Bangla - ভূতের গল্প

শবঘরের গান

Spread the love

প্রবাল ধর


উত্তরবঙ্গের এক বিস্মৃতপ্রায় হাসপাতাল—দূর শহর থেকে বহু দূরে, চা-বাগান ঘেরা রাস্তায় কুয়াশা যেন চিরকালীন পর্দা হয়ে ঝুলে থাকে। চারদিক নিস্তব্ধ, মাঝে মাঝে শোনা যায় বন থেকে হুহু করে ওঠা হাওয়ার ডাক অথবা দূরে কোথাও বাঁশ ঝাড়ে দুষ্টু পেঁচাদের কুলকুল শব্দ। এই হাসপাতালটি দিনের আলোয় যেমন ফাঁকা লাগে, রাতের অন্ধকারে তা আরও বেশি নিঃসঙ্গ ও ভয়ার্ত হয়ে ওঠে। নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত রাহুল হালদার সেই হাসপাতালের শবঘরের রাত্রিকালীন রক্ষী হিসেবে প্রথম রাতে হাজির হয়। মা’র কাছ থেকে আশীর্বাদ নিয়ে বেরোনো ছেলেটির মনেও কিছুটা দোলাচল ছিল—এমন অদ্ভুত জায়গায় কাজ, তাও আবার শবঘরে! কিন্তু দারিদ্র্য মানুষকে অনেক কিছু শেখায়, এবং সে ভয় পেতে শেখে না—অন্তত বাহ্যিকভাবে। ওয়ার্ডবয়েরা বলেছিল, “তুমি শবঘরে থাকবা, ভাই? শুক্র রাইতের দিকে খেয়াল রাইখো, অইখানে গানের আওয়াজ আসে।” রাহুল হাসতে হাসতেই তাদের কথা উড়িয়ে দেয়, এমন সব গাঁগাঁ গল্পে সে বিশ্বাস করে না। প্রথম রাতের ঠান্ডা, শবঘরের চারপাশে রাখা পুরনো কাঠের সিন্দুক, ভাঙা জানালার কাঁচে বারবার ধাক্কা খেতে থাকা পাতা—এসব তাকে ভাবায় না যতটা ভাবায় দেয়ালের ওপর জমে থাকা ছোপ ছোপ ছাঁচের ধূসরতা, যেন কোনো দুঃখ জমে আছে বছরের পর বছর।

রাত গড়িয়ে মধ্যরাত। পুরো হাসপাতাল চুপচাপ—সদ্য জন্মানো শিশুর কান্না, দূরের কুকুরের ডাক অথবা অক্সিজেন সিলিন্ডারের হালকা ফিসফিস ছাড়া আর কিছুই শোনা যায় না। রাহুল তখন দরজার পাশে বসে, গায়ে মাফলার জড়িয়ে, নীল জ্যাকেটের পকেটে গরম রাখা রুমালি দিয়ে মুখ মুছে নিচ্ছিল। হঠাৎ—কান পেতে কিছু শুনল সে। দূরে, হাসপাতালের দক্ষিণ দিকের শেষ প্রান্তে—যেখানে শবঘর, ঠিক সেখান থেকেই আসছে মৃদু সুর। গানের সুর। মৃদু, ভাঙা গলায় এক নারী কণ্ঠ গান গাইছে—ঠিক যেন রবীন্দ্রসংগীত, কিন্তু তার মধ্যে এমন এক বিষণ্নতা মেশানো যেন প্রতিটি সুরে আত্মার আকুতি। “জানালা খোলো, তাহারে দেখো, কারে চাহে এই পাষাণ রাত…”—রাহুল এক ঝটকায় উঠে দাঁড়ায়। হৃদস্পন্দন দ্রুত হচ্ছে, হাত কাঁপছে, ঠোঁট শুকিয়ে এসেছে। সে ধীরে ধীরে এগোয়, পায়ে পায়ে নরম করে—যেন সুরটিকে ভয় না দেখিয়ে কাছে যেতে চায়। শবঘরের দরজার বাইরে এসে সে দেখে—সবকিছু ঠিকঠাক, তালা লেগে আছে, কিন্তু ভেতর থেকে গান এখনও আসছে। সে তালার ফাঁক দিয়ে কান রাখে, গলা কাঁপতে থাকে তার। হঠাৎ, পেছনে হাওয়ার ঝাপটা লাগে—কে যেন নাম ধরে ডাকছে, “রাহুল…” সে পিছন ফিরে তাকায়—কেউ নেই। ভয়ে সে দৌড়ে চলে আসে মূল ওয়ার্ডের দিকে, যেখানে ডিউটির নার্স মীনাক্ষী তখন ওষুধ নিচ্ছিলেন। তাঁকে সবটা বলতেই তিনি এক ঝলকে তাকিয়ে বলেন, “শবঘরের গানের গল্প শোনোনি? বছরের পর বছর ধরে চলছে। যারাই শোনে, তারা সহজে স্বাভাবিক থাকে না। তুমি ভালো করেই শুরু করলে রে।” রাহুল তখন কাঁপা গলায় বলে, “কিন্তু ওই সুরটা… আমি চিনি… ওই গান আমার মা গাইতেন, ছোটবেলায়…”

সকালে রাহুলের চোখে ঘুম নেই, কানে সুর বেজেই চলেছে। হাসপাতালের করিডোর ধরে হাঁটতে হাঁটতে সে একপ্রকার ছায়া হয়ে উঠেছে। ডঃ অনুরাধা সেনগুপ্ত তার অস্থির চেহারা দেখে জিজ্ঞেস করেন, “তুমি কি সেই গান শুনেছ?” রাহুল কিছু না বললেও তাঁর চোখেই ছিল উত্তরের ছাপ। ডাক্তারের মুখ কিছুটা কঠিন হয়ে উঠল। “তোমার আগেও পাঁচজন গার্ড এসেছে। কেউ পাগল, কেউ নিরুদ্দেশ। আমি ওই গল্পে বিশ্বাস করতাম না, কিন্তু… আমি নিজেও একবার শুনেছি গানটা। তার পর থেকে প্রতিরাতে ঘুম ভেঙে যায়,” তিনি বললেন, কণ্ঠে হতাশা আর রহস্যের ভার। রাহুল জানতে চায়—কে গায় এই গান? মৃতের আত্মা, না কেউ জীবিত? কিন্তু উত্তর নেই কারো কাছেই। পুরনো এক ফাইলঘরে সে আবিষ্কার করে একটি খবরের কাটিং—১৯৭৮ সালের। সেখানে লেখা, “হাসপাতালের শবঘরে আত্মহত্যা করল এক সঙ্গীতশিল্পী মহিলা—অনামিকা নামে। তার শরীর পাওয়া যায় নি, শুধু সাদা শাড়ি আর বেনারসীর ওড়না পড়ে ছিল একাধিক মৃতদেহের পাশে।” কাঁপা কাঁপা হাতে ফাইলটা বন্ধ করে রাহুল ভাবে—তবে কি গান সেই অনামিকার? তবে সে কেন ডাকছে? আর কেন এই গান শুনে মানুষ পাগল হয়ে যাচ্ছে? মাথার মধ্যে সুর গুঞ্জন করতে থাকে, যেন তার স্নায়ুর গায়ে গায়ে ঢেউয়ের মতো বয়ে যাচ্ছে। সেদিন রাতে সে আবার যায় শবঘরের দিকে—তালা বন্ধ, বাতি নিভে আসছে, কিন্তু কান পেতে শুনে—একই গান আবার বেজে উঠছে, এবার আরও গভীর, আরও বিষাদময়, যেন কে যেন শোকপত্র লিখছে সুরে সুরে।

পরদিন হাসপাতাল চত্বরে কুয়াশা ঘন হয়ে আসে দুপুরেও, যেন রাত্রির ছায়া দিনের আকাশেও মেখে থাকে। রাহুল অফিস কক্ষে ডঃ অনুরাধার সামনে বসে থাকে চুপচাপ, তার চোখের নিচে কালি, কথার গতি মন্দ। ডাক্তার এক ফাইলের পৃষ্ঠা ওলটাতে ওলটাতে বলে ওঠেন, “তুমি চুপ করে থাকলে চলবে না, রাহুল। তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে তুমি শুধু গান শুনোনি, কিছু আরও দেখেছ।” রাহুল এক নিঃশ্বাসে বলে ওঠে—“হ্যাঁ, দেখেছিলাম। কাল রাতে আবার গেছিলাম শবঘরের সামনে। সুরের তানে এমন কিছু ছিল, মনে হল দরজার ফাঁক গলে আলো বেরোচ্ছে। এক নারী অবয়ব—শাদা শাড়ি, মুখ দেখা যাচ্ছিল না, কিন্তু চোখ দুটি যেন ছায়ার মধ্যেও জ্বলজ্বল করছিল। সে কেবল গান গাইছিল, আমায় দেখেনি। হঠাৎ সুর থেমে গেলে দরজায় নড়ে উঠল, মনে হল তালা খুলতে চাইছে।” এই শুনে অনুরাধা কিছু না বলে ফাইল বন্ধ করলেন। তাঁর চোখে এবার বিস্ময় ও আতঙ্ক মিলেমিশে এক রকম অসহায়তা। তিনি ধীরে বলে ওঠেন—“১৯৭৮ সালের সেই ঘটনা, তুমি কি জানো ভালোভাবে?” রাহুল মাথা নাড়ে। অনুরাধা বললেন, “ওই সময় এক সঙ্গীতশিল্পী মহিলা, অনামিকা রায়, মানসিক রোগ বিভাগে ভর্তি ছিলেন। বুদ্ধিমান, সুরেলা কণ্ঠ—কিন্তু কথা বলতেন না। একদিন হঠাৎ নিখোঁজ। ওর ওষুধের কাগজপত্র, চিহ্ন—সব ছিল শবঘরে। তখনকার কর্মীরা বলত, হয়তো সে আত্মহত্যা করেছিল, কিন্তু তার মৃতদেহ পাওয়া যায়নি। আশ্চর্যভাবে, এরপর থেকেই ওই ঘরে শুক্র রাতে গানের আওয়াজ পাওয়া যেত।” রাহুল মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছিল। সে বুঝতে পারছিল—এই গানের সঙ্গে তার জীবনের কোনো লুকোনো যোগ রয়েছে। সে বলে ওঠে, “আমার মা ছোটবেলায় আমাকে যে গান শোনাতেন, তার সুর একদম মিলছে… তবে মা কখনো বলেননি কোথা থেকে গানটা পেয়েছিলেন।”

ওই দিন বিকেলে রাহুল হাসপাতালের পুরনো রেকর্ডরুমে যায়, যেখানে ধুলোঢাকা রেজিস্টার, ধ্বসে পড়া কাঁচ ও পুরনো স্টেথোস্কোপের কঙ্কালগুলো পড়ে থাকে। তার চোখ পড়ে একটি বাদামি ফোল্ডারে—তাতে লেখা, “প্যাথোলজি ইনসিডেন্ট রিপোর্ট – ১৯৭৮”। সে ফোল্ডার খুলে দেখে একটি ফাঁকা বিছানার ছবি, পাশে গানের নোটেশন, এবং একটি হস্তাক্ষরে লেখা পঙক্তি—“তুমি যদি আমায় না চেনো, আমি ডেকে যাব গান হয়ে।” সেই কাগজের নিচে সই—“অনামিকা রায়।” রাহুল অবাক হয়ে পড়ে—এই গান তবে মৃত্যুর পরেও বেঁচে আছে? কে এই অনামিকা? কেন সে প্রতি শুক্র রাতে ফিরে আসে? হঠাৎ পাশের জানালা খুলে গিয়ে বাতাস ঢোকে, ফোল্ডার উড়ে যায়, আর তার পায়ের কাছে এসে পড়ে একটি পুরনো ক্যাসেট—কোনো নাম নেই। পরের দিন রাহুল সেটি নিয়ে যায় নার্স মীনাক্ষীর কাছে, যিনি একসময় সঙ্গীত শিখতেন। ক্যাসেট চালাতেই ঘরে ভরে ওঠে সুমধুর অথচ বিষণ্ন এক কণ্ঠ—অত্যন্ত পুরনো রেকর্ডিং, কিন্তু প্রতিটি সুর যেন জীবন্ত। মীনাক্ষী অবাক হয়ে বলে ওঠেন—“এ সুর… এ তো আমার গুরুর গুরুর গাওয়া সুরের ধাঁচে। কিন্তু কেউ শেখায়নি এই গান। মনে হয় যেন আত্মা নিজেই সুর সৃষ্টি করেছে। ওর মধ্যে ব্যথা আছে, টান আছে, আহ্বান আছে। ভয় আছে, কিন্তু রূপ আছে।” রাহুল ভাবে, তবে কি এ গান আসলে কারোর না বলা কথা? কেউ যেন মৃতদের মধ্যেও গান গেয়ে ডাকছে জীবিতদের… হয়তো সে গান শোনার মধ্যেই রয়েছে ফাঁদ—বা মুক্তি। সে বুঝতে পারে, এই গল্পের কেন্দ্রবিন্দু অনামিকা নয়, বরং তার নিজের অতীত, তার মায়ের অতীতও কিছু না কিছু লুকিয়ে রেখেছে। সেই রাতেই সে সিদ্ধান্ত নেয়—পরের শুক্র রাতে সে শবঘরে ঢুকবেই, গান পুরোটা শুনবেই। কেননা প্রশ্ন শুধু সুরের নয়—প্রশ্ন আত্মার, স্মৃতির, আর এক হারিয়ে যাওয়া নারীর আহ্বানের—যার গলা হয়তো এখনও শবের ভিতর গান হয়ে ঘোরে।

বৃহস্পতিবার রাত। হাসপাতাল নিঃশব্দ, আকাশে মেঘ, জ্যোৎস্নার বদলে ঘন অন্ধকারে গাছের ছায়া যেন মাটির গায়ে আঁচড় কাটছে। রাহুল নিজের ঘরে বসে পুরনো সেই ক্যাসেটটি বারবার চালাচ্ছে। প্রতি বার শোনা গান যেন নতুন কোন ছায়া নিয়ে ফিরে আসে। এবার সে কেবল সুর শুনছে না, সে চেষ্টাও করছে সুরের ফাঁকে লুকিয়ে থাকা দমবন্ধ কান্না, চেপে রাখা কথাগুলোকে ধরতে। এমনকি মাঝে মাঝে মনে হয় গান থেমে যাওয়ার মুহূর্তে কারো নিঃশ্বাস কেঁপে উঠছে—যেন দীর্ঘ অপেক্ষার পরে কেউ আবার গাইতে শুরু করার সাহস খুঁজছে। পরের দিন শুক্র। বিকেল হতেই রাহুল রেডি হয়—হালকা খাওয়া, একপাটি পুরনো জুতো আর পকেটে মীনাক্ষীর দেওয়া ছোট্ট ত্রিশূল যা নাকি ভৌতিক শক্তি প্রতিরোধে কাজে লাগে। মীনাক্ষী তাকে সাবধান করে দেয়—“গানটা শুনলে হয়তো মনে হবে খুব কাছের কারো ডাক, কিন্তু নিজেকে হারিয়ে ফেলিস না, রাহুল। ও গান টানে, কিন্তু ছাড়ে না।” রাহুল মাথা নাড়ে। এবার সে ভয়কে ভয় পায় না, বরং জানার আগ্রহ তাকে সাহসী করে তুলেছে। সে ঠিক করে নেয়—আজ রাতেই দরজার ওপাশের সত্যি তাকে দেখা দেবে।

রাত বারোটা বেজে দশ। শবঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে রাহুল। ঠান্ডা বাতাস মুখের ওপর ছুরি চালানোর মতো। পকেট থেকে সে ছোট টর্চ বার করে চারপাশে আলো ফেলে—কিছু নেই, কেবল দরজা, তালা আর তার পেছনে সুনসান ছায়া। ঠিক তখনই, হঠাৎ—গান শুরু। একই সুর। সেই করুণ অথচ সৌম্য কণ্ঠ, যেন শবের কক্ষে বেঁচে থাকা হৃদয় কথা বলছে। এবার রাহুল কান পেতে নয়—ধাক্কা মেরে দরজা খুলে ফেলে। তালা অদ্ভুতভাবে খোলা পড়ে। সে ভেতরে ঢোকে—ঘরের ভেতরে অন্ধকার, বাতির সুইচ কাজ করে না। কিন্তু জানলার পাশে এক নারীমূর্তি বসে আছে, পিছন ফিরে। লম্বা চুল, সাদা শাড়ি, হাতে কাঠের পুরনো হারমোনিয়াম। গানের তালে তালে আঙুল চলে যাচ্ছে সুরের বুকে। রাহুল নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকে, তার পা যেন মাটিতে গেঁথে যায়। হঠাৎ সেই মূর্তি থামে, এবং ধীরে ধীরে পিছন ফিরে তাকায়। চোখ নেই, কিন্তু অদ্ভুত আলোয় জ্বলছে ফাঁপা দুটো গহ্বর। মুখে হাসি, না কান্না—বুঝে ওঠা যায় না। নারী বলে, “তুই এলি অবশেষে?” কণ্ঠে দুঃখ, আশ্বাস, আর অজানা আত্মীয়তার সুর। রাহুল শ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে, কাঁপা গলায় বলে, “আপনি অনামিকা?” উত্তর আসে না, নারী আবার গাইতে শুরু করে—কিন্তু এবার সুর বদলে যায়। গান হয়ে ওঠে মন্ত্র, আর মন্ত্র হয়ে ওঠে হাহাকার। রাহুলের কানে ভেসে আসে—“তুই আমায় চেনিস… তোর মায়ের কণ্ঠে আমার সুর… তোর রক্তে আমার স্মৃতি…” কক্ষের ভিতর বাতাস ভারী হয়ে ওঠে, ছায়া ঘন হয়, মেঝে যেন কাঁপছে। ঠিক তখন, এক মুহূর্তে সব থেমে যায়। নারী নেই, হারমোনিয়াম নেই, কেবল শবঘরের নিঃসঙ্গতা আর রাহুল একা দাঁড়িয়ে।

রাত কেটে যায়। রাহুলকে পাওয়া যায় হাসপাতালের দক্ষিণ করিডোরে অজ্ঞান অবস্থায়। জ্ঞান ফিরলে সে দেখে পাশে বসে আছেন ডঃ অনুরাধা ও মীনাক্ষী। অনুরাধা প্রশ্ন করেন, “কি দেখেছ?” রাহুল চোখ মেলে ধীরে ধীরে বলে, “আমি দেখেছি একজন মৃত নয়, বেঁচে থাকতে ভুলে যাওয়া আত্মা… যে গান দিয়ে নিজের অস্তিত্ব ধরে রাখতে চেয়েছে। আমি দেখেছি আমার মায়ের মুখ, কিন্তু অন্য এক চোখে। সে কণ্ঠ আমার চেনা, কিন্তু নাম তার অনামিকা।” মীনাক্ষী থমকে যায়—“তোমার মা কি কখনো বলেছিলেন কোথায় গান শিখেছিলেন?” রাহুল মাথা নাড়ে, “তিনি বলতেন, কিছু গান মানুষ শেখে না—জন্মের সাথে নিয়েই আসে।” অনুরাধা উঠে দাঁড়ান, জানালার দিকে তাকিয়ে বলেন, “তবে হয়তো এই গান কেবল ভয় নয়, উত্তরও। আমরা এখন খুঁজব—কে ছিল অনামিকা, আর তার সুর কেন আজও বাঁচে মৃত্যুর পরেও।” আর দূরে—শবঘরের দিক থেকে আবার এক মৃদু, অস্পষ্ট সুর ভেসে আসে… যেন গল্প এখনও শেষ হয়নি।

হাসপাতাল চত্বরে হঠাৎ করেই যেন সময়ের গতি বদলে গেছে। শুক্রবার রাতের সেই ঘটনার পর, রাহুল আর আগের মতো নেই। চোখে-মুখে এক ধরণের শূন্যতা—যা মানুষ দেখে শুধু তাদের মাঝে যারা মৃত ও জীবিতের সীমানা পার করে ফিরে আসে। সে আর জোরে কথা বলে না, রাতে সহজে ঘুমায় না, অথচ কাজে সময়মতো আসে। মীনাক্ষী একদিন জিজ্ঞেস করে, “রাহুল, তুই কি এখনও গান শুনছিস?” সে ধীরে মাথা নাড়ে—“হ্যাঁ, কিন্তু এখন সেটা ভয় পাই না। যেন কেউ আমায় ডাকছে না, বরং কথা বলতে চাইছে।” ডঃ অনুরাধা তখন হাসপাতালের পুরনো ফাইল খুঁজতে খুঁজতে এমন একটি চিঠির সন্ধান পান যা কয়েক দশক আগে কোনো রোগীর আত্মীয়ের হাতে পাঠানো হয়নি। সাদা খামে লেখা—“আনামিকা রায় – মানসিক চিকিৎসা বিভাগ”। ভেতরে এক পৃষ্ঠা লেখা কাগজ—কালির ছাপ কিছুটা ঝাপসা, তবুও পড়া যায়—“মা, তুমি বলেছিলে গান মানুষকে সুস্থ করে তোলে। কেন আমার গলা শুনে সবাই চুপ হয়ে যায়? আমি কি ভয় দেখাই? নাকি গানেই আমার সব পাপ আটকে আছে?” এই চিঠি পেয়ে ডঃ অনুরাধার চোখে জল চলে আসে। সে বুঝতে পারে, অনামিকা হয়তো কখনোই পুরোপুরি অসুস্থ ছিলেন না—সমাজ তার ব্যথা, তার অতলান্ত সুর বোঝেনি বলেই তাঁকে পাগলের খাতা ছুঁইয়ে দিয়েছিল।

এরপর রাহুল ঠিক করে, তাকে অনামিকার গ্রামের খোঁজে বের হতেই হবে। একটি পুরনো ঠিকানা উদ্ধার করে সে যায় এক প্রত্যন্ত বর্ধমানের গ্রামে—সেখানে এখনও কেউ কেউ অনামিকার কথা জানে। এক বৃদ্ধা বলেন, “ওর গলা ছিল সোনার মতন। ছোটবেলায় গান শিখতে আসত আমার স্বামীর কাছে। কিন্তু পরে যখন কলকাতায় গিয়ে বড় প্ল্যাটফর্মে গাইতে গেল, তখনই শুরু হয় যত সমস্যা। কেউ কেউ বলত, ওর গানে এমন কিছু আছে, যেটা শুনলে মানুষের ভিতর জমে থাকা সব দুঃখ বেরিয়ে পড়ে। কেউ হেসে উঠত, কেউ কাঁদত, কেউ আবার নিজের স্মৃতি হারিয়ে ফেলত। ওর কণ্ঠস্বর যেন মানুষকে আয়নায় নিজের অতীত দেখাত।” রাহুল অবাক হয়ে যায়—এতটাই শক্তিশালী ছিল সেই কণ্ঠ? বৃদ্ধা আরও বলেন, “শেষবার শুনেছিলাম, অনামিকা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি, তারপর আর কিছু জানি না। তবে একটা কথা ও আমাকে বলেছিল—যদি আমার গলা থেমে যায়, তবে আমি গান হবো।” রাহুলের হৃদয়ে শব্দগুলো গেঁথে যায়।

রাহুল যখন হাসপাতাল ফিরে আসে, তখন তার হাতে রয়েছে একজোড়া পুরনো গানের খাতা, কিছু হারিয়ে যাওয়া নোটেশন, আর একটি সাদা রুমাল—যেটি অনামিকার বাবার কাছ থেকে পেয়েছে। সে রাতে আবার সে শবঘরের দিকে এগোয়, হাতে গানের খাতা। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে। এবার ভেতর থেকে কোনো গান আসছে না। শবঘর নিঃস্তব্ধ। রাহুল ধীরে ধীরে বলে, “তুমি কি এবার আমার কণ্ঠে শুনতে চাও?” সে হারমোনিয়ামের সামনে বসে, পুরনো নোটেশন দেখে, অনামিকার লেখা সুরে গান শুরু করে। প্রথমে অস্পষ্ট, তারপর জোরে, তারপর… আশ্চর্যভাবে সেই গানের ভিতরেই কেউ যেন দ্বিতীয় কণ্ঠে সুর যোগ দেয়। নারীকণ্ঠ। তীক্ষ্ণ কিন্তু কোমল। শবঘরের দেয়ালে যেন আলো জ্বলে ওঠে, এক মুহূর্তে কুয়াশার পর্দা সরিয়ে দেখা যায় এক শাদা শাড়ি পরিহিতা রমণী—চোখে নেই অন্ধকার, কণ্ঠে নেই অভিশাপ—শুধু শান্তি। সে একটিবার রাহুলের দিকে তাকায়, মাথা হেলে সম্মতি জানায়, আর ধীরে ধীরে হারিয়ে যায় দেয়ালের ভেতরে। গান থেমে যায়, বাতাস নীরব হয়। শবঘরের কোলাহল আজ শ্মশানের নীরবতা নয়—আজ সেখানে একটি আত্মা শান্তি পেয়েছে।

রাহুল এখন আর শুধুই এক রাত্রিকালীন পাহারাদার নয়—সে যেন হয়ে উঠেছে এক আত্মার কথক, সুরের পথিক। শবঘরের সেই ভয় আর এখন তাকে তাড়া করে না; বরং সেখানে লুকিয়ে থাকা গানের নীরবতা তাকে টানে এক নতুন গভীরতায়। কিন্তু একটি প্রশ্ন তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে—অনামিকার আত্মা কি সত্যিই শান্তি পেল? নাকি সে কেবল রাহুলকে তার যন্ত্রণা শোনাতে এসেছিল? সেই রাতের গান এখনও রাহুলের কানে বাজে—তবে সম্পূর্ণ নয়। গানের মাঝপথে যেই দ্বিতীয় স্তবক শুরু হওয়ার কথা, তা কেমন যেন আটকে গেল, থেমে গেল এক অসমাপ্ত রাগের মতো। রাহুল খেয়াল করে, হারমোনিয়ামের পাশে রাখা নোটবুকে একটি পাতায় সুর কেটে গিয়ে থেমে গেছে। পাতার নিচে লেখা, “এই সুর রচিত হবে যেদিন কেউ নিজেকে হারিয়ে খুঁজে পাবে।”

এদিকে ডঃ অনুরাধা হঠাৎ এক চিঠি পান হাসপাতালের ডাকঘরে—কোনো প্রেরকের নাম নেই, খামের ভিতর শুধু একটি পাণ্ডুলিপি, নাম “অনামিকার শেষ রাগ”। ভেতরে এক সংগীতশাস্ত্রভিত্তিক ব্যাখ্যা—যেখানে লেখা, “এই রাগ কোনো রাগ নয়—এ হলো এক মৃত আত্মার আকুতি। গাওয়া যাবে না, কেবল অনুভব করা যাবে। যার হৃদয়ে অতীতের দাগ আছে, তারাই বুঝবে এ সুর।” এই রচনাটি পাঠিয়ে কেউ যেন ইঙ্গিত দিয়েছে যে গানের শেষ স্তবক এখনও জন্ম নেয়নি। রাহুল এরপর নানা সংগীত গুরু, পুরনো রেকর্ডিং স্টুডিও, এমনকি কল্যাণী মিউজিক আর্কাইভ ঘুরে বেড়াতে থাকে। একজায়গায় সে খুঁজে পায় এক ছেঁড়া রেকর্ড—এক নারী গান করছেন, সুর থেমে যাওয়ার আগে হঠাৎই বলে উঠছেন, “আমি ফিরব… গানের ভিতর…”—তারপর নিস্তব্ধতা। স্টুডিওর মালিক জানায়, “ওই রেকর্ড আমাদের আর্কাইভে ছিল না। কে রেখে গেছে জানি না। শুনেছি এই রেকর্ড বহু বছর আগে এক অন্ধ মহিলা নিয়ে গিয়েছিলেন, যিনি নিজেকে বলতেন ‘সুরের সন্ন্যাসিনী’। তার নাম ছিল—মধুরা রায়।”

মধুরা রায়। এই নাম শুনেই রাহুল থমকে যায়। তার মায়ের পুরনো নাম—বিয়ের আগে। হঠাৎ মনের ভেতরে ঝড় ওঠে। সে বাড়ি ফিরে মাকে প্রশ্ন করে, “মা, তুমি কি অনামিকাকে চিনতে?” মা তখন বহুক্ষণ চুপ করে থাকেন, তারপর ধীরে বলেন, “অনামিকা ছিল আমার দিদি। খুব ছোটবেলায় আমাদের আলাদা করে দেওয়া হয়। আমি গান ছেড়ে দিয়েছিলাম, কিন্তু তার কণ্ঠস্বর আমার ভিতর রয়ে গিয়েছিল। আমি চেয়েছিলাম তুই যেন জানিস না কিছু—কিন্তু বোধহয় সুর কাউকে আটকে রাখতে পারে না।” রাহুল তখন বুঝে ওঠে—এই গানের উৎস কেবল ভৌতিক নয়, আত্মীয়তার এক গভীর স্রোত বইছে যার ভিতর। রক্তের বাঁধনে বাঁধা গানটিকে সম্পূর্ণ করতে হলে, তাকে সেই অসমাপ্ত রাগটি শেষ করতে হবে—নিজের কণ্ঠে, নিজের ব্যথায়। সে আবার ফিরে যায় শবঘরে—এইবার সাথে নিয়ে মায়ের গলায় রেকর্ড করা প্রথম রাগ, আর সেই ছেঁড়া হারমোনিয়ামটি। সে রাত, আর এক শুক্রবার—এইবার শবঘরের বাতাসে কোনো ছায়া নেই, কেবল সুরের প্রত্যাশা। রাহুল গাইতে শুরু করে—নিজের ভয়, নিজের ব্যথা, নিজের হারানো অতীত দিয়ে গড়ে তোলে অনামিকার অসমাপ্ত রাগ। কণ্ঠ ফেটে যায়, কিন্তু শেষ স্তবক তৈরি হয়—গান শেষ হলে বাতাসে যেন কেউ নিঃশ্বাস ফেলল প্রশান্তির, হারমোনিয়ামের রিড ফেটে গিয়ে থেমে গেল নিজে থেকেই। জানালার বাইরে তখন ভোরের আলো উঠছে, আর শবঘরের দেয়ালে এক ঝলক দেখা গেল অনামিকার মুখ—একটিবারের জন্য, কণ্ঠে কোনো গান নেই, কিন্তু চোখে শান্তি।

শবঘরের সেই রাত যেন হাসপাতালের ইতিহাসে প্রথম সত্যিকারের নিঃশব্দ রাত ছিল—কোনো কান্না, কোনো সুর, কোনো ছায়া নয়; শুধু বাতাসে ভেসে বেড়ানো এক রকম প্রশান্তি, যা মৃত্যু নয়, বরং আত্মার পরিপূর্ণতা নিয়ে আসে। রাহুল হাসপাতালের মেঝেতে বসে থাকে দীর্ঘক্ষণ, হারমোনিয়ামের ফাটা রিডের দিকে তাকিয়ে। মনে হয়, যেন সেই যন্ত্রটিও তার শেষ সুর বাজিয়ে নিজের দায়িত্ব শেষ করেছে। বাইরে সূর্য উঠছে ধীরে ধীরে, জানালার কাঁচে হালকা শিশির জমে রুপালি রেখার মতো পড়ে আছে। হাসপাতালের রাতের নার্স মীনাক্ষী আসে কফি হাতে—কিন্তু রাহুল দেখে, তার মুখে কোনো প্রশ্ন নেই, শুধু বিস্ময়ের ছায়া। “তুই গেয়েছিলি, তাই না?” রাহুল মাথা হেঁট করে বলে, “না, আমি শুধু সেই সুরটাকে শেষ হতে দিয়েছি। হয়তো আমার কণ্ঠ দরকার ছিল না, শুধু কান দরকার ছিল, আর হৃদয়ের জায়গাটা খুলে রাখতে হয়েছিল।”

ডঃ অনুরাধা পরে এসে জানান, যে রাত্রে রাহুল গান গেয়েছিল, সেই রাতে নিকটবর্তী গ্রাম থেকে এক অন্ধ বৃদ্ধা মারা যান—মধুরা রায়। মৃত্যু হয়েছে ঘুমের মধ্যে, শান্তভাবে, চোখে মুখে ছিল এক অদ্ভুত প্রশান্তির ছাপ। মৃত্যুর আগে ঘরের দরজার কাছে একটা নোটবুক পাওয়া গেছে—তাতে লেখা, “আমার দিদিকে পৌঁছে দিও ওর গানটুকু… আমি দৃষ্টি হারালেও সুর চিনেছি।” সেই মুহূর্তে রাহুল অনুভব করে, যে যাত্রা শুরু হয়েছিল ভয় আর অজানাকে কেন্দ্র করে, তা এখন শেষ হচ্ছে আত্মীয়তা, ক্ষমা আর মুক্তির মধ্যে দিয়ে। কিন্তু একটি প্রশ্ন এখনো বাকি থাকে—এই গানের ইতিহাস যদি এক আত্মার সঙ্গে যুক্ত থাকে, তবে কি এমন আরও গান আছে, আরও শবঘর, আরও কেউ—যারা নিজেদের অপূর্ণতা ছড়িয়ে দিচ্ছে বাতাসে, অপেক্ষা করছে কারো কণ্ঠে প্রতিধ্বনি পেতে?

হাসপাতালের শবঘরটিকে নতুন করে রঙ করা হয়, হারমোনিয়ামটি সরিয়ে রাখা হয় এক কাচঘেরা বাক্সে, যেখানে লেখা থাকে—“অনামিকার গান—যে সুর মৃত্যুকেও ছুঁয়ে ফেলে।” রাহুল চাকরি ছেড়ে দেয় কিছুদিন পর, কিন্তু চলে না খুব দূরে। সে এখন স্থানীয়ভাবে সঙ্গীত থেরাপির কাজ করে, বিভিন্ন হাসপাতালে গিয়ে গানের মাধ্যমে মানসিক আরোগ্য নিয়ে কাজ করে। সে বলে, “প্রতিটি ব্যথা একটা সুর হতে পারে, যদি কেউ শোনে ঠিকভাবে।” মাঝে মাঝে, রাত গভীর হলে, সে চুপচাপ একা বসে হারমোনিয়ামের ছেঁড়া রিডটা হাতে নেয়, কানে বাজে সেই পুরনো গান, আর দূরে কোথাও শবঘরের জানালা দিয়ে চলে আসে বাতাসে মিশে থাকা এক শান্ত প্রতিধ্বনি—“আমি ফিরে যাবো না আর… আমি রয়ে গেলাম সুর হয়ে…”

বছরখানেক কেটে গেছে শবঘরের সেই রহস্যময় গানের রাত থেকে। রাহুল এখন মালদার এক ছোট শহরে—এক নতুন প্রতিষ্ঠানে সঙ্গীত-ভিত্তিক মানসিক থেরাপিস্ট হিসেবে কাজ করছে। দিন কাটে দুঃখী রোগীদের সাথে গান ভাগ করে, কিশোর-কিশোরীদের গলায় নিজের মতো করে স্বর বসিয়ে। সে ভাবে, হয়তো এটাই তার প্রকৃত কাজ ছিল—ভয়ের সুরকে মুক্তির সুরে রূপান্তর করা। কিন্তু এক সন্ধ্যায়, যখন সে বাসায় ফিরছে, তখন ডাক্তার অনুরাধার ফোন আসে। ফোনে কণ্ঠ ভারী, গম্ভীর—“রাহুল, উত্তর দিনাজপুরের একটা ছোট হাসপাতাল থেকে আমার কাছে একটা রিপোর্ট এসেছে। ওখানে প্রতিরাতে শবঘরের পাশের করিডোরে এক বৃদ্ধ রোগী দাঁড়িয়ে গান গাইছেন—ঠিক সেই সুরের মতো, যে সুর তুমি গেয়েছিলে… কিন্তু এই রোগী কথা বলতে পারতেন না জন্ম থেকেই। হঠাৎ একদিন গলা খুলেছে, আর গাইতে শুরু করেছেন। গান শুনে দুই নার্স জ্ঞান হারিয়েছেন।” রাহুল চুপ করে থাকে, যেন শরীরের মধ্যে সময় থেমে গেছে।

সে রাতে ঘুম আসে না। নিজের পকেট থেকে পুরনো সেই হারমোনিয়ামের ভাঙা রিডটা বের করে দেখে—অদ্ভুতভাবে, তাতে আবার সুর বেজে উঠছে মনে মনে। যেন কোথাও কেউ ডাকছে তাকে আবার। সকালে সে প্রস্তুত হয় রওনা দিতে। গন্তব্য: পান্নাগঞ্জ গ্রামীণ হাসপাতাল—উত্তর দিনাজপুর জেলার এক দুর্গম কোণে অবস্থিত, যেখানে হাসপাতালের পাশে অরণ্য, দূরে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের পুরনো স্তুপ, আর কাছেই একটা পোড়া লাইব্রেরির ধ্বংসাবশেষ। যাত্রাপথে রাহুল বারবার মনে পড়ে অনামিকার শেষ সুরের সেই শেষ পঙ্‌ক্তি—“আমি রয়ে গেলাম সুর হয়ে…” তবে কি সেই সুরের ছায়া আরেকবার জন্ম নিয়েছে অন্য কারো ভিতর? নাকি এমন সুর একটাই ছিল, কিন্তু তার প্রতিধ্বনি ছড়িয়ে যাচ্ছে নতুন শরীরে, নতুন শবঘরে?

হাসপাতালে পৌঁছে সে দেখে, রোগীটির নাম চরণ দাস—৭৬ বছর বয়স, কথা বলতে পারতেন না, কানে শুনতেন কম, কিন্তু এখন প্রতিরাতে এক-একটা ঘুমের পর জেগে উঠে অন্য ভাষায়, অন্য রাগে গেয়ে চলেছেন। ডাক্তারেরা থেমে গেছেন ব্যাখ্যায়—কারণ এই গানগুলো নাকি কোনো পরিচিত ভাষায় নয়, অথচ শুনলে মনে হয় হৃদয়ের ভাষা। রাহুল ওই রোগীর পাশে বসে, তার হাত ধরে। হঠাৎ, চরণ দাসের চোখ খুলে যায়, কণ্ঠে নিঃশব্দে উচ্চারণ হয়, “তুমি এসেছো… অনেক দিন পরে।” রাহুলের গায়ে কাঁটা দেয়—এ কণ্ঠ… এ ভাষা তো সে শুনেছে অনামিকার সেই শেষ রেকর্ডিংয়ে। কিন্তু চরণ তো কখনো গান শেখেননি, কোনো সংগীত পরিবার থেকেও নন। রাহুল অনুভব করে, এটি কেবল আরেকটি ঘটনা নয়—এ সুর যেন জন্ম নিচ্ছে, মৃত্যুর দেয়াল ভেঙে, আর তাকে ডাকছে এমন এক পরিণতির দিকে, যেখানে শবঘর কেবল শেষের নয়, শুরু হওয়ার স্থান।

পান্নাগঞ্জ গ্রামীণ হাসপাতালের আঙিনা কুয়াশায় ঢাকা, কিন্তু শীতের কামড়ের চেয়েও রাহুলের গায়ে স্রোতের মতো বয়ে যাচ্ছে এক অজানা উত্তাপ। সে দাঁড়িয়ে আছে সেই পুরনো শবঘরের দরজার সামনে, যেটির ভিতর ঘুমিয়ে আছে এক বৃদ্ধ, চরণ দাস, যিনি গাইছেন এমন সব সুর, যা পৃথিবীর কোনো সংগীতশিক্ষক শেখায়নি। হাসপাতালের ছাদে অন্ধকার, বাতাসে এক অদ্ভুত ধাতব গন্ধ, যেন পুরনো তার আর পোড়া কাঠের গন্ধ একত্রে মিলেছে। রাহুল ধীরে ধীরে ভেতরে প্রবেশ করে। ঘরের কোণায় বসে আছেন চরণ দাস—চোখ বন্ধ, কিন্তু ঠোঁটে কাঁপতে থাকা এক অজানা ভাষার গান। রাহুল শোনে না শব্দ, সে বোঝে আবেগ। গানের ভিতরে সে শুনতে পায় এক নারীকণ্ঠ, এক শিশুর কান্না, এক প্রাচীন মন্দিরের ঘণ্টা—আর এসবের মাঝখানে নিজের হৃদয়ের হারানো কিছু। চরণ হঠাৎ চোখ খুলে বলে ওঠেন, “রাহুল, তোর গলা শোনাবি না? সেই অসমাপ্ত সুর এখনও শেষ হয়নি… তুই তো আমার উত্তর… আমার গান।”

রাহুল প্রথমে কিছু বলতে পারে না, তারপর পকেট থেকে সেই হারমোনিয়ামের রিডটা বার করে চরণ দাসের হাতে দেয়। বৃদ্ধ তার কাঁপা আঙুলে সেটা স্পর্শ করতেই চোখ বেয়ে অশ্রু গড়ায়। হঠাৎ ঘরের বাতি কেঁপে ওঠে, কাঁচের জানালা দিয়ে ঢুকে পড়ে এক ঝলক ঠান্ডা হাওয়া। রাহুল বোঝে—এখানে কেবল গান নয়, আত্মার উত্তরাধিকারও চলে আসছে। সে হারমোনিয়ামের ছেঁড়া খামটা মেঝেতে বসিয়ে সুর তুলতে শুরু করে। কিন্তু এবার সে নিজে গাইছে না—চরণ দাস সেই সুরে মিশে যাচ্ছেন, কণ্ঠে অজানা এক রাগ, যা বোধহয় অনামিকার থেকেও পুরনো, অনেক আত্মা বহন করে চলেছে যুগ যুগ ধরে। সুর যখন চূড়ান্তে পৌঁছায়, তখন মনে হয় ঘরের ভেতর আরেকটি উপস্থিতি—এক ধবধবে সাদা কাপড়ে মোড়া নারী, মুখ ঢাকা, কেবল চোখ জ্বলছে। এবার সেই ছায়া মাথা নিচু করে সম্মতি জানায়—সুর পূর্ণ, আত্মা মুক্ত।

চরণ দাস শান্ত মুখে শুয়ে পড়েন, গানের মধ্যে নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে। পরদিন সকালে তাঁর মৃত্যু হয়—হৃদরোগ নয়, শ্বাসরোধ নয়—ডাক্তার লিখেন, “natural expiration during sleep”। কিন্তু রাহুল জানে, এই মৃত্যু আসলে মুক্তি। অনামিকা একদিন গান হয়ে গিয়েছিল, চরণ সেই গানের ধারক হয়েছিল, আর রাহুল—সে হলো সেই সেতু, যা জীবিত আর মৃতের মধ্যেকার সুরের পথে দাঁড়িয়ে সত্যি খুঁজে পেয়েছিল। হাসপাতালের পাশে যে পোড়া লাইব্রেরির ধ্বংসাবশেষ ছিল, সেখানে খোঁড়াখুঁড়িতে পাওয়া যায় কিছু পুরনো পালিম্পসট—যেখানে লেখা অদ্ভুত এক গানের স্কেল, যা কারও ভাষায় নেই, শুধু হৃদয়ের ধ্বনি। সেই স্কেল আজ সংরক্ষিত এক কাচঘেরা বাক্সে, যার নিচে লেখা থাকে—
“শবঘরের গান: যা ভয় ছিল, তা-ই মুক্তি। যা মৃত্যু ছিল, তা-ই রাগ। যা রাগ ছিল, তা-ই জীবন।”

শেষ

1000039051.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *