অপর্ণা বসু
অধ্যায় ১: নীরবতার দেয়াল
পুরোনো লাইব্রেরিটা যেন শহরের ব্যস্ততার ভেতরে এক অদ্ভুত দ্বীপ। বাইরে রাস্তায় গাড়ির হর্ন, মানুষের কোলাহল, দোকানের ভিড়; আর ভেতরে ঢুকলেই হঠাৎ যেন এক নরম নিস্তব্ধতা চারপাশে ছড়িয়ে যায়। দেয়ালে পুরোনো ঘড়ির টিকটিক শব্দটা স্পষ্ট শোনা যায়, কাঠের মেঝেতে কারও হাঁটার শব্দ প্রতিধ্বনির মতো ফিরে আসে। মলিন আলোয় আলোকিত বিশাল হলঘর জুড়ে সারি সারি বইয়ের আলমারি—কোথাও ঝুঁকে পড়া পুরোনো চামড়ার বাঁধাই, কোথাও অল্প বয়সী রঙিন প্রচ্ছদ। এই নীরবতার ভেতরেই প্রতিদিন সন্ধ্যার দিকে প্রবেশ করে এক তরুণ, নাম অর্ক। তার চোখে কেমন এক খোঁজ, যেন প্রতিটি বইয়ের ভেতর সে কিছু পেতে চায়। হয়তো উত্তর, হয়তো অজানা প্রশ্ন। বই হাতে নিলেই অর্কর চারপাশ যেন গলে যায়, বাকি পৃথিবী হারিয়ে যায় কেবল পাতা আর কালি মেশানো গন্ধে। লাইব্রেরির কর্মীরা ওকে চিনে ফেলেছে—চুপচাপ আসে, নির্দিষ্ট কর্নারের দিকে যায়, আর ঘণ্টার পর ঘণ্টা বইয়ের সঙ্গে ডুবে থাকে। তবু ওর জীবনটা খুব সহজ নয়। বাইরের জগতে অর্ক হয়তো নিরীহ এক ছাত্র, কিন্তু ভেতরে তার মনে একটা অদ্ভুত শূন্যতা, যেটা পূর্ণ করতে সে প্রতিদিন বইয়ের পাতায় ডুব দেয়।
একই সময়ে প্রায় প্রতিদিন আরেকজন আসে এই লাইব্রেরিতে—মীরা। গাঢ় লাল সোয়েটার পরে, কালো চুল খোলা রেখে, হাতে একগাদা নোটবুক নিয়ে সে ঢোকে। প্রথম দর্শনে মনে হয় সে যেন খুব স্বাভাবিক, খুব সাধারণ এক মেয়ে। কিন্তু বইয়ের প্রতি তার প্রেমটা অসাধারণ। মীরা বই পড়তে আসে ঠিকই, কিন্তু তার পড়ার ধরন আলাদা। প্রতিটি বইয়ের পাতায় সে যেন নিজের জীবনের ছায়া খুঁজে পায়। কোথাও নিজের কষ্ট, কোথাও নিজের স্বপ্ন, কোথাও আবার নিজের ভয়। সুতরাং লাইব্রেরি তার কাছে কেবল বইয়ের জায়গা নয়, এটা যেন একটা আশ্রয়স্থল, যেখানে সে লুকিয়ে থাকতে পারে নিজের ভেতরের সমস্ত ঝড় থেকে। মীরার প্রতিদিনের রুটিনে এই লাইব্রেরি এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছে। সে জানেই না, একই সময়ে প্রতিদিন যে ছেলেটিকে সে অল্প দূর থেকে দেখে আসছে, সেই অর্কও তার মতো একই শূন্যতা আর একই ভেতরের খোঁজে এখানে আসে। দুজনের চোখ হয়তো একবারের জন্যও মিলেছে, কিন্তু কথা হয়নি কখনও। তবু অদ্ভুতভাবে তাদের সময় মিলে গেছে, যেন অদৃশ্য কোনো সুতো একই মুহূর্তে তাদের এই নীরবতার দেয়ালের ভেতর টেনে এনেছে।
সেদিনও ঠিক এমনই এক বিকেল ছিল। জানালার বাইরে হালকা রোদ, ভেতরে আলো-আঁধারি ছায়ার খেলা। অর্ক হাঁটতে হাঁটতে গিয়েছিল তার প্রিয় কর্নারে, যেখানে ইতিহাস আর দর্শনের বই রাখা থাকে। একই শেলফের দিকে এগোতে এগোতেই সে লক্ষ্য করল—ওখানে আগেই দাঁড়িয়ে আছে মীরা, হাতে একটা বই ধরতে যাচ্ছে। অর্কর চোখ অনিচ্ছায় আটকে গেল। সে থেমে গেল না, পা এগোল, আর একই সময়ে হাত বাড়াল ঠিক সেই বইটার দিকে যেটা মীরা তুলতে যাচ্ছিল। মুহূর্তটা যেন থমকে গেল—দুজনের আঙুল একসাথে ছুঁয়ে গেল বইয়ের ঠান্ডা মলাট। ভেতরে যেন হঠাৎ একটা অজানা কম্পন ছড়িয়ে গেল দুজনের মধ্যে। কেউ কিছু বলল না, শুধু দুজনের চোখ এক মুহূর্তের জন্য মিলল। সেই চোখের ভেতরে লুকিয়ে ছিল বিস্ময়, লজ্জা, আর হয়তো অদৃশ্য এক টান। নীরব লাইব্রেরির দেয়ালের মধ্যে, এই প্রথমবার দুজনের অজান্তেই গল্পের সূচনা হয়ে গেল—একটা এমন গল্প, যেটা শুরু হবে বইয়ের পাতায়, কিন্তু শেষমেশ পৌঁছাবে হৃদয়ের গভীরে।
অধ্যায় ২: একই পাতার টান
পরদিন আবারও একই দৃশ্য। বিকেলের ম্লান আলো গড়িয়ে আসছে লাইব্রেরির জানালা দিয়ে, কাঠের মেঝের ওপর তৈরি হচ্ছে ছায়ার নকশা। অর্ক আগের মতোই ঢুকল, হাতে খাতা আর কলম। মাথার ভেতরে যেন আজ কিছু অন্যরকম চিন্তা ঘুরছে—গতকালের সেই মুহূর্তটা বারবার মনে পড়ছে। হাত ছোঁয়ার মতো তুচ্ছ ঘটনাও কেন যেন মনে গেঁথে গেছে, যেন বইয়ের মধ্যে হঠাৎ এমন একটি বাক্য পেয়ে গিয়েছে যা অনেকদিনের অজানা প্রশ্নের উত্তর দেয়। অর্ক বইয়ের তাকের দিকে যেতেই আবার চোখে পড়ল মীরাকে। মেয়েটা নীরবে দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু তার ভঙ্গিতে এমন কিছু ছিল, যা অর্ককে অদৃশ্যভাবে টেনে নিচ্ছিল। দুজনেই একসঙ্গে একই শেলফে হাত বাড়াল, আবারও একই বইয়ের দিকে। যেন কোনো অদৃশ্য নিয়ম তাদেরকে বারবার একই পাতার টানে এনে দাঁড় করাচ্ছে। বইটা বেরিয়ে এলো, দুজনেই তাকাল একে অপরের দিকে, কিন্তু এবারও কোনো কথা হলো না। শুধু মৃদু হাসি—একটা হালকা, লাজুক হাসি, যেটা যেন নীরবতার ভেতরে অনেক কিছু বলে গেল।
মীরা এবার বইটা অর্ককে দিয়ে বলল না কিছু, তবু তার চোখে ছিল এক ধরণের আমন্ত্রণ। যেন বলছে—“তুমি পড়ো আগে, আমি অপেক্ষা করব।” কিন্তু অর্ক এতটা সহজ ছিল না। সে বইটা নিতে গিয়ে হঠাৎ বলল, “আপনি যদি আগে পড়তে চান, আমি কালকে আবার আসব।” কথাগুলো নরম স্বরে বেরিয়ে এল, যেন সে নিজেই ভয় পাচ্ছিল তার কণ্ঠের প্রতিধ্বনি নীরব লাইব্রেরির দেয়ালে বাজবে। মীরা এক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল, তারপর আস্তে মাথা নেড়ে দিল। তার চোখে যেন এক অদ্ভুত প্রশান্তি, যেন এই সামান্য বিনিময়ের ভেতরেই সে খুঁজে পেল অনেক বড় এক আনন্দ। দুজনের মুখে লুকোনো হাসি, কিন্তু তা প্রকাশ পেল না শব্দে। তারা আলাদা হয়ে গেল, কিন্তু একই বইয়ের পাতার ভেতরে এখন দুজনের অদৃশ্য উপস্থিতি মিশে গেল একসঙ্গে। বই পড়তে বসেও তারা দুজনেই জানত—এই গল্পটা কেবল মুদ্রিত অক্ষরে সীমাবদ্ধ থাকবে না।
সন্ধ্যা নেমে এলো, লাইব্রেরির আলো আরও ম্লান হলো, আর সময় শেষের ঘণ্টা বাজল। মানুষজন বেরিয়ে গেল, কিন্তু অর্ক আর মীরা যেন তাদের নিজস্ব নীরব জগতে আটকে রইল। তারা দুজনই বুঝল, আজ কিছু একটা বদলে গেছে। এই বদলটা হয়তো চোখে দেখা যায় না, কথায় প্রকাশ করা যায় না, কিন্তু তা নিঃশব্দে তাদের ভেতরে ছড়িয়ে গেছে। দুজনের অদ্ভুত মিলন যেন বইয়ের পাতার মতো—আলাদা আলাদা অধ্যায় হলেও একসঙ্গে বাঁধা এক কাহিনী। নীরবতার দেয়ালের মধ্যে তাদের গল্প ধীরে ধীরে গড়ে উঠছে, এক পৃষ্ঠা থেকে আরেক পৃষ্ঠায়, এক মুহূর্ত থেকে আরেক মুহূর্তে। তারা জানত না ভবিষ্যতে কী হবে, কিন্তু আজকের এই মিলনের মুহূর্তই যেন এক অদৃশ্য শপথ—প্রতিদিন একই সময়ে, একই পাতার টানে তারা আবারও ফিরবে এই লাইব্রেরিতে।
অধ্যায় ৩: দৃষ্টি আর দ্বিধা
দিনের পর দিন একই দৃশ্য যেন ছক কাটা নিয়মে পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। সন্ধ্যা নামলেই অর্ক আর মীরা আলাদা আলাদা দরজা দিয়ে প্রবেশ করে লাইব্রেরির ভেতরে। তারা দুজনেই জানে অন্যজন থাকবে, তবু কেউ স্পষ্ট করে একে অপরের দিকে তাকায় না। চোখ যখনই চোখে মেলে, তখনই দুজনের বুকের ভেতর একটা অচেনা আলোড়ন জাগে। মীরার হাতে বই, কিন্তু চোখ বইয়ের অক্ষরের ওপরে স্থির থাকে না; অর্কর দৃষ্টি যেন তাকেই খুঁজে ফেরে। তবু দুজনের মধ্যে নীরবতার এক অদ্ভুত চুক্তি তৈরি হয়েছে—যেখানে কেউই কিছু বলে না, শুধু একে অপরের উপস্থিতিকে নিঃশব্দে স্বীকার করে নেয়। নীরবতা যেন এখানে শব্দের থেকেও বেশি জোরালো হয়ে ওঠে। লাইব্রেরির সেই গাঢ় আলোর নিচে প্রতিটি দৃষ্টিই হয়ে ওঠে একেকটি চিঠি, যা উচ্চারণ করার সাহস পায় না ঠোঁট।
অর্ক অনেকবার ভেবেছে মীরার সঙ্গে সরাসরি কথা বলবে। একদিন সে খাতার এক পাতায় লিখেছিল—“কখনও কি ভেবেছেন, কেন আমরা বারবার একই বইয়ের সামনে দাঁড়িয়ে যাচ্ছি?” কিন্তু সেই নোট মীরার দিকে এগিয়ে দিতে পারেনি। ভেতরের দ্বিধা আর ভয়ের দেয়াল তাকে আটকে রাখে। যদি মীরা অবাক হয়? যদি ভেবে নেয় এটা নিছক কাকতালীয়, আর এর ভেতরে কোনো অর্থ নেই? এসব প্রশ্ন তাকে কুরে কুরে খায়। মীরা-ও ঠিক একইভাবে নিজের ভেতরে এক যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। সে চায় অর্কের সঙ্গে কথা বলতে, চাইলে প্রথম শব্দটা নিজের থেকেই বলতে পারে। কিন্তু তারও ভয়—যদি এই নীরবতার সম্পর্ক ভেঙে যায়? হয়তো তারা দুজনেই ভয়ে স্থির, কারণ নীরবতা অটুট আছে বলে এক অদৃশ্য জগত টিকে আছে। এই অচেনা জগতটাই হয়তো তাদের প্রিয়, যেখানে দৃষ্টি দিয়ে সব কথা বলে ফেলা যায়।
কয়েক সপ্তাহ কেটে গেল। বাইরের জগতে ঋতু বদল হলো—পাতাঝরা শরৎ থেকে কুয়াশাচ্ছন্ন শীতে। কিন্তু লাইব্রেরির ভেতর সময় যেন থমকে দাঁড়িয়ে রইল। মীরা জানালার ধারে বসে বই পড়তে শুরু করল, আর অর্ক দূর থেকে তাকিয়ে রইল। দুজনেই বারবার চোখ সরিয়ে নেয়, আবারও চোরাচোখে তাকায়। একটা দৃষ্টি মেলাতে যতটা সাহস লাগে, শব্দ উচ্চারণে তার চেয়ে বহুগুণ বেশি। এই নীরবতার খেলা প্রতিদিন চলতে থাকে, আর ধীরে ধীরে তারা দুজনেই বুঝতে শুরু করে—এই দ্বিধা আর দৃষ্টির আড়ালে যে অনুভূতি জন্ম নিচ্ছে, তা নিছক আকস্মিক নয়। এটা একরকম অপেক্ষা, একরকম প্রতিশ্রুতি, যা এখনও বলা হয়নি, কিন্তু ভেতরে ভেতরে বেড়ে উঠছে নিঃশব্দে।
অধ্যায় ৪: পাতার ভেতর লুকানো বার্তা
সেই দিনটা ছিল অন্যসব দিনের মতোই, তবু ভেতরে ভেতরে ভিন্ন। লাইব্রেরির ঘড়ি তখন বিকেল পাঁচটা বাজাচ্ছে, চারপাশে নিস্তব্ধতা আরও গভীর। অর্ক চুপচাপ তার প্রিয় শেলফের সামনে গিয়ে দাঁড়াল, কিন্তু বুকের ভেতর আজ এক অদ্ভুত স্রোত বইছে। অন্যদিকে, মীরা আগেই এসে বই খুলে বসেছিল। অর্ক খেয়াল করল মেয়েটি আজ যেন বেশি মনোযোগী হয়ে পাতার ভেতর তাকিয়ে আছে, মাঝে মাঝে কলম দিয়ে কিছু লিখে রাখছে। কিন্তু তার লেখাটা নোটবুকে নয়, বইয়ের এক পুরোনো আলগা পাতার কোণায়। অর্কর কৌতূহল জাগল, তবে কিছু জিজ্ঞেস করল না। কিছুক্ষণ পরে মীরা বইটা ফেরত রাখল শেলফে, আর বেরিয়ে গেল। অর্কের চোখ অজান্তেই সেই বইয়ের দিকে চলে গেল। হাত বাড়িয়ে বইটা টেনে নিয়ে খুলতেই চোখে পড়ল ছোট্ট এক ভাঁজ করা কাগজ—অচেনা অথচ পরিচিত হাতের লেখা।
কাগজটা খুলতেই অর্কর বুকের ভেতর ধক করে উঠল। তাতে লেখা—
“তুমি কি প্রতিদিন এই বইয়ের জন্যই আসো? নাকি অন্য কোনো কারণে?”
এতটাই সরল, অথচ গভীর একটা প্রশ্ন যে অর্ক কয়েক মুহূর্ত অবাক হয়ে বসে রইল। এতদিনের নীরবতার আড়ালে লুকোনো এক গোপন ইচ্ছা যেন হঠাৎ প্রকাশ পেল। এটা নিছক কাকতালীয় নয়, এ যে সচেতন বার্তা। মীরার এই সাহসী পদক্ষেপ যেন ভেঙে দিল অর্কর দীর্ঘদিনের দ্বিধার দেয়াল। তার চোখে ভেসে উঠল মীরার লাজুক হাসি, তার বইয়ের পাতায় ঝুঁকে থাকা চেহারা, আর সেই বারবার মিলে যাওয়া দৃষ্টি। এই কাগজের টুকরো যেন হঠাৎ শব্দে ভরে দিল নীরবতাকে, এমন শব্দ যা উচ্চারণ করা হয়নি, কিন্তু লেখা হয়ে গেছে। অর্ক অনুভব করল, তার ভেতরের নিঃশব্দ আবেগ আজ প্রথমবারের মতো একটা রূপ পেল।
অর্ক বেশ কিছুক্ষণ ধরে ভাবল, কী করবে। কাগজটা সে নিজের কাছে রাখল না, বরং আবার বইয়ের পাতার ভেতরে ফিরিয়ে রাখল। তার মনে হলো, উত্তর দিতে হবে, আর উত্তরটা লিখিত হোক। শব্দ দিয়ে ভাঙুক তাদের এই নীরবতার দেয়াল। খাতা থেকে একটা ছোট্ট কাগজ ছিঁড়ে সে লিখল—
“হয়তো বইয়ের জন্য, হয়তো তোমার জন্য।”
কাগজটা ভাঁজ করে সে রেখে দিল ঠিক সেই জায়গাতেই। তারপর বুকের ভেতর ধকধক করতে করতে বইটা আবার শেলফে ফিরিয়ে রাখল। বাইরে তখন রাত নামছে, কুয়াশা জমছে। লাইব্রেরির দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসার সময় অর্কর মনে হলো—আজ তাদের গল্পে এক নতুন অধ্যায় শুরু হলো, যেটা আর শুধু দৃষ্টি বা দ্বিধায় আটকে থাকবে না, বরং কালি আর কাগজের ভেতর দিয়ে উঁকি দেবে প্রেমের প্রথম চিহ্ন।
অধ্যায় ৫: উত্তর লেখা হয় কালিতে
পরদিন বিকেল। লাইব্রেরির দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল মীরা। বাইরে শীতের কুয়াশা জমে আছে, অথচ ভেতরে যেন এক অচেনা উষ্ণতা। মীরা হাঁটতে হাঁটতে সরাসরি চলে গেল সেই শেলফের দিকে, যেখানে বইটা রেখে গিয়েছিল। তার চোখে যেন এক ধরনের অস্থিরতা—কেউ যদি দেখে ফেলে, কেউ যদি খুঁজে পায়! বুকের ভেতর ধুকপুকানি নিয়ে বইটা হাতে তুলে নিতেই পাতার ভেতর ছোট্ট কাগজটা আবার চোখে পড়ল। সে তাড়াহুড়ো করে কাগজ খুলল, আর হঠাৎ তার ঠোঁটে এক অচেনা হাসি খেলে গেল। কাগজে অর্কর লেখা—“হয়তো বইয়ের জন্য, হয়তো তোমার জন্য।” এতটুকুই, কিন্তু এতটুকুই যথেষ্ট ছিল মীরার বুকের ভেতর এক অদ্ভুত আলো ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য। যেন এক নীরব স্বীকারোক্তি, এক অদৃশ্য হাত ধরা, যা কেবল শব্দের আড়ালেই সম্ভব হয়েছিল।
মীরা কাগজটা অনেকক্ষণ ধরে পড়ল। অক্ষরগুলো তার চোখে ঝাপসা হয়ে গেল, কারণ ভেতরে জমে উঠছিল এক অদ্ভুত আবেগ। সে ভেবেছিল হয়তো কোনো উত্তর পাবে না, অথবা পেলে তা নিছক ভদ্রতা হবে। কিন্তু এই কয়েকটি শব্দে অর্ক যা লিখল, তা যেন তার হৃদয়ের লুকোনো ইচ্ছাকে আলতো করে স্পর্শ করল। চারপাশে নীরবতা, কেবল দূরে ঘড়ির কাঁটার টিকটিক শব্দ। সেই নীরবতার মধ্যে মীরা আস্তে করে কাগজটা আবার ভাঁজ করে রাখল। তারপর নিজের কলম দিয়ে নতুন একটা কাগজে লিখল—“যদি তাই হয়, তবে আমি প্রতিদিন অপেক্ষা করব। আমাদের দেখা হোক এই বইয়ের পাতায়।” মীরার হাত কাঁপছিল, তবু তার লেখায় ভর ছিল দৃঢ়তার। এটা আর নিছক কাকতালীয় খেলা নয়, এটা তাদের নীরব সংলাপের সূচনা।
অর্ক সন্ধ্যার একটু দেরিতে এল। শেলফের দিকে এগিয়ে গিয়ে বইটা হাতে তুলল, আর পাতা উল্টাতেই পেল নতুন বার্তা। পড়েই তার বুক কেঁপে উঠল—“আমি প্রতিদিন অপেক্ষা করব।” অর্কর মনে হলো, এতদিনের দ্বিধা, এতদিনের অপ্রকাশিত অনুভূতি আজ কাগজে শব্দ হয়ে বেরিয়ে এসেছে। যেন একটা বন্ধ দরজা হঠাৎ খুলে গেল, আর ভেতর থেকে আলো এসে পড়ল। সে খাতার এক টুকরো কাগজ বের করে কলম চালাল—“তাহলে এই বই আমাদের সাক্ষাতের স্থান হোক।” কাগজটা গুঁজে দিয়ে সে বইটা শেলফে ফিরিয়ে রাখল। বাইরে তখন কুয়াশা জমে অন্ধকার ঘন হচ্ছে, কিন্তু অর্কর ভেতরে অদ্ভুত এক আলো জ্বলে উঠল। আজ আর কেবল নীরবতার বাঁধন নয়, শব্দের টানে তারা একে অপরের কাছে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। বইয়ের পাতার ভেতর লুকোনো এই গোপন বার্তাই হয়ে উঠল তাদের সম্পর্কের প্রথম সেতু।
অধ্যায় ৬: নীরব বন্ধুত্ব
দিনের পর দিন কেটে যেতে লাগল, আর বইয়ের পাতার ভেতর লুকোনো কাগজে জমতে থাকল শব্দের নীরব খেলা। অর্ক আর মীরা কেউ কাউকে সরাসরি কিছু বলেনি, তবু তাদের লেখা কথাগুলো হয়ে উঠছিল এক অদ্ভুত বন্ধনের সুতো। প্রতিটি নোট যেন অদৃশ্য এক ধাপ, যা তাদের আরও কাছাকাছি টেনে আনছিল। কখনও অর্ক লিখে যেত কোনো প্রিয় কবিতার লাইন, কখনও মীরা তার উত্তর দিত নিজের আঁকা একটা ছোট্ট ছবি দিয়ে। লাইব্রেরির চারপাশে অন্যরা ব্যস্ত নিজেদের পড়াশোনায়, অথচ এই দুই মন নীরবে গড়ে তুলছিল একান্ত জগত, যা কেবল তারা-ই জানে। এ যেন এক গোপন আশ্রয়, যেখানে কোনো শব্দ উচ্চারণ করতে হয় না, কেবল লেখা দিয়েই সব বলা যায়। এই লেখা আর পড়ার খেলায় তারা ধীরে ধীরে বুঝতে লাগল—এটা কেবল নিছক কাকতালীয় সম্পর্ক নয়, বরং অদৃশ্য বন্ধুত্বের শুরু।
প্রথমে তাদের কথাবার্তা সীমাবদ্ধ ছিল বই, লেখক আর প্রিয় চরিত্রে। অর্ক লিখত—“তুমি রবীন্দ্রনাথের কোন কবিতা সবচেয়ে বেশি ভালোবাসো?” মীরা লিখত—“শেষের কবিতা, কারণ সেটা অসমাপ্ত হয়েও পূর্ণ।” কখনও তারা আলোচনা করত প্রিয় ঋতু নিয়ে, কখনও স্বপ্নের ভ্রমণ নিয়ে। প্রতিটি নোট যেন একে অপরের জীবনের অন্দরমহলে একটু একটু করে প্রবেশ করার দরজা খুলে দিচ্ছিল। মীরা লিখেছিল—“তুমি কি কখনও কাউকে খুব বলতে চেয়েও থেমে গিয়েছ?” অর্ক উত্তর দিয়েছিল—“প্রায়ই, হয়তো এখনও।” এইসব সংলাপে ধীরে ধীরে তৈরি হচ্ছিল বিশ্বাস, আর সেই বিশ্বাসের ভেতর গড়ে উঠছিল এক ধরনের স্বস্তি। দুজনের মনই বুঝতে লাগল—এই নীরবতা আর লিখিত কথোপকথন ছাড়া তাদের দিন যেন অসম্পূর্ণ থেকে যায়।
শীত গাঢ় হয়ে উঠছিল, আর লাইব্রেরির ভেতরে বাতাস আরও ঠান্ডা। তবু প্রতিদিনই তারা আসত, প্রতিদিনই একই বই হাতে নিত। কখনও কখনও দুজন একই সময়ে শেলফে গিয়ে দাঁড়াত, আর ইচ্ছে করেও চোখ সরাত না। চোখে চোখ পড়লে লাজুক হাসি ফুটে উঠত, যেন বলা হলো—“আমরা জানি।” চারপাশের মানুষজন কিছুই টের পেত না, কিন্তু এই দুজনের নীরব বন্ধুত্বের মায়া তখন ক্রমশ গভীর হয়ে উঠছিল। এটা এমন এক সম্পর্ক, যেখানে না ছিল জোর, না ছিল দাবি; কেবল ছিল একরাশ বিশ্বাস, একরাশ কাগজে লেখা আন্তরিকতা। লাইব্রেরির নীরবতা আজ আর একঘেয়ে নীরবতা নয়, বরং হয়ে উঠেছে দুই তরুণ-তরুণীর গোপন বন্ধুত্বের উষ্ণ আশ্রয়।
অধ্যায় ৭: অপ্রকাশিত অনুভূতি
শীত প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, বসন্তের হাওয়া বইছে শহরের রাস্তায়। বাইরে গাছে নতুন পাতা গজাচ্ছে, ফুলের গন্ধ ভেসে আসছে, অথচ লাইব্রেরির ভেতরে নীরবতার আবরণ একই রকম রয়ে গেছে। এই নীরবতার ভেতরেই অর্ক আর মীরার লেখা চলছিল প্রতিদিন, কিন্তু এখন আর তা কেবল বই বা কবিতার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। ধীরে ধীরে তারা নিজেদের জীবন নিয়ে লিখতে শুরু করেছে। অর্ক একদিন লিখল—“আমি ছোটবেলা থেকে একা। বই-ই আমার সঙ্গী। কিন্তু আজকাল মনে হয়, তুমি না থাকলে এই নীরবতা আমাকে গিলে খেত।” মীরা উত্তর দিল—“আমিও একা। বই পড়তে ভালো লাগে কারণ ওরা কথা বলে না, বিচার করে না। কিন্তু তুমি কথা বলো কাগজে, অথচ কোনোদিন আমায় প্রশ্ন করো না। হয়তো এ কারণেই আমি তোমার কাছে সব বলতে চাই।” এই লেখা পড়ে অর্কর বুকের ভেতর কেমন আলোড়ন উঠল। এতদিনের অচেনা অনুভূতিগুলো শব্দের ভেতর দিয়ে ধীরে ধীরে রূপ নিতে শুরু করল।
তারা লিখতে লিখতে একে অপরের কাছে হয়ে উঠল স্বস্তির জায়গা। মীরা লিখত তার ভয়, তার হারিয়ে ফেলা স্বপ্ন, তার অদৃশ্য যন্ত্রণা। অর্ক মন দিয়ে পড়ত, আর লিখত তার উত্তর—“তুমি একা নও, আমি আছি।” কখনও অর্ক লিখত তার নিজের অক্ষমতা, তার ভিতরের দ্বিধা আর ভীতি। মীরা উত্তর দিত—“তুমি ভেবো না, আমি তোমাকে শুনছি।” এই নোটগুলো যেন তাদের মনের গভীরতম জায়গায় গিয়ে ছুঁয়ে দিচ্ছিল। কিন্তু তবু তারা মুখে কিছু বলত না। লাইব্রেরির ভেতর এখনও কেবল দৃষ্টি আর হাসিই তাদের একমাত্র প্রকাশ। বাইরের মানুষদের কাছে তারা নিছক দুই বইপাগল, কিন্তু ভেতরে ভেতরে তাদের অনুভূতি রূপ নিচ্ছে এক মায়াময় প্রেমে, যা এখনও তারা নাম দিতে পারছে না।
অর্ক অনেকবার ভেবেছে সরাসরি কিছু বলবে। হয়তো একদিন মীরাকে জানালার ধারে বসে থাকতে দেখে এগিয়ে যাবে, বই নামিয়ে মুখোমুখি হবে, বলবে—“আমি শুধু তোমার জন্য আসি।” কিন্তু প্রতিবারই ভয় তাকে আটকে দেয়। ভয় যে হয়তো মীরা কেবল বন্ধুত্ব চায়, আর সে যদি অন্য কিছু প্রকাশ করে তবে সব শেষ হয়ে যাবে। মীরারও একই দ্বিধা। সে লিখতে লিখতে বারবার ভেবেছে একবার কলম নামিয়ে রেখে বলে ফেলবে—“আমি তোমাকে পছন্দ করি।” কিন্তু বলা হয়ে ওঠে না। অপ্রকাশিত অনুভূতিগুলো জমতে থাকে নীরবতার ভেতর, একরকম চাপা জোয়ারের মতো, যেটা এখনও ভাঙেনি, কিন্তু ভেতরে ভেতরে প্রতিদিন প্রবল হয়ে উঠছে। এই অদ্ভুত টান, এই অদৃশ্য টুকরো টুকরো স্বীকারোক্তিই তাদের বন্ধুত্বকে নীরবে বদলে দিচ্ছিল—বন্ধুত্ব থেকে আরও গভীর কিছুতে, যার নাম তারা উচ্চারণ করার সাহস পায়নি।
অধ্যায় ৮: লাইব্রেরির বেঞ্চে অপেক্ষা
দিনের পর দিন জমতে থাকা সেই অপ্রকাশিত অনুভূতিগুলো একসময় আর কাগজের পাতার ভেতরে আটকে রাখা সম্ভব হলো না। অর্ক বহু রাত ঘুমোতে পারেনি—বারবার মনে হয়েছে, তারা যে কথা লিখে লিখে বলে চলেছে, সেটা একদিন মুখে উচ্চারণ করতেই হবে। হয়তো ভয় আছে, হয়তো দ্বিধা আছে, কিন্তু প্রতিদিনের এই অপেক্ষা আর দৃষ্টি মিলনের ভেতরে এমন এক টান তৈরি হয়েছে যা আর লুকোনো যায় না। অবশেষে এক বিকেলে অর্ক সিদ্ধান্ত নিল। সে বইয়ের পাতার ভেতরে একটি নতুন নোট গুঁজে দিল। তাতে লেখা—“যদি ইচ্ছে থাকে, কাল দুপুরে পাশের জানালার বেঞ্চে দেখা হবে। কেবল একটু বসে কথা বলার জন্য।” কাগজটা লিখেই অর্কর বুক ধুকপুক করে উঠল। এতদিন নীরবতার আড়ালে তারা একে অপরকে পেয়েছিল, আজ প্রথমবার সে নীরবতার বাইরের দিকে পা বাড়াল।
পরের দিন মীরা স্বাভাবিকের চেয়েও আগে লাইব্রেরিতে এলো। তার মনে কেমন এক অস্থির উত্তেজনা, চোখে লাজুক আলো। শেলফ থেকে বই তুলে নিতেই পাতা উল্টে পড়ল অর্কর লেখা। সে কয়েকবার পড়ল একই বাক্য, যেন নিশ্চিত হতে চাইছিল এটা স্বপ্ন নয়। বুকের ভেতর কাঁপুনি নিয়ে সে বই বন্ধ করল, আর আস্তে করে তাকাল জানালার ধারের দিকে। সেখানে একটি কাঠের বেঞ্চ রাখা আছে, যেখানে খুব কম মানুষ বসে। আলো-আঁধারি জায়গাটা যেন গোপন সাক্ষাতের জন্য তৈরি। মীরা প্রথমে দ্বিধায় দাঁড়িয়ে রইল, তারপর ধীরে ধীরে পা বাড়াল বেঞ্চের দিকে। তার প্রতিটি পদক্ষেপ যেন কানে প্রতিধ্বনি তুলছিল, অথচ চারপাশ তখনও নীরব।
অর্ক ইতিমধ্যেই সেখানে বসে ছিল, হাতে বই, যেন সবকিছু স্বাভাবিক। কিন্তু তার চোখে স্পষ্ট নার্ভাসনেস। মীরাকে আসতে দেখে তার বুকের ভেতর ধক করে উঠল। মীরা ধীরে ধীরে বেঞ্চের অপর প্রান্তে বসে পড়ল। কয়েক মুহূর্ত তারা কেউ কিছু বলল না। শুধু বাইরের আলো জানালা দিয়ে ভেতরে এসে দুজনের মুখ আলোকিত করল। তারপর অর্ক নিচু স্বরে বলল—“আমি ভাবছিলাম, বইয়ের পাতার বাইরে যদি কখনও কথা বলি, তবে কেমন হবে?” মীরা তাকিয়ে রইল, তার ঠোঁটে একটুখানি হাসি ফুটল। সেই হাসির ভেতর লুকিয়ে ছিল স্বীকৃতি, সম্মতি, আর অনেকটা স্বস্তি। আজ প্রথমবার তারা একই জায়গায় পাশাপাশি বসে নীরবতার সীমানা অতিক্রম করল। সেই কাঠের বেঞ্চে জন্ম নিল নতুন এক অধ্যায়, যেখানে দৃষ্টি আর লেখা ছাড়াও তারা খুঁজে পেল কথার উষ্ণতা।
অধ্যায় ৯: প্রথম মুখোমুখি
জানালার ধারের বেঞ্চটা যেন এক অদ্ভুত সাক্ষাতের মঞ্চ হয়ে উঠল। বাইরের আলো কাঁচ ভেদ করে ভেতরে আসছে, ধুলোয় ভাসা সোনালি রেখাগুলো ছড়িয়ে পড়েছে তাদের দুজনের গায়ে। এতদিন তারা একে অপরকে দেখেছে, চোখে চোখ মিলিয়েছে, কাগজে কাগজে গল্প লিখেছে—কিন্তু মুখোমুখি বসে থাকার এই অনুভূতি একেবারেই নতুন। অর্ক বই হাতে রেখেছিল, অথচ পড়ার ভানও করতে পারছিল না। তার বুকের ভেতর কাঁপুনি, কিন্তু ঠোঁটের কোণে লাজুক হাসি। মীরা জানত, অর্ক কিছু বলতে চাইছে, কিন্তু সাহস পাচ্ছে না। সে নিজেও চুপচাপ বসে রইল, নখ দিয়ে বইয়ের মলাটে অকারণ আঁকিবুঁকি করতে লাগল। নীরবতাটা বোঝাই যাচ্ছিল ভারী, অথচ তার ভেতরেই ছিল মিষ্টি এক স্বস্তি, যেন এই নীরবতাই তাদের ভাষা।
অর্ক অবশেষে সাহস করে মুখ তুলল। তার গলা একটু কাঁপছিল, তবু কথাগুলো বেরিয়ে এল—“আমি ভেবেছিলাম, হয়তো বইয়ের ভেতরই সব কথা বলা সহজ। কিন্তু মনে হলো, তোমাকে সামনে না পেলে আমি আসলেই কিছু বলতে পারব না।” মীরা অবাক হলো না, বরং তার চোখে নরম এক ঝলক আলো ফুটল। সে আস্তে বলল—“আমি-ও তাই ভাবতাম। শব্দগুলো লিখতে পারি, কিন্তু বলতে গেলে গলা বন্ধ হয়ে যায়।” দুজনেই হেসে ফেলল, হাসিটা ছিল নিঃশব্দে জমে থাকা ভয়ের মুক্তি। এতদিন যেটা অপ্রকাশিত ছিল, আজ সেই অস্বস্তি গলে গিয়ে রূপ নিল সহজ কথোপকথনে। লাইব্রেরির পরিবেশ আরও গভীর হয়ে উঠল, কিন্তু তাদের দুজনের মাঝে যেন নীরবতার জায়গা এখন কথায় পূর্ণ হতে শুরু করেছে।
কথার শুরুটা ছোট ছিল—বই, প্রিয় লেখক, লাইব্রেরি নিয়ে। কিন্তু ধীরে ধীরে তারা নিজেদের গল্পে ঢুকে গেল। মীরা বলল তার ছোটবেলার কথা, কিভাবে একা একা বসে বই পড়া তার সবচেয়ে প্রিয় সঙ্গী হয়ে উঠেছিল। অর্ক জানাল, কিভাবে লাইব্রেরি তার কাছে নিছক পড়াশোনার জায়গা নয়, বরং একরকম নিরাপদ আশ্রয়। তারা দুজনেই লক্ষ্য করল, প্রতিটি বাক্য যেন তাদের আরও কাছে টেনে নিচ্ছে, এমন এক জায়গায় যেখানে কাগজের লেখা আর দরকার হচ্ছে না। সময় কেটে গেল অজান্তেই, বাইরে অন্ধকার ঘন হলো, কিন্তু জানালার বেঞ্চে বসে দুজনের হাসি-চোখে জন্ম নিল এক অদ্ভুত উষ্ণতা। প্রথমবার তারা সত্যিকার অর্থে মুখোমুখি হলো, আর সেই মুহূর্তেই বোঝা গেল—তাদের গল্প আর কেবল বইয়ের পাতায় সীমাবদ্ধ নেই, তা এখন জীবন্ত হয়ে উঠেছে।
অধ্যায় ১০: প্রেমের নতুন অধ্যায়
সন্ধ্যা নেমে এসেছে শহরে। লাইব্রেরির ভেতরের আলো ঝিমঝিম করছে, বাইরের জানালা দিয়ে আসা আকাশে ধূসর রং মিশে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। অর্ক আর মীরা তখনও সেই বেঞ্চে বসে, যেন সময় থেমে গেছে তাদের জন্য। এতদিন যেসব কথা কেবল কাগজে লেখা হতো, আজ তা তাদের চোখে, ঠোঁটে, হাসিতে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। নীরবতার সীমানা পেরিয়ে তারা যে প্রথম মুখোমুখি কথোপকথন শুরু করেছে, তা যেন থামতেই চাইছে না। কিন্তু এর ভেতরেই অর্ক হঠাৎ গভীরভাবে মীরার দিকে তাকাল। তার চোখে একরকম দৃঢ়তা ছিল, যেটা আগে কখনও দেখা যায়নি। অর্ক নিচু গলায় বলল—“মীরা, আমি জানি না এই অনুভূতির নাম কী, কিন্তু প্রতিদিন এখানে এসে তোমার সঙ্গে থাকা ছাড়া আর কিছু কল্পনা করতে পারি না।” মীরার বুক কেঁপে উঠল, ঠোঁটে কাঁপন এল, চোখে জমে উঠল অশ্রুর এক ফোঁটা, কিন্তু সেই অশ্রুতেই লুকিয়ে ছিল আনন্দ।
মীরা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল, তারপর আস্তে বলল—“আমিও একইভাবে ভেবেছি। অনেকবার লিখতে গিয়েছি, অনেকবার বলতে চেয়েছি, কিন্তু সাহস পাইনি। মনে হতো, যদি তুমি কেবল বন্ধুত্ব ভাবো? কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আর লুকোনো যাবে না। আমি-ও চাই প্রতিদিন তোমার সঙ্গে থাকতে।” কথাগুলো শোনার সঙ্গে সঙ্গেই অর্কর বুক থেকে ভারী পাথর নেমে গেল। তাদের মাঝে যে নীরবতা এতদিন বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল, তা আজ ভেঙে গেল। এই স্বীকারোক্তির মুহূর্তে লাইব্রেরির নীরবতা যেন আশীর্বাদের মতো তাদের ঘিরে ধরল। বাইরে হয়তো রাত নেমেছে, কিন্তু তাদের ভেতর তখন আলোয় ভরে গেছে।
সেদিন থেকে তাদের গল্পে নতুন অধ্যায় শুরু হলো। তারা এখনও লাইব্রেরিতে আসে, এখনও বই নেয়, এখনও পাতার ভেতরে চিঠি লুকিয়ে রাখে। কিন্তু এখন সেই চিঠিতে আর কেবল লুকোনো কথা থাকে না, থাকে ভবিষ্যতের স্বপ্ন, একসাথে পথ চলার ইঙ্গিত। জানালার বেঞ্চ তাদের স্থায়ী ঠিকানা হয়ে উঠল, যেখানে তারা প্রতিদিন একটু সময় কাটায়, নিজেদের ভেতর খুঁজে পায় অদ্ভুত শান্তি। অর্ক আর মীরা বুঝতে পারল, বইপাগল দুজন মানুষ কেবল গল্প আর কবিতার ভেতরেই নয়, বাস্তব জীবনেও লিখতে শুরু করেছে এক নতুন প্রেমের কাহিনি। আর সেই কাহিনি লাইব্রেরির নীরবতা ভেদ করে পৌঁছে গেল তাদের হৃদয়ের গভীরে—যেখানে প্রতিটি শব্দ হয়ে উঠল ভালোবাসার অমলিন সাক্ষ্য।
শেষ