Bangla - প্রেমের গল্প

শহরের কোলাহলে

Spread the love

রূপক বসু


সকালবেলা আটটা থেকে দশটার ভেতর শহরের মেট্রো স্টেশন যেন এক আলাদা যুদ্ধক্ষেত্র। অসংখ্য মানুষের ভিড়ে দাঁড়িয়ে থাকা প্রতিটি মানুষই ব্যস্ত, সবাই যেন নিজের নিজের জগতে ডুবে আছে। কেউ কানে হেডফোন গুঁজে গান শুনছে, কেউ হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজে ব্যস্ত, কেউ অফিসের জরুরি প্রেজেন্টেশন নিয়ে নোট ঘেঁটে যাচ্ছে, আবার কেউ বা হাতে ধরা বইয়ের পাতায় ডুবে আছে চারপাশের কোলাহল ভুলে। প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের মধ্যে আবারও সেই চিরচেনা ছবি—অফিসগামী কর্মচারী, কলেজগামী ছাত্রছাত্রী, বয়স্ক মানুষ কিংবা একসাথে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকটি পরিবার। প্ল্যাটফর্মের ওপরে ঝুলে থাকা ডিজিটাল ডিসপ্লেতে মিনিট গুনে গুনে লোকেরা তাকিয়ে থাকে—আর কতক্ষণে ট্রেন ঢুকবে? সেই একই ভিড়ের মধ্যে প্রতিদিন চোখে পড়ে ঋতব্রত সেনকে। লম্বাটে গড়ন, পরনে সাধারণ ফরমাল শার্ট আর গলায় ঝোলানো ল্যাপটপ ব্যাগ। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, আর সবসময় যেন চিন্তায় মগ্ন এক অদৃশ্য পর্দার আড়ালে চলে যাওয়া মানুষ। ভিড়ের মধ্যেও ওর শান্ত স্বভাব চোখে পড়ে। আর ঠিক কয়েক ধাপ দূরেই, অন্য এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকে ঋতিকা মুখার্জী। গায়ে হালকা রঙের সালোয়ার, চুল খোলা, চোখেমুখে প্রাণবন্ত ভাব। হাতে একখানা বই, আর ভিড়ের শব্দে ডুবে না গিয়ে বইয়ের পাতার শব্দেই যেন ওর সকালটা শুরু হয়। প্রতিদিনের এই দৃশ্য যেন ভিড়ের নিয়মিত অংশ হয়ে উঠেছে, কিন্তু তাদের দুজনের মধ্যে কোনোদিন একটি শব্দও বিনিময় হয়নি। শুধু চোখের এক ঝলক দৃষ্টি বিনিময়—যেন অচেনা অথচ অদ্ভুতভাবে চেনা।

ঋতব্রত প্রতিদিন ভিড়ের ভেতর থেকে একটু চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলেও, যখনই ঋতিকার দিকে তার চোখ পড়ে, মনে হয় যেন শহরের অগণিত মুখের মধ্যে এ-একটা মুখ আলাদা। কিন্তু সে কোনোদিন এগিয়ে গিয়ে কিছু বলে ওঠেনি। মেট্রোর ভিড়কে সে জানে—এখানে মানুষজন আসে যায়, কেউ কারো দিকে তাকানোর সময় পায় না, কেউ কারো জীবনের গল্প শোনে না। তবুও, কেন জানি না, এই মেয়েটিকে দেখলেই তার মনে হয়—এখানে হয়তো একটা ভিন্ন গল্প আছে। অন্যদিকে, ঋতিকা প্রতিদিন বই পড়ার ফাঁকেই লক্ষ্য করে, যে ছেলেটা শান্তভাবে একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকে, তার চোখে মাঝে মাঝে যেন একরাশ কৌতূহল ভাসে। প্রথম দিকে বিষয়টা একেবারেই স্বাভাবিক মনে হলেও, ধীরে ধীরে সে বুঝতে পারে, প্রতিদিন একই স্টেশনে, একই সময়ে, একইভাবে দেখা হয়ে যাওয়া একেবারেই কাকতালীয় নয়। ভিড়ের শহরেও প্রতিদিন একই দু’জন মানুষের চোখে চোখ পড়া—এর মধ্যেই যেন অদ্ভুত এক টান তৈরি হয়ে উঠছে। কিন্তু সেই টানকে প্রকাশ করার মতো সাহস দু’জনের কারো মধ্যেই নেই। প্রত্যেকদিনই তারা মনে মনে ভাবে, “কে যেন!”—যেন স্মৃতির ভেতরে কোথাও আগে থেকে থাকা এক পরিচিত সুর হঠাৎ বাজছে, অথচ গলা চেনা যাচ্ছে না।

এভাবেই দিন কেটে যায়, ভিড়ের শহরে দু’জন মানুষের প্রতিদিন দেখা হওয়া আর সেই নীরব সম্পর্কের জন্ম। ট্রেন আসে, ভিড় গিলে নেয় সবাইকে, আবার ট্রেন ছেড়ে গেলে প্ল্যাটফর্ম ফাঁকা হয়। সেই ফাঁকা জায়গাতেও থেকে যায় দুই জোড়া চোখের স্মৃতি, যারা অল্পক্ষণের জন্য একে অপরের দিকে তাকিয়েছে। মেট্রোর কোলাহলে যেখানে মানুষ একে অপরকে ঠেলাঠেলি করে ওঠানামা করে, সেখানে এই নীরব দৃষ্টিই হয়ে ওঠে সবচেয়ে শান্ত মুহূর্ত। কোনো কথা নেই, কোনো স্পর্শ নেই—শুধুই দৃষ্টি, আর সেই দৃষ্টির ভেতর জমা হয় প্রতিদিনের না-বলা অনুভূতি। শহরের কোলাহল যেখানে সবকিছুকে ছাপিয়ে যায়, সেখানেই এই দুটি চোখের মিলন তৈরি করে এক আলাদা পৃথিবী, যেটা শুধু তাদের দু’জনের জন্য। ঋতব্রত ভিড়ের মধ্যে থেকেও বোঝে, সেই হাসিখুশি মেয়েটি তার প্রতিদিনের দিনচক্রে এক অদ্ভুত জায়গা দখল করে ফেলেছে। আর ঋতিকা বুঝে যায়, বইয়ের পাতার চরিত্রদের পাশাপাশি এখন তার জীবনে এক নতুন চরিত্রও ঢুকে পড়েছে, যে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকেও মনে দাগ কেটে যাচ্ছে। শহরের হাজারো কোলাহল আর মুখের ভিড়ের মধ্যে এভাবেই শুরু হয় এক না-বলা গল্প, যা হয়তো একদিন শব্দে রূপ নেবে, হয়তো একদিন প্রকাশ পাবে।

সকালের শহর সবসময় একরকম থাকে, তবুও প্রতিদিনের সেই একই ভিড়ের মধ্যে কিছু মানুষ একেবারে আলাদা হয়ে ওঠে। ঋতব্রত আর ঋতিকার ক্ষেত্রেও তাই ঘটতে থাকে। প্রতিদিন সকালবেলায় যখন তারা মেট্রো স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ায়, তখন ভিড়ের গমগম শব্দ, প্ল্যাটফর্মে ছুটোছুটি, গেটে ঢোকার জন্য যাত্রীদের হুড়োহুড়ি—সবকিছুর ভেতরেই এক অদৃশ্য নিয়ম তৈরি হয়। ঋতিকা সবসময় প্ল্যাটফর্মের এক কোণে দাঁড়িয়ে বইয়ের পাতায় মন দেয়। মাঝে মাঝে চুলে বাতাস লাগে, পাতার কোণে আঙুল গুঁজে সে যেন এক অন্য জগতে চলে যায়। আর ঋতব্রত সেই দূরত্ব বজায় রেখেই দাঁড়ায়, কানে হেডফোন, হাতে মোবাইল, কিন্তু দৃষ্টি অনেক সময়েই সরে আসে ঋতিকার দিকে। প্রথমে হয়তো এটা ছিল নিছকই কাকতালীয়, কিন্তু ধীরে ধীরে দুজনেই লক্ষ্য করতে শুরু করে—প্রতিদিন এই নিয়ম একইভাবে চলতে থাকে। কেউ কাউকে ডাকছে না, কেউ এগিয়ে যাচ্ছে না, কিন্তু প্রতিদিনের ভিড়ের এই মুখগুলোর মধ্যে একে অপরের চেনা হয়ে ওঠাটা অদ্ভুতভাবে আরামদায়ক লাগতে শুরু করেছে।

ভিড়ের শহরে প্রতিটি মানুষই অচেনা। প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা লোকদের নাম, পরিচয়, জীবনযাত্রা—কোনো কিছুই জানা নেই। কিন্তু এই অচেনা মুখগুলোর ভিড়ের মাঝেই যদি হঠাৎ একটা মুখ প্রতিদিন চোখে পড়ে, তবে সেটা ধীরে ধীরে পরিচিত হয়ে যায়। ঋতিকা একদিন বুঝতে পারে, ট্রেনের কামরায় ওঠার সময় ভিড় ঠেলে যখন সে জায়গা করে নেয়, তখনও ঋতব্রতের উপস্থিতি তার নজর এড়ায় না। যেন নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে থাকা এই মানুষটা তার সকালবেলার যাত্রার অংশ হয়ে উঠেছে। আর ঋতব্রতও একসময় বুঝে যায়, হেডফোনে বাজতে থাকা গান শুনলেও তার মনের এক কোণ ব্যস্ত থাকে অন্য জায়গায়—ঋতিকার হাসি কিংবা বই পড়ার অভ্যাস তাকে অজান্তেই টেনে নেয়। তারা দুজনেই না চাইতেও পরস্পরের জীবনে এক অদ্ভুত ছাপ রেখে চলেছে। শহরের অসংখ্য মানুষ প্রতিদিন ওঠানামা করছে, প্রতিদিন বদলাচ্ছে ভিড়ের চেহারা, তবুও এই দুটি মুখ যেন একইভাবে থেকে যাচ্ছে, একই রুটিনে বাঁধা পড়ে যাচ্ছে। এটা যেন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে—ঋতিকা জানে, প্ল্যাটফর্মে গেলে হয়তো সেই ছেলেটিকে আবার দেখবে, আর ঋতব্রত জানে, চোখের কোণায় সেই মেয়েটি বই পড়বে।

এইভাবে ধীরে ধীরে তারা হয়ে ওঠে একে অপরের ‘চেনা অচেনা মুখ’। কোনো কথা নেই, কোনো সরাসরি আলাপ নেই, কিন্তু প্রতিদিনের ছোট্ট ছোট্ট মুহূর্ত তাদের কাছে অনেক মূল্যবান হয়ে ওঠে। একদিন ট্রেন হঠাৎ কয়েক মিনিট দেরি করল, আর সেই কয়েক মিনিটেই ঋতিকা মাথা তুলে আশেপাশে তাকাল—চোখে পড়ল ঋতব্রতের চোখও তার দিকে নিবদ্ধ। দুজনেই এক মুহূর্তের জন্য লজ্জা পেল, আবার চোখ নামিয়ে নিলো নিজের নিজের দিকে। কিন্তু সেই এক সেকেন্ডের দৃষ্টি বিনিময় যেন অনেকটা বলার মতো—“আমি তোমাকে চিনি, যদিও আমাদের পরিচয় হয়নি।” শহরের বাকি সব মুখ যেখানে শুধু ভিড়ের অংশ, সেখানে এই দুটো মুখ হয়ে উঠছে একে অপরের সকালবেলার নীরব সঙ্গী। এভাবে অচেনা শহরের অচেনা ভিড়ে, ধীরে ধীরে তারা গড়ে তোলে এক নীরব পরিচয়, যার কোনো নাম নেই, কোনো সীমা নেই, আছে শুধু এক অদ্ভুত পরিচিতির আরাম।

সকালটা ছিল একেবারে অন্যরকম। আকাশ মেঘলা, রাস্তায় ট্রাফিক কিছুটা বেশি, তাই স্টেশনে পৌঁছতে ঋতব্রতের দেরি হয়ে গেল। সাধারণত সময় মেপে চলে সে, কিন্তু সেদিন সব হিসেব যেন এলোমেলো হয়ে গেল। প্ল্যাটফর্মে পৌঁছে সে দেখল, ঠিক তখনই ট্রেনটা ছেড়ে দিয়েছে। ভিড়ের একাংশ কামরায় ঢুকে পড়েছে, বাকিরা হতাশ মুখে দাঁড়িয়ে আছে। ডিজিটাল ডিসপ্লেতে লেখা উঠল—পরের ট্রেন আসতে আরও দশ মিনিট লাগবে। ট্রেন মিস করা ঋতব্রতের জন্য নতুন কিছু নয়, কিন্তু সেদিন কেন যেন অদ্ভুত এক অনুভূতি হচ্ছিল। চারপাশে তাকিয়ে সে দেখল, ঋতিকা বেঞ্চে বসে আছে, কোলে বই, কিন্তু বইটা খোলা নেই। সেও যেন একটু হাঁপ ছেড়ে বসেছে। এই প্রথমবার, ভিড়ের দাঁড়ানো দূরত্ব সরিয়ে তারা প্রায় পাশাপাশি হয়ে গেল। ঋতব্রত ভেবেছিল, হয়তো চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকবে, সময় কেটে যাবে, ট্রেন আসবে। কিন্তু অদৃশ্য এক টান তাকে টেনে নিল সামনে। এক ঝটকায় মুখ থেকে বেরিয়ে এলো সেই প্রথম বাক্য—“আজ তো আমরা একই ট্রেন মিস করলাম।” কথাটা শুনে ঋতিকা প্রথমে একটু চমকে তাকাল, তারপর ঠোঁটে ফুটে উঠল হালকা হাসি। এ যেন ভিড়ের মাঝে এক বিরল মুহূর্ত, যেখানে অচেনা পরিচিত মুখ অবশেষে শব্দে ভেঙে গেল।

ঋতিকার সেই হাসি ঋতব্রতের ভেতরে এক অদ্ভুত উষ্ণতা ছড়িয়ে দিল। এতদিন ধরে কেবল চোখে চোখ রেখে যে নীরবতা জমেছিল, তা ভেঙে পড়ল এক ঝলকে। ঋতিকা উত্তর দিলো হালকা কৌতুকে—“হ্যাঁ, তবে এই দোষ কিন্তু ট্রেনের, আমাদের না।” তার গলায় একরাশ স্বাভাবিকতা, যেন বহুদিনের পরিচিত কারো সঙ্গে সহজে কথা বলছে। ঋতব্রত বুঝতে পারল, কথোপকথনের এই সূচনা খুব সাধারণ, কিন্তু তবুও এই সাধারণতাই তার কাছে অমূল্য। এরপর কথার স্রোত আস্তে আস্তে খুলে গেল। তারা দুজনেই স্বীকার করল, প্রতিদিনই প্রায় একই সময়ে স্টেশনে আসে। ঋতিকা বলল, “আমি অফিসে পৌঁছনোর আগে কিছুটা পড়াশোনা সেরে নিতে চাই, তাই বইটা সবসময় সাথে রাখি।” ঋতব্রত হেসে বলল, “আমি গান শুনি, যেন ভিড়ের শব্দটা না শুনতে হয়।” এই ছোটখাটো স্বীকারোক্তি, ভিড়ের মধ্যে দুজনের জীবনের ছোট্ট খুঁটিনাটি শেয়ার, যেন হঠাৎ করেই একে অপরকে আরও কাছাকাছি নিয়ে এলো। তারা দুজনেই বুঝতে পারল, এতদিন ধরে যে অচেনা পরিচয় জমা হচ্ছিল, সেটা আসলে ভিতরে ভিতরে এক অদ্ভুত সখ্যে রূপ নিচ্ছিল।

বেঞ্চে বসা সেই কয়েক মিনিট যেন ভিড়ের কোলাহল থেকে আলাদা এক পৃথিবী তৈরি করল। চারপাশে মানুষ দাঁড়িয়ে, কেউ মোবাইলে ডুবে, কেউ বিরক্ত মুখে সময় গুনছে, কিন্তু ঋতব্রত আর ঋতিকা যেন অন্য জগতে আছে। তারা হাসছে, ছোট ছোট বাক্যে নিজেদের পরিচয় ছুঁয়ে যাচ্ছে। ঋতিকা জানালো, সে প্রকাশনা সংস্থায় কাজ করে, বই নিয়েই তার প্রতিদিনের জীবন। ঋতব্রত বলল, সে বিজ্ঞাপনী সংস্থায় গ্রাফিক ডিজাইনার, ছবি আঁকার প্রতি তার দুর্বলতা আজও রয়ে গেছে। কথার ভেতরে তারা নিজেদের ব্যস্ত শহুরে জীবন নিয়ে হাসাহাসি করল—“প্রতিদিনই তো আমরা এই ভিড়ে হারিয়ে যাই, অথচ কিছু মুখ থেকে যায়”—এই লাইনটা বলার পর দুজনেই একসাথে একে অপরের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল। ঠিক তখনই পরের ট্রেন ঢুকল স্টেশনে, ভিড় আবার উথলে উঠল। তারা একসাথে উঠল, ভিড়ের মধ্যে দাঁড়াল, কিন্তু সেই দিনের আলাপ যেন এক নতুন সূচনা হয়ে গেল। মেট্রোর কোলাহলের মধ্যেও তারা বুঝে গেল, আজকের এই ট্রেন মিস করার ঘটনাটা আসলে কোনো ক্ষতি নয়, বরং এক অমূল্য পাওয়া। যে দৃষ্টি বিনিময় এতদিন ধরে নীরব ছিল, তা অবশেষে শব্দ পেল, আর সেই শব্দ থেকেই জন্ম নিল এক অচেনা পরিচিতির প্রথম আলাপ।

প্রথম দিনের সেই আলাপ যেন এক অদৃশ্য সেতুর মতো কাজ করল। এরপর থেকে প্রতিদিন দেখা হলেই আর শুধু দৃষ্টি বিনিময়ে সীমাবদ্ধ থাকল না, কথোপকথনের এক নতুন অভ্যাস তৈরি হয়ে গেল। মেট্রোর ভিড়, আসন না পাওয়া, কিংবা দাঁড়িয়ে থেকে জানলার বাইরে তাকানো—সবকিছুর ফাঁকে ফাঁকেই গড়ে উঠতে লাগল ছোট ছোট আলাপ। কখনো বই নিয়ে আলোচনা, কখনো গান, কখনো আবার শহরের চিরচেনা সমস্যাগুলো নিয়ে অল্পস্বল্প অভিযোগ। ঋতিকা বইয়ের ভেতর ডুবে থাকতে ভালোবাসে, আর ঋতব্রত অবাক হয়ে দেখে, এত ব্যস্ততার মাঝেও তার পড়ার আগ্রহ এতটুকুও কমে না। সে মাঝে মাঝে বলে ওঠে, “তুমি এত মন দিয়ে পড়ো যে আশেপাশে কিছুই টের পাও না।” ঋতিকা হেসে উত্তর দেয়, “হয়তো এটাই আমার আশ্রয়।” আর ঋতব্রত নিজের ভেতরে উপলব্ধি করে, এই সাধারণ কথোপকথনও তাকে কতটা শান্তি দেয়। অন্যদিকে ঋতব্রতের স্বভাব ঋতিকাকে বিস্মিত করে। এত ভিড়, এত দৌড়ঝাঁপের মধ্যেও তার মধ্যে এক অদ্ভুত শান্ত ভাব কাজ করে। ঋতিকা ভাবে, এই শহরে যেখানে সবাই প্রতিদিন ছুটছে, সেখানে ঋতব্রত যেন একটু ধীরে হাঁটা মানুষ। সেই ধীরতা, সেই সংযম তাকে এক অদ্ভুত প্রশান্তি দেয়।

তাদের আলাপ ধীরে ধীরে বিস্তৃত হতে থাকে। কোনোদিন ঋতিকা প্রশ্ন করে, “তুমি কোন গান শুনছ?” ঋতব্রত ইয়ারফোনটা বাড়িয়ে দেয়, আর কয়েক সেকেন্ডের জন্য তারা একই সুরে ডুবে যায়। কোনোদিন আবার ঋতব্রত জানতে চায়, “তুমি যে বইটা পড়ছ, সেটা কেমন?” ঋতিকা উচ্ছ্বাস ভরে গল্প শুরু করে, চরিত্র আর ঘটনাগুলো নিয়ে বলে যায়। ঋতব্রত মন দিয়ে শোনে, মাঝেমধ্যে মাথা নাড়ে, আবার কখনো এক-দু’টি প্রশ্ন করে। এভাবেই বই আর গান হয়ে ওঠে তাদের আলাপের সেতু। শহরের নানা বিষয়ও আলোচনায় আসে। মেট্রো স্টেশনের গরম, অফিসের ক্লান্তি, কিংবা শহরের চিরকালীন ট্রাফিক—সবকিছু নিয়েই হালকা রসিকতা করে তারা। একদিন ঋতিকা হেসে বলল, “জীবনটা যদি মেট্রোর মতো হতো—একটা স্টেশন থেকে অন্যটায় থেমে থেমে এগোনো, তাহলে বোধহয় অনেক সহজ হতো।” ঋতব্রত সেই কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল, তারপর বলল, “হয়তো ঠিকই বলেছ, কিন্তু জীবনের ভিড়ও তো কখনো কখনো কিছু মুখকে কাছাকাছি নিয়ে আসে।” কথাটা শুনে ঋতিকা একটু থমকালেও, শেষে হেসে ফেলল। তারা দুজনেই বুঝল, এই ছোট ছোট বাক্য, এই সহজ আলাপচারিতার ভেতরেই যেন এক অদৃশ্য বন্ধন তৈরি হচ্ছে।

দিনের পর দিন সেই কথোপকথন জমতে জমতে এক অদ্ভুত স্বস্তি এনে দিল তাদের জীবনে। ভিড়ের শহরে যেখানে অচেনা মুখগুলো এক মুহূর্তে হারিয়ে যায়, সেখানে এই পরিচিত মুখ, এই নিত্যদিনের ছোট ছোট আলাপ তাদের জন্য হয়ে উঠল বিশেষ। ঋতব্রত প্রতিদিন অপেক্ষা করতে থাকে, কখন আবার সেই প্রাণবন্ত হাসি শুনবে। আর ঋতিকা বুঝতে পারে, এই শান্ত, সংযমী মানুষটির সাথে কথা বললে মন হালকা হয়ে যায়। অফিসের চাপ, ট্রাফিকের বিরক্তি, কিংবা শহরের অস্থিরতা—সবকিছু যেন কিছুটা কম মনে হয়। তারা কেউই এখনো নিজেদের অনুভূতি স্পষ্ট করে বলে না, কিন্তু প্রতিদিনের এই ছোট ছোট আলাপচারিতার মধ্যেই এক অদ্ভুত সখ্য জন্ম নেয়। যেন শহরের কোলাহল আর ভিড়ের ভেতরেও তারা খুঁজে পেয়েছে নিজেদের আলাদা একটা দুনিয়া—যেখানে হাসি, গল্প আর নীরবতায় মিশে যাচ্ছে এক অমূল্য ভালোবাসার শুরু।

মেট্রোর যাত্রা ধীরে ধীরে তাদের কাছে শুধু চলাফেরার সময় নয়, বরং প্রতিদিনের গল্প ভাগ করে নেওয়ার এক জায়গা হয়ে উঠল। প্রথমদিকে ছোট ছোট কথা ছিল—কোনো গান, কোনো বই, বা শহরের কোলাহল নিয়ে সামান্য হাসি-ঠাট্টা। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সেই আলাপ যেন গভীর হতে শুরু করল। একদিন হঠাৎ করেই ঋতিকা বলল, “আমি চাই একদিন নিজের একটা প্রকাশনা সংস্থা খুলতে। যেখানে নতুন লেখকদের লেখা ছাপা হবে, যাদের সুযোগ নেই, তাদেরও জায়গা দেওয়া হবে।” তার চোখে স্বপ্নের আলো ঝলমল করছিল, গলায় দৃঢ়তার সুর। ঋতব্রত মন দিয়ে শুনছিল, তার দৃষ্টি ঋতিকার কথার সাথে মিশে যাচ্ছিল। সে বলল, “জানো, আমারও একটা স্বপ্ন আছে। ছোটবেলা থেকে ছবি আঁকতে ভালোবাসি। কিন্তু গ্রাফিক ডিজাইনের চাকরিতে নিজের কল্পনা মতো আঁকা হয়ে ওঠে না। আমি চাই একদিন শুধু ছবি নিয়েই একটা প্রদর্শনী করতে, যেখানে আমি যা দেখি, যা অনুভব করি, সব ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলব।” এই প্রথমবার তারা একে অপরের ভেতরের মানুষটিকে খুঁজে পেল—যে শুধু চাকরির চাপে হারিয়ে যায়নি, বরং ভেতরে ভেতরে স্বপ্নকে আগলে রেখেছে। সেই মুহূর্তে ভিড়ের কোলাহল যেন মিলিয়ে গেল, তারা দুজনেই যেন এক অদৃশ্য নীরবতায় স্বপ্নের সেতুতে দাঁড়িয়ে রইল।

শহরের গল্পে তারা নিজেদের গল্প মিশিয়ে দিল। ঋতিকা বলল, “এই শহর মানুষকে সময় দেয় না। সবাই ছুটছে, কেউ থেমে শোনে না। কিন্তু বইয়ের ভেতরে আমি যেসব চরিত্র পাই, তারা আমাকে শোনে, তারা আমাকে বোঝে।” ঋতব্রত চুপচাপ শুনছিল, তারপর বলল, “আমার কাছে ছবি আঁকা একই রকম। রংয়ের ভেতরে আমি এমন একটা জগৎ পাই যেখানে শব্দ নেই, কিন্তু অনুভূতি আছে।” তাদের এই স্বীকারোক্তি যেন একে অপরকে আরও কাছে টেনে আনল। দুজনেই বুঝতে পারল, ভিড়ের শহর তাদের স্বপ্নকে পুরোপুরি গ্রাস করতে পারেনি। তারা এখনও কিছু করে দেখাতে চায়, নিজেদের ভেতরের সত্তাকে বাঁচিয়ে রাখতে চায়। সেই কথোপকথনের মধ্যে লুকিয়ে ছিল ভবিষ্যতের এক নীরব প্রতিশ্রুতি। যেন দুজনেই মনে মনে ভাবল, একদিন যদি সত্যিই তারা নিজেদের স্বপ্নের জায়গায় পৌঁছতে পারে, তাহলে এই আলাপচারিতা হবে সেই যাত্রার প্রথম অধ্যায়।

ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে এক অদ্ভুত সখ্য জন্ম নিল। শহরের গল্প বলতে বলতে তারা নিজেদের জীবনের গল্প শোনাতে লাগল। ঋতিকা বলল, সে ছোটবেলা থেকেই বইয়ের গন্ধে বড় হয়েছে, বাবার ছোট্ট লাইব্রেরিই ছিল তার প্রথম অনুপ্রেরণা। ঋতব্রত জানাল, তার প্রথম রংতুলি কিনে দিয়েছিল মা, তখনও স্কুলে পড়ে। এইসব ছোট ছোট স্মৃতির ভেতর দিয়ে তারা একে অপরকে বুঝতে শুরু করল। প্রতিদিনের ব্যস্ততার ভেতরেও তারা খুঁজে পেল একই রকম আকাঙ্ক্ষা—নিজেদের আলাদা জগৎ গড়ে তোলার। শহরের ভিড় যেখানে মানুষকে অচেনা করে তোলে, সেখানে তারা আবিষ্কার করল, দুজনের স্বপ্ন একে অপরের সাথে আশ্চর্যভাবে মিলে যাচ্ছে। এই মিল যেন এক অদৃশ্য আশ্বাস, এক ধরনের স্বস্তি। ঋতিকা মুগ্ধ হল ঋতব্রতের গভীর ভাবনায়, আর ঋতব্রত অবাক হল ঋতিকার সাহস আর দৃঢ়তায়। তারা বুঝল, শহরের কোলাহলের মাঝেও, জীবনের ব্যস্ততার মাঝেও, তাদের স্বপ্ন একে অপরের প্রতিধ্বনি হয়ে উঠছে—যেন অচেনা ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে একে অপরকে নতুন করে চিনে ফেলা।

সকালের ভিড়ে প্রতিদিনই তারা ট্রেনে করে যায়, কিন্তু সেদিন হঠাৎই এক অদ্ভুত খেয়ালে ঋতিকা প্রস্তাব দিল, “আজ যদি ট্রেনে না উঠে হাঁটতে হাঁটতে যাই? অফিস খুব দূরে নয়, মাঝেমধ্যে শহরটাকেও তো দেখা উচিত।” ঋতব্রত প্রথমে একটু অবাক হলেও, তার চোখে সেই কৌতূহলের ঝিলিক স্পষ্ট হয়ে উঠল। “চলো, দেখি শহরটা আমাদের কী দেখাতে চায়,” বলে সে রাজি হয়ে গেল। শহরের রাস্তাগুলো তখনও পুরোপুরি ভিড়ে ভরে ওঠেনি, সকালবেলার আলো ছড়িয়ে পড়ছে ধীরে ধীরে। ফুটপাতের ধুলো, চায়ের কাপে ভেসে ওঠা ধোঁয়া, হকারের ডাক—সব মিলিয়ে যেন আলাদা একটা দৃশ্য। ট্রেনের বন্ধ কামরা থেকে বেরিয়ে এসে তারা এক নতুন শহরের স্বাদ নিতে লাগল। দুজনেই অনুভব করল, এতদিন যে শহরকে শুধু ছুটোছুটির ভিড়ে দেখেছে, সেটাকে কাছ থেকে চিনে নেওয়ার সুযোগ এভাবে আগে পায়নি। ঋতিকা হেসে বলল, “দেখো, আজ যেন শহরও আমাদের সাথে হাঁটছে।” ঋতব্রতও মৃদু হেসে উত্তর দিল, “হয়তো শহরও চাইছিল আমরা একটু সময় দিই।” হাঁটতে হাঁটতে তাদের মধ্যে কথাবার্তাও ভিন্ন রঙ নিল। ট্রেনের নিয়মিত আলাপ থেকে বেরিয়ে এসে তারা আবিষ্কার করল, শহরটা যেন তাদের গল্প শোনার নতুন ক্যানভাস।

চায়ের দোকানে দুজন একসাথে বসে চা খেল। দোকানের টিনের ছাউনি থেকে টুপটাপ জল পড়ছিল আগের রাতের বৃষ্টির কারণে, আর পাশে দাঁড়িয়ে কিছু অফিসগামী লোক গরম গরম সিঙ্গারা খাচ্ছিল। সেই সাধারণ দৃশ্যও তাদের কাছে বিশেষ হয়ে উঠল। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে ঋতব্রত বলল, “এমন একসাথে বসা যেন অনেকদিনের অপেক্ষার মতো লাগছে।” ঋতিকা হাসল, “হয়তো আমাদের গল্পও শহরের ভিড় থেকে একটু দূরে থাকার অপেক্ষায় ছিল।” সেখান থেকে এগোতে এগোতে তারা পৌঁছল ফুটপাথে সাজানো বইয়ের স্টলে। ঋতিকা প্রায় লাফিয়ে গিয়ে বইগুলো হাতে তুলে নিতে লাগল। পুরোনো পৃষ্ঠার গন্ধে তার চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ঋতব্রত তাকে দেখতে দেখতে বলল, “তুমি বইয়ের ভেতরে ঢুকে যাও, আমি কখনোই তোমাকে সেখান থেকে টেনে বের করতে পারব না।” ঋতিকা হেসে বলল, “তাহলে আমিই হয়তো তোমাকে রংয়ের জগতে হারিয়ে যেতে দেব।” এই কথোপকথনের মধ্যে দিয়ে তারা বুঝতে পারল, তাদের স্বপ্ন আর ভালোবাসার জায়গাগুলো কেবল আলাদা নয়, বরং একে অপরকে সম্পূর্ণ করে। এরপর তারা রাস্তার এক কোণে দাঁড়ানো শিল্পীদের আঁকা ছবি দেখতে থামল। এক ছেলেকে ফুটপাতের উপর চক দিয়ে ছবি আঁকতে দেখে ঋতব্রতের চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখল, আর ঋতিকা সেই মুহূর্তে বুঝতে পারল—ঋতব্রতের ভেতরের শিল্পী কখনোই হারিয়ে যায়নি, বরং শহরের প্রতিটি রঙ তাকে নতুনভাবে ডাকছে।

সেদিনের সেই হাঁটা তাদের জন্য হয়ে উঠল এক অমূল্য অভিজ্ঞতা। শহরের প্রতিটি সাধারণ দৃশ্য, প্রতিটি ক্ষণিকের মুহূর্ত যেন একে অপরের সঙ্গকে আরও দৃঢ় করে তুলল। ট্রেনের ভিড়ের বাইরে, সময়ের তাড়াহুড়ো ছাড়া, তারা আবিষ্কার করল—আসলে একে অপরের উপস্থিতিই তাদের কাছে সবচেয়ে মূল্যবান। অফিসের গেটের কাছে পৌঁছে ঋতিকা মৃদু হেসে বলল, “আজকের দিনটা আলাদা হয়ে রইল। মনে হবে শহরটাকে আবার নতুন করে চিনলাম।” ঋতব্রত তার দিকে তাকিয়ে উত্তর দিল, “হয়তো শহরকে নয়, আমরা একে অপরকে নতুনভাবে চিনলাম।” সেই কথায় দুজনের চোখে এক অদ্ভুত স্বস্তি ফুটে উঠল। ভিড়ের মধ্যে প্রতিদিনের দেখা, প্রতিদিনের ছোট ছোট আলাপের বাইরে সেদিন তারা উপলব্ধি করল—এই সম্পর্ক শুধু মেট্রোর কামরার ভেতর সীমাবদ্ধ নয়। শহরের রাস্তায় পাশাপাশি হাঁটার মতোই, জীবনের পথেও তারা হয়তো একসাথে চলতে পারবে। সেই দিনটি তাদের মনে এক নীরব প্রতিশ্রুতি হয়ে রইল—শহরের বাইরে, ভিড়ের বাইরে, তাদের কাছে সবচেয়ে মূল্যবান হলো একে অপরের সঙ্গ।

দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল, প্রতিদিনের মতো তাদের দেখা হচ্ছিল, আলাপ হচ্ছিল, কখনো বই নিয়ে, কখনো গান নিয়ে, কখনো বা শহরের অবিরাম ভিড় নিয়ে। কিন্তু এর মাঝেও ঋতব্রতের মনে একটা অদ্ভুত দ্বিধা জায়গা করে নিয়েছিল। ঋতিকার হাসি, তার প্রাণবন্ত কথা, স্বপ্নভরা চোখ—সবকিছুই তাকে আকর্ষণ করছিল, তবু সে সাহস পাচ্ছিল না নিজের মনের কথা বলার। তার মনে হচ্ছিল, হয়তো ঋতিকা তাকে কেবলই বন্ধু মনে করে, যার সঙ্গে ভিড়ের শহরে একটুখানি স্বস্তি খুঁজে পাওয়া যায়। বন্ধুত্বের জায়গা থেকে বেরিয়ে গিয়ে যদি কিছু বলেও ফেলে, আর যদি ঋতিকা তার কথা মেনে না নেয়, তাহলে এই প্রতিদিনের দেখা-সাক্ষাতটাই নষ্ট হয়ে যাবে। এই ভয়ের কারণে ঋতব্রত প্রতিদিন নিজের অনুভূতিগুলোকে চেপে রাখছিল। মেট্রোর কামরায় দাঁড়িয়ে বা বেঞ্চে বসে যখন তারা কথা বলত, তখনই তার ইচ্ছে করত ঋতিকার চোখের দিকে তাকিয়ে সব বলে ফেলে—কতটা মুগ্ধ সে তাকে দেখে, কতটা শান্তি খুঁজে পায় তার সঙ্গে কথা বলে। কিন্তু সাহসের অভাবে সেই সব কথা তার ঠোঁটেই আটকে থাকত। ফলে এক অদৃশ্য দূরত্ব প্রতিদিন তাদের মাঝখানে জমে উঠছিল, যা ঋতব্রতের মনে ভার হয়ে বসে থাকত।

অন্যদিকে, ঋতিকার মনেও কম দ্বিধা ছিল না। তার প্রাণবন্ত হাসির আড়ালেও একটা অস্থিরতা কাজ করত। সে নিজেও অনুভব করত, ঋতব্রতের উপস্থিতি তার প্রতিদিনের জীবনকে অন্যভাবে সাজিয়ে তুলেছে। মেট্রোর ভিড়, শহরের কোলাহল—সব কিছুর মাঝেও সে যেন একটা আশ্রয় খুঁজে পায় ঋতব্রতের চোখে। কিন্তু সেই অনুভূতিকে স্পষ্ট করে বলতে ভয় পেত সে। তার মনে হতো, ঋতব্রত হয়তো তাকে কেবলই ট্রেনযাত্রার সঙ্গী মনে করে, হয়তো ব্যস্ত জীবনে বন্ধুত্বের বাইরে আর কিছু চাইবে না। তার ভেতরে একটা অনিশ্চয়তা কাজ করত—যদি সে নিজের অনুভূতির কথা বলে ফেলে, আর ঋতব্রত যদি সেই জায়গায় না দাঁড়ায়? সেই ভয় তাকে চুপ করিয়ে রাখত। অনেক সময় ঋতিকা বাড়ি ফিরে নিজের ডায়েরিতে লিখে ফেলত—“কেন জানি মনে হয় ওরও কিছু বলার আছে, কিন্তু হয়তো আমিই ভুল ভাবছি।” প্রতিদিনের এই দোলাচলে তার মন একদিকে ঋতব্রতের কাছে আরও টান অনুভব করত, অন্যদিকে সেই টানকে প্রকাশ করতে না পারার কষ্টে ভারী হয়ে উঠত।

এই দ্বিধা আর অনিশ্চয়তার মধ্যে তাদের সম্পর্ক ধীরে ধীরে এক অদ্ভুত ভারসাম্যে দাঁড়িয়ে রইল। বাইরে থেকে দেখলে মনে হতো, তারা দুই ভালো বন্ধু, যারা প্রতিদিন কথা বলে, হাসে, শহরের গল্প ভাগ করে নেয়। কিন্তু ভেতরে ভেতরে তারা দুজনেই অনুভব করছিল, একে অপরের উপস্থিতি কেবল বন্ধুত্বের সীমায় আটকে নেই। তবু কেউই প্রথম পদক্ষেপ নিতে পারছিল না। সেই নীরবতা যেন তাদের চারপাশে এক অদৃশ্য দেয়াল তৈরি করল, যা তারা দুজনেই দেখতে পাচ্ছিল, কিন্তু ভাঙার সাহস পাচ্ছিল না। শহরের কোলাহলের মাঝেও তাদের মাঝে জমে থাকা নীরবতার এই ভার যেন আরও প্রবল হয়ে উঠছিল। অনেক সময় ঋতব্রত ঋতিকার চোখে কিছু খুঁজে পেত, যা তাকে আশ্বস্ত করত—হয়তো সে-ও একইভাবে ভাবছে। আবার অনেক সময় মনে হতো, না, এসব শুধু কল্পনা, আর কিছুই নয়। ঠিক একইভাবে ঋতিকাও ঋতব্রতের সামান্য দ্বিধা, হঠাৎ থেমে যাওয়া কথার ভেতরে কিছু বোঝার চেষ্টা করত। কিন্তু দিনের শেষে তারা দুজনেই নিজেদের মনের গভীরে লুকিয়ে রাখা অনুভূতিকে প্রকাশ করতে পারল না। তাদের প্রতিদিনের হাসি, কথা, চলাফেরার ভেতরে জমে রইল অঘোষিত ভালোবাসা আর নীরবতার ভার—যা হয়তো একদিন প্রকাশ পাবে, কিন্তু তখনও তা শুধু অদৃশ্য দূরত্ব হয়েই রইল।

সেদিন সকালটা অন্য দিনের মতোই শুরু হয়েছিল। ঋতব্রত যথারীতি মেট্রো স্টেশনে পৌঁছে দাঁড়িয়ে ছিল, চোখ দিয়ে খুঁজছিল সেই পরিচিত মুখটিকে। ঋতিকা আসতেই তার চোখে ঝলক ফুটে উঠল। দুজনেই হালকা হাসল, যেন প্রতিদিনের অভ্যাস। ভিড় তখন ক্রমশ বাড়ছে, ট্রেনের দরজা খুলতেই সবাই ঠেলাঠেলি করে উঠতে লাগল। ঋতিকা আর ঋতব্রতও ভিড়ের সঙ্গে এগিয়ে গেল, কিন্তু এক মুহূর্তের জন্য ঋতিকা ঋতব্রতের হাতছাড়া হয়ে গেল। ভিড়ের ধাক্কায় তাকে অন্য কামরায় ঠেলে নিয়ে গেল, আর ঋতব্রত দাঁড়িয়ে রইল দরজার কাছে, কিছুটা অস্থির হয়ে। চোখের সামনে তাকে হারিয়ে ফেলল বলে তার ভেতরে হঠাৎই এক অদ্ভুত শূন্যতা তৈরি হলো। মেট্রোর ভিড় তো নিত্যদিনই দেখেছে, কিন্তু সেই ভিড়ের মধ্যে পরিচিত কাউকে হারিয়ে ফেলার অনুভূতি একেবারেই নতুন। ফোন বের করে কল দিল ঋতব্রত, কিন্তু ভিড়ের মধ্যে নেটওয়ার্ক না থাকায় সংযোগ পেল না। কয়েকবার চেষ্টা করেও যখন ঋতিকার ফোনে কল লাগল না, তখন তার বুকের ভেতরটা ভারী হয়ে উঠল। ভিড়ের শব্দ, ট্রেনের গর্জন, মানুষের হৈচৈ—সবকিছুর মাঝেও সে যেন একেবারে একা হয়ে পড়ল।

ট্রেন যখন পরের স্টেশনে থামল, ঋতব্রত তাড়াহুড়ো করে নেমে গেল। চারদিকে চোখ ঘুরিয়ে খুঁজতে লাগল ঋতিকাকে। প্রতিটি মুখেই খুঁজে ফিরল পরিচিত চাহনি, কিন্তু কোথাও তাকে দেখতে পেল না। মনের ভেতর এক অদ্ভুত ভয় জন্ম নিল—যদি সে ঠিকমতো না থাকে, যদি কিছু হয়ে যায়? তার এতদিনের দ্বিধা, নীরবতা, অনিশ্চয়তা সবকিছু মিলেমিশে মুহূর্তেই অদৃশ্য হয়ে গেল। মনে হলো, ঋতিকাকে ছাড়া শহরটা তার কাছে আর আগের মতো নেই। মানুষের ভিড়, রঙিন বিলবোর্ড, দোকানের শব্দ, হকারের ডাক—সবকিছুই যেন হঠাৎ ফাঁকা হয়ে গেল। ঋতব্রত বুঝতে পারল, এই শহরকে এতদিন যেভাবে চিনত, তা আসলে ঋতিকার উপস্থিতির কারণেই। সে না থাকলে শহরের এই ভিড় আর শব্দগুলো কেবল এক বিরক্তিকর কোলাহল ছাড়া আর কিছু নয়। মিনিট কয়েক পরেও যখন কোনো খোঁজ পেল না, তখন তার ভিতরে আতঙ্ক চেপে বসল। ফোনের দিকে তাকিয়ে রইল বারবার, কলের স্ক্রিনে কেবল ব্যর্থ সংযোগের নোটিফিকেশন। এই অস্থিরতার মাঝে সে যেন প্রথমবার স্পষ্ট করে বুঝল—ঋতিকাকে হারিয়ে ফেলার ভয় তার মনের গভীরে জমে থাকা সব দ্বিধাকে ছাপিয়ে গেছে।

অবশেষে, প্রায় আধঘণ্টা পর এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকা ঋতিকাকে দেখতে পেল সে। ভিড়ের চাপে ঋতিকা অন্য কামরায় চলে গিয়েছিল, আর ট্রেন থেকে নেমে এসে সিগন্যাল না থাকায় ফোন ধরতে পারেনি। তাকে সুস্থ-সাবলীল অবস্থায় দেখে ঋতব্রতের বুকের ভেতর থেকে যেন এক নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো। সে এগিয়ে গিয়ে বলল, “তুমি ভালো আছ তো? আমি… আমি ভেবেছিলাম তোমাকে হারিয়ে ফেলেছি।” তার কণ্ঠে ছিল ভয়ের ছাপ, যা সে এতদিন লুকিয়ে রেখেছিল। ঋতিকা প্রথমে কিছু বলল না, শুধু তার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর হালকা হাসি দিয়ে বলল, “আমি কি আর কোথাও পালিয়ে যাব? শহরের ভিড়ে হারিয়েও তো তোমার কাছেই ফিরে আসব।” সেই মুহূর্তে ঋতব্রত স্পষ্ট করে অনুভব করল, ঋতিকাকে ছাড়া সে কিছুই নয়। শহরের কোলাহল, ট্রেনের দৌড়ঝাঁপ, অফিসের ভিড়—সবই তার কাছে অর্থহীন হয়ে যায় যদি ঋতিকা না থাকে। ভিড়ের মাঝে হারানোর সেই অল্প সময়টুকুতে সে বুঝে গেল, ঋতিকার জন্যই তার প্রতিদিনের যাত্রা, প্রতিটি সকাল, প্রতিটি শহরের দৃশ্য বিশেষ হয়ে ওঠে। এই উপলব্ধি তাকে আরও গভীরভাবে ঋতিকার প্রতি টেনে নিল, আর অদৃশ্য দূরত্বটাও যেন একটু একটু করে ভাঙতে শুরু করল।

ঋতব্রত আর ঋতিকার প্রতিদিনের দেখা, প্রতিদিনের কথা যেন অনেকটা পথ অতিক্রম করে ফেলেছিল। কিন্তু সেই অদৃশ্য দূরত্ব, যা এতদিন তাদের আলাদা রেখেছিল, ভিড়ের শহরে হারিয়ে যাওয়ার ঘটনার পর থেকে ধীরে ধীরে ভাঙতে শুরু করেছিল। সেই ভয়, সেই অস্থিরতা ঋতব্রতকে নতুন সাহস দিয়েছিল। সে বুঝে গিয়েছিল—যদি এখনই না বলে, তবে হয়তো কখনোই বলা হবে না। দিন কেটে যাচ্ছিল, কিন্তু তার ভেতরে জমে থাকা অনুভূতি আর নীরব থাকতে চাইছিল না। অফিস থেকে ফেরার পথে এক সন্ধ্যায় ঋতব্রত ঠিক করল, আর কোনো দ্বিধা নয়, আর কোনো অনিশ্চয়তা নয়। আজ সে বলবেই—যা এতদিন ধরে তার ভেতরে জমে আছে। শহরের আলো, রাস্তার ভিড়, চায়ের দোকানের কোলাহল—সবকিছু পেরিয়ে সে ঋতিকাকে ফোন করল, দেখা করার জন্য। ঋতিকা রাজি হলো, যদিও তার ভেতরেও ছিল অদ্ভুত এক কৌতূহল, কেন হঠাৎ দেখা করার তাড়া।

সেই সন্ধ্যায় তারা মিলল এক চেনা ক্যাফেতে, যেখানে একসময় দু’জনে একসাথে চা খেয়েছিল। জায়গাটা বড়ো ছিল না, কিন্তু আরামদায়ক, ভিড়ভাট্টার মাঝেই যেন ছোট্ট এক শান্ত কোণ। ঋতিকাকে দেখামাত্র ঋতব্রতের বুক ধুকপুক করতে শুরু করল। এতদিন সে তার সঙ্গে কত কথা বলেছে, কত হাসি ভাগ করেছে, তবু আজকের এই মুহূর্তটাকে যেন অন্যরকম লাগছিল। চুপচাপ কিছুক্ষণ তারা বসে রইল, দু’জনের চোখে অদ্ভুত এক টান ছিল। অবশেষে, সাহস জুগিয়ে ঋতব্রত সোজাসুজি বলে ফেলল—“আমি তোমাকে ছাড়া এই ভিড়ের শহরটা কল্পনাই করতে পারি না।” কথাটা খুব সোজা, কিন্তু তার ভেতর ছিল অকৃত্রিম ভালোবাসার গভীরতা। মুহূর্তের জন্য ঋতিকা স্তব্ধ হয়ে গেল। তার চোখ ভিজে উঠল, বুকের ভেতর জমে থাকা সব দ্বিধা, সব অনিশ্চয়তা যেন গলে গেল। সে এতদিন যা ভেবেছিল, যা কল্পনা করেছিল, তা-ই তো সত্যি হলো।

ঋতিকার ঠোঁটে ধীরে ধীরে হাসি ফুটে উঠল। তার চোখে জল চিকচিক করছিল, কিন্তু সেই জল দুঃখের নয়, স্বস্তির, আনন্দের। সে ধীরে ধীরে বলল, “তুমি জানো, আমিও একই কথা ভাবতাম প্রতিদিন। কিন্তু সাহস পাইনি বলার।” এই স্বীকারোক্তির পর যেন পুরো পরিবেশ বদলে গেল। বাইরের শহরের শব্দ, ভিড়, কোলাহল—সব মিলেমিশে এক ধরনের পটভূমি হয়ে দাঁড়াল, আর তাদের দুজনের জন্য থেকে গেল কেবলই এক অমূল্য মুহূর্ত। ঋতব্রত হাসল, স্বস্তি পেল, যেন বুকের ভেতর থেকে বড়ো এক বোঝা নেমে গেল। এতদিনের নীরবতা, দ্বিধা, ভয় সবকিছু ভেসে গেল একসাথে। ঋতিকার হাতটা সে আলতো করে ধরে ফেলল, আর সেই হাতের উষ্ণতায় যেন শহরের সমস্ত কোলাহল মিলিয়ে গিয়ে তৈরি হলো এক শান্ত, নিরাপদ জায়গা। এভাবেই, দীর্ঘদিনের দ্বিধা ভেঙে তারা দুজন একে অপরের কাছে স্বীকার করল—শহরের কোলাহল তাদের আলাদা করেনি, বরং সেই ভিড়ের মাঝেই জন্ম দিয়েছে অমূল্য ভালোবাসার।

১০

শহরের কোলাহল যেন চিরকালীন—গমগমে ভিড়, ট্রেনের দৌড়ঝাঁপ, স্টেশনের হৈচৈ, অফিস ফেরত মানুষের তাড়া। এতদিন এই ভিড়ের ভেতরেই ঋতব্রত আর ঋতিকা প্রতিদিনের মতো হারিয়ে যেত, একে অপরের উপস্থিতি খুঁজে নিত নিঃশব্দ চোখের দৃষ্টিতে। কিন্তু স্বীকারোক্তির পর দিনগুলো বদলে গেল। এখন সেই ভিড় আর তাদের বিরক্ত করে না, বরং প্রতিদিনের যাত্রা হয়ে উঠল আরও বিশেষ। তারা দুজনে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ট্রেনের ভিড় সামলায়, একে অপরকে ঠেলাঠেলির হাত থেকে আড়াল করে। আগে যেখানে কেবল চাহনি বিনিময়ে সীমাবদ্ধ ছিল, সেখানে এখন একে অপরের হাত ধরে থাকার নীরব নিশ্চয়তা আছে। আশেপাশের মানুষদের কাছে হয়তো তারা কেবল আরেক জোড়া যাত্রী, কিন্তু নিজেদের কাছে তারা হয়ে উঠেছে আশ্রয়। ভিড়ভাট্টার শহরে যে শান্তি খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব, সেই শান্তি তারা খুঁজে পেয়েছে একে অপরের সান্নিধ্যে।

শহরের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে তারা এখন ছোট ছোট জিনিসকে নতুনভাবে আবিষ্কার করে। ফুটপাতের চায়ের দোকানে একসাথে বসে ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপ ভাগ করে নেয়, বইয়ের স্টলে দাঁড়িয়ে পুরনো বই ঘাঁটে, রাস্তার শিল্পীদের গান শুনতে থেমে যায়। এতদিন যে শহরটা কেবল ক্লান্তির, ব্যস্ততার আর প্রতিযোগিতার জায়গা ছিল, সেটাই এখন হয়ে উঠছে তাদের প্রেমের সাক্ষী। ট্রেনের কামরায় ভিড়ের ধাক্কায় যেখানে আগে বিরক্তি জন্মাত, সেখানে এখন হাসি ফোটে ঠোঁটে, কারণ ধাক্কা খেলেও তারা একে অপরের কাছেই থাকে। অফিস ফেরত রাস্তায় ভিড়ের ভেতর হাত ধরে হাঁটার মধ্যে যে এক অদ্ভুত নিরাপত্তা আর আনন্দ আছে, তা তারা নতুন করে আবিষ্কার করে চলেছে। ভিড়ের শহরে প্রেম মানেই হয়তো কেবল সময় চুরি করে নেওয়া, কিন্তু তাদের জন্য সেই চুরি করা সময়গুলোই এখন হয়ে উঠছে জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান মুহূর্ত।

এভাবে শহরের কোলাহল তাদের জন্য আর কোলাহল নয়, বরং ভালোবাসার এক অদৃশ্য আবরণ। যেখানে চারপাশের দৌড়ঝাঁপ আর ব্যস্ততা মিলেমিশে তৈরি করে এক আলাদা তাল, আর সেই তালে তারা নিজেদের গল্পকে বুনে নেয়। মেট্রো স্টেশনের ভিড়, ট্রেনের জানালার বাইরে ছুটে যাওয়া শহরের ছবি, রাস্তার আলো আর অচেনা মানুষের ভিড়—সবকিছু এখন তাদের গল্পের অংশ। তারা জানে, শহর কখনোই থামবে না, ভিড় কখনোই কমবে না, কিন্তু তাতে তাদের কিছু যায় আসে না। কারণ তারা খুঁজে পেয়েছে ভিড়ের ভেতরেই নিজেদের ভিড়মুক্ত শান্তি, খুঁজে পেয়েছে এমন এক ভালোবাসা যা শহরের সব কোলাহলকে ছাপিয়ে যায়। এই ভালোবাসাই তাদের প্রতিদিনের নতুন যাত্রা, যেখানে শহরকে আর শত্রু মনে হয় না, বরং এক চিরন্তন সাক্ষী—দুটি হৃদয়ের মিলনের।

সমাপ্ত

1000057772.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *