ভাস্কর চক্রবর্তী
কলকাতার জনবহুল শহরের বুকেই যেন অধ্যাপক অরিন্দম মুখার্জীর জীবন বাঁধা ছিল বই, গবেষণাপত্র আর ছাত্রছাত্রীদের ব্যস্ত ভিড়ের মাঝে। নৃবিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসেবে তিনি বহুদিন ধরেই আদিবাসী সমাজ, লোকাচার, লোকসংগীত ও তন্ত্রসংক্রান্ত বিশ্বাস নিয়ে গবেষণা করছিলেন। তাঁর ডেস্কে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নানা নথি, পুরনো গ্রন্থ আর নোটবইতে বারবার উঠে এসেছে এক শব্দ—“শবর মন্ত্র।” এই শব্দটি তাঁকে দীর্ঘদিন ধরে টানছিল, কারণ এ নিয়ে খুব বেশি লিখিত তথ্য পাওয়া যায়নি, কেবল অস্পষ্ট কিছু উল্লেখ রয়েছে প্রাচীন পুঁথি আর কয়েকটি বিদেশি ভ্রমণকারীর ডায়েরিতে। যতই তিনি এ বিষয়ে পড়েছেন, ততই তাঁর মনে হয়েছে যে এর আসল সূত্র কেবল বইয়ে নয়, লোকসমাজের বুকে লুকিয়ে আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকর্মীরা তাঁর আগ্রহকে কখনো তুচ্ছ করেছেন, কখনো আবার অযথা সাহসী বলে মনে করেছেন, কিন্তু অরিন্দমের দৃঢ় বিশ্বাস—একদিন এই শবর মন্ত্র নিয়ে তিনি এমন একটি প্রবন্ধ লিখবেন, যা শুধু একাডেমিক মহলেই নয়, বিশ্বসংস্কৃতির আলোচনাতেও নতুন দিগন্ত খুলে দেবে। অনেক রাত তিনি নিজের ঘরে বসে মানচিত্রের ওপরে চোখ বুলিয়ে গেছেন, পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া জেলার ছোট ছোট গ্রামগুলো চিহ্নিত করেছেন, আর ভেবেছেন কোন গ্রামটিতে লুকিয়ে আছে সেই রহস্যের দরজা। ঠিক সেই সময়েই তাঁর হাতে আসে এক সাঁওতাল ছাত্রের লেখা ছোট্ট প্রবন্ধ, যেখানে ইঙ্গিত পাওয়া যায়—পুরুলিয়ার এক প্রত্যন্ত গ্রামে আজও শবর মন্ত্র চর্চা হয়। সেই সূত্রেই অরিন্দম সিদ্ধান্ত নেন, সমস্ত দ্বিধা কাটিয়ে তিনি সশরীরে সেখানে যাবেন।
যাত্রার প্রস্তুতি নিতে গিয়ে অরিন্দম অনুভব করেছিলেন এক অদ্ভুত টান। যেন কেউ তাঁকে ডাকছে, টেনে নিয়ে যাচ্ছে অচেনা এক অন্ধকারের দিকে। তিনি জানতেন, গবেষণা মানেই ঝুঁকি, কিন্তু তবুও এ আকর্ষণ অস্বাভাবিক। স্ত্রী চিত্রা বারবার তাঁকে সতর্ক করছিলেন—“এমন জায়গায় যাচ্ছ, যেখানে ভাষা, সংস্কৃতি, আর বিশ্বাস—সবকিছুই আমাদের অচেনা। তুমি যদি অযথা বেশি খোঁজখবর কর, লোকেরা কিন্তু ভালোভাবে নেবে না।” অরিন্দম হাসতেন, বলতেন, “তুমি চিন্তা কোরো না, আমি তো কেবল নথি চাই, ওদের সংস্কৃতিকে আঘাত করতে নয়।” কিন্তু অন্তরে তিনিও বুঝছিলেন, এ যাত্রা অন্য সব ভ্রমণের মতো হবে না। ট্রেনের জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তাঁর চোখে ভেসে উঠত পুরুলিয়ার লালমাটির দৃশ্য, শুকনো জঙ্গল, টিলার সারি আর দূরে বাজানো কোনো অচেনা বাঁশির শব্দের মতো প্রতিধ্বনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্ত নিরিবিলি লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে অচেনা অরণ্যে প্রবেশের কল্পনা তাঁকে শিহরিত করছিল।
গ্রামে পৌঁছানোর আগেই তিনি শুনেছিলেন, গ্রামের নাম সহজে উচ্চারণ করা হয় না। স্থানীয়রা বিশ্বাস করে—যদি কেউ অবহেলাভরে উচ্চারণ করে ফেলে, তবে অশরীরী শক্তি জেগে ওঠে। ট্যাক্সি ড্রাইভার, যিনি তাঁকে জঙ্গলের পথ ধরে নিয়ে যাচ্ছিলেন, একবারও গ্রামের নাম মুখে আনেননি। শুধু বলেছিলেন, “ওই জায়গাটা… সাবধানে যাবেন। ওখানে সবাই বিশ্বাস করে, মন্ত্র মানে খেলা নয়।” সন্ধ্যা নামার সময় অরিন্দম যখন গ্রামটির কাছে পৌঁছালেন, চারপাশে ঘন গাছপালার আড়ালে ডুবে যাচ্ছিল সূর্যের শেষ আলো। ঝোপের ভেতর থেকে ভেসে আসছিল ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক, আর মাঝে মাঝে দূরে শুনতে পাওয়া যাচ্ছিল অদ্ভুত এক বাঁশির সুর, যার উৎস খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। সাঁওতালদের কুঁড়েঘরের আগুনের ধোঁয়া আকাশে মিশছিল, অথচ গ্রামের লোকেরা যেন ইচ্ছে করেই বাইরে দাঁড়িয়ে অরিন্দমকে চেয়ে দেখছিল এক অস্বস্তিকর দৃষ্টিতে। তাদের চোখে কৌতূহল ছিল, কিন্তু তার সঙ্গে মিশে ছিল এক অচেনা সতর্কবার্তা। অধ্যাপক নিজের নোটবই আঁকড়ে ধরলেন, আর মনে মনে ভাবলেন—“হয়তো এ পথই আমাকে নিয়ে যাবে সেই রহস্যের দরজার কাছে, যেটি খুঁজে ফিরছি।” তিনি তখনও জানতেন না, এই গ্রাম তাঁর জীবন বদলে দেবে, আর হয়তো জীবিত আর মৃতের মাঝের সীমানাকেই মুছে দেবে।
_
অন্ধকার নেমে এসেছে পুরুলিয়ার জঙ্গলে। দিনের বেলায় দেখা লাল মাটি, শুকনো শাল-পিয়ালের বন, আর ধুলো মাখা আঁকাবাঁকা পথ—সবকিছুই এখন যেন ঘন ছায়ার আড়ালে ঢেকে গেছে। ট্রেন থেকে নেমে দীর্ঘ পথ পেরিয়ে, স্থানীয়দের অল্প কথার সাহায্যে অবশেষে যখন অধ্যাপক অরিন্দম মুখার্জী সেই গ্রামে পৌঁছালেন, তখন চারদিক ইতিমধ্যেই ভরে গেছে নিশাচরের সুরে। দূরের পাহাড় থেকে হাওয়ার ঝাপটা এসে গাছের পাতা নাড়াচ্ছে, আর ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক যেন এক অদৃশ্য পর্দা তৈরি করেছে গ্রামটিকে ঘিরে। কিন্তু এর মাঝেই হঠাৎ ভেসে এল এক অদ্ভুত শব্দ—কোনো বাঁশির মতো, আবার কখনো মনে হল যেন একসাথে বহু বাঁশি বেজে উঠেছে। সুরটা এত গভীর, এত অচেনা যে, অরিন্দম থমকে দাঁড়িয়ে গেলেন। তাঁর মনে হল, এ সুর যেন সরাসরি তাঁর হাড়ের ভেতরে ঢুকে পড়ছে। ট্যাক্সি ড্রাইভার, যে তাঁকে নামিয়ে দিয়ে তাড়াহুড়ো করে চলে গিয়েছিল, শেষ মুহূর্তে বলেছিল—“বাবু, রাত নামার আগে গ্রামে ঢুকে পড়বেন। অচেনা বাঁশির ডাক শুনলেও বাইরে বেরোবেন না।” সেই কথাই যেন হঠাৎ আবার মনে পড়ে গেল। সুরটা যখন আরও কাছে এলো, অরিন্দম লক্ষ্য করলেন গ্রামবাসীরা সবাই থেমে গেছে। কিশোর থেকে বৃদ্ধ—সবাই যেন চুপচাপ দাঁড়িয়ে শুনছে। কিন্তু তাদের চোখেমুখে কোনো বিস্ময় নেই, বরং এক ধরণের আতঙ্ক মেশানো অভ্যাস। যেন এ বাঁশির সুর তাদের জীবনের চিরন্তন সত্য, প্রতিদিন রাত নামলে যা ফিরে আসে, কিন্তু তারা কোনোদিনই তাকে প্রশ্ন করে না।
অরিন্দম এগিয়ে গিয়ে একদল মানুষকে জিজ্ঞাসা করলেন, “এটা কীসের শব্দ?” তাদের মধ্যে একজন মধ্যবয়সী লোক ফিসফিস করে বলল, “ওটা আত্মাদের গান। আমাদের পুরোনো মৃতেরা জঙ্গলের ভেতর বাজায়। কেউ ওদিকটায় যায় না। আপনারা শহুরে মানুষ, বিশ্বাস করবেন না হয়তো, কিন্তু ওরা আছে।” এই উত্তর শুনে অরিন্দম থমকে গেলেন। যুক্তিবাদী মানুষ তিনি, তবুও অনুভব করলেন—এই লোকেরা যা বলছে, তা কেবল কোনো লোককথা নয়, বরং এক জীবন্ত বিশ্বাস, যা তাদের প্রতিটি দিন ও রাতকে নিয়ন্ত্রণ করে। তখনই তাঁর সঙ্গে দেখা হয় জগেন হাঁসদার, গ্রামের একজন বয়স্ক সাঁওতাল মানুষ, যিনি অন্যদের তুলনায় একটু বেশি খোলামেলা। ধূসর চুল, কুঞ্চিত মুখ, আর চোখে এক অদ্ভুত দীপ্তি। তিনি ধীর কণ্ঠে বললেন, “আপনি সেই অধ্যাপক বাবু, তাই না? কলকাতা থেকে এসেছেন শবর মন্ত্রের খোঁজে?” অরিন্দম অবাক হয়ে তাকালেন, “আপনি জানলেন কীভাবে?” জগেন একটুখানি হেসে উত্তর দিলেন, “আপনাদের আসার খবর গোপন থাকে না। বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। আমরা জানতাম আপনি আসবেন।” জগেনের পাশে দাঁড়িয়েছিল এক কিশোরী মেয়ে, নিতান্তই তরুণী, নাম রূপা। মেয়েটির গায়ে ছিল সাদামাটা রঙিন শাড়ি, চোখে কৌতূহলের ঝিলিক, আর মুখে এমন এক সরল হাসি যা অরিন্দমকে মুহূর্তের জন্য শহুরে জীবন ভুলিয়ে দিল। রূপা কণ্ঠে লাজুক ভঙ্গিতে বলল, “দাদু বলেছিল আপনি মন্ত্র নিয়ে জানতে চান। কিন্তু সাবধান হবেন, সবাই আপনাকে পছন্দ করবে না।”
গ্রামের ভেতরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই অরিন্দম বুঝতে পারলেন, তাঁর আগমনে গ্রামবাসীরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়েছে। একদল কৌতূহলী, তারা মনে করছে শহরের অধ্যাপক হয়তো তাদের সংস্কৃতি বাইরের দুনিয়ায় নিয়ে যাবে। অন্যদল ভয় আর অবিশ্বাসে ভরা, তারা ভাবে এ অচেনা লোক আসলে অশরীরী শক্তিকে উসকে দেবে। জগেন তাঁকে কুঁড়েঘরে বসতে বললেন এবং আগুন জ্বালিয়ে পাতা দিয়ে কিছু খাবার দিলেন। চারপাশে তখনও বাঁশির অদ্ভুত সুর ভেসে আসছে। অরিন্দম নোটবই খুলে লিখতে চাইলেন, কিন্তু কলমের নিব বারবার থেমে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, এ শব্দে তাঁর হাত কাঁপছে। রূপা চুপচাপ তাঁর পাশে বসে আগুনের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমরা ছোট থেকে শিখেছি, এই সুর মানে—আমাদের পুরোনো পূর্বপুরুষেরা এসে দেখে যাচ্ছে। যারা মন্ত্র জানে, তারাই বুঝতে পারে কোন সুরে কী বার্তা আছে। কিন্তু আপনারা তো শুনে শুধু ভয় পাবেন।” অরিন্দম বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করলেন, “তাহলে কি এই সুরের মানে বোঝা যায়?” জগেন গম্ভীর মুখে বললেন, “হ্যাঁ, বাবু। প্রতিটি সুর এক একটি ভাষা, এক একটি ইঙ্গিত। কিন্তু সব কানে তা শোনায় না। অনেক সময় যে মন্ত্র শেখে, সে-ই কেবল বুঝতে পারে। তবে সাবধান, সব জেনে নেওয়াও ভালো নয়। কারণ এই বাঁশি বাজে তখনই, যখন জীবিত আর মৃতের মাঝের সীমানা পাতলা হয়ে যায়।” অরিন্দম মনে মনে কাঁপলেও তাঁর ভেতরের গবেষকের তৃষ্ণা আরও তীব্র হয়ে উঠল। তিনি বুঝলেন—তিনি সত্যিই এমন এক গ্রামে এসে পৌঁছেছেন, যেখানে লোকবিশ্বাস শুধু কল্পনা নয়, জীবন্ত অভিজ্ঞতা। রাত যত গভীর হচ্ছিল, বাঁশির সুর তত ঘন হয়ে উঠছিল, আর তাঁর মনে হচ্ছিল—এই অদৃশ্য সঙ্গীত যেন তাঁকে আরও গভীর জঙ্গলের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।
_
পরদিন সকালে অরিন্দম যখন ঘুম ভাঙলেন, তখন গ্রামের চারপাশে ভোরের আলো ছড়িয়ে পড়েছে। শীতল কুয়াশার মধ্যে দিয়ে দেখা যাচ্ছিল দূরে শালবন আর মাটির পথ ধরে চলা কয়েকজন মহিলা, মাথায় কলস নিয়ে পুকুরে যাচ্ছে। রাতের অদৃশ্য বাঁশির সুর এখনও যেন তাঁর কানে বাজছিল, ঘুমের মধ্যেও বহুবার তিনি চমকে উঠেছিলেন। গবেষকসুলভ স্বভাব তাঁকে প্রলুব্ধ করছিল—আজই তিনি আরও গভীরে খোঁজ নেবেন, কারা এই বাঁশি বাজায়, কেন গ্রামবাসীরা এতো ভয় পায়। কিন্তু জগেন হাঁসদা সকালে তাঁকে জানালেন, গ্রামের সবাই তাঁর আগমন নিয়ে আলোচনা করছে। কেউ কেউ খুশি নয়, কেউ বা উৎসাহী। এমনই সময় গ্রামে প্রবীণতম পুরোহিত, ভৈরব পহান, খবর পাঠালেন যে তিনি অধ্যাপকের সঙ্গে দেখা করতে চান। অরিন্দম ভেবেছিলেন হয়তো এ এক মূল্যবান সুযোগ—লোকবিশ্বাসের সঙ্গে জড়িত একজন অভিজ্ঞ মানুষ তাঁর প্রশ্নের উত্তর দেবেন। কিন্তু তিনি বুঝতে পারেননি, এই সাক্ষাৎ তাঁর যাত্রার মোড় ঘুরিয়ে দেবে।
ভৈরব পহান ছিলেন বৃদ্ধ, তবুও তাঁর দেহভঙ্গিতে ছিল এক গম্ভীর দৃঢ়তা। শরীরে ছাই মাখা, গলায় বড় বড় রুদ্রাক্ষ-মালা, আর হাতে কাঠের ছড়ি। তাঁকে দেখামাত্র অরিন্দমের মনে হল, এ মানুষটি যেন শুধু গ্রামের পুরোহিত নন, বরং এক জীবন্ত ইতিহাস, যে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলে আসা আচার-সংস্কারকে বুকে ধারণ করে আছেন। পহান তাঁকে বসতে বললেন এক মাটির চৌকিতে, চারপাশে ধূপের ধোঁয়া উড়ছিল। গম্ভীর কণ্ঠে তিনি প্রথমেই বললেন, “আপনি শহরের লোক, বইপত্র নিয়ে পড়াশোনা করেন। কিন্তু সব সত্যি কি বইতে লেখা যায়? কিছু জিনিস আছে, যেগুলো বই জানে না, কেবল রক্ত আর হাড় জানে।” অরিন্দম মৃদু হাসি দিয়ে উত্তর দিলেন, “আমি বুঝি, কিন্তু আমার উদ্দেশ্য কোনো কুসংস্কার ভাঙা নয়। আমি শুধু জানতে চাই, শবর মন্ত্রের আসল মানে কী।” তখনই পহান চোখ তুলে তাঁর দিকে তাকালেন, দৃষ্টি এত তীক্ষ্ণ যে অরিন্দম কিছুক্ষণ চুপ করে গেলেন। পহান ধীরে ধীরে বললেন, “শবর মন্ত্র খেলনা নয়, বাবু। এটা শুধু লোকাচার নয়, এটা জীবিত আর মৃতের মাঝখানে একটা সেতু। ওই সেতু কখনো খোলা উচিত নয়। ভুল করে কেউ যদি মন্ত্রে গণ্ডগোল করে ফেলে, তবে সেই সেতু খুলে যায় আর মৃতেরা ফিরে আসে।”
অরিন্দম ভেবেছিলেন লোকটি হয়তো কুসংস্কারে ভরা গল্প বলবেন, কিন্তু তাঁর কণ্ঠের দৃঢ়তা তাঁকে অস্থির করে তুলল। তিনি চেষ্টা করলেন যুক্তি দিতে, “কিন্তু আত্মা বলে কিছু তো নেই, সবই মানুষের ভয় আর বিশ্বাসের সৃষ্টি।” পহান হাসলেন না, শুধু বললেন, “আপনারা শহুরে লোকেরা অনেক কিছু জানেন, কিন্তু সব না। এখানে যারা থাকে, তারা প্রতিদিন রাতে সেই সুর শোনে, মৃতদের ছায়া দেখে। আমাদের দাদা-ঠাকুরদারা মন্ত্র জানতেন, তারা আত্মাদের শান্তি দিতেন। এখন সেই মন্ত্র প্রায় হারিয়ে গেছে, ভুল করলে আত্মারা মুক্তি পায় না, বরং আটকে থেকে আমাদের জীবনকে তছনছ করে।” তিনি থেমে গিয়ে একদৃষ্টে অরিন্দমের দিকে তাকিয়ে যোগ করলেন, “আপনি যদি বেশি খোঁজখবর করেন, তবে গ্রাম বিপদে পড়বে। আর আপনার নিজেরও ক্ষতি হতে পারে।” মুহূর্তের জন্য অরিন্দমের শরীর শিরশির করে উঠল। অথচ ভেতরের গবেষক মানতে চাইছিল না। তিনি নোটবই খুলে কিছু প্রশ্ন করতে চাইলেন, কিন্তু পহান তাঁর হাত থামিয়ে দিলেন, “সব জানতে নেই, বাবু। মন্ত্র মানে শুধু শব্দ নয়, এটা দরজা খোলার চাবি। চাবি যার হাতে থাকবে, সে-ই ঠিক করবে আত্মারা বাইরে আসবে কি আসবে না। আর একবার যদি বাইরে আসে, তখন তাদের ফেরানো প্রায় অসম্ভব।”
সেদিনের কথোপকথনের পর গ্রামে অরিন্দমকে আর সবাই আগের মতো দেখতে লাগল না। যারা তাঁকে নিয়ে কৌতূহলী ছিল, তারাও দূরে সরে গেল। ভৈরব পহানের সতর্কবার্তা যেন সবার কানে পৌঁছে গিয়েছিল। সন্ধ্যা নামতেই আবার বাঁশির সুর ভেসে এলো, অরিন্দমের বুক ধড়ফড় করে উঠল। তিনি জানতেন, তাঁর যুক্তিবাদী মন এসব মানতে চায় না, কিন্তু তবুও অদ্ভুত এক ভয় তাঁকে গ্রাস করছিল। তিনি রূপাকে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি কি এসব বিশ্বাস করো?” রূপা আগুনের আলোয় চুপ করে বসে থেকে মৃদুস্বরে বলল, “আমি জানি, বাবু। আমি ছোটবেলায় দেখেছি, আমার মাকে মৃত দাদার ছায়ার সঙ্গে কথা বলতে। ওটা ভয়ঙ্কর ছিল।” অরিন্দম অনুভব করলেন, ভৈরব পহানের সতর্কতা শুধু অকারণ ভয় দেখানো নয়, বরং অভিজ্ঞতার গভীর থেকে উঠে আসা এক সত্য। তবুও তাঁর ভিতরে এক অদম্য কৌতূহল জন্ম নিল—এই সেতুটা কেমন, কীভাবে খোলে, আর সত্যিই কি মৃতেরা ফিরে আসে? তিনি জানতেন, এ প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে তাঁকে এগোতেই হবে। কিন্তু সেই মুহূর্তে তিনি বুঝতে পারেননি, তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপই তাঁকে ক্রমশ সেই ভয়ঙ্কর সেতুর আরও কাছে টেনে নিচ্ছে।
_
অরিন্দমের মনে কৌতূহলের আগুন যেন একবার জ্বলে ওঠার পর আর নিভতে চাইছিল না। ভৈরব পহানের সতর্কতা সত্ত্বেও তাঁর গবেষণার ইচ্ছে ক্রমশ আরও প্রবল হচ্ছিল। এক সন্ধ্যায়, কাকভোরের আলো ফিকে হয়ে আসছে, আকাশজোড়া হালকা মেঘে সূর্য লুকোচুরি খেলছে—ঠিক সেই সময় অরিন্দমের কুঁড়েঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল রূপা। হাতে ধরা এক পুরোনো তালপাতার পুঁথি, চোখে বিস্ময়কর দৃঢ়তা। সে নিঃশব্দে ঘরে ঢুকে বসে পড়ল। অরিন্দম অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল—“এটা কী?” রূপা হেসে উত্তর দিল, “শবর মন্ত্র। আমাদের ঠাকুর্দাদের ঠাকুর্দারাও এই পুঁথি মুখে মুখে শিখে এসেছেন। আজ আমি তোমাকে শেখাব।” অরিন্দম প্রথমে দ্বিধাগ্রস্ত হলেও মনের ভেতরের গবেষকের ডাক তাকে টেনে নিয়ে গেল। মেয়েটির কণ্ঠস্বর ছিল মৃদু অথচ স্পষ্ট, প্রতিটি শব্দ যেন গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে আসা বাতাসের মতো কানে এসে বাজছিল। সে ব্যাখ্যা করতে লাগল কীভাবে এই মন্ত্র কেবল অক্ষরের উচ্চারণ নয়, বরং প্রকৃতির সাথে একাত্ম হওয়ার এক প্রাচীন প্রয়াস। রূপার বিশ্বাস, শহুরে দাদাবাবুর কলমেই হয়তো এ গ্রামের গোপন সংস্কৃতি একদিন বিশ্বজোড়া সম্মান পাবে। আর তাই সে সব বাঁধা অগ্রাহ্য করে অরিন্দমকে শেখানোর জন্য এগিয়ে এসেছিল। অরিন্দম বিস্মিত ও উত্তেজিত চোখে তাকিয়ে রইল, যেন এক অচেনা জগতের দরজা ধীরে ধীরে খুলে যাচ্ছে তার সামনে।
রূপা পুঁথির মলাট ছেড়ে খুলতেই ঘরে ছড়িয়ে পড়ল পুরোনো কালি আর শুকনো পাতার গন্ধ। বাইরে ঝিঁঝিঁর ডাক আরও জোরে উঠতে লাগল, যেন জঙ্গল নিজেই এই পাঠের সাক্ষী হতে চাইছে। মেয়েটি অরিন্দমকে প্রথম কয়েকটি শব্দ শিখিয়ে দিল, যেগুলি উচ্চারণ করতেই অরিন্দমের বুক কেঁপে উঠল। সে অনুভব করল যেন দেহের ভেতর দিয়ে অদৃশ্য এক স্রোত বয়ে যাচ্ছে। রূপা শান্তভাবে ব্যাখ্যা করছিল, “মন্ত্র কখনো নিছক শব্দ নয়, এগুলো সেতু—যা পার করলে মানুষের জগত আর অদৃশ্য জগতের মধ্যে যাতায়াত শুরু হয়।” অরিন্দম মন্ত্রোচ্চারণ করতে করতে দেখল, ঘরের দেওয়ালে ঝুলে থাকা কুপির আলো এক মুহূর্তের জন্য কেঁপে উঠল। তার মনে হচ্ছিল, হয়তো এই শব্দগুলো কেবল উচ্চারণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়—তাদের ভেতরে অদ্ভুত এক শক্তি ঘনীভূত। রূপা হঠাৎ তার হাত ধরে ফিসফিস করে বলল, “ভয় পেও না, আমি আছি। শুধু মন দিয়ে শোনো আর বিশ্বাস করো।” অরিন্দম বুঝল, গ্রামের এই তরুণীর বিশ্বাসই তার সাহসের উৎস। কিন্তু তার ভেতরে আবার ভৈরব পহানের সেই সতর্কবাণী প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল—“ভুল করলে সেতু খুলে যাবে।” এই দ্বন্দ্বের মাঝেই সে মন্ত্র শেখা চালিয়ে গেল। একসময় তার মনে হলো, রূপার চোখে ভেসে উঠেছে অদ্ভুত এক দীপ্তি, যা কেবল মানুষী নয়, যেন তার ভেতর দিয়ে কোনো প্রাচীন শক্তি কথা বলছে।
মন্ত্র শেখার সেই আবহে হঠাৎ বাইরের জঙ্গল থেকে অস্বাভাবিক এক শব্দ ভেসে এলো। যেন একসাথে একাধিক মানুষের হাঁটা—তবু কোথাও কেউ নেই। রূপা ভয় পেয়ে জানলার ফাঁক দিয়ে তাকাল, তারপর নিচু গলায় বলল, “দেখো, ছায়াগুলো!” অরিন্দমও দেখল—ঘন অন্ধকারের ভেতর কয়েকটি অদ্ভুত আকার নড়াচড়া করছে। তারা মানুষ নয়, আবার পুরোপুরি পশুও নয়। তাদের দেহ ছায়ার মতো, কিন্তু চলাফেরা বাস্তব। অরিন্দমের গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল, সে বুঝল—এই মন্ত্রোচ্চারণ হয়তো অজান্তেই অদৃশ্য দরজার কপাট ছুঁয়ে ফেলেছে। রূপা তার হাত শক্ত করে ধরে বলল, “চুপ থাকো, শব্দ কোরো না। যদি বুঝে ফেলে, তবে আর ফেরানো যাবে না।” কিন্তু অরিন্দমের চোখ সরে গেল না সেই ছায়াগুলো থেকে—যেন তারা ধীরে ধীরে গ্রামের দিকেই এগোচ্ছে। বাতাস হঠাৎ ঠান্ডা হয়ে উঠল, গাছের পাতা শিরশির করে উঠল। সেই মুহূর্তে অরিন্দম উপলব্ধি করল—ভৈরব পহান ঠিকই বলেছিলেন, শবর মন্ত্র কেবল লোকাচার নয়, এর ভেতরে সত্যিই এক সেতু লুকিয়ে আছে। আর তারা হয়তো অজান্তেই সেই সেতুর পথ খুলে ফেলেছে। রূপা আতঙ্কিত হলেও দৃঢ় কণ্ঠে বলল, “যা শুরু করেছি, তা শেষ করতেই হবে। নইলে অশুভ শক্তি পিছু নেবে।” অরিন্দমের বুক ধকধক করতে লাগল, তবু তার গবেষণার নেশা ও রূপার সাহস তাকে থামতে দিল না। এইভাবে, অন্ধকারে ছায়াদের উপস্থিতি আর মন্ত্রের শব্দ মিলেমিশে এক ভয়ংকর অথচ অদ্ভুত মোহময় রাতের সূচনা করল।
_
অধ্যাপক অরিন্দম সেই রাতে নির্জন কুঁড়েঘরের ভেতরে বসে ছিলেন, সামনে রাখা ছিল তামার থালা, ভিজে মাটির উপর ছড়ানো কিছু বিলুপ্ত বীজ আর শুকনো নিমপাতা। রূপা আগের দিন তাঁকে মন্ত্রের ধ্বনি শিখিয়েছিল, সতর্ক করেছিল প্রতিটি উচ্চারণ যেন সঠিক হয়, কারণ শব্দই এখানে মূল চাবিকাঠি। কিন্তু শহুরে দাদাবাবুর কৌতূহল যে সবসময় সতর্কতার ওপর ভর করে না, সেটা রূপা জানত না। ঘরের অন্ধকারে দীপশিখার আলো দুলছিল, অরিন্দম কাগজে লেখা অক্ষরের দিকে তাকিয়ে অনিশ্চিত গলায় মন্ত্র জপ শুরু করলেন। একবার, দু’বার, তিনবার—তারপরেই হঠাৎ একটি অক্ষর তিনি ভুল উচ্চারণ করলেন। সঙ্গে সঙ্গে ঘরের ভেতর যেন ভারী শ্বাস টেনে নেওয়ার শব্দ উঠল, থালার উপর রাখা নিমপাতাগুলো কেঁপে উঠল, আর মাটির তলদেশে যেন অদৃশ্য ঢেউ বয়ে গেল। অরিন্দম প্রথমে ভাবলেন এ কেবল তাঁর কল্পনা, কিন্তু পরমুহূর্তে বাতাস ঘন কালো হয়ে এল, শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছিল। কুঁড়েঘরের বাঁশের ফাঁক দিয়ে হঠাৎ ডানা মেলার শব্দ ভেসে এল, আর রাতের আকাশ থেকে শত শত কালো কাক ঝাঁপিয়ে নামতে লাগল, যেন অদৃশ্য কারো আদেশে সমবেত হয়ে গিয়েছে। চারপাশে পাখির অস্বাভাবিক ডাক ও ডানার শব্দে ঘরটি কেঁপে উঠছিল, যেন অরণ্যের গোপন দ্বার হঠাৎ খুলে গেছে।
অরিন্দম ভীত, কিন্তু তাঁর ভয়ের সঙ্গে মিশে ছিল এক অদ্ভুত উত্তেজনা—যেন বহু বছর ধরে বইয়ের পাতায় খুঁজে বেড়ানো এক অজানা সত্য আজ ধরা দিয়েছে। কিন্তু এই সত্য তার নিজের নিয়ন্ত্রণে নয়, সেটা তিনি তাড়াতাড়িই বুঝতে পারলেন। কুঁড়েঘরের বাইরের অন্ধকার হঠাৎ ঘন হতে হতে এমন এক স্তরে পৌঁছাল, যেখানে হাতের দূরত্বেও কিছু দেখা যায় না। কাকগুলো কেবল উড়ছিল না, তারা যেন চিৎকার করে ডাকছিল, প্রতিটি ডাকে আতঙ্কের ছায়া ছড়াচ্ছিল চারপাশে। রূপা যখন দৌড়ে এল, তখন অরিন্দম কুঁড়েঘরের মাটিতে বসে কপালে হাত রেখে শ্বাস নিচ্ছিলেন। রূপা অবাক হয়ে দেখল—অরিন্দমের চোখ যেন লালচে আলোয় চকচক করছে। সে তৎক্ষণাৎ বুঝতে পারল মন্ত্রের ভুল উচ্চারণে অরিন্দম কেবল প্রাচীন শক্তিকেই আহ্বান করেননি, বরং এমন কিছু দরজা খুলে ফেলেছেন, যা বন্ধ করা দুরূহ। রূপা কাঁপা গলায় বলল, “আপনি কী করেছেন? এই শব্দ তো অন্য কিছুকে ডেকে এনেছে।” কিন্তু তার জবাব দিতে পারলেন না অরিন্দম, কারণ চারপাশের বাতাস এতটাই ভারী হয়ে উঠেছিল যে কথা বেরোনোও কঠিন হয়ে পড়েছিল। দূরে বাঁশবনের দিক থেকে তখন হাওয়ার সঙ্গে মিশে এক অদ্ভুত শীতল গন্ধ ভেসে আসছিল, যা মানুষের শরীরের শিরায় কাঁপুনি ধরিয়ে দিচ্ছিল।
রাত বাড়তেই গ্রামের মানুষ হঠাৎই অস্বস্তি অনুভব করতে লাগল। কুকুরগুলো একসঙ্গে চিৎকার করে উঠছিল, গৃহস্থের উঠোনে দাঁড়িয়ে থাকা গরুগুলো হঠাৎ অশান্ত হয়ে লাফালাফি শুরু করেছিল, আর শিশুদের কাঁদুনি যেন কোনো অদৃশ্য আতঙ্কে আরো তীব্র হচ্ছিল। অরিন্দম বুঝলেন, তাঁর ভুল কেবল একটি ব্যক্তিগত ব্যর্থতা নয়, এটি গোটা গ্রামকে স্পর্শ করছে। রূপা আতঙ্কে তাঁকে অনুনয় করছিল মন্ত্র বন্ধ করতে, কিন্তু যে দরজা খুলে গেছে, তা কি এত সহজে বন্ধ করা যায়? ঠিক তখনই কুঁড়েঘরের দরজা নিজে থেকেই খুলে গেল, অথচ বাতাস ছিল একেবারে স্থির। দরজার ফাঁক দিয়ে অন্ধকারের ভেতর থেকে যেন দুটি অদৃশ্য চোখ তাকিয়ে রইল তাদের দিকে, আর সেই মুহূর্তে অরিন্দম স্পষ্ট অনুভব করলেন—এই প্রথমবার, সত্যিকারের অশরীরীর প্রবেশ ঘটেছে। তিনি ভয়ে জমে গেলেন, মনের ভেতর ছুটতে লাগল হাজারো প্রশ্ন—তিনি কি এই শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন, না কি এটি তাঁকে গ্রাস করবে? রূপা তাঁর হাত শক্ত করে ধরল, যেন বলতে চাইছে—এখন থেকে পথ আর সহজ নয়, শুরু হয়েছে এক অচেনা যাত্রা, যা হয়তো তাঁদের জীবন পাল্টে দেবে চিরতরে।
_
গ্রামের শান্ত-সুবিধে জীবন যেন হঠাৎই অচেনা অশান্তির আঁচ পেতে শুরু করল। প্রথমে ছোটখাটো ঘটনা, তারপর ক্রমে ভয়ঙ্কর রূপ নিতে লাগল সবকিছু। রাতের বেলা পুকুরপাড়ে গেলে মানুষজন শুনতে পেত নিজের নাম, যেন কেউ অদৃশ্য কণ্ঠে ডাকছে। শুরুতে সবাই ভেবেছিল হয়তো দুষ্টুমি বা বিভ্রম, কিন্তু যখন হরিদাসের ছেলে গভীর রাতে সেই ডাক শুনে পুকুরে ঝাঁপ দেয় এবং আর ভেসে ওঠে না, তখন আতঙ্ক চেপে বসে প্রতিটি হৃদয়ে। অদ্ভুতভাবে, সেই ছেলেকে টেনে তোলার সময় গ্রামের কয়েকজন স্পষ্ট শুনেছিল—জলের নিচ থেকে সে নিজের বাবার নাম ধরে চিৎকার করছে। এমন দৃশ্য দেখে গ্রামের বয়স্করা থরথর করে কেঁপে ওঠে। যেন পুকুরের জলে কিছু ভয়ঙ্কর শক্তি আস্তে আস্তে দখল নিচ্ছে। কিন্তু ভয় শুধুই পুকুরেই সীমাবদ্ধ থাকল না। কয়েকদিনের মধ্যেই দেখা গেল, মাঠের পাশে খড়ের গাদায় হঠাৎই আগুন লেগে যাচ্ছে, যেন অদৃশ্য কেউ শিখা জ্বালিয়ে দিয়েছে। গ্রামের মানুষ একে অপরকে সন্দেহ করতে শুরু করল, কেউ ভেবেছিল শত্রুপক্ষের কাজ, আবার কেউ ফিসফিস করে বলত—“ওটা ভূতের আগুন, মানত শোধ না হলে এই আগুন নিববে না।”
কিন্তু গ্রামের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা শুরু হল যখন মানুষজন মাঝরাতে ঘুম থেকে উঠে নিজের চোখেই দেখতে লাগল মৃত আত্মীয়দের। খোকনের মা এক রাতে আতঙ্কে চিৎকার করে ওঠেন, কারণ তিনি স্পষ্ট দেখেছিলেন তাঁর প্রয়াত স্বামী দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন, মুখে এক অচেনা ম্লান হাসি নিয়ে। অন্য এক বাড়িতে বৃদ্ধা হরিমতী শিউরে উঠে দরজা বন্ধ করে দেন, কারণ তিনি দেখেছিলেন তাঁর বহু আগে মারা যাওয়া মেয়েটি এসে তাঁর ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে ডাকছে—“মা, দরজা খোলো।” মৃতের ফিরে আসা যেন গ্রামটাকে এক অদ্ভুত দুঃস্বপ্নে ঢুকিয়ে দিল। মানুষজন আতঙ্কে রাত জাগতে শুরু করল, মশাল জ্বালিয়ে পাহারা দিতে লাগল, কিন্তু তবুও অদ্ভুত কাণ্ড একের পর এক ঘটতে থাকল। ভয় ধীরে ধীরে গ্রাস করতে লাগল প্রতিটি পরিবারকে, কেউ আর বাইরে যেতে চাইত না, এমনকি দিনের আলোতেও অনেকে পুকুরপাড় বা শ্মশানঘাট এড়িয়ে চলত।
এই সমস্ত ঘটনার জন্য গ্রামের মানুষ ধীরে ধীরে একমুখী সিদ্ধান্তে পৌঁছল—এর নেপথ্যে দোষী আর কেউ নন, অধ্যাপক অরিন্দম। তাদের বিশ্বাস হল, কিছুদিন আগে যে আচার তিনি পুনরায় করতে গিয়ে ভুল মন্ত্রপাঠ করেছিলেন, সেই ভুলই গ্রামে এই অশরীরীর শক্তিকে টেনে এনেছে। অরিন্দম যতই ব্যাখ্যা দিতে চেষ্টা করলেন যে তিনি কেবল গবেষণার অংশ হিসেবে একটি নিরীহ আচার করেছিলেন, গ্রামবাসীরা ততই তাঁর প্রতি রাগ আর ঘৃণা পোষণ করতে লাগল। মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ল—“ওই শহুরে অধ্যাপকই দোষী, ওর হাতেই গ্রামে কাল এসেছে।” রাতের পর রাত মানুষের ভিড় জড়ো হতে শুরু করল অরিন্দমের বাড়ির সামনে, কেউ কেউ তাকে তাড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিল, আবার কেউ কেউ চাইল তাকে বেঁধে শাস্তি দিতে। এমন এক অস্থির সময়ে অরিন্দম নিজের ভেতর ভয় আর অপরাধবোধের অদ্ভুত মিশ্রণ অনুভব করলেন। তাঁর চোখে পড়ছিল গ্রামের আতঙ্কিত মুখগুলো, যেখানে ভয়, সন্দেহ আর ক্রোধ একসঙ্গে মিশে আছে। তিনি বুঝতে পারলেন—মন্ত্রের ভুলে যে দ্বার তিনি অজান্তেই খুলে ফেলেছেন, তা বন্ধ না করতে পারলে কেবল তাঁর জীবন নয়, গোটা গ্রামই ভয়ঙ্কর বিপদের মধ্যে পড়বে।
_
গ্রামে আতঙ্ক দিন দিন বাড়তেই থাকল। মরা মানুষের নাম পুকুরের জলে ভেসে ওঠা, খড়ের ঘরে আগুন লাগা কিংবা হঠাৎ মাঝরাতে দরজার সামনে দাঁড়ানো অচেনা ছায়াগুলো—সব মিলিয়ে গ্রাম যেন এক অভিশপ্ত অচলাবস্থায় পড়ে গেল। গ্রামের মানুষ ধীরে ধীরে নিজেদের ভেতরে ভয় আর সন্দেহে বন্দি হয়ে পড়ছিল। এই ভয়ের ছায়ার মাঝেই সবচেয়ে এগিয়ে এল গ্রামের তরুণ নকুল মাহাতো। নকুল স্বভাবে দৃঢ়চেতা, সাহসী আর প্রভাবশালী, গ্রামে তার কথার যথেষ্ট দাম ছিল। সে বিশ্বাস করতে শুরু করল যে এই সমস্ত অশান্তির কারণ অরিন্দম, বাইরের মানুষ বলে যার ওপর গ্রামবাসীদের ক্রোধ কেন্দ্রীভূত হচ্ছিল। তার যুক্তি ছিল—অরিন্দম আসার আগে গ্রামে এসব ভয়ংকর কিছু ঘটত না, আর এখন প্রতিদিনই নতুন নতুন আতঙ্ক দেখা দিচ্ছে। নকুল গ্রামের যুবকদের একত্রিত করে বলল, “ওকে না তাড়ালে আমরা কেউ শান্তিতে বাঁচব না। বাইরের লোককে এনে আমরা নিজেরাই বিপদ ডেকে এনেছি।” যুবকেরা অর্ধেক ভয়ে, অর্ধেক ক্রোধে একমত হলো। তারা পরিকল্পনা করতে শুরু করল কীভাবে অরিন্দমকে গ্রাম থেকে বের করে দেওয়া যায়। কারও মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ জাগেনি যে এ ভয়াবহতার পেছনে হয়তো অন্য কোনো কারণ থাকতে পারে। সবাই শুধু ভাবছিল, বাইরের মানুষটিকে তাড়ালেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
সেই রাতেই অন্ধকারে মশাল হাতে নকুল ও তার দল অরিন্দমের বাড়ির দিকে এগোতে থাকে। বাতাসে তখন অদ্ভুত কেঁপে ওঠা আওয়াজ, যেন চারপাশের অদৃশ্য কেউ তাদের পথ রোধ করতে চাইছে। কিন্তু নকুল দমবার মানুষ নয়, সে সামনে এগিয়ে চলল, গলা ফাটিয়ে সবাইকে সাহস দিতে লাগল। ঠিক তখনই হঠাৎ গ্রামের ভেতর থেকে ছুটে এল এক আতঙ্কিত আর্তনাদ। শব্দটা নকুলের বাড়ি দিক থেকেই আসছে। দল ছেড়ে দৌড়ে গেল নকুল। গিয়ে দেখে, তার ছোট বোন চঞ্চলা মাটিতে পড়ে কাঁপছে, তার চোখ উল্টে গেছে, মুখ দিয়ে ফেনা বেরোচ্ছে। পরিবারের লোকেরা চিৎকার করে বলল, কিছুক্ষণ আগে জানলা খুলে সে এক অচেনা ছায়ামূর্তি ঘরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিল। সেই ছায়া ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে আসে, আর হঠাৎ করে চঞ্চলা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। নকুল সেই দৃশ্য দেখে থমকে গেল। যাকে তাড়াতে উদ্যত হয়েছিল সে বাইরের লোক, কিন্তু এই অশরীরী ভয়ঙ্কর রূপ স্পষ্ট করল যে সমস্যা শুধু একজন মানুষের উপস্থিতির জন্য নয়। চারপাশে যেন এক অদৃশ্য অশুভ শক্তি ক্রমেই জেঁকে বসছে। নকুল প্রথমবারের মতো বুঝতে পারল, বাইরের লোককে তাড়ালেই শান্তি ফিরবে না। তার চোখে আতঙ্ক ভেসে উঠল, বুকের ভেতর অজানা ভয়ের ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল।
চঞ্চলার অসুস্থতা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল। ওঝারা মন্ত্র পড়ে ঝাড়ফুঁক করল, কিন্তু কোনো কাজ হলো না। গ্রামের অনেকেই একসময় বলল, “দেখেছিস তো, বাইরের মানুষকে অভিশাপ দেওয়ার আগে নিজের বাড়ির কী অবস্থা হলো।” নকুল এবার বুঝল, যে আগুন সে জ্বালাতে যাচ্ছিল, তা আসলে তার নিজের দিকেই ঘুরে আসছে। তার নেতৃত্বে গ্রামবাসীরা অরিন্দমকে ঘিরে ধরলেও এবার তাদের চোখে অন্য রকম প্রশ্ন দেখা দিল। সত্যিই কি অরিন্দমই এই অশান্তির কারণ? নাকি সে-ও এই অশুভ শক্তির শিকার? নকুল নিজের ভেতর দ্বন্দ্বে ভুগতে লাগল—একদিকে তার অহংকার, অন্যদিকে বোনের অবস্থা। চঞ্চলার ঠোঁট নড়ল, অচেনা ফিসফিসে স্বরে সে বলে উঠল, “ওকে দোষ দিও না… ও-ই তোমাদের বাঁচাতে এসেছে…” এই রহস্যময় বাক্য সবাইকে স্তব্ধ করে দিল। গ্রামের মানুষদের বুকের ভেতর জমে থাকা ক্রোধ মুহূর্তেই বিভ্রান্তি আর শঙ্কায় রূপ নিল। নকুল মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকল, আর মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল—সে অন্ধ ক্রোধে আর সিদ্ধান্ত নেবে না। এখন থেকে সত্যিই কী ঘটছে তা জানার চেষ্টা করবে, কারণ স্পষ্ট বোঝা গেল—এই লড়াই শুধু বাইরের লোককে গ্রামছাড়া করার নয়, বরং অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে টিকে থাকার।
_
জগেন হাঁসদা অনেকদিন চুপচাপ ছিলেন, অরিন্দম বারবার প্রশ্ন করলেও তিনি স্পষ্ট করে কিছু বলতেন না। কিন্তু সেদিন সন্ধ্যায়, ঝড়ের আগে আঁধার নেমে আসছিল গ্রামে, বাতাসে এক অজানা অস্থিরতা জমাট বেঁধেছিল। অরিন্দম সেই অস্থিরতার ভার অনুভব করছিলেন—যেন গ্রামজুড়ে কোথাও অদৃশ্য চোখেরা তাকিয়ে আছে। সেই সময়ই জগেন তাঁকে এক কোণে টেনে নিয়ে এসে বললেন, “আপনি যদি সত্যিই জানতে চান কেন এই গ্রাম এমন অশান্তিতে ভুগছে, তবে আমার সঙ্গে আসুন।” তাঁরা দু’জনে গ্রাম পেরিয়ে জঙ্গলের দিকে গেলেন। গাছের অন্ধকার ছায়া, পাখিদের হঠাৎ ডানা ঝাপটানো, আর বাতাসে ধুলো উড়ে যাওয়া—সব মিলিয়ে পরিবেশটা যেন একেবারে গম্ভীর আর ভয়ানক। কিছু দূরে একটি পুরনো বটগাছের নীচে দাঁড়িয়ে জগেন এক নিঃশ্বাসে বলতে শুরু করলেন—“এখানে শুধু মন্ত্র বা তন্ত্র নেই, আছে রক্তাক্ত ইতিহাস।” অরিন্দম অবাক হয়ে তাঁর মুখের দিকে তাকালেন। জগেনের কণ্ঠে কাঁপন থাকলেও চোখে ছিল দৃঢ়তা। তিনি জানালেন, ব্রিটিশ আমলে এক ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ ঘটেছিল এই গ্রামে। তখন সাঁওতাল বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়েছিল চারপাশে। এই গ্রাম ছিল বিদ্রোহীদের গোপন আশ্রয়স্থল, যেখানে শতাধিক সাঁওতাল একত্রিত হয়েছিল। কিন্তু ব্রিটিশ সেনারা খবর পেয়ে হঠাৎ রাতের অন্ধকারে গ্রাম ঘিরে ফেলে। একে একে সবাইকে ধরে এনে গুলি করে মেরে ফেলা হয়। চিৎকার, রক্ত, আর্তনাদে সেই রাত ভরে উঠেছিল, আর যারা পালাতে পেরেছিল তাদেরও ধরার জন্য নৃশংস শিকার শুরু হয়েছিল। শেষমেশ শতাধিক দেহ জঙ্গলের মাটির নীচে গচ্ছিত করা হয়েছিল, চিহ্ন মুছে দেওয়ার জন্য। কিন্তু ইতিহাসের সেই ক্ষত থেকে রক্ত শুকোলেও আত্মাদের কান্না শুকায়নি।
অরিন্দম স্তব্ধ হয়ে শুনছিলেন। জগেন জানালেন, সেই সময় গ্রামের পুরনো শবর তান্ত্রিকরা আত্মাদের শান্তি দেওয়ার জন্য এক বিশেষ মন্ত্র রচনা করেছিলেন। মন্ত্রটির উদ্দেশ্য ছিল, যারা অন্যায়ভাবে নিহত হয়েছে, তারা যেন অন্তত পরপারে শান্তি পায়, তাদের আর্তনাদ যেন গ্রামজুড়ে চিরকাল ঘুরে বেড়ায় না। বহু বছর ধরে সেই মন্ত্রই গ্রামকে রক্ষা করেছিল। মন্ত্রপাঠের মাধ্যমে মৃতদের আত্মাকে আহ্বান করে, তাদের যন্ত্রণা বুঝে, আর প্রার্থনার মাধ্যমে মুক্তি দেওয়া হত। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই মন্ত্র বিকৃত হয়ে যায়। নতুন প্রজন্মের কিছু লোভী ও স্বার্থপর তান্ত্রিক মন্ত্রটিকে ব্যবহার করতে শুরু করে ভয় দেখানোর জন্য, নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করার জন্য। শান্তির জন্য তৈরি মন্ত্র পরিণত হয় প্রতিশোধের সেতুতে। মৃতদের আত্মা আর মুক্তি পায় না, বরং মন্ত্রের বাঁধনে আটকে পড়ে। আর সেই বাঁধনে আটকে পড়েই আজকের এই অশরীরীদের উন্মত্ততা—যেন তারা মুক্তি চাইছে, আবার প্রতিশোধও চাইছে। জগেনের কণ্ঠে ভয় আর বেদনা একসঙ্গে বাজছিল। তিনি বললেন, “আপনি যে অশরীরীদের দেখেছেন, তারা আসলে এই মাটির সন্তান। ওরা শত্রু নয়, ওরা কেবল মুক্তির পথ খুঁজছে। কিন্তু এই মন্ত্র এখন আর মুক্তি দিতে পারে না, কেবল অশান্তি ডেকে আনে।” অরিন্দমের বুকটা ভারী হয়ে উঠল। তিনি বুঝতে পারলেন, এতদিন যেটাকে তিনি কুসংস্কার বা লোককথা ভেবেছিলেন, তার ভিতরে লুকিয়ে আছে রক্তমাখা ইতিহাস, অমানবিক হত্যাযজ্ঞের প্রতিধ্বনি।
কথা শেষ করে জগেন দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, যেন বুকের ভেতর জমে থাকা ভার কিছুটা হালকা হলো। তিনি বললেন, “এখন আপনি বুঝতে পারছেন, কেন শুধু বাইরের শত্রুকে তাড়িয়ে বা মন্ত্র উচ্চারণ করে এই সমস্যার সমাধান হবে না। আসল সমাধান লুকিয়ে আছে আত্মাদের শান্তি দেওয়ায়। যদি তাদের যন্ত্রণা স্বীকার না করা হয়, যদি ইতিহাসের ক্ষত মেনে নেওয়া না হয়, তবে এই অশান্তি কখনও থামবে না।” অরিন্দম নীরব রইলেন। তাঁর মনে হল, গ্রামবাসীরা আসলে ইতিহাসকে ভুলে যেতে চেয়েছিল, ভয়ঙ্কর অতীতকে মুছে ফেলতে চেয়েছিল। কিন্তু ইতিহাস ভুলে গেলেও আত্মারা ভুলে যায় না, তাদের দুঃখ গ্রামে ছায়ার মতো লেগে থাকে। আর এখন, সেই দুঃখই রূপ নিয়েছে অভিশাপে। অরিন্দম অনুভব করলেন, তাঁর সামনে এক বিরাট দায়িত্ব এসে দাঁড়িয়েছে—শুধু গবেষক হিসেবে নয়, মানুষের মতো। তাঁকে এখন চেষ্টা করতে হবে, কীভাবে এই আত্মাদের মুক্তি দেওয়া যায়, কীভাবে বিকৃত মন্ত্রকে ভেঙে সত্যিকারের শান্তির পথ খুঁজে পাওয়া যায়। দূরে বজ্রপাতের আলো অন্ধকার আকাশ ছিঁড়ে দিল, আর সেই আলোয় অরিন্দম দেখলেন, জগেন হাঁসদার মুখে যেন বহু বছরের লুকোনো বেদনা ভেসে উঠেছে। গ্রামের নীরব ইতিহাস যেন দু’জন মানুষের সামনে হঠাৎ শব্দ হয়ে ফেটে পড়ল। আর সেই শব্দের ভেতরেই লুকিয়ে ছিল মুক্তির একমাত্র সূত্র—মৃতদের সম্মান জানিয়ে তাদের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেওয়া।
_
অন্ধকার নেমে এসেছে দ্রুত, যেন সূর্য অস্ত যাবার মুহূর্তটুকুও গ্রামকে আর আলো দিতে চাইছিল না। আকাশ জুড়ে ছেয়ে আছে কালো মেঘ, দূরে বাজ পড়ছে টপটপ শব্দে, বাতাসে আগাম ভয়ঙ্কর ঝড়ের আভাস। ভৈরব পহান এক হাতে প্রদীপ আর অন্য হাতে ধূপকাঠি ধরে আচারস্থলের মাঝখানে বসেছেন, তার চোখ দুটো গভীর আর ভয়ংকর স্থিরতায় পূর্ণ। চারপাশে দাঁড়িয়ে আছে অরিন্দম, রূপা আর নকুল, প্রত্যেকের মুখে উদ্বেগের ছাপ। গ্রামের কেন্দ্রে পুরোনো বটগাছের নীচে এই আচার শুরু হওয়ার কথা, কারণ গ্রামের প্রাচীন বিশ্বাস অনুযায়ী ওই গাছই ছিল সব অশরীরীর আবাস। ধূপ-ঢাক বাজানো শুরু হতেই ভয়ঙ্কর গম্ভীর আওয়াজে বাতাস ভরে উঠল, গাছের পাতাগুলো অস্বাভাবিকভাবে কাঁপতে লাগল। ভৈরব পহান শান্ত অথচ দৃঢ় কণ্ঠে মন্ত্র উচ্চারণ শুরু করলেন—একটার পর একটা দীর্ঘ, জটিল মন্ত্র যা বহুকাল ধরে শুধুই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে চলে আসছে। আগুন জ্বলে উঠল কাঠের স্তূপে, ধোঁয়া ভেসে উঠতে লাগল আকাশে, আর গ্রামজুড়ে এক অদ্ভুত শীতলতা নেমে এলো, যেন পৃথিবীর সমস্ত উষ্ণতা মুহূর্তে হারিয়ে গেছে।
আচার চলতে থাকায় অরিন্দম ও রূপা ক্রমে নিজেদের সাহস জড়ো করল, কিন্তু নকুলের বুকের ভেতর শিরশিরে ভয় লুকিয়ে ছিল। প্রতিটি মন্ত্রোচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে যেন চারপাশে অদৃশ্য কিছু নড়ে উঠছে, বাতাসের মধ্যে গর্জন শোনা যাচ্ছে, যেন শত শত কণ্ঠ মিলিয়ে চিৎকার করছে। হঠাৎই রূপার কানে ভেসে এলো তার নাম ধরে ডাক—স্বপ্নের মতো, অথচ তীব্র বাস্তব। সে ভয় পেয়ে চারদিকে তাকাল, দেখল কেউ নেই, কিন্তু বাতাসের ভেতর অস্পষ্ট ছায়া নড়ছে। ভৈরব পহান থামলেন না, বরং আরও জোরে মন্ত্র পড়তে লাগলেন, হাতের প্রদীপ উঁচু করে রাখলেন। আগুন যেন এক অদৃশ্য শক্তির সঙ্গে যুদ্ধ করছে, একবার উঁচু হয়ে ওঠে, আবার প্রায় নিভে যায়। নকুল হঠাৎ শুনতে পেল এক পরিচিত কণ্ঠ—তার মৃত বাবার কণ্ঠস্বর—যেন তাকে বলছে, “থামো, নকুল, এইসব বৃথা!” সে কেঁপে উঠল, কিন্তু রূপা তার হাত চেপে ধরে বলল, “পিছিয়ে গেলে আমরা সবাই শেষ।” তাদের শরীরে শিহরণ ছড়িয়ে গেল, কিন্তু এখন আর ফেরার পথ নেই। চারদিকে কালবৈশাখীর মতো ঝড় উঠেছে, মাটি কাঁপছে, আচারস্থলের মাটিতে ফাটল ধরছে, আর ভৈরব পহানের কণ্ঠ যেন বজ্রের মতো গর্জে উঠছে অন্ধকারে।
এই অস্থিরতার মধ্যেই ঘটল ভয়ঙ্কর মুহূর্ত—হঠাৎ আকাশ থেকে এক বিদ্যুৎ ঠিক আচারস্থলের কাছেই পড়ল, এবং সেই আলোতে স্পষ্ট দেখা গেল অসংখ্য আত্মার অবয়ব, তারা গাছের শেকড় থেকে বেরিয়ে এসে বাতাসে ঘূর্ণায়মান। তাদের চোখ জ্বলছে আগুনের মতো, তারা হাত বাড়িয়ে যেন ভৈরব পহানকে থামাতে চাইছে। রূপা কান্না থামাতে পারছিল না, অরিন্দম নিজের বুক চেপে দাঁত কামড়ে লড়ছিল, আর নকুল তলোয়ার হাতে দাঁড়িয়েও জানত এই লড়াই শারীরিক নয়, সম্পূর্ণ মানসিক ও আধ্যাত্মিক। ভৈরব পহান তখন প্রায় ধ্বস্ত, তাঁর কণ্ঠ কাঁপছে, কিন্তু তিনি থামলেন না। আগুন হঠাৎ প্রজ্জ্বলিত হয়ে উঠল, ঝড়ের তীব্রতা বেড়ে গেল, ধূপ-ঢাকের শব্দ যেন আকাশ বিদীর্ণ করে ফেলল। একসময় মনে হলো আচার ভেস্তে যাবে, আত্মারা মুক্তি পাবে না, বরং আরও রক্তপিপাসু হয়ে উঠবে। ঠিক তখনই রূপা সাহস করে এগিয়ে এসে ভৈরব পহানের পাশে দাঁড়িয়ে মন্ত্র উচ্চারণে তাকে সহায়তা করল। তার কণ্ঠ ভীত হলেও আন্তরিকতায় পূর্ণ। নকুল চোখ বন্ধ করে হাতজোড় করল, অরিন্দম শেষ শক্তি দিয়ে ধূপ-ঢাক বাজাতে থাকল। হঠাৎই এক প্রচণ্ড বিস্ফোরণের মতো শব্দ হলো, আগুন লেলিহান শিখায় আকাশ ছুঁলো, আর আত্মাদের আর্তনাদ প্রতিধ্বনির মতো আকাশে ছড়িয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ পরে ঝড় থেমে গেল, ধোঁয়াশার ভেতর কেবল বটগাছ আর নিভে যাওয়া অগ্নিকুণ্ড। চারজনই হাঁপাতে হাঁপাতে একে অপরের দিকে তাকাল—তারা জানত না আচার সফল হয়েছে কি ব্যর্থ। কিন্তু তাদের চোখে স্পষ্ট ছিল—তারা চরম মুহূর্তে ভয়কে অতিক্রম করেছে, এবং যাই ঘটুক, সেই রাত তাদের গ্রামকে নতুন ইতিহাসের মুখোমুখি করেছে।
_
শেষ রাতটা যেন গোটা গ্রামকে অবসাদের এক অচেনা ছায়ায় ঢেকে রেখেছিল। নদীর ধারে বাঁশবনের ফাঁক দিয়ে ঠান্ডা হাওয়া বয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু সেই হাওয়াতেও ছিল অদ্ভুত এক ভারী শীতলতা, যা মানুষের শরীরের গভীর পর্যন্ত পৌঁছে শিরদাঁড়া কাঁপিয়ে তুলছিল। অধ্যাপক অরিন্দম জানতেন, আর কোনো সময় নেই, মন্ত্র এখনই সম্পূর্ণ করতে হবে, না হলে এই গ্রাম চিরকালের মতো অশান্ত আত্মাদের কবলে পড়বে। গ্রামের মানুষদের ভিড় উঠোন জুড়ে দাঁড়িয়ে ছিল, কারও চোখে ভয়, কারও চোখে আকুতি—সকলেই যেন নিঃশব্দে তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে। অগ্নিকুণ্ডের পাশে বসে তিনি শেষবারের মতো মন্ত্রোচ্চারণ শুরু করলেন। তাঁর কণ্ঠ গম্ভীর, শক্ত, কিন্তু কোথাও যেন মৃত্যুকে সামনে দাঁড়িয়ে দেখার মতো এক গভীর ক্লান্তি ভর করেছিল। বাঁশির সুর বাজতে শুরু করল—সেই একই সুর, যা এতদিন আত্মাদের ডাক দিয়েছিল, এবার তা হয়ে উঠল বিদায়ের মেলডি। অন্ধকার থেকে ছায়ার মতো আত্মারা ধীরে ধীরে বেরিয়ে এলো—চোখে শূন্য দৃষ্টি, দেহ নেই, কেবল মুখগুলোতে দীর্ঘ যন্ত্রণার চিহ্ন। গ্রামের বৃদ্ধরা কাঁপা গলায় মন্ত্রের প্রতিধ্বনি তুলতে লাগলেন, কিন্তু শিউরে উঠছিলেন প্রত্যেকবার, কারণ তারা স্পষ্টই বুঝতে পারছিলেন—এ যেন শুধু এক আচার নয়, বরং জীবন-মৃত্যুর মাঝখানে দাঁড়িয়ে এক সেতুর খোলা-বন্ধের আয়োজন।
হঠাৎ আগুনের শিখা উঁচু হয়ে উঠল, সেই আলোয় প্রতিটি আত্মার ছায়া স্পষ্ট দেখা গেল। কেউ কৃষক, কেউ বালক, কেউবা নারী—যাদের জীবন বহু আগেই মাটির নিচে চাপা পড়ে গেছে। তারা এগিয়ে এলো অরিন্দমের দিকে, যেন ডাকছে তাকে নিজেদের সঙ্গে নিয়ে যেতে। রূপা চিৎকার করে উঠেছিল—“না স্যার! থামুন! আপনি ছেড়ে দেবেন না!” কিন্তু অরিন্দম যেন আর শুনতে পাচ্ছিলেন না, তাঁর দৃষ্টি চলে গিয়েছিল আগুনের কেন্দ্রবিন্দুর ওপারে, যেখানে এক অদৃশ্য সেতু ধীরে ধীরে খোলার অপেক্ষায়। তিনি জোরে জোরে শেষ মন্ত্র উচ্চারণ করতে লাগলেন, আর তার প্রতিটি শব্দে চারদিকের বাতাস আরও ভারী হয়ে উঠছিল। গ্রামের পহান ভৈরব হাঁটু গেড়ে প্রার্থনা করছিলেন, যেন এই যাত্রা সফল হয়, কিন্তু তার কণ্ঠও কেঁপে যাচ্ছিল—কারণ তিনি জানতেন, এই আচার শেষ করার মানে একটাই—প্রাণ বিসর্জন। আত্মারা তখন বাঁশির সুরের সাথে সাথে দুলছিল, তাদের চোখের ভয়াবহতা মিলিয়ে গিয়ে এক প্রশান্তি ছড়িয়ে পড়ছিল চারদিকে। রূপা ছুটে গিয়েছিল অরিন্দমের কাছে, কিন্তু আগুনের তাপে কাছে পৌঁছাতে পারল না, এক অদৃশ্য প্রাচীর যেন তাকে আটকে দিল। অরিন্দম শেষবারের মতো চোখ তুলে রূপার দিকে তাকালেন, সেই দৃষ্টিতে ছিল পিতার মতো স্নেহ, শিক্ষকের মতো দৃঢ়তা, আর এক যোদ্ধার মতো আত্মসমর্পণের সাহস।
আলোর ঝলকানি হঠাৎ এতটাই তীব্র হলো যে গ্রামের সবাই চোখ বন্ধ করে ফেলল। বাঁশির সুর ক্রমে ক্ষীণ হয়ে মিলিয়ে গেল, আত্মাদের ছায়াগুলো ধীরে ধীরে বাতাসে ভেসে গিয়ে এক বিন্দু আলোকরেখায় পরিণত হলো। ভোরের প্রথম আলো ফুটতেই পুরো গ্রাম যেন আবার প্রাণ ফিরে পেল—পাখির ডাক শোনা গেল, বাতাসে শান্তির গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল। কিন্তু অরিন্দম আর ফিরলেন না। অগ্নিকুণ্ড নিভে গিয়েছিল, চারদিকে কেবল ছাই আর ভাঙা কাঠের গন্ধ ভেসে আসছিল। গ্রামের মানুষরা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল, কারও মুখে কোনো শব্দ নেই। রূপা হাঁটু গেড়ে বসে কান্নায় ভেঙে পড়ল—“শবর মন্ত্র শুধু আচার নয়, এ এক সেতু—যা একবার খোলালে তার দাম দিতে হয়।” তার কণ্ঠস্বর কাঁপছিল, চোখের জল মাটিতে পড়ছিল, যেন সেই মাটিও আজ অধ্যাপকের ত্যাগের সাক্ষী। ভৈরব ধীরে ধীরে উঠে এসে আকাশের দিকে হাত জোড় করলেন, তাঁর চোখে জল গড়িয়ে পড়ছিল। তিনি জানতেন, এই গ্রাম বেঁচে গেলেও, অরিন্দমের আত্মত্যাগ চিরকাল তাদের ইতিহাসে থেকে যাবে। মানুষরা ধীরে ধীরে বাড়ি ফিরে গেল, কিন্তু কেউ আর কিছু বলতে পারল না। যেন সবাই বুঝে গিয়েছিল—মৃত্যুর সেতু বন্ধ করতে হলে একজনকে সেই সেতুর ওপারে দাঁড়াতে হয়, আর অরিন্দম সেই যাত্রার চিরন্তন পথিক হয়ে রইলেন।
শেষ




