Bangla - রহস্য গল্প

শহরের নীল মুখোশ

Spread the love

সৈকত রায়


কলকাতার শহরতলির অন্ধকার গলিপথ পেরিয়ে, এলগিন রোডের নামী এক আর্ট গ্যালারির কাচের দরজা ভাঙার শব্দে প্রথমে ঘাবড়ে গিয়েছিল আশেপাশের কেয়ারটেকার আর রাতের প্রহরীরা। সেদিন রাতটা ছিল আষাঢ় মাসের—অবিরাম বৃষ্টির ধারা শহরকে ভিজিয়ে রেখেছিল অদ্ভুত এক নৈঃশব্দ্যে, যেখানে কেবল বৃষ্টির টুপটাপ শব্দই রাতের শূন্যতাকে পূর্ণ করছিল। রাত প্রায় আড়াইটে নাগাদ গ্যালারির সাইরেন হঠাৎ বেজে ওঠে। পুলিশ পৌঁছোতে পৌঁছোতে ভাঙা কাচের টুকরোগুলো ছড়িয়ে পড়েছে গ্যালারির মেঝেতে, ভিজে বাতাসে যেন কাচের গন্ধ মিশে আছে। কিন্তু ভেতরে গিয়ে দেখা গেল—চুরি হয়েছে একটিমাত্র ছবি, প্রবীর গুহ ঠাকুরতার “অদৃশ্য নগরী” নামের চিত্রকর্মটি। অন্যসব ছবিগুলো যথাস্থানে অক্ষত অবস্থায় ঝুলছে, অথচ ওই ছবির জায়গায় কেবল খালি ফ্রেম আর দেয়ালে খসে পড়া কাগজের দাগ। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়—সেই ছবির নিচেই পড়ে আছে একটি মুখোশ, একেবারে গভীর নীল রঙের, যেন কারও চেহারার ছায়া ফেলে রাখা হয়েছে সেখানে। পুলিশ অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে মুখোশটির দিকে, আর সাংবাদিকরা ক্যামেরার ফ্ল্যাশে তার প্রতিটি কোণ ধরে রাখছে। কিন্তু যেটা সবার চোখে ধরা পড়লেও ব্যাখ্যা মেলেনি—মুখোশটি যেন নতুন, একেবারে অচেনা কোনো উপকরণ দিয়ে তৈরি। যেন ইচ্ছাকৃতভাবে রেখে যাওয়া হয়েছে, শুধু একটাই বার্তা দিতে—এই চুরি নিছক লোভের জন্য নয়।

সেই রাতে ঘটনাস্থলে পৌঁছোনো প্রথম সাংবাদিকদের একজন ছিলেন রিক সেন। বয়স মাত্র চৌত্রিশ, কিন্তু কলকাতার সাংবাদিক মহলে তিনি পরিচিত একজন নির্ভীক অনুসন্ধানকারী হিসেবে। রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র থেকে শুরু করে মাফিয়া দুনিয়ার খবর—বহুবার নিজের প্রাণকে বাজি রেখে তিনি অদ্ভুত সব সত্য উদঘাটন করেছেন। তার কাঁধে ঝোলানো ছিল কালো সাইডব্যাগ, ভেতরে রেকর্ডার, ছোট নোটবুক আর কলম। গ্যালারির সামনে দাঁড়িয়ে তিনি প্রথমে তাকালেন ভাঙা কাচের টুকরোগুলির দিকে, তারপর ধীরে ধীরে এগোলেন ভেতরে। গ্যালারির সাদা দেওয়ালে স্পটলাইটের আলো এখনও জ্বলছে, আর ঝুলে থাকা ছবিগুলির ছায়া মেঝেতে পড়ে তৈরি করেছে এক অদ্ভুত আবহ। রিক চোখ আটকে রাখলেন সেই ফাঁকা জায়গায়, যেখানে একসময় “অদৃশ্য নগরী” ছিল। এ ছবির চারপাশে অনেক গুজব ছড়িয়ে আছে—কেউ বলে প্রবীর গুহ ঠাকুরতা এই ছবিটি এঁকেছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে কলকাতার অজানা দুঃস্বপ্ন দেখে; কেউ বলে, এর ভেতরে লুকোনো আছে এক গোপন মানচিত্র। রিক আগেও শুনেছিলেন এইসব গল্প, কিন্তু এতদিন তা নিছক রটনাই ভেবেছিলেন। তবে আজ, ছবিটি চুরি হয়ে যাওয়া আর তার পাশে পড়ে থাকা রহস্যময় নীল মুখোশ দেখে তিনি প্রথমবার ভাবলেন—এই গুজবগুলির মধ্যে হয়তো সত্যিই লুকিয়ে আছে কোনো সূত্র। পুলিশ ঘটনাটিকে সাধারণ চুরি হিসেবে নথিভুক্ত করতে চাইছিল, কিন্তু রিকের অভিজ্ঞ চোখ বুঝে ফেলেছিল, এটা নিছক এক রাতের ডাকাতি নয়।

বাইরে বৃষ্টির শব্দ তখনও গর্জে উঠছিল, আর শহরের নৈঃশব্দ্য ভেঙে কেবল শোনা যাচ্ছিল পুলিশের ওয়াকিটকির ভনভন আর ফটোগ্রাফারদের ফ্ল্যাশের ঝলকানি। রিক চুপচাপ হাঁটলেন গ্যালারির ভেতর দিয়ে, আর লক্ষ্য করলেন—চোরেরা একটিও অ্যালার্ম বা ক্যামেরা নষ্ট করেনি, অথচ অ্যালার্ম বেজেছিল। যেন তারা ইচ্ছে করেই চেয়েছিল চুরির খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ুক। ঘটনাস্থলে পড়ে থাকা নীল মুখোশটি তিনি একবার নিচু হয়ে ভালো করে দেখলেন। মসৃণ, ঠান্ডা, আর এক অদ্ভুত গভীর নীল—যেন অন্ধকারের ভিতর থেকে আলো শুষে নিচ্ছে। পুলিশের একজন কনস্টেবল মুখ টিপে বলল, “মনে হয় ফ্যান্সি ড্রেস পার্টির মুখোশ।” কিন্তু রিক মাথা নাড়িয়ে নোটবুকে লিখে নিলেন—এটা কোনো সাধারণ মুখোশ নয়, এটা এক ধরনের ছাপ, একটা স্বাক্ষর, এক অদৃশ্য চোরের বার্তা। তিনি জানতেন, প্রবীর গুহ ঠাকুরতার “অদৃশ্য নগরী” কোনো কাকতালীয় কারণে চুরি হয়নি। এর মধ্যে নিশ্চয়ই লুকিয়ে আছে এমন কিছু, যা বহুদিন ধরে চাপা পড়ে ছিল। আর সেই রহস্যের প্রথম ইঙ্গিত শহরের সামনে রেখে গেল এই অচেনা নীল মুখোশ। রিক সেদিন রাতেই ঠিক করলেন, এই গল্প কেবল একটা আর্ট হাইস্টের খবর নয়—এটাই হবে তার পরবর্তী বড় অনুসন্ধান, যা হয়তো তাকে টেনে নিয়ে যাবে শহরের সবচেয়ে অন্ধকার গলির দিকে।

বৃষ্টিভেজা পরের সকালে কলকাতার আকাশ ধূসর হয়ে নেমে ছিল শহরের কোলাহলে। রাতের চুরির খবর ইতিমধ্যেই ছড়িয়ে পড়েছে পত্রিকাগুলির প্রথম পাতায়—শিরোনামে বড় হরফে লেখা “নামী গ্যালারিতে চুরি, ঘটনাস্থলে নীল মুখোশ”। সাংবাদিক রিক সেন তখনও ঘটনার তদন্তে মগ্ন। ভোরে নিজের অফিসে প্রাথমিক রিপোর্ট জমা দিলেও তার মনের ভেতরে কৌতূহল দানা বাঁধছিল—কেন কেবল প্রবীর গুহ ঠাকুরতার ছবি চুরি হলো? আর কেন চোরেরা এত সহজে ক্যামেরা আর সাইরেন অক্ষত রেখে গেল? ঠিক তখনই ফোন এলো গ্যালারির তরুণ কিউরেটর অদিতি লাহার কাছ থেকে। গ্যালারির ভেতরে গণ্ডগোলের পর থেকেই সে ভীষণ বিচলিত ছিল, কিন্তু পুলিশের প্রশ্নোত্তরে স্পষ্ট করে কিছু বলতে পারেনি। রিককে ফোনে সে কেবল বলল, “আপনি কি আজ দুপুরে আমার সঙ্গে গ্যালারিতে দেখা করতে পারবেন? পুলিশের বাইরে, আমি কিছু বলতে চাই।” রিক কণ্ঠে সেই আতঙ্কিত কাঁপুনি শুনে বুঝে গেল—অদিতি কিছু জানে, যেটা হয়তো সে প্রকাশ করতে ভয় পাচ্ছে। দুপুর নাগাদ, রিক গ্যালারিতে গিয়ে পৌঁছোল। ভাঙা কাচ বদলে নতুন কাচ বসানো হয়েছে, ভেতরে পুলিশি প্রহরা এখনো জারি। নিস্তব্ধতার মধ্যে গ্যালারির দেয়ালে ঝোলানো ছবিগুলো যেন আরও গম্ভীর হয়ে উঠেছে, আর যেখানে “অদৃশ্য নগরী” ছিল, সেখানে এখনো ফাঁকা জায়গার নিঃসঙ্গতা স্পষ্ট।

অদিতি তখন গ্যালারির এক কোণে বসে ছিল—চোখে ক্লান্তি, হাতে এক কাপ কফি। বয়স খুব বেশি নয়, আটাশের বেশি নয় নিশ্চয়, কিন্তু চোখের দৃষ্টিতে যেন বহু অদ্ভুত সত্য লুকোনো। রিক তার সামনে বসতেই সে নিচু স্বরে বলল, “আপনি জানেন তো, পুলিশ এটাকে সাধারণ চুরি ভেবেই থামাতে চাইছে। তারা বলছে এটা হয়তো একদল পেশাদার চোর, যারা দামি ছবি বিক্রি করতে চাইছে। কিন্তু আমি জানি, এর পিছনে আরও কিছু আছে।” রিক ভ্রু কুঁচকে তাকালেন—“আপনার সন্দেহটা আসলে কোথায়?” অদিতি গভীর শ্বাস নিয়ে গ্যালারির দেয়ালে ঝোলানো অন্য ছবিগুলির দিকে আঙুল দেখাল। “এই ছবিগুলি—সবকটিই ভারতীয় আধুনিক শিল্পের বিরল সংগ্রহ। কিন্তু বিশেষ করে প্রবীর গুহ ঠাকুরতার ছবিগুলির ভেতরে লুকিয়ে আছে এক ধরণের ইতিহাস। সাধারণ মানুষ হয়তো তা দেখতে পায় না, কিন্তু যারা শিল্পকলার ইতিহাস বোঝে, তারা জানে—এই ছবিগুলো আসলে ভারতের বিভাজনকালীন ইতিহাসের দলিলের মতো।” রিক অবাক হয়ে গেল। শিল্পকলা, ইতিহাস আর চুরি—সব মিলে যেন অদ্ভুত এক জাল বোনা হচ্ছে। অদিতি আরও বলল, “আমি ভেবেছিলাম হয়তো কাকতালীয়, কিন্তু প্রথম চুরিটা ঘটার পর থেকেই আমার মনে হচ্ছে, এটা কোনো আন্তর্জাতিক শিল্পচক্রের কাজ। তারা কেবল ছবির দামে আগ্রহী নয়, বরং ছবির ভেতরে লুকোনো সত্যটায় তাদের নজর।”

রিক অদিতির কথাগুলো মন দিয়ে শুনছিলেন, আর নিজের নোটবুকে দ্রুত লিখে নিচ্ছিলেন প্রতিটি শব্দ। তার চোখে ভেসে উঠছিল আগের রাতের দৃশ্য—ভাঙা কাচ, ফাঁকা দেয়াল, আর সেই নীল মুখোশ। তিনি ধীরে ধীরে বললেন, “আপনার মনে হচ্ছে, এই ছবিগুলি কেবল শিল্পকর্ম নয়, বরং একধরণের তথ্যবাহী দলিল?” অদিতি মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। “হ্যাঁ, প্রবীরবাবু সবসময় বলতেন তাঁর কিছু ছবিতে তিনি ইতিহাসকে কোড করে রেখেছেন। তখন আমরা ভেবেছিলাম উনি হয়তো রসিকতা করছেন, কিন্তু এখন যখন ছবিগুলো একে একে হারিয়ে যাচ্ছে, তখন মনে হচ্ছে সত্যিই কোনো গোপন রহস্য আছে।” গ্যালারির কাচের বাইরে তখন বৃষ্টির টুপটাপ শব্দ পড়ছিল, আর আলো-অন্ধকারে গ্যালারির মেঝে যেন মায়াময় এক আবহ তৈরি করছিল। রিক অনুভব করলেন, এই রহস্য কেবল শহরের অন্ধকার চোরাই-বাজারে আটকে নেই—এর পেছনে আছে আরও গভীর কোনো খেলা। হয়তো আন্তর্জাতিক শিল্পমাফিয়া, হয়তো কোনো রাজনৈতিক শক্তি, অথবা হয়তো দুটোই মিলে গেছে। তিনি চুপচাপ অদিতির দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনি আমাকে সাহায্য করতে থাকুন। আমি যা জানার দরকার, সব জানতে চাই। কারণ এই মুখোশ কেবল শহরের নয়, দেশের জন্যও বিপদের সংকেত হতে পারে।” অদিতির চোখে তখন এক ঝলক ভয় আর দৃঢ়তা একসঙ্গে দেখা গেল। সে নীচু স্বরে বলল, “আপনি জানেন না, রিকদা… এই মুখোশের ছায়া আসলে কতটা বড়।”

সকালের কুয়াশা তখনও পুরোপুরি কাটেনি। কলকাতার উত্তর শহরের এক পুরনো বাড়ির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল রিক সেন। পুরনো লোহার গেটের ওপারে বিস্তীর্ণ এক আঙিনা, যেখানে শুকনো পাতার স্তূপ আর শ্যাওলায় ঢাকা মেঝে মিলিয়ে উঠোনটিকে আরও ভগ্নপ্রায় করে তুলেছিল। এ বাড়িতেই থাকেন প্রবীর গুহ ঠাকুরতা—আধুনিক শিল্পের অন্যতম বিতর্কিত কিন্তু অসাধারণ প্রতিভাধর চিত্রশিল্পী। বয়স এখন আশির কোঠায়, চলাফেরায় ভরসা লাঠির, কিন্তু চোখে-মুখে এখনও এক অদ্ভুত দীপ্তি। অনেকেই বলেন, তিনি অদ্ভুত রাগী, কারও সঙ্গে কথা বলতে পছন্দ করেন না। কিন্তু রিক জানত, তার তদন্তে এই মানুষটির কাছে আসা ছাড়া উপায় নেই। ভেতরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে আঁকা ছবির গন্ধ, পুরনো রঙ, টারপেনটাইন আর ধূমপানের ধোঁয়ায় ভরপুর এক অস্থির পরিবেশ রিককে ঘিরে ধরল। দেয়ালজুড়ে ঝুলছে অসমাপ্ত ক্যানভাস—কোথাও অর্ধেক আঁকা মুখ, কোথাও ভেঙে যাওয়া নগরীর রেখাচিত্র। প্রবীরবাবু চেয়ারটিতে হেলান দিয়ে বসেছিলেন, হাতে তুলি, কিন্তু তার দৃষ্টি ছিল জানলার বাইরে। রিক ভদ্রভাবে পরিচয় দিতেই তিনি মুখ ঘুরিয়ে তাকালেন, আর তার কণ্ঠে ভেসে এল অদ্ভুত রূঢ়তা—“তুমি এসেছ সাংবাদিকতার নামে, তাই না? রাতের চুরির খবর তো সবাই জানে। কিন্তু শোনো, সেই ছবিটা অনেক আগেই হারিয়ে যাওয়ার কথা ছিল।”

রিক চমকে গেল। প্রবীর গুহ ঠাকুরতার এই মন্তব্য যেন হঠাৎ করে অন্ধকারে ছুড়ে দেওয়া অগ্নিস্ফুলিঙ্গ। তিনি ধীরে ধীরে বললেন, “কী বলতে চাইছেন, স্যার? আপনি কি আগেই জানতেন, ছবিগুলো চুরি হবে?” প্রবীরবাবু হেসে উঠলেন—ক্লান্ত, তবু ভয়ার্ত হাসি। “জানতাম না। তবে বুঝেছিলাম। দেখো, এই ছবিগুলো কেবল রঙ আর ক্যানভাস নয়। এগুলো আসলে ইতিহাসের দাগ। আমি যখন এগুলো এঁকেছিলাম, তখন এই শহরের, এই দেশের বুক ফুঁড়ে চলছিল বিভাজনের আগুন, বিদেশি শক্তির ছায়া, আর গুপ্তচরের খেলা। আমি শুধু শিল্পী নই, আমি ছিলাম সাক্ষী। অনেক কিছু আমি দেখেছিলাম, যেগুলো সরকারি দলিলপত্রে কখনো লেখা হয়নি। আমি সেই স্মৃতিগুলো, সেই সত্যগুলো রেখেছি রঙের ভেতর, ব্রাশের আঁচড়ে। তাই বলছি, এই ছবিগুলোকে বহু মানুষ চাইবে না—কারণ এর ভেতরে লুকোনো আছে এমন সব তথ্য, যা কেউ আলোয় আসতে দিতে চাইবে না।” রিক তার কথাগুলো একেবারে গিলে নিচ্ছিল, যেন প্রতিটি শব্দই একেকটি সূত্র। অদিতি যে বলেছিল, ছবিগুলির মধ্যে ইতিহাস লুকোনো আছে—আজ প্রবীর গুহ ঠাকুরতার মুখ থেকে শুনে সেটাই সত্যি মনে হচ্ছিল। কিন্তু এর অর্থ তো দাঁড়াল, আন্তর্জাতিক শিল্পচোরের পাশাপাশি আরও কেউ—হয়তো রাজনৈতিক শক্তি—এই ছবিগুলির পেছনে ছুটছে।

বাইরে তখন হালকা হাওয়া বইছিল, জানলার ফাঁক দিয়ে আসা আলো ছবির রঙিন টুকরো টুকরো ছায়া ফেলছিল মেঝেতে। প্রবীরবাবু কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে হঠাৎ বললেন, “তুমি ভেবেছ নীল মুখোশ কেবল চোরের স্বাক্ষর? না রে। এটা অনেক পুরোনো খেলা। ষাটের দশকে আমি এক বিদেশি কালেক্টরের সঙ্গে দেখা করেছিলাম, তার কাছেই প্রথম শুনেছিলাম এক গোপন সংগঠনের কথা, যারা নিজেদের পরিচয়ের জন্য মুখোশ ব্যবহার করে। তারা শিল্পকলা ব্যবহার করে বার্তা পাঠাতো, মানচিত্র লুকোতো, আর ইতিহাস বিকৃত করত। আমার আঁকা ছবির ভেতরে তারা কিছু খুঁজছিল—যেটা আমি দিতে চাইনি। তাই বলছি, এই ছবিগুলো কেবল শিল্পকর্ম নয়, এগুলো যেন সাক্ষী, প্রমাণ, আর একই সঙ্গে বোঝা।” রিকের বুকের ভেতর ধকধক শব্দ হচ্ছিল। তিনি জানতেন, প্রবীরবাবুর প্রতিটি কথাই তাকে এক নতুন রহস্যের পথে নিয়ে যাচ্ছে। তিনি নোটবুকে লিখলেন—ছবির ভেতরে লুকোনো তথ্য = ইতিহাসের গোপন দলিল। নীল মুখোশ = আন্তর্জাতিক সংগঠনের প্রতীক। প্রবীরবাবু শেষে শুধু বললেন, “তুমি যদি সত্যিই খুঁজতে চাও, তবে সাবধানে থেকো। কারণ এই খোঁজ তোমাকে শহরের অন্ধকারের চেয়েও গভীরে নিয়ে যাবে। যে আঁচড় আমি এঁকেছি, সেটা অনেক আগেই রক্তের কালি দিয়ে লেখা হয়েছিল।” রিক চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল, আর বুঝতে পারল—তার সামনে যে রহস্য খুলছে, সেটা কেবল এক সাংবাদিকের রিপোর্ট নয়, বরং এমন এক সত্য, যা হয়তো শহরের, দেশের ইতিহাসকেই পাল্টে দিতে পারে।

কলকাতার রাত তখন ঘনিয়ে এসেছে। ভিড়ভাট্টা কমে যাওয়ার পর শহরের অলি-গলিগুলো যেন হঠাৎ করে অন্য এক জগতে পরিণত হয়—যেখানে আলো আর অন্ধকার মিলেমিশে তৈরি করে এক রহস্যময় ছায়া। রিক সেন এ শহরকে অনেকদিন ধরে চেনেন, কিন্তু এ শহরের যে গোপন রূপ আছে, তা সাধারণ মানুষের চোখে পড়ে না। এ শহরের বুকের ভেতরে আছে আন্ডারওয়ার্ল্ড—মাদক, দালালি, চোরাই ব্যবসা, আর অদৃশ্য খুনোখুনি দিয়ে গড়ে ওঠা ভয়াবহ এক দুনিয়া। আর আজ রিক স্বেচ্ছায় পা রাখল সেই অন্ধকারের দোরগোড়ায়। তার লক্ষ্য কেবল একটাই—সুবীর ‘কানা’ দত্ত। একসময় গলির দাদাগিরি করে নামডাক ছিল, এখন নাম তার ভয়ে ফিসফিস করে উচ্চারিত হয়। কথিত আছে, সম্প্রতি সে এক আন্তর্জাতিক চক্রের সঙ্গে মিশেছে, যার প্রতীক—নীল মুখোশ। শিয়ালদহের কাছের ভাঙাচোরা এক গুদামঘরের ভিতরে রিক পৌঁছল। ভেতরে মৃদু আলো, ধোঁয়ার গন্ধ, আর কোণে বসে থাকা কয়েকজন লোক। রিককে দেখে সবাই প্রথমে চুপচাপ তাকাল, তারপর ধীরে ধীরে সরে গেল, যেন জানে এই সাক্ষাৎ কারও জন্য শুভ নয়। কোণের একটি চেয়ার দখল করে বসেছিল সুবীর দত্ত—চোখে ভয়ের ছায়া, মুখে কপালে এক গভীর দাগ, আর বাম চোখ আধাআধি অন্ধ।

রিক তার সামনে বসতেই সুবীর সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ল, আর হঠাৎ করেই যেন হকচকিয়ে উঠল। “তুমি এসেছ… সাংবাদিক, তাই না?”—তার গলা শুকনো, কাঁপা। রিক শান্ত গলায় বলল, “হ্যাঁ, আমি এসেছি। নীল মুখোশদের নিয়ে তোমার নাম শুনেছি।” সুবীর হেসে উঠল, কিন্তু সেই হাসির ভেতরে ছিল এক ধরনের আতঙ্ক। “শুনেছিস? শোন, শোনা মানেই জানা নয়। এরা শুধু ছবি চুরি করছে না। এরা কিছু খুঁজছে। এমন কিছু, যেটা আমাদের নাগালের বাইরে।” রিক ঝুঁকে এল, তার চোখে প্রতিটি শব্দের আগ্রহ ঝলসে উঠল। “কী খুঁজছে তারা?” সুবীর এক মুহূর্তের জন্য চুপ করে গেল, তার হাত কাঁপছিল, সিগারেটের ছাই পড়ছিল মাটিতে। “আমিও ঠিক জানি না। তবে যা বুঝেছি, ছবিগুলির ভেতরে কিছু লুকোনো আছে—কোড, মানচিত্র, হয়তো কোনো গুপ্তধন বা গোপন তথ্য। এই শহরের বুকের ভেতরে এমন কিছু আছে, যেটা নিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে কোটি কোটি ডলার খেলা হতে পারে।” রিক মনে মনে প্রবীর গুহ ঠাকুরতার কথা মনে করল—ছবিগুলোর ভেতরে ইতিহাসের দাগ, সত্যের গোপন আঁচড়। মনে হচ্ছিল ধীরে ধীরে টুকরো টুকরো সূত্র একসাথে জোড়া লাগছে। কিন্তু সুবীরের ভয় এতটাই প্রবল ছিল যে, সে গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বলল, “আমি ওদের সঙ্গে গেছি মাত্র একবার। দেখেছি ওরা নীল মুখোশ পরে সভা করে। নাম-পরিচয় লুকিয়ে রাখে। কেবল মুখোশটাই ওদের পরিচয়। আর বিশ্বাস করো, এদের কাছে জীবন মানুষের চেয়ে অনেক সস্তা।”

গুদামঘরের ভেতরে তখন বাতাস ভারী হয়ে উঠছিল। বাইরের অন্ধকারে হঠাৎ কুকুরের ডাক ভেসে এলো, যেন শহরের এই গোপন জগতের জন্যই এক সতর্কবার্তা। রিক অনুভব করল, সুবীর ভয় পেয়ে আস্তে আস্তে ভেঙে পড়ছে। “দাদা,” সে হঠাৎ হাত জোড় করে বলল, “আমি জানি না আর কতদিন বাঁচব। এরা আমাকে ব্যবহার করছে। আমি শুধু ছোটোখাটো কাজ করি—ডেলিভারি, খবর দেওয়া। কিন্তু আসল খেলাটা অন্য জায়গায় চলছে। আমি শুধু জানি, পরের টার্গেটও ঠিক হয়ে গেছে। আরও এক প্রবীর গুহ ঠাকুরতার ছবি হারাবে, আর তার ভেতরে লুকোনো সূত্র যাবে এদের হাতে।” রিক বুঝল, সময় দ্রুত ফুরোচ্ছে। সে শান্তভাবে বলল, “তুমি আমাকে বলো, কোথায় ওরা পরের বার আঘাত হানবে। যদি আমি এই খবর বাইরে আনতে পারি, হয়তো কিছু মানুষ বাঁচবে।” সুবীর কাঁপা গলায় বলল, “তুমি বুঝতে পারছ না। ওরা শুধু ছবি খুঁজছে না, সাংবাদিক। ওরা শহরের বুকের নিচে চাপা এক সত্য খুঁজছে। যে সত্য বাইরে এলে শুধু এ শহর নয়, গোটা দেশের মানচিত্র বদলে যেতে পারে।” তার কণ্ঠে এমন এক আতঙ্ক ছিল যে, রিক নিজেও মুহূর্তের জন্য অস্বস্তি অনুভব করল। কিন্তু সে স্থির রইল, কারণ এখন আর পিছিয়ে আসা সম্ভব নয়। আন্ডারওয়ার্ল্ডের দরজা একবার খোলা হয়ে গেছে—এবার তাকে হেঁটেই যেতে হবে আরও গভীরে, নীল মুখোশের আসল অন্ধকারে।

কলকাতার আকাশে তখন বর্ষার কালো মেঘ জমে আছে, রাস্তার বাতিগুলো কেবলমাত্র ঝাপসা আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে। রিক সেন অদিতিকে নিয়ে বসেছিল এক ক্যাফের কোণে, তাদের সামনে ছড়িয়ে রাখা কিছু কাগজপত্র, আর ল্যাপটপের পর্দায় ঝলসে উঠছিল এক নাম—ইরফান মালিক। নামটা শোনামাত্রই অদিতির চোখে আতঙ্কের ছাপ দেখা দিল। ইরফান মালিক—আন্তর্জাতিক আর্ট-ডিলার, যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে লন্ডনের একাধিক নামি নিলামঘর ও কালোবাজারি চক্রের নাম। বহুদিন ধরে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, সে ভারতের প্রাচীন ভাস্কর্য, মন্দিরের অলঙ্কার, আর চিত্রকর্ম বিদেশে পাচার করে দিয়েছে। তবুও প্রতিবারই সে অদৃশ্য থেকে গেছে, হয় আইনকে কিনে, নয়তো প্রমাণ গায়েব করে। রিক বলল, “নীল মুখোশ পড়ে থাকা ঘটনাগুলো সবই কলকাতায়, কিন্তু টাকার লেনদেন হচ্ছে লন্ডনে। অর্থাৎ এখানকার চুরি আসলে আন্তর্জাতিক বাজারের চাহিদা মেটাচ্ছে।” অদিতি ধীরে মাথা নেড়ে বলল, “কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে—প্রতিটি নীল মুখোশ কি ইরফানের লোক রেখে যাচ্ছে, নাকি অন্য কেউ ইরফানের ছায়া ব্যবহার করছে? কারণ ইরফান বরাবরই চাইত চুপিসারে কাজ সারতে। তার স্টাইল এতটা নাটকীয় নয়।” কথার মধ্যে রিক হঠাৎ মনে করল, প্রবীর গুহ ঠাকুরতা বলেছিলেন ষাটের দশকে এক বিদেশি কালেক্টর মুখোশধারী চক্রের কথা বলেছিল। তাহলে কি ইরফান সেই পুরনো শেকড়েরই আধুনিক উত্তরাধিকারী? নাকি অন্য কেউ এই চক্রকে ব্যবহার করছে আরও গভীর ষড়যন্ত্রে?

অদিতি ল্যাপটপে ইরফানের কিছু পুরনো নিলামের ছবি দেখাচ্ছিল। ছবিগুলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল, কলকাতার চুরি হওয়া শিল্পকর্ম বিদেশের মঞ্চে নতুন পরিচয়ে হাজির হয়েছে। একসময় কলকাতার জাদুঘরের দেওয়ালে ঝোলানো চিত্রকর্ম লন্ডনের নিলামে কয়েক কোটি পাউন্ডে হাতবদল হয়েছে। অদিতি ক্ষোভে ফিসফিস করে বলল, “এই মানুষটা কেবল আমাদের শিল্প চুরি করছে না, আমাদের ইতিহাসও বিক্রি করছে। প্রতিটি ছবি, প্রতিটি ভাস্কর্যের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের স্মৃতি। আর সে এগুলোকে বিদেশে লুকিয়ে দিয়ে আমাদের শূন্য করে দিচ্ছে।” রিক শান্তভাবে বলল, “তাহলে এখন আমাদের দেখতে হবে, নীল মুখোশের সূত্র কি সরাসরি ইরফানের কাছে পৌঁছায়, নাকি এই মুখোশ অন্য কারও খেলা।” এসময় রিক একটি নতুন সূত্র বের করল—সাম্প্রতিক চুরি হওয়া ছবির মধ্যে একটি ইতিমধ্যেই লন্ডনের এক গোপন গ্যালারিতে দেখা গেছে। অর্থাৎ চুরির সঙ্গে সঙ্গে ছবিগুলো দ্রুত পাচার করা হচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এই গতি কেবল একজন লোকের পক্ষে সম্ভব নয়। এখানে নিশ্চয়ই বড়সড় নেটওয়ার্ক কাজ করছে। অদিতি বলল, “মানে দাঁড়াল কলকাতায় যারা নীল মুখোশ ফেলে যাচ্ছে, তারা হয়তো শুধু স্থানীয় খেলোয়াড়। আসল মাস্টারমাইন্ড হয়তো বাইরে বসে দড়ি টানছে।”

রিক চেয়ারে হেলান দিয়ে গভীর চিন্তায় ডুবে গেল। তার মনে হচ্ছিল ছবিগুলো আর মুখোশ কেবল পুতুলের মতো, আসল সুতো অন্য কোথাও বাঁধা। ইরফান মালিক হয়তো সেই সুতোগুলির এক প্রান্ত ধরে আছে, কিন্তু অন্য প্রান্ত কোথায়, সেটা এখনও অজানা। তার মাথায় ঘুরছিল আরও একটি সম্ভাবনা—যদি ইরফানের নাম ব্যবহার করে আরেকটি চক্র কাজ চালাচ্ছে? তাহলে এই খেলা দ্বিগুণ বিপজ্জনক। বাইরে তখন মুষলধারে বৃষ্টি নামতে শুরু করেছে, জানলার কাচ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছিল, শহরের আলো এক অদ্ভুত অস্থির ছায়া ফেলছিল ক্যাফের টেবিলে। রিক জানত, এই রহস্যের পরবর্তী ধাপ তাকে টেনে নিয়ে যাবে শহরের সীমানার বাইরে, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। কিন্তু সেই পথে নামার আগে তাকে নিশ্চিত হতে হবে—ইরফান মালিক আসল খলনায়ক, নাকি শুধুই ধোঁয়াশার মুখোশ? অদিতি ধীরে গলা নামিয়ে বলল, “আমাদের যদি লন্ডনে যোগাযোগ থাকে, তাহলে হয়তো জানতে পারব ইরফানের আসল ভূমিকা। কিন্তু সাবধান, রিক, এই খেলা যতটা শিল্প নিয়ে, তার চেয়ে অনেক বেশি রক্ত আর ক্ষমতার।” রিক জানালার বাইরে তাকিয়ে নিঃশব্দে বলল, “তাহলে লন্ডন কানেকশনই পরের দরজা। আর দরজা একবার খোলা হলে, হয়তো আর ফিরে আসার পথ থাকবে না।”

কলকাতার বুকে রাত তখন গভীর, কিন্তু শহরের প্রাণকেন্দ্র পার্ক স্ট্রিটের কাছে এক নামী গ্যালারিতে হঠাৎ আলো নেভার মতো এক শব্দে সারা এলাকা থমকে গেল। চারপাশে অন্ধকার আর নিস্তব্ধতা ছড়িয়ে পড়ল, যেন কেউ ইচ্ছে করেই বাতাসের শব্দও বন্ধ করে দিয়েছে। সেই সময় রিক সেন গোপনে গ্যালারির বাইরে অবস্থান করছিল, কারণ আগেই খবর পেয়েছিল—আজ রাতেই চক্র আবার সক্রিয় হতে পারে। সে দেখল সশব্দে তালা ভেঙে ভেতরে ঢুকে পড়ল কালো পোশাক পরা দু’টি ছায়া। দুজনেই মুখোশ পরেছে, সেই একই নীল মুখোশ, যেটি এতদিন ধরে প্রতিটি ঘটনার পাশে পড়ে থাকত। রিক চুপচাপ তাদের অনুসরণ করল, হাতে কেবল একটি ছোট টর্চ আর নোটবুক। ভিতরে ঢুকেই সে অনুভব করল ভয়ার্ত এক উত্তেজনা—শিল্পকর্মগুলো দেয়ালজুড়ে ঝুলছে, প্রতিটি ক্যানভাসে লুকিয়ে আছে শতাব্দীর ইতিহাস, অথচ এই মুহূর্তে তা যেন মৃত্যুর হুমকির মুখে। মুখোশধারীরা দ্রুত একটি নির্দিষ্ট চিত্রের দিকে এগিয়ে গেল—একটি বিরল প্রাচীন চিত্র, যার নাম শুনলেই প্রবীর গুহ ঠাকুরতার রহস্যময় মন্তব্য মনে পড়ে যায়। রিক কাঁচের আড়াল থেকে দৃশ্যটি দেখছিল, কিন্তু হঠাৎই একটি অদ্ভুত ব্যাপার তার চোখে পড়ল—চুরি করতে আসা মুখোশধারীরা একে অপরের সঙ্গে যেন ইঙ্গিত করছে, অথচ তাদের মধ্যে সম্পর্কটা সহযোগিতার চেয়ে গোপন প্রতিদ্বন্দ্বিতার মতো। এই মুহূর্তে রিকের মাথায় বজ্রপাতের মতো একটি চিন্তা এল—তাহলে নীল মুখোশ কেবল একজন নয়, বরং একাধিক মানুষ?

রিক নিজেকে আর সামলাতে পারল না। সে হঠাৎ বেরিয়ে এসে চিৎকার করে বলল, “থামো! তোমরা কে? এভাবে আমাদের ইতিহাস লুট করতে দেবে না।” দু’জন মুখোশধারী মুহূর্তের জন্য স্থির হয়ে গেল, তারপর অবিশ্বাস্য দ্রুততায় তারা আলাদা আলাদা দিকে ছুটল। রিক একজনকে অনুসরণ করল, কিন্তু করিডরের আঁকাবাঁকা গলিপথে তার চোখে পড়ল, দু’জনই আলাদা রাস্তায় পালাচ্ছে। হঠাৎ একটার মুখোমুখি হল সে। অন্ধকারে তাদের মধ্যে কয়েক সেকেন্ডের তীব্র লড়াই চলল—রিক এক সাংবাদিক, সে লড়াইয়ে প্রশিক্ষিত নয়, তবুও প্রাণপণ চেষ্টা করল মুখোশটা খুলে ফেলতে। তার আঙুল মুখোশের ধারে পৌঁছে যেতেই মুখোশধারী ভীষণ শক্তিতে তাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিল, তারপর দ্রুত অদৃশ্য হয়ে গেল। রিক মাটিতে পড়ে হাঁপাচ্ছিল, মাথায় ঘুরছিল হাজারো প্রশ্ন। কেন তারা দু’জন? একই ধরনের মুখোশ পরে দু’জন কি একই চক্রের অংশ, নাকি আলাদা দুটো গোপন গোষ্ঠী? আর যদি আলাদা হয়, তাহলে কারা আসল, আর কারা ধোঁকা দিচ্ছে? রিকের শরীর কাঁপছিল, কিন্তু তার ভেতরে এক অদম্য কৌতূহল জেগে উঠছিল—এই খেলা এখন আর কেবল আন্তর্জাতিক পাচারচক্র নয়, এর ভেতরে অন্য কোনো বৃহত্তর শক্তি কাজ করছে।

ঘটনার পর পুলিশ গ্যালারিতে পৌঁছল, কিন্তু স্বাভাবিক নিয়মে তারা এটাকে কেবল আরেকটা চুরি হিসেবেই নিল। রিক একপাশে দাঁড়িয়ে ছিল, ভেতরে অদিতি এসে উপস্থিত হল, চোখে স্পষ্ট আতঙ্ক আর অস্থিরতা। রিক তাকে ধীরে ধীরে বলল, “অদিতি, আমি দেখেছি। একজন নয়, দু’জন ছিল। দু’জন নীল মুখোশ।” অদিতি থমকে দাঁড়াল, মুখে অবিশ্বাসের ছায়া। “দু’জন? তাহলে ব্যাপারটা অনেক জটিল হয়ে যাচ্ছে। হয়তো একদল ইরফানের, আরেকদল অন্য কারও।” রিক মাথা নাড়িয়ে বলল, “হয়তো তাই, কিন্তু আমি যা দেখেছি, তারা একে অপরের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করছে না। যেন প্রতিযোগী, কিন্তু একই সময়ে একই জায়গায় উপস্থিত।” অদিতি ফিসফিস করে বলল, “মানে দাঁড়াল, কলকাতার বুকের নিচে আরও গভীর ষড়যন্ত্র চলছে। নীল মুখোশ কেবল আন্তর্জাতিক পাচারচক্রের প্রতীক নয়, এটা হয়তো এক গোপন প্রতিযোগিতার মুখোশ।” বাইরে তখন ভোরের আলো ফুটছে, কিন্তু রিকের চোখে অন্ধকার আরও গাঢ় হয়ে উঠছিল। সে জানত, আজকের এই আবিষ্কার তার সামনে নতুন দরজা খুলে দিয়েছে—এক দরজা, যার ওপারে অপেক্ষা করছে অজানা শক্তি, অজানা রহস্য। আর সে দরজা একবার পেরোলে হয়তো আর ফিরে আসা যাবে না।

কলকাতার উত্তর শহরের এক পুরনো গলিতে দাঁড়িয়ে থাকা দোতলা বাড়ির দালান ভেদ করে ধুলোর গন্ধে ভরা লাইব্রেরির ঘরে প্রবেশ করল রিক সেন। এটাই ডঃ অনিরুদ্ধ বসুর আস্তানা—শহরের নামী ইতিহাসবিদ, আর বিভাজনকালীন ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাস নিয়ে যার অগাধ গবেষণা আছে। ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়ল বইয়ের স্তুপ, পুরনো নথি, হলদে হয়ে যাওয়া মানচিত্র, আর কাঠের টেবিলের ওপর ছড়িয়ে রাখা খাতাপত্র। ডঃ বসু চশমার ভেতর দিয়ে রিকের দিকে তাকালেন, তারপর আস্তে বললেন, “শুনেছি তুমি নীল মুখোশের ঘটনাগুলো নিয়ে ঘুরছ। সাবধান থেকো, রিক, এই খেলাটা কেবল শিল্পচুরির নয়।” রিক ধীরে ধীরে ঘটনাগুলো খুলে বলল—গ্যালারির চুরি, নীল মুখোশ পড়ে থাকা, ইরফান মালিকের লন্ডন কানেকশন, আর অবশেষে সেই রাত, যেদিন সে একসঙ্গে দু’জন মুখোশধারীকে দেখেছে। অনিরুদ্ধ মনোযোগ দিয়ে শুনলেন, তারপর বুকশেলফ থেকে বের করলেন এক মোটা ডায়েরি। ডায়েরিটি পুরনো, চামড়ার মলাটে সাদা হয়ে যাওয়া দাগ, ভেতরে হাতে লেখা নোট আর রঙিন কালি দিয়ে আঁকা চিহ্ন। তিনি শান্ত গলায় বললেন, “এই ডায়েরি আমার শিক্ষক আমাকে দিয়েছিলেন। এর ভেতরে লুকোনো আছে কিছু অজানা তথ্য—চুরি হওয়া ছবিগুলোর সূত্র আসলে এখানেই।” রিক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল, যখন অধ্যাপক পাতাগুলো উল্টে দিতে শুরু করলেন।

ডায়েরির ভেতরে লেখা ছিল—১৯৪০-এর দশকে ভারতের কয়েকজন তরুণ চিত্রশিল্পী গোপনে কাজ করছিলেন। তাদের কাজ কেবল শিল্প ছিল না, বরং রাজনৈতিক বার্তা। তারা তখনকার অস্থির সময়—দেশভাগের দ্বিধা, বাংলার দাঙ্গা, অব্যক্ত আতঙ্ক—সব কিছুকে লুকিয়ে রাখছিল ক্যানভাসের ভেতরে। ডঃ বসু ব্যাখ্যা করলেন, “যে ছবিগুলো এখন চুরি হচ্ছে, সেগুলো আসলে সেই সময়ের আঁকা। প্রতিটি ছবির স্তরের নিচে লুকোনো আছে বিভাজনকালীন ভারতের এক হারিয়ে যাওয়া দলিল—গোপন নথি, মানচিত্র, কিংবা গোপন চুক্তি, যা ইতিহাসের বইয়ে লেখা হয়নি। কেউ যদি এগুলো উদ্ধার করে প্রকাশ করে, তবে তা রাজনৈতিক অস্ত্র হয়ে উঠতে পারে।” রিক শিহরিত হয়ে গেল। “মানে, যারা চুরি করছে তারা কেবল শিল্পের দামি বাজারে বিক্রি করার জন্য নয়, বরং এর ভেতরে থাকা তথ্যের জন্য মরিয়া?” ডঃ বসু মাথা নেড়ে বললেন, “হ্যাঁ। ইরফান মালিক হয়তো আন্তর্জাতিক পাচারচক্রের অংশ, কিন্তু নীল মুখোশধারীদের মধ্যে কেউ হয়তো জানে ছবিগুলোর গোপন তাৎপর্য। সেই কারণেই চুরি হচ্ছে একটার পর একটা ছবি।” রিকের মনে পড়ল প্রবীর গুহ ঠাকুরতার সেই কথাটা—“এই ছবিগুলো অনেক আগেই হারিয়ে যাওয়ার কথা ছিল।” এবার সে বুঝল, প্রবীর হয়তো জানতেন ছবির ভেতরে কী লুকোনো আছে।

রিকের কৌতূহল এবার ভয় হয়ে উঠল। সে ভাবছিল, যদি সত্যিই এই দলিলগুলো ভারতের বিভাজন নিয়ে কোনো অজানা তথ্য ফাঁস করে, তবে তা আজও রাজনীতি কাঁপিয়ে দিতে পারে। কে জানে, হয়তো নতুন দাবির জন্ম হবে, পুরনো ক্ষতের ওপর নতুন রক্তক্ষরণ শুরু হবে। অধ্যাপক অনিরুদ্ধ বসু চুপচাপ এক পাতা খুলে দেখালেন—একটা স্কেচ, যেখানে গোপনে আঁকা আছে সীমান্তরেখার বিকল্প মানচিত্র। তিনি বললেন, “এমনই কিছু ছবি এখন চুরি হচ্ছে। ভাবো রিক, যদি কারও হাতে এগুলো যায়, তবে সেটা কেবল কালোবাজারি নয়—এটা হবে ক্ষমতার খেলা।” রিক গভীর শ্বাস নিয়ে জানাল, “তাহলে নীল মুখোশধারীরা আসলে এই নথি খুঁজছে। হয়তো দু’জন আলাদা দলের সদস্য—একদল কেবল বাজারে বিক্রির জন্য, আরেকদল রাজনৈতিক কারণে।” অধ্যাপক ধীরে বললেন, “সেটাই হয়তো সত্যি। মনে রেখো, রিক, এই মুখোশ কেবল ছদ্মবেশ নয়, এটি এক দীর্ঘ ষড়যন্ত্রের প্রতীক। আর সেই ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছিল দেশভাগের সময় থেকে।” জানলার বাইরে তখন রাতের আকাশে বজ্রপাতের আলো দেখা যাচ্ছিল। রিক অনুভব করল, শহরের ওপর নেমে আসছে এক ভয়ঙ্কর ঝড়, যার সূচনা হয়েছে বহু দশক আগে, আর এখন সে ঝড়ের কেন্দ্রবিন্দুতে দাঁড়িয়ে আছে।

কলকাতার লালবাজার থানার ভেতরকার ঘরে বসে রিক যেন এক অন্য রকম উত্তেজনায় কাঁপছিল। দেয়ালে ঝোলানো মানচিত্রে পিন দিয়ে চিহ্নিত করা হয়েছে গত কয়েক মাসে ঘটে যাওয়া চুরির ঘটনাস্থলগুলো, আর তার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন ইন্সপেক্টর অলোক মিত্র—কঠোর চাহনি, ঠোঁটে সিগারেটের দাগ, গলায় বছরের পর বছর পুলিশের চাকরির ধ্বনি। অলোক এক ঝলক রিকের দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় বললেন, “মি. সেন, তুমি সাংবাদিক, তোমার কাজ হলো খবর সংগ্রহ করা, গুপ্তচরবৃত্তি নয়। তুমি যেসব ব্যাপারে নাক গলাচ্ছ, সেটা এখন দেশের নিরাপত্তার প্রশ্ন।” রিক ঠোঁট কামড়ে বলল, “কিন্তু স্যার, আমি যা দেখেছি সেটা সাধারণ চুরি নয়। দু’জন মুখোশধারী, তাদের আলাদা উদ্দেশ্য, আর ছবিগুলোর ভেতরে লুকোনো দলিল—এগুলো উপেক্ষা করলে আমরা সবাই আরও বড় বিপদে পড়ব।” অলোক টেবিলে হাত চাপড়ে উঠলেন, “তুমি কি ভাবছো পুলিশ অন্ধ? আমরা জানি এই ছবিগুলো গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সাংবাদিকদের অবাধে তদন্ত করতে দিলে বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে। তুমি যা জানো, সেটা পুলিশের হাতে দাও, বাকি দায়িত্ব আমাদের।” রিক চুপচাপ বসে রইল, কিন্তু ভেতরে আগুন জ্বলছিল। তার মনে হচ্ছিল, পুলিশ ইচ্ছে করেই কিছু তথ্য গোপন করছে, যেন ষড়যন্ত্রের পেছনে অন্য কোনো শক্তি কাজ করছে।

সেই রাতেই রিক দেখা করল অদিতির সঙ্গে, শহরের এক নির্জন কফি শপে। অদিতি চোখে চোখ রেখে ধীরে বলল, “অলোক মিত্র স্যার ঠিকই বলেছেন, এটা বিপজ্জনক। কিন্তু আমি ভেতর থেকে যা দেখছি, তাতে মনে হচ্ছে পুলিশও পুরো সত্যিটা জানাতে চাইছে না।” রিক বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করল, “মানে? তোমার গ্যালারির ভেতরকার কেউ এই চুরিতে জড়িত?” অদিতি ধীরে মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ। আমি খেয়াল করেছি, প্রতিবার চুরির আগে গ্যালারির ভেতরে ছোটখাটো অস্বাভাবিকতা ঘটে—নথি গায়েব হওয়া, ভুয়ো কাগজপত্র জমা পড়া, কিংবা রাতের নিরাপত্তা কমিয়ে দেওয়া। এগুলো বাইরের চোরের পক্ষে সম্ভব নয়, ভেতরের কেউ না থাকলে।” রিক এক মুহূর্ত ভাবল, তারপর বলল, “মানে দাঁড়াল, পুলিশ আমাদের থামাতে চাইছে, আর গ্যালারির ভেতরে কিছু মানুষ নিজেরাই এই চক্রকে সাহায্য করছে।” অদিতি কাঁপা কণ্ঠে বলল, “আমাদের ভেতরে যারা কাজ করে, তাদের মধ্যে কেউ কেউ আন্তর্জাতিক পাচারচক্রের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে। হয়তো তারা ছবিগুলোর ভেতরের আসল মূল্য বোঝে না, কিন্তু মোটা টাকার লোভে সব করছে।” রিকের চোখে দৃঢ় সংকল্প জ্বলে উঠল—এখন তার কাজ কেবল চোরকে খুঁজে বের করা নয়, বরং গ্যালারির ভেতরের গোপন দালালদের মুখোশ খুলে দেওয়া।

পরের দিন রিক গোপনে গ্যালারিতে ঢুকে নথি ঘাঁটতে লাগল, অদিতির সহায়তায়। তারা আবিষ্কার করল কয়েকটি রহস্যজনক এন্ট্রি—কিছু আর্টওয়ার্কের আগমনের তারিখ মিথ্যে লেখা হয়েছে, আবার কিছু চিত্রকর্মের দাম অস্বাভাবিকভাবে কম দেখানো হয়েছে, যেন এগুলো সহজে পাচার করা যায়। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, এইসব নথিতে সই করা আছে গ্যালারির এক প্রভাবশালী কর্মকর্তার—যাকে রিক আগে নিছক প্রশাসনিক কর্মকর্তা ভেবেছিল। তখনই তার মাথায় স্পষ্ট হলো, পুলিশ হয়তো অনেক কিছু জানলেও ইচ্ছে করে এই বিষয়গুলো সামনে আনছে না। হয়তো ভেতরের এই গোষ্ঠী এতটাই প্রভাবশালী যে আইনকেও নিজের স্বার্থে ব্যবহার করছে। রিক এক গম্ভীর স্বরে বলল, “অদিতি, এখন বুঝতে পারছি, কেন অলোক মিত্র আমাকে থামাতে চাইছিলেন। যদি আমি এ সত্যি বের করি, তবে সেটা কেবল পুলিশের ওপর নয়, রাষ্ট্রযন্ত্রের ওপর আঘাত করবে।” অদিতি ফিসফিস করে বলল, “তাহলে আমরা কি করব?” রিক জানাল, “আমরা থামব না। কারণ এটা এখন আর সাংবাদিকতা বা গ্যালারির প্রশ্ন নয়, এটা সত্যকে বাঁচানোর লড়াই। পুলিশ হয়তো চুপ থাকবে, কিন্তু আমরা নীল মুখোশের আড়ালে থাকা প্রকৃত মুখগুলো প্রকাশ করব।” জানলার বাইরে কলকাতার ব্যস্ত শহর শব্দে ভরে উঠছিল, কিন্তু রিক ও অদিতির মনে হচ্ছিল তারা এক ভয়ঙ্কর নিস্তব্ধতার ভেতর দাঁড়িয়ে আছে—যেখানে প্রতিটি পদক্ষেপ তাদের জীবন বদলে দিতে পারে।

কলকাতার এক অন্ধকার গুদামঘরে দাঁড়িয়ে রিক যেন হঠাৎ উপলব্ধি করল, তার এতদিনের ছুটে চলা, এত ধাঁধা মেলানো, সবকিছুর উত্তর যেন এখানে জমাট বেঁধে আছে। ধুলো-মাখা দেওয়ালের সামনে টেবিলে ছড়িয়ে ছিল নীল মুখোশের কয়েকটি স্তূপ—একটা নয়, দুটো নয়, বরং ডজনখানেক। প্রতিটি মুখোশ যেন একেকটা ভিন্ন চরিত্রের ছদ্মবেশ, আর রিক তখন বুঝল—এটা কোনো একক চোরের খেলা নয়। টেবিলের চারপাশে গোপন বৈঠকে বসেছিল নানা মানুষ—কেউ শিল্প জগতের পরিচিত মুখ, কেউ বিদেশি ব্যবসায়ী, কেউ রাজনৈতিক দলের ছায়ামূর্তি। অদিতির হাত শক্ত করে ধরে রিক ফিসফিস করে বলল, “দেখছো, এই মুখোশের আড়ালে আসলে একটা পুরো নাট্যশালা লুকিয়ে আছে।” সে শুনতে পেল ভেতরে আলোচনা চলছে—কোন ছবি কবে চুরি হবে, কোথায় যাবে, আর কিভাবে সেই ছবির গোপন দলিল ব্যবহার করে কেউ রাজনৈতিক ক্ষমতা পাবে, কেউ আবার আন্তর্জাতিক বাজারে কোটি টাকার ব্যবসা করবে। এই মুহূর্তে রিকের চোখে ভেসে উঠল অধ্যাপক অনিরুদ্ধ বসুর কথা—“এই মুখোশ কেবল ছদ্মবেশ নয়, এটি এক দীর্ঘ ষড়যন্ত্রের প্রতীক।” রিক বুঝল, এই মুখোশধারীরা আলাদা আলাদা কারণে একত্র হয়েছে, কিন্তু তাদের আসল লক্ষ্য একই—অতীতকে ব্যবহার করে বর্তমানকে নিয়ন্ত্রণ করা।

কিন্তু সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা এল যখন রিক আবিষ্কার করল, এই চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে আছে তার নিজের অতীত। গুদামের ভেতরে হঠাৎই আলো এসে পড়ল এক পরিচিত মুখে—তার কাকাতো ভাই অনির্বাণ সেন। বহু বছর আগে এক পারিবারিক কলহে রিকের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে বিদেশে চলে গিয়েছিল অনির্বাণ, আর আজ সে দাঁড়িয়ে আছে নীল মুখোশ হাতে। অনির্বাণের চোখে ছিল ঠান্ডা আগুন, সে বলল, “রিক, তুমি সব সময় সত্য খুঁজতে চেয়েছ। এবার সেই সত্যের মাঝেই তুমি ফেঁসে গেছ। এই ছবিগুলোর ভেতরে যে দলিল আছে, সেটা যদি প্রকাশ পায়, তবে ইতিহাস পাল্টে যাবে। আমরা সেটা চাই না। আমরা চাই নিয়ন্ত্রণ।” রিকের মাথায় বজ্রপাত হলো—তার নিজের রক্তের মানুষ এই ষড়যন্ত্রে শামিল! তার পাশে থাকা অদিতি আঁতকে উঠল, কিন্তু রিক শান্ত স্বরে বলল, “তুমি জানো না, ইতিহাস চাইলেই চেপে রাখা যায় না। মুখোশ যতই পরো, একদিন না একদিন তা খুলে যায়।” অনির্বাণ তীক্ষ্ণ হেসে উত্তর দিল, “তাহলে সেই দিন আজই।” এই মুখোমুখি দাঁড়ানোতে রিকের ভেতর শুধু সাংবাদিক নয়, রক্তের টান আর বিশ্বাসঘাতকতার দ্বন্দ্ব একসঙ্গে বাজতে লাগল।

রিক তখন বুঝতে পারল, এই পুরো চক্রের কাঠামো আসলে এক বিশাল জাল—একদিকে আন্তর্জাতিক পাচারকারী ইরফান মালিক, অন্যদিকে কলকাতার শিল্পকর্মের ভেতরের দালালরা, তার ওপরে রাজনৈতিক শক্তি, আর সবশেষে তার নিজের পরিবার। প্রতিটি স্তরে মুখোশ আছে, আর প্রতিটি মুখোশ খোলার সঙ্গে সঙ্গে সামনে আসে নতুন চমক। সে উপলব্ধি করল, এই ষড়যন্ত্র শুধু অর্থ বা ক্ষমতার নয়, এটা অতীত আর বর্তমানের যুদ্ধ—যেখানে ইতিহাসের দলিলকে ব্যবহার করে ভবিষ্যতকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায় একদল মানুষ। অদিতির হাত চেপে ধরে রিক শপথ করল, “আমি মুখোশের আড়ালের সত্য সবাইকে দেখাব। যতো বড় বিপদই আসুক না কেন।” তখনই বাইরে থেকে পুলিশের সাইরেন শোনা গেল—ইন্সপেক্টর অলোক মিত্র হয়তো তাদের পিছু নিয়েছেন, কিংবা হয়তো পুরো নাটকটা জানতেন আগেই। মুখোশধারীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পালাতে লাগল, কেউ অন্ধকারে মিলিয়ে গেল, কেউ মুখোশ ফেলে রেখে দৌড় দিল। আর রিক দাঁড়িয়ে রইল এক চৌরাস্তার সামনে—যেখানে তাকে বেছে নিতে হবে, সে কি কেবল সাংবাদিক থাকবে, নাকি সত্যের যোদ্ধা হয়ে নিজের অতীতকেও পরাস্ত করবে। তার বুকের ভেতর তখন একটাই শব্দ বাজছিল—“মুখোশ খুলে যায়।”

১০

কলকাতার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের মহা-প্রদর্শনীর রাত। আলো ঝলমলে চত্বর, অতিথিদের ভিড়, আর চারদিক জুড়ে কড়া নিরাপত্তা। শহরের শিল্পমোদীরা সেজে উঠেছে, সাংবাদিকরা মাইক্রোফোন হাতে দৌড়ঝাঁপ করছে, আর প্রদর্শনীর কেন্দ্রে রাখা হয়েছে সেই সব বিতর্কিত ছবিগুলি—যেগুলো নিয়ে গত কয়েক মাস ধরে কলকাতার আন্ডারওয়ার্ল্ড কেঁপে উঠেছিল। রিক সাদা শার্ট, কালো কোট পরে অতিথিদের ভিড়ের মধ্যে যেন সাধারণ এক প্রতিবেদক হয়েই মিশে আছে, কিন্তু তার চোখে সেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টি—আজ রাতেই সব শেষ করতে হবে। অদিতি, প্রদর্শনীর অফিসিয়াল কিউরেটর হিসেবে, ভেতরের সব তথ্য জানে; আর ইন্সপেক্টর অলোক মিত্র, নিজের বাহিনীসহ, গোপনে চারপাশে ছড়িয়ে রেখেছে ফাঁদ। তারা জানে, আজ রাতেই আবার হামলা হবে। প্রশ্ন হলো—কে, কখন, কিভাবে? চারদিকে ক্যামেরা ঘুরছে, অতিথিদের ফিসফাস, আর সেই পরিবেশে রিকের মনে হচ্ছিল যেন প্রতিটি মুখই একেকটা সম্ভাব্য মুখোশ।

প্রদর্শনীর মাঝামাঝি সময়ে হঠাৎই আলো নিভে গেল, এক মুহূর্তের অন্ধকার যেন সমস্ত হলঘরকে গ্রাস করল। সেই অন্ধকারের ভেতর শোনা গেল কাচ ভাঙার শব্দ, আর কারও দৌড়ে পালানোর ছাপ। অতিথিরা চিৎকার করে উঠল, বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়ল। কিন্তু রিক প্রস্তুত ছিল—সে দেখল দু’জন নীল মুখোশধারী ছবির কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করছে। মুহূর্তেই অলোক মিত্রের বাহিনী আলো জ্বালিয়ে ধরল জায়গাটিকে, আর অদিতি মাইক্রোফোনে ঘোষণা করল, “আপনারা কেউ নড়বেন না—এটা পুলিশের পরিকল্পিত অভিযান।” অতিথিদের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে গেলেও ধীরে ধীরে সত্যি উন্মোচিত হতে লাগল। পুলিশের হাতে ধরা পড়ল একদল মুখোশধারী—তাদের মধ্যে শিল্পচক্রের নামকরা ডিলার, এক বিদেশি ব্যবসায়ী, আর চমকপ্রদভাবে, এক রাজনৈতিক দলের সদস্য। প্রতিটি মুখোশ খুলে বেরিয়ে এলো সেইসব মানুষ, যারা এতদিন ছায়ার আড়ালে থেকে ইতিহাস বিকৃতির চেষ্টা চালাচ্ছিল। কিন্তু সবচেয়ে বড় ধাক্কা ছিল, রিকের কাকাতো ভাই অনির্বাণও ধরা পড়ল তাদের সঙ্গে। তার চোখে ছিল পরাজয়ের ছায়া, আর ঠোঁটে নিস্তব্ধ এক হাহাকার। রিক চেয়ে রইল—অপরাধ আর রক্তের সম্পর্কের মধ্যে দাঁড়িয়ে সে যেন ভেতরে ভেঙে পড়ছে, কিন্তু সত্যকে অস্বীকার করতে পারছে না।

রাতের শেষে শহর যখন আবার শান্ত হলো, রিক নিজের ডেস্কে বসে প্রতিবেদন লিখতে শুরু করল। সে লিখল কিভাবে “শহরের নীল মুখোশ” আসলে কোনো একক চোর ছিল না, বরং এক জটিল ষড়যন্ত্রের প্রতীক। শিল্পচুরির আড়ালে লুকানো ছিল এক ভয়াবহ উদ্দেশ্য—ভারতের বিভাজনকালীন ইতিহাসকে বিকৃত করে নতুন করে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। রিক জানাল কিভাবে এই চক্রের ভেতরে যুক্ত ছিল আন্তর্জাতিক পাচারকারী, গ্যালারির অভ্যন্তরের কিছু দালাল, এমনকি রাজনৈতিক শক্তিও। তার প্রতিবেদনে বিশেষভাবে উঠে এলো সেই বাক্যটি—“মুখোশ যতই পরা হোক, সত্যের মুখোশ নেই।” কলকাতার সকালের পত্রিকায় ছাপা হলো রিক সেনের লেখা সেই প্রতিবেদন, আর শহর জুড়ে আলোড়ন ছড়িয়ে পড়ল। মানুষ বুঝতে পারল, শিল্প শুধু সৌন্দর্যের নয়, ইতিহাসের ধারকও বটে; আর ইতিহাসকে বিকৃত করার চেষ্টা মানে এক গোটা জাতিকে বিভ্রান্ত করা। প্রদর্শনীর রাতের ফাঁদে ধরা পড়া মুখগুলো আদালতে যাবে, কিন্তু রিক জানে, তার যুদ্ধ এখানেই শেষ নয়। সত্যের লড়াই চলবেই, কারণ “শহরের নীল মুখোশ” হয়তো ধরা পড়েছে, কিন্তু নতুন মুখোশের জন্ম কখনও যে থেমে যায় না।

শেষ

WhatsApp-Image-2025-08-16-at-2.09.15-PM.jpeg

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *