Bangla - ভূতের গল্প

লাল টিপওয়ালী

Spread the love

মৈত্রেয়ী বসু


অধ্যায় ১: “নবাগত”
কলকাতার ব্যস্ত শহরের কোলাহল থেকে খানিক দূরে, টালিগঞ্জের এক পুরনো গলিতে একটি তিনতলা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ছিল অভিষেক আর মীনাক্ষী। নতুন বিয়ে, নতুন জীবন, আর এই নতুন ভাড়া বাড়ি—সবকিছুতেই একরকম সতেজ উত্তেজনা কাজ করছিল। বাড়িটির গায়ে সময়ের ছাপ স্পষ্ট; ধূসর দেয়ালে ফাটল, জানালার পাল্লাগুলো পুরনো, আর সিঁড়িতে কাঠের ঘষাঘষির শব্দ যেন নিজেই গল্প বলতে পারে। তবে বাড়ির মালিক মিত্রবাবু বলেছিলেন, “ভালো বাড়ি, হাওয়া-বাতাস যথেষ্ট, আর শহরের ভিড় থেকে দূরে। কেবল পুরনো, তাই লোকজন আগ্রহ দেখায় না।” মীনাক্ষীর বুকের গভীরে তখন এক ধরনের শীতল বাতাস খেলে যাচ্ছিল, যেন এই পুরনো বাড়ির দেয়ালগুলো শুধু ইট-কাঠের নয়, অনেক স্মৃতি আর চুপ চাপ ছায়া লুকিয়ে রেখেছে। তারা যখন ঘরে ঢোকে, পলিথিন মোড়া ফার্নিচারের নিচে জীর্ণ এক আয়না পড়ে ছিল—মীনাক্ষী চোখের কোণে অদ্ভুত এক ছায়া দেখতে পায়, কিন্তু সে ভাবে হয়তো আলো-আঁধারি খেলছে। নতুন বাড়ির গন্ধ, পুরনো কাঠের চিড়বিড় আওয়াজ, আর দূরে চলন্ত ট্রামের ঘণ্টাধ্বনি—সব মিলিয়ে প্রথম রাতটা যেন গল্পের বই থেকে উঠে আসা কোন দৃশ্য। রাতে বিছানায় শুয়ে অভিষেক যখন নিদ্রার দেশে, মীনাক্ষী তখন ঘরের চুপচাপ বাতাসে এক অজানা কাঁপুনি টের পায়, যেন কারো নিশ্বাস তার খুব কাছে এসে মিশে যাচ্ছে।
রাত প্রায় আড়াইটে হবে—ঘরের এক কোণায় রাখা দেওয়াল ঘড়ির ঘণ্টা ধীরে তিনবার বেজে উঠল। হঠাৎই দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ, তিনবার, স্পষ্ট ও মেপে দেওয়া ছন্দে। প্রথমে মনে হলো কেউ নিচের ফ্ল্যাট ভুল করে এখানে কড়া নাড়ছে। কিন্তু রাতের ওই নীরবতা ভেদ করে সেই শব্দ যেন বুকের ভেতর কেঁপে উঠল। মীনাক্ষী কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল—কোনো আওয়াজ নেই। অভিষেক ঘুমোচ্ছে গভীরভাবে, তাকে না ডেকে মীনাক্ষী নিজেই দরজার দিকে এগিয়ে গেল। দরজার ছিটকিনি লাগানো ছিল, চোখ রেখে দোরের পাশের ছিদ্র দিয়ে দেখল—কেউ নেই। তবুও ঠিক সেই মুহূর্তে আবার এক কণ্ঠস্বর কানে এল, যেন ঠিক দরজার গা ঘেঁষে কেউ দাঁড়িয়ে বলছে—”শুভ্র আছে?” মীনাক্ষী ধড়মড় করে পিছিয়ে এল। কণ্ঠটা ছিল স্তব্ধতা-মাখা, কিন্তু তার ভেতর এক অসমাপ্ত আকুতি। সে দরজা না খুলে ফিরে গেল, কিছু না বলেই। ঘরে এসে শুয়ে পড়ল ঠিকই, কিন্তু ঘুম এলো না। চোখ বন্ধ করতেই যেন দেখতে পেল এক লাল টিপওয়ালী নারী—নির্বাক, ভেজা চুল, আর নিঃশব্দে তাকিয়ে আছে কোথাও। সকালে উঠে এই কথাগুলো সে অভিষেককে বলতে গিয়েও বলল না, কেবল বলল, “বাড়িটা কেমন যেন অদ্ভুত লাগছে না?” অভিষেক হেসে বলল, “তুই সবসময় এত ভাবিস! প্রথম রাত, নতুন জায়গা… একটু সময় নে। সব ঠিক হয়ে যাবে।”
কিন্তু সময় যতই এগোতে লাগল, মীনাক্ষীর মনে এক অদ্ভুত অস্থিরতা জমতে লাগল। দুপুরবেলা জানালার ধারে বসে চা খাচ্ছিল, হঠাৎই নিচে রাস্তায় চোখ পড়ে যায়—এক মহিলা রাস্তার পাশ ধরে হেঁটে যাচ্ছেন, লাল শাড়ি পরা, কপালে টকটকে লাল টিপ। তিনি বাড়ির দিকে তাকিয়েই হাঁটছিলেন, আর হঠাৎ থেমে গিয়ে একবার সরাসরি উপরে তাকালেন—যেখানে মীনাক্ষী দাঁড়িয়ে ছিল। সেই চোখে যেন কোনো দৃষ্টিপথ ছিল না, শুধু গভীর শূন্যতা। মুহূর্তেই তিনি আবার হাঁটতে শুরু করলেন। মীনাক্ষী নীচে ছুটে গিয়ে দেখল, কেউ নেই। চারপাশ ফাঁকা, কোনো পায়ের শব্দ, কোনো কাপড়ের ঘষাঘষির শব্দ নেই। বিকেল গড়িয়ে সন্ধে নামতে না নামতেই পাড়ার একজন বৃদ্ধা, গঙ্গা মাসি, বাড়ির সামনে থেমে মীনাক্ষীর সঙ্গে কথা বলতে বলতে বললেন, “এই বাড়ি তো অনেক পুরনো। শুনেছি, বহু বছর আগে একটা বড় কাণ্ড ঘটেছিল এখানে… তবে নতুনরা সেসব জানে না। তুমি জানো নাকি ‘শুভ্র’ নামের কাউকে?” মীনাক্ষীর শরীর ঠান্ডা হয়ে গেল। সে কিছু না বলে মাথা নাড়ল। গঙ্গা মাসি চুপ করে থাকলেন কিছুক্ষণ, তারপর বললেন, “রোজ রাত ২টার পর দরজায় যদি কেউ তিনবার কড়া নাড়ে, খোলা যেও না। আর যদি কেউ বলে ‘শুভ্র আছে?’—উত্তর দিও না। কিছু কথা চিরকাল চুপ করে থাকাই ভালো…” এই অদ্ভুত বার্তার পরেও যখন মীনাক্ষী ঘরে ফিরে আসে, তখন চারদিকে সন্ধ্যার নীলচে ছায়া, আর মনে একটাই প্রশ্ন ঘুরতে থাকে—কে এই লাল টিপওয়ালী? আর কে সেই শুভ্র, যার নাম উচ্চারণে কাঁপে পাড়ার বাতাস?
অধ্যায় ২: “শুভ্র কে?”
পরদিন সকালে অভিষেক কাজে বেরিয়ে যাওয়ার পর মীনাক্ষী বসে ছিল বারান্দায়, এক কাপ চায়ের সঙ্গে আগের রাতের ঘটনাগুলো মাথায় ঘুরছিল। সে ঠিক করল এবার বাড়িওয়ালার সঙ্গে খোলাখুলি কথা বলবে। নিচের তলায় থাকেন মিত্রবাবু, বাড়ির মালিক। বয়সে পঁচিশ-ত্রিশের কম নয়, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, আর গলায় বরাবর কাশির সুর। মীনাক্ষী তাকে জিজ্ঞেস করল, “মিত্রবাবু, একটা কথা জানতে চাই… এই বাড়িতে কি আগে ‘শুভ্র’ নামে কেউ থাকতেন?” প্রশ্ন শুনেই মিত্রবাবুর কাশি থেমে গেল। এক মুহূর্ত চুপ থেকে তিনি বললেন, “না তো… অন্তত গত দশ বছরে এমন নামের কেউ তো ছিল না।” মীনাক্ষী বলল, “কিন্তু গতকাল রাতে কেউ দরজায় এসে বারবার জিজ্ঞেস করল—‘শুভ্র আছে?’ এই প্রশ্ন শুনে তো মাথায় ঘুরে গেল।” মিত্রবাবুর মুখে একরকম কৃত্রিম অপ্রস্তুতি ফুটে উঠল। তিনি বলেন, “এই বাড়ি অনেক পুরনো, আগে অনেকেই এসেছেন-গেছেন। আপনি অত ভাববেন না।” এরপর তিনি প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে দেন, বললেন বিলে কত টাকা দিতে হবে, জলবিল উঠবে কিনা ইত্যাদি। মীনাক্ষী আবার উপরে ফিরে এল, কিন্তু তার মনের সন্দেহ কাটল না। বিকেলে সে বেরিয়ে পড়ল আশেপাশের লোকেদের সঙ্গে কথা বলবে বলে। পাড়ার মুদি দোকানের মালিক, শ্যামলদা, প্রথমে হেসে উড়িয়ে দিল, “ওসব গুজব, দিদি। পুরনো বাড়িতে ভূতের গল্প থাকেই।” কিন্তু পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা বৃদ্ধা এক মহিলা ফিসফিস করে বললেন, “আস্তে বলুন। ও সব কথা জোরে বলার নয়।” মীনাক্ষী কাছে এগিয়ে গিয়ে জানতে চাইল, “আপনি কিছু জানেন?” মহিলা একটু চুপ করে বললেন, “আমি পঁচিশ বছর ধরে এই পাড়ায় আছি। অনেক কিছু দেখেছি। ১৯৮১ সালের জুন মাসে… একটা ভয়াবহ আগুন লেগেছিল ওই বাড়িতে। সবাই বলেছিল দুর্ঘটনা, কিন্তু আদতে সে আগুন কোনো দুর্ঘটনা ছিল না… ওই আগুনেই পুড়ে মারা গিয়েছিল এক কিশোর ছেলে—তার নাম ছিল শুভ্র।”
সেই মুহূর্তে যেন মীনাক্ষীর বুকের মধ্যে হিমেল একটা স্রোত বয়ে গেল। সে ফিসফিস করে বলল, “কিশোর? কত বছর বয়স হবে?” বৃদ্ধা বললেন, “হয়তো বারো-তেরো… ওই বাড়ির এক কোন ঘরে সে থাকত, আর সবসময় একা থাকত। কেউ তাকে দেখতে পেত না ঠিকঠাক। লোকমুখে শোনা যায় তার মা–এক মানসিক রোগী মহিলা, প্রায়শই বলতেন—‘ও আসবে’, ‘ও ফিরে আসবে’। কেউ বুঝত না কাকে বোঝাতে চাইছেন। সেই মহিলা দিনরাত কপালে লাল টিপ পরে ঘুরতেন পাড়ায়, গায়ে থাকত লাল শাড়ি, চোখে খালি একরাশ ক্লান্তি। আগুন লাগার সময় লোকজন বলেছিল মা-ছেলে একসঙ্গে ঘরে ছিল, কিন্তু শুধু শুভ্রর দেহ পাওয়া গেছিল, মায়েরটা না।” মীনাক্ষী শিউরে উঠল, বলল, “আপনার কি মনে হয়—তিনি মরেননি?” বৃদ্ধা একরকম হাসলেন, “মরলে তো বাঁচা যেত, মা। মরেননি বলেই আজও আসেন, খুঁজতে—‘শুভ্র আছে?’” এই কথার পরে আর বেশি কথা হয়নি, কিন্তু সেই রাতে মীনাক্ষী আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছিল—যে নারী প্রতিরাতে এসে জিজ্ঞেস করছে, সে কি শুধুই আত্মা, না কি কোনো অসমাপ্ত যন্ত্রণার প্রতিরূপ? আয়নায় নিজেকে দেখতে গিয়ে চোখটা পড়ে ঘরের কোণে রাখা সেই পুরোনো আয়নার দিকে, যার পেছনে সে আগের দিন একটা কাগজ পায়—তাতে লেখা ছিল “ও আসবে…” সেই লেখার হাতের লেখা যেন কারও স্কুলের খাতার মত কাঁপা কাঁপা।
রাত বাড়ে, অভিষেক ফিরে আসে, সে আজ একটু ক্লান্ত। মীনাক্ষী তাকে সব কিছু খুলে বলে—বাড়ির ইতিহাস, শুভ্র নামের ছেলের কথা, সেই আগুন, আর লাল টিপ পরা মায়ের রহস্যময় উপস্থিতি। অভিষেক প্রথমে হেসে বলে, “তুই তো একদম ভূতের গল্প বানিয়ে ফেললি!” কিন্তু মীনাক্ষী তার মুখ দেখে বুঝিয়ে দেয় এটা মজা নয়। সে বলে, “এই সব কিছুর মধ্যে একটা সংযোগ আছে… দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ, শুভ্রর নাম, আয়নার পেছনের লেখাটা—সবই যেন কিছু বলতে চাইছে।” অভিষেক চুপ করে যায়, কিন্তু তার চোখেও উদ্বেগ ফুটে ওঠে। তারা সিদ্ধান্ত নেয় পরদিন সকালে কলকাতা পুরসভার পুরোনো রেকর্ডে খোঁজ করবে—১৯৮১ সালের অগ্নিকাণ্ডের খবর। সে রাতে ঘরে অদ্ভুতভাবে যেন বাতাস ভারী হয়ে আসে, জানালার কাঁচে বারবার কিছুর ঠোক্কর লাগে, কিন্তু বাইরে কিছু দেখা যায় না। এবং রাত ঠিক দুইটা এক মিনিটে সেই একই শব্দ—তিনবার দরজায় কড়া নাড়া, আর সেই একই কণ্ঠ: “শুভ্র আছে?” এবার অভিষেক নিজে গিয়ে দরজার পাশে দাঁড়ায়, আর চোখ রাখে ছিদ্রে—কেউ নেই, শুধু হাওয়া যেন কানে ফিসফিস করে বলে, “ও আসবে…” ঠিক সেই সময় ঘরের বাতি এক সেকেন্ড নিভে আবার জ্বলে ওঠে। তারা কেউ দরজা খোলে না, চুপচাপ বসে থাকে। ঘরের ভিতর থমথমে নীরবতা, আর বাইরে এক অজানা অপেক্ষা—যেন লাল টিপওয়ালী জানে, তার ডাক আজও কেউ শোনেনি, কিন্তু সে আবার আসবে, বারবার আসবে, যতক্ষণ না কেউ তাকে সত্যি কথা বলে। মীনাক্ষীর মনে প্রশ্ন ঘুরতে থাকে—এই আত্মা কি কারো অপেক্ষায়? নাকি শুধু নিজেই এক যন্ত্রণার গোলকধাঁধায় আটকে আছে, সেই একটিমাত্র নাম উচ্চারণ করে?
অধ্যায় ৩: “আয়নার পেছনে”
পরদিন সকালে মীনাক্ষীর ঘুম ভাঙে ভোরবেলা, ঘরে আলো এখনও ঠিকমতো ফোটেনি। কিন্তু জানালার পাশ দিয়ে এক পলকের মতো যেন দেখতে পেল কেউ লাল শাড়ি পরে রাস্তার ওপারে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ঘুমচোখে সে চোখ কচলে আবার তাকাল—কেউ নেই। এইসব ছোট ছোট অস্পষ্ট দৃশ্য যেন তাকে দিশেহারা করে দিচ্ছিল, বাস্তব আর কল্পনার সীমারেখা প্রতিদিন একটু একটু করে মুছে যাচ্ছিল। অভিষেক তখনো ঘুমিয়ে, মীনাক্ষী নিঃশব্দে নেমে গেল নিচে, বাড়ির পুরোনো ঘরগুলো একবার ঘুরে দেখতে। বাড়ির সিঁড়ির নিচের স্টোর রুমে একটা পুরনো কাঠের খাটের নিচে পড়ে থাকা ধুলো ধুলো আয়নাটার কথা মনে পড়ল—যেটা তারা বাড়িতে ঢোকার সময় দেখেছিল। সে ধুলো ঝেড়ে সেটা টেনে বার করল, আর অবাক হয়ে লক্ষ্য করল আয়নার ফ্রেমের পেছনে কিছু একটা ঠেসে রাখা আছে। ধীরে ধীরে খুলে বের করতেই মেলে একটি পুরনো পাণ্ডুলিপির পাতা, যার ওপর আঁকাবাঁকা অক্ষরে লেখা—“ও আসবে। ওর জন্য অপেক্ষা করিস। দরজা খুলিস না যতক্ষণ না সময় আসবে।” তার নিচে শিশুর হাতের লেখায় খসখসে দাগে আবার লেখা—“মা কাঁদে। ও জানে না আমি কি জানি। আমি জানি।” সেই মুহূর্তে মীনাক্ষীর মনে হল কোনো এক চাপা কান্নার আওয়াজ যেন দূর থেকে ভেসে আসছে, একটা বদ্ধ দরজার অন্য পাশ থেকে, ঠিক যেমন আগের রাতে শুনেছিল। এই লেখাগুলো নিশ্চয় শুভ্রর লেখা—তার ভয়, তার সচেতনতা, আর হয়তো তার মায়ের রহস্যময় অবস্থান সম্পর্কে কিছু ইঙ্গিত। মীনাক্ষীর মাথার মধ্যে শব্দগুলো বারবার ঘুরপাক খেতে লাগল—‘ও আসবে’, ‘দরজা খুলিস না’, ‘আমি জানি’… কিন্তু সে কী জানত? কে ছিল সেই “ও”? আর কিসের ‘সময়’?
অভিষেক সকালে অফিসে বেরিয়ে যাওয়ার আগে মীনাক্ষী তাকে এই লেখাগুলোর কথা জানাল। অভিষেক চিন্তিত হলেও বলে, “তুই এসব মানসিকভাবে নিতে পারিস না, মানে অত ডুবে যাস না। হতেই পারে ছোট ছেলের ভয়ের বশে কিছু লেখা, তাও তিরিশ বছর আগে। এখন কিছু নেই তো!” কিন্তু মীনাক্ষী চুপ করে থাকে। সে জানত এই ঘটনাগুলোর গভীরে আরও কিছু আছে, যা এখনো অজানা। দুপুরে সে নিজে গেল দক্ষিণ কলকাতার মেইন লাইব্রেরিতে, পুরনো খবরের কাগজের রেকর্ড ঘাঁটতে। ১৪ জুন ১৯৮১ সালের “আনন্দবাজার” এর একটি কপি খুলতেই তার চোখ আটকে গেল একটি ছোট খবরের উপর—“টালিগঞ্জের পুরাতন বাড়িতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড: এক কিশোর নিহত”। খবরে লেখা, “সন্ধ্যে সাতটার সময় অজ্ঞাত কারণে আগুন লাগে, দোতলা বাড়ির একটি ঘরে। উদ্ধারকারীরা জানিয়েছে, ঘরের এক কোণে পাওয়া যায় একটি অক্ষত কাগজ, যাতে লেখা ছিল ‘ও আসবে’। মৃত কিশোরের নাম শুভ্র মৈত্র। তার মা, মৃণালিনী মৈত্র, ঘটনার পর নিখোঁজ।” লাইব্রেরির নিস্তব্ধতা ভেদ করে যেন একটা কাঁপুনি মীনাক্ষীর মেরুদণ্ড বেয়ে নেমে এল। সেই নাম—মৃণালিনী মৈত্র, শুভ্রর মা, সেই লাল টিপওয়ালী? মানসিক ভারসাম্যহীন, যার কান্না, whose red bindi, whose voice asks only for one thing—“শুভ্র আছে?”
সন্ধ্যেবেলায় ঘরে ফিরে আসার সময় সে লক্ষ্য করল তাদের ফ্ল্যাটের সামনে কেউ যেন দাঁড়িয়েছিল কিছুক্ষণ আগে—কারণ দরজার সামনের মেঝেতে একটি ছাইয়ের পাতলা ছাপ, আর একটা গন্ধ—জ্বলন্ত কাপড়ের মত। অভিষেক যখন ঘরে ফেরে, তখন মীনাক্ষী তাকে সব খুলে বলে—খবরের কাগজ, পাণ্ডুলিপির টুকরো, শুভ্রর লেখা, মৃণালিনীর নিখোঁজ হওয়া। অভিষেক এবার আর হাসে না, বরং চুপ করে গিয়ে সিগারেট ধরায়, জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। হঠাৎ সে বলে ওঠে, “কাল রাতে আমি একটা স্বপ্ন দেখেছি। দেখলাম আমি দরজায় দাঁড়িয়ে আছি, আর এক নারী আমাকে বলছে—‘ও আসবে’। আমি দরজা খুলতেই সে ঝুঁকে পড়ছে সামনে, আর তার কপালে একটা টকটকে লাল টিপ।” কথাটা শুনে মীনাক্ষী কেঁপে ওঠে। তারা বুঝতে পারে এটা আর কাকতাল নয়—ঘরের দেওয়াল, আয়নার পেছন, পুরনো কাগজ, আর মানুষের মুখে মুখে ঘোরা রহস্য—সব যেন এক জায়গায় এসে মিলছে। আর একটাই নাম উচ্চারিত হচ্ছে বারবার—শুভ্র। কে সে? আর কী জানত সে এমন, যা লিখে রেখে গিয়েছিল, যা মৃত্যুর পরেও কেউ জানাতে চাইছে না? রাত নামে ধীরে ধীরে, আর সময় এগোয় রাত দুটার দিকে। তারা এবার একসঙ্গে বসে থাকে, দরজার পাশেই, আলো নিভিয়ে, নিঃশব্দে। এবং তখনই আবার সেই শব্দ—টুক… টুক… টুক… দরজায় তিনবার কড়া নাড়া। এবং সেই কণ্ঠস্বর, যেন বহু দূর থেকে—“শুভ্র আছে?” তারা কিছু না বলেই বসে থাকে। কিন্তু মীনাক্ষী এবার ঠিক করে—সে সত্য জানবে, দরজা খুলবে না যতক্ষণ না জানে—কী জানত শুভ্র?
অধ্যায় ৪: অগ্নিসাক্ষী
মীনাক্ষী পরদিন সকালেই ঠিক করল যে সে এবার থেমে থাকবে না—যতই ভয় আসুক, যতই প্রতিবন্ধকতা আসুক না কেন, সে বুঝতে পারছে এই রহস্যের গভীরে একটা ভয়ঙ্কর সত্য লুকিয়ে আছে, যেটা জানলে হয়তো সে, অভিষেক, বা এই বাড়ির পরবর্তী বাসিন্দারা মুক্তি পেতে পারে। সকালবেলা সে গঙ্গা মাসির কাছে আবার গিয়ে বসল, এবার অনেকটা অনুরোধের সুরে বলল, “দয়া করে সত্যিটা বলেন মাসি, আপনি যা জানেন—সব বলেন।” গঙ্গা মাসি একটু চুপ করে রইলেন, যেন তার চোখদুটো অতীতের কোনো দৃশ্যপটে চলে গেল। তারপর তিনি বললেন, “তুই বলেছিলি শুভ্রর কথা… আমি তাকে দেখেছি মা, ছোট থেকে বড় হতে, একেবারে শেষ দিন পর্যন্ত। ও বাচ্চাটার স্বভাব ছিল একেবারে নিজের মতো—চুপচাপ, কারো সঙ্গে কথা বলত না, একটানা কাগজে কিছু লিখে যেত। ওর মা—মৃণালিনী—সে ছিল শিক্ষিতা, কিন্তু লোক বলত সে উন্মাদ। আমি বলি, সে কেবল অন্যরকম ছিল। স্বামীর মৃত্যুতে সে একেবারে ভেঙে পড়ে, তারপর ছেলেকে আঁকড়ে ধরেছিল। কিন্তু ওই পুরনো বাড়ির অনেকেই ওকে পছন্দ করত না, বিশেষ করে ওর দেবর অমিতাভ—সে সবসময় চাইত সম্পত্তিটা তার নামে হোক। শুভ্রের মধ্যে কিছু ছিল, মা… আমি নিজে দেখেছি, সে অনেক সময় এমন সব কথা বলত যা আগে হয়নি, কিন্তু পরদিন ঘটে যেত। কেউ বলত ভবিষ্যৎদৃষ্টি, কেউ বলত পাগলামি। কিন্তু একদিন, সেই ১৪ই জুন, বিকেলবেলা সে হঠাৎ এসে বলল, ‘আজ আগুন লাগবে, আমি থাকব না।’ আমি হেসে বলেছিলাম, ‘বাজে কথা বলিস না।’ কিন্তু রাতে আগুন লেগে গেল… ভীষণ আগুন। সারা বাড়ি জ্বলছিল। ফায়ার ব্রিগেড এসে পানি দিয়েও কিছু করতে পারেনি। শুভ্রকে পেয়েছিল ঘরের এক কোণে, যেখানে এক কাগজ পড়ে ছিল… তাতে লেখা ছিল—‘ও আসবে।’”
মীনাক্ষীর সারা শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠল। সে ধীরে জিজ্ঞেস করল, “আপনি কি জানেন ওর মা… মানে মৃণালিনী… কী হয়েছিল তার?” গঙ্গা মাসি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, “সে তো দেখাই গেল না আর কখনো। কেউ বলল পুড়ে গেছে, কেউ বলল পালিয়ে গেছে। আমি বলি—সে কোথাও আটকে আছে, সময়ের মধ্যে, ওর ছেলের শোকের মধ্যে। সেই থেকে এই বাড়িতে মাঝেমাঝে রাতের বেলা কেউ দরজায় আসে, আর ‘শুভ্র আছে?’ বলে খোঁজে। সবাই ভয় পায়, কেচ্ছা বলে উড়িয়ে দেয়। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি, আমি কখনো কখনো জানালা দিয়ে লাল টিপওয়ালীকে দেখেছি… সে শুধু তাকিয়ে থাকে, সেই বাড়িটার দিকেই।” মীনাক্ষী চুপ করে বসে থাকে, মনে হয় কিছু বলার নেই আর। বাড়ি ফিরে এসে সে পুরনো সেই আয়নাটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকে। তারপর হঠাৎ এক অদ্ভুত বিষয় খেয়াল করে—আয়নার কাঁচের পেছনে কিছু যেন আঁকা আছে, যে আঁকাটা দিনে দেখা যায় না, কিন্তু বিকেলের আলো পড়ে যখন কোণাকুণিভাবে তাকায়, তখন কাঁচের মধ্যে দেখা যায় এক নারীর অবয়ব—চুল ভেজা, চোখ দুটো নিচের দিকে নুয়ে, আর কপালে একটা লাল টিপ। সেই মুখটা যেন বাস্তব নয়, কিন্তু নিঃশব্দে বলছে কিছু একটা। মীনাক্ষী ধীরে আয়নার সামনে বসে পড়ে। আয়নার নিচে ছোট্ট একটা খোপ থাকে, যা আগে খেয়াল করেনি। খোপটা খোলার পর সে দেখতে পেল ভেতরে কিছু পুরোনো ফটো, কিছু হাতের লেখা, আর একটি পিতলের ছোট্ট কৌটো। ফটোগুলোতে দেখা যাচ্ছে মৃণালিনী আর ছোট শুভ্র, দুজনেই হাসছে, কিন্তু সেই হাসির মধ্যে চাপা এক অদ্ভুত বিষণ্নতা। আর একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে—মৃণালিনীকে কোলে নিয়ে এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে আছেন, যার চোখে একরকম অদ্ভুত দৃঢ়তা—সেই ব্যক্তির পেছনে গায়ে লেখা অমিতাভ মৈত্র।
মীনাক্ষী রাতের খাবার শেষে সব কিছু অভিষেককে দেখাল। তারা একমত হলো—এই বাড়ির আগুন নিছক দুর্ঘটনা ছিল না, বরং এর পেছনে সম্ভবত কোনো চক্রান্ত ছিল। শুভ্র যদি আগেই আগুনের কথা বলে থাকে, তবে সে কিছু বুঝতে পেরেছিল, হয়তো কিছু দেখে ফেলেছিল। আর সেই জন্যই হয়তো তাকে চিরতরে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মৃণালিনী হয়তো সেই সত্যের সঙ্গে আপস করতে পারেনি, আর আজও তার আত্মা ফিরে ফিরে আসে—ছেলের জন্য, নাকি প্রতিশোধের জন্য, তা বলা মুশকিল। রাত তখন দুটো ছুঁইছুঁই। ঘরটা নিস্তব্ধ। অভিষেক ঘরের আলো নিভিয়ে বলে, “আজ আমরা চোখে চোখ রেখে দেখি, দরজার সামনে কে আসে।” তারা দুজনে মোমবাতি জ্বালিয়ে বসে থাকে দরজার সামনে। সময় যেন থেমে থাকে। এবং তখনই, নিস্তব্ধতা ছিঁড়ে সেই শব্দ—টুক… টুক… টুক… তিনবার কড়া নাড়া। দুজনেই দাঁড়িয়ে পড়ে, দরজার পাশে। এবার তারা চোখ রাখে ছিদ্রে, একসঙ্গে। বাইরে কেউ নেই। কিন্তু ঠিক তখনই তারা দেখতে পায় ছায়ার মত একটা অবয়ব জানালার পাশে দাঁড়িয়ে, তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। কণ্ঠস্বর আসে—“শুভ্র আছে?” গলা যেন খুব কাছেই, অথচ অনেক দূরের। অভিষেক ধীরে ফিসফিস করে বলে ওঠে, “না… ও নেই। কিন্তু আমরা ওকে খুঁজছি।” কণ্ঠস্বর আর আসে না। শুধু মোমবাতির আলোয় ঘরের ছায়াগুলো যেন লালচে হয়ে ওঠে, আর আয়নার কাচে আবার দেখা যায় সেই মুখ—চোখে জল, কপালে টিপ, আর ঠোঁটে সেই একই বর্ণহীন বাক্য—“ও আসবে…”
অধ্যায় ৫: দরজার ওপারে
রাত পেরিয়ে সকাল হলেও ঘুম আর এল না অভিষেক আর মীনাক্ষীর চোখে। দরজার ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা সেই ছায়াময়ী উপস্থিতি, তার শান্ত অথচ শীতল কণ্ঠস্বর, আর আয়নার মধ্যে লুকিয়ে থাকা সেই নারী মুখ—সব কিছু মিলিয়ে যেন বাস্তব আর অবাস্তবের মধ্যে এক অদ্ভুত সীমানা তৈরি হয়ে গেছে। সকালের আলোয় অভিষেক চুপচাপ বসে চা খাচ্ছিল আর জানালার বাইরে তাকিয়ে ছিল—কিন্তু তার চোখে যেন অজস্র প্রশ্ন ভেসে বেড়াচ্ছে। মীনাক্ষী আয়নার পেছন থেকে পাওয়া কৌটোটা খুলে দেখল—ভেতরে আছে একটা সাদা সুতো দিয়ে বাঁধা লাল টিপ, কয়েকটি পোড়া কাগজের টুকরো আর একটি ছোট্ট তামার লকেট, যার পেছনে খোদাই করে লেখা ‘শ. মৈত্র’—সম্ভবত শুভ্রের নামের আদ্যাক্ষর। এসব জিনিস যেন একেকটা নিঃশব্দ সাক্ষী—এক ভয়ংকর রাত, এক হারিয়ে যাওয়া জীবন, আর এক নারীর নীরব প্রতিবাদ। তারা ঠিক করল, এবার সরাসরি সেই মানুষটার খোঁজ নিতে হবে যাকে এই গল্পের ছায়ায় ঘেরা হয়ে আছে—অমিতাভ মৈত্র। পুরনো খবরের কাটিং অনুযায়ী, অগ্নিকাণ্ডের পর তিনি একাই বাড়ির মালিক হন, তারপর বেশ কয়েক বছর ওই বাড়িতে থেকে পরে অন্যত্র চলে যান। অনেক খোঁজাখুঁজির পরে তারা এক পুরনো প্রতিবেশীর কাছ থেকে জানতে পারে—অমিতাভ এখন নিউ আলিপুরে থাকেন, বেশ আরামদায়ক ফ্ল্যাটে, স্ত্রী আর নাতি-নাতনির সঙ্গে। অভিষেক আর মীনাক্ষী সেই ঠিকানা নিয়ে বিকেলেই রওনা হয়।
নিউ আলিপুরের বহুতল বিল্ডিংয়ের সামনে দাঁড়িয়ে তারা একবার ভাবল—ঠিক কি না করছে। কিন্তু এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই তো এতদূর এসেছে। দরজায় বেল দেওয়ার পরে এক তরুণী দরজা খোলে, সম্ভবত অমিতাভর মেয়ে বা পুত্রবধূ। পরিচয় জানিয়ে অভিষেক বলে, “আমরা একটা পুরনো বিষয় নিয়ে জানতে এসেছি—১৯৮১ সালের অগ্নিকাণ্ড, টালিগঞ্জের বাড়ি, শুভ্র মৈত্র…” নামটা শুনেই মেয়েটি থমকে যায়, তারপর বলে, “দয়া করে ভিতরে আসুন।” ঘরটা অত্যন্ত আধুনিক, কিন্তু প্রাচুর্যের মধ্যেও যেন কোথাও একটা অস্বস্তি লুকিয়ে ছিল। অমিতাভ মৈত্র এখন প্রৌঢ়, কিন্তু চোখে সেই একই দৃঢ়তা যা ছবি দেখেই মীনাক্ষী চিনে নিয়েছিল। প্রথমে তিনি কিছু বলতে চান না, বলেন—“এত বছর আগের কথা, ভুলে যাওয়াই ভালো।” কিন্তু মীনাক্ষী আয়নার সেই ছবি, কৌটো, আর শুভ্রর লেখা দেখিয়ে বলে, “আপনি হয়তো ভুলে যেতে চেয়েছেন, কিন্তু কেউ ভুলতে পারেনি। দরজায় এখনো কেউ এসে দাঁড়ায়, রাত দুটোয়, তিনবার কড়া নাড়ে, আর বলে—‘শুভ্র আছে?’” সেই বাক্য শুনে অমিতাভ কেঁপে ওঠেন, মুখে ছায়া নেমে আসে, হাত থেকে তার চায়ের কাপ পড়ে যায় মেঝেতে। ধীরে ধীরে, নীরবতা ভেঙে তিনি বলেন, “আমি ওকে সরিয়ে দিইনি… আমি শুধু সত্যি চেপে গিয়েছিলাম।” এবং তখন তিনি খুলে বলেন এক ভয়ংকর অতীত—কীভাবে ভাইঝিকে তার মানসিক অবস্থা অস্থির দেখিয়ে সমাজের চোখে একঘরে করে দিয়েছিলেন, কীভাবে বাড়ির দখল নিতে চেয়েছিলেন, আর কেমনভাবে এক রাতে এক ‘অঘটন’ ঘটে যায়—যার পেছনে সে নিজেই দাঁড়িয়ে ছিল নীরবে।
অমিতাভ বলেন, “শুভ্র খুব সাধারণ ছিল না। তার ভেতরে এমন কিছু ছিল যা আমার ভয় ধরাত। সে আমার দিকে তাকিয়ে চুপচাপ বলেছিল—‘তুমি চাও আমরা না থাকি, তাই না?’ আমি কাঁপে উঠেছিলাম। ওর মা, মৃণালিনী, বুঝেছিল সবকিছু। কিন্তু কেউ তার কথা শুনত না, কারণ সবাই তাকে পাগল ভেবেছিল। আমি ঠিক করেছিলাম ওদের দুজনকে আলাদা করব… কিন্তু যা ঘটেছিল, সেটা… আমি চেয়েছিলাম শুধু মৃণালিনীকে সরিয়ে দিতে, কিন্তু শুভ্র সেদিন ঘরে ছিল, জানত না আগুন কোথা থেকে আসছে। আর তারপর যা হলো… জানলার বাইরে দাঁড়িয়ে আমি দেখছিলাম আগুনের শিখা উঠছে… জানতাম ভেতরে ওরা আছে।” কথাগুলো শুনে মীনাক্ষীর চোখে জল এসে যায়, কিন্তু তার গলায় কাঁপন নেই—সে শুধু বলে, “আপনি কি মনে করেন ও ক্ষমা করবে আপনাকে?” অমিতাভ বলে, “আমি জানি না… কিন্তু প্রায়ই রাতে ঘুম ভেঙে দেখি জানালায় দাঁড়িয়ে এক নারী তাকিয়ে আছে… তার কপালে লাল টিপ।” সেইদিন সন্ধ্যায় অভিষেক আর মীনাক্ষী বাড়ি ফেরার পথে আর কোনো কথা বলেনি। সব প্রশ্ন যেন উত্তর পেয়েও থেকে গেছে অসমাপ্ত। তারা ঠিক করে এই সত্যটা জানাবে—এই ইতিহাস চাপা পড়ে থাকুক না আর। কিন্তু সে রাতে যখন তারা বাড়ির সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছে, তখন পেছনে যেন আবার সেই পায়ের শব্দ… ধীরে ধীরে, সিঁড়ি বেয়ে উঠছে কেউ, যেন দরজার ওপারে অপেক্ষা করছে—আবার তিনবার কড়া নাড়বে, আবার সেই প্রশ্ন করবে—“শুভ্র আছে?” কিন্তু এবার তারা জানে, সত্য জানানো হয়েছে, এবং দরজার ওপারে দাঁড়িয়ে যে, সে এখন শুধু অপেক্ষা করছে—শেষ উত্তরের।
অধ্যায় ৬: ছাইয়ের কাহিনি
রাত যত গভীর হচ্ছিল, বাড়িটা যেন ধীরে ধীরে অতীতে ডুবে যাচ্ছিল। সিঁড়ির প্রতিটি ধাপে পায়ের ছাপের মতো অদৃশ্য শব্দ ছিল, দেয়ালের গায়ে জমে থাকা ধুলোর ভেতর কেউ যেন নিঃশব্দে নিঃশ্বাস ফেলছে, আর প্রতিটি কোণায় ছড়িয়ে ছিল এক অসমাপ্ত গল্পের ছায়া। মীনাক্ষী সেই রাতে ঘুমোতে পারল না। বিছানায় শুয়ে সে বারবার ফিরে যাচ্ছিল শুভ্রর ছোট ছোট লেখা, আয়নার ছায়া, আর অমিতাভর চোখে লুকানো অপরাধবোধে। গভীর রাতে সে উঠে গিয়ে একে একে ঘরের সমস্ত বাতি নিভিয়ে দেয়। তারপর একটিমাত্র মোমবাতির আলোয় বসে পড়ে সেই আয়নার সামনে, যার কাঁচে এখনও মৃদু হয়ে ফুটে ওঠে সেই লাল টিপওয়ালীর মুখ। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার মনে হল যেন সেই মুখটা আজ একটু বেশি পরিষ্কার, একটু বেশি জীবন্ত। হঠাৎ যেন কাঁচের ওপার থেকে সেই নারীমুখ বলছে—“ছাইয়ের নিচে যা আছে, তা এখনো আছে।” ঠিক তখনই ঘরের বাতাস ভারী হয়ে আসে, আর দরজার দিকে তাকাতেই দেখে, মেঝেতে ছড়িয়ে পড়েছে একরাশ ধূসর ছাই। মীনাক্ষী উঠে গিয়ে সেই ছাইয়ের মধ্যে হাত দিয়ে স্পর্শ করে—নরম, গরম, যেন নতুন পোড়া কিছু—আর তার ভিতরে মেলে এক টুকরো কাগজ, আধপোড়া, তবুও পাঠযোগ্য—তাতে লেখা আছে, “আমার মৃত্যুর আগে আমি ওকে দেখে গেছিলাম, সে চেয়েছিল আমি চুপ থাকি, কিন্তু আমি পারিনি। শুভ্র জানত, আমি বলেছিলাম, তাই…” বাকিটা ছাই হয়ে গেছে, কিন্তু কথাগুলোই যথেষ্ট।
পরদিন সকালে মীনাক্ষী আর অভিষেক একসঙ্গে আবার গিয়েছিল টালিগঞ্জ থানায়। পুরনো রেকর্ড ঘেঁটে তারা চিঠি আর পত্রিকায় থাকা ঘটনার বিবরণ মিলিয়ে এক ধাপে ধাপে পুনর্গঠন করতে থাকে সেই রাতে কী কী ঘটেছিল। পুলিশ রিপোর্টে উল্লেখ ছিল, “অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়েছে রান্নাঘর থেকে, তবে কোথা থেকে আগুন ছড়াল তা নিশ্চিত নয়।” সাক্ষ্যদাতাদের তালিকায় ছিল মিত্রবাবুর বাবার নাম—তিনি জানিয়েছিলেন, “মৃণালিনী মৈত্র মানসিকভাবে স্থিতিশীল ছিলেন না, অনেকসময় হঠাৎ রেগে গিয়ে জিনিসপত্র ভাঙচুর করতেন।” কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে, কোনো চিকিৎসা সংক্রান্ত দলিল নেই, কোনো মনোরোগ বিশেষজ্ঞের রিপোর্ট নেই—শুধুই মৌখিক অভিযোগ। অভিষেক নোট করে, “এই মানসিক ভারসাম্যহীনতার তকমা কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে দিয়েছে, যাতে সত্যকে ঢেকে ফেলা যায়।” আরেকটি প্রতিবেদনে লেখা—“শুভ্রর শরীরে কোনো পোড়ার চিহ্ন নেই, বরং তার মৃত্যু শ্বাসরোধজনিত। সম্ভবত আগুন লাগার আগে মারা গেছে।” এই লাইনটাই যেন তাদের জন্য চূড়ান্ত ধাক্কা। মানে, শুভ্রকে আগেই হত্যা করা হয়েছিল, আর আগুন দেওয়া হয়েছিল প্রমাণ লোপাটের জন্য? সেদিন বিকেলে তারা ফিরে এসে এক এক করে সেই সমস্ত চিহ্ন খুঁজতে থাকে—পুরনো কাগজ, বাড়ির নির্মাণ পরিকল্পনা, আর ঘরের ভেতরে লুকানো কুঠুরি। সিঁড়ির নিচে থাকা একটি ঢাকনা খুলতেই সেখানে পায় একটি ছোট্ট কাঠের বাক্স—ভেতরে শুভ্রর একটি রঙিন খাতা। তার ভেতরে লেখা, “আমি জানি মা কাঁদছে, সে জানে আমি কী জানি। আমি দেখেছি কাকুকে, আমি শুনেছি সে বলেছে—‘এখনই সময়।’ মা চিৎকার করেছিল, আর তারপর…” বাকিটা কাটা, কিন্তু যথেষ্ট বলার জন্য। মীনাক্ষী সেই খাতা বুকের কাছে চেপে ধরে, যেন এই শিশুটির কণ্ঠে এখনো সাড়া দিতে পারে কেউ, যেন এত বছর পরেও কেউ তার পক্ষে দাঁড়াতে পারে।
সন্ধের পরেই মিত্রবাবু হঠাৎ এসে হাজির হলেন, তার চোখে উদ্বেগ। তিনি বলেন, “আপনারা কোনো কাগজপত্র খুঁজেছেন? আমি দেখেছি আপনারা নীচের ঘরেও গিয়েছিলেন।” মীনাক্ষী একটু ঠান্ডা গলায় বলেন, “হ্যাঁ, আমরা খুঁজছি সত্যি। আপনি কিছু জানেন, মিত্রবাবু?” মিত্রবাবু কাঁপা কাঁপা গলায় বলেন, “আমার বাবা ওই অগ্নিকাণ্ডের সময় এই বাড়িতেই ছিলেন। তিনি বলতেন, একটা নারীকণ্ঠ মাঝরাতে কাঁদত, আর বারবার বলত ‘আমার ছেলে… আমার ছেলে…’। আমি তখন ছোট ছিলাম, কিন্তু এখনো মাঝরাতে সেই আওয়াজ ঘুমে শুনি। আপনি বিশ্বাস করুন বা না করুন, ওই কণ্ঠস্বর বাড়ি ছাড়ে না।” সে রাতেই, ঠিক দুইটা বাজার কিছু আগে, দরজায় আবার তিনবার কড়া নাড়ে কেউ। কিন্তু এইবার মীনাক্ষী একা দরজার পাশে দাঁড়ায় না—সে নিয়ে আসে সেই ছোট্ট খাতা, পোড়া কাগজ, আর লাল টিপওয়ালীর ছবি। দরজা খুলে সে কিছু না দেখে নিচে রাখে খাতাটি, বলে—“শুভ্র এখানেই ছিল, কিন্তু এখন নেই। আপনি যদি শান্তি চান, তবে জেনে রাখুন—সত্য প্রকাশ হয়েছে। আমরা দেখেছি।” দরজা বন্ধ করার কিছুক্ষণ পর, জানালার কাঁচে এক শিশুর হাতের ছাপ দেখা যায়, আর আয়নার কাঁচে ভেসে ওঠে এক শান্ত মুখ—চোখে আর কান্না নেই, কপালে সেই একই লাল টিপ। তার ঠোঁট নড়ে, আর কাঁচে জমে থাকা ছাইয়ের ওপর লেখা হয়ে যায়—“ধন্যবাদ।”
অধ্যায় ৭: ফিরে দেখা
দিন তিনেক কেটে গেছে। বাড়ির বাতাস বদলে গেছে—যেখানে আগে ঘন এক অদৃশ্য ভার ঘর জুড়ে থাকত, এখন সেখানে হালকা এক নিঃশ্বাসের মতো প্রশান্তি ছড়িয়ে পড়েছে। অভিষেক আর মীনাক্ষী রোজকার জীবনে ফিরেছে বটে, কিন্তু মনে মনে জানে, তারা কোনো সাধারণ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আসেনি। দুপুরবেলায় একদিন মীনাক্ষী পুরোনো আয়নাটা বারান্দায় নিয়ে রোদে রেখেছিল। আলো পড়ে কাঁচের গায়ে, আর সেই পরিচিত নারীমুখ আর দেখা যায় না—কেবল কাঁচে নিজেদের প্রতিচ্ছবি, আর একরাশ রোদ্দুর। সে আয়নার ফ্রেমের পাশ থেকে ছোট্ট লকেটটা বের করে এনে গলায় ঝুলিয়ে নেয়, যেন এক নীরব শপথ নেয় যে কোনোদিন সেই ইতিহাসকে অস্বীকার করবে না। সেদিন সন্ধ্যেয় হঠাৎই হাজির হয় গঙ্গা মাসি, হাতে এক পুরোনো খাম, যার ওপরে অদ্ভুত হস্তাক্ষরে লেখা—“যদি কখনো কেউ সত্য খোঁজে।” মীনাক্ষী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, “এটা আপনি কোথা থেকে পেলেন?” মাসি বলেন, “তোর জন্য রেখে গেছিল একসময়… আমার বিশ্বাস ছিল, কারো না কারো হাত দিয়ে এটা খোলা হবে। এখন সময় এসেছে।” খাম খুলে দেখা গেল, ভেতরে আছে এক পাতার চিঠি—মৃণালিনী নিজ হাতে লেখা, তার ছেলের জন্য। চিঠির ভাষা ছিল না কান্নার, বরং এক অভিভাবকের গাঢ় মমতায় মোড়া—“শুভ্র, যদি কোনোদিন আমি না থাকি, যদি কেউ তোর পাশে না দাঁড়ায়, তবে মনে রাখিস—তুই আলাদা বলেই সবাই তোকে ভয় পায়। কিন্তু তোর সত্যটাই একদিন আলো হবে। কেউ না কেউ সেটা খুঁজে পাবে।”
মীনাক্ষী চিঠিটা বারবার পড়ে। সে জানে—এই একজন মা, যাকে সমাজ ‘পাগল’ বলেছিল, তার দৃষ্টিতে কিন্তু সময়কে অনেক আগে থেকেই বোঝার ক্ষমতা ছিল। সেই চিঠিটা যেন কোনো অতিপ্রাকৃত বার্তা নয়, বরং একজন মায়ের গভীর উপলব্ধির দলিল। সন্ধ্যায় অভিষেক জানায় যে তার অফিসের মিডিয়া ডিপার্টমেন্ট এই অগ্নিকাণ্ড আর রহস্যময় ঘটনার ওপর একটা ডকুমেন্টারি করতে চায়। মীনাক্ষী প্রথমে দ্বিধায় পড়ে যায়, কারণ কিছু সত্য এতটাই ব্যক্তিগত যে তা ক্যামেরার লেন্সে ধরতে গেলেই বিকৃত হওয়ার ভয় থাকে। কিন্তু পরে ভাবে, যদি এই মাধ্যমে কেউ শুভ্র আর মৃণালিনীর কথা জানতে পারে, তাহলে হয়তো এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি কিছু নেই। তারা মিত্রবাবুর কাছ থেকে অনুমতি নেয়, ছাদে গিয়ে আগুনে পোড়া কাঠের টুকরো, পুরোনো ঘরের দেয়ালে জমে থাকা কুয়াশার মত দাগ, আর আয়নার গায়ে ছাইয়ের গন্ধ সবই ক্যামেরায় তুলে নেয়। সেই ডকুমেন্টারির নাম রাখা হয়—“শুভ্র আছে?” এবং তা মুক্তি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। কেউ বলেন—এ ভূতের গল্প নয়, এটা অন্যায়ের ইতিহাস। কেউ বলেন—এ শুধু অতীতের পুনরাবৃত্তি নয়, বরং ভুতুড়ে স্মৃতি। আর সেইসব প্রতিক্রিয়ার মাঝে সবচেয়ে শান্ত থাকে মীনাক্ষী, কারণ সে জানে, সে যা দেখেছে তা শুধু ইতিহাস নয়, আত্মার একটি অসমাপ্ত অধ্যায়।
এক রাতে, যখন সবকিছু নিস্তব্ধ, অভিষেক ঘুমিয়ে পড়েছে, মীনাক্ষী একা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। কাঁচে তার নিজের মুখ ছায়ার মত নড়ে উঠছে। সে ধীরে ফিসফিস করে বলে, “তোমরা এখন শান্তিতে তো?” অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর, আয়নায় কোনো মুখ দেখা যায় না, কিন্তু হঠাৎ কাঁচটা একবার ধোঁয়ায় ঢেকে যায়, আর ধীরে ধীরে লেখা হয়ে যায়—“আছি।” শব্দটা পড়েই মীনাক্ষীর চোখে জল আসে না, বরং মুখে এক চিলতে শান্ত হাসি ফুটে ওঠে। সে জানে, লাল টিপওয়ালীর যন্ত্রণা শেষ হয়েছে, শুভ্রের নীরব প্রতিবাদ মূল্য পেয়েছে। ঠিক তখনই জানালার বাইরে, গলির মোড়ে একটা ছোট ছেলেকে দেখা যায়, সাদা শার্ট পরে সে হেঁটে যাচ্ছে, মাথা নিচু। তাকে দেখতে গিয়ে মীনাক্ষী বলে ওঠে, “শুভ্র?” কিন্তু ছেলেটা পেছন না ঘুরেই অদৃশ্য হয়ে যায়। হয়তো সে সত্যিই চলে গেছে, হয়তো সে কেবল এক স্মৃতি হয়ে ফিরে আসে মাঝে মাঝে। ঘরের বাতাসে আর কোনো কান্নার ধ্বনি নেই, দরজায় আর কেউ কড়া নাড়ে না, আয়নার কাঁচে ছাই জমে না। সবকিছু নীরব, কিন্তু সেই নীরবতা এক প্রশান্ত, মৃদু ধ্বনি রেখে যায়—যা বলে, “যারা সত্য জানায়, তারা কখনো একা পড়ে না।” এবং সেই মুহূর্তে মীনাক্ষী জানে, এই গল্প তার নয়, এটা শুভ্র আর তার মায়ের, যারা সময়ের গহ্বরে আটকে গিয়েও একদিন মুক্তি পেয়েছে—একজন স্তব্ধ চিৎকার আর একজন নীরব অপেক্ষার শেষে।
অধ্যায় ৮: কফিনে শেষ পেরেক
ডকুমেন্টারির প্রচার শেষ হওয়ার পর স্থানীয় সংবাদমাধ্যম, ইতিহাস গবেষক এবং এমনকি কিছু মানবাধিকার সংস্থা এই ঘটনার অতীত নিয়ে আলোচনা শুরু করে। ১৯৮১ সালের অগ্নিকাণ্ড নতুন করে তদন্তের দাবি ওঠে, বিশেষ করে যেহেতু পুরনো পুলিশ রিপোর্টে অসঙ্গতি এবং শুভ্র মৈত্রের শ্বাসরোধজনিত মৃত্যুর ইঙ্গিত রয়েছে। অভিষেক একটি বিশদ প্রতিবেদন তৈরি করে পেশ করে কলকাতা মিউনিসিপাল আর্কাইভ এবং কলকাতা পুলিশের ক্রাইম রিভিউ ইউনিটে। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই জানা যায়, পুলিশের ফাইল ঘেঁটে একটি পুরনো, ‘অনফাইল্ড’ রিপোর্ট বেরিয়েছে, যেখানে এক প্রত্যক্ষদর্শী—তৎকালীন বাড়ির গৃহপরিচারিকা—লিখিতভাবে জানিয়েছিল, ঘটনার ঠিক আগের দিন অমিতাভ মৈত্র এবং এক অজ্ঞাত ব্যক্তি গভীর রাত্রে ওই ঘরে ঢুকেছিল। সেই সাক্ষ্য তখন গুরুত্ব পায়নি কারণ মৃণালিনীকে ‘অবসেসড’ বা মানসিক ভারসাম্যহীন বলে আদালতে উল্লেখ করা হয়। এবার নতুন তথ্য ও ডকুমেন্টারির প্রভাবের ফলে মামলা পুনরায় খোলা হয়। মীনাক্ষী ও অভিষেক সাক্ষ্য দিতে সম্মত হন, এবং তারা নিজেদের সংগ্রহ করা নথি, ছবি, ও শুভ্রর লেখা খাতা আদালতে জমা দেন। সবকিছু বিচার বিশ্লেষণ করে প্রাথমিকভাবে একটি তদন্ত কমিটি গঠন হয় যা সিদ্ধান্ত নেয়—তৎকালীন তদন্তে অসততা ছিল এবং সম্পত্তির স্বার্থে ঘটনার মোড় ঘোরানোর প্রচেষ্টা হয়েছিল।
এই পর্যায়ে অমিতাভ মৈত্রকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। প্রাথমিকভাবে তিনি দায় অস্বীকার করেন, তবে বেশ কয়েক দফা জিজ্ঞাসাবাদের পর শেষ পর্যন্ত তিনি স্বীকার করেন যে, মৃণালিনীর ওপর মানসিক চাপ সৃষ্টি করতে গিয়ে তিনি কিছু ‘চরম সিদ্ধান্ত’ নিয়েছিলেন। যদিও তিনি শুভ্রর মৃত্যুকে দুর্ঘটনা বলেই দাবি করেন, তদন্তকারী অফিসারদের সন্দেহ গাঢ় হয় কারণ শুভ্রর দেহে কোনো পুড়ার চিহ্ন ছিল না এবং মৃত্যুর প্রকৃতি শ্বাসরোধজনিত ছিল—যা আগুন লাগার আগেই ঘটে থাকতে পারে। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট যেহেতু তখনকার মতো প্রভাবিত ছিল, বর্তমান ফরেনসিক বিশেষজ্ঞদের সহযোগিতায় পুরনো ফটোগ্রাফ এবং লিপিবদ্ধ তথ্য দিয়ে পুনর্মূল্যায়ন শুরু হয়। আদালতে এই সমস্ত নথিপত্র জমা দিলে বিচারক অমিতাভকে জিজ্ঞাসা করেন কেন তিনি এত বছর নীরব ছিলেন। তিনি কোনো সরাসরি উত্তর না দিয়ে বলেন, “আমি যা করিনি, তার দায় নিয়েও বেঁচেছি।” বিচারক পর্যবেক্ষণে বলেন, “এই মামলায় যা ঘটেছে তা শুধু এক ব্যক্তির নয়, গোটা সমাজের ব্যর্থতা—একজন মায়ের মুখ বন্ধ করতে গিয়ে সত্যকেও চাপা দেওয়া হয়েছিল।” এ মন্তব্যের প্রেক্ষিতে তদন্তের শেষ পর্যায়ে আদালত জানায়, যদিও ৪০ বছরের পুরনো মামলায় প্রত্যক্ষ প্রমাণ অনুপস্থিত, তথাপি পর্যাপ্ত পারিপার্শ্বিক তথ্য ও সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে নতুন অনুসন্ধান চলবে এবং ভবিষ্যতে প্রয়োজনে পুনঃবিচার শুরু হতে পারে।
এই আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যেই মীনাক্ষী এবং অভিষেক বুঝতে পারে, তাদের দায়িত্ব এখানেই শেষ নয়। তারা সিদ্ধান্ত নেয়, শুভ্র মৈত্র ও মৃণালিনী মৈত্রের নামে একটি স্বচ্ছ অলাভজনক প্রতিষ্ঠান তৈরি করবে, যেখানে সমাজে অবহেলিত শিশু এবং মানসিকভাবে লাঞ্ছিত মায়েদের জন্য সহায়তা প্রদান করা হবে। সংগঠনের নাম রাখা হয়—“শুভ্রতাই আলো”—যার মূল প্রতিপাদ্য, “যারা শোনে না, তারা ভুল বোঝে, কিন্তু যারা বোঝে, তারা বদলায়।” প্রতিষ্ঠানের উদ্বোধনী দিনে মীনাক্ষী সেই আয়নাটিকে সামনে রেখে রাখে—যেটা একদিন এক রহস্যের প্রতীক ছিল, আজ তা হয়ে উঠেছে মুক্তির পরিচায়ক। সেই আয়নার কাঁচে কোনো মুখ আর ফুটে ওঠে না, কোনো ছায়া আর ভেসে বেড়ায় না, কিন্তু আয়নার পেছনের কাঠের ফ্রেমে ছোট করে খোদাই করা থাকে—“ও আসবে না, কারণ এখন ও শান্তিতে আছে।” এই বার্তাটি যেন শেষ পেরেক গেঁথে দেয় এক যন্ত্রণাদায়ক অধ্যায়ের কফিনে। এখনকার সেই বাড়িটি সংস্কার করে একটি শিশুগ্রন্থাগার তৈরি করা হয়, যেখানে শুভ্রর আঁকা কিছু ছবির প্রতিলিপি ও লেখা রাখা হয় দেয়ালের উপর। অতীতকে স্বীকার করে, সত্যকে স্বীকৃতি দিয়ে, ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে চলাই এখন তাদের লক্ষ্য।
অধ্যায় ৯: সন্ধ্যাশেষে
বছর ঘুরে গেছে। “শুভ্রতাই আলো” এখন কলকাতার এক পরিচিত নাম, যেখানে অবহেলিত শিশুদের নিয়ে কাজ হচ্ছে প্রতিদিন, এবং সেই সঙ্গে মায়েদের জন্য কাউন্সেলিং, সৃজনশীল চর্চা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা হচ্ছে আন্তরিকভাবে। যে বাড়িটিকে একসময় ভুতুড়ে আর অশুভ মনে করা হত, আজ সেখানে শিশুরা বই পড়ে, দেয়ালে রঙ তোলে, ছাদে ঘুড়ি ওড়ায়। এক সন্ধ্যায় মীনাক্ষী ছাদে দাঁড়িয়ে ছিল, সূর্য ডুবে যাচ্ছে ধীরে ধীরে, আর সেই সোনালি আলোয় তার মনে হচ্ছিল—সমস্ত অন্ধকার যেন গলে গলে আলোয় মিশে যাচ্ছে। আয়নাটা এখন দেয়ালের এক কোণে রাখা, তার পেছনে রাখা শুভ্রর আঁকা একটি ছবি—তাতে সে নিজেকে এঁকেছে, আর তার পাশে এক নারীমুখ, যার কপালে লাল টিপ। ছবির নিচে শুভ্রর লেখায় লেখা, “ওর চোখে আকাশ ছিল।” এই সরল কিন্তু গভীর বাক্যটার দিকে তাকিয়ে মীনাক্ষী অনুভব করে, অতীতের ছায়া শুধু ভয় নয়, এক বিশুদ্ধ স্মৃতিও বটে। তার পাশেই এসে দাঁড়ায় অভিষেক, হাতে এক কাপ কফি, আর বলে, “আজ নতুন ছয়জন ভর্তি হয়েছে। একজনের নামও শুভ্র।” দুজনের চোখে একরকম স্থিরতা, যেন তারা জানে—সত্যের পথ যত কঠিন হোক না কেন, তার শেষে দাঁড়িয়ে থাকে শান্তি।
একদিন রাতে, মীনাক্ষী নিজে একা গিয়ে বসে সেই পুরনো টালিগঞ্জ লাইব্রেরির সামনে। ভিতরে গিয়ে পুরনো খবরের পাতা, বিবরণগুলো আবার দেখে। এবার আর তদন্তের খাতিরে নয়, বরং নিজের ভেতরের কোনো অমীমাংসিত প্রশ্নের জবাব পেতে। ১৯৮১ সালের সেই কাটিং তার সামনে খোলা—আগুন, মৃত্যুর সংবাদ, মৃণালিনীর নিখোঁজ হওয়া, এবং সেই ভুল ব্যাখ্যা। কিন্তু এবার সেই সবকিছুকে দেখে সে ভিন্ন দৃষ্টিতে—তথ্য নয়, অনুভব দিয়ে। সে জানে, কাগজের ভাষা মিথ্যে নয়, কিন্তু অসম্পূর্ণ। সত্য তো ছিল মৃণালিনীর চোখে, তার কান্নায়, শুভ্রর আঁকায়, আর প্রতিটি রাতের সেই দরজার কড়া নাড়ায়। লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে আসার সময় এক বৃদ্ধা কণ্ঠস্বর বলে ওঠে, “আপনি ওদের কথা লিখবেন?” মীনাক্ষী ঘুরে তাকায়, একজন অচেনা নারী দাঁড়িয়ে, চোখে চশমা, মুখে অদ্ভুত এক শান্তি। “হ্যাঁ,” বলে সে, “কারণ আমি ভুলতে চাই না।” বৃদ্ধা মাথা নাড়ে—“তবেই আপনি ওদের সত্যিকারের উত্তরাধিকারী।” মীনাক্ষী বুঝে ওঠে না, সে স্বপ্ন দেখছে, নাকি বাস্তবে দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু সেদিন রাতটাকে সে জীবনের সবচেয়ে ভারমুক্ত সন্ধ্যা বলে মনে রাখবে।
পরদিন সকালে আবার যখন তারা “শুভ্রতাই আলো”-তে ফিরে আসে, এক নতুন কিশোর দরজায় দাঁড়িয়ে। মীনাক্ষী বলে, “তোমার নাম?” সে মাথা নিচু করে বলে, “অভিষেক… কিন্তু আমার ডাকনাম শুভ।” মীনাক্ষী অভিষেকের দিকে তাকায়, দুজনের চোখে এক নিমেষের আলো। তারা জানে, সময় আবার একটা নতুন গল্প শুরু করতে চলেছে। আর পুরনো গল্প, যা শেষ হয়েছিল ছাই, কান্না, আর এক অপূর্ণ অপেক্ষায়—তা শেষ হয়েছে এখন শান্তিতে, ভালোবাসায়, এবং সত্যের সম্মানে। সন্ধ্যার আলোয় আর কোনো ছায়া জানালায় এসে দাঁড়ায় না, আয়নার কাঁচে ভেসে ওঠে না কোনো কান্নাময় মুখ, কিন্তু বাতাসে এক নীরব ধ্বনি প্রতিফলিত হয়—“যারা শোনে, তারা জানে; আর যারা জানে, তারা জাগিয়ে তোলে আলো।”
অধ্যায় ১০: লাল টিপের শেষ রাত্রি
রাত ছিল পূর্ণিমার, আকাশে চাঁদের আলো ঝরে পড়ছিল “শুভ্রতাই আলো”-র উঠোনে খেলা করা বাচ্চাদের মাথার ওপর। চারপাশে এক অদ্ভুত শান্তি, যেন বাড়ির প্রতিটি ইঁট এখন আর ইতিহাসের ভার বইছে না, বরং ভালোবাসার আশ্রয় হয়ে উঠেছে। মীনাক্ষী খেয়াল করে, সেই পুরনো আয়নাটা আজ একেবারে স্বচ্ছ, যেন কাঁচের পেছনে জমে থাকা সব ছায়া, সব অশ্রু আর যন্ত্রণার দাগ ধুয়ে গেছে। দেয়ালে টাঙানো শুভ্রর শেষ চিত্রকর্মটিও যেন বদলে গেছে—যেখানে আগে ছিল কুয়াশার মুখ, এখন সেখানে একটি উজ্জ্বল সূর্য ওঠা সকাল, তার সামনে এক নারী, লাল টিপ পরে, হাতে শিশুর হাত ধরে হাঁটছে দূরের দিকে। মীনাক্ষী বুঝে নেয়, এটা শুধু শুভ্র আর তার মায়ের গল্প নয়—এটা সমস্ত হারিয়ে যাওয়া, অপমানিত, ভুল বোঝা আত্মার মুক্তির গল্প। সন্ধ্যায় এক বিশেষ অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়েছে—সংস্থার এক বছর পূর্তি উপলক্ষে। অভিষেক তার বক্তৃতায় বলেন, “এই বাড়ির প্রতিটি দেয়াল, প্রতিটি জানালা আজ আমাদের সাক্ষী যে একসময় এখানে কেউ অপেক্ষা করত শুধু একটি প্রশ্নের জন্য—‘শুভ্র আছে?’ আজ আমরা সবাই জানি, শুভ্র আছে। সে আছে প্রতিটি শিশুর চোখে, প্রতিটি প্রতিবাদের রঙে, প্রতিটি নির্যাতনের মুখে ফিরে আসা সাহসে।” মীনাক্ষীর চোখে জল আসে না, শুধু বুকের ভেতরটা নরম হয়ে যায়।
রাত এগোতে থাকে। অনুষ্ঠান শেষে সবাই বাড়ি ফিরে যায়, কেবল মীনাক্ষী থেকে যায় ছাদের কোণে বসে। চাঁদের আলোয় চারপাশ স্নিগ্ধ, আর তার চোখে ভাসছে শুভ্রর সেই শেষ খাতার পৃষ্ঠা—যেখানে লেখা ছিল “ও আসবে।” সেই লেখাটিকে সে আজ নতুন অর্থে দেখে—ও মানে হয়তো সে নারী, হয়তো এক প্রতিশ্রুতি, হয়তো একজন সাক্ষী, যে চিরকাল অপেক্ষায় ছিল সত্যের জন্য, স্বীকৃতির জন্য। হঠাৎ বাতাসে এক শীতলতা আসে। মীনাক্ষী দাঁড়িয়ে জানালার কাছে যায়, যেখান থেকে একসময় সেই মুখ দেখা যেত, লাল টিপ পরা। জানালার কাঁচে এবার কোনো মুখ নেই। শুধু, কাঁচের ওপরে এক বিন্দু শিশির জমে একটা গোলাকার দাগ ফেলে—ঠিক যেন এক লাল টিপের ছাপ। সে ফিসফিস করে বলে ওঠে, “তুমি এসেছিলে… আর আমি শুনেছিলাম।” মুহূর্তেই জানালা দিয়ে ভেসে আসে এক অদ্ভুত শান্তির সুর, যেন কারো দীর্ঘশ্বাস, তবু তাতে আর যন্ত্রণা নেই—শুধু মুক্তি। সেই রাতে মীনাক্ষী প্রথমবার ঘুমায় সেই ঘরে, যেখানে আগে কেউ সাহস করে একা রাত কাটায়নি। ঘুমের মধ্যে যেন সে দেখে এক বড় উঠোন, তার মাঝে ছোট শুভ্র খেলে বেড়াচ্ছে, তার মা পাশে দাঁড়িয়ে—কপালে লাল টিপ, মুখে প্রশান্ত হাসি।
পরদিন সকালে যখন সূর্য ওঠে, “শুভ্রতাই আলো”-র ছাদে এসে পড়ে এক দীর্ঘ রশ্মি, যা সোজা গিয়ে পড়ে সেই আয়নার কাঁচে। মীনাক্ষী উঠে এসে দেখে আয়নাটা এবার একদম ফাঁকা—না কোনো মুখ, না কোনো ছাপ, না কোনো ছায়া। সে ধীরে ফ্রেমের পেছন থেকে বের করে শেষবারের মতো সেই লাল টিপ, যেটা পিতলের কৌটোতে ছিল। সে সেটা রাখে ঘরের কোণে এক ছোট প্রদীপের পাশে, মাথা নিচু করে বলে, “এবার বিশ্রাম করো।” এবং সেই মুহূর্তে যেন বাড়ির প্রতিটি দরজা, জানালা, বাতাস, ছায়া—সবাই মিলিয়ে বলে ওঠে, “ধন্যবাদ।” শহরের এক কোণে থাকা এই পুরনো বাড়িটি এখন আর ভয় নয়—এটা সাহসের প্রতীক। শুভ্র, মৃণালিনী, এবং এক লাল টিপওয়ালীর কাহিনি এখানেই শেষ হয়—এক দুঃস্বপ্নের শীতল ছায়া থেকে আলোর স্পর্শে জেগে ওঠা এক নতুন সকালের ভেতর দিয়ে।

1000034537.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *