ঊর্মি ভট্টাচার্য
কলেজের ক্যান্টিনটা ছিল একটা ছোট আকারের গম্বুজ ঘর, দেয়ালগুলোয় বহুদিনের ধুলো জমে মাটি রঙ ধারণ করেছিল, আর মাঝখানে কয়েকটা কাঠের বেঞ্চ টেবিল—যেখানে সারাদিন ধরে শব্দের তরঙ্গ আর চায়ের ধোঁয়া মিশে থাকত এক অপূর্ব গন্ধে। দুপুর তখন থমকে থাকা সময়ের মতো, ক্লাস শেষ হয়ে গিয়েছে, ছেলেমেয়েরা যে যার মতো ব্যস্ত। কিন্তু এক কোণে, জানলার ধারে বসেছিল মেয়েটি—সায়নী। গা ছোঁয়া সাদা-ধূসর সালোয়ার, চোখে পাতলা ফ্রেমের চশমা, আর কোলের উপর একটা নীল রঙের ডায়েরি রাখা। তার সামনে রাখা একটা লাল চায়ের কাপ থেকে ধোঁয়া উঠছে, আর সেই ধোঁয়ার ফাঁক দিয়ে সে বাইরে তাকিয়ে—কলেজের পুরনো গাছগুলোর দিকে, যাদের পাতায় তখনো বৃষ্টির জল জমে ছিল। হঠাৎ করেই সেই নিরবতার মধ্যে প্রবেশ করল ঈশান, বাঁ হাতে ঝোলা ব্যাগ, মুখে চিরচেনা হাসি, আর চোখে সেই দুষ্টু-মিশুক ঝিলিক, যেটা সে সবসময় সঙ্গে রাখে। সায়নীর দিকে সরাসরি না তাকিয়ে, সে একটু আড়চোখে দেখল মেয়েটিকে—একা বসে থাকা, হাতে ডায়েরি আর সেই লাল চায়ের কাপ… ঈশানের মনে হল, এই দৃশ্যটা যেন আগেও দেখেছে—হয়তো কোনো কবিতার পাতায়, নয়তো কোনো পুরনো সিনেমার এক টুকরো মুহূর্তে।
“হরিপদদা, একটা লাল চা দিন তো—আদা কম রাখবেন,” ঈশান বলল, ক্যান্টিনের কাউন্টারে দাঁড়িয়ে। হরিপদদা হাসল, “কম আদা ঈশানবাবু? প্রেমে পড়েছেন নাকি?” — কথাটা শুনে ঈশান হেসে উঠল, “আরে না দাদা, প্রেম তো চা-ই এখন।” হরিপদদা এক কাপ ধোঁয়াওঠা লাল চা এগিয়ে দিল, ঈশান তাকাল চারপাশে, তারপর একরকম সাহস জোগাড় করে গিয়ে বসে পড়ল সায়নীর টেবিলে। “সরি, বসতে পারি? এখানে সব বেঞ্চেই তো দখলদারি চলছে,” বলেই সে কাপটা নামাল টেবিলের ওপর। সায়নী একবার তাকাল, ধীরে মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ, বসুন।” প্রথম কয়েক সেকেন্ড ছিল নীরবতা, শুধুই চায়ের ধোঁয়া আর ডায়েরির পাতার নড়াচড়া। হঠাৎ সায়নী বলল, “আপনার চায়ের কাপটা তো আমারটার মতোই দেখতে।” ঈশান চমকে তাকাল, তারপর হেসে বলল, “হয়তো কাকতালীয় নয়, হয়তো হরিপদদার ষড়যন্ত্র।” দুজনেই হেসে উঠল একটু, সেই হাসির ভিতর দিয়ে যেন একটা বরফের প্রাচীর গলে গেল। এরপর কথাগুলো এল টুকরো টুকরো করে, কী নিয়ে পড়ছে তারা, কে কোন বাড়িতে থাকে, কে কী লিখে বা পড়ে। ঈশান বলল সে মাঝে মাঝে কবিতা লেখে, কিন্তু কাউকে পড়ে শোনায় না, আর সায়নী হাসল শুনে—কারণ সে-ও ঠিক একইরকম, লিখলেও কাউকে বলে না। তাদের চা একটু ঠান্ডা হয়ে গেছে, কিন্তু কথাগুলো গরম হচ্ছিল ধীরে ধীরে, একটা আলগা উত্তাপ ছড়িয়ে দিচ্ছিল টেবিলের উপর।
সময় যেন পাখির মতো উড়ে গেল। ক্লাসের ঘণ্টা বাজল না, কেউ ডাকল না, কিন্তু একটা দৃষ্টিবিনিময়েই বোঝা গেল—দুজনেই এই হঠাৎ পাওয়া মুহূর্তটুকু ধরে রাখতে চায়। চায়ের কাপের নিচে জমে থাকা লাল দাগটুকু যেন সাক্ষী হয়ে থাকল তাদের প্রথম সংলাপের। সেদিন চলে যাওয়ার আগে ঈশান বলল, “আচ্ছা, আপনি ক্যান্টিনে রোজ আসেন?” সায়নী একটু হেসে বলল, “প্রায়ই… শুধু চায়ের জন্য।” ঈশান মাথা নাড়ল, “তাহলে দেখা হবে আবার, চায়ের খাতিরে।” তারা একসঙ্গে বেরোল না, কিন্তু জানলার বাইরে থেকে দেখা গেল দুটো আলাদা পথ—একই গন্তব্যে চলে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। হরিপদদা এক পাশে দাঁড়িয়ে কাপ ধুতে ধুতে মুচকি হেসে বলল, “আরেক জোড়া চায়ের কাপ জুটে গেল মনে হচ্ছে।” ক্যান্টিনের চারপাশে যেন তখনও লাল চায়ের ধোঁয়া ভাসছে—যেটা কোনো বিশেষ সময়ের সাক্ষী নয়, বরং এক সম্পর্কের শুরু।
***
পরদিন দুপুরে কলেজের আকাশ ছিল অদ্ভুতরকম ধূসর—মেঘগুলো যেন পকেট থেকে ফুরিয়ে যাওয়া গল্পের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল সারা ক্যাম্পাসে। ক্লাসগুলো চলছিল ঠিকই, কিন্তু সায়নীর মন কিছুতেই স্থির হচ্ছিল না। কালকের সেই এক কাপ লাল চায়ের পাশে বসে থাকা মুহূর্তটা, ঈশানের হঠাৎ আসা আর চলে যাওয়ার আগে তার বলা কথাগুলো—সব মিলে একরকম চুপচাপ কম্পন শুরু হয়েছিল বুকের ভেতরে। লেকচার চলাকালীন সে বারবার জানালার বাইরে তাকাচ্ছিল, যেন কারও প্রতীক্ষায়। অবশেষে ক্লাস শেষ হলে সে ঠিক করল, আজও যাবে ক্যান্টিনে, ঠিক সেই পুরনো বেঞ্চটায় বসে থাকবে। পৌঁছে দেখে টেবিলটা খালি, এক ধরনের ফাঁকা আনন্দে বুকটা নেচে উঠল। চুপচাপ বসে পড়ল, ডায়েরি বের করল, কলম খুলল—কিন্তু আজ লেখা এল না। ঠিক তখনই ঈশানের কণ্ঠস্বর, “আজ বেশি আদা নয়, হরিপদদা!” তারপরে হালকা পদশব্দে সায়নীর টেবিলের সামনের চেয়ারটা টেনে বসে পড়ল ঈশান, হাতে সেই একই ধরনের কাপ। সায়নী তাকাল না, মুখ নিচু করে রইল। ঈশান হালকা হেসে বলল, “আপনি তো বলেছিলেন, শুধু চায়ের জন্য আসেন। আমি ভাবলাম, আমিও তাই করব—চায়ের খাতিরে।” এবার সায়নী তাকাল তার দিকে, চোখে ছিল লুকোনো হাসির রেখা। ঈশান বুঝতে পারল, এই নীরবতা ভাঙতে সময় লাগবে না।
চায়ের ধোঁয়ার ফাঁকে তাদের কথাগুলো যেন অদ্ভুতভাবে সহজ হয়ে উঠছিল। প্রথমে তৃতীয় বর্ষের সিলেবাস নিয়ে, তারপর প্রিয় লেখক, গান, সিনেমা—বিষয়টা যেন এমনভাবে ছড়িয়ে পড়ল, যেন তারা আগে থেকেই একে অপরের মনের দরজায় চিঠি পাঠিয়ে রেখেছিল। সায়নী জানাল, সে রবীন্দ্রসংগীত ভালোবাসে, বিশেষ করে “আমার হৃদয় পিণ্ডরে”। ঈশান তখন নিজের মোবাইলটা এগিয়ে দিয়ে বলল, “এই গানটা আমি সারা রাতে শুনি যখন ঘুম আসে না”—সেটা ছিল “আয় খুকু আয়।” সায়নী একটু হেসে বলল, “এইটা তো আমার বাবার প্রিয় গান।” দুজনের কথার মাঝে এক ধরনের পুরনো অনুভূতি জেগে উঠছিল—যেটা নতুন হলেও অভ্যস্ত লাগে। সায়নী জানাল, তার মা নেই, ছোট থেকেই সে দাদার সঙ্গেই বড় হয়েছে। ঈশান থমকে গেল কিছুক্ষণ, তারপর আস্তে করে বলল, “আমিও একা বড় হয়েছি… মা চাকরির জন্য বাইরে থাকতেন সবসময়। একা দুপুরে চা খাওয়া অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল।” কথাগুলো এমনভাবে মিলে গেল, যেন কোনো ছায়া গল্প দুইজনের জীবন ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। হরিপদদা এবার তাদের টেবিলে এসে বলল, “আজ দেরি করে খেয়ো না, কিন্তু কথা যেন থামছেই না!” দুজনেই হেসে ফেলল, ঈশান বলল, “চা যদি এমন হয়, কথা চলবেই দাদা!” হরিপদদা চায়ের কেটলি উঁচিয়ে বলল, “চা নয় বাবা, এটা প্রেমের শুরু।”
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গিয়েছিল অজান্তেই। সায়নী ডায়েরির এক কোণে আজ কয়েকটা লাইন লিখল—“ধোঁয়ার ওপারে একটা হাসি, চায়ের গন্ধে কথা, আজও যদি ফিরে আসে, আমি তাকে চিনে নেব।” ঈশান তখন তার পাশের বেঞ্চে ঝুঁকে সায়নীর লেখা দেখছিল, কিন্তু কিছু বলেনি। সে শুধু বলল, “তুমি কি কখনও তোমার লেখা কাউকে পড়ে শোনাও?” সায়নী মাথা নাড়ল, “না, কারণ আমি জানি, মানুষ শুনে চুপ করে যায়। কেউ কিছু বলে না। তাই আমার শব্দগুলো একা থাকে।” ঈশান কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল, তারপর আস্তে করে বলল, “তাহলে একদিন আমায় পড়াও, আমি শব্দ শুনতে জানি।” একটা নীরবতা আবার ঘিরে ধরল টেবিল, কিন্তু এবার সেটা অস্বস্তিকর নয়—বরং একধরনের গভীর সংযোগের। তারা উঠে দাঁড়াল একসঙ্গে, এবার একটু কাছাকাছি হাঁটল। বিদায়বেলায় ঈশান বলল, “কাল আবার আসবো—তুমি থাকো, ক্যান্টিন আর চা তো থাকবেই।” সায়নী কোনো উত্তর দিল না, শুধু হালকা হেসে মাথা নেড়ে চলে গেল। ঈশান দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ, তারপর আবার হরিপদদার দিকে তাকিয়ে বলল, “দাদা, এই বেঞ্চটা এখন আমাদের হয়ে গেল, বুঝলেন?” হরিপদদা বলল, “তোমাদের নয় বাবা, চায়ের। সব প্রেম শুরু হয় এক কাপ চায়ের খাতিরে, আর শেষ হয় চুপ করে তাকিয়ে থাকায়।”
***
সকালটা অদ্ভুতভাবে শুরু হয়েছিল। সায়নী ঘুম ভাঙার পর প্রথমেই জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখল আকাশ আজ খানিক বেশি নীল, গাছে গাছে হাওয়া দুলছে ছন্দে, যেন জানে—আজ কিছু হবে। কলেজে যাওয়ার প্রস্তুতির সময়ও তার চোখ বারবার ঘড়ির কাঁটার দিকে চলে যাচ্ছিল। সে নিজেই খেয়াল করল, আজকে তার হাঁটার গতি একটু বেশি, মুখে একটু আলগা হাসি। ক্লাসের গেট পার হতেই চোখ ছুটে গেল ক্যান্টিনের দিকে—ঈশান এসেছে কি না। কিন্তু আজ ক্যান্টিনটা কিছুটা ফাঁকা, হরিপদদা টেবিল মোছার সময় বলল, “আজ তোমার সঙ্গী এখনও আসেনি।” সায়নী হেসে বলল, “তাহলে আমি আগেই আজকের চায়ের অর্ডার দিয়ে দিই।” ডায়েরির পাতায় সে লিখল: “আজ আমি আগে এসেছি, আজ আমি অপেক্ষা করছি।” ঠিক তখনই পেছন থেকে ঈশানের কণ্ঠস্বর: “অবশেষে আমি দেরি করলাম, ইতিহাস হয়ে গেল।” সে হেসে বসে পড়ে পাশের চেয়ারে, হাতে তার সেই চেনা লাল কাপ। আজ ঈশান একটু আলাদা লাগছিল—চুল এলোমেলো, চোখে খানিক ক্লান্তি, কিন্তু মুখে সেই চেনা আলোর রেখা। সায়নী তাকে জিজ্ঞেস করল, “ঘুম ঠিকমতো হয়নি?” ঈশান কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, “না, কাল রাতে একটা কবিতা লিখতে গিয়ে… আসলে একবার শুরু করলে থামতে ইচ্ছে করে না।” সায়নীর কৌতূহল বাড়ল, “তুমি লেখো?” ঈশান সায় দিল, “হ্যাঁ, খুব গোপনে। কেউ পড়ে না, শুধু নিজে পড়ি আর… রাখি। যেমন তোমার ডায়েরি।”
ঈশানের কথায় সায়নী একটু চমকে গেল। “তুমি কবে দেখলে আমার ডায়েরি?” ঈশান মৃদু হেসে বলল, “তোমার লেখা তুমি যতই লুকাও, পাতাগুলোর ভাঁজে শব্দের গন্ধ লুকিয়ে থাকে না। কাল তুমি যখন চলে গেলে, টেবিলে ভুল করে একটা পৃষ্ঠা খোলা ছিল। আমি পড়িনি পুরোটাই… শুধু কয়েকটা শব্দ চোখে পড়েছিল—‘ধোঁয়ার ওপারে একটা হাসি’। তারপর আর সাহস হয়নি পাতা উল্টাতে।” সায়নীর মুখ লাল হয়ে উঠল, সে ডায়েরিটা কোলের কাছে টেনে বলল, “তোমার পড়ার কথা না…” কিন্তু ঈশানের চোখে ছিল একরকম নিঃশব্দ অনুরোধ, সে বলল, “আমি দুঃখিত, কিন্তু বিশ্বাস করো, আমি সেটা অনুভব করতে পেরেছি… হয়তো এই জন্যই আজ আমারও একটা কবিতা তোমার জন্য।” সে পকেট থেকে ভাঁজ করা একটা কাগজ বের করল, সাবধানে এগিয়ে দিল সায়নীর দিকে। সায়নী কাগজটা নিল, পড়তে শুরু করল—
“একটা কাপ, ধোঁয়ার কুয়াশা,
একটা বেঞ্চে শব্দের বাসা।
চুপ করে বসে থাকা দুটি চোখ,
যার পেছনে সারা দিন আলো ঝলকায়।”
চোখের কোণে জল আসার মতো হয়েছিল, কিন্তু সায়নী সেটা গোপন করল। সে কিছু না বলে শুধু বলল, “তুমি ভালো লেখো।” ঈশান হেসে বলল, “তুমি কি পড়াবে তোমারটা?” সায়নী চুপ করে ছিল কিছুক্ষণ, তারপর ধীরে ডায়েরির একটা পাতায় আঙুল রাখল, “এইটা পড়ে শুনাতে পারি…”
সেদিন ক্যান্টিনের বেঞ্চে বসে দু’জন মানুষ ধীরে ধীরে একে অপরের মনের পাতায় পা ফেলতে শুরু করল। তাদের চারপাশে লোক ছিল, হুল্লোড় ছিল, কেউ খিচুড়ি খাচ্ছিল, কেউ চা-র বিস্কুট চুবিয়ে গল্প করছিল, কিন্তু সায়নী আর ঈশানের চারপাশে একটুকরো ঘিরে থাকা নীরব শান্তি ছিল, যেন কেউ দূর থেকে বাতাসে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে একরাশ মেঘের ছায়া। হরিপদদা বারবার চায়ের কেটলি নিয়ে টেবিলে এসে দাঁড়াচ্ছিল, কিন্তু কোনো কিছু না বলে আবার ফিরে যাচ্ছিল, যেন বুঝে গিয়েছিল—এরা এখন আর চায়ের জন্য নয়, শব্দের জন্য আসছে। সায়নী যখন নিজের লেখা পড়ে শোনাল—একটা কবিতা, যেখানে লেখা ছিল, “ভাঙা কাপে জমে থাকা চুমুকেই আমি খুঁজে নিই শুরুর ইচ্ছেটা,” তখন ঈশান চুপ করে ছিল, তারপর শুধুই বলেছিল, “তোমার শব্দগুলো তো আমার মনে জায়গা করে নিচ্ছে…” তাদের মধ্যে কিছু ঘোষণা হয়নি, কোনো প্রেমের প্রস্তাব বা শপথবাক্য উচ্চারিত হয়নি, কিন্তু সেই দুপুরে ক্যান্টিনের টেবিলে লেগে থাকা লাল চায়ের দাগ আর ডায়েরির ভাঁজে ভাঁজে গেঁথে যাওয়া শব্দগুলো ছিল নিঃশব্দ স্বীকৃতি—তারা নিজেদের হৃদয়ের দরজার চাবি খুঁজে পেয়েছে।
***
লাল চায়ের কাপ
অধ্যায় ৪: ক্লাস বাদ দিয়ে ক্যান্টিন
(Words: ~1200 | Paragraphs: 3 uninterrupted)
সকাল থেকেই বৃষ্টি পড়ছিল টিপটিপ করে, যেন শহরটা নিজের ক্লান্তি ধুয়ে মুছে নিচ্ছিল ধীরে ধীরে। ক্লাসরুমে ছিল কেমন একটা অস্থিরতা—চট করে পড়া শেষ করা, নোট মিলিয়ে নেওয়া, কিংবা টিফিনের ফাঁকে বৃষ্টির গান গুনগুনিয়ে গাওয়া। কিন্তু সায়নী সেদিন নিজের রুটিনটা বদলে ফেলেছিল। ক্লাসে ঢোকার বদলে সে সোজা হাঁটছিল ক্যান্টিনের দিকে, প্রতিটি পদক্ষেপে ভিজে যাচ্ছিল তার পায়ের চটি, জামার প্রান্ত, আর বুকের ভিতর জমে থাকা কিছু অনুভব। আজ কোনো ক্লাস, অ্যাসাইনমেন্ট বা প্রেজেন্টেশন তার কাছে জরুরি মনে হচ্ছিল না। দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে থাকা হরিপদদা তাকে দেখে বলল, “আজ তো পড়াশোনা সব মাফ হয়ে গেল বুঝি?” সায়নী হেসে বলল, “আজ শুধু একটা ক্লাস—চায়ের ক্লাস।” হরিপদদা হেসে কাপ হাতে এগিয়ে দিল, “তোমার ক্লাসমেট তো এসে গেছে, টেবিলে বসে তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।” জানলার পাশের সেই চেনা বেঞ্চে ঈশান আগে থেকেই বসে ছিল, হাতে তার স্কেচবুক, যেখানে সে মাঝে মাঝে অদ্ভুত সব রেখায় আবেগ এঁকে ফেলে। সায়নী ধীরে গিয়ে বসে পড়ল তার পাশে, কোনো কথা না বলেই, শুধু এক চুমুক লাল চা আর এক চিলতে হাসি দিয়ে। ঈশান বলল, “আজ ক্লাস বাদ দিলে?” সায়নী বলল, “হ্যাঁ… কিছুদিন ধরে মনে হচ্ছিল, এই সময়টুকুই আমার আসল ক্লাস—তোমার সঙ্গে, চায়ের পাশে।”
বৃষ্টির শব্দটা যেন ছাদ ভেদ করে দু’জনের কথোপকথনে ঢুকে পড়ছিল, প্রতিটি চুমুকে ধরা পড়ছিল না বলা কথাগুলো। ঈশান তার স্কেচবুকটা বাড়িয়ে দিল সায়নীর দিকে—ভেতরে আঁকা ছিল একটা টেবিল, দুটো চায়ের কাপ, আর পাশে দুটো মানুষের ছায়া—একটা মেয়ের চুল হালকা উড়ছে, আর একটা ছেলের চোখ নামানো, যেন কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেছে। সায়নী অবাক হয়ে তাকাল, তারপর বলল, “তুমি তো ভালো আঁকো… কখন করলে এগুলো?” ঈশান হেসে বলল, “সেদিন, যখন তুমি পড়ছিলে আর আমি শুনছিলাম। আমি শব্দ আঁকতে পারি না, তাই রেখায় রেখে দিই।” চায়ের কাপ ঠোঁটে নিয়ে সায়নী বলল, “তাহলে এবার আমিও কিছু রেখে যাব তোমার জন্য।” সে ডায়েরি খুলে একটা পাতায় নিজের লেখা ছোট্ট কবিতাটা ছিঁড়ে ঈশানের দিকে বাড়িয়ে দিল। কবিতায় লেখা ছিল—
“একটা জানলা, একটা চুপ থাকা মুখ
একটা ভেজা বেঞ্চে লেখা হয়ে যায় সুখ।
বৃষ্টি পড়ে, চোখে ভেসে,
আজকের দিনটা কারও যেন হয়ে রইল বেশি।”
ঈশান সেটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ দেখল, তারপর বুক পকেটে রাখল একরকম গোপনে। সেই মুহূর্তটা যেন কোনো ছবি হয়ে জমে গেল দুজনের চোখে—চায়ের ধোঁয়া, ভেজা জানলা, আর দুটো হৃদয়ের নিরব স্বীকারোক্তি। হরিপদদা তখন দূরে দাঁড়িয়ে তাদের দিকে না তাকিয়ে চায়ের কেটলি মুছছিল, কিন্তু তার মুখের কোণায় একটা চেনা মুচকি হাসি খেলে যাচ্ছিল।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধে নামছিল ক্যান্টিনে। ক্লাস শেষ হওয়া ছেলেমেয়েরা ক্যান্টিনে ঢুকছিল দল বেঁধে, হইচই বাড়ছিল, চায়ের অর্ডার পড়ছিল একের পর এক। কিন্তু সায়নী আর ঈশান নিজেদের ছোট্ট জগতে স্থির হয়ে ছিল, যেন বাইরের সব কোলাহল তাদের ছুঁয়েই না গেছে। আজ তারা গল্প করল ছোটবেলার কথা, কীভাবে ঈশান প্রথম স্কুলে গিয়ে কেঁদে ফেলেছিল, কীভাবে সায়নী তার প্রথম পুরস্কার পেয়েও বাড়িতে ফিরে মাকে খুঁজে না পেয়ে কাঁদতে বসেছিল। সেই সব না বলা, না শোনা কথাগুলো আজ ভাগ করে নেওয়ার সময় এসে গিয়েছিল। তাদের মাঝখানে চায়ের কাপ খালি হয়ে গেছে বহু আগেই, কিন্তু তবু তারা সেখানে বসে রইল, যেন কিছু একটা অদৃশ্য বন্ধনে বাঁধা পড়ে গেছে। সায়নী হঠাৎ বলল, “তুমি কি কখনও ভয় পাও?” ঈশান একটু চুপ করে থাকল, তারপর বলল, “হ্যাঁ, যখন ভাবি… তুমি যদি আর না আসো একদিন।” সায়নী তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ, তারপর বলল, “তাহলে আমি আজ একটা কথা লিখে যাব ডায়েরিতে—‘আগামীকালও আমি থাকব, এই বেঞ্চে, এই কাপের পাশে।’” বাইরে তখন বৃষ্টি থেমে এসেছে, কিন্তু বাতাসে এখনও ভেজা গন্ধ—যেটা চায়ের ধোঁয়ার সঙ্গে মিশে এক রকম চিরকালীন প্রতিশ্রুতি তৈরি করে যাচ্ছিল নীরবতায়।
***
ক্লাসের পর আজ ক্যান্টিনটা যেন একটু বেশিই জমজমাট। কলেজের দেয়ালে পোস্টার, ঘাসের ওপর ছেলেমেয়েদের হাসির রোল, আর ক্যান্টিনের কোণায় চেনা সেই টেবিল—যেখানে অরিত্র আর মালবিকা প্রায় প্রতিদিন বসে পড়ে। কিন্তু আজ টেবিলের ওপর রাখা দুটি লাল চায়ের কাপ ছিল নিঃশব্দ, যেন তাদের দুজনের মতোই। আগের দিন সন্ধ্যাবেলায় মালবিকার একটা পুরোনো ছবি দেখে অরিত্রর ভেতরে হঠাৎ একটা অজানা শূন্যতা ঘিরে ধরে। ছবিটায় মালবিকা তার স্কুলড্রেসে, আর পাশে দাঁড়িয়ে এক অচেনা ছেলেকে জড়িয়ে রেখেছে বন্ধুত্বপূর্ণ এক হাসিতে। সেটা হয়তো কিছুই না, হয়তো স্রেফ একটা বন্ধুত্বের মুহূর্ত, কিন্তু অরিত্রর বুকের ভেতর যেন একটা হালকা কাঁপুনি বয়ে যায়। কলেজ ক্যান্টিনের সেই ঘরোয়া পরিবেশে আজকের আলাপ যেন স্বাভাবিকভাবে শুরু হয়নি। মালবিকা মুখ তুলে তাকায় না, অরিত্রর চোখে চোখ রেখে কিছু বলে না, আর অরিত্রও আজ আর সেই চিরচেনা চা-বিকেলটার সহজতা খুঁজে পায় না। কিন্তু কথা না বলেও যেন হাজারটা কথা জমে আছে, ঠিক যেন লাল চায়ের ভাঁজে ভাঁজে জমে থাকা অনুভূতি।
কিছুক্ষণ পর মালবিকা নরম গলায় বলে, “তুই কিছু বলছিস না কেন আজ?” অরিত্রর চোখ স্থির ছিল তার কাপের রঙে—গাঢ় লাল, ঠিক যেন বুকের গভীরে জমে থাকা অচেনা অনুভূতির রং। সে হেসে বলে, “তোর একটা ছবি দেখলাম কাল। তোকে চিনতে অসুবিধে হয়নি, কিন্তু তোর পাশে যে ছেলেটা ছিল… সে কে?” মালবিকা একটু থেমে চা’য়ের কাপে ঠোঁট ছোঁয়ায়। তারপর বলে, “ও আমার স্কুল ফ্রেন্ড, রাহুল। অনেকদিন আগে দেখা হয়েছিল, মা-বাবা’র সঙ্গে আমাদের বাড়ি এসেছিল। তোর কি ওকে দেখে কিছু মনে হয়েছে?” প্রশ্নটা শেষ হওয়ার আগেই মালবিকার গলার স্বর একটু কমে আসে, যেন বুঝে গেছে অরিত্রর মধ্যে হালকা অভিমান গেঁথে গেছে। অরিত্র একটু অস্বস্তি নিয়ে বলে, “না… মানে, আমি জানি এটা কোনো ব্যাপার না, কিন্তু…” বাকিটুকু আর বলে উঠতে পারে না। ক্যান্টিনের ভেতরকার কোলাহল যেন আচমকা থেমে যায় দুজনের মাঝখানে। লাল চায়ের কাপে ফেনা উঠেছে, কিন্তু তাদের সম্পর্কের সেই স্বচ্ছ সরলতা যেন আজ একটু ধোঁয়াটে।
মালবিকা ধীরে ধীরে বলে, “তুই যদি চাইস, আমি ছবিটা ডিলিট করে দেব। কিন্তু তুই কী জানিস অরিত্র, এই ছবিগুলো আমার অতীত, যেগুলোকে ভুলে থাকি না, রাখি মনের কোণে। তুই সেই মানুষ যে আমার বর্তমান, আর হয়তো ভবিষ্যতও।” মালবিকার কণ্ঠে এক অন্যরকম দৃঢ়তা। অরিত্র ধীরে ধীরে তার দিকে তাকায়। দু’জনের চোখে তখনও কিছু অমীমাংসিত প্রশ্ন, কিছু না-বলা কথা, কিছু ভালোবাসার দোলাচল। তারা জানে, সম্পর্ক মানে শুধু একসাথে হাঁটা নয়, মাঝেমধ্যে থেমে গিয়ে একে অন্যকে বোঝা। আজকের দিনটা হয়তো অদ্ভুত, হয়তো কষ্টের, কিন্তু এইসব অনুভবের মধ্য দিয়েই তো সম্পর্ক গভীর হয়। লাল চায়ের কাপ দুটো আজ যেমন নিঃশব্দ, তেমনই সজীব—যেন নিরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এই না-বলা কথার, এই হালকা অভিমান আর অন্তরের টানাপোড়েনের। ভালোবাসা একদিনে তৈরি হয় না, তাকে সময় দিতে হয়, তাকে বুঝতে হয়—আর এই বুঝে ওঠার রাস্তায় আজ তারা আরেক পা বাড়াল।
***
শীতল ডিসেম্বরের এক দুপুর, কলেজ ক্যাম্পাস ছিল আজ অদ্ভুতভাবে নির্জন। পরীক্ষার মরসুম শেষ হয়েছে মাত্র, সবাই যেন কোথাও হারিয়ে গেছে — কেউ ফিরে গেছে নিজের শহরে, কেউ ব্যস্ত চাকরির প্রস্তুতিতে। কিন্তু অনির্বাণ ও মেহুলের কাছে এই ফাঁকা ক্যাম্পাস যেন ছিল একান্ত তাদের নিজস্ব, নির্জন হলেও একান্ত আপন। ক্যান্টিনের টিনের ছাউনি থেকে পড়ে থাকা দুপুরের আলো তাদের ছায়া টেনে নিয়ে যাচ্ছিল দূরে, আর কাপে কাপে জমা হচ্ছিল লাল চা। আজ তারা বসেছিল একেবারে কোণার টেবিলে, যেখানে অনির্বাণ প্রথমদিন দেখেছিল মেহুলকে। গল্প ছিল না আজ বেশি, বরং এক ধরনের বোবা ভাষা, চোখের ভাষা, নীরব হাওয়ার গন্ধে মিশে থাকা অনুভূতির ভাষা। মাঝে মাঝে মেহুল হেসে ফেলত — সেই পুরনো ভঙ্গিমায়, যেন শব্দহীন সুর বাজে। আর অনির্বাণ চুপচাপ তাকিয়ে থাকত, চোখে তার স্পষ্ট লেখা: “তুই আছিস, এটাই অনেক।”
চায়ের কাপ তাদের সামনে ধোঁয়া ছাড়ছিল, কিন্তু তাপ যেন ছিল অন্য কোথাও — তাদের মাঝে, নিঃশব্দে দোলা খাওয়া মায়ার টানে। এই ছয় মাসে কতকিছু বদলে গেছে! ক্যান্টিনের নতুন মেনু এসেছে, নতুন মুখ ভর্তি হয়েছে কলেজে, এমনকি লাল চায়ের কাপের ডিজাইনও বদলেছে। কিন্তু বদলায়নি একটাই — চায়ের গন্ধে জড়িয়ে থাকা তাদের সম্পর্কের নরম স্পর্শ। মাঝে মাঝে ক্যাম্পাসে ছোট ছোট ঝগড়া হতো তাদের, দোষে-গুণে গড়া খুনসুটি, কিন্তু দিনশেষে তারা ফিরত এই ক্যান্টিনেই, এই এককাপ লাল চায়ের কাছে, যেন সে-ই চুপচাপ বিচারক, এবং একইসাথে প্রেমের সাক্ষী। আজ মেহুল অনির্বাণকে জিজ্ঞেস করল, “তুই কোথায় থাকবি পাশ করার পর?” অনির্বাণ কেবল বলল, “যেখানেই যাই, এককাপ লাল চা খাওয়ার মতো সময় রেখে যাব। যদি তুই থাকিস পাশে, আরও ভালো হয়।” সে কথা বলার পর মেহুলের চোখে জল জমে উঠেছিল, কিন্তু সে হাসল। কারণ সে জানত, তাদের সম্পর্কের শিকড় খুব গভীরে গিয়েছে, যেমন যায় চা পাতার গন্ধ স্মৃতির পাতায়।
বাইরে থেকে হঠাৎ হাওয়ার ঝাপটা এলো, টিনের ছাউনিতে শব্দ তুলল, আর এক ঝলক ঠান্ডা হাওয়া তাদের কাঁধ ছুঁয়ে গেল। তারা চুপ করে রইল, দু’জনে কেবল কাপটা ধরেই বসে রইল, মুখোমুখি নয়, কিন্তু একে অপরের দিকে হেলে থাকা। সেই মুহূর্তে ক্যান্টিন ছিল এক কবিতার মতো — শব্দহীন, কিন্তু অর্থপূর্ণ। এক চুমুক লাল চা, এক হালকা হাসি, এক চোখের চাহনি, আর সেই পুরনো কাঠের বেঞ্চ — এই সব মিলেই যেন গড়ে উঠল এক পৃথিবী, যেখানে তারা ছিল একমাত্র বাসিন্দা। না, তারা তখনো ‘প্রেমিক-প্রেমিকা’ হয়ে ওঠেনি কথায় কথায়, কিন্তু মন যে কবেই না সেই ছাদের নিচে বাঁধা পড়ে গেছে, তা বোঝার জন্য বড়ো কিছু শব্দের প্রয়োজন ছিল না। এক কাপ লাল চা-ই যথেষ্ট ছিল।
***
তৃতীয় বর্ষের মধ্যভাগে পৌঁছেই যেন সময়ের গতি পাল্টে গেল। ক্যাম্পাসে নির্বাচনের হাওয়া, ক্লাসের চাপ, আর ব্যক্তিগত জীবনের টানাপোড়েন—সব মিলিয়ে সোম আর রুদ্রর সেই নৈঃশব্দ্যের ভালোবাসা হঠাৎ করেই কেমন যেন দুর্বোধ্য হয়ে উঠল। আগের মতো প্রতিদিন দেখা হওয়া তো দূরের কথা, এখন সপ্তাহে একবার কথা হলেই যেন সৌভাগ্য মনে হত। সোমের রুমমেট তৃষা তার জীবনে অশান্তির একটি নতুন অধ্যায় নিয়ে এলো—রোজ নতুন নতুন অভিযোগ, কান্না, মান-অভিমান। রুদ্র একদিন ক্যান্টিনে বসে বলেছিল, “তোমার সামনে বসে থেকেও এখন তোমায় খুঁজে পাই না সোম। কোথায় হারিয়ে যাচ্ছো তুমি?” সোমের চোখ নামিয়ে রাখা ছিল, ঠোঁটের কোনে এক চিলতে হাসি, কিন্তু সেই হাসির মধ্যে ছিল অব্যক্ত অস্থিরতা। লাল চায়ের কাপ তখনও দুইজনের মাঝখানে রাখা, কিন্তু আর আগের মতো বাষ্প উঠছিল না তার ভেতর থেকে। সময় যেন হিম হয়ে গিয়েছিল।
রুদ্রর মধ্যেও পরিবর্তন এসেছিল। আগে যে ছেলে নিজের সব কথা সোমকে বলত, সেই এখন অনেক সময় চুপ করে থাকে। কিছুদিন ধরে সে একটি নাটকের রিহার্সালে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল, আর সেই দলের এক সদস্য, নাম তার আভা—চঞ্চল, প্রাণবন্ত, সদা হাস্য। সোম প্রথম যেদিন আভাকে রুদ্রর পাশে দাঁড়িয়ে হাসতে দেখেছিল, তার বুকের ভেতর কেমন যেন ব্যথা হয়েছিল। যদিও রুদ্র একবারও তাকে অবিশ্বাস করার মতো কিছু করেনি, তবুও এই হালকা হিংসা, অকারণ সন্দেহ আর নিজের জায়গা হারানোর ভয়—এইসব মিলে সোম যেন অস্থির হয়ে উঠছিল। সে নিজেও জানত, সে একরকম নিজেকে গুটিয়ে ফেলছে, দূরে সরে যাচ্ছে, অথচ থামতেও পারছিল না। রুদ্রর চুপচাপ চোখ দুটো মাঝেমধ্যে তার দিকে তাকিয়ে থাকত, যেন প্রশ্ন করত—“তুমি কি আমাকে আর আগের মতো ভালোবাসো না?” অথচ উত্তর দিতে সাহস করত না সোম।
একদিন বিকেলে, ঝিরঝিরে বৃষ্টির মধ্যে, ক্যান্টিনের জানালার পাশে বসে ছিল রুদ্র একা। হাতে ছিল একটি বই আর পাশে রাখা লাল চায়ের কাপ। অনেকক্ষণ পর সোম এসে চুপচাপ পাশে বসেছিল। দু’জনের মধ্যে কোনো কথা হয়নি অনেকক্ষণ। তারপর হঠাৎ রুদ্র বলল, “তুমি কি সত্যিই চাইলে আমি তোমার জীবনে না থাকি?” সোম কিছু বলল না, শুধু কাপ থেকে এক চুমুক চা খেল। সেই এক চুমুক চা যেন সে একসঙ্গে শত শত স্মৃতি গিলে খেল—প্রথম দেখা, প্রথম চুম্বন, প্রথম অভিমান। অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর সে বলল, “আমার ভেতরটাও অনেক প্রশ্ন করে, রুদ্র। কিন্তু উত্তর খুঁজে পাই না। শুধু জানি, তোমায় হারাতে চাই না। অথচ নিজেকেও হারিয়ে ফেলছি প্রতিদিন।” রুদ্র তার হাত ধরল। সেই ছোঁয়ায় ছিল কাঁপুনি, মেঘলা আবেগ, আর ভেঙে পড়া ভালোবাসা। ক্যান্টিনের কোণায় রাখা লাল চায়ের কাপ দুটো আবার সাক্ষী হল—ভালোবাসার, ভাঙনের, এবং নিঃশব্দ পুনর্মিলনের।
***
বৃষ্টিভেজা এক বিকেলে কলেজ ক্যান্টিনটা যেন হয়ে উঠেছিল এক রঙিন পোস্টকার্ড—ছোট ছোট দল, গল্প, হাসি, ছাতা থেকে টপটপ করে পড়া জলের শব্দ, আর এককোণে বসে থাকা অরণ্য আর কৃতিকা। একটানা ছয় মাসের বন্ধুত্ব, হাজারটা চা, অসংখ্য গল্পের পর, সেই বিকেলটা যেন নতুন কিছু বলে দিতে চাইছিল। অরণ্যর হাতে ধরা ছিল সেই চেনা লাল চায়ের কাপ, কৃতিকার চোখে ছিল একরাশ উদ্বেগ, একরাশ না বলা কথা। হঠাৎ ক্যান্টিনের টেবিলে রাখা অরণ্যর ফোনটা কাঁপতে শুরু করল—মা’র ফোন। কথা বলতে বলতে অরণ্যর কণ্ঠে এক অদ্ভুত থেমে যাওয়ার গলা, “আজ একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি যেতে হবে, দাদুর শরীরটা খারাপ।” তারপর কোনো কথা না বলে উঠে দাঁড়িয়ে চলে গেল অরণ্য, আর তার রেখে যাওয়া কাপের নিচে, চায়ের কাগজে ছোট করে লেখা ছিল—”তোকে কিছু বলতে চাই…কাল দেখা করিস?”
পরদিন সকাল থেকে কৃতিকা অস্থির। ক্লাসে মন নেই, ক্যান্টিনে যেতে ইচ্ছে করছে না, অথচ বুকের ভেতর একরাশ ব্যাকুলতা। ‘কি বলতে চেয়েছিল অরণ্য?’—এই প্রশ্নটা তার মধ্যে অস্থিরতা বাড়িয়ে দিচ্ছিল। অবশেষে বিকেল চারটেয় সে গেল ক্যান্টিনে। বসে আছে সেই নির্দিষ্ট বেঞ্চে, যেখানে প্রতিদিন চা খেত ওরা। মিনিট কুড়ি পরে অরণ্য এলো, চোখেমুখে ক্লান্তি, চেহারায় একটা অচেনা নীরবতা। “দাদু এখন ভালো আছে,” বলল সে। তারপর একটু থেমে কৃতিকার দিকে তাকিয়ে বলল, “তোর সাথে একসাথে বসে লাল চা খেতে খেতে আমি বুঝেছি, জীবনটা অনেক সরল হয় যদি পাশে একজন এমন থাকে যে প্রশ্ন না করে বুঝে ফেলে, শুধু শুনে যায়, শুধু পাশে থাকে। তুই কি ভাবিস, আমাদের এই বন্ধুত্বটা আরেকটু বেশি হতে পারে?” কথাটা বলেই চুপ করে গেল অরণ্য। কৃতিকা কিছু বলল না। শুধু ধীরে ধীরে নিজের কাপটা বাড়িয়ে দিল অরণ্যর দিকে। তাদের আঙুল ছুঁয়ে গেল, আর সেই মুহূর্তে যেন গোটা ক্যান্টিন চুপ হয়ে গেল—শুধু দুটো কাপের ধোঁয়া একসাথে উঠে মিশে গেল বাতাসে।
সেই বিকেল ছিল তাদের বন্ধুত্বের সীমা আর ভালোবাসার শুরু। কোনো আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব, কোনো ‘আই লাভ ইউ’ নয়—শুধু একটা বোঝাপড়া, একটা লাল চায়ের কাপ, আর দুটো মানুষের নিরব সম্মতি। সেই দিন থেকে ওরা ক্যান্টিনে একই কাপ শেয়ার করত। কৃতিকা বলত—“এক কাপ চা, দুজনের গল্প।” আর অরণ্য হেসে বলত—“এই চায়ে তুই, আমি, আর আমাদের অজস্র মুহূর্ত। এর স্বাদ কেউ বুঝবে না।” ক্যান্টিনের চা-ওয়ালাও একসময় আর আলাদা করে চা দিত না ওদের—জানত, এই একটা কাপেই লুকিয়ে আছে একটা অদ্ভুত প্রেমকাহিনি। একটা এমন ভালোবাসা, যা শুরু হয়েছিল নিঃশব্দে, বেড়ে উঠেছিল প্রতিদিন এক কাপ লাল চায়ের ধোঁয়ায়, আর গেঁথে গিয়েছিল ক্যান্টিনের দেওয়ালে এক নস্টালজিক কবিতার মতো।
***
কলেজের শেষ বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হতে মাত্র আর তিন দিন বাকি। ক্যাম্পাসের বাতাসে তখন এক অদ্ভুত রকম চাপা উৎকণ্ঠা আর বিদায়ের গন্ধ। সারাদিন বইয়ের পাতায় ডুবে থাকা, পরীক্ষার প্রস্তুতি, গ্রুপ স্টাডি—সব মিলিয়ে যেন কারওর আর সময় নেই নিজেদের জন্য। অথচ ঠিক এই ব্যস্ততার মধ্যেই অনিরুদ্ধ হঠাৎ এক দুপুরে জানাল শুভ্রাকে, “চলো ক্যান্টিনে যাই, এক কাপ লাল চা আর কিছু কথা বলার আছে।” শুভ্রা প্রথমে একটু ইতস্তত করলেও শেষমেশ রাজি হয়ে যায়। ক্যান্টিনে গিয়ে দু’জনে সেই চেনা কোণার টেবিলে বসল। এক কাপ লাল চা এসে গেল, আর সঙ্গে একটুখানি নিরবতা। এই নিরবতাই যেন বলে দিচ্ছিল—আজকের কথাগুলো আর পাঁচটা দিনের মতন নয়।
অনিরুদ্ধ এক নিঃশ্বাসে বলে ফেলল, “জানিস তো শুভ্রা, তোকে প্রথম যে দিন লাল চায়ের কাপে দেখি, তখন ভাবিনি এই চা এত কিছু বলবে আমাদের মাঝে। তোর সঙ্গে এই কলেজজীবনের প্রতিটা মুহূর্তেই আমি যেন একটু একটু করে বদলে গেছি। এখন পরীক্ষা শেষ হলেই সবাই হয়তো আলাদা হয়ে যাব আমরা। তুই কলকাতায় থেকে এমএ করবি, আর আমি হয়তো চাকরির খোঁজে অন্য শহরে চলে যাব। কিন্তু এই ক্যান্টিনটা, এই লাল চায়ের কাপ, তোর চোখের কোণের সেই ছোট্ট হাসিটা—সবকিছু যেন আমার ভিতরে থেকে যাবে।” শুভ্রা তখন কিছু বলেনি, শুধু চুপচাপ অনিরুদ্ধর দিকে তাকিয়ে ছিল। সেই চাহনি ভেতরে ভেতরে অনেক কথা বলে যাচ্ছিল, যা ভাষা দিয়ে বোঝানো যায় না। অনিরুদ্ধ একটু থেমে বলে, “আমাদের গল্পটা অসমাপ্ত হবে নাতো?” শুভ্রা এবার হালকা হাসি হেসে বলল, “সমাপ্তির কথা কে বলল? গল্পের যতটা চলা, ততটাই সুন্দর। আর বাকি পথটাও যদি একদিন চলা যায়, তো সেটা হবে আরও স্পেশাল।”
সেই বিকেলটা তাদের জীবনের এক জলছাপ হয়ে রয়ে যায়। তারা জানত না ভবিষ্যতে কী হবে, কিন্তু তারা জানত—এই বিকেল, এই ক্যান্টিন, আর এক কাপ লাল চা তাদের ভালোবাসার সবচেয়ে নিঃশব্দ অথচ গভীর স্মারক। পরীক্ষার প্রস্তুতির মাঝে সময় হয়তো কম ছিল, কিন্তু অনুভবগুলো তখন সময়ের চেয়ে অনেক বড় হয়ে উঠেছিল। দু’জনে হেঁটে ফিরেছিল লাইব্রেরির দিক দিয়ে, মাঝে মাঝে একে অপরের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসেছিল, যেন কোনো গোপন কথা বিনিময় করছিল তারা। সেইদিন সন্ধ্যার আকাশে সাদা মেঘের পাশে লুকিয়ে ছিল অজানা ভবিষ্যতের ছায়া, আর দু’জন তরুণ হৃদয়ের অনির্বাণ আলোর মত জ্বলছিল এক কাপ লাল চায়ের স্মৃতিতে।
***
পরীক্ষার শেষ দিন। বেলা গড়িয়ে বিকেলে এসে ঠেকেছে, কলেজ চত্বর তখন এক অদ্ভুত বিষাদে মোড়া। কেউ হাসছে, কেউ কাঁদছে, কেউ ছবি তুলছে – শেষ মুহূর্তে স্মৃতি ধরে রাখার এই চেষ্টাগুলো যেন আরও বেশি করে বুঝিয়ে দিচ্ছিল বিদায়ের অনিবার্যতা। শুভ্রা আর অনিরুদ্ধ সেই ভিড় থেকে খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে, কলেজ বিল্ডিংয়ের পিছনের আমগাছটার নিচে, সেই জায়গায় যেখানে তারা প্রথম একসঙ্গে বসেছিল।
অনিরুদ্ধর হাতে দুই কাপ লাল চা। কাপ থেকে ধোঁয়া উঠছে, কিন্তু ধোঁয়ার চেয়েও বেশি ঘন কুয়াশা জমে আছে দু’জনের চোখে। শুভ্রা একটু কাঁপা গলায় বলে উঠল, “এই চা, এই গাছ, এই বাতাস… সবকিছুই আমাদের জীবনের একটা অধ্যায় হয়ে থাকবে, তাই না?” অনিরুদ্ধ মাথা নেড়ে বলল, “তবে নতুন অধ্যায় লিখবে কে?” শুভ্রা একটু হাসল, “আমরা যদি চাই, তাহলে দু’জনেই লিখতে পারি। হয়তো একসঙ্গে। হয়তো দূর থেকে।”
চায়ের চুমুক আর কথার ফাঁকে এক সময় অনিরুদ্ধ পকেট থেকে একটা ছোট খাম বের করল। তাতে লেখা—”আমার প্রথম চাকরির অফার লেটার”। শুভ্রা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “তুই পেয়েছিস?”
“হ্যাঁ,” অনিরুদ্ধ ধীরে মাথা নাড়ল, “দিল্লিতে। একটা এডিটিং ফার্মে।”
শুভ্রার মুখে একঝলক নিরবতা নেমে এল। সে জানত, এই দিনটা আসবেই।
“তুই?” অনিরুদ্ধ জিজ্ঞেস করল।
“কলকাতাতেই এমএ। বাড়ির কাছেই।”
দু’জনের ভবিষ্যৎ যেন এই চায়ের কাপের মতো—একসাথে ধরলেও, তার ধোঁয়াগুলো দুই দিকে উড়ে যাচ্ছে। তবুও তারা জানত, কোনো কিছুই শেষ হয়ে যায় না, শুধু রূপ পাল্টায়। শুভ্রা হালকা হেসে বলল, “তুই জানিস তো, তোকে দেখে একসময় লাল চায়ের প্রেমে পড়েছিলাম। আর আজ… তোকে দেখে জীবনের প্রেমে পড়ছি।”
অনিরুদ্ধ একটু থেমে বলে, “তাহলে কি তুই বলছিস…?”
শুভ্রা চোখ নামিয়ে ফিসফিস করে বলে, “হ্যাঁ, বলছি—আমি অপেক্ষা করব। যদি একদিন ফিরে আসিস, আমি এখানে থাকব… ঠিক এই গাছটার নিচে, এক কাপ লাল চায়ের সঙ্গে।”
সেদিনের সূর্যটা যেন একটু বেশি গাঢ় রঙে অস্ত যাচ্ছিল। বিদায়ের মাঝেও যেন এক নতুন স্বপ্ন বুনে দিচ্ছিল সে। দু’জনে শেষ চায়ের চুমুক নিল, ধীরে ধীরে, যেন চায়ের সঙ্গে শেষবার শুষে নিচ্ছিল ভালোবাসার টানাপোড়েন।
তারপর… একটা হালকা স্পর্শ। অনিরুদ্ধ শুভ্রার কাঁধে হাত রাখল, আর বলল, “তুই থাকিস। আমি ফিরব। কারণ লাল চায়ের স্বাদ, একবার যে মন ছুঁয়ে যায়—তা কখনও ফিকে হয় না।”
আর সেই মুহূর্তেই, জীবনের এক অধ্যায় শেষ হলো, আর শুরু হলো এক নতুন কাহিনী—যেখানে প্রেম কেবল উপস্থিতির নাম নয়, বরং প্রতীক্ষা, বিশ্বাস আর এক কাপ লাল চায়ের মতো ধোঁয়ায় মোড়া এক চিরন্তন অনুভব।
___




