Bangla - নারীবিষয়ক গল্প

শঙ্খবালা

Spread the love

তনুশ্রী বসাক


অধ্যায় ১: জন্মের অশনি

নীলডিহি গ্রামের পূর্বপাড়ার শেষে, একটি জরাজীর্ণ কুঁড়ে ঘর। শিউলি ফুলের গাছ তার সামনের উঠোনে ঝুঁকে পড়েছে, আর ঘরের ভিতর থেকে এক আর্তনাদ ভেসে আসছে—এক প্রসূতির কষ্টকর আর্তি। গ্রামের বয়স্কা ধাইমা চৈতালী বুড়ি দরজা বন্ধ করে ভেতরে নিঃশব্দে কাজ করছে। ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে দু-তিনজন নারী, চোখে ভয়, কানে হাওয়ায় ভেসে আসা শতাব্দী পুরনো গুজবের প্রতিধ্বনি। আজকের এই জন্ম আলাদা। ঠিক একশো বছর পর আবার সেই অমঙ্গল বার্তাবাহী ‘শঙ্খচক্ষু কন্যা’ জন্ম নিচ্ছে — এমনটাই বলছে লোককথা। সন্ধ্যা নামছে, তালগাছের মাথায় দাঁড় টেনে সূর্য ডুবে যাচ্ছে পশ্চিমে, আর ঠিক সেই মুহূর্তে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে এক নবজাতকের কান্না। চৈতালী বুড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে আসে—হাতে এক সদ্যোজাত কন্যা শিশু, চোখ দু’টো অদ্ভুত, যেন শঙ্খের ভেতরের ছায়া মেখে আছে সেখানে। তার চোখে তাকিয়ে সকলে কেঁপে ওঠে।

গ্রামে আগেই ছড়িয়ে পড়েছিল গাঁজিয়ে ওঠা বিশ্বাস—”যদি আবার জন্মায় শঙ্খচক্ষু কন্যা, তবে ফিরবে কালিকেত”। শত বছর আগে নীলডিহি গ্রামে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড হয়েছিল, নদীর জল কালো হয়ে গিয়েছিল, গবাদিপশু মারা পড়েছিল এক এক করে। গ্রামের প্রাচীন পুঁথিতে লেখা আছে, “শঙ্খের ছায়া যার নয়নে, তার পদস্পর্শে দুঃখ নেমে আসে। তবে সে-ই দেবে মুক্তি, যখন অন্ধকার সবচেয়ে ঘন হয়।” কিন্তু ভয় মানুষের মনে আলো ফোটাতে দেয় না। তাই শঙ্খবালার জন্ম মুহূর্ত থেকেই তার বাড়ির দরজা বন্ধ হয়ে যায়, লোকজন এড়িয়ে চলে শিশুটিকে। তার মা কুসুমবালা নিজের মেয়েকে বুকের কাছে টেনে রাখে, কিন্তু চোখেমুখে জেগে থাকে এক আশঙ্কার রেখা। বাবার কোনো চিহ্ন নেই — লোক বলত, “অমন অপয়া সন্তানের পিতা কি আর সয়ে নিতে পারে?”

বছর গড়াতে থাকে, আর শঙ্খবালার চোখে প্রতিফলিত হয় এমন সব দৃশ্য যা অন্য কেউ দেখতে পায় না। সে নদীর ধারে দাঁড়িয়ে থেকে বলে—“মাটি কাঁপবে এখানে”, আর পরদিন সত্যিই সেখানে ভেঙে পড়ে পুরনো বাঁশের সাঁকো। মা কুসুমবালা দিনে দিনে দুর্বল হয়ে পড়ে, চাপা কষ্ট আর সামাজিক নিপীড়নে একসময় মরে যায়। তখন শঙ্খবালার বয়স মাত্র আট। তাকে দয়ায়-অনুগ্রহে বাঁচিয়ে রাখে কিছু নারীবন্ধু, আর একমাত্র সঙ্গী হয়ে ওঠে ঋদ্ধি, সমবয়সী আর এক প্রাণবন্ত কিশোরী, যে ভয় পায় না — বরং শঙ্খবালাকে প্রশ্ন করে, “তোর চোখে এমন করে আলো পড়ে কেন?” শঙ্খবালা জবাব দিতে পারে না, কেবল নদীর দিকে তাকিয়ে চুপ করে থাকে। তবে রাত নামলে, একা ঘুমোতে গেলে তার মাথায় ভেসে ওঠে আগুন, ঝড়, আর এক ছায়াময় মুখ — অন্ধকারের উৎস।

এই সময়, বহু দূরে পাহাড়ের গুহায় বসে ধ্যান করছেন এক রহস্যময় মানুষ — অরিন্দম। গ্রামের কেউ তাকে চেনে না, তার অস্তিত্ব নিয়েও কেউ নিশ্চিত নয়। কিন্তু অরিন্দম জানেন, শঙ্খচক্ষু কন্যা আবার জন্মেছে। তিনি বছর ধরে অপেক্ষা করছিলেন এই মুহূর্তটির জন্য। কারণ কেবল শঙ্খচিহ্নধারিনী কন্যাই পারে বন্ধ করতে আসন্ন সর্বনাশ — যে সর্বনাশ আবার ঘনিয়ে আসছে কালিকেতের জেগে ওঠায়। পাহাড়ের গুহার ভিতর শঙ্খ রাখা কাঠের বাক্সের উপর হাত রেখে অরিন্দম চোখ বন্ধ করেন। বাতাস থমকে দাঁড়ায়। আর ঠিক তখন, নীলডিহি গ্রামের আকাশে প্রথমবার বাজ পড়ে — যেটা ছিল না শুধুই প্রাকৃতিক ঝড়, বরং একটি শুরু, অজানা ভয় আর এক অপূর্ব পরিণতির।

অধ্যায় ২: মেয়েটির একলা শৈশব

নীলডিহি গ্রামের সকলে শঙ্খবালাকে এড়িয়ে চলে। স্কুলে গেলে মেয়েরা পালিয়ে বসে দূরে, ছেলেরা তার দিকে পাথর ছোঁড়ে, কেউ কেউ খোলাখুলিই বলে—”ওর চোখে অপশক্তি আছে, ওর পাশে বসলে ছায়াও পোড়ে।” অথচ সে কখনও কারো ক্ষতি করেনি। বরং নিরবে নিঃশব্দে সে বুঝতে শিখেছিল গাছেদের ভাষা, নদীর কান্না, বাতাসের অস্থিরতা। প্রতিদিন বিকেলে সে চলে যেত পশ্চিমের জঙ্গলঘেরা পুকুরটার ধারে, যেখান থেকে ভেসে আসত অদ্ভুত এক মৃদু শঙ্খধ্বনি—যদিও কেউই তার উৎস খুঁজে পায়নি। তার সেই নীরব জীবনে একদিন ঢুকে পড়ে আর-এক কিশোরী — ঋদ্ধি। কাঁচা লম্বা চুল, মুখে দুঃসাহসিক জিজ্ঞাসা, গলায় গাঁদাফুলের মালা। ঋদ্ধি একদমই অন্যরকম। ভয় কী জিনিস সে জানে না, কুসংস্কারকে সে তাচ্ছিল্য করে হেসে উড়িয়ে দেয়।

ঋদ্ধি প্রথম দিনই বলেছিল — “তোর চোখ দেখে আমি ভয় পাই না, বরং মনে হয় তুই অনেক কিছু দেখতে পারিস, যা আমরা পারি না।” তখন শঙ্খবালা অবাক হয়ে বলেছিল — “তুই আমায় ভয় পাচ্ছিস না?” ঋদ্ধি হেসে জবাব দিয়েছিল, “ভয়ের চেয়ে বড় কথা, তোকে চিনতে চাই।” সেইদিন থেকেই শুরু হয় তাদের অদ্ভুত বন্ধুত্ব। তারা একসঙ্গে খেলত না, কিন্তু হাঁটত একসঙ্গে। জঙ্গল ঘুরত, নদী পেরিয়ে ধানখেতের ভিতর দিয়ে যেত, আর শঙ্খবালা মাঝে মাঝে থেমে গিয়ে বলত — “এই গাছটা ব্যথা পেয়েছে”, অথবা “এই ঘাসের তলায় কিছু লুকিয়ে আছে।” ঋদ্ধি কখনও হাসত না, কখনও সন্দেহ করত না — সে কেবল শুনত। আর শঙ্খবালার হৃদয়ের ভার কিছুটা হালকা হতো, যেন প্রথমবার কেউ তার ভিতরের শব্দ শুনছে।

তবে এই সম্পর্ক গ্রামের চোখে ছিল বিদ্রোহ। বড়রা ঋদ্ধিকে বকত, “তুই ওর সঙ্গে এত ঘোরাঘুরি করিস কেন? জানিস না সে অপয়া?” কিন্তু ঋদ্ধি জবাব দিত, “ভয় তোমাদের চোখে, ওর নয়।” শঙ্খবালার মধ্যে তখনও কোনও শক্তি জাগেনি প্রকাশ্যে, কিন্তু কিছু কিছু অলৌকিকতা ঘটছিল তার উপস্থিতিতে। একবার স্কুলের পুরনো ঘড়ি, যেটা বছরের পর বছর বন্ধ ছিল, তার ছোঁয়ায় আবার চলতে শুরু করে। আবার একবার, গ্রামে হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যাওয়া ছোট এক শিশু, যার খোঁজ সবাই ছেড়ে দিয়েছিল, তাকে খুঁজে পায় শঙ্খবালা — এক গাছতলার ছায়ায়, ঘুমন্ত। এইসব ঘটনার কথা গ্রামের অনেকে জানলেও, ভয় আর গুজবে চেপে রাখে।

 

একদিন সন্ধ্যায়, শঙ্খবালা নদীর ধারে বসে থাকে একা। ঋদ্ধি সেদিন আসেনি। হঠাৎ বাতাস থেমে যায়, পাখিরা উড়ে পালায়। নদীর ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা তালগাছগুলি কাঁপতে থাকে অদ্ভুতভাবে, অথচ বাতাস নেই। তখন শঙ্খবালা প্রথমবার অনুভব করে শরীরের ভিতর কাঁপুনি — কেবল ভয় নয়, যেন কে তাকে ডাকছে। জলে মুখ দেখতেই দেখে চোখে শঙ্খের ছায়া আরও গাঢ়, ঘূর্ণি রূপ নিচ্ছে, তার চারপাশের জলে বুদবুদ উঠছে যেন নদী নিজেই কেঁদে উঠছে। সেই মুহূর্তে কোথাও দূরে, অরিন্দম তার গুহা থেকে চোখ মেলে চায়। বাতাসে ভেসে আসে তার কণ্ঠ—”সময় আসছে, মেয়েটি বুঝতে শুরু করেছে।” আর শঙ্খবালা, একলা বসে, জলের ধ্বনি শুনতে থাকে, যেখানে অদৃশ্য এক বার্তা যেন ফিসফিস করে বলে ওঠে—”তুই অপয়া নোস… তুই রক্ষা করবি… কিন্তু তোর সময় এখনও আসেনি।”

অধ্যায় ৩: স্বপ্নে আগুন, ছায়ায় নদী

শঙ্খবালার বয়স তখন বারো পেরিয়েছে। দিনগুলো প্রায় একইরকম কাটে — স্কুলে গিয়েও এক কোণে বসে থাকা, ঋদ্ধির সঙ্গে নদীপাড়ে সন্ধ্যার আলোয় হাঁটা, আর রাত নামলে ঘরের এক কোণে মাটির বিছানায় গুটিসুটি হয়ে শুয়ে থাকা। কিন্তু সেই বয়স থেকেই রাত তার কাছে আর কেবল ঘুমের সময় থাকেনি। তার ঘুমে আসতে শুরু করে একের পর এক বিভ্রান্তিকর স্বপ্ন — পুড়ে যাওয়া ঘরবাড়ি, গাছের পাতা ছিঁড়ে পড়ে থাকা মৃত পাখি, মাটির ফাটল দিয়ে বেরিয়ে আসা আগুনের লেলিহান শিখা। এসব সে কারো সঙ্গে বলতে সাহস পায় না। কেবল ঋদ্ধির কাছেই সে বলেছিল একদিন — “রাতে আমি দেখি, পুরো গ্রামটা পুড়ে যাচ্ছে। মানুষ ছোটাছুটি করছে, আর নদীর জল লাল হয়ে গেছে।” ঋদ্ধি চুপ করে শুনেছিল, তারপর বলেছিল — “তুই ভুল কিছু দেখিস না। কেউ না বুঝলেও আমি তোকে বুঝি।”

এরপরের দিনগুলোয় শঙ্খবালার স্বপ্ন আরও তীব্র হয়। সে দেখে, এক অন্ধকার মূর্তি নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে — চোখ নেই, মুখ নেই, কেবল ধোঁয়ায় মোড়া ছায়া। আর সেই ছায়া বলে — “তোর ভিতরেই আছে আলো, তোর দ্বারাই আমি ফিরব।” প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙার পর তার শরীর ভেজা, যেন ঘেমে গেছে — কিন্তু ঘরে গরম নেই। একদিন তার স্বপ্নে ভেসে আসে এক গুহার দৃশ্য, যেখানে কাঠের বাক্সে রাখা একটি সাদা শঙ্খ আপনাআপনি ঘুরছে, আর তার চারপাশে রয়েছে মাটির চিত্রে আঁকা এক নারী মূর্তি, যার চোখও শঙ্খের মত। শঙ্খবালা ভয় পায়, কিন্তু মুগ্ধও হয়। তার মনে হয়, কেউ যেন তাকে চিনছে — কেউ যাকে সে কোনোদিন দেখেনি।

এই সময়েই পাহাড়ের গুহায় সাধনায় নিমগ্ন অরিন্দম ধ্যান ভাঙেন। বহু বছর আগে, যখন তিনি তরুণ, তখন এক পুঁথিপাঠে জানতে পেরেছিলেন — “প্রতি শতকে একবার শঙ্খচিহ্নিত কন্যা জন্মায়, যার মাধ্যমে প্রকৃতি পুনরায় শুদ্ধ হয়, কিন্তু যাকে মানুষ অপয়া ভেবে ত্যাগ করে।” অরিন্দম জানেন, এবার সেই কন্যা জন্মেছে — নাম তার শঙ্খবালা। তার ইন্দ্রিয় বলে দেয়, মেয়েটির শক্তি জেগে উঠতে শুরু করেছে, কিন্তু ঠিকমতো দিশা না পেলে সে নিজেই ভেঙে পড়বে। তিনি পাহাড়ের ভেতর বসে শঙ্খের ধ্বনি শুনতে পান — যা কেবল বিশেষ সময়েই বেজে ওঠে। সেই ধ্বনি জানান দেয় — অন্ধকার আসছে। সময় এসেছে মেয়েটির পাশে দাঁড়ানোর।

 

একদিন বিকেলে নদীর ধারে বসে শঙ্খবালা দেখল জল হঠাৎ নড়তে শুরু করেছে — যেন কারও দম নিয়ে ওঠানামা করছে জলের গভীরে। সে কাছে যেতেই দেখে, জলে প্রতিফলিত হচ্ছে তার নয়, বরং সেই ছায়ামূর্তির মুখ — যেটি সে স্বপ্নে দেখে। ভয় পেলেও সে দৃষ্টিকে ভাঙতে পারে না। হঠাৎ জলের ফাঁকে ফাঁকে সে শুনতে পেল মন্ত্রের মতো শব্দ — “শঙ্খধ্বনি দিয়ে অন্ধকার ভেদ করিস। ভয় তোর নয়, তুই ভয়কে ছিন্ন করবি।” শঙ্খবালার মাথা ঘুরে গেল, সে পড়ে গেল পাড়ের পাশে। তখন ঋদ্ধি দৌড়ে এসে তাকে জাপটে ধরল। শঙ্খবালা চোখ খুলে কাঁপতে কাঁপতে বলল — “ও আসছে রে ঋদ্ধি… সেই ছায়া… যেটা আগুন নিয়ে আসে। সবাইকে বল, সময় কম… নদী কাঁদছে…” কিন্তু কেউই বুঝতে পারল না, সেই সন্ধ্যা থেকে কেন গ্রামের বাতাস ভারী হয়ে উঠল, কেন কুকুরেরা হাউহাউ করে রাতভর কাঁদল, আর কেন পুকুরের জল একদম চুপচাপ হয়ে গেল — যেন কিছু অপেক্ষা করছে, যেটা এখনো কারও চোখে ধরা দেয়নি, কিন্তু ধীরে ধীরে গিলে খেতে আসছে সমগ্র গ্রামটাকে।

অধ্যায় ৪: কালিকেতের প্রত্যাবর্তন

নীলডিহি গ্রামের মাঝখানে এক শিবমন্দির, যা আজ বহু বছর ধরে প্রায় পরিত্যক্ত। কেউ আর সেখানে পুজো দিতে যায় না, কারণ শোনা যায়, শত বছর আগে সেই মন্দির চত্বরেই প্রথমবার দেখা গিয়েছিল এক অন্ধকার ছায়া — অশুভের দূত কালিকেত। এখন, এক শতাব্দী পরে, মন্দিরের পেছনের ঝোপঝাড়ে হঠাৎ আগুনের মতন আলো দেখা যায়। গ্রামের কয়েকজন বলাবলি করে, “শোনেনি? গতরাতে কালীপুকুরের জল নাকি নিজে থেকেই গড়িয়ে ওঠে… যেন কারো নিঃশ্বাস নিচ্ছিল।” গবাদি পশুদের আচরণ পাল্টে যায় — গরু হঠাৎই বেঁচে ওঠে, কুকুর রাতভর কাঁদে, আর দক্ষিণ হাওয়ার রুক্ষতায় শুকিয়ে যায় ধানের কানাগুলো। পুরোহিত ধৃতিমান পন্ডিত, যিনি বহুদিন শাস্ত্রচর্চা করে সময় কাটান, একদিন কপালে ঘাম মুছতে মুছতে বলেন, “শত বছরের সময় পূর্ণ হল… কালিকেত ফিরছে।”

গ্রামের প্রবীণরা এখন আর হেসে উড়িয়ে দেয় না। তাদের মনে পড়ে, শত বছর আগে সেই আগুনের রাতে গ্রামের একাংশ পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল। মানুষের বিশ্বাস, কালিকেত অশুভ শক্তির প্রতীক — ধোঁয়ার আড়ালে জন্ম নেয়, মানুষের ভয় থেকে শক্তি পায়, আর ফিরে আসে প্রতিটি শতাব্দীতে সেই শঙ্খচিহ্নধারিণী কন্যার জন্মের পরে। শঙ্খবালার চোখে যে শঙ্খের ঘূর্ণি, তা যেন কালিকেতকেই আহ্বান করে। অনেকেই মুখে না বললেও মনে মনে ধরে নেয় — “এবারও ওই মেয়েটির কারণেই সর্বনাশ হবে।” কেউ কেউ বাড়ির দরজায় নেমপাতার মালা ঝুলিয়ে রাখে, কেউ দরজায় শঙ্খ আঁকে, আবার কেউ গিয়ে ধৃতিমান পন্ডিতের কাছে রাত্রিকালীন যজ্ঞের বন্দোবস্ত করতে বলে।

অন্যদিকে, শঙ্খবালার ভিতরে অস্থিরতা বাড়ছে। রাতে সে হঠাৎ ঘুম থেকে চমকে উঠে বসে, দেখে তার চারপাশে ঘরের বাতাস স্থির হয়ে আছে — যেন সময় থেমে গেছে। খোলা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে দেখে, পশ্চিমের দিকের আকাশ লালচে হয়ে আছে, যদিও তখন রাত গভীর। সে জেনে যায় — যা আসছে, তা শুধু ভয় নয়, বরং পরীক্ষা, এবং এই পরীক্ষায় সে একা। পরদিন সকালে নদীপাড়ে বসে সে বলে, “কালিকেত ফিরে এসেছে।” পাশে থাকা ঋদ্ধি চমকে জিজ্ঞাসা করে, “কে?” শঙ্খবালা বলে — “সে ছায়া, যেটা আমি স্বপ্নে দেখি। আগুনের গন্ধ আসে তার কাছাকাছি গেলে, আর শব্দ হয় না কোনো… কেবল নিঃশ্বাস পড়ে ভারি বাতাসে।”

এমন সময় গ্রামে ফিরে আসে রুদ্রনাথ চৌধুরী, শহর থেকে পড়াশোনা শেষ করে ফিরে আসা জমিদার বংশের উত্তরাধিকারী। সে গ্রামের অলৌকিক কাহিনিগুলিকে একসময় নিছক কুসংস্কার ভাবলেও এবার নিজেই দেখতে পায় — গ্রামের ধারে ছোট গাছগুলোর পাতা শুকিয়ে পড়ছে, শিশুরা ভয় পেয়ে রাতে কান্না করছে, আর সবচাইতে অদ্ভুত — নদীর জল এখন আর নিজের স্বরে বয়ে যাচ্ছে না, যেন চুপ করে আছে। রুদ্রনাথ শঙ্খবালার চোখের দিকে তাকিয়ে বলে — “আমি জানি, তুমি আলাদা। তুমি ভয় না, বরং যা আসছে, তা ঠেকানোর জন্য জন্মেছ।” শঙ্খবালা তখন তাকিয়ে বলে — “সবাই বলে আমি আনছি সর্বনাশ। কিন্তু আমি তো নিজেই জানি না, আমি কী করতে পারি।” রুদ্রনাথ মৃদু হেসে বলে — “তুমি কেবল যা দেখছ, সেটাই তোমার শক্তি নয়। তুমি যা বোঝো, সেটাই তোমার অস্ত্র হবে।”

 

অধ্যায়ের শেষে, এক রাত। শিবমন্দিরের চূড়ায় হঠাৎ দেখা যায় এক ছায়া — সুস্পষ্ট নয়, কিন্তু বিশাল ও স্থির। বাতাস থেমে যায়। চারপাশে কোনো শব্দ নেই। কেবল পেছনের নদী থেকে ওঠে এক চাপা, গম্ভীর শব্দ — যেন জল নিজে কাঁপছে ভয়ের তীব্রতায়। এবং সেই রাতে, গ্রামের মাঝখানের একটি বটগাছ নিজে থেকেই উপড়ে পড়ে — অথচ বাতাস ছিল না একটুও। পরদিন সকালের আলোয় কেউ কেউ দেখে, বটগাছের গুঁড়ির গায়ে দাগ কাটা — যেন কেউ আঁচড় কেটেছে ভিতর থেকে বেরিয়ে আসার সময়। শঙ্খবালা জানে — এখন আর সময় নেই। কালিকেত ফিরেছে। এবার তাকে লড়তে হবে, নিজের অস্তিত্ব প্রমাণের জন্য — শুধু গ্রামের নয়, নিজের জন্যও।

অধ্যায় ৫: রক্ষাকর্ত্রীর ইশারা

কালিকেতের আগমনের পর নীলডিহির আকাশে যেন স্থায়ী হয়ে গিয়েছে এক বিষণ্ণ ছায়া। সূর্যের আলো ফুটলেও গ্রামের উপর নেমে থাকে অদৃশ্য ধোঁয়ার পরত। বাচ্চারা ঘুমের মধ্যে চিৎকার করে ওঠে, পশুপাখিরা এলোমেলো দৌড়ায়, আর নদীর জল স্পষ্টভাবে দুধে কালির ছায়া ধরে ফেলেছে। এমন অবস্থায় শঙ্খবালার অবস্থাও বদলাতে শুরু করে। তার শরীরে অদ্ভুত কম্পন হয়, হাতে জল ছুঁলেই তা শীতল হয়ে ওঠে, এবং তার আশেপাশের বাতাসে দেখা যায় সূক্ষ্ম ঢেউ, যাকে চোখে দেখা যায় না ঠিক, কিন্তু অনুভব করা যায়। এই পরিবর্তনের মুহূর্তে রুদ্রনাথ তার পাশে এসে দাঁড়ায় — একমাত্র মানুষ, যে তাকে বিশ্বাস করে নির্জলা ভাবে। রুদ্রনাথ বলে, “তোমার মধ্যে এমন কিছু আছে যা বাকি সবাই ভয় পায়, আর আমি তাকেই শ্রদ্ধা করি।” এই কথাগুলো শঙ্খবালাকে নাড়িয়ে দেয়। প্রথমবার, সে নিজেকে শুধু অপয়া নয়, সম্ভাব্য রক্ষাকারিণী হিসেবে ভাবতে শেখে।

ঋদ্ধি, তার একমাত্র সাথী, লক্ষ্য করে শঙ্খবালার চোখে বদল এসেছে। আগের ভয়মিশ্রিত নীরবতা নেই, বরং চোখে এখন এক রকমের দৃঢ়তা। এক রাতে, যখন তারা নদীপাড়ে বসে থাকে, শঙ্খবালা বলে, “ঋদ্ধি, আমি অনুভব করি—জল আমাকে ডাকে, বাতাস আমায় কথা শোনায়। আমার মনে হয়, আমার ভেতরে কিছু জেগে উঠছে।” ঋদ্ধি বলে, “আমি তোকে প্রথমদিন থেকেই আলাদা ভেবেছি। এখন তুই যা করবি, তা গ্রাম নয়, ইতিহাস বদলাবে।” কিন্তু এমন সময়ে চারদিকে আবার একটা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে — গ্রামের মাঝপথে রাতের বেলা নিজে থেকে জ্বলে ওঠে একটি পুরনো পানের দোকান। আগুন দেখে মানুষ দৌড়ে আসে, কিন্তু আগুনের ধারে যেতে কেউ সাহস পায় না — কারণ সেই আগুনের চারপাশে ছিল এক অদৃশ্য বলয়, যেটা স্পর্শ করলেই মানুষ পিছিয়ে আসছিল, যেন অসহনীয় গরম নয়, বরং এক ধরণের অলৌকিক ভয় ছড়িয়ে দিচ্ছিল।

পরদিন সকালে, ধৃতিমান পন্ডিত পাণ্ডুলিপি খুলে বসে, মুখে বিড়বিড় করে বলে — “এই আগুন সাধারণ নয়… আগুন ফিরেছে মানেই কালিকেত তৈরি। কিন্তু কোথায় আমাদের প্রতিরক্ষা? কোথায় সেই নারী শক্তি?” তখন রুদ্রনাথ পন্ডিতের সামনে গিয়ে প্রথমবার জোরে বলে, “আপনি নিজেই শাস্ত্রে লিখেছেন, প্রতিটি ধ্বংসের আগে আসে রক্ষাকারিণী। আপনি যদি সত্যিই বিশ্বাস করেন শঙ্খচিহ্ন অপয়া, তাহলে সেই একই চিহ্ন দিয়েই তো আসবে মুক্তি।” ধৃতিমান প্রথমে নীরব থাকে, তারপর তার চোখের কোণে ঝলকে ওঠে বিস্ময়ের ছায়া। সেদিন বিকেলে, গ্রামপ্রধানদের ডাকা এক সভায় প্রথমবার রুদ্রনাথ ও ঋদ্ধি প্রকাশ্যে ঘোষণা করে — “শঙ্খবালাকে আর অপয়া ভাবা চলবে না। ওই মেয়েটিই আমাদের রক্ষা করবে। কালিকেতের মুখোমুখি দাঁড়াতে পারবে কেবল ও-ই।”

সন্ধ্যার মুখে, শঙ্খবালা একা নদীর পাড়ে বসে। তার সামনে জলে প্রতিফলিত হয় না তার মুখ, বরং ভেসে ওঠে এক নারীমূর্তি — চোখে শঙ্খ, কপালে অগ্নিকণা। হঠাৎ তার কানে ভেসে আসে এক কণ্ঠ — “তুই আমার রক্ত, তুই আমার শক্তি। ভয় নয়, আগুনকে ভালোবাস। আগুন তো destruction নয়, আগুন তো সৃষ্টির পূর্বশর্ত।” শঙ্খবালা দাঁড়িয়ে পড়ে, তার চারপাশে বাতাস ঘুরতে থাকে, গাছের ডালে ঝরঝর শব্দ, জলে হালকা ঘূর্ণি। সে বুঝতে পারে — এটা স্বপ্ন নয়, এ তার উত্তরাধিকার। সেই মুহূর্তে তার দেহ যেন হালকা হয়ে ওঠে, হৃদয়ের গভীর থেকে বেরিয়ে আসে এক ধ্বনি — “ওঁ শঙ্খিনী নমঃ।” জলের বুকে আলো জ্বলে ওঠে। আর সেই রাতেই, পাহাড়ের গুহায় বসে থাকা অরিন্দম চোখ মেলে বলেন, “এবার সে প্রস্তুত… এবার সময় এসেছে তাকে শেখানোর, কীভাবে রক্ষা করতে হয় — ভয় নয়, আত্মশক্তি দিয়ে।”

 

সেই দিন থেকেই, শঙ্খবালার চরিত্র বদলে যায়। সে আর নীরব নয়। গায়ের লোকজন আর তাকে এড়িয়ে চলে না — বরং দূর থেকে দেখে, ভয় আর কৌতূহলের মিশেলে। গ্রামের কিছু সাহসী নারী তার দিকে এগিয়ে এসে বলে — “তুই যা দেখিস, সেটা আমাদের শেখা দরকার।” শঙ্খবালা একবার চোখ বন্ধ করে জিজ্ঞেস করে — “তোমরা বিশ্বাস করো?” তারা বলে, “তোর চোখে যেটা আছে, সেটা অপয়া নয়। সেটা আলো… আমরা আজ পর্যন্ত অন্ধ ছিলাম।” তখন শঙ্খবালা প্রথমবার হাঁসলো — এক নির্ভীক হাসি। কারণ তার ভেতরের ভয় সেদিন ভেঙে গিয়েছিল। এবার সে জানত — কালিকেত যতই অন্ধকার হোক, তাকে থামানো সম্ভব। কারণ রক্ষা শুধু অস্ত্রে নয়, হৃদয়ে বিশ্বাস জাগাতেও হয়।

অধ্যায় ৬: গুহার অন্তরালে শিক্ষা

নীলডিহি থেকে দূরের পাহাড়ি ঝোপের গায়ে একটি গোপন গুহা। বহু বছর ধরে সেখানে একা ধ্যান করছেন অরিন্দম—এক সময়ের যোগী, এখন এক জ্ঞাতপ্রবণ নির্জন পুরুষ, যিনি লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে সময়ের গতিপথ বুঝে চলেন। তার চারপাশে ছড়ানো আছে ধূলিমাখা তালপাতার পুঁথি, কাঠের পেটিকায় বন্দি পাথরচূর্ণ, শুকনো বেলপাতা, আর মাঝখানে একটি ধবধবে সাদা শঙ্খ, যা কারও না ছোঁয়ালেও মাঝে মাঝে আপনাআপনি কম্পন করে। সেদিন রাতে, গুহার দরজায় এসে দাঁড়ায় শঙ্খবালা — একা, নির্ভীক। গুহার অন্ধকারে চোখ অভ্যস্ত হয়ে গেলে সে দেখে অরিন্দম স্থির বসে রয়েছেন, চোখ বন্ধ, কিন্তু যেন সব জেনে গেছেন আগে থেকেই। তিনি কেবল বলেন, “তুই এসেছিস, সময় হয়েছে।”

শঙ্খবালা বিস্মিত হয়—“আপনি কে? আমাকে কীভাবে চেনেন?”
অরিন্দম শান্ত গলায় বলেন—“আমি সেই পাহারাদার, যে শত বছর ধরে অপেক্ষা করে তোর জন্য। তুই ‘শঙ্খবালা’, কেবল একটি নাম নয় — এটি এক উত্তরাধিকার, যা বহন করে আদি শক্তির অস্তিত্ব। তোর পূর্বসূরী ছিলেন দেবী মৈত্রেয়ী, যাঁর রক্তের ধারা বয়ে আজ তুই এসেছিস।”
শঙ্খবালা স্তব্ধ। তার সমস্ত পরিচয় ভেঙে যাচ্ছে। সে ভাবে, “আমি কি তবে কেবল অপয়া নই? আমি কি একজন ধারক?”
অরিন্দম বললেন, “শক্তির ধারক হওয়া যেমন আশীর্বাদ, তেমনি তা পরীক্ষা। কালিকেতকে মোকাবিলা করতে গেলে ভয় নয়, চাই শুদ্ধতা, ধৈর্য, আর জাগ্রত মন। এখন তোর ভিতরের দীপ্তি জাগাতে হবে।”

সেই রাতেই শুরু হয় তার প্রস্তুতি। গুহার ভিতরে মাটির ওপর বসে, অন্ধকারকে সঙ্গী করে, শঙ্খবালা শিখতে থাকে নীরব ধ্যান। তাকে শেখানো হয় — কিভাবে প্রকৃতির সাড়া শোনা যায়, কিভাবে বাতাসের স্পন্দন পড়ে বোঝা যায় বিপদের আগমন, কিভাবে নিজের হৃদয়ের ভাষা বিশ্বাস করা যায়। অরিন্দম তার কপালে ছুঁয়ে বলে — “তুই যে জলে চোখ রাখিস, সে জল তোর সঙ্গে কথা বলে। তুই যে বাতাসে হাঁপাসিস, সে বাতাস তোর মনের খোলা পাতার মত। তুই সেগুলো বুঝতে শিখ, শক্তি তোকে আপনাআপনি ডাকবে।” শঙ্খবালা অবাক হয়ে দেখে, প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙার পর তার আশপাশে পড়ে থাকে বালুকণায় আঁকা চিহ্ন — যেন রাতের অন্ধকারে কোনো অদৃশ্য শক্তি তাকে মন্ত্র লিখে দিয়ে যাচ্ছে।

একদিন রাতে, যখন সে গুহার সামনের জলের পাত্রে বসে ধ্যান করছিল, তখন হঠাৎ জলের বুকে দেখা যায় সেই নারীমূর্তি—দেবী মৈত্রেয়ী। আগুনের আলোয় চোখদুটো দীপ্ত, কণ্ঠে বলে ওঠেন, “তোর ভয় তুই নিজেই—যদি তাকে চেনিস, তবে সে আর ভয় নয়। তুই শুধু শিখে যা, কবে কীভাবে ব্যবহার করতে হয়।” সেই মুহূর্তে শঙ্খবালা বুঝতে পারে—তার ভেতরে যে আলো, সেটাই কালিকেতের অন্ধকারের প্রতিরোধ। সে এখন আর শুধু ভবিষ্যদ্বাণীর বস্তু নয়, সে নিজেই ভবিষ্যৎ বদলের সম্ভাবনা।

গুহায় কেটেছে সাতদিন। অরিন্দম তাকে বিদায় জানান এই বলে—“এবার তুই ফির, কারণ তোর জায়গা গুহায় নয়, লোকের মধ্যে। ভয় যেখানেই বাস করে, তোকেও থাকতে হবে সেখানে। এ গুহা তোকে প্রস্তুত করল, কিন্তু তোর যুদ্ধ শুরু হবে মাঠে।”
ফিরে আসার পথে, পাহাড় থেকে নেমে আসা কুয়াশার মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে শঙ্খবালা মনে মনে অনুভব করে—এখন তার চোখে ভয়ের ছায়া নেই, আছে দৃঢ়তা। এক পা এক পা করে সে নামে গ্রামে, আর তার সঙ্গে সঙ্গে বাতাসের শব্দ বদলায়, যেন প্রকৃতি জানিয়ে দেয়—”সে প্রস্তুত।”

 

ঠিক সেই সময়, নীলডিহির দক্ষিণ প্রান্তে, শ্মশানের ধার দিয়ে উঠে আসে ঘন কালো ধোঁয়া। একজন বুড়ো কাঠুরে দেখেন, ছায়ার ভেতর দাঁড়িয়ে আছে এক বিকৃত মূর্তি — চোখ নেই, কিন্তু তাকিয়ে আছে গভীরভাবে। তার পাশে পড়ে থাকে শুকনো ছাগলের হাড়, আর বাতাসে বাজে চাপা হুঁশিয়ারি — “আলো ফিরেছে… তবে অন্ধকার এখনো শেষ হয়নি…” কালিকেত তার প্রথম রূপে প্রবেশ করেছে গ্রামে। আর গ্রামের বুকেই দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে শঙ্খবালা — যে এবার জানে, কীভাবে আলো জ্বালাতে হয়, অন্ধকারের মাঝখানে দাঁড়িয়ে।

অধ্যায় ৭: আলোর পরীক্ষাক্ষণ

নীলডিহি যেন নিঃশ্বাস ধরে আছে। সকাল হতেই চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে অদ্ভুত ঠান্ডা, যেন হাড়ের মধ্যে কাঁপুনি নামে। গ্রামের মানুষদের মনে এক অদৃশ্য চাপ — কেউ খেতে পারে না, কেউ স্বাভাবিক কথা বলতেও ভুলে যায়। পুকুরের জল কুয়াশায় মোড়া, আর বাতাস ভারী। সেদিন সকালে, দক্ষিণ দিকের মাঠে একটি দৃশ্য দেখা যায়, যা কেউ কল্পনাও করতে পারেনি — ভেঙে পড়েছে গ্রামের প্রাচীন অশ্বত্থগাছ। এক মুহূর্তে যেন গোটা গ্রাম বোঝে, কালিকেত এখন আর দূরের গল্প নয়, সে এসে গেছে। সেই গাছ ছিল প্রতীকের মতো — গ্রামের অভিভাবক, যার ছায়া পড়ত প্রতিটি ঘরে। এখন সেই ছায়া নেই, এখন কেবল শীতলতা আর ভয়।

এমন অবস্থায় গ্রামের মন্দির চত্বরে একত্র হন প্রধানরা। ধৃতিমান পণ্ডিত মুখ থুবড়ে পড়ে বলেন, “আমাদের হাতে আর কিছু নেই… কেবলমাত্র একটি আশ্রয়—সে হল শঙ্খচিহ্নধারিণী।” রুদ্রনাথ ও ঋদ্ধি এই প্রথম শঙ্খবালার পাশে দাঁড়িয়ে তাকে আহ্বান করে—“তুমি আজ কেবল আমাদের আশা নয়, তুমি আমাদের অস্ত্র।” শঙ্খবালা, যার চোখে এখন জেগে উঠেছে শঙ্খের আলো, সামনে এসে দাঁড়ায় — প্রথমবার, সকলের সামনে। তার পরনে সাদা ধুতি, মাথায় পিঠ ছাড়ানো চুল, আর চোখে সেই ঘূর্ণি যা জল আর বাতাস দুইকেই কাঁপাতে পারে। সে বলে—“আমি তোমাদের মধ্যে জন্মেছি, কিন্তু তোমাদের বাইরেরও। আমি আলো আনি, তবে সে আলো তোমাদের ভিতর থেকেই জাগাতে হবে।”

তার কথার মধ্যে ছিল মন্ত্রের মতো কিছু। লোকজন নীরবভাবে শোনে। এমন সময়ে পশ্চিমের দিক থেকে উঠে আসে এক কুয়াশার ঢেউ — কেউ চিৎকার করে বলে, “ওই যে! ওইখানে ছায়া নড়ছে!” গ্রামের ধারে ধূসর কুয়াশার মধ্যে ভেসে ওঠে কালিকেতের প্রথম রূপ—ধোঁয়ার মধ্যে গড়া একটি বিকৃত অবয়ব, যার শরীর নেই, কেবল অন্ধকারের ছায়া, যেটা ছোঁয়া যায় না, ধরা যায় না, কিন্তু অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়। তার উপস্থিতিতে গাছের ডাল মরে যায়, ঘাস শুকিয়ে যায়, আর বাতাসের শব্দ বন্ধ হয়ে যায়। গ্রামে মৃত্যুর গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। সেই সময় শঙ্খবালা এগিয়ে আসে, দুই চোখে শঙ্খের ছায়া ঘূর্ণায়মান। সে দুই হাত আকাশের দিকে তুলে দাঁড়ায়, বাতাস তার চারপাশে পাক খেতে শুরু করে।

তার কণ্ঠে উচ্চারিত হয়—
“ওঁ নাদবিন্দু পরব্রহ্ম, শঙ্খিনী শক্তি প্রকাশ!”
এই মন্ত্রে শোনা যায় শঙ্খের ধ্বনি — যে ধ্বনি মানুষের কানে নয়, হৃদয়ে প্রবেশ করে। আর ঠিক সেই মুহূর্তে কুয়াশার ভিতর ছায়া থমকে দাঁড়ায় — কালিকেত যেন প্রথমবার উপলব্ধি করে, তার বিরুদ্ধে এবার কেবল এক অপয়া কন্যা নয়, এক প্রত্যাগত শক্তির উত্তরাধিকার দাঁড়িয়ে গেছে। শঙ্খবালার কপাল থেকে উঠে আসে সাদা জ্যোতি, যা সোজা আঘাত করে ছায়ার কেন্দ্রে। কালিকেত আর্তনাদ করে, কিন্তু মিলিয়ে যায় না — সে জানে, এক লড়াই শুরু হল।

এই প্রথম মুখোমুখি হয় আলো আর অন্ধকার।
কালিকেত কেবল ভয় নয়, সে মানুষকে মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন করে, বিশ্বাস ভাঙে, আতঙ্কে আবদ্ধ রাখে।
আর শঙ্খবালা, সে আনে মিলন, অভ্যন্তরীণ জাগরণ, শক্তির দিশা।
যুদ্ধের শুরুটা হলো আভাসে — কুয়াশা সরল না, ছায়া মিলল না, কিন্তু গ্রামবাসীরা প্রথমবার বুঝল — ভয় এখন আর একতরফা নয়।

অধ্যায়ের শেষে, সেই রাতে শঙ্খবালা একা বসে থাকে নদীর পাশে। জলে পড়ে আছে শঙ্খের প্রতিবিম্ব। হঠাৎ জলের মাঝে ভেসে ওঠে আবার সেই নারীমূর্তি — দেবী মৈত্রেয়ী। তিনি বলেন,
“তুই আজ যাত্রা শুরু করলি। যুদ্ধের জয় কেবল শক্তিতে হয় না, বিশ্বাসেও হয়। তোর শক্তি জেগেছে, কিন্তু তোকে আরও শিখতে হবে… কারণ কালিকেত এবার সহজে যাবে না।”
শঙ্খবালা চোখ বন্ধ করে শোনে।
তার সামনে যে অন্ধকার আসছে, তা ভয়ানক।
কিন্তু এবার সে ভয় পায় না।
সে তৈরি।
আর নদী, বাতাস, গাছেরা — সবাই তার সঙ্গে প্রস্তুত।

অধ্যায় ৮: অগ্নিদিকের ছায়া

কালিকেত আর ছায়া নয়, সে এবার আলোকে স্পর্শ করতে চায় — তাকে দমন করতে নয়, গ্রাস করতে। সেই রাতে, যখন চাঁদের আলো পড়ে ছিল ধানক্ষেতে, তখনই গ্রামের দক্ষিণ কোণ থেকে শুরু হয় এক অনাহুত আগুন। খড়ের ঘরগুলো হঠাৎ জ্বলে উঠতে শুরু করে, বাতাসে উঠে আসে শুকনো ধোঁয়া। আগুনে পুড়তে থাকে মাটি, কিন্তু আশ্চর্যভাবে — আগুন ছড়ায় না বাইরে, সে যেন ঘূর্ণি হয়ে নাচে জায়গায় জায়গায়। রুদ্রনাথ, ঋদ্ধি ও গ্রামের মানুষ আগুন নেভাতে ছুটে আসে, কিন্তু কেউ আগুনের ধারে যেতে পারে না — আগুন কারও গায়ে লাগে না, কিন্তু সবাই ভিতর থেকে দমবন্ধ অনুভব করে।

শঙ্খবালা দূর থেকে আগুনের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার চোখে পড়ে, আগুনের মাঝে ভেসে ওঠে এক মুখ — কালো, বিকৃত, কিন্তু চোখদুটি লালচে আভায় দ্যুতি ছড়ায়। সেটি সরাসরি শঙ্খবালার দিকে তাকায় এবং বলে,
“তুই আলোর সন্তান হবি না। তুই হবি রূপান্তরের অস্ত্র। মানুষ তোকে দেবী বানাতে চায়, কিন্তু আমি তোকে মানুষ রাখতে চাই। আসল প্রশ্ন—তুই কী হতে চাস?”

এই প্রশ্নে শঙ্খবালার ভিতরে শুরু হয় দ্বন্দ্ব। সে ভাবে—সে কি জন্মেছে কেবল যুদ্ধের জন্য? কেবল দেবীর প্রতীক হয়ে বাঁচার জন্য? তার কি নিজস্ব কোনো জীবন নেই? সেই রাতে, গুহার সামনে গিয়ে বসে, সে এই প্রশ্ন ফেলে দেয় বাতাসে। তখন তার সামনে এসে দাঁড়ান অরিন্দম। তিনি বলেন,
“তুই দেবী হতে জন্মাসনি। তুই মানুষ, যে ভিতর থেকে আলো খুঁজে পেয়েছে। আলোর বাহক হতে গেলে দেবত্ব নয়, মনুষ্যত্ব লাগে বেশি। দেবী হবি কি না, সেটা তোর সিদ্ধান্ত নয়। কিন্তু মানুষ হিসাবে দাঁড়ানোর সাহস যদি থাকে, তবে তুই কালিকেতকে প্রতিহত করতে পারবি।”

পরদিন সকালে, আগুন নিভে গেলেও মাঠের মাটি হয়ে থাকে কালো, দগ্ধ। ধান গাছগুলি পুড়ে যায় না, কিন্তু সেগুলো শুকিয়ে ওঠে—ভেতর থেকে। শঙ্খবালা স্পর্শ করে দেখে, এই আগুন বাহ্যিক নয়, এটি মানসিক ভয়কে রূপ দেয়। তার মানে, কালিকেত এখন ভয়ের ছায়া থেকে বেরিয়ে বাস্তব দুঃস্বপ্নে রূপ নিচ্ছে। এখন আর শুধু আত্মবিশ্বাস নয়, চাই প্রতিরক্ষা। তখনই সে অরিন্দমের কাছ থেকে নেয় সেই শঙ্খ, যেটি বহু বছর ধ্যানের মধ্য দিয়ে রক্ষা করা হয়েছিল।

এই শঙ্খ কোনও অস্ত্র নয় — এটি একটি স্মারক, এক আদি ধ্বনি, যা জাগাতে পারে হারিয়ে যাওয়া আত্মবিশ্বাস, স্মৃতি, বিশ্বাস। শঙ্খবালা জেনে যায়, এই শঙ্খ দিয়ে কেবল যুদ্ধ করা নয়, বোঝানো যায় আলো আসতে চায় — যদি মানুষ গ্রহণ করতে জানে। সেই রাতে, গ্রামবাসীদের সামনে এসে দাঁড়িয়ে সে বলে—
“তোমরা যদি সত্যিই মুক্তি চাও, তবে ভয়কে ভয় পাবে না। আমি একা লড়ব না — আমার পাশে যদি না থাকো, তবে আমি দেবী হয়ে জিতলেও কিছু থাকবে না। আলো একা হাঁটতে পারে না — তাকে বহন করতে হয় সবার মনের ভিতর দিয়ে।”

সেই বক্তৃতার শেষে, রুদ্রনাথ প্রথমে এগিয়ে আসে। তারপর ঋদ্ধি, তারপর এক এক করে গ্রামের প্রাচীন নারীরা, আর শেষে কিশোরেরা—সবাই এসে দাঁড়ায় তার চারপাশে। শঙ্খবালা জানে, এটাই তার জাগরণ। সে আর কেউ নয় — সে সেই আলো, যা ভয় পায় না, কিন্তু ভয়কে বোঝে।

অধ্যায়ের শেষ দৃশ্যে, নদীর ওপার থেকে ভেসে আসে কালিকেতের কণ্ঠস্বর—
“তুই তো তৈরি হস, কিন্তু আমি এবার আসব অন্যরূপে… সেই রূপে, যা তোকে সবচেয়ে বেশি কাঁপাবে — ভালোবাসা। তুই কি জানিস, তোর ভিতরের মানুষটাকে হারালে আলো আর আলাদা কিছু থাকে না?”

শঙ্খবালা চুপ করে থাকে।
কারণ সে জানে, পরবর্তী যুদ্ধ বাহ্যিক নয়—এটা হৃদয়ের ভিতরে।
আর সেই যুদ্ধেই ঠিক হবে, সে শঙ্খবালা থাকবে… নাকি হয়ে উঠবে শঙ্খিনী, সময়ের আলো ও ছায়ার মাঝে জন্ম নেওয়া এক চূড়ান্ত রূপ।

অধ্যায় ৯: হৃদয়ের শত্রু

নীলডিহির আকাশ যেন চাপা দুঃস্বপ্নে ঢেকে গেছে। আগুন নিভেছে, মাঠে শান্তি ফিরেছে, তবু বাতাসের মধ্যে এক অদৃশ্য অনুরণন — যেন কারো গলা, খুব চেনা, খুব নরম, কিন্তু ভিতরে বিষ। ঠিক এমন এক সকালে শঙ্খবালা উঠে দেখে, তার ঘরের মধ্যে বসে আছে ঋদ্ধি। সে বিস্ময়ে বলে, “তুই এখানে?” ঋদ্ধি বলে, “ঘুম ভাঙার পর থেকেই তোকে দেখতে চাইছিলাম। তুই কেমন আছিস?” কিন্তু কণ্ঠে কিছু যেন অচেনা। চোখে সেই পুরনো উষ্ণতা নেই। প্রথম কয়েক মুহূর্তে বুঝতে না পারলেও, শঙ্খবালা অনুভব করে — এই ঋদ্ধি সেই ঋদ্ধি নয়

সে সামনে এগিয়ে গিয়ে বলে, “তুই কে?”
ছায়া-ঋদ্ধি ঠোঁটে এক হালকা হাসি টেনে বলে,
“আমি সেই, যাকে তুই হারাতে ভয় পাইস। আমি তোর দুর্বলতা। তুই দেবী হতে চাইস, কিন্তু তোর ভিতরে যে ভালোবাসা, যে আবেগ, সেইটাই তোকে ভেঙে দেবে। আমি তোর ‘ঋদ্ধি’, কিন্তু আমি কালিকেত।”

এই মুহূর্তে শঙ্খবালার সমস্ত ভিতরটা হিম হয়ে যায়। যে ছেলেটা শৈশব থেকে তাকে বোঝে, তার পাশে ছিল, যার পাশে সে নীরবতাকে ভাষা বানিয়েছিল — সেই ঋদ্ধির চেহারায় এখন দাঁড়িয়ে আছে কালিকেত! শঙ্খবালা চিৎকার করে ওঠে না। সে স্থির থাকে। সে ভাবে, এই তো সে পরীক্ষার মুখ — যেখানে ভয় বাহ্যিক নয়, আসে হৃদয়ের গভীর থেকে।

ছায়া-ঋদ্ধি বলে,
“তুই যদি আমার চোখে তাকাস, তুই নিজের সমস্ত অনুভব হারাবি। তুই দেবী হয়ে দাঁড়াবি, কিন্তু তুই মানুষ থাকবি না। কি চাস তুই — শক্তি? না সম্পর্ক?”
শঙ্খবালা কাঁপে না। তার চোখে জল আসে, কিন্তু কণ্ঠে স্পষ্ট উচ্চারণ—
“আমি কিছু হারাব বলে থামব না। যদি আমার ভেতরের মানুষটাকেই হারাতে হয়, তবে ওই দেবত্ব চাই না। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি — আমি দেবী নই, মানুষ হয়েও যুদ্ধ করতে পারি। তুই ঋদ্ধি নোস। তুই শুধু আমার স্মৃতিকে ছুরি বানিয়ে এসেছিস। কিন্তু স্মৃতির ছুরি কখনও আত্মাকে কেটে ফেলতে পারে না।”

এই কথা শুনে কালিকেত প্রথমবার প্রতিবাদ না করে চুপ করে যায়। সেই ছায়া-ঋদ্ধি ধীরে ধীরে হেসে বলে —
“তুই ঠিক বলেছিস, শঙ্খবালা। আমি ভয়, কিন্তু তুই ভয় চেনিস। এবার আমি তোর সামনে অন্য রূপে আসব — এমন এক রূপ, যেখানে তোর সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হবে।”

তারপরই সে মিলিয়ে যায় বাতাসে।
সেই মুহূর্তে ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ায় সত্যিকারের ঋদ্ধি — ঘেমে, দমবন্ধ হয়ে।
সে বলে, “শঙ্খ… আমি জানি না কেন, কিন্তু আমি ভীষণ ভয় পাচ্ছি। যেন কেউ আমার নামে তোর কাছে এসে গেছে…”
শঙ্খবালা ধীরে ধীরে উঠে আসে, তাকে জড়িয়ে ধরে।
সে বলে, “তুই এসেছিস, সেটাই যথেষ্ট।”

এই অধ্যায় শঙ্খবালার একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষার স্তর।
কালিকেত এবার কেবল শারীরিক আগুন বা ছায়া নয় — সে রূপ নিয়েছে ভালোবাসার, শোকের, স্মৃতির।
তাকে জিততে হলে কেবল মন্ত্র নয়, চাই মানবিক আত্মবিশ্বাস।

শেষ দৃশ্যে, শঙ্খবালা নদীপাড়ে বসে শঙ্খ হাতে নিয়ে বলে —
“আমার ভয় আমার ভিতরেই আছে, তাই তাকে দূর নয় — গ্রহণ করতে শিখব। আমি দেবী নই, আমি শঙ্খবালা — যে ভয়কে চোখে দেখে হাঁটে।”

অধ্যায় ১০: শেষ সংযোগ

নীলডিহির আকাশে সূর্য ওঠে না সেদিন। সকাল বেলায়ই চারদিক জুড়ে ঘন কালো মেঘ — যেন রোদ নিজেই গ্রামটিকে ভুলে গেছে। পাখিরা উড়ে যায়, কুকুরেরা আর ডাকেও না। সবকিছু এক ভয়ানক নিস্তব্ধতায় ঢেকে পড়ে। এই নিস্তব্ধতার মধ্যে কেউ কেউ কাঁপতে থাকে, কেউ প্রার্থনা করে, কেউ নিজের পুরনো ভুল মনে করে। শঙ্খবালা উঠে দাঁড়ায়, শাড়ির আঁচলে বাঁধা সেই পুরোনো শঙ্খ হাতে নেয়। সে জানে — আজ রক্ষা নয়, আজ হবে বিচার।

সেই সময় অরণ্যের দিক থেকে উঠে আসে এক ঝড় — ধুলোর, ছিন্ন পাতার, আর অশরীরি গর্জনের। সেই ঝড়ের কেন্দ্র থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসে কালিকেত, এবার আর ছায়া নয়, এবার সে মাটির রূপে — এক বিশাল কালো মানবাকৃতি, যার চোখদুটো লাল অগ্নিতে জ্বলছে, শরীর যেন পুড়ে যাওয়া ছাই দিয়ে গড়া, আর কণ্ঠে সেই পুরনো প্রলয়ের ধ্বনি। সে গর্জন করে, “তুই তৈরি হস, শঙ্খবালা? এবার আমি তোর চোখে তাকিয়ে তোর আলো নিভিয়ে দেব!”

গ্রামের মানুষরা ভয়ে দৌড়ে পালায়, শুধু রুদ্রনাথ, ঋদ্ধি ও কিছু সাহসী নারী দাঁড়িয়ে থাকে শঙ্খবালার পাশে। শঙ্খবালা একবার চারপাশের দিকে তাকায়।
সে বলে—
“তুই বারবার ফিরে এসেছিস। তুই আমার পূর্বসূরীদের ভেঙে দিয়েছিস।
কিন্তু এবার, আমি শুধু আলো হয়ে আসিনি, আমি সেই ভয়ও, যাকে মানুষ গ্রহণ করে।
আমি তোর ছায়া চিনে ফেলেছি, কালিকেত। তুই বাইরে নয়, তুই আমাদের ভিতরে।
তুই সেই ভয়, যাকে অস্বীকার করলে সে বেড়ে ওঠে।
আর আমি সেই আলো, যে ভয়কে গ্রহণ করে তাকে শান্ত করে দেয়।”

এই বাক্যের সঙ্গে সঙ্গে শঙ্খবালা শঙ্খে ফুঁ দেয়।
না, এ শঙ্খে যুদ্ধের আহ্বান নয় — এ শঙ্খে আত্মজাগরণের মন্ত্র।
শঙ্খের ধ্বনি বাতাসে গলে গিয়ে পৌঁছে যায় মানুষের মনের ভিতরে।
তারা থেমে যায়, তারা ঘুরে দাঁড়ায়।
রুদ্রনাথ বলে — “তুই একা না, শঙ্খ। তোর আলো আমরা সবাই বহন করব।”

তখন কালিকেত প্রচণ্ড গর্জনে শঙ্খবালার দিকে ছুটে আসে।
চারদিকে শুরু হয় এক অদৃশ্য লড়াই — বাতাস দাঁড়িয়ে পড়ে, মাটি কেঁপে ওঠে, নদীর জল উথলে ওঠে।
শঙ্খবালা দাঁড়িয়ে থাকে, চোখ বন্ধ করে কেবল মন্ত্র বলে —
“ওঁ শঙ্খবালা নমঃ। ভয় তুই আমার ভিতরেই ছিলি, আজ তোকে আমি আলোর জলে ছুঁইয়ে দিচ্ছি।”

সেই মুহূর্তে কালিকেত থেমে যায়।
সে কাঁপে, তার মুখের ছায়া ভেঙে গিয়ে এক একটি মুখ হয়ে দাঁড়ায় — হারিয়ে যাওয়া মা, উপেক্ষিত কন্যা, নিঃস্ব বৃদ্ধ, নির্যাতিত প্রেমিক।
কালিকেত চিৎকার করে — “আমাকে তুমি মেরে ফেলছ না। তুমি আমাকে… গ্রহণ করছ!”
শঙ্খবালা চোখ খুলে বলে —
“হ্যাঁ। আমি ভয়কে ভয় করি না। আমি তাকে ভালোবাসা দিই। আলো কেবল জেতার অস্ত্র নয়, আলো ক্ষমার শক্তিও।”

এই কথার সঙ্গে সঙ্গে কালিকেত হালকা হতে থাকে — ধীরে ধীরে ভেসে যায় বাতাসে, তার ছায়া গলে গিয়ে মিশে যায় ধুলোর রঙে।
গ্রামে আবার আলো ফোটে। পাখিরা ফিরে আসে। বাতাসে আসে এক শান্তির ঘ্রাণ।

শেষ দৃশ্যে, শঙ্খবালা নদীপাড়ে বসে আছে, পাশে রুদ্রনাথ, ঋদ্ধি, গ্রামের নারীরা। কেউ কিছু বলে না।
শুধু শঙ্খবালা বলে—
“আমার শঙ্খ এখন আর অস্ত্র নয়। এটা আমার হৃদয়।
আর আমি কেবল রক্ষাকর্ত্রী নই — আমি সেই মেয়ে, যাকে এক সময় অপয়া বলা হয়েছিল,
কিন্তু সেই অপয়াই একদিন আলোকে চেনার চোখ দিল সবার।”

1000037626.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *