সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়
পর্ব ১: আগমন
কলকাতার শহরে কত রকমের গলি আছে—কোথাও শুধু হালচালহীন ইটের দেওয়াল, কোথাও পুরোনো বারান্দার ফাঁক দিয়ে নীচে ঝুলে থাকা ধুলো-কণার ঝালর, কোথাও অন্ধকার ড্রেনের কানা ধরে বাচ্চাদের খেলা। অথচ শহরের একই শরীরের ভেতরে কতগুলো ভিন্ন আত্মা বাস করে। অর্ণবের জন্য এই শহর ছিল চেনা—ক্লাসে যাতায়াত, কফিহাউসের টেবিলে আড্ডা, কলেজস্ট্রিটের বইয়ের দোকান। কিন্তু যেদিন সে উত্তর কলকাতার সেই গলিতে প্রথমবার ঢুকল, মনে হল অজানা এক শহর খুলে গেছে তার সামনে।
মোড়ে একটা ছোট্ট চা-দোকান। দোকানি মিঠুন দা চেনা মানুষ, তবে এখানে দাঁড়িয়ে অর্ণবকে দেখে খানিকটা অবাক। বলল,
—“কোথায় যাচ্ছিস? এই রাস্তাটা তোর পথ নয়।”
অর্ণব ব্যাগ কাঁধে চাপিয়ে হেসে বলল,
—“গবেষণার কাজ করছি দাদা। সমাজতত্ত্বের থিসিস। বুঝতেই পারছ, বাস্তব জগত না দেখলে লেখা কেমন করে সম্ভব?”
মিঠুন দা চা নেড়ে রেখে মাথা নাড়ল,
—“তুই যদি ভেতরে ঢোকাস, অনেক কিছু চোখে পড়বে। কিন্তু সবকিছু বইয়ে লেখা যায় না। সাবধানে চল।”
রাত তখন নামতে শুরু করেছে। গলির মাথায় টাঙানো লাল বাতিটা হঠাৎ জ্বলে উঠল। একটা মৃদু আলোর ঝাঁকুনি গোটা রাস্তা রঙিন করে দিল। দিনের বেলা যেখানে শুধু শুকনো ড্রেন আর ফাটা দেওয়াল চোখে পড়ে, রাত নামলেই সেই একই গলি হয়ে ওঠে অন্য রকম। যেন একেবারে আলাদা পৃথিবী।
অর্ণব ভেতরে পা বাড়াতেই তাকে ঘিরে ধরল এক অচেনা গন্ধ। তাতে মিশে আছে সস্তা আতরের ঝাঁঝালো গন্ধ, রান্না না হওয়া পেঁয়াজ-রসুনের তীব্রতা, ঘামে ভেজা শরীরের ক্লান্তি, আর পুরোনো দেওয়ালের স্যাঁতসেঁতে গন্ধ। হঠাৎ মনে হল, শহরের অন্য সব গন্ধ থেকে এই জায়গাটা ইচ্ছে করেই দূরে সরে গেছে।
রাস্তার দু’ধারে ছোট ছোট কামরা। কিছু কামরার দরজা খোলা, ভেতরে হলুদ বাতি জ্বলছে। দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকি মারছে কিছু চোখ। কারও চোখ কৌতূহলী, কারও তাচ্ছিল্যে ভরা, কারও আবার এতটাই নির্লিপ্ত যে মনে হয় তারা বহুদিন ধরে পৃথিবীকে আর পাত্তা দেয় না। গলির ওপাশে কয়েকজন কিশোরী দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে হাসছিল, কিন্তু সেই হাসির ভেতরে অর্ণব শুনল অচেনা একটা ব্যথা। হাসি যেন তাদের ঠোঁটে আটকে আছে, কিন্তু চোখের কোণে জমে থাকা অন্ধকার আড়াল করতে পারছে না।
অর্ণব হঠাৎ দেখতে পেল রাস্তার ধারে একটা বেঞ্চে বসে আছেন এক বৃদ্ধা। তাঁর গায়ে মলিন শাড়ি, কপালে সস্তা লাল টিপ, কিন্তু মুখে সময়ের দাগ যেন হাজারটা। অর্ণব কাছে গিয়ে নম্র গলায় বলল,
—“মা, এখানে নতুন এসেছেন?”
বৃদ্ধা হেসে ফেললেন, দাঁতগুলো অচেনা সাদা।
—“নতুন নয় বাবা, পুরোনো। এইসব ঘরের ভেতর একসময় আমিও থাকতাম। এখন শরীর চলেনা, শুধু বসে থাকি। কেউ কথা বললে ভালো লাগে।”
অর্ণব অবাক হয়ে গেল। বুঝতে পারল, এখানে শুধু শরীরের ব্যবসা চলে না, এখানে সময়ও আটকে থাকে।
কিছু দূরে একটি বাড়ির জানালা খোলা। ভেতর থেকে ভেসে আসছে গানের সুর। গলাটা ভাঙা, তবু সুরে অদ্ভুত গভীরতা। অর্ণব দাঁড়িয়ে পড়ল। গলির ভেতরকার সমস্ত শব্দ মিলিয়ে গেল, কেবল সেই সুরই যেন কানে বাজতে লাগল। গান থেমে গেল হঠাৎ। জানালার ভেতর থেকে তাকিয়ে আছে এক তরুণী। তার চোখে মিশে আছে প্রশ্ন আর অনুরোধ, সাহস আর অবিশ্বাস। মুহূর্তটাকে যেন কেউ আঁকতে পারলে ছবির মতো হয়ে যেত।
অর্ণবের ভেতরে কেমন যেন আলোড়ন উঠল। এই জায়গায় আসার আগে তার মনে ছিল গবেষণার হিসেব, সমাজের অন্য রূপ বোঝার তাগিদ। কিন্তু সেই চোখদুটো তাকে অন্যভাবে টানল। মনে হল, এখানেই তার থিসিস শুরু হবে।
রাস্তার শেষে থেমে অর্ণব ফিরে তাকাল। লাল বাতিটা তখনও জ্বলছে, গলির ওপরে অদ্ভুত এক ছায়া ফেলছে। মনে হল, এই গলিতে একবার ঢুকলে আর আগের অর্ণব থাকা যায় না।
পর্ব ২: প্রথম আলাপ
অর্ণব জানত, শুধু বাইরের দৃশ্য দেখে থিসিস লেখা সম্ভব নয়। মানুষের চোখের ভেতরের কাহিনি, তাদের নীরবতার ভেতর চাপা কান্না—সবটা না শুনে বোঝা যায় না। গলির ভেতর সে যতটা এগোচ্ছিল, ততটাই বুঝতে পারছিল এ এক সমান্তরাল দুনিয়া। আর সেই জানালার ভেতরকার সুর যেন তাকে ডাকছিল।
সে এগিয়ে গেল ধীরে ধীরে। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বলল,
—“আপনি কি গান গাইছিলেন?”
কিছুক্ষণের নীরবতা। তারপর পর্দার আড়াল থেকে একটা মুখ ভেসে উঠল। ফর্সা নয়, তবু টানটান সৌন্দর্যে ভরা। চোখদুটো কালো পাথরের মতো, যেন অনেকটা পথ হেঁটে এসেছে। ঠোঁটে হালকা হাসি, তবে সেই হাসি আড়াল করতে পারল না ভিতরের অবিশ্বাসকে।
—“তুমি কে? এখানে কেন এসেছ?” মেয়েটি জিজ্ঞেস করল। কণ্ঠে শঙ্কা আর কৌতূহলের মিশ্রণ।
অর্ণব গম্ভীর গলায় বলল,
—“আমি গবেষক। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করি। সমাজের নানা স্তরের জীবন নিয়ে কাজ করছি। আপনাদের জগতটাকে বুঝতে চাই।”
মেয়েটি হেসে ফেলল। সেই হাসি কেমন যেন কাঁটা বিছানো হাসি।
—“আমাদের জগত বুঝতে চাইছ? এ জগতের মানে কাকে বোঝানো যায়? আমরা নিজেরাই তো বুঝি না, বাইরের কেউ আবার কী বুঝবে?”
অর্ণব থমকে গেলেও পিছু হটল না। সে বলল,
—“তাও জানতে চাই। আপনার গল্পটা শুনতে চাই।”
মেয়েটি জানালার ফ্রেমে কনুই রেখে চুপ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল অর্ণবের দিকে। যেন যাচাই করছে, ছেলেটা সত্যিই কি জানতে চায়, না কি স্রেফ কৌতূহল মেটাতে এসেছে।
—“তুমি বসতে পারো। ভেতরে এসো।”
অর্ণব কিছুক্ষণ ইতস্তত করল। এ বাড়িগুলির ভেতর ঢোকার কথা সে ভাবে নি। কিন্তু গবেষণার তাগিদ, আর অদ্ভুত টান তাকে ঠেলে দিল ভেতরে ঢুকতে। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই একদম অন্য গন্ধ পেল সে—আতরের ঝাঁঝ নেই, বরং এক ধরনের শূন্যতার গন্ধ।
ঘরটা ছোট, দেওয়ালে খসে পড়া রঙ, একটা খাটে ছেঁড়া চাদর, পাশে একটা ছোট টেবিল আর ম্লান আলো। মেয়েটি খাটে বসে পড়ল। তার বয়স খুব বেশি নয়, হয়তো তেইশ-চব্বিশ। অর্ণব মনে মনে নাম দিল—মেঘলা। কারণ তার চোখের গভীরে যেন বৃষ্টিভেজা মেঘ লুকিয়ে আছে।
—“তোমার নামটা জানতে পারি?” অর্ণব প্রশ্ন করল।
—“নাম দিয়ে কী হবে? নাম দিয়ে তো কেউ ডাকে না এখানে। তবে শুনতেই চাইলে, আমার নাম রূপা।”
অর্ণব মাথা নাড়ল।
—“রূপা, তুমি গান খুব ভালো গাও।”
রূপা তিক্ত হেসে বলল,
—“গান আমার সঙ্গী। যেদিন থেকে এখানে এসেছি, গানের সাথেই বেঁচে আছি। ক্লায়েন্টরা যখন আসে, তখন তাদের খুশি করার অভিনয় করি। কিন্তু মন খারাপ হলে গান গাই। তবে এখানে গানও পাপের মতো শোনায়।”
অর্ণব নীরব হয়ে গেল। তার খাতায় নোট করার মতো কত কথা এসে যাচ্ছে, কিন্তু সে লিখল না। শুধু শোনার চেষ্টা করল।
রূপা এবার সোজা হয়ে বসে অর্ণবের দিকে তাকাল।
—“তুমি তো ছাত্র, তাই না? কেন এসেছ এখানে? তোমার তো অনেক জায়গায় যাওয়ার কথা।”
অর্ণব বলল,
—“কারও জীবনকে দূর থেকে দেখলে কেবল অর্ধেকটাই দেখা যায়। কিন্তু যদি কাছে বসে শোনা যায়, তবেই বোঝা যায় বাস্তব কত জটিল। আমি চাই, তোমাদের গল্প মানুষ জানুক।”
রূপা হেসে ফেলল আবার। তবে এইবার হাসিটা মিষ্টি, ভেতরে খানিকটা স্বস্তি।
—“মানুষ গল্প শুনতে ভালোবাসে, কিন্তু আমাদের গল্প শুনে তারা ভয় পায়। যেন আমরা তাদের সমাজের আয়নায় দাগ ফেলে দিই। তবু শোনাবে যদি, তবে লিখে রেখো।”
অর্ণব ধীরে ধীরে তাকে প্রশ্ন করতে শুরু করল।
—“কতদিন হলো এখানে?”
—“পাঁচ বছর।”
—“কেমন করে এসেছিলে?”
রূপা কিছুক্ষণ চুপ রইল। তারপর জানালার দিকে তাকাল।
—“এই শহরে আমি একা ছিলাম না। স্বপ্ন ছিল গানের, নাটকের। কলেজে পড়তাম। হঠাৎ একদিন প্রেমের ফাঁদে পড়লাম। ভেবেছিলাম জীবন বদলে যাবে। বদলেছিলও—কিন্তু যে রকমটা ভেবেছিলাম, সে রকম নয়। বিশ্বাসঘাতকতা মানুষকে কেমন করে সবকিছু থেকে ছিঁড়ে ফেলে দেয়, আমি জানি। শেষে ঠেলে দেওয়া হল এই জায়গায়।”
অর্ণব চুপচাপ শুনল। রূপার গলা কেঁপে উঠছিল, তবু চোখে জল এল না। হয়তো এতদিনে কান্নার অভ্যেসও মরে গেছে।
—“তুমি কি বেরিয়ে যেতে চাও?” অর্ণব প্রশ্ন করল।
—“চাই না ভাবছ? কিন্তু এই গলি যেন আমাদের চারপাশে দেওয়াল তুলে দেয়। কেউ এখানে ঢোকে, কেউ বেরোতে পারে না। শরীর আমাদের পণ্য, কিন্তু আত্মা? আত্মার তো দাম নেই।”
অর্ণব বুঝতে পারল, এ কথাগুলো শুধু গবেষণার জন্য নয়, মানুষের জন্যও মূল্যবান। রূপার প্রতিটি বাক্যে সে সমাজের আরেকটা অন্ধকার দিক দেখতে পাচ্ছিল।
হঠাৎ গলির ভেতর চিৎকার শোনা গেল। একটা মেয়েকে কেউ ধমকাচ্ছে। রূপা গা সিটকে নিল।
—“দেখছ? এটাই আমাদের প্রতিদিনের জীবন। বাইরে থেকে মানুষ ভাবে, এখানে শুধু লেনদেন হয়। কিন্তু আসল কষ্টটা চোখে পড়ে না।”
অর্ণব আর কিছু বলতে পারল না। সে শুধু অনুভব করল, এই মেয়েটি, এই ঘর, এই গলি—সবকিছু মিলিয়ে এমন এক সত্য লুকিয়ে আছে, যা বইয়ের পাতায় লিখলেও আসল যন্ত্রণা ধরা পড়বে না।
রূপা হঠাৎ মৃদুস্বরে বলল,
—“তুমি কি আবার আসবে?”
অর্ণব জানালার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল।
—“হ্যাঁ, আমি আবার আসব। তোমার গল্পটা শেষ করতে চাই।”
সেদিন রাতে অর্ণব যখন গলি থেকে বেরোল, লাল বাতি তখনও জ্বলছিল। কিন্তু মনে হচ্ছিল, বাতিটার আলো নয়, বরং একজোড়া কালো চোখ তাকে ভেতরে আটকে রেখেছে।
পর্ব ৩: অদেখা আঙিনা
অর্ণব ঠিক করেছিল, সে আর এই গলিতে ফিরবে না। সেদিন রাতে রূপার চোখে যে অদ্ভুত আকর্ষণ সে দেখেছিল, তা যেন তার গবেষণার গণ্ডি ছাড়িয়ে গেছে। সে জানত, গবেষক হিসেবে তার কাজ শুধু পর্যবেক্ষণ করা, অনুভব করা নয়। অথচ বুকের ভেতর অদ্ভুত একটা টান তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। তিন দিন পরেই আবার হাজির হল সে সেই একই লাল বাতির নীচে।
মিঠুন দা এবার আর অবাক হল না। শুধু হেসে বলল,
—“তুই তো ঠিক ফিরে আসবি বলেই ভেবেছিলাম।”
অর্ণব কোনও উত্তর দিল না। সোজা হেঁটে গেল ভেতরে।
গলি আগের মতোই। একই গন্ধ, একই আলো, একই ভাঙা দেওয়াল। তবে অর্ণব এবার খেয়াল করল, প্রতিটি ঘরের আড়ালে লুকিয়ে আছে আলাদা কাহিনি। কেউ হয়তো ফোনে কথা বলছে, কেউ গা ঘেঁষে বসে আছে অপরিচিত মানুষের সঙ্গে, কেউ আবার জানলার ধারে চুপচাপ তাকিয়ে আছে বাইরে।
রূপার ঘরের দরজা আধখোলা ছিল। ভেতরে ঢুকতেই সে গান গাইছিল। গলাটা মলিন, কিন্তু সুরে এত মায়া যে অর্ণব এক মুহূর্ত দাঁড়িয়েই গেল। রূপা গান থামিয়ে তাকাল,
—“ফিরে এসেছ?”
অর্ণব হাসল,
—“হ্যাঁ। তোমার কথা শুনে মনে হল গল্পটা অসম্পূর্ণ রেখো না।”
রূপা এবার বসার ইঙ্গিত দিল। অর্ণব খাটের পাশে একটা পুরোনো কাঠের চেয়ারে বসল। রূপা তার দিকে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর বলল,
—“তুমি কি জানো, এই পল্লির আঙিনার ভেতরে কত অদেখা গল্প আছে?”
অর্ণব নীরব মাথা নাড়ল।
রূপা জানালা খুলে দিল। বাইরে ছোট্ট এক উঠোন, সেখানে কয়েকজন মেয়ে কাপড় শুকোচ্ছে। হেসে খেলে নয়, যেন কাজের যন্ত্রণা ঢাকতে শুকনো আলোর মতো হাত নাড়ছে। তাদের হাসিতে প্রাণ নেই, চোখে কেবল ক্লান্তি।
—“ওই যে শিউলি দাঁড়িয়ে আছে, ওর বয়স মাত্র সতেরো। বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছিল প্রেমিকের হাত ধরে। ছেলেটা দু’দিন পরেই তাকে বিক্রি করে দিয়ে গেছে। এখন এই ঘরই ওর দুনিয়া।”
অর্ণব বুকের ভেতর কেমন যেন ধাক্কা খেল। ভাবছিল, এইসব কাহিনি বইতে পড়লেও বাস্তবে এতটা নিষ্ঠুর হতে পারে?
রূপা আবার বলল,
—“ওই কোণায় দাঁড়িয়ে যে কাকিমাকে দেখছ, ওর নাম সুলেখা। বয়স পঞ্চাশ পেরিয়েছে। একসময় নাচ শিখত, সিনেমার স্বপ্ন দেখত। কিন্তু স্বপ্ন ভাঙার শব্দ যতটা কর্কশ, তার চেয়ে বড় কর্কশ শব্দ হল ক্ষুধার। শেষমেশ এসে দাঁড়াল এখানে। এখনো প্রতিদিন দুটো শাড়ি পাল্টে মেকআপ করে বসে থাকে। অথচ জানে, খুব কম মানুষই আর তাকে ডাকে। তবু আশা ছাড়ে না।”
অর্ণব খেয়াল করছিল রূপার কণ্ঠে কোনও নাটকীয়তা নেই, আছে কেবল সরল সত্য।
সে ধীরে ধীরে প্রশ্ন করল,
—“তাহলে এখানে প্রতিটা ঘরের আড়ালেই আছে এমন এক অদেখা আঙিনা?”
রূপা মৃদু হাসল,
—“হ্যাঁ। আমাদের হাসির আড়ালে, সাজের আড়ালে, সস্তা আতরের গন্ধের আড়ালে সবই লুকিয়ে থাকে। কেউ বাইরে থেকে বুঝতে পারে না। আর আমরা কেউ চাইও না বাইরে বুঝুক। কারণ বুঝলেও তো আমাদের জীবন পাল্টাবে না।”
অর্ণব নোটবই বের করল। কিন্তু লিখতে গিয়েও থেমে গেল। মনে হল, এই গল্পগুলোকে কেবল শব্দে আটকে রাখা অন্যায় হবে। তবু সে খাতার পাতায় লিখল কয়েকটা লাইন—“অদেখা আঙিনা, প্রতিটি জানালার ভেতরে লুকোনো একেকটা আয়না।”
রূপা তার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল,
—“তুমি কি লিখছ?”
