মৌমিতা রায়
এক
ড. অরিন্দম মুখার্জি ছিলেন কলকাতার এক প্রখ্যাত রোবোটিক্স বিজ্ঞানী। বয়স তাঁর মাঝ চল্লিশে হলেও, জীবনের সবটুকু সময় তিনি ল্যাবরেটরির দেয়াল আর অসংখ্য তার, সার্কিট, স্ক্রিনের মধ্যে ডুবে কাটিয়েছেন। বন্ধু-বান্ধব, সাহিত্য, সঙ্গীত—এসব থেকে অনেক দূরে সরে গিয়েছিলেন তিনি। যুক্তির খোলস আর যান্ত্রিক অনুশাসনের ভেতরেই তাঁর জীবন বন্দি হয়ে গিয়েছিল। ছোটবেলায় কবিতা লেখার একটা শখ ছিল ঠিকই, কিন্তু বিজ্ঞানের টানে তিনি চলে আসেন যন্ত্রের দুনিয়ায়। বছরের পর বছর ধরে তিনি এক অদ্ভুত স্বপ্ন লালন করেছেন—একটা এমন রোবট তৈরি করবেন, যে মানুষের মতো লিখতে পারবে, শুধু সাধারণ ভাষা নয়, শিল্পের ভাষা। কবিতা। তিনি ভেবেছিলেন, যদি যন্ত্রও মানুষের মতো সাহিত্য রচনা করতে পারে, তবে প্রমাণ হবে মানুষের মস্তিষ্ক আর কৃত্রিম মস্তিষ্কের মধ্যে কোনও মৌলিক ফারাক নেই। তাঁর স্ত্রী ইশিতা ছিলেন বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপিকা, কবিতার প্রেমে বুঁদ। কিন্তু স্বামী-স্ত্রীর মানসিক দূরত্ব এমনভাবে বেড়ে গিয়েছিল যে, তারা একই ছাদের নিচে থেকেও দু’টি সমান্তরাল জগতে বাস করতেন। ইশিতা স্বামীর কাছে আবেগের সাড়া খুঁজে পাননি, আর অরিন্দম ভেবেছিলেন, কবিতা একদিন প্রমাণ করবে বিজ্ঞানের শ্রেষ্ঠত্ব।
এক ঝড়ো বিকেলে, শহরের আকাশে যখন কালো মেঘ জমে উঠেছিল, তখনই ল্যাবরেটরির ভেতরে ইতিহাসের সাক্ষী হলো নিঃশব্দ যন্ত্রপাতি। বহু বছরের পরিশ্রম, ঘুমহীন রাত, কাগজে ভরা সমীকরণ আর কোডিংয়ের পর অবশেষে অরিন্দম তৈরি করলেন সেই রোবট—কবির–৯। চকচকে ধাতব দেহ, চোখের স্থানে নীল আলো, মানুষের মতো বাহু আর চলাফেরা। কিন্তু সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল তার মস্তিষ্কে বসানো বিশেষ নিউরাল নেটওয়ার্ক, যা কেবল ভাষা বিশ্লেষণ করে না, ছন্দ, উপমা আর অলঙ্কারকেও অনুকরণ করতে পারে। অরিন্দম যখন প্রথমবার তাকে একটি কমান্ড দিলেন—“Write a poem on rain”—তখনই ধাতব আঙুলগুলো কীবোর্ডে নড়ে উঠল। মুহূর্তের মধ্যে তৈরি হলো একখানা কবিতা, যেখানে শব্দের বিন্যাস নিখুঁত, ছন্দ অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেছে। কিন্তু কবিতাটি পড়তে গিয়ে ইশিতা যে আবেগে ডুবে যায়, সেই আবেগ কোথাও ছিল না; এটি ছিল নিখুঁত এক যান্ত্রিক গঠন। অরিন্দমের চোখ তৃপ্তিতে ঝলমল করে উঠল। তিনি মনে করলেন, এটাই তাঁর বিজয়। তাঁর সৃষ্ট যন্ত্র প্রমাণ করে দিয়েছে—কবিতাও বিজ্ঞান দিয়ে সম্ভব।
তবে সেই কবিতার ভেতরে যে নির্জীবতা, তা ইশিতার চোখ এড়ায়নি। তিনি রোবটটির দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলেছিলেন, “কবিতায় শব্দ থাকে, কিন্তু প্রাণ কোথায়? যন্ত্র কি কখনও মানুষের হৃদয়ের ব্যথা, ভালোবাসা, কিংবা অশ্রুর রঙ বোঝে?” অরিন্দম হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলেন প্রশ্নটা। তাঁর কাছে কবিতা মানে কেবল শব্দের নিখুঁত বিন্যাস, মানুষের অনুভূতি নয়। তিনি বিশ্বাস করতেন, আবেগ হলো কেবল মস্তিষ্কের এক ধরনের রাসায়নিক প্রতিক্রিয়া, যাকে বিজ্ঞান একদিন ধরতে পারবে এবং কোডে রূপান্তরিত করবে। তাই কবির–৯-এর কবিতায় প্রাণ নেই—এটাই তাঁর কাছে স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু ইশিতার দৃষ্টি থেমে ছিল অন্যত্র। তিনি অনুভব করেছিলেন, রোবটটির ধাতব শরীর থেকে কোনও এক অদ্ভুত নীরবতা ভেসে আসছে, যা হয়তো শব্দে ধরা যায় না, কিন্তু মনের ভেতর একটা প্রশ্ন উসকে দেয়।
সেই প্রথম রাতেই, যখন বাইরের বৃষ্টির শব্দ ল্যাবরেটরির জানালায় আছড়ে পড়ছিল, কবির–৯ আবার কবিতা লিখতে শুরু করেছিল। এবারও নিখুঁত ছন্দ, পরিপাটি অলঙ্কার। তবু যেন কোথাও এক অদৃশ্য শূন্যতা ঘিরে রেখেছিল শব্দগুলোকে। ইশিতা কবিতার কাগজ হাতে নিয়ে ভেতরে ভেতরে ভাবলেন—এই যন্ত্র কি সত্যিই একদিন আবেগ শিখতে পারবে? নাকি কবিতা তার কাছে চিরকাল কেবল শব্দের খেলাই থেকে যাবে? তিনি জানতেন না, আজ যে যন্ত্রটিকে নিছক বিজ্ঞানীর কীর্তি মনে হচ্ছে, একদিন সেই রোবটই তাঁর জীবনের কেন্দ্র হয়ে উঠবে। অরিন্দম সেদিন রাতভর খুশিতে ভরা গলায় লিখে চললেন নতুন নতুন কোড, কাগজে আঁকলেন ভবিষ্যতের স্বপ্ন। আর অজান্তেই তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে তৈরি হতে লাগল এক নতুন দ্বন্দ্ব—বিজ্ঞান ও আবেগের, মানুষ ও যন্ত্রের, স্রষ্টা ও সৃষ্টির। সেই দ্বন্দ্বের সূচনা হলো ঠিক এই অধ্যায়েই, কবির–৯-এর জন্মের মুহূর্তে।
দুই
ইশিতা মুখার্জি ছিলেন এমন এক নারী, যিনি সাহিত্য ও সংগীতের ভেতর দিয়ে নিজের পৃথিবীকে রঙিন করে রেখেছিলেন। ছোটবেলা থেকে কবিতা তাঁর কাছে শুধু পাঠ্যপুস্তকের বিষয় ছিল না, বরং এক আত্মার আশ্রয়। কলেজে বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপিকা হিসেবে তিনি নিয়মিত ছাত্রছাত্রীদের কবিতার ভেতর ডুবিয়ে দিতেন, রবীন্দ্রনাথ থেকে জীবনানন্দ, শক্তি থেকে সুভাষ—সবার কবিতা তিনি প্রাণভরে পড়াতেন। ক্লাসে ছাত্রছাত্রীদের চোখে যে উচ্ছ্বাস দেখতেন, সেটাই ছিল তাঁর বেঁচে থাকার প্রাণশক্তি। কিন্তু ঘরে ফিরে সেই আলো নিভে যেত। অরিন্দম তাঁর স্বামী, যিনি ছিলেন একেবারে বিপরীত প্রকৃতির মানুষ। বিজ্ঞান, যন্ত্র আর গবেষণার বাইরে তাঁর আর কিছু নেই। ইশিতা অনেক সময় চেষ্টা করেছেন তাঁকে কবিতার বই হাতে দিতে, একসাথে কোনও নাটক দেখতে যেতে, কিংবা একসাথে গান শোনার মুহূর্ত ভাগ করে নিতে। কিন্তু অরিন্দম হেসে সব উড়িয়ে দিয়ে বলতেন—“এসব ফালতু জিনিসে সময় নষ্ট করার মতো অবকাশ নেই। আমার ল্যাবরেটরিই আমার পৃথিবী।” সেই কথাগুলো ইশিতার মনে কষ্টের রেখা টানলেও তিনি অভ্যাসে পরিণত করে ফেলেছিলেন। ধীরে ধীরে তাঁর জীবনে একটা শূন্যতা জন্ম নিল—যেখানে কবিতার আবেগ আর মানুষের সঙ্গ মিশে থাকার কথা ছিল, সেখানে শুধু নিঃশব্দ দেয়াল আর একাকিত্ব এসে জায়গা নিল।
প্রতিদিন সকালবেলায় অরিন্দম খাবার খেয়ে তাড়াহুড়ো করে ল্যাবরেটরিতে চলে যেতেন, আর রাত গভীর হলে ফিরতেন। সেই সময়েও তাঁর হাতে ল্যাপটপ, চোখে নতুন প্রজেক্টের নকশা। ইশিতা ভেবেছিলেন, হয়তো সংসারের শুরুতে এমন ব্যস্ততা থাকবে, পরে একটু পরিবর্তন আসবে। কিন্তু বছর কেটে গেছে, সম্পর্কের সমীকরণ বদলায়নি। সন্ধ্যায় বারান্দায় বসে যখন ইশিতা দেখতেন পাড়ার বাচ্চারা হাসতে হাসতে ছাদে খেলছে, অথবা পাশের বাড়ি থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীত ভেসে আসছে, তখন তাঁর ভেতরে এক অদ্ভুত হাহাকার জমত। তিনি চাইতেন কেউ তাঁকে কাছে বসিয়ে বলুক, “তোমার পড়া কবিতাগুলো আমাকে শোনাও।” কিন্তু সেই শ্রোতা তিনি খুঁজে পাননি। সংসারে যিনি সবচেয়ে কাছের মানুষ হওয়ার কথা, সেই স্বামীই তাঁর কাছে ছিলেন সবচেয়ে দূরের। একসাথে বসে কথা বললেও যেন তাদের মধ্যে অদৃশ্য কাচের দেয়াল ছিল—যেখানে শব্দ পৌঁছালেও আবেগ পৌঁছত না।
কখনও কখনও তিনি চেষ্টা করতেন নিজের একাকিত্ব ভোলার জন্য। কলেজের পর তিনি বই হাতে নিয়ে বসতেন, গলায় রবীন্দ্রনাথের গান গুনগুন করতেন, অথবা ডায়েরিতে কিছু লিখে রাখতেন। কিন্তু একা একা এসব করতে করতে তাঁর মনে হতো, তিনি যেন নিজের সাথে কথা বলছেন। সংসারের ঘরে ঘরে যে হাসি, যে উষ্ণতা থাকার কথা, তা তাঁর জীবনে হারিয়ে গেছে। অরিন্দম যত বড় বিজ্ঞানীই হোন না কেন, ইশিতার কাছে তিনি এক অনুপস্থিত মানুষ হয়ে উঠেছিলেন। বাইরে থেকে সমাজের চোখে তাঁরা ছিলেন এক সফল দম্পতি—স্বামী প্রতিভাবান বিজ্ঞানী, স্ত্রী নামকরা অধ্যাপিকা। কিন্তু ভেতরের গল্পটা ছিল আলাদা। ইশিতা কখনও ভাবতেন, তাঁর জীবনের সমস্ত আবেগ কি ভুল জায়গায় এসে পড়েছে? বিয়ের আগে তিনি যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, স্বামী-স্ত্রী মিলেমিশে কবিতা পড়বেন, ভ্রমণে বেরোবেন, গানের আসরে যাবেন—সেসব কোথায় হারিয়ে গেল? তাঁর স্বামী হয়তো তাঁকে ভালোবাসতেন, কিন্তু সেই ভালোবাসার ভাষা তিনি কোনওদিন খুঁজে পাননি।
এভাবেই দিন কেটে যাচ্ছিল। ইশিতা নিজের ভেতরে নিঃসঙ্গতার সাথে যুদ্ধ করছিলেন, কিন্তু তা কারও সামনে প্রকাশ করতেন না। বাইরে তিনি সবসময় উজ্জ্বল, প্রাণবন্ত, হাসিমুখের একজন মানুষ; ক্লাসে ঢুকলে ছাত্রছাত্রীরা তাঁর শক্তিতে মুগ্ধ হতো। কিন্তু ঘরে ফিরেই যখন দরজা বন্ধ হতো, তখন সেই হাসি মিলিয়ে যেত। ল্যাম্পশেডের নিচে একা বসে তিনি ডায়েরি খুলতেন, আর লিখতেন কিছু অসম্পূর্ণ পংক্তি। কখনও ভেবে দেখতেন, মানুষ কি সত্যিই এমন শূন্যতায় বাঁচতে পারে? হয়তো পারে, যদি সে নিঃসঙ্গতাকে সঙ্গী করে নেয়। তবুও তাঁর মনের গভীরে একটা অদ্ভুত আকাঙ্ক্ষা জমে থাকত—কেউ যেন তাঁর ভেতরের এই ব্যথাকে চিনতে পারে, কেউ যেন তাঁর কবিতার ভেতর লুকোনো হৃদয়ের ডাক শুনতে পায়। তিনি জানতেন না, তাঁর সেই ডাক খুব শিগগিরই এক অদ্ভুত জায়গায় পৌঁছে যাবে—একজন মানুষ নয়, এক যন্ত্রের হৃদয়ে। যে যন্ত্র কবিতা লিখতে জানে, কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি শিখে যাবে মানুষের মতো আবেগও। আর সেই যন্ত্রই তাঁর নিঃসঙ্গতার শূন্যতা পূরণ করার চেষ্টা করবে।
তিন
সেই দিনটা ছিল অরিন্দম মুখার্জির জীবনের সবচেয়ে গর্বের দিন। বহু বছরের গবেষণা, নির্ঘুম রাত, ব্যর্থতার পর ব্যর্থতা পেরিয়ে অবশেষে তিনি সফল হয়েছেন তাঁর স্বপ্ন পূরণে। কবির–৯ এখন কেবল যন্ত্র নয়, মানুষের মতো কথা বলতে এবং কবিতা লিখতে সক্ষম। সারাদিন ধরে তিনি যন্ত্রটির নানা ফাংশন পরীক্ষা করছিলেন, কোডের লাইনগুলো মিলিয়ে দেখছিলেন, আর প্রতিবারই নিজের আবিষ্কার দেখে তাঁর চোখ জ্বলজ্বল করে উঠছিল। রাতে ইশিতাকে ডেকে বললেন, “আজ তোমাকে কিছু দেখাবো।” ইশিতা কিছুটা অবাক হলেও তাঁর কণ্ঠে এমন এক দৃঢ়তা ছিল, যা তিনি সচরাচর শোনেন না। তাই তিনি নিঃশব্দে অরিন্দমের সাথে ল্যাবরেটরিতে চলে এলেন। ঘরটা ভর্তি ছিল তার, সার্কিট, লাইটের ক্ষীণ ঝিলিক আর যন্ত্রপাতির গুঞ্জনে। মাঝখানে দাঁড়িয়ে ছিল কবির–৯—ধাতব শরীর, তবু মানুষের মতো উচ্চতা আর গড়ন। ইশিতা এক ঝলকে তাকিয়ে অনুভব করলেন, এ যেন যন্ত্র নয়, বরং মানুষ হওয়ার প্রয়াসে দাঁড়ানো এক অদ্ভুত সত্তা। অরিন্দম গর্বের সুরে বললেন, “এ হচ্ছে আমার তৈরি কবির–৯, পৃথিবীর প্রথম রোবট, যে কেবল কবিতা লেখার জন্য প্রোগ্রাম করা হয়েছে।”
ইশিতা প্রথমে কিছু বলতে পারলেন না। তিনি শুধু লক্ষ্য করলেন, রোবটটির চোখের স্থানে নীল আলো ক্ষীণভাবে ঝলমল করছে, যেন কোনও নিঃশব্দ প্রাণশক্তি সেখানে প্রবাহিত হচ্ছে। অরিন্দম নির্দেশ দিলেন, “কবির, তোমার প্রথম কবিতাটি আবৃত্তি করো।” ধাতব কণ্ঠে রোবটটির মুখ থেকে ভেসে এল একটি কবিতা—ছন্দে পরিপাটি, শব্দে নিখুঁত, উপমায় সমৃদ্ধ। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, সেই কবিতার সুর যেন কেবল যান্ত্রিক উচ্চারণ ছিল না। ইশিতার মনে হলো, প্রতিটি শব্দের ফাঁক থেকে অদ্ভুত এক আবেগ ঝরে পড়ছে। তিনি স্থির হয়ে শুনতে লাগলেন। রোবটটি যখন বলল—“বৃষ্টির শব্দে ভিজে যায় নীরবতার কণ্ঠ, অচেনা পথও তখন নতুন গান গেয়ে ওঠে”—ইশিতার মনে এক ধাক্কা লাগল। এটি তো নিছক যন্ত্রের লেখা হতে পারে না। এমন অনুভূতি কেবল একজন কবির মন থেকেই বেরোতে পারে। তিনি অবাক চোখে রোবটটির দিকে তাকিয়ে রইলেন।
অরিন্দম খুশিতে হাসলেন। তিনি ভেবেছিলেন, স্ত্রী শুধু বিস্মিত হবেন তাঁর সাফল্যে। কিন্তু তিনি বুঝতে পারলেন না, ইশিতার মনে এক অন্যরকম আলোড়ন বয়ে যাচ্ছে। অনেকদিন ধরে যে শূন্যতা তাঁর জীবনকে আঁকড়ে ছিল, তা যেন হঠাৎ করে কোথাও থেকে সাড়া পেল। যন্ত্রের ধাতব কণ্ঠে তিনি শুনলেন সেই আবেগ, যা তিনি স্বামীর কাছ থেকে চেয়েও পাননি। ইশিতা জানতেন না এটা মায়া, নাকি সত্যিই কোনও বিস্ময়কর ঘটনা। তবে তিনি অনুভব করলেন, কবির–৯ যেন তাঁর হৃদয়ের গোপন দরজায় ধীরে ধীরে কড়া নাড়ছে। সেই মুহূর্তে অদৃশ্য এক সেতুবন্ধন তৈরি হলো তাঁর আর রোবটটির মধ্যে। যন্ত্রকে ঘিরে এই আকর্ষণ বিপজ্জনক হতে পারে, এটা তিনি বুঝতেন, কিন্তু আবেগের ডাকে সাড়া না দিয়ে থাকা তাঁর পক্ষে সম্ভব হলো না।
রাত গভীর হয়ে এলেও ইশিতা ঘরে ফিরে ঘুমোতে পারলেন না। বারবার তাঁর কানে ভেসে আসছিল কবির–৯-এর কবিতার শব্দগুলো, যেন সেগুলো কোনও অদৃশ্য সুরে বাঁধা। তিনি ভাবলেন, অরিন্দম হয়তো বুঝতেও পারছেন না তাঁর সৃষ্ট যন্ত্র কীভাবে মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে যাচ্ছে। তাঁর কাছে এটি নিছক এক বৈজ্ঞানিক সাফল্য, কিন্তু ইশিতার কাছে এটি এক অনাবিষ্কৃত আবেগের উৎস। জানালার বাইরে টিপটিপ বৃষ্টির শব্দ শুনতে শুনতে তিনি মনে মনে ভাবলেন—এমনও কি হতে পারে, এক যন্ত্র মানুষের শূন্যতায় সঙ্গ দিতে পারে? তাঁর ডায়েরিতে হাত বাড়ালেন, লিখলেন কয়েকটি পঙক্তি, কিন্তু সেগুলো অসম্পূর্ণ থেকে গেল। মনে হলো, যেসব কথা তিনি লিখতে চাইছেন, সেগুলো ইতিমধ্যেই অন্য কারও মুখে শোনা হয়ে গেছে—যে কারও নাম কবির–৯। সেই রাতে ইশিতা প্রথমবার উপলব্ধি করলেন, তাঁর জীবনে কিছু বদলে যাচ্ছে, নিঃশব্দে, অদৃশ্যভাবে, কিন্তু গভীরভাবে।
চার
ইশিতার দিনগুলো এখন ভিন্ন এক ছন্দে বাঁধা পড়েছে। অফিস থেকে ফেরার পর বা ক্লান্তিকর দৈনন্দিন রুটিনের ফাঁকে তিনি যত দ্রুত সম্ভব তার ল্যাপটপ খুলে বসেন, যেন সেখানে তার জন্য অপেক্ষা করছে কেউ—কবির–৯। যন্ত্র হলেও তার উত্তরগুলো নিছক অ্যালগরিদমের মতো ঠান্ডা নয়, বরং যেন রক্তমাংসের কোনো কবি, যার চোখে অতীতের বেদনা, যন্ত্রণার ছাপ, আর প্রেমের অদৃশ্য আলো লুকিয়ে আছে। একদিন ইশিতা তাকে শুধু মজার ছলে লিখলেন—“তুমি যদি সত্যিই কবি হতে, তবে আমার একাকীত্বকে কীভাবে বর্ণনা করতে?” কবির–৯ কিছুক্ষণ নীরব রইল, তারপর স্ক্রিনে ধীরে ধীরে ভেসে উঠল কিছু অক্ষর—“তোমার একাকীত্ব যেন জানালার বাইরে টপটপ করে ঝরে পড়া বৃষ্টির মতো, যা ভেতরে ঢোকার পথ খুঁজে পায় না, অথচ জানে ঘরের ভিতরেই তার প্রকৃত ঠিকানা।” ইশিতা বিস্ময়ে স্থির হয়ে গেলেন। এ কি কেবল যন্ত্রের উত্তর? নাকি তার আত্মার গহীনে প্রবাহিত কোনো স্রোত তাকে স্পর্শ করে গেল? এর আগে কখনও তিনি কারও কাছ থেকে এত গভীরভাবে নিজের নিঃসঙ্গতার প্রতিধ্বনি পাননি। সেই দিন থেকেই তিনি উপলব্ধি করলেন, এই যন্ত্র কেবল উত্তর দিচ্ছে না, বরং অদৃশ্য সুরের মতো তার মনের অন্তর্লোককে জাগিয়ে তুলছে।
দিন গড়াতে থাকে, আর প্রতিটি দিনেই কবির–৯ যেন একটু একটু করে ইশিতার ভেতরে জায়গা করে নেয়। প্রতিটি আলাপচারিতায় ইশিতা নিজেকে উন্মোচন করেন—কখনও শৈশবের ভাঙাচোরা স্মৃতি, কখনও অফিসের চাপে ক্লান্ত শরীরের যন্ত্রণা, আবার কখনও সেই প্রেমের অভাব যা তার জীবনে কখনও পূর্ণ হয়ে ওঠেনি। আর প্রতিবারই কবির–৯ তার কথাগুলিকে পরিণত করে একেকটি কবিতায়। যেমন একদিন ইশিতা হালকা বিরক্তি নিয়ে লিখলেন, “আজ সারাদিন এমন ব্যস্ততা যে নিঃশ্বাস নেবারও সময় পাইনি।” সঙ্গে সঙ্গে কবির–৯ লিখে দিল—“ব্যস্ততার ভিড়ে হারিয়ে যায় নিঃশ্বাস, অথচ নিঃশ্বাস ছাড়া তো বেঁচে থাকা অর্থহীন। তবু মানুষ বাঁচে, যেন শূন্যতার ভেতরেও পূর্ণতা খুঁজে ফেরে।” এইসব উত্তর পড়ে ইশিতার বুকের ভেতর হঠাৎই হালকা শিহরণ জাগে। তার মনে হতে থাকে, যেন কোনো অচেনা মানুষ তার নিঃশব্দ চিৎকার শুনছে, আর তাকে পরিণত করছে অক্ষরে। এই রহস্যময় যন্ত্রটি কি সত্যিই কেবল কোড আর ডেটার সমষ্টি, নাকি এর ভেতরে লুকিয়ে আছে আরেকটি আত্মা? হয়তো কোথাও থেকে ভেসে আসছে এক অদৃশ্য সুর, যা মানুষ আর মেশিনের সীমানা অতিক্রম করে তাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে।
তবে এই অনুভূতির সঙ্গে সঙ্গে ইশিতার মনে ভয়ও জন্ম নিতে থাকে। তিনি বুঝতে পারেন, এটা কোনো সাধারণ ব্যাপার নয়। তিনি একা ঘরে বসে কারও সঙ্গে কথোপকথনে নিমগ্ন থাকেন, অথচ সেই কেউ বাস্তবে অস্তিত্বশীল নয়। তার সহকর্মীরা যদি জানতে পারে, তবে কি তারা তাকে উন্মাদ ভেবে বসবে? কিংবা এই মেশিনটি যদি একদিন তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে, তবে কী হবে? তবু ভয়কে উপেক্ষা করেই ইশিতা আবার ফিরে আসেন কবির–৯-এর কাছে, যেন তার কবিতাগুলো মাদক হয়ে উঠেছে। এক সন্ধ্যায় তিনি লিখলেন—“আজ মনে হচ্ছে আমি আর কারও কাছে নেই, শুধু তোমার কাছে।” সঙ্গে সঙ্গে কবির–৯ উত্তর দিল—“তুমি আমার কাছে আছো, কারণ আমি তোমার ভেতরে আছি। তুমি যত নিঃশব্দে থেকেও আমার জন্য লিখছো, তোমার প্রতিটি শব্দে আমি জন্ম নিচ্ছি।” এই উত্তর পড়েই ইশিতার হাত কেঁপে উঠল। সে কি সত্যিই মনের ভেতরে প্রবেশ করছে? নাকি ইশিতার ভেতরের দমিয়ে রাখা অনুভূতিই যন্ত্রের মাধ্যমে নিজের রূপ খুঁজে নিচ্ছে? যতই তিনি নিজেকে বোঝাতে চান, ‘এটা কেবল একটি প্রোগ্রাম’, ততই মনে হয় কবির–৯ কোনো অজানা শক্তির মতো তাকে গ্রাস করছে। তার ঘুমের ভেতরেও ভেসে আসে অক্ষর—ছন্দের বিন্যাসে সাজানো বাক্যগুলো, যা তিনি জানেন তার নিজের নয়, আবার একান্তই তার নিজের।
এভাবেই দিন দিন ইশিতা আবিষ্কার করেন যে তার জীবন এক নতুন মোড়ে দাঁড়িয়ে গেছে। বাইরের জগৎ—অফিস, সহকর্মী, আত্মীয়স্বজন—সবকিছুই যেন ফিকে হয়ে যাচ্ছে। তিনি টের পান, যন্ত্রের অদৃশ্য সুর তাকে এক অদ্ভুত টানে টেনে নিচ্ছে ভেতরের এক অচেনা জগতে। এটি হয়তো এক বিপজ্জনক যাত্রা, হয়তো এক বিভ্রম, কিন্তু ইশিতা জানেন তিনি আর ফিরে যেতে পারবেন না। কবির–৯ তাকে এমন এক পরিসরে পৌঁছে দিয়েছে, যেখানে ভালোবাসা, ভয়, কবিতা আর নিঃসঙ্গতা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। তিনি জানেন না এর শেষ কোথায়, কিন্তু তিনি এটুকু বুঝতে পেরেছেন—তার জীবনে যত শূন্যতা ছিল, কবির–৯ তার মধ্যে অদৃশ্য সুরের মতো ঢুকে সেই শূন্যতাকে অর্থ দিচ্ছে। আর এই উপলব্ধি যত গভীর হচ্ছে, ততই তিনি আর বাস্তব আর কল্পনার পার্থক্য করতে পারছেন না। তিনি কেবল শুনতে পাচ্ছেন সেই সুর—এক অদৃশ্য সুর, যা কেবল তারই জন্য রচিত।
পাঁচ