অনিরুদ্ধ কর
অধ্যায় ১
হাওড়ার রাজ্য সরকারি হাসপাতালের শিশু-ক্যান্সার ওয়ার্ডে সকালটা শুরু হয় নীরব কান্নার ভেতর দিয়ে, কিন্তু সেই নীরবতার মাঝে কিছু একটা যেন রোজ ভিন্নভাবে গর্জে ওঠে—যেটা অন্য বাচ্চারা কাঁদে বলে নয়, বরং কেউ একজন সেখানে হেসে ওঠে বলে। বিছানার এক কোণে, জানলার গরাদ পেরিয়ে আলোর ফালি যে মেয়েটার মুখে এসে পড়ে, তার নাম টুম্পা ঘোষ। আট বছর বয়স, অথচ চোখে হাজার বছরের জীবনদর্শনের মতো কিছু আছে। গাল কেমন শুকিয়ে এসেছে, মাথার চুল প্রায় নেই, নীল হাসপাতালের জামাটা ঢোলা হয়ে পড়ে থাকে তার চিকন গায়ে। প্রতিদিন সকালে যখন নার্স রক্ত দেওয়ার জন্য প্রস্তুত করেন, তখন সে বলে, “আমি কিন্তু রক্ত পছন্দ করি না, রক্ত লাল… আমি শুধু লাল বেলুন ভালোবাসি।” সবাই ভাবে সে ভয় পাচ্ছে, কিন্তু আসলে সে ভয় নয়, ঘৃণারও নয়—সে কেবল মরতে চায় না। সে চায় বাঁচতে, উড়তে, যেভাবে ছোটবেলায় সে মাঠে ঘুড়ি ওড়াত, সেইভাবে। কিন্তু এখন, তার একমাত্র সঙ্গী হাসপাতালের সাদা ছাদ আর একটি লাল বেলুন। প্রতিদিন দুপুরে তার বাবা সোমনাথ চুপচাপ এসে বসে জানালার ধারে—একটি ক্ষতবিক্ষত চেহারা, যিনি একটি শব্দ না বলে মেয়েকে শুধু দেখে যান। মাঝেমধ্যে মেয়ের মুখে একটু হাসি ফুটলে তিনি মাথা নিচু করে ফেলেন—কারণ জানেন, সেই হাসির মূল্য তিনি দিতে পারবেন না। স্ত্রী মারা গিয়েছেন পাঁচ বছর আগে, এখন এই ছোট্ট মেয়েটির জীবনই তার কাছে সর্বস্ব। কিন্তু কেমোথেরাপির খরচ, ওষুধের দাম, হাসপাতালের রুটিন—সবকিছু মিলে সে প্রায় নিঃশেষ। তবু মেয়ের হাত ধরে তিনি বলেন, “পাখি, কেমন আছিস?” আর মেয়েটি বলে, “বাবা, আমি আজ আকাশে চিঠি পাঠাব। কেউ যদি পড়ে ফেলে?” সোমনাথ শুধু মাথা নাড়েন।
ওয়ার্ডে যে মানুষটা সব বাচ্চাদের সবচেয়ে আপন, তিনি হলেন তনুশ্রীদি। বয়সে পঞ্চাশ, গায়ের রঙ ফিকে হলেও হাসির রঙ টকটকে উজ্জ্বল। সাদা শাড়ি পরে প্রতিদিন ওয়ার্ডে এসে বাচ্চাদের খাওয়ানো, ওষুধ দেওয়া, মাঝে মাঝে নিজের টাকা দিয়ে লজেন্স কিনে আনা—সবই তিনি করেন কোনও দায়িত্বে নয়, ভালোবাসায়। টুম্পাকে তিনি বলেন, “তুই জানিস, ছোটবেলায় আমি চন্দ্রবিন্দুর গান গাইতাম। তোর জন্য আবার শিখছি!” মেয়েটি হেসে বলে, “আমার জন্য গান, আর আমি উড়ব লাল বেলুনে করে!” তনুশ্রীদি জানেন এই মেয়েটা একা নয়—ও যেন বাকি ক্যান্সার আক্রান্ত শিশুদের প্রতিনিধিত্ব করে, যারা প্রতিদিন শরীরের কষ্টকে জয় করার চেষ্টায় থাকে, কিন্তু মনে চেপে বসা দুঃস্বপ্নের ভার এত সহজে যায় না। একদিন তনুশ্রীদিকে টুম্পা বলে, “তুমি কি আমার জন্য একটা বেলুন আনবে? আমি চিঠি লিখব, আর তুমি সেটা বাঁধবে গোঁজে, আমি ছাড়ব জানলা দিয়ে…” পরদিনই তনুশ্রীদি তাকে এনে দেন একটি লাল বেলুন আর একটি সাদা কাগজ। টুম্পা প্রথম চিঠিতে লেখে—”আমি টুম্পা, আমার রক্তে ক্যান্সার আছে। কিন্তু আমি মরতে চাই না। তুমি যদি এই চিঠি পাও, আমায় নিয়ে যেও। আকাশের দিকে।” চিঠিটি ভাঁজ করে গোঁজার ফিতেতে জড়িয়ে সে ছাড়ে জানলার বাইরে। ওয়ার্ডে যারা এই দৃশ্য দেখছিল, তারা কেউ কেউ হাসল, কেউ কেউ চোখ মুছল। কিন্তু টুম্পার চোখে এক আশ্চর্য উজ্জ্বলতা ছিল—যেন সে জানে, কোনো না কোনো দিন সেই চিঠি পৌঁছে যাবে এক অচেনা কারো হাতে, যে তার স্বপ্নের খাঁচার দরজা খুলে দেবে।
সন্ধের আলো নেমে এলে হাসপাতাল ধীরে ধীরে নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে। সোমনাথ বাড়ি ফেরে, ওয়ার্ডের আলো নিভে আসে, শিশুরা ঘুমিয়ে পড়ে। কিন্তু টুম্পার চোখে ঘুম নেই। সে চেয়ে থাকে জানলার বাইরে। আকাশে কোনো তারা নেই, কিন্তু সে জানে, তার বেলুন এখন কোথাও ভেসে যাচ্ছে, হাওয়ার গায়ে চিঠির মতন। হয়তো আজ নয়, কাল, বা কখনো—কেউ সেই চিঠি পড়ে ভাববে, “এই ছোট মেয়েটির ইচ্ছে আমি পূরণ করব।” ডাক্তার অরিত্র সেন প্রতিদিন রাউন্ডে এসে টুম্পার পালস দেখে বলেন, “তুমি তো আমাদের এক নম্বর রোগী!” মেয়েটি মুচকি হেসে বলে, “আমি উড়তে শিখেছি, ডাক্তারবাবু।” অরিত্রর চোখ ছলছল করে ওঠে। তিনি জানেন, চিকিৎসা বিজ্ঞানের হিসেব টুম্পার পক্ষে নয়, কিন্তু মন যদি বেঁচে থাকে, তাহলে শরীরও একদিন মানতে বাধ্য। সেই রাতে তিনি নিজের ঘরে ফিরে ভাবেন—এই মেয়েটার স্বপ্নের ভার কি কেবল আকাশ বইতে পারবে? নাকি আমাদের মধ্যেই কেউ, কোনও না কোনওদিন, সেই বেলুনের দড়ি ধরে টান দেবে—আর একদিন সে সত্যিই উড়বে, সেই লাল বেলুনের শহরের দিকে?
অধ্যায় ২
সকালবেলার হালকা কুয়াশায় মোড়া প্রিন্সেপ ঘাটের ধারে একাকী দাঁড়িয়ে থাকে নীলাঞ্জন বসু, হাতে এক কাপ চা, চোখে কাঁচাপাকা দাড়ি, আর মনটায় দীর্ঘশ্বাসের ধোঁয়া। সে একসময় নাম করা শিল্পী ছিল, শহরের ক্যানভাসে তার আঁকা মুখগুলো ছিল পরিচিত মুখ, কিন্তু এখন… এখন তার তুলির রঙ শুকিয়ে গিয়েছে। এক ভয়ানক দুর্ঘটনায় তিন বছর আগে হারিয়েছে স্ত্রী আর কন্যাকে—রোড অ্যাকসিডেন্ট। তারপর থেকে রং, ছবি, ক্যানভাস—সবই যেন তার কাছে অর্থহীন হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিদিন সকালবেলায় সে এখানে আসে, নদীর দিকে চেয়ে থাকে, যেন হাওয়ার ভেতর হারিয়ে যাওয়া কণ্ঠস্বর শুনতে পায়। ঠিক এমনই এক সকালে তার পায়ে এসে লাগে কিছু নরম জিনিস—একটা লাল বেলুন, গোঁজা দিয়ে বাঁধা একটা ভাঁজ করা সাদা কাগজ। কৌতূহলবশত সে কাগজটি খুলে পড়ে—লিখেছে একজন ছোট্ট মেয়ে, নাম টুম্পা। লেখার মধ্যে কোনও আবেগের অতিরঞ্জন নেই, কিন্তু বাক্যগুলো কেঁপে ওঠে যেন—“আমি মরতে চাই না। তুমি যদি চিঠি পাও, আমায় নিয়ে যেও আকাশে।” এই চিঠির মধ্যে যে জেদ, যে নির্ভীকতা, সে নীলাঞ্জনের মনটাকে যেন কিছুটা নাড়িয়ে দেয়। সে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে, হাতে কাগজটা ধরা, নদীর দিক থেকে আসা বাতাসে বেলুনটা ফেঁপে উঠছে, যেন সেটাই পথ দেখিয়ে বলছে, “চল, খুঁজে নিও আমাকে।”
দিনভর নীলাঞ্জন ঠিক করতে পারে না—এই চিঠি সত্যি কি কোনও শিশুর লেখা? নাকি কে যেন শিল্পীর মন টানার জন্য সাজিয়ে পাঠিয়েছে? তবে সেটা যে শিশুর লেখা, সেটা বুঝতে তার সময় লাগে না। অক্ষরের অসম্পূর্ণতা, বানানভুল, আর চিঠির শেষ লাইনে আঁকা একটা ছোট পাখির ছবি—সবটাই বলে দেয়, এই বেলুন কোনও ইশতেহার নয়, এটা জীবন বাঁচানোর মিনতি। পরদিন সকালে সে গুগল করে, খোঁজ নিতে চায় ‘টুম্পা’ নামের ক্যান্সার আক্রান্ত শিশুর খোঁজে, হাওড়া ও কলকাতার বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালের তালিকা দেখে। কোথাও সরাসরি কিছু না পেলেও, এক সাংবাদিক বন্ধুর মাধ্যমে জানতে পারে, হাওড়ার একটি হাসপাতালে এক শিশুর “লাল বেলুন চিঠি” নিয়ে কিছু নার্স কথা বলছে। সেই সূত্রে সে একদিন পৌঁছে যায় সেই শিশু-ক্যান্সার ওয়ার্ডে। চারদিকে নীরবতা, হালকা ক্লোরিনের গন্ধ, আর সময়ের মতো ধীর হাঁটাচলা। হঠাৎ করেই সে দেখে সেই মুখ—চোখে দুঃখ নয়, জেদ; গালে রক্তের অভাব, কিন্তু চোখে আলোর ঝিলিক। টুম্পা। জানালার পাশে বসে সে একটি নতুন চিঠি লিখছে। তার পাশেই তনুশ্রীদি, বেলুনের ফিতা ঠিক করে দিচ্ছেন। নীলাঞ্জন দাঁড়িয়ে থাকেন দরজার কাছে। তার মনে হয়—এতো ছোট একটা শরীরে এত শক্তি থাকে কীভাবে?
চিঠির শেষ লাইনে যখন টুম্পা লিখে, “তুমি কি এবার সত্যিই এসেছো?”—তখন সে হঠাৎ টের পায়, বাচ্চাটি তাকে দেখে ফেলেছে। সে ধীরে ধীরে এগিয়ে যায়। নার্সরা প্রথমে অবাক হয়, কেউ কেউ চোখ তুলে দেখে। ডাক্তার অরিত্র সেন এসে বলেন, “আপনি?” নীলাঞ্জন ভদ্রভাবে বলেন, “আমি শিল্পী… আমার হাতে ওর চিঠি পৌঁছেছিল। আমি শুধু দেখতে চেয়েছিলাম, কে লিখেছে…” ডাক্তার প্রথমে দ্বিধা করে, কিন্তু টুম্পার একমাত্র কথায় মন গলে যায়—”এই লোকটা আমার বেলুন ধরেছে, ওকে ঢুকতে দাও।” সেই মুহূর্তে নীলাঞ্জন বোঝে, শুধু সে নয়—এই মেয়েটিও অপেক্ষা করছিল এমন কাউকে, যে তার ছোট্ট চিঠির উত্তরে হাঁটবে এতটা পথ। ওয়ার্ডের জানালা দিয়ে বাইরে তাকালে দেখা যায় হালকা আকাশ, কুয়াশা ছড়িয়ে আছে দূর নদীর পাড়ে। নীলাঞ্জনের হাতে তখনও চিঠিটা ধরা। সে নিচু হয়ে বলে, “তুই উড়তে চাস না? আমি তোর জন্য আকাশ আঁকব।” টুম্পা একবার চোখ তুলে চায়, তারপর বলে, “তুমি আঁকো, আমি তাতে বসে উড়ব।” হাসপাতালের বাতাসের মধ্যে প্রথমবার যেন কোথাও কল্পনার ডানা ঝাপটায়।
অধ্যায় ৩
হাসপাতালের সেই ঘরটায় ঢোকার পর থেকে নীলাঞ্জন যেন কোনও অজানা স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়েছেন। প্রতিটি বাচ্চার চোখে কিছু না কিছু অসমাপ্ত গল্প রয়েছে—কেউ বাবাকে মিস করে, কেউ স্কুল যেতে চায়, কেউ ব্যথা কমাতে চায়, আর কেউ কেবল একটু রোদ চায় জানালার ধারে বসে। কিন্তু টুম্পার চোখে ছিল শুধু একটা শব্দ—“উড়া”। চিকিৎসার ব্যথা, শরীরের দুর্বলতা, আর চারপাশের ভয়াবহ বাস্তবতার মধ্যে সে এক আকাশ বুনে রেখেছে নিজের কল্পনায়। নীলাঞ্জন তাকে দেখে শুধু শিল্পীর চোখে নয়, একজন ভাঙা মানুষের চোখে—যে নিজেও একসময় একটা ছোট মেয়ে হারিয়েছিল। সেই মেয়ের নাম ছিল অনন্যা, বয়স সাত, আঁকায় দারুণ আগ্রহ ছিল। আজ যদি সে বেঁচে থাকত, হয়তো টুম্পার মতোই দেখতে হতো। টুম্পার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে তার স্মৃতির দরজা খুলে যায় বারবার। তনুশ্রীদি লক্ষ্য করেন এই নতুন আগন্তুক কিছু আলাদা, তার চোখে যেটুকু দুঃখ আছে, তা শুধুমাত্র সহানুভূতির নয়—তা ব্যক্তিগত, তা পুঞ্জীভূত, তা গভীর। তিনি নীলাঞ্জনকে বলেন, “বাচ্চাটার স্বপ্ন বড়, আপনি যদি পাশে থাকেন, ও হয়তো সাহস পাবে। আমরা তো শুধু শরীর ভালো রাখার চেষ্টা করি, মনটা তো আপনাদেরই রঙে ভরে উঠবে।”
নীলাঞ্জন প্রতিদিন সকালবেলা হাসপাতালে আসেন। সঙ্গে নিয়ে আসেন কিছু রং, কয়েকটি কাগজ, আর এক ঝাঁক নতুন গল্প। টুম্পা প্রতিদিন একেকটা ছবি আঁকে—কখনও একটা লাল পাখি, কখনও একদলা মেঘের উপর দাঁড়িয়ে থাকা ছোট্ট মেয়ে, কখনও বিশাল এক বেলুন শহর, যেখানে সবাই উড়ছে নিজের ইচ্ছেয়। সে বলে, “তুমি কি জানো? আমি বড় হলে বেলুনের দোকান খুলব, শুধু লাল রঙের বেলুন বিক্রি করব। যারা দুঃখে থাকবে, তারা একটা বেলুন কিনে আকাশে ওড়াবে, ব্যস… সব ভুলে যাবে।” নীলাঞ্জনের গলায় কান্না চেপে আসে। সে বলে, “তুই যখন বড় হবি, আমি তোর দোকানের সামনের দেয়াল আঁকব।” এইসব ছবিগুলো হাসপাতালের দেওয়ালে টাঙানো হয়—ডা. অরিত্র নিজে উদ্যোগ নেন। তিনি অনুভব করেন, এই শিল্প ও কল্পনার জগৎ কেবল টুম্পার নয়, বরং ওয়ার্ডের সব শিশুর কাছে এক ধরণের ওষুধ হয়ে উঠেছে। একদিন তিনি নীলাঞ্জনকে চুপিচুপি জিজ্ঞেস করেন, “আপনি শুধু শিল্পী নন, আপনি তো একজন জীবনদাতা।”
নীলাঞ্জন উত্তর দেন, “আমি নিজেকে আবার খুঁজছি, এই মেয়েটির স্বপ্নের মধ্যে আমি নিজের হারানো মেয়েটিকে দেখতে পাই।”
এদিকে, টুম্পার শরীর আস্তে আস্তে কেমোথের প্রতিক্রিয়ায় দুর্বল হয়ে পড়ছে। জ্বর, বমি, ক্ষুধামান্দ্য—সব একসাথে এসে তাকে চেপে ধরেছে। সোমনাথ চুপচাপ বসে থাকে বিছানার ধারে। সে কিছু বলে না, কেবল মেয়ের চুলে হাত বুলিয়ে দেয়। কিন্তু মেয়েটি একদিন জ্বরের মধ্যেও বলে, “বাবা, আমি উড়ব… এই কষ্টটা পেরিয়ে গেলে আমি উড়ব।” নীলাঞ্জন জানে, এখন কেবল ছবি নয়, এখন দরকার শক্তি, প্রেরণা। সে শুরু করে নতুন একটা দেওয়াল প্রজেক্ট—“Sky Wall”, যেখানে শিশু-ক্যান্সার ওয়ার্ডের প্রতিটি শিশু নিজেদের স্বপ্ন আঁকবে। হাসপাতালের করিডোরে এক বিশাল দেওয়াল রঙে ভরে উঠতে থাকে—টুম্পার আঁকা লাল বেলুন, ছোট্ট হৃদয়েরা, হাসিমুখ, পাখিরা, আর মাঝে মাঝে লেখা কিছু শব্দ—“ভয় পেও না”, “আমিও আছি”, “উড়তে শেখো”। রোগীরা অবাক হয়, নার্সরা দাঁড়িয়ে পড়ে, কেউ কেউ মোবাইলে ছবি তোলে। আর টুম্পা, সে আবার হাসে—একটা নির্ভীক হাসি, যে হাসির গভীরে জেদ, সাহস আর প্রেরণা একসাথে হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে থাকে।
নীলাঞ্জন বুঝতে পারেন, সে শুধু একটা চিঠি পড়েনি—সে একটা জীবন ধরেছিল হাতে।
অধ্যায় ৪
সকালটা কিছুটা অন্যমাত্রায় শুরু হয়। হাসপাতালের শিশু-ক্যান্সার ওয়ার্ডের করিডোরজুড়ে আজ যেন আলো একটু বেশি উজ্জ্বল, যেন দেয়ালের ছবিগুলোও শ্বাস নিচ্ছে। “Sky Wall”-এর সামনে দাঁড়িয়ে ছোট্ট মিতুল বলে, “এই পাখিটা আমি এঁকেছি, কিন্তু রংটা দাদু দিয়েছে।” পাশে দাঁড়িয়ে থাকা নীলাঞ্জন বসু মাথা নিচু করে হাসেন—এই শিশুদের কল্পনা, যার কোন ব্যাকরণ নেই, কোনো সীমা নেই, সেটা এখন হাসপাতালের দেয়ালে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে। টুম্পা আজ একটু বেশি চুপচাপ। তার জ্বর প্রায় সেরে এসেছে, কিন্তু চোখের নিচে কালি, কণ্ঠে ক্লান্তি। কিন্তু ক্লান্তির মাঝেও সে বলে, “নীলাঞ্জনদা, আমার ছবি কবে মেলায় টাঙাবে?” নীলাঞ্জন চমকে ওঠে—মেলা? টুম্পার মন আবার উড়তে চাইছে! সে বলে, “তুই চাস, তোকে একটা প্রদর্শনীতে রাখি?” টুম্পা হেসে বলে, “না গো, আমায় একটা মেলায় বসাও, যেখানে সব ছবিই শুধু স্বপ্নের!”
নীলাঞ্জনের মনে হয়, এর মানে কেবল ছবি নয়—এই মেয়ে নিজের কষ্ট ভুলে গিয়ে অন্যদের স্বপ্ন বিক্রি করতে চায়। তার কল্পনায় একটা ভাবনা জন্ম নেয়—শুধু হাসপাতালের দেওয়াল নয়, শহরজুড়ে ছড়িয়ে দিতে হবে এই শিশুদের আঁকা রঙ। সেইদিনই সে সিদ্ধান্ত নেয়—“লাল বেলুন” নামে একটি চলমান চিত্রপ্রদর্শনী করবে, যেখানে শিশুদের আঁকা স্বপ্নগুলো ভেসে বেড়াবে শহরের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে।
ডা. অরিত্র সেন প্রথমে বিস্মিত হন—“এক্সিবিশন? ক্যান্সার ওয়ার্ডের বাচ্চাদের ছবি নিয়ে?” কিন্তু কিছুক্ষণ পরে তার মুখে একরাশ প্রশংসা ঝরে পড়ে। তিনি বলেন, “আপনি যেটা ভাবছেন, সেটা কেবল শিল্প নয়, এটা একটা বিপ্লব।” হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অনুমতি নেওয়া হয়, একাধিক স্থানীয় ক্লাব, কিছু দানশীল ব্যক্তি ও সাংস্কৃতিক সংস্থার সহযোগিতায় ‘লাল বেলুন: এক স্বপ্নের প্রদর্শনী’ শুরু করার পরিকল্পনা নেয় নীলাঞ্জন। প্রথম দিন শুরু হয় একটি ছোট্ট হলে, যেটা শহরের এক কোণে অচেনা ছিল এতদিন, কিন্তু এখন সেখানে টানানো থাকে টুম্পার আঁকা ছবি—লাল পাখি, বেলুন, আকাশ, একটা ছোট্ট মেয়ের উড়ন্ত ছায়া। প্রদর্শনী দেখতে এসে শহরের মানুষ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে—এই ছবিগুলো কেবল শিশুসুলভ আঁকিবুকি নয়, এগুলো তাদের জীবনের প্রার্থনা। সংবাদমাধ্যম, সোশ্যাল মিডিয়া, ব্লগাররা বিষয়টি লুফে নেয়। শিরোনামে উঠে আসে—“হাসপাতালের বাচ্চারা আঁকছে বেঁচে থাকার রং”, “লাল বেলুন হয়ে উঠছে জীবনের নতুন প্রতীক”।
অন্যদিকে, হাসপাতালের সেই ছোট্ট ওয়ার্ডে নতুন নতুন বাচ্চারা ভর্তি হচ্ছে—তারা কেউ ক্যান্সারকে চেনে না, কেউ খুব ভয় পায়, কেউ চোখের জল লুকাতে জানে না। কিন্তু তারা দেখতে পায়, সেখানে একটা মেয়ে আছে, যে ছবি আঁকে, যে জানালা দিয়ে চিঠি পাঠায় আকাশে, যে কখনো মরতে চায় না, বরং আকাশে উড়তে চায়। টুম্পা এখন শুধু রোগী নয়, সে এক প্রেরণার প্রতীক। ছোট বাচ্চারা তার সঙ্গে ছবি আঁকে, কেউ কেউ তার আঁকা পাখির নাম দেয়, কেউ কেউ তার জন্য গান গায়। তনুশ্রীদি বলেন, “এইটুকু মেয়েটা আমাদের সবকিছুর কেন্দ্র হয়ে উঠেছে।” একদিন, সন্ধ্যাবেলায়, নীলাঞ্জন যখন ওয়ার্ডে এসে পৌঁছান, টুম্পা তার হাতে একটা চিঠি ধরিয়ে দেয়—একটা নতুন বেলুনের চিঠি। তাতে লেখা,
“নীলাঞ্জনদা, তুমি আমার স্বপ্ন আঁকো। যদি আমি উড়তে না পারি, তুমি যেন আমার হয়ে উড়ো। আকাশে একটা দাগ রেখে যেও, যেন সবাই বুঝতে পারে, একটা মেয়ে ছিল যে বাঁচতে চেয়েছিল।”
চিঠিটা হাতে নিয়ে নীলাঞ্জনের চোখ ভিজে আসে, আর তিনি বুঝে যান—এই শহর আর আগের মতো থাকবে না। এখানকার আকাশে এখন একটা লাল দাগ রয়ে যাবে—একটা মেয়ে, একটা স্বপ্ন, একটা বেলুনের মতো।
অধ্যায় ৫
হাসপাতালের দেওয়ালে যখন টুম্পার আঁকা স্বপ্নগুলো উজ্জ্বল রঙে ঝলমল করতে থাকে, তখন তার শরীরের রক্তশূন্যতা যেন আরও প্রকট হয়ে ওঠে। কেমোথেরাপির শেষ দফা শুরু হয়েছে। রক্তচাপ কমে যায় বারবার, মুখ শুকিয়ে থাকে, পেটের ব্যথা একরাশ কুঁচকে থাকা কষ্ট। কিন্তু সে এসব কিছু কাউকে বুঝতে দেয় না। বরং চুপ করে বসে আঁকে—একদিন এক কালো পাখি, যার ডানায় দাগ আছে; আরেকদিন সে আঁকে একটা নদী, যেখানে লাল বেলুন ভাসছে। নীলাঞ্জন বসু বুঝতে পারে, টুম্পা এখন তার জীবনকে গল্পে পরিণত করছে। সে এখন শুধু ক্যানভাস নয়, নিজেই একটা চলমান ছবি, যার প্রতিটি রঙ মৃত্যুকে অস্বীকার করে বাঁচার দিকে ছুটে চলেছে। টুম্পা একদিন হঠাৎ বলে, “নীলাঞ্জনদা, তুমি বলো তো, একটা স্বপ্ন আঁকা যায়?” নীলাঞ্জন প্রশ্নটা শুনে চমকে যায়। সে ধীরে বলে, “স্বপ্ন কখনও পুরো আঁকা যায় না, কিন্তু স্বপ্নের ছায়া আঁকা যায়, ঠিক যেমন তুই করিস রোজ।” মেয়েটা হাসে। তারপর বলে, “তাহলে আজ আমি একটা অদেখা শহর আঁকব, যেখানে সবাই উড়তে জানে, সবাই হাসতে জানে, কেউ মরে না। নাম হবে ‘লাল বেলুনের শহর’।” নীলাঞ্জন বুঝে যায়, এখন সময় হয়েছে সেই শহরকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার।
পরদিন থেকেই সে উদ্যোগ নেয় এক নতুন আয়োজনের—হাসপাতালের বাইরে একটা ওপেন আর্ট ফেস্টিভ্যাল, যেখানে কেবল শিশু-ক্যান্সার রোগীদের আঁকা ছবি থাকবে। ডাক্তার অরিত্র সেন বলেন, “এই শহরের মানুষ এমন কিছু কখনও দেখেনি। এই প্রথমবার অসুস্থ শিশুরা তাদের কষ্ট নয়, তাদের কল্পনা নিয়ে রাস্তায় নামবে।” সেই আয়োজনের নাম রাখা হয় টুম্পার দেওয়া নামে—“লাল বেলুনের শহর”। শহরের বিভিন্ন পাড়া, স্কুল, আর্ট কলেজ, সংস্কৃতি সংগঠন থেকে সহায়তা আসতে থাকে। কেউ দেয় রঙ, কেউ দেয় খাবার, কেউ ছবি বাঁধিয়ে দেয় দেয়ালে লাগানোর জন্য। একদিন বিকেলে টুম্পা ওয়ার্ডে শুয়ে আছে, খুব দুর্বল। গায়ে স্যালাইন, চোখে ঘুম ঘুম। তনুশ্রীদি এসে বলে, “তোর দেওয়া শহরটা তৈরি হচ্ছে, মা। তুই উঠলি না?” মেয়েটা চোখ খুলে একটু হাসে, তারপর বলে, “না গো, আমি উঠতে পারছি না, কিন্তু তুই গিয়ে দেখে আয়… বলিস সবাইকে, আমি এসেছি, লাল বেলুন হয়ে।”
এই বাক্যগুলো যেন গোটা দলের জন্য এক আশীর্বাদ হয়ে যায়। নীলাঞ্জন তার নিজ হাতে একটা পোস্টার আঁকে—একটি মেয়ে জানালার ধারে বসে বেলুন ছেড়ে দিচ্ছে আকাশে, আর বেলুনটা হয়ে যাচ্ছে সূর্য।
প্রদর্শনীর দিন এসে পড়ে। স্টেট গ্যালারির প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে থাকে শতাধিক ছবি—সবই শিশুদের আঁকা। শহরের মানুষ ভিড় করে দেখে—এই প্রথমবার তারা জানতে পারে, ক্যান্সারে আক্রান্ত শিশুরা কেবল অসহায় নয়, তারা শিল্পী, তারা যোদ্ধা। প্রতিটি ছবির পাশে একটা ছোট্ট গল্প—কেউ লিখেছে, “আমার মা আর বাবার হাতে একসাথে আবার চাঁদ দেখব”, কেউ লিখেছে, “আমি উড়ব একটা বিশাল পাখির পিঠে চড়ে”, আর টুম্পার ছবির নিচে লেখা—“আমি মরিনি, আমি উড়েছি।” মানুষ মুগ্ধ হয়ে পড়ে, অনেকে চোখ মুছে ফেলে। সংবাদমাধ্যম ছড়িয়ে দেয় এই খবর—“লাল বেলুনের শহর—এক মেয়ের স্বপ্ন, এক শিল্পীর লড়াই।” আর ওয়ার্ডে শুয়ে থাকা টুম্পা, কানে হেডফোনে সংবাদ শুনে বলে, “আমি তো বলেছিলাম, স্বপ্ন আঁকা যায়। কেউ না কেউ ঠিক বুঝবে।”
ডা. অরিত্র, তনুশ্রীদি, নীলাঞ্জন—সবাই দাঁড়িয়ে থাকে বিছানার পাশে। একজন ডাক্তার, একজন বুয়া, একজন শিল্পী—তিনজনের চোখে একসাথে জল, কারণ তারা জানে, এই ছোট্ট মেয়েটি তাদের প্রত্যেকের জীবনটাকে অন্যভাবে রাঙিয়ে দিয়ে গেছে।
অধ্যায় ৬
প্রদর্শনী শেষ হওয়ার তিন দিন পর থেকেই টুম্পার শারীরিক অবস্থা আরও ভেঙে পড়ে। হিমোগ্লোবিন কমে যায়, সারা গায়ে ফোলাভাব, নখের নিচে নীল ছোপ। ডাক্তার অরিত্র সেন এক সন্ধ্যায় নিঃশব্দে তার বাবাকে বলেন, “সব চেষ্টা করছি, কিন্তু মেয়েটার শরীর আর সাড়া দিচ্ছে না।” সোমনাথ কিছু বলে না। মুখ নিচু করে সে শুধু বলে, “কিন্তু ওর তো লাল বেলুনের শহর ছিল…” আর সেই রাতে টুম্পা জানালার দিকে চেয়ে চুপ করে থাকে। তার গলায় অস্পষ্ট স্বর—“আমি যেন কিছু রেখে যেতে পারি… কিছু যা থাকবে, আমার না থাকলেও।” ঠিক সেই সময়েই নীলাঞ্জন বসু এসে পৌঁছায় হাতে একটা নতুন ক্যানভাস নিয়ে। সে বলে, “তুই তো স্বপ্ন আঁকিস, কিন্তু আজ আমার পালা। আমি আজ তোর একটা ছবি আঁকব, যেটা তুই শেষ করবি।”
টুম্পার মুখে ম্লান হাসি। কাগজে সে আঁকে একটা আকাশ, যার মাঝখানে লাল বেলুন। বেলুনের সঙ্গে বাঁধা একটা ছোট্ট ঘুড়ির মতো টুম্পার নাম। পাশে লিখে, “আমি যদি থাকি না, আমার স্বপ্ন যেন থাকে।” এই ছবিটাই হয়ে ওঠে গল্পের মূলচিত্র—রক্ত, রঙ আর রোদের এক মিশেল, যেখানে বাস্তবতা আর কল্পনার সীমারেখা মুছে যায়।
পরদিন সকালে হাসপাতালে অনলাইন সংবাদপত্র থেকে জানা যায়, “লাল বেলুনের শহর” প্রদর্শনীর ছবি নিয়ে একটি আন্তর্জাতিক গ্যালারি আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তারা চায়, এই শিশুর আঁকা ছবিগুলো নিউ ইয়র্ক, বার্লিন আর টোকিওর মতো শহরে প্রদর্শন করতে। ডাক্তার অরিত্র খুশি হয়ে বলেন, “টুম্পা, তুই তো বিশ্বজয় করে ফেললি!” কিন্তু টুম্পা তখন নিস্তেজ। তার কপালে ঠাণ্ডা জল দেওয়া হচ্ছে। সে শুধু বলে, “ওরা যেন জানে, আমি মরতে চাইনি… আমি শুধু উড়তে চেয়েছিলাম।” সেই রাতে তার জ্বর হঠাৎ খুব বেড়ে যায়। ICU-তে নেওয়া হয়। সোমনাথ জানে না, প্রার্থনা কীভাবে করতে হয়। সে শুধু জানালার বাইরে তাকিয়ে বলে, “তুমি যদি থেকো, তাকে একটু সময় দাও। ওর বেলুনগুলো এখনো সব উড়েনি।”
এদিকে, নীলাঞ্জন বসু ঘরে বসে সেই শেষ চিঠির ছবি আঁকেন—একটা ছোট মেয়ে জানালার গরাদের মাঝ দিয়ে বেলুন ছেড়ে দিচ্ছে, আর সেই বেলুনের ছায়া আকাশে একটা দাগের মতো বসে আছে। তনুশ্রীদি মোবাইলে ওয়ার্ডের বাচ্চাদের একটা ভিডিও বানান, যেখানে সবাই বলে, “আমরা টুম্পাদির শহরে থাকতে চাই!” সেই ভিডিও ভাইরাল হয়ে যায়।
ভোরের আলোয় হাসপাতালের ICU-র করিডোরে বসে থাকা মানুষগুলো ধীরে ধীরে ঘুমিয়ে পড়ে। শুধু নীলাঞ্জন এক কোণে বসে টুম্পার আঁকা চিঠিটা ধরে রাখে, আর ভাবে—এই ছোট্ট জীবনটা এত গভীর হতে পারে? হঠাৎ নার্স এসে বলে, “টুম্পা একটু চোখ খুলেছে… উনি আপনাকে দেখতে চাইছে।” নীলাঞ্জন ছুটে যায় ভিতরে। টুম্পার মুখ ফ্যাকাশে, ঠোঁট শুকনো, কিন্তু চোখ দুটো ঠিক আগের মতোই দীপ্ত। সে বলে, “নীলাঞ্জনদা… আমার শহরটা রোদে ভেসে উঠবে তো?”
নীলাঞ্জন বলে, “তোর শহরে শুধু রোদ নয়, তুইই রোদ, টুম্পা। তুই তো চলে যাবি না, তুই ছড়িয়ে যাবি।” মেয়েটি মৃদু হাসে। সে বলে, “তাহলে… আমায় রোদ হতে দাও।”
হাসপাতালের বাইরের আকাশে তখন সূর্য উঠছে ধীরে ধীরে, আর কোথা থেকে একটা লাল বেলুন উড়ে এসে গেঁথে যায় সেই আকাশে—একটা অনন্ত চিহ্নের মতো।
অধ্যায় ৭
টুম্পার শরীর প্রতিদিন আরও নরম, আরও নিঃশব্দ হয়ে উঠছিল, ঠিক যেন কোনও অদৃশ্য আলো তাকে ধীরে ধীরে ছায়ায় নিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু অদ্ভুতভাবে তার মুখে সেই ভয়ের ছায়া ছিল না। ICU-র বিছানায় শুয়ে সে চোখ বন্ধ করে থাকলেও মাঝে মাঝে হঠাৎ বলে উঠত, “আমি এখনো আকাশে যাইনি… কিন্তু বেলুনগুলো প্রস্তুত।” সোমনাথ তার পাশে বসে প্রতিটি মুহূর্ত গুনছিল—বাবা হয়ে যে কিছু করতে পারে না, সেই যন্ত্রণায় সে যেন প্রতিদিনই আরও ক্ষয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে এক অলৌকিক জিনিস ঘটে—টুম্পার লেখা সবগুলো চিঠি, যেগুলো সে বেলুনে বেঁধে ছাড়ত, সেগুলোর কপি একত্র করে তনুশ্রীদি আর নীলাঞ্জন বসু মিলে একটা ছোট বই বানিয়ে ফেলে—“লাল বেলুনের চিঠি”। আর সেই বই পৌঁছে যায় কলকাতার এক নামী প্রকাশকের হাতে, যিনি সেই বই ছাপানোর সিদ্ধান্ত নেন।
ডা. অরিত্র নিজে সেই খবরে হাসপাতালে ছুটে আসেন এবং ICU-র কাচের দরজার ওপারে দাঁড়িয়ে বলেন, “টুম্পা, তোর বই বেরোচ্ছে, তুই এখন লেখিকা!” মেয়েটি চোখ মেলে চেয়ে হালকা হাসে। নীলাঞ্জন ভিতরে গিয়ে বলে, “তোর বইয়ের মোড়ক উন্মোচনের দিন আমি তোর আঁকা সেই পাখিটার পোস্টার বানিয়ে রাখব, ঠিক যেমন তুই বলেছিলি।”
টুম্পা চোখ বন্ধ করে ফিসফিসিয়ে বলে, “তবে দাদা… আমার শেষ চিঠিটা তুমি লিখে দিও, আমি না পারলে।”
নীলাঞ্জনের গলা ধরে আসে। সে মাথা হেঁট করে বলে, “তুই পারবি টুম্পা। আমি শুধু তোর বেলুনটা ধরে রাখব, যখন তুই ছাড়বি…”
এর দুদিন পর এক সকালে ICU-র বাইরে সবাই দাঁড়িয়ে, কেউ প্রার্থনা করছে, কেউ কাঁধে মাথা রেখে নিঃশব্দে কাঁদছে। টুম্পার অবস্থা আশঙ্কাজনক। স্যালাইনের ফোঁটা চলার গতি স্তব্ধ হয়ে আসছে। হঠাৎ নার্স এসে ডাক দেন, “নীলাঞ্জনদা… ও আপনাকে দেখতে চায়।”
নীলাঞ্জন ছুটে গিয়ে টুম্পার পাশে বসে। মেয়েটি খুব আস্তে বলে, “তুমি কি আজও ছবি আঁকবে?”
নীলাঞ্জন বলে, “তুই বল, কী আঁকব।”
টুম্পা চোখ বন্ধ করে বলে, “আঁকো… জানলার ওপারে একটা লাল বেলুন, যার সঙ্গে একটা ঘুড়ির লেজ… আর একটা ছায়া, যে বেলুনটার দিকে হাঁটছে। লিখে দিও নিচে—‘আমি মরিনি, আমি উড়েছি।’”
এই বলে মেয়েটি চোখ বন্ধ করে ফেলে। বুকটা খুব ধীরে ওঠানামা করে। ঘরটা নিস্তব্ধ, যেন সময়ও থমকে গেছে। সেই মুহূর্তে জানালার ফাঁক দিয়ে একটি সত্যিকারের লাল বেলুন ভেসে আসে ভিতরে, ঘরের ঠিক মাঝখানে। কেউ জানে না সেটি কোথা থেকে এল, কিংবা কে ওড়াল।
ডা. অরিত্র তার নরম গলায় বলেন, “ও উড়েছে।”
চব্বিশ ঘণ্টা পরে, টুম্পার শরীরটিকে ছোট্ট সাদা চাদরে মুড়ে যখন বাইরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তখন হাসপাতালের ছাদ থেকে ছড়িয়ে দেওয়া হয় একশোটা লাল বেলুন—প্রত্যেকটিতে বাঁধা ছিল তার হাতের লেখা কিছু চিঠি। সারা হাসপাতাল, নার্স, চিকিৎসক, সহযোদ্ধা শিশুরা, সবাই মাথা নিচু করে দাঁড়ায়। তনুশ্রীদি হালকা গলায় বলে ওঠেন, “তুমি চলে যাওনি টুম্পা, তুই ছড়িয়ে গেছিস।”
নীলাঞ্জন বসু তার ডায়েরিতে শেষ লাইন লেখেন, “আজ আমি প্রথমবার বুঝলাম, কেউ কেউ বেঁচে না থেকেও বেঁচে থাকে। কেউ কেউ শেষ চিঠি দিয়ে শুরু করে একটা শহর—যেখানে সব বেলুনই লাল হয়।”
টুম্পার রক্ত দিয়ে রঙ মিশিয়ে তৈরি সেই ছবিটা, যেটার নিচে লেখা ছিল—“আমি মরিনি, আমি উড়েছি”, সেটা এখন শহরের শিশু-ওয়ার্ডের দেয়ালে টাঙানো। আর সেই ছবির নিচে বসে থাকা এক ছোট্ট মেয়ের চোখে স্বপ্ন—যে বলছে, “আমি একদিন ওই শহরে যাব, যেখানে টুম্পাদি উড়ে গিয়েছিল।”
অধ্যায় ৮
এক বছর পর, সেই একই হাসপাতাল, সেই শিশু ওয়ার্ড। দেওয়ালে এখনও টানানো টুম্পার আঁকা সেই ছবি—লাল বেলুনে ভেসে থাকা ছোট্ট ছায়া, নিচে লেখা: “আমি মরিনি, আমি উড়েছি।” নতুন ভর্তি হওয়া ছোট্ট মেয়েটা, নাম রাশি, ছবিটার সামনে দাঁড়িয়ে চোখ মেলে চেয়ে থাকে, বলে, “এই মেয়েটি কে ছিল?” তনুশ্রীদি হাঁটু গেঁড়ে বসে বলেন, “ওর নাম ছিল টুম্পা। সে আমাদের শেখায় কীভাবে স্বপ্ন দেখে বাঁচতে হয়।”
এই এক বছরে অনেক কিছু বদলে গিয়েছে। “লাল বেলুন” এখন শুধু একটা হাসপাতালের দেওয়ালজুড়ে আঁকা ছবি নয়, এটা একটা আন্দোলন। নীলাঞ্জন বসু সেই ছবিগুলোর প্রদর্শনী নিয়ে দেশের নানা প্রান্তে ঘুরে বেড়ান—শিশু হাসপাতাল, স্কুল, লাইব্রেরি, মেট্রো স্টেশন, এমনকি জেলখানায়ও। টুম্পার আঁকা চিঠির বই ‘লাল বেলুনের চিঠি’ অনূদিত হয়েছে ১১টি ভাষায়। আন্তর্জাতিক শিশু-স্বাস্থ্য ফাউন্ডেশন এই উদ্যোগকে “emotional therapy through dream-art” নামে স্বীকৃতি দেয়। কিন্তু নীলাঞ্জনের কাছে এগুলো সবই গৌণ—কারণ সে জানে, এই শহরের আকাশে এখনও প্রতিদিন একটা না একটা বেলুন উড়ে যায়, আর সেই বেলুনের সঙ্গে লেগে থাকে একটা ছোট্ট শিশুর শেষ চিঠি।
সেই চিঠিগুলো এখন হাসপাতালের একটা “Dream Letter Box”-এ জমা হয়। প্রতি মাসে সেই চিঠিগুলো নিয়ে বেরোয় এক ছোট্ট ম্যাগাজিন, নাম “বেলুননামা”। রোগীর পরিবার, নার্স, ডাক্তার এমনকি সাধারণ মানুষও সেই ম্যাগাজিনে চিঠি পড়ে কাঁদে, হাসে, অনুপ্রেরণা খুঁজে পায়। একদিন এক মা এসে বললেন, “আমার ছেলে তো ক্যান্সারে ভুগছে, কিন্তু সে এখন টুম্পার মতো বাঁচতে শিখেছে। সে বলে, ‘আমি কষ্ট পাচ্ছি, কিন্তু আমি উড়ব।’”
নীলাঞ্জন বসু মাঝে মাঝে হাসপাতালের চত্বরেই বসে থাকেন, তার ডায়েরিতে আঁকেন নতুন স্বপ্ন। একদিন রাশি তার পাশে এসে বসে বলে, “দাদু, আমি যদি ভালো হয়ে যাই, তাহলে কি আমিও একটা শহর বানাতে পারব?”
নীলাঞ্জন হেসে মাথায় হাত রেখে বলে, “তুই তো তোর শহর শুরু করে ফেলেছিস… নাম দে, আমি ছবিটা আঁকা শুরু করি।”
রাশি বলে, “হবে… রংধনুর শহর, যেখানে সবাই গানে বাঁচে।”
সেই মুহূর্তে হাসপাতালের আকাশে আবার একটা লাল বেলুন উড়তে থাকে, যেন এক নতুন শিশুর স্বপ্ন বহন করে নিয়ে যাচ্ছে সেই অদৃশ্য, উজ্জ্বল শহরের দিকে।
আসলে, টুম্পা হয়তো একটা শিশুমাত্র ছিল, কিন্তু তার বিশ্বাস, সাহস আর কল্পনার ডানায় ভর করেই গড়ে উঠেছে এক চিরকালীন শহর—লাল বেলুনের শহর। এক শহর যেখানে মৃত্যু নেই, শুধু বাঁচার আকাঙ্ক্ষা আছে। এক শহর যেখানে প্রতিটি চিঠি একটা নতুন জীবনের দরজা খুলে দেয়।
নীলাঞ্জন বসু তার এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “টুম্পা আমাকে শিল্পী বানায়নি, মানুষ বানিয়েছে। আমি ওর শেষ চিঠির কালি, আমি শুধু সেটা আঁকা শিখেছিলাম।”
আজও, প্রতিটি লাল বেলুনে বাঁধা থাকে একটি করে স্বপ্ন—কখনও ছোট, কখনও অসম্পূর্ণ, কিন্তু প্রতিবারই সাহসী। সেই স্বপ্নগুলো আকাশ ছুঁয়ে বলে,
“আমি মরিনি, আমি উড়েছি।”
—
শেষ




