Bangla - সামাজিক গল্প

লাল মাটির গান

Spread the love

অভিজিৎ মল্লিক


পর্ব ১: লাল মাটির পথে

লাল মাটির রাস্তা ধরে যখন ইরা প্রথমবারের মতো পুরুলিয়ার দিকে এগোচ্ছিল, তখন আগস্টের ভিজে বাতাসে গায়ে লাগছিল শালপাতার গন্ধ। কলকাতার ভিড় ঠেলে, চাকরির ক্লান্তি থেকে মুক্তির খোঁজে এই জায়গায় আসা যেন তার বহুদিনের স্বপ্ন। ছুটি পেয়েছে মাত্র দু’সপ্তাহ, কিন্তু সেই সামান্য সময়ের ভেতরেই সে খুঁজে পেতে চায় এক অন্য জগৎ—যেখানে মোবাইল টাওয়ারের থেকে উঁচু হয় না কোনো গাছ, যেখানে শহরের ধোঁয়া ঢেকে রাখে না আকাশের রঙ।

বাসটার জানালা দিয়ে তাকিয়ে সে দেখে ধানক্ষেতের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে লালচে-খয়েরি মাটির ঢিবি, দূরে ঝাপসা পাহাড়। মাঝেমাঝে গরুর গাড়ি রাস্তা পার হচ্ছে, আবার কোনো কোনো মোড়ে ঢোলের শব্দ ভেসে আসছে। ইরা বুঝতে পারছিল, এ এক অন্য সময়, এক অন্য ছন্দ—যা তার শহুরে ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে খাপ খায় না।

স্টেশন থেকে হেঁটে যে গ্রামে তার হোমস্টে, সেটির নাম শিরোমণিপুর। নাম শুনেই একধরনের কাব্যিক টান অনুভব করেছিল সে। গ্রামের প্রান্তে শালবনের ভেতর ছোট্ট কুঁড়ে-ঘরের মতো হোমস্টেটি বানিয়েছেন এক দম্পতি—অলোক ও মিতা। ইরা পৌঁছনোর পর মিতা হাসিমুখে জলখাবারের থালা এগিয়ে দিলেন—মুড়ি, আলুর চপ আর সাথে গরম চা। সেই চায়ের ধোঁয়া যেন শহরের ধোঁয়া থেকে একেবারে আলাদা।

“আপনি কলকাতা থেকে?” মিতা জিজ্ঞেস করলেন।
ইরা মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ, সাংবাদিকতা করি। তবে এই কয়েকটা দিন শুধু লেখালিখি ছাড়া সব ভুলে থাকতে চাই।”
অলোক হেসে বললেন, “ভুলতে আসুন, তবু পুরুলিয়া আপনাকে মনে করিয়ে দেবে কত কিছু।”

রাতে মাটির ঘরে শোবার সময় ইরার মনে হচ্ছিল, যেন এই মাটির গন্ধ তার শরীরের ভেতরে ঢুকে পড়ছে। ছাদের বাঁশের ফাঁক দিয়ে শোনা যাচ্ছিল পোকামাকড়ের শব্দ, দূরে কোথাও মহুয়ার নেশায় টলমল এক তরুণের গলা বাজছিল।

পরদিন সকালে সে বেরোল গ্রামের ভেতর হাঁটতে। কাঁচা রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে দেখতে পেল স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক লম্বা, রোদে পুড়ে যাওয়া ছেলেটি। বয়স চব্বিশ-পঁচিশ হবে। ছেলেটি সাইকেল ঠেলছিল, সাইকেলের পিছনে বাঁধা গামলায় ফুলগাছ।

“আপনি এখানে নতুন এসেছেন?” ছেলেটি এগিয়ে এসে প্রশ্ন করল।
“হ্যাঁ,” ইরা বলল। “আমি শহর থেকে এসেছি। ভ্রমণ করতে।”
ছেলেটি একটু মুচকি হেসে বলল, “আমি সুব্রত। এই গ্রামেই থাকি। ফুল চাষ করি।”

সুব্রতের চোখে এক অদ্ভুত দৃঢ়তা ছিল। ইরা টের পেল, এই দৃঢ়তা এসেছে মাটি থেকে, গাছ থেকে, শ্রম থেকে। শহরের লোকেরা যেরকমভাবে ডিগ্রিকে গর্ব মনে করে, এরা তেমনি গর্ব করে মাটির সঙ্গে লড়াই করাকে।

সেদিন দুপুরে সুব্রত তাকে নিয়ে গেল পাশের শালবনে। শালগাছের পাতার ফাঁক দিয়ে রোদ গড়িয়ে পড়ছিল লাল মাটিতে। বনভূমির ভেতর এমন এক নিস্তব্ধতা ছিল, যা আবার শব্দে ভরা—পাখির ডাক, পাতার খসখস, ঝিঁঝিঁ পোকার গুঞ্জন।

“এই বনের নাম আমরা বলি ‘ছায়ার বাগান’,” সুব্রত বলল।
“কেন?” ইরা জানতে চাইল।
“কারণ এখানে দাঁড়ালে মনে হয় সব ছায়া যেন আপনাকে ঢেকে রাখছে, আপনার নিজের ছায়াকেও। অনেক পুরনো কাহিনি আছে এই বাগান নিয়ে—কেউ বলে এখানে আত্মা ঘোরে, কেউ বলে দেবতার আসন।”

ইরা মুগ্ধ হয়ে চারপাশে তাকাল। তার মনে হচ্ছিল, হয়তো এই বনই তার লেখার শুরু হবে।

বিকেলে ফিরে এসে সে ডায়রিতে লিখল—
শহর থেকে দূরে এসে পুরুলিয়া যেন আমার ভেতরের আড়ষ্টতাকে খুলে দিচ্ছে। কিন্তু এক অন্য বাস্তবতা—যেখানে প্রকৃতির সৌন্দর্যের সঙ্গে লুকিয়ে আছে সংগ্রাম, স্মৃতি আর অদৃশ্য শিকল।”

সেই রাতে হঠাৎ গ্রামে হৈচৈ পড়ে গেল। কারো চিৎকার—“বন থেকে কাঠচোরেরা ঢুকেছে!” ইরা ছুটে বাইরে গিয়ে দেখল, কয়েকজন টর্চ হাতে ছুটছে শালবনের দিকে। সুব্রতও দৌড় দিল তাদের সঙ্গে।

ইরা দাঁড়িয়ে রইল হোমস্টের দরজায়। তার মনে হচ্ছিল, এই শান্ত পুরুলিয়া আসলে নীরব আগ্নেয়গিরি—ভেতরে কিছু একটা ফুঁসছে, যা সময় হলে বিস্ফোরিত হবে। আর সেই বিস্ফোরণের সাক্ষী হবে সে নিজে।

পর্ব ২: রাতের টর্চ, সকালের ধোঁয়া

নিশীথ রাতে টর্চের আলো যেমন হঠাৎ এসে মাটির ওপর তীক্ষ্ণ ত্রিভুজ আঁকে, তেমনি হঠাৎই গ্রামের নিস্তব্ধতার ওপর আঁচ কাটল লোকজনের চিৎকার। ইরা দরজার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে শুনছিল—কেউ একবার বলে উঠছে “ওইদিকে দৌড়েছে!”, আবার কারও গলার স্বর দম নিয়ে এসে কেঁপে উঠছে, “গাছে কাটা শব্দ শুনেছি, শালটা পড়ে গেছে।” পুরুলিয়ার এই যাত্রাপথে রাতকে সে এতটা তীব্রভাবে আগে কখনও দেখেনি: যেন রাতের শরীরটা কাঁটার তারে মোড়া, অন্ধকারের ভেতরেই কোথাও একটা রক্তচাপ ধুঁয়ে ধুঁয়ে বেড়ে চলেছে।

সুব্রত টর্চ হাতে দৌড়ে গেল। ইরা এক পা বেরিয়ে আবার থেমে গেল। এ জায়গা তার নিজের নয়, তবু আজকের রাত তাকে অচেনা মালিকানায় টানছিল। মিতা এসে কাঁধে হাত রাখলেন, “আপনি ভেতরে যান। এখানে এইসব রাত আমরা প্রায়ই দেখি। কেউ আসে, কেউ যায়। সকাল হলে আবার বাজার বসবে।” ইরা অর্ধেক হাসল, অর্ধেক দীর্ঘশ্বাসে মাথা নেড়ে ভিতরে ফিরে গেল, অথচ ঘুম নামল না, শুধু জানলার ফাঁক দিয়ে যে কাঁচা আলোটা ঢুকছিল সেটাকে তাকিয়ে দেখতে দেখতে তার খেয়াল হচ্ছিল—জঙ্গলও কি ঘুমোয়? না কি কেবল চোখ বুজে শ্বাস মাপতে থাকে?

ভোরের আগে ফিরল সুব্রত। হাঁপাচ্ছে, কাঁধে ধুলো, কপালের পাশে সামান্য আঁচড়। দরজায় ইরাকে দেখে অবাক হল না, যেন ধরে নিয়েছিল সে জেগে থাকবে। “পালিয়ে গেছে,” বলল সে, “দুটি বাইক ছিল, শব্দে বোঝা গেল। একটা গাছ পড়েছে; শিকড় দেখলে কষ্ট হয়।” সে কপালের ঘাম হাতের পিঠ দিয়ে মুছে নিল। ইরা পানির গ্লাস এগিয়ে দিতেই সে চুপচাপ খেয়ে নিল, তারপর দীর্ঘশ্বাস, “এইসব রাত আমাদের জড়িয়ে ধরে। সাবধান থাকুন। বাইরের লোক এলে খবর পায়, কোন গাছটা কাটা সহজ, কোনটা ভারি।”

সকালটা এল মাটির গায়ে নরম রোদ মেখে। শালপাতার ভেজা গন্ধ ঘুমকাতুরে চুলে ঢুকে রইল। গরুর গাড়ির সকাল, মসজিদ থেকে ফজরের পরের নরম গুঞ্জন, দূরে কোনো একটা বাড়ির উঠোনে ধোঁয়া উঠছে, মহুয়ার কাঠে আগুন ধরেছে। ইরা ডায়রি খুলে পাতা উলটাল। সে লিখতে চাইল, আবার কাগজে শব্দের আগে এসে দাঁড়াল একরকম পাথরের বোধ—যেন এই মাটির শব্দ তাকে আগে শোনাতে হবে, তারপর লেখা। সে আজ ঠিক করল, বাজারে যাবে। মানুষ দেখতে হবে—কেনাকাটার দরদাম, সুতা পাকানো, ছাগলের বাচ্চার অকারণ ডাক—যে দৃশ্যগুলো ডকুমেন্টারি ছবির মতো দূরে থাকে, অথচ গল্পের ভিতরে ঢুকে পাতার গন্ধ বাড়িয়ে দেয়।

হাটের দিকে রওনা দেওয়ার মুখে সুব্রত এসে বলল, “আমি যাচ্ছি পানাগড়ের রাস্তার কাছে, যেখানে গাছটা কেটেছে। সঙ্গে যাবেন? দূরের জঙ্গল পেরোতে হবে।” ইরা একবার মিতার মুখের দিকে তাকাল। মিতা হাসি চাপা দিয়ে বললেন, “ওর সঙ্গে গেলে ভরসা থাকে। ফিরতে দেরি করবেন না।” ইরা মাথা নেড়ে রওনা হল। শালপাতা ভেজা, রোদের নীচে টলটল করছে; কোথাও কোথাও রাতের টর্চের ক্লান্ত আঁচ এখনও মাটির চামড়ায় দাগ কেটে রাখা। হাঁটতে হাঁটতে সুব্রত বলছিল, “কাগজে লেখেন তো? এবার যদি লেখেন, নাম লিখবেন না আমাদের। যারা কেটেছে তাদের নাম লিখুন। এখানে যারা থাকে, তারা তো গাছের ছায়া—ছায়াকে কেউ দেখে না, কেবল গাছ পড়ে গেলে ফাঁকা জায়গাটা দেখা যায়।”

কাটা জায়গাটায় পৌঁছে ইরার বুক ধক্ করে উঠল। বিশাল শালের গুঁড়ি মাটিতে শায়িত, গা থেকে বেরোনো রক্তচক্রের মতো বয়সের বৃত্তেরা একেকটা বর্ষের দাগ দেখাচ্ছে। চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পাতা, কাঠের গুঁড়া, ফেলে রাখা একটা সিগারেটের ঠোঙা—ভিজে মাটি ধরে রেখেছে রাতের অপরাধের শেষ চিহ্ন। সুব্রত হাঁটু গেড়ে হাত বোলাল গুঁড়ির ওপরে। “এ গাছটা বর্ষায় ছায়া করত, পথের মানুষ দাঁড়িয়ে রুটি খেত। এখন দেখুন, কেমন সদ্য মরার গায়ের গন্ধ।” ইরা ছবি তুলল না। মোবাইল সে পকেটেই রেখে দিল। মনে হল, এই ক্ষতটা কেবল চোখে দেখলে হয় না, গন্ধে, ছোঁয়ায়, শ্বাসে নিতে হয়।

সেদিন দুপুরে গ্রামে পঞ্চায়েতের উঠোনে লোক জড়ো হল। মাঝখানে গামছা পেতে যে-চেয়ারটা রাখা হয়, তাতে বসেছেন স্থানীয় সভাপতি—প্রভাকর মাহাতো। বয়স পঞ্চাশ পেরোনো, চোখে একধরনের অভিজ্ঞতার কুঞ্চন, তবু কোথাও যেন সাম্প্রতিক থকথকে ক্লান্তি। তিনি বললেন, “রাতের ঘটনাটা আমরা জানি। পুলিশে খবর গেছে। কিন্তু তার আগে আমাদের বনের পাহারা টাইট করতে হবে। খালপাড়ে যারা নতুন বাড়ি করছে, তাদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। বাইরের কন্ট্রাক্টররা এসেছে, রাস্তা বানানোর নাম করে রাতে লোক ঢোকে। আমরা দেখি—কেউ দেখে না!”

একজন বুড়ো দাঁড়িয়ে বললেন, “দেখি, কিন্তু চোখ বাঁধা থাকে। দেখলেই তো ভয়—যারা বাইক চড়ে আসে তারা কারা? কাদের নামে পুলিশ কেস হয় না?” বাজারের গুঞ্জন থেমে গেল একমুহূর্ত। বাতাসে চাপা একটা নাম ভাসল—ধর মল্লিক। কেউ জোরে বলেনি, তবু বোঝা গেল, শহরের কন্ট্রাক্টর, নতুন রাস্তা, নতুন স্টোন-চিপস, নতুন কাজ—সব কিছুর আড়ালে একটা গাছ-রক্তের ব্যবসা আছে। ইরা নিজের নোটবুকে ছোট হরফে লিখল: “ধর মল্লিক—নামটা ফাঁসলে ফাঁসবে কে?”

সভা ভেঙে গেলে সুব্রত ইরাকে নিয়ে গেল পাশের মাঠে। দুপুরের রোদে ঘাসে লেগে আছে হলুদের টান, দূরে কয়েকজন কিশোর বাঁশের কাঠামোয় ঝুলিয়ে চৌ নাচের মুখোশ শুকোচ্ছে। ইরা কাছ গিয়ে দেখল—মুখোশের চোখ দুটো বাঁকা, পাতলা দাগে আঁকা জ্যোৎস্নার মতো হাসি। ছেলে বলল, “চৌ-নাচ হবে পূর্ণিমায়। শহর থেকে ফটোগ্রাফার আসবে। আপনারা থাকবেন?” সুব্রত ইরার দিকে তাকাল। ইরা হাসল, “থাকতে চাই। চৌ নাচ তো কেবল নাচ নয়, একটা জায়গার শ্বাস।” মুখোশ বানানো ছেলেটা খুশি হয়ে বলল, “এই শ্বাসই তো কেউ কেটে নেয় রাতে—গাছ কেটে, মানুষ কেটে—কখনও নাচের গান বন্ধ করে।”

সন্ধের পর হোমস্টেতে বসে চা খেতে খেতে আলোক বললেন, “শুনুন, ধর মল্লিক শুধু কাঠের ব্যবসায় নেই। ওর সঙ্গে বড় বড় লোক জড়িত। শুনতে পাবেন, বেসরকারি স্টিল-প্রোজেক্ট আসছে এদিকে। সেই আগেই রাস্তা, সেই আগেই জঙ্গল পাতলা। খবর করলে সাবধানে করবেন। শহরের কাগজে নাম গেলে গ্রামটার ওপর যেন বোঝা না হয়।” ইরা নিঃশব্দে মাথা নেড়ে বলল, “আমি বুঝি। খবরের শব্দ যদি মাটির চেয়ে উঁচু হয়, তবে সেই শব্দ মাটি আর শিকড়কে মাড়িয়ে যায়।” মিতা হেসে দিলেন, “আপনি শহর থেকে এসেও মাটির কথা জানেন। তাই তো আপনার থাকা ভালো লাগছে।”

রাত নেমে এল ধীরে। শালপাতায় হাওয়া, দূরে ঢোলের নরম টান, কোনো একটা বাড়ির উঠোনে কেউ শিশুকে ঘুম পাড়াচ্ছে। ইরা জানলার ধারে বসে খালি পায়ে মাটিতে ছোঁয়া রেখে ডায়রি খুলল। সে লিখল—“আজ বুঝলাম, প্রতিরোধ নামে একটা শব্দ শুধু মানুষের হাতে নয়, পাতার শিরাতেও লেখা থাকে। একটা গাছ পড়ে গেলে যে ফাঁকা জায়গা তৈরী হয়, সেটাকে শুধু কাঠের গন্ধ দিয়ে ভরা যায় না, সেখানে ভেসে থাকে মানুষের হারানো ছায়া। সুব্রত বলেছিল—আমরা ছায়া। কিন্তু ছায়াও তো আলো দরকার। আলো যদি কেবল টর্চের হয়, তবে ছায়া টেকে না।”

ঠিক তখনই দরজায় টোকা। সুব্রত। হাতে একটা পুরোনো ফাইল-ফোল্ডার, রবার দিয়ে বাঁধা। “এটা রাখুন,” সে বলল। “আমি চাষের পাশাপাশি একটা কাজ করি—জায়গার কাগজ বুঝি। বনের ধারেকাছের যে জমিগুলো আছে, সেগুলো নিয়ে কিছু সময় ধরে লোকজন ঘুরছে। কতদিন আগের দলিল, কতদিনের বনভূমি—সব মেশানো আছে। আপনি সংবাদ করেন বলেই দিচ্ছি না, আপনি শুনতে পারেন বলে দিচ্ছি। লিখবেন কি না বলবেন না এখনই।” ইরা চমকে ফোল্ডার নিল। পুরোনো কাগজে সেপিয়া দাগ, কোথাও সই, কোথাও থানা সীল। একটা ফটোকপির ধার বইছে, তার ওপর কালচে হাতের লেখা—“ফরেস্ট ডিমারকেশন, ২০০৩—বাউন্ডারি পিলার নং ১৭-২২।” ইরা বুঝল, এ কাগজগুলো একেকটা সুতো, যা ধরে টানলে একটা ঘোলাজাল বেরোবে।

“আপনি কেন আমাকে দিচ্ছেন?” প্রশ্নটা হালকা হাওয়ার মতো বেরোল। সুব্রত একটু থেমে বলল, “কারণ আপনি শহরের, কিন্তু শহরের লোক নন—আপনি শুনতে চান। আমরা এখানে যত দিন বসবাস করি, তত দিন শিখি যে কীভাবে একই সঙ্গে ভয় পেতে হয় আর লড়তে হয়। আপনার কাছে ভয়টা ভাগ করে দিলাম।” ইরা তাকিয়ে দেখল, সুব্রতের চোখে আজ রাতের টর্চের আলো নেই; সেখানে একটা নরম, দূর স্থিরতা। যেন সে জানে, পথটা বিপজ্জনক, তবু হাঁটা ছাড়া উপায় নেই।

সেই রাতে ইরা আর ঘুমোতে পারল না। ফাইল খুলে একেকটা কাগজে আঙুল রেখে সে পড়ল—জমির খতিয়ান, বনের নোটিশ, চৌ নাচের মাঠের পাশ দিয়ে কাটতে থাকা একটা পরিকল্পিত রাস্তার ম্যাপ, যেখানে ছোট্ট ডটেড লাইনে লেখা—“প্রস্তাবিত ডাইভারশন”—যেন কারও অন্যমনস্ক কলমে কেউ বলেছে, “এখানটা এড়িয়ে যান।” কিন্তু এড়ানো যায় কি? ডটেড লাইন তো একদিন সলিড হয়ে যায়, যেমন গুজব একদিন ঘোষণায় পরিণত হয়। তার কলম দপদপ করে উঠতে চাইছিল; সাংবাদিকতা তার পেশা, অথচ এই মুহূর্তে সে কেবল একজন শ্রোতা হতে চায়। তাকে শুনতে হবে পাতার আওয়াজ, দলের লোকদের নাম না-লেখা ভয়, ধানের ক্ষেতে নেমে আসা সাদা কুয়াশার মতো টলমলে সংবাদ—সবটাই আগে কানে নিতে হবে, তারপর শব্দে বসাতে হবে।

ভোরের আগে আবারও গ্রামটার দিকে নেমে এল এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। যেন রাত বলছে—আজ আর টর্চ নয়, আজ তোমাদের ভিতরের আলো জ্বেলো। ইরা বাইরে বেরিয়ে এল। শালগাছের মাথায় ভোরের প্রথম আভা, পাখির ডাকে আলোটা একটু একটু করে ঘন হচ্ছে। দূরে হাঁটু-সমান কুয়াশায় মানুষ হেঁটে যাচ্ছে। সে ভাবল, “চৌ নাচের পূর্ণিমা আসছে—তার আগে আমি এই জায়গাটার গানটা শিখে নিতে চাই। গান বুঝলে হয়তো যুদ্ধটা বোঝা যায়।” তার চোখে পড়ল, রাস্তায় হাটুরলাঠি হাতে প্রভাকর মাহাতো হাঁটছেন, পাশে দু’জন কিশোর—রাতের পাহারাদারির নতুন দল। ইরা ফাইলটা বুকে চেপে ধরল—কাগজের শিরিষ-ধুলো গায়ে লেগে রইল।

দুপুরে সুব্রত এসে বলল, “আজ বিকেলে আপনাকে একটা জায়গায় নিয়ে যাব—ছায়ার বাগানের ভেতর একটা পুরোনো ইটের চৌকি আছে। লোকজন বলে, সেখানে বসলে যে-প্রশ্ন মাথায় আসে তার জবাব দূরের বাঁশিপথ থেকে ভেসে আসে। বিশ্বাস করবেন না, তবু একবার শুনে দেখুন।” ইরা হাসল, “প্রশ্ন তো অনেক। জবাবও যদি আসে, তাহলে গল্প লেখা সহজ হবে।” সুব্রত মাথা নাড়ল, “গল্প সহজ হলে আমরা নাচবো। আর যদি না-ও হয়, জঙ্গলের পাতায় যে-লিখন আছে, সেটা পড়তে শিখবেন।”

বিকেলে দুইজন ঢুকে পড়ল ছায়ার বাগানে। শালপাতার মধ্যিখানে নরম আলো, মাটিতে শুকনো ফুলের পুরোনো গন্ধ, কোথাও ফেলে রাখা একখানা টিনের ডিব্বা—মনে হল কেউ পিকনিক করে রেখে গেছে, কিন্তু ফেরেনি আর। ইরা বুঝতে পারল, সে আসলে এক শহুরে ভ্রমণকারী নয়; সে এক ক্রমশ-জড়ানো সুতোর মধ্যে ঢুকে পড়া মানুষ, যে হাত দিয়ে গিঁটের চামড়া স্পর্শ করছে। পুরোনো ইটের চৌকিতে বসতেই দূর থেকে ভেসে এল একটা বাঁশির সুর। কার সুর? কে বাজায়? সুব্রত ফিসফিসিয়ে বলল, “ওই যে ধানক্ষেতের দিকটা—শিশির পড়ছে; সেই শিসির টুপটাপে সুর মেলে।”

ইরা চোখ বন্ধ করল। প্রশ্ন মাথায় এলো একে একে—“ধর মল্লিকের জাল কোথায় শুরু? প্রভাকর মাহাতোর হাতে কতখানি ক্ষমতা? এই বনের আইন কাগজে লিপিবদ্ধ, কিন্তু মানুষের শরীরে কি লেখা নেই? আর সবচেয়ে বড়, গল্পের ভেতরে আমার থাকা কি নিরাপদ?” বাঁশির সুর যেন একটা উত্তর দিল—“নিরাপদ কথা জিজ্ঞেস কোরো না। পথ কীরকম তা বোঝার চেষ্টাই তো যাত্রা।”

সন্ধের ঠিক আগে যখন তারা ফিরছিল, দূরে কাঁচা রাস্তার ধুলোয় দেখা গেল একদল বাইক এসে থেমেছে। গায়ে চকচকে হেলমেট, চোখে সানগ্লাস, হাসির ভেতরে মোচড়ানো অবজ্ঞা। তাদের একজন দূর থেকে হাত নেড়ে বলল, “এই যে ফুলওয়ালা, আজকাল শহরের মেয়েদের নিয়ে বন ঘোরা শুরু করেছ? সাবধানে থাকা উচিত।” কথাটা আকাশে থাপ্পড়ের মতো এসে পড়ল। সুব্রত থামল না, শান্ত গলায় বলল, “জঙ্গল সবার, পথও সবার। আপনারা পথ আটকে দাঁড়ালে রাস্তা মার্কা পড়ে যায়।” লোকটা হেসে উঠল, “রাস্তা মার্কা তো হবেই—নতুন রাস্তা হবে তো।” তারপর এক চালাকি ভরা চোখ ইরার দিকে—“ম্যাডাম, ভালো ছবি তোলেন? নইলে কাজ হবে না।” তারা ধুলো উড়িয়ে চলে গেল।

ইরা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। বুকের মধ্যে কাগজের ফাইলটা কেঁপে উঠল যেন। সে জানল, পরের পূর্ণিমার আগে তাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে—সে শুধু ভ্রমণকারী থাকবে, না কি গল্পকার-শ্রোতা-সাক্ষী হয়ে উঠবে। আর ঠিক সেই মুহূর্তে শালবনের পাতায় বাতাস বয়ে গেল, শব্দ হল—একটা পাতার, আরেকটা পাতাকে ছুঁয়ে দেওয়া। যেন বনের ভাষায় বলা হলো, “লেখো। যতটা দেখে, ততটাই শোনো।”

রাত নামল আবার। কিন্তু আজ রাতের ভেতরে একটা ক্ষুদ্র জোনাকি জ্বলছে—ইরার ডায়রির পাতায়, সুব্রতের হাতের কাছে, আলোক-মিতার চায়ের কাপে। দূরে, অদৃশ্য ডটেড লাইনের ওপরে অন্ধকারের কলম চলতে চাইছে; আর এখানে, শালবনের ছায়ায় কেউ একজন প্রথম বাক্যটা লিখে ফেলেছে।

পর্ব ৩: বনের কাগজ, শহরের খবর

ইরা সেই রাতটা প্রায় পুরোটা জেগেই কাটাল। খোলা ফাইলের কাগজগুলো টেবিলের ওপর ছড়ানো ছিল—পুরোনো কালি, ফিকে সীল, হাতের লেখার জট। প্রতিটা দলিল যেন একেকটা বীজ, মাটির নিচে লুকিয়ে থাকা অতীতের গোপন গাছ। জানলার বাইরে শালপাতায় হাওয়ার টান লেগে শোঁ শোঁ শব্দ হচ্ছিল। শব্দটা যেন কাগজের ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া অদৃশ্য পায়ের শব্দ।

ভোর হতেই সে নোটবুক হাতে নিয়ে হাটের দিকে বেরোল। আজ হাটে জমবে বেশি ভিড়, শুনেছিল। রোদ ওঠার আগেই মাঠ ভর্তি হয়ে গিয়েছিল—ধানের বস্তা, আলুর ঝাঁপি, বেতের ঝুড়ি, আর হরেক রকম রঙিন শাড়ি। গন্ধ ভেসে আসছিল শুকনো মাছ আর মহুয়ার মিশ্রণে। ইরা হাঁটতে হাঁটতে মানুষের কথোপকথন শুনছিল।

“কাজ হবে নাকি?”
“রাস্তা হবে, টাকা আসবে।”
“কিন্তু বন কাটলে বৃষ্টি কমে যাবে।”
“এখন বৃষ্টি কে দেখে? বাজারে চালের দামই মুখ্য।”

প্রতিটি বাক্য যেন ফাইলের কাগজের পাশে আরেকটা মন্তব্য লিখে দিচ্ছিল। সে বুঝতে পারল—গ্রামের মানুষদের ভিতরে দ্বন্দ্ব চলছেই। কেউ লড়াই চায়, কেউ টাকার লোভে নীরব। এই নীরবতাই সবচেয়ে ভয়ানক, বুঝতে পারল ইরা।

হাটে হঠাৎ দেখতে পেল সুব্রতকে। তার হাতে ছিল গাঁদাফুলের মালা। ইরাকে দেখে এগিয়ে এসে বলল, “আজ একটা মেলা হবে, নাচ-গান। শহর থেকে লোক আসবে। আপনি যাবেন?”
ইরা হেসে বলল, “যাব। তবে তার আগে এই কাগজগুলো নিয়ে আপনাকে কিছু বলতে হবে।”
সুব্রত ভুরু কুঁচকে তাকাল। “সব দেখেছেন?”
“হ্যাঁ। এগুলো শুধু জমির দলিল নয়, এ হলো গ্রামের ভবিষ্যতের কাগজ। যদি এগুলো বাইরে প্রকাশ পায়, তবে কারা লাভবান হবে, কারা বিপদে পড়বে—সেটা ভাবা দরকার।”

সুব্রত কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর ধীরে ধীরে বলল, “আমাদের ভয় আছে। আমরা জানি কোন দিক থেকে ঝড় আসছে, কিন্তু বললে মাথার ওপর দিয়ে গাছ পড়তে পারে। তাই আমরা চুপ করি। কিন্তু আপনি শহরের মানুষ, আপনার বলার ভাষা আছে। আপনি কি বলবেন?”
ইরা সোজাসুজি উত্তর দিল না। কেবল মাথা নুইয়ে বলল, “শোনার আগে আমি বলব না। আজকের মেলা দেখি আগে।”

বিকেল গড়িয়ে সন্ধে নামতেই মেলার মাঠ ভরে উঠল। বাঁশের কাঠামোয় রঙিন আলো জ্বলছিল, ঢোল আর বাঁশির সুর ভেসে আসছিল। মেয়েরা নাচের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল—রঙিন ঘাগরা, চোখে কাজল। চারপাশে মানুষের ভিড়, শিশুরা কটকটি কিনছে। ইরার মনে হচ্ছিল—এই তো আসল পুরুলিয়া, গান আর নাচের ভেতরে বেঁচে থাকা মানুষের স্পন্দন।

কিন্তু ভিড়ের ভেতর দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকটা মুখ অন্যরকম লাগছিল। চকচকে শার্ট, চোখে সানগ্লাস, হাতে মোবাইল। তারা নাচ দেখছিল না, বরং লোকজনের ভিড় মাপছিল। ইরার চোখে পড়ল—তাদের একজন সুব্রতের দিকে ইশারা করে কিছু বলল।

নাচ শুরু হতেই ঢোলের শব্দে মাটি কেঁপে উঠল। মেয়েদের পায়ের ঘুঙুর যেন বনজুড়ে বাজছিল। ইরা মোহিত হয়ে গেল। সে ভুলেই যাচ্ছিল শহর, কাগজ, দলিল। কিন্তু সেই সময়ই আচমকা আলো নিভে গেল কয়েক মিনিটের জন্য। ভিড়ের মধ্যে গণ্ডগোল শুরু হলো। কেউ ঠেলাঠেলি করছে, কেউ দৌড়চ্ছে। আলো ফের আসতেই দেখা গেল, সুব্রতের ফুলের ঝাঁপি উল্টে মাটিতে পড়েছে, আর সে নিজে দাঁড়িয়ে আছে রাগে গরম মুখে।

“কে করেছে?” গর্জে উঠল সে।
ভিড়ের ভেতর থেকে একটা গলা এল—“ফুল দিয়ে কি হবে? আসল কাজ হলো রাস্তা।”

ইরা ঠাহর করতে পারল না কে বলল। কিন্তু তার বুক কেঁপে উঠল। সে টের পেল—এ শুধু নাচের মেলা নয়, এটা একপ্রকার যুদ্ধক্ষেত্র। লোকজন হাসছে, নাচছে, কিন্তু অদৃশ্য তলোয়ার ঘুরছে চারপাশে।

রাত শেষে যখন সবাই ফিরে যাচ্ছিল, ইরা হাঁটছিল সুব্রতের পাশে। সে তখনো চুপ। অবশেষে বলল, “আপনি বুঝলেন তো? এরা শুধু ভয় দেখাচ্ছে না, এরা আমাদের ভেতরের গানটাকেও ভাঙতে চাইছে।”
ইরা ধীরে বলল, “হ্যাঁ। আমি বুঝলাম।”

পরদিন সকালে ইরা ঠিক করল কলকাতায় ফোন করবে তার অফিসে। হয়তো রিপোর্ট পাঠানো দরকার। কিন্তু হোমস্টের বারান্দায় বসে যখন ফোন কানে নিল, তখনই মিতা এসে চুপ করে তার কাঁধে হাত রাখলেন।
“দিদি, খুব লিখবেন না। বেশি লিখলে এই গ্রামকে কেউ চিনতে চাইবে না। আপনি যা দেখেছেন, সেটা হৃদয়ে রাখুন, তবেই লিখবেন।”

ইরা হতচকিত হয়ে গেল। “আপনি চাইছেন আমি না লিখি?”
মিতা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। “না, লিখুন। কিন্তু যতটা প্রয়োজন, ততটাই। বনের গান কাগজে নামলেই অনেক সময় বনকে পুড়িয়ে দেয়। সেটা যেন না হয়।”

ইরা থেমে গেল। জানালার বাইরে শালপাতা আবারও কাঁপছিল। সেই কাঁপন যেন তাকে বলছিল—“সব লিখো না। যা লিখতে হবে, সেটা শোনো আগে।”

দুপুরে সুব্রত আবার এল। হাতে একটা বাঁশির খোল। সে বলল, “কাল রাতে চৌ নাচের সময় যে বাঁশি বাজছিল, সেটা এই গ্রামের বুড়ো গোপালের। উনি বললেন, আপনাকে দিয়ে দিতে। কারণ আপনার শোনার কান আছে।”
ইরা বাঁশিটা হাতে নিল। পুরোনো বাঁশ, কিন্তু ভেতরে যেন কোনো শব্দ আটকে আছে। সে কানে লাগাতেই মনে হলো—দূরের গাছপালার কোলাহল গলে এসে ঢুকছে ভেতরে।

সুব্রত তাকিয়ে বলল, “এ বাঁশির সুরে আপনি হয়তো উত্তর পাবেন।”
ইরা হেসে বলল, “তাহলে এবার আমি শোনার মানুষ, লেখার আগে।”

সেই রাতেই আবার খবর এল—ধর মল্লিকের লোকজন গ্রামে ঢুকেছে। তবে এবার গাছ কাটেনি, তারা পঞ্চায়েত ঘরে বসে সভাপতি প্রভাকর মাহাতোর সঙ্গে কথা বলেছে। কেউ বাইরে থেকে দেখেছে, কেউ শুনেছে। কিন্তু আসল কথা কেউ জানে না।

ইরা জানল—এইখানেই গল্প ঘনীভূত হচ্ছে। বন, মেলা, নাচ, দলিল—সব মিলেমিশে একটা সত্য দাঁড়িয়ে যাচ্ছে, যা লিখলে ঝড় আসবেই। কিন্তু না লিখলেও ঝড় থামবে না।

সে ডায়রিতে লিখল—
পুরুলিয়ার আকাশে আজকাল চাঁদ উঠলেও তার আলো পুরোপুরি পৌঁছায় না। মাঝে এসে দাঁড়ায় ব্যবসার ছায়া। তবু মানুষের নাচ, বাঁশির সুর সেই ছায়ার ভেতরেও আলো ফোটায়। আমি লিখব। কিন্তু সেই আলো যেন ছায়াকে ভেঙে দেয়, বনকে নয়।”

এভাবেই তার ভিতরে সিদ্ধান্ত পাকতে শুরু করল।

পর্ব ৪: পঞ্চায়েত ঘরের দরজা

প্রভাকর মাহাতোর পঞ্চায়েত ঘরটা গ্রামের মাঝখানে—পাকা দালান নয়, ইট-সিমেন্টে তৈরি চারচালা একতলা, সামনের বারান্দায় দু’টো চেয়ারে সবসময় কেউ না কেউ বসে থাকে। ঘরের ভেতর পুরোনো কাঠের টেবিল, চারটে চৌকি, আর দেওয়ালে ঝুলছে নেতার ছবি—মলিন হয়ে যাওয়া ফ্রেমে সোনালি গিল্টার কেটে বেরিয়েছে কাঠের আসল গা। এখানেই প্রতিদিন জমে ওঠে গ্রামের খবর, বিচার, লেনদেন।

সেদিন সকালে ইরা গিয়ে দাঁড়াল বারান্দায়। ভেতরে তখনো বৈঠক শুরু হয়নি। বাইরে কয়েকজন লোক গালগল্প করছে—কে কত দামে ধান বিক্রি করবে, কে আবার শহরে কাজ খুঁজতে যাবে। ইরা খেয়াল করল, কথার ফাঁকেই লোকজন বারবার চোখ ফেরাচ্ছে পঞ্চায়েত ঘরের ভেতরের দিকে, যেন ভেতর থেকে কিছু বেরোবে।

ঠিক তখনই একটা জিপ এসে থামল। ধুলো উড়িয়ে নামল তিনজন—চকচকে জামা, এক জনের গলায় সোনার চেইন। সবার মাঝখানে দাঁড়িয়ে রইল মোটা দেহের এক ব্যক্তি—চওড়া কাঁধ, চোখে কালো সানগ্লাস। ইরা ছবিতে দেখেছে আগে—এই হলো ধর মল্লিক। তার হাত নেড়ে ওঠার ভঙ্গিটা যেন অভ্যাসে গাঢ় হয়ে গেছে—কারও দিকে বিশেষ না তাকিয়েও লোকজনকে যেন আদেশ করছে।

লোকজন সরে দাঁড়াল। ধর মল্লিক ঢুকে গেল ভেতরে। দরজা বন্ধ হল। বাইরের ভিড়ে গুঞ্জন ছড়িয়ে গেল—“আজ ঠিক হবে… রাস্তার ব্যাপার।” কেউ আবার ফিসফিস করে বলল, “প্রভাকর কিছু বলবে তো?” আরেকজন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “বলার ক্ষমতা ক’জনের আছে?”

ইরা নোটবুক বের করতে গিয়েই থেমে গেল। সুব্রত তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। নিচু গলায় বলল, “দেখছেন তো? এখন যা হবে, তা কেউ লিখে রাখতে চাইবে না।”
ইরা উত্তর দিল, “তাই তো লিখতে হবে।”

ঘন্টার খানেক পরে দরজা খুলল। প্রভাকর মাহাতো বেরিয়ে এলেন, মুখে ক্লান্তি মিশ্রিত একধরনের নিরুপায়তা। ধর মল্লিক হেসে বেরিয়ে এল, লোকজনের সঙ্গে হাত মেলাতে মেলাতে গলির দিকে চলে গেল। লোকজন ভিড় করে প্রশ্ন করতে লাগল—“কি হল? রাস্তা হবে তো?” প্রভাকর শুধু বললেন, “আলোচনা হয়েছে, সিদ্ধান্ত আসবে পরে।”

কিন্তু ইরার চোখ এড়িয়ে গেল না—প্রভাকরের কপালে ঘাম জমে আছে, গলার কাছের শিরা কেঁপে উঠছে। সে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, “আপনি কি সত্যিই সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন, নাকি চাপ দেওয়া হচ্ছে?” প্রভাকর চমকে তাকাল। তার চোখে একমুহূর্তের জন্য ভেসে উঠল ভয়ের রেখা। তারপরই ধপাস করে বসে পড়লেন বারান্দার চেয়ারে।

“আপনি শহরের মানুষ,” তিনি ধীরে বললেন। “সবকিছু কি এত সোজা মনে হয়? এখানে আমরা বাঁচি বন দিয়ে, মাটি দিয়ে। কিন্তু যে-রাস্তাটা বানাতে চাইছে ওরা, সেটা না হলে আমাদের ছেলেরা কাজ পাবে না। সরকারি কাগজপত্র তো ওদের হাতে। আমরা না বললে আমাদের নাম কেটে দেওয়া হবে তালিকা থেকে। কী করব বলুন?”

ইরা চুপ করে শুনছিল। এই দ্বন্দ্বটাই সে লিখতে চেয়েছিল। বনের ছায়া আর শহরের উন্নয়ন—দুটোই দরকার, কিন্তু একসঙ্গে দাঁড় করানো যায় না।

ঠিক তখনই গ্রামের কয়েকজন যুবক হট্টগোল করতে করতে এসে দাঁড়াল। তারা বলল, “আমরা চাই রাস্তা হোক। কাজ পাব, বাজারে যাওয়া সহজ হবে।” অন্য একদল চিৎকার করে উঠল, “কিন্তু বন কেটে রাস্তা করলে আমাদের ছায়া যাবে, মাঠে পানি কমবে। তখন খেতে ধান ফলাবেন কিভাবে?” মুহূর্তে পঞ্চায়েত ঘরের সামনে দ্বন্দ্ব বাঁধল।

সুব্রত এগিয়ে গেল। “সবাই শুনুন,” সে গলা উঁচু করল। “বন কেটে রাস্তা হলে কাজ মিলবে ঠিকই, কিন্তু কটা বছর? পাঁচ বছর, দশ বছর? তারপর রাস্তা থাকবে, কিন্তু মাটি থাকবে না। আপনারা তখন আবার শহরে কাজ খুঁজতে যাবেন। এই বন যদি টিকে থাকে, তা হলে ছায়া, জল, বৃষ্টি সব থাকবে।”

লোকজন দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে গেল। ইরা এই দৃশ্য দেখে লিখতে শুরু করল নোটবুকে। তার মনে হচ্ছিল—এই মুহূর্তটাই হয়তো তার প্রথম রিপোর্টের মেরুদণ্ড হবে।

বিকেলে হোমস্টেতে ফিরে সে ল্যাপটপ খুলল। রিপোর্টের শিরোনাম দিল—ছায়ার বাগানে নতুন রাস্তার ছায়া”। সে লিখতে লাগল কিভাবে ধর মল্লিকের মতো ব্যবসায়ী গ্রামের মাটিতে পা রেখেছে, কিভাবে মানুষ বিভক্ত হয়ে পড়ছে উন্নয়ন আর প্রকৃতির লড়াইয়ে। সে প্রভাকরের দ্বন্দ্বটাও লিখল—“পঞ্চায়েত প্রধান জানেন বন হারালে বাঁচা কঠিন, কিন্তু রাস্তা চাইছে তার নিজের মানুষ। দু’দিকেই ফাঁস।”

রাতের খাওয়ার সময় আলোক বলল, “শুনলাম আপনি রিপোর্ট লিখছেন। সাবধানে থাকবেন। এখানে খবর বাইরে গেলে আমাদের নামও জড়াবে।”
ইরা শান্ত গলায় উত্তর দিল, “আমি কারও নাম লিখছি না। শুধু ঘটনার কাহিনি লিখছি। এই বন যদি হারায়, তবে শহরের মানুষও একদিন বুঝবে কিসের ক্ষতি হল।”

সেদিন রাতে আকাশে মেঘ জমেছিল। বিজলির আলোয় শালগাছের ছায়া আরও গাঢ় হয়ে উঠছিল। ইরা বারান্দায় বসে ভাবছিল—তার লেখা কাগজে ছাপা হলে কাকে আঘাত করবে? বনকে রক্ষা করবে তো? নাকি গ্রামকে আরও বিপদে ফেলবে?

ঠিক তখনই সুব্রত এসে বলল, “আজকে আপনি যা লিখলেন, সেটা কাল শহরে ছাপা হলে মল্লিকরা জানবে। তখন ওরা এখানে আসবে আরও রাগ নিয়ে। আপনি কি ভেবেছেন?”
ইরা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “হ্যাঁ। ভেবেছি। তবু লিখব। কারণ এই লড়াই শুধু আপনারা করছেন না, আমিও করছি—শব্দ দিয়ে।”

সুব্রত দীর্ঘশ্বাস ফেলল। “তাহলে প্রস্তুত থাকুন। পূর্ণিমার চৌ নাচের রাতে হয়তো আসল ঝড় নামবে।”

ইরা বাঁশিটা বের করে কানে লাগাল। শিসের ভেতর থেকে যেন ভেসে এল বনের নিঃশ্বাস। তার মনে হল—হয়তো এই সুরই তাকে সাহস জোগাবে।

পর্ব ৫: পূর্ণিমার আগুন

রিপোর্টটা ছাপা হলো তৃতীয় দিনেই। কলকাতার এক নামী দৈনিক—প্রথম পাতায় নয়, তবে ভেতরের পাতায় বড় কলামে জায়গা পেল। শিরোনাম ছিল:
শালবনের বুকে রাস্তার ছায়া: পুরুলিয়ার দ্বন্দ্ব”

ইরা জানত শহরের কাগজে সব খবর মানুষের চোখে পৌঁছায় না। তবু সে চমকে গেল যখন সকালে হোমস্টের উঠোনে দুইজন ছাত্র সাইকেল নিয়ে হাজির হয়ে বলল, “দিদি, আপনার ছবি আমরা কাগজে দেখেছি। আপনি কি ইরাদি?” তাদের কণ্ঠে শ্রদ্ধা মিশ্রিত কৌতূহল, কিন্তু সঙ্গে ভয়ের রেখাও।

মিতা সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, “দেখলেন তো? আজ থেকে আপনাকে সবাই চিনবে। এখন সাবধানে থাকতে হবে।”

বিকেলের দিকেই অশান্তির খবর ছড়াল। ধর মল্লিকের লোকেরা হাটের কাছে এসে চেঁচামেচি করেছে, কাগজ ছিঁড়ে আগুনে ফেলে দিয়েছে। তাদের মুখে ছিল একই কথা—“শহরের সাংবাদিক এসে আমাদের নামে মিথ্যা লিখছে।”

সুব্রত খবরটা নিয়ে ছুটে এল। তার চোখে রাগের আগুন। “আমি জানতাম,” সে বলল, “এমন হবে। কিন্তু ভয় পাবেন না। যারা সত্যি বোঝে তারা আপনাকে পাশে পাবে।”

ইরা তার দিকে তাকাল। “তোমরা কি সত্যিই পাশে দাঁড়াবে? যদি তারা আক্রমণ করে?”
সুব্রত নির্ভীক কণ্ঠে বলল, “বনের ছায়া কি কখনো একা থাকে? প্রতিটা গাছের শিকড় অন্য গাছের শিকড়ের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে। আমরাও তেমনি।”

এদিকে গ্রামে ভেদরেখা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। একদল মানুষ বলছিল, “ইরাদি আমাদের কণ্ঠকে কাগজে তুলেছে।” আরেকদল গর্জে উঠছিল, “উনি বাইরের লোক, উনি লিখে দিয়ে গেছেন আমাদের বিপদ ডাকতে।”

প্রভাকর মাহাতো সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়লেন। পঞ্চায়েত ঘরের সামনে এসে তাঁকে অনেকে জেরা করল—“আপনি কেন সাংবাদিককে সব দেখালেন?” প্রভাকর কেবল মাথা নেড়ে বললেন, “আমি কিছুই দেখাইনি। উনি নিজেই লিখেছেন।” কিন্তু চোখে ধরা পড়ছিল তার ক্লান্তি, এবং এক অদৃশ্য ভয়।

রাত নামতেই চারদিকে টানটান নিস্তব্ধতা। পূর্ণিমার আলোয় শালবনের গায়ে সাদা ছায়া পড়ছিল। এই ছায়ার ভেতরে ইরার মন কাঁপছিল—আজই যদি তারা আসে? যদি হোমস্টেতে ঢুকে পড়ে?

কিন্তু সেই রাতটা অশান্ত হয়নি। বরং আশ্চর্যজনকভাবে চৌ নাচের প্রস্তুতির শব্দ ভেসে আসছিল দূরের মাঠ থেকে। বাঁশির সুর, ঢোলের তাল। ইরা জানত, পূর্ণিমার রাতেই হবে আসল বিস্ফোরণ।

পরদিন সকালেই সুব্রত এসে বলল, “আজ রাতে চৌ নাচ। তবে এবার শুধু নাচ নয়, প্রতিবাদও হবে।”
“প্রতিবাদ?” ইরা চমকে উঠল।
“হ্যাঁ। গ্রামের যে-দল বাঁচাতে চায় বন, তারা নাচের মধ্যেই জানাবে নিজেদের কথা। আপনি থাকবেন। লিখে রাখবেন।”

দিনটা যেন অস্থিরতায় ভরে উঠল। দুপুর থেকে মেলা বসতে শুরু করল। মাঠে খেজুরপাতার ছাউনি দেওয়া দোকান, মহুয়ার হাড়ি, বাঁশির দোকান, খেলনা। লোকজন হাসছে, অথচ তাদের চোখের ভেতর একটা গোপন উদ্বেগ জমে আছে।

ইরা মাঠে গিয়ে দাঁড়াল। তার পাশে দাঁড়াল সুব্রত। দূরে দেখতে পেল প্রভাকর মাহাতো বসে আছেন এক কোণে, মুখে গাম্ভীর্য। আরেক প্রান্তে দাঁড়িয়ে ধর মল্লিকের কয়েকজন লোক—চকচকে পোশাক, হাতে মোবাইল, চোখে হালকা অবজ্ঞা।

সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হলো নাচ। মেয়েরা সাজল রঙিন পোশাকে, মুখে রঙিন মুখোশ। ঢোল বাজতেই মাঠ কেঁপে উঠল। আলোর নিচে ঘুরপাক খেতে লাগল শরীর, ঘুঙুরের শব্দে মিশে গেল পায়ের ধুলো।

ইরা মুগ্ধ হয়ে দেখছিল। হঠাৎই নাচ থেমে গেল মাঝপথে। এক তরুণী মুখোশ খুলে সামনে এগিয়ে এলো। সে জোরে বলল, “আমরা চাই বন বাঁচুক। এই মাটির ছায়া ছাড়া আমাদের গান থাকবে না।”

মুহূর্তে মাঠে গুঞ্জন ছড়িয়ে গেল। ঢোল থেমে গিয়েছিল, কিন্তু মানুষের হৃদস্পন্দন যেন বাজছিল আরও জোরে। সুব্রত উঠে দাঁড়াল। সেও বলল, “রাস্তা যদি হয়, হোক। কিন্তু বন না কেটে। বনের পাশ দিয়ে হোক, বনের বুক চিরে নয়।”

এই ঘোষণায় অস্থির হয়ে উঠল ধর মল্লিকের লোকেরা। তাদের একজন চেঁচিয়ে উঠল, “এইসব নাটক শহরের সাংবাদিকের জন্য। আমরা কাজ আনব, উন্নয়ন আনব। যারা বাঁধা দিচ্ছে, তারা গ্রাম শত্রু।”

চেঁচামেচি বাড়তে লাগল। হঠাৎই এক লোক মাটিতে মশাল ছুড়ে দিল। শালপাতা শুকনো ছিল, সঙ্গে সঙ্গে আগুন জ্বলে উঠল। মাঠে আতঙ্ক ছড়িয়ে গেল। নারী-শিশু দৌড়ে পালাতে লাগল।

ইরা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তার চোখের সামনে আগুন লেলিহান হয়ে উঠছিল, আর চারপাশে ছুটোছুটি। সুব্রত তার হাত ধরে টেনে নিল, “চলুন, এখানে দাঁড়ালে বিপদ।”

কিন্তু ইরা ফিসফিস করে বলল, “না, আমাকে দেখতে হবে। আমি না দেখলে কে লিখবে?”

সুব্রত তার হাত শক্ত করে ধরে টেনে নিয়ে গেল মেলার প্রান্তে। দূরে দাঁড়িয়ে তারা দেখল—আগুনের আলোয় নাচের মাঠ যেন যুদ্ধক্ষেত্র। কেউ মশাল ছুঁড়ছে, কেউ পানি ঢালছে, কেউ দৌড়চ্ছে। ঢোলের শব্দ মিলিয়ে গেছে আতঙ্কে।

প্রভাকর মাহাতো দাঁড়িয়ে চিৎকার করছিলেন, “থামাও, সবাই থামাও!” কিন্তু কেউ শুনছিল না।

ঠিক তখনই ইরা মনে করল বাঁশিটার কথা। সে ব্যাগ থেকে বাঁশি বের করে কানে লাগাল। আশ্চর্য—তার ভেতরে যেন বনের একটা সুর গুনগুন করছিল। আগুনের লেলিহান শব্দের ভেতরেও সে শুনতে পাচ্ছিল পাতার ফিসফিসানি—“সব লিখে রাখো। ভয় পেও না।”

রাত গভীর হলো। আগুন শেষ পর্যন্ত নিভল, কিন্তু মাঠ ছাই হয়ে গেল। নাচ অসমাপ্ত থেকে গেল।

সেদিন রাতেই ইরা লিখল—
পূর্ণিমার আলোয় পুরুলিয়ার আকাশ রক্তে রঙিন হয়ে উঠল। উন্নয়ন আর প্রকৃতির লড়াই শুধু কাগজে নয়, মানুষের শরীরে আগুন হয়ে নেমে এলো। এই আগুন যদি ছড়ায়, তবে ছাই হয়ে যাবে শুধু বন নয়, মানুষের বিশ্বাসও।”

সুব্রত পাশে বসে বলল, “আপনি দেখলেন তো? এটাই শুরু।”
ইরা উত্তর দিল, “হ্যাঁ। আর আমার কলমও আজ থেকে শুরু করল নতুন যুদ্ধ।”

দূরে, ছাইয়ের গন্ধে ভিজে থাকা মাঠের ভেতর দিয়ে আবার হাওয়ার ঝাপটা বয়ে গেল। শালবনের ছায়া কাঁপল, যেন ফিসফিস করে বলল—“এখনও শেষ হয়নি।”

পর্ব ৬: পুলিশের লাঠি, বনের শিকড়

পূর্ণিমার রাতের আগুন ছড়িয়ে পড়েছিল শুধু মাঠে নয়, মানুষের গলায়, চোখে, কথার ভেতরেও। সকালে উঠে ইরা দেখল—গ্রামটা যেন নতুন করে গুঞ্জনময়। কারও উঠোনে লোক জড়ো হয়েছে, কেউ বাজারের মোড়ে বসে জোরে জোরে আলোচনা করছে। আগুনের ছাই এখনো ঠান্ডা হয়নি, তবু গরম হয়ে আছে মানুষের রক্ত।

ঠিক তখনই হোমস্টের সামনে এল দুটো পুলিশের ভ্যান। ধুলো উড়িয়ে নামল অফিসার আর কয়েকজন কনস্টেবল। গায়ে হেলমেট, হাতে লাঠি। ইরা চমকে গেল। মিতা রান্নাঘর থেকে ছুটে এসে ফিসফিস করে বললেন, “দিদি, এখন সাবধানে থাকুন। পুলিশ এলে কথাটা ঘুরে যাবে।”

অফিসার সোজা বারান্দায় উঠে এল। “আপনিই সাংবাদিক ইরা সেন?”
ইরা মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ।”
“আপনার লেখা কাগজটা পড়েছি। গতকালের গোলমালের দায়ে আপনার নামও উঠছে। লোকজন বলছে, আপনার লেখার কারণে বাইরের লোক উসকানি পেয়েছে।”

ইরার বুক ধক করে উঠল। সে শান্ত গলায় বলল, “আমি শুধু সত্যি লিখেছি।”
অফিসার কষে হেসে বলল, “সত্যি কি সবসময় শান্তি আনে? কখনও কখনও সত্যিই আগুন ধরায়।”

কনস্টেবলরা হাটে গিয়ে কয়েকজনকে ধরে আনল। চেঁচামেচি, ধস্তাধস্তি। প্রভাকর মাহাতোকেও টেনে নিয়ে এল। লোকজন প্রতিবাদ করছিল—“আমাদের প্রধানকে ছাড়ুন!” কিন্তু পুলিশের লাঠি উঠতেই সবাই সরে গেল।

সুব্রত তখনো কোথাও ছিল না। ইরা ভয়ে কাঁপছিল—যদি ওকেও ধরে নিয়ে যায়?

একটু পরেই দেখা গেল, সুব্রত লোকজনকে নিয়ে হাটের কোণে দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে ছিল একটা বাঁশের লাঠি, কিন্তু সে এগোয়নি। শুধু চিৎকার করে বলছিল, “আমরা কারও শত্রু নই। আমরা চাই বন বাঁচুক।”

পুলিশের ভিড়ে দাঁড়িয়ে থাকা ধর মল্লিকের লোকেরা ঠোঁটে হাসি টানল। তাদের একজন বলল, “এটাই চেয়েছিলাম—এবার সবাই শিখবে কাকে শুনতে হয়।”

দিন গড়াল অস্থিরতায়। প্রভাকরকে ছেড়ে দেওয়া হলো রাতে, তবে তার মুখে ভয় জমে ছিল। ইরার সঙ্গে একা বসে বললেন, “আপনার লেখা আমার জন্য ফাঁস হয়ে গেল। মল্লিক আমাকে বলেছে, রাস্তা তৈরি মানতেই হবে। না হলে আবার কেস হবে।”

ইরা বলল, “তাহলে কী করবেন?”
প্রভাকর দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। “আমি জানি না। আমি যদি প্রতিবাদ করি, আমাকে সরিয়ে দেবে। আমি যদি রাজি হই, গ্রাম আমাকে আর মেনে নেবে না।”

এই দ্বন্দ্বই যেন ইরার কলমে বারবার ফিরে আসছিল। সে বুঝল—এই লড়াই কেবল বন-রাস্তার লড়াই নয়, এটা মানুষের অন্তর্দ্বন্দ্ব, ভয় আর প্রতিরোধের লড়াই।

পরদিন দুপুরে সুব্রত এল। তার চোখে ক্লান্তি, কিন্তু মুখে দৃঢ়তা। “আজ রাতে আমরা সবাই বসব বনের ভেতরে। গোপালদা বাঁশি বাজাবেন, সবাই আসবে। আপনিও আসবেন।”

ইরা অবাক হয়ে বলল, “বনের ভেতরে সভা করবেন?”
“হ্যাঁ। কারণ মাঠে করলে পুলিশ আসবে। বনই আমাদের আশ্রয়।”

রাত নামতেই তারা গেল ছায়ার বাগানে। শালগাছের ছায়ায় জড়ো হয়েছিল চল্লিশ-পঞ্চাশ জন মানুষ। আগুনের আলোয় তাদের চোখে প্রতিজ্ঞার ঝিলিক। গোপালদা বাঁশি বাজাতে লাগলেন—সুরটা ছিল করুণ, কিন্তু ভেতরে লুকিয়ে ছিল বিদ্রোহের সুর।

সুব্রত দাঁড়িয়ে বলল, “আমরা ভয় পেতে পারি, কিন্তু চুপ থাকলে সব হারাব। বন কাটা মানে শুধু গাছ হারানো নয়, জল হারানো, গান হারানো। আজ থেকে আমরা পাহারা দেব। বাইরের লোক এলে থামাব।”

লোকজন হাত তুলল, “আমরাও সঙ্গে আছি।”

ইরা সেই দৃশ্য দেখে শিউরে উঠল। যেন সে সাক্ষী হচ্ছে এক নতুন লড়াইয়ের জন্মের। তার মনে হচ্ছিল, এটা কেবল সংবাদ নয়, ইতিহাস।

কিন্তু সভার মাঝেই হঠাৎই ভেসে এল মোটরের শব্দ। বাইকের হেডলাইট কেটে ফেলল অন্ধকার। তিনজন হেলমেটধারী লোক এসে দাঁড়াল। তাদের একজন চেঁচিয়ে বলল, “কিসের সভা হচ্ছে এখানে? কে দিয়েছে অনুমতি?”

সুব্রত এগিয়ে গেল। “এ আমাদের বন, আমাদের জমি। অনুমতির দরকার নেই।”
লোকটা হেসে উঠল, “বন কারও নয়। বন সরকারের। সরকার ঠিক করেছে রাস্তা হবে। আর তোমাদের মাথার দাম কত, সেটা একদিন বোঝা যাবে।”

এবার গোপালদার বাঁশি থেমে গেল। চারপাশ নিস্তব্ধ হয়ে উঠল। লোকজন ভয়ে পিছিয়ে গেলেও সুব্রত এগিয়ে দাঁড়াল। “তাহলে আসুন, আমাদের মারুন। কিন্তু আমরা বনের শিকড় তুলে দেব না।”

ইরা সেই মুহূর্তে বুঝল—এটা কেবল গাছের জন্য নয়, অস্তিত্বের জন্য লড়াই। সে ডায়রিতে লিখে রাখল—যদি কেউ জানতে চায় পুরুলিয়ার মানুষ কীভাবে বাঁচতে শেখে, উত্তর হলো: তারা গাছের মতো শিকড় গেঁড়ে দাঁড়িয়ে থাকে।”

বাইকের লোকেরা শেষমেশ চলে গেল, কিন্তু হুঁশিয়ারি দিয়ে গেল। সভা আবার শুরু হলো। সিদ্ধান্ত হলো—প্রতিদিন দু’জন করে পাহারা দেবে বনে। মহিলারাও থাকবে।

ইরা সেদিন রাতে হোমস্টেতে ফিরে ঘুমোতে পারল না। তার মনে হচ্ছিল, পুলিশের লাঠি হয়তো আবার নামবে, আগুন হয়তো আবার জ্বলবে। তবু ভেতরে একটা অদ্ভুত শান্তি ছিল। কারণ সে জানত—এই লড়াইয়ের সাক্ষী হওয়ার জন্যই হয়তো তাকে এখানে আনা হয়েছে।

সকাল হলে সে রিপোর্ট লেখা শুরু করল। শিরোনাম দিল—শালবনের সভা: লড়াইয়ের জন্ম”। সে লিখল কিভাবে মানুষ নিজের ভয় কাটিয়ে দাঁড়াচ্ছে, কিভাবে বন তাদের অস্তিত্বের প্রতীক হয়ে উঠছে।

মিতা পাশে এসে দাঁড়িয়ে বললেন, “আপনি কি ভেবেছেন, এটা ছাপা হলে কী হবে?”
ইরা শান্ত কণ্ঠে উত্তর দিল, “হ্যাঁ। তখন ঝড় আসবে। কিন্তু ঝড়ের সাক্ষী থাকাটাই আমার কাজ।”

সেই সময়েই বাইরে থেকে ভেসে এল সুব্রতের গলা—“ইরা, পুলিশ আবার হাটে নেমেছে। এবার তারা খুঁজছে আপনাকে।”

ইরা উঠে দাঁড়াল। তার হাতে ডায়রি, চোখে স্থির দৃষ্টি। সে জানত—আজ থেকে তার নাম কেবল সাংবাদিক নয়, গ্রাম আর বনের কণ্ঠ হিসেবেও উচ্চারিত হবে।

দূরে শালপাতার ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো পড়ছিল। ছায়ার বাগান ফিসফিস করে যেন বলছিল—“যে লিখে, সে-ই বাঁচায়।”

পর্ব ৭: জেরার আলো, প্রতিরোধের ছায়া

সকালটা ছিল অস্বাভাবিক শান্ত। পাখির ডাক, শালপাতায় রোদের টুকরো টুকরো খেলা—সবই যেন এক মুহূর্তে আটকে গেল যখন হোমস্টের সামনে এসে দাঁড়াল পুলিশের ভ্যান। ধুলো উড়িয়ে নামল অফিসার। তার চোখে আজ কোনো আনুষ্ঠানিকতা নেই, সরাসরি কঠোরতা।

“ইরা সেন?”
ইরা এগিয়ে এল, বুকের ভেতর কাঁপন থাকলেও গলায় শান্ত স্বর। “হ্যাঁ।”

অফিসার বলল, “আপনার রিপোর্টগুলির কারণে এলাকায় অশান্তি বাড়ছে। আপনাকে থানায় গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে।”

মিতা ছুটে এসে প্রতিবাদ করলেন, “কেন? উনি তো শুধু লিখেছেন!”
অফিসার গম্ভীর গলায় বলল, “শুধু লেখা নয়, উনি লোকজনকে উসকানি দিয়েছেন বলেও অভিযোগ আছে।”

ইরা একবার সুব্রতের দিকে তাকাল। সে তখন উঠোনে দাঁড়িয়ে ছিল, চোখে দপদপ করা আগুন। সে এগিয়ে এসে অফিসারকে বলল, “আমাদের গ্রামকে বাঁচাতে উনি লিখেছেন। উনি উসকানি দেননি।”

অফিসার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল সুব্রতের দিকে। “তুমি খুব বড় কথা বলছ। সাবধান থাকো।”

ইরাকে নিয়ে যাওয়া হলো থানায়। ঘরের ভেতর খাটে রাখা পুরোনো ফাইল, দেওয়ালে ক্যালেন্ডার, আর মাঝখানে একটা কাঠের টেবিল। অফিসার বসে বলল, “আপনি কি জানেন, এই অঞ্চলে উন্নয়ন প্রকল্পে বাধা দিলে সরকারি ক্ষতি হয়? আপনার লেখা সেই বাধা তৈরি করছে।”

ইরা উত্তর দিল, “আমার লেখা কেবল বাস্তবতা বলছে। বন কেটে রাস্তা বানালে প্রকৃতির ক্ষতি হবে। গ্রামের মানুষ নিজের ভয় কাটিয়ে দাঁড়াচ্ছে। সেটা আমি লিখেছি।”

অফিসার টেবিলে হাত মেরে বলল, “বাস্তবতা কে ঠিক করবে? আপনি, না সরকার?”

ইরা শান্ত গলায় বলল, “বাস্তবতা ঠিক করে মাটি। যেদিন বৃষ্টি কমে যাবে, সেদিন সবাই বুঝবে।”

ঘরের ভেতরে নিস্তব্ধতা নেমে এলো। অফিসার চুপ করে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ, তারপর বলল, “আপনাকে সতর্ক করছি। আরেকবার এমন হলে কেস হবে।”

ইরাকে ছাড়ার সময় থানার বাইরে দেখতে পেল ভিড় জমে গেছে। সুব্রত, গোপালদা, মিতা—সকলেই অপেক্ষা করছে। ইরাকে বের হতে দেখে সবাই হর্ষধ্বনি করল, যেন সে কোনো যুদ্ধ জিতে ফিরছে।

সেদিন রাতে বনের ধারে পাহারায় ছিল সুব্রত আর কয়েকজন যুবক। ইরা গিয়েছিল তাদের সঙ্গে। চারপাশে কুয়াশার চাদর, শালপাতার ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো। হঠাৎ দূরে মোটরের শব্দ ভেসে এল। সবাই সতর্ক হয়ে উঠল। বাইক এসে থামল। তিনজন লোক নেমে বলল, “তোমরা পাহারা দিয়ে কী করবে? উন্নয়ন থামানো যায় না।”

সুব্রত এগিয়ে গিয়ে গম্ভীর গলায় বলল, “রাস্তা চাইলে বনকে এড়িয়ে চলুন। বন কাটতে এলে আমাদের শরীরের ওপর দিয়ে যেতে হবে।”

লোকজন হেসে উঠল। “তোমাদের শরীর ক’দিন টিকবে?” বলে তারা চলে গেল, কিন্তু হুমকির ছায়া ফেলে রেখে গেল।

ইরা সেই মুহূর্তে বুঝল—এ শুধু লোকাল ঝগড়া নয়, এ লড়াই ক্রমশ বড় হচ্ছে।

পরদিন সকালে কলকাতা থেকে ফোন এল ইরার অফিস থেকে। এডিটর বললেন, “তুমি যা লিখছ, সেটা পড়ছে সবাই। কিন্তু সাবধান থেকো। আমাদের হাতে খবর দরকার, তবে তোমার নিরাপত্তাও দরকার।”

ইরা উত্তর দিল, “আমি লিখবই। এখানে যা ঘটছে, সেটা কাগজে না উঠলে ইতিহাস মুছে যাবে।”

দুপুরে গ্রামে বৈঠক ডাকল প্রভাকর মাহাতো। তার চোখে ভয়ের রেখা, তবু আজ দৃঢ়তা। তিনি বললেন, “আমরা ভেবেছিলাম বাইরে থেকে সাহায্য এলে উন্নয়ন আসবে। কিন্তু তার সঙ্গে আসছে ভয়, আগুন, হুমকি। আমাদেরই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বনকে বাঁচাতে হলে আমাদের একসঙ্গে দাঁড়াতে হবে।”

মাঠে তখন কয়েকশো মানুষ। কেউ বলল, “আমরা কি পুলিশের বিরুদ্ধে যাব?”
প্রভাকর উত্তর দিলেন, “না। আমরা পুলিশের বিরুদ্ধে নই। আমরা বনকে রক্ষার পক্ষে।”

সুব্রত দাঁড়িয়ে বলল, “আজ থেকে আমরা চৌকিদারি শুরু করব। পালা করে পাহারা। মহিলারা গান গাইবে, পুরুষরা আগুন জ্বালিয়ে বসবে। বনকে আমরা বাঁচাব।”

মানুষ হাত তুলল সমর্থনে। সেই হাতের দৃঢ়তায় ইরার বুক ভরে উঠল। সে ডায়রিতে লিখল—
আজ আমি দেখলাম, ভয় থেকে জন্ম নিল প্রতিরোধ। পুলিশের লাঠি ভয় দেখাতে পারে, কিন্তু শিকড় মাটির নিচে আরও শক্ত হয়ে যায়।”

সন্ধে নামতেই গ্রামের প্রতিটি ঘরে প্রদীপ জ্বলল। শিশুরা ঢোল বাজাল, মহিলারা পালাগান ধরল। পরিবেশটা একধরনের উৎসব হয়ে উঠল—যেন ভয়কে গান দিয়ে হারানো যায়।

কিন্তু রাতে আবারও ভেসে এল বাইকের গর্জন। এবার তারা হোমস্টের সামনে এসে দাঁড়াল। ইরা জানলার ফাঁক দিয়ে দেখল—তাদের হাতে লাঠি, চোখে আগুন। একজন চিৎকার করে বলল, “শহরের সাংবাদিক! লিখতে থাকুন, কিন্তু মনে রাখবেন, এই মাটিতে সব শব্দ বেঁচে থাকে না।”

ইরার বুক কেঁপে উঠল। কিন্তু সে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে রইল। তার হাতে ছিল বাঁশি। সে বাঁশিতে ফুঁ দিল। সুর ভেসে উঠল রাতের নিস্তব্ধতায়। বাইকের লোকেরা থমকে গেল। তারা মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে রইল, তারপর হাসতে হাসতে চলে গেল।

সুব্রত দৌড়ে এসে বলল, “আপনি ভয় পাননি?”
ইরা মৃদু হেসে উত্তর দিল, “ভয় তো ছিল। কিন্তু বাঁশির সুর ভয়কে ছাপিয়ে গেল।”

রাতের শেষে ডায়রিতে লিখল সে—
আজ শিখলাম, প্রতিরোধ মানে শুধু লড়াই নয়। প্রতিরোধ মানে গান, বাঁশি, আলো—যা ভয়কে ছাপিয়ে যায়।”

পর্ব ৮: প্রথম প্রতিরোধ

ভোরের আকাশে তখনো কুয়াশার পর্দা। ধানক্ষেতের ওপর শিশির ঝুলে আছে, পাখিরা মাটি থেকে খাবার খুঁজছে। কিন্তু সেই শান্ত ভোরের বুক চিরে এল ভারী গাড়ির গর্জন। কয়েকটা ট্রাক, সঙ্গে ডজনখানেক শ্রমিক, আর পুলিশের ভ্যান। খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল—রাস্তার কাজ শুরু হবে আজ থেকেই।

গ্রামের ভেতর যেন বজ্রপাত নেমে এলো। লোকজন দৌড়ে বেরোল। মহিলারা কাঁধে শাড়ির আঁচল শক্ত করে বাঁধল, পুরুষরা বাঁশের লাঠি হাতে নিল। শিশুদের পাঠানো হলো ঘরের ভেতর। ডাকে ডাকে খবর পৌঁছাল—“ছায়ার বাগানের ধারেই খনন হবে, সবাই ছুটে আসো।”

ইরাও বেরিয়ে পড়ল। তার ডায়রি আর কলম ব্যাগে, চোখে অদ্ভুত দৃঢ়তা। মনে হচ্ছিল—আজকের দিন ইতিহাসে ঢুকে যাবে।

যখন তারা পৌঁছাল, তখন দৃশ্যটা ভয়াবহ। ট্রাক থেকে নামানো হচ্ছে খুন্তি, কোদাল। পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে চারপাশে। আর সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে আছে ধর মল্লিক। সাদা শার্ট, চোখে কালো চশমা, ঠোঁটে হালকা হাসি।

প্রভাকর মাহাতো এগিয়ে গিয়ে বললেন, “মল্লিকদা, অন্তত আলোচনা ছাড়া কাজ শুরু করবেন না।”
মল্লিক হেসে বলল, “আলোচনা অনেক হয়েছে, প্রভাকরবাবু। এখন কাজ হবে। উন্নয়ন থামানো যায় না।”

সুব্রত সামনে এগিয়ে এল। গলা কাঁপছিল না। সে বলল, “রাস্তা হোক, কিন্তু বন কেটে নয়। এই শিকড় যদি ভাঙেন, তবে আমাদের শরীরের ওপরে দিয়েই ভাঙতে হবে।”

গ্রামের মানুষ তখন সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে গেল। মহিলারা গান ধরল—
“শালগাছ বাঁচাও, মাটির গান বাঁচাও,
ধর মল্লিক শোনো, আমাদের প্রাণ বাঁচাও।”

ঢোল বাজতে শুরু করল। প্রতিরোধ যেন উৎসব হয়ে উঠল।

পুলিশের অফিসার চেঁচিয়ে উঠল, “সবাই সরে দাঁড়ান, নইলে লাঠিচার্জ হবে।”
কেউ সরল না। বরং আরও জোরে গান উঠল।

শ্রমিকরা দ্বিধায় পড়ে গেল। তারা গ্রামের মানুষদের চেনে। কারও ভাই, কারও আত্মীয়। কেউ ফিসফিস করে বলল, “এভাবে শুরু করলে রক্ত ঝরবে।”

মল্লিক রেগে গর্জে উঠল, “চুপ করে কাজ করো। আমি টাকা দিচ্ছি, আমি চাকরি দিচ্ছি। এরা বুঝবে না।”

ঠিক তখনই এক শ্রমিক কোদাল হাতে নিয়ে এগোল। ভিড় থেকে একটা বাচ্চা কেঁদে উঠল। মুহূর্তে মহিলারা ঝাঁপিয়ে পড়ল। কোদাল নামল না মাটিতে, থেমে গেল মানুষের হাতের চাপায়।

পুলিশ লাঠি তুলল। প্রথম আঘাত পড়ল এক যুবকের কাঁধে। রক্ত ঝরল। কিন্তু ভিড় সরে গেল না। বরং স্লোগান উঠল—“বন বাঁচাও, মাটি বাঁচাও।”

ইরা কাঁপতে কাঁপতে লিখে চলছিল। তার কলম থামছিল না। চোখের সামনে রক্ত, কান্না, লাঠির শব্দ—সবই শব্দে ধরা পড়ছিল। সে বুঝল, তার রিপোর্ট হয়তো কাল ছাপা হবে, কিন্তু এই দৃশ্য মানুষের মনে ছাপ ফেলবে আজই।

গোপালদা বাঁশি বাজাতে শুরু করলেন। সুরটা এত করুণ, এত তীব্র যে এক মুহূর্তের জন্য লাঠির শব্দও যেন থেমে গেল। পুলিশও স্তব্ধ হয়ে তাকাল। মল্লিক চেঁচিয়ে উঠল, “এই নাটক বন্ধ করো!”

কিন্তু তখনই ভিড় থেকে সুব্রত চিৎকার করে বলল, “আমরা লড়ব। যতদিন শালপাতা কাঁপবে, ততদিন এই মাটি টিকবে।”

ভিড় একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল। স্লোগানে আকাশ কাঁপল। পুলিশ লাঠি নামাল আবার, কিন্তু এবার গ্রামের মানুষ শুধু মার খেল না, বাঁশের লাঠি দিয়ে প্রতিরোধও করল। ধস্তাধস্তি, চিৎকার, রক্ত আর ধুলোয় ভরে গেল মাঠ।

ইরা দেখল—এক তরুণী নিজের শিশুকে পেছনে রেখে দাঁড়িয়ে আছে পুলিশের সামনে। তার চোখে ভয় নেই, শুধু দৃঢ়তা। সে চিৎকার করছে, “আমাদের বনকে ছোঁবেন না!”

অফিসার থমকে গেল মুহূর্তের জন্য। হয়তো তার ভেতরের মানুষটা এক সেকেন্ডের জন্য নড়ে উঠেছিল। সেই সুযোগে শ্রমিকরা পিছিয়ে গেল। কাজ থেমে গেল।

মল্লিক রাগে ফুঁসতে লাগল। “এভাবে উন্নয়ন থামানো যায় না। আমি আবার আসব।”

পুলিশ লোকজনকে ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করল, কিন্তু গ্রামের মানুষ একজোট। শেষমেশ ভ্যানগুলো চলে গেল। ট্রাক ঘুরে গেল ধুলো উড়িয়ে।

মাঠে পড়ে রইল কয়েকজন আহত মানুষ। রক্ত মাটিতে মিশে গেল। মহিলারা পানি আনল, কাপড় ছিঁড়ে বাঁধল। ইরা কাঁপা হাতে লিখল—
আজ পুরুলিয়ার শালবনে প্রথম প্রতিরোধ দাঁড়িয়ে গেল। রক্ত ঝরল, কিন্তু শিকড়ও শক্ত হলো। এই লড়াই আর থামবে না।”

সন্ধ্যায় গ্রামের উঠোনে লোকজন আবার জড়ো হলো। এবার মুখে ক্লান্তি, শরীরে আঘাত, কিন্তু চোখে আলো। প্রভাকর বললেন, “আজ আমরা প্রমাণ করলাম, আমরা ভয় পাই না। কাল থেকে আরও সংগঠিত হতে হবে। গ্রামজুড়ে পালা করে পাহারা। আমরা হারব না।”

সুব্রত বলল, “আজ যদি ইরাদি না থাকতেন, হয়তো এই কাহিনি বাইরে পৌঁছাত না। আমাদের লড়াই কেবল এখানে নয়, শহরেও ছড়াতে হবে।”

মানুষ হাত তুলল সম্মতিতে। মহিলারা আবার গান ধরল—
“শালবন আমাদের বুকের নিশ্বাস,
কেটে ফেললে হারাবে আশ্বাস।”

রাত নামল ধীরে। শালপাতায় শিশির পড়ল। কিন্তু আজ গ্রামের বুক জুড়ে জেগে উঠল এক অদম্য আগুন—প্রথম প্রতিরোধের আগুন।

ইরা ডায়রিতে লিখল—
আজ থেকে আর শুধু দর্শক নই। আমি সাক্ষী। এই লড়াই আমারও।”

পর্ব ৯: ছায়ার ভিতরে বিশ্বাসঘাতকতা

প্রথম প্রতিরোধের পর গ্রামে একধরনের নীরব উত্তেজনা জমে রইল। মানুষদের চোখে ক্লান্তি থাকলেও গলার স্বরে গর্ব। তারা জানত—রাস্তার কাজ একদিন থামানো গেলেও ধর মল্লিক এভাবে হার মানবে না।

ইরা চারদিকে ঘুরে ঘুরে নোট নিচ্ছিল। সে আহতদের নাম লিখছিল, কার কোথায় আঘাত লেগেছে। কেউ হাতে ব্যান্ডেজ বাঁধা, কেউ মাথায় সেলাই নিয়ে বসে আছে উঠোনে। অথচ কারও চোখে ভয় নেই। সবাই বলছে, “আমরা লড়ব।”

কিন্তু সেই সাহসের ভেতরে লুকিয়ে ছিল ভয়ও। রাত নামলেই মহিলারা ছেলেদের ঘরে ফেরাতে চাইত। কুকুর ঘেউ ঘেউ করলেই মনে হতো বাইকের গর্জন।

তৃতীয় দিনেই গুজব ছড়াল—মল্লিকের লোকেরা নাকি গ্রামের ভেতরে ঢুকে গেছে। তারা কারও কারও সঙ্গে গোপনে কথা বলছে। কেউ কেউ নাকি টাকার বিনিময়ে প্রতিরোধ ভাঙতে চাইছে।

সুব্রত রেগে উঠল। সে বলল, “আমাদের ভেতর থেকে যদি কেউ ফাঁসায়, তবে সব শেষ।”
প্রভাকর মাথা নিচু করে বললেন, “মানুষের পেটের দায়কে অবহেলা কোরো না। কেউ কেউ হয়তো টাকার লোভে ভুল করবে।”

সেই রাতেই ঘটনা ঘটল। পাহারায় ছিল দুইজন যুবক। হঠাৎই তারা নিখোঁজ হয়ে গেল। সকালে বনের ধারে পাওয়া গেল শুধু ফেলে যাওয়া একটা লাঠি আর ছেঁড়া গামছা। কে তুলে নিয়ে গেছে কেউ জানল না।

গ্রামে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল। মহিলারা কান্নায় ভেঙে পড়ল, পুরুষরা ক্ষোভে ফুঁসতে লাগল। সবাই বুঝল—ভেতরে বিশ্বাসঘাতক আছে।

ইরা চুপচাপ বসে লিখছিল। প্রতিরোধ ভাঙতে হলে বাইরের শত্রু যথেষ্ট নয়, ভেতরের ফাটলই আসল অস্ত্র।”

বিকেলে হাটে হঠাৎ ভিড় জমল। খবর এল—দুই নিখোঁজ যুবক নাকি মল্লিকের ক্যাম্পে দেখা গেছে। তারা এখন কাজ করছে ট্রাকের পাশে। ভিড়ে হৈচৈ উঠল—“ওরা বিক্রি হয়ে গেছে!”

সুব্রত গর্জে উঠল, “আমরা ভুল লোককে বিশ্বাস করেছিলাম।”
একজন বয়স্ক মানুষ শান্ত কণ্ঠে বলল, “শুধু ওদের দোষ নয়। দোষ আমাদেরও, যারা ভাবতাম টাকার ক্ষুধা প্রতিরোধের গান ঢেকে দিতে পারবে না।”

ইরা লক্ষ্য করল—এই প্রথমবার ভিড় বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে। কেউ বলছে, “ওরা বিশ্বাসঘাতক।” আবার কেউ বলছে, “পেটের দায়ে গেছে।”

সেই সন্ধ্যায় মল্লিক আবার হাজির হল। গাড়ি থেকে নেমে গলায় হাসি ঝুলিয়ে বলল, “তোমাদের লড়াই সুন্দর। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সবাই তো বাঁচতে চায়। যারা আমাদের সঙ্গে এসেছে, তারা চাকরি পাবে, টাকা পাবে। বাকিরা? বন খেয়ে কি পেট ভরবে?”

সুব্রত তীব্র স্বরে বলল, “বন না থাকলে জমিও থাকবে না। জমি না থাকলে পেটও ভরবে না।”

মল্লিক হেসে উঠল। “তুমি খুব কথা বলতে শিখেছ। কিন্তু মনে রেখো, বড় রাস্তার সঙ্গে লড়াই করা মানে নিজের ভবিষ্যৎ কেটে ফেলা।”

তার চোখ একবার ঘুরল ইরার দিকে। “আর শহরের সাংবাদিক মেমসাহেব, আপনি তো অনেক লিখলেন। আপনার কাগজে নাম ছাপা হলো। কিন্তু ভেবে দেখেছেন, আপনার নাম যদি কাল থানার এফআইআরে উঠে যায়?”

ইরার বুক কেঁপে উঠল, কিন্তু মুখে শান্ত স্বর রাখল। “আমি ভয় পাই না। আমি শুধু সত্যি লিখি।”

মল্লিক মৃদু হেসে বলল, “সত্যি লিখলে সবাই বাঁচে না। অনেকে মরে।” তারপর গাড়িতে উঠে চলে গেল।

রাত নামতেই আবার নিস্তব্ধতা। হঠাৎই হোমস্টের দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। ইরা দরজা খুলে দেখল—এক অচেনা কিশোর দাঁড়িয়ে আছে, চোখে আতঙ্ক। সে ফিসফিস করে বলল, “দিদি, আপনাকে খুঁজছে। তারা বলছে আপনাকে তুলে নিয়ে যাবে।”

মিতা কেঁপে উঠলেন। “কে খুঁজছে?”
ছেলেটি কাঁপা কণ্ঠে বলল, “মল্লিকের লোকেরা।”

ইরার শরীর ঠান্ডা হয়ে গেল। সুব্রত দৌড়ে এল। “আপনাকে আজ রাতেই অন্য জায়গায় রাখতে হবে। এখানে থাকলে বিপদ।”

তারা দ্রুত বেরিয়ে পড়ল। অন্ধকার গলিপথ ধরে শালবনের ভেতর দিয়ে এক নির্জন কুঁড়ে ঘরে নিয়ে গেল ইরাকে। সেখানে গোপালদা অপেক্ষা করছিলেন। বাঁশি হাতে, চোখে দৃঢ়তা।

“ভয় পাবেন না,” তিনি বললেন। “আমাদের বন আপনাকে রক্ষা করবে।”

কুঁড়ে ঘরের ভেতর বসে ইরা ডায়রিতে লিখল—
বিশ্বাসঘাতকতা কেবল রক্ত ঝরায় না, ভয়ও ছড়ায়। আজ আমি নিজেকে শিকার মনে করছি। কিন্তু বনের ফিসফিসানি আমাকে বলছে—ভয়কে লিখে ফেলো, তবেই ভয় হারে।”

সকাল হলে তারা আবার গ্রামে ফিরল। মানুষ জমেছে মাঠে। সুব্রত ঘোষণা করল, “আজ থেকে আমাদের পাহারা দ্বিগুণ হবে। আর যারা মল্লিকের লোকেদের সঙ্গে গেছে, তাদের আমরা শত্রু ভাবব না। আমরা জানি, তারা ভুল করেছে। কিন্তু যদি আবার ফিরে আসে, আমরা গ্রহণ করব।”

এই কথায় ভিড়ে কানাঘুষো হলো। কেউ বলল, “এটাই ঠিক। একতাই শক্তি।”

কিন্তু তখনই হঠাৎ এক বিস্ফোরণ হল মাঠের কোণে। ধুলো আর ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ল। সবাই আতঙ্কে দৌড়তে লাগল। কেউ চিৎকার করল, “বোমা! বোমা ফাটল!”

ইরা স্তব্ধ হয়ে গেল। সে বুঝল—মল্লিক এবার ভয় দেখানোর খেলায় নামল। শুধু পুলিশ আর লাঠি নয়, এবার বোমার ভয়।

মানুষ কাঁপছিল, শিশুরা কাঁদছিল। কিন্তু সুব্রত গর্জে উঠল, “যদি বোমা ফাটে, তবু আমরা সরব না। বনকে ছাড়ব না।”

ইরা সেই মুহূর্তে বুঝল—এখন আর পিছু হটার উপায় নেই। এই লড়াই রক্ত, বিশ্বাসঘাতকতা আর ভয় পেরিয়ে এগোবে।

সে ডায়রিতে লিখল—
আজ আমি বুঝলাম, ছায়ার ভিতরেই জন্ম নেয় অন্ধকার। আর সেই অন্ধকার ভেদ করতে হলে আলোকে আরও উজ্জ্বল হতে হয়। আমাদের লড়াই এখন বাঁচার লড়াই।”

রাতের আকাশে তখন পূর্ণিমার দাগ মুছে গিয়ে নতুন অমাবস্যার ছায়া নেমে আসছিল। ইরা জানত—পরের দিনগুলো আরও ভয়ঙ্কর হবে।

পর্ব ১০: ছায়ার ভেতর আলো

মাঠে বোমার বিস্ফোরণের পর থেকে গ্রামে নিস্তব্ধতার পর্দা নেমে এল। মহিলারা আর শিশুদের বের হতে দেওয়া হলো না, পুরুষরা রাতদিন পাহারা দিতে শুরু করল। শালগাছের পাতায় বাতাস বয়ে গেলে এখন আর সুর শোনা যায় না, কেবল ভয় কেঁপে ওঠে।

ইরা বারবার নিজের ডায়রি খুলছিল, কিন্তু হাত কাঁপছিল। শেষ কোথায়?” এই প্রশ্নই তাকে তাড়া করছিল। সাংবাদিক হিসেবে সে জানত—শেষ মানে হয় রক্ত, নয়ত আলো। কিন্তু কোনটা পুরুলিয়ার ভাগ্যে লেখা আছে, তা সে বুঝতে পারছিল না।

পরের দিন সকালেই খবর এল—মল্লিক এবার বড় দল নিয়ে আসছে। ট্রাক ভর্তি মানুষ, পুলিশের সঙ্গও থাকবে। রাস্তার কাজ যেভাবেই হোক শুরু হবে।

প্রভাকর মাহাতো গ্রামবাসীদের ডেকে পাঠালেন। তার মুখে ছিল গভীর ক্লান্তি, কিন্তু চোখে ঝলক। তিনি বললেন, “আজ শেষ লড়াই। আজ আমরা ঠিক করব আমাদের ছায়া থাকবে কি না।”

সুব্রত সামনে দাঁড়িয়ে বলল, “আমরা লড়ব। ভয় নেই। আমাদের পাশে আছে ইরাদি, আছে গোপালদার বাঁশি। বনকে আমরা ছাড়ব না।”

মানুষ একসঙ্গে স্লোগান তুলল। মহিলারা গলা উঁচু করে গান ধরল—
“মাটির বুক কেটে নয়,
শালগাছ বাঁচুক জয়।”

ইরা বুঝল—আজকের দিনই ইতিহাস হয়ে যাবে।

দুপুর নাগাদ ট্রাকের গর্জন শোনা গেল। ধুলো উড়িয়ে এলো গাড়ি, বাইক, পুলিশ। সামনের সারিতে ধর মল্লিক, চোখে সানগ্লাস, মুখে বাঁকা হাসি। সে চেঁচিয়ে বলল, “হটাও এদের। রাস্তা আজ থেকেই শুরু হবে।”

পুলিশ এগিয়ে এল লাঠি হাতে। কিন্তু গ্রামের মানুষ ইতিমধ্যেই সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে গেছে। হাতে বাঁশের লাঠি, মুখে স্লোগান। মহিলারা সামনে, পুরুষরা পেছনে। শিশুরা ঘরের জানালা দিয়ে তাকাচ্ছে আতঙ্কে।

প্রথম লাঠি পড়ল এক মহিলার কাঁধে। কিন্তু সে ভাঙল না। বরং আরও জোরে গান গাইল। ঢোল বাজতে লাগল, বাঁশি বাজতে লাগল।

ইরা সেই দৃশ্য দেখে কেঁপে উঠল। তার মনে হচ্ছিল—এটা কেবল প্রতিবাদ নয়, এ যেন উৎসর্গ।

হঠাৎই সুব্রত এগিয়ে এল। সে চিৎকার করে বলল, “যদি রাস্তা বানাতেই হয়, তবে আমাদের লাশের ওপর দিয়ে বানাও!”

পুলিশ হতবাক হয়ে গেল মুহূর্তের জন্য। কিন্তু মল্লিক গর্জে উঠল, “লাঠি চালাও!”

ধস্তাধস্তি শুরু হলো। লাঠি নামল, রক্ত ঝরল। তবু কেউ সরল না। মানুষের কণ্ঠে স্লোগান গর্জে উঠল—
“বন বাঁচাও, মাটি বাঁচাও!”

ইরা ডায়রি নামিয়ে রাখল। এবার আর লেখা নয়—এবার সে দাঁড়িয়ে পড়ল মানুষের ভিড়ে। কেউ চিৎকার করে বলল, “ইরাদি আমাদের সঙ্গে থাকুন!”

সে হাত তুলল আকাশের দিকে। “আমি আছি। আমার শব্দ থাকবে আপনাদের সঙ্গে।”

ঠিক তখনই অদ্ভুত এক ঘটনা ঘটল। গোপালদা বাঁশি বাজাতে শুরু করলেন। সুরটা এত গভীর, এত তীব্র যে এক মুহূর্তের জন্য সবাই থেমে গেল। পুলিশের লাঠিও কেঁপে উঠল। শ্রমিকরা কোদাল নামিয়ে ফেলল।

সেই সুযোগে প্রভাকর গলা উঁচু করে বললেন, “মল্লিকদা, এই মানুষদের সঙ্গে লড়তে পারবেন না। এরা গাছের মতো। যতই কাটবেন, আবার জন্ম নেবে। রাস্তা যদি হয়, বন এড়িয়ে হোক। নইলে কখনো হবে না।”

ভিড় একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল। শব্দে আকাশ ফেটে গেল। পুলিশ আর এগোতে পারল না। শ্রমিকরা পিছু হটল।

মল্লিক রাগে ফুঁসতে লাগল। সে চেঁচিয়ে বলল, “তোমরা জিতলে ভেবো না। আমি আবার আসব।”

কিন্তু তার গলার স্বর চাপা পড়ে গেল মানুষের স্লোগানে। ট্রাকগুলো ঘুরে গেল, পুলিশ ভ্যান দূরে মিলিয়ে গেল।

মাঠে পড়ে রইল আহত মানুষ, কিন্তু তাদের চোখে আলো। তারা জানত—আজকের দিন তারা জয় করেছে।

সন্ধ্যা নামল ধীরে। গ্রামে দীপ জ্বালানো হলো। মহিলারা গান ধরল, শিশুরা ঢোল বাজাল। মানুষ একসঙ্গে বসে বলল, “আজ থেকে আমরা আরও সংগঠিত হব। বন আমাদের প্রাণ, আমরা বনকে ছাড়ব না।”

ইরা বারান্দায় বসে ডায়রি খুলল। তার চোখে জল, কিন্তু মুখে হাসি। সে লিখল—
আজ আমি দেখলাম মানুষের জয়। বন শুধু গাছ নয়, বন মানুষের আত্মা। সেই আত্মাকে বাঁচাতে মানুষ দাঁড়িয়েছে। ধর মল্লিক হার মানেনি হয়তো, কিন্তু আজ বনের ছায়া জয়ী।”

সুব্রত পাশে এসে বলল, “আপনি আমাদের সঙ্গে থেকে লিখেছেন। এখন শহর জানবে আমরা কীভাবে বাঁচি।”

ইরা তাকাল শালপাতার দিকে। পূর্ণিমার আলোয় তারা ঝলমল করছে। মনে হলো, গাছগুলো ফিসফিস করে বলছে—“ধন্যবাদ।”

রাত গভীর হলো। গ্রাম নিস্তব্ধ। কিন্তু সেই নিস্তব্ধতার ভেতর জন্ম নিল নতুন আশা।

ইরা শেষ লাইন লিখল—
শালবনের ছায়ায় আমি শিখলাম—অন্ধকার যতই গভীর হোক, মানুষের কণ্ঠ আর সুরই আলো হয়ে ওঠে।”

সমাপ্ত

WhatsApp-Image-2025-09-01-at-5.06.27-PM.jpeg

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *