নির্মলেন্দু বিশ্বাস
১
দূর পশ্চিমবঙ্গের অরণ্যঘেরা অঞ্চলে, যেখানে ঘন বনভূমি আর ভাঙাচোরা ধ্বংসাবশেষ প্রকৃতির আঁচলে লুকিয়ে থাকে, সেখানে এসে পৌঁছেছিল একদল প্রত্নতত্ত্ববিদ। দলের নেতৃত্বে ছিলেন ড. অনিরুদ্ধ, এক সুপরিচিত কিন্তু রহস্যময় গবেষক, যিনি ইতিহাসের হারানো অধ্যায়গুলো উন্মোচন করার জন্য প্রায় অর্ধেক জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল—প্রাচীন মন্দিরগুলোর ধ্বংসস্তূপের ভেতর শুধু পাথরের স্তূপ নয়, লুকিয়ে আছে সভ্যতার অজানা কাহিনি, অদেখা প্রতীক আর অব্যাখ্যাত গোপন রহস্য। দলের সদস্যরা, যাদের মধ্যে ছিলেন তরুণ গবেষক, আলোকচিত্রী এবং স্থানীয় গাইডরা, সবাই এক অদ্ভুত উদ্দীপনায় ভরপুর ছিলেন। তাঁরা যখন লতাপাতায় আচ্ছাদিত, কালের ভারে নুয়ে পড়া সেই মন্দিরে প্রবেশ করলেন, চারপাশে নিস্তব্ধতা আর পাখির ডানার শব্দ ছাড়া আর কিছু শোনা যাচ্ছিল না। হঠাৎই মনে হচ্ছিল—যেন তাঁদের পদচিহ্নের আওয়াজই শতাব্দী প্রাচীন শূন্যতার ভেতর প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। দলটি খননযন্ত্র বসিয়ে মাটি কাটতে শুরু করল, ধীরে ধীরে ভেসে উঠতে লাগল ভাঙাচোরা স্তম্ভ, মসৃণ খোদাই, আর পুরনো অলঙ্করণ—যেন শতাব্দীর ঘুম ভাঙিয়ে নতুন করে ইতিহাসকে জাগিয়ে তোলা হচ্ছে।
কয়েক ঘণ্টার শ্রম আর অগণিত ধুলো-ধোঁয়া গায়ে মেখে সন্ধ্যার ঠিক আগে ঘটে গেল সবচেয়ে অদ্ভুত আবিষ্কারটি। ড. অনিরুদ্ধ যখন পশ্চিম দিকের একটি ভাঙা স্তম্ভের নিচের অংশ খুঁড়ছিলেন, তখন তাঁর কাস্তে-মত যন্ত্রের ধাক্কায় কড়া শব্দ উঠল—যেন মাটির নিচে লুকানো কোনো ধাতব বস্তুর অস্তিত্ব জানান দিল। তিনি দ্রুত দলের বাকি সদস্যদের ডেকে নিলেন, আর সকলে মিলে সতর্ক হাতে মাটি সরাতে শুরু করলেন। ধীরে ধীরে ভেসে উঠল একটি প্রাচীন শঙ্খ, যা প্রথম দর্শনেই বাকিদের চমকে দিল। সাধারণ শঙ্খের মতো নয়, এর পৃষ্ঠজুড়ে ছিল অচেনা নকশা, জটিল অলঙ্করণ, আর খোদাই করা শিলালিপি, যেগুলো কোন ভাষায় লেখা বোঝা মুশকিল। এর রঙ ছিল হালকা সবুজাভ, যা আলোয় ঝলমল করে উঠছিল, আর স্পর্শে অদ্ভুত শীতলতা ছড়াচ্ছিল। দলের তরুণ সদস্য তনিমা বিস্মিত হয়ে বলল, “এটা তো একেবারেই সাধারণ কিছু নয়… মনে হচ্ছে যেন কোনো বিশেষ আচার বা রহস্যময় উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়েছিল।” ড. অনিরুদ্ধ শঙ্খটি হাতে নিয়ে গভীর মনোযোগে খুঁটিয়ে দেখছিলেন। তাঁর চোখে-মুখে দেখা দিল এক অদ্ভুত কৌতূহল আর উত্তেজনার মিশ্রণ—যেন তিনি জানেন এই আবিষ্কার শুধু একটি শঙ্খ নয়, এর ভেতর লুকিয়ে আছে এমন কিছু যা পুরো গবেষণার ধারা পাল্টে দিতে পারে।
শঙ্খের খোদাইগুলোতে অদ্ভুত প্রতীক ছড়িয়ে ছিল—যেনো কোনো গুপ্ত বার্তা, যা সময়ের পর্দা পেরিয়ে বর্তমানকে সতর্ক করছে। কিন্তু দলটির কেউই সেগুলো পড়তে পারছিল না। স্থানীয় গাইড হরেকৃষ্ণ কাঁপা গলায় বলল, “বাবু, এই জিনিসটা ভালো নয়… ছোটবেলায় বুড়োদের মুখে শুনেছিলাম এই এলাকায় এক ‘অভিশপ্ত শঙ্খ’ চাপা দেওয়া আছে, যেটা বাজালেই বিপদ ডেকে আনে। বহু বছর আগে গ্রামের লোকেরা ভয় পেয়ে মন্দির ছেড়ে চলে গিয়েছিল।” বাকিরা তার কথা শুনে হেসে উড়িয়ে দিলেও, ভেতরে ভেতরে একটা অস্বস্তি সবার মনে গেঁথে গেল। তবুও গবেষকরা জানতেন—এমন একটি নিদর্শন খুঁজে পাওয়া ইতিহাসের জন্য অমূল্য। ড. অনিরুদ্ধ শঙ্খটি সাবধানে কাচের বাক্সে ভরে রাখলেন এবং দলের বাকি সদস্যদের শান্ত থাকতে বললেন। তিনি বললেন, “ভয় নয়, বিজ্ঞান দিয়ে দেখতে হবে এর পেছনে আসল সত্যি কী।” কিন্তু তাঁর কণ্ঠে যে দৃঢ়তা ছিল, তার আড়ালে লুকানো এক অদ্ভুত অস্থিরতা অনুভব করেছিল সবাই। অরণ্যের ঘন অন্ধকারে, প্রাচীন মন্দিরের নিস্তব্ধতায়, আর সেই রহস্যময় শঙ্খের ঠান্ডা দীপ্তিতে যেন আসন্ন অজানা বিপদের ইঙ্গিত ভেসে উঠছিল—যেন ইতিহাসের মাটি কেটে তাঁরা যে ধন আবিষ্কার করলেন, তা শুধু গবেষণার উপাদান নয়, বরং এক অদ্ভুত অভিশাপেরও দ্বারপ্রান্ত।
২
রাত গভীর হলে গবেষণাশিবিরে চারদিক নিস্তব্ধ হয়ে আসে। অরণ্যের ভেতর পোকামাকড়ের ডাক, দূরে শিয়ালের হুক্কাহুয়া, আর বাতাসে পাতা দোলার শব্দ ছাড়া কিছু শোনা যাচ্ছিল না। দিনের ক্লান্তিতে দলের বাকি সদস্যরা ঘুমিয়ে পড়েছিল, কিন্তু ড. অনিরুদ্ধের চোখে ঘুম আসছিল না। তাঁর চিন্তার ভেতর বারবার ঘুরপাক খাচ্ছিল সেই রহস্যময় শঙ্খের অদ্ভুত নকশা, অচেনা প্রতীক আর শিলালিপি। তাঁর মনে হচ্ছিল—যদি সত্যিই এই শঙ্খ কোনো গোপন আচার বা প্রাচীন ধর্মীয় ক্রিয়াকলাপে ব্যবহৃত হত, তবে এর ভেতর হয়তো লুকিয়ে আছে এমন এক শক্তি, যা ইতিহাসের বহু অমীমাংসিত রহস্য উন্মোচন করতে পারে। তর্কবিতর্ক আর বৈজ্ঞানিক যুক্তি তাঁকে সামনের দিকে ঠেলছিল, আর স্থানীয় গাইডের সতর্কবাণী তাঁর কানে মৃদু প্রতিধ্বনির মতো বাজছিল। অবশেষে কৌতূহল তাঁকে পেয়ে বসল। তিনি শিবিরের আলো নিভিয়ে কাচের বাক্স থেকে শঙ্খটি বের করলেন। এর ঠান্ডা শরীর স্পর্শ করার সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর বুকের ভেতর এক অদ্ভুত কম্পন ছড়িয়ে গেল। এক মুহূর্তের জন্য দ্বিধা হল—কিন্তু বিজ্ঞানীসুলভ জেদ তাঁকে থামতে দিল না। তিনি ধীরে ধীরে ঠোঁটে তুললেন শঙ্খটি, গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে বাজালেন প্রথমবার।
প্রথমে মনে হল কিছুই ঘটল না। অরণ্যের অন্ধকার, রাতের শূন্যতা আর শঙ্খের প্রতিধ্বনি মিলেমিশে যেন একটি ভৌতিক সুর তুলল, কিন্তু তাতে তেমন কোনো অস্বাভাবিকতা চোখে পড়ল না। ড. অনিরুদ্ধ খানিকটা হতাশই হলেন—তিনি ভেবেছিলেন কিছু অদ্ভুত শক্তি বা অন্তত অস্বাভাবিক শব্দ ভেসে উঠবে। কিন্তু ঠিক কয়েক মুহূর্ত পরেই বাতাস যেন বদলে গেল। অদৃশ্য কারও নিঃশ্বাসে হঠাৎ ঠান্ডা হয়ে উঠল চারপাশ। বাতাসের সঙ্গে মিশে আসতে লাগল অচেনা ফিসফিসানি, যা এতটাই মৃদু যে মনে হচ্ছিল যেন বনজঙ্গলের পাতার ফাঁকে ফাঁকে কারও গোপন কথা ভেসে আসছে। ড. অনিরুদ্ধ প্রথমে নিজের কল্পনা বলে ভেবে উড়িয়ে দিতে চাইলেন, কিন্তু ফিসফিসানিগুলো ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগল। যেন একসঙ্গে বহুজন অচেনা ভাষায় কিছু আওড়াচ্ছে—কখনো তা মন্ত্রের মতো, কখনো আবার শোকে ভরা বিলাপের মতো শোনাচ্ছিল। তাঁর শরীরের লোম দাঁড়িয়ে গেল। তিনি কণ্ঠ শুকনো হয়ে আসা সত্ত্বেও শঙ্খটি শক্ত করে ধরে রইলেন। আরেকটু মনোযোগ দিয়ে শুনতে গেলে মনে হচ্ছিল সেই ফিসফিসানি তাঁর নাম ডাকছে—“অনিরুদ্ধ… অনিরুদ্ধ…”।
ড. অনিরুদ্ধ চারপাশে তাকালেন। বাতাস এতটাই হিমশীতল হয়ে উঠেছিল যে তাঁর নিঃশ্বাস থেকে সাদা কুয়াশা বের হচ্ছিল। গাছের পাতাগুলো অকারণে দুলছিল, অথচ বাতাসের গতি ছিল না। দূরে রাতচরা পাখিরা অস্থির হয়ে ডানা ঝাপটাচ্ছিল, যেন কোনো অদৃশ্য উপস্থিতিকে ভয় পাচ্ছে। হঠাৎই শিবিরের পাশের লণ্ঠনগুলো একে একে নিভে গেল, অন্ধকার গাঢ় হয়ে উঠল। ড. অনিরুদ্ধের বুকের ভেতর ধকধক করতে লাগল, কিন্তু কৌতূহল তাঁকে এক ইঞ্চি নড়তে দিল না। ফিসফিসানির ভেতর থেকে এবার ভেসে এল এক দীর্ঘশ্বাস, যা যেন শত শত বছর ধরে কারাগারে আটকে থাকা আত্মার আর্তনাদ। তাঁর কানে স্পষ্ট শোনা গেল—“আমাদের মুক্ত করো…”। মুহূর্তেই তিনি বুঝলেন, এই শঙ্খ সাধারণ কোনো নিদর্শন নয়; এর ভেতর লুকিয়ে আছে এমন এক শক্তি যা প্রাচীন অভিশাপের সঙ্গে যুক্ত। হঠাৎ চারপাশের অন্ধকারে এক ঝলক নীলাভ আলো ফুটে উঠল, শঙ্খের গায়ে খোদাই করা প্রতীকগুলো জ্বলে উঠল যেন আগুনের রেখা। ভয়ে তাঁর হাত কেঁপে উঠল, শঙ্খ মাটিতে পড়ে গেল, আর সঙ্গে সঙ্গে শব্দগুলো থেমে গেল। নিস্তব্ধতা ফিরে এলো, কিন্তু সেই নিস্তব্ধতা ছিল ভীষণ ভারী, যেন এক অদৃশ্য উপস্থিতি এখনও চারপাশে ঘোরাফেরা করছে। ঘামের ভেজা শরীর আর আতঙ্কে ছটফট করা মনের ভেতর দাঁড়িয়ে তিনি বুঝতে পারলেন—তিনি এমন এক নিষিদ্ধ শব্দ জাগিয়ে তুলেছেন, যা হয়তো কখনোই মানুষের কানে শোনার জন্য ছিল না।
৩
সকালের অরণ্য সবসময়ই অন্যরকম। ভোরের কুয়াশা গাছের ডালে ডালে লেপ্টে থাকে, আর দূরে মাটির গন্ধ মিশে আসে শিশিরভেজা ঘাসে। প্রতিদিনের মতোই গবেষণা দলের সদস্যরা খননের কাজে নামার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন। কিন্তু সেই সকালে, শিবিরের ভেতর এক অদ্ভুত নীরবতা নেমে এসেছিল। সাধারণত সকালের কাজ শুরুর আগে সবার ভিড় জমে ওঠে, কেউ কফি বানায়, কেউ যন্ত্রপাতি গুছিয়ে নেয়, কেউবা আবার মজা করে হইচই শুরু করে দেয়। কিন্তু আজকে যেন সেই স্বাভাবিকতার মধ্যে কিছু একটার অভাব ছিল। দলের তরুণ শ্রমিক রমেশ, যিনি প্রতিদিন সবার আগে উঠে যেতেন, তাঁকে দেখা যাচ্ছিল না। প্রথমে কেউ বিষয়টিকে গুরুত্ব দিল না—ভাবল হয়তো একটু দেরিতে উঠেছে। কিন্তু সময় বাড়তে থাকল, আর রমেশকে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না। শেষমেশ কয়েকজন তাঁর তাঁবুর দিকে এগিয়ে গেলেন। তাঁবুর চেন টেনে খুলতেই যা দেখা গেল, তা প্রত্যেকের বুকের ভেতর শীতল আতঙ্ক নামিয়ে আনল। রমেশ মাটিতে ছড়িয়ে পড়ে আছে, শরীর ঠান্ডা, আর চোখ দুটো বিস্ফারিত, যেন মৃত্যুর আগ মুহূর্তে সে এমন কিছু দেখেছিল যা মানুষ সহ্য করতে পারে না।
তাঁর মুখে আঁকড়ে ধরা ছিল এক অদ্ভুত অভিব্যক্তি—ভয়, বিস্ময় আর অসহায়ের মিশ্রণ। ঠোঁট সামান্য ফাঁক হয়ে আছে, কিন্তু কোনো শব্দ আর বের হয়নি। দলের ডাক্তারি জ্ঞানসম্পন্ন সদস্য ড. সোমা ছুটে এসে শরীর পরীক্ষা করলেন। তিনি হতবাক হয়ে বললেন, “হৃদযন্ত্র হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু এর কোনো চিকিৎসাগত ব্যাখ্যা নেই… শরীরে আঘাতের কোনো চিহ্ন নেই, বিষক্রিয়ারও প্রমাণ নেই। কেবল চোখে আর মুখে সেই ভয়ের ছাপ।” বাকিরা স্তম্ভিত হয়ে একে অপরের দিকে তাকাল। এ কি শুধুই এক দুর্ঘটনা? না কি এর পেছনে আছে আরও গভীর কোনো কারণ? শিবিরের মধ্যে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ল। কেউ কেউ ফিসফিস করে বলতে লাগল—“এটা কি সেই শঙ্খের কারণে?”। স্থানীয় গাইড হরেকৃষ্ণের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে উঠল। সে গম্ভীর গলায় বলল, “আমি আগেই সাবধান করেছিলাম। ওই জিনিস ছোঁয়া উচিত হয়নি। রাতের বেলা কেউ ওটা বাজিয়েছে কি?” প্রশ্ন শুনে ড. অনিরুদ্ধের বুকের ভেতর কেঁপে উঠল। তিনি কারও দিকে তাকালেন না, কেবল ঠোঁট কামড়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। নিজের অপরাধবোধ চাপা দিতে তিনি বললেন, “এটা কেবলই কাকতালীয়। বিজ্ঞান ছাড়া অন্য কিছু ভাবার দরকার নেই।” কিন্তু তাঁর কণ্ঠস্বরের দৃঢ়তা আর আগের মতো জোরালো রইল না।
সকালের সেই আতঙ্ক পুরো দলের ভেতর অস্থিরতা ছড়িয়ে দিল। যন্ত্রপাতি হাতে নেওয়ার আগেই যেন সবার মনে এক অজানা ভয়ের ছায়া নেমে এলো। কেউ কেউ বলল, তারা আর খননকাজ চালাতে পারবে না; কেউবা প্রস্তাব দিল গ্রামে ফিরে গিয়ে পণ্ডিত বা পুরোহিত ডেকে আনা উচিত। কিন্তু ড. অনিরুদ্ধ নিজের যুক্তি দিয়ে সবাইকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন—“এটা নিছকই একটা দুর্ঘটনা। আমরা যদি ভয় পেয়ে কাজ থামাই, তবে ইতিহাসের এক মূল্যবান অধ্যায় হারিয়ে যাবে।” তবুও দলের সবার চোখে স্পষ্ট হয়ে উঠল অবিশ্বাস আর আতঙ্ক। রমেশের মৃতদেহ মন্দিরের পাশে মাটিচাপা দেওয়ার পরও সেই মুখভর্তি আতঙ্কের ছবি কারও মাথা থেকে মুছল না। রাতের বেলা ফিসফিসানির শব্দ শোনার স্মৃতি ড. অনিরুদ্ধকে তাড়া করে ফিরছিল। তিনি জানতেন, এই মৃত্যু কোনো সাধারণ মৃত্যু নয়। তিনি এক নিষিদ্ধ শক্তিকে জাগিয়ে তুলেছেন, আর রমেশ তার প্রথম শিকার। কিন্তু এখন পিছিয়ে আসা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়—কারণ যে অজানার দ্বার তিনি খুলে দিয়েছেন, তা আর বন্ধ করা যাবে না।
৪
রমেশের মৃত্যু যেন পুরো দলের ভেতর এক ভয়াল ছায়া ফেলে দিয়েছিল। দিনের বেলা সবাই খননের কাজ চালিয়ে গেলেও, কারও চোখেমুখে আর আগের মতো আগ্রহ বা উদ্দীপনা ছিল না। প্রত্যেকেই নিজের ভেতর ভয়ে কেঁপে উঠছিল, যদিও মুখে কেউ কিছু বলছিল না। রাত নামার সঙ্গে সঙ্গেই সেই ভয়ের রূপ আরও স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগল। শিবিরের চারপাশে কেরোসিন লণ্ঠন জ্বালিয়ে রাখলেও, চারপাশের ঘন অন্ধকার যেন আরও গাঢ় হয়ে উঠছিল। বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছিল অজানা শীতলতা, যা কারও কারও শরীর কাঁপিয়ে তুলছিল। প্রথমে অনেকে ভেবেছিল—এটা হয়তো মানসিক চাপ, বা রমেশের অস্বাভাবিক মৃত্যুর পর স্নায়ুর দুর্বলতা। কিন্তু শীঘ্রই প্রমাণ মিলল, বিষয়টা কেবল মানসিক ভ্রম নয়। কয়েকজন খননকর্মী একসঙ্গে চিৎকার করে উঠল, কারণ তারা দেখেছে শিবিরের আলো থেকে সামান্য দূরে কালো ছায়ার মতো কিছু নড়ছে। যেন অদৃশ্য কোনো মানুষ গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে তাদের লক্ষ্য করছে। কিন্তু যখন টর্চের আলো ফেলা হল, দেখা গেল সেখানে কিছুই নেই। সেদিন রাতেই ক্যাম্পের ভেতর গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ল—মন্দিরে প্রাচীন দেবতার অভিশাপ আজও সক্রিয়।
দলটি ধীরে ধীরে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেল। একদল ছিল যারা এখনও যুক্তি আর বিজ্ঞানের ওপর ভরসা করে বিশ্বাস করছিল, এই সবই কল্পনা আর মানসিক দুর্বলতার ফল। আরেকদল দৃঢ়ভাবে বলতে লাগল, এই শঙ্খ আর মন্দিরে লুকিয়ে থাকা শক্তির সঙ্গে সাধারণ মানুষের লড়াই সম্ভব নয়। স্থানীয় গাইড হরেকৃষ্ণ ভয়ে কাঁপা গলায় পুরোনো কিংবদন্তির কথা আবারও স্মরণ করাল। সে বলল, “গ্রামের লোকেরা বহু বছর আগে বলত—এই মন্দির ছিল এমন এক দেবতার আসন, যাকে ভুলে মানুষ অবহেলা করেছিল। সেই দেবতার রোষ থেকে বাঁচতে পুরোহিতেরা শঙ্খকে চাপা দিয়ে রাখে। কিন্তু আমরা আবার ওটা জাগিয়ে তুলেছি। তাই আজ ছায়ারা ঘুরে বেড়াচ্ছে।” এই কথা শুনে অনেকে শিবির ছেড়ে পালাতে চাইলো। কিন্তু ড. অনিরুদ্ধ কড়া গলায় সবাইকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন। তিনি বললেন, “ছায়া কোনো বাস্তব প্রমাণ নয়। আমাদের ভয়ই এদের জন্ম দিচ্ছে। আমরা যদি ভেঙে পড়ি, তবে গবেষণার সব ব্যর্থ হবে।” তাঁর কথায় সাময়িকভাবে দলের শৃঙ্খলা বজায় থাকল, কিন্তু ভেতরে ভেতরে আতঙ্কের আগুন আরও বেড়ে উঠছিল।
রাত গভীর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই ছায়াগুলো আরও স্পষ্ট হতে লাগল। এক কর্মী শপথ করে বলল, সে দেখেছে ছায়া শুধু নড়ছে না, বরং তার দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। অন্য এক কর্মী দাবি করল, ছায়ার ফাঁকে ফাঁকে সে অদ্ভুত চোখের দৃষ্টি টের পেয়েছে—যেন অমানবিক জ্যোতিতে জ্বলছে। এ ছাড়া শিবিরের লণ্ঠনগুলো বারবার অকারণে নিভে যাচ্ছিল, আর বাতাসের দমকা ঝাপটা এনে দিচ্ছিল হাড়-কাঁপানো ঠান্ডা। কেউ আর ঠিকভাবে ঘুমোতে পারছিল না; তাঁবুর ভেতরে সবাই অস্থির হয়ে এপাশ-ওপাশ করছিল। ড. অনিরুদ্ধ বাইরে দাঁড়িয়ে সব দেখছিলেন। শঙ্খটি তাঁর ঘরের ভেতরে রাখা, কিন্তু তাঁর মনে হচ্ছিল যেন ওই শঙ্খের ভেতর থেকেই ছায়াগুলো জন্ম নিচ্ছে। আতঙ্ক তাঁকে গ্রাস করছিল, তবুও তিনি নিজেকে বোঝাচ্ছিলেন—বিজ্ঞান ছাড়া কিছুই নেই, এসবই মানসিক প্রতিক্রিয়া। কিন্তু মনের গভীরে তিনি বুঝতে পারছিলেন, যে শক্তিকে তিনি গত রাতে জাগিয়ে তুলেছেন, তা আর থামানো সম্ভব নয়। প্রাচীন দেবতার অভিশাপ যেন ধীরে ধীরে তাঁদের চারপাশ ঘিরে ফেলছে, আর কালো ছায়াগুলো শুধু ভয় দেখানোর জন্য নয়—বরং আরও ভয়ঙ্কর কিছুর পূর্বাভাস।
৫
দিন যত এগোচ্ছিল, দলের ওপর অদৃশ্য আতঙ্কের ছায়া ততই গাঢ় হয়ে উঠছিল। রমেশের মৃত্যু, রাতের অদ্ভুত ফিসফিসানি আর ক্যাম্পের চারপাশে ভেসে বেড়ানো ছায়াগুলো সবাইকে মানসিকভাবে ভেঙে দিচ্ছিল। ড. অনিরুদ্ধও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না, যদিও তিনি প্রকাশ্যে কোনো দুর্বলতা দেখাননি। কিন্তু ভেতরে ভেতরে তাঁর বিজ্ঞানী মন আর কুসংস্কারের ভয় একে অপরের সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত হচ্ছিল। সেই দ্বন্দ্ব মেটানোর জন্যই তিনি শঙ্খটির গায়ে খোদাই করা শিলালিপি গভীর মনোযোগে পড়তে শুরু করলেন। দিনের আলোয় শঙ্খের গায়ে খোদাই করা প্রতীকগুলো আগের চেয়ে অনেক স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। প্রথমে এগুলো একেবারেই অচেনা ভাষার মতো লাগছিল, কিন্তু ধীরে ধীরে তিনি বুঝতে পারলেন, এগুলোর কিছুটা প্রাচীন সংস্কৃত আর পালি লিপির মিশ্রণ। ঘন্টার পর ঘন্টা বসে তিনি প্রতিটি চিহ্ন মিলিয়ে দেখতে লাগলেন, মাঝে মাঝে পুরোনো প্রত্নতাত্ত্বিক অভিধান ঘেঁটে তার অর্থ বের করার চেষ্টা করলেন। দলের অন্যরা বিস্মিত চোখে তাঁর কাজ দেখছিল—কারণ তাঁরা জানত, এই লিপির অর্থই হয়তো তাঁদের মুক্তি বা সর্বনাশের চাবিকাঠি হয়ে দাঁড়াবে।
অবশেষে অনিরুদ্ধ এক বিকেলে শিলালিপির অর্থ খুঁজে পেলেন। তাঁর মুখে তখন শুষ্কতা, চোখে ভয়ের ছাপ। তিনি ধীরে ধীরে দলের বাকিদের সামনে উচ্চারণ করলেন লিপির বাক্য—“যে বাজাবে, তার আত্মা শোষণ করবে মৃত্যুর দেবদূত।” শিবিরের ভেতর সঙ্গে সঙ্গে আতঙ্কের তরঙ্গ বয়ে গেল। কেউ চিৎকার করে উঠল, কেউ আবার স্তব্ধ হয়ে বসে পড়ল। দলের এক তরুণ প্রত্নতত্ত্ববিদ বলল, “তাহলে রমেশের মৃত্যু নিছকই দুর্ঘটনা নয়! ওই শঙ্খ থেকেই সব শুরু হয়েছে।” স্থানীয় গাইড হরেকৃষ্ণ কপালে হাত ঠেকিয়ে বিড়বিড় করতে লাগল, “দেবতার অভিশাপ… মৃত্যুর দেবদূত জেগে উঠেছে।” এ কথা শোনার পর দলের সবাই যেন একসঙ্গে আতঙ্কে আক্রান্ত হল। কেউ কেউ শঙ্খটি ধ্বংস করার দাবি তুলল, আবার কেউ বলল, ওটা ধ্বংস করা যাবে না—কারণ তাতে অভিশাপ আরও ভয়ংকর রূপ নিতে পারে। অনিরুদ্ধ তাঁদের শান্ত করার চেষ্টা করলেন, যদিও তাঁর নিজের কণ্ঠস্বর তখনও কাঁপছিল। তিনি বললেন, “আমাদের এখনও নিশ্চিত প্রমাণ নেই যে শঙ্খই মৃত্যুর কারণ। লিপি হয়তো কোনো পুরোনো ধর্মীয় সতর্কবাণী, যা ভয় দেখানোর জন্য লেখা হয়েছিল।” কিন্তু তাঁর ব্যাখ্যা কেউই বিশ্বাস করল না। শিবিরের প্রতিটি মানুষ এখন মনে করতে লাগল—তাদের চারপাশে মৃত্যু লুকিয়ে আছে, আর শঙ্খ বাজানোর সঙ্গে সঙ্গেই তার ছায়া নেমে এসেছে।
এরপর থেকে দলের পরিবেশ আরও ভয়াল হয়ে উঠল। আগুনের পাশে বসে সবাই অস্থিরভাবে চারপাশে তাকাচ্ছিল, যেন অন্ধকারের ভেতর থেকে মৃত্যুর দেবদূত হঠাৎ বেরিয়ে আসবে। কেউ আর খোলাখুলি কথা বলছিল না, কারও হাসি শোনা যাচ্ছিল না। শিবিরে এক অদ্ভুত ভারী নীরবতা নেমে এলো, যা ভাঙত শুধু পাতার খসখস বা দূরে শিয়ালের ডাক। অনিরুদ্ধ রাতে শঙ্খটিকে আবার বাক্সে ভরে রাখলেন, কিন্তু সেই বাক্স থেকেও তিনি যেন অদ্ভুত শব্দ শুনতে পাচ্ছিলেন—মৃদু ফিসফিসানি, ভাঙা নিঃশ্বাস, আর অসংখ্য অচেনা কণ্ঠস্বর। তিনি জানতেন না এটা তাঁর কল্পনা, নাকি সত্যিই শঙ্খের ভেতর বন্দী শক্তি জীবন্ত হয়ে উঠছে। তাঁর বুকের ভেতর অপরাধবোধ আরও গভীর হচ্ছিল—কারণ তিনিই প্রথম রাতে শঙ্খ বাজিয়েছিলেন, তিনিই লুকানো নিষিদ্ধ শক্তিকে মুক্ত করেছিলেন। কিন্তু এখন তাঁর হাতে ছিল কেবল একটিই পথ—এই লিপির ভেতর লুকিয়ে থাকা আরও ইঙ্গিত খুঁজে বের করা। হয়তো তাতেই জানা যাবে, কীভাবে অভিশাপ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। কিন্তু দলের অন্যরা যে আতঙ্কে পাগল হয়ে উঠছিল, তাতে তিনি বুঝতে পারলেন—সময় হাতে খুব বেশি নেই। মৃত্যুর দেবদূতের ছায়া তাঁদের ওপর নেমে এসেছে, আর প্রথম শিকার হওয়ার পর এবার কার পালা সেটাই কেবল অজানা।
৬
রাতের আতঙ্ক আর শিবিরে ক্রমশ ছড়িয়ে পড়া অস্থিরতা ড. অনিরুদ্ধকে ভাবিয়ে তুলেছিল। তিনি বুঝতে পারছিলেন, শুধুমাত্র বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ দিয়ে এই ঘটনার ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব নয়। শঙ্খের শিলালিপি ইতিমধ্যেই এক ভয়ঙ্কর সত্য প্রকাশ করেছে, আর এখন তাঁকে জানতে হবে এই নিদর্শনের ইতিহাস। তাই পরদিন সকালে তিনি স্থানীয় পুরোনো নথি, প্রাচীন লিপি ও কাহিনি সংগ্রহের চেষ্টা শুরু করলেন। হরেকৃষ্ণ, যিনি গ্রামের অনেক কিংবদন্তি জানতেন, তাঁকে সাহায্য করতে রাজি হলেন, যদিও তাঁর কণ্ঠে ভয় লেগে ছিল। সন্ধ্যার আগেই তাঁরা মন্দিরসংলগ্ন ধ্বংসাবশেষ থেকে এক ভাঙা শিলালিপি উদ্ধার করলেন, যাতে কিছু শব্দ এখনও স্পষ্ট ছিল। সেগুলো পড়তে গিয়ে অনিরুদ্ধ অনুভব করলেন যেন অতীতের এক ভয়াল কাহিনি তাঁর সামনে খুলে যাচ্ছে। এর সঙ্গে মিলিয়ে গ্রামের প্রবীণদের মুখে প্রচলিত গল্পগুলোও তিনি শুনলেন। ধীরে ধীরে জোড়া লাগল ইতিহাসের ছিন্ন সূত্র—শঙ্খটি এক অভিশপ্ত রাজপুরোহিতের ছিল, যিনি একসময়ের রাজসভায় পূজিত হলেও দেবতাদের অভিশাপ পেয়ে মৃত্যুর দেবদূতের দূত হয়ে উঠেছিলেন।
কাহিনি অনুযায়ী, সেই রাজপুরোহিত ছিলেন অত্যন্ত শক্তিশালী মন্ত্রজ্ঞ, যিনি শঙ্খের অলৌকিক শক্তি ব্যবহার করে বলিদান দিতেন। বিশ্বাস ছিল, প্রতিবার শঙ্খ বাজালে মৃত্যুর দেবদূত তাঁর সামনে আবির্ভূত হয়ে মানুষের আত্মা গ্রাস করত। রাজ্যের মানুষ ধীরে ধীরে ভয়ে তাঁর বিরুদ্ধে উঠতে শুরু করে, কিন্তু পুরোহিত এতটাই ক্ষমতাশালী ছিলেন যে তাঁকে কেউ থামাতে পারেনি। অবশেষে দেবতারা নিজেরাই তাঁর ওপর অভিশাপ নেমে আনেন। অভিশাপ ছিল—তিনি চিরকাল মৃত্যুর দেবদূতের দাস হয়ে থাকবেন, আর তাঁর আত্মা মুক্ত হবে না। তখন থেকে তিনি এই শঙ্খ বাজিয়ে একের পর এক আত্মা বলি দিতে থাকেন, যতক্ষণ না রাজ্যের মানুষ বিদ্রোহ করে মন্দিরকে ধ্বংস করে এবং শঙ্খটিকে মাটির গভীরে চাপা দেয়। কিংবদন্তি বলে, সেই সময় বহু পুরোহিত একত্রিত হয়ে শাপগ্রস্ত শঙ্খটিকে নিস্তেজ করার চেষ্টা করেন, কিন্তু পুরোপুরি সফল হতে পারেননি। তাই তাঁরা সতর্কবাণী হিসেবে লিপি খোদাই করে রেখেছিলেন—যাতে কেউ যদি ভবিষ্যতে এই শঙ্খ আবিষ্কার করে, তবে অন্তত বুঝতে পারে এর ভেতরে লুকিয়ে আছে মৃত্যুর দূতের অভিশাপ।
ড. অনিরুদ্ধ যখন এই কাহিনি দলের বাকি সদস্যদের শোনালেন, তখন শিবিরে এক অদ্ভুত নীরবতা নেমে এলো। প্রত্যেকেই রক্তহিম হয়ে শুনছিলেন—যেন তাঁরা বুঝে ফেললেন তাঁদের ভাগ্য ইতিমধ্যেই নির্ধারিত হয়ে গেছে। কেউ কেউ কাঁদতে শুরু করল, কেউ আবার রাগে চিৎকার করে উঠল, “তাহলে আমাদের এখানে আনা কেন? কেন এই মন্দির খুঁড়তে এলাম?” অনিরুদ্ধ চুপচাপ বসে ছিলেন। তাঁর মনে হচ্ছিল, তিনি যেন এক ভয়ঙ্কর চক্রের মধ্যে বন্দি হয়ে পড়েছেন, যার শুরু করেছিলেন তিনি নিজেই। কিন্তু ইতিহাসের এই সূত্র তাঁকে নতুন এক উপলব্ধির দিকে ঠেলে দিল। তিনি বুঝলেন, অভিশপ্ত পুরোহিতের আত্মা হয়তো এখনও শঙ্খের ভেতরে আবদ্ধ, আর প্রতিবার শঙ্খ বাজলে মৃত্যুর দেবদূত নতুন আত্মা শিকার করে। এই সত্যি দলের ভেতর আতঙ্কের আগুন আরও বাড়িয়ে দিল। সবাই এখন জানত, তাঁরা কেবল প্রত্নতাত্ত্বিক খননে অংশ নিচ্ছেন না—বরং তাঁরা এক অশুভ শক্তির সঙ্গে লড়াই করছেন, যে শক্তি শতাব্দী প্রাচীন কাহিনিকে জীবন্ত করে তুলেছে। অনিরুদ্ধের চোখে তখন এক কঠিন সংকল্প ফুটে উঠল—ইতিহাসের এই সূত্রই হয়তো মুক্তির পথও বলে দেবে, কিন্তু সেই মুক্তি পেতে হলে তাঁদের আরও গভীরে প্রবেশ করতে হবে অন্ধকারের গহ্বরে।
৭
প্রথম মৃত্যুটা ঘটেছিল হঠাৎ, যেন আকাশ থেকে বজ্রপাত নেমে এসেছে। রাত তখন গভীর, শিবিরের আগুন নিভে আসছে। দলের একজন কর্মী, গোপাল, নিজের তাঁবুর ভেতর শুয়ে ছিল। হঠাৎ ভোরের আলো ফোটার আগে দেখা গেল, তাঁর মুখে অদ্ভুত এক ভয়ের ছাপ জমে আছে, যেন মৃত্যুর মুহূর্তেও তিনি কিছু ভয়ঙ্কর জিনিসের সম্মুখীন হয়েছিলেন। ডাক্তারি পরীক্ষায় ধরা পড়ল, তাঁর শ্বাসরোধ হয়ে মৃত্যু হয়েছে, অথচ তাঁবুর ভেতরে কারও প্রবেশের চিহ্ন নেই। এই রহস্যজনক মৃত্যুতে পুরো শিবির কেঁপে উঠল। সকালের আলোয় সবার মুখে তখন আতঙ্কের ছাপ, কেউ কারও সঙ্গে চোখাচোখি করতে পারছিল না। সেই ভয়কে আরও বাড়িয়ে তুলল অনিরুদ্ধের মনে পড়া শিলালিপির সতর্কবার্তা—“যে বাজাবে, তার আত্মা শোষণ করবে মৃত্যুর দেবদূত।” গোপালের মৃত্যু যেন সেই বাক্যকেই সত্যি করে তুলল। দলের ভেতর গুজব ছড়িয়ে পড়ল যে মৃত্যুর দেবদূত এখন তাঁদের চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অনেকেই কাজকর্ম বন্ধ করে শিবির ছাড়ার কথা বলতে শুরু করল, কিন্তু শঙ্খের রহস্য তাঁদের যেন অদৃশ্য শেকলে বেঁধে রেখেছিল।
দ্বিতীয় শিকার হলেন রঞ্জিত, যিনি আগের রাতে পাহারায় ছিলেন। ভোরে তাঁকে আর খুঁজে পাওয়া গেল না। চারদিকে খোঁজা হল, জঙ্গলে তল্লাশি চালানো হল, কিন্তু কোথাও তাঁর চিহ্ন মেলেনি। শুধু নদীর ধারে এক জায়গায় বালির ওপর গভীর পদচিহ্ন পাওয়া গেল, যা মানুষের নয়, বরং যেন অদ্ভুত আকারের, বিশাল আর শীতল। সবার গা কাঁটা দিয়ে উঠল। কেউ বলল, হয়তো বন্য জন্তু তুলে নিয়ে গেছে, আবার কেউ ফিসফিস করে বলল—“না, ওটা মৃত্যুর দূতের পায়ের চিহ্ন।” ভয়ের ছায়া তখন আরেকটু গাঢ় হয়ে ছড়িয়ে পড়ল। দলের কয়েকজন ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে শিবির গুটিয়ে ফেরার জন্য অনুরোধ জানাল, কিন্তু অনিরুদ্ধ দ্বিধায় পড়লেন। তিনি জানতেন, ফিরে গেলে হয়তো তাঁরা বাঁচবেন, কিন্তু শঙ্খের রহস্য অমীমাংসিত থেকে যাবে, আর এই অশুভ শক্তি হয়তো আবার কোনোদিন ফিরে আসবে। এই দ্বন্দ্বের মাঝেই মৃত্যু যেন তাঁদের চারপাশে ঘোরাফেরা করছিল। রাত নামতেই শিবিরে এক অদ্ভুত নীরবতা নেমে এল। বাতাস ভারি হয়ে উঠেছিল, মনে হচ্ছিল প্রতিটি ছায়ার ভেতরে কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে, নিঃশ্বাস ফেলছে, অপেক্ষা করছে পরবর্তী শিকার হওয়ার জন্য।
তৃতীয় ঘটনা ঘটল আরও ভয়ঙ্করভাবে। শিবিরের সবাই যখন গভীর ঘুমে, তখন হঠাৎ ভোররাতে চিৎকারে কেঁপে উঠল ক্যাম্প। ছুটে গিয়ে দেখা গেল, যুবক কর্মী সঞ্জয় মাটিতে লুটিয়ে আছে। তাঁর গলায় যেন অদৃশ্য কোনো হাত শক্ত করে চেপে ধরেছিল, কারণ কোনো বাহ্যিক ক্ষত না থাকলেও শ্বাসরোধ হয়ে তাঁর প্রাণ গেছে। তাঁর মুখের চোখদুটো বিস্ফারিত, যেন তিনি মৃত্যুর মুহূর্তে কোনো অমানবিক দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেছিলেন। এবার আর কারও সন্দেহ রইল না—এটা কোনো কাকতালীয় ঘটনা নয়, এ যেন অভিশাপের ধারাবাহিকতা। দলের ভেতর হাহাকার পড়ে গেল। কেউ কাঁদছে, কেউ প্রার্থনা করছে, কেউ আবার উন্মাদের মতো চিৎকার করছে। চারপাশের জঙ্গল, শিবির, এমনকি বাতাসও যেন মৃত্যুর ছায়ায় আচ্ছন্ন হয়ে গেল। অনিরুদ্ধের মনে হচ্ছিল, প্রতিটি মৃত্যু কেবল তাঁদের ভয় বাড়াচ্ছে না, বরং শঙ্খের অশুভ শক্তিকে আরও সক্রিয় করে তুলছে। তিনি উপলব্ধি করলেন, যতক্ষণ না অভিশাপের মূল রহস্য ভেদ হচ্ছে, ততক্ষণ এই মৃত্যুমিছিল থামবে না। কিন্তু এরই মধ্যে দলের সদস্যরা একে একে ভেঙে পড়তে শুরু করল। কারও মনে ভীতি, কারও মনে সন্দেহ, আর সবার মনে একই প্রশ্ন—পরবর্তী শিকার কে?
৮
রাত্রি যখন গভীর, তখন শিবিরে ভয়ের ছায়া সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। অনিরুদ্ধ এবং তাঁর দলটি দিনভর হওয়া মৃত্যুর পরও ধীরে ধীরে শান্তির খোঁজে ছিল, কিন্তু ভেতরের অস্থিরতা কিছুতেই কমছিল না। প্রথমে সকলে চুপচাপ বসে কল্পনা করে ভীতি সামলানোর চেষ্টা করছিল। কিন্তু ক্রমশই দলের কিছু সদস্য—বিশেষ করে তরুণ কর্মীরা—ভয়, ক্ষোভ আর অপরাধবোধের চাপ সহ্য করতে পারছিল না। তারা ভাবল, শিবির ছেড়ে গ্রামে ফিরে যাওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। তাঁরা নিজেদের মধ্যে চুপচাপ আলোচনা করল, কিছু সরঞ্জাম এবং শঙ্খটির নিরাপদ দূরে রাখার পরিকল্পনা করল, যেন যত দ্রুত সম্ভব এই অভিশপ্ত স্থান ত্যাগ করা যায়। রাতের অন্ধকারে তারা নীরবভাবে ব্যাগ গুছিয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছিল। কিন্তু শিবিরের চারপাশে বাতাসে ভেসে আসা হিমশীতল ফিসফিসানি, অদ্ভুত ছায়ার নড়াচড়া তাদের কাঁপিয়ে দিচ্ছিল। প্রত্যেকটি পদক্ষেপে মনে হচ্ছিল, যেন কোনো অদৃশ্য চোখ তাঁদের দিকে তাকাচ্ছে।
পলায়নের প্রস্তুতি নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই, গ্রামের দিকে যাওয়ার জন্য তারা হরেকৃষ্ণকে খুঁজল। স্থানীয় গাইড হরেকৃষ্ণ, যিনি সব ভয়ঙ্কর কাহিনি জানতেন, তাঁদের সতর্ক করলেন। তিনি কাঁপা গলায় বললেন, “যদি শঙ্খ একবার বাজানো হয়ে গেছে, তবে আর কোনো পালানোর পথ নেই। অভিশাপ যে যিনি প্রথম বাজালেন, তাকে তাড়া করবে, তা ইতিহাস সাক্ষী। গ্রামে ফিরে যাওয়া কোনো সমাধান নয়, বরং আরও বিপদ ডেকে আনবে। কেউ যদি শিবির ছেড়ে যায়, সেই অভিশাপ সঙ্গে সঙ্গে তার ওপর নেমে আসবে। শুধু সচেতন থাকতে হবে এবং উপায় খুঁজে বের করতে হবে, না হলে মৃত্যুর ছায়া তাদের গ্রাস করবে।” এই সতর্কবার্তা শোনার পর তরুণ কর্মীদের মধ্যে আতঙ্ক আরও বেড়ে গেল। তাঁরা বুঝতে পারল, তাঁদের পলায়ন পরিকল্পনা কোনও কাজে আসবে না। অনিরুদ্ধও মনে করলেন, ভয়কে নিয়ন্ত্রণ করে শঙ্খের রহস্য সমাধান করার পথ খুঁজে বের করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
গ্রামের লোকের সতর্কবার্তার পরেও দলের ভেতর বিভক্তি দেখা দিল। কিছু সদস্য এখনও পালানোর চেষ্টা করতে চাইছিল, আবার কিছু সদস্য অনিরুদ্ধের নেতৃত্বে থেকে রহস্য উদ্ঘাটনের পথ অনুসরণ করতে চাইছিল। রাতের অন্ধকারে শিবিরে বাতাস ভারী হয়ে উঠল, আর অদৃশ্য শক্তির উপস্থিতি প্রতিটি কণায় অনুভূত হচ্ছিল। শঙ্খটি বাক্সে রাখা হলেও, অদৃশ্য কম্পন এবং ফিসফিসানি তাদের ভেতরে ঢুকে গিয়ে আতঙ্কের মাত্রা বৃদ্ধি করছিল। প্রত্যেকেই বুঝতে পারছিল—এই অভিশপ্ত যন্ত্রটির সঙ্গে লড়াই শুধুমাত্র তাদের মানসিক দৃঢ়তার পরীক্ষা নয়, বরং জীবন ও মৃত্যু নির্ধারণের এক চূড়ান্ত পরীক্ষাও বটে। অনিরুদ্ধ সিদ্ধান্ত নিলেন, দলের সবাইকে একত্রিত করে, ধৈর্য ও বুদ্ধি ব্যবহার করে সমস্যার সমাধান করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। তবে রাত যত গভীর হচ্ছিল, আতঙ্ক ততই বেড়ে যাচ্ছিল, আর শিবিরের চারপাশে মৃত্যুর ছায়া যেন তাদের চারপাশে মৃদু কম্পনে ভেসে বেড়াচ্ছিল—এক অদৃশ্য শক্তি যা পলায়ন বা স্বাভাবিক কৌশলকে চূর্ণ করে দিতে প্রস্তুত ছিল।
৯
রাত গভীর ও অন্ধকার, আর শিবিরের চারপাশে মৃত্যুর ছায়া একেবারে ঘন হয়ে উঠেছে। অনিরুদ্ধকে প্রতিনিয়ত মনে পড়ছে শিলালিপির বার্তা—“যে বাজাবে, তার আত্মা শোষণ করবে মৃত্যুর দেবদূত।” দলের একের পর এক সদস্য মৃত্যুর ঝুঁকিতে পড়েছে, আতঙ্কের মাত্রা ক্রমশ অগ্রসর হচ্ছে। অনিরুদ্ধ গভীরভাবে উপলব্ধি করলেন, যে একমাত্র উপায় এই অভিশাপ ভাঙার, তা হলো শঙ্খটি আবার বাজানো। কিন্তু এবার যেকোনো অগোছালো কৌশল নয়—শঙ্খকে বাজাতে হবে মন্দিরের মূল গর্ভগৃহে, প্রাচীন আচার অনুসরণ করে। তাঁর মনে পড়ে গেল হরেকৃষ্ণের কথাগুলো, যা শতাব্দী পুরোনো কাহিনির অংশ—পুরোহিতরা শঙ্খ বাজানোর আগে নির্দিষ্ট মন্ত্র জপ করত, আগুনের চারপাশে চক্রাকারে দাঁড়াত এবং চারটি কোণায় প্রাচীন প্রতীক স্থাপন করত। অনিরুদ্ধ জানতেন, সময় কম, দলের সবাই একেবারে ভয় ও হতাশায় আক্রান্ত। তার জন্য এই শেষ বাজনা একমাত্র আশার আলো।
মন্দিরের ভেতরে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে বাতাস আরও ভারী হয়ে উঠল। প্রতিটি স্তম্ভ, প্রতিটি ভাঙাচোরা দেয়াল যেন অতীতের অভিশাপ নিয়ে নড়াচড়া করছে। অনিরুদ্ধ শঙ্খ হাতে নিয়ে ধীরে ধীরে মূল গর্ভগৃহের দিকে এগোচ্ছিলেন। তিনি চারপাশে থাকা প্রতীকগুলো পুনরায় স্থাপন করলেন, আগুন জ্বালালেন, এবং মন্ত্র জপ শুরু করলেন—প্রাচীন শব্দগুলো বাতাসে কণ্ঠরেখা হয়ে প্রতিধ্বনিত হল। হঠাৎ অনুভূত হলো মন্দির কেঁপে উঠছে—ভাঙা স্তম্ভ থেকে ধুলো উড়ে যাচ্ছে, বাতাসে অদ্ভুত কম্পন, আর দূরে দূরে ফিসফিসানি। দলের বাকিরা ভয়ংকর দৃশ্য প্রত্যক্ষ করছিল। ছায়া যেন জীবন্ত হয়ে উঠল, মন্দিরের কোণায় ঘোরাফেরা করছে। অনিরুদ্ধ ধৈর্য্য ধরে মন্ত্র জপ চালিয়ে যাচ্ছিলেন, চোখ বন্ধ রেখে সমস্ত শক্তি মন্দিরের কেন্দ্রে কল্পিত আবাহনে নিয়োজিত করছিলেন। প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি নিঃশ্বাস যেন শঙ্খের অভিশপ্ত শক্তিকে দমন করার জন্য আবির্ভূত হচ্ছে।
শেষ মুহূর্তে, অনিরুদ্ধ শঙ্খটি শক্তভাবে বাজালেন। এমন এক প্রতিধ্বনি মঞ্চে ভেসে এলো, যা বাতাসকে কাঁপিয়ে দিল, মন্দিরের সব স্তম্ভ, দেয়াল আর ধ্বংসাবশেষ যেন সঙ্গীতে নাচতে শুরু করল। ছায়া, ফিসফিসানি, হিমশীতল বাতাস—সবই একত্রে ভয়ানকভাবে থেমে গেল। একটি মৃদু, কিন্তু শক্তিশালী ঝলক দেখালেন—মন্দিরের কেন্দ্র থেকে নীলাভ আলো ফুটে উঠল, যা অভিশপ্ত শক্তিকে গহ্বর থেকে টেনে বের করে দিয়ে নিঃশেষ করে দিল। অনিরুদ্ধের চোখে ঘাম আর চোখের জলে অশ্রু মিশে গেল, কিন্তু ভেতরে শান্তি—অত্যন্ত নীরবতা নেমে এলো। দলের বাকি সদস্যদের শরীরে কাঁপন থেমে গেল, মৃতপ্রায় আতঙ্ক ধীরে ধীরে মুছে গেল। শিবিরের চারপাশের মৃত্তিকা আর বাতাস, যা আগে হিমশীতল ও ভয়ঙ্কর ছিল, এখন শান্তি ও প্রশান্তিতে ভরে উঠল। অনিরুদ্ধ জানতেন, ইতিহাসের এই অধ্যায় কঠিন, ভয়ঙ্কর ও জীবন-হানিকর হলেও, শেষ বাজনার মাধ্যমে তারা অভিশাপ ভেঙে দিয়েছিলেন। মন্দিরের প্রতিটি স্তম্ভ, প্রতিটি ধ্বংসাবশেষ যেন প্রমাণ দিচ্ছিল—যে একবার অশুভ শক্তি জাগে, তা কেবল ধৈর্য, জ্ঞান ও সাহসের মাধ্যমে জয় করা সম্ভব। শিবিরের মধ্যে সকলেই ধীরে ধীরে শান্ত হলেন, তাদের মনে একটি গভীর শিক্ষা ও নতুন প্রত্যয় জন্ম নিল—প্রাচীন রহস্য ও শক্তি যত ভয়ঙ্করই হোক, সাহস, বুদ্ধি এবং ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধা থাকলেই তা জয় করা সম্ভব।
১০
ভোরের প্রথম আলো মন্দিরের ধ্বংসস্তূপকে সোনালী আভায় আচ্ছাদিত করল। ধুলো আর ধ্বংসাবশেষের মধ্য দিয়ে সূর্যের আলো এসে পড়ে, যেন মৃত্যু এবং ভয়াল রাতের সব প্রমাণকে ম্লান করে দিচ্ছে। শিবিরের বাকিরা নিঃশব্দে চারপাশে তাকাচ্ছিল, হৃদয় ভারাক্রান্ত। বাতাস এখন শান্ত, আর রাতের হিমশীতল ফিসফিসানি আর অদৃশ্য ছায়া কোথাও নেই। মন্দিরের মূল গর্ভগৃহে যা হয়েছিল, তা যেন ইতিহাসের পাতায় এক রহস্যময় অধ্যায় হয়ে গেছে। রমেশ, রঞ্জিত, সঞ্জয়—যারা একে একে শিকার হয়েছিলেন—তাদের মৃত্যু আর আতঙ্ক যেন স্থির হয়ে গেছে। শিবিরের বাকি সদস্যরা কিছুটা স্বস্তি পেয়েছিল, মনে হচ্ছিল যে অভিশাপ শেষ হয়ে গেছে, আর তারা জীবিত বেঁচে আছে। কিন্তু এই শান্তি যেন শুধুই সাময়িক; প্রত্যেকের মনেই জাগছিল অনিরুদ্ধের জন্য অগোচর উদ্বেগ।
অনিরুদ্ধের অবস্থান ছিল অজানা। তিনি শেষ বাজনার সময় শঙ্খের সঙ্গে মন্দিরের কেন্দ্রস্থলে প্রবেশ করেছিলেন। দলের বাকি সদস্যরা তাকে দেখেছিল শেষ মুহূর্তে, শিলালিপি পড়ার ও মন্ত্র জপের সময়। তারপর থেকেই অনিরুদ্ধ নিখোঁজ। ধ্বংসস্তূপের মধ্যেও তাঁর কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়নি—না পা, না হাতের ছাপ, না কোনো পোশাকের অবশিষ্টাংশ। কেউই বলতে পারছিল না, তিনি কি মৃত্যুর হাতে পরাজিত হয়েছেন, নাকি কোনো অদৃশ্য শক্তি তাঁকে নিয়ে গেছে। তার অনুপস্থিতি দলের মধ্যে ভয় এবং অনিশ্চয়তার এক নতুন স্তর সৃষ্টি করল। আতঙ্কের রাত শেষ হলেও, অনিরুদ্ধের নিখোঁজ থাকা যেন সবকিছুকে নতুন করে ভয়ানক করে তুলল। তাঁরা বুঝতে পারল—যে শক্তি শেষ বাজনার মাধ্যমে সংযত হয়েছে, তা হয়তো ঠিকঠাক নিয়ন্ত্রিত হয়েছে, কিন্তু সম্পূর্ণ ধ্বংস করা যায়নি।
সর্বশেষে, ধ্বংসস্তূপের মধ্যে এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। দলের একজন সদস্য ধুলো এবং ধ্বংসাবশেষ থেকে কিছু উঁচুতে ভেসে ওঠা দেখতে পেল। সেটি একটি নতুন শিলালিপি, যা অতি প্রাচীন লিপিতে খোদাই করা—কিন্তু এর মানে স্পষ্ট। ধীরে ধীরে পড়ে বোঝা গেল, এতে লেখা আছে: “শঙ্খ নতুন প্রভুর অপেক্ষায়।” এই বাক্য শিবিরে এক চরম আতঙ্ক এবং বিভ্রান্তি সৃষ্টি করল। সকলের চোখে ভয়, বিস্ময় এবং কৌতূহল একত্রে ফুটে উঠল। তারা বুঝতে পারল, যদিও তারা মৃত্যুর অভিশাপ থেকে মুক্ত হয়েছে, তবে শঙ্খের শক্তি স্থায়ীভাবে সমাপ্ত হয়নি। বরং এটি এখন নতুন কোনো প্রভুর জন্য অপেক্ষা করছে—কারও জন্য, যিনি একদিন আবার এই অভিশাপকে উদ্দীপিত করবেন। ধ্বংসস্তূপের মধ্যেও এই ভয়ঙ্কর সতর্কবার্তা স্পষ্ট—মুক্তি এসেছে, কিন্তু নতুন অধ্যায়ের আভাস দিয়ে, যা পরবর্তী কাহিনির সম্ভাবনা খুলে দিয়েছে। বাতাসের মধ্যে এখন নিস্তব্ধতা এবং হালকা কম্পন, যেন শঙ্খের অপেক্ষার প্রতিফলন, তাদের মনে ভীতির পাশাপাশি এক ধরনের রহস্যময় কৌতূহলও জাগিয়েছে।
শেষ