Bangla - নারীবিষয়ক গল্প

শঙ্খচিল

Spread the love

শিবানী চৌধুরী


এক

মাধবীলতার জীবনের ভোর আর রাতের মধ্যে যেন আর কোনো পার্থক্য নেই। সকালবেলায় জানালার ফাঁক গলে আলো এসে পড়লেও তার চোখে সেই আলো ঢোকে না। দিন শুরু হয় কড়াইতে ছটফট করা তেলের শব্দে, চাল ধোয়ার গন্ধে আর শ্রীময়ীর স্কুলে যাওয়ার তাড়াহুড়োয়। কিন্তু সব কিছুর মধ্যেই থাকে এক গভীর শূন্যতা। স্বামী মারা যাওয়ার পর এই কয়েক বছরে সে শিখে গেছে কীভাবে মানুষ নিঃশব্দে বাঁচতে শেখে, কীভাবে একা থেকে চারপাশের মানুষের সহানুভূতির অভিনয় সহ্য করতে হয়। সবাই মুখে বলে—“কি সুন্দর শক্ত করে বাঁচছো গো, মাধবী”—কিন্তু সেই কথার আড়ালে থাকে এক অদৃশ্য বিদ্রূপ, যেন বিধবার জীবনে হাসি-খুশি মানায় না। ঘর সামলাতে, মেয়েকে মানুষ করতে আর সংসারের দায়িত্ব নিতে নিতে তার বয়সের কাঁটা অনেকটা এগিয়ে গেছে, মুখে ঝরে পড়েছে ক্লান্তির ছাপ, তবে চোখে এখনও রয়ে গেছে এক অদম্য সজীবতা, যা সমাজ খেয়াল করে না কিংবা খেয়াল করতে চায় না।

প্রতিদিন সকালে পাড়ার উঠোনে মাধবীলতা যখন জল ঢালতে বেরোয়, পাশের বাড়ির মহিলারা তাকে কৌতূহলী চোখে দেখে। কারও চোখে মায়া, কারও চোখে অবজ্ঞা। বিধবা হওয়ার পর সমাজ যেন তার চারপাশে এক অদৃশ্য প্রাচীর তৈরি করে দিয়েছে। পাড়ার কোনো উৎসবে তাকে আর ডাকা হয় না, সিঁদুরখেলা তো দূরের কথা, দুর্গাপুজোর অঞ্জলিতেও তাকে দেখতে চায় না অনেকেই। অথচ একই সময়ে তারা আবার তার দরজায় এসে শ্রীময়ীর জন্য জামা-কাপড় কিংবা টিউশনের খবর দেয়, যেন এক অদ্ভুত দ্বন্দ্ব—একদিকে সহানুভূতি, অন্যদিকে কুসংস্কারের শৃঙ্খল। মাধবীলতা কখনো প্রতিবাদ করে না; সে চুপচাপ নিজের মতো করে সংসারের ফাঁকে একটু বই পড়া, জানালার ধারে বসে আকাশ দেখা আর চুপচাপ একা কেঁদে নেওয়ার মধ্য দিয়েই বেঁচে থাকে। তার ভেতরে কোথাও যেন এক অচেনা আকাঙ্ক্ষা ফোঁটা ফোঁটা হয়ে জমে থাকে—যে আকাঙ্ক্ষা আবারও জীবনের ছোঁয়া পেতে চায়, আবারও ভালোবাসায় ভিজতে চায়। কিন্তু সেই ইচ্ছা সমাজকে বলবে কীভাবে? বিধবার মুখে এ কথা বলা মানেই যেন পাপ।

রাতে যখন শ্রীময়ী পড়ার টেবিলে বসে, মাধবীলতা শোবার ঘরে আলো নিভিয়ে জানালার ফাঁক দিয়ে দূরের আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। আকাশ ভরা তারা তার কাছে আর কেবল সৌন্দর্য নয়, বরং এক গভীর নিঃসঙ্গতার প্রতিচ্ছবি। প্রতিটি তারা যেন তাকে মনে করিয়ে দেয়—সে একা। সেই একাকীত্বই তার বুকের ভেতরে কুরে কুরে খায়। মাঝে মাঝে সে ভাবে, যদি এই জীবনটা এভাবেই কেটে যায় তবে কী রইল তার অস্তিত্বের মানে? শ্রীময়ীর জন্য তার বেঁচে থাকা জরুরি, তবু তার নিজের ভেতরের শূন্যতাকে কে ভরাবে? সে জানে, সমাজের চোখে তার ভালোবাসা খোঁজা বেমানান, কিন্তু হৃদয়ের ডাককে কি সত্যিই চেপে রাখা যায়? নিস্তব্ধ রাতগুলোতে যখন হাওয়ার দোলায় জানালার পর্দা দুলে ওঠে, তখন মাধবীলতার মনে হয়—জীবন এখনও তাকে ডাকে, শুধু সাহস করে হাত বাড়াতে হবে। কিন্তু সমাজের চোখরাঙানির ভয়ে সে বারবার পিছিয়ে যায়। এই দ্বন্দ্বই তাকে আরো নিঃসঙ্গ করে তোলে, আর প্রতিটি নিঃশ্বাসে তার অনুভব হয়, সে যেন এক পাখি—শঙ্খচিলের মতো—যার ডানা আছে, আকাশ আছে, কিন্তু উড়তে নেই।

দুই

সেদিন ছিল পাড়ার বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। অন্য সময়ের মতো মাধবীলতা এ ধরনের আড্ডা বা জমায়েতে যেতে চায়নি, কিন্তু শ্রীময়ীর অনুরোধে রাজি হয়। মেয়ে নাচের দলে যোগ দিয়েছে, তাই না গিয়ে উপায় ছিল না। অনুষ্ঠান শুরু হতেই ভিড় জমল মাঠে—মাইক, আলো, হইচই, সব মিলিয়ে এক অন্য পরিবেশ। মাধবীলতা ভিড়ের ভেতর একপাশে চুপচাপ বসে রইল, যেন উপস্থিত থেকেও অনুপস্থিত। ঠিক সেই সময় পাশের চেয়ারটিতে এসে বসল এক মানুষ—অরিন্দম। পরনে সাধারণ পাঞ্জাবি, চোখে চশমা, মুখে শান্ত হাসি। শুরুতে সে খুব সাধারণভাবে বলল, “এত ভিড়, অথচ আপনার মতো নীরব মুখ এখানে মানাচ্ছে না।” কথাটি হঠাৎ শুনে মাধবীলতা একটু অপ্রস্তুত হলেও মৃদু হেসে জবাব দিল, “সবাই যে হইচই পছন্দ করে, তা নয়।” এরপর অরিন্দম আলতো ভঙ্গিতে প্রশ্ন করল, “তাহলে আপনি কী পছন্দ করেন?” এই প্রশ্ন যেন এক অচেনা দরজা খুলে দিল তার সামনে। বহুদিন পরে কেউ তার পছন্দ-অপছন্দ জানতে চাইছে—শুধু বিধবা, মা, বা সংসারের খোলসে আটকে থাকা মানুষ হিসেবে নয়, একজন নারী হিসেবে।

সাধারণ কথোপকথন ধীরে ধীরে গাঢ় হতে লাগল। মাধবীলতা জানাল বই পড়ার প্রতি তার ভালোবাসার কথা, বলল কীভাবে একসময় রবীন্দ্রনাথের কবিতায় ডুবে যেত সে। অরিন্দম হাসতে হাসতে জানাল, সেও একজন কলেজের অধ্যাপক, সাহিত্য তার নেশা। সাহিত্য থেকে কথোপকথন গড়িয়ে গেল জীবনের দিকে। দু’জনেই অবাক হয়ে দেখল, কত মিল তাদের ভাবনায়—একই রকম নির্জনতা, একই রকম একাকীত্বকে আপন করে নেওয়ার চেষ্টা। মাধবীলতার ঠোঁটে যখন অনিচ্ছাকৃত হাসি ফুটে উঠল, অরিন্দম সেটি খেয়াল করল গভীর মনোযোগ দিয়ে। সে বলল, “আপনার হাসিটা খুব নীরব, তবু ভীষণ জীবন্ত।” এই ছোট্ট বাক্য মাধবীলতার ভেতর এক অদ্ভুত আলো জ্বেলে দিল। এতদিন ধরে কেউ তাকে এভাবে লক্ষ্য করেনি, এভাবে বুঝতেও চায়নি। অনুষ্ঠানের কোলাহল, মাইকের আওয়াজ, মানুষের হাততালি—সব যেন দূরে সরে গেল, শুধু কথোপকথনের টানাপোড়েনই ভাসল চারপাশে। তার মনে হল, বহুদিন ধরে যাকে খুঁজে ফিরছিল, সেই বোঝাপড়ার মানুষটি হয়তো ঠিক পাশেই বসে আছে।

অনুষ্ঠান শেষে যখন মানুষজন ঘরে ফিরতে শুরু করল, অরিন্দম তখনও দাঁড়িয়ে কথা বলছিল মাধবীলতার সঙ্গে। শ্রীময়ী এসে বলল, “মা, চল, দেরি হয়ে যাচ্ছে।” মাধবীলতা উঠে দাঁড়ালেও ভেতরে ভেতরে অনুভব করল, এই সন্ধ্যা যেন তার জীবনের কোনো বাঁক ঘুরিয়ে দিল। বাড়ি ফেরার পথে মনের ভেতর এক অদ্ভুত আলো জ্বলে রইল, ঠিক যেন গাঢ় অন্ধকারে হঠাৎ দূরে দেখা যায় শঙ্খচিলের ডানা মেলে উড়ে যাওয়া—স্বাধীন, স্বপ্নময়। সেদিন রাতে জানালার ধারে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে সে বুঝল, সেই নীরব আলাপের মধ্যে জন্ম নিয়েছে এক অচেনা অনুভূতি—যা একদিকে ভয় জাগায়, অন্যদিকে আবার অজানা আনন্দে ভরিয়ে দেয় মন। এতদিনের শূন্যতা ভেদ করে আসা এই আলোকে সে নাম দিল—“অচেনা আলোর রেখা।”

তিন

সেই একবারের আলাপ যেন অদৃশ্য এক সুতোয় বেঁধে ফেলল মাধবীলতা আর অরিন্দমকে। পাড়ার অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর তাদের দেখা হওয়ার অজুহাত যেন নিজে থেকেই খুঁজে আসতে লাগল। কখনও শ্রীময়ীর পড়াশোনার খোঁজ নিতে গিয়ে, কখনও বই ধার দেওয়ার অছিলায়, আবার কখনও হঠাৎ পথে হেঁটে আসা-যাওয়ার সময় অরিন্দমের সঙ্গে মাধবীলতার চোখাচোখি হতে লাগল। প্রথমদিকে সে অস্বস্তি বোধ করত—“এই বয়সে, এই অবস্থায় কেন এমন টান লাগছে?”—কিন্তু যতবার অরিন্দমের সঙ্গে কথা বলত, ততবার মনে হত এই মানুষটির সংবেদনশীলতা যেন তার শূন্যতার ভেতর আলো ছড়িয়ে দেয়। সাহিত্য, ইতিহাস, পুরোনো গান—যে বিষয়েই আলাপ হোক না কেন, অরিন্দম কথা বলত মনোযোগ দিয়ে, শোনাতো ধৈর্য নিয়ে। আর এই মনোযোগী শ্রবণেই মাধবীলতা খুঁজে পেত নিজের হারানো অস্তিত্বকে। অনেকদিন ধরে কেউ তার কথাকে এভাবে গুরুত্ব দেয়নি, কেউ তার অনুভূতিকে এভাবে জায়গা দেয়নি।

দিন গড়িয়ে সপ্তাহ কেটে যেতে যেতে তাদের মধ্যে এক অদ্ভুত বোঝাপড়া জন্ম নিল। একদিন অরিন্দম মাধবীলতার হাতে একটা বই দিল—শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত। বইটা হাতে নিয়ে মাধবীলতার মনে হল যেন সে আবার সেই যৌবনের দিনে ফিরে গেছে, যখন স্বামী মারা যাননি, যখন সে অবাধে বই পড়ত, গান শুনত, হাসত। বইয়ের পাতার গন্ধের সঙ্গে মিশে গেল অরিন্দমের আন্তরিকতা। সেই দিন থেকে তাদের মধ্যে নিয়মিত বই আদানপ্রদান শুরু হল—রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, বুদ্ধদেব বসু—সব কবিতাই নতুন করে বেঁচে উঠতে লাগল। শুধু বই নয়, জীবনকথাও ভাগ করে নিতে শুরু করল তারা। মাধবীলতা স্বীকার করল, বিধবা হওয়ার পর তার একাকীত্ব কতটা অসহনীয়, আর অরিন্দম জানাল নিজের পরিবারে কীভাবে সমাজের গোঁড়ামি তাকে বারবার দমিয়ে রাখে। এই খোলামেলা স্বীকারোক্তি যেন তাদের আরও কাছাকাছি নিয়ে এলো। মাধবীলতার মনে হতে লাগল, সে আর কেবল একজন “বিধবা” নয়—সে একজন নারী, যার অনুভূতি আছে, যার আকাঙ্ক্ষা আছে, যার জীবনেরও দাবি আছে।

অরিন্দমের দৃষ্টিতে মাধবীলতা নতুন করে নিজেকে চিনতে শিখল। যখনই সে কথা বলত, অরিন্দমের চোখে এক ধরনের শ্রদ্ধা আর মুগ্ধতা ঝরে পড়ত। আর সেই দৃষ্টির ভেতরেই মাধবীলতা খুঁজে পেত নারীত্বের নতুন স্বীকৃতি। এতদিন সে ভাবত, বিধবার জীবনে সৌন্দর্য কিংবা আকর্ষণের জায়গা নেই—কিন্তু অরিন্দম তাকে অন্যভাবে দেখতে শেখাল। একদিন রাস্তায় হেঁটে যেতে যেতে অরিন্দম হঠাৎ থেমে বলল, “আপনি জানেন, আপনার চুলে যে সামান্য রুপোলি রেখা ফুটেছে, সেটা আপনাকে আরও বেশি মর্যাদাবান করে তোলে।” কথাটা শুনে মাধবীলতা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেও ভেতরে ভেতরে তার হৃদয়ে এক অদ্ভুত উষ্ণতা ছড়িয়ে গেল। সে বুঝল, বহুদিন পর তার নারীসত্তা আবার জেগে উঠছে, আর সেই জাগরণই তাকে এক নতুন পৃথিবীর দরজায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। সেই দরজার ওপাশে কী আছে, সে জানে না, কিন্তু অরিন্দমের সান্নিধ্যে সেই অজানার দিকে পা বাড়াতে তার আর ভয় লাগছে না।

চার

পাড়ার অলিগলি, রোদে পুড়ে যাওয়া পুরনো দেওয়াল আর চায়ের দোকানের আড্ডায় নতুন করে আলোচনার বিষয় হয়ে উঠল মাধবীলতা আর অরিন্দম। মানুষের চোখ সবসময়ই অদ্ভুত—যেখানে প্রেমের কোমলতা আর মানবিকতার আলোক ছটা থাকে, সেখানেই তারা কদর্য সন্দেহের আঁচড় কাটতে ভালোবাসে। প্রতিদিন ভোরবেলা বা সন্ধ্যায় যখন অরিন্দম মাধবীলতার সঙ্গে দেখা করতে আসে, তখন কেউ না কেউ ছাদের জানলা ফাঁক করে কিংবা বাজার ফেরত গলিতে দাঁড়িয়ে তাদের দিকে কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকায়। অরিন্দমের শান্ত স্বভাব, সংবেদনশীল কথা আর মাধবীলতার নিঃসঙ্গ জীবনে এনে দেওয়া সামান্য উষ্ণতাই এই দৃষ্টি আর ফিসফিসানির কারণ হয়ে ওঠে। “কলেজের পুরনো প্রেম তো?”—কেউ হেসে বলে, আবার কেউ কপট উদ্বেগের ভঙ্গিতে বলে ওঠে, “একজন বিধবা মহিলার বয়সে এইরকম সম্পর্ক কি মানায়?” কথাগুলো হাওয়ার মতো ভেসে বেড়ায়, গলির প্রতিটি মোড়ে, প্রতিটি দরজার আড়ালে। আর মাধবীলতা চাইলেও সেই শব্দগুলো এড়িয়ে যেতে পারে না, কারণ তার জীবনযাত্রা সবসময়ই সমাজের নজরে ছিল—একজন একা নারী, যাকে সবাই করুণা আর কৌতূহলের মিশ্র দৃষ্টিতে দেখে। এখন সেখানে নতুন এক অধ্যায় যোগ হলো—“গোপন প্রেমের” গুজব।

গুজব পৌঁছে যায় মাধবীলতার ঘরের ভেতরেও, সবচেয়ে কষ্টের জায়গায়—তার একমাত্র মেয়ে শ্রীময়ীর কানে। স্কুল থেকে ফিরতে ফিরতে বা বন্ধুদের ফোনালাপে সে হঠাৎই শুনে ফেলে মায়ের নাম অন্যভাবে উচ্চারিত হচ্ছে। “তোর মা নাকি কলেজের পুরনো প্রেমিকের সঙ্গে আবার ঘুরছে?”—এক বন্ধুর হালকা মন্তব্য হেসে হেসে বলা হলেও শ্রীময়ীর কিশোরী মনে সেটাই বিষের মতো ঢুকে যায়। ঘরে ফিরে সে মায়ের দিকে কেমন সন্দেহভরা দৃষ্টিতে তাকাতে শুরু করে। আগে যেখানে মা’কে সে নিঃশর্তভাবে ভালোবাসত, সেখানে এখন এক অদ্ভুত দূরত্ব জন্ম নিল। মায়ের হাত ধরে গল্প করার বদলে সে নির্লিপ্তভাবে নিজের ঘরে চলে যায়, স্কুলের খাতা খুলে বসে, কিন্তু পড়াশোনায় মন বসে না। শ্রীময়ীর চোখে এখন মা যেন অন্য এক মানুষ—যিনি নিজের ইচ্ছের জন্য সমাজের রীতিকে উপেক্ষা করছেন। অথচ মাধবীলতা টের পায়, মেয়ে কিছু একটা শুনেছে, কিন্তু সে সরাসরি কিছু বলছে না। শ্রীময়ীর নীরবতা মাধবীলতার বুকের ভেতরে ভীষণ অস্বস্তি আর অপরাধবোধ তৈরি করে। অরিন্দমের প্রতি টান সত্যি হলেও, মেয়ে যেন তাকে ভুল বুঝছে—এই যন্ত্রণা দিনরাত তাকে কুরে কুরে খেতে শুরু করে।

এদিকে অরিন্দমও টের পায় পাড়ার দৃষ্টিগুলো কেমন বদলে যাচ্ছে। যে মানুষগুলো আগে তাকে হেসে শুভেচ্ছা জানাত, তারা এখন কেমন এড়িয়ে যায় বা ইঙ্গিতপূর্ণ ভঙ্গিতে তাকিয়ে থাকে। কিছু সময়ের জন্য অরিন্দম চুপচাপ থাকতে চাইলেও, সে জানে মাধবীলতার একা লড়াই করার ক্ষমতা সীমিত। এক রাতে দু’জন যখন একসঙ্গে বসেছিল, মাধবীলতা চোখ ভিজে বলেছিল—“অরিন্দম, আমি ভয় পাচ্ছি… আমি চাই না শ্রীময়ী আমাকে ঘৃণা করুক। সমাজের চোখের সামনে আমি সব সামলে নিতে পারি, কিন্তু মেয়ের সামনে যদি আমি ভেঙে পড়ি, তবে আর পারব না।” অরিন্দম তার হাত চেপে ধরে আশ্বাস দিয়েছিল, কিন্তু সেই মুহূর্তে দু’জনের মনেই তীব্র এক দ্বন্দ্ব চলছিল। তারা জানত, একদিকে সমাজের অব্যক্ত শাসন, অন্যদিকে পারিবারিক সম্পর্কের টানাপোড়েন—এই দুইয়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে তাদের ভালোবাসা যেন বারবার ধাক্কা খাচ্ছে। পাড়ার কানাঘুষো হয়তো থামবে না, শ্রীময়ীর মনে হয়তো সংশয় আরও গভীর হবে, তবুও তারা এই সম্পর্কের সত্যকে অস্বীকার করতে পারবে না। সমাজের চোখ, মানুষের রটনা, সন্তানের সন্দেহ—সব মিলিয়ে মাধবীলতার জীবনে যেন এক নতুন ঝড় এসে আছড়ে পড়ল, যার সামনে দাঁড়িয়ে এখন তাকে ঠিক করতে হবে, কোনটা বেছে নেবে—নিজের হৃদয়ের ডাক, না সমাজ আর সন্তানের প্রত্যাশার দায়।

পাঁচ

শ্রীময়ীর মনের ভেতরে আগুন জ্বলে উঠেছিলো, সেই আগুন সে আর চেপে রাখতে পারলো না। বিকেলের ঘরে বাতাস ভারী হয়ে উঠেছিলো, জানলার পর্দা বারবার উড়ে গিয়ে মেঝেতে পড়ছিলো আর সেই শব্দ যেন তার রাগকে আরও বাড়িয়ে তুলছিলো। সে মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে চোখ লাল করে চিৎকার করে উঠলো—“তুমি কি ভুলে গেছো তুমি বিধবা?” কথাগুলো যেন শুধু অভিযোগ নয়, মায়ের চরিত্রের ওপর আঘাত। এতদিন ধরে অন্যদের কানাঘুষো শুনে তার কিশোরী মনে একরকম বিষ ঢুকে গিয়েছিলো, সেই বিষই আজ বেরিয়ে এলো। মাধবীলতা চুপ করে তার মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলো, যেন প্রতিটি শব্দ তার হৃদয়ে ছুরি চালাচ্ছে। গায়ে শাড়ির আঁচল শক্ত করে ধরে সে দাঁড়িয়ে রইলো, কোনো উত্তর দিলো না। বাইরে পাড়ার বাচ্চারা খেলা করছিলো, তাদের হাসি-চিৎকার ঘরের ভেতরে আসছিলো, কিন্তু মা-মেয়ের এই দমবন্ধ পরিবেশের মধ্যে সেই শব্দও যেন ব্যঙ্গের মতো শোনাচ্ছিলো। শ্রীময়ী একসময় চুপ করে গেলো, কিন্তু তার চোখের দৃষ্টি এতটাই কষাঘাতী ছিলো যে মাধবীলতার বুকের ভেতর কাঁপুনি শুরু হলো।

সেই মুহূর্তে মাধবীলতা ভেতরের এক অদৃশ্য বাঁধন ভাঙার মতো করে গভীর নিঃশ্বাস নিলো। এতদিন ধরে সে সমাজের ভয়ে, শ্রীময়ীর ভবিষ্যতের চিন্তায়, আর নিজের ভেতরের দমিয়ে রাখা আবেগের কারণে সবকিছু চেপে রেখেছিলো। কিন্তু মেয়ের এভাবে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেওয়ায় তার বুকের ভেতরের ঝড় আর থামানো গেলো না। ধীরে ধীরে কাঁপা গলায় সে বললো—“আমি এখনও বেঁচে আছি, শ্রীময়ী।” এই প্রথমবার সে নিজের মনের গভীর আকাঙ্ক্ষাকে মুখে আনলো। শ্রীময়ীর বিস্ফারিত চোখে যেন অবিশ্বাস ছড়িয়ে পড়লো। মা, যাকে সে সবসময় নিঃশব্দ, ত্যাগী, সংসারের খাতিরে সবকিছু মেনে নেওয়া একজন নারী হিসেবে দেখেছে, তিনি আজ তার সামনে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করছেন যে তিনিও মানুষ, তাঁরও চাওয়া আছে, তাঁরও ভালোবাসার অধিকার আছে। মাধবীলতার চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগলো, কিন্তু সেই অশ্রু দুর্বলতার নয়, বরং এক অদম্য সাহসের প্রতীক। তার কণ্ঠস্বর ধীরে ধীরে দৃঢ় হয়ে উঠলো—“আমি কি শুধু তোমার মা হয়ে বেঁচে থাকবো? আমার নিজের জন্য কোনো জীবন থাকবে না? বিধবা মানেই কি মানুষ আর বাঁচতে পারে না? সমাজ যদি আমাকে ঠেলে সরিয়ে দেয়, তাহলে কি আমাকেও নিজের মনের সমস্ত দরজা বন্ধ করে দিতে হবে?” কথাগুলো এত গভীর ও তীব্র যে শ্রীময়ী চুপ করে মাটির দিকে তাকিয়ে রইলো, যেন উত্তর খুঁজে পাচ্ছিলো না।

মা-মেয়ের এই কথোপকথন যেন ঘরের ভেতরে বজ্রপাতের মতো বাজলো। শ্রীময়ীর মনে ছিলো অস্থিরতা, অপরাধবোধ আর একরকম ভয়। সে যতই রাগে মায়ের দিকে অভিযোগ ছুঁড়ে দিয়েছে, ভেতরে ভেতরে সে জানে মা সারা জীবন অনেক কষ্ট সহ্য করেছেন, অনেকটা একা পথ চলেছেন। অথচ সমাজের তৈরি শৃঙ্খল তাকে মায়ের স্বাভাবিক চাওয়াগুলো বোঝার সুযোগ দেয়নি। শ্রীময়ী জানালার বাইরে তাকালো—পাড়া প্রতিবেশীর জানালার পর্দার আড়ালে হয়তো কেউ তাদের ঘরের দিকে তাকিয়ে আছে, হয়তো কারও কানে তাদের ঝগড়ার আওয়াজ পৌঁছে যাচ্ছে। তার বুকের ভেতরে তখন এক ধরনের দ্বন্দ্ব শুরু হলো। সে একদিকে মায়ের প্রতি ভালোবাসায় ভরা, আবার অন্যদিকে সমাজের ভয় তাকে গ্রাস করছে। মাধবীলতা এদিকে একেবারে স্থির হয়ে গেছেন, যেন জীবনের সব ভয়ের বাঁধন ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছেন। তিনি জানেন এই মুহূর্ত থেকে তাঁর আর কোনো গোপনীয়তা নেই, মেয়ের চোখে তিনি নগ্ন সত্য হয়ে দাঁড়িয়ে গেছেন। কিন্তু তবুও তার ভেতরে এক ধরনের মুক্তির স্বাদ আছে—অবশেষে তিনি নিজের মনের কথা বলেছেন, অবশেষে সমাজের তৈরি কাঁটাতার ভেদ করে তিনি নিজের মানুষ হয়ে উঠেছেন। বাইরে তখন হাওয়ার ঝাপটা এসে দরজাকে বারবার কাঁপাচ্ছিলো, আর ভেতরে মায়ের আকাঙ্ক্ষা আর মেয়ের ভয় মিলে তৈরি হচ্ছিলো দ্বন্দ্বের এক ভয়ঙ্কর ঝড়।

ছয়

নন্দিনী সেই সন্ধ্যায় মাধবীলতার উঠোনে এসে বসেছিল, হাতে শাড়ির আঁচলে আঁকড়ে ধরা কিছু শুকনো ফুল। মুখে ছিল এক অদ্ভুত দ্বিধা, যেন বন্ধুত্বের টান আর সমাজের ভয় একসাথে তার বুকের ভেতর লড়াই করছে। সে ধীরে ধীরে বলল, “মাধবী, তুমি কি বুঝতে পারছো তুমি কী করতে যাচ্ছো? এই গ্রামে মানুষের চোখ, মানুষের জিভ, কাউকে ছাড়বে না।” মাধবীলতা চুপ করে শোনে, কেবল চোখের গভীরে অদম্য সাহসের ঝিলিক। নন্দিনীর কথায় লুকানো ভয়টা স্পষ্ট—সে জানত, সমাজের নিয়ম মানতে গিয়ে কতজন নারী সারাজীবন নিজের হৃদয়ের কবর তৈরি করেছে। কিন্তু আজ সে ভয়কে বন্ধুর সামনে দাঁড় করাতে এসেছে। তার মনে হচ্ছিল, যদি মাধবীলতা সত্যিই নিজের ভালোবাসাকে বেছে নেয়, তবে তাদের দীর্ঘদিনের বন্ধুত্ব কি বদলে যাবে? নাকি আরও গভীর হবে?

মাধবীলতা এবার শান্ত স্বরে বলল, “নন্দিনী, তুই জানিস তো আমি কতটা একা? বিধবা হবার পর এই সংসার, এই সমাজ আমাকে শুধু শূন্যতা দিয়েছে। আমি চেয়েছিলাম অন্তত তুই বুঝবি।” তার চোখে জল টলমল করছিল, কিন্তু কণ্ঠে ছিল দৃঢ়তা। নন্দিনী কেঁপে উঠল, কারণ সেও নিজের জীবনের অন্ধকার গোপন করেছিল এতদিন। মাধবীলতার সাহস তাকে ভেতর থেকে নাড়িয়ে দিল। সে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “আমি তোর মতো শক্ত নই মাধবী। আমি সারাজীবন ভয় পেয়ে বেঁচেছি। সমাজ কী বলবে, লোক কী ভাববে—এই ভেবে নিজের ভেতরের শূন্যতা ঢেকে রেখেছি। আজ যখন তুই দাঁড়িয়ে বলছিস যে ভালোবাসার অধিকার তোরও আছে, তখন মনে হচ্ছে আমি নিজেই হয়তো সেই অধিকার থেকে পালিয়ে এসেছি।” তাদের দুজনের চোখ মিলতেই বোঝা গেল, এই আলাপ আর শুধু বন্ধুত্বের ছিল না, বরং দুজন নারীর অদম্য লড়াইয়ের প্রতিফলন হয়ে উঠেছে।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছিল, পাড়ার গলি থেকে শাঁখের আওয়াজ আর ভজনের সুর ভেসে আসছিল। সমাজের সেই পুরোনো কাঠামো যেন বাইরের আকাশে ছায়া ফেলছিল। কিন্তু উঠোনের ভেতর, মাধবীলতা আর নন্দিনীর মধ্যে এক অন্যরকম আলো জ্বলে উঠেছিল—যা সাহস আর সত্যিকার বন্ধুত্বের প্রতীক। নন্দিনী ধীরে ধীরে মাধবীলতার হাত ধরল, মুখে ক্লান্ত অথচ আন্তরিক হাসি। বলল, “আমি জানি, তোর পথ সহজ হবে না। কিন্তু আমি তোর পাশে থাকব। হয়তো ভয় এখনও আমাকে ছাড়বে না, কিন্তু তোকে দেখে আমি শিখছি কেমন করে ভয়কে হারাতে হয়।” মাধবীলতা এক মুহূর্তের জন্য চোখ বুজে নিল, মনে হলো আজ তার একার যুদ্ধ আর একা রইল না। এই মুহূর্তে তাদের বন্ধুত্ব শুধু কথা বা সঙ্গ নয়, বরং এক অটুট প্রতিজ্ঞায় বাঁধা হয়ে গেল—যে প্রতিজ্ঞা সমাজের অন্ধকারকে ছিঁড়ে, তাদের নিজের আলোকিত সত্যকে সামনে আনবে।

সাত

অরিন্দমের জীবনে এই প্রথম এমন এক ঝড় নেমে আসে, যেখানে সে নিজের অস্তিত্বকেই প্রশ্ন করতে থাকে। তার পরিবার, বিশেষত মা এবং কাকা, প্রতিদিন তাকে বুঝিয়ে চলেছে—“একজন বিধবার সঙ্গে সম্পর্ক রাখলে সংসারে অশান্তি নামবে, দেবদেবীরা রুষ্ট হবেন।” গ্রামের লোকেরাও নানাভাবে কটু কথা বলতে শুরু করেছে। বাজারে বেরোলে কেউ সরাসরি মুখের ওপর বলে দেয়—“তোর মতো ছেলের কাছ থেকে এমন আশা করিনি।” অরিন্দমের মনে হচ্ছিল, যেন চারদিক থেকে লোহার খাঁচায় আটকে যাচ্ছে সে। মাধবীলতার প্রতি তার ভালোবাসা সত্যিকারের, নিখাদ, আর সেই ভালোবাসার জন্যই সমাজ তার ওপর এত ক্রূর হয়ে উঠেছে। তবু মনের গভীরে সে জানত—মাধবীলতাকে ছেড়ে দেওয়া মানে নিজের আত্মাকে মেরে ফেলা। রাতে ঘুম ভেঙে বারবার তার মনে পড়ত মাধবীলতার চোখের সেই অশ্রুসিক্ত দৃঢ়তা, যে চোখ সমাজের অভিশাপ সত্ত্বেও জীবনের আলো খুঁজে নিতে চায়। এই টানাপোড়েনে অরিন্দমের ভেতর ভীষণ দ্বন্দ্ব তৈরি হলো—সে কি নিজের পরিবার আর সমাজের রীতি মেনে মাধবীলতাকে ছেড়ে দেবে, নাকি নিজের হৃদয়ের ডাককে মান্যতা দিয়ে সবকিছুর বিরুদ্ধে দাঁড়াবে?

পরিবারের চাপ ক্রমশ অসহনীয় হয়ে উঠল। মা একদিন কেঁদে বললেন—“অরিন্দম, তুই যদি ওই মেয়ের হাত ধরে থাকিস, তবে আমি তোকে ছেলে বলে মানব না।” বাবার মুখ কঠোর, তিনি কেবল বললেন—“আমাদের বংশের মানহানি করিস না।” এমনকি ছোট ভাইও বিদ্রুপ করে বলল—“ভাইয়া, এত মেয়ে থাকতে বিধবার প্রেমে পড়তে হলো?” এই কথাগুলো অরিন্দমের বুককে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছিল, কিন্তু সে নীরব থেকে যাচ্ছিল। তার মনে হচ্ছিল, ভালোবাসা যেন পাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবুও এক বিকেলে, মাঠের ধারে দাঁড়িয়ে মাধবীলতার সঙ্গে কথা বলার সময় তার সমস্ত ভয় দূর হয়ে গেল। মাধবীলতা বলল—“তুমি যদি ভয়ে পিছিয়ে যাও, আমি তোমাকে দোষ দেব না। আমি জানি আমি সমাজের চোখে অভিশপ্ত। কিন্তু যদি কখনও আমার হাত ধরে রাখার মতো শক্তি তোমার থাকে, তবে আমি হাঁটব তোমার সঙ্গে।” সেই কথাগুলো অরিন্দমের ভেতরে এক অদ্ভুত শক্তির জন্ম দিল। সে বুঝল, এ লড়াই কেবল প্রেমের লড়াই নয়, এটি তার নিজের পরিচয়, তার নিজের সত্যের লড়াই। সেই রাতে সে পরিবারের সামনে দাঁড়িয়ে স্পষ্ট জানিয়ে দিল—“আমি মাধবীলতার হাত ছাড়ব না। তোমাদের আশীর্বাদ চাই, কিন্তু যদি তা না-ও পাই, আমি তবুও তাকে ছেড়ে যাব না।” ঘরে হঠাৎ নীরবতা নেমে এল, সবার চোখে বিস্ময়, রাগ, হতাশা। অরিন্দম তখনও দৃঢ়, যেন নিজের ভেতরে এক পাহাড়ের শক্তি খুঁজে পেয়েছে।

অরিন্দমের এই সিদ্ধান্তে তার পরিবার ভেঙে পড়লেও, তার ভেতরের দ্বিধা যেন দূর হলো। সে অনুভব করল, যে ভালোবাসা তার এবং মাধবীলতার মধ্যে জন্মেছে, তা কোনো প্রথা বা ভয়ের চাপে ভাঙবার নয়। গ্রামজুড়ে নানা কথা চলতেই থাকল—“অরিন্দম সমাজকে কলঙ্কিত করছে”—কেউ বা বলল—“ওদের সম্পর্ক টিকবে না।” কিন্তু এই কটুক্তি আর অরিন্দমকে নড়াতে পারল না। বরং প্রতিটি কথাই তাকে আরও দৃঢ় করল। মাধবীলতার সামনে গিয়ে সে বলল—“আমি তোমার হাত ধরেছি, আর জীবনের শেষ পর্যন্ত ধরেই রাখব।” মাধবীলতা তখন চোখ ভরা জল নিয়ে তার দিকে তাকাল, আর সেই মুহূর্তে তাদের দুজনের নীরব প্রতিজ্ঞা যেন আকাশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ল। সমাজের ভয়, পরিবারের চাপ, সবকিছুর ঊর্ধ্বে দাঁড়িয়ে তারা দুজন যেন এক নতুন সূর্যের দিকে হাঁটতে শুরু করল—যেখানে তাদের ভালোবাসা হবে অস্ত্র, সাহস হবে ঢাল। অরিন্দম জানত, সামনে আরও ঝড় আসবে, আরও প্রতিবন্ধকতা দাঁড়াবে, কিন্তু অন্তত আজকের দিনে সে নিজের ভিতরের ভয়কে জিতেছে, নিজের মানুষকে বেছে নিয়েছে। এটাই তার জীবনের সবচেয়ে বড় লড়াই, আর সে এই লড়াই জিতে গেছে—প্রেমের হাত ধরে।

আট

মাধবীলতার জীবনে ভালোবাসা একদিকে যেমন আশ্রয় হয়ে উঠছিল, অন্যদিকে সমাজের চোখে সেটাই হয়ে উঠেছিল অপরাধ। অরিন্দমের সঙ্গে তার সম্পর্ক গ্রামের অলিগলিতে আর চায়ের দোকানের আড্ডায় আলোচনার মূল বিষয় হয়ে উঠল। কারও চোখে কৌতূহল, কারও চোখে ঘৃণা, আবার কারও চোখে নিছক উপহাস। কিন্তু যখন রটনা সীমা ছাড়িয়ে গেল, তখন একদিন সন্ধ্যায় পাড়ার কয়েকজন প্রভাবশালী লোক একসঙ্গে মাধবীলতাকে প্রকাশ্যে অপমান করার পরিকল্পনা করল। হাটের মোড়ে, যেখানে সকলে আসে-যায়, সেখানে দাঁড়িয়ে কেউ বলল, “বিধবা হয়ে এত সাজগোজ কিসের?” আবার কেউ কটাক্ষ করে বলল, “অশ্লীলতারও তো একটা সীমা আছে।” মাধবীলতা প্রথমে নীরবে দাঁড়িয়ে রইল, যেন কারও কথায় তার কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। কিন্তু ভিতরে ভিতরে তার বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠছিল, বারবার মনে হচ্ছিল এই সমাজ কি তাকে একবারও মানুষ হিসেবে স্বীকার করবে না? তার চোখের সামনে যেন ভেসে উঠল অরিন্দমের দৃঢ় দৃষ্টি, যে বলেছিল—“তুমি আমার জীবনের সবচেয়ে সত্যি ভালোবাসা।” সেই স্মৃতি মাধবীলতাকে সাহস দিল, আর সে ভাবল—আজ যদি চুপ করে যায়, তবে চিরকাল তাকে সমাজের শিকার হতে হবে।

অপমানের চূড়ান্ত মুহূর্তে মাধবীলতা দৃঢ় কণ্ঠে এগিয়ে এসে বলল, “ভালোবাসা কি অপরাধ? বিধবা মানেই কি সে মানুষ নয়? আপনাদের চোখে আমার সাজ, আমার হাসি যদি অশ্লীল হয়, তবে আসল অশ্লীলতা আপনাদের চোখে, আমার জীবনে নয়।” তার কণ্ঠস্বর এতটাই দৃঢ়, এতটাই স্পষ্ট ছিল যে মুহূর্তের জন্য চারপাশের কোলাহল স্তব্ধ হয়ে গেল। যারা কটূক্তি করছিল, তাদের মুখ শুকিয়ে এল, যেন হঠাৎ তারা বুঝতে পারল, এই নারীকে ছোট করার ক্ষমতা তাদের নেই। ভিড়ের মধ্যে কেউ কেউ চুপচাপ সরে গেল, আবার কারও চোখে কৌতূহল মিলল শ্রদ্ধার সঙ্গে। মাধবীলতা বুঝল, তার প্রতিবাদ শুধু নিজের জন্য নয়—এটা তাদের জন্যও, যারা বছরের পর বছর অন্যায়ের শিকার হয়েছে কিন্তু মুখ খোলেনি। হঠাৎ সে অনুভব করল, বুকের ভেতর জমে থাকা সমস্ত যন্ত্রণা যেন মুক্তি পাচ্ছে, যেন সে নিজের শিকল ভেঙে দাঁড়িয়ে গেছে।

সেই ঘটনার পর গ্রামের পরিবেশ যেন বদলে গেল। অনেকে মাধবীলতার সাহসকে প্রশংসা করতে শুরু করল, যদিও অনেকে এখনও বিরূপ ছিল। কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না—কারণ মাধবীলতা নিজের ভেতরে নতুন শক্তির সন্ধান পেয়েছিল। রাতে বাড়ি ফিরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সে নিজের চোখের দিকে তাকাল; সেখানে কোনো লজ্জা বা ভাঙন নেই, বরং এক অদম্য দীপ্তি। সে বুঝল, সমাজ যতই আঘাত করুক না কেন, তার সত্যকে কেউ নষ্ট করতে পারবে না। অরিন্দমের পাশে থেকে তার এই লড়াই আরও দৃঢ় হবে, আর সেই লড়াই শুধু ভালোবাসার জন্য নয়—সমাজের ভ্রান্ত ধ্যানধারণার বিরুদ্ধে। মাধবীলতা জানল, আগামী দিনে হয়তো আরও কষ্ট আসবে, আরও বিদ্রূপ শুনতে হবে, কিন্তু আজকের প্রতিবাদই প্রমাণ করে দিয়েছে—সে আর ভাঙবে না, বরং ভাঙা সমাজকে চ্যালেঞ্জ করবে। এই এক রাতেই সে বিধবা থেকে হয়ে উঠল এক যোদ্ধা—যার হাতে ভালোবাসার পতাকা, আর কণ্ঠে সত্যের আগুন।

নয়

শ্রীময়ী সবসময় ভেবেছিল, মা শুধু একজন কঠিন ও দায়িত্ববান মানুষ, যার জীবন মানেই সংসার আর সন্তান লালন-পালন। ছোটবেলা থেকে সে দেখেছে, মা কখনো নিজের জন্য আলাদা সময় রাখেনি, এমনকি নিজের শখ বা ইচ্ছাগুলোও মুছে ফেলেছে সংসারের টানে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে মায়ের চোখের এক অদ্ভুত শূন্যতা তাকে ভাবিয়ে তুলেছিল। মায়ের মধ্যে যে নিঃসঙ্গতা ধীরে ধীরে জমে উঠেছে, তা আর লুকোনো যাচ্ছিল না। একদিন সন্ধ্যায় পড়াশোনা করতে করতে শ্রীময়ী লক্ষ্য করে, মায়ের হাতে একখানা পুরনো চিঠি—যা তিনি গোপনে পড়ছিলেন। সেই মুহূর্তে শ্রীময়ীর মনে হয়েছিল, মা আসলে শুধুই মা নন, তিনিও একজন মানুষ—যার স্বপ্ন আছে, অনুভূতি আছে, ভালোবাসার আকাঙ্ক্ষা আছে। এই উপলব্ধি তাকে গভীরভাবে নাড়া দেয়। তার মনে হয়, মা সবসময় অন্যের জন্য বাঁচলেন, অথচ নিজের সুখকে কোনোদিন গুরুত্ব দিলেন না। এটা কি ন্যায়সঙ্গত? শ্রীময়ীর ভেতরে প্রশ্ন জেগে উঠল—যদি সমাজ মেয়েদের সুখ, ভালোবাসা বা দ্বিতীয়বার নতুনভাবে জীবন গড়ার অধিকার না দেয়, তবে সেই সমাজ কতটা মানবিক?

ধীরে ধীরে শ্রীময়ী মায়ের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে শুরু করে। আগে যেখানে সে মায়ের প্রেমের খবরে অস্বস্তি বোধ করত, এখন সেখানে জন্ম নেয় সহানুভূতি ও বোঝাপড়া। সে ভাবে, বাবার মৃত্যুর পর এতগুলো বছর মা একা কীভাবে কাটালেন! রাতের নিস্তব্ধতায় হয়তো মায়ের বুকের ভেতরেও হাহাকার জমে উঠেছে, কিন্তু বাইরে তিনি ছিলেন শক্ত, সংসারের পাহারাদার। শ্রীময়ীর মনে পড়ল, কতবার সে খুঁতখুঁতে হয়ে মায়ের সিদ্ধান্তকে প্রশ্ন করেছে, কিন্তু কখনো ভেবে দেখেনি—মা কতটা নিঃসঙ্গ। এখন মনে হচ্ছে, মা যেন নিজের প্রাপ্য সুখ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন কেবল সমাজের ভয়ে, কিংবা সন্তানের ‘সম্মান’ বাঁচাতে। কিন্তু সম্মান কি এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে একজন মানুষকে তার মানবিক চাহিদা থেকে বঞ্চিত করতে হবে? মায়ের চোখে নতুন প্রেমের আভা শ্রীময়ীকে ভীত করেনি, বরং আশ্বস্ত করেছে। সে বুঝেছে, ভালোবাসা কোনো বয়স মানে না, কোনো সামাজিক বিধি-নিষেধে বাঁধা পড়ে না। এই ভাবনা তার মনকে এক ধরনের মুক্তি এনে দেয়—যেন সে নিজের ভেতরেই নতুন এক দরজা খুলে ফেলল।

শেষমেশ শ্রীময়ী এক সন্ধ্যায় মায়ের কাছে গিয়ে বলে, “মা, তুমি যদি আবার ভালোবাসো, আমি তোমার পাশে আছি।” কথাটা বলতে গিয়ে তার গলা কেঁপে উঠলেও, সে জানত এটাই সত্যি। মাধবীলতা বিস্মিত হয়ে তাকিয়েছিলেন মেয়ের চোখে, সেখানে কোনো অভিযোগ নেই, শুধু স্বীকৃতি আর সমর্থন। এই স্বীকারোক্তি মা-মেয়ের সম্পর্ককে নতুন মাত্রা দিল। শ্রীময়ী অনুভব করল, মা আসলে তাকে শেখাচ্ছেন—নিজেকে ভালোবাসা মানে স্বার্থপরতা নয়, বরং জীবনের প্রতি দায়িত্ববোধেরই আরেক রূপ। এরপর থেকে শ্রীময়ী সমাজের কথায় কান না দিয়ে দৃঢ়ভাবে মায়ের পাশে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়। সে বুঝে গেছে, মায়ের সুখই তার আসল শক্তি, আর সেই সুখকে অস্বীকার করা মানে নিজের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করা। এভাবে এক কিশোরী কন্যা থেকে ধীরে ধীরে শ্রীময়ী হয়ে ওঠে প্রাপ্তবয়স্ক, যে শিখেছে—ভালোবাসা লুকোনোর নয়, বরং বাঁচিয়ে রাখার নাম।

দশ

অরিন্দমের হাত মুঠোয় শক্ত করে ধরে মাধবীলতা যেন হঠাৎ করেই নতুন এক জগতে প্রবেশ করল। এতদিন ধরে সমাজ, পরিবার আর লোকের কথার শৃঙ্খলে যে নারী নিজের জীবনকে বারবার থামিয়ে দিয়েছে, আজ সে যেন সমস্ত বাঁধন ছিঁড়ে দিয়ে এক নতুন সূর্যের আলোয় দাঁড়িয়ে গেল। সকালবেলার হালকা রোদ গাছের ডালপালার ফাঁক দিয়ে তাদের উপর এসে পড়ছিল, যেন প্রকৃতিও তাদের পাশে দাঁড়িয়ে এই মুহূর্তকে আশীর্বাদ করছে। দীর্ঘদিনের লুকোনো প্রেম, চাপা যন্ত্রণা আর ভয়ের আবরণ সরে গিয়ে মাধবীলতার চোখে এবার ফুটে উঠল অদ্ভুত এক দীপ্তি। অরিন্দমও অনুভব করছিল, এত বছর পর এই সাহসী পদক্ষেপই ছিল তার জীবনের সত্যিকারের সিদ্ধান্ত। দুজনার মিলন শুধু প্রেমের নয়, বরং আত্মমর্যাদা আর মুক্তির জয়গান। এই পথ সহজ নয়, জানে তারা দুজনেই। গ্রামের মানুষ, আত্মীয়স্বজন, এমনকি শ্রীময়ীর বাবার পরিবারও তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে, সমাজ আঙুল তুলবে, কিন্তু মাধবীলতার মনে আর কোনও দ্বিধা নেই। তার আত্মা যেন মুক্ত পাখির মতো ডানা মেলেছে—যেখানে ভয় নেই, সংকোচ নেই, শুধু ভালোবাসার নীল আকাশ।

যেদিন তারা একসাথে সিদ্ধান্ত নিল নতুন জীবনের পথে হাঁটবে, সেদিন থেকেই তাদের জীবন যেন এক অদ্ভুত স্রোতে ভেসে গেল। মাধবীলতা সাহস করে প্রথমবারের মতো শ্রীময়ীর চোখে চোখ রেখে বলল—”তোর মায়েরও তো বাঁচার অধিকার আছে, মা শুধু মা নয়, সে-ও একজন মানুষ।” শ্রীময়ীর মুখে দেখা গেল স্বীকৃতির হাসি, আর সেই হাসি মাধবীলতার চোখে জল এনে দিল। এই সমর্থন তার কাছে ছিল পৃথিবীর সবটুকু শক্তি। এরপর সমাজ যতই গর্জে উঠুক, যতই কেউ কটু কথা বলুক, সে জানে তার মেয়ে তার পাশে আছে, আর অরিন্দমের হাত তার হাত শক্ত করে ধরে আছে। তারা একসাথে ছোট ছোট পরিকল্পনা করছিল—একটা ভাড়া বাড়ি, একটুখানি সংসার, যেখানে নেই বাঁধাধরা নিয়ম, নেই সমাজের ভ্রুকুটি, আছে শুধু স্নেহ আর নির্ভেজাল ভালোবাসা। মাধবীলতা বারবার অনুভব করছিল, এই নতুন যাত্রা যেন শঙ্খচিলের উড়ানের মতো—অসীম আকাশে ডানা মেলে উড়ে যাওয়া, যেখানে তাকে আর কেউ বেঁধে রাখতে পারবে না। অতীতের সমস্ত অশ্রু, ত্যাগ আর যন্ত্রণাকে যেন সে পেছনে ফেলে আসছে, আর প্রতিটি পদক্ষেপে নতুন ভোরের আলো তাকে সাহস জোগাচ্ছে।

অরিন্দম মাধবীলতার দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারছিল, এই নারী কতটা গভীর যন্ত্রণা পেরিয়ে এসেছে এখানে দাঁড়াতে। তার চোখের কোণে থাকা অশ্রুবিন্দু আর ঠোঁটের কোণে খেলে যাওয়া অল্প হাসি একসাথে মিলেমিশে যেন এক নতুন গল্প লিখছে—সংগ্রামের, জেদের, এবং অটল প্রেমের। তাদের চারপাশে এখনও সন্দেহ, কটূক্তি আর সমাজের প্রশ্নবাণ বিদ্যমান, কিন্তু তারা দুজনেই স্থির—এবার আর পিছিয়ে যাবার উপায় নেই। মাধবীলতা মনে মনে বলল, “আমি আর বদ্ধ খাঁচার পাখি নই, আমি শঙ্খচিল—আকাশ আমার, মুক্তি আমার।” অরিন্দম তার পাশে দাঁড়িয়ে বলল, “আমরা একসাথে আছি, এটাই সবচেয়ে বড় সত্য।” তারা হাত ধরাধরি করে এগিয়ে চলল, আর দূরের আকাশে শঙ্খচিল উড়ে গেল—স্বাধীন, সাহসী, অদম্য। যেন সেই পাখির ডানার ঝাপটায় মাধবীলতা আর অরিন্দমের জীবনের সমস্ত ভয় ও অন্ধকার দূর হয়ে গেল। ভালোবাসার এই স্বীকৃতি শুধু তাদের দুজনের নয়, বরং সেই সব মানুষের জন্য এক আলো, যারা সমাজের ভয়ে নিজেদের স্বপ্ন চাপা দিয়ে রাখে। তাদের যাত্রা শুরু হলো, মুক্তির আকাশে—যেখানে শঙ্খচিলের মতো তারাও উড়ে যাবে অসীম, স্বাধীন, অদম্য ভবিষ্যতের পথে।

***

 

1000061052.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *