Bangla - রহস্য গল্প

শঙ্খসেতুর ছায়া

Spread the love

অধ্যায় ১ –

গঙ্গার বুকে তৈরি সেই প্রাচীন সেতুটি এক অদ্ভুত সময়ের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ব্রিটিশ আমলে, প্রায় দেড়শো বছর আগে, সেতুটি নির্মাণ করা হয়েছিল কলকাতার সাথে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের সংযোগ সহজ করার জন্য। গাঢ় ধূসর পাথরে গড়া এই সেতুটি শুধু পরিবহনের জন্য নয়, ছিল ঔপনিবেশিক শাসনের শক্তির প্রতীক। গঙ্গার স্রোতকে যেন অমানুষিক জোরে বেঁধে রাখার এক দম্ভ দেখাতে চেয়েছিল ব্রিটিশরা। বিশাল খিলান, উঁচু খুঁটি, আর পাথরের গায়ে খোদাই করা সেই সময়কার নকশা এখনও মানুষের বিস্ময় জাগায়। দিনের বেলায় সেতুটা যতই দৃঢ় আর স্থায়ী মনে হোক, রাতের অন্ধকারে তার রূপ একেবারে পাল্টে যায়। গঙ্গার কুয়াশায় ঢাকা সেই পাথরের খিলানগুলো অদ্ভুত ভৌতিক হয়ে ওঠে। নদীর জল যখন আছড়ে পড়ে সেতুর স্তম্ভে, তখন সৃষ্ট ধ্বনিগুলো কখনো ঢেউয়ের গর্জন, কখনো বাঁশির মতো সুর, আবার অনেক সময় শোনা যায় শঙ্খধ্বনির মতো অদ্ভুত শব্দ। এভাবেই সেতুর নামকরণ হয়—শঙ্খসেতু। স্থানীয় মানুষজন বছরের পর বছর ধরে এই নামকেই সত্য হিসেবে মেনে নিয়েছে।

গ্রামের প্রবীণরা বলেন, সেতুর জন্মলগ্ন থেকেই এর চারপাশে নানা অস্বাভাবিক ঘটনার গল্প প্রচলিত ছিল। সেতু বানানোর সময় নাকি প্রচুর শ্রমিক মারা গিয়েছিল—কেউ দুর্ঘটনায়, কেউ রোগে, আবার কারও মৃত্যু হয়েছিল রহস্যজনকভাবে। সেই অকালমৃত মানুষের আত্মাই নাকি আজও গঙ্গার বুকে ঘুরে বেড়ায়। রাতে যখন হাওয়া আর জলের স্রোত একসাথে গর্জে ওঠে, তখন সেই আত্মাদের আর্তনাদ শোনা যায় শঙ্খধ্বনির মতো। অনেকে আবার বলেন, এটা কেবল গঙ্গার ঢেউ আর বাতাসের খেলা, কিন্তু তাদের কথা শোনার মতো মানুষের সংখ্যা খুব কম। কারণ, বহু মানুষ সেতুর নিচে গিয়ে অদ্ভুত অভিজ্ঞতার শিকার হয়েছে। কেউ নাকি শুনেছে পরিষ্কার শঙ্খ বাজানোর শব্দ, আবার কেউ দেখেছে কুয়াশার মধ্যে সাদা শাড়ি পরা ছায়ামূর্তি। সবচেয়ে ভয়ংকর গল্পটি হলো—যে মানুষ একবার রাতের বেলায় একা শঙ্খসেতুর নিচে যায়, সে আর কখনও ফিরে আসে না। এইসব কাহিনি যতই লোকগাথা মনে হোক না কেন, স্থানীয়দের বিশ্বাসে সেগুলো অটল হয়ে বসে গেছে।

সেতুর ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করতে গেলে দেখা যায়, ব্রিটিশ শাসকেরা একে শুধু যোগাযোগের মাধ্যম নয়, বরং এক প্রকার কর্তৃত্বের স্মারক হিসেবে তৈরি করেছিল। সেতুর নির্মাণশৈলীতে রয়েছে ইউরোপীয় স্থাপত্যের ছাপ, তবুও পাথর, ইট, চুন-সুরকি সবই সংগ্রহ করা হয়েছিল গঙ্গার পারের স্থানীয় অঞ্চল থেকে। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে মনে হতে পারে, সেতুটি নিছক একটি পুরোনো স্থাপত্য, কিন্তু স্থানীয় মানুষের কাছে এটি এক রহস্যময় স্থান—যেখানে ইতিহাস আর অতিপ্রাকৃত এক অদৃশ্য সুতোর মতো মিশে গেছে। প্রতিদিন সন্ধ্যা নামলেই গ্রামের মানুষজন সেতুর দিকটা এড়িয়ে চলে। দূর থেকে শুধু দেখা যায়—আকাশের নিচে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে শঙ্খসেতু, আর তার তলায় গঙ্গার অন্ধকার জলে ঢেউয়ের সাথে মিশে যায় অজানা কোনো প্রাচীন সুর। সেই সুরই একসময় হয়ে উঠবে গল্পের কেন্দ্রবিন্দু, যা অজানার প্রতি মানুষের কৌতূহলকে উসকে দেবে, আবার ভয়ের শিহরণ জাগাবে। শঙ্খসেতু যেন কেবল পাথর আর লোহার তৈরি এক সেতু নয়, বরং সময়, মৃত্যু আর রহস্যের এক অদৃশ্য দ্বার—যেখানে পা রাখলেই মানুষকে সম্মুখীন হতে হয় অজানা অতীতের।

অধ্যায় ২ –

অর্ণব চক্রবর্তী, কলকাতার এক তরুণ সাংবাদিক, যার চোখে সবসময় কৌতূহলের ঝিলিক খেলে যায়। বয়স বেশি নয়, সবে ত্রিশ পেরিয়েছে, কিন্তু তার কাজের প্রতি আগ্রহ আর সাহসী পদক্ষেপের জন্য সে ইতিমধ্যেই সাংবাদিক মহলে আলাদা পরিচিতি পেয়েছে। অর্ণব সাধারণ খবরের কাগজে সীমাবদ্ধ না থেকে সবসময় খুঁজে বেড়ায় সেইসব অদ্ভুত কাহিনি, যেগুলোর ভেতরে লুকিয়ে থাকে ইতিহাস, রহস্য আর মানুষের অব্যক্ত ভয়। ঠিক সেই আগ্রহ থেকেই একদিন তার কানে আসে গঙ্গার তীরে দাঁড়িয়ে থাকা এক প্রাচীন সেতুর কথা, যার নাম শঙ্খসেতু। এক সহকর্মী তাকে বলে—“ওই সেতুতে গিয়ে যদি ডকুমেন্টারি বানাতে পারো, তাহলে দর্শক টানবে অনেক। শুধু ইতিহাস নয়, ভয় আর রহস্যের মিশেলটাই ওখানে আছে।” কথাটা শুনেই অর্ণবের মনে একটা আলোড়ন জেগে ওঠে। বহুবার সে ভৌতিক কিংবা অমীমাংসিত রহস্যের গল্প কভার করেছে, কিন্তু এই সেতুর কাহিনি যেন তাকে অন্যরকম টানছিল। বুকের ভেতর এক অদ্ভুত উত্তেজনা আর অজানা আশঙ্কা নিয়ে সে ঠিক করে ফেলে—হ্যাঁ, তাকে অবশ্যই সেখানে যেতে হবে।

অর্ণব তার ক্যামেরা, ট্রাইপড আর কিছু রেকর্ডিং যন্ত্রপাতি গুছিয়ে যাত্রা শুরু করে এক শীতের সকালের দিকে। কলকাতা থেকে ট্রেনে কয়েক ঘণ্টার পথ, তারপর নৌকো করে পৌঁছতে হয় গঙ্গার তীরের ছোট্ট গ্রামে, যেখানে দাঁড়িয়ে আছে শঙ্খসেতু। ট্রেনের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে সে দেখছিল দূরের বিস্তৃত মাঠ, ধান কাটা হয়ে গেছে, শুকনো খড়ের গন্ধ মিশে আছে বাতাসে। গ্রামের নাম সে আগে শুনেওনি, অথচ আজ সেখানে গিয়ে হয়তো সে এমন এক গল্পের সন্ধান পাবে, যা তার সাংবাদিক জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেবে। ট্রেনের শব্দ, পথের দৃশ্য, মানুষের আনাগোনা সব মিলিয়ে তার মনে হচ্ছিল, সে যেন ধীরে ধীরে ঢুকে পড়ছে এক অচেনা জগতে। নৌকোয় ওঠার পর গঙ্গার বিশাল বিস্তৃত জলরাশি তাকে স্তব্ধ করে দেয়। মাঝনদীতে দাঁড়িয়ে দূরে দেখা যায় সেতুর বিশাল খিলান, কুয়াশার আবছা পর্দার ভেতরেও তার রূপ স্পষ্ট। নদীর বুক চিরে সেতুটি যেন দাঁড়িয়ে আছে বহু শতাব্দীর সাক্ষী হয়ে, অথচ তার চারপাশে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। সেই মুহূর্তেই অর্ণব বুঝতে পারে, এই যাত্রা নিছক সাংবাদিকতার নয়, এর ভেতরে রয়েছে এক রহস্যের আহ্বান।

গ্রামে পৌঁছেই অর্ণব কিছু স্থানীয় মানুষের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করে। প্রথমে লোকজন একটু ভয়ে চুপচাপ থাকলেও, ধীরে ধীরে তারা নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা বলতে শুরু করে। কারও দাদু শুনেছিলেন রাতে সেতুর নিচে শঙ্খ বাজানোর শব্দ, কারও বাবা নাকি চোখে দেখেছিলেন কুয়াশার ভেতর সাদা শাড়ি পরা এক তরুণীকে দাঁড়িয়ে থাকতে। এসব শোনার পর অর্ণবের কৌতূহল আরো বেড়ে যায়। কিন্তু সবচেয়ে অবাক করে তাকে যে তথ্য, তা হলো প্রায় সত্তর বছর আগে এক তরুণী হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যায় সেতুর কাছ থেকে, আর সেই মামলাটি কখনও সমাধান হয়নি। পুলিশের নথি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল প্রমাণের অভাবে, কিন্তু গ্রামবাসীর মুখে আজও ঘুরে বেড়ায় সেই গল্প। মানুষ বলে, সেই তরুণীর আত্মাই নাকি সেতুর নিচে বন্দী হয়ে আছে, আর তার আর্তনাদই শোনা যায় শঙ্খধ্বনি হয়ে। অর্ণব তার নোটবুকে সবকিছু লিখে রাখে, ক্যামেরায় মানুষের বয়ান রেকর্ড করে। তার মনে হয়, এই নিখোঁজ মামলাই পুরো গল্পের কেন্দ্রে রয়েছে, আর সেই রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারলেই শঙ্খসেতুর আসল ইতিহাস বেরিয়ে আসবে। কিন্তু তার অন্তরের গভীরে কোথাও এক অদৃশ্য শীতল স্রোত বইতে থাকে, যেন এই রহস্য উন্মোচন করতে গেলে তাকে খুব বড় মাশুল দিতে হবে। তবুও সাংবাদিকের প্রবল জেদ আর সত্য জানার নেশা তাকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যায়—যে পথে হয়তো তাকে পা রাখতে হবে অন্ধকারের দিকে।

অধ্যায় ৩ –

গ্রামের প্রবীণ বাসিন্দাদের মুখে মুখে ঘুরে বেড়ানো যে গল্পটি শঙ্খসেতুকে ঘিরে সবচেয়ে বেশি আলোড়ন তোলে, তা হলো এক তরুণীর রহস্যময় নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার কাহিনি। সময়টা ছিল স্বাধীনতার আগে, প্রায় সত্তর বছরেরও বেশি পুরোনো এক দিন। গ্রামের মানুষ এখনও বলেন, সেই সময়ের জমিদার পরিবার ছিল প্রভাবশালী, ধন-সম্পদে ভরপুর, কিন্তু ভেতরে ভেতরে অনেক শত্রু তৈরি হয়েছিল তাদের। জমিদারের একমাত্র কন্যা, নাম ছিল চন্দ্রাবতী, সে ছিল অতুলনীয় সুন্দরী, স্নিগ্ধ মুখে গভীর চাহনি আর মিষ্টি হাসি, যার কারণে গ্রাম-গঞ্জের বহু মানুষ তাকে দূর থেকে চুপচাপ দেখত। কিন্তু চন্দ্রাবতীর মন ছিল অন্যরকম—সে বই পড়তে ভালোবাসত, নদীর ধারে সময় কাটাতে পছন্দ করত, আর অনেক সময় একা একাই গঙ্গার স্রোত দেখত ঘণ্টার পর ঘণ্টা। তার স্বভাবের এই স্বাধীনচেতা দিকটাই হয়তো তাকে আলাদা করে তুলেছিল, আবার সেই কারণেই হয়তো সে একদিন সবার চোখের আড়ালে চলে গেল। গ্রামে আজও কথিত আছে, এক সন্ধ্যায় চন্দ্রাবতী বেরিয়েছিল নদীর ধারে হাঁটতে, ঠিক শঙ্খসেতুর কাছাকাছি, আর তারপর থেকে তাকে আর কখনো দেখা যায়নি।

চন্দ্রাবতীর নিখোঁজ হওয়া নিয়ে নানা কাহিনি প্রচলিত আছে। কেউ বলে, সে প্রেমে পড়েছিল এক স্বাধীনতা সংগ্রামীর, আর সেই সম্পর্ক পরিবারের কাছে মেনে নেওয়া হয়নি। তাকে হয়তো জোর করে আলাদা করা হয়েছিল, কিংবা হয়তো পরিবারেরই কারও ষড়যন্ত্রে সে গুম হয়ে যায়। আবার কারও কারও মতে, ব্রিটিশ সেনারা তাকে ধরে নিয়ে যায়, কারণ তার প্রেমিক স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিল। সেই সময়ে অনেক তরুণ-তরুণীর জীবন হঠাৎ করেই থেমে গিয়েছিল, কেউ জেলে গিয়েছিল, কেউ আর ফেরেনি। চন্দ্রাবতীর কাহিনিও হয়তো সেই ধারাবাহিকতার একটি অংশ। তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো, পুলিশের দীর্ঘ তদন্ত সত্ত্বেও কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। নদীর তীরে খুঁজে পাওয়া যায়নি তার কোনো গয়নাগাটি, কোনো কাপড়চোপড়, এমনকি দেহটুকুও না। গ্রামবাসীরা পুলিশকে অনেকবার জানিয়েছিল যে সেতুর নিচে তারা অদ্ভুত শঙ্খধ্বনি শুনেছে আর কুয়াশার মধ্যে সাদা শাড়ি পরা ছায়া ভেসে উঠতে দেখেছে, কিন্তু ব্রিটিশ পুলিশের কাছে এসব ছিল কুসংস্কার ছাড়া কিছু নয়। তাই মামলাটি ধীরে ধীরে অন্ধকারে চাপা পড়ে যায়, আর চন্দ্রাবতীর নাম শুধু গুজব হয়ে গ্রামে রয়ে যায়।

তবুও, সাত দশক পেরিয়েও চন্দ্রাবতীর কাহিনি আজও এই গ্রামকে ঘিরে রেখেছে। প্রবীণরা বলেন, সেই দিন থেকে শঙ্খসেতুর নিচে শোনা যায় অদ্ভুত ধ্বনি—কখনো যেন শঙ্খ বাজানোর মতো, আবার কখনো যেন একজন তরুণীর কান্নার মতো। অনেকেই দাবি করেন, রাত গভীর হলে সেতুর নিচে কুয়াশার ভেতর দাঁড়িয়ে থাকে সাদা শাড়ি পরা এক মেয়ে, আর তাকে দেখলেই মানুষের গা শিউরে ওঠে। গ্রামের ছেলেমেয়েরা ছোটবেলা থেকেই এই গল্প শুনে বড় হয়, আর তাই সন্ধ্যার পর কেউই সেতুর দিকে যায় না। এমনকি বহু বছর পরেও, গ্রামের মানুষজনের মনে একটাই প্রশ্ন ঘুরে বেড়ায়—চন্দ্রাবতী কি সত্যিই নদীর স্রোতে ভেসে গিয়েছিল, নাকি কোনো অশুভ শক্তির কবলে পড়েছিল? যেহেতু এর উত্তর আজও কেউ জানে না, তাই সেতুটিকে ঘিরে রহস্য আরও গভীর হয়েছে। আর অর্ণব যখন গ্রামে এসে এসব কাহিনি শোনে, তখন তার মনে হয়, এই নিখোঁজ হওয়ার গল্পটাই আসল সূত্র, যা হয়তো তাকে শঙ্খসেতুর গোপন পর্দা সরাতে সাহায্য করবে। কিন্তু সে তখনও বুঝতে পারেনি, সত্যের সন্ধান করতে গিয়ে তাকে কতটা ভয়ংকর অন্ধকারের মুখোমুখি হতে হবে।

অধ্যায় ৪ –

অর্ণব দিনের আলোতে সেতুর আশেপাশের পরিবেশ দেখে তার মনে হয়েছিল, সবটাই হয়তো গুজব আর লোককথা ছাড়া কিছু নয়। গঙ্গার প্রবল স্রোত, বাতাসের শব্দ, আর বিশাল পাথরের খিলান—এসব মিলেই হয়তো মানুষের কানে অন্যরকম আওয়াজ পৌঁছে যায়। কিন্তু রাতে যখন সত্যিকার অর্থে ক্যামেরা বসিয়ে চিত্র ধারণ শুরু করল, তখন তার সমস্ত যুক্তি ধীরে ধীরে ভেঙে পড়তে লাগল। রাত নামার সাথে সাথে নদীর উপর ভেসে এল ঘন কুয়াশা, যেন সেতুর নিচে এক অদৃশ্য পর্দা টানল কেউ। নদীর ঢেউয়ের মৃদু আওয়াজের সাথে মিলেমিশে হঠাৎই এক তীব্র, স্পষ্ট শঙ্খধ্বনি বেজে উঠল। সেই ধ্বনিটা এতটাই স্পষ্ট যে, অর্ণবের বুকের ভেতর ধক করে উঠল। মুহূর্তের জন্য তার মনে হয়েছিল, হয়তো কাছেই কোথাও সত্যিই কেউ শঙ্খ বাজাচ্ছে, কিন্তু চারপাশ অন্ধকার আর কুয়াশায় ঢাকা, সেখানে মানুষের উপস্থিতি অসম্ভব। ক্যামেরার মাইক্রোফোনে সেই শব্দ নিখুঁতভাবে ধরা পড়ল, আর অর্ণবের হাত কেঁপে উঠল শাটার টিপতে গিয়ে। সে জানত, এ দৃশ্য তার ডকুমেন্টারিকে অন্য মাত্রা দেবে, কিন্তু একই সাথে মনে হচ্ছিল—এই শব্দে কোনো এক অদৃশ্য যন্ত্রণা লুকিয়ে আছে, যেন অনেক দূর থেকে কেউ ডাকছে।

কুয়াশার ভেতরে চোখ কুঁচকে তাকাতেই অর্ণব দেখল, সেতুর নিচে ধীরে ধীরে একটা সাদা ছায়ামূর্তি নড়ছে। প্রথমে মনে হলো আলো-অন্ধকারের খেলা, হয়তো নদীর জল আর কুয়াশার প্রতিফলন, কিন্তু কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সে বুঝল—এটা নিছক বিভ্রম নয়। সেই ছায়ামূর্তির অবয়ব এক তরুণীর মতো, লম্বা সাদা শাড়ি গায়ে, মাথা নিচু, আর হাতদুটো ঝুলে আছে শরীরের পাশে। কুয়াশার ভেতর দিয়ে সে ধীরে ধীরে হাঁটছে, কিন্তু পায়ের শব্দ নেই, নদীর ঢেউ স্পর্শ করলেও জলে কোনো আলোড়ন উঠছে না। অর্ণব নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না, অথচ ক্যামেরার লেন্সে ফ্রেম পরিষ্কার ধরা দিচ্ছিল সেই অবয়ব। তার বুকের ভেতর ভয়ের স্রোত বয়ে গেলেও সাংবাদিকসুলভ জেদ তাকে স্থির রাখল—সে শাটার টিপে গেল, ভিডিও রেকর্ড চালু করল, যেন কোনো প্রমাণ সে হারাতে না পারে। তবে কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই অবস্থা আরও ভয়াবহ হয়ে উঠল। শঙ্খধ্বনির আওয়াজ ক্রমশ তীব্র হয়ে উঠতে লাগল, যেন চারদিক থেকে প্রতিধ্বনি হয়ে আছড়ে পড়ছে সেতুর স্তম্ভে। অর্ণবের কানে তখন আর কিছুই পৌঁছাচ্ছিল না, শুধু সেই শঙ্খের গম্ভীর ডাক, যা বুক কাঁপিয়ে দিচ্ছিল।

এক সময় কুয়াশার মধ্যে ছায়ামূর্তিটি থেমে দাঁড়াল। অর্ণব অনুভব করল, সে যেন সোজা তার দিকেই তাকিয়ে আছে, যদিও মুখ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল না। তবুও ভেতর থেকে ভেসে আসছিল এক অদ্ভুত শীতল অনুভূতি, যেন কারও দৃষ্টি তাকে বিদ্ধ করছে। হঠাৎ করেই তার ক্যামেরার ডিসপ্লে কেঁপে উঠল, স্ক্রিনে ঝাপসা দাগ দেখা দিল, আর রেকর্ডিং প্রায় বন্ধ হয়ে আসছিল। অর্ণব ঘেমে উঠল, তার শরীর ভারী লাগছিল, পা যেন নড়াচড়া করছে না। ঠিক সেই মুহূর্তে ছায়ামূর্তির চারপাশে কুয়াশা আরও ঘন হয়ে গেল, আর ভেসে এল এক দীর্ঘ শঙ্খধ্বনি, যা শেষ হতে হতে যেন এক মহিলার বিলাপের শব্দে পরিণত হলো। অর্ণবের গা শিউরে উঠল, সে মরিয়া হয়ে ক্যামেরাটা টেনে নিল, রেকর্ড বন্ধ করল, আর দ্রুত সেতুর দিক থেকে দূরে সরে গেল। সেদিন রাতের সেই অভিজ্ঞতা তার জীবনের সবচেয়ে বাস্তব অথচ অবিশ্বাস্য ঘটনা হয়ে রইল। বাড়ি ফিরে সে বারবার রেকর্ডিং চালিয়ে দেখল—মাইক্রোফোনে শঙ্খের শব্দ ধরা পড়েছে, কিন্তু ভিডিওতে ছায়ামূর্তির চিহ্ন খুব সামান্য, প্রায় অদৃশ্য। যেন সত্য তাকে শুধু নিজের চোখেই দেখতে দিয়েছে, কিন্তু ক্যামেরায় পুরোটা ধারণ করতে দেয়নি। তবুও অর্ণব জানত, সে একা বিভ্রমে ভুগছে না, সেতুর নিচে সত্যিই কোনো অদৃশ্য শক্তি রয়েছে, আর সেই শক্তিই শঙ্খসেতুকে ঘিরে সমস্ত রহস্যের কেন্দ্রবিন্দু।

অধ্যায় ৫ –

অর্ণব পরদিন ভোরেই গ্রামের পোস্ট অফিসের পাশের লাইব্রেরিতে যায়, যেখানে পুরোনো কাগজপত্র রাখা আছে। স্থানীয় এক শিক্ষক তাকে বলেন, ব্রিটিশ আমলের কিছু পুলিশি রেকর্ড এখনও আর্কাইভে মজুত আছে, তবে ধুলোয় ঢেকে থাকা, ভঙ্গুর কাগজগুলো খুলতে সাহস লাগে। অনেকেই সেগুলো আর পড়তে যায় না, যেন অশুভ কিছু লেখা আছে তাতে। অর্ণব ঝুঁকির তোয়াক্কা না করেই সেই নথিগুলো খুঁজতে শুরু করে। পুরু ফাইল, কালচে দাগে ভরা পাতাগুলো, জীর্ণ ইংরেজি হাতে লেখা রিপোর্ট—সব মিলিয়ে যেন আরেক জগতে প্রবেশ করা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে সে খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে পায় একটি ফাইল—শিরোনামে লেখা আছে *”Case No. 47-B, Sankhasetu Disappearance”। ফাইলের ভেতরে প্রথম পাতায় স্পষ্ট উল্লেখ—“প্রমাণের অভাবে মামলা বন্ধ করা হলো।” কিন্তু যত অর্ণব পড়তে থাকে, ততই এক অস্বাভাবিক আতঙ্ক তার শরীরে চেপে বসে।

ফাইলের ভেতরে পুলিশের দৈনিক রিপোর্টে খুঁটিনাটি নোট পাওয়া গেল। একজন ব্রিটিশ অফিসার লিখেছেন, স্থানীয় জমিদারের কন্যা নিখোঁজ হওয়ার পর পুলিশ কয়েকদিন ধরে সেতুর আশেপাশে তল্লাশি চালিয়েছিল। জেলে, মাঝি, এমনকি গ্রামের মহিলারাও সাক্ষ্য দিয়েছিল যে তারা রাতে সেতুর নিচে থেকে অদ্ভুত শঙ্খধ্বনি শুনেছে। আরও অদ্ভুত হলো—কিছু কনস্টেবল রিপোর্টে স্বীকার করেছে তারা নিজের চোখে আলোর ঝলকানি আর সাদা পোশাকের মতো ছায়া দেখেছে। কেউ কেউ বলেছে, মেয়েটি হয়তো নদীতে পড়ে গিয়েছিল, কিন্তু প্রমাণ নেই। মৃতদেহ বা কোনো কাপড়চোপড় পর্যন্ত উদ্ধার হয়নি। অথচ প্রতিদিন রাতে এক নির্দিষ্ট সময়ে সেতুর নিচে সাদা আলো জ্বলে ওঠে—এক কনস্টেবল লিখেছেন—“as if a spirit walks beneath the stone.” এই স্বীকারোক্তিগুলো অফিসিয়ালি গুরুত্ব পায়নি, বরং আদালতের কাগজপত্রে সেগুলোকে বাদ দেওয়া হয়। তবু হাতে লেখা নোটগুলো স্পষ্ট প্রমাণ দিচ্ছিল, অফিসাররা নিজেরাও ভয় পেয়েছিল।

অর্ণব এক এক করে সেই রিপোর্ট পড়তে পড়তে যেন এক ভৌতিক পরিবেশে ঢুকে গেল। সেতুর নিখোঁজ কাহিনি শুধু গ্রামবাসীর মুখের গল্প নয়, পুলিশের অফিসিয়াল নথিতেও তার প্রতিধ্বনি পাওয়া যাচ্ছে। এটি তাকে আরও তাড়িত করল ডকুমেন্টারিটি শেষ করার জন্য। সে ভাবতে লাগল, সত্তর বছর আগের কনস্টেবলরা যদি একই অদ্ভুত শব্দ ও আলো দেখে থাকেন, তবে গত রাতে তার ক্যামেরার সামনে যা ঘটেছে, তা নিছক কাকতালীয় নয়। ইতিহাস যেন বারবার নিজেকে পুনরাবৃত্তি করছে। কিন্তু কেন? কার আত্মা সেই সেতুর নিচে ঘুরে বেড়ায়? আর কী রহস্য লুকিয়ে আছে শঙ্খসেতুর বুকে? অর্ণব বুঝতে পারল, সে আর শুধুই সাংবাদিক নেই—সে হয়ে উঠেছে এক অনুসন্ধানকারী, যে শঙ্খসেতুর সত্য উদ্ঘাটন না করা পর্যন্ত থামবে না।

অধ্যায় ৬ –

অর্ণবের পুরোনো নথি খোঁজার খবরে পুরো গ্রামে হইচই পড়ে গেল। কেউ তাকে উৎসাহ দিল, কেউ আবার ভয়ে কেঁপে উঠল। সন্ধ্যার পর অর্ণব হাঁটতে হাঁটতে মন্দিরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল, তখন গ্রামের প্রাচীনতম পুরোহিত তাকে ডাকলেন। বয়স আশি পেরিয়েছে, গায়ের হাড়গোড় ভেঙে যাওয়া, তবু চোখে অদ্ভুত দীপ্তি। তিনি ধীরে ধীরে বললেন, “শোনো বাবা, তোমাকে সতর্ক করছি। শঙ্খসেতুর যে ধ্বনি তুমি শুনেছ, সেটা নদীর খেলা নয়, ওটা আত্মার ডাক। যারা তার টানে কাছে গিয়েছে, তারা আর কোনোদিন ফিরে আসেনি।” পুরোহিতের গলা যেন কেঁপে উঠছিল, বহু বছরের ভয় আর অভিজ্ঞতার বোঝা সেই কথার মধ্যে মিশে ছিল। তিনি জানালেন, ছোটবেলায় তিনিও শুনেছিলেন সেই শঙ্খধ্বনি, এবং দেখেছিলেন কীভাবে গ্রামের দুই যুবক সেতুর দিকে গিয়েছিল আর তারপর চিরদিনের মতো উধাও হয়ে গিয়েছিল। গ্রামের মানুষ আজও তাদের নাম নিতে ভয় পায়।

অর্ণব মন দিয়ে শুনলেও তার সাংবাদিকসুলভ যুক্তি থামল না। সে ভাবতে লাগল, আত্মা-টাত্রার কথা শুধু কুসংস্কার, সত্যি কিছু থাকলে এত বছর ধরে কেউ তার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা খুঁজে পেত না কেন? তবু পুরোহিতের চোখে যে আতঙ্ক ঝিলিক দিচ্ছিল, তা তাকে কাঁপিয়ে তুলল। বৃদ্ধ বললেন, “তুমি শহর থেকে এসেছ, বই পড়েছ, বিজ্ঞানের যুক্তি বোঝো। কিন্তু বিশ্বাস করো, সব রহস্যের উত্তর বইয়ে পাওয়া যায় না। কিছু জিনিস মানুষের বোধের বাইরে। নদীর বুকে যার আত্মা ঘুরে বেড়ায়, সে শঙ্খধ্বনি দিয়ে তার শিকার ডাকে। সেই ডাক অমানবিক—মানুষ তা এড়াতে পারে না। শোনার পর যে যায়, সে আর ফেরে না।” পুরোহিত আরও বললেন, যারা ফেরত আসেনি, তাদের পরিবার আজও ওই সেতুর নাম উচ্চারণ করতে চায় না। তিনি হাতজোড় করে অনুরোধ করলেন অর্ণবকে এই তদন্ত ছেড়ে শহরে ফিরে যেতে।

কিন্তু অর্ণবের ভেতরে তখন অন্যরকম ঝড়। ভয়ের সঙ্গে লড়াই করছে কৌতূহল আর পেশাগত দায়বদ্ধতা। পুরোহিতের সতর্কবাণী তার কানে প্রতিধ্বনি তুললেও, তার মনের ভেতর গেঁথে গেল অন্য এক প্রশ্ন—যদি সত্যিই আত্মার ডাক থাকে, তবে কেন এত বছর ধরে রহস্যটা কেউ সমাধান করতে পারেনি? কেন পুলিশের নথিতেও ইঙ্গিত আছে, আর কেন আজও গ্রামবাসী আতঙ্কে কাঁপে? এই সবকিছুর উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত তার কাজ শেষ হবে না। তাই পুরোহিতকে সম্মান জানিয়ে সে বলল, “আপনার ভয় আমি বুঝতে পারছি, কিন্তু আমি সত্য বের না করে ফিরব না। হয়তো এটাই সুযোগ সবার সামনে সত্য উন্মোচন করার।” বৃদ্ধ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, যেন জানতেন অর্ণব আর থামবে না। সেই রাতেই অর্ণব মনে মনে শপথ নিল, শঙ্খসেতুর রহস্য উন্মোচন করেই তবে সে ফিরবে, যত ভয় আর বিপদই সামনে আসুক না কেন।

অধ্যায় ৭ –

অর্ণবের অনুসন্ধান এবার তাকে টেনে নিয়ে গেল সেই পরিত্যক্ত জমিদার বাড়ির ভাঙা দালানে, যেটি বহু বছর ধরে গ্রামের মানুষ এড়িয়ে চলে। ধুলো মলিন সিঁড়ি, ভাঙা দরজা, শ্যাওলায় ঢাকা দেওয়াল—সবকিছু যেন ভয়ের এক অদৃশ্য আবরণে ঢেকে আছে। দুপুরের আলোতেও বাড়িটি কেমন অন্ধকার আর গুমোট, তবু অর্ণব হাতে টর্চ নিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ল। তার মনে হচ্ছিল এখানে কোনো না কোনো প্রমাণ নিশ্চয়ই লুকিয়ে আছে। ঘর থেকে ঘরে ঘুরতে ঘুরতে সে হঠাৎ এক কোণে ভাঙা সিন্দুকের ভেতরে চাপা দেওয়া হলদেটে কাগজপত্র দেখতে পেল। সাবধানে টেনে বের করে দেখল, পুরোনো এক চিঠি, যেটি সময়ের দাগে প্রায় ঝাপসা হয়ে গেছে। অর্ণব সাবধানে অক্ষরগুলো পড়তে লাগল, আর প্রতিটি শব্দ যেন তার বুকের ভেতর কাঁপন তুলল।

চিঠিতে লেখা ছিল জমিদারের কন্যার শেষ আর্তি। তিনি লিখেছিলেন—কীভাবে ব্রিটিশ সেনারা তাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল, কীভাবে নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছিল বারবার, আর কীভাবে সে মুক্তির জন্য প্রার্থনা করেছিল। শেষ দিকে লেখা ছিল—“আমার আত্মা যদি মুক্তি না পায়, তবে আমি শঙ্খসেতুর তলায় থেকে যাব, আর শঙ্খধ্বনি দিয়ে ডাকব সকলকে, যেন তারা আমার যন্ত্রণা অনুভব করে।” অর্ণবের চোখের সামনে যেন কুয়াশার ভেতর এক দুঃখভরা মুখ ভেসে উঠল। সে বুঝতে পারল, এতদিন যে রহস্য ঘিরে ছিল সেতুকে, তার পেছনে লুকিয়ে আছে এক নারীর অসমাপ্ত যন্ত্রণা, এক আত্মার অনন্ত ক্রন্দন। পুরোনো চিঠির কাগজে অশ্রুর দাগ শুকিয়ে থাকলেও আজও তার শব্দে অমোঘ শক্তি। অর্ণব শিউরে উঠল, কারণ চিঠির প্রতিটি লাইন তাকে যেন বলছিল—“তুমি যদি সত্য জানতে এসেছ, তবে এই কষ্টকেও বুঝে নাও।”

অর্ণব চিঠি হাতে নিয়ে গভীর চিন্তায় ডুবে গেল। হঠাৎ তার মনে হলো, এটাই হয়তো সেই প্রমাণ, যা এতদিন কেউ খুঁজে পায়নি। পুলিশের নথিতে শুধু ইঙ্গিত ছিল, কিন্তু সত্যটা লুকিয়ে ছিল এই ভাঙা দালানের অন্ধকারে। এখন প্রশ্ন হলো—সে কি এই প্রমাণ প্রকাশ্যে আনবে? নাকি এটিকে চাপা দিয়ে রাখবে, যেমন এতদিন সবাই করেছে? তার ভেতরে সাংবাদিকের দায়িত্ব আর মানুষের আবেগের দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে গেল। সে জানত, এই সত্য প্রকাশ করলে গ্রামবাসীর ভয় আরও বেড়ে যেতে পারে, কিন্তু একইসাথে অন্যায়ের ইতিহাসকেও আড়াল রাখা যায় না। এক নারীর আত্মা যদি আজও শান্তি না পেয়ে থাকে, তবে তার যন্ত্রণা আলোর মুখ দেখানোই ন্যায়। অর্ণব চিঠি বুকের কাছে চেপে ধরল, মনে হলো সেই কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে—শঙ্খধ্বনি শুধু ভয় নয়, বরং এক নীরব আর্তি, যা শোনা হয়নি এতদিন। সেই মুহূর্তে অর্ণব প্রতিজ্ঞা করল, যত ঝুঁকিই থাকুক না কেন, সে সত্যকে প্রকাশ্যে আনবেই, কারণ এই রহস্য আর চাপা দিয়ে রাখা যায় না।

অধ্যায় ৮ –

অর্ণব দ্বিতীয় রাতে আবার ক্যামেরা নিয়ে সেতুর দিকে রওনা দিল, কিন্তু এবার তার ভেতর এক অদ্ভুত শঙ্কা কাজ করছিল। গতকাল যে চিঠি সে পড়েছিল, তার প্রতিটি শব্দ যেন মনের ভেতর প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। গঙ্গার হাওয়া কেমন ভারি লাগছিল, চারপাশে কুয়াশা জমে নদীর ধারে একটা অদ্ভুত নিস্তব্ধতা নেমে এসেছিল। সেতুর নিচে গিয়ে ক্যামেরা বসানোর সময় তার হাত কেঁপে উঠছিল, কিন্তু সাংবাদিক হিসেবে তার কৌতূহল ভয়কে পেছনে ঠেলে দিল। ঘড়ির কাঁটা যখন মধ্যরাত ছুঁলো, তখন হঠাৎ গঙ্গার বুক চিরে ভেসে উঠল শঙ্খধ্বনি—কিন্তু এবার তা গতবারের চেয়ে অনেক জোরে, যেন কারও বুকে চাপা ক্রন্দনকে শঙ্খের আওয়াজে প্রকাশ করছে। ধ্বনিটা যত বাড়তে লাগল, অর্ণবের বুকের ধুকপুক ততই জোরে হতে লাগল, মনে হচ্ছিল কেউ তাকে অদৃশ্য শক্তি দিয়ে টেনে নিচ্ছে নদীর দিকে।

ক্যামেরার লেন্সে হঠাৎ দেখা গেল কুয়াশার ভেতর এক সাদা শাড়ি পরা তরুণী দাঁড়িয়ে আছে সেতুর ঠিক নিচে। তার মুখ অস্পষ্ট, কিন্তু চুলগুলো ভিজে নেমে এসেছে বুকের ওপর, চোখ যেন গভীর অন্ধকারের মতো কালো। অর্ণব স্থির হয়ে তাকিয়ে রইল, হাত থেকে ট্রাইপড প্রায় পড়ে যাচ্ছিল। তরুণী কোনো শব্দ করল না, কিন্তু তার নিঃশব্দ দৃষ্টি যেন ভেদ করে যাচ্ছিল অর্ণবের অন্তর। হঠাৎ ক্যামেরার স্ক্রিন কেঁপে উঠল, ছবিটা বিকৃত হয়ে গেল, তারপর আবার স্পষ্ট হলো—তরুণী এক পা এক পা করে সেতুর খুঁটির নিচ থেকে বেরিয়ে আসছিল। প্রতিটি পদক্ষেপে গঙ্গার পানি আলো ছড়িয়ে উঠছিল, যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি তাকে ঘিরে রেখেছে। অর্ণব বুঝতে পারল, এ শুধু কল্পনা নয়, এ বাস্তব। তার শরীর শীতল হয়ে গেল, কিন্তু সে চোখ ফেরাতে পারল না, সাংবাদিকতার তাগিদ তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য করল।

মুহূর্তের মধ্যে শঙ্খধ্বনি আরও ভয়ঙ্করভাবে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল, নদীর ঢেউ যেন অস্থির হয়ে উঠল। তরুণী হঠাৎ হাত বাড়াল, অর্ণবের দিকে—যেন তাকে ডাকছে, তার যন্ত্রণার ভাগীদার বানাতে চাইছে। অর্ণব শ্বাস নিতে পারছিল না, মনে হচ্ছিল কোনো অদৃশ্য দড়ি তার বুক চেপে ধরছে। ক্যামেরায় রেকর্ড হচ্ছিল সবকিছু, কিন্তু অর্ণবের মনে হচ্ছিল এ দৃশ্য কোনো মানুষকে দেখানো সম্ভব নয়। হঠাৎ প্রচণ্ড ঝড়ো হাওয়া বইতে লাগল, ক্যামেরা কেঁপে উঠল, আর তরুণীর মুখ হঠাৎ স্পষ্ট হয়ে উঠল—সে জমিদারের সেই কন্যা, যাকে নির্যাতনের পর অদৃশ্য হয়ে যেতে হয়েছিল। তার চোখ থেকে নদীর জলের মতো অশ্রু ঝরছিল, ঠোঁট নড়ছিল, কিন্তু কোনো শব্দ বেরোচ্ছিল না। অর্ণব এক পা পিছোতে গিয়েও থমকে দাঁড়াল, কারণ বুঝল—সে যদি আজ পালিয়ে যায়, তবে আর কখনো সত্য জানতে পারবে না। সেই রাতের ভৌতিকতা তাকে গ্রাস করলেও তার অন্তরে জন্ম নিল এক নতুন সিদ্ধান্ত—এ রহস্যকে আলোর মুখ দেখানোই হবে, যতই ভয়ঙ্কর হোক না কেন।

অধ্যায় ৯ –

অর্ণবের মনে বারবার ভেসে উঠছিল সেই সাদা শাড়ি পরা তরুণীর মুখ। দ্বিতীয় রাতের অভিজ্ঞতা তাকে বদলে দিয়েছিল পুরোপুরি। সে জানত, এই রহস্যের সমাধান না করলে সে স্বাভাবিকভাবে বাঁচতে পারবে না। পরদিন সকালেই সে আবার নেমে পড়ল খোঁজখবর নিতে, গ্রামের প্রবীণ মানুষদের সঙ্গে কথা বলতে। বহু বোঝানোর পর এক বৃদ্ধ মুখ খুললেন। কাঁপা গলায় তিনি বললেন, জমিদারের কন্যার নাম ছিল বিন্দুপ্রভা। সে শুধু জমিদারের মেয়ে নয়, এক স্বাধীনতা সংগ্রামীর প্রেমিকা ছিল। ব্রিটিশদের চোখে সে ছিল বিপজ্জনক, কারণ তার মাধ্যমে সেই সংগ্রামী বারবার লুকিয়ে দেখা করত গ্রামের মানুষের সঙ্গে, পরিকল্পনা করত বিদ্রোহের। জমিদার নিজের প্রভুত্ব রক্ষার জন্য মেয়ের এই সম্পর্ককে বিশ্বাসঘাতকতা মনে করত। ব্রিটিশদের সঙ্গে আঁতাত করে সে নিজের মেয়েকেই ফাঁদে ফেলে দিল। এক রাতের আঁধারে বিন্দুপ্রভাকে ডেকে আনা হলো শঙ্খসেতুর নিচে, আর সেখানেই তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হলো। নদী গিলে নিল তার দেহ, কিন্তু মুক্তি পেল না তার আত্মা। সেই থেকে প্রতিরাতে শঙ্খসেতুতে ধ্বনি ওঠে, যেন সে চিরদিন ডাকছে—তার ভালোবাসাকে, তার হারানো জীবনের প্রতিশোধকে।

অর্ণব স্তব্ধ হয়ে শুনছিল। তার মনে হচ্ছিল, এতদিনের সমস্ত টুকরো টুকরো রহস্য এখন একসঙ্গে জোড়া লাগছে। ব্রিটিশ সেনাদের নির্যাতনের চিঠি, পুলিশের নথিতে অদ্ভুত শব্দ ও আলোর উল্লেখ, পুরোহিতের আতঙ্কভরা সতর্কবার্তা—সব মিলিয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠল সত্য। বিন্দুপ্রভা ছিল না শুধু জমিদারের মেয়ে, সে ছিল স্বাধীনতার সঙ্গী, এক তরুণীর সাহসী আত্মত্যাগ। অথচ তার পরিণতি হলো বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়ে নির্মম মৃত্যু। অর্ণব কল্পনা করল, নদীর কালো স্রোতে ডুবে থাকা সেই মুহূর্তে বিন্দুপ্রভা কতটা আর্তনাদ করেছিল, আর কিভাবে তার কান্না চিরন্তন শঙ্খধ্বনিতে রূপান্তরিত হয়েছে। সে বুঝল, শঙ্খসেতুর অভিশাপ কোনো কুসংস্কার নয়, বরং সত্যিকারের ইতিহাসের প্রতিধ্বনি। জমিদার ও ব্রিটিশদের ষড়যন্ত্র তার জীবনের আলো নিভিয়ে দিলেও, তার আত্মার চিৎকার আজও বেঁচে আছে কুয়াশার আড়ালে।

অর্ণবের ভেতরে তখন দ্বন্দ্ব তৈরি হলো। সাংবাদিক হিসেবে তার কাজ হলো সত্যকে প্রকাশ্যে আনা, কিন্তু মানুষের মনস্তত্ত্ব এত সহজ নয়। যদি এই সত্য জানাজানি হয়, তবে গ্রামের ভয় আরও তীব্র হতে পারে, আবার অন্যদিকে এ সত্য লুকিয়ে রাখলে বিন্দুপ্রভার আত্মা হয়তো চিরদিন শান্তি পাবে না। অর্ণব ভাবতে লাগল, হয়তো তারই হাতে সেই মুক্তির চাবি আছে। হয়তো সত্যিটা তুলে ধরা, বিন্দুপ্রভার গল্প সবার সামনে আনা—এই পথেই শেষ হবে তার অভিশপ্ত ভ্রমণ। সেদিন রাতে সে সেতুর দিকে তাকিয়ে শপথ নিল—সে বিন্দুপ্রভাকে ভুলে যেতে দেবে না। তার কাহিনি শুধু ভয়ের গল্প নয়, বরং ভালোবাসা, স্বাধীনতা আর বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাস, যা লুকিয়ে রাখা মানেই অন্যায়ের সঙ্গী হওয়া। অর্ণব জানত সামনে আরও বিপদ অপেক্ষা করছে, কিন্তু সত্যের মুখোমুখি হয়ে সে প্রথমবার উপলব্ধি করল, তার অনুসন্ধান আর কেবল সাংবাদিকতার দায়িত্ব নয়—এ যেন ইতিহাসের প্রতি এক গভীর দায়, আর এক অসমাপ্ত আত্মার মুক্তির যাত্রা।

অধ্যায় ১০ –

অর্ণবের দিনগুলো আর আগের মতো থাকল না। প্রতিটি রাত তার কাছে হয়ে উঠল দুঃস্বপ্নের মতো, আর প্রতিটি সকাল অদ্ভুত এক অস্থিরতা নিয়ে আসত। সে জানত, বিন্দুপ্রভার আত্মা আজও শান্তি পায়নি, আর এই শঙ্খসেতু তার অভিশপ্ত কারাগার। চিঠি, পুলিশের নথি আর প্রবীণদের কাহিনি মিলিয়ে সত্যিটা সে পেয়েছে, কিন্তু কীভাবে সেই আত্মাকে মুক্তি দেওয়া যায়, তা নিয়ে তার মন ছটফট করতে লাগল। একরাতে সে সিদ্ধান্ত নিল, সেতুর নিচে বসে প্রার্থনা করবে, বিন্দুপ্রভার যন্ত্রণা ও বিশ্বাসঘাতকতার কাহিনি প্রমাণ হিসেবে নদীর জলে সমর্পণ করবে। যেন এইভাবে তার আত্মা বুঝতে পারে—কেউ তার কষ্টকে শুনেছে, কেউ তার ইতিহাসকে বিস্মৃত হতে দেয়নি। মধ্যরাত পেরিয়ে অর্ণব সেতুর কাছে পৌঁছল, হাতে পুরোনো চিঠি, পাশে ক্যামেরা, আর বুকভরা বিশ্বাস যে সে ইতিহাসকে তার প্রাপ্য সম্মান দিতে এসেছে। গঙ্গার হাওয়া ভারি হয়ে উঠছিল, কুয়াশা জমছিল ধীরে ধীরে, আর সেই অচেনা সুরে আবার ভেসে উঠল শঙ্খধ্বনি।

অর্ণব হাঁটু গেড়ে বসে কাগজের টুকরো নদীর জলে ভাসিয়ে দিল, আর ধীর কণ্ঠে বলল—“বিন্দুপ্রভা, তোমার কাহিনি আমি ভুলব না। তোমার সত্য আমি লুকাব না। তুমি মুক্ত হও।” আশ্চর্যভাবে সেই মুহূর্তে শঙ্খধ্বনি ধীরে ধীরে স্তব্ধ হয়ে গেল। নদীর বুকের ঢেউ থেমে এল, সেতুর নিচের আলোকছটা ম্লান হয়ে মিলিয়ে যেতে লাগল। মনে হচ্ছিল, কোনো দীর্ঘস্থায়ী যন্ত্রণা অবশেষে শান্তির পথে এগোচ্ছে। অর্ণবের বুক ভরে উঠল অদ্ভুত এক স্বস্তিতে, যেন তার সব শ্রম সার্থক হলো। সে বিশ্বাস করল, এতদিনের আতঙ্ক, এতদিনের অভিশাপ—সবই হয়তো শেষ হলো আজ রাতে। কিন্তু সেই মুহূর্তেই বাতাসে হঠাৎ জমাট অন্ধকার নেমে এলো, কুয়াশার আস্তর ঘন হয়ে তাকে ঘিরে ধরল। সে তাকিয়ে দেখল, নদীর ধারে কেউ দাঁড়িয়ে আছে—সাদা শাড়ির ভিজে কাপড়ে জড়ানো বিন্দুপ্রভা, যাকে সে আগেও দেখেছে। তার চোখে আর কান্না নেই, মুখে অদ্ভুত শান্তি, কিন্তু সেই শান্তির আড়ালে লুকিয়ে আছে রহস্যময় শূন্যতা।

অর্ণব তার দিকে হাত বাড়াতে গিয়েছিল, কিন্তু তখনই সে অনুভব করল মাটি যেন তার পা থেকে সরে যাচ্ছে। কুয়াশা ক্রমশ ঘনীভূত হয়ে তার শরীরকে আচ্ছন্ন করতে শুরু করল। ক্যামেরার আলো ঝলসে উঠল একবার, তারপর নিভে গেল। শঙ্খধ্বনি ফিরে এল না, নদীও শান্ত, কিন্তু তার চারপাশে নিস্তব্ধতা অমানবিক হয়ে উঠল। অর্ণব চিৎকার করতে চাইলেও গলা থেকে কোনো শব্দ বেরোল না। ধীরে ধীরে সে অনুভব করল, তার শরীর কুয়াশার ভেতর অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে, যেন তাকে ডেকে নিয়ে যাচ্ছে অন্য এক জগতে। শেষ মুহূর্তে তার চোখে ভেসে উঠল বিন্দুপ্রভার মুখ—কঠিন অথচ করুণ, যেন সে মুক্তি পেলেও অর্ণবকে নিজের সঙ্গে টেনে নিচ্ছে। তারপর সব অন্ধকার। পরদিন সকালে গ্রামবাসী সেতুর নিচে শুধু ফাঁকা ক্যামেরা আর জলে ভেসে থাকা হলদেটে চিঠির টুকরো দেখতে পেল। শঙ্খসেতুর ধ্বনি সেদিন থেকে আর শোনা গেল না, কিন্তু গ্রামের লোকেরা ফিসফিস করে বলতে লাগল—“মুক্তি কি সত্যিই হলো? নাকি অভিশাপের ভার এবার অর্ণবের ওপর এসে পড়ল?” গঙ্গার কুয়াশায় তার নাম মিশে গেল, আর শঙ্খসেতুর ইতিহাস পেল এক নতুন অধ্যায়—যেখানে সত্য উদঘাটনের মূল্য হলো চিরন্তন অদৃশ্য হয়ে যাওয়া।

শেষ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *