ইন্দ্রনীল দত্ত
অধ্যায় ১:
কলকাতার উপকণ্ঠে একটা জায়গা আছে যেখানে শহরের শব্দ পৌঁছায় না ঠিকভাবে, শুধু হঠাৎ হঠাৎ ফ্লাইওভারের গম্ভীর গর্জন এসে কানে বাজে। সেখানে রয়েছে একটা ছোট্ট বস্তি—মাটির ঘর, টিনের চাল, বালতিভর্তি বৃষ্টির জল, আর সরু অলিগলি। এই জায়গার নাম বস্তির লোকেরা ‘জিন্নাহ কলোনি’ বলে ডাকে, যদিও কারো আধিকারিক কাগজে সেই নামে কিছু নেই। এখানকার ঘুম ভাঙে অ্যালুমিনিয়ামের প্লেটের ঠুং ঠাং শব্দে, রান্নাঘরের আগুনের শিখায়, আর এক অন্যরকম শব্দে—ফুটবলের শব্দে। হ্যাঁ, প্রতিদিন ভোর পাঁচটা বাজলেই বস্তির মাঠে শুরু হয় এক আশ্চর্য দৃশ্য। ধুলো আর শিশিরে মাখা একটা কাঁচা মাঠ, পাশে নালার ধারে একটা পুরনো ব্যাগের ভেতর থেকে বেরোয় একজোড়া ছেঁড়া ফুটবল বুট, আর তারপর দেখা যায় রাফিক শেখকে। বয়স ষোলো, গায়ের রঙ মাটি মেশানো, চোখে একরাশ দৃঢ়তা, পরনে স্কুলের পুরনো ট্রাউজার আর ফাটা জার্সি—কিন্তু সে যখন বলটা পায়ের নিচে রাখে, তখন পুরো মাঠ স্তব্ধ হয়ে যায়। বল তার শরীরের সঙ্গে যেন কথা বলে। সে যখন পায়ের পেছন দিয়ে বল ফেলে দেয় সামনের দিকে, বা মাথার ওপর দিয়ে ওভারহেড কিক মারে, তখন দূরের গাছতলার পাখিরাও থেমে যায়। কোচ মৃণাল ঘোষ, যিনি নিজেই এককালে হাওড়া স্টেট লেভেলে খেলেছেন, নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন মাঠের এক কোণে। তাঁর চোখে মুগ্ধতা—কারণ তিনি জানেন, এই ছেলেটা সাধারণ নয়। প্রতিদিনের মতো আজও তিনি কিছু বলেন না, শুধু একবার বল জালে গড়ালে মৃদু হাসেন। তারপর ধীর পায়ে রাফিকের পাশে এসে দাঁড়ান। “আজ একটু জাম্পিং পাস প্র্যাকটিস করবি, বলটা দু’বার পা ছোঁয়ালে গোল বাতিল,” তিনি বলেন। রাফিক কিছু বলে না, মাথা নাড়ায়, আবার মাঠে ছুটে যায়। বল তার ছায়া, মাঠ তার বাড়ি।
তবে মাঠের বাইরে রাফিকের জীবন একেবারেই আলাদা। সকাল সাতটা বাজলেই তার সামনে দাঁড়িয়ে যান আজিজ শেখ, তার বাবা। চোখে রাগ নয়, তবে ক্লান্তি আর হাল ছেড়ে দেওয়া অভিমান। “আজকেও খেলবি? স্কুল নেই? আর কবে বুঝবি রাফিক, এইসব করে কিছু হয় না! আমি বুড়ো হচ্ছি, টোটো চালিয়ে আর কতদিন চলবে?”—আজিজের কণ্ঠে রাগ যতটা না আছে, বেশি আছে ভয় আর পরাজয়ের গন্ধ। রাফিক মাথা নিচু করে থাকে। সে কাউকে কিছু বোঝাতে চায় না এখন, কারণ সে জানে, তার কথা কেউ শুনবে না। কোচ মৃণাল ছাড়া তার স্বপ্নে কেউ বিশ্বাস করে না। সে জানে—পাড়ার মুদি, শিবুদা, পাশের বাড়ির বুড়ো গাফ্ফার কাকু—সবাই ভাবে রাফিক সময় নষ্ট করে। একমাত্র শিবা, তার বন্ধু, পাশে দাঁড়ায় সবসময়। শিবা বলে, “দেখিস রাফু, একদিন তোর খেলা দেখে কলকাতা ক্লাব থেকে লোক আসবে।” রাফিক চুপ করে থাকে, কিন্তু ভেতরে কোথাও একটা ইচ্ছের আগুন জ্বলতে থাকে—অদ্ভুত এক আগুন, যেটা শুধু মাঠে গিয়েই শান্ত হয়। স্কুলের ইউনিফর্ম পড়তে তার ভালো লাগে না, অংক আর ইংরেজি তার কাছে বল কন্ট্রোল আর পাসিং-এর চেয়েও কষ্টকর লাগে। কিন্তু সে জানে, বাবাকে খুশি রাখতে হলে তাকে স্কুল যেতেই হবে। তাই আজ সকালেও খেলার পর সে বাড়ি ফিরে চুপচাপ ইউনিফর্ম পরছে, হাতে বলের জায়গায় ব্যাগ, আর চোখে ফুটে উঠেছে অন্যরকম এক ক্ষোভ—নিজের স্বপ্নের কাছে বিশ্বাসঘাতকতা করার ক্ষোভ।
বিকেলের দিকে আবার বস্তির মাঠে হাজির হয় রাফিক। স্কুলে সে মন বসাতে পারে না। ক্লাসে সবাই তাকে নিয়ে হাসাহাসি করে—“অ্যাই ফুটবলস্টার, বিশ্বকাপে নাম লিখেছিস নাকি?”—রাফিক শুনেও কিছু বলে না। তার মনে শুধু ঘোরে আজিজ শেখের মুখ, তার হতাশ চোখ, আর কোচ মৃণালের সেই একচিলতে হাসি। বিকেলে কোচ বলেন, “একটা স্থানীয় টুর্নামেন্ট হচ্ছে, বড় ক্লাবের স্কাউট আসবে, তোকে খেলতে হবে।” রাফিক চমকে ওঠে, তারপর হাসে না কাঁদে বোঝা যায় না। কোচ তখন বলে, “তোর খেলা যদি মন জয় করে, তোর নাম পৌঁছবে শহরের ক্লাবগুলোতে। তবে এটা শুধু খেলার পরীক্ষা নয়, তোর জীবনেরও পরীক্ষা।” মাঠে শিবা বল নিয়ে ছুটছে, আর রাফিক পায়ের নিচে বল রেখে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর এক মুহূর্তে আবার মাঠের বুকে ঢুকে পড়ে, যেন কোনো যুদ্ধক্ষেত্রে নামছে। বলটা আর শুধু বল নয়, তা যেন তার অস্ত্র, তার ভাষা, তার দম। সূর্য নামছে ধীরে ধীরে, বস্তির আকাশে লালচে আলো, আর তার মধ্যে দিয়ে ছুটছে এক কিশোর—যার মুখে ধুলো, চোখে আগুন। এক বস্তির মাঠে, কলকাতার শহুরে আলো থেকে অনেক দূরে, একটুকরো স্বপ্ন জন্ম নিচ্ছে ধুলো আর ঘামের ভিতর।
অধ্যায় ২:
সকালের আলো যখন ঘরের ফাটল গলে টিনের চালায় বাজতে থাকে, রাফিক তখন চোখ খোলে না, শুধু বিছানায় শুয়ে শুয়ে পাশ ফিরে নেয়। তার শরীর ব্যথায় ভারী হয়ে আছে, কিন্তু তার চেয়েও বেশি ভারী হয়ে আছে মন। গতরাতে বাবা আজিজ তাকে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে—“আর একদিন ফুটবল খেলতে গেলে হাতে-পায়ে ভেঙে দেব।” সে কথাটা বলেছিল রেগে গিয়ে নয়, ঠান্ডা স্বরে, যেন এই নিষেধাজ্ঞা কোনো আবেগ থেকে নয়, বরং বাস্তবতা থেকে উঠে এসেছে। রাফিক জানে, বাবা চায় সে স্কুল ছেড়ে দিয়ে টোটো চালাতে শেখে। পাড়ায় টোটো চালানোর ব্যবসা চলছে, ভালো রোজগার হয়, আজিজও চাইছে ছেলেটা একদিন অন্তত তার গাড়ি চালিয়ে সংসারের বোঝা ভাগ করে নেয়। কিন্তু রাফিকের মাথায় শুধু ফুটবল, সেই মাঠ, সেই বল, সেই শব্দ—যা তাকে আর কিছু ভাবতে দেয় না। সে মনে মনে ভাবে, “আমি যদি বলটা ঠিক মতো পায়ে না পেতাম, তাহলে হয়তো সব কিছু ঠিক থাকত।” কিন্তু সে জানে, বলটাই তার জীবনের সবচেয়ে আপন জিনিস, তার ভাষা, তার শ্বাস-প্রশ্বাস। সকালবেলায় সে উঠে দেখে, রান্নাঘরে বয়ামের কাঁপা কাঁপা গ্যাসের আগুনে বাবা আলু ভাজছে, চোখ মুখ শান্ত, কিন্তু তার উপস্থিতিতেই ঘরটা ভারি হয়ে ওঠে। রাফিক কিছু বলে না, শুধু একটা শুকনো রুটি মুখে দেয় আর স্কুলব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। স্কুলে যাবার পথে পায়ের নিচে খসে পড়া পাতা চুপচাপ গুঁড়িয়ে যায়, কিন্তু তার মনে যেন দপদপ করছে এক অদৃশ্য রাগ, কষ্ট, এবং একরাশ অসহায়তা।
স্কুলে পৌঁছে সে নিজের চেয়ারটায় বসে, কিন্তু স্যার কী পড়াচ্ছেন, কিছুই তার কানে ঢোকে না। তার সামনে খোলা বইয়ের পাতাগুলোর অক্ষরগুলো যেন সরে সরে গিয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে মাঠের সীমারেখার সঙ্গে। রাফিক জানে, এই স্কুলটা তার বাবার শেষ আশ্রয়—তিন বছর আগে তার মা মারা যাবার পর আজিজ একরকম জেদ করে বলেছিলেন, “মার মুখ দেখেও পড়তে হবে তোকে।” কিন্তু সেই কথার মানে রাফিক এখন বুঝতে পারে—সেই জেদ ছিল না আসলে, ছিল একরকম পরাজয় মেনে নেওয়ার চেষ্টা। ক্লাসে হঠাৎ করেই টিফিনের ঘন্টা বাজলে সে যেন সম্বিৎ ফিরে পায়। বাইরে এসে দেখে শিবা দাঁড়িয়ে, হাতে একটা প্যাকেট—ভেতরে দুটো লুচি আর একটা ডিমভাজি। “খা, আজ আমার মামি বানিয়েছে, বেশি দিয়েছে,” বলে শিবা। রাফিক কিছু বলে না, শুধু মাথা নিচু করে খাবার নেয়, দুজনে মাঠের পেছনের ঝোপে বসে। শিবা বোঝে রাফিক কিছু একটা গিলে নিচ্ছে, কথা নয়, কান্না নয়, বরং একরকম হার মেনে নেওয়া। “তোর বাবা তোকে বুঝতে পারে না রে রাফু,” বলে শিবা। রাফিক আস্তে উত্তর দেয়, “তুই বুঝিস তো?” শিবার চোখ চকচক করে ওঠে, “আমি না বুঝলে কে বুঝবে?” তারা চুপচাপ বসে থাকে কিছুক্ষণ। পেছনের মাঠে ফুটবলের আওয়াজ আসছে—স্কুলের অন্য দলের ছেলেরা প্র্যাকটিস করছে, সেই শব্দটা রাফিকের হৃদয়ে ঘা মারে যেন। সে অনুভব করে, আজ তার বলের সঙ্গে দূরত্ব শুধু মাঠের নয়, জীবনের।
বিকেলে যখন কোচ মৃণাল মাঠে আসে, তখন রাফিক আসেনি। সাধারণত সে অনুশীলনের আধঘণ্টা আগেই চলে আসে, জুতো পরার আগে বল নিয়ে একা প্র্যাকটিস করে, কিন্তু আজ সে নেই দেখে কোচ কিছুটা চিন্তিত হয়। শিবা তাকে জানায় রাফিকের উপর বাবা চাপ দিচ্ছে খেলাধুলা ছেড়ে দেওয়ার জন্য। কোচ মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে, তারপর বলে, “অনেক সময় পরিবার স্বপ্নের পথে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়।” সন্ধ্যায় যখন মাঠ ফাঁকা হয়ে গেছে, হঠাৎ করেই দেখা যায় রাফিক ঢুকছে মাথা নিচু করে, হাতে নেই বল, মুখে ক্লান্তি, চোখে অসহায়তা। কোচ কাছে গিয়ে বলে, “আজ তো তোকে দেখি না!” রাফিক ধীরে মাথা নাড়ে, তারপর বলে, “বাবা বলেছে আর খেলতে পারব না। আমি ঠিক জানি না কী করব কোচ।” মৃণাল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, তারপর আস্তে করে বলে, “এই লড়াই তোর একার নয়, রাফিক। অনেকেই হেরে যায় এখানেই। কিন্তু তুই জিততে পারিস। শুধু সাহস ধরে রাখ, আমি আছি পাশে।” সেই রাতে বাড়ি ফিরে রাফিক দেখে, বাবা ঘরের কোণে চুপচাপ বসে আছে। সে কিছু বলে না, শুধু তার চোখের দিকেই তাকিয়ে থাকে। রাফিক তার জুতোজোড়া নিয়ে নিজের বিছানার নিচে রেখে দেয়, জানে না সে আবার মাঠে ফিরতে পারবে কিনা, কিন্তু একটা কথা সে নিজের মনেই উচ্চারণ করে, “যতক্ষণ বলটা আছে, আমি হেরে যাইনি।” বাইরে রাত নামছে, কিন্তু সেই রাতের অন্ধকারে একটুকরো আলো ফুটে উঠছে—সাহস, ক্ষোভ, আর জেদের আলো, যা একদিন হয়তো গোটা শহর দেখবে।
অধ্যায় ৩:
ভোরের আলো তখনো ভালো করে পল্লবিত হয়নি, কিন্তু বস্তির মাঠে ধুলো উড়িয়ে ফুটবল গড়াচ্ছে রাফিকের পায়ের নিচে। শরীরে কোনো ক্লান্তির চিহ্ন নেই, বরং যেন রাগে-জেদে তার পা আরও দ্রুত চলে। বিগত দুই দিন কোচ মৃণাল ঘোষ তাকে খেলার অনুমতি দেননি—চুপচাপ দূর থেকে লক্ষ্য করেছেন শুধু। আজ সকালে তিনিই বল নিয়ে মাঠে নামতে বলেন রাফিককে। তবে প্রথম কয়েকটা ড্রিবলেই সমস্যা দেখা দেয়—জুতো জোড়া আর টিকছে না। ফাটা সোল, ঢিলা ফিতের মাথা ছেঁড়া—একেকটা পাসের সঙ্গে ঝুঁকি বাড়ছে। একবার তো বাঁ পায়ের জুতোটা বলেই ছিটকে পড়ে মাঠের একদিকে। রাফিক থেমে যায় না, খালি পা নিয়েই ড্রিবল করে যায়, চেহারায় ফুটে ওঠে একরাশ হতাশি আর হীনমন্যতা। পাশে দাঁড়িয়ে শিবা চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ, তারপর বলে, “তোর জুতো তো একেবারে শেষ রে ভাই।” রাফিক কিছু বলে না। তার মুখে কোনোরকম অভিযোগ নেই, কারণ সে অভ্যস্ত—শরীরের ব্যথা, সমাজের কটুক্তি, বাবার গালমন্দ, ফাটাফাটা জুতো সবকিছুর সঙ্গে বাস করতে শিখে গেছে। কোচ মৃণাল পেছন থেকে এসে বলে, “জুতো না থাকলে খেলা হয় না রাফিক, কিন্তু খেলার ইচ্ছে থাকলে জুতো এসে যাবে, সময়মতো। তবে তোর এই মনটা যদি হারিয়ে যায়, কিছুই ফিরবে না।” সেই কথা শুনে রাফিক কেবল মাথা নিচু করে হাঁটে। তার মনে হয়, শুধু একটা জুতো যদি থাকত, তাহলে হয়তো অনেক কিছু বদলে যেত। কিন্তু এখানে, এই বাস্তবের মাঠে, একজোড়া ভালো জুতো পাওয়া যেন চাঁদের গায়ে হাত দেওয়া।
দুপুরে রাফিক বাড়ি ফিরলেও খায়নি কিছু, কেবল স্কুল ব্যাগটা পাশে রেখে বিছানায় গড়িয়ে পড়ে। বারবার নিজের পায়ের দিকে তাকিয়ে তার মনে হতে থাকে, বলটা যেমন গড়াতে জানে, তার স্বপ্নটাও তেমনি গড়িয়ে গড়িয়ে দূরে সরে যাচ্ছে। তার পাশে যে কেউ দাঁড়াবে না, তা সে জানে। বাবা দুপুরে এসে ঝাঁঝিয়ে ওঠেন—“আজও খেলতে গেছিস? আমি না বলেছি, আর মাঠে যাবি না?”—রাফিক মাথা নিচু করে থাকে। কোনো প্রতিবাদ নেই, কোনো যুক্তিও না। এটাই এখন তার জীবন—অভিমান গিলে নেওয়া, স্বপ্নকে ঘরে তালাবন্দি করা। সেই রাতে শিবা আসে তার ঘরে, হাতে একটা পুরনো শপিং ব্যাগ। “চোখ বন্ধ কর,” বলে সে। রাফিক অবাক হয়ে চোখ বন্ধ করে। যখন চোখ খোলে, দেখে ব্যাগের ভেতরে একটা একেবারে নতুন জুতোজোড়া—কালো আর সাদা স্ট্রাইপের, চকচকে নয়, কিন্তু একদম মাপমতো। রাফিক প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারে না। “এটা কোথা থেকে এল রে?” শিবা হেসে বলে, “আমার মামা একটা গুদামে কাজ করে, সেখান থেকে কিছু ছেঁড়া-ফাটা জিনিস আলাদা করে দেয়, আমি সেটা সেলাই করে ঠিক করিয়ে এনেছি। পুরনো হলেও টেকসই। এখন আর খেলায় দোষ হবে না।” রাফিক চুপ করে থাকে, চোখ দুটো জলের মতো ভিজে ওঠে। সে শিবাকে জড়িয়ে ধরে, কিছু বলে না। এই বন্ধুত্ব, এই বোঝাপড়া, এই সহানুভূতি—এই জিনিসগুলো কোনো বড় শহরের ক্লাব, কোনো ট্রফি দিতে পারবে না। সেই রাতে রাফিক জানে, একজোড়া জুতো পেয়েছে সে, কিন্তু তার থেকেও বড় জিনিস সে পেয়েছে—একজন ভাইয়ের মতো বন্ধু, যে তার স্বপ্নের পাশে দাঁড়ায় নিঃশব্দে।
পরদিন সকালে মাঠে যখন রাফিক আসে, তখন তার পায়ে সেই নতুন জুতো, এবং মুখে এক অদ্ভুত দৃঢ়তা। বলটা এখন যেন আরও ভালো করে চলে তার পায়ের সঙ্গে। কোচ মৃণাল মুগ্ধ হয়ে বলেন, “আজকের ড্রিল হবে নন-স্টপ পাসিং, ৩ মিনিট ধরে। তুই পারবি?” রাফিক কোনো কথা না বলে বল নিয়ে দাঁড়ায়। মাঠের ধুলো, আশেপাশের ছেলেদের চিৎকার, দূরের ল্যাম্পপোস্টের নিচের অন্ধকার কিছুই তাকে স্পর্শ করতে পারে না। তিন মিনিটের সেই ড্রিলে সে ভুল করে না একবারও। বল একবারের জন্যও বাইরে যায় না, পা থেকে পায়ে, নিখুঁত ছন্দে চলে। মৃণাল এবার পাশে দাঁড়িয়ে বলে, “তোর খেলায় আগুন আছে রাফিক, এখন দরকার সেই আগুন ধরে রাখার সাহস।” মাঠের একপাশে দাঁড়িয়ে শিবা তালি দেয়—চোখে তার গর্ব, মুখে আনন্দ। বিকেলে, যখন মাঠ ফাঁকা হয়ে আসে, তখন কোচ চুপচাপ রাফিককে ডাকে, বলে, “একটা ম্যাচ হচ্ছে আগামী রবিবার, স্থানীয় ক্লাবের সঙ্গে, বড় স্কাউট আসবে—তুই প্রস্তুত থাক।” রাফিক শুধু মাথা নাড়ে। সেই মুহূর্তে তার মুখে কোনো কথা নেই, কিন্তু তার হৃদয়ের ভিতরে বাজতে থাকে একটাই শব্দ—“আমি পারব, আমি পারতেই হবে।” মাঠে সূর্য নেমে আসে ধীরে ধীরে, আর সেই আলোয় দাঁড়িয়ে থাকে এক কিশোর, যার হাতে নেই কোনো ট্রফি, ঘরে নেই বৈদ্যুতিক আলো, কিন্তু যার পায়ে আছে বল, পায়ে আছে জুতো, আর চোখে আছে সেই প্রাচীন, অদম্য স্বপ্ন—যেটা হার মানে না, কোনো লাল কার্ডের ভয়েও না।
অধ্যায় ৪:
রবিবার সকালটা যেন ভিন্নরকম আলোয় জেগে উঠেছিল রাফিকের কাছে। বস্তির মেঘলা আকাশ, মাঠের চারপাশে জমে থাকা কাদা, পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কিছু মাতাল পাড়ার বয়স্ক মানুষ—সব কিছুই ছিল আগের মতো, কিন্তু রাফিকের মনে ছিল এক অনির্বচনীয় উত্তেজনা। আজ তার জীবনের প্রথম বড় ম্যাচ, যেখানে কোচ মৃণাল ঘোষের ডাকে সে নামছে বস্তির ছেলেদের টিমের হয়ে, সামনে শহরের নামী স্থানীয় ক্লাব ‘ব্রাদার্স ইয়ুথ’। শুনেছে, মাঠে থাকবে একজোড়া চোখ—একজন স্কাউট, যার সিদ্ধান্তে বদলে যেতে পারে জীবন। শিবা তার কাঁধে হাত রেখে বলল, “তুই খালি নিজের মতো খেল, ব্যস। বাকি সব আমি সামলে নেব।” রাফিক একটা হালকা হাসি দিল, কিন্তু তার ভেতরে যেন বোমা ফাটার মতো কিছু চলছিল—ভয়, আত্মবিশ্বাস, জেদ, আর একটা অসম যুদ্ধের প্রস্তুতি। খেলা শুরু হয় সকাল ন’টায়, প্রথম থেকেই দুই দলের মধ্যে চলতে থাকে দারুণ প্রতিযোগিতা। শহরের ক্লাবের ছেলেরা ইউনিফর্মে সুসজ্জিত, তাদের বুট, হেয়ারস্টাইল, আর চোখের দৃষ্টি থেকেও বোঝা যায় তারা অনেক বেশি সুবিধাজনক পজিশনে। কিন্তু রাফিক যেন আজ ভিন্ন মানুষ—বল পেয়ে সে যেভাবে ছুটছে, ড্রিবল করছে, ফ্ল্যাঙ্ক চেঞ্জ করছে, তা দেখে আশেপাশের দর্শকদের চোখ আটকে যায়। শিবাও দুই নম্বর জার্সি পরে তাকে সাহায্য করছে—দুই বন্ধু যেন মাঠে এক অনবদ্য সমতা তৈরি করেছে। প্রথমার্ধে স্কোর হয় ১–০, রাফিকের পাস থেকেই গোল করে দেয় শিবা।
কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধে খেলার রং বদলাতে শুরু করে। শহরের ক্লাবের এক খেলোয়াড়, নাম তুষার, যে ডিফেন্সে খেলে, বারবার ফাউল করে রাফিককে আটকানোর চেষ্টা করে। কোচ মৃণাল মাঠের সাইডলাইন থেকে চিৎকার করে রেফারিকে বলে, “মারছে ছেলেটাকে, কিছু দেখছেন না?”—কিন্তু রেফারির চোখ যেন অন্যদিকে। রাফিক তার খেলায় মন দেওয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু একটা সময় আসে যখন তুষার তার পেছন থেকে পায়ে কিক করে সরাসরি ফেলে দেয় মাঠে। রাফিক মুহূর্তে উঠে দাঁড়ায়, রাগে তার চোখ লাল হয়ে যায়। গায়ে কাদা, ঠোঁট ফেটে গেছে, কিন্তু তার মাথার ভেতরে তখন যেন আগুন জ্বলছে। সে তুষারকে সামনে দাঁড়িয়ে দেখে আর নিজেকে আর আটকাতে পারে না—এক লাফে গিয়ে তাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয় মাঠে। চারদিকে হৈ চৈ পড়ে যায়, দুই দলের প্লেয়াররাও ঘিরে ধরে, গ্যালারি থেকে চিৎকার আসে—“ফাউল! লাল কার্ড! মারামারি!” রেফারি বাঁশি বাজিয়ে সোজা এসে রাফিকের সামনে দাঁড়ায়, তার পকেট থেকে বের করে একটা উজ্জ্বল লাল কার্ড—যেটা দেখেই রাফিকের সমস্ত শরীর যেন জমে যায়। সে যেন বিশ্বাসই করতে পারে না—তার স্বপ্নের দিনে, এমন একটা মুহূর্তে সে মাঠ থেকে বের করে দেওয়া হল! কোচ মৃণালের মুখ কালো হয়ে যায়, সে কিছু বলার আগেই রাফিক মাথা নিচু করে মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে আসে। শিবা ছুটে আসে পেছনে, বলে, “তুই ভুল করিসনি রে, ওরা তোকে ফেলে মারছিল!”—কিন্তু রাফিক কিছু শুনতে পায় না, শুধু দূর থেকে শুনতে পায় গ্যালারির লোকেরা বলছে, “এই ছেলে তো মাথার ঠিক নেই! বড় ফুটবল খেলবে নাকি?”—সে ছুটে যায় মাঠের বাইরে, গলির ভেতরে, একা।
সন্ধ্যেবেলায় মাঠ ফাঁকা, কোচ মৃণাল একা বসে আছেন সাইডলাইনের বেঞ্চে, হাতে একটা পুরনো নোটবুক। পাশে এসে দাঁড়ায় শিবা, বলে, “রাফিক বাড়ি ফিরে গেছে, কারো সঙ্গে কথা বলেনি।” কোচ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, “খেলার মাঠে আবেগ কখনো কখনো ভয়ঙ্কর শাস্তি নিয়ে আসে। কিন্তু রাফিকের ভেতরে আগুন আছে—সে আগুন বাঁচিয়ে রাখতে হলে তাকে বুঝতে হবে, লড়াই মাঠে বল দিয়েই হয়, হাত দিয়ে নয়।” সেই রাতে, নিজের ঘরের কোণে বসে রাফিক জুতোজোড়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। আজকের খেলায় তার পা ভালোই কাজ করেছিল, কিন্তু মাথা হেরে গিয়েছিল। বাবার কথাও মনে পড়ে—“খেলাধুলা দিয়ে কিছু হয় না, মাথা খারাপ হয়ে যাবে।” এখন সে বুঝতে পারে, বাবা বাস্তবের কথা বলতেন, কিন্তু সে কখনো তাকে বোঝায়নি যে স্বপ্নও বাস্তব হতে পারে। চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে, কিন্তু সে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। পাশে রাখা টুকরো খবরের কাগজে লেখা, “বস্তির লড়াইয়ের মাঠে উত্তেজনা, ফুটে উঠল প্রতিভা ও প্রতিশোধ।” রাফিক জানে, এই লাল কার্ড শুধু একটা কাগজ নয়—এ এক প্রতীক, একটা চাবি যেটা হয় তাকে শেষ করে দেবে, নয়তো এক নতুন দরজা খুলে দেবে। সে জানে না ভবিষ্যৎ কী হবে, কিন্তু সেই মুহূর্তে সে দাঁড়িয়ে প্রতিজ্ঞা করে—“আমি ফিরে আসব। এই মাঠেই, এই লাল কার্ডকে জবাব দেব।” মাঠে তখন অন্ধকার, কেবল দূরে গ্যাসের আলো টিমটিম করে জ্বলছে, আর এক কিশোর তার ছেঁড়া জার্সির নিচে আগুন পুষে যাচ্ছে চুপচাপ।
অধ্যায় ৫:
যেদিন মাঠ থেকে লাল কার্ড হাতে বেরিয়ে এসেছিল রাফিক, সেদিন তার পৃথিবী যেন থেমে গিয়েছিল। শরীরের প্রতিটি শিরায় ক্ষোভ আর অপমান জমে জমে একটা পাথরের মতো ভার সৃষ্টি করেছিল তার বুকের মাঝে। সেই রাতটা সে আর নিজের ঘরে কাটায়নি। ঘরে ফিরলে বাবার চোখে হয়তো তাচ্ছিল্য দেখত, হয়তো শুনতে হত, “আমি তো বলেছিলাম, ফুটবল দিয়ে কিছু হয় না।” তাই সে চুপচাপ চলে আসে পাশের গলির মাথায় থাকা আফসানা খালার ঘরে। আফসানা খালা তার মায়ের বয়সী, ছোটবেলা থেকে রাফিকের মাথায় হাত রেখে কথা বলে, খিদে পেলে ভাত খেতে দেয়, ঠান্ডা লাগলে পুদিনা চা বানিয়ে দেয়। খালার ছোট্ট একচালা ঘরের একপাশে কাঁথা পেতে সে বসে পড়ে, কোনো কথা না বলে, কোনো ব্যাখ্যা না দিয়ে। খালা তার মুখ দেখে কিছু বোঝে না, কিন্তু অভ্যাসবশত আঁচল দিয়ে রাফিকের মাথা মুছে দেয় আর বলে, “বলো মা, কী হয়েছে?” রাফিক চুপ করে বসে থাকে। গলার কাছে আটকে থাকা কান্নাটা আর পেছনে ঠেলে রাখা যায় না। সে হঠাৎ করেই মাথা গুঁজে দেয় খালার কোলে আর ফুপিয়ে কাঁদে—একটা নির্ভরতার জায়গা পেয়ে তার ভেতরের আগুন আর ধরে রাখা যায় না। খালা কোনো প্রশ্ন করে না, কেবল তার চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে, “আমরা গরিব মা, আমাদের জীবনটা মাপের মতো না। আমরা এক পা বাড়ালে দশজন টেনে ধরে, আর তুই সেই টানটা উপেক্ষা করে বল নিয়ে ছুটতে চাস। তাই তো তোকে এত লাগে। কিন্তু মন খারাপ করিস না, খেলার মাঠে যদি একদিন লাল কার্ড এসে থাকে, মনে রাখিস, সেটা তোকে খেলার বাইরে ফেলতে পারে, খেলোয়াড়ের মন থেকে নয়।”
সেই রাতে খালার ঘরে একটা পুরনো কুপির আলোয় বসে রাফিক ভাত খায়, মুখে রুচি নেই, কিন্তু খালা বারবার ঠেলে দেয়—“জোর করে হলেও খা, না খেলে তোর শক্তি ফিরবে না।” খাওয়ার পর খালা তার পুরনো কম্বলের নিচে কাঁথা পেতে দেয়, নিজে পাশে বসে থাকে। বাইরে থেকে ট্রেনের হুইসেল শোনা যায়, দূরে কুকুরের ডাক, ছিন্ন ছাঁড়া শহরের কিছু চেনা অচেনা শব্দে ভেসে আসে সেই বস্তির উপকণ্ঠ। রাফিক চুপচাপ বলে, “আমার বাবা কখনো বোঝে না খালা, সে ভাবে আমি শুধু খেলতে চাই বলেই খেলি, কিন্তু ও জানে না, আমি বলটা না পেলে নিঃশ্বাস নিতে পারি না।” খালা একটু হাসে, বলে, “তোর বাবা যা বলছে, তা তার অভিজ্ঞতা থেকে বলছে। মানুষ যা দেখে এসেছে, সে তার বাইরে ভাবতে পারে না রে মা। তুই একটা আলাদা পথ নিতে চাস, তাই বাধা বেশি আসছে।” রাফিক চুপ করে থাকে। সেই চুপ করে থাকাটাই হয়তো তার আসল অভিমান, কারণ সে বুঝে গেছে, কেউ কিছু না বললেও তার ভেতরের যন্ত্রণা কাউকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। খালা বলে, “তুই যদি সত্যিই বিশ্বাস করিস নিজের ওপর, তাহলে এই লাল কার্ড তোর পায়ের নিচে থাকবে একদিন, মাথার ওপর নয়।” সেই কথা শুনে রাফিক কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে, তারপর বলে, “কোচ দাদাকে আমি মুখ দেখাব কীভাবে খালা? ও তো কত ভরসা করেছিল আমার ওপর।” খালা বলে, “ভরসা থাকলেই তো ভুল হয়, আর ভুল হলেই তা শুধরানো যায়।” রাত বাড়ে, কুপির আলো নিভে আসে ধীরে ধীরে, কিন্তু রাফিকের ভেতরে এক নতুন আলো জ্বলে ওঠে—এবার সে শুধু ফুটবলার নয়, এবার সে একজন যোদ্ধা।
পরদিন সকালে সূর্য ওঠার আগেই রাফিক খালার ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে। সে পেছনে ফিরে খালাকে বলে, “একটা কাজ করে ফেলতে হবে খালা, তারপর দেখি কী হয়।” খালা জানে না কী কাজ, কিন্তু মাথা নাড়ে। রাফিক ছুটে চলে যায় মাঠের দিকে। মাঠ তখন ফাঁকা, শুধু কোচ মৃণাল একা দাঁড়িয়ে জার্সি ভাঁজ করছেন। রাফিক কিছু না বলে সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। মুখ নিচু, কিন্তু চোখে দৃঢ়তা। “আমি ফিরে আসতে চাই কোচ। আমাকে একটা সুযোগ দিন। আমি এবার আমার আবেগকে বলের ভিতর ঢুকিয়ে দেব, কারও মুখে না।” কোচ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, “তুই জানিস, একটা ভুল অনেক কিছু নষ্ট করে দিতে পারে, কিন্তু যেটা ফেরত পাওয়া যায়, তা হল সাহস। আজ থেকে আবার অনুশীলন শুরু কর।” রাফিক যেন বিশ্বাসই করতে পারে না। তার মুখে আলোর রেখা, মুখে কোনো কথা নেই, শুধু পায়ের কাছে বলটা রেখে সে মাথা নিচু করে বলে, “ধন্যবাদ কোচ।” কোচ তখন বলে ওঠেন, “এই ‘ধন্যবাদ’ কথাটা মাঠে বল দিয়ে বোঝা দে, মুখ দিয়ে নয়।” বলটা পায়ে নিয়ে আবার ছুটতে শুরু করে রাফিক, নতুন জুতোটা যেন আরও শক্ত হয়ে উঠেছে পায়ের সাথে। তার মাথার ভিতর তখনো লাল কার্ডের ছবিটা গেঁথে আছে, কিন্তু এবার সেটা তাকে থামাতে নয়, তাকে তাড়া দিতে এসেছে। লাল কার্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে তার দ্বিতীয় প্রেরণা, যার রঙ এখন আর রক্ত নয়, বরং এক অবিনাশী লড়াইয়ের প্রতীক। মাঠের ওপারে সূর্য উঠছে ধীরে ধীরে, আর সেই আলোয় ছুটে যাচ্ছে রাফিক—একটা অশ্রুসিক্ত রাতের শেষে নতুন স্বপ্ন নিয়ে।
অধ্যায় ৬:
সকাল ছ’টা। অন্যদিনের মতো আজও মাঠে প্রথম হাজির হয় রাফিক। পায়ে তার সেই জুতোজোড়া, যা নতুন নয়, কিন্তু এখন তার বিশ্বাসের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোচ মৃণাল স্যারের দেওয়া দ্বিতীয় সুযোগটা সে কোনওভাবেই নষ্ট করতে চায় না। কিন্তু আজকের অনুশীলনের মাঝেই বারবার তার চোখ চলে যাচ্ছে গ্যালারির পাশে রাখা একটা বেঞ্চের দিকে, যেখানে দু’দিন ধরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে এক অপরিচিত, ছিমছাম পোশাকের, আধুনিক পোশাক পরা এক মহিলা। সেদিন অনুশীলন শেষে সে নিজেই এগিয়ে এলেন—“তুমি রাফিক শেখ, না?” বিস্মিত রাফিক মাথা নাড়ল। মহিলা বললেন, “আমি শৈলজা সেন, সাংবাদিক। আমি তোমার খেলা দেখেছি সেদিন টুর্নামেন্টে। তোমার ফাউলের পর যেটা লাল কার্ড হল।” রাফিক একটু চমকে গেল—তার কীর্তি নিয়ে একজন সাংবাদিকের আগ্রহ আছে, এটা তার কল্পনারও বাইরে ছিল। শৈলজা বললেন, “সেদিনের প্রতিবেদনটা আমি লিখেছি—‘লাল কার্ডের ছেলেটা’। বেশ পাঠক পেয়েছে। শুনেছি, তুমি আবার মাঠে ফিরেছ। আমি চেয়েছিলাম নিজের চোখে দেখার জন্য।” রাফিক মাথা নিচু করে বলে, “আমি ভুল করেছিলাম দিদি, কিন্তু এবার আর করব না। আমি শুধু খেলতে চাই।” শৈলজা তার কাঁধে হাত রাখলেন, “তোমার ভেতরে যে আগুন আছে, সেটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে শিখলে অনেক দূর যাবে। আমি চেষ্টা করব যাতে আরও অনেকে তোমাকে দেখতে পায়।” সেদিন প্রথমবার, মাঠের বাইরে দাঁড়িয়ে কেউ রাফিকের পাশে দাঁড়াল—বিনা শর্তে, বিনা চাপে। এই শহরের যান্ত্রিক গণ্ডির বাইরে থেকেও কেউ তার নাম মনে রাখছে—এটা তার কাছে এক নতুন রকম সাহস।
কিন্তু এই সাহসের ভিতরেই বাড়ছে আরেক যুদ্ধ, যেটা মাঠের ভিতরে নয়, বরং চার দেওয়ালের মধ্যে। বাবা আজিজ শেখ, যিনি আগেও ফুটবলকে অপছন্দ করতেন, এখন রীতিমতো বিরক্ত। “এই মেয়েটা তোর পেছনে ঘুরছে কেন? সাংবাদিক মানে কি মন্ত্রী? তোর এই খেলার ভেলকি দিয়ে কী হবে বলতো?”—এমন প্রশ্ন প্রতিদিনই রাফিককে শুনতে হয়। শুধু তাই নয়, পাড়ার মানুষও ফিসফিস করছে—“মাঠে খেলে নাম হয় না রে ভাই, চালাতে হলে সংসার চালা।” এমনকি স্কুলের কিছু শিক্ষকও মন্তব্য করেন—“লড়াই করছ, ভালো কথা, কিন্তু কেরিয়ার তো চাই।” একদিকে কোচ মৃণাল, শৈলজা সেন—এই দুটি মানুষ তার স্বপ্নকে রঙ দিতে চাইছে, আর অন্যদিকে তার পরিবার, সমাজ, অর্থনৈতিক বাস্তবতা তাকে প্রতিনিয়ত পেছনে টানছে। শিবা অবশ্য এখনও পাশে, কিন্তু তারও সমস্যা আছে—তার বাবা গত সপ্তাহে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, বাড়িতে রোজগার বন্ধ। তার মধ্যে দাঁড়িয়ে রাফিক একদম একা হয়ে যায় অনেক সময়। এক সন্ধ্যায়, মাঠে অনুশীলনের শেষে, সে বসে থাকে একা, বলটা পাশে রেখে, চোখ ফাঁকা। কোচ এসে বলে, “কি রে, আজ বল ঠিকমতো গড়াচ্ছে না কেন?” রাফিক মাথা নাড়ায়, বলে, “মাঠে সব ঠিক, কোচ, কিন্তু মাঠের বাইরে খুব অন্ধকার। সবাই টেনে ধরে, কেউ বুঝতে চায় না যে আমার জীবন বল ছাড়া অসম্পূর্ণ।” কোচ হালকা হাসেন, “জীবনে মাঠের বাইরেও অনেক ফাউল হয়, কিন্তু রেফারি থাকে না। তাই বুঝতে হয়, কোনটাকে পাত্তা দিতে হবে, আর কোনটাকে উপেক্ষা করে খেলতে হবে।”
এই সময়েই একদিন বিকেলে শৈলজা সেন খবর নিয়ে আসে—একটি বড় ক্লাবের জুনিয়র স্কাউট রাফিকের খেলার ভিডিও দেখতে চেয়েছেন। শৈলজা ইতিমধ্যে তার ভিডিও পাঠিয়েছে। তারা চাইছে তাকে ট্রায়ালে ডাকার জন্য, যেখানে কলকাতার বিভিন্ন এলাকা থেকে বাছাই করা প্রতিভাবান কিশোররা আসবে। রাফিক শুনে স্তব্ধ হয়ে যায়। তার চোখে যেন কিছু সময়ের জন্য আলো নেমে আসে। কিন্তু পর মুহূর্তেই তার মুখে দ্বিধা ফুটে ওঠে—“ট্রায়ালের দিন আমার স্কুলের পরীক্ষা পড়েছে। বাবা জানতে পারলে যেতে দেবে না। আর সাউথ কলকাতায় যেতে হলেও ভাড়া দরকার হবে, যা আমার কাছে নেই।” শৈলজা বলে, “আমি ব্যবস্থা করব, তোমাকে যেতে হবে। অনেক বাধা আসবে, কিন্তু আজ যদি পিছিয়ে যাও, তাহলে আগামীকাল কেউ আর সুযোগ দেবে না।” রাফিক তখন বোঝে, এবার সে একেবারে বাঁধার মুখোমুখি—যেখানে আর শুধু খেলার জন্য খেলছে না, বরং নিজের অস্তিত্ব বাঁচানোর জন্য খেলতে হবে। সে চুপ করে বলে, “আমি যাব, যেভাবেই হোক।” সেই রাতটা সে জেগে কাটায়, বিছানায় শুয়ে ছাদের দিকে তাকিয়ে ভাবে, “এই জীবনটা যদি একটা ম্যাচ হত, তাহলে আজ আমি লাল কার্ড পেয়ে বেরিয়ে যেতাম। কিন্তু এটা তো জীবন, এখানেও ফেরার রাস্তা আছে, যদি আমি সেটা খুঁজে পাই।” দূরে রাতের ট্রেন যায়, বাতাসে ছড়ায় ধুলোর গন্ধ, কিন্তু রাফিকের ভেতর সেই মুহূর্তে জন্ম নিচ্ছে এক নতুন সংকল্প—এই জীবন সে শুধু বাঁচবে না, জিতবে।
অধ্যায় ৭:
রবিবার ভোরবেলা যখন শহরের অনেকেই তখনো ঘুমিয়ে, রাফিক বেরিয়ে পড়ে তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লড়াইয়ের দিকে। শৈলজা সেন তাকে আগের দিন একসেট হালকা নীল জার্সি, একটা হ্যান্ড স্যানিটাইজার, আর কিছু শুকনো খাবার দিয়েছিলেন—সবকিছুর চেয়ে বড় ছিল তার মুখের কথা: “তুমি যাও, ভয় পেও না, তুমি এই শহরের হাজার ছেলের থেকে আলাদা।” রাফিক টোটোর ভাড়া বাঁচাতে ভোরেই হেঁটে চলে আসে মেইন রোড অবধি, সেখান থেকে লোকাল ট্রেনে দাঁড়িয়ে পৌঁছায় দক্ষিণ কলকাতার সেই নামকরা মাঠে, যেখানে ট্রায়ালের আয়োজন। গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেদের দেখে সে অবাক হয়—তারা সকলেই ঝকঝকে ইউনিফর্ম পরা, কেউ মোজা পর্যন্ত মিলে গেছে জার্সির রঙে, কেউ স্টাডেড বুট পরে ছবি তুলছে। রাফিক একটু দূরে দাঁড়িয়ে পেছনের ব্যাগে হাত রাখে—তার সেই পুরনো বুট, যেটা শিবা সেলাই করে দিয়েছিল, তার জার্সি ভাঁজ করে রাখা, আর একরাশ আত্মবিশ্বাস যা তার গলার কাছে দলা পাকিয়ে আছে। মাঠে ঢোকার আগে তার নাম ডাকা হয়, “রাফিক শেখ?” সে হাত তুলে বলে, “আমি।” রেজিস্ট্রেশন ভলান্টিয়ার একটা হাসি দিয়ে বলে, “বসো, তোমার গ্রুপ ডি, এক ঘণ্টা পর ডাক পড়বে।” সে মাঠের একপাশে বসে, মাথার ভিতর চক্কর খায়—আজকের খেলার ফল নির্ভর করবে তার পরবর্তী পথের উপর।
এক ঘণ্টা পর তার নাম ডাকা হয়। সে উঠেই মাঠে নামে, চারপাশে নজর যায়—গ্রুপে আছে শহরের নানা স্কুলের, একাডেমির, প্রাইভেট কোচিংয়ে তৈরি হওয়া ছেলে, যাদের গায়ে আত্মবিশ্বাসের চেহারা, শরীরে পেশীর দৃঢ়তা। রাফিক জানে না তাদের অভিজ্ঞতা কেমন, কিন্তু জানে নিজের মাঠের ধুলো গায়ে মাখা দিনের পর দিন তাকে তৈরি করেছে অন্যভাবে। ট্রায়ালের কোচ, যিনি মূল ক্লাবের জুনিয়র স্কাউট, বলেন, “তোমরা সবাই আজ পঁচিশ মিনিটের একটা ইনটেনস ম্যাচ খেলবে। আমাদের ফোকাস থাকবে স্পিড, পজিশনিং, পাস অ্যাকিউরেসি, আর ম্যাচ সেন্সের উপর।” তারপর খেলা শুরু হয়। প্রথম দশ মিনিটেই রাফিক তার ছন্দ খুঁজে পায়—ডান দিক থেকে লম্বা রান, একের পর এক নিখুঁত ক্রস, এবং একবার গোলের মুখ থেকে ক্লিয়ারেন্স—সবই নজর কাড়ে। তার প্রতিটি মুভমেন্টে একটা প্রাণ আছে, একটা অভিজ্ঞতা, যা শহরের ছেলেদের প্র্যাকটিসে শেখানো হয় না—তা আসে মাঠের কাঁদা মেখে শিখতে হয়, অভাবের ভিতর থেকে গড়ে নিতে হয়। একসময় একটা বল পায় সে মাঝমাঠে, একজন খেলোয়াড় পেছন থেকে চাপ দিচ্ছে, সামনে তিনজন, কিন্তু সে এমনভাবে ঘুরে বল ছাড়ে যে গোলের ঠিক আগে থাকা ছেলেটা মাত্র এক পায়ে গোল করে দেয়। পুরো মাঠ স্তব্ধ, কোচের মুখে মৃদু প্রশংসা—“নাইস ভিশন, বস্তির ছেলে বলে মনে হয় না।” সে কথা শুনে রাফিক কিছু বলে না, শুধু মনে মনে বলে—“আমার ঠিকানা আমার খেলার মধ্যে।”
ম্যাচ শেষে ক্লান্ত রাফিক মাঠের একপাশে বসে পড়ে। তার পায়ের পাতায় জুতো কামড়ে ধরেছে, শরীর ঘেমে ভিজে গেছে, কিন্তু তার চোখ জ্বলছে। একটু পর কোচ তাকে ডেকে বলেন, “তোমার খেলা ভালো লেগেছে। আমরা চূড়ান্ত তালিকার জন্য তোমাকে বিবেচনা করব।” সেই মুহূর্তে রাফিকের বুকের ভিতর বাজে এক অন্যরকম ঢাকের শব্দ—যেন দুর্গাপুজোর মতো, বিজয়ার মতো, অথবা যেন তার জীবনের প্রথম কোনো প্রাপ্তির মতো। কিন্তু মাঠ থেকে বেরোনোর পর আবার বাস্তব মুখ তুলে দাঁড়ায়—পকেটে ভাড়া নেই, ফোনে ব্যালেন্স নেই, বাবা জানে না সে আজ কোথায়। সে রাস্তার এক চায়ের দোকানে বসে, দোকানদার তাকে এক কাপ চা দেয়, বিনামূল্যে। “কী হইল দাদা, খেলায় নামলেই বুঝি স্টার?”—সে হেসে মাথা নাড়ে, বলে, “এখনো নয়, একদিন হব।” বিকেলে সে ট্রেন ধরে বাড়ি ফেরে, কেউ কিছু জানে না—শুধু কোচ মৃণাল আর শৈলজা সেন। বাড়ি পৌঁছে দরজা খুলে বাবা জিজ্ঞেস করে, “কোথায় ছিলি?” রাফিক উত্তর দেয়, “একটা জায়গায় খেলতে গেছিলাম।” বাবা কিছুমাত্র রেগে না গিয়ে চুপ করে থাকে, কেবল বলে, “আজ সারা দিন দোকানে বসেছিলাম, পিঠে ব্যথা দিচ্ছে।” সেই মুহূর্তে রাফিক চুপ করে বাবার পায়ে হাত রাখে, বলে, “একদিন তুমি গর্ব করবে বাবা, এই পায়ের ব্যথা মিটিয়ে দেব আমি।” বাবা কিছু না বলে তাকিয়ে থাকে, তার চোখে কঠোরতা নেই, কেবল একধরনের হতবাক হয়ে যাওয়া স্বীকৃতি। রাতে, নিজের ঘরে, জানালার পাশে দাঁড়িয়ে রাফিক আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবে—আজ মাঠে সে আবার ফিরেছে, এবার কেউ তাকে লাল কার্ড দেখায়নি। এবার সে বল দিয়েই উত্তর দিয়েছে—নিজেকে, সমাজকে, আর নিজের অতীতকেও।
অধ্যায় ৮:
ট্রায়ালের দিন পেরিয়ে গেছে তিন সপ্তাহ। প্রথম সপ্তাহ কাটল অস্থিরতায়—প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যে ফোন হাতে বসে থাকত রাফিক, কখনো শৈলজা সেনকে মেসেজ করত, কখনো কোচ মৃণালের চোখে কিছু ইশারা খুঁজে নিতে চাইত। দ্বিতীয় সপ্তাহে অপেক্ষাটা ক্রমশ বিষণ্ণতায় পরিণত হল। পাড়ার লোকজন জানত না, রাফিক কী লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে, তারা কেবল বলত—“আজকাল তো মাঠেও কম যাচ্ছে ছেলেটা।” বাবা কিছু না বলে ঘরের কাজ করতেন, কিন্তু তার মুখের অভিব্যক্তি থেকে বোঝা যেত, তিনিও বুঝতে পারছেন, ছেলেটার ভেতর কিছু চলছে—অজানা, অথচ গভীর। সেই তৃতীয় সপ্তাহের বুধবার সকালে, যখন রাফিক মাঠে একা প্র্যাকটিস করছিল, হঠাৎ কোচ মৃণাল দৌড়ে এসে চিৎকার করে বললেন, “রাফিক! ফোন ধর! শৈলজা সেন কল করছে!” ধুলো মাখা, ঘামে ভেজা শরীরটা নিয়ে রাফিক ছুটে যায়, ফোনটা কানে ধরতেই ওপার থেকে শৈলজার উত্তেজিত কণ্ঠ—“কনগ্র্যাচুলেশন রাফিক! তুমি সিলেক্টেড! ক্লাবের জুনিয়র ট্রেনিং স্কোয়াডে তোমার নাম ঘোষণা হয়েছে! তুমি রিজার্ভে নয়, সরাসরি মূল স্কোয়াডে যাচ্ছ!” কয়েক সেকেন্ড রাফিক কোনো শব্দই করতে পারে না—তার চারপাশের শব্দ, মাঠের শিস, বাতাসের গন্ধ—সব যেন মিলিয়ে গিয়ে একটা নিঃশব্দ আনন্দের বিস্ফোরণে পরিণত হয়। তারপর সে হঠাৎ করে মাটিতে বসে পড়ে, বলটাকে জড়িয়ে ধরে, আর বলে, “আমি পারলাম কোচ… আমি পারলাম।”
এই খবরে বস্তির চেনা চেহারাগুলোও বদলাতে শুরু করল। আগে যারা বলত, “ফুটবল খেলে কী হবে?” তারা এখন বলে, “ও তো আমাদের পাড়ার গর্ব, খবরের কাগজে নাম এসেছে।” শৈলজা সেনের এক সাক্ষাৎকার বের হল কলকাতার জনপ্রিয় পত্রিকায়—“লাল কার্ড থেকে রুপোলি মাঠ: এক বস্তির ছেলের গল্প।” সেই লেখায় শুধু রাফিকের নাম নয়, উঠে এল তার কোচ, তার বন্ধু শিবা, এমনকি খালার কথাও। একদিন সন্ধ্যায় পাড়ার মোড়ে শিবা দাঁড়িয়ে বলল, “তোর এই খবরে আমার বাবাও আজ হেসেছে রে, বলেছে, ‘ভালো করেছে তোর বন্ধু’।” এই কথাটা শোনার পর রাফিক জানে, তার অর্জন কেবল একটুখানি নাম নয়, বরং চারপাশে আশা ফেরানোর উপাদান। এমনকি আজিজ শেখ, যে কোনোদিন রাফিকের ম্যাচ দেখতে যায়নি, সেদিন ছেলেকে চুপিচুপি জিজ্ঞেস করে, “ওরা কবে থেকে প্র্যাকটিস ডাকবে?” রাফিক বিস্ময়ে বলে, “আপনি জানতে চাইছেন?” বাবা মাথা নিচু করে বলেন, “ভুল করেছি রে, আমি তোকে বোঝার চেষ্টা করিনি। আজ বুঝছি, ফুটবল শুধু বল না, ইচ্ছেরও গল্প।” সেই রাতে রাফিক প্রথমবার বাবার সামনে বসে খায়, দুজনে একসঙ্গে খেতে খেতে নীরবতায় বলে নেয় অনেক কথা—যেগুলো এতদিন জমে ছিল। সেই শান্ত, নিঃশব্দ সন্ধ্যায় যেন বাতাসেও এক নতুন আত্মবিশ্বাস—এখন আর রাফিক একা নয়, তার পাশে দাঁড়িয়েছে পরিবার, পাড়া, শহর, আর তার লাল কার্ড পেরোনো গল্প।
কিন্তু প্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে শুরু হল নতুন এক চাপ—প্রতিযোগিতা। ক্লাবের ট্রেনিং শুরু হল পরের সপ্তাহ থেকে, দক্ষিণ কলকাতার সুবিশাল স্টেডিয়ামে। সেখানে গিয়ে রাফিক প্রথমবার বুঝল, তার চেনা মাঠের চেয়ে এই জায়গা কত আলাদা—জল ঢালার টাইম টেবিল নির্দিষ্ট, প্র্যাকটিসের পদ্ধতি কঠোর, এবং সবচেয়ে বড় কথা, প্রতিটি খেলোয়াড় নিজের জায়গার জন্য মরিয়া। এখানে ভুলের কোনও জায়গা নেই, আবেগ দেখানোর সুযোগ নেই। প্রথম দুদিন তার পা ঠিকমতো চলছিল না, কোচের ধমক খেতে হয়েছিল, একবার তো বলের মিসপাসে পুরো দল গোল খেয়ে বসে—সবাই তার দিকে তাকিয়ে থাকে। রাফিকের মাথা নিচু, চোখে পুরনো সেই ভয়, কিন্তু সন্ধ্যেয় যখন সে ফোন করে খালাকে বলে, “খেলা জমছে না খালা, সবাই বড় বড় ছেলে,” খালা শুধু বলে, “তুইও তো খেলতে গিয়ে লাল কার্ড খেয়েছিলি, তারপরেও ফিরেছিলি, না?”—সেই এক লাইনে তার ভেতরের ভয় গলে জল হয়ে যায়। এরপর সে আর পিছু ফিরে চায় না। প্রতিদিন উঠে পড়ে ঘুম ভেঙে মাঠে ছুটে যায়, অতিরিক্ত ড্রিল করে, কোচের প্রশ্নের আগে উত্তর দেয়। একদিন সেই কঠোর কোচ তাকে বলেন, “তুমি হয়তো শহরের সবচেয়ে দামী প্লেয়ার না, কিন্তু সবচেয়ে ক্ষুধার্ত তুমি—এটাই তোমার আসল শক্তি।” সেই প্রশংসা তার জন্য ট্রফির মতো। বস্তির ধুলো থেকে উঠে আসা যে কিশোর একদিন লাল কার্ড পেয়ে মাথা নিচু করেছিল, আজ সে শহরের মাঠে পা বাড়িয়ে বলে, “এই গল্পটা আমার, এবং আমি এখনও লিখে চলেছি।”
অধ্যায় ৯:
শহরের নামী ক্লাবের হয়ে প্র্যাকটিস শুরু করে কিছু সপ্তাহ কেটে যাওয়ার পর রাফিক বুঝতে পারে, প্রতিযোগিতা শুধু পায়ের খেলার না—এটা মাথার খেলা, সহ্য করার খেলা, প্রতিদিন নিজের অস্তিত্ব প্রমাণ করার খেলা। বস্তির মাঠে সে ছিল একমাত্রার বিস্ময়—সবাই জানত তার নাম, তার পাস, তার দৌড়; কিন্তু এখানে, এই কঠোর পেশাদার পরিবেশে, সে এক নামহীন প্লেয়ার, যাকে নিজের অস্তিত্ব গড়তে হয় প্রতিটি বলের ছোঁয়ায়। সকাল সাড়ে পাঁচটায় স্টেডিয়ামে পৌঁছে এক ঘণ্টার শরীরচর্চা, তারপর পাসিং ড্রিল, ম্যাচ সিচুয়েশন, তারপর ভিডিও বিশ্লেষণ—সাধারণ কোনো ক্লাবে নয়, বড় ক্লাবের জুনিয়র স্কোয়াডে জায়গা করে নেওয়া মানেই মানসিকভাবে প্রতিনিয়ত উত্তীর্ণ হওয়া। কোচ বিক্রম স্যারের চোখ এড়িয়ে কোনো ভুল যায় না, কিন্তু তিনিই একদিন অনুশীলনের মাঝে বললেন, “রাফিক, ডান দিক থেকে ওভারল্যাপ করো, তারপর কিক—যেমন ওই ট্রায়ালে করেছিলে।” সে মুহূর্তে রাফিকের বুকের ভেতর বেজে ওঠে সেই দিনের কথা—ট্রায়াল, অভাব, শৈলজা সেন, শিবার দেয়া জুতো, কোচ মৃণালের অপেক্ষা। সেইদিন যে মুভমেন্টটা তাকে তুলে এনেছিল শহরের আলোয়, আজ আবার সেই পাসের হাত ধরেই সে প্রশংসা পেল। চোখে কোনো অশ্রু নেই, কিন্তু মন জুড়ে একটা অনুভব—সে আজও সেই রাফিক, কিন্তু আর আগের মতো একা নয়।
এই পরিস্থিতির মধ্যেই আসে একটি নতুন চ্যালেঞ্জ—ক্লাবের জুনিয়র টিম বনাম অন্য দুটি শহর ক্লাবের সংযুক্ত টিমের প্র্যাকটিস ম্যাচ। ম্যাচ হবে দর্শকদের সামনেই, কোচিং স্টাফ, সিনিয়র খেলোয়াড়, এমনকি স্পনসররাও মাঠে থাকবে। এই ম্যাচে পারফর্ম করলেই পাওয়া যাবে মূল একাদশে থাকার সুযোগ। দিন গুনতে গুনতে ম্যাচের আগের রাতে রাফিক নিজের ঘরে বসে শিবার সঙ্গে ফোনে কথা বলছিল। শিবা বলল, “এই যে সুযোগটা, এটা অনেক বড় রে। তোর জন্য আমি একটা নতুন ব্যানার বানিয়ে ফেলেছি—‘আমাদের রাফিক’—কাল মাঠে নিয়ে যাব।” রাফিক হাসে, বলে, “পাগল না হলে বন্ধু হওয়া যায় না।” কিন্তু সেই হাসির নিচে একটা চাপা টেনশন। ম্যাচের আগের দিন রাতে সে ঘুমাতে পারে না—জেগে থাকে, বারবার ম্যাচের কল্পনায় ফিরে ফিরে আসে সেই মাঠ, সেই লাল কার্ডের মুহূর্ত, সেই চোখে চোখ রাখা বাবার স্বীকৃতি। সকালে উঠে স্টেডিয়ামে পৌঁছে দেখে, গ্যালারি প্রায় ভর্তি। সে জানে, আজকের গোল হয়তো তার ভবিষ্যতের দরজা খুলে দেবে, কিংবা আবার ছিটকে ফেলবে কোন অন্ধকারে। ম্যাচ শুরু হয়। প্রথমার্ধে তার কিছু ছোট পাস হয়, একটি ভালো ক্লিয়ারেন্সও করে সে, কিন্তু গোলের সুযোগ পায় না। দ্বিতীয়ার্ধের দশম মিনিটে হঠাৎ ডান দিক থেকে বল আসে, রাফিক ঠিক জায়গায়, সামনে কেবল এক ডিফেন্ডার, সে স্টেপ ওভার করে বলটা নিজের বাঁ পায়ের দিকে টেনে এনে জোরে শট নেয়। মুহূর্তে বল জালে। গোল! মাঠ গর্জে ওঠে। কোচ উঠে দাঁড়িয়ে তালি দেন, গ্যালারিতে শিবা লাফিয়ে ওঠে, তার হাতে ‘আমাদের রাফিক’ ব্যানার। সেই মুহূর্তে সময় যেন থেমে যায়, আর সেই গোল হয়ে দাঁড়ায় শুধু একটা স্কোর নয়, হয়ে ওঠে একটা গল্পের প্রতিশোধ।
ম্যাচ শেষে কোচ ডাকে রাফিককে—“তোমার জায়গা এখন মূল একাদশে, ছেলেটা। প্রস্তুত থাকো, সামনে জুনিয়র টুর্নামেন্ট আসছে।” সেই শব্দগুলো শুনে রাফিক কিছু বলে না, শুধু মাথা নিচু করে সম্মতি জানায়, কিন্তু বুকের মধ্যে ঢেউ ওঠে, যেটা তার চোখে আসা জল দিয়ে আর কাবু করা যায় না। মাঠ থেকে বেরিয়ে এসে শিবাকে জড়িয়ে ধরে সে বলে, “তুই পাশে না থাকলে আমি আজ এই মাঠে আসতেই পারতাম না।” শিবা কাঁধে হাত রেখে বলে, “তোর ওই গোলটা শুধু গোল না রে—ওটা আমার জীবনেও একটা গোল, আমার স্বপ্নেও। আমরা দুজনই জিতলাম আজ।” সেই সন্ধ্যায়, বস্তির গলির ধারে দাঁড়িয়ে, রাফিক আকাশের দিকে তাকায়। তার হাতে নেই কোনো ট্রফি, পকেটে নেই টাকাপয়সা, কিন্তু তার চোখে আছে ভবিষ্যতের ছবি, যেটা লাল কার্ড নয়, স্বীকৃতির আলোয় আঁকা।
অধ্যায় ১০:
রাফিকের জীবনে আরেকটা ভোর নেমে আসে, কিন্তু এবার সেটা স্রেফ আরেকটা প্র্যাকটিস ডে নয়—এটা তার প্রথম জাতীয় স্তরের জুনিয়র টুর্নামেন্টে ক্লাবের মূল একাদশে খেলার দিন। সকালটা অস্বাভাবিক নীরব ছিল। বাবার মুখে আজ রাফিক দেখেছিল এক অন্যরকম শান্তি, আর খালার চোখে সেই পুরনো আর্শীবাদের ছায়া। মাঠে পৌঁছে রাফিক বুঝতে পারে, আজ তার জীবনের সবচেয়ে বড় ম্যাচ হতে চলেছে। গ্যালারিতে শৈলজা সেন হাজির, সঙ্গে ক্যামেরা; শিবার চোখে অদ্ভুত আত্মবিশ্বাস। কোচ বিক্রম স্যার এসে শুধু একটা কথা বলেন, “আজও যদি খেলো নিজের মতো, তাহলে ভবিষ্যৎ তোমার পেছনে দৌড়াবে।” ম্যাচ শুরু হয় হাই টেম্পোতে, প্রতিপক্ষ শক্তিশালী—প্রথম দশ মিনিটেই গোল খেয়ে বসে রাফিকদের দল। কিন্তু সে নিজের জায়গা ধরে রাখে, সাইলেন্ট কমান্ডার-এর মতো খেলতে থাকে—প্রতিটা পাসে তার সেই বস্তির মাঠের অনুশীলনের ছাপ, প্রতিটা ছোঁয়ায় শিবার সঙ্গে খেলা সেই পুরনো স্মৃতি। দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই সে একটা বল পায় মাঝমাঠে—একটু জায়গা খুঁজে নিয়ে সে ড্রিবল করে এগোয়, সামনে দুই ডিফেন্ডার, সে হঠাৎ করে ডান দিকে পাস করে দেয় উইঙ্গারকে, আর মুহূর্তে কাট করে ঢুকে পড়ে বক্সে। উইঙ্গার ফিরে পাস দেয়—রাফিক নিখুঁত হেডে বল জালে পাঠায়। গোল! সমতা ফেরে ম্যাচে।
গোল করার পর সে কিছু বলে না, শুধু দুই হাত তুলে মাঠের চারপাশ ঘুরে দেখে। হাজার লোকের ভিড়ে সে খুঁজে পায় তার মানুষদের—খালা, কোচ মৃণাল, শৈলজা, শিবা, এমনকি বাবার মুখও দূরে দেখা যায়, চোখের কোণ ভিজে। সেই মুহূর্তে রাফিক জানে, তার এই গোল কেবল একটা স্কোর নয়—এটা তার গল্পের ‘ফুল স্টপ’-এর জায়গা। খেলার শেষদিকে একটা পেনাল্টি হয় প্রতিপক্ষের পক্ষে, তারা গোল করে। রাফিকদের দল হারে ২–১ ব্যবধানে। কিন্তু কোচ এসে বলে, “তোমরা হেরেছো স্কোরে, কিন্তু তুমি আজ জিতেছো নিজের লড়াইয়ে।” সেই কথা শুনে রাফিক মাথা নিচু করে বলে, “আমার লড়াই এখনো শেষ হয়নি, স্যার, আমি আরও খেলতে চাই, আরও জিততে চাই।” সাংবাদিকরা ছবি তোলে, ক্যামেরার ফ্ল্যাশ পড়ে তার চোখে, সে প্রথমবার মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে বলে, “আমি একটা লাল কার্ড পেয়েছিলাম অনেকদিন আগে, কিন্তু সেই লাল কার্ড আজ আমার লাল রঙের জার্সিতে গর্ব হয়ে আছে। আমি বস্তির ছেলে, আমি খেলি বল দিয়ে, আর স্বপ্ন দেখি গোলপোস্টের বাইরে।” সবাই অবাক হয়ে তাকায়—একটা ছেলের মুখে এত শক্তি, এত নির্ভরতা, এত স্বপ্ন!
সেই রাতে বস্তিতে ফিরে রাফিক দেখে, পাড়ার ছেলেরা হাতে জ্বলন্ত রঙিন বাতি হাতে দাঁড়িয়ে আছে গলির মুখে। তারা সবাই চিৎকার করে—“জিন্দাবাদ, রাফিক ভাই!” শিবা ছুটে এসে বলে, “তোর জন্য আমরা আজকেও হারকে জয় বলে মনে করছি।” রাফিক হাসে, বলে, “তোমরা পাশে থাকলে, আমি কোথাও হারব না।” খালা এগিয়ে এসে কপালে চুমু দিয়ে বলে, “দেখিস, তোর নাম একদিন বইয়ের পাতায় থাকবে।” বাবার চোখে জল, সে শুধু কাঁধে হাত রেখে বলে, “তুই আমার ছেলের থেকে বড় হয়ে গেছিস, তুই এই বস্তির ছেলে না, তুই সবার ছেলে।” সেই কথা শুনে রাফিক বলে, “না বাবা, আমি এই বস্তিরই ছেলে, এখান থেকেই তো শিখেছি কীভাবে ওঠা যায়।” আকাশে তখন আলো-আঁধারির মিশেল, ফুটপাতের গন্ধে মেশে নুন-মাটির গন্ধ। রাফিক সেই গলির মাঝে দাঁড়িয়ে ভাবে, তার গল্পের এখানেই শেষ নয়—এটা কেবল প্রথম সিজন শেষ হওয়া মাত্র। সামনে আরও অনেক ম্যাচ, আরও অনেক লাল কার্ড, আরও অনেক গোল। আর তার জীবনটা এখন একটা বল, যেটা সে নিজের স্বপ্নের মাঠে ঘুরিয়ে চলেছে, অবিরাম।
___