Bangla - ছোটদের গল্প

লাল চুড়ির রহস্য

Spread the love

অঙ্কিতা প্রধান


কলেজের ব্যস্ত ক্যাম্পাসে ভোরের প্রথম ক্লাস শুরু হওয়ার আগে ছাত্রছাত্রীদের ভিড়ের মধ্যে এক অদ্ভুত দৃশ্য চোখে পড়ে ঐশীর। সে তখনই লক্ষ্য করে, প্রতিদিন যেন এক নিয়মিত ছায়া, একটি অচেনা মেয়ে লাল চুড়ি পরে ভিড়ের মধ্যে হেঁটে বেড়ায়। প্রথম দিনটি কেবল নজরকাড়া এক ঘটনা মনে হয়েছিল—কোনো ক্লাসের ছাত্রী কিংবা পরিচিত মুখের মতো নয়, তবু যেন তার উপস্থিতি পুরো ক্যাম্পাসকে আলাদা রঙে ভাসিয়ে দেয়। ঐশী প্রথমে ভেবে নেয় এটি হয়তো কারো ব্যক্তিগত স্টাইল, অথবা শুধু কৌতূহল। কিন্তু পরের দিন, ঠিক একই সময়, একই লাল চুড়ি, একই ধীরে ধীরে ভিড়ের মধ্য দিয়ে হেঁটে যাওয়া—এটি কোনো সাধারণ ঘটনা নয়। ঐশীর মনে কৌতূহল ও উত্সাহ একসাথে জেগে ওঠে।

দিনের মধ্যে ঐশী আরও চোখ রাখে এই অচেনা মেয়ের দিকে। কলেজের হোস্টেল থেকে বের হওয়া পথ, লাইব্রেরির পাশের সরু গলি, শিক্ষকেরা যেসব ক্লাসে যাওয়ার পথে হাঁটেন—প্রায় সব জায়গায় সে একই ছায়া দেখতে পায়। মেয়েটি কখনো কারও দিকে তাকায় না, হাসে না, কথা বলে না। কেউ তাকে চিনতে চায় না বা হয়তো কেউ খেয়ালই করে না। যেন সে কোনও অদৃশ্য শক্তি দিয়ে ঘেরা। কখনও কখনও মনে হয়, সে যেন সময়ের বাইরে, এক ভিন্ন বাস্তবতার অংশ। ঐশী মনে করতে থাকে—এই লাল চুড়ি কেন? কেন এই মেয়েটি প্রতিদিন একইভাবে ভিড়ের মধ্য দিয়ে চলাচল করে? তার লাল চুড়ি যেন কোনো নিদর্শন, কোনো বার্তা।

ঐশী ব্লগার হওয়ার কারণে এই ধরনের রহস্য তাকে আকৃষ্ট করে। সে মনে মনে নিজেকে বলতে থাকে, “এটা তো শুধু দেখা নয়, অনুভব করা দরকার।” ক্যাম্পাসের ছোট-বড় কোণগুলো, লন, গাছতলা, হোস্টেল গলি—সব জায়গায় এই মেয়ের ছায়া তাকে অনুসরণ করছে। প্রতিদিন সেই একই দৃশ্য—ছোট লাল চুড়ির জ্বলজ্বলানি, সরু কাঁধ, এবং নিঃশব্দ হেঁটে যাওয়া—ঐশীর মনে এক অদ্ভুত সংবেদন জাগায়। সে নিজেকে মানিয়ে নেয় না, কারণ এমন ঘটনা প্রতিদিন ঘটে। ব্লগার হিসেবে তার কাজই রহস্য উদঘাটন করা, গল্প তৈরি করা। তাই সে ঠিক করে, এই অচেনা মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে, কোনোভাবে তার পরিচয় জানার চেষ্টা করতে হবে।

কিন্তু প্রথমবার চেষ্টা করেই সে বুঝতে পারে, এটা সহজ হবে না। মেয়েটি কোনো খোলামেলা প্রতিক্রিয়া দেয় না। কখনও কখনও ঐশী তার দিকে চুপচাপ তাকিয়ে থাকে, মেয়েটির চোখে এক অদ্ভুত ভিন্ন দুনিয়ার ছাপ দেখতে পায়। কখনও মনে হয়, সে তার উপস্থিতি জানে না, আবার কখনও মনে হয়, সে যেন ঐশীর চোখের দিকে গভীরভাবে তাকাচ্ছে, এক গভীর বার্তা পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করছে। ঐশী বুঝতে পারে, এই মেয়েটি কোনো সাধারণ মানুষ নয়—তার রহস্য, তার লাল চুড়ি, তার চুপচাপ পদচারণা সবই কোনো গোপনকথা বহন করছে। এবং সেই মুহূর্তে ঐশী ঠিক করে, এই গল্প তার ব্লগের জন্য এক অবিস্মরণীয় অধ্যায় হবে। কৌতূহল আর উত্তেজনার সঙ্গে, সে জানে, এই অচেনা মেয়ের রহস্য উন্মোচনের যাত্রা এখন শুরু।

~

ঐশী তার ব্লগে অচেনা মেয়ের প্রথম নজরকাড়া উপস্থিতি নিয়ে একটি পোস্ট লিখে দেয়। ছবিগুলো যতটা সম্ভব সচেতনভাবে, ঝলমলে আলো বা পরিচিত স্থান ছাড়া তোলা হয়েছে, যেন রহস্য আরো গাঢ় হয়। পোস্টে সে লিখে, “কেউ কি কখনো এমন অচেনা ছায়া লক্ষ্য করেছেন আমাদের কলেজে? লাল চুড়ি পরে, নীরব, যেন সময়ের বাইরে থাকা কেউ।” সঙ্গে সঙ্গে পাঠকরা প্রতিক্রিয়া জানাতে শুরু করে। মন্তব্যের ধারাবাহিকতা অবাক করা—কেউ লিখে, “এটা কি কোনো ভূতের উপস্থিতি?” কেউ আবার বলে, “হয়তো প্রেমে প্রতারিত কোনো মেয়ের ছায়া।” কেউ আবার ভেবে বলে, “আমরা হয়তো তার দিকে খেয়ালই করি না।” প্রতিক্রিয়াগুলো এত বৈচিত্র্যময় যে ঐশী অবাক হয়ে যায়। সে বুঝতে পারে, রহস্যের গভীরতা কেবল তার নিজের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; সবাই যেন অচেনা মেয়ের উপস্থিতিকে অনুভব করছে, কিন্তু কেউই স্পষ্টভাবে তার সঙ্গে পরিচিত নয়।

প্রথমবার পোস্টের পরে, ঐশী আরও উৎসাহিত হয়। সে ঠিক করে, শুধু ব্লগের মাধ্যমে নয়, সরাসরি খোঁজখবর নেবে। কলেজের প্রশাসনিক অফিসে যেয়ে সে পুরনো রেকর্ডগুলো খুঁজতে শুরু করে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, বছরের হিসাব অনুযায়ী কোনো ছাত্রীর নাম তালিকায় নেই। কলেজের ভর্তি রেকর্ড, একাডেমিক রেজিস্ট্রেশন, ছাত্রছাত্রীদের উপস্থিতি তালিকা—সবকিছুতে একে খুঁজে পাওয়া যায় না। প্রশাসনিক কর্মীরা অবাক হয়ে তাকায়, “আপনি ঠিক বলেন, আমরা তাকে কোথাও পাইনি।” ঐশীর কৌতূহল আরও বাড়ে। সে ভাবতে থাকে, এমন কি কোনো বাস্তব মানুষ, যার অস্তিত্ব কেবল ছায়ার মতো, কেউ দেখলেও সঠিকভাবে তাকে চিনতে পারছে না।

ঐশী আরও জানতে চেষ্টা করে সহপাঠীদের কাছে। সে নানা জায়গায়, পরিচিত এবং অচেনা ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে। অধিকাংশই বলেন, “হ্যাঁ, আমরা তাকে ভীড়ের মধ্যে দেখেছি, কিন্তু কেউ সত্যিই তাকে চিনতে পারি না।” কেউ বলেন, “সে আমাদের কোনো ক্লাসে উপস্থিত হয় না,” কেউ আবার যোগ করেন, “সে যেন কখনও ক্লাসে আসে, কখনও নয়।” সহপাঠীদের তথ্য অসংলগ্ন, কিন্তু একই সময়ে একটি ধাঁধার মতো সংযোগ রয়েছে—সবাই নিশ্চিত যে মেয়েটিকে তারা লক্ষ্য করেছে, কিন্তু কেউ তার পরিচয় জানে না। এই অস্পষ্টতা ঐশীর মনে এক অদ্ভুত দ্বন্দ্ব তৈরি করে; সে জানে, রহস্য আছে, কিন্তু সেটা কোন বাস্তবতা বা কাল্পনিকতার অংশ, তা বোঝা মুশকিল।

রাতের সময় ব্লগার হিসেবে নিজের কাজের প্রতি দায়িত্ববোধ নিয়ে ঐশী পুনরায় বিশ্লেষণ শুরু করে। সে ছবিগুলো পর্যবেক্ষণ করে, প্রতিদিনের হাটবাজারের ছবি এবং ক্যাম্পাসের ভিডিও ফুটেজ মিলিয়ে দেখে। প্রতিটি ছবিতে অচেনা মেয়ের পদচারণা নিয়মিত—লাল চুড়ি, সরু কাঁধ, ধীরপদচারণা। এমনকি কিছু ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, মেয়েটি যেন ভীড়ের মধ্যেও এক অদৃশ্য দেয়াল পেরিয়ে চলেছে। এই দৃশ্যগুলো দেখেও ঐশী অবাক হয়। সে ব্লগে নতুন পোস্ট যোগ করে, পাঠকদেরকে জানায়, “আমি রেকর্ড খুঁজেছি, সহপাঠীদের সঙ্গে কথা বলেছি, কিন্তু কেউ তাকে চিনতে পারছে না। সে কি আসলেই আমাদের মাঝে আছে, নাকি অন্য কোনো জায়গার ছায়া?” এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে খুঁজতে ঐশী নিজেই একটি নতুন জিজ্ঞাসার মধ্যে প্রবেশ করে। রহস্য যেন শুধু কলেজের নয়, তার নিজের মধ্যে ঢুকে পড়েছে।

~

ঐশী সেই অচেনা মেয়েটিকে অনুসরণ করার সিদ্ধান্ত নেয়। প্রথম দিকে সে ভীড়ের মধ্যে হঠাৎ চোখ রেখে দেখার চেষ্টা করে, কিন্তু লক্ষ্য করে মেয়েটি যেন সবসময় অদৃশ্যতার মতো চলে যায়। একদিন সে সাহস নিয়ে লাইব্রেরির অন্ধকার করিডোরের দিকে ধীরে ধীরে এগোয়। প্রতিটি ধাপ যেন মনে হয় চুপচাপ প্রতিফলিত হচ্ছে। সেখানে একেবারে নীরবতা—শুধু তার নিজের শ্বাসরাশ আর ধীরে ধীরে পা রাখার শব্দ। কিন্তু হঠাৎ সে লক্ষ্য করে, দূরে কণ্ঠহীন ছায়া, লাল চুড়ি ঝকঝকে, সরু কাঁধ হালকা দুলছে। মেয়েটি যেন ধীরে ধীরে করিডোরের প্রান্তে এগোচ্ছে, আর ঐশীর চোখ যেন স্বপ্নের মতো দৃশ্যের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। সেই প্রথম মুহূর্তে, কৌতূহল এবং ভয় একসাথে তার মনে ঢুকে পড়ে।

পরদিন, ঐশী কলেজের বাগানের দিকে নজর রাখে। সকাল কিংবা বিকেল—যে কোনো সময়, মেয়েটি সেখানে আসে, সুনিপুণভাবে, যেন একটি অদৃশ্য রুটিন মেনে। ঐশী হেঁটে হেঁটে ছায়াটিকে অনুসরণ করে, চেষ্টা করে সে যেন হঠাৎ মেয়েটির সঙ্গে সরাসরি মিশে যায়। মেয়েটির পদচারণা খুবই ধীর, চুপচাপ, যেন নিজেকে খুঁজে বের করার মতো এক অভ্যাস। বাগানের গাছ, ফুল, এবং পথের ধুলোর সঙ্গে মেয়েটি একাকার হয়ে যায়। সে কখনও হেসে না, কথা বলে না, কেবল সামনে এগোয়, লাল চুড়ির জ্বলজ্বলানি দিয়ে পথকে আলোকিত করছে। ঐশীর কানে ধীরে ধীরে শোনা যায়—চুড়ির টুংটাং শব্দ। প্রথমে সে ভাবতে পারে, বাতাসের শব্দ, পাতা ঝরে পড়েছে—কিন্তু চারপাশ খালি। কোনো পা, কোনো মানুষ, কোনো অঙ্গন—কিছু নেই। শুধুই টুংটাং।

দিনের পর দিন, এই ঘটনাগুলো আরও বেশি রহস্যময় হয়ে ওঠে। ঐশী লক্ষ্য করে, মেয়েটি যেন কলেজের পুরনো নাট্যঘরের সামনে বারবার উপস্থিত হয়। কখনও দরজার কাছে, কখনও ভাঙা ধাপের ধারে। নাট্যঘর, যা অদূর অতীতে বন্ধ হয়ে গেছে, তার ধ্বংসাবশেষের মধ্যে লাল চুড়ি, সরু কাঁধ—সবকিছু যেন জীবন্ত। ঐশী কল্পনা করে, মেয়েটি কি কোনো স্মৃতির ছায়া? অথবা নাট্যঘরের অতীতের কোনো গল্পের অংশ? সে তার ব্লগে লিখে, “প্রতিদিন সে এখানে আসে, কিন্তু কেউ তাকে দেখে না। চারপাশ ফাঁকা, শুধু চুড়ির টুংটাং ধ্বনি শোনা যায়। কেউ বলতে পারবে না, এটা বাস্তব নাকি ভয়।” রাতের নিঃশব্দতা, পুরনো বিল্ডিংয়ের ছায়া, আর লাল চুড়ির ঝলমল—সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত ভীতিকর পরিবেশ তৈরি করে, যা ঐশীর মনে গভীর প্রভাব ফেলে।

একদিন সন্ধ্যার দিকে, ঐশী ঠিক করে মেয়েটির কাছাকাছি যাওয়ার জন্য এক সাহসী উদ্যোগ নেবে। সে নাট্যঘরের সামনে ছায়ার দিকে ধীরে ধীরে এগোয়। হঠাৎ, চুড়ির টুংটাং শব্দ স্পষ্টভাবে কানে বাজতে থাকে, যেন কোনো ছায়া ধ্বনি তৈরি করছে। ঐশীর হৃদয় দ্রুত বেজে ওঠে—ভয়, উত্তেজনা, কৌতূহল—সবই একসাথে। সে লক্ষ্য করে, মেয়েটির চোখে কোনো পরিচিত অভিব্যক্তি নেই, কিন্তু তার দৃষ্টিতে এক গভীর বার্তা আছে। ঠিক সেই মুহূর্তে ঐশী বুঝতে পারে, এই রহস্য কেবল তার চোখে সীমাবদ্ধ নয়; এটি পুরো কলেজের, এমনকি তার নিজের জীবনের মধ্যেও প্রবেশ করেছে। লাল চুড়ির ছায়া যেন ধীরে ধীরে তার মনকে ঘিরে রাখছে, আর ঐশী প্রস্তুত হয় এই অচেনা মেয়ের সত্যিকার রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য।

~

ঐশীর চোখে সেই অচেনা মেয়ের রহস্য আরও গভীরভাবে বেঁধে যায় যখন তার বন্ধু তানিশা একদিন হঠাৎ তাকে সতর্ক করে। তারা কলেজ ক্যাম্পাসের ক্যাফেটেরিয়ায় বসে কফি খাচ্ছিল, হালকা হাওয়া বইছিল, আর চারপাশে ছাত্রছাত্রীরা ব্যস্ত। তানিশা কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকে, তারপর হেসে হেসে বলেন, “ঐশী, শুনেছ কি? যাকে তুমি এত খুঁজছ, যার কোনো অতীত নেই—তার বর্তমান খুঁজতে যেও না। সব রহস্য যেন সবসময় ভালো জায়গায় থাকে না।” ঐশী প্রথমে হেসে ফেলে, মনে করে, বন্ধু হয়তো অযথা ভয় দেখাচ্ছে। কিন্তু তানিশার চোখের মধ্যে একটি গভীর সতর্কতা আছে, যা তাকে থামতে বাধ্য করে। তানিশা বলেন, “আমি শুধু বলছি, কখনও কখনও মানুষ, গল্প বা ছায়া—যে সম্পর্কে আমরা জানি না—তাদের সত্যিকার রহস্য আমাদের কেবল অস্থির করে দেয়।”

এরপর তানিশা ঐশীকে কলেজের এক পুরনো ঘটনার গুজব শোনায়। কয়েক বছর আগে, এক ছাত্রীর মৃত্যু হয়েছিল, প্রেমঘটিত কারণে। পুরো কলেজ তখন এক ভয়ঙ্কর উন্মাদনার মধ্যে ভেঙে পড়েছিল। কেউ বলেছিল, সে ছেলেটির প্রেমে হতাশ হয়ে নিখোঁজ হয়েছিল, আবার কেউ বলেছিল, রহস্যময় কিছু ঘটনার কারণে তার মৃত্যু হয়েছিল। তানিশা বলেন, “কলেজের অনেকেই বিশ্বাস করে, ওই ছাত্রী আজও কোথাও তার অস্তিত্বের ছায়া রেখে গেছে। কেউ তাকে দেখেছে, কেউ শুনেছে, কিন্তু সত্যিই কেউ তাকে চিনতে পায়নি।” ঐশী কানে শুনে কিছুক্ষণ স্থবির হয়ে যায়, কিন্তু তার কৌতূহল কমে না; বরং আরো গভীর হয়ে যায়। মনে হয়, এই অচেনা মেয়ের সঙ্গে পুরনো ঘটনার কোন না কোন সংযোগ রয়েছে।

ঐশী দিনের পর দিন তানিশার কথাগুলো স্মরণ করে। রাতের ব্লগিং সেশনে সে নিজেকে প্রশ্ন করতে থাকে—কেন কোনো মানুষ, যার অতীত নেই, কলেজের ভিড়ের মধ্যে এমন অদ্ভুতভাবে চলাচল করে? তানিশার সতর্কবার্তা যেন মধুর বিষের মতো তার মনে ঢুকে যায়—একদিকে কৌতূহল, অন্যদিকে ভয়। ঐশী তার ব্লগে লিখে, “যদি কোনো ছায়া আমাদের চারপাশে ঘুরে বেড়ায়, কিন্তু তার অতীত বা পরিচয় জানা না যায়, আমরা কি তা অনুসরণ করতে পারি? কৌতূহল কি ভয়কে হারাতে পারবে, নাকি আমরা নিজেই সেই রহস্যের অংশ হয়ে যাব?” এই প্রশ্নগুলো ব্লগার হিসেবে তাকে আরও শক্তি যোগায়। সে ঠিক করে, তানিশার সতর্কতা যতই গুরুতর হোক, সে থামবে না।

একদিন সন্ধ্যার পরে, ঐশী আবার কলেজের পুরনো নাট্যঘরের দিকে যায়। বাতাস ঠান্ডা, গাছপালা নিঃশব্দ, এবং ছায়ার মধ্যে লাল চুড়ি ঝলমল করছে। তানিশার কথাগুলো মনে আসে—“যার অতীত নেই, তার বর্তমান খুঁজে যেও না।” কিন্তু ঐশী মনে মনে ভাবে, “যদি সত্যিই রহস্যের মধ্যে কোনো গল্প থাকে, তা না জানলে আমি শান্ত থাকতে পারব না।” সে মেয়েটির ছায়ার দিকে ধীরে ধীরে এগোয়। সেই মুহূর্তে বুঝতে পারে, কৌতূহল আর ভয় একসাথে তার হৃদয়কে জড়িয়ে ফেলেছে। লাল চুড়ির ছায়া যেন আরও জীবন্ত হয়ে উঠছে, আর ঐশী প্রস্তুত তার সঙ্গে সরাসরি সংযোগের জন্য। বন্ধু যতই সতর্ক করুক, এই রহস্যের আড়ালে লুকানো সত্য তাকে আকৃষ্ট করে, এবং সে জানে, এই যাত্রা এখানেই শেষ হবে না—বরং এখন থেকে শুরু হবে তার সবচেয়ে গভীর অনুসন্ধান।

~

ঐশী দিনের পর দিন কলেজের অন্ধকার করিডোর, বাগান, এবং পুরনো নাট্যঘরের ধ্বংসাবশেষে লাল চুড়ির ছায়া অনুসরণ করতে করতে অবশেষে একটি পুরনো কেয়ারটেকারের খোঁজ পায়। সেই বৃদ্ধ কেয়ারটেকার—যিনি বহু বছর কলেজে কাজ করেছেন—হঠাৎই ঐশীর রহস্যময় অনুসন্ধানে প্রধান সূত্র হয়ে ওঠেন। তিনি চেয়ারটির পাশে বসে ধীরে ধীরে বলতে শুরু করেন, “যে মেয়েটিকে তুমি খুঁজছ, তার নাম ছিল সৌমি। কলেজের অনেকেই তাকে ভুলে গেছে, কেউ চেয়েছে তাকে মনে রাখুক না, কেউ চেয়েছে সব সত্য লুকিয়ে রাখুক।” ঐশীর চোখে কৌতূহল আরও বেড়ে যায়। কেয়ারটেকারের চোখে একটি মৃদু বিষাদ ভাসছে, যেন তিনি অনেক পুরনো বেদনা স্মরণ করছেন। সে জানে, সৌমির কাহিনি কোনো সাধারণ গল্প নয়—এটি প্রেম, প্রতিকূলতা এবং রহস্যের মিশ্রণ।

বৃদ্ধ কেয়ারটেকার অব্যাহত রাখেন, “সৌমি এক ছাত্রের সঙ্গে প্রেমে পড়েছিল। তার চোখে মিষ্টি স্বপ্ন, হৃদয়ে এক অব্যক্ত ভালোবাসা। কিন্তু সমাজ ও পরিবারের কঠোর নিয়ম এবং শিক্ষকের কঠোর দৃষ্টিভঙ্গি এই প্রেমকে অসমাপ্ত করে দেয়। সবাই তাকে ভীড়ের মধ্যে, সুনিপুণভাবে লুকিয়ে রাখে। কেউ তার সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চায় না, কেউ তার ভালোবাসার কাহিনি শুনতে চায় না।” ঐশী কানে শুনে চুপ থাকে, কিন্তু মনে মনে অনুভব করে সেই সময়ের অস্থিরতা এবং প্রেমের গভীরতা। সে ভাবতে থাকে, কীভাবে একজন যুবতী, যার হৃদয় স্বপ্নে ভরা, এমন অপ্রিয় বাস্তবতার মুখোমুখি হয়। সৌমির চোখে প্রেম, কষ্ট এবং স্বপ্নের মিশ্রণ, এবং তার লাল চুড়ি যেন সেই সব স্মৃতিকে প্রতিফলিত করছে।

কেয়ারটেকার আরও বিস্তারিত জানায়, “কলেজের এক অনুষ্ঠানের রাতে, হঠাৎ সৌমি নিখোঁজ হয়ে যায়। কেউ জানে না ঠিক কী হয়েছে। কেউ বলে, সে আত্মহত্যা করেছে। কেউ বলে, তাকে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু তার শরীর আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। সবাই ভয় পেয়েছিল, অনেকেই মিথ্যা গল্প তৈরি করেছিল। কলেজে তখন এক অদ্ভুত নীরবতা ছড়িয়ে পড়েছিল। কেউ সাহস করে সত্য জানতে চায়নি। সেই রাতের পর থেকে, কেউ সৌমির কথা মনে রাখে না, কেউ চোখের সামনে তার ছায়া দেখলেও সেগুলোকে বিশ্বাস করে না। কিন্তু লাল চুড়ি, ঐ ধীর পদচারণা, যেন আজও তাকে স্মরণ করায়।” ঐশীর মন কাঁপে। সে অনুভব করে, এই রহস্য শুধু অতীত নয়, বর্তমানের মধ্যে প্রবেশ করেছে।

ঐশী গভীরভাবে ভাবতে থাকে—কীভাবে এই প্রেম অসমাপ্ত থেকে যাওয়া সৌমি আজও কলেজের কোণায় ছায়ার মতো ঘুরছে? তার ব্লগে লিখে, “সৌমির প্রেম অসমাপ্ত। তার গল্প শেষ হয়নি। হয়তো তার ছায়া আমাদের মাঝে ঘুরছে, যেন আমরা তার হৃদয়ের কষ্ট অনুভব করি। লাল চুড়ি, নিঃশব্দ পদচারণা, কলেজের অন্ধকার করিডোর—সবই তার স্মৃতির নিদর্শন।” ঐশী সিদ্ধান্ত নেয়, তার ব্লগ কেবল রহস্য উদঘাটনের জন্য নয়, সৌমির অসমাপ্ত প্রেমের কাহিনি মানুষের সামনে আনার জন্য। সে প্রস্তুত হয় নতুন অধ্যায়ের জন্য—যেখানে সরাসরি সৌমির সঙ্গে সংযোগ ঘটবে, এবং সম্ভবত, অতীতের কষ্ট ও রহস্যের গোপন সত্য সামনে আসবে। লাল চুড়ির ছায়া আর রহস্যের গন্ধ তার কৌতূহলকে আরও তীব্র করে তুলেছে, আর ঐশী জানে, এই যাত্রা এখন শুধু অনুসন্ধান নয়, আবেগ এবং ইতিহাসের সঙ্গে মুখোমুখি হওয়ারও যাত্রা।

~

ঐশীর কৌতূহল আর উত্তেজনা তাকে কলেজের সবচেয়ে পুরনো, প্রায় ভোলা-অবহেলিত আর্কাইভ রুমের দিকে নিয়ে যায়। রুমটি তেমন পরিচ্ছন্ন নয়; ধুলো, পুরনো বই, ছেঁড়া কাগজ, এবং গোপন জিনিসপত্রের গন্ধ বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। রুমের সীমানা অন্ধকারাচ্ছন্ন, জানালার ছিদ্র দিয়ে অল্প আলো ঢুকছে। প্রতিটি ধাপ তাকে অতীতের এক অদৃশ্য যাত্রায় প্রবেশ করাচ্ছে। ঐশী জানে, এখানে কিছু এমনই থাকতে পারে যা সে এখন পর্যন্ত দেখেনি—সৌমির অপ্রকাশিত অনুভূতি, তার কষ্ট, তার আশা। ধীরে ধীরে সে ধুলোর স্তরে ডুবে থাকা ছেঁড়া ডায়েরিগুলো উঁচু করে খুঁজতে থাকে। প্রতিটি পাতা যেন তাকে অতীতে, সৌমির চোখে ভরা অন্ধকার ও স্বপ্নের জগতে নিয়ে যাচ্ছে।

ডায়েরিগুলো খুলে প্রথমে কেবল অদ্ভুত অক্ষর আর অর্ধেক লেখা বাক্যই দেখতে পায়। কিন্তু কিছু পাতা থাকে যেখানে লেখা স্পষ্ট—সৌমির হাতের লেখা, লাল চুড়ির প্রতি তার অনুভূতি এবং অসমাপ্ত প্রেমের বেদনা। ঐশী চোখে পড়ে একটি লাইন: “লাল চুড়ি আমার ভালোবাসার প্রতীক। ও যদি আমাকে গ্রহণ না করে, তবে এই চুড়িই হবে আমার শেষ স্মৃতি।” ঐশী থেমে যায়। সে অনুভব করে কষ্ট আর ভয় একসাথে তার হৃদয় দখল করেছে। একটি মানবিক অনুভূতি, প্রেমের গভীরতা এবং অব্যক্ত বেদনার মিশ্রণ যেন তাকে জড়িয়ে ধরেছে। মনে হয়, সৌমি এখনও তার চুড়ির মাধ্যমে কথা বলছে, আজও তার প্রেমের গভীরতা প্রকাশ করতে চায়।

ঐশী ডায়েরি পড়তে পড়তে ধীরে ধীরে বুঝতে পারে, প্রতিটি শব্দে একটি গল্প লুকানো। কেবল লাল চুড়ি নয়, তার অনুভূতির প্রতিটি অংশ—ভয়, আশা, আকাঙ্ক্ষা, অপ্রকাশিত প্রেম—সবই ডায়েরিতে ফুটে উঠেছে। সে ভাবতে থাকে, কীভাবে সমাজ, পরিবার এবং প্রেমের অসমাপ্ততা সৌমিকে এত গভীর সংকটে ফেলে। প্রতিটি লাইন তাকে কষ্ট দেয়, কিন্তু একই সাথে রহস্য উদঘাটনের জন্য আরও উৎসাহ যোগায়। তার মনে ভয়, কৌতূহল এবং সহানুভূতি একসাথে প্রবাহিত হয়। ঐশী বুঝতে পারে, সে শুধু রহস্য উদঘাটন করছে না—সে ইতিহাসের একটি হারানো অনুভূতির সঙ্গে সরাসরি সংযোগ স্থাপন করছে।

ডায়েরি শেষ হওয়ার পর, ঐশী দীর্ঘক্ষণ নীরব থাকে। তার চোখে অশ্রু, হৃদয়ে এক অদ্ভুত অস্থিরতা। লাল চুড়ি কেবল একটি অলঙ্কার নয়—এটি সৌমির অসমাপ্ত প্রেম, তার আশা, এবং তার যন্ত্রণা প্রতিফলিত করছে। ঐশী মনে মনে ঠিক করে, এই রহস্য শুধু তার ব্লগের জন্য নয়, সৌমির গল্প মানুষের সামনে আনার জন্য। সে সিদ্ধান্ত নেয়, আরও গভীরে খুঁজে বের করবে—যেখানে অতীত এবং বর্তমান মিলিত হয়, এবং সম্ভবত সে সৌমির ছায়ার সঙ্গে সরাসরি মুখোমুখি হবে। আর্কাইভ রুমের সেই নীরবতা, ধুলোয় ঢাকা ডায়েরি, এবং লাল চুড়ির প্রতীক ঐশীর হৃদয়ে চিরদিনের জন্য একটি ছাপ রেখে যায়। এই যাত্রা এখন শুধুই রহস্যের নয়; এটি মানবিক আবেগ, প্রেম এবং হারিয়ে যাওয়া গল্পের সঙ্গে মুখোমুখি হওয়ার যাত্রা।

~

এক সন্ধ্যায়, যখন সোনালি সূর্যাস্তের আলো নাট্যঘরের ভাঙা জানালার কাচ দিয়ে ভেতরে ঢুকছে, ঐশী ধীরে ধীরে ধুলোময় করিডোর অতিক্রম করে ভেতরে প্রবেশ করে। বাতাসে পুরনো বইয়ের গন্ধ, মরিচা ধরা লোহার ফ্রেম আর ভাঙা মঞ্চের কাঠের গন্ধ মিশে আছে। সে জানে, আজ তার কৌতূহল চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছাবে। ডায়েরি পড়ে, আর্কাইভ রুমে অতীতের সব তথ্য বিশ্লেষণ করে, সে সেই মুহূর্তটির জন্য প্রস্তুত। হঠাৎ, মঞ্চের ধ্বংসাবশেষের পাশে সে লক্ষ্য করে লাল চুড়ি—সরাসরি তার চোখে চোখ মিলিয়ে তাকিয়ে আছে সৌমি। ঐশীর হৃদয় দ্রুত ধড়ফড় করতে শুরু করে। কল্পনা করতে পারে না, এতদিন ধরে যে রহস্যময় ছায়া অনুসরণ করছিল, সে আজ তার চোখের সামনে জীবন্ত।

সৌমি ধীরে ধীরে হাত উঁচিয়ে মৃদু হাসি দেয়। সেই হাসি কেবল তার মুখের আলো নয়; এটি যেন অতীতের সমস্ত বেদনা, অসমাপ্ত প্রেম, এবং অপ্রকাশিত অনুভূতি একসাথে প্রকাশ করছে। ঐশীর গায়ে কাঁটা যায়। মুহূর্তের মধ্যেই সে বুঝতে পারে, এটি কেবল একজন মানুষের উপস্থিতি নয়; এটি অতীতের আর্তনাদ, প্রেমের ছায়া, এবং রহস্যের এক অদ্ভুত সংমিশ্রণ। সৌমি কোনো শব্দ বলে না, কিন্তু তার চোখ, তার দৃষ্টিভঙ্গি, এবং হাতের ছোট ছোট অঙ্গভঙ্গি—সবই যেন একটি গল্প বলছে। ঐশী অনুভব করে, তার সমস্ত অনুসন্ধান, তার কৌতূহল এবং ভয়, সবই এক মুহূর্তে তার সামনে প্রকাশিত হচ্ছে।

মেয়েটির কণ্ঠে কোনো শব্দ নেই, কিন্তু চুড়ির ভাঙা আওয়াজ স্পষ্টভাবে শোনা যায়। সেই আওয়াজ যেন একটি নিঃশব্দ বার্তা বহন করছে। ঐশী লক্ষ্য করে, চুড়ির টুংটাং ধ্বনি, মৃদু ভাঙা শব্দ—সবই তার কানে অতীতের গল্পটি জাগিয়ে তোলে। সে ধীরে ধীরে বুঝতে পারে, সৌমি কিছু বলতে চাচ্ছে, কিন্তু শব্দে নয়, প্রতীক, ভঙ্গি, এবং চুড়ির আওয়াজে তার ভাব প্রকাশ করছে। ঐশী নিজেকে ধীরে ধীরে সাহসী করে তোলে। সে জানে, এখন তার কাজ শুধু খুঁজে বের করার নয়, বরং বোঝার—সৌমির নিঃশব্দ বার্তা, তার প্রেমের কাহিনি, তার অমোঘ বেদনা বোঝার।

ঐশীর হৃদয় অস্থির, চোখে অশ্রু, এবং হাতের স্পর্শ না থাকলেও সে সৌমির উপস্থিতিকে স্পষ্টভাবে অনুভব করে। মঞ্চের ধ্বংসাবশেষ, ভাঙা জানালা, সূর্যের শেষ আলো—সব মিলিয়ে এক ভিন্ন জগৎ তৈরি করছে। ঐশী ধীরে ধীরে নিজেকে বলছে, “এটি শুধু অনুসন্ধান নয়, এটি মানুষের অনুভূতি, হারানো প্রেম এবং অসমাপ্ত গল্পের সঙ্গে সংযোগ।” সে খুঁজে পায়, সৌমি তার সামনে বাস্তব, কিন্তু একই সময়ে অতীতের এক ছায়া। চুড়ির ভাঙা আওয়াজ, চোখের গভীরতা, এবং নিঃশব্দ হাসি—সবই ঐশীর মনে এক অদ্ভুত দমবন্ধ করা অনুভূতি তৈরি করে। সে জানে, এই মুহূর্ত তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত, যেখানে রহস্য, অতীত এবং বর্তমান একসাথে মিলিত হয়েছে।

~

ঐশী ধীরে ধীরে বুঝতে শুরু করে, যে অচেনা মেয়ের ছায়া, লাল চুড়ি, নিঃশব্দ পদচারণা—সবই এক অদ্ভুত আবেগের প্রকাশ। কয়েকদিন ধরে নাট্যঘর, আর্কাইভ রুম, পুরনো ডায়েরি, এবং কেয়ারটেকারের বর্ণনা মিলিয়ে সে উপলব্ধি করে, সৌমির আত্মা শান্তি খুঁজছে। তার অসমাপ্ত প্রেমের গল্প, পরিবারের কঠোর দৃষ্টিভঙ্গি, এবং সমাজের কঠোর মানসিকতার কারণে যে কষ্ট তাকে ভেঙে দিয়েছে, তা এখনও ক্যাম্পাসের দেয়ালে, মঞ্চের ধ্বংসাবশেষে, এবং বাতাসের মধ্যে লুকিয়ে আছে। প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি চুড়ির আওয়াজ, এবং প্রতিটি ছায়ার দুল—সবই ঐশীর মনে এই গল্পের এক গভীর বাস্তবতার অনুভূতি জাগায়। সে বুঝতে পারে, সৌমি তার প্রেম, কষ্ট, এবং আবেগের শেষ নিঃশ্বাস প্রকাশ করার জন্য এই ধূসর জগতে উপস্থিত।

ঐশী তার ব্লগে এক বিস্তৃত পোস্ট লিখতে শুরু করে। সে প্রতিটি তথ্য সংক্ষেপে, কিন্তু আবেগের সঙ্গে পাঠকদের সামনে তুলে ধরে। লেখায় সে লিখে, “লাল চুড়ি মানে শুধু শৃঙ্গার নয়, কখনো কখনো ভাঙা প্রেমের শেষ প্রতীক। এটি সেই অপ্রকাশিত প্রেম, হারানো স্বপ্ন, এবং অসমাপ্ত অনুভূতির চিহ্ন, যা সময়ের স্রোতে হারিয়ে যায়নি। সৌমি আমাদের চোখের সামনে এসেছে, যেন আমরা তার গল্প অনুভব করতে পারি।” ব্লগ পোস্টে সে শুধুমাত্র রহস্য উদঘাটন করেনি; বরং সৌমির আবেগ, কষ্ট, এবং অসমাপ্ত প্রেমের ইতিহাসকে জীবন্ত করে তুলেছে। পোস্ট প্রকাশের পর মুহূর্তের মধ্যে পাঠকরা প্রতিক্রিয়া জানায়—কেউ মন্তব্য করে, “আমি প্রথমবার বুঝতে পারলাম, লাল চুড়ি মানে শুধু সাজ নয়, এটি অনুভূতির চিহ্ন।” কেউ লিখে, “এই গল্প পড়ে আমি কাঁদলাম, প্রেম ও বেদনার এক অনন্য মিশ্রণ।”

ব্লগ পোস্টের প্রতিক্রিয়ায় ঐশী খুশি হলেও, তার মনে কেবল উল্লাস নয়, বরং গভীর এক নীরবতা। নাট্যঘরের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে, আর্কাইভ রুমের ধুলোময় কোণে, এবং পুরনো ডায়েরির পাতায় এখনও সেই চুড়ির টুংটাং আওয়াজ বাজতে থাকে। ঐশী অনুভব করে, অতীত এখনও পুরোপুরি চলে যায়নি। সৌমির আত্মা, তার প্রেমের অমোঘ বেদনা, এবং অসমাপ্ত কাহিনী যেন ক্যাম্পাসের বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। প্রতিটি ধূসর কোণ, ভাঙা জানালা, ছায়া—সবই ঐশীর মনে বারবার সেই নিঃশব্দ বার্তা পৌঁছে দেয়। ঐশী বুঝতে পারে, সত্য উদ্ভাসিত হয়েছে, কিন্তু অতীত কখনও পুরোপুরি নিঃশব্দ হয় না।

শেষে, ঐশী দাঁড়িয়ে থাকে নাট্যঘরের ধ্বংসাবশেষের পাশে। বাতাসে ধুলো ও সূর্যাস্তের আলোর সঙ্গে মিশে আছে লাল চুড়ির নিঃশব্দ আওয়াজ। তার হৃদয় কেবল ব্লগের সাফল্যের জন্য দোলে না, বরং সৌমির গল্পের সঙ্গে তার সংযোগের জন্যও। সে জানে, এই যাত্রা শুধু রহস্য উদঘাটন নয়; এটি মানুষের অনুভূতি, অসমাপ্ত প্রেম, এবং অতীতের নীরব বেদনার সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের যাত্রা। ঐশীর চোখে নতুন এক দৃঢ়তা জন্মায়—যে কেউ হারানো গল্পের কথা জানতে চায়, তার জন্য সাহসী হয়ে মুখোমুখি হওয়া যায়। সেই সন্ধ্যার বাতাস, লাল চুড়ির ছায়া, এবং নিঃশব্দ টুংটাং—সবই ঐশীর মনে চিরদিনের জন্য একটি ছাপ রেখে যায়।

***

1000065480.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *