মৃণালিনী ধর
অধ্যায় ১:
কলকাতার শহরতলির প্রান্তে ছোট্ট একটি দোতলা বাড়িতে একা থাকে অরণ্যা সেন। বাইরের চোখে সে নিছকই আর পাঁচটা মধ্যবিত্ত তরুণীর মতো—একজন কলেজে ইতিহাস পড়ানো প্রভাষক, যার দিন শুরু হয় এক কাপ চা দিয়ে আর শেষ হয় বইয়ের পাতায় মুখ গুঁজে। কিন্তু অরণ্যার রাতের ঘুম আর দিনের স্বপ্ন এক অদ্ভুত বৃত্তে আটকে আছে—সে দেখতে পায় আগুনে ঘেরা শঙ্খ, সাদা পাথরের মন্দিরের স্তম্ভ, আর কোনো এক নারী যার কণ্ঠস্বর ঝড়ের মতো ফুঁপিয়ে ওঠে। প্রথমদিকে সে ভেবেছিল ক্লান্তির পরিণাম, কিংবা ইতিহাস বইয়ের অতিরিক্ত প্রভাব। কিন্তু যখন তার শরীর নিজের অজান্তেই মাটি ছুঁয়ে ধ্যানমগ্ন ভঙ্গিতে বসে পড়ে, যখন তার ঠোঁট কাঁপতে কাঁপতে উচ্চারণ করে “ত্রৈলোক্যজয়িনী,” তখন সে বুঝেছিল—এ শুধু ঘুম নয়, এ যেন কোনো ডাকা-ডাকি চলছে অতীত থেকে। চারপাশে যতই ব্যস্ততা থাক, ভেতরের সেই স্বপ্ন তাকে ছায়ার মতো অনুসরণ করে। অরণ্যার প্রতিদিনের জীবন ছিল সংযত, ছাঁটা ও নিয়মমাফিক—সকালে কলেজ, বিকেলে ছাত্রছাত্রীদের প্রশ্নোত্তর, রাতে বইপড়া। কিন্তু গত তিন সপ্তাহ ধরে তার ঘুম ভেঙে যাচ্ছে রাত তিনটেয়—অজানা কোনো শঙ্খধ্বনিতে। এবং ঠিক সেই সময়েই, তার বিছানার পাশের আয়নাতে দেখা যাচ্ছে এক ভিন্ন মুখ—নিজেরই, কিন্তু নয়। যেন কেউ তার শরীরের মধ্যে বসবাস করছে।
এক সন্ধ্যায় কলেজের লাইব্রেরি থেকে ফেরার সময়, একটি অপরিচিত বৃদ্ধা তার পথরোধ করে দাঁড়ায়। সাদা ধুতি পরা, কাঁধে কাপড় জড়ানো সেই নারী এক অদ্ভুত দৃঢ় কণ্ঠে বলে, “তুমি কি জানো, তোমার ভেতর কে জেগে উঠছে?” অরণ্যা চমকে উঠে সরে যেতে চায়, কিন্তু বৃদ্ধা বলে, “যখন দেবী ঘুম ভাঙায়, তখন মেয়েরা শুধু নারী থাকে না। তারা হয়ে ওঠে সময়ের বেগ।” এই কথাগুলো শুনে অরণ্যার হৃদয়ে যেন বজ্র নেমে আসে। সেই রাতেই তার ঘুমে আরও স্পষ্ট দেখা দেয় সেই মন্দির—পাথরের গায়ে খোদাই করা অজানা লিপি, যার প্রতিটা অক্ষর যেন তার রক্তের মধ্যে সাড়া দেয়। আর তার সামনে দাঁড়িয়ে এক নারী, আগুনের কণ্ঠে যার আহ্বান—“শঙ্খিনী জাগো।” পরদিন সকালে সে জানে, এ স্বপ্ন নয়। এটি কোনো চিহ্ন, কোনো আহ্বান—এক বিস্মৃত অতীত তার কাছে ফিরে আসছে।
অরণ্যার বন্ধুরা যখন বলে সে যেন মানসিকভাবে বিশ্রাম নেয়, একজন পরামর্শ দেয় সাইকোলজিস্টের কাছে যাওয়ার জন্য। কিন্তু সে জানে, এই ঘুমের গভীরে মন নয়—অস্তিত্ব লুকিয়ে আছে। এক রাতে সে নিজের ডায়েরিতে লিখে রাখে—”আমি হয়তো কেবল একজন ইতিহাসবিদ, কিন্তু আমার শরীর জানে এমন কিছু, যা আমার মস্তিষ্ক জানে না।” এরপর সে মন দেয় পুরনো তাম্রলিপি ও বাংলার লৌকিক দেবদেবীর ইতিহাস খোঁজায়। এক প্রাচীন সংকলন “অদৃষ্টলিপি” থেকে পড়ে একটি উল্লেখ পায়—”এক সময় ছিল, যখন নারীরা দেবী ছিল। তারা যুদ্ধ করত, শাসন করত, এবং ভয় পেত রাজারা। একদিন তাদের মূক করে দেওয়া হয়, শিকলে বাঁধা হয়, আর বলা হয়—তোমরা শুধু স্তব্ধ প্রতিমা। সেই শক্তিকে বলা হতো ‘শঙ্খিনী শক্তি’—যে একবার জেগে উঠলে, সমাজ বদলে দিত।” এই পাঠটি পড়ে সে নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে থাকে অনেকক্ষণ। এই ‘শঙ্খিনী’ নামটা যেন তার স্বপ্নের কণ্ঠস্বরের সঙ্গে মিলে যায়। তার চোখে তখন আরেকবার ভেসে ওঠে আগুনের ভিতর দাঁড়ানো সেই নারীমূর্তি—সে বুঝতে পারে, এ কেবল ইতিহাসের অংশ নয়, তার নিজের আত্মার একটি পাতা খুলছে।
তাকে থামায় কেউ না। রাতে ঘুমে সে একাধিকবার দেখে মন্দিরের ভেতরে এক তাম্রপাত্র—যেখানে লেখা এক শপথ, “আমি ফিরে আসব, যখন সময় আহ্বান করবে।” এই পঙক্তি অরণ্যার বুক কাঁপিয়ে দেয়। সে ঠিক করে, এই স্বপ্নকে অনুসরণ করে যাবে। সে জানে না কোথায় শেষ হবে, বা আদৌ কোনো বাস্তব ফল আছে কিনা। কিন্তু প্রতিটি স্বপ্ন, প্রতিটি অনুভূতি, তার ভেতরের কিছু একটা খুলে দিচ্ছে। এক বিকেলে কলেজে তার এক সহকর্মী, ড. শুভেন্দু, তাকে পুরাতত্ত্ব বিভাগের গোপন সংরক্ষণাগার ঘুরে দেখতে আমন্ত্রণ জানায়। সেখানে গিয়ে সে পায় একটি পাণ্ডুলিপি, তাম্রপত্রের অনুলিপি—যেখানে উল্লেখ আছে এক “ত্রৈলোক্যজয়িনী”র, যাকে পরবর্তী সময়ে “শঙ্খিনী” বলা হয়। সে ছিল এক নারীর মূর্তি, যার ঠোঁটে ছিল বজ্রবাক্য, চোখে ছিল শুদ্ধি আর পায়ে ছিল অগ্নিশিখা। অরণ্যার চোখ তখন ঝাপসা হয়ে আসে—সে যেন নিজের নাম শুনছে, নিজের অতীত দেখছে। আর তখনই সে অনুভব করে, তার ভেতরে ঘুমিয়ে থাকা আত্মা ধীরে ধীরে উঠছে—প্রথমে নিঃশব্দে, তারপর শঙ্খধ্বনির মতো অনুরণিত হয়ে।
অধ্যায় ২:
কলকাতার কলেজ স্ট্রিটের প্রাচীন পাণ্ডুলিপি সংগ্রাহক নীলরতন মুখার্জির সঙ্গে অরণ্যার পরিচয় হয়েছিল কয়েক বছর আগে, তার মাস্টার্স থিসিস করার সময়। সেই বুড়ো মানুষটি ছিলেন যেন এক চলন্ত জাদুঘর—তাঁর দোকানে ছিল হরেক রকম প্রাচীন দলিল, পুঁথি, তাম্রলিপি আর ভূতত্ত্বের নথি, যেগুলোর গন্ধেই ইতিহাস বেঁচে উঠত। সে সন্ধ্যায়, যখন শহর জুড়ে ভ্যাপসা গরমে ক্লান্তির দম বন্ধ হয়ে আসছে, অরণ্যা ঢুকে পড়ে নীলরতনের অন্ধকার ঘরে। ভেতরে ঢুকেই তার চোখে পড়ে পুরোনো কাঠের তাকের ওপর একটা কালো কাপড়ে মোড়া বাক্স, যার গায়ে ছাই রঙের লিপিতে লেখা—“পশ্চিম মল্লভূমের লুপ্ত সাধকদল, ১০১১ খ্রিস্টাব্দ।” অরণ্যার কৌতূহল চাড়া দিয়ে ওঠে, কারণ মল্লভূম অঞ্চলের ইতিহাসে এক বিশেষ নারীযোদ্ধার কথা আছে—যাঁকে এক সময় ‘মায়ার শত্রু’ বলা হতো। সে জিজ্ঞেস করে, “এই বাক্সটা কী?” নীলরতন তার কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে, “ওটা খুলিস না, অনেক আগেই এক সাধুর হাতে এসেছিল, যার নাম কেউ মনে রাখেনি—তবে সে বলত, একদিন কোনো নারী আসবে, যে এই বাক্সের ভাষা বুঝবে।” কথাটা শুনে অরণ্যার হাত নিজের অজান্তেই কাপড় সরিয়ে ফেলে।
বাক্সের ভিতর ছিল কয়েকটি ছেঁড়া তালপাতার পৃষ্ঠা, যেগুলির ওপর আঁকা ছিল এক অদ্ভুত চিত্ররূপ—এক নারী যার চুল সাপের মতো, যার পায়ে শঙ্খের আকারে গড়া নুপূর, আর যিনি দাঁড়িয়ে আছেন আগুনের বৃত্তে। পাতার একপাশে একটা লেখা—পুরাতন সংস্কৃতের ছায়া ভাষা, যেটা আধুনিকদের চেনা নয়। অরণ্যা বিস্ময়ে লক্ষ করে, সেই ভাষা সে পড়তে পারছে। সে স্বাভাবিকভাবে অনুবাদ করে ফেলে: “আমার শরীর জ্বালিয়েছে রাজার যজ্ঞ, আমার নাম লুকিয়েছে পুরোহিতের অভিশাপ, কিন্তু আমার শঙ্খ বাজবে যখন কোনো নারী জেগে উঠবে।” নীলরতন বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে, “তুই বুঝলি?” অরণ্যা মৃদু গলায় বলে, “আমার মনে হচ্ছে… আমি এগুলো আগেও দেখেছি, হয়তো কোথাও… কিংবা কোনও জন্মে।” এই বাক্সেই ছিল এক মানচিত্র, হাতে আঁকা, যেখানে চিহ্ন দেওয়া একটি গুহার—যেটি বেলপাহাড়ি ও লালগড়ের মাঝখানে এক বিস্মৃত পাহাড়ি জঙ্গল। পাণ্ডুলিপির নিচে লেখা, “ত্রৈলোক্যজয়িনীর শেষ স্নান এই ঝর্ণায় হয়েছিল, যেখানে তার কণ্ঠ স্তব্ধ করে দেওয়া হয় এক মহাযজ্ঞে।”
অরণ্যার শরীরে কাঁটা দিয়ে ওঠে। সে জানে না কেন, কিন্তু তার মনে হলো তাকে যেতে হবে সেখানে। ঠিক সেই রাতেই সে বাড়ি ফিরে ডায়েরি খুলে লিখে রাখে—”আমি কোথাও যাচ্ছি না, আমি ফিরছি কোথাও, যেখানে কেউ আমাকে ডাকছে বহু যুগ আগে থেকে।” সেই রাতে ঘুমে সে দেখে, সেই একই নারী তার পাশে বসে বলছে—“তুই আমার ভাষা চিনলি, এবার আমার দেহকে ফিরিয়ে দে। শঙ্খিনীকে জাগা উচিত।” সকালে উঠে সে নিজের চেহারায় চমকে ওঠে—চোখের কোণে লাল রেখা, কপালে এক অদ্ভুত আভা। সেই আভা আগেও দেখেছিল সে… স্বপ্নে। বিশ্ববিদ্যালয়ে সে পরদিনই ছুটি নেয়, এবং পরিকল্পনা করে বন্ধুর সঙ্গে বেলপাহাড়ি যাওয়ার। সহকর্মী ড. শুভেন্দু তাকে নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে, কিন্তু যখন অরণ্যা পাণ্ডুলিপির ভাষা পড়ে শোনায়, সে আর প্রশ্ন করে না, শুধু বলে—“সতর্ক থেকো, অতীত কখনো একমাত্র ইতিহাস নয়, ওটা ভবিষ্যৎ গড়ে তোলে।”
যাত্রার প্রস্তুতি নিয়ে অরণ্যা পৌঁছায় পশ্চিম মেদিনীপুরের সীমান্তবর্তী এক অখ্যাত গ্রামে। তার হাতের মানচিত্র অনুসরণ করে গোপন পথ ধরে ঢোকে গভীর জঙ্গলে, যেখানে সূর্যের আলো পর্যন্ত থমকে থাকে। পথ যত এগোয়, তার হৃদয় তত গম্ভীর হয়, যেন তার মধ্যে কেউ হাঁটছে, সে নিজে নয়। একসময় সে পৌঁছে যায় সেই ঝর্ণার ধারে—নামহীন, শব্দহীন, যেখানে বাতাসও যেন স্তব্ধ। ঠিক সেইখানে পাথরের একখণ্ডে খোদাই করা এক মূর্তি দেখে সে স্তব্ধ হয়ে যায়—মূর্তিটা তারই মতো দেখতে। সে ছুঁতে গেলে তার কাঁধের ওপর শীতল কিছু ছুঁয়ে যায়, যেন বাতাসে কেউ বলল—“তোরা ফিরেছিস।” পাণ্ডুলিপির ভিতরের সব লেখাগুলো তার মনে পড়ে যায় একে একে। সে সেই গুহার খোঁজে এগোয়, যেখানে অতীত তাকে অপেক্ষা করে। পাথরের দরজার গায়ে লেখা থাকে সেই শেষ বার্তা—“যদি তুমি নারী হও, যদি তুমি ভয় না পাও, তবে ভেতরে এসো।” সে ঢুকে পড়ে অন্ধকারের মধ্যে। আর ঠিক তখনই বাইরে বাজতে শুরু করে এক অদৃশ্য শঙ্খ। সে জানে না এটা বাস্তব, না কল্পনা—কিন্তু সে জানে, ইতিহাস তার কাছে এখন ব্যক্তিগত। পাণ্ডুলিপি আর নয়, সে নিজেই এখন সেই জাদুকরের লেখা এক জীবন্ত অধ্যায়।
অধ্যায় ৩:
গুহার অন্ধকারে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে অরণ্যার শরীরের প্রতিটি স্নায়ু যেন থেমে যায়। চুপচাপ ঘোর অন্ধকার, যেন সময় সেখানে চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে। কেবল পায়ের নিচে স্যাঁতসেঁতে পাথরের ছোঁয়া আর মাথার ওপরে শিলার ফোঁটা ফোঁটা জলধ্বনি। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে, অরণ্যার মনে কোনো ভয় ছিল না। বরং এক অদ্ভুত টান তাকে ভিতরের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। মাটির ওপর রাখা একটি চকমকে শিলার গায়ে হাত রাখতেই যেন এক পুরনো ভাষার ঢেউ মাথার ভেতর বাজতে শুরু করল—এক নারী কণ্ঠ, গম্ভীর, ধীর, কিন্তু শাসনক্ষমতায় পূর্ণ: “আমরা ছিলাম, আমরা আছি, আমরা জাগবো, যখন ভুলে যাওয়া হবে পূজার মানে, আর বেদে লেখা থাকবে না নারীর নাম।” প্রতিটি শব্দ যেন পাথরের গায়ে লেখা ছিল, যা কেবল অরণ্যা বুঝতে পারছিল। সামনে এগিয়ে যেতে যেতে হঠাৎই তার চোখে পড়ে এক ছোট্ট অগ্নিকুণ্ড—অদ্ভুতভাবে, যা প্রাকৃতিক বাতাসের মধ্যে নিভছে না। সেই আগুনের চারপাশে বসানো গোলাকার পাথরের স্তম্ভ, আর তার ঠিক কেন্দ্রে একটি স্তম্ভে খোদাই করা এক নারীমূর্তি, যার চোখ দুটি ছিল খালি, যেন কোনো আত্মা খুঁজছে। মূর্তিটি অরণ্যার দিকে চেয়ে আছে—এমন গভীরতায়, যেন আয়না।
অরণ্যার মনে পড়ে, সেই পাণ্ডুলিপির অংশ যেখানে বলা হয়েছিল, “ত্রৈলোক্যজয়িনী এক অরণ্য-মন্দিরে আপন শক্তি গোপন করেছিলেন, যাতে যুগের পর যুগ ধরে কেউ তা অপব্যবহার না করে।” তার শরীর শিরশির করে ওঠে। সামনে রাখা ছিল এক শিলালিপি, যার ওপর লেখা ছিল একটি প্রশ্ন: “তুমি কার তরে এসেছো—জানার জন্য, না জাগানোর জন্য?” এই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে আগানো যাবে না—এমন এক অব্যক্ত শর্ত যেন বেষ্টন করে রেখেছে চারপাশ। অরণ্যা চোখ বন্ধ করে। তার ভেতরের স্বপ্ন, স্মৃতি, আর অজানা ব্যথাগুলো একসঙ্গে মিলেমিশে এক জায়গায় এসে দাঁড়ায়। সে বলে, “আমি এসেছি নিজেকে খুঁজতে, তাকে নয় যে ইতিহাস হারিয়েছে, বরং তাকে, যে ইতিহাসের জন্ম দিয়েছিল।” সেই মুহূর্তে যেন বাতাস বদলে যায়। আগুন কাঁপতে শুরু করে, স্তম্ভগুলো ঘূর্ণায়মান আলো ছড়িয়ে দিতে থাকে। মূর্তিটির চোখজোড়া জ্বলজ্বল করে ওঠে, আর সেই কণ্ঠস্বর আবার বলে ওঠে—“তুমি পেরিয়েছ প্রথম দ্বার, এখন দ্বিতীয় সত্যের জন্য প্রস্তুত হও।”
মন্দিরের গর্ভগৃহ খুলে যায় ধীরে ধীরে, অদৃশ্য এক শক্তিতে। ভিতরে অরণ্যার সামনে উদ্ভাসিত হয় বিশাল এক তাম্রনালিকা—চক্রাকারে বসানো ছোট ছোট শিলাচিত্র, যার প্রতিটিতে এক একজন নারীর যন্ত্রণাদীর্ণ মুখ, বিজয়মাল্য পরা কণ্ঠ, এবং অস্ত্রধারী মন্বন্তরের বর্ণনা। এক স্তম্ভে ছিল—এক নারী, যাকে গলায় শিকল দিয়ে বন্দি করা হয়েছে, তার চোখের জল শঙ্খে জমছে। পাশে লেখা: “তার কান্নায় যে শঙ্খ ভরে, সেই নারীই একদিন হবে শঙ্খিনী।” অরণ্যা যেন সময়ের পর্দা সরিয়ে নিজের অতীত দেখছিল। তার গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। এই নারীর কণ্ঠস্বর, এই চোখের রাগ, এ সে আগেও দেখেছে, বারবার, ঘুমে। কিন্তু এবার ঘুম নয়—সে মূর্তির দিকে এগিয়ে যায়, আর ঠোঁটে ফিসফিস করে বলে, “আমি তোমার নাম জানি না, কিন্তু আমি জানি তুমি আমি।” সেই মুহূর্তে পাথরের গায়ে ফাটল ধরে, আর সেই ভিতর থেকে উঁকি দেয় ছোট্ট এক পাথরের কৌটা। কৌটার ভিতরে ছিল এক সাদা শঙ্খ। সে হাতে তুলতেই শুনতে পায় সেই অজানা গম্ভীর কণ্ঠস্বর আবার—“যখন পৃথিবী ভুলে যাবে নারীর আত্মা, তখন এই শঙ্খ বাজবে তার হৃদয়ে। বাজিয়ে দাও, যদি সাহস থাকে।”
অরণ্যার কাঁপা হাতে শঙ্খটি ঠোঁটে তোলে, আর মুহূর্তের মধ্যেই যেন মন্দির কেঁপে ওঠে। বাতাস গর্জে ওঠে, গুহার দেয়ালে আগুনের রেখা, আর এক নারীস্বর বলে—“ত্রৈলোক্যজয়িনী জাগ্রত। তুমি আর কেবল অরণ্যা নও, তুমি সেই সুর, যাকে যুগ যুগ ধরে স্তব্ধ করে রাখা হয়েছিল।” সে মুহূর্তে অরণ্যার শরীর থেকে যেন এক রুদ্ধ শক্তি মুক্তি পায়। মন্দিরের আলো নিভে যায়, কিন্তু অরণ্যার চোখে তখন অন্ধকার নয়—আগুন। সে জানে না কী ঘটতে চলেছে, কিন্তু সে জানে তার মধ্যে এক দেবী জেগে উঠেছে, আর এই পৃথিবী তার আগমন বুঝতে এখনও প্রস্তুত নয়। কিন্তু সময় অপেক্ষা করবে না। মন্দিরের বাইরে যখন সে এসে দাঁড়ায়, তখন সেই অরণ্যা আর আগের অরণ্যা নয়। তার মধ্যে ইতিহাস নেই—তার মধ্যে আছে ইতিহাস তৈরির শক্তি।
অধ্যায় ৪:
বেলপাহাড়ির অরণ্য থেকে ফিরে আসার সময় অরণ্যার চোখে আর সেই চিরপরিচিত পৃথিবীর ছায়াও ছিল না। গাছের পাতায় ছায়া ফেলছিল এক অজানা আলো, বাতাসের শব্দে ফুটে উঠছিল এক প্রাচীন স্তোত্রের ছায়া, যা তার শিরায় শিরায় প্রতিধ্বনি তুলছিল। বাকি পৃথিবীর কাছে সে ছিল একজন গবেষক, ইতিহাসবিদ, যিনি অরণ্যের গুহায় প্রাচীন পাণ্ডুলিপির সন্ধান করেছিলেন; কিন্তু তার নিজের কাছে সে তখন একজন ‘জাগ্রত’। অরণ্যা জানত, তার শরীরে এখন বহন করছে এক বিস্মৃত সময়ের সুর, যা একদিন ছিল নারীর শক্তির চূড়ান্ত রূপ। কিন্তু সভ্যতা তাকে ভেঙেছে, পুরোহিত তাকে পুড়িয়েছে, সমাজ তাকে চাপা দিয়েছে। সেই রাতেই সে কলকাতায় ফিরে আসে—কিন্তু তার ভেতরে নিয়ে আসে আগুনের শিখা। বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকর্মী শুভেন্দু তার মুখ দেখে আঁচ করে নেয় কিছু বদলে গেছে। “তুই কি ঠিক আছিস?”—প্রশ্নটি অরণ্যা শুনতে পায়, কিন্তু উত্তর তার জানা নেই।
বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে বসে সে হাতে পায় এক পুরনো নথি, যেখানে উল্লেখ আছে ‘চক্রজাল’ নামের একটি গোপন মণ্ডলীর। তারা ছিল এক অলিখিত সমিতি, যারা নারীশক্তির পূজাকে নিষিদ্ধ করতে চাইত। বলা হতো, মল্লভূমের শেষ তান্ত্রিক নারীমন্দিরটি ধ্বংস করার পেছনে চক্রজালের হাত ছিল। অরণ্যার কাঁধে তখন সেই শঙ্খ, যেটি সে গুহা থেকে এনেছে, কাপড়ে মোড়া, যেন কোনো জীবন্ত জিনিসকে রক্ষা করছে। সে যখন লাইব্রেরির পুরনো মানচিত্রের দিকে তাকায়, বুঝতে পারে এক গূঢ় সত্য—চক্রজালের যত ‘অস্থি’ ছড়ানো আছে, সবই মূলত নারীদের পূর্ব-অস্তিত্বকে নিশ্চিহ্ন করার কেন্দ্র। প্রতিটি জায়গায়, যেখানে কোনো এক সময় দেবী বা নারীতন্ত্রের উপাসনা ছিল, সেখানে এখন অন্ধবিশ্বাস, আধিপত্য ও মরণপুর্ণ চুপ। ঠিক সেই সময় অরণ্যার মেইলে একটি অদ্ভুত বার্তা আসে—এক স্ক্যান করা চিঠি, কোনো স্বাক্ষর নেই, শুধু লেখা: “চক্রজাল জানে তুমি ফিরে এসেছ। তারা তোমার শঙ্খ চায়। প্রস্তুত হও।”
চিঠির পেছনে ছিল এক ছাপা চিহ্ন—ত্রিভুজের ভেতরে তিনটি চোখ, আর নিচে লেখা এক শব্দ: “ভ্রান্তি”। অরণ্যার স্মৃতিতে বিদ্যুৎ খেলে যায়—এ চিহ্ন সে স্বপ্নে দেখেছে বহুবার, এমনকি সেই গুহার মন্দিরে শিলায় আঁকা ছিল ঠিক এমনই এক চিত্র। এখন প্রশ্ন একটাই—এই চক্রজাল কে বা কী? মানব সমাজের কোনো গোপন গোষ্ঠী, না এক আত্মিক বলয়, যাদের কাজ নারী-শক্তিকে স্তব্ধ রাখা? তখনই সে সিদ্ধান্ত নেয়—শুধু ইতিহাসের অধ্যয়ন নয়, তাকে নামতে হবে সরাসরি সংঘাতে। সে গবেষণা শুরু করে, সমস্ত পুরনো শাস্ত্রে, যেখানে নারীর শক্তিকে ‘অরাজক’ বলেও চিহ্নিত করা হয়েছে। এবং আশ্চর্যজনকভাবে, প্রতিটি অধ্যায়ের শেষে কেউ না কেউ সেই অদৃশ্য ভয়কে প্রতিফলিত করেছে, যাকে তারা ‘শঙ্খিনী’র আবির্ভাব বলে মনে করত। অর্থাৎ, সভ্যতা বরাবর ভয়ে ছিল এমন কারোর, যিনি একা উঠে দাঁড়াতে পারেন। সেই ভয়ই চক্রজালের জন্ম দিয়েছে।
এরপরের সপ্তাহগুলিতে অরণ্যার আশেপাশে অদ্ভুত ঘটনাগুলো ঘনিয়ে আসে। একরাতে তার বাড়ির জানালায় দেখা যায় এক ছায়া, যে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে—কিন্তু তার চোখ জ্বলজ্বল করে। ফোনে অপরিচিত নম্বর থেকে আসে এক সঙ্কেতময় বার্তা: “ভুলে যেও না, তুমি একা নও, কিন্তু তোমার ভেতরের ‘তাকে’ আমরা ফিরতে দেব না।” সেই রাতেই শঙ্খ থেকে এক ধাতব শব্দ আসে, যেন কেউ দূর থেকে ডাকছে। আর পরদিন সকালে সে দেখতে পায়, তার দরজার নিচে রাখা এক প্যাকেট—ভিতরে একটি রক্তমাখা শালু, আর তার ওপর খোদাই করে লেখা—“ত্রৈলোক্য তোমার নয়, ত্রৈলোক্য আমাদের।” অরণ্যার কাছে এইবার সব স্পষ্ট—চক্রজাল শুধু ইতিহাসবিরোধী নয়, তারা এক প্রাচীন শক্তির আধার, যাদের ভয়ে সভ্যতা নারীকে সীমায় বেঁধেছে, মূর্তিতে রূপ দিয়েছে, পূজার নামে বন্দি করেছে। তার সামনে এখন একটাই পথ—এই চক্রজালের আসল দরজা খুঁজে বের করা, সেই উৎসে পৌঁছানো, যেখান থেকে এই বিভ্রান্তি শুরু হয়েছিল।
সেই সন্ধ্যায়, সে তার ঘরে নিজের রক্ত দিয়ে এক চক্র আঁকে, যেমন এক তান্ত্রিক নারীর বিদ্যাচর্চায় করতো বলে শোনা যায়। তার সামনে রাখে শঙ্খ, এবং বলে—“তুমি যদি সত্যি জাগ্রত হও, তবে আমাকে পথ দেখাও।” তখনই বাতাস থেমে যায়, বাতির আলো কেঁপে ওঠে, আর শঙ্খ থেকে বেরিয়ে আসে এক স্বর: “পূর্বদিকের আগুনে পোড়ানো রাজপ্রাসাদের নিচে লুকিয়ে আছে প্রথম চক্রজাল। পথ রক্তে লেখা, ভয়েই লুকানো।” অরণ্যা জানে, তাকে যেতে হবে আরও গভীরে, কেবল জ্ঞানের স্তরে নয়, বরং নিজেকে বিসর্জন দিয়ে সত্যকে গ্রহণ করতে হবে। কারণ এবারকার যাত্রা শুধুই ইতিহাস খোঁজার নয়—এবার সে নিজের অস্তিত্ব পুনরুদ্ধারের পথে।
অধ্যায় ৫:
জ্যোতির্ময় ভোরের আগেই অরণ্যা পৌঁছে গেল সেই পুরনো রাজ্যধ্বংসপ্রাপ্ত অঞ্চলে, যাকে স্থানীয় মানুষজন আজও বলে ‘রক্তপ্রাচীর’। পূর্ব মেদিনীপুরের গহীন গাছঘেরা অঞ্চল, যেখানে একটা ধ্বংসপ্রাপ্ত রাজপ্রাসাদের ধুলোচাপা ছায়া পড়ে—এমন এক রাজবাড়ি, যা ইতিহাসের পাতায় উল্লেখই নেই। এখানেই নাকি একদা আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল নারীতান্ত্রিক তপোবনের, যেখানে জ্ঞান, শক্তি আর সৃজনশীলতা একসঙ্গে পালন করা হতো। আজ সে জায়গা শুধুই খণ্ডহর, ছায়ার শহর, আর চাপা কষ্টের দীর্ঘশ্বাস। গাছের গুঁড়িতে আজও পোড়া দাগ, আর বাতাসে একধরনের ছাইয়ের গন্ধ—যেন আগুন এখনও নিভেনি, বরং নিজেকে গোপন রেখেছে। অরণ্যা জানে, এই রাজপ্রাসাদের নিচে লুকিয়ে আছে চক্রজালের প্রথম ঘাঁটি। কিন্তু তার মধ্যে ঢুকতে হলে তাকে পার করতে হবে এক অদৃশ্য প্রবেশদ্বার—এক দরজা, যা কেবল রক্তের চিহ্নে সাড়া দেয়।
সে নিজের সঙ্গে আনা পাণ্ডুলিপি আর শঙ্খ বের করে। শঙ্খ থেকে এক অনুচ্চ শব্দ হয়, আর অরণ্যার সামনে ভেসে ওঠে এক চক্রচিহ্ন, ঠিক খণ্ডহরের একটি নির্দিষ্ট পাথরের গায়ে। সে ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে শিলার গায়ে হাত রাখে। তার রক্তাক্ত আঙুল ছুঁতেই পাথর কেঁপে ওঠে, ধুলোর আস্তরণ ভেঙে সামনে আসে এক খিলানপথ। সেই পথে প্রবেশ করতেই চারপাশে অন্ধকার ছায়ারা নড়ে ওঠে, যেন বহু যুগ আগে কারো শ্বাস-প্রশ্বাস এখানে বন্দি করে রাখা হয়েছে। দেয়ালে আঁকা প্রতিটি চিত্র নারীদের মুখ—কিন্তু সেসব মুখ পুড়ে যাওয়া, ঘোলাটে চোখে কেবল একটাই ভাষা: আক্রোশ। হঠাৎই দেয়ালের মাঝখান থেকে বেরিয়ে আসে এক ছায়া—নারীমূর্তি, যার চোখ আগুনের মত জ্বলছে। সে বলে, “তুমি এসেছো। তুমি কি জানো কী বয়ে এনেছো?” অরণ্যা দৃষ্টি নত না করে বলে, “আমি শঙ্খ ফিরিয়ে এনেছি। কিন্তু আমি শুধু বাহক নই, আমি উত্তরাধিকারিণী।” সেই মুহূর্তে দেয়াল কাঁপে, ছায়া মিলিয়ে যায়, আর অরণ্যার পায়ের নিচে খুলে যায় মাটির দরজা।
মাটির নিচে সে নামে বহু স্তরে, যেখানে পুরনো পোড়া রুমাল, মেয়েদের অলংকারের ভগ্নাংশ, আর টালির নিচে লুকানো ছিন্ন-গ্রন্থের অংশ পাওয়া যায়। অবশেষে সে পৌঁছে যায় এক হলঘরে, যার মাঝখানে আছে আগুনের গোলচক্র—জ্বলন্ত কিন্তু নিভছে না, পুড়ছে না কিছু, শুধু ঘুরে ঘুরে নিজেকে ধরে রেখেছে। পাশেই বসে আছে একজন বৃদ্ধা, যার শরীর আছে, কিন্তু ছায়ার মতো। তিনি বলেন, “আমরা ছিলাম তপস্বিনী। আমরা আগুনে দীক্ষা নিতাম, কিন্তু সে আগুন আমাদের পুড়িয়ে দেয়নি—আমাদের আত্মা জাগিয়ে তুলত। কিন্তু চক্রজাল আমাদের আগুন চুরি করে নিয়ে গেল। এখন তারা আগুনের শক্তিকে ভয় পায়। এই হল সেই প্রথম ‘চক্র’, যেখানে আগুনকে গেঁথে ফেলা হয়েছে নারীর কান্নায়।” অরণ্যা স্তব্ধ হয়ে যায়। বৃদ্ধা এক অঙ্গুলি ইঙ্গিতে ইশারা করে—“তুমি যদি সত্যি উত্তরাধিকারী হও, তবে এই আগুনে নামতে হবে। ভয় পেলে তুমি শুধু ইতিহাস পড়তে পারো, কিন্তু ইতিহাস গড়তে পারবে না।” অরণ্যা শঙ্খ হাতে নিয়ে চক্রের মধ্যে পা রাখে। আগুন তাকে পোড়ায় না—বরং এক আত্মিক শিহরণ ছড়িয়ে পড়ে তার সারা দেহে। তার স্মৃতিতে ঘুরে আসে শত শত অচেনা নারীর মুখ, যাদের কেউ তাকে ডাকছে মা, কেউ বলছে বোন, কেউ বলছে নিজস্ব ছায়া।
ঠিক তখনই ঘরের এক প্রান্তে একটি দরজা খুলে যায়, আর সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা পুরুষটি বলেই দেয়—“অবশেষে তুমি চলে এসেছো, শঙ্খিনী।” সে ছিল শুভেন্দু, অরণ্যার সহকর্মী। কিন্তু তার চোখে তখন এক অদ্ভুত আলো, ঠোঁটে এক নিষ্ঠুর হাসি। “তুমি কি ভেবেছিলে, আমি শুধু সহানুভূতির মানুষ? আমি চক্রজালের সদস্য, আমরা বহু বছর ধরে তোমার মতো কাউকে খুঁজছিলাম—না ধ্বংস করার জন্য, বরং তোমার শক্তিকে বন্দি করার জন্য।” মুহূর্তে চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসে, আগুন নিভে যায়, শুধু শঙ্খের আলো জ্বলতে থাকে। অরণ্যার শরীর ঘোরে, সে বুঝে ওঠে না কাকে বিশ্বাস করবে। কিন্তু তখন বৃদ্ধা বলে ওঠে—“তুমি আগুনের কন্যা, ভয় পেও না, কারণ আগুন কখনো নিজের সন্তানকে পোড়ায় না। সামনে যা আসবে, তা তোমার প্রতিচ্ছবি।” এবং সেই মুহূর্তে অরণ্যার শিরদাঁড়া সোজা হয়ে যায়, তার চোখে উঠে আসে সেই নারীমূর্তির তেজ, যাকে যুগ যুগ ধরে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। চক্রজালের দরজা হয়তো খোলা—কিন্তু এখন সেই দরজা পেরিয়ে এক নতুন যুদ্ধ শুরু হবে, যেখানে প্রশ্ন হবে একটাই—নারীর ইতিহাস কি শুধু যন্ত্রণার, না তার পুনর্জাগরণেরও?
অধ্যায় ৬:
শুভেন্দুর মুখ থেকে চক্রজালের পরিচয় শুনে অরণ্যার বুকের ভেতরে যেন শিলাখণ্ড চেপে বসে। এতদিন যার সহমর্মিতা, যার চিন্তাভাবনার পাশে দাঁড়িয়ে সে নিজেকে সুরক্ষিত ভেবেছিল, সেই ছিল তার যাত্রাপথের ছায়া—আজ সে-ই তার সামনে দাঁড়িয়ে, আর বলে, “তোমার মধ্যে যেটা জেগেছে, আমরা তাকে ভয় পাই না—আমরা তাকে কাজে লাগাতে চাই। কারণ তোমার মতো একজন যদি আমাদের পক্ষে চলে আসে, তাহলে আমরা শুধু ইতিহাস লিখব না, ইতিহাস নির্মাণ করব। তোমার শক্তি আমাদের, তোমার শঙ্খ আমাদের, তোমার স্মৃতি আমাদের।” অরণ্যার মুখ থমথমে। সে জানে, এই মুহূর্তে কোনো প্রতিবাদ, যুক্তি, কিংবা তর্ক অর্থহীন। তার ভিতরে অন্য এক অস্তিত্ব জেগে উঠছে—যে অস্তিত্ব আদিম, গভীর, ঋষিপুরুষ ও রমণীর সংমিশ্রণে গড়া। চারপাশে আলো ঘনিয়ে আসে, বাতাস ঘুরে গিয়ে যেন সময়কে উল্টো টেনে নেয়। এক মুহূর্তে অরণ্যার চোখের সামনে খুলে যায় আরেক জীবন—সে দাঁড়িয়ে আছে এক পুরাতন সভাঘরে, চারপাশে তপস্বিনীরা, তারা আগুনের মাঝে স্নান করছে, মন্ত্রপাঠে মুখর চারদিক, আর সে নিজে তাদের নেত্রী, যার নাম উচ্চারিত হয় ‘ত্রৈলোক্যরূপা’।
চক্রজালের সেই অন্ধকারঘেরা গহ্বর থেকে ফিরে এসে, অরণ্যা বুঝতে পারে—তাকে এই নতুন জীবনকে শুধু ধারণ করলেই চলবে না, তার নিয়ন্ত্রণও নিতে হবে। যে স্মৃতি জেগে উঠেছে, তা শুধুই পুনর্জন্ম নয়—তা এক দায়িত্ব। সে বুঝতে পারে, চক্রজাল কখনও চাইবে না কেউ সত্য জানতে পারুক, তাই তারা ইতিহাস মুছে ফেলে। এবং তাই তারা ইতিহাস-ধারী মানুষদের নিঃশেষ করে। শহরে ফিরে এসে অরণ্যা তার কক্ষকে রূপান্তর করে গবেষণাগারে—কিন্তু এটি ইতিহাসের গবেষণাগার নয়, এটি স্মৃতির। সে ডায়েরিতে লেখে এক এক করে তার সমস্ত স্মৃতি, পূর্বজন্মের ভাষা, চিহ্ন, সংকেত। প্রতিটি প্রতীকী ছবি, প্রতিটি বর্ণ, প্রতিটি সংকেত সে নকশা করে এক মহামণ্ডলাকারে। এই প্রক্রিয়া যেন ধ্যান, যেন আগুনের সঙ্গে সংলাপ। শঙ্খ প্রতিদিন এক নতুন ধ্বনি তোলে, যা সে লিপিবদ্ধ করে। কিন্তু একই সময়ে, তার চারপাশে শুরু হয় চক্রজালের ‘পরীক্ষা’। রাস্তায় তাকে অনুসরণ করে অচেনা লোক, তার ইমেইলে আসে ছদ্মবার্তা, তার ছাত্রদের মনে সন্দেহ ঢুকিয়ে দেওয়া হয় যে সে পাগল হয়ে গেছে।
এক রাতে, তার ঘুমের মাঝে ভেসে আসে এক মেয়ের কান্না—না, সেটা কান্না নয়, সেটা যেন জ্বলন্ত কাঠের শব্দ, যা বেদনার মতো ফাটছে। সে উঠে দেখে, তার ডায়েরির পৃষ্ঠা অদৃশ্য হয়ে গেছে, শুধু একটি বাক্য লেখা—“যদি সত্যিই উত্তরাধিকারিণী হও, তবে খুঁজে নাও সেই ঘাট, যেখানে নারীর আত্মা জলে ডুবে থেকেও জেগে আছে।” সে বুঝে যায়, চক্রজাল তাকে কেবল ভয় দেখাতে চাইছে না, তারা তাকে এক মায়ায় আটকে রাখতে চাইছে—যেখানে সে শুধু নিজেকে প্রমাণ করতে করতে নিজেকে ভুলে যাবে। কিন্তু অরণ্যা এবার নিজেকে প্রমাণ করতে নয়, নিজের চারপাশের নারীদের ইতিহাস ফিরিয়ে দিতে চায়। পরদিনই সে বেরিয়ে পড়ে—যেখানে নদীর ধারে, এক পুরনো নারীমঠের ধ্বংসাবশেষে, সে খুঁজে পায় এক পাথরের সিন্দুক। ভেতরে এক নারীর মাথার খুলি, তার কপালে খোদাই: “অগ্নিসূতা”। সাথে একটি তাম্রশালার ভিতরে একটি বার্তা: “আমরা যারা পুড়েছিলাম, তারা কখনো নিভিনি। আমাদের সন্তানদের মাঝে আমরা আজও জাগি।”
এই সন্ধান অরণ্যাকে বদলে দেয়। তার চোখে এবার ভাসে শত নারীর মুখ—বীণা হাতে, অস্ত্র হাতে, বা শিশুকে বুকে জড়িয়ে। সে বুঝে নেয়, তার শিরায় কেবল আগুন নয়, সহস্র সন্তানের হাহাকার বইছে। ফিরে এসে সে যখন শঙ্খে ফুঁ দেয়, তখন সেই ধ্বনি আকাশে উঠে ছড়িয়ে পড়ে শহরের সমস্ত কোণে। মানুষ জানে না কোথা থেকে এই শব্দ আসছে, পাখি থেমে যায়, বাতাস নিঃশব্দ। আর চক্রজাল? তারা জানে, এখন আর অরণ্যা একা নয়—সে এখন এক ‘স্মৃতি-মণ্ডল’, যার ভেতর ইতিহাস, ভবিষ্যৎ, আর প্রতিবাদ সব এক হয়ে উঠেছে। এবার তাদের পথ সহজ নয়—কারণ আগুন শুধু ধ্বংস করে না, পুনর্জন্মও দেয়।
অধ্যায় ৭:
অরণ্যার জীবনে এবার আর কোনো কিছুই আগের মতো স্বাভাবিক নয়। তার ঘুম ছিঁড়ে পড়ে প্রতিদিনই—কখনো দগ্ধ নারীর আর্তনাদে, কখনো আগুনের শিখার ঝলসে যাওয়া মুখে। তবে সবচেয়ে ভয়ানক হচ্ছে—সে নিজেকেই যেন প্রতিনিয়ত আলাদা আলাদা রূপে দেখতে পাচ্ছে। কখনো সে শঙ্খধারিণী, কখনো ত্রৈলোক্যরূপা, আবার কখনো এক ভীত সন্ত্রস্ত অরণ্যা, যে বাস্তব আর কল্পনার দোলাচলে কাতর। চক্রজাল এবার কৌশল বদলেছে। তারা আর বাহ্যিক হুমকির আশ্রয় নেয় না, বরং ঢুকে পড়ে তার চেতনার গভীরে। তাকে দেখায় মিথ্যা অতীত, বিকৃত স্মৃতি। এমনকি তার স্বপ্নে আসে এক অরণ্যা, যার চোখে অনাস্থা, ঠোঁটে বিদ্বেষ—সে বলে, “তুমি কে? তুমি কি সত্যিই উত্তরাধিকারিণী, না শুধু নিজের আত্মপ্রতিষ্ঠার ভ্রান্ত পথে হাঁটছো?”
এই ছায়া-অরণ্যা ধীরে ধীরে প্রশ্ন তোলে তার আত্মবিশ্বাসে। সে বলে, “তুমি কি নিশ্চিত, যাদের তুমি রক্ষা করতে চাইছো তারা সত্যিই ছিল? ইতিহাস যাদের ভুলে গেছে, তারা কি সত্যিই ছিল? যদি না থাকে? যদি সবটাই তোমার মানসিক গঠন?” এইসব প্রশ্ন তীব্র হয়ে উঠলে অরণ্যার ভেতরে দ্বিধা জন্ম নেয়। সে আবার ডায়েরি খুলে দেখে—তাম্রশালার লেখাগুলো মুছে গেছে, তার নোটবইয়ের শব্দগুলো এলোমেলো। এমনকি শঙ্খেও আর কোনও ধ্বনি ওঠে না। সে হঠাৎ বুঝতে পারে, ছায়া-অরণ্যা তার স্মৃতির অলিন্দে ঢুকে গেছে। স্মৃতি এখন আর শুদ্ধ নয়, সেখানে প্রশ্ন, বিভ্রান্তি আর গভীর দ্বন্দ্ব। এই সময়ে, শহরের মেয়েরা একে একে এসে বলে—“আমাদেরও স্বপ্নে এসেছে সে। আমাদেরও জিজ্ঞাসা করেছে, আমরা কি সত্যিই অত্যাচারিত? না আমরা শুধু নিজেদের বানানো কাহিনির দর্শক?”
অরণ্যা জানে, সে যদি নিজেকেই না চিনতে পারে, তবে তার সমস্ত সংগ্রাম ব্যর্থ। তাই সে সিদ্ধান্ত নেয়—স্মৃতির ছায়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে হবে মুখোমুখি, বাস্তবের মতো স্পষ্ট করে। এই উদ্দেশ্যে সে আবার ফিরে যায় আগুনের চক্রে—পূর্বপ্রাচীরের নিচে, সেই গোপন ঘরে। এবার আগুন নিভে আছে, শুধু মাঝখানে ছায়া-অরণ্যা বসে, চোখে তাচ্ছিল্য। “তুমি জানো না তোমার মনের কতখানি আমি,” সে বলে, “তুমি আমাকে দমন করতে পারবে না।” তখন অরণ্যা বলে, “তুমি যদি আমারই অংশ হও, তবে আমি তোমাকে নিঃশেষ করতে চাই না—আমি তোমাকে জাগাতে চাই। তুমি যে ভয় পেয়ে পিছু হটেছো, আজ আমি তোমাকে আলোর পথে নিতে চাই।” এই কথায় ছায়া কাঁপে, ম্লান হয়, আবার স্পষ্ট হয়—তবে এবার তার চোখে পানি, ঠোঁটে ব্যথার হাসি। “আমার ভয় ছিল, তুমি যদি আমাকে গ্রহণ না করো?” অরণ্যা এগিয়ে গিয়ে তার কাঁধে হাত রাখে। সেই স্পর্শেই ছায়া-অরণ্যা মিশে যায় তার ভেতর, একটি দীপ্ত অঙ্গীকারে।
সেই রাতেই শঙ্খে আবার ধ্বনি ওঠে—কিন্তু এবার তা কেবল অতীতের আহ্বান নয়, বরং ভবিষ্যতের ভাষা। অরণ্যা এখন শুধু উত্তরাধিকারিণী নয়, সে এখন ‘সংগ্রাহিণী’—যে স্মৃতিকে শুধু রক্ষা করে না, তাকে বহন করে আগামীর দিকে। পরদিন সকালে, সে এক সম্মেলনে বক্তৃতা দেয়, যেখানে কেবল গবেষক নয়, সাধারণ মেয়েরাও আসে। সে বলে, “আমরা সবাই বহন করি কিছু ছায়া, কিছু দহন, কিছু দ্বিধা। এইসব মিলিয়েই আমাদের স্মৃতি। ইতিহাস আমাদের যেভাবে বলে, তার বাইরেও আমাদের গল্প আছে—যা আমরা বলব, গড়ব, আর শোনাব।” চক্রজালও এই ঘোষণার প্রতিধ্বনি শুনে চমকে ওঠে—তারা জানে, এবার সে শুধু এক নারী নয়, সে এক চলমান ইতিহাস, যার মুখ থামানো কঠিন। তাদের পরিকল্পনায় এবার ছেদ পড়েছে। এবং ঠিক তখনই শহরের এক গোপন কক্ষে বসে, একজন বলে—“শঙ্খিনী প্রস্তুত। এবার শুরু হবে শেষ খেলা।”
অধ্যায় ৮:
শরতের ভোরের আলো এসে পড়ে অরণ্যার জানালায়, কিন্তু এই আলো যেন অন্যরকম—গভীর, গাঢ়, আর বিস্ময়করভাবে নীরব। বিছানা ছেড়ে দাঁড়াতেই অরণ্যার মনে হয়, তার শরীর বদলে গেছে। না, আয়নায় সেই একই মুখ—কিন্তু চোখে কোথা থেকে যেন নেমে এসেছে অতল আত্মবিশ্বাস। সেই রাতে ছায়া-অরণ্যার সঙ্গে মিলনের পর, যেন তার ভেতরকার হাহাকার মিশে গেছে এক বিস্তৃত সত্তায়। শঙ্খে আবার ধ্বনি উঠছে, কিন্তু এবার সেই শব্দে আর অতীতের আহ্বান নেই—আছে গর্ভধারিণী অগ্নিসূত্রার ভাষা, যে জন্ম দেবে ভবিষ্যতের ইতিহাসকে। অরণ্যার মনে হয়, তার শিরা-উপশিরায় আগুন বইছে, কিন্তু এই আগুন দহন করে না—সে আলোকিত করে। তার চোখে বারবার ভেসে ওঠে এক আগুনঘেরা নারীর মুখ—যার কপালে চন্দনের বদলে অগ্নিকণা, যার ওঁঠে রয়েছে মন্ত্র নয়, প্রতিবাদের ধ্বনি।
চক্রজাল এবার সরাসরি কোনও আক্রমণ করে না। বরং শহরের বিভিন্ন প্রান্তে তারা ছড়িয়ে দেয় ‘জ্ঞান ও শৃঙ্খলা’র নামে তৈরি নতুন প্রচার—নারীদের ‘আধ্যাত্মিক শুদ্ধতা’ ফিরিয়ে আনার জন্য এক নতুন প্রতিষ্ঠান গঠিত হয়। সেখানে অরণ্যার নাম উচ্চারিত হয় ‘ভ্রষ্ট ইতিহাসবিদ’ হিসেবে, যাকে তারা মনে করে “অযৌক্তিক স্মৃতিচর্চার মাধ্যমে নারীকে বিপথে চালিত করা এক প্রতিকৃতি”। কিন্তু মানুষ এবার প্রশ্ন তোলে—কার স্মৃতি ভ্রান্ত? কে ঠিক নির্ধারণ করবে নারীর সত্যিকারের আত্মপরিচয়? আর অরণ্যা এবার চুপ করে না। সে শহরের নারীদের ডাকে একত্র করে, প্রতিটি নারী যার যার অতীত, গল্প, কান্না নিয়ে আসে। এইসব গল্প একত্র হয়ে যেন এক সমুদ্র হয়ে ওঠে, যার ঢেউয়ে ভেসে যায় ভ্রান্ত ব্যাখ্যার পাথর। অরণ্যা এখন এক জননী, যিনি জন্ম দিচ্ছেন ইতিহাসের নতুন রূপকে—যেখানে নারী কেবল ভুক্তভোগী নয়, সৃষ্টির কেন্দ্র।
এই সময়েই ঘটে এক অপ্রত্যাশিত ঘটনা। এক রাতে, তার দরজায় কড়া নাড়ে এক মেয়ে, বয়স তেরো কিংবা চৌদ্দ। তার চোখে ভয়, শরীরে দাগ, কিন্তু তার হাতে রয়েছে এক পুরনো রুদ্রাক্ষের মালা আর একটি পোড়া শঙ্খ। মেয়েটি বলে, “আমি জানি না আপনি কে, কিন্তু আমি স্বপ্নে দেখেছি আপনি আমাকে ডাকছেন। সেই আগুন, সেই ছায়া, সেই শব্দ আমি বারবার শুনি। আপনি আমাকে বলেছিলেন, আমি কারো উত্তরসূরি।” অরণ্যার কণ্ঠ বুজে আসে। সে মেয়েটিকে জড়িয়ে ধরে—সে বুঝে যায়, ইতিহাস কেবল স্মৃতির ভেতর বাঁচে না, সে উত্তরাধিকার বহন করে ভবিষ্যতে। সে মেয়েটিকে নাম দেয় “ঊর্মি”—কারণ সে এসেছে ঢেউ হয়ে, যা ভাঙবে দেয়াল। তখন থেকেই অরণ্যার কক্ষে প্রতিদিন রাতের বেলা জন্ম নিতে থাকে এক ধ্বনি, যা কেবল একটি নয়—বিভিন্ন কণ্ঠে, বিভিন্ন রূপে, বিভিন্ন ভাষায়। তার কক্ষে যেন সময় থেমে যায় না—তা বয়ে চলে ইতিহাস থেকে জন্মান্তর, স্মৃতি থেকে প্রত্যাবর্তন।
অরণ্যা জানে, সে অন্তঃসত্ত্বা—কিন্তু কোনও শিশু নয়, বরং এক ধারণা, এক শক্তি, এক অভিজ্ঞান নিয়ে। যে শক্তি পুরনো দেবীমূর্তির সংজ্ঞা ভেঙে, সৃষ্টি করতে চায় এক মানব-দেবীকে—যার অস্তিত্ব বৈজ্ঞানিক, ঐতিহাসিক, এবং আধ্যাত্মিক সব একসঙ্গে। এই অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় অরণ্যা শুরু করে এক নতুন দলিল—“অগ্নিবীজ”। এই নথিতে সে লিপিবদ্ধ করে সেই সমস্ত নারীর কাহিনি, যারা ভুলে গিয়েছিল নিজের আগুনের উৎস। চক্রজাল এবার বুঝতে পারে, তারা যদি এই ধারাকে না থামায়, তবে তাদের তৈরি করা ‘ঐতিহাসিক সত্য’ চূর্ণ হয়ে যাবে। সুতরাং তারা এবার অরণ্যাকে ধ্বংস করতে নয়—ধারণ করতে চায়। তারা তাকে দাওয়াত পাঠায়—এক শেষ সমঝোতার, যেখানে বলা হয়: “তুমি আমাদের হয়ে লিখো ইতিহাস। আমরা তোমার শঙ্খকে চিরস্থায়ী করে দেব, তোমার নাম দেব ‘আধুনিক ঋষিকা’। শুধু আমাদের কণ্ঠে কথা বলো।”
অধ্যায় ৯:
অরণ্যার সামনে রাখা ছিল একটি কৌটো—রূপার তৈরি, তার মুখে খোদাই করা এক অদ্ভুত চিহ্ন, যেটি সে তার স্বপ্নে বহুবার দেখেছে। চক্রজালের তরফ থেকে এটি পাঠানো হয়েছে, সাথে একটি হাতে লেখা পত্র—যেখানে সুন্দর ভাষায় লেখা: “শঙ্খধ্বনি যতই প্রবল হোক, তার ধ্বনি শেষপর্যন্ত বাতাসে মিলিয়ে যায়। ইতিহাসকে যদি তুমি চিরস্থায়ী করতে চাও, তবে তার কণ্ঠস্বরকে আমাদের সংরক্ষণের পদ্ধতিতে এনে দাও। আমরা তোমাকে দেব এমন এক আসন, যেখান থেকে তুমি নারী-ইতিহাসকে লিখতে পারো, কিন্তু আমাদের কাঠামোর মধ্যে থেকে। তুমি থাকবে দেবী—শুধু সেই দেবী, যার প্রতিমা আমরা গড়ব।” এই প্রস্তাব স্নিগ্ধ, সুন্দর, এমনকি সম্মানজনকও বটে। তবে অরণ্যার চোখে এই চিঠি ছিল আগুনে মোড়ানো এক ঠাণ্ডা বিষ। চক্রজাল তাকে নিশ্চিহ্ন করতে না পেরে এবার ব্যবহার করতে চাইছে—তাকে পবিত্রতার মুখপাত্র বানিয়ে, তার শঙ্খকে নিস্তরঙ্গ করে দিতে।
ঊর্মি তখন অরণ্যার পাশে বসে, সে ফিসফিস করে বলে, “তুমি যদি তাদের হয়ে কথা বলো, তাহলে আমাদের কেউ কথা বলবে না।” এই কথায় অরণ্যার ভেতর যেন বজ্রপাত হয়। তার মনে পড়ে সেই নারীমঠের ধ্বংসাবশেষে পাওয়া তাম্রশালার পঙক্তি: “আমরা পুড়েছি, যাতে আর কেউ পোড়ার আগে বলতে পারে—না, আমি বাঁচতে চাই।” অরণ্যা বুঝে যায়, সম্মানিত আসন নয়, প্রয়োজন প্রতিধ্বনি—প্রতিমা নয়, প্রয়োজন প্রতিবাদ। সে বুঝতে পারে, চক্রজালের প্রস্তাব মানে আত্মসমর্পণ নয়, বরং আত্মবিসর্জন। পরদিন, শহরের এক পরিত্যক্ত ঘরে সে আহ্বান করে কয়েকজন নারীকে—যারা স্কুল থেকে বিতাড়িত, যারা আশ্রমে নিগৃহীত, যারা গৃহস্থালি থেকে নির্যাতিত। তাদের সামনে দাঁড়িয়ে অরণ্যা বলে, “আজ থেকে আমরা গড়ব শঙ্খবাহিনী—যেখানে প্রতিটি নারী তার নিজের শঙ্খ নিজের মতো বাজাবে। কোনও চক্র, কোনও প্রস্তাব, কোনও সম্মান আমাদের স্বাধীনতার মূল্য নির্ধারণ করবে না।”
শঙ্খবাহিনীর খবরে চক্রজাল চমকে ওঠে। তারা চায়নি এক রাজনৈতিক প্রতিরোধ—তারা চেয়েছিল এক ‘নিয়ন্ত্রিত সম্মতি’। তারা এখন বুঝতে পারে, এই বিদ্রোহ যেন আগুনে হাওয়া দেওয়া। শহরের নারীরা একে একে যোগ দেয় অরণ্যার ডাকে—কেউ শঙ্খ বাজাতে জানে না, কেউ ইতিহাস পড়েনি, কিন্তু সকলেই জানে—ভুলে যাওয়ার কষ্ট কেমন, নিঃশব্দে পোড়ার অভিজ্ঞতা কেমন। শঙ্খবাহিনী এখন আর শুধু এক সংগঠন নয়, এক অভিজ্ঞান। প্রতিটি সন্ধ্যায় তারা মিলিত হয়, একটি করে গল্প বলে—ভুলে যাওয়া কোনো নারীর, যে কখনো ছিল, কিন্তু লিপিবদ্ধ হয়নি। এই গল্পগুলো অরণ্যা সংকলন করে এক নতুন পুস্তকে, যার নাম দেয় “অপর্ণা”—যার অর্থ ‘যা উৎসর্গযোগ্য নয়।’ একরাতে, শঙ্খের শব্দে শহরের বাতাস কেঁপে ওঠে। চক্রজাল এবার বুঝে যায়, তারা ইতিহাস লিখলেও, ইতিহাস ধারণ করে না।
এই পর্বে, অরণ্যা একান্তে বসে সেই রূপার কৌটোটি খোলে—ভেতরে একটি চূর্ণ ধ্বংসপ্রায় শঙ্খ, যা একসময় কোনো এক ‘বিদ্রোহী’র ছিল, যাকে চক্রজাল নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল। অরণ্যা তা হাতে নিয়ে বলে, “তোমার ধ্বনি হারিয়ে যায়নি—আজ তুমি আমার মধ্যে।” পরদিন, শহরের কেন্দ্রে এক স্থানে অরণ্যা দাঁড়িয়ে ঘোষণা দেয়—“আমরা ইতিহাসকে বইয়ে লিখব না, আমরা ইতিহাসকে হাঁটতে শিখাব।” তখন থেকেই, প্রতিটি রাস্তা, প্রতিটি বিদ্যালয়, প্রতিটি পাঠশালায় শুরু হয় শঙ্খবাহিনীর অভিযান—তারা প্রশ্ন করে, শোনায়, শেখায়। চক্রজাল পরিণত হয় শুধুই এক অতীতের ছায়ায়। তাদের প্রস্তাব ইতিহাসের গোপন পৃষ্ঠায় চাপা পড়ে যায়, কারণ মানুষ শোনে সেই ধ্বনি—যা আগুন নয়, আশ্বাসের, কিন্তু যে আগুনকে লুকোয় না।
অধ্যায় ১০:
শহরের দক্ষিণ প্রান্তে একটি পুরনো স্কুলঘর, বহু বছর পর আবার জেগে উঠেছে। রোদ এসে তার জানালায় পড়ে আর ভেতরে শোনা যায় শঙ্খের নিনাদ—not as a call to war, but as an awakening. অরণ্যা সেখানে বসে আছে এক বৃত্তে, তার চারপাশে মেয়েরা—বয়সে, রূপে, ব্যথায় ভিন্ন, কিন্তু চোখে একরকম দীপ্তি। এই বৃত্তে কেউ নেই ‘শিক্ষিকা’, কেউ নয় ‘শিষ্যা’; সবাই কাহিনিকার, প্রত্যেকের গল্প আলাদা, তবু একসূত্রে বাঁধা। সেই বৃত্তে হঠাৎ করে ঢুকে পড়ে এক শিশু—মেয়েটির মুখে ধুলো, হাতে ছেঁড়া কাপড়, চোখে সেই একই প্রশ্ন যা অরণ্যা বহন করে চলেছে জন্মজন্মান্তরে: “আমি কে?” কেউ মেয়েটিকে চিনে না, কেউ জানে না সে কোথা থেকে এসেছে। অথচ তার উপস্থিতিতে বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। অরণ্যা তাকে নিজের কাছে ডাকে। মেয়েটি পাথরের মতো চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। অনেকক্ষণ পর সে শুধু বলে, “আমার নাম নেই।”
এই বাক্য যেন বৃত্তের ভেতর প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসে—‘নাম নেই’, ‘নাম নেই’…। এক বৃদ্ধা বলেন, “আমার মায়ের নাম ওরা বদলে দিয়েছিল।” এক তরুণী বলে, “আমার নাম রাখা হয়েছিল কন্যাসন্তান বলে ক্ষমা চেয়ে।” এই শিশুর নাম নেই—এটাই যেন তার শক্তি। অরণ্যা তাকে জড়িয়ে ধরে, বলে, “তুমি যা নাম দিতে চাও, তাই হবে তোমার পরিচয়। অথবা, তুমি চাইলে—একটা নামেও বাঁধা পড়বে না।” এই মেয়েটি তখন উঠে দাঁড়িয়ে বৃত্তের মধ্যে হাঁটতে শুরু করে। সে চোখ বন্ধ করে বলে, “আমি একদিন স্বপ্নে শুনেছিলাম, কেউ একজন বলছে—‘শঙ্খে বাজে না কেবল শব্দ, বাজে এক নামহীন আত্মা।’ আমি বুঝেছি, আমি সেই আত্মা।” তখন থেকেই, শঙ্খবাহিনীতে তার পরিচয় হয় ‘নামহীনা’ নামে—যিনি আসে ইতিহাসে জায়গা করতে, কিন্তু নিজের নামে নয়—নিজের সত্যে।
নামহীনার উপস্থিতি অরণ্যাকে নতুন করে আলোড়িত করে। তার মনে পড়ে বহু শতাব্দী আগে নারীমঠের কেন্দ্রে যে এক অদৃশ্য আত্মার কথা লেখা ছিল—যাকে বলা হয়েছিল “আনামিকা শিখা”—এক নামহীন শিখা, যা জ্বলে, নিভে না, এবং পরিচয়ের দাসী নয়। অরণ্যা উপলব্ধি করে, শঙ্খবাহিনীর মধ্যে এবার জন্ম নিচ্ছে এমন এক প্রজন্ম, যারা কেবল ইতিহাসের উত্তরাধিকার বহন করবে না, বরং ইতিহাসের কাঠামো নিজেই নতুন করে লিখবে। নামহীনার চলাফেরা শহরের অলিগলিতে শুরু হয় এক অদ্ভুত শক্তি নিয়ে—সে কথা কম বলে, কিন্তু তার চোখ দেখে অনেকেই চুপ হয়ে যায়। একদিন সে এক পুরুষ প্রফেসরের সামনে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন তোলে—“আপনি যখন ‘ঐতিহাসিক সত্য’ বলেন, তখন কাদের কথা বলেন? যারা কাগজে নাম লেখে? নাকি যারা জ্বলেছিল, পোড়েছিল, তবুও বেঁচে ছিল?” সেই প্রফেসর কোনো উত্তর দিতে পারে না। তার ঠোঁট কাঁপে, আর ক্লাসরুমের ভিতর শঙ্খ ধ্বনি বেজে ওঠে।
শঙ্খবাহিনী এবার শহরের দেয়ালে দেয়ালে এক নতুন পোস্টার সাঁটে—“তোমার নাম যদি না থাকে ইতিহাসে, এসো—আমরা একসঙ্গে লিখি নতুন পরিচয়ের চিহ্ন।” এই ডাক সাড়া দেয় আরও অনেকে—যারা এতদিন নিজের ভিতরে গোপন করেছিল স্মৃতি, ব্যথা, এবং ক্ষোভ। এখন তারা এগিয়ে আসে নামহীন হয়ে, নির্ভীকভাবে। অরণ্যার চোখে জল আসে না, আসে আগুন। সে বুঝতে পারে, তার অন্তঃসত্ত্বা আগুন এবার প্রসব করেছে এক আত্মপরিচয়হীন স্বাধীনতাকে—যে নামহীন হয়েও সমস্ত পরিচয়কে ধারণ করে। চক্রজাল এবার দিশেহারা। তারা জানে না কাকে আটকাবে—অরণ্যাকে? না নামহীন আত্মাকে? তারা এক নীরব বৈঠক ডাকে—এক প্রস্তাব নিয়ে। তারা ভাবে, “যদি আমরা এই নামহীনতাকে স্বীকৃতি দিই, তবে হয়তো তাকে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে।” কিন্তু তারা জানে না—যা নামহীন, তা ধরা যায় না।
অধ্যায় ১১:
নামহীনার চোখে জেগে ওঠে এমন এক আলো, যা কেবল দেখার নয়—অনুভব করার। অরণ্যা লক্ষ্য করে, মেয়েটি প্রতিটি শব্দের আগে থেমে থাকে, যেন শব্দ নয়, তার স্পন্দনের গভীরতা যাচাই করে। এক সন্ধ্যায় তারা দু’জনে বসে থাকে এক পুরনো বটগাছের ছায়ায়। দূরে শোনা যায় কোকিলের ডাক, বাতাসে জড়িয়ে থাকে শালপাতার গন্ধ। নামহীনা বলে, “শব্দের অতিরিক্ত ব্যবহার আমাদের সত্যি থেকে দূরে নিয়ে যায়। শব্দ দিয়ে তারা গড়েছে শৃঙ্খল। আমরা চাই, শব্দের ঊর্ধ্বে গিয়ে আমরা ইতিহাস অনুভব করি—লিপি ছাড়া, ভাষা ছাড়া, কেবল ধ্বনি আর দেহের কম্পনে।” অরণ্যা হতবাক। এত অল্প বয়সে এমন উপলব্ধি—সে বুঝে যায়, এই নামহীনা কেবল ভবিষ্যতের সন্তান নয়, সে আদিকালেরই প্রতিধ্বনি। তখন থেকেই শুরু হয় এক অভূতপূর্ব প্রয়াস—‘লিপিহীন কাহিনি’-র যাত্রা।
এই যাত্রা শুরু হয় গানে, স্পন্দনে, চোখের ভাষায়, নীরবতার দোলায়। শঙ্খবাহিনীর মেয়েরা এখন আর শুধু বক্তৃতা করে না—তারা চুপ থেকে কথা বলে, তারা শরীরী অভিব্যক্তি দিয়ে শুনিয়ে দেয় এমন স্মৃতি, যা লেখা যায় না, বলা যায় না, কেবল অনুভব করা যায়। শহরের অডিটোরিয়াম, লাইব্রেরি, ক্লাসরুমে এই নীরব নাট্যরূপের পরিবেশনায় মানুষ স্তব্ধ হয়ে যায়। তারা দেখে, এক মেয়ে শুধু দাঁড়িয়ে থেকে, বুকের মাঝে হাত রেখে, চোখের জল ফেলেই শুনিয়ে দেয় এক ধর্ষিতার গল্প। কেউ আবার হাঁটু গেড়ে বসে, মাটি স্পর্শ করে জানিয়ে দেয় কৃষিজীবী মায়ের বেদনা, যে নিজের নাম পর্যন্ত হারিয়েছে জমির কাগজে। অরণ্যা এই ‘লিপিহীন কাহিনি’-র প্রথম অধ্যায় লেখে না, সে শুধু বলে, “এই কাহিনিগুলো লেখা যাবে না, কারণ লেখা মানেই বেঁধে দেওয়া। আমরা চাই, কাহিনি যেন প্রতিটি দর্শকের শরীর দিয়ে বয়ে যায়।”
চক্রজাল এই অভ্যুত্থানে আরও বেশি শঙ্কিত। তারা চিরকাল নিয়ন্ত্রণ করেছে শব্দ, পুস্তক, ইতিহাসের ভাষা। এখন যখন এই বিদ্রোহের ভাষা নিঃশব্দ, তখন তাদের হাতে আর কিছুই থাকে না ধরে রাখার জন্য। তারা এবার চেষ্টা করে—এই ‘লিপিহীন কাহিনি’-কে তাদের প্রতিষ্ঠানে আনতে। এক বিখ্যাত সাহিত্য উৎসবে তারা অরণ্যাকে আমন্ত্রণ জানায়, বলে: “তুমি আমাদের মঞ্চে তোমার নতুন কাহিনি প্রকাশ করো। আমরা এটিকে বিশ্বের কাছে পৌঁছে দেব।” অরণ্যা হাসে—না অসম্মান করে, না সম্মতি দেয়। সে শুধু এক বৃত্ত এঁকে দেয় মাটিতে। বলে, “এই কাহিনি কোনো মঞ্চে বলা যায় না, কারণ এই কাহিনির প্রতিটি কণ্ঠ একেকজন দর্শকের হৃদয়ে জন্মায়।” সেই দিন উৎসবের বাইরে, এক নির্জন চত্বরে, শতাধিক নারী একসঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকে চোখ বন্ধ করে, শুধু বুকের তাল দিয়ে একসঙ্গে দেয় ছন্দ—কোনো শব্দ ছাড়া, তবু কান্না, আগুন, প্রেম আর যুদ্ধ যেন তার মধ্যেই বয়ে যায়।
অরণ্যার মনে পড়ে সেই প্রাচীন নারীমঠের দেওয়ালে খোদাই করা একটি লিপি, যেটা আধা-মুছে যাওয়া ছিল। তখন বোঝা যায়নি সেটি কী। কিন্তু এখন, নামহীনার দৃষ্টি আর এই লিপিহীন কাহিনির অভিজ্ঞতায় সেই লেখাটি পাঠযোগ্য হয়ে ওঠে—“যেখানে ভাষা থেমে যায়, সেখানেই আত্মার শুরু। আমরা সেই আত্মা—লিপি-চ্যুত, তবু চিরন্তন।” অরণ্যা জানে, তারা ঠিক পথেই এগোচ্ছে। ‘শঙ্খিনী’ এখন আর এক ব্যক্তির নাম নয়, এক ভাষাহীন প্রতিধ্বনি, যা শুধু নারীর নয়—সমস্ত স্তব্ধ আত্মার কণ্ঠস্বর। এই লিপিহীন কাহিনি শেষ হয় না, কারণ সে কেবল শুরু—প্রতিটি মানুষের দেহে, চোখে, হৃদয়ে নতুনভাবে জন্ম নেওয়ার এক প্রবাহ।
অধ্যায় ১২:
সেই রাত। এক পূর্ণিমা, ঝাঁ-চকচকে, যেন আকাশ নিজেই নিজেকে খুলে দিয়েছে। শহরের প্রান্তে, যেখানে একসময় ছিল নারীমঠের ধ্বংসস্তূপ, সেখানে দাঁড়িয়ে অরণ্যা। চারপাশে শঙ্খবাহিনীর মেয়েরা, নামহীনা, ঊর্মি, বৃদ্ধা দেবেশ্বরী, সেই নীরব মেয়েটি যে একদিন স্কুল থেকে বিতাড়িত হয়েছিল, আর সেই মঞ্চহীন শিল্পীরা, যারা শব্দের বাহিরে গল্প বলেছিল। অরণ্যার হাতে সেই পুরোনো শঙ্খ, যেটি সে প্রথম দিন রক্তে রাঙিয়ে তুলেছিল। আজ, তার কণ্ঠে না আছে ক্রোধ, না বেদনা—আছে এক অদ্ভুত শান্তি, যা জন্ম দেয় বিস্ফোরণের, তবু তা শ্রুতিহীন। সে বলে না কিছু, শুধু শঙ্খটি ঠোঁটে তোলে। মুহূর্তটি চুপচাপ, স্থির। তারপর ধীরে ধীরে, ধ্বনি ওঠে—শঙ্খের ধ্বনি, কিন্তু তার মধ্যে যেন গলে যায় ইতিহাসের সব কান্না, বিদ্রোহ, স্মৃতি আর স্বপ্ন। ধ্বনিটি শরীরের ভিতর দিয়ে চলে যায়, আকাশে পৌঁছায়, আর সেখান থেকে নেমে আসে মাটির গায়ে।
ধ্বনির স্পন্দনে নারীমঠের ধুলো যেন জেগে ওঠে। কেউ কেউ পরে বলে, তারা দেখেছিল ছায়া-ছায়া নারীদেহ উঠছে মৃত স্তম্ভ থেকে—কারো হাতে শঙ্খ, কারো কণ্ঠে ভাষা নেই, তবু তারা কথা বলে। নামহীনা সামনে এগিয়ে আসে, সে মাটিতে হাটু গেঁড়ে বসে বলে, “এই যে ধ্বনি—এ আমার নয়, তোমাদের নয়, এ আমাদেরই আত্মার ঋণ শোধ।” সে চোখ বন্ধ করে, বুকের মধ্যে হাত রাখে, আর ততক্ষণে শতশত নারী একসঙ্গে একই ভাবে বসে পড়ে, তাদের দেহে স্পন্দন হয় একসাথে—একপ্রকার কম্পন, যা কোনো যন্ত্রে মাপা যায় না। অরণ্যা তখন দাঁড়িয়ে, মাথা তুলে আকাশের দিকে তাকায়। সে জানে, তার কাজ শেষ হয়নি—তবু পূর্ণতা পেয়েছে। কারণ এখন আর শঙ্খিনী কেবল তার ভিতরে নয়, হাজারে হাজারে নারীর হৃদয়ে গেঁথে গেছে সেই ধ্বনি।
চক্রজাল চেষ্টা করে এক শেষবার—তারা প্রস্তাব দেয়, এই শঙ্খধ্বনিকে রাষ্ট্রীয় স্মৃতিচিহ্ন করে তোলার, একটি দিবস ঘোষণা করার। তারা চায় শঙ্খিনী নামটি স্বীকৃত হোক—একটি মিউজিয়ামে, একটি পাঠ্যবইয়ে, একটি প্রতিমূর্তিতে। অরণ্যা তখন শহরের কেন্দ্রস্থলে দাঁড়িয়ে, গণমাধ্যমের সামনে বলে, “না। শঙ্খিনী কোনো দিবস নয়, কোনো মূর্তি নয়, কোনো শিক্ষাব্যবস্থার পাতা নয়। সে তোমার আমার ভিতরেই আছে। তার চিহ্ন থাকবে না—তবু সে থেকেই যাবে, কারণ সে কোনো এক নামে বাঁধা নয়, কোনো ধর্মে নয়, কোনো শ্রেণিতে নয়।” এই বক্তব্যের পর, চক্রজাল চুপ করে যায়। ইতিহাস নীরব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে অরণ্যার সামনে। সে জানে, ইতিহাস এবার তাকে লিখবে না—বলে যাবে, শোনাবে, প্রতিটি লিপিহীন গল্পে, প্রতিটি শঙ্খের স্পন্দনে।
শেষ রাতে, অরণ্যা একা হাঁটে সেই নারীমঠের ধ্বংসস্তূপে। তার হাতে আর কোনো শঙ্খ নেই, কেবল একটিমাত্র শালপাতায় লেখা থাকে একটি পঙক্তি: “আমি ফিরে আসব—নতুন মুখে, নতুন কণ্ঠে, তবু একই আত্মায়।” সে তা পুঁতে দেয় মাটির নিচে, ঠিক যেখানে প্রথম দিন দাঁড়িয়ে সে শঙ্খ ফুঁকেছিল। বাতাস আসে, চুল উড়িয়ে দেয়, চোখে আনে জল। কিন্তু এবার সেই জল বেদনার নয়—স্বস্তির, মুগ্ধতার, জন্মের। অরণ্যা পেছনে ফিরে তাকায় না। তার পা চলে এক নির্দিষ্ট পথে, যেমন যায় নদী, যা জানে—সে সাগরে মিশবে, তবু তার পথ থামে না।
সমাপ্ত