তানিয়া দে
সকালবেলার রোদ যখন সবে ধানক্ষেতের মাথায় নরম সোনালি আলো ছড়িয়ে দিতে শুরু করেছে, তখনই গ্রামের মাঠে হাওয়া বইছিল এক অদ্ভুত প্রশান্তি নিয়ে। মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা লাল কাপড়ে মোড়া কাকতাড়ুয়াটা যেন চারদিকের দৃশ্যকে গম্ভীর দৃষ্টিতে দেখছিল—তার জীর্ণ মুখখানা, খড়ভর্তি বুক আর বাঁশের দেহে ঝোলানো লাল জামাটি বাতাসে দুলে উঠছিল। দূর থেকে দেখলে মনে হত কোনো মানুষ হাত পা ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু গ্রাম্য বাচ্চাদের কাছে সে ছিল বন্ধু আর খেলনার মতো। সেদিনও কৃষ্ণ প্রথমবার সেখানে এসেছিল—খালি পায়ে ধুলো মাখা মাঠে দৌড়ে এসে কাকতাড়ুয়ার পায়ের কাছে বসে পড়েছিল। তার হাতে একটা ছোট্ট কাঠের গাড়ি, যেটা তার বাবা তৈরি করে দিয়েছিলেন। আর তখনই হঠাৎ পাশের দিক থেকে ভেসে এলো হাসির শব্দ। মাটির পথ ধরে দৌড়ে এল কনিকা—বয়সে কৃষ্ণর সমান, ফর্সা গায়ের রং, কাঁধে বাঁধা দুটি বেণি দুলতে দুলতে এগিয়ে আসছিল। হাতে তার কাদামাটি দিয়ে বানানো পুতুল। কৃষ্ণ প্রথমে একটু লজ্জা পেয়ে তাকিয়ে ছিল, পরে দুজনের চোখাচোখি হতেই কেমন এক অচেনা বন্ধুত্বের আলো ঝিলিক দিয়ে উঠল। কাকতাড়ুয়া যেন সেই প্রথম সাক্ষাতের সঙ্গী হয়ে মাথা নেড়ে অনুমতি দিল, “এই মাঠে তোমাদের বন্ধুত্বের গল্প শুরু হোক।”
তারপর থেকে প্রতিদিন বিকেলে কৃষ্ণ আর কনিকা একই মাঠে এসে হাজির হতো। কখনো তারা কাকতাড়ুয়ার পাশে বসে খেলত, কখনো তার চারপাশে ঘুরে লুকোচুরি করত। কৃষ্ণ কাঠের গাড়ি ছুটিয়ে নিয়ে যেত ধানক্ষেতের কিনারায়, কনিকা তার কাদামাটির পুতুলকে সাজাত ঘাসের ফুল দিয়ে। আকাশে যখন কাক উড়ে যেত, তারা মজা করে বলত—“দেখ, কাকতাড়ুয়া কাকগুলোকে ভয় দেখাচ্ছে!”—এবং দুজনে হেসে গড়াগড়ি খেত। গ্রামের অন্য বাচ্চারা মাঝে মাঝে খেলতে আসত, কিন্তু কৃষ্ণ আর কনিকর মধ্যে যে অদ্ভুত বোঝাপড়া জন্ম নিয়েছিল, সেটা অন্য কারো সঙ্গে ভাগ করা যেত না। কাকতাড়ুয়ার ছায়ার নিচে বসে তারা ছোট ছোট গল্প বানাত—কখনো বলত, কাকতাড়ুয়া রাতে নাকি নড়ে উঠে পাহারা দেয়, কখনো আবার কল্পনা করত, সে নাকি গোপনে তাদের খেলনা পাহারা দিচ্ছে। সূর্য ডুবে গেলে, যখন পশ্চিম আকাশে লাল আভা ছড়িয়ে পড়ত, তখন কাকতাড়ুয়া আর তার লাল জামাটা যেন সোনালি আলোয় জ্বলজ্বল করত। সেই আলোয় কৃষ্ণ আর কনিকর চোখে ভেসে উঠত শৈশবের নির্ভেজাল আনন্দের রং।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মাঠ, কাকতাড়ুয়া আর সন্ধ্যার হাওয়া মিলে তাদের দুজনকে এক অদৃশ্য বন্ধনে বেঁধে ফেলেছিল। কৃষ্ণর মধ্যে ছিল চুপচাপ স্বভাব, আর কনিকা ছিল প্রাণবন্ত, হাসিখুশি; অথচ একে অপরের ভেতর তারা যেন নিজের অর্ধেক খুঁজে পেত। কনিকা গল্প করত গ্রামের মেলা, গরুর দৌড়, নদীর পাড়ের কথা—কৃষ্ণ মুগ্ধ হয়ে শুনত। আর কৃষ্ণ কাগজে আঁকতে শুরু করেছিল কাকতাড়ুয়ার ছবি, যা দেখে কনিকা হাততালি দিয়ে খুশি হতো। মাঝে মাঝে দুজনেই ঝগড়া করত—কখনো খেলনা নিয়ে, কখনো কাকতাড়ুয়া নিয়ে কল্পিত দাবিদাওয়া নিয়ে—কিন্তু রাগ বেশিক্ষণ স্থায়ী হতো না। রাগ ভাঙাত সেই কাকতাড়ুয়ার নীরবতা, তার লাল জামার দোল খাওয়া। তাদের শৈশবের এই নির্ভেজাল দিনগুলোকে কাকতাড়ুয়া আপন ছায়ার মতো আগলে রেখেছিল। যেন সে বুঝিয়ে দিচ্ছিল—এই মাঠ, এই মাটি, আর এই বন্ধুত্বের কাহিনি চিরকাল গ্রামীণ বাতাসে ভেসে থাকবে। শৈশবের সেই প্রথম পর্বের সাক্ষী হয়ে লালরঙা কাকতাড়ুয়া দাঁড়িয়ে রইল, যে ছায়ার নিচে কৃষ্ণ আর কনিকা নিজেদের খুঁজে পেল এক নতুন বন্ধুত্বের উষ্ণতায়।
–
সময় গড়িয়ে শৈশবের নির্ভেজাল খেলার দিন ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছিল। কৃষ্ণ আর কনিকা এখন কিশোর, দুজনের চোখে স্বপ্নের রংও নতুনভাবে ফুটে উঠছে। মাঠে কাকতাড়ুয়া তখনও দাঁড়িয়ে আছে, তবে তাদের কাছে তার অর্থ যেন আরও গভীর হয়ে উঠেছে—শুধু খেলাধুলার সঙ্গী নয়, বরং ভবিষ্যতের গোপন কথার নীরব শ্রোতা। কৃষ্ণ বইয়ের পাতায় ডুবে যেতে শিখেছে, অঙ্ক আর ইতিহাসের দুনিয়া তাকে মুগ্ধ করে; তার কল্পনায় গ্রাম ছাড়িয়ে শহরের স্কুল, বড় লাইব্রেরি, নতুন মানুষের সঙ্গে পরিচয়ের স্বপ্ন ভেসে ওঠে। সে ভাবে একদিন এই গ্রামের মাটির রাস্তা থেকে অনেক দূরে গিয়ে পড়াশোনা করবে, নিজের কৃতিত্বে পরিবারের মুখ উজ্জ্বল করবে। অন্যদিকে কনিকার কাছে স্বপ্নের মানে ভিন্ন—সে নদীর ধারে বসে জলে প্রতিফলিত আকাশ দেখে, তার চোখে ভেসে ওঠে উৎসবের দিন, মাটির গন্ধ, মায়েদের সুরেলা গান আর মাঠের ধান কাটা। কৃষ্ণ তাকে জিজ্ঞেস করলে—“তুই বড় হয়ে কী হতে চাইবি?”—কনিকা হেসে উত্তর দেয়, “আমি নদীর মতো হতে চাই। যেখানে মাটি আছে, গাছ আছে, মানুষ আছে—সেখানেই বয়ে যাব।” কৃষ্ণ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে, সে ভাবে কনিকা পড়াশোনায় ততটা মন দেয় না কেন, কিন্তু ভেতরে ভেতরে বুঝতে পারে—এই মাটির সঙ্গে কনিকর বন্ধন তার বইয়ের পাতার চেয়েও বেশি দৃঢ়।
সন্ধ্যা নামলে তারা আবার সেই কাকতাড়ুয়ার পাশে বসত, যেন দিনশেষের আড্ডাটা তাদের জীবনের এক অঙ্গ হয়ে গেছে। কৃষ্ণ বই খুলে কনিকার সামনে পড়তে চেষ্টা করত—রামায়ণ-মহাভারতের গল্প, বা কোনো নতুন কবিতা। কনিকা মন দিয়ে শোনে, কিন্তু শোনার পর নদীর জলে হাত ছুঁইয়ে বলত, “বইয়ের গল্প যত সুন্দরই হোক, নদীর স্রোতের গল্প তার চেয়ে বড়।” তার কল্পনা সবসময় প্রকৃতির সঙ্গে বাঁধা—পাখি, গাছ, আকাশ আর বৃষ্টির রং। মাঝে মাঝে কৃষ্ণ বিরক্ত হয়ে বলত, “তুই যদি শুধু নদীর গান শুনিস, তবে দুনিয়া চেনবি কীভাবে? শহরে গেলে বইয়ের জ্ঞান ছাড়া চলবে না।” কনিকা তখন হেসে বলত, “শহর যদি দুনিয়া হয়, তবে আমাদের এই গ্রামটা কি দুনিয়ার বাইরে?” তাদের এই কথোপকথন অনেকটা ঝগড়ার মতো শোনালেও ভেতরে ভেতরে ছিল টানাপোড়েন আর পরস্পরের প্রতি অদ্ভুত আকর্ষণ। কাকতাড়ুয়া দাঁড়িয়ে থাকত নীরব সাক্ষী হয়ে, যেন সে-ই জানে—কৃষ্ণ আর কনিকর দুনিয়া আলাদা হলেও হৃদয়ের সেতুটা ভেঙে পড়বে না। তাদের ভিন্ন স্বপ্নে লুকিয়ে ছিল এক অদৃশ্য মিলনবিন্দু, যা কেবল সময়ের সঙ্গে প্রকাশ পাবে।
একদিন আকাশে প্রচণ্ড ঝড় উঠেছিল, ধানক্ষেতের মাথায় কালো মেঘ নেমে আসছিল। কৃষ্ণ বই হাতে নিয়ে দৌড়ে মাঠে গেল, দেখল কনিকা কাকতাড়ুয়ার পাশে বসে আছে, চোখে নদীর দিকে তাকানো অভিমানী দৃষ্টি। বাতাসে কাকতাড়ুয়ার লাল জামাটা উড়ছিল দোল খেয়ে, যেন তাদের স্বপ্নের পতাকা। কৃষ্ণ কনিকার হাত ধরল, বলল, “একদিন আমি বড় শহরে যাব, হয়তো পড়াশোনা করব, চাকরি করব… কিন্তু তুই?” কনিকা স্থির চোখে তাকিয়ে বলল, “আমি থাকব এখানেই, এই মাঠ, এই নদীর পাশে। কিন্তু ভুলিস না, শহরের আলো যতই উজ্জ্বল হোক, তোর শৈশবের আলো এই মাঠেই লুকিয়ে আছে।” সেই মুহূর্তে দুজনের ভেতরে অদ্ভুত এক উপলব্ধি জন্ম নিল—তাদের স্বপ্ন আলাদা হলেও টান এক, তারা একে অপরের কাছে ফিরে আসবেই। কাকতাড়ুয়ার ছায়া তখন যেন আরও বড় হয়ে তাদের দুজনকে জড়িয়ে ধরল, ঝড়ের মাঝেই মনে হল সে তাদের প্রতিজ্ঞার সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিশোর বয়সের স্বপ্নগুলো সেইদিন থেকে এক নতুন রূপ নিল—কৃষ্ণর চোখে বইয়ের পাতা আর কনিকর চোখে নদীর জল, কিন্তু হৃদয়ের গভীরে দুজনেই জানল, একে অপর ছাড়া তাদের গল্প অসম্পূর্ণ।
–
কৈশোরের সীমানা পেরিয়ে যখন কৃষ্ণ আর কনিকা যৌবনের প্রথম দোরগোড়ায় পা রাখল, তখন তাদের চোখে–মুখে ভেসে উঠতে লাগল এক নতুন আলো। শৈশবের খুনসুটি আর কিশোর বয়সের স্বপ্ন ভাগাভাগির দিনগুলো ধীরে ধীরে রূপ নিচ্ছিল এক অচেনা আবেগে, যাকে তারা নাম দিতে পারত না, কিন্তু দুজনেই অনুভব করত। কাকতাড়ুয়ার ছায়ার নিচে বসে থাকা এখন আর শুধু খেলা বা গল্পের জন্য নয়, বরং একে অপরের সান্নিধ্য পাওয়ার অদ্ভুত টান ছিল। কৃষ্ণ যখন বই পড়ত, কনিকা তার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকত; মনে হত বইয়ের অক্ষরগুলো নয়, বরং কৃষ্ণর ঠোঁট নড়ার ভঙ্গিই তাকে টানছে। কৃষ্ণও তা টের পেত, কিন্তু কিছু বলতে পারত না। কনিকা যখন হেসে উঠত, তার মুখের কোণে যে আলো ঝলমল করত, কৃষ্ণর বুকের ভেতর কেমন যেন অজানা কাঁপন উঠত। সে লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিত, মাটিতে কাঠি দিয়ে কিছু আঁকতে শুরু করত, কিন্তু ভেতরে ভেতরে জানত—এই অনুভূতি আর স্রেফ বন্ধুত্বের নয়।
তাদের প্রতিদিনের দেখা এখন যেন অন্য রঙে রাঙানো। বিকেলবেলা যখন সূর্য ডুবে যেতে থাকে, মাঠের বাতাসে যখন নরম শীতলতা নামে, তখন কনিকা লাজুক ভঙ্গিতে কাকতাড়ুয়ার পাশে বসত, আর কৃষ্ণ একটু দূরে বসে তার চুলের গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে মনে মনে হারিয়ে যেত। কনিকা বুঝতে শিখেছে কৃষ্ণর চোখে এক অদ্ভুত গভীরতা, যেন সে তাকালেই মন ভিজে যায় অজানা আবেগে। সে আর আগের মতো খুনসুটি করে না, বরং মাঝে মাঝে চুপচাপ বসে থাকে, শুধু কৃষ্ণকে দেখেই তার মন ভরে যায়। কৃষ্ণও বুঝতে শুরু করেছে, তার দিনের সবচেয়ে সুন্দর সময় হলো এই মাঠে আসা, কনিকর পাশে বসা। কিন্তু তার মুখে কথা আসে না, বুকের ভেতর শুধু কাঁপন তোলে। গ্রামের অন্যরা হয়তো এড়িয়ে যায়, কিন্তু তারা দুজনেই জানে, এই অনুভূতি কোনো খেলার মতো নয়, এটা যেন নতুন এক জীবনের শুরু। কাকতাড়ুয়া, যে এতদিন ধরে তাদের শৈশবের খেলার সাথী ছিল, এখন সেই প্রথম প্রেমের নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে—তার লাল জামা বাতাসে দুলছে, যেন গোপনে তাদের দুজনকে আশীর্বাদ করছে।
কোনো কোনো দিন কৃষ্ণ কনিকার জন্য ফুল তুলে আনত—কখনো ধানক্ষেতের সোনালি শিষ, কখনো মাঠের ঘাসফুল। কনিকা লজ্জায় মুখ নামিয়ে নিত, কিন্তু বুকের ভেতর সে আনন্দের ঢেউ অনুভব করত। আবার কখনো কনিকা নদীর ধারে বসে কৃষ্ণর নাম অকারণে বালিতে লিখত, পরে হেসে তা মুছে দিত, কিন্তু মুছলেই কি মন থেকে মুছে যায়? এক সন্ধ্যায়, হঠাৎ করেই কৃষ্ণ কনিকার হাত ধরেছিল—খুব বেশি কিছু নয়, শুধু একটু কাঁপা কাঁপা স্পর্শ। কনিকা প্রথমে অবাক হয়েছিল, কিন্তু মুহূর্তের মধ্যেই সে সেই স্পর্শে এক অদ্ভুত উষ্ণতা টের পেয়েছিল। দুজনেই কিছু বলেনি, শুধু নিঃশব্দে আকাশের দিকে তাকিয়েছিল। আকাশে তখন নতুন চাঁদ উঠেছে, মাঠ জুড়ে নরম আলো ছড়িয়ে পড়েছে। সেই আলোয় কাকতাড়ুয়া দাঁড়িয়ে আছে আগের মতোই, কিন্তু কৃষ্ণ আর কনিকার কাছে মনে হচ্ছিল—সে যেন আজ অন্যরকম, যেন সে তাদের প্রথম প্রেমের আলোর এক নীরব রক্ষক। সেই দিন থেকেই তাদের দুজনের মধ্যে জন্ম নিল এমন এক অনুভূতি, যা আর শুধু বন্ধুত্ব নয়, বরং প্রথম প্রেমের স্পর্শ—কাঁচা, লাজুক, অথচ চিরকালীন।
–
কৃষ্ণর ফলাফলের দিনটা ছিল গোটা গ্রামে এক অন্য রকম উৎসবের মতো। মধুমিতা যেন বুকভরা আনন্দে তাকিয়ে ছিল তার শৈশবের সঙ্গীর দিকে—যে ছেলেটি কাদামাখা মাঠে, বাঁশঝাড়ের ছায়ায়, কিংবা নদীর ধারে বসে পড়াশোনা করত সেই একখানা বই হাতে নিয়েই; সেই ছেলেটিই আজ স্কুলের পরীক্ষায় প্রথম হয়ে শহরে পড়াশোনার সুযোগ পেয়েছে। গ্রামের মানুষদের কাছে বিষয়টা ছিল গর্বের—যেন একজনের সাফল্যে গোটা গ্রামটির সম্মান উজ্জ্বল হয়ে উঠল। কিন্তু মধুমিতার ভেতরে আনন্দের সঙ্গে মিশে গেল এক অজানা শঙ্কা। শহর তো আলাদা এক দুনিয়া—আলো, রঙ, চঞ্চলতা, আর মানুষের ভিড়; সেখানেই কৃষ্ণ যাবে নতুন জীবন গড়তে। মধুমিতা জানত, এই যাত্রা শুধু কৃষ্ণর জন্য নতুন পথের সূচনা নয়, তাদের দুজনের সম্পর্কের উপরেও এক অদৃশ্য রেখা টেনে দেবে। সে অনুভব করল, কৃষ্ণর সাফল্যে তার নিজের বুকের ভেতরও কিছুটা গর্ব জেগে উঠছে, কিন্তু সেই গর্বের আড়ালে এক ভয় গোপনে জায়গা করে নিচ্ছে—ভয়, এই অগ্রযাত্রা কি তাদের দূরে সরিয়ে দেবে?
কৃষ্ণ শহরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করলে তাদের দুজনের দিনযাপনেও এক অদ্ভুত পরিবর্তন এলো। আগে প্রায় প্রতিদিন বিকেলের দিকে নদীর ধারে দেখা হতো, যেখানে বইয়ের পাতার ফাঁকে হাসি-ঠাট্টার সঙ্গে মিশে যেত গোপন স্বপ্ন। এখন সেই সময়গুলো ক্রমশ কমতে শুরু করল। কৃষ্ণর মাথায় ভর্তি হলো নতুন পড়ার বই, নতুন পরীক্ষার সিলেবাস, আর শহরের কলেজের নানা কথা। মধুমিতা তার পাশে দাঁড়িয়ে সবকিছু বোঝার চেষ্টা করলেও, ভেতরে ভেতরে অনুভব করছিল অদ্ভুত শূন্যতা। শহরের গল্পগুলো, যেগুলো কৃষ্ণ আনন্দ নিয়ে শোনাত, সেগুলো কখনো তার কাছে আকর্ষণীয় মনে হতো না। বরং সে যেন শুনতে শুনতে উপলব্ধি করত, এই গল্পগুলোই তাদের মধ্যে অচেনা এক দেয়াল গড়ে তুলছে। গ্রামে থাকার একরঙা অথচ সহজ সরল জীবন থেকে কৃষ্ণর মন ক্রমশ সরে যাচ্ছে; মধুমিতা বুঝতে পারল, শহরের ডাক শুধু কৃষ্ণকেই টানছে না, বরং ধীরে ধীরে তাদের সম্পর্ককেও নতুন পথে ঠেলে দিচ্ছে—এক পথে যেখানে দুজনের পা একসঙ্গে পড়ছে না। তবুও কৃষ্ণর চোখের দীপ্তি দেখে সে সবসময় হাসিমুখে তাকে উৎসাহিত করত, যদিও অন্তরের গভীরে তার ভয় আরও দৃঢ় হয়ে উঠছিল।
দিন গড়াল, বিদায়ের ক্ষণ আসন্ন হলো। শহরে পড়াশোনার ডাক যেন কৃষ্ণর ভেতর এক অদম্য উচ্ছ্বাস জাগিয়ে তুলল—সে বারবার বলত, “মধু, একদিন আমি শহরে ভালো কিছু করব, তোমাদের সকলের মুখ উজ্জ্বল করব।” মধুমিতা শুনে মাথা নেড়ে হাসত, কিন্তু মনে মনে ভাবত, সেই ‘তোমাদের’ শব্দের ভেতর কি সত্যিই তার জন্য আলাদা কোনো জায়গা থাকবে? গ্রামের সরল মাঠ, বকুলগাছের ছায়া, আর তাদের যৌথ স্বপ্নগুলো শহরের কোলাহলে কোথাও হারিয়ে যাবে না তো? সেদিন বিদায়ের আগে নদীর ধারে শেষবার দাঁড়িয়ে দুজন নীরবে অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিল একে অপরের দিকে। কথাগুলো গলা থেকে বেরোতে চাইছিল না—যেন নীরবতাই হয়ে উঠেছিল শেষ সাক্ষাৎকারের ভাষা। কৃষ্ণর চোখে শহরের নতুন জীবনের স্বপ্ন জ্বলজ্বল করছিল, আর মধুমিতার চোখে ভেসে উঠছিল অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ভয়। তাদের মধ্যে কোনো প্রতিশ্রুতি হয়নি, কোনো অঙ্গীকার হয়নি, শুধু নদীর স্রোতের মতো নিঃশব্দে বয়ে চলল সময়, আর মধুমিতা বুঝল—শহরের ডাক শুধু কৃষ্ণকে নয়, তাকেও এক নতুন পরীক্ষার মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।
–
ভোরের আলো তখনো পুরোপুরি ছড়িয়ে পড়েনি, আকাশ জুড়ে একরাশ ফিকে লালচে আভা। গ্রামের পথ ধরে গরুর গাড়ির শব্দ, দূরে ভোরের পাখিদের ডাক—সবকিছুই যেন সাধারণ দিনের মতো হলেও কৃষ্ণ আর কনিকর কাছে দিনটা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। আজ কৃষ্ণ শহরে যাচ্ছে, আর সেই যাত্রা মানেই অজানা দীর্ঘ বিরহ। স্টেশনের দিকে হাঁটতে হাঁটতে কৃষ্ণর চোখে ফুটে উঠছিল অগণিত স্বপ্ন—নতুন শহর, নতুন চাকরি, নিজের জীবনের নতুন অধ্যায়। কিন্তু পাশে হাঁটা কনিকর চোখে তখন শুধুই জল, বুক ভরে উঠছিল শূন্যতায়। গ্রাম থেকে শহরে যাওয়ার এই পথটা যেন শুধু ভৌগোলিক দূরত্ব নয়, বরং হৃদয়ের মাঝেও এক অচেনা ফাঁক তৈরি করে দিচ্ছিল। কনিকা বারবার কৃষ্ণকে প্রশ্ন করতে চাইছিল—“তুই ফিরবি তো?”, কিন্তু ঠোঁটে কোনো শব্দ আসছিল না। সে শুধু চুপচাপ কৃষ্ণর হাত আঁকড়ে ধরে হাঁটছিল, যেন শেষ মুহূর্তে সেই উষ্ণতাটুকু বুকের ভেতরে জমিয়ে রাখতে চায়। চারপাশের মানুষজন, গ্রাম থেকে আসা কয়েকজন যাত্রী, কিংবা হকারদের হাঁক—সব মিলিয়েও তাদের নিঃশব্দ দুঃখ ঢাকতে পারছিল না।
স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে পৌঁছে দৃশ্যটা আরও ভারী হয়ে উঠল। চারদিকে লোকজনের ভিড়, ট্রেনের সিটি বাজছে, চায়ের দোকান থেকে ধোঁয়া উড়ছে—সবকিছু এক অদ্ভুত বিশৃঙ্খলার মতো। কিন্তু কৃষ্ণ আর কনিকর চোখে তখন শুধু একে অপরই ভেসে উঠছিল। কৃষ্ণ কনিকার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বলল, “কেঁদিস না, আমি খুব তাড়াতাড়ি ফিরে আসব। শহরে দাঁড়িয়ে যদি অনেক দূরে যেতে হয়, তাও তুই সবসময় আমার ভেতরে থাকবি।” কনিকা কিছু বলতে পারল না, শুধু তার চোখের জল গড়িয়ে পড়ছিল কৃষ্ণর শার্টে। সেই ভেজা দাগ যেন কোনো প্রতিশ্রুতির মতো থেকে গেল। ট্রেন আসতেই কৃষ্ণ ব্যস্ত হয়ে উঠল, লোকজন ঠেলাঠেলি শুরু করল। কনিকা একবার হাত বাড়িয়ে দিল, কৃষ্ণ তার হাতটা দৃঢ়ভাবে ধরল—শেষবারের মতো, বিদায়ের চিহ্ন এঁকে দিল তাদের সম্পর্কের ওপর। সেই স্পর্শে যেন কথার চেয়েও অনেক বেশি কিছু বলা হয়ে গেল। কৃষ্ণ উঠে গেল ট্রেনে, জানলার পাশে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে কনিকাকে দেখছিল, আর কনিকা অশ্রুভেজা চোখে শুধু তাকিয়ে ছিল তার দিকে। ট্রেন চলতে শুরু করল, ধীরে ধীরে দূরে চলে গেল কৃষ্ণ। কনিকর বুকের ভেতরটা ফাঁকা হয়ে গেল, মনে হল যেন তার সমস্ত শৈশব, কৈশোর আর ভালোবাসা একসঙ্গে ট্রেনের শব্দের সঙ্গে মিলিয়ে অচেনা শহরের দিকে ছুটে যাচ্ছে।
স্টেশন থেকে ফিরে আসতে আসতে কনিকা অনুভব করছিল ভেতরের এক গভীর শূন্যতা। গ্রামের মাঠ, নদী, কাকতাড়ুয়ার ছায়া—সব যেন হঠাৎ আরও নিঃসঙ্গ হয়ে উঠল। কাকতাড়ুয়া, যে এতদিন তাদের হাসি-খুনসুটি, স্বপ্ন আর প্রথম প্রেমের নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, আজ তাকে মনে হচ্ছিল একেবারে একা। মাঠের মাঝে লাল জামা পরা সেই কাকতাড়ুয়া বাতাসে দুলছিল, যেন সে-ও বিদায়ের বেদনায় কাঁপছে। কনিকর চোখের জল আবারও গড়িয়ে পড়ল, মনে হল কাকতাড়ুয়া তার বুকের ব্যথার প্রতিচ্ছবি। কৃষ্ণর চলে যাওয়া শুধু তাদের দূরত্বের সূচনা নয়, বরং গ্রামের জীবনের সরলতার সঙ্গে শহরের টানাপোড়েনের এক নির্মম সাক্ষাৎ। কনিকা বুঝতে পারল, এই বিদায় কেবল আজকের নয়—এটা এক নতুন জীবনের সূচনা, যেখানে তাদের ভালোবাসা সময় আর দূরত্বের পরীক্ষার মুখোমুখি হবে। তবুও, কাকতাড়ুয়ার ছায়ায় দাঁড়িয়ে সে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল—যত দূরেই যাক কৃষ্ণ, সে প্রতিদিন এই মাঠে আসবে, এই কাকতাড়ুয়ার সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে, কারণ এই নীরব প্রহরীই তো তাদের গল্পের শুরু থেকে আজ অবধি অটুট থেকে গেছে।
–
শহরে এসে কৃষ্ণ যেন নতুন এক দুনিয়ার দরজা খুলে ফেলল। চারদিকে কোলাহল, উঁচু দালান, ব্যস্ত রাস্তায় মানুষের ভিড়—এই সবকিছুর সঙ্গে প্রথমে তার মন যেন দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে সে অভ্যস্ত হয়ে উঠল। অফিসের চাকরি, সকাল থেকে রাত পর্যন্ত প্রতিযোগিতার ভিড়ে লড়াই করা, সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনা—সবকিছু মিলিয়ে তার প্রতিটি দিন ভরে উঠল নতুন অভিজ্ঞতায়। কৃষ্ণ বুঝল, শহরে টিকে থাকতে হলে শুধু মেধা নয়, সময়ের সঙ্গে দৌড়তে হবে, নিজেকে প্রমাণ করতে হবে বারবার। কাজের চাপ, নতুন বন্ধুদের আড্ডা, অফিসের বাইরে শহরের অচেনা আলো-ঝলমলে জীবন—সবকিছু তাকে ধীরে ধীরে এক নতুন ছন্দে বেঁধে ফেলল। সেই ছন্দে জায়গা কমে এল গ্রামের গল্পের, কাকতাড়ুয়ার ছায়ার, কিংবা কনিকর সঙ্গে কাটানো সেই সরল মুহূর্তগুলোর। মাঝেমধ্যে রাতে নিঃশব্দে কৃষ্ণর মনে ভেসে উঠত কনিকর হাসি কিংবা নদীর ধারে তাদের দীর্ঘ নীরবতা, কিন্তু শহরের পরদিনের ব্যস্ততা সেই স্মৃতিকে ঠেলে দিত দূরে। কৃষ্ণ বুঝতে পারছিল, শহরের জীবন এক অদ্ভুত যন্ত্র, যা মানুষকে এগিয়ে নিয়ে যায়, কিন্তু একই সঙ্গে ধীরে ধীরে ভেতরের অনেক কিছু কেড়ে নেয়।
অন্যদিকে কনিকা থেকে গেল গ্রামে, যেখানে সময় থেমে আছে অন্য এক ছন্দে। সকালবেলা পাখির ডাক, দুপুরে মাঠের শস্যের ঘ্রাণ, বিকেলের শেষে নদীর ধারে বাতাস—এই ছোট ছোট জিনিসই তার দিনকে সাজিয়ে রাখত। কিন্তু সবকিছুর মাঝেও কৃষ্ণর অনুপস্থিতি যেন প্রতিদিন আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। কনিকা প্রায়ই একলা মাঠে যেত, কাকতাড়ুয়ার পাশে বসত, আর মনে করত কৃষ্ণ এখনো ঠিক তার পাশে আছে। কাকতাড়ুয়া যেন তার সঙ্গী হয়ে উঠেছিল—নীরব, অথচ স্থির; যেমন কৃষ্ণ ছিল তার জীবনের নীরব আশ্রয়। ধানক্ষেতের ফাঁক দিয়ে বয়ে যাওয়া বাতাসে সে কখনো শুনতে চাইত কৃষ্ণর কণ্ঠ, নদীর ঢেউয়ের শব্দে খুঁজে ফিরত সেই দিনের আড্ডা। কিন্তু বাস্তবতা অন্য কথা বলে—কৃষ্ণ শহরে ডুবে আছে নিজের নতুন জীবনে, আর সে আটকে আছে এই নিস্তব্ধতায়। গ্রামের মানুষজনের সঙ্গে হাসি-ঠাট্টা করলেও কনিকর ভেতরে এক অদ্ভুত শূন্যতা লেগে থাকত। কৃষ্ণ ছাড়া তার দুনিয়া যেন অসম্পূর্ণ, অথচ সেই শূন্যতাকেই সে মেনে নিতে শিখছিল কাকতাড়ুয়ার পাশে দাঁড়িয়ে।
এভাবেই দুটি পৃথিবী সমান্তরাল পথে এগোতে লাগল—একদিকে শহরের ব্যস্ততা, অন্যদিকে গ্রামের নিস্তব্ধতা। কৃষ্ণ দিনে দিনে আরও বাস্তববাদী হয়ে উঠছিল, ভবিষ্যতের পরিকল্পনা, সাফল্যের দৌড়, অর্থ আর প্রতিষ্ঠার দিকে ছুটছিল নিরন্তর। কনিকা হয়ে উঠছিল ক্রমশ অন্তর্মুখী, তার প্রতিটি অনুভূতি যেন আটকে যাচ্ছিল মাঠের সবুজে, নদীর নীরবতায়, আর কাকতাড়ুয়ার চিরকালীন উপস্থিতিতে। মাঝে মাঝে কৃষ্ণ চিঠি লিখত, মাঝে মাঝে ফোন করত, কিন্তু সেই কথোপকথনগুলোতে শহরের কোলাহলই বেশি শোনা যেত—অফিসের কাজ, নতুন মানুষ, নতুন স্বপ্নের গল্প। কনিকা শুধু শুনত, আর ভেতরে ভেতরে অনুভব করত তাদের মধ্যে দূরত্বটা দিন দিন বাড়ছে। তবুও, সে প্রতিদিন সন্ধ্যায় মাঠে গিয়ে দাঁড়াত, কারণ তার বিশ্বাস ছিল—যেখানেই থাকুক কৃষ্ণ, তাদের প্রথম স্বপ্ন আর ভালোবাসার সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সেই কাকতাড়ুয়া কোনোদিন একা করবে না তাকে। শহরের ব্যস্ততা আর গ্রামের নিস্তব্ধতার মাঝেই গড়ে উঠতে লাগল এক অদৃশ্য দেয়াল, যার ওপারে তারা দুজন একইসঙ্গে থাকলেও আলাদা হয়ে যাচ্ছিল ধীরে ধীরে।
–
সময় এগিয়ে যাচ্ছিল নিজের মতো করে, আর সেই সময়ের ভেতরেই কৃষ্ণ আর কনিকর সম্পর্ক বদলাতে শুরু করল ধীরে ধীরে। প্রথমদিকে কৃষ্ণ নিয়মিত চিঠি লিখত, কনিকার খবর নিত ফোনে, গ্রামের ছোটখাটো ঘটনার কথা শুনে আনন্দ পেত। কিন্তু শহরের প্রতিযোগিতার ভিড় যত বাড়তে লাগল, ততই এই যোগাযোগের ফাঁকগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগল। কনিকা সন্ধ্যা নামলেই মাঠে যেত, কাকতাড়ুয়ার পাশে বসে চিঠির অপেক্ষায় থাকত—কোনো দিন ডাকপিয়ন চিঠি নিয়ে এল, কোনো দিন ফাঁকা হাতেই চলে গেল। কৃষ্ণর লেখা কাগজে থাকত অফিসের ব্যস্ততার গল্প, শহরের নতুন মানুষের সঙ্গে পরিচয়ের কথা, আর কনিকার জন্য আশ্বাস—“খুব শিগগির ফিরব।” কিন্তু সেই “শিগগির” যেন প্রতিদিনই আরও দূরে সরে যাচ্ছিল। ফোনে কণ্ঠস্বর মিলত, কিন্তু যেন তার ভেতরে আর সেই আগের উষ্ণতা ছিল না। শহরের শব্দ, ব্যস্ততা আর ক্লান্তি কৃষ্ণর কথার ভেতর ঢুকে পড়েছিল, আর কনিকা বুঝতে পারছিল সেই দূরত্ব শুধু মাইলের নয়, মনেরও। কাকতাড়ুয়ার ছায়ায় বসে সে মাঝেমধ্যে মনে করত, এই নীরব প্রহরী যেন ফিসফিস করে বলছে—“দূরত্বও একধরনের বিচ্ছেদ।”
শহরের নতুন জীবন কৃষ্ণকে বারবার টেনে নিচ্ছিল নিজের ভেতর। অফিসের কাজের চাপ, প্রমোশনের লোভ, সহকর্মীদের সঙ্গে আড্ডা, রাতজাগা পার্টি—সব মিলিয়ে সে ক্রমশ এক ভিন্ন মানুষ হয়ে উঠছিল। গ্রামের সরলতা, কনিকার নিষ্পাপ হাসি, কাকতাড়ুয়ার নীরবতা—এসব যেন ধীরে ধীরে স্মৃতির অ্যালবামে আটকে যাচ্ছিল। কৃষ্ণর ভেতরে নতুন এক দ্বন্দ্ব শুরু হল—সে গ্রামকে ভালোবাসে, কনিকাকে ভালোবাসে, কিন্তু শহরের এই দৌড়ও তাকে মুগ্ধ করছে। নতুন প্রলোভন, নতুন স্বপ্ন—এসবের ভেতর সে যেন আর খুঁজে পাচ্ছিল না সেই পুরনো কৃষ্ণকে। অন্যদিকে কনিকা নিজেকে ভিন্নভাবে গড়ে তুলতে শুরু করল। গ্রামের মাটির গন্ধ, নদীর ধারা, শস্যের মাঠ—এসবের সঙ্গে তার সম্পর্ক আরও গভীর হয়ে উঠল। সে কৃষিকাজে হাত লাগাল, গ্রামের মেয়েদের নিয়ে ছোট্ট সংগঠন গড়ল, পড়াশোনার বাইরে তাদের জীবনে আলো আনতে চেষ্টা করল। কৃষ্ণর অনুপস্থিতি তার ভেতর শূন্যতা তৈরি করলেও, সেই শূন্যতা পূরণ করতে সে গ্রামীণ জীবনের সঙ্গে নিজেকে আরও জড়িয়ে নিল। মাঝে মাঝে সে মনে মনে প্রশ্ন করত—“শহরের প্রলোভনে ডুবে যাওয়া কৃষ্ণ কি কোনোদিন ফিরবে?” আর সেই প্রশ্ন যেন মাঠের মাঝখানে দাঁড়ানো কাকতাড়ুয়ার ঠোঁট দিয়ে ভেসে আসত—“কেউ কি ফিরবে?”
এই অদৃশ্য দূরত্বের দেয়াল দিনে দিনে আরও উঁচু হয়ে উঠছিল। কৃষ্ণ তার ব্যস্ততার ভেতরে ডুবে থেকে বুঝতেই পারছিল না কনিকার ভেতরে কীভাবে সময় বদলে দিচ্ছে অনুভূতির দিকচিহ্ন। আর কনিকা বুঝে যাচ্ছিল, শুধু চিঠি বা ফোন ভালোবাসার সমস্ত শূন্যতা ভরতে পারে না। কৃষ্ণ শহরের ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে, আর সে গ্রামে দাঁড়িয়ে ধীরে ধীরে একা হয়ে যাচ্ছে। সন্ধ্যা নামলে, যখন আকাশে লাল আভা ছড়িয়ে পড়ে, কনিকা মাঠে গিয়ে কাকতাড়ুয়ার দিকে তাকিয়ে থাকত—সেই পুরনো দিনের মতো। তার মনে হত, কাকতাড়ুয়া যেন সত্যিই নীরবে তাকে জিজ্ঞেস করছে—“কেউ কি ফিরবে?” উত্তর সে জানত না, কিন্তু বুকের গভীরে তীব্র ব্যথা অনুভব করত। এই দূরত্বের দেয়াল তাদের ভালোবাসাকে ধীরে ধীরে এমন এক অবস্থায় ঠেলে দিচ্ছিল, যেখানে স্মৃতি, আশা আর বাস্তবতা একে অপরের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছিল। কৃষ্ণ আর কনিকা দুজনই বুঝছিল, তারা যেন একই গল্পের দুই চরিত্র হয়েও আলাদা আলাদা পৃথিবীতে আটকে গেছে—একজন শহরের কোলাহলে, আরেকজন গ্রামের নিস্তব্ধতায়।
–
কয়েক বছর কেটে গেল কৃষ্ণর শহুরে জীবনের ব্যস্ততায়। কাজের চাপে, প্রতিযোগিতার ভিড়ে, রাতজাগা সভা আর বন্ধুবান্ধবের আড্ডায় সে যেন নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিল। কিন্তু একসময় মনে হল, এই দৌড়েরও তো শেষ নেই—শহরের সবকিছু থাকলেও ভেতরে এক শূন্যতা জমে উঠছিল। অফিস থেকে ছুটি নিয়ে সে অবশেষে ফিরে এল গ্রামে, সেই মাটিতে যেখানে তার শিকড়, যেখানে কনিকর হাসি আর কাকতাড়ুয়ার ছায়ায় তার শৈশব-কৈশোরের স্মৃতি। ট্রেন থেকে নেমে মাটির রাস্তা ধরে হেঁটে যাওয়ার সময় কৃষ্ণ অনুভব করল, বাতাসে এখনো সেই ধানের গন্ধ, সেই নদীর কলকল, সেই পাখির ডাক—সবকিছু আছে ঠিক আগের মতো, শুধু সে-ই বদলে গেছে। গ্রামে ঢুকতেই ছোটোরা দৌড়ে এসে তাকে ঘিরে ধরল, বড়রা খোঁজখবর নিল, কিন্তু কৃষ্ণর চোখ খুঁজে ফিরছিল শুধু এক মুখ—কনিকার। তবে কনিকা তাকে দেখতে এল না; তার অভিমান জমে উঠেছিল বছরের পর বছর ধরে। কৃষ্ণ বুঝল, ফিরে আসা যতটা সহজ, সম্পর্ককে আবার আগের জায়গায় ফিরিয়ে নেওয়া ততটা সহজ নয়। তবু বুকের ভেতরে এক অদৃশ্য আশা জন্ম নিল—হয়তো কনিকাও এখনো তার জন্য অপেক্ষা করছে।
কনিকা কৃষ্ণর ফেরা খবর শুনে ভেতরে এক অদ্ভুত আলোড়ন টের পেল। কতদিন পর তার দেখা হবে কৃষ্ণর সঙ্গে, কতদিন পর আবার মুখোমুখি দাঁড়াবে সেই মানুষটির, যাকে নিয়ে তার শৈশব, কৈশোর, স্বপ্ন সব জড়িয়ে আছে। কিন্তু সেই আনন্দকে আড়াল করে রাখল গভীর অভিমান। সে নিজেকে প্রশ্ন করল—যে মানুষ শহরের চাকরি, আলো-ঝলমলে জীবনের প্রলোভনে ডুবে থেকে তাকে ভুলে গিয়েছিল, আজ হঠাৎ করে ফিরে এসে কি আগের মতো জায়গা নিতে পারে? তাই প্রথম কয়েকদিন কনিকা কৃষ্ণর সঙ্গে দেখা করতে গেল না, দূর থেকেই খোঁজ নিল তার। কৃষ্ণ বারবার কনিকার কথা জানতে চাইল, কিন্তু স্পষ্ট বোঝা গেল—এই দীর্ঘ অভাবন-অভিমান সহজে ভাঙার নয়। তবে একদিন সন্ধ্যায়, যখন মাঠের দিকে হাঁটতে হাঁটতে কৃষ্ণ কাকতাড়ুয়ার পাশে গিয়ে দাঁড়াল, তখনই হঠাৎ কনিকা এসে পড়ল সেখানে। দুজনের চোখে চোখ পড়ল, মুহূর্তেই যেন সময় ফিরে গেল শৈশবে। কিন্তু কেউ কিছু বলল না; বাতাসে ভেসে এল শুধু ধানক্ষেতের শব্দ, আর কাকতাড়ুয়া যেন নীরবে দাঁড়িয়ে রইল তাদের অদ্ভুত নীরবতার সাক্ষী হয়ে।
সেই নীরবতার বাঁধ প্রথম ভাঙল কনিকার কণ্ঠে। তার গলায় ছিল অভিমান, আবার কোথাও লুকানো স্নেহও—“এতদিন পর মনে পড়ল?” কৃষ্ণ মাথা নিচু করে বলল—“ভুলিনি, শুধু দূরে সরে গিয়েছিলাম।” তারপর দুজনে বসে পড়ল কাকতাড়ুয়ার পাশে, ঠিক যেমন শৈশবে বসত। ধীরে ধীরে তারা কথা বলতে শুরু করল—পুরোনো স্মৃতি, হারিয়ে যাওয়া দিন, গ্রামের গল্প, শহরের গল্প। কনিকা বলল কিভাবে সে গ্রামে থেকে মেয়েদের নিয়ে সংগঠন বানিয়েছে, কৃষ্ণ বলল তার চাকরির সাফল্য আর ব্যস্ততার গল্প। অভিমানী চোখে কনিকা শুনছিল, কিন্তু তার ভেতরে কোথাও একটা প্রশান্তি জমে উঠছিল—কৃষ্ণ এখনো তার কাছে ফিরেছে, এখনো সেই মাঠ, সেই কাকতাড়ুয়ার কাছে এসেছে। রাত নামল, আকাশ ভরে গেল তারায়, আর তাদের মনে ভরে উঠল এক অদৃশ্য টান, যা এখনো বেঁচে আছে। হয়তো তাদের সম্পর্কের অনেক কিছুই বদলেছে, কিন্তু এই মাঠ, এই নীরব প্রহরী কাকতাড়ুয়া আবারও প্রমাণ করল—ভালোবাসা যত দূরেই যাক, তার শিকড় মাটির ভেতরে অটুট থেকে যায়। কৃষ্ণ আর কনিকা দুজনেই বুঝতে পারল, দূরত্বের দেয়াল ভাঙা কঠিন হলেও, আশার আলো এখনো নিভে যায়নি।
–
কৃষ্ণর ফিরে আসা প্রথমে যেন এক সোনালি আলোয় ভরে দিয়েছিল কনিকর হৃদয়। মাঠে বসে পুরোনো দিনের স্মৃতি রোমন্থন, কাকতাড়ুয়ার নীচে শৈশব থেকে কৈশোরের যাত্রাপথ আবার স্মরণ করা—এসবেই ভেতরে জন্ম নিয়েছিল নতুন করে বাঁচার আকাঙ্ক্ষা। কিন্তু দিন গড়াতেই স্পষ্ট হয়ে উঠল, তাদের স্বপ্নের আকাশ আসলে ভিন্ন ভিন্ন রঙে রঙিন। কৃষ্ণ চায় শহরে ফিরে গিয়ে স্থায়ী হতে, কারণ সে জানে শহরেই আছে সম্ভাবনা, চাকরির নিরাপত্তা, উন্নতির সিঁড়ি। শহরের আলো-ঝলমলে জীবন তাকে আকর্ষণ করে, যদিও ভেতরে সে এখনো গ্রামকে ভুলতে পারে না। অন্যদিকে কনিকা দৃঢ়—সে গ্রাম ছেড়ে কোথাও যাবে না। এই মাটির গন্ধ, নদীর ধারা, ধানের শিষ আর কাকতাড়ুয়ার নীরব ছায়ায় তার জীবন। সে জানে, শহরের কোলাহল হয়তো কৃষ্ণকে ডাকছে, কিন্তু তার আত্মা বেঁধে আছে গ্রামের শান্ত নিস্তব্ধতায়। এই টানাপোড়েনের ভেতর শুরু হল দ্বন্দ্বের আসল পর্ব—প্রেম বনাম দায়িত্ব, স্বপ্ন বনাম বাস্তবতা।
একদিন সন্ধ্যায় তারা দুজন আবার কাকতাড়ুয়ার পাশে বসল, কিন্তু এবার আর আগের মতো হাসিখুশি নয়, চারপাশে যেন এক অদৃশ্য উত্তেজনা জমে উঠল। কৃষ্ণ বলল, “শোন কনিকা, শহর ছাড়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি যদি শুধু গ্রামে থেকে যাই, তাহলে নিজের যোগ্যতা নষ্ট করব। আমাদের ভবিষ্যতের জন্যও তো কিছু করতে হবে।” কনিকা নির্লিপ্তভাবে উত্তর দিল, “ভবিষ্যৎ কি শুধু টাকার ওপর দাঁড়িয়ে? শহরের চাকরি যদি তোমায় আমাকে থেকে দূরে সরিয়ে দেয়, তবে সে ভবিষ্যৎ আমি চাই না। আমি এই গ্রাম ছেড়ে কোথাও যেতে পারব না।” কথাগুলো বাতাসে ভেসে উঠল যেন ছুরি হয়ে। কৃষ্ণ বুঝতে পারল, সে যতোই বোঝাক না কেন, কনিকার চোখে শহর মানে বিচ্ছেদ, মানে নিজের শিকড় থেকে ছিঁড়ে ফেলা। আর কনিকা বুঝতে পারছিল, কৃষ্ণকে ধরে রাখার মানে তাকে নিজের স্বপ্নের বিরুদ্ধে টেনে নিয়ে যাওয়া। দুজনেই নীরব হয়ে গেল, কাকতাড়ুয়া যেন তাদের দিকে তাকিয়ে আছে, ঠিক বিচারকের মতো, অথচ কোনো রায় দিচ্ছে না—শুধু নীরবে দাঁড়িয়ে আছে।
দিন যতই গড়াতে লাগল, এই দ্বন্দ্ব আরও তীব্র হয়ে উঠল। গ্রামের লোকজনও বিষয়টা টের পেতে লাগল—কৃষ্ণকে সবাই শহরের মানুষ ভেবে দেখছে, আর কনিকাকে গ্রামের শিকড়ের প্রতীক। দুজনের ভালোবাসা গভীর হলেও, সেই ভালোবাসার ভেতরেই ক্রমশ জমে উঠছিল ভাঙনের রেখা। কৃষ্ণ মাঝে মাঝে কনিকাকে বোঝাতে চাইত—“আমরা একসাথে শহরে গেলে সব ঠিক হবে, তুমি নতুন কিছু দেখবে, শিখবে।” কিন্তু কনিকা প্রতিবারই তার চোখে চোখ রেখে বলত—“আমার নতুন কিছু দরকার নেই। আমার পৃথিবী এই মাঠ, এই মানুষ, এই আকাশ।” এভাবে একদিন তাদের কথার লড়াই এমন জায়গায় পৌঁছল, যেখানে দুজনেই নিঃশব্দে কাঁদতে লাগল—একজন শহরের স্বপ্নে বন্দী, আরেকজন গ্রামের টানে বাঁধা। সেদিন রাতে, আকাশ ভরে ছিল তারায়, আর মাঠের মাঝখানে কাকতাড়ুয়া নীরবে দাঁড়িয়ে ছিল, যেন সাক্ষী হয়ে দেখছিল কিভাবে দুটি হৃদয় একই ভালোবাসায় বাঁধা থেকেও ভিন্ন স্বপ্নের জন্য আলাদা আলাদা পথের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। তাদের নিঃশব্দ কান্না আর অদৃশ্য যন্ত্রণার মাঝে কাকতাড়ুয়ার অবয়ব যেন সত্যিই বলছিল—“প্রেমকে রক্ষা করা সহজ নয়, কারণ স্বপ্ন সবসময় এক পথে হাঁটে না।”
–
দ্বন্দ্বের তীব্রতা যখন কৃষ্ণ আর কনিকাকে প্রায় আলাদা করে দিচ্ছিল, তখনই যেন ভেতরে ভেতরে এক নতুন আলো জ্বলে উঠল। তারা দুজনেই বুঝতে পারল—ভালোবাসার মানে শুধু একসাথে বসবাস নয়, বরং একে অপরের স্বপ্নকে সম্মান করা। কৃষ্ণ এক রাতে অনেক ভেবে কনিকার সামনে সত্যি স্বীকার করল, “আমি হয়তো শহরে গিয়ে বড় হতে পারতাম, কিন্তু যদি তোমায় হারাই, তবে সে সাফল্যের কোনো মানে নেই। আমি শহরের চাকরি, আলো সব ছেড়ে দিতে পারি, যদি তুমি পাশে থাকো।” কনিকার চোখে জল ভরে উঠল, কিন্তু সেই জলে ছিল আনন্দের দীপ্তি। সে ধীরে বলল, “তুমি যদি এখানে থেকে কিছু করতে চাও, আমি তোমার হাত শক্ত করে ধরব। শুধু প্রতিশ্রুতি দাও—তুমি আমার গ্রাম, আমার মানুষকে নিজের মানুষ মনে করবে।” কৃষ্ণ মাথা নেড়ে প্রতিশ্রুতি দিল। তখনই তারা অনুভব করল, সম্পর্কের আসল শক্তি এই সম্মান, এই একে অপরকে জায়গা দেওয়া। তারা বুঝল—কাকতাড়ুয়া সবসময় নীরব থেকে তাদের শেখাচ্ছিল, ভালোবাসা মানে কোনো একপক্ষের জেতা নয়, বরং দুজনের একসাথে পথ খোঁজা।
পরের দিন কৃষ্ণ সত্যিই নতুন সিদ্ধান্ত নিল। শহরের চাকরির পরিবর্তে গ্রামে থেকে নতুন উদ্যোগ শুরু করবে। গ্রামের মানুষকে সঙ্গে নিয়ে সে গড়ে তুলবে একটি ছোটো কৃষি-প্রকল্প, যেখানে আধুনিক পদ্ধতিতে চাষ হবে, ফসল ভালো হবে, আর গ্রামের তরুণরা কাজ পাবে। কনিকা পাশে থেকে তাকে সাহায্য করল—কৃষ্ণ পরিকল্পনা করত, কনিকা মেয়েদের সংগঠনের মাধ্যমে নারীশক্তিকে যুক্ত করত। গ্রামের মানুষ প্রথমে অবাক হলেও ধীরে ধীরে সবাই এগিয়ে এল। মাঠে নতুন প্রাণ ফিরল, নদীর ধারে শিশুদের খেলা জমে উঠল, আর কাকতাড়ুয়ার নীচে আবার শোনা গেল আড্ডা আর হাসির শব্দ। কৃষ্ণ বুঝতে পারল, শহরে সে হয়তো একজন কর্মচারী হয়ে থাকত, কিন্তু এখানে সে হয়ে উঠছে নিজের মানুষদের জন্য আশা আর শক্তির প্রতীক। আর কনিকা দেখল, তার প্রিয় মাঠে, তার গ্রামে এখন নতুন স্বপ্নের বীজ বপন হচ্ছে—যেখানে প্রেম আর দায়িত্ব একে অপরকে সম্পূর্ণ করছে।
এক সন্ধ্যায় তারা দুজনে আবার গেল সেই কাকতাড়ুয়ার কাছে। সূর্যের আলো তখন লাল হয়ে মাঠে ছড়িয়ে পড়েছে। কাকতাড়ুয়া বাতাসে দুলছে, তার লাল কাপড় যেন হাসিমুখে দোলে। কৃষ্ণ কনিকার হাত ধরে বলল, “দেখো, আমাদের কাকতাড়ুয়া আজ হাসছে।” কনিকা মৃদু হেসে বলল, “হয়তো ও জানে, আমরা ঠিক উত্তর খুঁজে পেয়েছি।” তারা বসে রইল মাঠে, চারপাশে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক, দূরে গরুর ঘণ্টা, আর আকাশে নক্ষত্র ভেসে উঠছে। তাদের হৃদয়ে আর কোনো দ্বন্দ্ব নেই, আছে কেবল একসাথে বাঁচার দৃঢ় প্রতিশ্রুতি। কাকতাড়ুয়া, যে শৈশব থেকে কৈশোর, প্রেম থেকে দ্বন্দ্ব সবকিছুর সাক্ষী, আজ যেন এক আশীর্বাদের মতো দাঁড়িয়ে আছে। তার লাল কাপড় বাতাসে দুলছে, যেন মাঠে জীবনের গান বাজাচ্ছে। কৃষ্ণ আর কনিকা বুঝল—ভালোবাসা মানে শুধু কারো পাশে থাকা নয়, বরং সেই মাটির সঙ্গে একাত্ম হওয়া, যেখানে তাদের গল্প জন্ম নিয়েছিল। আর সেই দিন থেকেই, লালরঙা কাকতাড়ুয়া হয়ে উঠল তাদের নতুন জীবনের প্রতীক—স্বপ্ন, ভালোবাসা আর আশার প্রতিমূর্তি।
***




