মৌপ্রিয়া ঘোষ
১
কলেজের সেমিনার লাইব্রেরি তখন অর্ধেক ফাঁকা, বিকেলের ঘোলাটে আলো জানালার কাঁচে ঠেকেছে। সবার চোখ বইয়ে, কিন্তু অনিন্দ্যের চোখ স্থির হয়ে গিয়েছিল ডানদিকের চতুর্থ সারিতে বসা মেয়েটির দিকে। মেয়েটি তার সামনে রাখা বইয়ে মুখ গুঁজে থাকলেও তার ঠোঁটে ভেসে উঠছিল এক অচেনা সুর—গলা নিচু, কিন্তু কানে লেগে থাকার মতো। “এই পথ যদি না শেষ হয়…”—এই গানের লাইনটাই তখন হাওয়ায় মিশছিল। অনিন্দ্য একটু অবাক হয়েছিল। এতখানি নিঃশব্দতার ভিতরেও এত স্পষ্টভাবে সুর বেজে উঠতে পারে? সে জানত না মেয়েটির নাম, জানত না তার বিষয়ে কিছুই, শুধু চোখের পলক ফেলে দেখতে শুরু করেছিল। মেয়েটির গায়ের শাড়ির রঙ ছিল ইটের মতো লাল, আর গলায় ঝুলছিল একটা পাতলা রুপোর চেইন। সে গানের লাইনটা থামিয়ে চোখ তুলতেই এক মুহূর্তের জন্য তাদের চোখে চোখ পড়ে যায়। সেই চাহনিতে না ছিল লজ্জা, না ছিল কিছু কৃত্রিমতা—ছিল এক ধরনের নিষ্পাপ স্পষ্টতা। অনিন্দ্যর বুকের ভিতর যেন কেঁপে ওঠে। যেন বহুদিন ধরে লেখা কোনো কবিতা আচমকা তার সামনে জীবন্ত হয়ে উঠল।
সেই দিনটা ছিল বৃহস্পতিবার, পরদিন রূপসাকে আবার দেখা গেল ক্যানটিনের এক কোণে বসে থাকতে। তার হাতে ছিল ছোট্ট একটা ডায়েরি আর একটা জলখাবার—সিঙ্গারা আর কফি। অনিন্দ্য ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে পাশে বসল। কিছু না বলে বসে পড়ার সাহসটা সে নিজের মধ্যেই খুঁজে পেয়েছিল আগের রাতের কবিতায়। রূপসা প্রথমে তাকিয়ে দেখে একটু চমকে ওঠে, তারপর হালকা হেসে বলে, “তুমি কবিতা লেখো?” অনিন্দ্য একটু হেসে মাথা নাড়ায়, “কীভাবে বুঝলে?” — “তোমার চোখে বোঝা যায়। আর যারা মন দিয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনে, তারা কিছু না কিছু লেখেই।” সেই সময়টা যেন অন্যরকম হয়ে উঠেছিল। তাদের মধ্যে কথা হচ্ছিল না শুধু গান বা কবিতা নিয়ে, বরং সেইসব অদৃশ্য অনুভব নিয়ে—যা অন্য কেউ বুঝবে না। অনিন্দ্য জানতে পারে মেয়েটির নাম রূপসা, ইতিহাস অনার্সের দ্বিতীয় বর্ষে। তার গলায় হালকা গাম্ভীর্য, অথচ সে যখন হাসে, হাসিটার মধ্যে লুকিয়ে থাকে একধরনের নির্ভার বিদ্রোহ। সেদিন অনিন্দ্য তাকে শোনায় নিজের লেখা একটা ছোট কবিতা—“চাঁদের আলোয় শরীরের ছায়া / তুমি ধরো না, আমি তবু কাঁপে যাই…”। রূপসা চুপ করে শুনে যায়, চোখে একটা অস্পষ্ট আলো ফুটে ওঠে। তার চোখে যেন অনেক অজানা প্রশ্ন আর অর্ধেক বলা কথা ভাসছিল।
পরদিন সন্ধ্যায় ছাদের ধারে আবার দেখা। শরতের শুরু, হালকা বাতাসে শুকনো পাতার খসখসানি আর দূরে কোনো পাড়ার পূজার প্রস্তুতির শব্দ ভেসে আসছে। রূপসা এবার একটা শাড়ি পরে এসেছিল—সাদা-লাল পাড়, চোখে কাঁচের কাজ করা কাজল। সে বসে বলে, “তুমি জানো, শরৎকাল আমার প্রিয় ঋতু। শরৎ মানেই অপেক্ষা, কিন্তু কিসের জন্য তা বোঝা যায় না। হয়তো সেই অপেক্ষা কখনো কাউকে ছুঁয়ে ফেলার।” অনিন্দ্য বুঝতে পারে, এই মেয়েটির মধ্যে রয়েছে এক অসম্পূর্ণ কবিতা—যেটা নিজেকে শরীরের ভাষায় সম্পূর্ণ করতে চায়। সে পাশে বসে ধীরে ধীরে কথা বলতে থাকে, জিজ্ঞেস করে, “তুমি কি শুধু মন দিয়ে প্রেমে বিশ্বাস করো, নাকি শরীরও তার অংশ?” রূপসা একটু থেমে বলে, “প্রেম যদি সত্যি হয়, তাহলে শরীর তো তার ছায়া। কবিতার মতোই স্পর্শও প্রয়োজন, না হলে ভাষা অপূর্ণ থেকে যায়।” সেই মুহূর্তে ছাদের চারপাশে ছড়িয়ে থাকা চাঁদের আলো তাদের দেহে পড়ে এক অদ্ভুত আবরণ তৈরি করছিল। চোখে চোখ রাখা, ঠোঁটের কোণে হালকা কম্পন—এ যেন এক নীরব গান, যেখানে সুর ওঠে শুধু নিঃশ্বাসে। সেই দিন থেকেই তারা বুঝে গিয়েছিল—এই সম্পর্ক আর শুধু গানের সুর বা কবিতার কাগজে আটকে থাকবে না। শরৎ ধীরে ধীরে তাদের ভিতরে নিজের শরীরী ছোঁয়া মিশিয়ে দিচ্ছে।
২
কলেজের পাঠ চুকে যাওয়ার পর বিকেলটা যেন নিজের মত করে সাজিয়ে নিয়েছিল। উত্তর কলকাতার এক পুরনো বাড়ির তিনতলার টিনের ছাদ—যেখানে বিকেলের রোদ আর পুরোনো লোহার গ্রিল মিলে তৈরি করেছিল এক নির্জন উপাখ্যানের জায়গা। রূপসা সেদিন নিজেই অনিন্দ্যকে ডেকেছিল নিজের পাড়ার ছাদে, বলেছিল, “আজ তোমার কবিতা শোনাবি?” অনিন্দ্য যেন ভেতরে ভেতরে অপেক্ষা করছিল এই ডাকটার জন্যই। সে হাতে করে ছোট একটা চটি খাতা নিয়ে আসে—ময়লা হলুদ রঙের, কিনে আনা এক সময়ের স্টেশনারি দোকান থেকে, যার পাতাগুলোর মাঝেই লুকিয়ে ছিল বহু নির্জন মুহূর্তে লেখা লাইন। ছাদে বসেই তারা মুখোমুখি হয়ে বসে, চারপাশে টিনের দেয়াল, উপরে কাকদের আনাগোনা, দূরের গলিতে ট্রাম চলার শব্দ। রূপসা তার ওড়নাটা হালকা গুছিয়ে নিয়ে বলে, “এবার পড়ো।” অনিন্দ্যর কণ্ঠে ধরা পড়ে হালকা কম্পন, সেই কম্পনে মিশে থাকে এক অচেনা আকুলতা। কবিতার নাম ছিল “স্পর্শ যদি কবিতা হতো”। সে পড়তে শুরু করে—“যখন তোমার চোখে ধরা পড়ে নিজেকে হারানোর ভয়, আমি স্পর্শে লিখি সাহসের ভাষা / যখন চাঁদের আলোয় তোমার চুলে খেলে যায় বাতাস, আমি কবিতার মতো ধরি সে মুহূর্ত।” প্রতিটি শব্দ যেন ধীরে ধীরে ছুঁয়ে যায় রূপসার শরীর, তার বাহু, তার চোখের পাতা। সে চুপ করে শোনে, অনিন্দ্যের দিকে তাকিয়ে থাকে। সেই মুহূর্তে দু’জনের মাঝখানে আর কোনো সময়, কোনো নিয়ম, কোনো নাম ছিল না—ছিল শুধু এক অলিখিত সম্মতি।
অনিন্দ্য কবিতা শেষ করে তাকায় রূপসার দিকে। সে দেখে মেয়েটির চোখে এক অদ্ভুত ধরণের শান্তি, যেটা সে আগে কখনো দেখেনি। রূপসা ধীরে বলে, “এই কবিতাগুলো তো শুধু শব্দ না… এগুলো তো আমার শরীরের চারপাশে জড়ানো কিছু আলগা স্পর্শের মতো। জানো, আজকাল মনে হয়, শরীর একটা কাব্য হতে পারে যদি তাকেই লেখা যায় সঠিক সুরে।” অনিন্দ্য চুপ করে থাকে। সে বুঝতে পারে, যে সম্পর্কের শুরু হয়েছিল গানে, সেটা এখন ধীরে ধীরে শরীরের দিকে এগিয়ে চলেছে, কিন্তু সেটা কোনো তাড়াহুড়োর মধ্যে নয়, কোনো লুকিয়ে রাখা কামনার ছলে নয়—বরং এক গভীর সম্মতিতে, যেখানে চোখে চোখ রেখে দু’জন মেনে নেয় নিজেদের দুর্বলতা, আকাঙ্ক্ষা আর সাহস। সেই সন্ধ্যায় ছাদের হাওয়ায় অনিন্দ্য আর রূপসার মাঝখানে দূরত্বের ভাষা ছিল না—তারা হাত ধরেনি, ঠোঁট ছুঁয়ে দেয়নি, কিন্তু তাদের নিঃশ্বাস একে অপরের গায়ের উপর চেপে ছিল নিঃশব্দ কবিতার মত। রূপসা বলে, “তুমি কি জানো, আমাদের চারপাশের দেওয়ালগুলো যতই পুরনো হোক, শরীরের ভিতরে একটা চিরনতুন কবিতা প্রতিদিন জন্ম নেয়?” অনিন্দ্য তখন কেবল মাথা নাড়ে, কারণ তার ভাষা তখন শরীর ছেড়ে কবিতার পাতায় রয়ে গেছে।
ফিরে যাওয়ার সময় রূপসা নিচু গলায় বলে, “তুমি আমাকে ছুঁয়ো না আজ। কিন্তু তুমি ফিরে গিয়ে আজ রাতে লিখে রেখো—যে স্পর্শ তুমি দাওনি, সেটাই কীভাবে আমার শরীরের ভাষা হয়ে উঠেছে।” সেই কথা শুনে অনিন্দ্য স্তব্ধ হয়ে যায়। তার মনে হয়, সে যেন কোনো এক মায়াবী জগতে প্রবেশ করছে, যেখানে প্রেম মানে শুধু চুম্বন নয়, শুধু শরীরি তৃষ্ণা নয়—বরং প্রতীক্ষার সৌন্দর্য, সম্মতির ভাষা, আর নিঃশব্দ কবিতার এক ধ্রুপদী গঠন। সে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাওয়ার সময় পেছনে একবার তাকায়—রূপসা ছাদের রেলিংয়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে, চোখে এক অমোঘ আবেদন। চাঁদ তখনো উঠেনি, আকাশের ধারে রক্তবর্ণ। কিন্তু সেই সন্ধ্যা, সেই টিনের ছাদ আর সেই কবিতার পাতাগুলো, যেন একসঙ্গে বলে যাচ্ছিল—শরতের রাতগুলো আর কেবল শিউলি ফোটা সময় নয়, তারা এক স্পর্শের অনন্ত অপেক্ষা।
৩
সেদিন আকাশে পাতলা মেঘ, বাতাসে এক ধরনের নিরবতা—যেটা শরৎকালের নয়, বরং কারো ব্যক্তিগত অস্থিরতার ছাপ রেখে যায়। অনিন্দ্য কলেজ শেষে মেসে ফিরতে না ফিরতেই ফোনে একটি হোয়াটসঅ্যাপ বার্তা আসে—রূপসা লিখেছে, “আজ বিকেলে আসবে আমার বাড়ি? কিছু দেখাবো। মা নেই, একা আছি।” বার্তার ভাষায় কোনো অতিরিক্ত কিছু ছিল না, কিন্তু সেই “একাকিত্ব” শব্দটা অনিন্দ্যর হৃদয়ে অদ্ভুতভাবে নাড়া দেয়। সেদিন সে নিজের শার্টটা একটু ভালো করে পরে, সামান্য আতর মেখে রিকশা ধরে রূপসার বাড়ির দিকে রওনা দেয়। রাস্তার দুই ধারে কাশফুল মাথা নেড়ে চলেছে, যেমন করে কেউ দূর থেকে বলে—“সব ঠিক আছে, শুধু এগিয়ে যাও।” রূপসার পাড়ার মোড়ে নামতেই সে দেখে জানালার পাশ দিয়ে লাল পর্দা সরে গিয়ে এক জোড়া চোখ তাকিয়ে আছে। উপরে উঠে দরজায় কল দিতেই রূপসা দরজা খুলে দাঁড়িয়ে—আজ তার পরনে একসাদা কুর্তা আর হালকা নীল পায়জামা, কপালে ছোট্ট সাদা টিপ। ঘরে ঢুকেই অনিন্দ্য টের পায়, ঘরটা অন্যরকম—শব্দহীন, যেন কোনো এক স্থির জলের মত ঘন অনুভূতির মধ্য দিয়ে তৈরি।
ঘরের দেওয়ালে ঝুলছে মাটির প্রদীপ, জানালার পাশে রূপসার ছোট মিউজিক সিস্টেম, যেখানে তখন বাজছিল “বলো না বলো না…”—গানের সেই চেনা সুর যেন ঘরের প্রতিটি কোণায় মিশে গেছে। রূপসা অনিন্দ্যকে বসতে বলে নিজের পড়ার টেবিলের সামনে রাখা দুটি চায়ের কাপ নিয়ে আসে—একটায় দার্জিলিং, একটায় আদা-চা। অনিন্দ্য মৃদু হাসে, বলে, “তুমি জানো না আমি কোনটা খাই, তাই দুটো এনে দিলে?” রূপসা তাকিয়ে হেসে বলে, “না, আমি জানি… তুমি দার্জিলিংই পছন্দ করো। কিন্তু আজ আমারটা খাবে।” অনিন্দ্য কিছু না বলে তার কাপটা নেয়। জানালার বাইরে চাঁদের আলো তখনো পূর্ণ নয়, কিন্তু ঘরের মধ্যে আলো-ছায়া খেলে যাচ্ছে বাতাসে নড়ে ওঠা পর্দার ফাঁকে। রূপসা ধীরে এসে তার পাশে বসে, বলে, “তুমি কী ভেবেছিলে? ডাকলাম শুধু গান শোনাতে?” অনিন্দ্য একটু থমকে যায়। চোখে চোখ রাখতেই সে দেখে, রূপসার চোখে কোনো দ্বিধা নেই—তাতে আছে আত্মবিশ্বাস আর কবিতার মতো সরল আহ্বান। সে আলতো করে অনিন্দ্যের হাত ছুঁয়ে বলে, “তুমি তো আমাকে কবিতার ভাষায় ভালোবাসো, আজ যদি শরীরের ভাষায় কিছু বলতে চাই—তবে কি তুমি শুনবে না?” অনিন্দ্যর হৃদস্পন্দন যেন আচমকা বেড়ে যায়, শরীরে এক ধরনের শীতল উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু সে চুপ করে থাকে, কারণ সে জানে—এই মুহূর্তে শব্দ নয়, সম্মতি প্রয়োজন।
রূপসা ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে তার পড়ার টেবিল থেকে একটা সাদা খাতা এনে দেয়। খাতার প্রথম পাতায় লেখা ছিল:
“তুমি যদি চাঁদের আলো হও
আমি হতে চাই সেই জানালার গ্লাস—
যার গায়ে তোমার স্নিগ্ধতা পড়ে
আর ধীরে ধীরে গলে যায় সন্ধ্যা।”
অনিন্দ্য কবিতাটি পড়ে চোখ তুলতেই দেখে, রূপসা একেবারে কাছে এসে দাঁড়িয়ে। তার কাঁধে পড়ে থাকা ওড়নাটা হালকা সরে গেছে, কাঁধের হাড়ে হালকা আলো। সে কিছু বলে না, শুধু চোখের ইঙ্গিতে জানায়—এটাই তার কবিতা, এটাই তার সম্মতি। অনিন্দ্য ধীরে হাত বাড়ায়, কিন্তু ছোঁয় না। সে জানে, এই ছোঁয়া কোনো চটজলদি আকর্ষণ নয়, এটা এক দীর্ঘ প্রতীক্ষার ছায়ায় গড়ে ওঠা স্পর্শ। রূপসা আবার তার হাত ধরে বলে, “তুমি কবিতা লেখো ঠিকই, কিন্তু এবার যদি শরীরকেও এক লাইন করে লেখো, আমি কিছু মনে করব না।” তখন অনিন্দ্য তার কপালের কাছে মুখ নিয়ে যায়, খুব আস্তে, যেন শব্দ ছাড়াই কোনো চরণ উচ্চারিত হচ্ছে। রূপসা চোখ বন্ধ করে নেয়, চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। তারা তখনো চুম্বন করেনি, শুয়ে পড়েনি, কোনো শরীরী অতিরিক্ততা আসেনি—তবে তাদের ভেতরকার অপেক্ষা আর ভাষার মধ্যে ছুঁয়ে ফেলেছিল সেই রাতের শুরুর রেখা। সেই বিকেল, সেই ঘর, সেই কবিতার পাতা যেন রূপসার শরীরে লেখা এক অনুচ্চারিত কবিতা হয়ে গেল—যার ছত্রে ছত্রে ছিল চাঁদের আলো, ঘরের নিঃশব্দতা, আর অনিন্দ্যর স্পর্শহীন স্পর্শ।
৪
সেদিন ছিল আশ্বিন মাসের একটা মাঝবেলা—যে সময়টা কলকাতার বাতাসে পুজোর গন্ধ ঘুরতে শুরু করে। আকাশে ছিল হালকা মেঘের চাদর, মাঝে মাঝে সূর্য চোখ লুকিয়ে খেলছিল দোলচালে। অনিন্দ্য ক্লাস শেষে বেরিয়ে এসেই মেসে ফেরার বদলে চলে গেল কলেজের উল্টোদিকে পুবদিকের বটতলায়। ও জানত রূপসা আসবে, কারণ সে আগের রাতে বলেছিল—“কাল একটু হেঁটে যাবি? শরতের রোদে গায়ে গায়ে লাগবে এক টুকরো কবিতা।” সত্যিই তাই হল। রূপসা এল, সেদিন তার পরনে ছিল একটা অফ-হোয়াইট সালোয়ার-কামিজ, গলায় বাদামি গামছার মত পাতলা ওড়না, আর কপালে ছোট্ট লাল টিপ। অনিন্দ্যর চোখ সে টিপেই আটকে গেল প্রথম। টিপটা যেন অকারণে উজ্জ্বল, যেন তাকে নির্দেশ করছিল—সেই জায়গাটাকেই দেখতে, যেখান থেকে স্পর্শের ভাষা শুরু হতে পারে। রূপসা এসে বসল পাশে, তার চোখে সেদিন এক অন্য ধরণের নীরবতা। সে হালকা করে বলল, “আজ হাওয়াটা কেমন বলতো? মনে হচ্ছে শরীরের ভেতর দিয়েও বইছে।” অনিন্দ্য মাথা নেড়ে হাসে, কিন্তু তার হাসির মধ্যে একটা ধরা পড়ে যাওয়া অভিব্যক্তি ছিল। ও অনুভব করছিল, আজকের দিনটা অন্যরকম। আজ শরৎ আর শুধুই মৌসুম না—আজ সে তাদের মধ্যে এক আশ্চর্য নির্লজ্জ রোমান্স বুনে ফেলছে।
ওরা হাঁটতে শুরু করল কলেজের পাশের গলিটা ধরে, যেখানে দুই পাশে পুরোনো বাড়ির ছায়া, রোদ এসে পড়ে দেয়ালে ছোপ ছোপ। মাঝে মাঝে বাতাসে রূপসার চুল উড়ছিল অনিন্দ্যর মুখের দিকে, আর সে নিজের অজান্তেই হাত বাড়িয়ে চুল সরিয়ে দিচ্ছিল। প্রথমবার—তারা হাত ধরল না ঠিকই, কিন্তু আঙুলের ছোঁয়া আঙুলে এসে ঠেকছিল। কথাগুলো সেদিন আর পংক্তিতে ছিল না, তারা হয়ে উঠেছিল নিঃশব্দ গদ্য—তবুও কাব্যিক। একসময় রূপসা হঠাৎ থেমে দাঁড়িয়ে বলে, “তুই কখনো আমার টিপের কথা ভাবিস?” অনিন্দ্য একটু চমকে গিয়ে তাকায়, মাথা নাড়ে। রূপসা হেসে বলে, “এই লাল টিপটা আমি পরি শুধুই নিজের জন্য। কিন্তু আজ জানি, তোর চোখে পড়বে বলেই পরেছি।” অনিন্দ্য তখন আস্তে করে বলে, “এই টিপটা তোর কপালে যতটা নয়, আমার হৃদয়ের মধ্যে অনেক বেশি উজ্জ্বল।” সেই কথার মধ্যে যে সত্য ছিল, তা রূপসা বুঝতে পারে চোখ দেখে। তার চোখে জল জমে আসে না, কিন্তু একটি তীব্র অনুরণন জেগে ওঠে—যা তাকে ঠেলে দেয় সাহসের দিকে। সে অনিন্দ্যের দিকে এগিয়ে এসে বলে, “তুই কি কখনো আমার কপালটা ছুঁয়ে দেখতে চাস না?” এই প্রশ্নটা যেন বাতাসের মধ্যে খোলা হয়ে থাকে, আর অনিন্দ্য কিছু না বলেই হাত বাড়িয়ে আঙুল রাখে সেই টিপের ঠিক নিচে। গালের কোণে, কপালের পাশটায়।
সেই মুহূর্তে সময় যেন স্থির হয়ে গেল। চারপাশে গাড়ির হর্ণ, রাস্তার কোলাহল, দোকানদারদের হাঁক—সব একসাথে নিঃশব্দ হয়ে গেল। রূপসা চোখ বন্ধ করে নেয়, আর অনিন্দ্যর আঙুল তার কপালের পাশ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে কানের পাশে। শরীরের কোনো স্পর্শ তখনো হয়নি—কিন্তু যে ভাষায় তারা একে অপরকে ছুঁয়েছিল, তা শরীরের চেয়েও গভীর। হাওয়ার ভিতর এক অলিখিত কবিতা বইছিল—তাদের শ্বাসে, চোখে, আঙুলে। রূপসা ধীরে বলে, “তুই যখন স্পর্শ করিস না, তখনও আমি জানি তুই কীভাবে আমাকে লিখতে থাকিস নিজের চাওয়ায়।” অনিন্দ্য মাথা নিচু করে, তার ঠোঁটে সামান্য কম্পন। সে শুধু বলে, “আমি ভয় পাই… যদি কখনো তোমাকে ছুঁয়ে ফেলি ভুল ভাষায়।” রূপসা এবার এক পা এগিয়ে বলে, “ভুল ভাষা নেই। যদি ভালোবাসা থাকে, তবে সব ভাষাই কবিতা।” সেই বিকেলটা তাদের মধ্যে এক নতুন আত্মবিশ্বাস জন্ম দেয়। সেদিন তারা জানে যায়—প্রেমের সঙ্গে শরীর আসবেই, কিন্তু সেটা কখনই আকস্মিক নয়। সেটা আসে অপেক্ষার কবিতায়, সম্মতির গদ্যে, আর এক চুম্বনহীন স্পর্শের ছায়ায়। সেই দিন শেষ হতেই, রূপসা বলে, “পরশু পূর্ণিমা… চাঁদ উঠবে আমাদের ছাদের ঠিক সামনে। আসবি?” অনিন্দ্যর চোখে তখন চাঁদের ছায়া—সে মাথা নেড়ে বলে, “আমি আসব… পুরো চাঁদের আলো নিয়ে।”
৫
অন্ধকারে ঢেকে থাকা শরতের গভীরতা যেন ধীরে ধীরে ভেদ করে রূপসার চোখে ছায়ার মতো ভেসে উঠছিল অনিন্দ্য। সেই বিকেলে কলেজের ছাদে, ল্যাব ক্লাস শেষ হয়ে যাওয়ার পর, সবাই যখন নীচে নেমে গেছে, ওরা থেকে গিয়েছিল দু’জনেই। নীল আকাশের কোণে হালকা সাদা মেঘ, পাখির ঝাঁক আর অনেক দূরে পূর্ণিমার আলোয় উদ্ভাসিত হতে থাকা শহরের ছায়া—সব মিলিয়ে একটা অলৌকিক অনুভূতি তৈরি করছিল চারপাশে। অনিন্দ্য টিফিন বাক্সে রাখা ইলিশ ভাজা আর বাসি ভাত নিয়ে বসেছিল, রূপসা পাশেই ল্যাব কোট খুলে চুলটা বাঁধছিল হালকা এলোমেলোভাবে। ওদের মধ্যে কোনো কথা হচ্ছিল না, শুধু নিঃশব্দে ভেসে আসছিল পেছনের কোনো ক্লাসরুম থেকে একটি রবীন্দ্রসঙ্গীত— “চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙে যায়…”। সেই মুহূর্তে রূপসার চোখে যে আলোটা ফুটে উঠেছিল, সেটাই হয়তো অনিন্দ্যর সমস্ত দ্বিধা ভেঙে দেয়। ও উঠে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল ওর একদম সামনে, আর ধীরে ধীরে রূপসার কাঁধে হাত রেখে বলেছিল— “তুই জানিস তো, তোর চোখে চাঁদের আলো লুকিয়ে আছে?”
সেই স্পর্শে রূপসা প্রথমে একটু কেঁপে ওঠে, কিন্তু পালায় না। তার ঠোঁটে ফুটে ওঠে এক হালকা হাসি, আর অনিন্দ্যর দিকে তাকিয়ে বলে, “চাঁদের আলোয় কিন্তু ছায়াও থাকে অনিন্দ্য। তুই পারবি তো সেই ছায়া সহ্য করতে?” অনিন্দ্যর চোখে তখন আত্মবিশ্বাসের ঝলক। ও এক কদম এগিয়ে আসে, তাদের শরীরের ফাঁকটা ফুরিয়ে আসে, আর তখনই রূপসার শরীর অনিন্দ্যর গায়ে হেলান দেয়। ছাদের চারপাশটা নিস্তব্ধ, শুধু রূপসার নিঃশ্বাস অনিন্দ্যর গালে এসে লাগছে। সেই মুহূর্তে, কোনও কণ্ঠস্বর, কোনো ঘড়ির টিকটিকি, এমনকি বাতাসের শব্দ পর্যন্ত আর ছিল না ওদের পৃথিবীতে—শুধু ছিল এক ধরণের ধীর, ছন্দময় দোল যেন ওদের দুই হৃদয়ের মাঝখানে সেতুবন্ধন তৈরি করে দিচ্ছিল। রূপসার চুলের মধ্যে দিয়ে অনিন্দ্যর আঙুল চলে যাচ্ছিল, ওর গাল ছুঁয়ে ওর ঠোঁটে থেমে যাচ্ছিল। ওরা কারো কাছ থেকে শেখেনি, কোথাও পড়েনি—শুধু সময়ের আবেগে, শরতের গন্ধে, এবং পূর্ণিমার জাদুতে নিজে নিজেই সমস্ত অনুভব জেগে উঠছিল ওদের শরীরে।
রূপসার ঠোঁট প্রথমে একটু কাঁপে, তারপর ধীরে ধীরে অনিন্দ্যর ঠোঁটের ওপর রেখে দেয় ওর নিজেরটা। এই চুম্বনে কোনো তাড়াহুড়ো ছিল না, কোনো কিশোরসুলভ হালকা ভাব ছিল না—ছিল এক গভীর অনুভব, একদম অস্তিত্ব ছুঁয়ে যাওয়া অভিজ্ঞতা। সেই চুম্বন ভাঙতেই অনিন্দ্য বলেছিল, “তুই জানিস, এই মুহূর্তটা আমার কবিতার প্রথম পংক্তি হয়ে থাকবে?” রূপসা হেসে বলেছিল, “তাহলে দ্বিতীয় পংক্তিটা হবে কখন?” অনিন্দ্য চোখ বন্ধ করে বলেছিল, “যখন তোর শরীরের মধ্যে দিয়ে আমি তোর মনটা ছুঁতে পারব।” আর এই বলে ওর হাতটা ধীরে ধীরে রূপসার পিঠ ছুঁয়ে ওর কোমরে এসে থেমে যায়। এই মুহূর্তে শরতের শরীরী চাঁদটা যেন তাঁদের উপরে এক অদ্ভুত আশীর্বাদের মতো ঝুঁকে পড়েছিল। সেই ছাদে, এক শারীরিক আবেগের ভিতর দিয়েই ওদের প্রেম নতুন এক রূপ নিচ্ছিল—যেখানে শরীর শুধু শরীর ছিল না, বরং এক অন্তরঙ্গ কাব্য যা ওদের হৃদয়ের গোপন ভাষায় লেখা হচ্ছিল।
৬
রাত তখন নেমে এসেছে নিঃশব্দে, শহরের আলো-আঁধারি এক আকাশের গায়ে দোলা দিয়ে চলেছে পূর্ণিমার চাঁদ। অনিন্দ্য আর রূপসা বসেছিল সাউথ ক্যাম্পাসের নিরিবিলি একটি গাছতলায়, চারপাশে নিঃশব্দতার এক প্রশান্ত কোলাহল। কথার খাতায় ছেঁড়া ছেঁড়া পঙ্ক্তির মতো এসে বসছিল তাদের নিজস্ব উপলব্ধির কিছু মুহূর্ত। সেই রাতে রূপসা পরেছিল একটি হালকা নীল শাড়ি, আর অনিন্দ্যর গায়ে ছিল তার প্রিয় সাদা পাঞ্জাবি। এক সময় রূপসা বলল, “তুই কি জানিস, শরতের এই পূর্ণিমা চাঁদ দেখে আমার মনে হয় যেন পৃথিবীর সমস্ত প্রেম এক মুহূর্তে জমে গেছে এখানে।” অনিন্দ্য একটু হাসল, সেই হাসির মধ্যে ছিল এক মৃদু কবিতার সুর। তারা পাশাপাশি বসে রইল, দু’জনের দৃষ্টির মধ্যে ঢেউ খেলছিল নীরব কিছু কবিতা। হঠাৎ যেন এক নিঃশ্বাসে দূরত্ব মুছে গেল, আর রূপসার আঙুল ধরা পড়ে গেল অনিন্দ্যর হাতে।
সেই ধরা-ধরির মধ্যে ছিল এক নির্ভীক কোমলতা, যেন দুই মন গভীর আত্মবিশ্বাসে ভেসে যাচ্ছে আবেগের নদীতে। রূপসা মাথা রাখল অনিন্দ্যর কাঁধে, অনিন্দ্যর দৃষ্টিতে তখন কেবল রূপসার কপালের ঝুলে পড়া চুলের স্পন্দন। শীতল বাতাস আসছিল বোটানিক্যাল গার্ডেনের দিক থেকে, পাতার মৃদু কাঁপনে যেন প্রকৃতি সাক্ষী হচ্ছিল এই প্রেমের। অনিন্দ্য ধীরে ধীরে রূপসার হাতটা নিজের ঠোঁটে তুলল, সেই স্পর্শে ছিল অগাধ শ্রদ্ধা, কামনা, আর নিরবিচারে মিলিয়ে যাওয়ার গভীরতা। রূপসার চোখ তখন ধীরে ধীরে বুজে আসছিল, আর অনিন্দ্যর ঠোঁটে জমা হচ্ছিল অপ্রকাশিত কবিতার এক দীর্ঘ চুম্বন। তারা জানত, সেই রাতের জোছনা তাদের একেবারে নিজস্ব করে নিচ্ছে, তারা সেই চাঁদের আলোয় গলে যাচ্ছে ধীরে ধীরে, একে অপরের শরীরে, একে অপরের আবেগে।
আকাশে তখনো চাঁদ ফুটে ছিল, নিঃশব্দ, প্রশান্ত, কিন্তু তার আলোয় কেবল প্রেম নয়, এক অব্যক্ত শরীরী ভাষা খেলা করছিল তাদের চারপাশে। রূপসার কণ্ঠে উঠে এল এক চাপা শ্বাস, আর অনিন্দ্যর হাতে তখন রূপসার কোমরের নরম রেখা। তাদের শরীর যেন দুই খণ্ড নীলাভ ধোঁয়া হয়ে মিশে গেল সেই রাতের গভীরতায়, আর চারপাশে নেমে এলো এক ছন্দবদ্ধ নিস্তব্ধতা। তারা জানত, এই ভালোবাসা কেবল হৃদয়ের নয়, শরীরেরও, এই প্রেম কেবল চোখের নয়, স্পর্শেরও। সেই রাতের শেষে, তারা একে অপরের কোলে মাথা রেখে চুপচাপ বসে থাকল, শরতের সেই চাঁদ মাথার উপর থেকে নেমে এল যেন মাটির খুব কাছাকাছি। তাদের নিঃশ্বাসে, স্পর্শে, আর স্পন্দনে তখন কেবল একটাই শব্দ—ভালোবাসা।
৭
সন্ধ্যা নামতে নামতেই রূপসা ফিরে আসে ওদের প্রিয় সেই ছাদে, যেখানে একদিন অনিন্দ্য তাকে প্রথম বলেছিল, “তোমার চোখে আমি আমার লেখা কবিতার শেষ চরণটা খুঁজে পাই।” আজ তার ঠোঁটে নেই কোনো লিপস্টিক, চুল খোলা, চোখে গাঢ় কাজল। শরতের হিমেল বাতাসে ওর রেশমি চুল উড়ে এসে অনিন্দ্যর গাল ছুঁয়ে যায় বারবার, ঠিক যেমন ছুঁয়ে যায় ওদের প্রেমের অলিখিত সীমারেখা। ছাদের কোণার দিকের বেঞ্চিটায় বসে ওরা দু’জনে চুপচাপ। তাদের চারপাশে পূর্ণিমার আলো ছড়িয়ে পড়েছে, নীলাভ-রূপালি সেই জোছনার ভেতর রূপসা হঠাৎ বলে ওঠে, “অনিন্দ্য, কখনও কি মনে হয়—শরীর আসলে একটা ছায়া? চাঁদের আলো পড়লে সে ছায়া দীর্ঘ হয়, জ্যোৎস্নার মতই স্বচ্ছ, কিন্তু ঠিক ধরতে গেলেই ফসকে যায়?” অনিন্দ্য এক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকে রূপসার মুখের দিকে—সে জানে, আজ রূপসা শুধু ভালোবাসা চায় না, সে চায় ছুঁয়ে-দেওয়া, ছুঁয়ে-জানা, একান্ত, নির্ভার, নিঃশব্দ ভালোবাসা। এ এক নিবিড় ভাষাহীনতা, যেখানে কোনো শব্দ নয়, শুধু নিঃশ্বাসের ধাক্কা-ধাক্কি। তাদের ঠোঁট যখন মিশে যায়, চাঁদের আলো সরে আসে একটু পাশ কাটিয়ে, যেন শরতের আকাশ নিজেও জানে এই প্রেম অন্ধকারকে ভয় পায় না।
রাত গভীর হতে হতে অনিন্দ্য ও রূপসা শরতের সেই সাদা বিছানার মতো ছাদে শুয়ে পড়ে। ওপরের নীল আকাশ, তারাগুলো যেন লক্ষ-কোটি প্রশ্ন করে চলে: “এই ভালোবাসা কতটা সত্যি?” রূপসার আঙুল অনিন্দ্যর বুকের ওপর দিয়ে লেখে একেকটা অদৃশ্য শব্দ—“আমি”, “তুমি”, “আমরা”। অনিন্দ্য ধীরে ধীরে ওর পিঠে আঙুল বুলিয়ে দেয়, যেন কোনো কবিতার শেষ পঙক্তির খসড়া বানাচ্ছে। ঠোঁট থেকে গলা, গলা থেকে কাঁধ—সব জায়গা দিয়ে মিশে যেতে থাকে একে অপরের শরীরের ছায়া। কোনো তাড়াহুড়ো নেই, কোনো গোপন উত্তাপ নেই—শুধু শরতের ঠাণ্ডা হাওয়ার মধ্যে এক উষ্ণতা, যা শুধু গভীর ভালোবাসা থেকেই আসে। তারা একে অপরকে খুঁজে পায় না কোনো তৃষ্ণার মধ্যে, বরং এক নিঃসঙ্গ তৃপ্তির আশ্রয়ে। শরীর এখানে কবিতা, আর স্পর্শ তার ছন্দ—এই ছন্দে কোনো বিকার নেই, নেই কোনো লজ্জা, শুধুই সম্মতি, সংবেদন, আর সেই গোপন নৈঃশব্দ্য, যাকে বলে সত্যিকারের প্রেম।
ভোরের দিকে, যখন আকাশে হালকা লালচে রেখা দেখা দেয়, রূপসা আর অনিন্দ্য একে অপরকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকে, ঠিক যেমন শরৎকালের আকাশ জড়িয়ে ধরে তার পূর্ণিমাকে। রূপসা বলে, “এই মুহূর্তটা যেন কখনও ফুরিয়ে না যায়।” অনিন্দ্য বলে, “এই মুহূর্তটাই তো চিরন্তন। যে অনুভব একবার হয়ে যায়, তা কি আর ফুরোয়?” তারা জানে, এই রাতটা ওদের জীবনে এক কবিতা হয়ে থেকে যাবে, যেটার পঙক্তি শুধু তারাই বোঝে, কাগজে লেখা যাবে না, প্রকাশ্যে বলা যাবে না। এ এক নিঃশব্দ স্বাক্ষর, শরতের জোছনায় লেখা, দু’জন মানুষের শরীরে খোদাই করা সেই প্রেম, যার মানে কেবল তারাই জানে।
৮
রূপসা সেই সন্ধ্যেয় খুব কম কথা বলছিল, যেন কিছু একটা মনে মনে ওলটপালট হচ্ছে। অনিন্দ্য বুঝতে পারছিল, ওর চোখে আজ অন্যরকম এক আলো—যেটা শুধু কামনার নয়, অভিমান, অপেক্ষা, এবং একটা নতুন আত্মসমর্পণের ছায়া। সন্ধ্যে গড়িয়ে রাত হতেই রূপসার ফোনে ভেসে এলো, “আজ একটু দেখা হবে? পূর্ণিমার আলোয় হাঁটতে ইচ্ছে করছে।” অনিন্দ্য কোনো প্রশ্ন না করেই বলল, “এসো, কলেজ মাঠের পেছনের গেটের ধারে থাকবো।” শহর তখন সাদাকালো আলোয় ভেসে যাচ্ছে, শরতের সেই বিখ্যাত নিশ্বাসে ভিজে আছে গাছের ছায়া, রাস্তার ধারে ঝরা শিউলি, আর দুইটি অস্থির হৃদয়। দেখা হতেই রূপসা একবার অনিন্দ্যের চোখের দিকে তাকাল—তাকানো নয়, যেন চুম্বনের আগেই চোখে চোখ রাখার প্রস্তুতি। অনিন্দ্য বলল, “আজ তুমি একটু অন্যরকম লাগছে,” রূপসা হেসে বলল, “তোমার কবিতাগুলোর মতো।” সেই মাঠের নির্জনতা, আলোছায়ার খেলায় তারা একে অপরকে ধীরে ধীরে অনুভব করছিল, প্রথমে শব্দে, পরে নিঃশব্দে। অনিন্দ্যের হাত যখন রূপসার আঙুলে ছুঁয়ে গেল, মনে হলো যেন শরতের কোনও বাতাস বুকের মধ্যে ঢুকে পড়ল।
ধীরে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে তারা পৌঁছালো একটি ফাঁকা বেঞ্চে—কলেজ চত্বরে যেখানে রাতের পর রাত প্রেমিকেরা চুপচাপ বসে থাকে, কেউ কথা বলে, কেউ শুধু হাত ধরে থাকে। রূপসা বসে, অনিন্দ্য তার পাশে। কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ। তারপর রূপসা বলল, “তুমি কখনো ভেবেছো, ভালোবাসা ঠিক কতদূর গিয়ে থামে?” অনিন্দ্য বলল, “যখন শরীর আর আত্মা একই ভাষায় কথা বলে, তখনই হয়তো থামে।” সেই থামা কি আদৌ থেমে যাওয়া, না কি একধরনের গতি—যেখানে স্পর্শে উচ্চারণ হয় কবিতা? রূপসা হঠাৎ করেই মাথাটা অনিন্দ্যের কাঁধে রেখে দিল, আর অনিন্দ্য তার চুলে আঙুল চালাতে লাগল ধীরে ধীরে। চাঁদের আলো তাদের ছুঁয়ে যাচ্ছে, মনে হচ্ছে যেন সেই আলোই তাদের শরীরের ভাষা অনুবাদ করে দিচ্ছে, কবিতা থেকে ছায়ার শরীরী কাব্যে। অনিন্দ্যের ঠোঁট যখন রূপসার কপালে ছুঁল, সেখানে কোনও লালসা ছিল না, ছিল সম্মতির গভীর এক স্পন্দন। রূপসা বলল, “আজ আমার খুব ইচ্ছে হচ্ছে তোমার কবিতায় একবার নিজেকে পড়ে ফেলি।” অনিন্দ্য তার দিকে তাকিয়ে বলল, “তাহলে এসো, আমার কবিতা হয়ে ওঠো তুমি।”
সেই রাত তাদের প্রথম প্রেমের, প্রথম আলিঙ্গনের, প্রথম মৃদু দোলা—যেখানে স্পর্শে ছিল না অস্থিরতা, ছিল বোঝার চেষ্টা, সম্মতির দীর্ঘ ভাষ্য। রূপসার শরীর যেন এক গন্ধমাখা পাতার মতো খুলে যাচ্ছিল অনিন্দ্যের সামনে, প্রতিটি অনুভবে সে যেন পড়ছিল এক গভীর কবিতা, যেটার পংক্তিগুলোতে ছিল আলোর স্পর্শ, ছায়ার লুকোচুরি। তারা একে অপরের মাঝে ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে থাকল, যেন দুইটি নদী একটায় গিয়ে মিশে যাচ্ছে। শরতের সে রাত তাদের জন্য রেখে দিয়েছিল একটা ধ্রুব মুহূর্ত—যেটা শুধু শরীরের নয়, আত্মার, কবিতার, পূর্ণিমার মতো নিঃশব্দ কিন্তু দীপ্ত। শেষরাতে, রূপসা চুপচাপ বলল, “এই মুহূর্তটা কখনো ভুলতে পারব না।” অনিন্দ্য বলল, “এই মুহূর্তেই তো আমরা একে অপরকে সত্যি করে পেলাম।” তারা জানত, শহরের বাতি নিভে গেলেও, শরতের এই আলো আর ছায়ার কবিতা থেকে যাবে তাদের চিরকালীন স্মৃতিতে—যেখানে ভালোবাসা এক অন্তরঙ্গ সম্মতিতে রচিত হয় শরীরী ছন্দে।
৯
ক্লাসরুমে বসে অনিন্দ্যর চোখ আটকে ছিল রূপসার দিকে, কিন্তু আজকের দৃষ্টিতে যেন কিছু একটা অন্যরকম ছিল। রূপসা গম্ভীর, যেন চুপচাপ একটা যুদ্ধ লড়ছে নিজের মধ্যে। শরতের আলো তখন পড়ন্ত বেলার দিকে ঝুঁকেছে, জানালার বাইরের কাশফুলগুলো বাতাসে দুলছে, কিন্তু এই নরম বাতাস অনিন্দ্যর মনে কোনও প্রশান্তি আনছিল না। সে অপেক্ষা করছিল কখন রূপসা কথা বলবে, কী বলতে চায় সে। কলেজ শেষে দুজনে বসেছিল সেই পুরোনো কফির দোকানে। কাপের ধোঁয়া তাদের নীরবতার মতোই ধোঁয়াটে। অবশেষে রূপসা বলল, “তুই জানিস অনি, আমি কী চাই?” অনিন্দ্য একবার তার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “তুই যা বলবি, আমি শুনব।” রূপসা জানালা দিয়ে পূর্ণিমার কাঁচা আলোয় ডুবে থাকা আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি চাই, আমাদের শরীরের ছায়া যেন এই চাঁদের আলোয় মিশে একরকম কাব্য হয়ে যায়। শুধু শরীর নয়, আত্মাও জড়াক সেই কাব্যে।” অনিন্দ্যর হৃদয় কেঁপে উঠল।
তারা ঠিক করল, এবারে শরতের পূর্ণিমা যেদিন পড়বে, সেদিন তারা আবার সেই পুরনো নদীর ঘাটে যাবে—যেখানে একদিন কবিতা আবিষ্কৃত হয়েছিল তাদের মাঝে। কিন্তু এবার তারা শুধু কবিতা বলবে না, ভালোবাসার এমন এক ভাষা রচনার সাহস করবে, যা শরীর দিয়েও প্রকাশ পায়। সেই দিন আসার আগে প্রতিটি সন্ধ্যা তাদের উত্তেজনায় কেটে যাচ্ছিল। একে অপরকে চিঠি লিখছিল তারা—কবিতার ছলে লেখা ইচ্ছের ব্যাখ্যা, শরীরের প্রতি টান, ভালবাসার গভীরতা। রূপসা এক চিঠিতে লিখেছিল, “তোর আঙুলগুলো যেন আমার কবিতার পংক্তি হয়ে শরীরে লেখা হয়।” অনিন্দ্য লিখেছিল, “তোর পিঠের তিলটা যেন পূর্ণিমার চাঁদের মতো উজ্জ্বল, আর আমি সেই আকাশ।” প্রত্যেকটা বাক্যে যেন তারা নিজেদের নগ্নতা, সাহস ও প্রেমকে আরও প্রকাশ্যে নিয়ে আসছিল।
অবশেষে সেই পূর্ণিমার রাত এলো। নদীর ঘাটে বসে তারা কবিতা পাঠ করল—প্রথমে চোখে চোখ রেখে, তারপর আঙুলে আঙুল রেখে। এরপর ধীরে ধীরে, নিঃশব্দে, কাপা কাঁপা হাত তাদের শরীর ছুঁয়ে গেল। চাঁদের আলোয় রূপসার ত্বক দুধের মত উজ্জ্বল দেখাচ্ছিল। অনিন্দ্য তাকে বলল, “তুই আজ আমার কবিতা, আমি শুধু পাঠ করছি।” রূপসা হেসে বলল, “তুই আমায় পড়ে ফেলিস, কিন্তু শেষ হয় না।” তারা একে অপরের দিকে এগিয়ে এল, যেন পুরো শরৎ-রাতটাই কেবল তাদের প্রেমের জন্যই লেখা। কোনও শব্দ নেই, শুধু নিঃশ্বাসের অনুরণন, নদীর শব্দ, আর শরীরের ভাষা। সেই রাত যেন একটা জীবন্ত কবিতা হয়ে গিয়েছিল, যা শরীর দিয়ে লেখা, চাঁদের আলোয় আঁকা, আর হৃদয়ের কালি দিয়ে চিরকালীন হয়ে ওঠা এক গল্প।
১০
শরতের সেই শেষরাত। হাওয়ার মধ্যে কিছু একটার আলগা সুর ছিল, যেন আসন্ন বিদায়ের মৃদু ধ্বনি। অনিন্দ্য আর রূপসা বসেছিল লালচে পাতা ঝরা এক বটগাছের নিচে, শহরের বাইরে একটি অচেনা বাঁশবাগানের কোলে। পূর্ণিমার আলো ঝরে পড়ছিল তাদের চোখে, ঠিক যেন শেষ অধ্যায়ের আলোর রেখা। কথা হচ্ছিল না তেমন—শুধু চোখ, হাত আর নিঃশ্বাসে চলছিল এক অন্তরঙ্গ সংলাপ। রূপসার ঠোঁটের কোণে ছিল এক অদ্ভুত নরম হাসি, যেন সে জানে—এ ইতি। অনিন্দ্যর চোখে ভাসছিল সেই প্রথম কবিতা, সেই রবীন্দ্রসঙ্গীতের দুপুর, সেই কাঁপা-কাঁপা স্পর্শ। শরীর থেকে শরীর ছুঁয়ে একেবারে হৃদয়ের গভীরে পৌঁছে যাওয়া—সেই সব স্মৃতিরা যেন শরতের শিশিরে জমে থাকা পদ্য হয়ে উঠছিল।
হঠাৎ করেই রূপসা বলেছিল, “অনিন্দ্য, যদি আগামী বছর এই শরতের রাতেও একই চাঁদের নিচে দেখা হয়, তাহলে জেনে নেব—আমরা সত্যি ছিলাম।” অনিন্দ্য কিছু বলেনি। শুধু তার আঙুল শক্ত করে ধরেছিল রূপসার কবজি, যেন সময়কে বেঁধে রাখতে চায়। সেই রাত্রির কুয়াশা, সেই কপালে ছোঁয়া চুম্বন, সেই শরীরী নরমতা—সবকিছু মিলিয়ে এক অপার্থিব অনুভূতি জন্ম নিয়েছিল, যা ভাষায় নয়, শুধু শরীর আর মন দিয়ে বোঝা যায়। সে রাতের প্রেম যেন আর শুধু শরীরী ছিল না, তা হয়ে উঠেছিল এক অনন্ত মিলনের রূপক। রূপসা তার গাল ঘেঁষে ফিসফিস করে বলেছিল, “তুই না থাকলে আমার শরীরও অচেনা লাগে।” সেই কথাটুকু যেন হাজার কবিতার চেয়েও গভীর ছিল, আর সেই গভীরতাই ছুঁয়ে দিয়েছিল অনিন্দ্যকে।
পরদিন সকালটা ছিল নীরব। কুয়াশায় ঢাকা রাস্তায় আলাদা পথ ধরেছিল দুজন। কোনো বিদায় নয়, কোনো চোখের জল নয়—শুধু এক মৌন প্রতিশ্রুতি রেখে যাওয়া। সেই শরতের শরীরী চাঁদ, যা দুজনকে প্রেম আর শরীরের রূপকথায় জড়িয়েছিল, সে আজও উঁকি দেয় আকাশে। কিন্তু সে আলো এখন আর শরীরের উত্তাপে জ্বলে না—সে এখন স্মৃতির মৃদু দীপ্তি, এক ছায়াপথ, যেখানে অনিন্দ্য আর রূপসা বারবার হাঁটে, আলাদা হয়ে থেকেও একসাথে। সময় চলে যায়, প্রেম রয়ে যায়, কবিতা হয়ে, শরীর হয়ে, আর সেই শরতের রাত্রির এক নিঃশব্দ চুম্বনের প্রতিধ্বনি হয়ে।
***