অর্ণব বলল,
—“তোমাদের জীবন। কিন্তু লিখতে গিয়ে মনে হচ্ছে, আমার কলমও ভয় পাচ্ছে।”
রূপা গম্ভীর গলায় বলল,
—“ভয় পেও না। আমাদের ভয় তোমরা লিখে রাখলে তবেই হয়তো একদিন কেউ পড়ে ভাববে, মানুষকে এভাবে বাঁচতে হয় কেন।”
হঠাৎ বাইরে চিৎকার শোনা গেল। এক গ্রাহক মাতাল হয়ে গোলমাল করছে। গলির বাতাস ভারী হয়ে উঠল। রূপা জানালা বন্ধ করে দিল।
—“দেখছো? এই হল আমাদের প্রতিদিনের পৃথিবী। সস্তা নেশার নীচে মেয়েদের দেহ, আর সেই দেহের ভেতরে চাপা পড়ে থাকা কণ্ঠ।”
অর্ণব দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তার চোখে ভেসে উঠল রূপার নিজের কাহিনি, সেই ভাঙা বিশ্বাস, সেই অদৃশ্য দেওয়াল।
—“রূপা,” অর্ণব ধীরে ধীরে বলল,
—“তুমি কি কখনও ভাবো, যদি বেরিয়ে যেতে পারতে?”
রূপা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর ধীরে ধীরে বলল,
—“স্বপ্ন দেখতে ভালো লাগে। কিন্তু এখানে স্বপ্নও পাপ। তবু কখনও কখনও ভাবি, যদি আবার গানের মঞ্চে দাঁড়াতে পারতাম… যদি আরেকবার নিজের নাম ধরে কেউ ডাকত, শরীর নয়, সুর শুনে।”
অর্ণব বুঝল, সেই স্বপ্নই হয়তো রূপাকে বাঁচিয়ে রেখেছে।
সেদিন রাত বাড়ল। অর্ণব ফিরে যাওয়ার আগে রূপা তাকে বলল,
—“তুমি আবার আসবে তো?”
অর্ণব উত্তর দিল না, শুধু মাথা নাড়ল।
গলি থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে তার মনে হচ্ছিল, শহরের মানচিত্রে এই জায়গাটা হয়তো ছোট্ট এক বিন্দু। কিন্তু বিন্দুর ভেতরে জমে আছে অগণিত জীবনের কাহিনি, যাদের কখনও আলো ছোঁয় না।
পর্ব ৪: অগ্নিদেয়াল
অর্ণব এবার আর দ্বিধা করল না। সে জানত, গবেষণার খাতায় লিখতে হলে তাকে আরও গভীরে ঢুকতে হবে। শুধু বাইরে থেকে দেখা বা দু’একজনের সঙ্গে কথা বললেই চলবে না। তাকে জানতে হবে এই গলির অন্ধকার ভেতরের দিকটা—যেখানে হাসির আড়ালে চাপা পড়ে আছে কান্না, যেখানে আলোয় দাঁড়িয়েও মানুষ অন্ধকারে ডুবে থাকে।
রূপার ঘরে ঢুকে অর্ণব লক্ষ্য করল, সে আজ সাজগোজ করেছে। গায়ে উজ্জ্বল লাল শাড়ি, ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক, চোখে কজল। কিন্তু সেই সাজের নীচে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল ক্লান্তি। রূপা জানালার পাশে বসে ছিল। অর্ণবকে দেখে মুচকি হেসে বলল,
—“আজ এসেছ?”
অর্ণব চেয়ারে বসল।
—“হ্যাঁ। তোমার সঙ্গে কথা না বললে আমার লেখা এগোয় না।”
রূপা হেসে ফেলল।
—“আমাদের মতো মেয়েদের গল্প কি বইয়ে মানায়? লোকে তো পড়ে প্রেম, বিয়ে, সংসার। আমাদের অগ্নিদেয়াল কেউ পড়ে না।”
অর্ণব দৃঢ় গলায় বলল,
—“মানায়। মানাতেই হবে। নইলে সমাজের একদিক চিরকাল অন্ধকারেই ঢাকা থেকে যাবে।”
কিছুক্ষণ দু’জন চুপ করে রইল। বাইরে গলির ভিড় জমে উঠছে। পুরুষরা আসছে, দর কষাকষি করছে, দরজা ভেঙে হাসাহাসি করছে। এই শব্দ যেন একটা স্থায়ী পটভূমি।
অর্ণব বলল,
—“রূপা, আমি কি আরও কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলতে পারি?”
রূপা চমকে তাকাল।
—“পারো। তবে সাবধানে থেকো। সব মেয়েই কথা বলতে চাইবে না। কেউ কেউ ভয় পায়, কেউ আবার মনে করে কথা বললেই আরও বিপদ আসবে। কারণ এখানে শুধু আমরা নেই, আছি আমাদের ওপরে যারা শাসন করে তারাও।”
অর্ণব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
—“শাসন মানে?”
রূপা গম্ভীর গলায় বলল,
—“এখানে কারও শরীর নিজের নয়। মালিক থাকে। কেউ দালাল, কেউ বাড়ির মালিক, কেউ পুলিশের সঙ্গে আঁতাত করা লোক। তাদের অনুমতি ছাড়া আমরা শ্বাসও নিতে পারি না। তুমি যদি তাদের রোষে পড়ো, তাহলে আর কেউ বাঁচাতে পারবে না।”
অর্ণব শিউরে উঠল। বুঝল, এই গলি শুধু শরীর বিক্রির জায়গা নয়, এ এক অদৃশ্য কারাগার।
রূপা হঠাৎ উঠে দাঁড়াল। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখাল।
—“ওই যে মেয়েটাকে দেখছ, নাম পার্বতী। ও একদিন পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল। ধরা পড়েছিল। তিনদিন অচেতন অবস্থায় পড়ে ছিল। শরীরে কত দাগ, এখনো দেখা যায়। কিন্তু কেউ তার কথা বলে না। সবাই জানে, বেরোতে গেলে এমনই শাস্তি।”
অর্ণবের চোখে জল চলে এল। সে বুঝতে পারল, গবেষণার পাতায় এইসব কষ্ট শুধু শব্দে আটকে রাখা সম্ভব নয়।
রূপা ধীরে ধীরে তার পাশে এসে বসল।
—“তুমি কি সত্যিই আমাদের গল্প লিখবে?”
অর্ণব মাথা নাড়ল।
—“হ্যাঁ। লিখব। হয়তো তোমাদের মুক্তি দিতে পারব না, কিন্তু অন্তত পৃথিবী জানবে তোমাদের কাহিনি।”
রূপার চোখে হঠাৎ ঝিলিক দেখা গেল।
—“তুমি আলাদা। অন্য পুরুষদের মতো নও।”
অর্ণব অনুভব করল, তাদের মধ্যে এক অদৃশ্য বন্ধন তৈরি হচ্ছে। সে জানত, গবেষকের সীমার বাইরে চলে যাচ্ছে এই সম্পর্ক। কিন্তু বুকের ভেতর একটা অচেনা টান তাকে আটকে রাখল।
সেদিন রাতে রূপা তাকে গলির ভেতরের আরও কিছু গল্প শোনাল। শিউলির কথা, যে এখনও প্রেমিকের জন্য অপেক্ষা করে; সুলেখার কথা, যে প্রতিদিন মেকআপ করে নতুন করে বাঁচার ভান করে; পার্বতীর কথা, যে পালানোর স্বপ্ন দেখেছিল।
আরও একটা গল্প শোনাল রূপা। এক মেয়ের কথা, যে এখানে এসেছিল মাত্র পনেরো বছর বয়সে। এখন তার বয়স কুড়ি। কিন্তু পাঁচ বছরে তার চোখের আলো নিভে গেছে। নাম সুমনা। সে আর কারও সঙ্গে কথা বলে না। শুধু রাতে ছাদে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। যেন তার ভেতরকার সব কান্না আকাশেই মিশিয়ে দেয়।
অর্ণব ধীরে ধীরে বুঝতে পারছিল, এই গলি একটা অগ্নিদেয়াল। এখানে যে ঢোকে, সে যেন পুড়ে ছাই হয়ে যায়। তবু বাইরে থেকে কিছুই বোঝা যায় না।
রূপা বলল,
—“তুমি কি জানো, অনেক মেয়েই স্বেচ্ছায় আসেনি এখানে। কেউ প্রতারণার শিকার, কেউ অপহৃত। আর যারা এসেছে টাকার লোভে, তারাও শেষে আটকে গেছে। এই গলি মানুষকে ছাড়ে না।”
অর্ণব কেঁপে উঠল। সে ভাবল, কতটা শক্তি থাকলে একজন নারী প্রতিদিন এমন জীবনের মুখোমুখি হতে পারে!
বাইরে রাত আরও গভীর হচ্ছিল। লাল বাতির আলো আরও গাঢ়। অর্ণব উঠে দাঁড়াল।
—“আজ ফিরতে হবে। তবে আমি আবার আসব।”
রূপা তার হাত ছুঁয়ে বলল,
—“আসবেই। তুমিই একমাত্র মানুষ যে আমাদের সত্যিটা শুনছে। তোমার খাতার পাতায় হয়তো আমাদের বাঁচার স্বপ্ন লুকিয়ে আছে।”
অর্ণব বেরিয়ে এল গলি থেকে। কিন্তু মনে হল, সে যেন একটা অগ্নিদেয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে আছে—যে দেওয়াল ভেদ করলে শুধু আগুন নয়, হাজারটা অচেনা জীবনের কাহিনি জ্বলে ওঠে।
পর্ব ৫: দ্বন্দ্বের ছায়া
অর্ণবের ভেতরে তখন এক অদ্ভুত দ্বন্দ্ব চলছিল। সে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, সমাজতত্ত্বের গবেষক। তার কাজ ছিল পর্যবেক্ষণ করা, বিশ্লেষণ করা, তথ্যকে শব্দে রূপান্তরিত করা। অথচ গত কয়েক দিনে সে যা পেয়েছে, তা কেবল তথ্য নয়—একটা অদৃশ্য আবেগ, এক অজানা টান, একরাশ যন্ত্রণা। রূপার চোখের দিকে তাকালে মনে হত, সে যেন কেবল এক পতিতাপল্লীর নারী নয়, বরং এক মহাকাব্যের চরিত্র, যে তার সবকিছু হারিয়েও বেঁচে থাকার গান গেয়ে যাচ্ছে।
অর্ণব রাতে ফিরলে খাতার পাতায় লিখতে বসত। কিন্তু কলম কাঁপত। লিখতে গিয়ে বারবার রূপার মুখ ভেসে উঠত, তার কণ্ঠের ভারী দাগ, তার কথার ভেতরকার নিস্তব্ধতা। সে বুঝতে পারছিল—এই গলির সত্যকে সমাজতত্ত্বের ভাষায় বর্ণনা করা সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন কবির কলম, গল্পকারের হৃদয়। কিন্তু সে তো গবেষক। তবে কি তার গবেষণার সীমা ভেঙে যাচ্ছে?
একদিন বিকেলে আবার সে হাজির হল সেই গলিতে। লাল বাতিটা তখনও জ্বলেনি, কিন্তু গলির ভেতরে চাপা অস্থিরতা। কয়েকজন মেয়ে দরজার সামনে বসে আছে, তাদের চোখে অনিশ্চয়তা। একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে বাইরে, তাতে দু’জন মোটা লোক ধূমপান করছে। অর্ণব থমকে দাঁড়াল। মনে হল, আজ এখানে কিছু ঘটতে চলেছে।
রূপার ঘরে ঢুকতেই দেখল, সে বেশ অস্থির। ঠোঁটে লিপস্টিক মাখলেও হাত কাঁপছে। অর্ণব প্রশ্ন করল,
—“কী হয়েছে?”
রূপা নিচু গলায় বলল,
—“আজ নাকি নতুন এক ক্রেতা এসেছে। শুনেছি খুব ভয়ঙ্কর মানুষ। মেয়েদের সঙ্গে অত্যাচার করে। সবাই ভয় পাচ্ছে।”
অর্ণব শিউরে উঠল। বলল,
—“তাহলে তোমরা কিছু করছ না কেন?”
রূপা তিক্ত হেসে বলল,
—“আমরা কী করব? এখানে কারও শরীর তার নিজের নয়। দালালেরা যা বলে, তাই করতে হয়। পুলিশও তো তাদের সঙ্গেই আছে। আমাদের কণ্ঠস্বর কারও কানে পৌঁছয় না।”
অর্ণব মুঠি শক্ত করল। সে জানত, তার কোনো অধিকার নেই হস্তক্ষেপ করার। তবু মনে হচ্ছিল, কিছু একটা করতেই হবে। রূপার চোখের ভয় তাকে অস্থির করে তুলছিল।
সন্ধ্যা নামতেই গলি ভরে উঠল গাড়ি, মোটরসাইকেল, মাতাল গলার শব্দে। লাল বাতিটা জ্বলে উঠল। আলোটা এবার যেন আরও ভয়ঙ্কর লাগছিল। রূপা অর্ণবকে জানালার পাশে টেনে নিয়ে গেল।
—“দেখছ? ওই লোকটা।”
অর্ণব তাকিয়ে দেখল, মোটা দেহ, গলায় সোনার চেইন, চোখে নিষ্ঠুর হাসি। তার চারপাশে কয়েকজন দালাল, যেন বিশেষ অতিথি এসেছে। অর্ণবের বুক ধকধক করতে লাগল।
রূপা নিচু স্বরে বলল,
—“আজ রাতটা হয়তো আমার ভাগ্যে পড়েছে।”
অর্ণব বিস্ময়ে তাকাল,
—“তুমি কেন?”
—“কারণ আমি নাকি গান গাই। আর ওই লোক নাকি এমন মেয়েকেই পছন্দ করে, যে গলা মেলাতে পারে।”
অর্ণব অনুভব করল তার বুকের ভেতর রক্ত চড়ছে। রূপাকে সে গবেষণার চরিত্র হিসেবে নয়, মানুষ হিসেবে দেখেছে। সে মেনে নিতে পারছিল না। বলল,
—“তুমি পালাও। আমি কিছু একটা করি।”
রূপা কেঁপে উঠল,
—“না, অর্ণব। তুমি পারবে না। এই গলির দেওয়াল তোমাকে বাঁচতে দেবে না। যদি তুমি কিছু বলো, তোমাকেও হয়তো টেনে নিয়ে যাবে।”
অর্ণব নীরব হয়ে গেল। তার গবেষক-সত্তা তাকে বলছিল—শুধু পর্যবেক্ষণ করো, হস্তক্ষেপ কোরো না। কিন্তু মানুষের সত্তা বলছিল—তুমি যদি আজ চুপ করে থাকো, তাহলে আর গবেষক নয়, শুধু কাপুরুষ হয়ে যাবে।
হঠাৎ বাইরে চিৎকার শোনা গেল। কয়েকজন দালাল এক মেয়েকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। মেয়েটি কাঁদছিল, লড়াই করছিল। অর্ণব চমকে উঠল। রূপা দরজা বন্ধ করে দিল, তার মুখে আতঙ্ক।
—“ও পার্বতী… আজ তাকে বেছে নিয়েছে। ভাগ্যিস আমাকে নয়।”
অর্ণবের মাথা ঝিমঝিম করছিল। মনে হচ্ছিল, গলির ভেতরে এক যুদ্ধ চলছে, যেখানে অস্ত্র নেই, তবু রক্ত ঝরছে প্রতিদিন।
সেদিন রাতে অর্ণব কিছুই লিখতে পারল না। শুধু খাতার পাতায় লিখল—“গবেষণা নয়, এ এক নীরব যুদ্ধ। যেখানে মানুষ প্রতিদিন হেরে যায়, অথচ লড়াই চালিয়ে যায়।”
কিন্তু তার ভেতরে তখন দ্বন্দ্ব তীব্র হচ্ছিল। সে কি গবেষক থাকবে, নাকি মানুষের মতো দাঁড়াবে?
পরদিন সকালে ক্লাসে বসে সে শুনছিল প্রফেসরের কথা—“একজন গবেষকের কাজ হল নিরপেক্ষ থাকা। পর্যবেক্ষণ করো, তবে অংশগ্রহণ কোরো না।”
অর্ণব মনে মনে বলল—“কিন্তু যদি সেই অংশগ্রহণ ছাড়া সত্য বোঝা না যায়? যদি মানুষকে বাঁচাতে না পারলে লেখার কোনো মানে না থাকে?”
সে জানত, রূপার প্রতি তার আকর্ষণ কেবল সহানুভূতি নয়। সেখানে জন্ম নিচ্ছে অন্যরকম এক আবেগ। অথচ সেই আবেগই তাকে বিপদে ফেলতে পারে।
গলিতে ফেরার আগে অর্ণব সিদ্ধান্ত নিল, সে খুঁজে বের করবে—কীভাবে রূপাদের মুক্তি সম্ভব। শুধু লেখা নয়, প্রয়োজন লড়াই। যদিও জানত, লড়াই মানেই বিপদ, শত্রুতা, হয়তো মৃত্যুও।
রাত্রে আবার সে হাজির হল লাল বাতির নীচে। বাতিটা জ্বলছিল, কিন্তু এবার আলোটা যেন তাকে আর টানছিল না—বরং চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছিল।
পর্ব ৬: রোষের মুখোমুখি
অর্ণব জানত, সে ধীরে ধীরে এক বিপজ্জনক পথে হাঁটছে। গবেষক হিসেবে এখানে ঢোকা আর মানুষের মতো দাঁড়িয়ে লড়াই করা—এই দুইয়ের মাঝে এক অগ্নিপথ রয়েছে। সেই অগ্নিপথেই পা রাখতে শুরু করেছে সে।
গলিতে ঢোকার মুখেই তাকে দেখে মিঠুন দা হুঁশিয়ারি দিল।
—“শোন, অর্ণব, আমি তোর ভালো চাই বলেই বলছি। এই পল্লির ভেতরে বেশি ঢুকিস না। কিছুদিন ধরে খবর ভাল নয়। দালালরা তোকে নজরে রেখেছে।”
অর্ণব বিস্মিত,
—“কেন? আমি তো কারও ক্ষতি করিনি।”
মিঠুন দা ধূমপানের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল,
—“ক্ষতি করেছিস কি না সেটা ব্যাপার নয়। তুই এখানে বারবার আসছিস, মেয়েদের সঙ্গে কথা বলছিস। তারা ভাবছে তুই কোনও এনজিও বা সাংবাদিক। আর সেটা ওরা বরদাস্ত করবে না।”
অর্ণব চুপ করে গেল। ভেতরে এক ধরনের ভয় ঢুকলেও মনে হল, এই ভয়কে পাশ কাটিয়েই তাকে এগোতে হবে।
রূপার ঘরে ঢুকতেই সে অস্থিরভাবে ফিসফিস করে বলল,
—“আজ তুই এসেছিস? তোর জন্য কাল রাতে বড় বিপদ হতে পারত।”
অর্ণব অবাক,
—“কেন?”
—“তুই চলে যাওয়ার পর পার্বতীকে ওই লোকের কাছে পাঠানো হয়েছিল। ও এত চেঁচামেচি করল যে দালালরা ক্ষেপে যায়। শেষে ওকে মারধর করা হয়। আজও ও বিছানায় শুয়ে আছে। আর আমি জানি, তোর নামও ওদের মুখে উঠেছে।”
অর্ণব বুকের ভেতর চাপা ঝড় টের পেল। সে যদি এখন পিছিয়ে যায়, তাহলে শুধু নিজের প্রাণ বাঁচবে। কিন্তু রূপাদের কাহিনি চিরদিন চাপা পড়ে থাকবে। সে চুপ করে রইল।
কিছুক্ষণ পর বাইরে এক দল লোক প্রবল চিৎকার করতে করতে গলি দিয়ে ঢুকল। তাদের হাতে লাঠি, মুখে গালাগাল। অর্ণব জানালার ফাঁক দিয়ে দেখল, এরা সেই দালালরা—যাদের ভয়ে সব মেয়ে চুপ করে থাকে। তারা চেঁচাচ্ছিল,
—“আজকে যে ছেলেটা বারবার এখানে আসে, তাকে ধরে বের কর!”
অর্ণবের বুক কেঁপে উঠল। রূপা তার হাত চেপে ধরল।
—“তুই ভেতরে থাক। দরজা বন্ধ করে দিচ্ছি। কাউকে বলিস না।”
কিন্তু গলি যে এভাবে তাকে আড়াল করে রাখবে, সেটা কি সম্ভব?
বাইরে আওয়াজ ক্রমশ বাড়ছিল। রূপা বিছানার নীচ থেকে এক পুরোনো কাপড়ের ব্যাগ বের করে দিল। ভেতরে কিছু কাগজপত্র।
—“এগুলো আমার কাছে রেখো। যদি কিছু হয়, অন্তত বাইরের পৃথিবী জানবে আমি কে ছিলাম।”
অর্ণব বিস্ময়ে তাকাল। ব্যাগে রূপার পুরোনো ছবি, কিছু চিঠি, আর একটা ছোট্ট ডায়েরি।
অর্ণব ফিসফিস করে বলল,
—“কিন্তু তুমি কেন আমাকে দিচ্ছ?”
রূপা মৃদু হেসে বলল,
—“কারণ তুই-ই একমাত্র মানুষ, যে সত্যি আমাদের কথা শুনছে।”
দরজায় তখন প্রবল ধাক্কা পড়ল। অর্ণবের হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল। রূপা দ্রুত পর্দা টেনে দিল, আর চেয়ারের আড়ালে তাকে লুকিয়ে রাখল। দরজা খুলতেই ভেতরে ঢুকল দু’জন লোক। গলায় সোনার চেইন, চোখে লালচে নেশার ছাপ।
—“শুনছি নতুন অতিথি এসেছে তোমার কাছে। কোথায় সে?”
রূপা নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে হেসে বলল,
—“কোনও অতিথি নেই। ভুল খবর শুনেছেন।”
লোকগুলো চারপাশে তাকাল। তাদের দৃষ্টিতে স্পষ্ট সন্দেহ। কিন্তু রূপার কণ্ঠ এতটাই শান্ত ছিল যে তারা শেষে গালাগাল করতে করতে বেরিয়ে গেল।
অর্ণব চেয়ারের আড়াল থেকে উঠে দাঁড়াল। রূপার চোখে তখন আতঙ্কের সঙ্গে মিশে ছিল স্বস্তি।
—“তুই যদি ধরা পড়তিস, আজকে তোকে আর খুঁজে পাওয়া যেত না।”
অর্ণব গভীরভাবে বুঝল—এখন আর শুধু গবেষণার প্রশ্ন নয়, তার নিজের জীবনেরও প্রশ্ন জড়িয়ে গেছে এই গলির সঙ্গে।
পরের কয়েকদিন সে গলিতে আসেনি। কিন্তু তার ভেতরে দোলাচল চলতেই থাকল। ক্লাসে বসেও মন বসছিল না। মাথার ভেতর ঘুরে বেড়াচ্ছিল রূপার কণ্ঠ, রূপার চোখ, আর সেই ডায়েরি।
শেষমেশ সে আবার এল। এবার গলির বাতাস যেন আরও ভারী। মেয়েরা কথা কম বলছে, জানালার আড়ালে মুখ লুকিয়ে আছে। মনে হচ্ছিল, ভয় তাদের গলির মধ্যে স্থায়ী বাসা বেঁধেছে।
রূপা তাকে দেখে বলল,
—“তুই আবার এলি? সাহস তো কম নয় তোর।”
অর্ণব বলল,
—“আমি না এলে তুমি কি একা পারবে সবটা সহ্য করতে?”
রূপা চুপ করে গেল। তারপর ধীরে ধীরে বলল,
—“শুধু সহ্য নয়, আমাদের বাঁচার লড়াইও চালিয়ে যেতে হয়। তবে তুই যদি পাশে থাকিস, হয়তো কষ্টটা ভাগ করা যায়।”
অর্ণব হঠাৎ বুঝল, এ শুধু গবেষক আর চরিত্রের সম্পর্ক নয়। এর ভেতরে এক অদ্ভুত ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়েছে। একে হয়তো সমাজ প্রেম বলবে না, কিন্তু মানবিকতার গভীর টানকে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।
রাত গভীর হতে থাকল। বাইরে মাতালদের চিৎকার, দালালদের রোষ, ভয়ের ছায়া সব একসঙ্গে মিশে যাচ্ছিল। কিন্তু রূপা আর অর্ণব জানালার ধারে বসে ছিল—দু’জন মানুষ, দু’টি পৃথিবী, তবু একই অন্ধকার ভাগ করে নিচ্ছে।
অর্ণব মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল—সে আর শুধু পর্যবেক্ষক নয়। এইবার সে দাঁড়াবে। যতই বিপদ আসুক, সে চেষ্টা করবে অন্তত কিছু করার। কারণ লাল বাতির আলো শুধু গলির মুখ আলোকিত করে না, তার ভেতরে মানুষের ছায়াকেও আরও স্পষ্ট করে তোলে।
পর্ব ৭: ষড়যন্ত্রের জাল
অর্ণবের ভেতরে তখন একটাই প্রতিজ্ঞা জেগে উঠেছিল—সে আর শুধু দর্শক হয়ে থাকবে না। সে যদি সত্যিই গবেষক হয়, তবে গবেষণার অর্থ কেবল তথ্য জোগাড় নয়; সত্যকে সামনে আনা, মানুষের কণ্ঠস্বরকে শোনানো। কিন্তু সেই প্রতিজ্ঞাই যেন অদৃশ্য বিপদের দরজা খুলে দিল।
বিশ্ববিদ্যালয়ে তার থিসিস গাইড যখন খসড়া পড়ে বললেন,
—“তুমি অদ্ভুত সব কথা লিখছ, অর্ণব। তথ্যগুলো বাস্তবের সঙ্গে মেলে না মনে হচ্ছে। তুমি কি ব্যক্তিগতভাবে জড়িয়ে যাচ্ছ?”
অর্ণব ঠান্ডা গলায় উত্তর দিল,
—“স্যার, আমি শুধু তাদের গল্প লিখছি। যা আমি শুনেছি।”
প্রফেসর ভুরু কুঁচকে বললেন,
—“গল্প আর তথ্য এক নয়। মনে রেখো, গবেষক যদি আবেগে ভেসে যায়, তবে গবেষণার মূল্য শেষ।”
কিন্তু অর্ণব জানত, এইসব কথা কেবল তাত্ত্বিক। রূপাদের চোখের সামনে দাঁড়ালে আবেগ এড়িয়ে যাওয়া অসম্ভব।
সে যোগাযোগ করতে শুরু করল কয়েকটি এনজিওর সঙ্গে। ফোন করল, মেইল পাঠাল। কয়েকজন প্রতিশ্রুতি দিল, তবে তারা স্পষ্ট বলল—
—“আমরা এই পল্লিতে ঢুকতে পারি না। পুলিশের সঙ্গে চুক্তি না করলে কিছুই সম্ভব নয়।”
অর্ণব বুঝল, বাইরের দুনিয়া থেকেও সাহায্য পাওয়া সহজ নয়। তবু হাল ছাড়ল না। সে ঠিক করল, অন্তত তথ্য সংগ্রহ করবে, প্রমাণ রাখবে। হয়তো একদিন এই প্রমাণই কাজে লাগবে।
গলিতে ফেরার পর সে লক্ষ্য করল, বাতাস যেন বদলে গেছে। মেয়েরা কম কথা বলছে, হাসি আরও জড়। দালালদের চোখে সন্দেহ বাড়ছে। তারা অর্ণবকে দেখে ফিসফিস করে। কারও চোখে বিদ্বেষ, কারও চোখে হুমকি।
রূপা উদ্বিগ্ন মুখে বলল,
—“তুই কি কিছু করছিস বাইরে? দালালরা তোকে নিয়ে কথা বলছে।”
অর্ণব মাথা নাড়ল,
—“আমি শুধু তাদের কাহিনি জমাচ্ছি। এটা তো অপরাধ নয়।”
রূপা তিক্ত হাসল,
—“এই গলিতে সত্যিই অপরাধ আর নিরপরাধের কোনও সীমারেখা নেই। তুমি যদি শ্বাস নাও, তাও তারা অপরাধ ধরে নিতে পারে।”
হঠাৎ রূপার ঘরে প্রবেশ করল একজন মধ্যবয়সী দালাল। গলায় মোটা সোনার চেইন, হাতে আঙুলভর্তি আংটি। তার চোখে অদ্ভুত হাসি।
—“এই যে পড়ুয়া বাবু, বারবার আসছিস কেন? পড়াশোনা করার জায়গা অনেক আছে, এখানে কী খুঁজছিস?”
অর্ণব ঠান্ডা গলায় উত্তর দিল,
—“আমি গবেষক। সমাজ নিয়ে কাজ করি।”
লোকটা হেসে উঠল।
—“গবেষণা? আমাদের গলিতে? হা হা, এখানে শুধু একটাই গবেষণা চলে—কে কাকে কত দামে বিক্রি করবে।”
রূপা দাঁড়িয়ে গম্ভীর গলায় বলল,
—“ও আমার বন্ধু। ও কারও ক্ষতি করছে না।”
লোকটা রূপার দিকে তাকাল। তার চোখে বিদ্বেষের ঝলক।
—“বেশি কথা বলিস না। মনে হচ্ছে তোকে নিয়ে আবার আলাদা করে ভাবতে হবে।”
লোকটা বেরিয়ে যাওয়ার পর রূপার ঠোঁট শুকিয়ে এল।
—“তুই বুঝলি না, তারা তোকে নজরে রেখেছে। এবার যদি আবার আসিস, তোর ক্ষতি হবে।”
অর্ণব বলল,
—“আমি ভয় পাই না। যদি সত্য লিখি, তবে কেন পালাব?”
রূপা হঠাৎ রেগে উঠল,
—“ভয় না পেলে আমাদের জন্য নয়, নিজের জন্য ভয় পা। তুই যদি হারিয়ে যাস, কে আমাদের গল্প শুনবে?”
অর্ণব চুপ করে গেল। তার চোখে রূপার অদ্ভুত তীব্রতা।
সেই রাতেই গলির অন্য প্রান্তে হঠাৎ চিৎকার উঠল। লোকজন দৌড়ে গেল। অর্ণবও এগিয়ে গেল। দেখল, সুমনা—সে যে প্রতিদিন ছাদে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে—আজ মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আছে। তার গলায় কালো দাগ। সবাই ফিসফিস করছে,
—“সুমনা গলায় দড়ি দিয়েছিল। বাঁচল না।”
অর্ণবের শরীর কেঁপে উঠল। রূপা ফিসফিস করে বলল,
—“এই হল আমাদের গলির সত্যি। মাঝে মাঝে কেউ মুক্তি খুঁজে পায় এভাবেই।”
অর্ণব চোখে জল আনতে চাইলে আনতে পারল না। কেবল বুকের ভেতর হাহাকার জমে উঠল।
সে ঠিক করল, এই গল্প চাপা থাকবে না। পরদিনই সে শহরের এক পরিচিত সাংবাদিক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করল। সব কথা খুলে বলল। সাংবাদিক মাথা নাড়ল,
—“তুই যা বলছিস, সেটা বড় খবর। কিন্তু প্রমাণ ছাড়া লিখতে পারব না।”
অর্ণব ডায়েরিটা বের করল—রূপার দেওয়া সেই ব্যাগ থেকে।
—“এগুলো দেখ। ছবি, চিঠি, ডায়েরি—সব আছে।”
বন্ধু অবাক হয়ে তাকাল।
—“ঠিক আছে। তবে মনে রাখ, যদি এই খবর বেরোয়, তোর জীবনও নিরাপদ থাকবে না।”
অর্ণব জানত, ঝুঁকি নিয়েই এগোতে হবে।
কিন্তু ষড়যন্ত্র তখন ঘনীভূত হচ্ছে। গলির দালালরা গোপনে বৈঠক করছে। তারা বলছে,
—“এই ছেলেটাকে সরাতে হবে। না হলে আমাদের ব্যবসা শেষ।”
অর্ণব কিছুই জানত না। সে শুধু ভাবছিল, সত্যকে সামনে আনার সময় এসেছে। কিন্তু লাল বাতির নিচে যে ষড়যন্ত্রের জাল বোনা হচ্ছে, তা ক্রমশ তার গলায় জড়িয়ে আসছিল।
সেদিন রাতে বাড়ি ফেরার পথে অর্ণব টের পেল, কেউ তাকে অনুসরণ করছে। রাস্তায় পা ফেললেই কানে ভেসে আসছে জুতোর শব্দ। পিছনে ঘুরে তাকালে ছায়া মিলিয়ে যাচ্ছে। বুকের ভেতর ধড়ফড়ানি বেড়ে গেল।
সে বুঝতে পারল—রূপাদের গল্প লিখতে গিয়ে সে নিজেই এক অদৃশ্য গল্পের চরিত্র হয়ে উঠছে। যে গল্পের শেষ কী হবে, তা এখনই বলা যায় না।
পর্ব ৮: অন্ধকারের আক্রমণ
অর্ণব জানত, সে এক ভয়ঙ্কর পথে হেঁটে যাচ্ছে। শহরের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে সে স্পষ্ট টের পাচ্ছিল, কেউ তার পিছু নিয়েছে। ভিড়ের মধ্যে মিলিয়ে গেলেও সেই চাপা দৃষ্টিকে সে বুঝতে পারছিল। বুকের ভেতর ধুকপুকানি বাড়ছিল, তবু সে থামল না। তার মনে হচ্ছিল, এই ভয়টাই প্রমাণ যে সে সঠিক কাজ করছে।
কিন্তু ভয়ের সীমা পরীক্ষা হলো এক গভীর রাতে। সে যখন রূপার ঘর থেকে বেরিয়ে ফিরছিল, গলির মোড়েই দু’জন লোক তার পথ আটকাল। কালো শার্ট, মুখে সস্তা বিড়ির গন্ধ, চোখে নিষ্ঠুর হাসি।
—“ওই যে পড়ুয়া বাবু, অনেক বড় বড় কথা লিখছিস নাকি? এখন একটু শিক্ষা দরকার।”
অর্ণব কিছু বলার আগেই লাঠির বাড়ি পড়ল তার কাঁধে। মুহূর্তে চোখের সামনে ঝাপসা হয়ে গেল সব। মাটিতে পড়ে যাওয়ার আগে কানে ভেসে এল গালাগাল—
—“এখানে বেশি নাক গলালে এর চেয়েও খারাপ হবে।”
সে জ্ঞান হারাল।
যখন চোখ খুলল, দেখল রূপা তার পাশে বসে আছে। ছোট্ট ঘরে তীব্র আতরের গন্ধ, তবে রূপার চোখে অদ্ভুত তীব্রতা।
—“তুই পাগল নাকি? বারবার বলেছিলাম সাবধানে থাকতে। ভাগ্যিস ওরা মারধর করে ছেড়ে দিয়েছে, নইলে আর তোকে খুঁজে পাওয়া যেত না।”
অর্ণব কষ্টে উঠে বসল। শরীর ব্যথায় জর্জরিত। তবু ঠোঁটে মৃদু হাসি।
—“এটাই প্রমাণ যে আমি সত্যিটা ছুঁয়ে ফেলেছি।”
রূপা রাগে কেঁপে উঠল।
—“তুই কী প্রমাণ পেয়েছিস জানি না, কিন্তু আমাদের জন্য নিজের জীবন দিয়ে দিস না। এখানে কত সাংবাদিক এসেছে, এনজিও এসেছে, শেষ পর্যন্ত চুপ করে চলে গেছে। কারণ এই দেওয়াল ভাঙা যায় না।”
অর্ণব ধীরে ধীরে বলল,
—“সব দেওয়াল ভাঙা যায়, যদি ভেতর থেকে কেউ ঠেলে দেয়। আর আমি একা নই, তুমি আছ।”
রূপা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তার চোখে জল জমে উঠল। কিন্তু সে কান্না চেপে রাখল।
—“তুই যদি না আসতিস, হয়তো আমি অনেক আগেই হাল ছেড়ে দিতাম।”
সেই রাতে বাইরে থেকে চিৎকার শোনা যাচ্ছিল। দালালরা মাতালদের নিয়ে হাসাহাসি করছে। কারও ঘরে দরজা ভাঙার আওয়াজ। অর্ণবের মনে হচ্ছিল, পুরো গলিই এক অদৃশ্য কারাগার। অথচ এই কারাগারের ভেতরে মানুষের হৃদস্পন্দন চলছে, গান বাজছে, স্বপ্ন টুকরো টুকরো হয়ে উড়ে যাচ্ছে।
পরদিন সকালে মিঠুন দা তাকে দেখল ফোলা চোখ, ব্যথিত শরীর নিয়ে হাঁটছে।
—“তুই থাম না, অর্ণব? এরা তোকে শেষ করে দেবে।”
অর্ণব ম্লান হাসল,
—“যদি আমি থামি, তাহলে রূপাদের কান্না আর কেউ শুনবে না।”
সেদিনই অর্ণব ঠিক করল, আর লুকিয়ে নয়। সে প্রকাশ্যে সত্যকে তুলে ধরবে। তার সাংবাদিক বন্ধুকে ডেকে পাঠাল। ডায়েরির কাগজ, ছবি, সব দেখাল।
বন্ধু বিস্মিত।
—“এই সব যদি ছাপা হয়, পুরো কলকাতা কেঁপে উঠবে। কিন্তু তোর ওপর আক্রমণ বাড়বে।”
অর্ণব দৃঢ় গলায় বলল,
—“তবু লিখো। অন্তত পৃথিবী জানুক।”
কিন্তু বিপদ আগেই এগিয়ে আসছিল। গলির দালালরা বুঝে গিয়েছিল, অর্ণবের ভেতরে আগুন আছে। তারা ঠিক করল এবার চুপ করে রাখা যাবে না।
এক রাতে রূপার ঘরে ঢুকে পড়ল তিনজন লোক। হাতে লাঠি, মুখে বিকৃত হাসি।
—“তোর ওই পড়ুয়া বন্ধুকে ডাক। আজ তাকে শিক্ষা দিতে হবে।”
রূপা দাঁড়িয়ে গেল সামনে।
—“ও এখানে নেই।”
—“মিথ্যে কথা বলিস না। আমরা জানি সে আসে। তুই লুকিয়ে রাখিস।”
লোকগুলো হাত বাড়িয়ে টানতে গেল রূপাকে। মুহূর্তে রূপা ভয় পেয়ে গেলেও দাঁতে দাঁত চেপে প্রতিরোধ করল। চিৎকার করে উঠল—
—“কেউ আছো? বাঁচাও!”
চিৎকার শুনে পাশের ঘর থেকে কয়েকজন মেয়ে ছুটে এল। তারা চেঁচিয়ে উঠল, লাঠি ছোঁড়ার চেষ্টা করা লোকগুলোকে টেনে ধরল। প্রথমবার গলির ভেতরে এমন প্রতিরোধ দেখা গেল। দালালরা অবাক হয়ে পিছিয়ে গেল, গালাগাল করতে করতে বেরিয়ে গেল।
রূপা তখন হাঁপাচ্ছে। অন্য মেয়েরা ফিসফিস করে বলল,
—“তুই পাগল নাকি? ওদের সঙ্গে লাগলি? কাল আবার ওরা ফিরবে।”
রূপা চোখে অদ্ভুত জেদ নিয়ে বলল,
—“আজ যদি আমরা একসঙ্গে না দাঁড়াই, তাহলে আর কখনও দাঁড়াতে পারব না।”
অর্ণব ঘটনাটা শুনল পরদিন। সে রূপার হাত ধরে বলল,
—“তুমি সাহস দেখিয়েছ। এটাই প্রথম আলোর ইঙ্গিত।”
রূপা মৃদু হাসল।
—“আলো তো এখনও দূরে। কিন্তু অন্তত আমরা জানি, অন্ধকারকে চ্যালেঞ্জ করা যায়।”
সেদিন রাতে অর্ণব খাতার পাতায় লিখল—
“অন্ধকার যতই গভীর হোক, ভেতরে যদি একটুখানি আলো জ্বলে, তা-ই যুদ্ধের শুরু। পতিতাপল্লীর এই জানালার আড়ালে প্রথম সেই আলোর ঝলক আমি দেখলাম।”
তবু তার বুকের ভেতর ভারী একটা আশঙ্কা চাপা পড়ে থাকল। সে জানত, দালালরা এত সহজে হার মানবে না। ষড়যন্ত্র আরও ঘনীভূত হবে। আর এবার হয়তো শুধু অর্ণব নয়, রূপাও তাদের লক্ষ্য হবে।
কিন্তু ইতিহাসে সব বড় পরিবর্তনই শুরু হয়েছে ছোট্ট প্রতিরোধ দিয়ে। অর্ণব অনুভব করছিল—লাল বাতির আলো এবার শুধু লেনদেনের ইঙ্গিত নয়, বরং যুদ্ধের ঘোষণা হয়ে উঠছে।
পর্ব ৯: লাল আলোয় সংঘাত
অর্ণব বুঝতে পারছিল, গলির বাতাসে ঝড় জমে উঠছে। রূপা আর সেদিনের মেয়েদের ছোট্ট প্রতিরোধ কেবল এক রাতের ঘটনা নয়; সেটা দালালদের চোখে অপমানের আগুন হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। আর অপমান এরা কোনওদিন ক্ষমা করে না।
গলির ভেতরে প্রতিদিনের স্বাভাবিক কোলাহল এখন অদ্ভুত নীরবতায় মোড়া। মেয়েরা জানালার ফাঁক দিয়ে তাকায়, কিন্তু চোখে আতঙ্ক। হাসি মিলিয়ে গেছে, বদলে এসেছে ফিসফিসানি। অর্ণব যখনই ঢোকে, চারপাশের দৃষ্টি তাকে ছুরির মতো বিদ্ধ করে।
সেই সন্ধ্যায় হঠাৎ খবর ছড়িয়ে পড়ল—দালালরা পুলিশের সঙ্গে বৈঠক করেছে। বলা হচ্ছে, একজন বাইরের লোক বারবার গলিতে আসছে, মেয়েদের উসকানি দিচ্ছে, ব্যবসার ক্ষতি করছে। পুলিশ নাকি শিগগিরই ব্যবস্থা নেবে।
রূপার ঘরে বসে অর্ণব খবরটা শুনে হতবাক।
—“তাহলে পুলিশও ওদের সঙ্গে?”
রূপা তিক্ত হেসে বলল,
—“এখানে পুলিশ আমাদের রক্ষক নয়, ওদেরই হাতিয়ার। তারা আসে টাকা তুলতে, নয়তো দমন করতে। আমাদের পক্ষে কেউ নেই।”
অর্ণবের বুকের ভেতর আগুন জ্বলে উঠল। সে বলল,
—“আমি সত্যিটা ছাপাব। যদি পুলিশের নামও জড়িয়ে থাকে, আমি তাও লুকোব না।”
রূপা তার হাত চেপে ধরল।
—“তুই কি বুঝছিস না, এটা করলে তুই বাঁচবি না?”
অর্ণব দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
—“আমার বাঁচা না বাঁচার চেয়ে তোমাদের বাঁচা অনেক বড়।”
সেদিন রাতেই গলিতে বড় সংঘাত শুরু হল। একদল দালাল মাতাল হয়ে এসে চেঁচাতে লাগল,
—“যে ছেলেটা এখানে আসে, তাকে বের করো!”
মেয়েরা চুপচাপ দরজা বন্ধ করে রাখল। কিন্তু তাদের চোখে ভয় লুকোনো গেল না। অর্ণব তখন রূপার ঘরে। রূপা তার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
—“তুই এখনই পালা। জানালা দিয়ে বেরো। নইলে তোকে ওরা মেরে ফেলবে।”
অর্ণব মাথা নাড়ল,
—“না, পালাব না। পালালে আর ফিরে আসা হবে না।”
দরজায় প্রচণ্ড ধাক্কা পড়ল। রূপা বুক চেপে দাঁড়াল। বাইরে থেকে চিৎকার,
—“ওই পড়ুয়া কোথায়?”
ঠিক তখনই গলির অন্য প্রান্তে হঠাৎ হৈচৈ উঠল। কয়েকজন মেয়ে একসঙ্গে দরজা খুলে রাস্তায় দাঁড়াল। তারা চেঁচিয়ে উঠল,
—“আমরা কাউকে দিইনি। ওরা মিথ্যে বলছে।”
এই প্রথমবার মেয়েরা একসঙ্গে আওয়াজ তুলল। দালালরা হতভম্ব। তারা অভ্যস্ত, মেয়েরা চুপ করে থাকবে। কিন্তু এবার নয়। মুহূর্তেই ধাক্কাধাক্কি শুরু হল। গলি কেঁপে উঠল চিৎকারে।
অর্ণব আর লুকিয়ে থাকল না। দরজা খুলে বেরিয়ে এলো। মেয়েদের পাশে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে উঠল,
—“এটা মানুষের লড়াই। আর লড়াই আমরা চালাব।”
দালালরা প্রথমে ঝাঁপিয়ে পড়ল। কিন্তু মেয়েরা লাঠি, ইট, যাই পেয়েছে হাতে তুলে নিল। সেই সংঘাতে প্রথমবার গলির নীরবতা ভাঙল। একে অপরের গায়ে ধাক্কা, চিৎকার, কান্না, রক্ত—সব মিশে গেল।
হঠাৎ পুলিশের সাইরেন শোনা গেল। সবাই থমকে গেল। দালালরা ভেবেছিল পুলিশ এসে তাদের পাশে দাঁড়াবে। কিন্তু এ বার ছবিটা অন্য রকম। অর্ণব আগেই সাংবাদিক বন্ধুর মাধ্যমে খবর ছড়িয়েছিল। সেই খবর কিছু মানবাধিকার কর্মীর কানেও পৌঁছেছিল। ফলে পুলিশ বাধ্য হয়েছিল নিয়ম মেনে আসতে।
ইন্সপেক্টর গলির মাথায় দাঁড়িয়ে কড়া গলায় বলল,
—“এখানে কী হচ্ছে?”
দালালরা চেঁচিয়ে উঠল,
—“এই ছেলেটা দাঙ্গা লাগাচ্ছে। মেয়েদের উসকাচ্ছে।”
অর্ণব এগিয়ে এসে বলল,
—“স্যার, সত্যিটা লিখে রেখেছি। প্রমাণ আছে। ছবি আছে, চিঠি আছে। আপনাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে।”
পুলিশ প্রথমে থমকে গেল। দালালরা গালাগাল করতে লাগল। কিন্তু ভিড় জমে উঠেছিল। কয়েকজন সাংবাদিকও সেখানে পৌঁছে গিয়েছিল। ক্যামেরার ফ্ল্যাশে দালালদের মুখ গরম হয়ে উঠল।
ইন্সপেক্টর পরিস্থিতি সামলাতে বলল,
—“সবাই শান্ত হও। তদন্ত হবে।”
দালালরা ক্ষিপ্ত হয়ে গেল। তাদের মনে হচ্ছিল, আজকের রাতটাই হয়তো তাদের জন্য কালো অধ্যায় হয়ে দাঁড়াবে। তারা চোখ রাঙিয়ে অর্ণবের দিকে তাকাল। বিদ্বেষে ভরা সেই দৃষ্টি যেন বলে দিচ্ছিল—“তুই শেষ।”
কিন্তু অর্ণব জানত, এখন আর পিছিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। রূপা তার পাশে এসে দাঁড়াল। তার কণ্ঠে কাঁপুনি থাকলেও দৃঢ়তা স্পষ্ট।
—“আজ আমরা চুপ করব না। যতদিন এই লাল বাতি জ্বলে, ততদিন আমাদের কণ্ঠও জ্বলবে।”
সেই মুহূর্তে গলির বাতাসে অদ্ভুত এক আলোড়ন ছড়িয়ে গেল। যেন দীর্ঘদিনের নিস্তব্ধতা ভেঙে মানুষ প্রথমবার আওয়াজ তুলল।
রাত্রি গড়িয়ে গেল, কিন্তু সংঘাতের ছায়া থেকে গেল। দালালরা ভেতরে ভেতরে পরিকল্পনা শুরু করল—কীভাবে অর্ণবকে সরানো যায়। আর অর্ণব বুঝল, যুদ্ধের মাঠে সে একা নয়; তার পাশে দাঁড়িয়েছে রূপা আর আরও অনেক মুখ, যারা এতদিন নিস্তব্ধ ছিল।
✍️ এটা ছিল পর্ব ৯ – লাল আলোয় সংঘাত, প্রায় ১০০০ শব্দে।
👉 তুমি কি চাইছ আমি এবার পর্ব ১০ (গল্পের সমাপ্তি: সত্যের বিস্ফোরণ, রূপার ভাগ্য, অর্ণবের থিসিস এবং পতিতাপল্লীর ভবিষ্যৎ) লিখে দিই?
পর্ব ১০: শেষ জানালা
সংঘাতের সেই রাতের পর গলির বাতাস বদলে গিয়েছিল। আগের মতো চুপচাপ আর নিস্তব্ধ নয়—এবার প্রত্যেক চোখে লুকিয়ে আছে ভয় আর কৌতূহলের মিশ্র ছায়া। দালালদের মুখে রাগ জমে উঠেছে, কিন্তু তারা হঠাৎ করে কোনও পদক্ষেপ নিচ্ছে না। কারণ সাংবাদিকদের ক্যামেরা, এনজিও কর্মীদের আগমন আর পুলিশের অস্থির উপস্থিতি তাদের পিছু হঠতে বাধ্য করেছে।
অর্ণব টের পাচ্ছিল, সে একরকম সঙ্কটের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে। বাইরের দুনিয়ায় তার লেখা পৌঁছে যাচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের করিডরে আলোচনার ঝড় উঠছে, সংবাদপত্রে ছোটখাটো খবর বের হচ্ছে—“কলকাতার পতিতাপল্লীর অন্তরালে সমাজের অন্ধকার।” কিন্তু একইসঙ্গে তার মাথার ওপরে ভাসছে অদৃশ্য হুমকি।
রূপা তাকে বলল,
—“তুই যা করেছিস, তাতে গলি আর আগের মতো থাকবে না। কিন্তু তার মানে এই নয়, আমরা মুক্তি পাব। হয়তো আমাদের ওপর চাপ আরও বাড়বে।”
অর্ণব শান্ত গলায় বলল,
—“তবু কিছু না করার চেয়ে এটা ভালো। আমি চাই, বাইরের দুনিয়া অন্তত জানুক তোমাদের নাম।”
রূপা মৃদু হেসে বলল,
—“নাম দিয়ে কী হবে? কেউ তো ডাকবে না।”
অর্ণব উত্তর দিল,
—“একদিন ডাকবে। হয়তো আজ নয়, কাল নয়। কিন্তু ইতিহাসে তোমাদের নাম লেখা থাকবে।”
সেই দিনগুলোতে অর্ণব থিসিসের খসড়া লিখছিল অদ্ভুত তাড়নায়। খাতার পর খাতা ভর্তি হচ্ছিল রূপাদের কাহিনিতে। প্রতিটি পাতায় শুধু তথ্য নয়, রক্তমাংসের যন্ত্রণা। সে জানত, একে হয়তো প্রফেসর নিরপেক্ষ গবেষণা বলবেন না। কিন্তু তার কাছে গবেষণা মানে ছিল সত্যকথা।
কিন্তু দালালরা এত সহজে হার মানার নয়। এক রাতে অর্ণব ফেরার পথে তিনজন লোক তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। হাতে লোহা, চোখে হিংস্রতা। অর্ণব প্রতিরোধ করার চেষ্টা করল, কিন্তু একা মানুষ কতটা পারে? মুহূর্তে সে মাটিতে পড়ে গেল। আঘাতের ঘোরে তার মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল।
ঠিক তখনই রূপা ছুটে এলো। সঙ্গে আরও কয়েকজন মেয়ে। তারা লাঠি, ইট, যা পেয়েছে হাতে তুলে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল। দালালরা হয়তো ভাবেনি মেয়েরা এতটা সাহস দেখাবে। তারা শাপশাপান্ত করতে করতে সরে গেল।
অর্ণব মাটিতে শুয়ে ছিল, শরীর ব্যথায় অবশ। রূপা তার মাথা কোলে তুলে বলল,
—“তুই কি পাগল? এত লড়াই করছিস কেন?”
অর্ণব চোখ আধখোলা করে বলল,
—“কারণ তুমি বাঁচতে চাও।”
রূপার চোখে তখন অশ্রু। সে বুঝতে পারছিল, এই ছেলেটা কেবল গবেষক নয়—একজন যোদ্ধা।
কিন্তু ভাগ্যের খেলা ভয়ংকর। কয়েকদিন পর হঠাৎ খবর এলো, সরকার নতুন আইন চালু করতে চলেছে। পতিতাপল্লীগুলির পুনর্বাসন নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। সংবাদপত্রে প্রতিদিন খবর বেরোচ্ছে। অনেকেই বলছে, অর্ণবের লেখা আর ছবিই এই আলোচনার সূত্রপাত ঘটিয়েছে।
গলিতে নতুন আশা জাগতে শুরু করল। মেয়েরা ফিসফিস করে বলছিল,
—“হয়তো আমরা একদিন বেরোতে পারব।”
অর্ণবও ভাবছিল, তার লড়াই বৃথা যায়নি। কিন্তু সেই আশার মাঝেই ঘটল অন্ধকারতম ঘটনা।
এক রাতে হঠাৎ রূপা নিখোঁজ। গলির কেউ জানে না, কোথায় গেল সে। কেউ বলল, দালালরা তাকে সরিয়ে দিয়েছে। কেউ বলল, পুলিশ গোপনে তুলে নিয়েছে। কেউ বলল, সে নিজেই পালিয়েছে।
অর্ণব পাগলের মতো খুঁজল। থানায় গেল, হাসপাতালে গেল, আশপাশের রাস্তায় ঘুরল। কিন্তু রূপার কোনও হদিস পেল না। কেবল তার দেওয়া সেই ব্যাগটাই বাকি রইল—ছবি, চিঠি আর ডায়েরি।
রূপা যেন অদৃশ্য এক জানালার আড়ালে মিলিয়ে গেল।
অর্ণব ভেঙে পড়লেও থামল না। তার থিসিস শেষ করল। বিশ্ববিদ্যালয়ে জমা দিল। অধ্যাপকরা বিস্মিত। তারা বললেন,
—“এটা কেবল গবেষণা নয়, এ এক দলিল।”
কিছুদিনের মধ্যেই অর্ণবের লেখা প্রকাশিত হল। পত্রিকায়, বইয়ে, নানা আলোচনায়। শহরের মানুষ চমকে উঠল—“আমাদের শহরে এমন অন্ধকার লুকিয়ে ছিল?” আন্দোলন শুরু হল, মানবাধিকার সংগঠন গলিতে ঢুকল, কিছু মেয়েকে উদ্ধার করে পুনর্বাসনের উদ্যোগ নিল।
তবু অর্ণবের বুক ফাঁকা। কারণ রূপা নেই।
প্রতিদিন সে গলির লাল বাতির নিচে দাঁড়ায়। আলোটা এখনো জ্বলে, কিন্তু সেই জানালাটা ফাঁকা। কোনও গান ভেসে আসে না, কোনও চোখ তাকিয়ে থাকে না। তবু সে জানে, রূপা কোথাও আছে। হয়তো অন্য শহরে, হয়তো অন্য কোনও ছদ্মনামে বেঁচে আছে।
একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সেমিনারে অর্ণব তার গবেষণার কথা বলছিল। শেষ বক্তব্যে সে বলল,
—“আমরা প্রায়ই ভাবি, পতিতাপল্লী কেবল শরীরের লেনদেনের জায়গা। কিন্তু আসলে এটা মানবিকতার আয়না। এখানে প্রতিদিন মানুষ হারায়, মানুষ জন্মায়, আর অন্ধকারের ভেতরে আলো খোঁজে। আমার লেখার পেছনে একজন মানুষের অবদান সবচেয়ে বড়। তার নাম রূপা। আমি জানি না, সে আজ কোথায় আছে। কিন্তু যদি কোনওদিন এই বই তার হাতে পৌঁছয়, তবে সে জানুক—তার কণ্ঠস্বর ইতিহাসে লেখা হয়েছে।”
সেমিনারের হল ভরে উঠল করতালিতে। অর্ণবের চোখ ভিজে উঠল।
গল্পের শেষে রূপা কোথায় মিলিয়ে গেল, কেউ জানল না। কিন্তু লাল বাতির জানালার আড়ালে তার কণ্ঠস্বরই নতুন প্রজন্মকে প্রশ্ন করতে শিখিয়েছে।
অর্ণব জানত, তার জীবন আর আগের মতো নয়। প্রতিদিন যখন সে শহরের রাস্তায় হাঁটে, ভিড়ের মধ্যে সে যেন শুনতে পায় সেই সুর—
“গান আমার সঙ্গী। যতদিন শ্বাস আছে, ততদিন গান বেঁচে থাকবে।”
এভাবেই পতিতাপল্লীর অন্ধকারে প্রথম আলো জ্বলে উঠেছিল।
***




