বিভাস সেনগুপ্ত
এক
নীলয় রায় জানালার ধারে বসে ছিল ট্রেনের কামরায়, মাথায় হেডফোন, চোখ দু’টো দৃঢ়ভাবে বাইরে, কিন্তু মন দূরে, একেবারে অন্যখানে। বাইরের কুয়াশায় ঢাকা দৃশ্যপট যেন তার ভেতরের অস্পষ্ট অনুভূতিগুলোরই প্রতিচ্ছবি ছিল। তার ব্যাগে একটি Nikon DSLR, দুটি লেন্স, একটি নোটবুক আর মুঠোফোন ছাড়া তেমন কিছু ছিল না। কলকাতা শহরের কোলাহল থেকে পালিয়ে সে চলেছে পুরুলিয়ার দিকে—এইবার শুধু একটি প্রজেক্টের জন্য নয়, বরং নিজের ভেতরের এক চাপা প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়ার জন্য। সে শুনেছিল শঙ্খ নদীর পাড় ঘিরে একটি লোককথা—“নদী নাকি কথা বলে, যদি তুমি কান পেতে শোনো।” শহুরে যুক্তিবাদী মানুষদের কাছে হয়তো এসব নিছক রূপকথা, কিন্তু নীলয়ের কাছে এই গল্পটা যেন একটা ডাক হয়ে উঠেছিল। তার নিঃসঙ্গ জীবনের বাঁকে বাঁকে যে শব্দহীনতা জমে আছে, তা যেন একমাত্র সেই নদীর ধারে গিয়েই গলে পড়বে—এই বিশ্বাসেই সে চলেছিল।
পুরুলিয়ার ছোট্ট স্টেশন ছেড়ে তাকে জিপ নিয়ে সীতারডিহি গ্রামের দিকে যেতে হচ্ছিল। রাস্তা এবড়োখেবড়ো, মাঝে মাঝে এমনভাবে ঘুরছিল যেন পথ নিজেই সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, গন্তব্য কোথায় হবে। ড্রাইভার বলল, “এইখানে খুব কম লোক আসে বাবু, বিশেষ করে বাইরের লোক।” নীলয় মাথা নাড়ল, হাসল না, চুপচাপ দেখে যাচ্ছিল চারপাশের পাথুরে টিলা আর শুষ্ক গাছের সারি। বেলা পড়ে এসেছিল। একটা মুহূর্তে সে দেখল—সামনে অনেক দূরে সূর্যটা একেবারে নিচে নামছে, আর ঠিক তার নিচে ছায়ার মতো বয়ে চলেছে একটা সরু সোনালি রেখা—শঙ্খ নদী। তার বুকের ভেতরে অদ্ভুত কিছুর গতি শুরু হল, যেন বহু বছর ধরে চেনা কোনও কিছু আবার সামনে আসছে, অথবা কোনও অপরিচিত কিছু তার দিকেই টেনে নিচ্ছে। পথ শেষ হল গ্রামঘেঁষা একটা কাঁচা রাস্তায়, যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল দু-তিনটে শিশু আর কিছু কৌতূহলী চাহনি। জিপ থেমে গেল। নীলয় ব্যাগ কাঁধে নামল, আর চুপচাপ হাঁটা শুরু করল—নদীর শব্দের দিকে।
গ্রামের শেষ প্রান্তে একটা একলা কুঁড়ে ঘর, যার পেছনেই বয়ে চলেছে শঙ্খ নদী, এবং তার সামনেই ধূপের ধোঁয়ার গন্ধ মিশে আছে সন্ধ্যার ঠান্ডা হাওয়ায়। সেখানেই প্রথম দেখা হল জহরা দিদির সঙ্গে—একজন বছর ষাটের মহিলা, যার চোখে যেন শতাব্দীর কথা লুকিয়ে ছিল। তিনি বসে ছিলেন মাটির চৌকিতে, হাতে একটা ধূপকাঠি আর ঠোঁটে ভাঙা ভাঙা সুরে কোনও মন্ত্র আওড়াচ্ছিলেন। নীলয় কুঁড়েঘরের সামনে দাঁড়ালে তিনি চমকে ওঠেন না, এমনকি প্রশ্নও করেন না। তিনি শুধু বলেন, “নদী দেখলে কিন্তু তাকিয়ে থেকো না—শোনার চেষ্টা কোরো।” এই প্রথম বার কেউ ক্যামেরা নিয়ে আসা লোককে দেখে ছবি তুলতে বলেনি, বরং শোনার কথা বলেছে। সেই মুহূর্তে নীলয় বুঝল, এই যাত্রা শুধুমাত্র একটি ফিল্ম বা ছবি তৈরির নয়—এটা তার নিজের অস্তিত্বের গহন অরণ্যে ঢোকার সূচনা। সে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল নদীর পাড়ে, পায়ের নিচে শুকনো পাতা ভাঙছিল মৃদু শব্দে, আর সামনে থেকে ভেসে আসছিল শঙ্খ নদীর মৃদু অথচ আশ্চর্য গম্ভীর স্রোতের গান—একটি গান, যা সে জীবনেও আগে শোনেনি, অথচ মনে হচ্ছিল, কোনোদিন খুব চেনা ছিল।
দুই
নীলয় নদীর পাড়ে বসে ছিল অনেকক্ষণ ধরে। শরতের মরা রোদে নদীর জল নিঃশব্দে গড়িয়ে যাচ্ছিল। আকাশে পাখিরা উড়ছিল ফিরে যাওয়ার তাড়ায়, আর গাছের পাতাগুলো যেন তাদের সঙ্গেই হাঁপাচ্ছিল। শঙ্খ নদীর ঢেউয়ের শব্দ কেমন যেন স্থির, যেন নিঃসঙ্গ কারও দীর্ঘশ্বাস। হঠাৎ তার মনে হল, এই নিঃসঙ্গতা যেন ঠিক তার নিজের মতো—চুপচাপ, অথচ কণ্ঠভরা গল্প। সে ক্যামেরা হাতে তুলেছিল কিছু চিত্র, কিন্তু প্রতিটি ছবির মধ্যেই একটা অদৃশ্য ফাঁকা রয়ে গিয়েছিল—যা কিছু ধরা পড়ছিল, তার বাইরেও যেন কিছু ছিল, যা চোখে দেখা যায় না, শব্দে শোনা যায় না, কিন্তু অনুভবে স্পষ্ট। তখনই পেছন থেকে শোনা গেল এক কাশি আর শীতল স্বরে ভেসে এলো—“জল যখন বোঝা নেয়, তখন শব্দ কমে যায়।”
জহরা দিদি ছিলেন সেই কুঁড়ে ঘরের একমাত্র বাসিন্দা, যেটা ছিল নদীর একেবারে ধার ঘেঁষে। তার চোখ দুটি ছিল অসম্ভব স্থির, ত্বক কুঁচকানো, কণ্ঠ যেন শুষ্ক কালের মতো—তবু তার মধ্যে একরকম প্রশান্ত আগুন জ্বলছিল। তিনি কোনো প্রশ্ন করেননি নীলয়কে, শুধু তাকে দেখছিলেন—যেমন কেউ দেখে পুরনো কোন স্মৃতির আগমন। নীলয় তাকে নম্রভাবে জিজ্ঞেস করেছিল নদীর লোককথা সম্পর্কে। কিন্তু জহরা দিদি কোনো সরল উত্তর দেননি। তিনি বলেছিলেন, “এই নদীর কথা কাগজে লেখা যায় না, ক্যামেরায় ধরা যায় না। শোনার জন্য কান চাই না, চাই অন্তর। এখানে যে হারিয়ে যায়, সে আর কখনো সত্যিকারে ফেরে না।” সেই রাতটা নীলয় কাটিয়েছিল তার কুঁড়েঘরের এক কোণে, ধূপের গন্ধে ভেসে থাকা বাতাসে আর জ্যোৎস্নার নিঃসঙ্গ আলোয়, যেখান থেকে নদী দেখা যায়, কিন্তু ছোঁয়া যায় না।
সেই রাতে সে ঘুমোতে পারেনি। বারবার মনে হচ্ছিল—কেউ যেন নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে গান গাইছে। এক নারীকণ্ঠ, কাঁপা, বিষাদময়, তবু অসীম টানযুক্ত। সে ঘর থেকে বেরিয়ে নদীর দিকে এগিয়ে গেল, হাতে ক্যামেরা। কিন্তু গিয়ে দেখে—কেউ নেই। শুধুই নদী, আর তার ওপারে এক ছায়ামূর্তি, যাকে সে ঠিক চিনতে পারছে না, কিন্তু অনুভব করছে—কোথাও যেন এই মুখটা আগে দেখেছে। ক্যামেরার স্ক্রিনে ভিউফাইন্ডার তুলতেই সব ঝাপসা হয়ে যায়, এক মুহূর্তের জন্য মনে হয় ক্যামেরার ভিতর থেকে কে যেন তাকিয়ে আছে তার দিকেই। ঠিক তখনই পেছনে দাঁড়ানো জহরা দিদির কণ্ঠ শুনল সে—“তুই দেখতে এসেছিস, কিন্তু শুনতে পারবি কি? এই নদী চোখকে ধোঁকা দেয়, কিন্তু অন্তরকে করে নগ্ন।” নীলয় চমকে তাকাল, তার ভেতরটা কেঁপে উঠল—প্রথমবারের মতো সে বুঝতে পারল, সে যা খুঁজতে এসেছে তা শুধু ক্যামেরায় বন্দী কোনো ছবি নয়, বরং এমন কিছু যা তাকে উলঙ্গ করে তুলবে, কেড়ে নেবে তার অভ্যস্ত যুক্তি আর মনের দম্ভ।
তিন
পরদিন সকালটা ছিল অদ্ভুত রকমের শান্ত, যেন নদী নিজেই ক্লান্ত ছিল সারারাত জেগে। নীলয় ঘুম থেকে উঠে এসে ক্যামেরা ব্যাগ খুলল। রাতে যে ক’টা ছবি তুলেছিল, সেগুলো ট্রান্সফার করে দেখতে বসে গেল ল্যাপটপে। কিন্তু স্ক্রিনে যে দৃশ্য ফুটে উঠল, তা দেখে সে স্তব্ধ হয়ে গেল। ছবির প্রেক্ষাপটে শঙ্খ নদীর পাড়, জ্যোৎস্নায় ভিজে থাকা ঘাস আর কুয়াশার নরম পর্দা—সবই ছিল যেমন প্রত্যাশিত, কিন্তু একটিতে এক নারীমূর্তি স্পষ্ট ধরা পড়েছে, দাঁড়িয়ে আছে নদীর ঠিক মাঝখানে, চোখ তুলে তাকিয়ে আছে ক্যামেরার দিকেই। তার পরনের সাদা শাড়ি আর কপালে লাল টিপ—আলো-ছায়ার ভেতরেও এক চমকপ্রদ স্পষ্টতা। অথচ সে নিশ্চিত ছিল, তখন সে একাই ছিল সেখানে, আর এমন কাউকে চোখে পড়েনি। ছবির ডেটা যাচাই করে দেখল—শাটার ক্লিক করার সময়টাও ঠিক আছে, কিন্তু সে নিজে তখন স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখেছিল শুধুই ফাঁকা পাড়। তাহলে এই ছায়ামূর্তি এল কোথা থেকে?
সে ছবিগুলো জহরা দিদিকে দেখাতে চেয়েছিল, কিন্তু বৃদ্ধা তখন কুঁড়েঘরের পেছনে বসে ছিলেন চোখ বন্ধ করে, মাটিতে আঙুল দিয়ে কিছু আঁকছিলেন। নীলয় প্রশ্ন করতেই তিনি বললেন, “ওর নাম কেউ জানে না, জানার দরকারও হয়নি। নদী যাকে ধরে রাখে, তাকে আর কেউ পুরোপুরি চিনতে পারে না।” নীলয় তার কথায় এক অদ্ভুত দ্বৈততা অনুভব করল—এ যেন ধাঁধা, কিন্তু সমাধানের জন্য নয়, অনুভব করার জন্য। সে ছবি নিয়ে গ্রামের মানুষের সঙ্গেও কথা বলার চেষ্টা করল, কিন্তু তারা হাসল, কিছু বলল না—হয়ত ভয়, হয়ত অস্বস্তি, কিংবা তারা নিজেই জানে না কীভাবে বিশ্বাস করবে। তবে গ্রামের এক বৃদ্ধ পুরুষ ফিসফিসিয়ে বলল, “আগেও কেউ কেউ এমন ছবি তুলেছিল বাবু, কিন্তু সেগুলো পরে নিজেরাই উধাও হয়ে গেছে। এই নদী কেবল জল নয়—এই নদী স্মৃতি, এই নদী ফাঁকি।”
সন্ধ্যেবেলায় সে আবার নদীর পাড়ে গেল, এইবার আরও দৃঢ়তায়, মনে মনে ঠিক করল, সে সত্যি সামনে আসা পর্যন্ত হাল ছাড়বে না। নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে সে এক মুহূর্তের জন্য চোখ বন্ধ করল, আর যেন শুনতে পেল সেই রাতের নারীকণ্ঠ আবার ফিরে এসেছে—একটা ভাঙা সুর, যার প্রতিটি শব্দ হৃদয়ে কাঁপন তোলে, যেন বহুদিন আগে হারানো কোনো ডাক আবার ফিরে এসেছে বাতাসে। চোখ খুলে দেখে, নদীর ওপার থেকে কুয়াশার ফাঁক দিয়ে কেউ আবার তাকিয়ে আছে তার দিকে। ক্যামেরা তুলতেই আবার সেই চঞ্চলতা, যেন আলো নিজেই সরে যাচ্ছে, ছায়া গা-ঢাকা দিচ্ছে। এক মুহূর্তের জন্য সে নিজেকে প্রশ্ন করল—এই ছবি যদি না তোলা যেত, তবে কি তার অস্তিত্ব থাকত না? কিংবা, যদি সে ছবি না তুলত, তবে কি সেই নারী চোখে পড়তই না? নীলয় বুঝতে পারল, এই নদীর ধারে সে কেবল ছবি তুলতে আসেনি—সে এসেছে এমন কিছু অনুভব করতে, যা তাকে বারবার নিজের ভেতরে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। এই ছবিগুলো কোনো প্রামাণ্য তথ্য নয়—এরা তার নিজের নিঃসঙ্গতার ছায়াপথ।
চার
পরদিন দুপুরে গ্রামের ছায়াঘেরা চায়ের দোকানে বসে যখন নীলয় নিজের খাতায় কিছু টোকা দিচ্ছিল, তখনই তার সামনে এসে দাঁড়াল এক যুবক—চোখে কৌতূহল, ঠোঁটে একটু হাসি, হাতে মাটির ভাঁড়। সে নিজেই বলে উঠল, “আপনি সেই শহরের ক্যামেরাওয়ালা, না? আমার নাম বিরাজ। আপনি যদি চান, আমি আপনাকে চারপাশটা ঘুরিয়ে দেখাতে পারি।” নীলয় অবাক হলেও তার চোখে যে আন্তরিকতা ছিল, সেটাকে অস্বীকার করা যায় না। কাঁধে একটা পুরনো ঝোলাব্যাগ, গলায় তাগার মালা, আর গায়ের রঙে পাথরের মতো চাপা রোদ লেগে থাকা বিরাজ যেন এই মাটিরই ছেলে, কিন্তু কণ্ঠে ছিল গভীর একটা টান, যা গল্প বলতে ভালোবাসে। তারা একসাথে হাঁটতে শুরু করল নদীর উজানে, যেখানে পুরনো শিবমন্দির আর কয়েকটা পরিত্যক্ত দেউল আছে। নীলয় তাকে জিজ্ঞেস করল নদীর গল্প, আর সেই ছবিতে দেখা মেয়েটির কথা।
বিরাজ একটু থেমে তাকাল নদীর দিকে। তার কণ্ঠ নিমেষেই বদলে গেল—সাধারণ এক গাইডের মতো নয়, বরং যেন নিজের ভিতর থেকে কোনো অভিজ্ঞতা টেনে আনছে। সে বলল, “অনেক বছর আগে এই গ্রামের এক মেয়ে ছিল—নাম ছিল শবনম। শুনেছি সে গান গাইত, নদীর ধারে বসে বসে। সকলে বলত তার গলায় যাদু ছিল। কিন্তু হঠাৎ একদিন বর্ষার সময়ে সে হারিয়ে যায়। কেউ বলে সে নদীতে ডুবে গেছে, কেউ বলে শহরের কোনও লোক ফুঁসলিয়ে নিয়ে গেছে। কিন্তু কয়েকজন বলে, নদী নিজেই তাকে ডেকে নিয়েছিল। তারপর থেকে পূর্ণিমার রাতে এই নদীর ধারে কেউ কেউ সেই গানের সুর শুনেছে। কেউ দেখেছে সাদা শাড়ি পরা এক মেয়েকে পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকতে—যে কেউ তার দিকে তাকালে সে মিলিয়ে যায় কুয়াশার মধ্যে।” বিরাজ থেমে যায়, তার চোখে তখন একটা অদ্ভুত স্পষ্টতা। “আমার মা বলেন, যাকে নদী একবার নেয়, তাকে কেউ ফেরাতে পারে না। কিন্তু আপনি যদি তার কথা শুনতে পারেন, বুঝবেন—সে এখনও কিছু বলতে চায়।”
নীলয়ের মনে হল, তার ক্যামেরায় ধরা পড়া সেই ছায়াটি—হয়তো শবনম-ই। অথবা হয়তো এমন কারও প্রতিবিম্ব, যার অভিমান আজও নদীর স্রোতে ভেসে থাকে। তার মনে পড়ল, সেই ছবির চোখের চাহনি ঠিক যেমন ছিল, এই গল্পের শবনম তেমনই কারো জন্য অপেক্ষা করত। নীলয় বিরাজকে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কি কখনও তাকে দেখেছ?” বিরাজ একটু হাসল—“আমার বিশ্বাস আছে, কিন্তু চোখে দেখিনি। কেউ দেখেছে বললেও আমি বিশ্বাস করেছি। বিশ্বাসে নদী কথা বলে, চোখে নয়।” কথাটা শুনে নীলয় ভিতরে ভিতরে একটু কেঁপে উঠল। সে বুঝল, এখানে প্রতিটি মানুষ, প্রতিটি বৃক্ষ, এমনকি বাতাসও যেন ওই এক নারীপ্রতিম ছায়ার জন্য অপেক্ষা করছে, যে আসলে কারো না, অথচ সকলের। সেই রাতে, নীলয় প্রথমবার ভেবে দেখল—এই নদী শুধু একটি প্রাকৃতিক সত্তা নয়, বরং একটি অপেক্ষার আখ্যান, একটি বিস্মৃত স্বরের উৎস, যা ক্যামেরা নয়, কেবল অন্তরই গ্রহণ করতে পারে।
পাঁচ
সন্ধ্যার সময়ে নীলয় একা হাঁটছিল নদীর পাড় ধরে, যেখানে পাথর আর শুকনো পাতা ভরে আছে নীরবতায়। বিরাজ যে গল্প বলেছিল শবনম নামের সেই মেয়েটিকে ঘিরে, তার প্রতিধ্বনি যেন প্রতিটি ঢেউয়ের সঙ্গে ফিরে আসছিল তার কানে। নীলয় ছবিগুলো আবার দেখতে লাগল মোবাইলে—বিশেষ করে একটি ছবি, যেখানে সেই নারীমূর্তির মুখ কিছুটা ঝাপসা, কিন্তু চোখ দুটি এতটা জীবন্ত যে মনে হয়েছিল, সে যেন এখনই কিছু বলবে। সে ছবিটি গ্রামের কিছু প্রবীণদের দেখাল। একজন বৃদ্ধা কাঁপা হাতে চোখে চশমা চাপিয়ে ছবির দিকে তাকিয়ে বললেন, “এই মুখটা কোথায় যেন দেখেছি রে… খুব চেনা চেনা লাগছে… তবে এখনকার কেউ না।” পাশ থেকে একজন বলল, “ও কি শবনম না? সেই মেয়ে যে হঠাৎ একদিন উধাও হয়ে গেছিল?” আরেকজন কেশে উঠল—“ধুস, শবনম কি আদৌ ছিল? সবাই তো বলে ও গল্প, কোন শ্মশানঘেরা গীত।” কেউ বিশ্বাস করতে চায়, কেউ ভয় পায়, আবার কেউ মেনে নিতে চায় না যে অতীত ফিরতে পারে ছবি হয়ে।
নীলয় এই দ্বিধার মাঝখানে দাঁড়িয়ে বুঝতে পারছিল—শবনম নামটা যেন গ্রামবাসীদের ভেতরে দ্বৈত প্রতিক্রিয়া জাগায়। কেউ ভাবে সে এক কল্পনার মূর্তি, কেউ ভাবে নদীর মালিকানা কেড়ে নেওয়া কেউ। কিন্তু তার নিজের মনে হচ্ছিল, শবনম যেন আসলে শুধুমাত্র একটি ব্যক্তি নয়—এক চিহ্ন, এক স্মৃতি, যাকে কেউ মুখে স্বীকার না করলেও মনের অলিন্দে ঠিক রেখে দিয়েছে। সে আবার গেল জহরা দিদির কুঁড়ে ঘরে, যেখানে ধূপ জ্বলছিল। জহরা তার প্রশ্ন শুনে একটানা চেয়ে রইলেন কিছুক্ষণ, তারপর বললেন—“নদী যার কণ্ঠ টানে, তার নাম মনে রাখা যায় না, শুধু সুরটা থেকে যায়। শবনম যদি থেকেও থাকে, তবে সে এখন নদীর পাড় নয়—নদীর স্রোতে গলে গেছে। তোর ছবি যদি তার সুরে বাঁধা হয়, তুইও হয়তো একদিন ভুলে যাবি নিজের নাম।” কথাগুলো শুনে নীলয়ের পিঠ দিয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল। সে শুধু জানতে চাইছিল কে এই মেয়ে, কিন্তু নদী আর তার ঘেরা গলিরা তাকে প্রতিবার নতুন প্রশ্নের কাছে এনে দাঁড় করাচ্ছিল।
রাত বাড়ছিল। চাঁদের আলো নদীর জলে সাদা সাদা ছিটে ছিটে পড়ছিল। নীলয় ক্যামেরা নিয়ে আবার গিয়ে দাঁড়াল নদীর পাড়ে, ঠিক সেই জায়গায় যেখানে আগের রাতে সে সেই ছায়াটিকে দেখেছিল। এবার সে চোখ বন্ধ করল, শোনার চেষ্টা করল সেই গান। ধীরে ধীরে বাতাসে মিলিয়ে যাওয়া একটি টানা সুর তার কানে এল—এবার একটু স্পষ্ট, যেন জল ঘেঁষে ভেসে আসছে। সে চোখ খুলে দেখে আবার সেই সাদা শাড়ি পরা নারীমূর্তি, এবার আরও পরিষ্কার, আরও জীবন্ত। এইবার সে ক্যামেরা তোলে না, শুধু তাকিয়ে থাকে। নারীটি তাকিয়েই থাকে তার দিকে, তারপর ধীরে ধীরে পেছন ফিরে যায় কুয়াশার ভেতরে। নীলয় এবার ক্যামেরা নামিয়ে রাখে, বোঝে—সব কিছু ধারণ করা যায় না। কিছু কিছু অভিজ্ঞতা ধারণ না করেই হৃদয়ে বাস করে, ঠিক যেমন শবনম—ছবিতে না, কিন্তু সুরে, স্মৃতিতে, নদীর স্পর্শে।
ছয়
পরদিন সকাল, আকাশে রোদের রঙ খুব মলিন, যেন আলো নিজেও কিছু গোপন করছে। নীলয় হাঁটতে হাঁটতে নদীর উজানে উঠে গেল—যেখানে সাধারণ পর্যটক বা গ্রামের লোকজন সচরাচর যায় না। তার হাতে ক্যামেরা ছিল না, আজ সে শুধু দেখতে আর শুনতে চেয়েছিল। নদীর পাথরের গায়ে বসে তার চোখে পড়ল এক খণ্ড পাথর, যেখানে হাতে আঁকা কিছু রেখা ছিল—যেন কেউ পাথরের গায়ে শব্দের ছায়া বসিয়েছিল। সে হাত দিয়ে সেই রেখাগুলো ছুঁয়ে দেখে, এবং তার আঙুলে ঠেকে যায় কয়েকটা হিন্দি-সংস্কৃত মিশ্র লিপি—“শব্দ নয়, স্মৃতি শোনো।” নীলয় শিউরে ওঠে—কার লেখা? কবে? কে রেখে গেছে এই বার্তা? সেই মুহূর্তে নদীর স্রোত যেন সামান্য জোরে বইতে শুরু করে, আর হাওয়ার টানে তার খাতা উড়ে গিয়ে পড়ে ঠিক পাথরের পাশে। সেই খাতার পেছনের পাতায় সে লিখে রাখে—”নদী শুধু পথ নয়, এটি একটি সংরক্ষণাগার, যেখানে শব্দ নয়, অনুভব জমা থাকে।”
বিকেলে সে ফেরে জহরা দিদির কাছে, পাথরের খণ্ডটি হাতে নিয়ে। দিদি এক দৃষ্টিতে দেখে বলেন, “ওটা তো অনেকদিন আগের কথা… যখন শবনম একা নদীর পাড়ে বসে থাকত, তখন এমনই কিছু পাথরে লিখত। তার বিশ্বাস ছিল, নদী কথা শোনে, এবং মনে রাখে। তুই সেই লেখা খুঁজে পেয়েছিস—মানে নদী তোকে কিছু বলছে।” নীলয় অবাক হয়ে জানতে চায়, “শবনম কি সত্যিই মানুষ ছিল, নাকি কেবল গল্প?” জহরা তখন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, “মানুষ, কিন্তু সব মানুষ তো শুধু মাটিতে থাকে না। কেউ কেউ জলেও রয়ে যায়। শবনম ছিল সেইরকম, যার কথা এই গ্রামের বাতাসেও আছে, পাথরেও আছে, নদীর হাড়ের নিচেও।” কথাগুলো শোনার পর, নীলয়ের মনে হচ্ছিল, সে যেন আর নিজের জগতের অংশ নয়—সে যেন একেকটা সময়, একেকটা স্মৃতির মধ্য দিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে, যার শুরু আছে, শেষ নেই।
রাত বাড়লে সে একা একা বেরিয়ে পড়ে নদীর দিকে, হাতে কেবল একটা পেন আর নোটবুক। আজ সে ছবি তুলবে না, শুধু লিখবে—যা সে অনুভব করেছে, শুনেছে, এবং যা তাকে ধরা দিয়েছে চোখ বন্ধ করলে। পাড়ে বসে, জলের গা ঘেঁষে, সে প্রথম লাইন লেখে—“যারা ডাকে না, তারাও শোনে। শবনম ডাকেনি, তবু আমি শুনেছি।” সে বুঝতে পারে, শবনম নদীতে হারিয়ে যাওয়া কোনো কাহিনি নয়—বরং নদীর ভেতরে আটকে থাকা সেই অগণিত অসমাপ্ত কথার প্রতীক, যা আমরা ভুলে যাই, কিন্তু তারা আমাদের ভোলে না। তার মনে হয়—প্রতিটি ঢেউ যেন একটি লেখা, প্রতিটি ছায়া যেন এক অক্ষর। হঠাৎ হাওয়ায় উড়ে আসে এক শালপাতার খণ্ড, যেখানে লাল কালিতে লেখা—“আমি এখনও এখানে আছি।” সে চারপাশে তাকায়—কেউ নেই। শুধু নদী, আর এক পাথর, যেখানে লেখা ছিল—“শবনম”।
সাত
সেই রাতের পর নীলয়ের ঘুম আর ঠিকমতো আসছিল না। নদীর প্রতিটি ঢেউ, প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি পাতা পড়ার আওয়াজ তার মনে অদ্ভুত এক দোলা দিয়ে যাচ্ছিল। একদিন বিকেলে সে নদীর ধারে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছেছিল একটি পাথুরে বাঁকে, যেখানে জল অনেকটাই স্থির, আর নদীর বুকে স্পষ্ট প্রতিবিম্ব পড়ে। সে দাঁড়িয়ে পড়ে, চোখ রাখে জলে—নিজেকে দেখতে চায়, কিন্তু দেখতে পায় না নিজেকে। বরং সে দেখে এক নারীমুখ, যাকে সে আগেও দেখেছে, ছবিতে, কল্পনায়, স্বপ্নে—কিন্তু এবার সে কোনো ঝাপসা ছায়া নয়। তার চুল নদীর মতো নেমে এসেছে কাঁধে, চোখ দুটি স্থির অথচ মায়াময়, আর কপালে সেই লাল টিপ। নীলয় হাত দিয়ে জলে ছোঁয়, প্রতিবিম্ব ভেঙে যায়। সেই মুহূর্তে যেন বাতাস থেমে যায়, আর তার কানে ভেসে আসে একটা কণ্ঠস্বর—“তুমি কী খুঁজছো? আমি তো হারাইনি, তুমি শুধু ভুলে গেছো।” সে চমকে উঠে দেখে, তার পেছনে কেউ নেই, কিন্তু মনে হয়, তার আত্মার মধ্যেই কেউ কথা বলছে।
সে ছুটে ফিরে যায় জহরা দিদির কাছে, ভেতরে ভেতরে কেঁপে উঠতে থাকলেও তার কণ্ঠে জেদ—“আমি তার চোখে তাকিয়েছি। এবার আমি তাকে চিনি। আমি জানি, সে শবনম।” জহরা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে, তারপর একটানা বলে ওঠে, “তুই যদি তাকে চিনে ফেলেছিস, তবে তোর আয়না আর আগের মতো থাকবে না। যাকে নদী একবার দেখায়, তার ভিতরের জলও পাল্টে যায়। মনে রেখো—এই নদী শুধু দেহে টানে না, আত্মাকেও গিলে ফেলে।” নীলয় বসে পড়ে মাটিতে, তার ক্যামেরা তার পাশে, কিন্তু সে আজ আর সেটাকে স্পর্শ করে না। সে জানে, কিছু কিছু দৃশ্য ফ্রেমে আটকে ফেললে তা মরে যায়। বরং এই অনুভবটা জীবিত থাকুক, যতটা সত্য, ততটাই অস্পষ্ট।
রাতে ঘরে বসে, মাটির প্রদীপের আলোয় সে লিখতে শুরু করে—নিজের দেখা, অনুভব, এবং সেই মুখটি নিয়ে যার চোখে সে নিজের নিঃসঙ্গতা খুঁজে পেয়েছে। সে লেখে—“আমরা যারা ক্যামেরা হাতে ঘুরি, তারা আসলে ছবির জন্য নয়, প্রমাণের জন্য খুঁজি। কিন্তু শবনম কোনো প্রমাণ নয়—সে অনুপস্থিতিরও উপস্থিতি, অনুচ্চারিতের প্রতিধ্বনি। সে জানত, কে কখন হারিয়ে যায়, আর কে সত্যিই বেঁচে থাকে।” তার মনে হয়, নদীর ওপারে যে জগত, তা হয়ত আয়নার উল্টো দিকের এক পৃথিবী, যেখানে সময় থেমে আছে, আর প্রতিটি আত্মা তাদের অসমাপ্ত গল্পগুলো বয়ে বেড়ায়। শবনম সেই জগতের প্রতিনিধি, যে হারিয়ে গিয়েও থেকে গেছে, এবং তাকেই সে খুঁজতে এসেছিল—অবচেতনেই।
আট
পরদিন সকালে বিরাজ একটি পুরনো কাপড়ে মোড়া খাতা নিয়ে এল, তার চোখে একধরনের সংকোচ এবং উত্তেজনার মিশেল। সে বলল, “এটা আমি খুঁজে পেয়েছিলাম আমাদের পুরনো গোয়ালঘরের মেঝের নিচে, অনেক দিন আগে। তখনও জানতাম না এটা কার। কিন্তু কাল রাতে আপনি যেটা বললেন, আর আমি আপনার চোখে যা দেখলাম… মনে হল, এই খাতা আপনার সঙ্গেই কথা বলতে চায়।” নীলয় ধীরে ধীরে সেই খাতা খুলে দেখে—পাতাগুলো পুরনো, কিছুটা হলুদ, কিছু ছেঁড়া, কিন্তু লেখাগুলো রয়ে গেছে—একটা মেয়েলি হাতের লেখা, বাংলা আর উর্দুর মিশ্র ছায়ায়। প্রথম পাতায় লেখা: “যদি কখনও কেউ এসে নদীর ভাষা বুঝতে চায়, তাকে এই কথাগুলো দিয়ে শুরু করতে হবে। কেননা নদী কখনো চুপ করে না—আমরা শুধু কান বন্ধ করে রাখি।” নীলয় স্তব্ধ হয়ে যায়। এই খাতা যেন শবনমের আত্মজীবনী—অথচ কারো জন্য লেখা নয়, কেবল নদীর জন্য।
পাতা উল্টাতে উল্টাতে সে দেখে, শবনম নিজে তার নিঃসঙ্গতা, ভালোবাসা, ভয় আর প্রতীক্ষার কথা লিখেছে। একটি পাতায় লেখা—“আমি জানি, কেউ একদিন আসবে, যে ছবি তুলতে নয়, শুনতে আসবে। আমি তার অপেক্ষায় নদীর পাড়ে বসে থাকি, যেন হাওয়া আমাকে ছুঁয়ে বলে—সে এসেছে।” নীলয়ের মনে হলো, এই খাতা যেন কোনো কল্পনায় লেখা নয়, বরং তার নিজের মনের পাতায় লেখা কোনও অতীত স্বপ্নের ভাষ্য। সে লেখাগুলো পড়ে বুঝতে পারে, শবনম একদিন গিয়েছিল শহরের দিকে, ফিরে এসেছিল হৃদয়ভাঙা হয়ে। তারপর থেকেই সে নদীর ধারে বসে থাকত, গান গাইত, আর বিশ্বাস করত নদী তাকে গ্রহণ করবে ঠিক একদিন। এই বিশ্বাসই যেন তাকে করে তুলেছিল নদীর চেয়ে বেশি কিছু—একটি সত্তা, একটি অনুভব, একটি লোককথার মূর্তি।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। নীলয় খাতাটি নিয়ে ফেরে নদীর ধারে। সে সেই জায়গায় দাঁড়ায়, যেখানে প্রথম শবনমের মুখটি দেখেছিল জলে। এবার সে খাতাটি পাথরের উপর রাখে, খুলে রেখে দেয় সেই পৃষ্ঠাটি যেখানে লেখা—“আমার প্রার্থনা নদীর মতো—অতল, নিরব, কিন্তু প্রবাহমান।” হঠাৎ বাতাস এক ঝাপটা দিয়ে খাতার পাতাগুলো ওলটাতে শুরু করে, আর দূর থেকে হালকা সেই গানের সুর শোনা যায়—এইবার আরও কাছে, আরও স্পষ্ট, যেন কোন গলা নয়, কোন আত্মা গান গাইছে। নীলয় বুঝতে পারে, এই গানের মধ্যে আছে তার নিজের প্রশ্নের উত্তর। সে বুঝে যায়—শবনমকে কেউ চিনত না ঠিকই, কিন্তু সে ছিল প্রতিটি নিঃশব্দ আকাঙ্ক্ষার মুখ। আর আজ, সে নয় শুধু নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা এক ফটোগ্রাফার—সে নিজেও এক শ্রোতা, এক উত্তরসূরি, নিখোঁজ সময়ের এক ধারক। নদী তার মধ্যে দিয়ে বয়ে যাচ্ছে।
নয়
রাত গভীর হলে গ্রামের আকাশে ছায়া ঘনিয়ে আসে। তারা ছাড়াও যে আকাশ জ্বলে, তার আলো হয়ত ভিন্ন, কিন্তু শবনমের গল্পের মতই অদৃশ্য এবং জ্যোতির্ময়। সেই রাতে নীলয় আর ঘরে ফেরে না। সে কুঁড়েঘরের পাশে আগুন জ্বালিয়ে বসে থাকে, কোলে সেই খাতা, হাতে মাটির ভাঁড়ের শেষ চুমুকের উষ্ণতা। তার চারপাশে পাতা ঝরছে, বাতাস বইছে শবনমের গানের মত করুণ সুরে। সে জানে, আজ কিছু একটা হবে—নির্বাচিত কোনও মুহূর্ত এসে পড়বে, যেটা খুঁজে পাওয়া যায় না, কেবল তার ভিতরে জেগে ওঠা যায়। হঠাৎ নদীর ওপার থেকে এক ম্লান আলো ভেসে আসে—তাকে মনে হয় এক আগুনজ্বলা প্রদীপ, যেন কেউ রেখে গেছে পথ দেখানোর জন্য। নীলয় উঠে দাঁড়ায়, হাঁটা শুরু করে সেই আলোর দিকে।
পাথর ভেঙে, কুয়াশা পেরিয়ে সে পৌঁছায় এক নিঃশব্দ মোহনার কাছে, যেখানে নদী স্থির, অথচ ভিতরে ভিতরে নাড়ছে। সেখানে সে দেখতে পায় শবনমকে—এইবার স্পষ্ট, জীবন্ত। সে দাঁড়িয়ে আছে একা, কিন্তু চোখে জল নেই, মুখে ভয় নেই, কেবল এক গভীর শান্তি। তার ঠোঁটে একটি গান—যা কোনও ভাষায় বাঁধা যায় না, কেবল হৃদয়ে গেঁথে যায়। নীলয় কিছু বলার আগেই সে হাত তোলে, যেন থামাতে চায়। তারপর সে ধীরে ধীরে বলে—“তুমি যাকে খুঁজতে এসেছ, সে শুধু আমি নই। আমি সেই প্রতিটি গল্পের প্রতিচ্ছবি, যেগুলো কেউ লেখে না। তুমি যেদিন শুনতে শিখেছ, সেদিনই তুমি আমাকে খুঁজে পেয়েছ।” কথা শেষ করে সে হেঁটে চলে যায় কুয়াশার ভিতরে, এবং নীলয় দেখে, নদীর বুকে ছায়া জলের মতো গলে যাচ্ছে।
সেই মুহূর্তে নীলয়ের মনে হয়, এই সন্ধিক্ষণ—এই ক্ষণিক সাক্ষাৎ—তার জীবনের সেই অনুপস্থিত খণ্ড, যা এতদিন ধরে সে পূরণ করার চেষ্টা করছিল। ক্যামেরা, শব্দ, গল্প—সবই ছিল তার নিজের ভেতরের নিস্তব্ধতাকে স্পর্শ করার চেষ্টা। কিন্তু শবনম সেই নিস্তব্ধতাকেই শব্দে রূপ দিয়েছে। সে ফিরতে থাকে ধীরে ধীরে, পদক্ষেপ ভারী, মন নিঃশব্দ। পেছনে তাকায় না, কারণ সে জানে—যা দেখা হয়েছে, তা এখন মনে গেঁথে গেছে। নদীর পাড়ে এসে সে শেষবারের মতো সেই খাতার পৃষ্ঠা উল্টায়। সেখানেই লেখা—“যদি কেউ দেখে, শুনে, ও বোঝে—তবে সে নিজেই হয়ে ওঠে নদীর আরেক শাখা।” নীলয় বুঝে যায়—সে আর আগের মতো নেই। সে শুধু ফটোগ্রাফার নয়—সে এখন নদীর একজন স্মৃতি-সংরক্ষক।
দশ
সকালের আলো পুরুলিয়ার আকাশে ধীরে ধীরে ফুটে উঠছিল, কিন্তু সেই আলো যেন আলাদা কিছু বয়ে আনছে। হাওয়ায় আজ একরকম ফুরফুরে নিশ্চয়তা, যেন দীর্ঘ কোনও ঋণ শোধ হয়েছে রাতের অজানা প্রহরে। নীলয় নদীর পাশে বসে ছিল, চোখের নিচে ক্লান্তির ছায়া, কিন্তু মুখে প্রশান্তির রেখা। তার পাশে সেই খাতা—যেটা সে আজ আর ফিরিয়ে দেবে না জহরা দিদিকে, বরং রেখে দেবে নিজের কাছে, যেমন রেখে দেবে শবনমের গান, সেই আলো, সেই ছায়ামূর্তি, আর নদীর কথার একান্ত প্রতিধ্বনি। সে জানে, শহরে ফিরতে হবে, যেখানে ফোনের রিংটোন, ট্যাক্সির হর্ন আর মানুষের ব্যস্ততার মাঝখানে এসব অভিজ্ঞতা নিছক এক অলীক গল্প মনে হবে। কিন্তু এই নদীর পাড়ে সে যা শুনেছে, যা অনুভব করেছে, তা কেবল এক যাত্রার নয়—এক আত্মদর্শনের ইতিহাস।
জহরা দিদি এসে দাঁড়ান তার পাশে, হাতে একটা লাল কাপড়ের ছোট পোটলি। বললেন, “তোর যাওয়ার সময় হয়েছে, তুই যা নিয়ে এসেছিলি—তা ছেড়ে যেতে পারিস। কিন্তু যা নিয়ে ফিরছিস—তা তুই নিজেই জানিস না, কতটা বড়।” নীলয় চুপ করে পোটলিটা হাতে নেয়। ভেতরে শ্বেতপাথরের এক ছোট মূর্তি—এক নারীর মুখ, যেটা অবিকল শবনমের মতো। জহরা দিদি বলেন, “এইটা শবনমের গান গাওয়ার মূর্তি। আমার মা গড়েছিলেন, ওর স্মৃতি বাঁচিয়ে রাখতে। কিন্তু তোকে দেওয়ার ইচ্ছা হল, কারণ তুই শুধু শুনিস না, বাঁচিয়ে রাখিস।” সেই মুহূর্তে নীলয়ের চোখের কোণে জমে ওঠে জল, এবং সে বুঝতে পারে—প্রতিটি শ্রোতা একদিন গল্প হয়ে ওঠে, যদি সে সত্যিই শোনে।
ট্রেন যখন তাকে নিয়ে ফিরছিল কলকাতার দিকে, তার ব্যাগে সেই মূর্তি, সেই খাতা, আর মনের মধ্যে এক নদী বয়ে চলছিল—যার নাম শঙ্খ নয়, বরং স্মৃতি। সে জানত, এই গল্প সে লিখবে না কোনো ম্যাগাজিনে, ছাপাবে না ছবির অ্যালবামে। সে এই গল্প রেখে দেবে নিজস্ব আকাশে, যেন কোনোদিন যদি আবার কেউ একলা হয়ে পুরুলিয়ার পাথরভরা নদীর ধারে এসে দাঁড়ায়, তবে সে নিজেই খুঁজে নেবে নিজের শবনমকে। কারণ, নদী কারোর নয়, কিন্তু সে কারো অপেক্ষায় থাকে—যে তাকিয়ে নয়, শোনে। এবং সেই শ্রোতা একদিন হয়ে ওঠে নদীর আরেক নাম।
***




