েছে—মানুষ কেবল মাংসের দেহ নয়, তার ডিজিটাল ছায়াও আছে, আর সেটাই একদিন তাকে গ্রাস করতে পারে। অনিকেত এই পরিবর্তনের দিকে গভীর মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে রইল। সাংবাদিক হিসেবে সে জানে, ঘটনার সমাপ্তি মানেই গল্প শেষ নয়—বরং এখান থেকেই শুরু হয় নতুন সতর্কতা। সে অনুভব করল, এই শহরের মানুষকে জাগ্রত করতে হবে, না হলে আবারও একই ভুলের পুনরাবৃত্তি ঘটবে।
রিহানা তখনও ব্যস্ত ছিল। তার হাতে ল্যাপটপ, পর্দায় ভেসে উঠছে পুনঃস্থাপিত ডেটাগুলো। সে ধীরে ধীরে কোড মুছে ফেলছিল, যাতে আর কেউ এই সেতুকে ব্যবহার করে মানুষকে নিখোঁজ করতে না পারে। অনিকেত তার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমরা মানুষকে ফিরিয়ে দিয়েছি, কিন্তু তাদের মনের ভিতরে ভয় ঢুকে গেছে। আমাদের কাজ শেষ হয়নি।” রিহানা মাথা নাড়ল, তার চোখে ছিল ক্লান্তি আর দৃঢ়তার মিশ্রণ। “ভয়টা দরকার,” সে বলল শান্ত গলায়। “যদি মানুষ সচেতন না হয়, যদি তারা নিজেদের জীবন শুধু স্ক্রিনে বন্দি করে রাখে, তবে আবারো কেউ তাদের মুখ মুছে দিতে পারবে। এখন দায়িত্ব তাদেরই।” অনিকেত বুঝল, এই লড়াই কেবল প্রযুক্তির ছিল না; এটা ছিল মানুষকে বোঝানোর, তারা যেন ভার্চুয়াল জগতকে বাস্তবের চেয়ে বড় করে না দেখে।
কয়েকদিন পর, অনিকেত তার কাগজে বড় এক প্রতিবেদন লিখল। প্রতিবেদনের শিরোনাম—“শহরের হারানো মুখ: বাস্তব বনাম ভার্চুয়াল”। সে সেখানে বিস্তারিত জানাল কিভাবে মানুষের মুখ ডিজিটাল জগৎ থেকে মুছে যাচ্ছিল, কিভাবে তারা বাস্তব থেকেও নিখোঁজ হচ্ছিল, আর কিভাবে প্রযুক্তির মাধ্যমে তাদের ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু অনিকেত কেবল ঘটনা বর্ণনা করেই থামল না, সে পাঠকদের সাবধান করল। প্রতিবেদনে সে লিখল—“আমরা প্রমাণ পেয়েছি, প্রযুক্তি আমাদের জীবন বাঁচাতে পারে, আবার নিঃশেষও করতে পারে। সোশ্যাল মিডিয়া কেবল ছবি, লাইক বা কমেন্ট নয়, এটি আমাদের অস্তিত্বের প্রতিফলন। তাই অন্ধ বিশ্বাস নয়, দরকার সতর্ক ব্যবহার। আমরা যদি সবকিছু ডিজিটাল দুনিয়ায় জমা রাখি, তবে একদিন বাস্তব আমাদের হাতছাড়া হয়ে যাবে।” তার লেখা পড়ে শহরের মানুষ নতুন করে ভাবতে শুরু করল।
দিন যেতে লাগল। শহরে আবার স্বাভাবিকতা ফিরে এলো। ট্রামে ভিড়, বাজারে দরদাম, স্কুলে শিশুদের হাসি—সব কিছু আগের মতো। কিন্তু সেই ঘটনার পর মানুষ এক শিক্ষা পেয়েছে। তারা বুঝেছে, অতিরিক্ত নির্ভরতা একসময় বন্ধন হয়ে দাঁড়াতে পারে। কেউ এখন আর নির্ভয়ে প্রতিটি ব্যক্তিগত তথ্য সোশ্যাল মিডিয়ায় আপলোড করে না, আবার কেউ প্রতিটি মুহূর্ত লাইক বা শেয়ারের জন্য ব্যস্ত হয় না। শহর সতর্ক হয়েছে। অনিকেত ও রিহানা যখন এক বিকেলে গঙ্গার ধারে বসে সূর্যাস্ত দেখছিল, তখন তাদের মনে হলো—এবার শহর হয়তো সত্যিই শান্ত হয়েছে। অনিকেত নোটবুকে শেষ লাইন লিখল—“মানুষ যদি ভার্চুয়াল আর বাস্তবের মধ্যে ভারসাম্য রাখতে শেখে, তবে কোনো Shadow_13 তাদের মুখ আর কখনো মুছে দিতে পারবে না।” বাতাসে ভেসে এলো ঢেউয়ের শব্দ, আর শহর ধীরে ধীরে ফিরে গেল স্বাভাবিক জীবনে—তবু হৃদয়ের গভীরে রয়ে গেল সতর্কতার আলো।
—