অভিজিৎ চট্টোপাধ্যায়
পর্ব ১
রাত তখন প্রায় দেড়টা। থেমে থেমে বৃষ্টি পড়ছিল লন্ডনের জানালা বেয়ে, যেমনটা এই শহরে বরাবরই হয়ে থাকে—নীরব অথচ জেদি। এলেনা ব্যাকলে তার ডেস্কে বসে শেষ পর্যন্ত সেই ইমেলটা আবার খুলল।
“Attend the séance this Friday. No cameras, no questions. Just watch. – L.S.S.”
কোনো সাইনেচার নেই, শুধু নিচে ছায়ার মতো ছাপানো এক গোল রাবার স্ট্যাম্পের চিহ্ন: একটি পেন্টাগ্রামের মাঝে শিখা এবং একটি চোখ।
তিনি ‘The Sentinel’–এর ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্টার। ভূত, তান্ত্রিকতা, এবং ডার্ক আর্টসে তার তেমন বিশ্বাস নেই। কিন্তু তিন মাস আগে কেমডেনে এক নিখোঁজ রাজনীতিবিদের মৃত্যু নিয়ে তদন্ত করতে গিয়ে এলেনা এই ক্লাবের নাম প্রথম শুনেছিলেন—The London Séance Society। তখনও এটি তার কাছে ছিল শহরের আর দশটা ‘স্পিরিচুয়ালিস্ট জোক’ এর মতোই।
কিন্তু এখন, সেই নিখোঁজ রাজনীতিবিদের ময়নাতদন্তে কোনো মৃত্যুর চিহ্ন না পাওয়া সত্ত্বেও তার মুখে থাকা অদ্ভুত এক আতঙ্কের ছাপ… তখন থেকেই সব কিছু পাল্টে যায়।
তিনি জানতেন, যেখানেই সত্য লুকিয়ে থাকে, সেখানেই প্রশ্ন ছুঁড়ে দিতে হয়। এবং কখনো কখনো—ভয় পেতেও হয়।
শুক্রবার, রাত দশটা।
পোশাক অনুযায়ী কালো ড্রেস পরে এলেনা পৌঁছে গেল ব্লুমসবেরির এক পুরোনো ভিক্টোরিয়ান বাড়ির সামনে। দরজায় না কোনো ঘণ্টা, না কোনো দরজার কড়া। শুধু একটা ছোট ব্রাস প্লেটে লেখা ছিল:
“Whisper, and it shall open.”
তিনি একটু ইতস্তত করলেন, তারপর ফিসফিসিয়ে বললেন, “I seek the truth.”
দরজাটি ধীরে ধীরে শব্দ না করেই খুলে গেল।
ভিতরে অদ্ভুত নীরবতা। ভেতরের সাজসজ্জা যেন বিশ শতকের গোড়ার দিকের—মোমবাতির আলো, বেগুনি পর্দা, ছায়ায় ঢেকে থাকা দেয়াল। একটা বড় ডাইনিং হলের মতো ঘরে ঢুকে তিনি দেখলেন আট-দশ জন মানুষ গোল করে বসে আছেন। ঘরের মাঝখানে এক গোল টেবিল, তাতে রাখা এক ক্রিস্টাল বল এবং মোমবাতির সারি।
ঘরের এক কোণে বসে ছিলেন একজন মহিলা—অত্যন্ত ফর্সা, চুল ধবধবে সাদা, ঠোঁটে গাঢ় লিপস্টিক। তার চোখে ছিল এমন এক শূন্যতা, যা দেখে এলেনার গা কাঁটা দিয়ে উঠল।
“Tonight, we listen,” তিনি বললেন ধীরে। “We do not summon. The spirits are already here.”
একজন বললেন, “Lady Sevrine, will they speak again?”
তিনি মৃদু হাসলেন। “If they choose to.”
তখনই মোমবাতিগুলোর আলো একে একে টিমটিম করে নিভতে লাগল। জানালা কেউ খোলেনি, দরজা বন্ধ, কিন্তু ঘরটা যেন ঠান্ডায় জমে গেল। এলেনা বুঝতে পারছিলেন তার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছে। কেউ একটা তার ঘাড়ের কাছাকাছি ফিসফিস করছে—কিন্তু পেছনে তাকিয়ে কিছুই দেখা গেল না।
“Speak, if you still remember,” Lady Sevrine বললেন ক্রিস্টাল বলের দিকে তাকিয়ে।
ক্রিস্টাল বলটি হঠাৎই মৃদু কম্পিত হলো। তারপর একটি কণ্ঠ ভেসে এল—কিন্তু কার কণ্ঠ তা বোঝা যাচ্ছিল না। কণ্ঠটি বলল,
“He knew too much… the one by the river…”
এলেনার শরীর জমে গেল। সে জানে, এই কথাটা ঠিক সেই রাজনীতিবিদের মৃত্যুর আগের রাতেও কেউ বলেছিল।
“Who knew? Who killed him?” এলেনা প্রায় অজান্তেই বলে ফেলল।
এক মুহূর্ত নীরবতা। তারপর হঠাৎই টেবিলের ওপর থাকা একটা চামচ নিজে নিজে ঘুরে উঠল, দেয়ালের আয়নাটায় ফাটল ধরল, আর সেই কণ্ঠটি এবার একেবারে পরিষ্কারভাবে বলল—
“You did.”
ঘরটা দুলে উঠল। এলেনা চেয়ার থেকে পড়ে যাচ্ছিলেন এমন সময় কেউ একজন তাকে ধরে ফেলল। চোখ তুলে দেখলেন, সেই সাদা চুলের মহিলাটি তাকে শক্ত করে ধরে আছেন।
“Questions come at a cost, Miss Backley,” তিনি বললেন। “Are you ready to pay?”
এলেনা বুঝতে পারলেন—এটি আর কোনো গল্পের ক্লাব নয়। এটি একটি দরজা, যেখান দিয়ে একবার ঢুকলে ফেরা যায় না।
তিনি ধীরে মাথা নাড়লেন। “Yes. Show me everything.”
Lady Sevrine চোখ বন্ধ করলেন। “Then let the next séance begin.”
পর্ব ২
বাড়িটি ঠিক যেমন ছিল বাইরে থেকে—নীরব, অন্ধকার, পুরনো—ভেতরটা তেমন ছিল না। পরের দিন সকালে এলেনা সেই বাড়ির কাছেই এসে দাঁড়ালেন, কিন্তু কাল রাতে যেখান দিয়ে ঢুকেছিলেন, সেই দরজাটা আর নেই। জায়গাটা যেন উবে গেছে। তার জায়গায় এখন এক ছুটির বিজ্ঞপ্তি ঝুলছে, তাতে লেখা, “Property under inspection by the City of London.”
তবে এলেনা জানতেন, তিনি যা দেখেছেন, তা স্বপ্ন নয়। তার ফোনে কিছু রেকর্ড ছিল না, ক্যামেরা অচল হয়ে গিয়েছিল সেই মুহূর্তে। কিন্তু তার কানে এখনও বাজছিল সেই আত্মার কণ্ঠ—“You did.”
তাঁর মাথায় ঘুরছিল প্রশ্ন—এই ক্লাব কি শুধুই আত্মা ডাকার জায়গা? নাকি তারা সত্যিই জানে এমন কিছু, যা পৃথিবীর কেউ জানে না?
সেদিন রাতেই তার দরজায় কাগজের খামে ভরা আরেকটা চিঠি আসে।
“Second Circle meets at midnight. Theatre Royal, Drury Lane. Come alone.”
Drury Lane-এর পুরনো থিয়েটার। এক সময় কুখ্যাত হয়ে উঠেছিল মঞ্চে আত্মহত্যার ঘটনার জন্য, পরে গুজব ছড়ায় যে এখানকার পর্দার পেছনে এখনও এক মহিলা ভূত ঘুরে বেড়ায়। এলেনা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিলেন, কে এইসব নিমন্ত্রণ পাঠাচ্ছে।
রাত ১২টা।
থিয়েটারের ভিতরে ঢুকতেই দেখলেন সব আলো নিভে গেছে, শুধু এক জায়গায় একেবারে মাঝখানে আলোর রেখা পড়ে আছে। সেই আলোয় দাঁড়িয়ে ছিলেন একজন—মাঝবয়সী পুরুষ, কালো স্যুট পরে, চোখে মোটা কাঁচের চশমা। মুখটা এলেনার চেনা মনে হলো না, কিন্তু তাঁর দাঁড়িয়ে থাকার ভঙ্গিতে ছিল প্রশাসনিক কর্তৃত্ব।
“Miss Backley,” তিনি বললেন, “You weren’t followed, I hope.”
এলেনা বললেন, “I don’t think so. Who are you?”
“Name’s irrelevant. What matters is you’ve been selected. The First Circle was a test. You passed. Now you must understand what you’ve entered.”
এলেনা তাকালেন, অন্ধকার থিয়েটারের মাঝখানে ছায়া ছায়া কয়েকজন দাঁড়িয়ে আছেন। তারা সবাই কালো পোশাক, মুখ আড়াল করা, প্রত্যেকের হাতে একটি করে ছোট টর্চলাইট।
তিনি বললেন, “We don’t just speak to the dead. We listen to what they won’t say aloud. Secrets, guilt, unspoken crimes—they float, and we draw them out.”
“Why?” এলেনা প্রশ্ন করলেন।
“Because truth is power. And power, Miss Backley, is never silent.”
এলেনা বুঝতে পারলেন এটা শুধুই এক তান্ত্রিক সংগঠন নয়—এরা তথ্য সংগ্রহ করে, হয়তো ব্ল্যাকমেইলের জন্য, হয়তো রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের জন্য।
ঠিক সেই সময় থিয়েটারের ছাদে কোনো অদৃশ্য জায়গা থেকে শোনা গেল এক শিশুর কান্না। ভৌতিক নয়, বরং থমথমে, নিঃস্ব।
সেই লোকটি বললেন, “Tonight, we summon not a ghost, but a memory. The hardest ones to hear are always the ones closest to home.”
একজন নারী এগিয়ে এলেন, তার মুখ আড়াল করা। সে থিয়েটারের মাঝখানে দাঁড়াল, চোখ বন্ধ করল, তারপর ধীরে ধীরে বলতে লাগল,
“My brother drowned when I was ten. But he never really left.”
তার কণ্ঠ কেঁপে উঠল, থিয়েটারের বাতাস ভারী হয়ে উঠল। চারপাশের বাতি একবার দপ করে নিভে গিয়ে আবার জ্বলে উঠল। কেউ যেন ধীরে পেছনের সারিতে হেঁটে যাচ্ছে—তবুও কোনো পায়ের শব্দ নেই।
একটা কান্নার মতো শব্দ উঠল, খুব কাছ থেকে। এলেনা পেছনে তাকালেন—কেউ নেই।
“Where did he drown?” কেউ একজন জিজ্ঞেস করল।
“Regent’s Canal,” মহিলা বললেন। “But I dreamt last week… he was crying. He said—someone held his head down.”
থিয়েটারে নিস্তব্ধতা। এক মুহূর্ত পরে সেই স্যুট পরা লোকটি বললেন, “This is what we do. We awaken what the world forgets.”
এলেনার হাত ঠাণ্ডা হয়ে এসেছে। সে বুঝতে পারছিল, তার নিজেরও এমন কিছু স্মৃতি আছে, যা কখনো মুখে আনেনি।
“Now it’s your turn,” লোকটি বললেন। “What guilt do you carry?”
এলেনা কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “I investigated a man’s death. I thought I was after corruption. But… I pushed him. Not literally. But my article ruined him. Two days later, he jumped off Waterloo Bridge.”
একটি নিঃশব্দ হাওয়া বইল। থিয়েটার কাঁপল না, কিছু ঘটল না। কিন্তু এলেনার মনে হল, কেউ তার হৃদয়ের গভীরতায় গিয়ে হাত দিয়েছে।
তখনই এক অচেনা কণ্ঠ, একেবারে পেছন থেকে বলল,
“He didn’t jump. He was thrown.”
এলেনা ফিরে তাকালেন। থিয়েটার ফাঁকা।
আর সেই স্যুট পরা লোকটি হাসলেন—
“Welcome to the Second Circle.”
পর্ব ৩
এলেনার জন্য রাতে ঘুমানো ক্রমেই অসম্ভব হয়ে উঠছে। প্রতিটি ঘুমে এখন শুধু ছায়া—জল থেকে ভেসে ওঠা মুখ, থিয়েটারের অন্ধকার ছায়ায় দাঁড়িয়ে থাকা এক ছায়ামূর্তি, আর সেই কণ্ঠ—“He was thrown.”
সকালবেলা সে চোখ খুলেই একরাশ শীতল ঘাম মুছল, তারপর জানালার পাশে গিয়ে দেখল—বাইরে আগের দিনের মতই বৃষ্টি। এই শহরের গায়ে যেন চিরস্থায়ী এক সোঁদা রহস্য লেগে থাকে।
ডাইনিং টেবিলে রাখা ছিল আরেকটি খাম। এতে কোনও চিঠি নয়—শুধু একটা ঠিকানা লেখা কার্ড:
“14 Morwen Street, Basement Vault, 9PM. Bring no lies.”
এলেনা জানত না এই “Morwen Street” কোথায়। গুগল ম্যাপে তা নেই। কিন্তু পুরোনো লন্ডন মানচিত্র ঘেঁটে সে খুঁজে পেল—উনিশ শতকে শোরডিচের কাছে এক গলির নাম ছিল Morwen Street, যেটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ধ্বংস হয়ে যায়।
সে সন্ধ্যায় সেই এলাকায় পৌঁছে দেখে একটা পুরোনো গ্রন্থাগারের ধ্বংসাবশেষ। ধীরে ধীরে তার পেছনের অন্ধকার গলিতে গিয়ে সে এক ভাঙা সিঁড়ি খুঁজে পেল, যেটা একেবারে নিচের দিকে নেমে গেছে। সেখানে কোনো দরজা নেই, শুধু একটি ইটের দেয়াল—আর তাতে টাঙানো ধাতব ফলক: “Whispers are the ink of truth.”
সে দেয়ালে হাত রাখতেই পুরো দেয়ালটি কেঁপে উঠল, এবং এক ফিসফিস শব্দে খুলে গেল।
ভেতরে ছিল এক গোপন আর্কাইভের মতো ঘর—পাথরের তৈরি, ঠান্ডা, আর অগুনতি ফাইলের তাক। একদিকে দাঁড়িয়ে ছিল সেই স্যুট পরা লোকটি, এবার তাঁর সঙ্গে আরও দু’জন—একজন বৃদ্ধা যাঁর চোখে যেন আগুন, আর একজন তরুণ যার মুখ সাদা কাপড়ে বাঁধা।
লোকটি বলল, “Welcome to the Ledger Room. Here, we collect the unheard.”
এলেনা জিজ্ঞেস করল, “What do you mean?”
তখন বৃদ্ধা বললেন, “Every séance creates echoes. Whispers. Sentences lost in air. We record them. Cross-check. Build the ledger of truths.”
তারা এলেনাকে একটি পুরোনো খাতা দেখাল—পাতাগুলো হলুদ, প্রান্তে ছেঁড়া, কিন্তু প্রতিটি পাতায় লেখা আছে নামহীন কিছু বাক্য:
“He buried her in the rose garden.”
“They poisoned the well.”
“I never wanted the baby.”
“The fire wasn’t an accident.”
এলেনা বলল, “These are confessions?”
লোকটি বলল, “Or truths the world refused to hear. Sometimes, the dead are the only honest witnesses.”
তখন সেই মুখ ঢাকা তরুণটি সামনে এগিয়ে এল। তার হাতে ছিল একটি নতুন পৃষ্ঠা। সে তাতে একটি বাক্য লিখল:
“Backley’s guilt runs deeper than she knows.”
এলেনার গলা শুকিয়ে গেল। “Who wrote that?”
লোকটি উত্তর দিল, “The room did. The whispers did. The more you come closer, the more you’ll be known. Even to yourself.”
সেই মুহূর্তে একটা কাঁচ ভেঙে পড়ার শব্দ হল ঘরের এক কোণে। তারা সবাই ছুটে গিয়ে দেখল—একটা পুরোনো আয়না ফেটে গেছে। আয়নার টুকরো থেকে ধীরে ধীরে ভেসে উঠছে এক মুখ—এটা সেই রাজনীতিবিদের! তাঁর ঠোঁট নড়ছে, কিন্তু কোনো শব্দ নেই।
তখনই ঘরের বাতি টিমটিম করে উঠল, বাতাস ভারী হয়ে গেল, আর এক কান্নাজড়ানো কণ্ঠ ভেসে এল—
“He begged her to stop. But she printed it anyway.”
এলেনা এবার আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। সে চিৎকার করে উঠল, “No! I just exposed corruption! I didn’t kill him!”
কিন্তু সেই মুখ আবার ফিরে এল, ঠোঁট কাঁপাতে কাঁপাতে বলল,
“You were the weapon. Truth cuts too.”
তখনই লোকটি এলেনার কাঁধে হাত রাখল। “You’re ready for the Third Circle.”
এলেনা ধীরে বলল, “What will I find there?”
লোকটির কণ্ঠে ছিল শীতলতা—
“Your own name, whispered by the dead.”
পর্ব ৪
থিয়েটার, আর্কাইভ, তারপর—একটা আয়নার ঘর। এলেনা এবার বুঝে গিয়েছিলেন, The London Séance Society নামটা যতটা শোনায় নিরপদ, আদতে তার ভেতরটা যেন সময়ের গভীরে লুকিয়ে থাকা এক রক্তমাখা স্মৃতি।
তিনি যখন পরদিন নতুন নির্দেশ পেলেন—
“Arrive at The Hall of Seven Reflections. Midnight. Alone. No light.”
—তখন তিনি আর প্রশ্ন করেননি।
পুরনো লন্ডনের একটি পরিত্যক্ত কারখানার নিচে নাকি এই ‘হল’ তৈরি হয়েছিল এক যুগোস্লাভ অভিজাত পরিবারের জন্য—যারা আয়না ব্যবহার করত ভবিষ্যৎ দেখার জন্য। কিন্তু পরিবারের সব সদস্য একদিন একসাথে অদৃশ্য হয়ে যায়। তারপর সেই ঘর বন্ধ করে দেওয়া হয়।
রাত বারোটায় এলেনা সেখানে পৌঁছালেন। ছায়ায় ঢাকা ভাঙা ইটের গলি ধরে এগিয়ে গিয়ে দেখলেন একটি লোহার দরজা, যার গায়ে আঁকা একটি জাদুকরী চিহ্ন—চোখের চারদিকে ঘূর্ণায়মান আয়নার টুকরো।
তিনি ফিসফিস করে বললেন, “Let me see.”
দরজাটি শব্দ না করে খুলে গেল।
ঘরের ভিতর অন্ধকার। কেবল মাঝখানে একটি গোলাকৃতি পাথরের মেঝে, তার চারপাশে সাতটি আয়না, একেকটি একেক মাপে। আশ্চর্যের কথা, ঘরটিতে কোনো আলো নেই, কিন্তু আয়নাগুলো নিজে থেকেই আলো ছড়াচ্ছে—একটা হালকা নীল, একটাতে সোনালি ঝলক, আরেকটিতে ধোঁয়াটে রক্তচাপা আভা।
একটি অদ্ভুত কণ্ঠ তখন বলল,
“Every mirror shows what you hide. Not from the world, but from yourself.”
এলেনা সামনে এগিয়ে গিয়ে প্রথম আয়নার সামনে দাঁড়ালেন।
প্রথম আয়না—তাকে দেখাল সেই কিশোরী এলেনাকে, যে প্রথম তার পিতার আত্মহত্যার খবর পেয়েছিল। আয়নার ভিতরে ছোট এলেনা চিৎকার করছে, মা ঘরের কোণে কান্না করছে। বাস্তবে এলেনা জানত, সে দৃশ্য সে মুছে ফেলেছিল, অনেকদিন আগে। কিন্তু আয়নার ভেতর সেই স্মৃতি জীবন্ত।
দ্বিতীয় আয়না—তাকে দেখাল সাংবাদিক হবার প্রথম দিনের সাক্ষাৎকার। কিন্তু তার পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা সম্পাদকটি ফিসফিস করে বলছে, “She’s too driven. She’ll burn everything in her way.”
তৃতীয় আয়না—এবার আরও অদ্ভুত। এলেনা নিজের মুখ দেখলেন না—দেখলেন সেই রাজনীতিবিদের। মুখে আতঙ্ক, ঠোঁটে আধখোলা একটা বাক্য: “You promised me time…”
সে পিছিয়ে এল, হৃদস্পন্দন দ্রুত। কিন্তু ঠিক তখনই সপ্তম আয়নাটি ফাটল ধরল, নিজে থেকেই। সেখান থেকে ধীরে ধীরে ধোঁয়া বেরোল, আর সেই ধোঁয়ার ভেতর ভেসে উঠল তার নিজের নাম—“Backley”—লিখে যাচ্ছে অদৃশ্য হাত। আর প্রতিটি অক্ষরের নিচে রক্তের ফোঁটা ঝরছে।
“Who’s doing this?” এলেনা চিৎকার করলেন।
পেছনে দাঁড়িয়ে সেই স্যুট পরা লোকটি বলল, “No one is doing this. The Circle shows only what you buried. Now you must ask yourself—how much of your truth is left unseen?”
এলেনা কাঁপা গলায় বলল, “I wanted to do good. Expose truth. Save lives.”
লোকটি এগিয়ে এসে বলল,
“And yet, you watched as your truth burned others. The mirror doesn’t lie, Miss Backley. But you might.”
তখনই আয়নার ভেতর থেকে আরেকটা মুখ ভেসে এল। এবার এলেনার নিজের মুখ। কিন্তু চোখের জায়গায় শূন্যতা। ঠোঁট কাঁপছে—একটা নাম বলছে।
“Sevrine…”
Lady Sevrine?
এলেনা পেছনে তাকালেন। কিন্তু কেউ নেই।
তখনই লোকটি বলল,
“The Fourth Circle ends where the First began. You must return.”
“Where?”
“Where the flame first flickered.”
তখন সেই ধোঁয়া ঘন হয়ে এল, ঘর ঘুরতে লাগল, আর আয়নাগুলো একে একে চূর্ণ হয়ে গেল। এলেনা চোখ বন্ধ করলেন। আর খুলে দেখলেন—তিনি একা দাঁড়িয়ে আছেন সেই প্রথম দিনের ভিক্টোরিয়ান বাড়ির বাইরে।
সেই দরজায় লেখা এখন আর নেই। কেবল তিনটে শব্দ খোদাই করা:
“Remember the dead.”
পর্ব ৫
এলেনা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে দেখছিলেন কুয়াশার মধ্যে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া সেই বাড়িটার ছায়া। তার মনে হচ্ছিল, সময় যেন এখন লন্ডনের ভিজে বাতাসের মতো—ধরা যায় না, ছুঁতে গেলে পিছলে যায়।
তিনটি শব্দ এখনও তার মাথায় ঘুরছে—“Remember the dead.”
রাত তখন তিনটে। আর ঘুম নেই। শুধু অপেক্ষা।
ঠিক তখনই দরজার নিচ দিয়ে গড়িয়ে আসে এক খাম। তাতে কোনও ঠিকানা নেই, কেবল লেখা:
“The Reversal begins at 4:04 AM. Bring the silence with you.”
এলেনা বুঝে গেলেন—এই পর্ব আর শুধু দর্শক হওয়ার নয়। এবার কিছু ফিরিয়ে দেওয়ার সময় এসেছে। হয়তো প্রশ্ন নয়, উত্তর নয়—কেবল নিঃশব্দ।
তিনি সময়মতো পৌঁছালেন হাইগেট কবরস্থানের এক গোপন প্রবেশপথে। সেখানে আগে থেকেই দাঁড়িয়ে ছিলেন Lady Sevrine—একটি কালো কেপ পরে, হাতে একটি লণ্ঠন।
তিনি বললেন, “You’ve seen the whispers. Now you’ll hear the silences.”
তারা দু’জনে মিলে ঢুকে গেলেন এক পুরনো সমাধির নিচে। নিচে ছিল এক ছোট ঘর, ঘিরে রাখা নানা পুরনো কফিন আর পাথরের ফলক। ঘরের মাঝখানে রাখা একটি বড় আয়তাকার আয়না—এই আয়না আগের আয়নাগুলোর মত নয়। এর পৃষ্ঠতলে কিছুই প্রতিফলিত হয় না।
Lady Sevrine বললেন, “This is the Mirror of the Unspoken. Tonight, we reverse the séance. Tonight, we offer them silence.”
এলেনা কিছুই বুঝতে পারলেন না। “Silence? What does that mean?”
Lady Sevrine একগুচ্ছ সাদা মোমবাতি জ্বালালেন। তারপর বললেন,
“Every séance pulls the dead back. They scream, they beg, they relive. But they never rest. We claim to listen, but we force them to speak. Tonight, we give them permission to stop.”
মোমবাতির আলোয় ঘরের তাপমাত্রা ধীরে ধীরে কমতে লাগল। দেয়ালের ছায়া নড়তে লাগল—কেউ যেন ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে।
Lady Sevrine বললেন, “We ask them one last time. And if they choose silence, we let them go.”
তখনই সেই আয়নার মধ্যে ধীরে ধীরে ফুটে উঠতে লাগল কয়েকটি মুখ—তাদের চোখে কান্না, কেউ ঠোঁট নাড়াচ্ছে, কেউ হাত বাড়াচ্ছে।
এলেনা তাদের চিনে ফেললেন—তারা সেই আত্মারা যারা বারবার সেই séances-এ ডাকা হয়েছে, সত্য বলার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে, আবার তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
Lady Sevrine বললেন, “Ask your question, Miss Backley. One final time.”
এলেনার গলা শুকিয়ে এল। কিন্তু সে বলল,
“Did I kill him? Or did I only tell the world what he tried to hide?”
আয়নার মধ্যে সেই রাজনীতিবিদটির মুখ ভেসে এল। চোখ দুটি খুব ক্লান্ত, ঠোঁটে আর কোনো বাক্য নেই। কেবল একবার মাথা নাড়ল—না।
এলেনার চোখ ভিজে উঠল। এতদিন ধরে সে নিজের ভেতরেই ছিল এক কৃতঘ্নতা, এক অপরাধবোধ। কিন্তু এখন সে জানে—তথ্য ছড়ানোই তার কাজ ছিল। কিন্তু যারা সেটা ব্যবহার করেছিল, তাদের মুখ সে কখনো দেখেনি।
Lady Sevrine বললেন, “He forgives you. Now forgive yourself.”
তখন আয়নার আলো নিভে গেল। মুখগুলো মিলিয়ে গেল কুয়াশায়। এক নিঃস্তব্ধতা নেমে এল ঘরে।
Lady Sevrine ধীরে বললেন, “The dead speak only when the living forget to listen. You remembered. Now the Circle is complete.”
এলেনা তখনও নিশ্চুপ। তার মনে হচ্ছিল, ভিতরে যেন কিছু একটার ওজন হালকা হয়ে গেছে।
ঠিক তখনই, ঘরের এক কোণে একটা ছায়া নড়ল। কেউ দাঁড়িয়ে ছিল অনেকক্ষণ ধরে। এলেনা তাকিয়ে দেখলেন—সে সেই স্যুট পরা লোকটি নয়, না কোনো আত্মা।
সে একজন সাংবাদিক। নাম তার গ্যাব্রিয়েল ড্যুন। সে পেছনে দাঁড়িয়ে বলল,
“Miss Backley, they’ve chosen you. But there’s something you don’t know.”
এলেনা তাকালেন তার দিকে।
“Sevrine… she was never alive.”
পর্ব ৬
এলেনা সেই কথাটা শুনে যেন কিছু সময়ের জন্য নিঃশ্বাস নিতে ভুলে গেলেন—“Sevrine… she was never alive.”
গ্যাব্রিয়েল ড্যুন সামনে এগিয়ে এলেন। তার হাতে ছিল এক পুরনো দস্তাবেজ—পাতলা, হলদেটে কাগজে ছাপা একটি মৃত্যু নিবন্ধন।
“Lady Sevrine Beaumont. Died: 21 October, 1894. Cause: Unknown. Buried: Highgate Cemetery.”
এলেনা হাতে নিলেন কাগজটা, চোখ বারবার ছুঁয়ে যাচ্ছিল লাইনের প্রতিটি শব্দ।
“Impossible,” সে ফিসফিস করল। “আমি তো তার স্পর্শ অনুভব করেছি… তার কণ্ঠ শুনেছি…”
গ্যাব্রিয়েল মাথা নাড়ল, “Yes. That’s why she’s powerful. She didn’t return as a ghost. She never left.”
তারা দু’জনে আবার সেই Vault-এ ফিরে এলেন, কিন্তু সেখানে এখন কিছুই নেই। না আয়না, না মোমবাতি, না Lady Sevrine-এর ছায়াও। কেবল একটা খোলা খাতা, যাতে লেখা এক লাইন—
“Those who lead the séance must learn to haunt.”
গ্যাব্রিয়েল বললেন, “The Séance Society believes the line between medium and spirit can blur. Sevrine was once a medium. But one night, during a séance meant to reach her lost lover, she went too far. She offered her own body. She became the gate.”
এলেনা বলল, “তাহলে আমি কাকে অনুসরণ করছি এতদিন?”
“Someone who never truly died,” গ্যাব্রিয়েল বলল। “She lives in the silence between the living and the dead. She feeds off guilt, grief, and secrets.”
ঠিক তখনই ঘরের এক দেয়াল কেঁপে উঠল, আর ভেতর থেকে এলেনার গলার আওয়াজ শোনা গেল—
“Did you think you could escape, Elena?”
এলেনা চিৎকার করে উঠল, “That’s me! That’s my voice!”
ঘরের বাতাস ঘুরপাক খাচ্ছিল, আলো ঝাপসা হয়ে আসছিল। আয়নার টুকরোর মতো ছায়া চারদিকে ঘুরছিল, এবং প্রতিটি ছায়া যেন এলেনার নিজের প্রতিবিম্ব—কিন্তু বিকৃত, গম্ভীর, শূন্য।
“Every séance opened you a little more,” সেই কণ্ঠ বলল। “And now, you are almost ready.”
গ্যাব্রিয়েল তাকে ধরে বলল, “We need to leave. Now!”
কিন্তু দরজা আর নেই। চারদিক শুধু দেয়াল। মাটির তলা যেন এক জীবন্ত কবরে পরিণত হয়েছে।
তখন ঘরের এক কোণে Lady Sevrine-এর অবয়ব আবার ফুটে উঠল—সাদা চুল, গাঢ় ঠোঁট, কিন্তু চোখে কোনো চোখ নেই। কেবল কালো ফাঁপা গহ্বর, যার মধ্যে টানছে সব আলো।
“Why me?” এলেনা চিৎকার করে জিজ্ঞেস করল। “Why choose me?”
Sevrine বলল, “Because you never feared truth. And the dead fear only one thing—being truly seen.”
গ্যাব্রিয়েল তখন একটা সোনালি রিং এলেনার হাতে তুলে দিল। “Wear this. It belonged to her. It binds her.”
এলেনা রিংটি পরতেই ঘরের তাপমাত্রা বদলে গেল। বাতাস থেমে গেল। Sevrine ধীরে ধীরে পেছিয়ে গেল, কণ্ঠ মৃদু হয়ে বলল,
“The seventh circle awaits… Come find me.”
এলেনা চোখ খুলে দেখলেন—তারা আবার কবরস্থানের বাইরে। কোনও দরজা নেই, কোনও গ্যাব্রিয়েল নেই। কেবল তার হাতে সেই সোনালি রিংটা, আর তার পেছনে গলার এক ফিসফিস শব্দ—
“You are the séance now.”
পর্ব ৭
সকালবেলা ঘুম ভেঙে এলেনা নিজেকে আবিষ্কার করলেন নিজের ফ্ল্যাটে, মেঝেতে পড়ে থাকা অবস্থায়। তার গায়ে ছিল গত রাতের পোশাক, হাতে সেই সোনালি রিং। দরজা বন্ধ, মোবাইল নিঃসাড়, ঘড়ির কাঁটা আটকে আছে ঠিক ৪:০৪-এ—সেই সময়টায়, যেদিন ‘Reversal’ হয়েছিল।
সে উঠে দাঁড়িয়ে আয়নার সামনে গেল। কিন্তু আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বটা একটু আলাদা—চোখে ক্লান্তি, ত্বকে ছায়া, এবং ঠোঁটে এক অচেনা অভিব্যক্তি।
বেশিক্ষণ ভাববার সময় ছিল না। দরজার নিচে আবার এক খাম। এবার ভিতরে একটিই কাগজ, তাতে কেবল এক লাইন—
“The Book waits where tongues were silenced.”
এলেনা ভাবতে লাগল—“tongues were silenced” বলতে কী বোঝাতে চায়? ইতিহাসে এমন কোন জায়গা আছে লন্ডনে, যেখানে মানুষকে কথা বলার অপরাধে শাস্তি দেওয়া হত?
জবাব খুঁজতে গিয়ে সে গেল ব্রিটিশ লাইব্রেরির গোপন আর্কাইভে। বহু খোঁজাখুঁজির পর, একটা তথ্য সামনে এল—এক পুরনো ব্ল্যাক চার্চ, Southwark-এর কাছে, যেখানে ১৬শ শতকে ধর্মবিরোধী বা ‘heretic’ মানুষদের শাস্তিস্বরূপ জিভ কেটে ফেলা হত। জায়গাটির নাম ছিল St. Leora’s Chapel.
জায়গাটা এখন একটা সেকেন্ড-হ্যান্ড বইয়ের দোকান। নাম: Mouthless Books.
দোকানে ঢুকেই এলেনার বুক কেঁপে উঠল। ভিতরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে বাতাস ভারী হয়ে গেল, যেন শত শত শব্দ থেমে আছে বইয়ের পাতার ফাঁকে। দেয়ালে টাঙানো ছিল অদ্ভুত এক পেইন্টিং—একজন মহিলার মুখ নেই, কেবল দুটি কালো গর্ত। নিচে লেখা: “Listen with the bones.”
দোকানের পেছনে, একটি সরু সিঁড়ি নামছে নীচে। কাউকে কিছু না বলে সে নেমে গেল। নিচে পৌঁছে দেখল—একটা ছোট ঘর, চারপাশে শেলফ ভর্তি পুরনো খাতা। মাঝখানে একটি ডেস্কে রাখা একটি বই—কালো মখমলে মোড়া, তার ওপর লেখা:
“The Book of Mouthless Names.”
বইটি ছুঁতেই একটা ঠান্ডা শিহরণ ছড়িয়ে পড়ল এলেনার শরীরে। সে প্রথম পৃষ্ঠা খুলল—কোনো লেখা নেই, শুধু চাপা চিহ্ন—যেন কেউ অদৃশ্য কালি দিয়ে লিখেছে।
সে বইটি চোখের কাছে নিয়ে গেল। তখনই মোমবাতির আলোয় চিহ্নগুলো ফুটে উঠল—প্রতিটি নামের পাশে একেকটা ফিসফিস শব্দ, যেন বাতাসে কারা নাম ধরে ডাকছে।
হঠাৎ সে নিজের নাম দেখল—E. Backley
তার নিচে লেখা:
“Bound to the Seventh.”
তখনই বইটি নিজে থেকেই পৃষ্ঠা ওল্টাতে লাগল, এবং এক পৃষ্ঠায় থেমে গিয়ে ফুটে উঠল এক নাম—
“Sevrine Beaumont – Mouthless Medium – Still Present.”
বাতাস ভারী হয়ে উঠল, বইয়ের পাতা যেন কাঁপছে। এক অজানা ছায়া এলেনার পেছনে দাঁড়িয়ে বলল,
“You opened the book. You must carry it now.”
সে ঘুরে তাকাল—কেউ নেই। কিন্তু টেবিলের পাশে রাখা আয়নাটিতে এক ছায়া দাঁড়িয়ে, যেটি তার নয়। ঠোঁট নেই, কিন্তু কণ্ঠ শুনতে পাচ্ছেন—
“Names forgotten scream the loudest.”
হঠাৎ পুরো ঘর অন্ধকার। শুধু একটা কণ্ঠ—
“She wore the ring. She opened the book. The Séance has a new keeper.”
এলেনা তখন বুঝলেন, এই বই আর শুধু তথ্য নয়—এটা এক অভিশাপ। নাম যারা ভুলে গিয়েছে, যারা কথা বলতে পারেনি, যারা চিরতরে নিঃশব্দে হারিয়ে গেছে—তাদের কণ্ঠ এই বইতে বন্দী। আর এখন সে নিজে তাদের রক্ষক।
তখনই বইয়ের শেষ পাতায় ফুটে উঠল আরেকটি ঠিকানা—
“Tower of Saint Giles. Midnight. For the Eighth.”
পর্ব ৮
সেন্ট জাইলসের টাওয়ারে পৌঁছাতে সময় লাগল না, কিন্তু টাওয়ারটি আজকের লন্ডনে শুধু ইতিহাস বইয়ের পাতায় থাকে। শহরের ব্যস্ত রাস্তাগুলোর ঠিক মাঝখানে, আধুনিক বিল্ডিংগুলোর ছায়ায় চাপা পড়ে থাকা এই প্রাচীন গির্জার ধ্বংসাবশেষে পা রাখার মুহূর্তেই এলেনার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল।
দরজা নেই, কিন্তু একটা অর্ধভাঙা প্রবেশপথ। দেয়ালে পুরনো গির্জার চিহ্ন এখনও টিকে আছে—একটা হাত, যেটার আঙুল ঠোঁটে তুলে নিঃশব্দ থাকার নির্দেশ দিচ্ছে।
এলেনার মনে হচ্ছিল, সেই বই এখনও তার ব্যাগে ফিসফিস করছে। শব্দ ছাড়া এমন একটা ভার সে আগে কখনও অনুভব করেনি।
ভিতরে পা রাখতেই গায়ের চামড়ায় শীতল বাতাস লাগল। এখানে আলো নেই, শুধু একটা সরু পথ যা একেবারে উপরে উঠে গেছে—সেই পুরনো মিনারের দিকে।
সে একাই উঠে যেতে লাগল। প্রতিটি ধাপ যেন অতীতের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এবং যত উপরে উঠছিল, তত কণ্ঠগুলো জোরে ফিসফিস করতে লাগল—নামহীন কণ্ঠ, হারিয়ে যাওয়া স্বর।
টাওয়ারের চূড়ায় উঠে দেখে, একটি গোল ঘর—চুনকাম করা দেয়ালে সাদা কালিতে আঁকা চক্র, আর ঘরের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে Lady Sevrine।
তবে এবার তিনি আগের চেহারায় নেই। চোখদুটি গাঢ় ছায়ায় ডুবে, মুখের এক পাশ থেকে চামড়া খুলে পড়ছে, ভিতর থেকে কেবল ছায়া গড়িয়ে আসছে।
এলেনা শক্ত কণ্ঠে বলল, “What are you now?”
Sevrine হাসলেন—একটা শীতল হাসি, যেন ভেতরে রক্ত নয়, স্মৃতি বয়ে চলে।
“I am what happens when truth is chained and silence becomes sacred. I am the voice that learned not to scream, but to echo.”
এলেনা রিংটা দেখিয়ে বলল, “You wanted me to take your place.”
Sevrine বললেন, “Not replace. Continue. The séance is not a ritual. It’s a lineage. Every few decades, one of us must stay behind. And one must become the throat.”
“Why me?”
“Because you listened. Even when it hurt.”
এলেনা বুঝে গেলেন—এই দায়িত্ব কোনো বরং নয়, এক ধরনের শাস্তি। সত্য শুনে যাওয়া, নাম ধরে ধরে ডাক শোনা, চিরকাল মৃতদের মাঝে বেঁচে থাকা।
ঠিক তখনই ঘরের চারপাশে ভেসে উঠল সাতটি ছায়া—আগের সেই আয়নার প্রতিফলন, আগের আত্মারা। তাদের মধ্যে একজন এগিয়ে এসে বলল,
“Will you be the throat? Will you speak for us?”
এলেনা এক মুহূর্ত চোখ বন্ধ করলেন। তার জীবনের সব ভুল, সব দায়, সব প্রকাশ, সব অপপ্রকাশ চোখের সামনে ভেসে উঠল। তারপর সে বলল,
“Only if you never scream alone again.”
Sevrine ধীরে সামনে এগিয়ে এলেন। তিনি তার ঠোঁট খোলার চেষ্টা করলেন, কিন্তু শব্দ বের হলো না। তিনি তার গলার নিচ থেকে এক ঝলক আলো তুলে এনে এলেনার কণ্ঠে ছুঁইয়ে দিলেন।
সেই মুহূর্তে ঘর জ্বলতে লাগল শব্দে। সব ফিসফিস একসাথে চিৎকার হয়ে উঠল। এলেনা তার মুখ খুলতেই শত শত কণ্ঠে একটা নাম বলল—
“Elena Backley – Keeper of the Eighth Circle.”
আলো নিভে গেল।
চোখ খুলে এলেনা নিজেকে দেখতে পেল ভোরের আলোয়, লন্ডনের একটি পার্ক বেঞ্চে বসে। হাতে সেই বই, আঙুলে সেই রিং, আর তার কণ্ঠে এক নতুন কণ্ঠ—মিলিয়ে দেওয়া হাজারো মৃত আত্মার কাহিনি।
সামনে একটি শিশু এসে দাঁড়াল। তার চোখে বিস্ময়।
“Are you the ghost lady?”
এলেনা তাকাল, হালকা হাসলেন।
“No. I’m the one who listens when no one else does.”
পর্ব ৯
এলেনা এখন আর কেবল একজন অনুসন্ধানী সাংবাদিক নন—তিনি এখন The Throat, The Listener, The Keeper of the Eighth Circle. এবং এই নতুন পরিচয়ে তার সবচেয়ে বড় শত্রু হল—শব্দ।
তিনি যে যা বলেন, তা আর কেবল তার নিজের কথা নয়। তার কণ্ঠে মিশে থাকে মৃতদের দীর্ঘশ্বাস, ভুলে যাওয়া নামের আকুলতা, হারিয়ে যাওয়া বিচারপ্রার্থীদের কান্না।
লন্ডনের প্রতিটি কুয়াশাভেজা সকাল তার কাছে এখন একেকটা নতুন গল্প—কখনো গলির মধ্যে হারিয়ে যাওয়া এক বালক, কখনো এক ক্লার্কের আত্নহত্যার আগে শেষ অস্পষ্ট চিৎকার, আবার কখনো কোনো বৃদ্ধার মুখে না বলা ভালোবাসার আহ্বান।
সেইসব কণ্ঠকে সে শ্রবণ করে, না বলে বুকে রাখে, এবং সঠিক সময়ে সঠিক মানুষের সামনে প্রকাশ করে দেয়।
তবে সব কণ্ঠ নিরীহ নয়। কিছু কণ্ঠ দাহ্য। কিছু কণ্ঠ প্রতিহিংসায় জ্বলতে থাকে।
একদিন, এক মধ্যরাতে, আবার একটি চিঠি আসে।
“They want more. The Pact must be renewed. Midnight. Thames tunnel.”
Thames নদীর নিচ দিয়ে যে পুরনো টানেল ছিল—একসময় রেলপথ, এখন বন্ধ, অন্ধকার, ছায়াময়। এলেনা ঠিক সময়ে সেখানে পৌঁছান।
ভেতরে অপেক্ষা করছিল সেই সাত আত্মা। তাদের মুখে ছিল না শব্দ, কিন্তু চোখে ছিল চাপা ক্রোধ।
তারা একত্রে তার দিকে তাকিয়ে বলল,
“You’ve become our voice. But what of our justice?”
এলেনা জানতেন, শুধু গল্প শোনালেই চলে না। কিছু সত্য দাফন করা হয় জেনে-বুঝে।
সে বলল,
“Tell me what you need.”
তারা মাটিতে এক চক্র আঁকল—The Pact. এই চুক্তি পুরনো, এমনকী Sevrine-ও যেটিকে এড়িয়ে গিয়েছিল। কারণ, এই চুক্তির মানে হল—শুধু শুনে যাওয়া নয়, প্রয়োজনে কার্যকর হওয়া।
প্রত্যেক আত্মা একটি নাম বলল। সেই নামেরা জীবিত, সমাজে সম্মানিত, কিন্তু তাদের অতীতে লুকানো আছে ভয়ানক অপরাধ—যা আজও শাস্তিহীন।
এলেনা বলল,
“I cannot kill. I cannot condemn.”
তারা বলল,
“We do not ask for blood. We ask for truth. Spoken. Loud.”
তখন এলেনা প্রতিশ্রুতি দিল,
“Each name shall be published. Each secret revealed. But I speak only truth, not vengeance.”
এই হল The Silence Pact—যেখানে মৃতেরা প্রতিশ্রুতি দেয় নিঃশব্দ থাকার, যদি তাদের সত্য জাগিয়ে রাখা হয় জীবিতদের সামনে।
তখনই একটি ছায়া সামনে এগিয়ে এল—সেই শিশু, যে আগে বলেছিল “Are you the ghost lady?” এবার সে বলল,
“You said you listen. Will you listen to mine?”
এলেনা তার দিকে এগিয়ে গেল।
শিশুটি বলল,
“My mother never came home. No one listened. Not the police. Not the school. Not my father.”
এলেনা চোখ বন্ধ করল। বুকের ভেতর যেন কিছু একটার দরজা খুলে গেল। শিশুটির কণ্ঠ ভেসে এল ভেতর থেকে—অন্ধকার, নদী, এক গলা চেনা হাসি, আর এক শেষ আর্তনাদ।
এলেনা জানল, এবার তার কাজ শুধু লেখা নয়। সে এখন একটা চলন্ত সান্ধ্যসভার মতো, যার প্রত্যেক ভোরে পেছনে পড়ে থাকে কিছু নাম, কিছু স্মৃতি, কিছু আলো।
পর্ব ১০
এলেনা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন—এবার সত্য প্রকাশ পাবেই। সে আর শুধু শ্রোতা নয়, এবার সে উচ্চারণ করবে, ছাপাবে, ছড়িয়ে দেবে সেইসব নাম, যাদের অপরাধ চাপা পড়ে ছিল টাকার, ক্ষমতার আর ভয়ের চাদরে।
সে তার পুরনো পরিচয় ফিরে নিল—একজন অনুসন্ধানী সাংবাদিকের, কিন্তু এবার কলমের নিচে কালি নয়, আত্মাদের দাবী।
প্রথম নামটি ছিল—Alec Thorne, একজন প্রভাবশালী মিডিয়া ব্যারন, যিনি তার এক তরুণ সহকর্মীকে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিয়েছিলেন।
দ্বিতীয়—Margaret Elms, এক দাতব্য সংস্থার মুখ্য ব্যক্তি, যিনি ছোট ছেলেমেয়েদের উপর নির্যাতনের অভিযোগে ছিল, অথচ কখনও গ্রেপ্তারই হননি।
তৃতীয়—Inspector R. Mallory, যার তদন্ত ফাইলের নীচে চাপা পড়ে ছিল পাঁচটা নারী নিখোঁজ হওয়ার অভিযোগ।
প্রতিটি নাম ছাপা হল। প্রতিটি প্রমাণ পেশ করা হল। এলেনার নতুন প্রকাশনা—Whispers In Ink—এক অনলাইন পোর্টাল, যেখানে নামহীন সত্যগুলো মুখ পেতে পেল।
প্রথম সপ্তাহেই ওয়েবসাইট হ্যাক হওয়ার চেষ্টা হল। দ্বিতীয় সপ্তাহে এলেনাকে অনুসরণ করা শুরু হল। তৃতীয় সপ্তাহে তার ফ্ল্যাটের দরজায় পেট্রল ছিটিয়ে আগুন লাগানোর চেষ্টা হল।
কিন্তু সে থামল না। কারণ প্রতিটি রাতে বইটা তার কাছে ফিরে আসে—The Book of Mouthless Names—নতুন নাম নিয়ে, নতুন গল্প নিয়ে।
তবে সবথেকে ভয়ের বিষয় ঘটল চতুর্থ সপ্তাহে।
তার কম্পিউটারে এক ফোল্ডার নিজে থেকেই তৈরি হয়—“You Missed One.”
সে ফোল্ডার খুলতেই দেখা গেল একটি ভিডিও। তাতে Sevrine বসে আছেন এক অন্ধকার ঘরে, তার সামনে রাখা একটি টাইপরাইটার। সে টাইপ করতে করতে বলে যাচ্ছেন—
“What if the one who speaks begins to lie?”
“What if the Throat becomes the Sword?”
এলেনার বুক কেঁপে উঠল। মানে কি এই? সে কি ভুল কিছু করছে?
ঠিক তখনই দরজায় কড়া নাড়া।
সে দরজা খুলল না। বরং ছুটে গিয়ে সেই সোনালি রিং খুলে ডেস্কে রাখল। তারপর বইটা খুলে দেখল—এক নতুন নাম ভেসে উঠছে।
“Elena Backley – Truth-teller. Now Under Watch.”
সে পিছিয়ে গেল। হঠাৎ খেয়াল করল আয়নায় সে নিজের চোখে আর চোখ রাখতে পারছে না। সেই সাহসী প্রতিবিম্ব কোথায়?
নাকি সত্য উচ্চারণের ক্লান্তি এত গভীর, যে একসময় সত্যও ভার হয়ে ওঠে?
তখন আবার ভিডিও চালু হল। Sevrine এবার বললেন—
“You were never chosen to save others. You were chosen to carry them. Now look behind you.”
সে ঘুরে তাকাল।
ঘরের প্রতিটি কোণে দাঁড়িয়ে আছে ছায়া। তারা চুপচাপ তাকিয়ে আছে। কেউ উচ্চারণ করছে না। কিন্তু প্রতিটি চোখে একটাই প্রশ্ন—“Will you still speak for us?”
পর্ব ১১
এলেনা ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন, চারদিকে ছায়ামূর্তির সারি। তারা কিছু বলছিল না, কেবল তাকিয়ে ছিল গভীর চোখে, অনুরোধ নয়, দাবি নয়—একধরনের নীরব উপস্থিতি, যেন কণ্ঠহীন স্বীকৃতি।
তার শরীর ভারী হয়ে উঠছিল। মাথার ভেতর গুঞ্জন, যেন শত শত নাম একসাথে ফিসফিস করছে—কারও নাম বলা হয়নি, কারও নাম বলা ঠিক হয়নি, কারও নাম বলা হয়ে গেছে অনেক দেরিতে।
ডেস্কের উপর রাখা সোনালি রিংটা তখন চকচক করছিল, আর বইটার শেষ পাতায় একটি লাইন ফুটে উঠছিল ধীরে ধীরে, যেন অদৃশ্য এক হাত লিখছে—
“The séance never ends. It only finds a new voice.”
এলেনা জানত, Sevrine চলে গেছে না। সে আকার বদলেছে, স্থান বদলেছে। এখন সে উপস্থিত প্রতিটি ব্যর্থ চুক্তির ভিতর, প্রতিটি অস্বীকৃত আবেগে, প্রতিটি মৃত আত্মার চিৎকারে যেটা কেউ শোনে না।
ঠিক তখনই তার ফোনে একটি কল আসে—No Caller ID.
তালভাঙ্গা গলায় একটি পুরুষ কণ্ঠ বলে,
“You think publishing names will save you? We built this city on silence, Miss Backley.”
সে কোনো উত্তর দিল না। ফোনটি বন্ধ করে আবার বইয়ের দিকে তাকাল। বইটি যেন খুলে যেতে চায় নিজের ইচ্ছেমতো, পাতাগুলি উল্টে এক নতুন নাম দেখাল—
“Gabriel Dune.”
সে চমকে উঠল। গ্যাব্রিয়েল—যিনি তাকে Sevrine-এর সত্য বলেছিলেন, যিনি সাহায্য করেছিলেন…
তার মনে পড়ল, গ্যাব্রিয়েল তাকে কখনও ছায়া থেকে বের হয়ে আসেনি। কখনও ছুঁয়ে দেয়নি। কখনও তার পরিচয় দেয়নি।
সে কি আদৌ জীবিত? নাকি তিনিও শুধুই এক আত্মা, যিনি সত্যের সীমানা পার করে এসেছিলেন?
সে সিদ্ধান্ত নিল, প্রশ্ন নয়, এবার দায়িত্ব।
তখনই বইয়ের শেষ পাতায় একটি নতুন চুক্তিপত্র ফুটে উঠল—
“Those who hold the book must never stop listening. Must never speak falsely. Must never forget. In return, they shall never die. Not fully.”
এলেনা কলম হাতে নিলেন। একটানা, শান্তভাবে লিখলেন—
“I accept. Let them speak.”
ঠিক সেই মুহূর্তে, ঘর আলোকিত হয়ে উঠল। প্রতিটি ছায়া ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে লাগল বাতাসে। তাদের চোখে ছিল প্রশান্তি, যেন অবশেষে তারা কোথাও পৌঁছেছে, যেখানে সত্য তাদের হয়ে কথা বলবে।
রাত পার হয়ে ভোর।
বাইরের পাখির ডাক, গাড়ির হর্ন, শিশুর কান্না—সব মিলিয়ে শহরের চিরচেনা সুর।
এলেনা ডেস্কে বসে লিখে চলেছেন। তার আঙুল চলতে থাকলে, যেন টাইপরাইটারই এখন séance-এর মাধ্যম।
দেয়ালে এখন একটা নতুন চিহ্ন—এক চোখ, এক শিখা, এক রিং।
বইয়ের শেষ পাতায় লেখা:
“She speaks for us now.”
এবং তার নিচে ছোট করে খোদাই—
The London Séance Society continues.
[শেষ]