সোহিনী রায়
অধ্যায় ১:
কলকাতার বৌবাজারের গলির শেষ মাথায় এক পুরনো দোতলা বাড়ি—সাদা রং মলিন হয়ে ধূসর, ছাদের কার্নিশে দোয়েলের বাসা, আর পেছনের বারান্দায় ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপের পাশে বসে কবি সৌরীন বন্দ্যোপাধ্যায় প্রতিদিনের মতোই বিকেলের কাগজে চোখ বুলিয়ে যাচ্ছিলেন। বয়স পঁত্রিশ ছুঁইছুঁই, কিন্তু চোখে একটানা জেগে থাকার ক্লান্তি, ঠোঁটের কোনে বিগত প্রেমের দাগ, আর কাঁধে ঝোলানো ভরা ব্যাগে পুরনো কবিতা ও কয়েকটি অপ্রকাশিত পত্রিকা। পত্রিকা ‘শব্দমেঘ’—তাঁরই হাতে গড়া এক ক্ষুদ্র সাহিত্যের বাতিঘর, যেখানে প্রতি মাসে তিনি অল্প কয়েকটি কবিতা প্রকাশ করেন, মূলত অজানা লেখকদের সুযোগ করে দিতে ভালোবাসেন তিনি। তাঁর মনে হত, যে লেখা পাঠকের হৃদয় চিরে যায়, তার লেখককে কখনও সভার মঞ্চ বা ক্যামেরার ফ্ল্যাশের প্রয়োজন হয় না—শুধু দরকার সঠিক একজন পাঠক। সেই ভাবনায় আজও তিনি দৃঢ়, অথচ দিনদিন পাঠকসংখ্যা কমছে, কবিতা যেন প্রান্তিক হয়ে যাচ্ছে বিজ্ঞাপন আর বিতর্কে ভরা এই শহরের ভাষার ভিড়ে। ঠিক এমন এক সন্ধ্যায়, চায়ের কাপে ঠান্ডা ধোঁয়া ভেসে উঠতে না উঠতেই, বাড়ির নিচে ডাকপিয়ন এসে রেখে যায় এক খাম—নীল রঙা, হাতে লেখা ঠিকানা, অচেনা হস্তাক্ষরে লেখা তাঁর নাম। প্রথমে কিছুটা অবাক হয়ে খামটি হাতে নেন সৌরীন, কিন্তু উৎসাহে খুলে ফেলেন চিঠি, যেটি লেখা হয়েছে পাহাড়ঘেরা শহর শিলিগুড়ি থেকে। প্রথম বাক্যেই চমকে ওঠেন—“আপনার একটি কবিতা পড়েছিলাম কলেজ ম্যাগাজিনে—‘অন্তরের ছায়াপথ’। সেই কবিতার শেষ তিনটি পংক্তি আমার ঘুম কেড়ে নিয়েছে। আপনি কে, কেমন আছেন, কেমন করে এমন লেখা আসে আপনার কাছে—জানতে ইচ্ছে করছে।” নিচে নাম লেখা—মৃণালিনী সাহা, ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী, শিলিগুড়ি কলেজ।
পরের কুড়ি মিনিট যেন কোথাও হারিয়ে গেল। চিঠিটি লেখার ভঙ্গি এতটাই আন্তরিক, আর ভাষা এতটাই সংবেদী, যেন পুরনো দিনের কোনও বাঙালি মেয়ের কল্পনাপ্রবণ চিঠি পড়ে ফেলেছেন তিনি। সৌরীন জানতেন, এমন পাঠক পাওয়া সৌভাগ্যের, আর চিঠির মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা যোগাযোগ অনেক বেশি অন্তরঙ্গ। অথচ এতদিন তিনি নিজেও তো একরকম একলা ছিলেন, কবিতার খাতায় জীবন গুছিয়ে রাখতেন, মানুষ এলে দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করে দিতেন। আজ এই অচেনা মেয়ে যেন দরজায় নাড়া দিলো, শুধু শব্দ দিয়ে। চিঠিতে মৃণালিনী লিখেছে, সে উত্তরবঙ্গের এক নীরব পাড়ায় থাকে—সন্ধেবেলায় পাহাড়ে ঢলে পড়ে রোদ, আর সেই রোদের মাঝে সে মাঝে মাঝে কল্পনায় সৌরীনের কবিতার চরিত্রদের দেখতে পায়। “আপনার কবিতা পড়ে মনে হয়, আপনি কেমন যেন এক দূরের মানুষ, কিন্তু শব্দে বড় আপন। আমি জানি, আপনি আমায় চিনবেন না। তবু যদি কখনও মনে হয়—কারও সঙ্গে চিঠি আদানপ্রদান করলে ভালো লাগবে, আমায় লিখবেন।” একটা অদ্ভুত মুগ্ধতা নিয়ে খামটা আবার ভাঁজ করে ব্যাগে রেখে দিলেন সৌরীন। মনের মধ্যে ঘুরপাক খেতে লাগল প্রশ্ন—এই মেয়েটি কে? কীভাবে এমন সহজে ঢুকে পড়ল তাঁর ব্যক্তিগত ঘরে? মনের ভেতর জমে থাকা একাকীত্ব কি ধীরে ধীরে গলে যাচ্ছে?
রাত বাড়ে। সৌরীন ছাদে উঠে সিগারেট ধরিয়ে বসেন পুরনো প্লাস্টিক চেয়ারে। আকাশে শরতের তারা, দূরের ট্রামের ঘণ্টা আর কুকুরের ডাক। তাঁর মনে হয়, যেন এই রাতে কেউ দূর থেকে তাঁকে ডেকে বলছে—”লিখো, উত্তর দাও।” তিনি সেই ডাক শুনে এক পাতার উত্তরে মৃণালিনীকে তাঁর জীবনের অল্প কিছু কথা লেখেন—কীভাবে কবিতা লেখা শুরু করেছিলেন, কেন সাহিত্য তাঁকে রক্ষা করে চলেছে, আর এই শহর কেমন করে তাঁকে প্রতিদিন তাড়িয়ে আর আগলে রাখে। লেখেন, “তোমার চিঠি একরকম আলো এনে দিয়েছে, যেটা জানলার বাইরে আজকাল আর দেখা যায় না।” চিঠির শেষে নিজের ফোন নম্বর বা ইমেল কিছু লেখেন না—শুধু নাম, আর শহরের নাম। যেন এটুকুই যথেষ্ট। পরদিন সকালে চিঠিটি ডাকবাক্সে ফেলে আসেন, এবং অনুভব করেন, অনেক দিন পর বুকের মধ্যে এক ধরনের অনামা অপেক্ষা জন্ম নিচ্ছে। একটা অদৃশ্য রোমাঞ্চ, যেটা কোনও মোবাইল স্ক্রিনে আসে না—শুধু অপেক্ষা করে একটা নীল খামের জন্য। হয়তো এই সম্পর্কের কোনও নাম নেই, কোনও ভবিষ্যৎ নেই, কিন্তু এটুকু বোঝেন সৌরীন—মৃণালিনীর হাতে লেখা চিঠির অক্ষরগুলোতে এমন এক আবেশ আছে, যা তাঁর দীর্ঘদিনের কবিসত্তাকেও নতুন করে জাগিয়ে তুলতে পারে। শহরের হর্ণ, পত্রিকার রাজনৈতিক হিংসা, কিংবা বাইরের যান্ত্রিকতা হঠাৎ যেন ক্ষীণ হয়ে আসে সেই চিঠির পাশে। তাঁর মধ্যবয়সী মনটাও চুপিচুপি বলতে থাকে—“এ কি তবে নতুন কোনও গল্পের শুরু?”
অধ্যায় ২:
শিলিগুড়ির সেই ছোট্ট পাড়ায়, কাঞ্চনজঙ্ঘার ছায়া এসে পড়ে যেদিকে, একটা সাদা কাঠের আলমারির খাঁজে রাখা ছিল সৌরীনের উত্তরচিঠি। মৃণালিনী চিঠি পাওয়ার পর থেকে তিনদিন পর্যন্ত চুপচাপ তাকিয়ে থেকেছে সেই খামের দিকে। পড়েছে বারবার, আবার ভাঁজ করে রেখে দিয়েছে। যেন সে বিশ্বাসই করতে পারছে না—একজন কবি, যাঁর লেখা সে কলেজের ম্যাগাজিনে পড়ে ভালোবেসে ফেলেছিল, তিনি তাঁকে উত্তর দিয়েছেন। অথচ মৃণালিনীর আশঙ্কাও কম ছিল না—সে ভেবেছিল, হয়তো কবি তাঁকে পাত্তাই দেবেন না। কিন্তু এই চিঠি যেন তার নিঃশব্দ হৃদয়কে ছুঁয়ে দিয়ে বলল—”তুমি আছো, আমি তা জানি।” সৌরীনের লেখায় সে একটা ধূসর আলো দেখতে পেল, যেন একজন নিঃসঙ্গ মানুষ তাকে না দেখেই চিনে ফেলেছে। চিঠির মধ্যে লেখা ছিল: “তোমার শব্দগুলোর মধ্যে একটা মৃদু সাহস আছে, মৃণালিনী। অনেকেই কবিতা পড়ে, কিন্তু সবাই হৃদয়ে শব্দ বসিয়ে পাঠায় না।” এই বাক্যটি পড়ে তার চোখ ভিজে উঠেছিল। তার মনে হয়েছিল, সৌরীন বুঝেছেন তাকে—একজন তরুণী, যে কেবল অনুভূতি খুঁজতে চায়, শব্দের মধ্যে আশ্রয় পেতে চায়।
তারপরের দিনগুলো যেন ভেসে গেল চিঠি লেখার প্রস্তুতিতে। মৃণালিনী নতুন খাতা আনল, আকাশি নীল কাগজে কলমের কালি টেনে নিয়ে বারবার লেখায় মগ্ন হলো। সে লিখল, কেমন করে তার মা মারা গিয়েছিলেন মাত্র দশ বছর বয়সে, আর কীভাবে সেই থেকে সে বইয়ের মধ্যে মায়ের গন্ধ খুঁজে পেত। লিখল, কীভাবে তার বিয়ের কথা উঠল গত বছর, কিন্তু সে সাহস করে বাবা-মাকে বলেছিল, সে আগে পড়াশোনা শেষ করতে চায়। আর লিখল—এই প্রথম কারও কাছে সে নিজেকে খুলে বলতে পারছে। “আপনার কবিতাগুলো আমার কাছে শুধু সাহিত্য নয়, এক ধরনের নির্ভরতা। যেন প্রতিটি লাইনের মধ্যে দিয়ে আমি কারও হাত ধরতে পারি।”—এই লাইনটা লেখার পর সে থেমে গিয়েছিল। ভাবছিল, ঠিক করে লিখছে তো? আবার লেখে, আবার ভাঁজ করে ফেলে দেয় খাতা। সে বুঝতে পারে, এই চিঠি নিছক উত্তর নয়—এ এক আত্মার আর্তি। আর আশ্চর্যভাবে, এই কবি পুরুষটি তাকে না দেখে, না চিনেই তার হৃদয়ের ভাষা বুঝে ফেলেছে। সে জানে, এই সম্পর্ক হয়তো বাস্তবে কোনও পরিণতি পাবে না। কিন্তু এই চিঠির ভেতর যে অদ্ভুত টান, তা আর কোনও কিছুর সঙ্গে তুলনীয় নয়।
চিঠিটি পোস্ট করে ফেরার সময় মৃণালিনীর মনে হয়েছিল, সে যেন কোনও বোধির কাছে কিছু অমূল্য দিয়ে এসেছে। বাড়ি ফিরে এসে বারান্দার সিঁড়িতে বসে, সে মনে মনে বলে—“এই যে দূরত্ব, এই না-দেখা ভালোবাসা—এরও কি কোনও নাম আছে?” কলেজের ক্লাসে সে এখন মন বসাতে পারে না, কারণ তার চোখে ভাসে এক ধূসর কলকাতার সন্ধে, আর একটি জানালার পাশে বসে থাকা কবির মুখ, যাকে সে কখনও দেখেনি। সৌরীনের উত্তর পাওয়ার পর, যেন তার চারপাশের রঙ বদলে যেতে শুরু করেছে। পাড়ার মোড়ের চায়ের দোকানের শব্দ, সন্ধেবেলা ঝিঁঝিঁর ডাক—সবকিছুতেই সে কবিতা খুঁজে পায়। একরকম নতুন অনুভব জন্ম নিচ্ছে তার মধ্যে—যেটা প্রেম? না কি আত্মার কাছে পৌঁছনোর কোনো অনন্ত রাস্তা? সে জানে না। শুধু জানে, চিঠিগুলো তার জীবনে এমন এক অধ্যায় খুলে দিয়েছে, যেটা সে কখনও কল্পনাও করেনি। সেই রাতে, সে একটা কবিতা লেখে—প্রথমবার, কারও জন্য। কবিতার শেষ লাইনে সে লেখে, “দূরের এক জানালায়, যদি আলো জ্বলে ওঠে, জানি আমি, কেউ আছি। কেউ শব্দে আমার হাত ধরেছে।”
অধ্যায় ৩:
কলকাতার ঘন কুয়াশায় ডুবে থাকা এক সকালে, সৌরীন যখন পোস্টবক্স খুলে আবার একটি চিঠি পেলেন, তখন তাঁর ভিতরটা হঠাৎ কেঁপে উঠল। জানতেন, চিঠি আসবে—অপেক্ষাও করছিলেন—তবু হাতে সেই নীল খাম আসার মুহূর্তে বুকের মধ্যে শব্দহীন এক ধ্বনি ওঠে, যেন পৃষ্ঠার ভাঁজে পৃষ্ঠার মতো হৃদয়ও খুলে যায়। চিঠি খুলে পড়তে শুরু করলেন, ধীরে, মন দিয়ে, যেন প্রতিটি শব্দের পেছনে লুকিয়ে থাকা নিঃশব্দ নিঃশ্বাস শুনতে পাচ্ছেন। মৃণালিনীর চিঠি এইবার আরও বড়, আরও গভীর। সে লিখেছে তার অতীত, মায়ের চলে যাওয়ার কথা, কীভাবে একটা মেয়ের কাঁধে অল্প বয়সেই পরিবারের দায়িত্ব এসে পড়ে, কীভাবে পাহাড়ের শহরে থেকেও সে যেন হৃদয়ের ভিতর অজস্র শূন্যতা নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। আর তার সেই শূন্যতার মধ্যে একদিন একটা কবিতা এসে আলো ফেলে দিয়েছিল। সৌরীনের ‘অন্তরের ছায়াপথ’ কবিতার কয়েকটি পংক্তি তুলে দিয়েছে চিঠিতে, পাশে নিজের অনুভূতি লিখেছে, প্রশ্ন রেখেছে—“আপনি কি ভালোবাসতে ভয় পান?”—এই প্রশ্নে এসে সৌরীন থমকে গেলেন। বহুদিন পর কেউ তাঁর ভিতরের ঘরের আলো নিভিয়ে রাখা প্রশ্নগুলো খুলে দেখল।
চিঠি পড়ে টেবিলের ওপর রাখলেন না। নিজের বুকে চেপে ধরলেন। অনুভব করলেন, এই মেয়ে কেবল কবিতার পাঠিকা নয়—এ যেন এক ব্যতিক্রমী আত্মা, যে অদৃশ্য শব্দপথে তাঁর সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছে। উত্তর লেখা শুরু করলেন সেদিন রাতেই। জানালেন, হ্যাঁ, ভালোবাসতে ভয় পান—কারণ একবার ভালোবেসে ফেলে সম্পূর্ণ খুইয়েছেন নিজেকে। “কবিতা ছাড়া কিছুই আর আমার কাছে চিরস্থায়ী নয়,” তিনি লিখলেন, “কিন্তু আজ বুঝতে পারছি, চিঠিও হতে পারে চিরস্থায়ী আত্মার আশ্রয়।” তিনি জানান, তাঁর জীবনের প্রিয় জায়গা হলো উত্তর কলকাতার কলেজ স্ট্রিটের পুরনো বইয়ের দোকানগুলো—যেখানে পাতা উল্টে গেলে কবিতার মতো শব্দেরা ধুলোয় মিশে ওঠে। মৃণালিনীর মত সাহিত্যের ছাত্রী বুঝবে এ কথার মর্ম। এই চিঠিতে সৌরীন প্রথমবার একটু হাসি, একটু উষ্ণতা নিয়ে লেখেন—“তুমি যদি কখনও কলকাতায় আসো, তোমায় নিয়ে যাবো সেই বইয়ের দোকানগুলোয়। তবে শুধু যদি মনে চায়।” চিঠির শেষে একটি ছোট কবিতা লেখেন—মাত্র চার লাইনের, কিন্তু গভীর:
“কান্নার শব্দে সুর নেই,
হৃদয় নীরব হয়ে বাজে,
চিঠির খামে বাঁধা তোমার নাম,
অদেখা অথচ আমার আজও বেঁচে।”
চিঠি পোস্ট করার পর, সৌরীন লক্ষ্য করলেন, তাঁর হাঁটাচলা একটু বদলে গেছে। ছাদে ধোঁয়া ছড়ানো সন্ধেগুলোতে এখন আর শুধু ক্লান্তি বা হতাশা থাকে না—থাকে এক চুপচাপ উল্লাস, অপেক্ষার আনন্দ। আর প্রতিদিন, খেয়াল না করেই, তিনি পোস্টবক্সটা একবার দেখেন। শুধু কবিতা নয়, তাঁর দিনলিপিতে এখন জায়গা করে নিয়েছে মৃণালিনী নামক শব্দবন্ধু। এই নামটি উচ্চারণ করলেই তাঁর মনে হয়, সে যেন একটা উষ্ণতার খোঁজ পেয়েছেন, এক ধরনের সাহচর্য—যেটা বহুদিন হারিয়ে গিয়েছিল। সে জানেন না, এটাকে প্রেম বলা যায় কিনা—কারণ প্রেম বললেই যেন তার একটা ছাঁচ পড়ে যায়, একটা নির্দিষ্টতা। কিন্তু এই চিঠিগুলোতে যে সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে, সেটার গভীরতা কোনও সংজ্ঞায় আটকে রাখা যায় না। অন্যদিকে, শিলিগুড়িতে মৃণালিনীও তাঁর চিঠি পাওয়ার পর, একরকম নিঃশ্বাস ছেড়ে অনুভব করেন—এই পৃথিবীর ভিড়ে কেউ একজন তাঁর অন্তরের শব্দ শোনেন। এবং সেই বোধে, একরকম বিশ্বাস গড়ে ওঠে—যে দূরত্বও বন্ধুত্বকে আটকে রাখতে পারে না, যদি শব্দে সেতু গড়ে ওঠে।
অধ্যায় ৪:
মাঘের এক কুয়াশাভেজা সকালে, পোস্টবক্সে রাখা খামে সৌরীন যখন হাতে লেখার ছাপ দেখলেন, বুঝে গেলেন—মৃণালিনী এসেছে, শব্দে, অনুভবে, এক নতুন চিঠির রূপে। তার চিঠিগুলো এখন আর কেবল উত্তরের জন্য থাকে না, সৌরীনের কাছে এ যেন কোনও শীতের দিন উষ্ণ করে রাখা কাগজের কোলাজ—যেখানে প্রতিটি বাক্যে আছে স্পর্শহীন এক আন্তরিকতা। তিনি ধীরে খুলে দেখলেন সেই খাম, ভিতরে ছিল নীলচে কাগজ, হালকা পারফিউমের গন্ধ, আর একটানা তিন পাতার চিঠি। শুরুতেই মৃণালিনী লিখেছে, “এই যে, আপনি বলেছিলেন কলেজ স্ট্রিটে নিয়ে যাবেন—আপনি জানেন তো, আমি তখন থেকেই নিজের মনে রাস্তা এঁকে ফেলছি। হয়তো কখনও যাবো না, কিন্তু তাও আমার মনে হচ্ছে, সেই বইয়ের দোকানগুলোর সামনে আমি দাঁড়িয়ে আছি। আর আপনি আমার পাশে, চুপ করে বইয়ের পাতা উল্টে দিচ্ছেন।” সৌরীন মন দিয়ে পড়তে থাকেন। পরের বাক্যেই ছিল একটা কবিতা—অর্ধেক। সে লিখেছে:
“বুকের ভিতর গোপন নদী
নামে প্রতিরাতে
জানি না তার উৎস কোথায়,
তুমি কি জানো?”
মৃণালিনী শেষ লাইনে লিখেছে—“এটা তোমার জন্য। যদি চাও, তুমি বাকিটা লেখো।”
চিঠি পড়তে পড়তে সৌরীনের চোখে জল জমে উঠল। তাঁর মনে হল, এই প্রথম কোনও মেয়ে, যাকে তিনি দেখেননি, ছুঁয়ে দেখেননি, তার হৃদয়ের ভাষা এমনভাবে ছুঁয়ে গেছে। সেই রাতে তিনি ঘরে বসে লিখলেন কবিতার উত্তর, সেই চার লাইনের কবিতায় আরও চার লাইন জুড়ে:
“তোমার লেখা নদীর ধারে
আমি একা দাঁড়িয়ে—
হাত বাড়ালেই ছুঁয়ে যাই জল,
যদিও জানি, স্পর্শ নয় এ।”
চিঠির শেষে সৌরীন লিখলেন, “তুমি কি জানো, শব্দের মধ্যে গড়া এই সম্পর্কের নাম আমি দিতে পারছি না। তবে এটুকু জানি, আমার দিন শুরু হচ্ছে তোমার চিঠি পড়ে, আর শেষ হচ্ছে তোমার কবিতার পঙ্ক্তি মনে করে। এই যে আমরা কবিতা লিখছি—এ তো কোনো সাহিত্যচর্চা নয়, এ এক গভীর সংলাপ।” এরপর থেকে তাঁদের চিঠিগুলো যেন কবিতার পংক্তিতে ঢুকে পড়ে। কখনও মৃণালিনী প্রথম লাইন লিখে দেয়, সৌরীন শেষ করেন। কখনও সৌরীন পুরো কবিতা লিখে পাঠান, মৃণালিনী তার পাশে নিজের ভাষা যোগ করে দেয়। পাঠকের দৃষ্টিতে এগুলো হয়তো সাদামাটা প্রেমের খেলা, কিন্তু তাঁদের কাছে—এই কবিতাই আত্মা বিনিময়ের উপায়।
এদিকে শিলিগুড়ির সেই মেয়েটি, যার মন একদিন ছিল পাহাড়ের মতোই নীরব, এখন শব্দে-শব্দে খুঁজে পায় ভালোবাসার ইঙ্গিত। এক সন্ধেয় সে জানালার ধারে বসে বাবা-মায়ের পুরনো অ্যালবাম দেখতে দেখতে চিঠি লেখে—“আপনার কোনও ছবি নেই, আপনি কেমন দেখতে তাও জানি না, তবুও আপনি আমার মনে গড়া একজন। আপনার চোখ কেমন, চুল কেমন, এসব জানার প্রয়োজন আমার নেই, কারণ আমার কাছে আপনি কেবল শব্দে গড়া। আপনি আমার চিঠির ভিতরেই পুরোপুরি।” সেই পঙ্ক্তি পড়ে সৌরীন এতটাই স্তব্ধ হয়ে যান, যে দীর্ঘক্ষণ চিঠিটি হাতে নিয়ে বসে থাকেন। তাঁর মধ্যে এমন গভীর প্রেম বহু বছর হয়নি—এমন এক সম্পর্ক, যেখানে না আছে হাহাকার, না আছে দখলের তাগিদ—শুধু আছে দুটো হস্তাক্ষরে লেখা ভালোবাসা, যেটা দিনদিন শব্দ দিয়ে আরও গভীর হয়ে উঠছে। তবু তাঁদের চিঠিতে কখনও বলা হয়নি—“আমি তোমায় ভালোবাসি।”
এই না-বলা কথার মধ্যেই, সৌরীন উপলব্ধি করেন—এটাই হয়তো প্রেমের সবচেয়ে পবিত্র রূপ।
অধ্যায় ৫:
শিলিগুড়ির সেই জানালাটা এখন অনিমিখার প্রিয় আশ্রয়। হিমেল হাওয়ায় দুলে ওঠা পাতাগুলো যেন তার মনের কথাগুলোই বলছে—নরম, নিঃশব্দ, অথচ গভীর। শরতের হালকা আলোয় সে যখন জানালার ধারে বসে, তখন তার সামনে থাকে খোলা কাগজ, পাশে রাখা থাকে সে চিরপরিচিত নীল কালি কলম। কিন্তু আজ কয়েকদিন হল কলমের নিব ছুঁয়েও দেখেনি সে। কারণ—নন্দনের চিঠি আর আসছে না। প্রায় দুই সপ্তাহ কেটে গেছে। প্রতিদিন সকালে দুধওয়ালা, খবরের কাগজ, কিংবা পাড়ার ডাকপিয়নের পায়ের শব্দে বুক ধড়ফড় করে ওঠে, কিন্তু প্রতিবারই হতাশা। তার সমস্ত কল্পনাকে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিয়ে চলে যায় সেই নির্লিপ্ত সময়। আজকাল তার মন পড়ার বইয়ের পৃষ্ঠায় থাকে না, খাওয়ার থালায় হাত চলে না, এমনকি গানের কথাও ভুল হয়ে যায় গলায়। নন্দনের শেষ চিঠিটা সে অন্তত শতবার পড়েছে। শেষ বাক্যে ছিল—“তুমি যদি আমার শব্দ হও, তবে আমি হতে চাই তোমার নিঃশ্বাস।” কী অপার্থিব ভালোবাসা! এমন কথা কেউ বলে কেবল কবিতায়, আর সেই কবিতার কবি যখন বাস্তবে তার ভালোবাসা হয়ে ওঠে, তখন নীরবতার প্রতিটা স্পন্দনও তো শব্দে পরিণত হয়।
কলকাতার ঘিঞ্জি গলির সেই ছোট্ট ছাদে বসে নন্দন কিন্তু ঠিক উল্টো দিকের গল্প লিখছে। সে যে কবিতা লিখছে, তা আর পাঠানো হয় না অনিমিখার ঠিকানায়। কেননা, তার নিজের জীবনের পাতাগুলোতে ছায়া নেমে এসেছে—এক অদ্ভুত বাস্তবতা যা প্রেমকে চিঠির কাগজের গণ্ডি ছাড়িয়ে এক কঠিন পরীক্ষার সামনে দাঁড় করিয়েছে। নন্দনের বাবা অসুস্থ। দীর্ঘদিনের হৃদরোগ এখন ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। প্রতিদিন হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকা সেই শান্ত মানুষটির দিকে তাকিয়ে তার সমস্ত কবিত্ব ম্লান হয়ে যায়। ব্যয়বহুল চিকিৎসার খরচ, কবিতার পত্রিকা থেকে না আসা সম্মানী, আর নিজের নিরুপায়তা তাকে চুপ করিয়ে দিয়েছে। একদিন হাসপাতাল ফেরার পথে সে ডাকঘরের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল হাতে এক খাম নিয়ে। খামের ভিতর অনিমিখার নামে লেখা একটি দীর্ঘ চিঠি—তাকে সব সত্যি জানাতে চাওয়া একটা খোলা স্বীকারোক্তি। কিন্তু পোস্টবক্সের কাছে এসে সে থেমে যায়। চিঠিটা সে ফেলে না—বাড়ি নিয়ে ফিরে আসে। কারণ সে জানে, অনিমিখা যাকে ভালোবেসেছে, সে এক দুরন্ত কল্পনার কবি। বাস্তবের ক্লান্ত, অসহায়, মুখ থুবড়ে পড়া নন্দন যেন সেই প্রেমের জন্য অযোগ্য।
এদিকে অনিমিখার মন আজ অস্থির। মা খেয়াল করেছেন, মেয়েটা কেমন গম্ভীর হয়ে গেছে। চোখে এক অজানা ক্লান্তি। মা জিজ্ঞেস করেন, “কি হয়েছে রে, শরীর খারাপ?” কিন্তু উত্তর মেলে না। কারণ ভালোবাসা আর শরীর আলাদা জগতের। আজ রাতে হঠাৎ করেই সে আবার কলম তুলে নেয়। কাগজে লিখতে থাকে—“তুমি কি জানো? প্রতিদিনের মতো আজও আমি তোমার চিঠির অপেক্ষায় ছিলাম। জানালার পাশের শিউলি গাছে নতুন ফুল ফুটেছে। তুমি বলেছিলে, শিউলি ফুলের গন্ধ নাকি কবিতার মতো। আজ তাই সেই গন্ধ নিঃশ্বাসে টেনে নিচ্ছি—তোমার অনুপস্থিতির কবিতা হয়ে।” সে চিঠিটা শেষ করে ঠিকানাটা লিখে ফেললেও খানিকক্ষণ থমকে থাকে। একটা প্রশ্ন মাথায় ঘোরে—এই চিঠির উত্তর কি আদৌ আসবে? ঠিক সেই মুহূর্তেই দরজায় টোকা পড়ে—মা এসে বলে, “একটা চিঠি এসেছে তোমার নামে।” অনিমিখা ছুটে যায়, বুকের ভেতর ঢেউ খেলতে থাকে হাজারটা প্রশ্ন। খামটা খুলে দেখে—নন্দনের হাতের লেখা নয়, অচেনা একজনের লেখা। ভিতরে মাত্র কয়েকটা লাইন—“নন্দন বাবুর পক্ষ থেকে জানাই, তিনি এখন কিছুদিনের জন্য দূরে আছেন। কবিতা লেখা বন্ধ নয়, কিন্তু চিঠি পাঠানো আপাতত বন্ধ থাকবে।” অনিমিখা স্তব্ধ। চিঠিটা হাতে নিয়ে চেয়ে থাকে জানালার বাইরের শিউলি গাছে। গন্ধটা সত্যিই আজ কিছুটা কম—হয়তো তাই কবিতাও আজ অনুপস্থিত।
অধ্যায় ৬:
রাত্রি গভীর হলে শহরটা যেন অন্যরকম হয়ে ওঠে। আলোর নিচে ছায়াগুলো লম্বা হয়, আর নিরবতা গায়ে জড়িয়ে থাকে আকাশ। সেই রাতে কলকাতার দক্ষিণ দিকের এক পাড়ায়, অভীক বসে ছিল তার ছাদের কোণায়, চেয়ারে হেলান দিয়ে, হাতে অর্ধেক ফাঁকা চায়ের কাপ। হেমন্তের শুরু, হালকা ঠান্ডা পড়তে শুরু করেছে। তার চোখের সামনে উড়ছিল কেবলই সাদা পাতার মত ভেসে ওঠা পুরনো মুহূর্তগুলি। সায়ন্তিকার শেষ চিঠিটা হাতে নিয়ে সে প্রতিবারের মত আবার পড়ল—”তুমি কি জানো, অভীক, পাহাড়ে যখন কুয়াশা নামে, আমি তোমার হাতের লেখা অনুভব করি আমার আঙুলে…” — একটার পর একটা শব্দ যেন কবিতার মত জড়িয়ে থাকত। কিন্তু সেই অনুভূতির ফাঁকে এক অলৌকিক শূন্যতা—আজ নয় মাস হতে চলল, কোনো চিঠি আসেনি। প্রথমে অভীক ভাবত হয়তো পরীক্ষার চাপ, পরে নিজেই লিখে ফেলেছিল একটানা তিনটি চিঠি। উত্তর আসেনি একটারও। বারবার ডাকঘর গিয়েছে, নিজের ঠিকানার সামনে চেয়ে থেকেছে, কিন্তু যেন শিলিগুড়ির সেই পাহাড়ি ঘরটা অদৃশ্য হয়ে গেছে। বন্ধুদের মুখে হাসি থাকলেও অভীকের মনে শুধু একটাই প্রশ্ন ঘুরত—কোথায় হারিয়ে গেল সেই কাগজে লেখা ভালোবাসা?
শিলিগুড়ি, সেই ভোরবেলার কুয়াশা ভেদ করে এখন অনেকটাই বদলে গেছে। সায়ন্তিকা এখন কলেজের শেষ বর্ষে, চোখে তীব্র এক লক্ষ্য, বড় হওয়ার, নিজের পরিচয়ে দাঁড়াবার। কিন্তু তার ভেতরে যে অনুভবের জগৎ, সেটা আর কেউ জানে না। নতুন শহরের ব্যস্ততা, জীবনের গতির দমক, এবং পরিবারে একটার পর একটা চাপ—সব মিলিয়ে জীবন যেন একটা অচেনা নদীর মত বয়ে যাচ্ছে। গত কয়েক মাসে অনেক কিছু বদলে গেছে, সায়ন্তিকার মা অসুস্থ, এবং তার বাবার বদলি হয়েছে দূরে এক সরকারি হিমঘরে। সেই পরিবর্তনের ধাক্কায় চিঠি লেখার রুটিনটাই ছিঁড়ে গেছে—আর তার সঙ্গে ভেঙে গেছে এক অন্তরঙ্গ সংযোগের সেতু। কিন্তু প্রতিরাতে, যখন সে জানালার কাছে দাঁড়ায়, পাহাড়ের গায়ে কুয়াশা জমে তখনও, তার মনে হয়—অভীক কি অপেক্ষা করছে এখনও? এমন কত রাত, যখন সে একটা চিঠি লিখে শেষমেশ ছিঁড়ে ফেলেছে, আবার লিখে পুরোনো বাক্সে রেখে দিয়েছে—প্রেরকের জায়গায় শুধু লিখেছে “অপরাধিনী”। এক অদ্ভুত অপরাধবোধ, এক অসম্পূর্ণ ভালোবাসার ভার যেন বয়ে বেড়াচ্ছে সে।
অভীক এদিকে একদিন সাহস করে পৌঁছে যায় কলেজ স্ট্রিটের পুরনো সেই বইয়ের দোকানে, যেখানে সে প্রথম সায়ন্তিকার ঠিকানাটা পেয়েছিল এক সাহিত্য ম্যাগাজিনে ছাপা তার কবিতা পড়ে। সেখানে আর সেই ম্যাগাজিন নেই, সেই পত্রিকার দপ্তরও বন্ধ। তখন সে একদিন একটি সাহসী সিদ্ধান্ত নেয়—যদি আর একবার দেখা না হয়, তাহলে অন্তত তাকে সে খুঁজে বার করবেই। এর জন্য সে শিলিগুড়ির ঠিকানাটা নিয়ে কলকাতা থেকে রওনা দেয় এক সকালে, বুকভরা আশা আর হাতে তার সবশেষ চিঠিটা। ট্রেনের জানালা দিয়ে ঝলসে যাওয়া সূর্যটা অভীকের মুখে পড়ে—সেই আলোয় তার চোখে এক অদ্ভুত মায়া। হয়তো দেখা হবে, হয়তো আর কখনও নয়। কিন্তু সে জানে, শব্দেরা যখন প্রেমের কাছে আত্মসমর্পণ করে, তখন মিলনের ঠিকানা কেবল দেহ নয়—স্মৃতিও হয়ে ওঠে সাক্ষাৎ। সেই বিশ্বাস নিয়েই অভীক ট্রেনের জানালায় ভেসে থাকা পাহাড়ের দিকে চেয়ে রইল—যেন কুয়াশার আড়ালেই দাঁড়িয়ে আছে সায়ন্তিকা।
অধ্যায় ৭:
গভীর শরতের রাতে কলকাতার জানলা দিয়ে ঢুকেছিল কুয়াশার ছোঁয়া। হাওয়ার গায়ে যেন সেদিন রুদ্রপ্রিয়র কোনো কবিতা লেপ্টে ছিল—কোনো না বলা অনুভব, কোনো অশ্রুত স্বর। সেই রাতেই অনিকেত প্রথম অনুভব করল, শরতের মধ্যে যেটুকু পূর্ণিমা সে পায়, তা বোধহয় কেবল চিঠিতে। ফাল্গুনীর শেষ চিঠিটা এসেছে দশ দিন আগে। ঠিক তার আগে নিয়ম করে প্রতি সপ্তাহে একবার, কখনও কখনও দু’বার চিঠি আসত শিলিগুড়ি থেকে—নীল অক্ষরের মধ্যে লুকানো মেঘলা পাহাড়, স্কুলের বারান্দা, আর চুপিসারে বলা একটা ভালোবাসার গান। কিন্তু এবার অদ্ভুত নীরবতা। ডাকপিয়নের সাইকেল থামছে না। পাড়ার মোড়ের সেই দোতলার রেলিংয়ে বসে অনিকেত অপেক্ষা করে, কিন্তু জানে না ঠিক কীসের জন্যে। কলকাতা শহরের ব্যস্ততার ভেতরেও সে যেন শুনতে পায়—একটা দূরের পাহাড়ের নিঃশব্দ আহ্বান, যার উৎস তার পরিচিত প্রেমিকায় নয়, বরং তার অচেনা একাকিত্বে।
ফাল্গুনীর চিঠিগুলো এখনো সে যত্ন করে রেখে দেয় কাঠের পুরনো বাক্সে, যেখানে কাঁচা কাগজের গন্ধ আর সেই পেনের রঙ মিশে গেছে কবিতার মতো। সে মাঝে মাঝে সেই চিঠিগুলোর কিছু লাইন মুখস্থ বলে ফেলে, যেন নিজের তৈরি করা কোনো কবিতার অংশ। “তুমি জানো, অনিকেত, পাহাড়ের রাতগুলোতে তুমি আমার চায়ের কাপের পাশে বসে থাকো”—এই একটি লাইনই বারবার ফিরে আসে তার মনে। সে বোঝে, এই প্রেম কেবল শরীরে গড়া নয়; এই প্রেম একান্তভাবে গড়ে উঠেছে শব্দে, কল্পনায়, আর অলৌকিক প্রত্যাশায়। তা সত্ত্বেও মানুষ তো শরীরী। হঠাৎ চিঠি আসা বন্ধ হয়ে গেলে হৃদয় চুপসে যায়। প্রথম তিনদিন অনিকেত ভাবল হয়তো ফাল্গুনীর স্কুলে পরীক্ষার ব্যস্ততা। তারপর পাঁচদিন, সাতদিন, দশদিন—প্রতিদিন অপেক্ষা ভেঙে গড়িয়ে যায় উৎকণ্ঠায়। মন বারবার প্রশ্ন করে—কি হয়েছে? কেন এমন হল?
চিঠি না পেয়ে প্রথমবারের মতো অনিকেত কলম তুলে চিঠি লিখল ফাল্গুনীকে। এতদিন ধরে সে শুধু উত্তর দিয়েছিল, এবার প্রথম লিখল—”ফাল্গুনী, তুমি ঠিক আছ তো? কেমন আছ? যদি অসুখে পড়ো, তাহলে শুধু একটা লাইন লিখে পাঠিয়ে দিও—’ভালো নেই’ বললেই আমি বুঝে নেব।” চিঠিটা পোস্ট করার পর দিনরাত পেরোয়, ঋতু বদলায়, কুয়াশা গাঢ় হয়, কিন্তু কোনো সাড়া আসে না। মাঝে মাঝে সে ভাবে, হয়তো ভুল ঠিকানায় গেছে। হয়তো কেউ সেই চিঠিগুলো চুরি করেছে। অথবা, হয়তো ফাল্গুনী নিজেই আর লিখতে চায় না। কিন্তু না, তার মন কিছুতেই মানে না। এই প্রেম যে শুধুই একতরফা নয়, তার প্রতিটি অক্ষরেই ছিল একে অপরের অস্তিত্ব। এ কি তবে কোনো ভয়ংকর ঘটনার পূর্বাভাস? নাকি এ এক নীরব অন্তর্ধান—যেখানে প্রেম হারিয়ে যায়, রেখে যায় শুধু শরতের নিস্তব্ধ আকাশ?
অধ্যায় ৮:
শরতের দিনগুলো আবার ফিরে এসেছে। শহরের গাছে গাছে সোনালি পাতা, আকাশের নীলেমায় যেন ঝরে পড়ছে চুপিচুপি কোনো দীর্ঘশ্বাস। অরিত্র নিজের ঘরের জানালার ধারে বসে থাকে অনেকটা সময়, চা ঠান্ডা হয়ে যায়, কলমের কালি শুকিয়ে যায় খোলা খাতায়। চিঠি আসে না। অনেক দিন হলো মেঘলা কিছু লেখেনি। প্রথমে ভাবছিল, হয়তো পরীক্ষার ব্যস্ততা, হয়তো পারিবারিক সমস্যা, কিংবা হয়তো সে অসুস্থ। কিন্তু চিঠি না আসার এই দীর্ঘ সময়—তাতে আজ অরিত্রর মন বলে ওঠে, “না, এ কেবল ব্যস্ততা নয়। কিছু হয়েছে।”
সে প্রতিদিন সন্ধে নামলেই নীলচে খামের আশায় ডাকবাক্স খোলে। বাড়ির কেউ এখন আর কিছু বলে না, যেন সবাই অভ্যস্ত হয়ে গেছে ওর চুপচাপ হয়ে যাওয়া, এক অদৃশ্য চিঠির অপেক্ষায় সময় কাটানোয়। কিন্তু অরিত্র জানে, প্রতীক্ষা কেবল কোনো কিছুর নয়—এ প্রতীক্ষা এক অনুভবের, এক অস্তিত্বের, যার প্রমাণ মেলে শব্দে, বাক্যে, সেই অনবদ্য হাতের লেখায়। শহরের এই বুকভরা নিঃশ্বাস, বিকেলের বাতাসে উড়ে আসা শিউলির গন্ধ, শীতের কুয়াশায় ঢাকা রাস্তাগুলি—সব যেন ওকে মনে করিয়ে দেয়, মেঘলার চিঠির প্রতি চুমু খাওয়া দিনের কথা।
শিলিগুড়ির সেই চিঠির উৎস, সেই কল্পনার মানুষটি এখন যেন এক রুপকথার চরিত্র। মাঝে মাঝে অরিত্র ভাবে, সব কি তবে এক কবিতার মতো? একটা সুন্দর দুঃস্বপ্ন? এক অদ্ভুতভাবে বোনা বন্ধনের গল্প, যা কখনও শুরু হয় না ঠিকঠাক, আর শেষও হয় না কখনো? অরিত্র চিঠির বাক্সে নতুন কাগজ রাখে, নিজেই লিখে ফের বন্ধ করে রাখে। কখনো লেখে—”তুমি কি আছো?” কখনো—”শেষ চিঠিটা ছিল কবে?” আবার কোনোদিন শুধুই একটি কবিতা, হয়তো নিজের, হয়তো নজরুল বা জীবনানন্দের। শিলিগুড়ির কোনো এক পাহাড়ঘেরা শহরে সেই চিঠিগুলো পৌঁছয় কি না, তা অরিত্র জানে না। কিন্তু সে থামে না। প্রতিদিনই কিছু না কিছু লেখে, যেন শব্দের জোরে সে আবার তৈরি করতে পারে সেই হারানো সেতু—যেখানে কেবল প্রেম নয়, ছিল ছুঁয়ে ফেলার অলিখিত আকাঙ্ক্ষা।
অধ্যায় ৯:
শরতের শেষভাগে হাওয়াতে এক রকম নিস্তব্ধতা আসে। পাখির ডাকও যেন ম্লান হয়ে যায়, পাতার ঝরাও একেবারে নিঃশব্দে ঘটে। কলকাতার এক কোণে, অরিত্রর জীবনে যেন সেই নিস্তব্ধতাই ছড়িয়ে পড়েছে চিরস্থায়ীভাবে।
চিঠি আর আসে না। প্রতীক্ষার ছায়া এতদিনে ধূসর হয়ে গেছে, আর এখন তা পরিণত হয়েছে নিরব দর্শনে। একদিন সকালের দিকে সে হঠাৎ সিদ্ধান্ত নেয়—আজ সে আর লিখবে না। আজ থেকে চিঠি বন্ধ। অপেক্ষাও নয়।
অরিত্র বেরিয়ে পড়ে; একা, হাতে কোনো খাতা নেই, পকেটে কোনো কবিতা নয়, শুধু বুকের ভেতর কেমন যেন এক শূন্যতা নিয়ে সে হাঁটে। বইয়ের দোকান, কফির দোকান, এমনকি সেই ডাকঘর—যেখানে একসময় তার সবচেয়ে বড় ভালোবাসার রাস্তাটা খোলে মনে হতো—সব যেন আজ নিষ্প্রাণ।
সন্ধ্যেবেলা সে সেই পুরনো শ্যামল কাঠের ডেস্কে বসে, চুপচাপ জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকে। আচমকা ঘরের নীরবতা ভেঙে, মা এসে বলে, “একটা চিঠি এসেছে, শিলিগুড়ি থেকে।”
অরিত্রর বুকটা ধক করে ওঠে। হাত কাঁপে। চোখের সামনে অন্ধকারে ভাসে সোনালি খামের রঙ। তবুও ধীরে ধীরে খামটা খোলে। পরিচিত হাতের লেখা।
চিঠির কিছুটা অংশ—
“অরিত্র,
চিঠি লেখার সাহস হচ্ছিল না। জানি, তুমি অপেক্ষা করছিলে। জানি, আমার হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যাওয়াটা তোমায় কষ্ট দিয়েছে। আমার বাবার হঠাৎ অসুস্থতা, তারপর মৃত্যুর ধাক্কায় নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলাম। তোমায় লিখতে পারিনি, শুধু চুপ করে গেছি। ভুল ছিল জানি, কিন্তু সেই ভুলে তুমি যদি পুরোটা ভালোবাসা মুছে দাও, তাহলে আমি আর কখনো তোমায় পাব না। জানি না, তুমি এখনো চিঠির পথেই হেঁটে আছো কিনা, কিন্তু জানিয়ে রাখি, আমি সেই পুরোনো ঠিকানায়ই আছি—প্রেমে, অপেক্ষায়।”
চিঠির শেষ লাইনে লেখা—
“ভালো থেকো। তবে যদি কখনো আবার লিখতে চাও, আমি আছি। চিঠির ওপারে দাঁড়িয়ে।”
অরিত্রর চোখ জলে ভিজে যায়। তার মনে হয়, ভালোবাসা কখনোই একমুখো নয়—সে শুধু সময়ের ওপারে গিয়ে দাঁড়ায় মাঝে মাঝে। আবার ফিরে আসে, শরতের শেষ হাওয়ার সঙ্গে, শেষ চিঠির দিনে।
সে জানে, এই চিঠিটাই ‘শেষ’ নয়—এটা নতুন এক ‘শুরুর’ ঠিকানা। কাল সে আবার লিখবে। পাতায়, শব্দে, ভালোবাসায়—একটি নতুন চিঠি, নতুন গল্পের জন্য।
অধ্যায় ১০:
সেই সকালে, কলকাতার নীলচে আকাশের নিচে দীপ্ত বসে ছিল তার প্রিয় জানালার ধারে। জানালার ওপার থেকে ছড়িয়ে পড়া আলোতে আজকের কাগজের খাম ঠিকরে উঠেছিল, যেন এক অচেনা শীতের সকাল নিজের আলোয় তাকে কিছু বলার চেষ্টা করছিল। এক সপ্তাহ হয়ে গেল—না কোনো চিঠি, না কোনো শব্দ, না কোনো বাতাসেও তার নাম। সুরমা লিখত নিয়মিত, মাঝে মাঝে দিনে দু’বারও। কিন্তু এখন যেন সেই অদৃশ্য সেতুটা একবারেই ভেঙে পড়েছে। ছটফটে মন নিয়ে সে আবার সেই পুরোনো সব চিঠিগুলোর খাম খুলে বসেছিল—মেঘলা কালি, ধীরে লেখা তার নাম, নিখুঁত হস্তাক্ষর। শেষ চিঠির তারিখ—পূজোর আগে। এতদিন সুরমার কোনো খোঁজ না পেয়ে একপ্রকার হাল ছেড়েই দিয়েছিল সে।
অন্যদিকে, শিলিগুড়ির এক ধুলোমাখা বিকেলে সুরমা বসে ছিল তার হাসপাতালের বিছানায়। হ্যাঁ, দুর্ঘটনার পর তার হাতের কবজি চিরতরে আহত হয়েছিল, ডাক্তার বলেছিলেন—হাতের লেখা এখন আর সম্ভব নয়। সে কাঁপা কাঁপা হাতে শেষ চিঠিটা লিখেছিল, কিন্তু তারপর আর পারেনি। সেই অসমাপ্ত চিঠিটা পড়ে ছিল তার টেবিলের ড্রয়ারে, যেখানে দীপ্তর ঠিকানাটা কাঁপা হাতে লেখা। সে চেয়েছিল কাউকে দিয়ে পাঠাতে, কিন্তু নিজের হাতেই না গেলে কি হয় প্রেম? সুরমা প্রতিদিন ভাবত, দীপ্ত হয়তো ভুল বুঝেছে, হয়তো ভাবছে সুরমা দূরে সরে গেছে। এই দুরত্বটা কেবল চিঠির না, জীবনেরও হয়ে উঠেছে। সে জানত না, চিঠির অনুপস্থিতির মধ্যেই জন্ম নিচ্ছে এক প্রলম্বিত বিষাদ, যে বিষাদ থেকে জন্ম নেবে হয়তো কোনো নতুন কবিতা।
এদিকে দীপ্ত আর চিঠি না পেয়ে শেষমেশ নিজের লেখা কবিতাগুলোর একটা সংকলন বানিয়ে পাঠায় সুরমার ঠিকানায়, ভেতরে ছোট করে লিখে—“তুমি যদি আবার কখনও লেখো, আমি থাকব। আমি আজও অপেক্ষায় আছি, সেই শরতের পাতা উড়ে আসা চিঠিটার জন্য।” সেই খাম যখন পৌঁছায় সুরমার হাতে, সে ডান হাতে ছুঁয়ে দেখে—অপটু বাম হাতে খাম খুলে পড়ে কবিতার প্রতিটি পংক্তি। তার চোখ ভিজে যায়, আবার সেই পুরনো নদীর মতো। তখন সে জানত, চিঠি লিখে সে ফিরতে পারবে না, কিন্তু দীপ্তর কবিতার ভেতর সে আজীবন বেঁচে থাকবে। একটা নতুন জীবন, যেখানে দেখা হয়নি কখনও, তবুও হৃদয় একে অপরের সমস্ত ভাষা বুঝে গেছে—নীরবতাও প্রেমের ভাষা হতে পারে, আর একটি চিঠির অনুপস্থিতিও চিরকালীন ভালোবাসার সীমানা।
শেষ।