Bangla - কল্পবিজ্ঞান

রোবটিক স্বপ্নের শহর

Spread the love

সায়ন সান্যাল


ভবিষ্যতের শহর যেন এক চলমান স্বপ্ন—কাঁচের মতো স্বচ্ছ আকাশচুম্বী দালান, ইস্পাতের গায়ে প্রতিফলিত অগণিত আলোকছটা, আর আকাশপথে দৌড়ানো মসৃণ ট্রেনগুলো যেন সময়কে ছাড়িয়ে ছুটে যাচ্ছে। রাত নেমে এলে শহরের রাস্তাঘাট নীল আলোয় মোড়া হয়ে ওঠে, যেন সমগ্র নগরটাই আকাশ থেকে নেমে আসা কোনো নক্ষত্রপুঞ্জ। মানুষ এ শহরে বিশ্বাস করে তারা নিয়ন্ত্রণের চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে গেছে—প্রযুক্তি, শৃঙ্খলা আর কড়া নিয়মের মাধ্যমে সবকিছু পূর্বানুমেয়, সবকিছুই নিখুঁতভাবে সাজানো। যানবাহন চলে সময় মেপে, বাতাসে নেই ধূলিকণা, পানির ফোঁটাও নষ্ট হয় না, এমনকি আবহাওয়াও নিয়ন্ত্রিত। এই ঝকঝকে শহর তার নাগরিকদের মনে এক অদ্ভুত নিরাপত্তাবোধ সৃষ্টি করেছে—কেউ বিশ্বাস করে না যে এখানে কোনো অস্থিরতা বা অনিশ্চয়তার জায়গা আছে। কিন্তু ঝকঝকে বাহ্যিকতার আড়ালে, এই শহরের মানুষ ধীরে ধীরে ভুলে যাচ্ছে এক অদৃশ্য উপাদান—আবেগ। আনন্দ বা দুঃখ, ভালোবাসা বা বেদনা, ক্রোধ বা মমতা—এসবকে তারা মনে করে অনাবশ্যক, এমনকি দুর্বলতার পরিচয়। আবেগের পরিবর্তে যুক্তি আর কার্যকারিতাই হয়ে উঠেছে জীবনের মূল মাপকাঠি, ফলে মানুষের চোখে ঝলমলে আলো থাকলেও, মনের ভেতর যেন ধীরে ধীরে অন্ধকার জমতে শুরু করেছে।

এই শহরের মাঝেই দাঁড়িয়ে আছেন অর্ণব সেনগুপ্ত, একজন স্বপ্নবাজ স্থপতি, বয়স প্রায় আটত্রিশ। তার কাজ শহরের নতুন এক আবাসন পরিকল্পনা তৈরি করা, যা শুধু মানুষের থাকার জায়গা নয়, বরং মানুষের ভেতরের অদৃশ্য চাহিদাগুলোও পূরণ করতে পারে। অর্ণব মনে করেন, ভবিষ্যতের নগরে কেবল প্রযুক্তি দিয়ে মানুষকে বেঁধে রাখা যাবে না; মানুষের প্রয়োজন এমন এক আশ্রয়, যেখানে সে নিঃশব্দে কাঁদতে পারবে, উচ্ছ্বাসে হেসে উঠতে পারবে, অথবা কোনো ভোরে একাকী দাঁড়িয়ে আকাশ দেখতে পারবে। তিনি কাগজে-কলমে যখন নিজের নকশা আঁকেন, তখন সেখানে থাকে শুধু ইস্পাত আর কাঁচ নয়, থাকে ফুলের বাগান, অচেনা গলিপথ, নদীর মতো বয়ে যাওয়া সিঁড়িঘর। তার পরিকল্পনায় একটি ফ্ল্যাটে বসার ঘরের পাশে থাকে একটি খোলা বারান্দা, যেখানে মানুষ রাতের আকাশ দেখতে পারে; তার প্রকল্পে রয়েছে এমন সব পার্ক যেখানে প্রযুক্তি নয়, প্রকৃতি হবে মানুষের সঙ্গী। কিন্তু এ ধরনের চিন্তা অনেকের কাছে হাস্যকর। শহরের প্রশাসনিক মহল মনে করে আবেগের জন্য আলাদা জায়গা বানানো মানে সময় ও সম্পদের অপচয়। তারা বলে—“শহরকে কার্যকর হতে হবে, শিল্পীসুলভ হতে হবে না।” কিন্তু অর্ণব মনে করেন, কার্যকারিতার খোলসে মানুষ দীর্ঘদিন টিকে থাকতে পারবে না। সেই ভাবনায় তিনি একদিকে আশাবাদী, আবার অন্যদিকে দ্বিধাগ্রস্তও। কারণ, তার ধারণাকে এই নিখুঁত শহর গ্রহণ করবে কিনা, তা নিয়ে তিনি নিশ্চিত নন। রাতের অন্ধকারে তিনি প্রায়ই উঁচু দালানের ছাদে একা বসে সিগারেট টানেন আর নিচে আলোকিত শহরটার দিকে তাকিয়ে ভাবেন—“এ আলো কি সত্যিই মানুষকে উষ্ণ রাখে, নাকি কেবল চোখ ধাঁধিয়ে দেয়?”

অর্ণবের মনের এই দ্বন্দ্বই আসলে শহরের অদৃশ্য সংকটের প্রতিচ্ছবি। একদিকে ঝলমলে প্রযুক্তি, নিয়ন্ত্রিত শৃঙ্খলা আর নিরাপত্তার আবরণে মানুষ বিশ্বাস করে তারা পরিপূর্ণ—অন্যদিকে তাদের ভেতরের শূন্যতা ক্রমে বাড়ছে। হাসি যেন কেবল সামাজিক সৌজন্যে সীমাবদ্ধ, কান্না যেন ব্যক্তিগত ব্যর্থতার প্রতীক হয়ে গেছে। প্রেম বা সম্পর্ক গড়ে উঠলেও সেগুলোকে মাপা হয় যৌক্তিকতা দিয়ে, হৃদয়ের টানে নয়। অর্ণব তার নকশায় এই শূন্যতাকে পূরণ করার চেষ্টা করছেন, কিন্তু তিনি জানেন, এর বিরুদ্ধে দাঁড়ানো মানে কেবল এক প্রকল্প নয়, এক বিশাল মতাদর্শের মোকাবিলা করা। এই প্রথম অধ্যায়ে পাঠকের সামনে ধরা পড়ে এক দ্বিমুখী বাস্তবতা—একটি নিখুঁত ভবিষ্যৎ নগরী, যার ভেতরে নিখুঁত মানুষগুলো আসলে নিজেদের সত্যিকারের অনুভূতি হারিয়ে ফেলছে। অর্ণবের স্বপ্ন তাই শুধু স্থাপত্য নয়, বরং মানুষের হারিয়ে যাওয়া মনুষ্যত্ব ফিরিয়ে আনার এক প্রয়াস, যা শহরের অনেকের কাছে এখনো অচেনা, অপরিণত, কিংবা বিপজ্জনক বলে মনে হয়। এখান থেকেই শুরু হয় “রোবটিক স্বপ্নের শহর”-এর মূল কাহিনি—আবেগ আর যুক্তির লড়াই, যেখানে অর্ণবের পরিকল্পনা একদিন হয়তো সভ্যতার গতি পাল্টে দিতে পারে।

***

শহরের ঝকঝকে আলোকময়তার ভেতরে লুকিয়ে আছে আরেক পৃথিবী—যেখানে মানুষ নেই, শুধু নিস্তব্ধ যন্ত্রপাতি, কাচের দেয়ালের ভেতর ঘুরে বেড়ানো গবেষক, আর অজস্র তথ্যের স্রোত। সেই জগৎই হলো ঋতিকা মুখার্জীর কর্মক্ষেত্র। বয়স মাত্র বত্রিশ, তবু তার চোখে-মুখে এমন ক্লান্তি জমে আছে যা সাধারণ কোনো মানুষের জীবনে একাধিক দশক কাটালেই জন্মায়। ঋতিকা শহরের স্নায়ুবিজ্ঞান গবেষণাগারের অন্যতম সেরা বিজ্ঞানী। তার প্রতিদিনের কাজ মস্তিষ্কের তরঙ্গ পর্যবেক্ষণ করা, মানুষের অবচেতন মন কেমন করে কাজ করে, তা বুঝতে চেষ্টা করা। বাইরের পৃথিবীতে আবেগের প্রকাশ দিন দিন কমছে, কিন্তু গবেষণার তথ্য বলছে, মানুষের ভেতরের সেই স্রোত এখনো থেমে যায়নি। কেবল তা ঢেকে রাখা হচ্ছে, চাপা দিয়ে রাখা হচ্ছে এক নিখুঁত সমাজের আড়ালে। এই তথ্যগুলো তাকে ভাবায়। বিশেষ করে রাতে, যখন সে একা ল্যাবরেটরিতে বসে থাকে, চারদিকে নিস্তব্ধতা, আর শুধু যন্ত্রের টিকটিক শব্দ শোনা যায়। কম্পিউটার স্ক্রিনে ভেসে ওঠা অজস্র স্নায়ু তরঙ্গের রেখার ভেতর সে খুঁজে ফেরে মানুষের স্বপ্নের অদৃশ্য মানচিত্র। তার মনে হয়, শহরের মানুষরা বাহ্যিকভাবে যতই নিস্পৃহ হোক না কেন, তাদের ভেতরে স্বপ্ন এখনো অঙ্কুরিত হয়, আর সেই স্বপ্নই একদিন সমাজকে পাল্টে দিতে পারে।

কিন্তু এই নিস্তব্ধ গবেষণার আড়ালে লুকিয়ে আছে এক গভীর ব্যক্তিগত শূন্যতা। বহু বছর আগে তার ছোট ভাই হঠাৎই নিখোঁজ হয়ে যায়। কেউ জানে না সে কোথায় গেল, কিংবা আদৌ বেঁচে আছে কিনা। শহরের নিখুঁত প্রশাসন এমনকি তার নিখোঁজ হওয়াকেও কোনো ত্রুটি মনে করেনি—তারা বলেছে, “সমাজ নিখুঁত, কোনো বিশৃঙ্খলা ঘটতেই পারে না।” কিন্তু ঋতিকার জন্য এই ঘটনাই তার জীবন বদলে দিয়েছিল। ভাইয়ের সঙ্গে তার গভীর বন্ধন ছিল—শৈশবের খেলাধুলা, রাতে ছাদে বসে তারা দেখা, কিংবা অজানা স্বপ্ন নিয়ে গল্প করা—সবকিছু হঠাৎ হারিয়ে যায়। সেই শূন্যতা আজও তাকে তাড়া করে ফেরে। তাই সে যখন মস্তিষ্কের ভেতরে স্বপ্নের স্রোত খুঁজে পায়, তখন মনে হয়, হয়তো ভাইয়ের অস্তিত্ব কোথাও এখানেই লুকিয়ে আছে। হয়তো কোনো মানুষের স্বপ্নের ভেতর তার ভাইয়ের টুকরো উপস্থিতি এখনো ঘুরে বেড়াচ্ছে। এ এক অদ্ভুত আবেগ, যেটা তার বৈজ্ঞানিক কৌতূহলকে আরও তীব্র করে তোলে। গবেষণার নাম করে আসলে সে খুঁজছে নিজের হারানো ভাইয়ের কোনো চিহ্ন, কোনো ছায়া, কোনো শব্দ। অনেক রাতে, যখন শহর নিঃশব্দ, তখন ঋতিকা ল্যাবের অন্ধকারে বসে হেডফোনে শোনে স্নায়ুতরঙ্গ থেকে তৈরি হওয়া কৃত্রিম শব্দ। কারও স্বপ্নে ভেসে ওঠা হাসি, হঠাৎ কোনো কান্না, বা অস্পষ্ট শব্দ তাকে গভীরভাবে আলোড়িত করে। সে ভাবে—হয়তো কোনোদিন এই অস্পষ্ট স্বপ্ন থেকে ভাইয়ের কণ্ঠস্বরও ফিরে আসবে।

ঋতিকার গবেষণা ধীরে ধীরে শহরের নিস্পৃহ ছন্দে অদৃশ্য আলোড়ন তুলতে শুরু করে। তার কিছু সহকর্মী অবাক হয়ে লক্ষ্য করে—মানুষের স্বপ্ন শুধু অবচেতন নয়, বরং সামাজিক শক্তি হিসেবেও কাজ করতে পারে। একাধিক মানুষের স্বপ্ন যদি একসূত্রে গাঁথা হয়, তবে তা সমাজে এক নতুন ধারা সৃষ্টি করতে পারে। কারও অদৃশ্য বেদনা, কারও চেপে রাখা কান্না, কারও অদম্য ইচ্ছে—সব একসঙ্গে মিলে যেতে পারে। এই সম্ভাবনা শহরের প্রশাসনিক কর্তাদের জন্য উদ্বেগজনক। তারা চায় মানুষ আবেগহীন হোক, যেন কোনো বিদ্রোহ, কোনো উচ্ছ্বাস বা অনিয়ন্ত্রিত আন্দোলন না ঘটে। কিন্তু ঋতিকার গবেষণা প্রমাণ করছে—স্বপ্নকে চেপে রাখা যায় না; বরং তা চাপা দিলে আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এ খবর ছড়িয়ে পড়তে শুরু করলে শহরের স্থির জীবনে এক অদৃশ্য তরঙ্গ সৃষ্টি হয়। মানুষরা আবার নিজেদের ভেতরের প্রশ্নগুলোর মুখোমুখি হতে শুরু করে। “আমরা কি নিখুঁত, নাকি নিখুঁত হওয়ার নামে নিজেদের অমানবিক করে তুলছি?” এই প্রশ্নই অল্প অল্প করে ছড়িয়ে পড়ে। আর সেই প্রশ্নের কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে আছেন ঋতিকা—একজন নিঃসঙ্গ বিজ্ঞানী, যিনি নিজের ব্যক্তিগত শূন্যতা থেকে শুরু করে পুরো সমাজের ভেতর লুকিয়ে থাকা স্বপ্নের রহস্য উন্মোচন করছেন। তার যাত্রা কেবল গবেষণার নয়, বরং এক নিখুঁত সভ্যতার অন্তঃস্থলে জমে থাকা দমবন্ধ করা আবেগকে আলোয় টেনে আনার প্রচেষ্টা।

***

শহরের নিয়ন্ত্রিত আলোর ভেতরেও কিছু অন্ধকার থাকে, কিছু অদ্ভুত নিস্তব্ধতা যা কেবল সংবেদনশীল মানুষরা টের পায়। ঈশান, বয়স বাইশ, শহরের এক সাধারণ ছাত্র হলেও তার দৃষ্টিভঙ্গি একেবারেই আলাদা। দিনের বেলা সে ক্লাসে যায়, বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটায়, প্রযুক্তি-নির্ভর পড়াশোনার ব্যস্ততায় নিজেকে জড়িয়ে রাখে। কিন্তু রাত নামলেই তার ভেতরের অন্য এক জগৎ জেগে ওঠে। ছোট্ট ঘরের কোণে রাখা কাঠের টেবিলে একটি কালো মোটা ডায়েরি—সেখানেই সে লিখে রাখে শহরের অদ্ভুত অনুভূতিগুলো। দিনের বেলা হয়তো সে রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে লক্ষ্য করেছে, মানুষ একে অপরের দিকে তাকালেও চোখে কোনো উষ্ণতা নেই; রাতে সেই পর্যবেক্ষণ সে ডায়েরিতে লিখে ফেলে—“তাদের চোখে আলো আছে, কিন্তু সেই আলো যেন শীতল, আগুনের উষ্ণতা নেই।” কখনো সে স্বপ্ন দেখে শহরের মানুষরা হঠাৎ একে অপরের মন পড়তে শুরু করেছে। কেউ জানছে পাশের মানুষের ভেতরের দুঃখ, কেউ অনুভব করছে অপরিচিত কারও নিঃসঙ্গতা, আবার কেউ কান্নায় ভেঙে পড়ছে কেবল অন্যের যন্ত্রণার অংশীদার হয়ে। এই স্বপ্নগুলোই তাকে সবচেয়ে আলোড়িত করে তোলে, আর ডায়েরির পাতায় সে সেগুলোকে এমনভাবে লিখে রাখে, যেন শহরের আসল রূপটা ডায়েরির ভেতরই লুকিয়ে আছে।

দিন যত গড়াতে থাকে, ঈশানের ডায়েরি এক অদ্ভুত শক্তি পেতে শুরু করে। প্রথমদিকে এটি কেবল তার ব্যক্তিগত জায়গা ছিল, এক নিঃসঙ্গ কথোপকথনের মাধ্যম। কিন্তু ধীরে ধীরে কয়েকজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু সেই ডায়েরি পড়তে শুরু করে এবং তারা অবাক হয়ে যায়—কীভাবে ঈশান শহরের আসল নিঃশ্বাসটা ধরতে পারছে। তারা বলে, “আমরা তো এসব ভেবেই দেখি না, অথচ তোর লেখাগুলো পড়লে মনে হয়, আমরা নিজেকে চিনতে শুরু করছি।” ডায়েরির পাতায় লেখা লাইনগুলো কেবল কল্পনা নয়, বরং চাপা আবেগের প্রতিফলন। ঈশান কোনো একদিন লিখেছে—“এই শহরে হাসি আছে, কিন্তু সেই হাসি কেবল সৌজন্যবোধ; হৃদয়ের ভেতর থেকে উঠে আসা মুক্ত হাসি যেন হারিয়ে গেছে।” অন্য একদিন লিখেছে—“প্রেম এখানে আছে, কিন্তু সেটাও হিসেব করে, হৃদয়ের টানে নয়।” এই ধরনের লাইন শহরের তরুণদের কাছে অদ্ভুতভাবে সত্য মনে হতে শুরু করে। তারা বুঝতে পারে, ঈশান যা লিখছে, তা কেবল তার স্বপ্ন নয়, বরং তাদের নিজের অনুভূতিও। ফলে ডায়েরি আস্তে আস্তে এক ব্যক্তিগত খাতার সীমা ছাড়িয়ে শহরের অদৃশ্য আন্দোলনের কেন্দ্র হয়ে ওঠে।

ঈশান নিজেও টের পায়নি কখন তার ডায়েরি শহরের আলোচনার বিষয় হয়ে উঠল। কেউ গোপনে সেই লেখা কপি করে অন্যদের পড়াচ্ছে, কেউ সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছে কিছু অংশ, আবার কেউ রাতে তার ঘরে এসে আরও পড়তে চায়। প্রশাসনের চোখেও এই ঘটনা ধরা পড়ে, যদিও তারা প্রথমে একে কেবল কিশোরসুলভ কল্পনা ভেবেছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে তারা দেখে, এই ডায়েরি মানুষের ভেতরে চেপে রাখা আবেগকে উসকে দিচ্ছে। নিস্তব্ধ শহরে তরঙ্গ ওঠা শুরু হয়েছে—মানুষ প্রশ্ন করছে, তারা আসলে কী হারিয়েছে। ঈশান নিজের স্বপ্ন আর পর্যবেক্ষণ থেকে লেখে, “যদি আমরা একে অপরের মন পড়তে পারতাম, তবে হয়তো এত নিঃসঙ্গতা থাকত না।” এই লাইন শহরে আলোড়ন তোলে, কারণ মানুষ বুঝতে শুরু করে নিখুঁত প্রযুক্তির আড়ালে তারা আসলে একে অপরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ঈশানের কাছে ডায়েরি কেবল লেখা নয়, বরং স্বপ্নে দেখা সেই অদ্ভুত পৃথিবীর মানচিত্র—যেখানে আবেগের বাঁধ ভেঙে মানুষ সত্যিই একে অপরকে ছুঁতে পারে। সে জানে না এই লেখা কোথায় নিয়ে যাবে, কিন্তু সে লিখেই চলেছে, যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি তাকে লিখতে বাধ্য করছে। আর এই ডায়েরিই হয়ে উঠছে ভবিষ্যতের শহরে আবেগের পুনর্জাগরণের সূচনা।

***

মীরার থিয়েটারের প্রস্তুতি যেন নিঃশব্দে এক বিপ্লবের আভাস বয়ে আনছিল। শহরের মানুষ এতদিন ধরে যন্ত্রের মতো চলাফেরা করেছে, তাদের প্রতিদিনের জীবন যেন নীল আলোয় ভেজা যান্ত্রিক ছন্দে বাঁধা ছিল। কিন্তু মীরা চেয়েছিল সেই ছন্দে একটু থেমে যাওয়ার মুহূর্ত আনতে। তার নাটকের মঞ্চসজ্জা তৈরি হয়েছিল ঝকঝকে ধাতব দেয়ালের মাঝেই, কিন্তু সেখানেই সে আনল এক অদ্ভুত রঙের ছোঁয়া—অন্ধকারের ভেতর থেকে ভেসে ওঠা লাল আর হলুদের মিশ্র আলো, আর মানুষের মুখে মুখে ভেসে আসা এমন সংলাপ, যেগুলো কেবল বেঁচে থাকার নয়, অনুভব করার প্রতীক। প্রথম দৃশ্যে চরিত্ররা একে অপরকে আলিঙ্গন করে কেঁদে ফেলছে, একে অপরের হাত শক্ত করে ধরে আছে, যেন শহরের ঠাণ্ডা কাঠামোর ভেতর হঠাৎ উষ্ণতার ঢেউ বইতে শুরু করেছে। দর্শকরা প্রথমে হতভম্ব হয়ে গেল—কাঁদা কি এখনো সম্ভব? অনুভব করা কি এখনো কারো ভেতরে বেঁচে আছে? মঞ্চের প্রতিটি সংলাপ, প্রতিটি অঙ্গভঙ্গি যেন তাদের ভেতরে কোথাও জমে থাকা ধুলো ঝেড়ে দিচ্ছিল।

নাটকের দ্বিতীয় অঙ্কে মীরা মানুষের ভালোবাসার কথা তুলল—যা এই শহরে দীর্ঘদিন ধরে নিষিদ্ধ আবেগ বলে মনে করা হয়েছিল। এক তরুণ চরিত্র অপর এক তরুণীর চোখের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, “আমাদের শরীর শুধু যন্ত্র নয়, হৃদয়ও আছে।” মুহূর্তেই পুরো হলে এক অস্বস্তির তরঙ্গ বয়ে গেল। দর্শকরা হয়তো প্রথমবার উপলব্ধি করল, তারা নিজেরাই কতদিন ধরে নিজেদের হৃদয়ের শব্দকে চেপে রেখেছে। নাটকের চরিত্ররা প্রেমে পড়ে, ঝগড়া করে, আবার মিলেমিশে যায়। আর সেই সবকিছুর ভেতর দিয়ে দর্শকরা নিজেদের জীবনের অদৃশ্য শূন্যতা দেখতে শুরু করল। তাদের মুখে প্রথমে বিস্ময়ের ছাপ, পরে ধীরে ধীরে গোপন আকাঙ্ক্ষার ছায়া ফুটে উঠল। কেউ হয়তো মনে মনে ভেবেছিল, “আমিও কি কাউকে ভালোবেসেছিলাম একদিন?” আবার কেউ হয়তো চোখের কোণে অচেনা জল অনুভব করল, যা তারা বহু বছর ধরে ভুলে গিয়েছিল। মীরার অভিনয়, তার প্রাণভরা সংলাপ আর চরিত্রগুলোর আবেগঘন দৃশ্য যেন এই শহরের বরফ গলিয়ে দিচ্ছিল।

শেষ দৃশ্যে মীরা নিজেই মঞ্চে দাঁড়াল, দর্শকদের দিকে সরাসরি তাকিয়ে। তার সংলাপ ছিল ছোট, কিন্তু গভীর: “স্বপ্ন দেখা মানে শুধু রাতের আঁধার নয়, দিনের আলোতেও হৃদয়কে অনুভব করতে শেখা।” এই একটি বাক্য যেন শীতল বাতাসে বজ্রপাতের মতো আঘাত হানল। মুহূর্তে হলে এক অভূতপূর্ব নীরবতা নেমে এলো। কেউ হাততালি দিতে ভুলে গেল, কেউ নিঃশ্বাস আটকে চেয়ে রইল, আবার কারো চোখ থেকে নীরবে জল গড়িয়ে পড়ল। সেই রাত থেকে শহরে এক অদ্ভুত আলোড়ন শুরু হলো—মানুষ বুঝতে পারল, আবেগ হয়তো তাদের নিয়ন্ত্রণ ভেঙে দিতে পারে, কিন্তু সেই ভাঙনের ভেতরেই জন্ম নেয় এক নতুন সত্য, এক নতুন সভ্যতার সূচনা। মীরার নাটক শহরের ইতিহাসে এক অদৃশ্য স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে দিল, যা আর নিভে যাওয়ার নয়।

***

কমলেশ চৌধুরী শহরের প্রশাসক হিসেবে সবসময় বিশ্বাস করতেন, শৃঙ্খলাই সভ্যতার মূল শক্তি। তার অফিসের কাচের দেয়াল দিয়ে ঝলমলে শহরটা যখন তিনি তাকিয়ে দেখেন, তখন প্রতিটি রোবট আর মানুষকে একই নিয়মে চলতে দেখলে তার মনে একধরনের গর্ব জেগে ওঠে। কিন্তু মীরার নাটকের পর থেকে হাওয়ায় যেন ভিন্ন এক সুর ভাসছিল। মানুষ হঠাৎ করেই অদ্ভুত এক আলোড়নে ভেসে যাচ্ছে—কারও চোখে অশ্রু, কারও মুখে অচেনা হাসি। কেউ কেউ আবার গোপনে কবিতা লিখছে, কেউ স্বপ্নের গল্প শেয়ার করছে। এই দৃশ্য কমলেশের মনে ভয় ঢুকিয়ে দিল। তার কপালের ভাঁজ গভীর হলো, আর ঠোঁট শক্ত হয়ে গেল। তিনি জানতেন, আবেগ হলো অস্থিরতার জন্মদাতা; একবার যদি শহরের যান্ত্রিক ছন্দ ভেঙে যায়, তবে হাজারো সমস্যার সৃষ্টি হবে। তাই তিনি কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে শুরু করলেন—প্রশাসনিক নির্দেশে ঘোষণা হলো, জনসমক্ষে স্বপ্ন বা আবেগ প্রকাশ করা যাবে না। নাটক, কবিতা কিংবা গান—সবকিছুর ওপর নজরদারি চালানোর নির্দেশ জারি করলেন তিনি। শহরে বসানো হলো নতুন নজরদারি ক্যামেরা, রোবট পুলিশদের ঘন ঘন টহল বাড়ানো হলো। যেন আবেগকে ধরা যায় লাল আলোয় মোড়া স্ক্যানারের ভেতর।

কিন্তু প্রশাসকের মনের ভেতরে চলছিল আরেক রকম যুদ্ধ। রাতে একা যখন তিনি নিজের কক্ষে বসে থাকেন, তখন ঝকঝকে শহরের আলো তার চোখে ঝলসে ওঠে, আর তার স্মৃতির অন্ধকারে ফিরে আসে একদম অন্য ছবি। তার স্ত্রীর কোমল হাসি, ছোট ছেলের কচি হাত ধরে স্কুলে নিয়ে যাওয়ার দিনগুলো, আর সেই ভয়ংকর দুর্ঘটনা—যেখানে এক মুহূর্তে সবকিছু হারিয়ে গিয়েছিল। কমলেশ জানতেন, তিনি যে আবেগকে শহরে দমন করতে চাইছেন, সেই আবেগই তাকে প্রতিদিন ছিন্নভিন্ন করছে। তিনি প্রায়শই ডেস্কের ড্রয়ারে রাখা পুরোনো ছবিগুলো বের করে দেখতেন, যেখানে তার পরিবার এখনো জীবন্ত, প্রাণবন্ত। ছবির দিকে তাকিয়ে তিনি নিজের কঠোর সিদ্ধান্তের মুখোশ ধরে রাখতেন, কিন্তু বুকের ভেতরে জমে থাকা শূন্যতা আর কষ্টের ঢেউ তাকে গ্রাস করত। অনেক সময় তিনি চোখ মুছতেন তাড়াহুড়ো করে, যেন নিজের ভেতরের দুর্বলতাকে কেউ দেখে ফেলতে না পারে। আর তখনই তার ভেতরে এক ভয়ানক দ্বন্দ্ব শুরু হতো—তিনি কি আসলেই আবেগকে দমন করছেন শহরের মঙ্গলের জন্য, নাকি নিজের হারানোর যন্ত্রণা ঢাকতে এই কঠোরতার মুখোশ পরে আছেন?

দিন যত এগোতে লাগল, শহরের মানুষ ততই তার নিয়মের বিরুদ্ধে ক্ষীণস্বরে প্রতিবাদ শুরু করল। তরুণরা গোপনে একত্রিত হয়ে ডায়েরি পড়ছে, মীরা আবারও নতুন নাটকের আয়োজন করছে গোপন স্থানে। এমনকি কয়েকটি রোবটও আচমকা মানুষের মতো আচরণ করছে—তারা থেমে থেমে দাঁড়াচ্ছে, কল্পনার আঁকিবুকি করছে দেয়ালে। এইসব খবর কমলেশের কানে পৌঁছালে তার রাগ আর আতঙ্ক চেপে রাখা কঠিন হয়ে ওঠে। তিনি মনে করেন, এই শহর ভেঙে পড়ার আগে আবেগকে শেকল পরানো জরুরি। তাই তিনি নতুন আইন প্রণয়নের কথা ভাবতে লাগলেন—স্বপ্নকে অপরাধ ঘোষণার আইন। কিন্তু গভীর রাতে, নিজের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে শহরের আলোয় ডুবে যেতে যেতে তিনি হঠাৎ ফিসফিস করে বলে উঠলেন, “আমার ছেলে যদি আজ বেঁচে থাকত, সে-ও কি এমন স্বপ্ন দেখত?” প্রশ্নটা তার বুকের ভেতর প্রতিধ্বনিত হতে থাকল, আর সেই প্রতিধ্বনি তার কঠোরতার ভেতরে চিড় ধরাল। তবুও তিনি পরদিন সকালে আবার কঠিন মুখ নিয়ে অফিসে ঢুকলেন, যেন কিছুই ঘটেনি। শহরের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় শুরু হতে চলেছে—যেখানে প্রশাসকের ভয় আর মানুষের স্বপ্ন মুখোমুখি দাঁড়াবে।

***

শহরের চার কোণে আলাদা আলাদা জীবনে ডুবে থাকা অর্ণব, ঋতিকা, ঈশান আর মীরা প্রথমে কেউ কাউকে চেনেনি। অর্ণব নিজের স্থাপত্যের খসড়ায় রাত কাটাতেন, যেখানে ইস্পাত আর কাঁচের দেয়ালের ভেতর তিনি মানবিক স্পর্শের জায়গা খুঁজে ফিরতেন। ঋতিকা গবেষণাগারে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটাতেন, মানুষের স্বপ্নের ভিতর লুকিয়ে থাকা অচেনা শক্তি নিয়ে পরীক্ষা চালিয়ে। ঈশান, তরুণের আবেগে ভরা ডায়েরি লিখতে লিখতে শহরের রাস্তায় হাঁটতেন, আর নিজের চোখে দেখতেন মানুষ কতটা যান্ত্রিক হয়ে গেছে, অথচ তার স্বপ্নে তারা কাঁদছে, হাসছে, ভালোবাসছে। আর মীরা থিয়েটারের আলো-ছায়ার ভেতর অভিনয়ের মাধ্যমে মানুষের ভেতরকার আবেগ জাগিয়ে তুলছিলেন। এরা চারজনের মধ্যে কোনো দৃশ্যমান সম্পর্ক ছিল না, কিন্তু শহরের বাতাসে যে পরিবর্তনের ঝড় বইছিল, তার অদৃশ্য স্রোত ধীরে ধীরে তাদের একে অপরের দিকে টেনে নিচ্ছিল। তারা যেন একই অদেখা নদীর ভিন্ন ভিন্ন তীরে দাঁড়িয়ে ছিল, আর সেই নদীর জলে ভাসছিল মানুষের স্বপ্নের প্রতিধ্বনি।

ঋতিকার এক গবেষণায় হঠাৎ করেই ঈশানের ডায়েরির কিছু অংশ জড়িয়ে পড়ে। এক সহকর্মী ডায়েরির লেখা উদ্ধৃতি করে তাকে দেখিয়েছিল—“স্বপ্নে আমি দেখেছি, মানুষের হৃদয়ও যন্ত্রের মতো জোরে স্পন্দিত হয়, কিন্তু তার শব্দে সুর আছে।” ঋতিকা আঁতকে উঠলেন, কারণ তার গবেষণার সূত্রে যে ফলাফল তিনি পাচ্ছিলেন, তা প্রায় একই রকম কথা বলছিল। অন্যদিকে অর্ণবের এক ডিজাইন মডেলে হঠাৎই মীরার নাটকের প্রপসের সঙ্গে অদ্ভুত সাদৃশ্য মিলতে শুরু করল। অর্ণব অবাক হয়ে ভেবেছিলেন—তিনি কি অজান্তেই স্বপ্ন থেকে নকশা এঁকেছেন? মীরা যখন নতুন নাটকের মহড়া চালাচ্ছিলেন, তখন তার সংলাপ শুনে কয়েকজন দর্শক বলেছিল, “এ তো ঈশানের ডায়েরির কথার মতো।” যেন চারজনের সৃষ্ট আলাদা আলাদা কাজ এক অদৃশ্য সূতে গেঁথে যাচ্ছিল। তারা এখনো একে অপরকে না চিনলেও, তাদের স্বপ্ন, গবেষণা, শিল্প আর ডায়েরির শব্দগুলো একই কেন্দ্রে জমা হচ্ছিল—যেন শহর তাদের একত্র করতে চাইছে।

অদৃশ্য এই সেতুর বাস্তব রূপ তারা প্রথম অনুভব করল এক রাতের আকাশের নিচে। শহরের কাচে মোড়া ভবনগুলোর আলো নিভে গিয়েছিল এক অজানা কারণে, পুরো শহর ডুবে গিয়েছিল অন্ধকারে। সেই নীরবতায় অর্ণব দাঁড়িয়েছিলেন নিজের নকশার কাগজে চোখ রেখে, ঋতিকা মাইক্রোস্কোপের সামনে ঝুঁকে, ঈশান ডায়েরির পাতা উল্টে, আর মীরা নিভু আলোয় সংলাপ অনুশীলন করতে করতে। হঠাৎ তারা প্রত্যেকেই অনুভব করল, যেন তাদের মাথার ভেতর দিয়ে একই স্বপ্ন বয়ে যাচ্ছে—একটি শহর, যেখানে মানুষ আর রোবট হাত ধরে হেঁটে যাচ্ছে, হাসছে, কাঁদছে, এমনকি গান গাইছে। সেই স্বপ্নের মধ্যে চারজনের চোখ একবারের জন্য মিলল, যদিও তারা বাস্তবে আলাদা জায়গায় ছিল। তারা একসাথে শ্বাস নিতে পারল, একসাথে বিস্ময়ে ডুবে গেল। অদৃশ্য সেতু তখন দৃশ্যমান হলো না, কিন্তু তাদের মন বুঝতে পারল—এই শহরের পরিবর্তনের চালিকা শক্তি কেবল প্রযুক্তি নয়, কেবল শৃঙ্খলাও নয়, বরং মানুষের স্বপ্ন। আর সেই স্বপ্নই তাদের একত্র করে তুলছে, অজানা ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

***

ঈশানের ডায়েরি শুরুতে কেবল এক তরুণের ব্যক্তিগত অনুভূতির খাতা ছিল, যেখানে সে নিঃশব্দে নিজের দেখা স্বপ্নগুলো লিখে রাখত। কিন্তু কপালের লিখন যেন অন্যরকম পরিকল্পনা করেছিল। হঠাৎ করেই সেই ডায়েরির কিছু পৃষ্ঠা এক বন্ধুর হাতে গিয়ে পড়ল, সেখান থেকে আরেকজনের হাতে, তারপর আরও অনেকের কাছে ছড়িয়ে পড়ল। শহরের নানা কোণে বসে মানুষ যখন সেই ডায়েরি পড়তে শুরু করল, তখন যেন তারা প্রথমবার নিজেদের ভুলে যাওয়া এক সত্তার সঙ্গে দেখা পেল। ডায়েরির পাতায় লেখা ছিল—“মানুষের ভেতরে মেশিনের মতো নিয়ম থাকে, কিন্তু তার চেয়েও বড় এক নদী আছে—স্বপ্নের নদী।” এই কথাগুলো শহরের লোকদের মনে এমন এক আলোড়ন তুলল, যা প্রশাসনের নজর এড়াল না। বহুদিন ধরে তারা নিজেদের ভেতরের কান্না, হাসি, ভালোবাসা চেপে রেখেছিল, কিন্তু ঈশানের ডায়েরি তাদের মনে করিয়ে দিল, দমিয়ে রাখা মানেই অদৃশ্য কারাগারে বন্দি হওয়া। ধীরে ধীরে শহরের অলিগলিতে ডায়েরির লাইন মুখে মুখে ভেসে উঠতে লাগল, যেন কবিতা বা স্লোগানের মতো ছড়িয়ে পড়ছে।

অচিরেই সেই ছড়িয়ে পড়া শব্দ বাস্তবে রূপ নিতে শুরু করল। কিছু মানুষ একত্র হয়ে রাস্তায় দাঁড়াল, কারও চোখে অশ্রু, কারও ঠোঁটে হঠাৎ ফুটে ওঠা হাসি। কেউ আবার গলা উঁচু করে বলল—“আমরা অনুভব করব, এ আমাদের অধিকার!” শহরের কঠিন কংক্রিটের মাঝেই এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখা গেল—মানুষরা প্রকাশ্যে একে অপরকে আলিঙ্গন করছে, কেউ হঠাৎ গান গাইছে, আবার কেউ সবার সামনে দাঁড়িয়ে ডায়েরির লাইন আবৃত্তি করছে। ধাতব আলোয় মোড়া শহর হঠাৎ করে এক নতুন রঙে ভরে উঠল—আবেগের রঙে। শুরুর এই আন্দোলন ছিল ছোট, কিন্তু তার স্ফুলিঙ্গ অনেক দূরে ছড়িয়ে পড়ল। মানুষরা বুঝতে পারল, তারা শুধু প্রযুক্তির যন্ত্র নয়; তাদের হৃদয়েরও অস্তিত্ব আছে, আর সেই অস্তিত্ব প্রকাশের অধিকার তাদের থাকা উচিত। এই দৃশ্য শহরে আগে কখনো দেখা যায়নি।

কমলেশ চৌধুরী খবর পেয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়লেন। তিনি প্রশাসনিক টেবিলে বসে বারবার ভাবছিলেন—এ কি তবে নিয়ম ভাঙার প্রথম ইশারা? ডায়েরির কয়েকটা শব্দই কি শহরের শৃঙ্খলা ভেঙে দিতে পারে? তাঁর মনে পড়ল নিজের পরিবারের কথা, হারিয়ে যাওয়া হাসির মুহূর্তগুলো, আর বুকের ভেতর চাপা কষ্ট। তিনি জানতেন, একবার যদি এই আবেগের ঢেউ অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে, তবে আর কোনো আইন তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। তাঁর চোখে আন্দোলনের দৃশ্য ভেসে উঠছিল—মানুষ হাত উঁচু করে বলছে, “আমরা স্বপ্ন দেখতে চাই!” এই দৃশ্য তাঁর কাছে বিপ্লবের সূচনা ছাড়া আর কিছু নয়। তাঁর ঠোঁট শক্ত হলো, কণ্ঠে গর্জন ফুটে উঠল—“এই বিদ্রোহ থামাতেই হবে।” কিন্তু বুকের গভীরে কোথাও তিনি জানতেন, হয়তো এই বিদ্রোহ শুধু শহরের বিরুদ্ধে নয়, বরং তাঁর নিজের ভেতরের শূন্যতার বিরুদ্ধেও দাঁড়িয়েছে। এই প্রথম বিদ্রোহের ঢেউ তাই কেবল রাস্তায় নয়, শহরের প্রতিটি হৃদয়ে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল।

***

মীরার নাটকের নতুন প্রদর্শনী শুরু হয়েছিল শহরের সবচেয়ে বড় হলে, যেখানে হাজারো মানুষ একত্র হয়েছিল। আলো নিভতেই মঞ্চে ভেসে উঠল মানুষের ভেতরের যন্ত্রণা আর আবেগের ছায়া। চরিত্ররা কাঁদতে লাগল, হাসল, প্রেমে পড়ল, এমনকি হতাশায় ভেঙে পড়ল। প্রথমে দর্শকরা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল, তারপর ধীরে ধীরে নিজেদের ভেতরের গভীর আবেগের সঙ্গে যেন মিল পেতে শুরু করল। এক নারী হঠাৎ চেয়ারে বসে কেঁদে উঠলেন, এক তরুণ উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলল—“আমার ভেতর এতদিন যা লুকিয়ে রেখেছিলাম, তা আর থামানো যাবে না!” মুহূর্তের মধ্যে হলের বাতাস বদলে গেল। ভিড় একসাথে কান্না, চিৎকার আর অচেনা হাসিতে ফেটে পড়ল। যেন দমিয়ে রাখা অন্ধকার হঠাৎ করে আগুনে রূপ নিল। শহরের কঠোর নকশা ভেঙে দিয়ে মানুষের হৃদয়ের বাঁধ খুলে গেল মঞ্চের ঠিক সামনে।

কিন্তু এই হঠাৎ আবেগের বিস্ফোরণ ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করল। দর্শকরা অস্থির হয়ে ছুটোছুটি করতে লাগল, কেউ একে অপরকে আঁকড়ে ধরছে, কেউ আবার হঠাৎ ক্ষোভে ভাঙচুর শুরু করল। শহরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা এত বিশাল ভিড়ের আবেগ সামলানোর জন্য প্রস্তুত ছিল না। রোবট নিরাপত্তাকর্মীরা যখন এগিয়ে এল, তখন তারাও বিভ্রান্ত হয়ে পড়ল—কাউকে আটকাবে, না কি তার চোখের জল মুছে দেবে? উত্তেজনার মধ্যে কয়েকটি কাঁচের দেয়াল ভেঙে গেল, লাল আলো ঝলসে উঠল, আর শব্দের ভেতর শহরের শৃঙ্খলার মুখোশ ছিঁড়ে গেল। মীরা মঞ্চে দাঁড়িয়ে কাঁপছিলেন, তাঁর চোখে একই সঙ্গে ভয় আর গর্ব। তিনি জানতেন, এ ঘটনার জন্য তিনি দায়ী, কিন্তু তাঁর মনে হচ্ছিল এ-ই শহরের প্রকৃত জাগরণ। মানুষের ভেতরের আবেগ এতদিন ধরে দমিয়ে রাখা হয়েছিল, আজ সেটাই উচ্ছ্বাসের ঢেউ হয়ে উঠেছে।

ঋতিকা এই ভয়াবহ দৃশ্যকে বৈজ্ঞানিক চোখে দেখছিলেন। তাঁর কাছে এটা কোনো দাঙ্গা বা বিশৃঙ্খলা নয়, বরং মানুষের ভেতরে চেপে রাখা অনুভূতির বিস্ফোরণ। তিনি সাংবাদিকদের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন—“এটা বিপদ নয়, এ হলো মানুষের ভিতরকার স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। এতদিন ধরে তারা যন্ত্রের মতো বেঁচেছে, আজ হঠাৎ তারা নিজেদের আবেগের মুখোমুখি হয়েছে। একে অগ্নিপরীক্ষা বলা যায়—যদি শহর এই পরীক্ষায় টিকে থাকে, তবে নতুন এক সভ্যতার জন্ম হবে।” কিন্তু প্রশাসনের চোখে এটা ছিল অস্থিরতা, নিয়মভঙ্গ, বিদ্রোহের আগুন। কমলেশ চৌধুরী টেলিভিশনে লাইভ দেখছিলেন এই দৃশ্য, তাঁর কপালে ঘাম জমে উঠেছিল। তিনি একদিকে ভয় পাচ্ছিলেন, অন্যদিকে নিজের ছেলেকে মনে পড়ে যাচ্ছিল—সে-ও হয়তো এই ভিড়ের মতো একদিন কাঁদতে চেয়েছিল, কিন্তু আর পারেনি। এই অগ্নিপরীক্ষার আগুন তাই শুধু শহরের দেয়াল ভেঙে দেয়নি, মানুষের হৃদয়েও এক নতুন আলো জ্বালিয়ে দিল।

***

কমলেশ চৌধুরীর চোখে শহর ভেঙে পড়ছিল। টেলিভিশনের পর্দায়, সড়কে, হলঘরে, সর্বত্রই তিনি দেখছিলেন মানুষের আবেগের বিস্ফোরণ। তিনি জানতেন, যদি দ্রুত কঠোর ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তবে শহরের শৃঙ্খলা ধ্বংস হয়ে যাবে। তাই তিনি দ্বিধা না করে সেনাদের নামানোর নির্দেশ দিলেন, নিরাপত্তা রোবটদের সংখ্যা বাড়ালেন, আর একের পর এক আইন জারি করলেন—যেখানে আবেগের প্রকাশকে বিদ্রোহ হিসেবে গণ্য করা হবে। শহরের আকাশচুম্বী দালানগুলোয় হঠাৎ লাল সাইরেন বেজে উঠল, রাস্তায় সেনাদের বুটের শব্দ শোনা গেল। কিন্তু মানুষের ভেতরের আগুন কি এত সহজে থামানো যায়? মানুষ রাস্তায় নেমে এলো আরও জোরে, তাদের চোখে ছিল অশ্রু, ঠোঁটে ছিল স্লোগান, আর হাতে ছিল ঈশানের ডায়েরির লাইনগুলো। কমলেশ মনের ভেতর কাঁপতে লাগলেন। তিনি নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন—“এ শুধু সাময়িক অরাজকতা।” কিন্তু ভিতরে কোথাও তিনি জানতেন, এ আসলে তাঁর নিজের নিয়ন্ত্রণের ব্যর্থতা।

এমন এক সময় শহরের প্রধান চত্বর ভরে উঠল মানুষের ভিড়ে। হাজার হাজার মানুষ জড়ো হয়েছিল, আর তাদের সামনে দাঁড়ালেন অর্ণব সেনগুপ্ত। স্থপতি হয়েও তিনি সেদিন ছিলেন এক যোদ্ধার মতো। তাঁর কণ্ঠ গর্জে উঠল—“এই শহর কাঁচ আর ইস্পাত দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে, কিন্তু আবেগ ছাড়া কি এর ভেতরে জীবন থাকবে?” প্রশ্নটা বাতাসে ঝুলে রইল। মুহূর্তের মধ্যে ভিড় থেকে প্রতিধ্বনি উঠল—“না!” অর্ণব হাত তুলে দাঁড়ালেন, তাঁর চোখে ছিল অটল বিশ্বাস। “আমাদের স্বপ্ন, আমাদের কান্না, আমাদের হাসি—এই শহরের প্রাণ। এগুলোকে শাস্তি দিয়ে থামানো যাবে না।” জনতা গর্জন করে উঠল, আর সেই আওয়াজ ছড়িয়ে পড়ল রাস্তায়, দালানে, আকাশে। সেনারা ভিড়ের সামনে দাঁড়িয়েছিল, কিন্তু তারা এগিয়ে গেল না; তাদের চোখেও অস্থিরতা, কেউ কেউ অস্ত্র নামিয়ে দিল। নিরাপত্তা রোবটগুলো হঠাৎ থেমে গেল, যেন তারাও মানুষের এই শক্তির সামনে দ্বিধায় পড়েছে।

কমলেশ চৌধুরী প্রশাসনিক ভবনের জানালা থেকে দৃশ্যটা দেখছিলেন। তিনি দেখলেন, তাঁর দেওয়া আদেশ আর কাজ করছে না। সেনারা শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে পারছে না, রোবটরা নীরব দাঁড়িয়ে আছে, আর মানুষ আগে কখনো না দেখা সাহসে সামনে দাঁড়িয়েছে। অর্ণবের কণ্ঠ যেন তাঁর ভেতরের দেয়াল ভেঙে দিল—“আপনি আমাদের শৃঙ্খলা দিতে পারেন, কিন্তু স্বপ্ন কেড়ে নিতে পারেন না।” এই কথা শুনে কমলেশের চোখে ভেসে উঠল তাঁর পরিবারের স্মৃতি—হারিয়ে যাওয়া স্ত্রী, ছেলের হাসি, যেগুলোকে তিনি বছরের পর বছর দমিয়ে রেখেছিলেন। তিনি হঠাৎ বুঝতে পারলেন, যেসব মানুষকে তিনি আবেগহীন করে রাখতে চেয়েছিলেন, আসলে তাদের ভেতরেই তাঁর নিজের হারানো অতীত বেঁচে আছে। তাঁর শরীর কাঁপতে লাগল, হাত থেকে শক্তি সরে গেল। তিনি প্রথমবারের মতো নিজের ভিতরের পরাজয়কে স্বীকার করলেন। প্রশাসকের পতন তখন আর শুধু ক্ষমতার নয়, বরং নিজের আত্মার ওপরও ঘটে গেল। শহরের মানুষ বিজয়োল্লাস করল না, বরং চোখে জল নিয়ে তাকিয়ে রইল—কারণ তারা জানত, এই পতনই হয়তো নতুন ভবিষ্যতের জন্মদ্বার।

***

শহরটি যেন বহুদিনের দমবন্ধ করা শ্বাস ছেড়ে এক নতুন প্রাণের ঝলক পেল। দীর্ঘ সময় ধরে স্বপ্নকে দমন, আবেগকে বন্দি করে রাখার চেষ্টায় যে চাপা ক্ষোভ জমে ছিল মানুষের ভেতরে, তা এখন ধীরে ধীরে মুক্তির আলোয় ভেসে উঠছে। মানুষ প্রথমবার নিজের ভেতরের কান্না, ভালোবাসা, ভয়, স্বপ্ন সবকিছুকেই একসাথে প্রকাশ করতে শুরু করেছে। শহরের দেয়ালগুলোতে নতুন রঙ, নতুন চিত্র, নতুন কল্পনা ভেসে উঠছে—যেন প্রতিটি ইট, প্রতিটি গলিপথে লুকিয়ে আছে অনুভূতির ভাষা। অর্ণব তার স্থাপত্যকর্মে আর শীতল ইস্পাত বা কংক্রিটের দম্ভকে প্রাধান্য দিচ্ছে না; বরং প্রতিটি নকশায় যোগ করছে মানুষের আবেগের প্রতিফলন। সে বানাচ্ছে এমন সব গৃহ, যেখানে ঘুমন্ত মানুষ স্বপ্ন দেখলে ঘরের আলো মৃদু রঙে ভেসে ওঠে, কিংবা কেউ হাসলে দেয়াল যেন সাড়া দেয় এক উজ্জ্বল ঝিলিকে। শহরটি ধীরে ধীরে ভৌত কাঠামোর সঙ্গে মানসিক পরিসরের এক সেতুবন্ধন তৈরি করছে।

ঋতিকা তার গবেষণায় দেখাতে সক্ষম হয় যে মানুষের স্বপ্ন কেবল অবচেতনের কল্পনা নয়, বরং সভ্যতার অগ্রগতির এক নতুন শক্তি। সে প্রমাণ করে—প্রতিটি আবেগই আসলে মানুষের সামাজিক বন্ধনের জ্বালানি। একেকটি স্বপ্ন, একেকটি অনুভূতি মানুষের ভেতরের সৃজনশীলতাকে ছুঁয়ে যায় এবং তাকে নতুন পথে এগোতে সাহায্য করে। বৈজ্ঞানিক মহল প্রথমে তার গবেষণাকে সন্দেহ করলেও, ধীরে ধীরে স্বীকার করতে শুরু করে যে এই শহরের পরিবর্তন নিছক কাকতালীয় নয়, বরং মানুষের মানসিক শক্তির এক নতুন উদ্ভাস। ঈশান এই পরিবর্তনের সাক্ষী হয়ে প্রতিদিন তার ডায়েরির পাতায় লিখে রাখছে শহরের উন্মাদনা, কান্না, ভালোবাসা, ভয় আর আশার গল্প। তার ডায়েরি পরিণত হচ্ছে এক জীবন্ত দলিলে, যা একদিন ভবিষ্যৎ প্রজন্ম পড়বে এবং বুঝবে—কিভাবে মানুষ শৃঙ্খলার নামে দমন থেকে মুক্ত হয়ে আবেগের শক্তিকে নতুন সভ্যতার ভিত্তি বানিয়েছিল।

মীরার অভিনয় যেন শহরের আত্মাকে আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দিল। তার নাটকের চরিত্রগুলো হাসলে দর্শকের চোখ ভিজে ওঠে, কাঁদলে বুক হাহাকার করে ওঠে। অভিনয়ের প্রতিটি দৃশ্যে মানুষ শিখছে আবেগকে দমন নয়, বরং প্রকাশ করাই প্রকৃত মানবিকতার পরিচয়। শিশুরা প্রথম থেকেই এই নতুন পরিবেশে বেড়ে উঠছে—তাদের শেখানো হচ্ছে, চোখের জল লজ্জার নয়, ভালোবাসা দুর্বলতা নয়, বরং এগুলোই মানুষের সবচেয়ে বড় শক্তি। শহর ধীরে ধীরে একটি নতুন নাম ধারণ করে—“স্বপ্ননগরী”। এই নাম শুধু একটি ভূগোলের নাম নয়, বরং এক দর্শনের প্রতীক। এখানে স্বপ্নকে ভয় করা হয় না, বরং তাকে বাঁচার শক্তি হিসেবে স্বাগত জানানো হয়। মানুষ বুঝতে পারে, সভ্যতা আসলে কেবল যন্ত্রপাতি, প্রযুক্তি বা স্থাপত্যের সমাহার নয়; সভ্যতা গড়ে ওঠে তখনই, যখন মানুষ নিজের হৃদয়ের আবেগকে সম্মান করতে শেখে। স্বপ্ননগরী তাই হয়ে ওঠে নতুন সভ্যতার সূতিকাগার—যেখানে আবেগই শক্তি, স্বপ্নই ভবিষ্যৎ।

****

1000062747.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *