Bangla - রহস্য গল্প

লাল কালি, কালো গল্প

Spread the love

নিলয় মিত্র


অধ্যায় ১

সাহিত্যিক সৌম্য মিত্রের নিথর দেহটি পড়েছিল তার উত্তর কলকাতার দোতলা বাড়ির লেখার ঘরে, জানালার পর্দা অর্ধেক সরানো, বাইরের ঝিরঝিরে বৃষ্টির আলো গালচে করে রেখেছে কাঁচের ওপর। ছোট একটি কাঠের টেবিলে ছড়িয়ে থাকা কাগজগুলো ছিল সযত্নে বাঁধা একটি পাণ্ডুলিপি, নামহীন, কেবল প্রতিটি পাতার নিচে লাল কালি দিয়ে স্পষ্টভাবে লেখা — “এটা আমার লেখা নয়।” তার ডান হাতে শক্ত করে ধরা একটি পার্কার কলম, পাশে পড়ে থাকা আধখোলা পেন্সিল বক্স, আর ঘরের কোণে নিঃশব্দে জ্বলছিল একটি কুয়াশামাখা টেবিল ল্যাম্প। পুলিশের প্রাথমিক রিপোর্ট বলেছে—আত্মহত্যা। ঘুমের বড়ি ও হুইস্কির সম্মিলিত প্রভাবে মৃত্যু হয়েছে সম্ভবত রাত আড়াইটার সময়। কিন্তু বাড়ির কাজের মেয়ে রেখা প্রথম বুঝতে পারে, কিছু ঠিকঠাক নেই, যখন সকাল সাতটায় দরজা ভাঙা অবস্থায় সৌম্যবাবুর স্টাডি রুম দেখে। সঙ্গে সঙ্গে খবর ছড়িয়ে পড়ে, সংবাদমাধ্যম হুমড়ি খেয়ে পড়ে, সাহিত্যজগত শোকস্তব্ধ হয়ে যায়। কেউ বিশ্বাস করতে চায় না যে এই মানুষটি—যিনি বাংলা সাহিত্যে আধুনিক রহস্য উপন্যাসের পথিকৃৎ—তিনি এভাবে শেষ করে দিতে পারেন নিজেকে।

ঋদ্ধি বসু তখন শান্তিনিকেতনে নিজের গবেষণাকর্ম নিয়ে ব্যস্ত। তার থিসিসের বিষয়ই ছিল “সৌম্য মিত্র ও তাঁর রহস্যের রাজনীতি”। হঠাৎই টেলিভিশনে মৃত্যুর সংবাদ দেখে সে দিশেহারা হয়ে পড়ে। পরদিন সে কলকাতা আসে, সৌম্য মিত্রের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকে সাংবাদিকদের ভিড়ের পেছনে, একরকম কাঁপতে কাঁপতে। তার মনে হয়, তার ভেতরের এক অংশ যেন এই মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত ছিল—সৌম্য মিত্র গত কয়েক বছর ধরে যেভাবে নিজের সাহিত্য থেকে সরে গিয়ে, এক নিঃসঙ্গ, নির্বাক মানুষে পরিণত হয়েছিলেন, তাতে ঋদ্ধি আগেই বুঝেছিল কিছু অদ্ভুত একটা ঘটছে। তবে এই মৃত্যুর থেকেও বেশি তাকে কৌতূহলী করে তোলে ওই শেষ পাণ্ডুলিপি। সৌম্যবাবুর পুরনো সহকারী রবিন ঘোষাল, যাকে সে আগে দেখেছে দু-একবার, হঠাৎ তাকে ডাকেন। “আপনি পড়ুন ম্যাম, আপনি বুঝতে পারবেন — ওনার লেখায় এমন কথা আগে কখনও ছিল না।”

ঋদ্ধি সেই পাণ্ডুলিপির প্রথম পাতা হাতে নেয়। প্রথমেই চোখে পড়ে, নিচে লাল কালি দিয়ে মোটা করে লেখা—”এটা আমার লেখা নয়”। লেখাটি পড়তে শুরু করে সে—গল্পটি এক খ্যাতনামা লেখকের মানসিক অবসাদ নিয়ে, যিনি একদিন বুঝতে পারেন, তিনি যা যা লিখছেন, তা তার নিজের নয়—কেউ যেন তার ভেতরে ঢুকে লেখা লিখিয়ে নিচ্ছে। প্রতিটি অধ্যায়ে লেখক এক পাপপূর্ণ সত্তার মুখোমুখি হন, যার নাম ‘সায়াহ্ন’। আর সায়াহ্ন ধীরে ধীরে লেখকের অস্তিত্ব দখল করে ফেলে। ঋদ্ধির গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে—এ তো একরকম আত্মজীবনী! পাণ্ডুলিপির চরিত্রগুলো যেন বাস্তবের ছায়া। লেখক নিজেই এখানে গল্পের চরিত্র হয়ে উঠেছেন, যাকে নিজস্ব সত্তা খেয়ে নিচ্ছে আরেক ‘লেখক’। এক নিঃশব্দ আতঙ্ক ঋদ্ধির মনের গভীরে ছায়া ফেলে।

পাণ্ডুলিপি পড়তে পড়তেই তার চোখ আটকে যায় দ্বিতীয় অধ্যায়ের পাশে লেখা আরেকটি লাল কালি লেখা চিহ্নে—এইবার বড় অক্ষরে লেখা, “আমি লিখিনি, আমাকে দিয়ে লেখা হয়েছে।” এখানেই প্রথমবার ‘আমি’ আর ‘আমার’ এর বিভাজন আসে। এটা কি কোনো ছায়ালেখকের লেখা? না কি লেখকের ব্যক্তিত্ব বিভাজনের কোনো প্রমাণ? তখনই রবিন পাশে এসে বলে, “ম্যাম, আপনি যদি সত্যিই এর রহস্য বুঝতে চান, তাহলে ওনার ছেলে আর্যর সঙ্গে কথা বলুন। আর্যদা তো বিদেশে থাকেন, কিন্তু পাণ্ডুলিপির কিছু অংশ তিনি ডিজিটালি টাইপ করেছিলেন। আর দেখুন ম্যাম, আমি যা লিখি, তা আপনি পড়েছেন… এটা আমার লেখা না।” রবিনের কণ্ঠে আতঙ্ক ছিল, অভিমানও। ঋদ্ধি বুঝতে পারে, এ মৃত্যু নয় শুধুই এক মানুষের, এ মৃত্যু এক লেখার, এক বিশ্বাসের, এক আত্মপরিচয়ের—যেখানে লেখক নিজেই জানতেন না শেষ পর্যন্ত কে লিখছিল তার কলমের নিচে সেই রক্তমাখা অক্ষর।

অধ্যায় ২

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছোট্ট কনফারেন্স কক্ষে বসে ঋদ্ধি বসু আগলে বসেছিল সেই পাণ্ডুলিপিটা। বাইরে বৃষ্টি পড়ছিল একটানা, আর কাচের জানালায় জমা হচ্ছিল অস্পষ্টতা। পাণ্ডুলিপির পাতাগুলো ছিল নড়বড়ে, মাঝে মাঝে স্যাঁতসেঁতে গন্ধ ভেসে আসছিল, অথচ যত এগোচ্ছিল সে, ততই অদ্ভুত এক টান পড়ছিল তার মনে। যেন সে নিজের গবেষণা নয়, নিজের অস্তিত্বের মধ্যে ঢুকে পড়ছে। লেখার মধ্যে এমন একধরনের অস্বস্তিকর মোহ ছিল, যা কাউকে আচ্ছন্ন করে ফেলতে পারে—ধীরে ধীরে, নিঃশব্দে। সৌম্য মিত্র, যিনি তাঁর উপন্যাসে জাদু ও বাস্তবতাকে এমনভাবে মিশিয়ে দিতেন যে পাঠক বুঝতেই পারত না কোনটা সত্য আর কোনটা কল্পনা, সেই মানুষটি কেন হঠাৎ করে লিখবেন, “আমি লেখিনি”? না কি তিনি সত্যিই লেখেননি?

ঋদ্ধির মধ্যে একটা সংশয় জেগে ওঠে—শেষ উপন্যাসটি কি তবে ghostwritten? সাহিত্যে ‘ছায়ালেখক’ বা ‘ghostwriter’ শব্দটি সে বহুবার শুনেছে, পড়েছে, ব্যবহারও করেছে, কিন্তু তা যেন এই মুহূর্তে একেবারে নতুন অর্থ নিচ্ছিল। সে রবিন ঘোষালের বাড়িতে যায়। ছোট্ট একটি ঘরে সে থাকেন, বুকে জড়িয়ে ধরা কাগজপত্র, পুরনো টাইপরাইটার, আর একঘেয়ে ঝাপসা আলো। রবিন চোখে তাকায় না, নীচুস্বরে বলে, “আমি প্রথমে শুধু টাইপ করতাম, ম্যাম… পরে স্যার বললেন, ‘তুমি তো ভালো লেখো, একবার একটা গল্প লিখে দেখাও।’ তারপর শুরু। প্রথম কয়েকটা বছর বুঝতেই পারিনি—কবে ওনার ছায়া হয়ে গেলাম।” ঋদ্ধি জিজ্ঞেস করে, “তবে শেষ উপন্যাসটা?” রবিন মাথা নেড়ে বলে, “না ম্যাম, ওই লেখা আমার নয়। আমি বলছি না আমি নির্দোষ, কিন্তু ওই লেখা… ওই লেখার মধ্যে কিছু আছে, যা ওনাকে শেষ করে দিল।”

সেই রাতে ঋদ্ধি ফিরে আসে একটি ভারী অনুভূতি নিয়ে। লেখক আর ছায়ালেখকের সম্পর্ক যেন এক রহস্যময় সমঝোতা—যেখানে কারা লেখে, আর কারা স্বীকৃতি পায়, তার পার্থক্য সময়ই ধীরে ধীরে ঘুচিয়ে দেয়। কিন্তু এই ক্ষেত্রে, সত্যিটা যেন অন্য কোথাও লুকিয়ে আছে। সে নিজের ল্যাপটপ খুলে সৌম্য মিত্রের বিখ্যাত প্রথম উপন্যাস ‘অন্ধকারে আয়না’ পড়তে শুরু করে। তুলনা করে শেষ পাণ্ডুলিপির ভাষা ও শৈলীর সঙ্গে। বিস্ময়ে ভাবে—এ যেন দু’জন সম্পূর্ণ আলাদা লেখকের কলম। তবু কোথাও কোথাও—একটা অলক্ষ্য বাঁক, শব্দচয়নে হালকা চাপ, চরিত্রের চোখের ভাষায় হঠাৎ সেই পুরনো সৌম্যকেই খুঁজে পায় সে। যেন সেই লেখক আবার ফিরে এসে বলছেন, “আমি এখনও আছি, আমার নাম মুছে ফেলো না।”

পরদিন সকালে ইন্সপেক্টর অনিরুদ্ধ সাহার ফোন আসে। “পাণ্ডুলিপি নিয়ে কিছু অগ্রগতি?”—তার প্রশ্ন। ঋদ্ধি একটু থেমে বলে, “এটা শুধু খুন বা আত্মহত্যার প্রশ্ন নয়, এটা সাহিত্যিক পরিচয়ের চূড়ান্ত ভাঙন। আপনি জানেন, লেখার মধ্যে একটা ছায়া চরিত্র আছে—‘সায়াহ্ন’? যে লেখককে দিয়ে লিখিয়ে নিচ্ছে?” অনিরুদ্ধ বলে, “আমরা সেই নামের খোঁজে ছিলাম, একটা পুরনো সাহিত্য ম্যাগাজিনে এই ছদ্মনাম পাওয়া গেছে। তবে ঠিক কোথায় ব্যবহার হয়েছে সেটা খুঁজে বের করতে হবে।” কথাটি শুনে ঋদ্ধির কাঁধে ঠান্ডা স্রোত বয়ে যায়। তাহলে ‘সায়াহ্ন’ আসলেই ছিল? না কি এটা ছিল সৌম্য মিত্রের মানসিক বিভ্রমের আরেক রূপ? তার মনে হয়, পাণ্ডুলিপি নয়, আসল রহস্য লুকিয়ে আছে সেই চরিত্রের মধ্যেই—যে লেখেনি, কিন্তু লেখা হয়েছিল তাঁর হাত দিয়ে। গল্পের ভিতরে গল্প, লেখকের ভিতরে লেখক। আর হয়তো, মৃত্যুর পরেও, সেই লেখাই বলে যাচ্ছে—”আমি ছিলাম, আমি আছি, আর আমার হাতেই হবে শেষ সত্যের লেখা।”

অধ্যায় ৩

বিকেলের শেষ আলোয় ঋদ্ধি বসু পৌঁছে যায় নন্দন চত্বরের পাশে এক পুরনো বইয়ের দোকানে, যেখানে প্রায়ই সৌম্য মিত্র তার প্রিয় বই কিনতেন—বিশেষ করে সাহিত্য পত্রিকা ও বহুল প্রচারিত না হওয়া ছোট ম্যাগাজিন। দোকানটির মালিক চরণ দত্ত, একজন বইপাগল বয়স্ক মানুষ, যিনি প্রায় তিন দশক ধরে সেখানে আছেন। ঋদ্ধি সৌম্য মিত্রের নাম বলতেই তিনি বললেন, “ও তো ছিল আমার প্রিয় গ্রাহক… তবে শেষ দু’বছর একরকম বদলে গিয়েছিল লোকটা, একবার তো বলেছিল, ‘চরণদা, আমি যাকে পড়ি, সে-ই আমায় লিখে ফেলছে।’” চরণদা একটি পুরনো বাল্বের নিচে থেকে বের করে আনলেন ধুলোমাখা একটি সাহিত্য পত্রিকা—‘শব্দশেষ’, সংখ্যাটি ২০০২ সালের। পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে ঋদ্ধির চোখ আটকে যায় একটি ছোটগল্পে, লেখকের নাম: সায়াহ্ন।

গল্পটির নাম ছিল “আয়নার দাগ”, গল্পে এক লেখক নিজের প্রতিচ্ছবি নিয়ে ধীরে ধীরে পাগল হয়ে যাচ্ছে। তার লেখা গুলি সে নিজেই পড়ে অবাক হয়, কারণ মনে থাকে না কখন লিখেছে, কোথায় রেখেছে। ধীরে ধীরে সে বুঝতে পারে, তার প্রতিচ্ছবি আয়নার মধ্যে থেকে তাকে দিয়ে লিখিয়ে নিচ্ছে। লেখাটি অসামান্য রকমের রুদ্ধশ্বাস ও মানসিক টানাপোড়েনে ভরপুর। এমনকি গল্পের শেষ লাইন ছিল—“সে লিখছে, আর আমি শুধু হাত দিচ্ছি; আমার কলম ওর রক্ত দিয়ে চলছে।” চরণদা জানালেন, “এই গল্পটা ছাপার পর সৌম্য একদিন এসে খুব খোঁজখুঁজি করছিল, বারবার বলছিল—এই লেখাটা আমার, কিন্তু আমি তো লিখিনি। তখন আমিও ভেবেছিলাম, লোকটা হয়তো সৃজনশীল পাগলামিতে ভুগছে।”

ঋদ্ধি সেই রাতেই ফিরে এসে ফোন করে ইন্সপেক্টর অনিরুদ্ধ সাহাকে। “আপনি যদি পারেন, আমাকে সায়াহ্ন নামটা যে ব্যবহার করেছিল, তার লেখাগুলোর তালিকা দেন। ওর লেখায় কিছু আছে, যা সৌম্যবাবুর মৃত্যুর কেন্দ্রে।” সাহা জানালেন, “আমরা যে ম্যানুয়াল আর্কাইভে কাজ করছিলাম, সেখানে চারটি পত্রিকায় ছয়টি গল্প পেয়েছি সায়াহ্ন নামে ছাপা—সেগুলোর বেশিরভাগই ছিল আত্মপরিচয়, দ্বৈতসত্তা আর অন্ধকার সাহিত্যের উপরে। কিন্তু আপনি বিশ্বাস করবেন না, সবগুলো গল্পের প্লট একরকম ভাবে সৌম্য মিত্রের জীবনের সঙ্গে মিলে যায়।” ঋদ্ধির গলা শুকিয়ে আসে, সে বোঝে—এই লেখক ছায়ার মতো সৌম্যর চারপাশে ছিল। প্রশ্ন উঠছে—এ কি কারও সুকৌশলী ছদ্মবেশ, না কি সৌম্য নিজেই ছিলেন সায়াহ্ন?

পরদিন, রবিন ঘোষালের সঙ্গে আবার দেখা করে ঋদ্ধি। সে এবার নির্ভরযোগ্য নয়—রবিন ভেতর থেকে ভেঙে পড়েছে, চোখ লাল, হাত কাঁপছে। সে বলে, “আপনি জানেন, একবার ওনার একটা গল্পে আমি লেখক চরিত্রের জায়গায় নিজের নাম লিখে দেখেছিলাম টাইপ করতে করতে। তখন এমন অদ্ভুত এক অনুভূতি হচ্ছিল, মনে হচ্ছিল আমার হাতটা যেন আমার নয়… এবং বিশ্বাস করুন, ওই দিন রাতে আমার ঘুমে সৌম্যদা এসে বলেছিলেন—‘আমার লেখা নকল করছো কেন?’ আমি ভয় পেয়ে উঠেছিলাম।” ঋদ্ধির মনে হয়, এই রহস্যের মূলসূত্র কোন ব্যক্তি নয়, বরং একটি অনুভব—লেখার মধ্যে ঢুকে পড়া এমন এক সত্তা, যাকে ধরা যায় না, ছুঁতে পারা যায় না, কিন্তু সে লেখে, নির্দেশ দেয়, আর ধীরে ধীরে লেখকের উপরে আধিপত্য স্থাপন করে।

ঋদ্ধি এবার নিজেই সন্দেহে জর্জরিত হয়ে পড়ে। তার নিজের থিসিসের লেখাগুলোর দিকে সে তাকিয়ে থাকে অনেকক্ষণ। কোথাও কি এমন কিছু লিখে ফেলেছে যা তার নিজের নয়? ল্যাপটপে খুঁজে পায় একটি ফাইল, নাম—“sayanha_notes.doc”। খোলা হয়নি কখনও, অথচ তার নিজের ফোল্ডারে। ফাইলটি খুলতেই দেখা যায় ছড়ানো ছিটানো কয়েকটি প্যারাগ্রাফ, ঠিক সেই স্টাইলে লেখা যা সে পাণ্ডুলিপিতে পড়েছে। লেখার ভেতরে এক জায়গায় লেখা: “তুমি পড়বে, বুঝবে, আর শেষত বুঝবে তুমি লেখনি কিছুই।” ঋদ্ধির চোখ স্থির হয়ে যায়। তবে কি ‘সায়াহ্ন’ নিছক একটি ছদ্মনাম নয়—এ এক অভিশপ্ত ধারাবাহিকতা, এক সাহিত্যিক সংক্রমণ, যা এক লেখকের শরীর থেকে আরেক লেখকের মধ্যে ছড়িয়ে যায়? রহস্য ক্রমেই ঘনীভূত হতে থাকে। এখন আর শুধু পাণ্ডুলিপির লেখক নয়, ঋদ্ধির নিজের আত্মপরিচয়ও প্রশ্নের মুখে—কে লিখছে কাকে দিয়ে? আর কার লেখা পড়ছি আমরা, যেটা আসলে লেখকের নয়?

অধ্যায় ৪

কলকাতার হেমন্তের সন্ধ্যায় ধোঁয়াশায় ঢাকা হাওয়ায় ঋদ্ধি বসে ছিল রাজ্য গ্রন্থাগারের পুরনো পাঠাগারে। চারদিকে যেন এক অদৃশ্য চাপা কণ্ঠস্বর—শুধু কাগজ উল্টানোর শব্দ আর দূরের ঘড়ির কাঁটার কড় কড় আওয়াজ। সে খুলে বসে আরও কিছু ‘সায়াহ্ন’-এর লেখা—যেগুলো ইন্সপেক্টর অনিরুদ্ধ সাহা পাঠিয়েছিলেন। তার চোখ আটকে যায় একটি নামহীন কবিতায়:
“একদিন কলম ধরল আমাকে,
বলল, লেখো—নইলে আমি তোমার রক্তে স্নান করব।
আমি লিখতে থাকি, অথচ বুঝি না,
যা লিখছি, তা পড়ে কাঁদছে আমার প্রতিচ্ছবি।”
ঋদ্ধি অনুভব করে, এই লাইনগুলো নিছক কল্পনার ফসল নয়—এ যেন কোন যন্ত্রণাময় বাস্তব, যেটা কারও ভেতরে শিকড় গেঁথেছে।

সন্ধ্যার দিকে সে পৌঁছায় সৌম্য মিত্রের ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডাঃ অভিজিৎ সেনের চেম্বারে। ডাঃ সেন বলেন, “আমি বহুবার চেষ্টা করেছিলাম ওনাকে কাউন্সেলিং-এ পাঠাতে। উনি বলতেন, ‘আমার মাথায় কেউ ঢুকে বসে আছে ডাক্তার, সে-ই আমার গল্প লিখছে, আমি কেবল কাগজে আঁকি।’ একদিন তো কেঁদে বললেন, ‘আমার গল্পগুলো আমাকে খেয়ে ফেলছে। আমি আছি, অথচ কেউ আমার মধ্যে লিখে যাচ্ছে—আমি তাকে থামাতে পারি না।’” এই কথা শুনে ঋদ্ধি শিউরে ওঠে—সৌম্য মিত্র কি মানসিক বিকারগ্রস্ত ছিলেন? না কি সত্যিই তার ভেতরে কেউ ছিল—একটা ভিন্নসত্তা?

ডাক্তার সেন আরও জানালেন, মৃত্যুর এক সপ্তাহ আগে সৌম্য মিত্র তার চেম্বারে এসে বলেন, “আমার নাম আর থাকবে না কোনো গল্পে, সায়াহ্ন সব লিখে নিচ্ছে। আমি চুপ করে আছি।” এরপরই শুরু হয়েছিল তাঁর অজানা পাণ্ডুলিপি লেখা, যার মধ্যে প্রতিটি পাতার নিচে লাল কালি দিয়ে লেখা সেই বিভীষিকাময় বাক্য—“এটা আমার লেখা নয়।” ডাক্তারের মতে, এটি ছিল split personality বা dissociative identity disorder-এর লক্ষণ। কিন্তু এখানেই রহস্য ঘনীভূত হয়—ঋদ্ধির খোঁজে দেখা যায়, বহু বছর আগে লেখা ‘সায়াহ্ন’-এর গল্পগুলোতেও লেখা ছিল লেখকের ভিতরের আরেক ‘ছায়া’ সত্তার কথা, যাকে থামানো যায় না।

ঋদ্ধি যখন এই সব নিয়ে ভাবছে, ঠিক তখনই তার কাছে আসে একটি কুরিয়ার—প্যাকেটের উপর লেখা: “ঋদ্ধি বসুর হাতে দিতে হবে, প্রেরক: অজ্ঞাত”। খোলার পর দেখা যায়, একটা পাণ্ডুলিপির শেষ অধ্যায়—হুবহু সেই লেখার শেষ অংশ যেটা সৌম্য মিত্রের মৃত্যুর ঘরে পাওয়া গিয়েছিল, কিন্তু এই কপিটা একেবারে পরিপাটি টাইপ করা, নোট করা অংশও পরিষ্কার। পাতার নিচে হাতে লেখা—”তুমি যদি সত্যি জানতে চাও, একবার আয়নার সামনে বসো। ঠিক যেখানে আমি শেষ হয়েছি, সেখান থেকেই শুরু করবে তুমি।” ঋদ্ধির বুক ধক করে ওঠে। সে বুঝে যায়, এই রহস্য শুধু কোনো মানসিক রোগ, প্রতিহিংসা বা গোপন ছদ্মনামের খেলা নয়। এই রহস্য—একটি সাহিত্যিক সংক্রমণ, একটি লিখনের ভাইরাস, যা এক লেখক থেকে অন্য লেখকে ছড়িয়ে পড়ে… একবার শুরু হলে, শেষ করতে পারে না কেউ।

সেই রাতেই, ঘরের সমস্ত আলো নিভিয়ে, ঋদ্ধি বসে আয়নার সামনে। হাতে সেই পাণ্ডুলিপির শেষ পৃষ্ঠা, চোখে বিষণ্ণ কৌতূহল। নিঃশব্দে সে পাতা খুলে পড়ে। একটা অদ্ভুত ঠান্ডা স্রোত বইতে থাকে তার ঘাড় বেয়ে। আয়নায় নিজের মুখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ তার মনে হয়—চোখের পেছনে কিছু নড়ছে। সে নিজের ছায়ার দিকে তাকিয়ে ভাবে, এই আমি—আমি তো ঠিক আগের মতো না। আমি পড়ছি, লিখছি, ভাবছি… কিন্তু যদি এই সব কিছুর নিয়ন্ত্রণ অন্য কারও হাতে থাকে? যদি আমিও কেউ হয়ে পড়ি… “সায়াহ্ন”?

অধ্যায় ৫

ভোরবেলা, নিজের ঘরের জানালা খুলতেই ঋদ্ধি দেখে সামনের বারান্দায় রাখা পত্রিকাগুলোর উপর কেউ একটা চিঠি চাপা দিয়ে রেখে গেছে—একটি ধূসর খামের ভিতরে লাল কালিতে লেখা কয়েকটি লাইন।
“যখন তুমি পড়ো, তখন সে লিখে।
যখন তুমি চুপ করো, তখন সে ফিসফিস করে।
আমি চেষ্টা করেছিলাম থামাতে। পারিনি।
তুমি পারবে?”
চিঠির নিচে স্বাক্ষর নেই। কেবল একটি প্রতীক আঁকা—একটি খোলা চোখ, যার পুতলিতে ছোট্ট একটি কলম বসানো। প্রতীকটি চেনা লাগলেও কিছুতেই মনে পড়ে না কোথায় দেখেছে। এই লেখাটি যেন রক্তের উপর লেখা, কালি নয়। এই মুহূর্তে সে নিশ্চিত—যে-ই এই চিঠি পাঠিয়েছে, সে পাণ্ডুলিপির শেষ অধ্যায় সম্পর্কে জানে। এমনকি সম্ভবত, সে-ই লিখেছে ‘সায়াহ্ন’ নামে।

ঋদ্ধি যায় কলেজ স্ট্রিটের ‘বুক ক্লাব’-এ, যেখানে আগে ‘সায়াহ্ন’-এর গল্প ছাপা হয়েছিল এমন পত্রিকাগুলোর আর্কাইভ থাকে। পুরনো ফাইলে খুঁজে পায় একটি ইন্টারভিউ—২০০৩ সালের, ছদ্মনামের সাহিত্যিক ‘সায়াহ্ন’-এর সঙ্গে করা ছোট্ট একটি চিঠিপত্র ভিত্তিক সাক্ষাৎকার। সেখানে লেখা, “আমি লেখক নই, আমি তো শুধু আত্মা ধার দিই, যেন লেখকের ভেতরের শব্দগুলো উঠে আসে। আমি আয়নার পেছনে থাকি, আমার কলম নেই—আমি অন্যের হাতই ধার নিই।” এই ইন্টারভিউ পড়েই ঋদ্ধি বুঝে যায়—‘সায়াহ্ন’ কেবল একজন লেখক নয়, বরং এক বিশ্বাস, এক ধারণা, এক সাহিত্যিক “আত্মা”। কেউ হয়তো তাকে সৃষ্টি করেছে, অথবা সে নিজেই ছড়িয়ে পড়েছে গল্প থেকে গল্পে, লেখক থেকে লেখকে।

এরপর সে দেখা করতে যায় আর্য মিত্রের সঙ্গে—সৌম্য মিত্রের ছেলে, সদ্য বিদেশ থেকে ফিরে আসা। আর্য, প্রথম দিকে চুপচাপ থাকলেও, ধীরে ধীরে নিজের ভেতরের কথা খুলে বলে। “তুমি জানো ঋদ্ধি, আমি প্রথমে বাবার লেখা টাইপ করতাম। একদিন টাইপ করতে করতে হঠাৎ দেখি—ফাইল সেভ করার পর নতুন করে কয়েকটি লাইন যুক্ত হয়েছে। আমি ভেবেছিলাম হয়তো কপি-পেস্ট হয়ে গেছে ভুল করে। কিন্তু বারবার এমন ঘটতে লাগল। এবং সবগুলো লাইনই একই ধাঁচে—‘তুমি যা ভাবছ, আমি তা-ই লিখিয়ে নেব।’ আমি ভয় পেয়ে গেলাম। বাবাকে বললে, উনি আমায় জিজ্ঞেস করেন—‘ও লাইনগুলো পড়েছ?’ আমি বলি, হ্যাঁ। তখন উনি শুধু একটা কথা বলেন—‘তাহলে দেরি হয়ে গেছে।’” আর্যর গলা কেঁপে ওঠে, চোখে জল। “আমি জানি না বাবা কেন নিজেকে শেষ করল, কিন্তু ওর চোখে তখন কেবল একটা প্রতিচ্ছবি ছিল—যেটা আমি দেখিনি, কিন্তু সে ওনার ভেতর থেকে সব লিখে যাচ্ছিল।”

ঋদ্ধি এবার বুঝে যায়, এ কাহিনি কারও মানসিক বিকার বা দোষের নয়। এ যেন এক প্রাচীন সাহিত্যিক ব্যাধি—লেখার পেছনে লেখা, ছায়ার নিচে আরেক ছায়া। সে যতই সামনে এগোচ্ছে, ততই তার চারপাশে ঘনিয়ে আসছে লাল কালি—এক ধরনের অস্পষ্ট শ্বাস, শব্দহীন নির্দেশ, আর পাণ্ডুলিপির পাতায় পাতায় বয়ে চলা রক্তমাখা অক্ষর। সে আরেকবার সেই শেষ পাণ্ডুলিপিটি খুলে পড়ে। তাতে এক নতুন বাক্য দেখা যায়, যেটা সে আগেও দেখেনি:
“তুমি এখন আমার গল্পের ভিতরে, ঋদ্ধি। এখন তুমি যা-ই লিখবে, আমার নামেই লেখা হবে। আর মনে রেখো, আমার নাম ভুলে গেলে… কালি লাল হয়ে যায়।”

রাত গভীর হয়, আকাশে জোছনা ঝুলে থাকে ক্লান্ত চোখের মতো। ঋদ্ধি বিছানায় শুয়ে, ঘুমিয়ে পড়ে হালকা অবসাদে। কিন্তু মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায় এক শব্দে—“লিখো…” একটানা চাপা কণ্ঠস্বর, যেন তার কানের ঠিক পাশেই কেউ ফিসফিস করে বলছে। সে উঠে বসে দেখে, ডেস্কের উপরে তার নোটবুকে একটি লাইন জ্বলজ্বল করছে—লাল কালি দিয়ে লেখা: “তোমার হাত এখন আমার।”

সেই মুহূর্তে ঋদ্ধি বুঝে যায়—রহস্য তাকে টানছে না, বরং গ্রাস করছে। আর সে যদি থামে, যদি চুপ করে যায়, তবে সেই নিঃশব্দ কণ্ঠটি louder হয়ে উঠবে—ধীরে ধীরে, নিরবধি। সায়াহ্ন হয়তো আর একজন না, একটা সংক্রমণ—যেটা শুরু হয় লাল কালি দিয়ে, শেষ হয় নিঃশব্দ গল্পে।

অধ্যায় ৬

কলকাতার একটি শীতল, ধোঁয়াশায় মোড়া সকাল। ঋদ্ধি বসু আজ যেন নিজেকে পুরোপুরি আলাদা মানুষ মনে করে। আগের মতো স্বাভাবিক কিছুই আর মনে হয় না—কলম ধরার সময় মনে হয়, কারা যেন আঙুলে হালকা চাপ দিচ্ছে, কেউ যেন নির্দেশ দিচ্ছে কোন শব্দ লিখতে হবে, কোন বাক্য বাদ দিতে হবে। প্রতিদিন সে সেই পাণ্ডুলিপির পাতাগুলো পড়ে, যেখানে এক অজানা সত্তা বলে চলে—”লিখে যাও, যতক্ষণ না সত্য উন্মোচিত হয়।” কিন্তু সত্য বলতে সে কাকে বোঝায়? সৌম্য মিত্র? সায়াহ্ন? নাকি এখন ঋদ্ধিকেও?

সে আরেকবার ফিরে যায় সৌম্য মিত্রের ব্যক্তিগত লাইব্রেরিতে—এইবার অনিরুদ্ধ সাহার বিশেষ অনুমতিতে। পুরনো কাঠের তাকের ভেতর থেকে সে আবিষ্কার করে একটি খাতা, যার উপর লেখা ‘ব্যক্তিগত নোট’। পাতা ওল্টাতেই তার চোখে পড়ে ছেঁড়া ছেঁড়া লাইন, অনেকখানি অসংলগ্ন কিন্তু ভয়ঙ্কর স্পষ্ট।
“আমি লিখি না, আমার মধ্যে কেউ বসে আছে—সে বলে, আমি শুনি।
আমি চেয়েছিলাম পালাতে, কিন্তু সে হাসে, বলে, ‘তুমি কি আমায় তৈরি করোনি?’
আমি একদিন তাকে দেখতে পেয়েছিলাম—ঘরের কোণায় দাঁড়িয়ে সে আমারই ছায়া হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল।”
এইবার সত্যটা আরও কাছে চলে আসে। সৌম্য মিত্র নিজেও জানতেন না তিনি যে গল্পগুলো লিখছেন, সেগুলো তার নিজের নয়। বরং তার মধ্য দিয়ে কিছু লিখে নিচ্ছে—একটা অদৃশ্য সত্তা, যার নাম সায়াহ্ন হোক বা অন্য কিছু, কিন্তু তা একটা ভয়ংকর বাস্তব।

ঋদ্ধি রাতের ঘুম হারিয়ে ফেলে। দিনের পর দিন লেখার চেষ্টা করলেও কিছুই লেখা হয় না—যখনই কলম তোলে, মনে হয় কোনও চাপা কণ্ঠ বলছে, “এভাবে নয়, এমন করো না, আমাকে লিখতে দাও।” এক রাতে হঠাৎ সে স্বপ্ন দেখে—এক অন্ধকার ঘরে সে বসে আছে, সামনে পাণ্ডুলিপির পাহাড়, আর প্রতিটি পাতায় রক্তে ভেজা অক্ষরে লেখা—“এটা আমার লেখা নয়, কিন্তু আমি তা লিখিয়েছি।” ঘুম ভাঙতেই দেখে, তার ডেস্কের কাগজের উপর তার হাত থেকে পড়ে থাকা কলম, আর লেখা—“তুমি তো শুরু করেছো, ঋদ্ধি… এখন শেষ করবে কে?”

ভোরবেলা অনিরুদ্ধ সাহা ফোন করে জানায়, forensic team পাণ্ডুলিপির লাল কালির লেখাগুলোর অদ্ভুত এক মিল খুঁজে পেয়েছে—যেটা সৌম্য মিত্রের হস্তাক্ষরের সঙ্গে আংশিক মিলে যায়, কিন্তু সম্পূর্ণ নয়। কেউ যেন তার হস্তাক্ষর হুবহু অনুকরণ করেছে, কিন্তু কৌশলে কিছু অংশ বদলে দিয়েছে। এটা মানুষের পক্ষেও সম্ভব, আবার এমন কেউ—যে নিজেকে লেখকেরই এক অংশ ভাবছে, তার পক্ষেও। অনিরুদ্ধ বললেন, “এই লেখা যেন সাহিত্যিক আত্মার এক ছিন্ন হওয়া খণ্ড, যেটা এখন আলাদা সত্তা হয়ে উঠেছে।”

ঋদ্ধি এরপর আরেকটি সিদ্ধান্ত নেয়—সে ফিরে যায় সেই প্রথম চিঠির প্রতীকের খোঁজে, চোখে পুতলি আর কলম আঁকা ছিল যেটা। বহু খোঁজের পর এক পুরনো ‘লিটল ম্যাগাজিন’ সংস্থার আর্কাইভে সে পায় সেই প্রতীক—‘লালদৃষ্টি’ নামে একটি বদ্ধ সাহিত্য গোষ্ঠীর চিহ্ন। এই গোষ্ঠী ছিল ১৯৮০ সালের এক দল সাহিত্যিকের নির্মিত, যাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সৌম্য মিত্র। জানা যায়, তারা এক বিশেষ ধাঁচের ‘লিখন চর্চা’ করতেন—যেখানে লেখক নিজেকে ‘মাধ্যম’ হিসেবে ব্যবহার করতেন, যেন তার মধ্যে দিয়ে অন্য কেউ লিখছে। কিছুকাল পর এই গোষ্ঠী রহস্যজনকভাবে বন্ধ হয়ে যায়, কারণ কিছু লেখক অস্বাভাবিক মানসিক ভাঙন ও বিভ্রমে ভুগে আত্মহত্যা করেছিলেন।

ঋদ্ধি বুঝে যায়—এটা নিছক কল্পনার খেলা নয়। সায়াহ্ন এক অদৃশ্য ঐতিহ্য, এক সাহিত্যিক আত্মার সংক্রমণ, যেটা লেখকের কলমে, চেতনায়, কিংবা ছায়ায় বাসা বাঁধে। যারা একবার তার শিকার হয়, তারা কখনোই পুরোপুরি লেখক থাকে না—তারা হয়ে যায় লেখা নিজেই। এবং এখন, সেই সংক্রমণ তাকে গ্রাস করতে শুরু করেছে। লেখা থেকে লেখক মুছে গেলে কেবল থাকে কালি—আর যদি সেই কালি লাল হয়, তাহলে পাঠক বুঝবে… সেখানে কোনও আত্মা কথা বলছে, যাকে লেখা হয়নি, সে নিজেই লিখছে।

ঋদ্ধি জানে, এই গল্প শেষ করতে গেলে তাকে লিখতে হবে—যেমনটা সৌম্য মিত্র চেয়েও পারেননি। কিন্তু সেই লিখন কাদের হয়ে? কাদের নামে? আর শেষ পর্যন্ত, তার নিজের কলম যখন চলবে… তখন কি সত্যিই সে নিজেই লেখক থাকবে? নাকি নিঃশব্দে কেউ লিখে যাবে, তার নামেই?

অধ্যায় ৭

কলেজ স্ট্রিটের এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকা ‘সৃষ্টিধ্বনি’ নামের একটি পুরনো বইয়ের দোকানে যখন ঋদ্ধি ঢোকে, তখন শহরজুড়ে এক অব্যক্ত উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে। সংবাদপত্রে বেরিয়েছে—সাহিত্যিক সৌম্য মিত্রের মৃত্যুর আগেই একটি “নিষিদ্ধ উপন্যাস” জমা পড়েছিল এক অখ্যাত প্রেসে, যার মূল পাণ্ডুলিপিতে লাল কালি দিয়ে লেখা ছিল “এটা আমার লেখা নয়”। এটি কি সেই একই উপন্যাস? নাকি সম্পূর্ণ অন্য কিছু? প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে, এবং উত্তর খুঁজছে শুধু সাংবাদিকেরা নয়—ঋদ্ধিও।

দোকানের ভেতরে কালো সোয়েটার পরা এক মধ্যবয়স্ক লোক খাতা উল্টাতে উল্টাতে বলে, “আপনাকে কেউ আসতে বলেছিল?” ঋদ্ধি জানায় নিজের পরিচয়, সৌম্য মিত্র ও ‘সায়াহ্ন’-র রহস্য নিয়ে তার গবেষণার কথা। দোকানদার একবার ভালো করে তার মুখের দিকে তাকিয়ে একটা পাতলা খাম এগিয়ে দেয়। “এইটা তিন দিন আগে একটা ছেলেপেলে দিয়ে রেখে গেছে। আপনার নাম ছিল খামের গায়ে।” খোলার পর দেখা যায়, অর্ধেক পুড়ে যাওয়া একটি পাণ্ডুলিপির অংশ—তাতে লাল কালিতে লেখা:
“তোমার পড়া শুরু মানেই আমার লেখা শেষ। এখন তুমি জানো, আমি কে ছিলাম না—তুমি জানবে, তুমি কে হতে চলেছো।”
ঋদ্ধির বুক ধড়াস করে ওঠে। খামের নিচে আবার সেই একই প্রতীক—খোলা চোখের পুতলিতে বসানো কলম।

ঋদ্ধি এরপর ডেকে পাঠায় ইন্সপেক্টর অনিরুদ্ধ সাহাকে। তিনি পাণ্ডুলিপিটি forensic টিমকে দেন। রিপোর্টে দেখা যায়, কাগজটি প্রায় তিরিশ বছর পুরোনো, এবং অদ্ভুতভাবে তার কালি এখনও ভিজে থাকার মতো রং ধরে রেখেছে—কোনও সাধারণ পেন দিয়ে লেখা হয়নি। এমনকি, অক্ষর বিশ্লেষণে উঠে আসে, লেখার ধরনে একইসঙ্গে দুটি হস্তাক্ষরের সমান্তরাল ব্যবহার হয়েছে—যা মানসিক বিভাজনের ইঙ্গিত দেয়। মানে, লেখক হয়তো লিখেছেন দুই ভিন্ন চরিত্রে—একই শরীরে, একই কলমে।

ঋদ্ধি সেই রাতে নিজের ডায়েরির একটি পুরনো পাতা খুলে দেখে—সেখানে একটি অনভিপ্রেত লেখা যুক্ত হয়েছে:
“তুমি লিখেছিলে সায়াহ্ন-কে থামাতে। কিন্তু সে কেবল পাল্টায়, মরে না।”
পড়ার সময় তার মনে হয়, সেই প্রতিটি শব্দ যেন ধাতব ধ্বনি তৈরি করে মস্তিষ্কে। পাণ্ডুলিপির পাতা পড়া মানেই যেন কারও হুইস্পার শুনতে পাওয়া—কানে-কানে, নিরবধি।

রাতে আর ঘুম হয় না। সে তার ল্যাপটপে সেই ‘লালদৃষ্টি’ সাহিত্য গোষ্ঠীর নাম নিয়ে আরও খোঁজ করে। অবশেষে সে খুঁজে পায় একমাত্র জীবিত সদস্য—অভিজিৎ কর, বর্তমানে হুগলিতে একটি নিভৃত আশ্রমে থাকেন। ঋদ্ধি পরদিনই সেখানে পৌঁছায়। অভিজিৎ কর, এক সময়ের খ্যাতনামা কবি, এখন একেবারে নির্জন, চোখে আতঙ্ক। তিনি বলেন, “সায়াহ্ন ছিল একজন নয়। সায়াহ্ন ছিল আমরা সবাই, যার যার মধ্যে ‘লিখে ফেলার আত্মা’ বাস করত। আমাদের সাহিত্য ছিল আত্মাহুতি—আমরা চাইতাম লেখার জন্য সব কিছু ত্যাগ করতে। আর একসময় আমরা বুঝতে পারলাম, কিছু লেখা লেখকের নিজের নয়, কিছু লেখা আত্মা দাবি করে নেয়।”

“তবে কি সৌম্য মিত্র…” — ঋদ্ধি প্রশ্ন করলে তিনি মাথা নাড়েন। “ও ছিল আমাদের মধ্যে সবচেয়ে সংবেদনশীল। ওর মধ্যে সায়াহ্ন পুরোপুরি বসে গিয়েছিল। ও থামতে পারেনি। ওর কলম চলত, অথচ ওর নিজের লেখা মনে হতো না। একটা সময় ও পাণ্ডুলিপির পাশে লিখে যেত—‘এটা আমার লেখা নয়’। তখন আমরা জানতাম, সায়াহ্ন ফিরে এসেছে।”

ঋদ্ধি বাড়ি ফিরে এসে নিজের গবেষণার কাগজপত্রগুলো গুছাতে গিয়ে আবিষ্কার করে, তার নিজের হাতে লেখা কিছু লাইন, যেগুলো তার নিজের বলেই মনে পড়ে না। প্রতিটি লাইনে একটি একই অনুভব—বিচ্ছিন্নতা, ভয়, অজানা নির্দেশ।
“আমি লিখি, অথচ আমি নেই।
যে লেখে, সে চুপ করে থাকে।
যার মুখ নেই, সে-ই লেখে আমার গল্প।”

ঋদ্ধি জানে, সংক্রমণ শুরু হয়ে গেছে। সৌম্য মিত্র তাকে নিয়ে শেষ গল্প লিখে ফেলেছেন। অথবা, সেই শেষ গল্প এখন সে নিজে লিখছে—অথচ কেউ ভেতর থেকে নির্দেশ দিচ্ছে। সায়াহ্ন আর শুধু এক চরিত্র নয়—এখন সে এক পরম্পরা, এক আত্মা, এক নিষিদ্ধ রচনার নির্মাতা। এবং সেই লেখা শেষ হতে পারে কেবল একজন নতুন লেখকের হাত দিয়ে—যার কলমে থাকবে লাল কালি, আর যার গল্পে থাকবে তার নিজের প্রতিচ্ছবির মৃত্যু।

শেষ লাইন লিখে, ঋদ্ধি নিজের দৃষ্টি তুলে দেখে—আয়নার দিকে তাকিয়ে থাকা ছায়া আর তার নয়।
সেই ছায়া শুধু হাসে…… আর বলে—“শুরু করো, শেষ এখানেই হবে না।”

অধ্যায় ৮

কলম হাতে ঋদ্ধি বসে আছে তার টেবিলের সামনে। বাইরে ঝমঝমে বৃষ্টি, আকাশে বজ্রপাতের অন্ধ অন্ধকার। ঘরের বাতাস ভারী, যেন শব্দহীন কণ্ঠস্বর দিয়ে চাপ দিচ্ছে তার কাঁধে। ডেস্ক ল্যাম্পের নিচে শুয়ে আছে সেই পাণ্ডুলিপির শেষ পৃষ্ঠা, যেখানে লাল কালি দিয়ে লেখা—
“তুমি লিখতে শুরু করলে আমি বাঁচি। তুমি থেমে গেলে, আমি শেষ। তুমি কি আমায় শেষ করতে পারবে?”
ঋদ্ধি জানে—এ আর শুধুই এক রহস্য সমাধানের গল্প নয়। এটা সেইসব শব্দের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো, যারা লেখকের উপর অধিকার দাবি করে। সে জানে, যদি এই লেখা শেষ না করে, তবে সায়াহ্ন আরও একজনকে খুঁজবে, আরও এক কলমে প্রবেশ করবে। সুতরাং তাকে লিখতেই হবে—শেষ বাক্যটি, যেটা সায়াহ্ন নিজে লিখতে পারে না।

সে পাণ্ডুলিপি খুলে পড়তে শুরু করে আরও একবার, এবার নিজের ভেতরে ঢুকে যেতে যেতে। প্রতিটি চরিত্র, প্রতিটি সংলাপ তার নিজের জীবনের সঙ্গে মিলে যেতে থাকে। যেন সেই গল্পটা তার জীবনেরই বর্ণনা, অথচ অন্য কেউ লিখেছে। শেষ অধ্যায়ে এসে সে খুঁজে পায় একটি পরিবর্তিত লাইন—যেটা আগে ছিল না:
“তুমি যাকে খুঁজছো, সে আয়নার পেছনে বসে আছে। তুমি লিখবে, আর সে পড়ে যাবে। তার নাম চিরকাল লেখা থাকবে তোমার নামে।”

ঋদ্ধি ভাবে—তবে কি সায়াহ্ন কেবলমাত্র এক আতঙ্কের নাম নয়? সে এক ধরনের চেতনা? এক সাহিত্যিক আত্মা, যে নিজের অস্তিত্বের জন্য শরীর খোঁজে, কলম খোঁজে, কাঁধ খোঁজে? সে নিজে লেখে না, সে লেখায়। আর যারা লেখে, তারা ধীরে ধীরে হারিয়ে যায়। সৌম্য মিত্র চলে গেছেন, কারণ তিনি থামাতে পারেননি। কিন্তু ঋদ্ধি যদি থামতে পারে, যদি সে শেষ করে দিতে পারে সায়াহ্নের গল্প—তবে হয়তো সে নিজেকে ফিরিয়ে আনতে পারবে।

সে কলম তুলে প্রথমবার একটি লাইন লেখে নিজে:
“এই গল্প আমার, এবং আমি একে শেষ করব।”
ঘরটা যেন হঠাৎ নিঃশব্দে গুঞ্জন করতে শুরু করে। বাতি কাঁপে, জানালার কাঁচে বৃষ্টির ফোঁটা থেমে যায়। তার আয়নার দিকে চোখ যায়—সেখানে দেখা যায় না কোনো প্রতিচ্ছবি। কেবল অন্ধকার, কুয়াশাময় শূন্যতা।

ঠিক তখনই ফোন বেজে ওঠে। অপর প্রান্তে ইন্সপেক্টর অনিরুদ্ধ সাহা।
“আমরা আজ বিকেলে আরেকটি তথ্য পেয়েছি। ‘সায়াহ্ন’ নামে ১৯৮৬ সালে এক মানসিক হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন এক যুবক—কবি, যিনি বলেছিলেন, তার লেখা তার নয়, কেউ তার মধ্যে দিয়ে লিখে চলেছে। নাম ছিল তন্ময় বসু। তিনি আত্মহত্যা করেন ছয় মাস পর। তবে তার মৃত্যুর আগে তার লেখা শেষ কবিতার নিচে লেখা ছিল—‘যে লিখে না, সে-ই লেখে।’”

ঋদ্ধির কাঁধ শিউরে ওঠে।
তন্ময় বসু, সৌম্য মিত্র, ‘লালদৃষ্টি’ গোষ্ঠীর মৃত কবিরা…
সবাই ছিল সেই সংক্রমণের শিকার। এবং এখন সে, ঋদ্ধি বসু, সেই রূপান্তরের দ্বারপ্রান্তে।

রাত ২টা ১৭ মিনিট। ঋদ্ধি লেখে—
“সায়াহ্ন, আজ আমি তোমার শেষ করি। তোমার নাম নয়, আমার নাম থাকবে এই লেখার নিচে। তুমি আর কারও হাত না ধরো।”
কলম থামে, বাতি নিভে যায়। চারপাশে নিঃশব্দ। পাণ্ডুলিপি বন্ধ করে সে মাথা তোলে। আয়নার দিকে তাকায়।

প্রতিচ্ছবি ফিরে এসেছে। ক্লান্ত, কিন্তু নিজের।

পরদিন সকালের কাগজে ছোট্ট একটি প্রতিবেদন:
“সাহিত্য গবেষক ঋদ্ধি বসু শেষ করলেন সৌম্য মিত্রের অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি। নাম দিলেন— ‘শেষ পৃষ্ঠা’ । লেখার নিচে ছিল একটি লাইন: ‘এইবার সত্যিই, এটা আমার লেখা।’”

ঋদ্ধি জানে, সায়াহ্ন হয়তো নিঃশেষ হয়নি। তবে এই অধ্যায়ে, তার কলম থেমেছে। আর কেউ যেন না লিখে ফেলে তার হাতে, লাল কালিতে।

সমাপ্ত

1000042182.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *