Bangla - প্রেমের গল্প

লাভার রোদঝরা দুপুর

Spread the love

অনির্বাণ ঘোষ


পর্ব ১: সেই প্রথম পাহাড় দেখা

নতুন জীবনের শুরুটা এমন হবে ভাবিনি কখনও। কলকাতা শহরের কোলাহল, আত্মীয়স্বজনের হইচই, বিয়ের নানা প্রস্তুতির মধ্যে একটুখানি নিঃশ্বাস ফেলার সময়ও ছিল না। কিন্তু ঠিক দশ দিন পর যখন নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনের ঠাণ্ডা বাতাস মুখে এসে লাগল, তখন বুঝলাম—এই শুরুটা আমার নিজের। অনন্যার সঙ্গে প্রথম সফর, প্রথম হানিমুন, আর সেই গল্পের প্রথম পাতায় পাহাড়। লাভা। নামটার মধ্যেই যেন এক ধরণের নরম তাপ আছে—যেটা আগুন নয়, কিন্তু উষ্ণতায় মোড়া।

ট্রেন থেকে নামার পর হালকা কুয়াশা জমেছিল স্টেশনের চতুর্দিকে। অনন্যা তখন একটা গোলাপি শাল গায়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, চোখে ক্লান্তির ছায়া, কিন্তু মুখে অদ্ভুত এক উত্তেজনা। ওর হাত ধরতেই ও বলল, “চলো, এবার পাহাড় ছোঁই।” আমি হাসলাম। সত্যিই তো, এই প্রথম ওর হাত ধরে এমন কোথাও যাচ্ছি যেখানে শুধুই আমরা, আর প্রকৃতি।

ট্যাক্সি ঠিক করা ছিল আগেই। কালিম্পং হয়ে আমরা উঠব লাভার দিকে। গাড়ি ছুটতে লাগল পাহাড়ি পথের বাঁকে বাঁকে। জানলার ধারে বসে অনন্যা চুপচাপ বাইরের দৃশ্য দেখছিল। কখনও চোখ আটকে থাকত পাইন গাছের মাথায়, কখনও বা কোনো পাহাড়ি ঝর্ণার শব্দে চমকে উঠত। আমি ওর দিকে তাকিয়ে থাকতাম মাঝেমাঝে। ওর চোখের ভেতর একটা নিঃশব্দ কল্পনা কাজ করছিল, যেন এই যাত্রার প্রতিটা মুহূর্ত ও মনে গেঁথে নিতে চাইছে।

কালিম্পংয়ের শহর ছাড়িয়ে আমরা যখন উঁচু দিকে উঠতে থাকি, তখন বাতাসটা ঠাণ্ডা হয়ে এল। গাড়ির কাচের ওপরে ধীরে ধীরে জমতে লাগল শিশিরের বিন্দু। অনন্যা আমার কাঁধে মাথা রাখল। বলল, “তুই জানিস, ছোটবেলায় আমার একটাই স্বপ্ন ছিল—বিয়ের পর একদিন পাহাড়ে যাব, খুব সকালে ঘুম ভাঙবে কুয়াশায় ঢাকা কোনো জানালায়।” আমি জবাবে শুধু ওর হাতটা ধরে রাখলাম। কারণ এমন কিছু মুহূর্ত থাকে, যেখানে কথার চেয়ে স্পর্শের দাম বেশি।

লাভায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে দুপুর পেরিয়ে বিকেল হয়ে এল। হোমস্টেটা ছোট্ট, কিন্তু বড়োই আপন। কাঠের ঘর, উঁচু ছাদ, আর সামনে একটা বারান্দা, যেখান থেকে দূরে পাইন বন দেখা যায়। হোমস্টের মাসিমা আমাদের দেখে হাসলেন। “নতুন দম্পতি তো? বেশ, এখানকার ঠাণ্ডা গায়ে লাগবে। গরম জল দিচ্ছি, চা তৈরি করে দিচ্ছি।”

ঘরের মধ্যে ঢুকে লাগেজ খুলতে খুলতেই দেখি জানালার কাঁচে জমে উঠেছে ঘন কুয়াশা। বারান্দায় দাঁড়াতেই একটা ঠাণ্ডা হাওয়া এসে কানে ফিসফিস করে বলে গেল, “স্বাগত তোমাদের লাভায়।” আমি ও অনন্যা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে রইলাম অনেকক্ষণ। কথা হয়নি, কিন্তু চোখের ভাষা বোঝা গিয়েছিল—এখানে এসে আমরা যেন একটু নতুন করে নিজেদের চিনতে শুরু করলাম।

সন্ধ্যাবেলা হোমস্টের রান্নাঘর থেকে গন্ধ ভেসে এল—চালের গন্ধ, কুমড়োর ঘন্ট, আর গরম গরম ডালের ঘ্রাণ। খেতে বসে অনন্যা বলল, “এখানে সময় যেন হাঁটছে। শহরে তো সব কিছু দৌড়চ্ছে।” আমি মাথা নেড়ে বললাম, “তাই তো এসেছি এখানে, সময়কে একটু ধরা দিতে।”

রাতের লাভা নিস্তব্ধ। দূরে কোথাও যেন একটা পেঁচার ডাক শোনা যাচ্ছে, আর মাঝে মাঝে কুয়াশার মধ্যে চুপিসারে সরে যাচ্ছে পাহাড়ি হাওয়া। আমি আর অনন্যা বসে রইলাম বারান্দায়, দু’জনের হাতে একটা করে কম্বল। আকাশে হাজার তারার ভিড়, যা শহরের আলোয় কখনও দেখা যায় না। অনন্যা হঠাৎ বলল, “তুই জানিস, এই আকাশটা এমন একদিনের জন্য নয়। আমি চাই, আমরা বারবার এমন কোনো জায়গায় আসি, যেখানে শুধু তুই আর আমি আর আকাশ।”

আমি ধীরে ধীরে বললাম, “তবে শুরু হোক এই আকাশ থেকেই, লাভা থেকে। আমাদের দুজনের প্রথম গল্প এখানেই লেখা হোক।”

রাত গভীর হতেই ঘরে ফিরে এলাম। কাঠের মেঝেতে পা ফেলার শব্দটাও যেন নরম হয়ে যায় এখানে। ঘুম আসছিল ধীরে ধীরে, কিন্তু তার আগেই অনুভব করলাম—এই পাহাড়, এই কুয়াশা, আর ওর পাশে থাকা—সব মিলিয়ে জীবন যেন একটু বেশিই সুন্দর।

পর্ব ২: কুয়াশার আড়ালে রোদ

ভোর পাঁচটা। ঘুম ভেঙে গেল এক অচেনা শব্দে। প্রথমে বুঝে উঠতে পারছিলাম না, কীসের আওয়াজ। জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই চোখে পড়ল—পাতায় পাতায় বৃষ্টি পড়ার শব্দ নয়, বরং সেটা ছিল মেঘের ঘনঘন ঠোকাঠুকি, যেন পাহাড়ের গায়ে এসে বেজে চলেছে এক অলিখিত সঙ্গীত। সামনে যতদূর চোখ যায়, সবটা ঢেকে আছে সাদা কুয়াশায়। ঠিক যেন কেউ তুলোর রোল খুলে ঢেকে দিয়েছে পুরো গ্রামটাকে।

অনন্যা তখনো ঘুমিয়ে। মুখের পাশে ছোট একটা চুল এলোমেলো হয়ে লেগে আছে, শ্বাস-প্রশ্বাসের ছন্দে ওর বুক ওঠানামা করছে। আমি আস্তে করে ওর কপালে একটা চুমু খেয়ে বেরিয়ে এলাম বারান্দায়। ভেতরে চায়ের জল বসিয়ে দিয়েছি। এই সকালটা চাই একা, কিন্তু স্মৃতিতে অনন্যাকে নিয়েই।

কিছুক্ষণের মধ্যেই ভিতর থেকে ওর ডাক এল, “তুই কোথায়?” আমি বললাম, “এখানেই, তুই উঠে এসেছিস?” ও বারান্দায় এসে দাঁড়াল, চোখে ঘুমের রেশ। গায়ে একটা মোটা সোয়েটার ওপর শাল জড়ানো। আমি ওকে একটা কাপে চা দিয়ে দিলাম। ঠোঁট ছুঁয়ে গরম ধোঁয়া উঠতেই ও চোখ বন্ধ করে বলল, “এই গন্ধটাই তো আমার স্বপ্নের হানিমুন ছিল।”

চুপচাপ বসে থাকলাম দু’জনে, কুয়াশার মধ্যে দিয়ে দেখা এক রোদহীন সকাল। পাখিরা ডেকেছে অনেকক্ষণ আগে, কিন্তু এ কুয়াশার দেয়াল যেন তাদের ডাকও মৃদু করে ফেলেছে।

সকাল আটটা নাগাদ আমরা হাঁটতে বেরোলাম। গন্তব্য—লাভা নেচার ইন্টারপ্রেটেশন সেন্টার। রাস্তা খাঁ খাঁ, মাঝে মাঝে স্থানীয় কিছু মানুষ দোকান খোলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তারা আমাদের দেখে হেসে বললেন, “আজকে নীচে রোদ, উপরে হালকা বৃষ্টি—মাঝখানে কুয়াশা ফাঁদ!” শুনে অনন্যা হেসে ফেলল। ও বলল, “এই কুয়াশার ফাঁদের মধ্যে আমি তো তোরই মাঝে হারিয়ে গেছি।”

আমি কাঁধে ওর হাত রেখে বললাম, “তবে চল, দেখি হারিয়ে গিয়ে আবার নিজেকে খুঁজে পাওয়া যায় কি না।”

পথের ধারে অজস্র নাম না জানা গাছ, আর গাছে গাছে জড়ানো সবুজ লতা। ছোট একটা পুলের কাছে থামলাম। পুলটার নীচ দিয়ে একটা ক্ষীণ ঝরনা বইছে। অনন্যা হঠাৎ জুতো খুলে পা ডুবিয়ে দিল পানিতে। ঠাণ্ডায় ওর মুখ সাদা হয়ে গেল, কিন্তু চোখে আনন্দের ঝিলিক। বলল, “তুই করবি না?” আমি বললাম, “আমার কাজ তো তোকে দেখেই আনন্দ নেওয়া।” ও হেসে বলল, “তাহলে চলো, আজ আমি এগিয়ে থাকি, তুই পিছনে পিছনে আয়।”

নেচার সেন্টারে পৌঁছে দেখি কেউ নেই প্রায়। কাঠের তৈরি ছোট্ট ঘর, চারপাশে সাজানো নানা প্রজাতির গাছপালা ও ছবি। এক বৃদ্ধ কেয়ারটেকার আমাদের দেখে বললেন, “নতুন বউ-বর বুঝি? লাভায় প্রথমবার?” আমি মাথা নেড়ে বললাম, “হ্যাঁ কাকা, নতুন বউ আর নতুন সফর।”

তিনি একটা ছোট্ট বনের দিকে দেখিয়ে বললেন, “এই যে বনটা, সকাল সকাল গেলে অনেক পাখি দেখা যায়। তবে আজ কুয়াশা ঘেরা আছে, তাই দেখা একটু কম মিলবে। তবে বাতাসে পাখির ডাক শুনলে বুঝবেন, আপনারা ঠিক জায়গায় এসেছেন।”

বনের পথ ধরে একটু হেঁটে গেলাম দু’জনে। চারপাশে কুয়াশার পরত, গায়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে ঠাণ্ডা জলবিন্দুরা। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আমি বললাম, “এই যে আমরা হাঁটছি, কোনও গন্তব্য ছাড়া, তবু মনে হচ্ছে ঠিক পথেই আছি।”

অনন্যা হেসে বলল, “কারণ পথের পাশে তুই আছিস, আর কুয়াশার ভিতরে ভালোবাসা হারায় না।”

ফিরে আসার পথে হঠাৎ একটু রোদ ফুঁড়ে এল। কুয়াশার ভিতর দিয়ে সূর্যের পাতলা আলো, গাছের পাতা ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে। চারদিকে রূপোলি একটা ঝিলিক। অনন্যা দাঁড়িয়ে রইল সেই আলোয়। ওর গায়ের শালটা হাওয়ায় একটু উড়ে উঠেছে, চোখে সূর্যের ঝলক। আমি কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। বললাম, “তুই জানিস, তোর এই মুহূর্তটার একটা ছবি হলে আমি চিরকাল রাখতাম।”

ও ধীরে কাছে এসে বলল, “ছবি নয়, তুই রাখিস শুধু স্মৃতি। কারণ ছবি পুরনো হয়, স্মৃতি নয়।”

বিকেলে আমরা ফিরে এলাম হোমস্টেতে। কেয়ারটেকার মাসিমা বললেন, “আজ রাতে আলু-পোস্ত আর গরম রুটি দেব। ওদিকের গ্রাম থেকে চাল এনেছি, তোমরা খেয়ে দেখো।” আমি আর অনন্যা একসঙ্গে বললাম, “দারুণ হবে!”

রাতে খেতে বসে দেখি, সত্যিই গ্রামের সুগন্ধি চালের সঙ্গে রান্নার জাদু মিলিয়ে এক অপূর্ব স্বাদ তৈরি হয়েছে। খাওয়া শেষে বারান্দায় বসে অনন্যা বলল, “তুই জানিস, এই সফরটা শুধু আমাদের নয়, আমাদের ভিতরের সময়কেও একটু চিনে নেওয়ার সময়।”

আমি বললাম, “তাহলে আগামীকালও চল, নিজেদের একটু একটু করে নতুন করে জানি।”

পর্ব ৩: ঝরনার শব্দে গলেপড়া সকাল

ভোরের হিমেল বাতাসে আজ একটু অন্যরকম ঘ্রাণ। ঘরের জানালার কাচের ওপারে রাতের শিশির জমে রুপোলি হয়ে আছে, আর দূর পাহাড়ে সূর্যের আলো নামছে ধীরে ধীরে—একটা সোনালি দড়ির মতো যেন টেনে আনছে দিনটাকে আমাদের দোরগোড়ায়। অনন্যা তখনো ঘুমিয়ে। ওর মুখের কোণে যেন একটা হালকা হাসি লেগে আছে, হয়তো স্বপ্নে লাভার বন ধরে হেঁটে চলেছে একা, বা হয়তো আমার সঙ্গেই।

আমি আস্তে করে হোমস্টের রান্নাঘরে গিয়ে কেয়ারটেকার মাসিমার কাছে চা চাইলাম। উনি মুচকি হেসে বললেন, “নতুন বররা অনেকেই ঘুম ভেঙেই চা খুঁজে নেয়, কিন্তু আপনি একটু আগে এসেছেন—ভালো লক্ষণ, বুঝলেন?” আমি হেসে মাথা নাড়লাম, “সকালটা চুপচাপ দেখতে ভালো লাগে, তার জন্যই।”

চায়ের কাপ হাতে বারান্দায় ফিরে এলাম। এক মুহূর্তেই আমার চোখ আটকে গেল—কুয়াশার ভেতর দিয়ে পাহাড়ি পথের নিচে যেন একটা সরু ঝরনার গুঞ্জন শুনতে পাচ্ছি। এই গানের মতো আওয়াজটাই আজকের সকালে নতুন কিছু ডেকে আনছে বলে মনে হলো।

অনন্যা একটু পর ঘুম থেকে উঠে এল, গায়ে প্যাঁচানো কম্বলের ভাঁজ খুলতে খুলতেই বলল, “আজ কোথায় নিয়ে যাবে আমাকে?” আমি হেসে বললাম, “যেখানে ঝরনার শব্দে প্রেম গলে পড়ে—চল আজ রিশপ যাওয়ার রাস্তায় হাঁটি, একেবারে মাঝপথে একটা ঝরনা আছে।”

সকালের খাবার শেষে হাঁটতে বেরোলাম দু’জনে। লাভার রাস্তা একদম ফাঁকা। মাঝেমধ্যে কয়েকজন স্থানীয় মানুষ, স্কুলগামী শিশুর দল, আর কিছু বিদেশি পর্যটক, যারা হয়তো আমাদের মতোই নিজেদের নতুন গল্প খুঁজছে এই পাহাড়ে।

পথের দু’পাশে ছড়ানো বুনো ফুল, ভিজে পাতায় জল জমে আছে, আর মাঝে মাঝে কুয়াশা সরে গিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে পাহাড়ি গাঁয়ের সিঁড়ির মতো বসতি। হাঁটতে হাঁটতে অনন্যা বলল, “এই রাস্তাটা যেন সারা জীবনের মতো মনে থাকবে।” আমি জবাবে বললাম, “এই রাস্তায় প্রথমবার তোকে আমার পাশে এতটা নির্ভার দেখছি, সেটাও মনে থাকবে।”

হঠাৎ একটা বাঁকে এসে থামলাম। নিচে একটা সরু পথ নেমে গেছে—ঠিক সেই ঝরনার দিকে। সেখানে বাঁশের তৈরি সাঁকো, আর তার ঠিক পাশে একটানা জলের ধারা পড়ছে পাথরের গায়ে। চারপাশে নিঃশব্দ, শুধু জলের টুপটাপ শব্দ যেন গানে মিশে গেছে।

অনন্যা পাথরের ওপরে বসে পা ছুঁইয়ে দিল জলে। হিমশীতল জলে ওর মুখটা লালচে হয়ে উঠল, কিন্তু চোখে আনন্দ। ও বলল, “তুই না বলেছিলি, প্রেম গলে পড়ে এই ঝরনার শব্দে? সত্যি বলেছিলি, আজ আমার ভিতরের সব কিছু যেন ধুয়ে যাচ্ছে এই জলে।”

আমি ওর পাশে বসলাম। একটু নীরবতা এল দু’জনের মাঝে। কেবল ঝরনার গান, আর পাখির ডানা ঝাপটানোর শব্দ। এই একটানা জলপ্রবাহের মতোই যেন আমাদের ভালোবাসার স্রোতও বয়ে চলেছে—নতুন, নির্ভার, সহজ।

অনন্যা হঠাৎ একটা পাথরে হাত বুলিয়ে বলল, “তুই কি জানিস, এই পাথরগুলো কত বছর ধরে জলের ধাক্কা খাচ্ছে? কিন্তু তাও তারা রয়ে গেছে। আমরা কি পারব তেমন হয়ে থাকতে? সময়ের, কথার, ভুল বোঝাবুঝির জলে ধুয়ে গিয়েও কি একসঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকতে পারব?”

আমি মৃদু গলায় বললাম, “জানি না অনন্যা, কিন্তু এই মুহূর্তটা যেমন সত্যি, তেমন করেই আমরা একসঙ্গে থাকি। সময় যা আনবে, সে তো ঝরনার মতোই—ধুয়ে দেবে, কিন্তু গান রেখে যাবে।”

পথে ফিরতে ফিরতে অনন্যার চোখে ধরা পড়ল একজোড়া পাহাড়ি শিশু, তারা একটা বাঁশের বাস্কেটে করে ফুল কুড়োচ্ছে। অনন্যা হাঁটু গেঁড়ে বসে ওদের সঙ্গে কথা বলল। ওরা হেসে বলল, “এই ফুল দিয়ে আজ পূজা হবে। পাহাড়ে যখন নতুন বিয়ে হয়, তখন এমন ফুল দিয়ে মন্দির সাজানো হয়।” অনন্যা আমার দিকে তাকিয়ে চোখ ইশারা করল, যেন বলল—“আমাদেরও তো এমন পূজা হয়ে গেছে!”

দুপুরে ফিরে এসে বারান্দায় বসলাম। আজ কুয়াশা পাতলা, আর আকাশে রোদ ফুঁড়ে আসছে। বারান্দা গরম হয়ে উঠেছে একটু। চায়ের কাপ হাতে অনন্যা বলল, “আজ বুঝলাম, ভালোবাসার আসল রূপ হয়তো এমনই—চুপচাপ কোথাও বসে থাকা, আর একটানা কোনো সুর শুনে যাওয়া। ঝরনার, হাওয়ার, কিংবা কারো নিঃশ্বাসের।”

আমি বললাম, “তাহলে চল, এই সুরটাকে চিরদিনের জন্য মনে রাখি।”

পর্ব ৪: বনপথে হেঁটে যাওয়া এক দুপুর

বেলা এগারোটার দিকে হালকা রোদ এসে পড়েছিল বারান্দায়। বাতাস ঠাণ্ডা হলেও তার মধ্যে একধরনের কোমলতা ছিল, যেন সূর্য নিজের পায়ের আওয়াজ রেখে হেঁটে চলেছে পাহাড়ের গায়ে। হোমস্টের কেয়ারটেকার মাসিমা বললেন, “আজ আবহাওয়া ভালো থাকবে সারাদিন। বনপথে ঘুরতে যেতে চাইলে এখনই ভালো সময়।” আমরা দু’জনেই মাথা নেড়ে রাজি হলাম।

তাই একটু হালকা খেয়ে, দুটো পানির বোতল, একটা ছাতা আর ওর প্রিয় খাতা-কলম নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। অনন্যা যেখানে যায়, সেখানেই ওর সেই ছোট্ট নোটবুকটা থাকে। সেখানে ও ছবি আঁকে না, গল্পও লেখে না, কেবল মুহূর্ত ধরে রাখে শব্দে—যা পরে নিজেকেই পড়ে শোনায়।

বনের পথে পা রাখতেই যেন এক অদ্ভুত নীরবতা আমাদের গায়ে এসে জড়িয়ে ধরল। এ নীরবতা ভয়ংকর নয়, বরং শান্তির। কচি ঘাসে পা পড়ার শব্দ, শুকনো পাতার ওপরে হালকা ভেজা ধ্বনি, আর মাঝে মাঝে পাখির নাম না জানা ডাক—সব মিলিয়ে একটা শব্দছায়া তৈরি হচ্ছিল, যার ভিতরে হেঁটে চলা মানে নিজেকে একটু একটু করে ছুঁয়ে যাওয়া।

পথের দু’ধারে ঘন সবুজ, মাঝে মাঝে সূর্যের আলোর রেখা পড়ে আছে পাতার ফাঁকে। অনন্যা মাঝে মাঝেই থেমে পড়ে, কিছু একটা দেখে। কখনও মাটির ধারে একটা ছোটো হলুদ ফুল, কখনও গাছের গায়ে প্যাঁচানো লতা, আবার কখনও গাছের গায়ে খোদাই করা কোনো নাম।

ও একবার বলল, “তুই কখনও গাছের গায়ে নিজের নাম লিখেছিস?” আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম, “না, লিখিনি। গাছের গায়ে কিছুর দাগ ফেলতে ইচ্ছে হয়নি কোনোদিন। বরং চেয়েছি গাছটা আমাকে মনে রাখুক, আমি যেন চিহ্ন না রেখে চলে যেতে পারি।”

ও কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল, তারপর বলল, “তুই যদি কোনো গাছ হতে, তাহলে তুই হতে ওই বাঁশগাছগুলো। চুপচাপ, লম্বা, নম্র। আর আমি হতাম এক বুনো ফুল, যা হয়তো অচেনা, কিন্তু গন্ধে টিকে থাকে।”

আমি হেসে বললাম, “তুই টিকে থাকিস আমার বুকের ভেতর, গন্ধে না হোক, স্মৃতিতে।”

পথে আরও একটু এগোতেই একটা ফাঁকা জায়গায় পৌঁছালাম। সেখানে কাঠের দুটো বেঞ্চ রাখা ছিল, পাশে একটা জীর্ণ চৌচালা ছাউনি। দূরে পাহাড়ের গায়ে গায়ে ছড়িয়ে থাকা সবুজ আর তার ফাঁকে ফাঁকে সাদা মেঘ। সেই দৃশ্য দেখে অনন্যা বসে পড়ল বেঞ্চে। ওর চোখ দুটো উজ্জ্বল, কিন্তু ঠোঁটে কোনো শব্দ নেই।

আমি পাশে গিয়ে বললাম, “কি ভাবছিস?”
ও ফিসফিস করে বলল, “ভাবছি, এই জায়গাটায় যদি একদিন ফেরত আসি, তুই কি আবার আমার পাশেই থাকবি?”
আমি বললাম, “ফেরত তো আমি আসবই, কারণ আমার স্মৃতি এখানে আটকে আছে। আর তুই তো সেই স্মৃতিরই নাম।”

একটা সময় পরে আমরা আবার হাঁটতে শুরু করলাম। বন আরও ঘন হতে লাগল। হালকা ভেজা গন্ধ, ধোঁয়ার মতো হাওয়া, আর যেন চারপাশে এক নরম ছায়া। অনন্যা বলল, “এই জায়গাটায় এসে আমার মনে হয় আমরা যেন আর নতুন বর-বউ নই, বরং বহু পুরোনো কোনো চেনা সম্পর্কের মানুষ, যারা ভুল করে একে অপরকে খুঁজে পেয়েছে।”

আমি বললাম, “হয়তো আগেও এসেছিলাম এই পথে, অন্য কোনো জন্মে, অন্য কোনো সময়ে, অন্য কোনো নামে। হয়তো সেদিনও তুই এমন করেই পায়ে ঘাস লাগিয়ে বলেছিলিস—এই অনুভূতিটা চিরকাল মনে রাখব।”

বিকেলের দিকে আমরা ফিরে এলাম। হোমস্টেতে ঢুকতেই মাসিমা বললেন, “আজ বিকেলে রিশপের দিকের রাস্তা থেকে সূর্যাস্ত ভালো দেখা যায়। চাইলে গিয়ে দেখতে পারো।” অনন্যা তখন বলল, “আজ শুধু বসে থাকতে ইচ্ছে করছে, হাঁটার চেয়ে বেশি।”

তাই বারান্দায় ফিরে চায়ের কাপ হাতে বসে রইলাম দু’জনে। একটানা বসে থাকা, কথা না বলা, শুধু মাঝেমধ্যে একে অপরের দিকে তাকানো—এইসব ছোট ছোট মুহূর্তেই যেন সম্পর্কের বড় অর্থ লুকিয়ে থাকে।

রাতের দিকে অনন্যা ওর খাতাটা খুলে লিখতে শুরু করল। আমি কিছু বলিনি। ওর লেখার শব্দ শুনতে শুনতে ভাবছিলাম—এই লাভা আমাদের দু’জনকে নতুন করে চিনিয়েছে, আমাদের সম্পর্কের ভিত গেঁথেছে একেবারে নরম মাটির মতো নীচে, যেটা সময় গেলে ফল দেবে নিশ্চয়।

আমি জানি, এই বনপথে হেঁটে যাওয়ার দুপুরটা শুধু একটা দিন ছিল না—এটা ছিল এক ভালোবাসার পরীক্ষার মুহূর্ত, যেখানে কথা নয়, চুপচাপ পাশাপাশি হাঁটা সবচেয়ে শক্তিশালী ভাষা হয়ে উঠেছিল।

পর্ব ৫: সেই সন্ধ্যার রঙে আঁকা প্রতিশ্রুতি

বিকেলের দিকে যখন আকাশে সোনালি ছায়া পড়ছিল, তখন অনন্যা হঠাৎ বলল, “চল না আজ একটু দূরে যাই, সূর্য ডুবে যাওয়ার আগেই।” আমি বললাম, “আজ তুই যা বলবি, তাই হবে।” ওর চোখে তখন একরকম জেদ আর কোমলতা মেশানো ছিল, যেটা বিয়ের আগে প্রায়ই দেখেছি—যখন ও নতুন কিছু আবিষ্কার করতে চায়, কিন্তু পাশে কাউকে চাই সেই পথ চলায়।

আমরা বেরিয়ে পড়লাম। হোমস্টে থেকে রিশপের দিকে যে কাঁচা পথটা গেছে, সেটা একটু ঢালু, দুই ধারে লাল মাটি আর বুনো ঘাসে ভরা। কুয়াশা তখন একটু পাতলা হয়েছে, আর দূরের আকাশে রঙের খেলা শুরু। পিচের রাস্তা ছেড়ে মেঠো পথে পা ফেলা মানে যেন সময় থেকে বেরিয়ে এসে অন্য এক শান্ত জগতে ঢুকে পড়া।

পথে খুব একটা লোকজন নেই। মাঝে মাঝে দু-একটা বাইক চলে যাচ্ছে, আর দোকানের সামনে বসে থাকা বৃদ্ধ পাহাড়ি মানুষজন আমাদের দেখে মুচকি হাসছেন। তাদের মুখে কোনো কথা নেই, কিন্তু চোখে যেন কিছু একটা বলে যাচ্ছেন—হয়তো আশীর্বাদ, হয়তো স্মৃতি।

অনন্যা পথ চলতে চলতে হঠাৎ থেমে গেল। একটা ছোট বাঁশঝাড়ের পাশে দাঁড়িয়ে বলল, “এই জায়গাটাকে মনে রাখিস। হয়তো পরে এখানে একটা ছবি তুলব, নয়তো শুধু তোর সঙ্গে বসে থাকব একদিন।” আমি ওর পাশেই দাঁড়ালাম। গায়ে লাগছিল শীতল হাওয়া, কিন্তু ওর কাঁধে হাত রাখতেই একটা উষ্ণতা ছড়িয়ে গেল।

আমরা যখন সেই জায়গায় পৌঁছালাম যেখান থেকে পুরো পশ্চিম দিকটা খোলা দেখা যায়, তখন সূর্য ঠিক পাহাড়ের কিনারায় এসে দাঁড়িয়েছে। আকাশের রঙ যেন ক্যানভাসে ছড়ানো জলরঙ—কমলা, সোনালি, হালকা নীল। সেই রঙে গা ভাসিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম দু’জনে, একেবারে চুপচাপ।

অনন্যা বলল, “এই রকম দৃশ্য আমি ছবিতে দেখেছি, সিনেমায় দেখেছি, কিন্তু চোখে দেখে বুঝলাম—রঙও শব্দহীন কথা বলে।” আমি বললাম, “তুই যদি এই রঙের মতো হয়ে যাস, আমি কি ছুঁতে পারব তোকে?” ও আমার দিকে তাকিয়ে হাসল। “তুই ছুঁয়ে ফেলেছিস অনেক আগেই। এখন শুধু ধরে রাখার গল্প।”

একটা সময় ও বলল, “তুই কি জানিস, আমি ভয় পাই?”
আমি একটু চমকে গিয়ে বললাম, “কিসের ভয়?”
“এই রকম সুন্দর মুহূর্ত যে বেশিক্ষণ থাকে না। এই যে আমরা এখানে, এই যে রঙ, এই শান্তি, সবকিছু মিলিয়ে এটা যেন স্বপ্ন। আর আমি ভয় পাই, ঘুম ভেঙে গেলে আর কিছুই থাকবে না।”

আমি বললাম, “তবে চল, আমরা জেগে জেগেই স্বপ্ন দেখি। যাতে ঘুম ভাঙলেও কিছুটা থেকে যায়।”

তখনই একটা ছোট্ট পাহাড়ি মেয়ে ফুলের মালা বিক্রি করতে এল। তার গলায় পলিথিনে বোনা দুটো মালা, একটায় বুনো ঝুমকো ফুল, অন্যটায় লাল বকুল। অনন্যা ওর কাছ থেকে একটা মালা কিনে আমার হাতে দিয়ে বলল, “তুই যদি কখনও আমায় হারিয়ে ফেলিস, এই মালাটা দেখে যেন মনে পড়ে—আমি তোকে ভালোবেসেছিলাম ঠিক এই রকম একটা সন্ধ্যায়।”

আমি মালাটা হাতে নিয়ে কেবল বললাম, “তুই হারাবার জন্য জন্মাসনি। তুই তো ওই রঙের মতো—রোজ সন্ধ্যায় ফিরে আসবি।”

সন্ধ্যা নামতে নামতে আমরা হেঁটে ফিরছিলাম। পথের ধারে আলো জ্বলছে না, কেবল দিগন্তে আলোর শেষ রেখাগুলো কাঁপছে। বারান্দায় ফিরে এসে দেখি আকাশের তারা একে একে জ্বলছে। পাহাড়ি রাত্রির নিজস্ব এক রোমান্স আছে—শব্দ নেই, আলো নেই, তবু একটা টান আছে হাওয়ার মধ্যে।

চায়ের কাপ হাতে আমরা বসে রইলাম। অনন্যা তখন হঠাৎ পায়ের কাছে রাখা খাতা থেকে কিছু পড়ে শোনাল। “এই পাহাড়ে রঙের সন্ধ্যায়, আমি লিখে রাখলাম প্রতিশ্রুতি। তোকে হারাব না, তোর থেকে দূরে যাব না। যদি একদিন থেমে যাই, তবু তোকে নিয়ে চলার স্মৃতি রেখে যাব।”

আমি আর কিছু বলিনি। শুধু ওর হাতটা শক্ত করে ধরে বললাম, “এই সন্ধ্যা আমাদের হয়ে থাকুক। রঙটা যেন মুছে না যায়।”

রাতে শুয়ে শুয়ে ও বলল, “তুই জানিস, এই হানিমুনের মানে শুধু ভালোবাসা নয়। এটা যেন ভালোবাসাকে জানার একটা উপায়।” আমি বললাম, “আর সেই জানাটাই হয়তো একেকটা সন্ধ্যায় লিখে রেখে যাবো।”

পর্ব ৬: হিমেল রাতে নামহীন কথোপকথন

রাত যত গভীর হচ্ছিল, লাভার বাতাস ততই শীতল হয়ে উঠছিল। হোমস্টের বারান্দায় বসে আমরা দু’জনে গুটিয়ে গিয়েছিলাম কম্বলের নিচে। কানের পাশ দিয়ে কুয়াশা হেঁটে যাচ্ছিল, আর মাথার ওপর আকাশে একরাশ তারার মেলা। এই পাহাড়ি রাতে কোনও কৃত্রিম আলো নেই, কোনও শব্দ নেই, শুধু প্রকৃতি তার আসল রূপে উন্মুক্ত।

অনন্যা বারান্দার খোলার দিকে তাকিয়ে ছিল। ওর চোখে ছিল আলো-ছায়ার এক ধরণের নাচ, যেন কোনও পুরোনো গল্প আবার নতুন করে বেঁধে আসছে। আমি ওর পাশে বসে চুপ করে থেকেছি অনেকক্ষণ, কিছু বলিনি। এমন কিছু মুহূর্ত থাকে, যেখানে ভাষা অপ্রয়োজনীয় হয়ে যায়।

অনন্যা হঠাৎ বলল, “তুই কি জানিস, এই রাতের ভেতর একটা শান্তি আছে, যেটা শব্দ ছাড়া বোঝা যায়?”
আমি বললাম, “হয়তো এই পাহাড়ের বুকেই জমে আছে সেই শান্তি। শহরে তো শব্দই আমাদের চেনা ভাষা, এখানে নীরবতা কথার মতো শোনায়।”

ও আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুই যখন চুপ করে থাকিস, তখন তোর ভেতরের সমস্ত কথা আমি যেন শুনতে পাই।”
আমি একটু ম্লান হাসি হেসে বললাম, “তুই তো আমার চুপ থাকাটাকেই ভাষা বানিয়ে নিয়েছিস।”

ও বলল, “তুই কী নিয়ে ভাবিস এতক্ষণ ধরে?”
আমি উত্তর দিলাম, “ভাবি এই সম্পর্কটা নিয়ে—তুই আর আমি। এই হানিমুন, এই লাভা, এই নিঃশব্দ রাত—সব কিছু মিলে একটা ভবিষ্যতের ছবি তৈরি করছে কি না, তাই নিয়ে।”

অনন্যা একটু চুপ করে রইল। তারপর ধীরে বলল, “তুই জানিস, আমার ভয় হয়, হয়তো এই সম্পর্কটা এই জায়গার সৌন্দর্যে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। হয়তো ফিরে গিয়ে আমরা আবার শহরের কোলাহলে হারিয়ে যাবো।”

আমি ওর হাতটা ধরে বললাম, “হয়তো আমরা শহরে ফিরব, কিন্তু এই লাভা আমাদের মধ্যে থেকে যাবে। যে রকম একটা কবিতা পড়ে কেউ বদলে যায়, তেমনি এই সফরটা আমাদের ভেতরের কিছু নরম করে দিয়েছে।”

অনন্যা ওর মাথাটা আমার কাঁধে রেখে বলল, “তুই কখনও নিজেকে গুটিয়ে নিস না, আর কখনও ভাবিস না যে আমি বুঝব না। আমি তো তোর চুপ কণ্ঠও শুনতে শিখে গেছি।”

আমি ধীরে বললাম, “তুই আমার সবচে বড়ো সাহস।”

সেই রাতে আমরা আর ঘরে ফিরলাম না তাড়াতাড়ি। চাদর মুড়ে বারান্দায় বসেই থেকে গেলাম। পায়ের নিচে কাঠের তক্তায় হালকা ঠাণ্ডা, মাথার ওপর তারা। অনন্যা বলল, “তুই জানিস, এমন রাতে মনে হয় আমরা যেন একটা নামহীন পাহাড়ি দেশে চলে এসেছি, যেখানে কেউ আমাদের চেনে না, আমরা শুধু দুটো শব্দ—তুই আর আমি।”

আমি বললাম, “এই নামহীনতাটাই তো আসল পরিচয়। যেখানে কেউ আমাদের ডাকছে না, সেখানে আমরা নিজেরাই একে অপরকে খুঁজে নিচ্ছি।”

রাত বাড়তেই কুয়াশা আরও ঘন হয়ে এলো। আমি ওকে জড়িয়ে ধরলাম। শরীর গরম হয়ে উঠছিল, কিন্তু তার চেয়েও বেশি গরম ছিল ওর নিঃশ্বাসের ছোঁয়া। এক মুহূর্তের স্পর্শে যেন ভরে উঠছিল এক জীবন।

অনন্যা আমার গলা ছুঁয়ে বলল, “ভালোবাসা শুধু চোখে চোখ রাখা নয়, বরং নীরবতার ভিতরে ডুবে গিয়ে কারও শ্বাস নেওয়ার শব্দ শুনে ফেলা।”

আমি কিছু বলিনি। শুধু ওকে জড়িয়ে ধরেই থাকলাম।

ভোর হতে হতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম দু’জনেই বারান্দার চেয়ারে। ঘুম ভাঙল হালকা আলোয়। ঠোঁটে জমে থাকা কুয়াশা, চুলে লেগে থাকা শিশির, আর ওর পাশে ঘুমন্ত মুখ—যেটা দেখে মনে হল, এই রাতটাই হয়তো আমাদের মধ্যে তৈরি করল এক এমন বৃত্ত, যেটা কোনো শব্দ চায় না, শুধু হৃদস্পন্দন বোঝে।

এই লাভার হিমেল রাত—চুপচাপ, গভীর, অথচ স্পষ্ট—আমাদের সম্পর্কের এমন এক অধ্যায় হয়ে থাকল, যেটার ভাষা কেউ লিখে উঠতে পারবে না।

পর্ব ৭: মেঘবালিকার পাহাড় ছোঁয়ার দিন

ভোর পাঁচটায় অনন্যার ঘুম ভাঙল হঠাৎ। ওর চোখে যেন ঘুমের পর্দা তখনও আধা টানানো, কিন্তু মুখে সেই স্বপ্নভেজা উচ্ছ্বাস। আমি তখনও আধো ঘুমে, কিন্তু ওর ডাকে উঠেই পড়লাম। “আজ একটা জায়গা দেখাব তোকে,” বলল অনন্যা। আমি বললাম, “আবার হাঁটা?” ও বলল, “না, এবার শুধু দাঁড়িয়ে থাকব, আর মেঘ ছুঁব।”

আমি কিছু না বলে শুধু মুচকি হেসে বললাম, “চলো, মেঘবালিকার খেয়ালই যখন, তখন পাহাড় তো সঙ্গ দেবে।”

হোমস্টের বাইরে তখন অন্ধকারে ঢাকা, কুয়াশা গাঢ় হয়ে পাহাড়ের গায়ে জড়ানো। কেয়ারটেকার মাসিমা আমাদের দেখে চুপিচুপি একটা থার্মাসে চা দিয়ে দিলেন। “আজ সকালে রাস্তার বাঁকে দাঁড়ালেই মেঘ নেমে আসবে মুখোমুখি,” বললেন তিনি। আমরা হাঁটতে হাঁটতে উঠলাম সেই রাস্তার দিকে—যেখানে ধাপে ধাপে পাহাড় নামছে, আর মাঝে মাঝে গাছেদের ছায়া পড়ে আছে কুয়াশায়।

অনন্যা একটা জায়গায় এসে দাঁড়িয়ে পড়ল। সেখান থেকে নিচের গ্রাম দেখা যায়, আর ওপরে সূর্য ওঠার আগেই আলো ফুটছে ধীরে ধীরে। “এই জায়গাটা,” ও বলল, “আমি অনেকদিন আগে ছবি দেখেছিলাম কোথাও। তখন ভাবতাম, আমি যদি একদিন এমন একটা পাহাড়ে দাঁড়িয়ে মেঘ ছুঁতে পারতাম!”

আমি পাশ থেকে বললাম, “আজ সেই দিন এল—তুই শুধু ছবি দেখিসনি, ছবির ভেতর ঢুকে পড়েছিস।”

মেঘ ধীরে ধীরে আমাদের গায়ের চারপাশে ঘিরে ধরল। ঠোঁটে শিশিরের স্বাদ, চোখে ছুঁয়ে যাওয়া বাষ্প। অনন্যা দু’হাত বাড়িয়ে বলল, “এই আমি, সেই মেয়েটা, যে একদিন বইয়ের পাতায় মেঘের গল্প পড়ত, আজ সে নিজেই মেঘে ঢুকে গেছে।”

আমি ওর পাশেই দাঁড়িয়ে ওর মুখের দিকে তাকালাম। সেখানে কোনও পরিণত প্রেমিকার ছাপ নেই, বরং একটা শিশুর উচ্ছ্বাস, যেটা দেখলে মানুষ নিজেকেও খুঁজে পায় নতুন করে। আমি বললাম, “তুই যেভাবে এই মুহূর্তটাকে নিজের করে নিচ্ছিস, আমি চেয়ে থাকতে পারি শুধু।”

অনন্যা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “এই পাহাড়ে, এই মেঘের মাঝে দাঁড়িয়ে তুই যদি আমাকে আবার প্রপোজ করিস, আমি আবার হ্যাঁ বলব।”

আমি হেসে হাঁটু গেঁড়ে বসে বললাম, “এই পাহাড়, এই মেঘ, এই শিশির আর এই মুখ—এর বাইরে আর কিছু চাই না। অনন্যা, আমাকে আবার ভালোবাসবি?”

ও দু’হাত মুখে দিয়ে হেসে ফেলল। “তোকে এতবার ভালোবাসব, যতবার এই পাহাড়ে কুয়াশা নামে।”

আমরা অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম সেই ধূসর আলোয়, মুখে কম কথা, কিন্তু মনে গুঞ্জন। ফেরার পথে অনন্যা বলল, “আজকের সকালটা আমার সারা জীবনের প্রিয় সকাল হয়ে থাকল। এখানে আমি আবার ছোট হয়ে গেলাম, আবার নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শিখলাম।”

হোমস্টেতে ফিরে এসে চা খেতে খেতে ও ওর খাতা খুলে লিখতে লাগল। মাঝে মাঝে থেমে পড়ছে, চোখের কোণে হাসি, কখনও দৃষ্টি বাইরে ছুটে যাচ্ছে।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কি লিখছিস?”
ও বলল, “আজকের মেঘ ছোঁয়ার গল্প। হয়তো এটা কাউকে কখনও দেখাব না, তুই ছাড়া।”

সেই বিকেলে হোমস্টের ছাদে বসে আমরা সূর্য ডুবে যাওয়া দেখছিলাম। কিন্তু আমাদের মধ্যে আলো ছিল। কারণ আজকের সকালটা আমাদের প্রেমের ভেতর এক নতুন আলো এনেছে—যেখানে না আছে সন্দেহ, না আছে জটিলতা, আছে শুধু এক ধরণের শিশুসুলভ নির্ভরতা।

মেঘবালিকার সেই পাহাড় ছোঁয়ার দিন হয়ে থাকল আমাদের জীবনের সেই পাতায়, যেখানে বয়স থেমে যায়, আর ভালোবাসা হেসে বলে—“তুই আমাকে যেভাবে দেখিস, সেভাবেই থাকি চিরকাল।”

পর্ব ৮: অচেনা পথ, চেনা হাত

সকালের খাবার শেষে অনন্যা হঠাৎ বলল, “আজ একটু ভিন্ন কিছু করি। ঘোরাঘুরির প্ল্যান নয়, বরং হেঁটে যাই এমন এক জায়গায় যেখানে আমরা আগে যাইনি।” আমি বললাম, “অচেনা পথ ধরলে চেনা হয়ে যায় সম্পর্কও। চল।”

পাহাড়ি রাস্তার পাশে একটা সরু পায়ে চলা পথ নেমে গিয়েছে বনের ভেতর। মাসিমা সাবধান করে বলেছিলেন, “ওদিকে খুব বেশি লোক যায় না, তবে পথে গেলে ফিরে আসার দিকটা দেখে নিয়ো।” আমরা মাথা নেড়ে বলেছিলাম, “আমরা দু’জনে একসঙ্গে গেলে, পথও ভুল হয় না।”

পথটা শুরুতেই অনেক শান্ত। শুকনো পাতা গাছের নিচে পড়ে আছে, বাতাসে হালকা পাখির ডাক, আর মাঝে মাঝে কাঠের ছাউনির মতো বাঁশের গায়ে সূর্যের আলো ছায়া ফেলছে। আমরা পাশাপাশি হাঁটছিলাম, কিন্তু কথাবার্তা হচ্ছিল কম। এই নীরবতাও আমাদের এক নতুন সম্পর্ক তৈরি করে দিচ্ছিল—যেখানে চোখই সবচেয়ে ভালো ভাষা।

অনন্যা একটা জায়গায় থেমে বলল, “এই বনটা অনেকটা আমার মনের মতো—বাইরে থেকে সহজ, কিন্তু ভিতরে ঢুকলে বুঝি কত স্তর।” আমি বললাম, “তাই তো তোর পাশে থাকতে এত ভালো লাগে। প্রতিবার নতুন কিছু শিখি।”

কিন্তু এই নির্জন পথের গভীরে হঠাৎ এক বাঁকে গিয়ে আমি বুঝে উঠতে পারলাম না কোন দিকে যাব। মোবাইলে নেটওয়ার্ক নেই, আর চারপাশে কোনও দিশারী বোর্ডও নেই। আমি বললাম, “দেখি, একটু সামনে গিয়ে বুঝি কোথায় উঠবে পথ।” অনন্যা বলল, “আমি এখানেই দাঁড়াই, তুই একটু এগিয়ে দেখে আয়।”

আমি মাত্র মিনিট পাঁচেক এগিয়েছিলাম, কিন্তু ফিরেই দেখি অনন্যা নেই।

সেই মুহূর্তে সময় যেন থমকে গেল। হাওয়াটা হঠাৎ যেন ভারী হয়ে উঠল, পাখির ডাক থেমে গেল, গাছের পাতাও নিঃশব্দ। আমি জোরে ডাকলাম, “অনন্যা! তুই কোথায়?” কোনো সাড়া নেই। কিছুক্ষণ পর দূর থেকে একটা কণ্ঠ ভেসে এল, কিন্তু তা অস্পষ্ট, যেন কুয়াশার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে।

আমি পাগলের মতো ছুটলাম সেই আওয়াজের দিকে। একটা বাঁশঝাড়ের পাশে গিয়ে দেখি, অনন্যা একটা গাছের গুঁড়ির ধারে বসে আছে। মুখে হালকা কষ্ট, চোখে জল। আমি কাছে গিয়ে ওর কাঁধে হাত রাখতেই ও বলল, “আমি পথ ভুলে গেছিলাম… আমি ভয় পেয়ে গেছিলাম…”

আমি ওকে জড়িয়ে ধরলাম। বললাম, “তুই যেখানেই থাকিস, আমি তোকে খুঁজে নেব। কারণ তুই শুধু আমার ভালোবাসা না, তুই আমার চেনা হাত।”

ওর কাঁধে মাথা রেখে আমি বুঝলাম, জীবনে অনেক সময় আমরা এমন ছোট ছোট হারিয়ে যাওয়া অনুভব করি, যেটা সম্পর্কের ভিত আরও গভীর করে। ওর চোখে জল ছিল, কিন্তু তাতে ভয় ছিল না—ছিল একধরনের নির্ভরতা, যেন আমি কাছে আছি বলেই ও ভাঙতে পারে চোখের বাঁধ।

ফিরে আসার পথটা তখন আরও চেনা লাগছিল। বনের ছায়া যেন একটু বেশি শান্ত লাগছিল, হাওয়ার শব্দ যেন বলছিল, “ভালোবাসা মানে একে অপরকে খুঁজে পাওয়া, বারবার, প্রতিবার।”

হোমস্টেতে ফিরে এসে অনন্যা চুপচাপ বসে থাকল অনেকক্ষণ। আমি খেয়াল করলাম, ওর সেই খাতা তখনও খোলা, কিন্তু আজ কোনো লেখা নেই। ও বলল, “আজ একটা লেখা মাথায় আসছে না। কারণ আজ যা ঘটল, সেটা লিখে বোঝানো যায় না—শুধু অনুভব করা যায়।”

আমি বললাম, “তাহলে রাখ এই পাতাটা খালি। এই খালি জায়গাটা তো তোর আমার মাঝে তৈরি হওয়া নির্ভরতার প্রতীক।”

সেই রাতে, যখন চারদিকে কুয়াশা ঘিরে ধরেছে, আর আমাদের ঘরের আলো নিভে এসেছে, আমি ওর হাতটা শক্ত করে ধরে বলেছিলাম, “তুই হারিয়ে গেলেও, আমি তোকে খুঁজে নেব। তুই শুধু ডাকবি।”

অনন্যা তখন ঘুমের ঘোরে মুখে একটুকরো হাসি রেখেছিল, আর আমি বুঝেছিলাম—আজকের এই হারিয়ে যাওয়া, আমাদের চেনা হয়ে ওঠার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন ছিল।

পর্ব ৯: রোদস্নান চুপ থাকা দুপুর

লাভায় সেই সকালটা ছিল আলাদা। না, পাহাড়ে বৃষ্টি হয়নি, না হাওয়া ছিল অস্বাভাবিক ঠাণ্ডা। বরং একধরনের স্বচ্ছতা নেমে এসেছিল আকাশ থেকে। পাহাড়ের গায়ে গায়ে সূর্য সোনার রেখা দিয়ে এঁকে দিচ্ছিল সকাল, আর তার গায়ে বসে ছিল পাখিদের নরম কোলাহল।

আমি আর অনন্যা বারান্দায় বসে সেই দৃশ্য দেখছিলাম চুপচাপ। ওর গায়ে হালকা নীল চাদর জড়ানো, চোখে অদ্ভুত এক শান্তি। আমরা কেউ কথা বলছিলাম না। কেবল একটা কথা আমাদের মাঝখানে ঘুরে বেড়াচ্ছিল—আমরা কি ঠিকভাবে কাটিয়ে ফেলছি এই সফরের শেষ দিনগুলিকে?

অনন্যা বলল, “তুই জানিস, আমি চুপ থাকতে পারি না সাধারণত। কিন্তু এখানে, এই পাহাড়ে, আমি শুধু চুপ হয়ে থাকতে পারি তোর পাশে।” আমি বললাম, “এই চুপ থাকাটাই তো আসল ভাষা। শহরে তো আমরা সবসময় কথা বলে যাই, কিন্তু এখানে এসে বুঝি—চুপ থাকাও একধরনের একান্ত সংলাপ।”

আমরা ঠিক করলাম, আজ কোনও পরিকল্পনা থাকবে না। শুধু কাটিয়ে দেওয়া একটা দুপুর, যেটা মনে থাকবে চুপ করে পাশাপাশি বসে থাকার জন্য। সকালে হাঁটতে বেরিয়েছিলাম হোমস্টের সামনের রাস্তায়, যেখানে পাইন গাছের গায়ে রোদ এসে পড়ে কাঁপছিল। সেদিকে তাকিয়ে অনন্যা বলল, “তুই কি জানিস, ভালোবাসা আসলে একটা রোদস্নানের মতো? বাইরে থেকে উষ্ণ, কিন্তু ভিতরে গিয়ে ছুঁয়ে ফেলে আত্মাকে।”

আমি বললাম, “তুই এই রোদের মতোই তো, প্রথমে গা ছুঁয়ে যাস, তারপর একটু একটু করে ভিতর গরম করিস।”

দুপুরে আমরা ফিরে এলাম হোমস্টেতে। মাসিমা বললেন, “আজ আমি তোমাদের জন্য একটু স্পেশাল রান্না করলাম—পাহাড়ি আলুর দম আর ধুঁধুল শাকের ঘণ্ট।” খেতে বসে অনন্যা বলল, “এই স্বাদগুলো আমার জীবনের অংশ হয়ে গেছে। এটা শুধু খাবার নয়, এটা আমাদের নতুন সংসারের শুরু।”

আমি চুপ করে ওর মুখের দিকে তাকালাম। জানতাম, এই মুহূর্তটা এমন একটা জায়গায় পৌঁছে গেছে যেখানে শব্দের দরকার নেই।

দুপুরে আমরা ফিরে এলাম সেই বারান্দায়, যেখানে বসেই কাটিয়েছিলাম সকালটা। অনন্যা ওর খাতাটা খুলে বসে রইল। এবারও সে কিছু লিখল না। ও বলল, “এই দুপুরটা আমি শুধু চুপ করে রাখতে চাই। যেন কোনো শব্দ না থাকে, শুধু হাওয়ার গন্ধ আর তোর উপস্থিতি।”

আমি বললাম, “তোর সঙ্গে এমন একটা দুপুর কাটানোর জন্য আমি হাজারটা শহরের জীবন ছেড়ে দিতে পারি।” ও বলল, “শহরে ফিরলেও, আমরা এই দুপুরটাকে নিজেদের সঙ্গে নিয়ে ফিরব। এই চুপ থাকা যেন আমাদের মধ্যে রয়ে যায়।”

আমি ওর পাশে বসে কেবল ওর হাতটা ধরলাম। পায়ের নিচে বারান্দার কাঠে হালকা কাঁপুনি, দূরে পাহাড়ে একটা ধোঁয়ার লাইন, হয়তো কোনো গৃহস্থের রান্না। পাখিরা ডাকছে ধীরে ধীরে, যেন এই দুপুরেও তারা অংশ নিতে চায়।

অনন্যা হঠাৎ বলল, “তুই যদি এই দুপুরটাকে চিরকাল মনে রাখতে চাস, তবে আজ থেকে তুই আমায় আর কখনও বলবি না ‘ভালোবাসি’। কারণ আমি চাই, তুই তা প্রতিদিন করে দেখাস—চুপ করে পাশে থেকে, হাত ধরে, আর এই রোদের মতো নরম হয়ে।”

আমি বললাম, “তুই যা বলিস, তাতেই আমি হ্যাঁ বলি। কারণ তুইই তো আমার ভেতরের দুপুর।”

সেই রোদস্নান ও চুপ থাকা দুপুর যেন পাহাড়ের পাতায় লেখা হয়ে থাকল আমাদের ভালোবাসার কবিতার মতো—শব্দহীন, অথচ উচ্চারিত।

পর্ব ১০: ফেরা, কিন্তু পুরোটাই থেকে যাওয়া

সকালে ঘুম ভাঙতেই কেমন একটা অস্বস্তি জাগল বুকের ভেতর। জানালার কাঁচে শিশির জমে আছে, দূরের পাহাড়ে সূর্য আসেনি এখনও, কিন্তু আমাদের ব্যাগ গুছিয়ে ফেলতে হবে আজ। আজ আমাদের ফেরার দিন।

অনন্যা খুব কম কথা বলছিল। চুপচাপ ওর জামা কাপড় গুছোচ্ছিল, মাঝে মাঝে কফির মগে চুমুক দিচ্ছিল। আমি বললাম, “তোর মন খারাপ?” ও মাথা নাড়িয়ে বলল, “না, তেমন কিছু না। শুধু মনে হচ্ছে, একটা গল্প শেষ হচ্ছে। যেটা আমি চাইনি এত তাড়াতাড়ি শেষ হোক।”

আমি বললাম, “গল্প তো কখনও শেষ হয় না। লাভার গল্প আমাদের মধ্যে চলতেই থাকবে, কেবল জায়গা বদলাবে। হয়তো ওই বাড়ির বারান্দায় নয়, এবার আমাদের ফ্ল্যাটের বেলকনিতে।”

চোখের কোণে জল জমল ওর, কিন্তু সে হাসল। সেই একই হাসি—যেটা আমি প্রথম দেখেছিলাম অনলাইনে, তারপর বাস্তবে, তারপর পাহাড়ে। একটা হাসি যা চুপ করেও অনেক কিছু বলে।

আমরা মাসিমার কাছে বিদায় নিতে গেলাম। উনি একজোড়া হাত জোড় করে বললেন, “এই ক’দিন তোমরা যেন আমার নিজের ছেলে-মেয়ের মতো হয়ে গেছ। সাবধানে যেও। আর কখনো এদিকে এলে, এই ঘর তোমাদেরই।” অনন্যা ওর গলায় হাত রাখল। কিছু বলতে পারছিল না, শুধু চোখের জল মুছে বলল, “এই ঘর আমাদের রয়ে যাবে, মনের মধ্যে।”

গাড়িতে উঠে আমরা রিশপ হয়ে কালিম্পংয়ের দিকে নামছিলাম। পেছনে বারবার তাকাতে ইচ্ছা করছিল—সেই ঘরটা, সেই রাস্তা, সেই পাইন গাছ, সেই মেঘগুলোকে দেখতে। ওর মুখ জানালার পাশে ছিল, হাওয়ায় চুল উড়ছিল, মুখে এক টুকরো নীরবতা।

আমি ওর হাত ধরতেই ও বলল, “জানিস, এই সফরে আমরা একটা নতুন সম্পর্ক তৈরি করেছি। এটা শুধু স্বামী-স্ত্রীর নয়, এটা দু’জন মানুষ যারা একসঙ্গে নীরবতা ভাগ করতে শিখেছে।”

আমি বললাম, “এই সফরে তুই আমাকে অন্যভাবে চিনিয়েছিস। তুই শুধু ভালোবাসা নয়, তুই আমার আত্মার আরাম।”

গাড়ি যখন ঘুরে নীচের দিকে নামছে, তখন মনে হচ্ছিল প্রতিটা বাঁক যেন কিছু রেখে দিচ্ছে আমাদের মনে। যেখানে দাঁড়িয়ে আমরা মেঘ ছুঁয়েছিলাম, সেই বাঁকে আমি ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, “তুই কি জানিস, এই মুহূর্তটা আবার ফিরে আসবে কোনো একদিন?”

ও বলল, “হয়তো না আসবে, তবু মনে থাকবে। কারণ এমন কিছু মুহূর্ত থাকে, যেগুলো ফিরে না এলেও বুকের মধ্যে থেকে যায়।”

স্টেশনে পৌঁছে ট্রেন ধরার আগে আমরা শেষবার পাহাড়ের দিকে তাকালাম। ওর চোখে জল ছিল না, কিন্তু মনটা ছিল ভার। আমি বললাম, “চল, যাই। এবার আমরা ফিরে যাই, কিন্তু নিয়ে যাই লাভাকে, রোদকে, কুয়াশাকে, চুপ থাকা দুপুরগুলোকে।”

ও বলল, “আর তোর সেই কথাগুলো, যা তুই বলিসনি, কিন্তু আমি বুঝেছি।”

ট্রেন ছাড়ল। আমরা জানালার পাশে বসে ছিলাম। বাইরের দৃশ্য পিছনে চলে যাচ্ছিল, কিন্তু ভিতরে সবকিছু স্থির হয়ে রয়ে যাচ্ছিল—বারান্দার কাঠের চেয়ার, কুয়াশার ভিতর দাঁড়িয়ে থাকা আমাদের ছায়া, সেই ঝরনার জল, সেই সন্ধ্যার রঙ।

এই সফরটা শেষ হল ঠিকই, কিন্তু মনে হচ্ছিল আমরা কিছু রেখে এলাম না—বরং সবটুকু নিয়েই ফিরে চলেছি।

লাভার সেই রোদঝরা দুপুর আমাদের ভালোবাসার দিনলিপি হয়ে থেকে গেল—যেখানে প্রতিটা মুহূর্ত নীরব, অথচ চিরকাল উচ্চারিত।

 

সমাপ্ত

WhatsApp-Image-2025-06-27-at-4.36.17-PM.jpeg

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *