Bangla - প্রেমের গল্প

রোদ্দুর ও ছায়া

Spread the love

তৃষ্ণা মুখার্জী


অরুনাভ ঘোষ অফিসে প্রবেশ করল সকাল সাড়ে ন’টার কিছু আগে, হাতে কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে। দক্ষিণের জানালাগুলো দিয়ে সকালের সূর্য ঠিক তখনই ঢুকছিল, আর তার চোখে সানগ্লাস চাপিয়ে সে যেন আরও বেশি উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল সেই আলোয়। পুরো ফ্লোর জুড়ে একটা গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ল—“অরু এসেছে।” কেউ হয়তো তার ঠাট্টায় সঙ্গী হবে, কেউ হেসে উল্টো পথে হাঁটবে, কেউ আবার অপেক্ষা করত দিনের প্রথম উৎসাহের উৎসটা কখন তাকিয়ে বলবে, “তোর শার্টটা তো আজ খুবই কালারফুল, কী ব্যাপার?” অফিসের রিসেপশন থেকে ক্যান্টিন, সেলস টিম থেকে ফিনান্স—সবাই কোনো না কোনোভাবে চিনত অরুনাভকে, কেউ ‘আলো’র মতো, কেউ ‘আলোচ্য’। তবে একটা ডেস্কে সবসময় নিঃশব্দ থাকত, যেটা অফিসের এক কোনায়, জানালার উল্টো দিকে। ওখানে বসত ঐশী চৌধুরী, একা, নিঃশব্দ, কাজের ভেতর ডুবে থাকা এক রহস্যময় ছায়া। সে কখনও কারো সঙ্গে গল্প করত না, মিটিংয়ের বাইরে খুব একটা কথা বলত না, এমনকি ক্যান্টিনেও একা বসে থাকত, যেন কারও চোখে পড়াও তার অপছন্দ।

অরুনাভ প্রথম দিন থেকেই খেয়াল করেছিল ঐশীকে। ঠিক খেয়াল নয়—জিজ্ঞাসা। এই মেয়েটা কারো সঙ্গে মিশে না কেন? এতটা নীরবতা কীভাবে সম্ভব? অফিসে তো হাসাহাসি, ফোনকল, রিপোর্ট আর রসিকতার ভেতর একরকম নৃত্য চলে—সেখানে কেউ নিজেকে এত দূরে রাখে কীভাবে? প্রথম কয়েক সপ্তাহ সে শুধু দেখেই গিয়েছিল ঐশীকে—কখন আসছে, কখন যাচ্ছে, কি কাজ করছে, আর কখন চোখ তুলে তাকাচ্ছে না। আর ঐশী? সে যেন চারপাশের সব আলোকে পাশ কাটিয়ে নিজের ছোট্ট ছায়ার গণ্ডিতে থেকেই বাঁচতে চাইছিল। তার ডেস্কের কোণে রাখা ছিল রবীন্দ্রনাথের ‘চিঠিপত্র’, একটা সাদা মগে লিলি ফুলের শুকনো ডাঁটা, আর পুরনো মডেলের এক বেতের পেনস্ট্যান্ড। একদিন বিকেলে, অরুনাভ সাহস করে ঐশীর পাশে গিয়ে বসে বলেছিল, “তুমি কি জানো, তুমি এই ফ্লোরে একমাত্র মানুষ, যার হাসি আমি আজও দেখিনি?” ঐশী চোখ তুলে তাকিয়েছিল, ঠোঁটে একটা বিনীত কিন্তু ঠাণ্ডা হাসি এনে বলেছিল, “হাসিটা হয়তো আমার ডেস্কে আসে না।” সেই উত্তর অরুনাভকে হাসিয়েছিল, কিন্তু সেই হাসির আড়ালে যে একটা গভীর বিষণ্ণতা আছে, তা তখনও সে পুরোপুরি বুঝতে পারেনি।

দিন গড়াতে লাগল। সপ্তাহ থেকে মাস। অরুনাভ নিজের স্বাভাবিক আলো নিয়ে ঠিক যেমন ছিল, ঠিক তেমনই থাকতে থাকতেও একটু একটু করে চেষ্টা করতে লাগল ঐশীর পাশে আসার। সে জানত, এই সম্পর্ক কোনো চটজলদি ঘনিষ্ঠতা নয়—বরং সময়ের ধৈর্যে গাঁথা এক যাত্রা। কিছুদিন পর, সে ঐশীর ডেস্কে মাঝেমধ্যে দুপুরের কফি রেখে যেতে লাগল, তার কোনো অনুমতি ছাড়াই। প্রথম প্রথম ঐশী বিরক্ত হতো না, আবার কৃতজ্ঞতাও দেখাত না। কিন্তু একদিন, হঠাৎ করেই সে বলে বসে, “তুমি যদি সত্যিই এত আলো নিয়ে ঘুরে বেড়াও, কখনও ছায়ার সঙ্গে ক্লান্তি হয় না?” অরুনাভ থমকে গিয়েছিল প্রশ্নে। বলেছিল, “হয়। তাইতো ছায়ার পাশে বসতে ভালো লাগে।” সেই সন্ধ্যায়, অফিস ছুটির পর হঠাৎ দেখা গেল ঐশী আর অরুনাভ একসঙ্গে বাস ধরেছে বালিগঞ্জ ফাঁড়ির মোড়ে। কোনো কথা হয়নি তেমন, শুধু একসঙ্গে থাকা। নীরবতা হয়তো একটা আলাপের পেছনে থাকা সাহস, আর সেই নীরবতার ভিতরেই জন্ম নেয় এক অদ্ভুত বন্ধুত্ব—একজন যার আলোতে নিজেকে লুকায়, আর অন্যজন যার ছায়ায় নিজেকে খুঁজে পায়।

ঐশী জানত, অরুনাভ আসবেই। ঠিক দুপুর একটা নাগাদ, যখন ক্যান্টিনের ভিড় একটু কমে, আর সে নিঃশব্দে বসে থাকে জানালার ধারে তার পছন্দের কাঠের চেয়ারে, তখনই অরুনাভ এসে হাজির হয়। কিন্তু সে চায় না, কেউ তার নিঃসঙ্গতার খাঁচায় ঢুকে পড়ুক। অরুনাভ প্রথম প্রথম প্রতিদিন তার পাশে না বসে পাশের টেবিলেই বসত, কথা বলত না—শুধু তার ফোনে কিছু একটা দেখত, মাঝেমধ্যে হালকা গুনগুন করত, অথবা চা খেতে খেতে বাইরে তাকিয়ে থাকত। ঐশী বুঝে গিয়েছিল—এই ছেলেটা কোনো উত্তরের খোঁজে আসছে না, সে শুধু তার পাশে থাকা চুপচাপ সময়টা ভাগ করে নিতে চাইছে। এক সন্ধ্যায়, কাজ শেষ করে ঐশী যখন অফিসের করিডোর ধরে নিচে নামছিল, হঠাৎ পেছনে পায়ের শব্দ শুনে ফিরে তাকায়। অরুনাভ। খুব স্বাভাবিকভাবে বলে, “হেঁটে যাবো আজ? বাসের ভিড়ের আর ইচ্ছে নেই।” ঐশী কিছু না বলেই মাথা ঝাঁকায়। তারা হাঁটে—দুজন পাশাপাশি, কিন্তু তবু আলাদা। কথাবার্তা হয় না বেশি, কিন্তু হাঁটার ছন্দে যেন একটা অব্যক্ত বোঝাপড়া গড়ে ওঠে।

সেই সন্ধ্যা থেকেই তাদের সম্পর্কটা বদলাতে শুরু করে। অফিসে কেউ কেউ লক্ষ্য করেছিল—ঐশী এখন দুপুরের ক্যান্টিনে কিছুক্ষণ থাকে, আর অরুনাভ আগের চেয়ে কিছুটা কম উচ্চকণ্ঠ। কিন্তু তারা কেউ জানত না, এক সন্ধ্যায় দক্ষিণ কলকাতার রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা এক পুরনো বইয়ের দোকানে, কীভাবে ঐশী অরুনাভকে বলেছিল, “তুমি কখনও একা থাকো না, ঠিক বলছি?” অরুনাভ তখন একটু থেমে বলেছিল, “আমি একা থাকলে ভয় পাই। তখন সব মনে পড়ে যায়।” ঐশী সেই প্রথমবার তার চোখে কিছু নরমতা দেখেছিল—যেটা হাসির আড়ালে লুকানো থাকে। সেই সন্ধ্যায় তারা দুজনে একসঙ্গে বসে রবীন্দ্রনাথের ‘ছুটি’ পড়েছিল—অরুনাভ উচ্চস্বরে, ঐশী নিঃশব্দে। শহরের মধ্যে তখন তারা আলাদা একটা জগতে ছিল—যেখানে সময়ের গতি ছিল ধীর, আর নীরবতাও একটা ভাষা হয়ে উঠছিল।

দিনগুলো গড়াতে থাকল—কিছুটা স্বাভাবিকতায়, কিছুটা অস্বস্তিতে। কারণ সম্পর্ক যত গভীর হয়, ততই তা টানাপোড়েন নিয়ে আসে। একদিন অফিসে একটি প্রেজেন্টেশনের সময় ঐশীর ছোট একটি বিশ্লেষণ ভুল ধরেছিলেন অরুনাভ, সহাস্যে—তবে সবার সামনে। ঐশীর মুখ দেখে সে বুঝেছিল কিছু একটা ভেঙে পড়েছে ভিতরে। সেদিন রাতে অফিসের ছাদে, যখন সবাই চলে গেছে, ঐশী দাঁড়িয়ে ছিল একা। হাওয়ায় ওড়ছিল তার খোলা চুল, চোখে চশমা সরিয়ে রেখেছিল। অরুনাভ এসে চুপচাপ পাশে দাঁড়িয়েছিল, কিছু বলার সাহস হয়নি। অবশেষে ঐশী নিজেই বলেছিল, “তুমি যদি আমার পাশে থাকতে চাও, তাহলে আমাকে সবাইয়ের সামনে হাস্যকর করে দিও না।” অরুনাভ বলেছিল, “আমি হাসিনি তোমার ভুলে, আমি তো ভাবছিলাম… তুমি ঠিক বুঝবে।” ঐশী বলেছিল, “তোমার আলো আমার চোখ ধাঁধিয়ে দেয় মাঝে মাঝে।” সেই রাতে অরুনাভ আর কিছু বলেনি, শুধু তার পাশে দাঁড়িয়ে থেকেছিল। তারা দুজনেই বুঝে গিয়েছিল—এই সম্পর্কটা সহজ নয়। একজন আলো নিয়ে এসেছে ভালোবাসা, আর অন্যজন ছায়ার আড়ালে লুকিয়ে রাখছে অতীতের ভয়।

শুক্রবারের সন্ধ্যা। অফিসে কাজ শেষ করে সবাই বেরিয়ে গেছে অনেকক্ষণ আগেই, শুধু অরুনাভ আর ঐশী রয়ে গেছে নিজেদের ডেস্কে, একেকজন একেক মনোযোগে। হঠাৎই বিদ্যুৎ চলে গেল পুরো ফ্লোরে। বাইরের ঝড়ো হাওয়ার শব্দ কাঁচের জানালায় ধাক্কা মারছে অনবরত। জেনারেটর চালু হতে কয়েক মিনিট দেরি হবে—এই অন্ধকারে আচমকা ঐশীর মনে হলো, ছায়া আর আলো এখন একসঙ্গে মিলেমিশে গেছে। অরুনাভ নিজের ডেস্ক ছেড়ে নিঃশব্দে তার পাশে এসে দাঁড়াল। বলল, “ভয় লাগছে?” ঐশী জানালার বাইরে তাকিয়ে বলল, “ভয় নয়… শুধু অস্থিরতা।” সেই মুহূর্তটা ছিল নির্জন, কাঁপা আলো ও অজানা উত্তরের অপেক্ষায় থাকা এক মুহূর্ত। হঠাৎ অরুনাভ বলল, “চলো আমার একটা জায়গায় যাই। আজ না হয় একটু ছুটির মতো হোক।” ঐশী কিছু না বলে তাকিয়ে রইল তার দিকে। তাতে ছিল না না-বলা সম্মতি, আবার ছিল না সরাসরি রাজিও। কিন্তু কয়েক মিনিট পরেই তারা দুজনে নিচে নেমে এলিভেটর ধরে বেরিয়ে পড়ল রাতের শহরের দিকে।

ট্যাক্সির ভেতর নীরবতা ছিল গাঢ়। অরুনাভ জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকলেও ঐশী চোখ সরায়নি তার মুখ থেকে। অরুনাভ যেখানে নিয়ে গেল, সেটা ছিল তার পুরনো ফ্ল্যাট—বালিগঞ্জের এক পুরনো বাড়ির দ্বিতীয় তলায়, মেসে থাকত যখন, তখনকার ঠিকানা। দরজা খুলতেই দেখা গেল, ঘরের মধ্যে একধরনের বিশৃঙ্খলা, পুরনো বুকশেলফ, ছেঁড়া ক্যালেন্ডার, মায়ের ছবির ফ্রেম রাখা এক কোণে, আর জানালার ধারে একটি সাদা ল্যাম্প যার আলো খুব হালকা। ঐশী অবাক হয়ে দেখল, এই অরুনাভ, যে রঙিন জামাকাপড়ে মুড়ে থাকে, সে আসলে একসময় কতোটা ধূসর জীবন কাটিয়েছে। অরুনাভ কফি বানাতে ঢুকে গেল রান্নাঘরে, আর ঐশী বইয়ের তাক থেকে একটা পুরনো ছবি তুলে দেখল—ছোট্ট একটা ছেলেকে মায়ের কাঁধে চড়ে আছে, আর পেছনে সমুদ্র। অরুনাভ ফিরে এসে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল ঐশীর পেছনে। বলল, “ছবিটা পুরী। শেষবার মায়ের সঙ্গে গেছিলাম। তারপর উনি স্ট্রোক করেন। তিন মাসের মধ্যেই চলে যান।” ঐশী ছবিটা নামিয়ে রেখে বলল, “তুমি হাসো, আলো করো, গল্প করো… অথচ তুমিও… একা ছিলে!” অরুনাভ হাসল না, বলল, “তুমি যেমন ছায়ায় লুকিয়ে থাকতে চাও, আমি তেমন আলোয় ঢেকে রাখি আমার ভাঙা জিনিসগুলো। জানো, ছায়ার মানুষরা হয়তো সাহসী, তারা নিজেকে দেখে—আমি শুধু পালাতে চাই।”

ঐ মুহূর্তে তাদের সম্পর্ক নতুন এক মাত্রা পায়—যেখানে একে অপরের সামনে তারা নিজেকে উলঙ্গ করে ফেলে, মুখোশহীন। ঐশী ধীরে ধীরে তার ছোট্ট ব্যাগ থেকে একটা চিঠি বার করে বলল, “এই চিঠিটা আমি কখনো পাঠাইনি। আমার কলেজের এক বান্ধবীকে লিখেছিলাম… সে আমার বিশ্বাসভঙ্গ করেছিল, আমার প্রেম, আমার গোপন কথা… সবাইকে বলে দিয়েছিল। তখন থেকে আমি নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছি। এই শহরে এসেছি নতুন করে বাঁচার আশায়, কিন্তু ভয়টা আর যায়নি।” চিঠিটা অরুনাভের দিকে এগিয়ে দিলেও সে নেয়নি। শুধু বলল, “তুমি যদি আমায় বিশ্বাস করো, চিঠিটা ছিঁড়ে ফেলো না—আমার হাতে দাও না। আমি শুধু তোমার পাশে থাকব, তোমার গল্পটা শোনার অপেক্ষায়।” ঐশীর চোখ ভিজে গিয়েছিল, কিন্তু সে মাথা নীচু করে শুধু বলেছিল, “তুমি তো খুব আলো নিয়ে এসেছিলে… আমি ভেবেছিলাম পুড়িয়ে দেবে আমায়।” অরুনাভ ধীরে ধীরে বলেছিল, “না, আমি শুধু তোমার ছায়ায় একটু বসতে চেয়েছিলাম।”

সপ্তাহান্তের দুপুরটা ছিল হালকা রোদের মতো—অরুনাভের প্রস্তাবে তারা বেরিয়েছিল শহরের কোলাহল থেকে একটু দূরে, হুগলি নদীর ধারে এক নির্জন জায়গায়। ট্রাম থেকে নেমে তারা হেঁটে গিয়েছিল পুরনো এক ঘাটে, যেখানে আজ আর সেভাবে কেউ আসে না। ঐশী প্রথমবার অরুনাভের সঙ্গে এমন কোথাও এসেছিল, যেটা অফিস বা কাজের বাইরের এক পরিসর। অরুনাভ খুব সতর্ক ছিল—সে বুঝেছিল ঐশীর ভিতরের জগৎটা সহজে কাউকে জায়গা দেয় না। সে তাই খুব হালকা হালকা গল্প করছিল—কলেজে ক্লাস ফাঁকি দেওয়ার দিন, বন্ধুবান্ধবদের অদ্ভুত কাণ্ড, আর হঠাৎ মাঝেমাঝে ঐশীর দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে প্রশ্ন করছিল—‘তুমি ভালো আছো তো?’ ঐশীও একটু একটু করে মিশছিল, মৃদু হাসি আসছিল ঠোঁটে, চোখের কোণায় দেখা দিচ্ছিল চঞ্চলতা। একটা নিরবিচারে শান্ত দুপুর, ঘাটের ধারে বসে থাকা দুটি মানুষ, একসঙ্গে থাকা, যেন দুই বিপরীত মেরু একটু একটু করে কাছাকাছি আসছিল।

ঠিক তখনই, যেন গল্পের মোড় ঘুরে গেল। দূর থেকে হঠাৎ একটা কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, “ঐশী?” দুজনেই চমকে তাকাল। একজন নারী—পরনে চকচকে সালোয়ার কামিজ, হাতে ফোন, চোখে অবাক প্রশ্ন—ধীরে ধীরে এগিয়ে এল। ঐশীর মুখের সমস্ত রঙ উড়ে গেল মুহূর্তে। সে উঠে দাঁড়াল, কাঁধের ব্যাগটা শক্ত করে ধরে ফেলল। নারীটি এসে দাঁড়িয়ে বলল, “তুই! এত বছর পর! ভাবিনি এখানে দেখব! আর এটা কে?” অরুনাভ উঠে দাঁড়াল, সামান্য স্বাভাবিক ভঙ্গিতে। ঐশী একটু কাঁপা গলায় বলল, “অরুনাভ, ও… সঞ্চরী। কলেজে একসাথে পড়তাম।” সঞ্চরী হাসল, কিন্তু সেই হাসিতে কিছু কৃত্রিমতা ছিল। সে বলল, “তুই তো তখন খুব লুকিয়ে লুকিয়ে চলতি… এখন দেখছি… হ্যান্ডসাম ছেলে সঙ্গে… ভালোই চলছে জীবন।” তারপর হেসে চলে গেল, কিন্তু চারপাশে একটা অদৃশ্য বিষ ছড়িয়ে দিয়ে। ঐশী অরুনাভকে কিছু না বলে হঠাৎ ঘাট থেকে উঠে হাঁটা শুরু করল। অরুনাভ হতবাক হয়ে পিছন পিছন গেল। “ঐশী, সব ঠিক তো?” —কিন্তু ঐশী কিছু বলল না। তার মুখে ছিল সেই পুরোনো ছায়া, যা এতদিনে খানিকটা সরেছিল, আবার নতুন করে নেমে এল।

এরপরের দিনগুলো যেন হঠাৎ থেমে গেল। ঐশী অফিসে এল ঠিকই, কিন্তু অরুনাভকে এড়িয়ে চলতে লাগল। ক্যান্টিনে একা, দুপুরে চুপচাপ, এমনকি দরকারি মিটিংয়েও চোখে চোখ পড়ে না তাদের। অরুনাভ বুঝতে পারছিল না, কী এমন হয়ে গেল? সে কি ভুল করেছে? না কি ঐ অতীতের মুখ, সঞ্চরী, কিছু এমন বলে গেল যার জন্য ঐশী আবার নিজেকে গুটিয়ে ফেলছে? এক সন্ধ্যায় অরুনাভ সাহস করে ঐশীর ডেস্কে গিয়ে চুপচাপ বলল, “তুমি পালিয়ে যাচ্ছো, কিন্তু আমি দোষটা জানি না। তুমি বলতে পারো?” ঐশী কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল, তারপর বলল, “তুমি জানো না অরুনাভ… তুমি বুঝবে না… সঞ্চরী আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু ছিল। সে আমার প্রতিটা দুর্বলতা জানত। আমার প্রথম প্রেম, আমার পরিবারের টানাপোড়েন, আমার ডিপ্রেশনের দিন… সব। আর ঠিক সেইসব ব্যবহার করে ও আমাকে অপদস্থ করেছিল পুরো কলেজে। আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলাম… আজ অনেক বছর পর তাকে দেখে মনে হলো, আমি এখনও পালিয়ে বেড়াচ্ছি তার ছায়া থেকে।” সে গভীরভাবে তাকিয়ে বলল, “তুমি সেই ছায়ার বাইরে ছিলে… তাই তোমাকে কাছে টানতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এখন আবার ভয় পাচ্ছি, যদি তুমি একদিন চলে যাও সেই ছায়াকে ভয় পেয়ে।” অরুনাভ বলল না কিছুই, শুধু তার হাতে রাখা কফির মগটা ঐশীর সামনে রেখে চুপচাপ চলে গেল। নীরবতার মাঝখানে সে শুধু মনে মনে বলল—‘আমার আলো যদি সত্যিই সত্যি হয়, তবে তা তোমার ছায়াকে ভালোবেসেই থাকবে, পালাবে না।’

হঠাৎ এক সকালে অরুনাভ অফিসে পৌঁছে দেখে, তার ডেস্কে রাখা একটি খোলা খাম—ভেতরে একটি হাতে লেখা চিরকুট: “এই শনিবার একটু সময় রেখো। ছুটির দিনটা শুধু আমাদের জন্য।” নিচে সই নেই, কিন্তু লেখাটা ঐশীর। অরুনাভ অবাক হয়ে হাসে—এমন সরাসরি আমন্ত্রণ এর আগে কখনও আসেনি। সেই শনিবার, ভোর ছ’টায় হাওড়ার স্টেশনে ঐশী এক সাদা দোপাট্টা জড়ানো হালকা নীল কুর্তিতে দাঁড়িয়ে ছিল, হাতে একটা ছোট ব্যাগ। অরুনাভ প্রথমবার দেখল তাকে শহরের কাঁধ ঝেড়ে ফেলা রূপে—নীরব, কিন্তু অস্থির নয়। তারা উঠে পড়ল শান্তিনিকেতনগামী লোকালে, আর গন্তব্য ছিল—ঐশীর শৈশবের বাড়ি, বল্লভপুর। স্টেশনে নেমে হেঁটে হেঁটে পৌঁছানো হল লালমাটির পথ পেরিয়ে, ছোট্ট একটা বাড়িতে। বাড়ির পেছনে কাঁঠাল গাছ, সামনে কুঁচি কুঁচি রোদ, আর একপাশে বাঁধানো পুকুরঘাট। বাড়িটা বেশ পুরোনো, দরজার কাঠে পোকা ধরা, কিন্তু দেয়ালে বইয়ের তাক, সেলাইয়ের মেশিন, আর মাটির ঘরের গন্ধে ভরা ছিল এক অবিচল শান্তি।

সেই দিনটা ছিল একধরনের নিরাময়ের মতো। দুপুরে ঐশী তাকে নিয়ে গেল রবীন্দ্রনাথের কাঁচঘর, তার প্রিয় বকুলতলার পাশে বসে বলল, “এই জায়গাটা আমার আশ্রয়… আমার পেছনের স্মৃতিগুলো এখানেই গুঁজে রেখেছি।” অরুনাভ শুনছিল, খুব মন দিয়ে। তারা গিয়েছিল বসন্ত উৎসবের মাঠে, যেখানে এখন শুধু ঘাসে শিশির, আর সেদিকে তাকিয়ে ঐশী বলেছিল, “তুমি জানো, আমি কেন ছায়ায় থাকি? কারণ আলোতে কেউ বেশিদিন থাকে না। সবাই দেখে, তারপর চলে যায়। কিন্তু ছায়া—সে পাশে বসে থাকে, কোনও শর্ত ছাড়াই।” অরুনাভ ধীরে ধীরে বলেছিল, “তুমি কখনও ভেবেছো, কেউ যদি আলো হয়েও ছায়ায় বাস করতে চায়, শুধু তোমার জন্য?” ঐশী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলেছিল, “তুমি হয়তো সেই প্রথম আলো, যে আমার অন্ধকারকে ভয় পায়নি।” সেই সন্ধ্যায় তারা পুকুরঘাটে বসে থেকেছিল অনেকক্ষণ—জোনাকির আলোয়। অরুনাভ বলেছিল, “এই পৃথিবীতে তুমি আমার প্রথম মানুষ, যার নিরবতাও আমার প্রিয় হয়ে উঠেছে।”

পরদিন ভোরে যখন তারা স্টেশনের দিকে হাঁটছিল, ঐশী আচমকা থেমে অরুনাভের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি ঠিক জানি না আমি প্রেমে পড়েছি কিনা। কিন্তু আমি ভয় পাই না তোমার পাশে থাকতে।” অরুনাভ তখনও কিছু বলেনি, শুধু ধীরে ধীরে তার কাঁধে হাত রেখেছিল। তারা ট্রেনে উঠে পড়ল—কিন্তু এবার আর দুটো জানালার পাশে বসেনি আলাদা করে। তারা একসঙ্গে, একটানা বসেছিল। আলো আর ছায়া—একসঙ্গে, একই জানালা ধরে দেখছিল হাওড়ার দিকে ছুটে চলা শহর। শহরে ফিরে তারা বুঝেছিল, অতীতের কষ্ট যেমন সত্য, তেমনি ভবিষ্যতের ভালোবাসাও আরেক সত্য—শুধু সেই সত্যটাকে সময় আর সাহসে ছুঁতে হয়। ঐশীর বল্লভপুরে যে যাত্রা শুরু হয়েছিল, তা তাদের সম্পর্কের নতুন অধ্যায়ের সূচনা। যেখানে ছায়া আর আলো—একজন আরেকজনকে না বদলে, পাশে থেকে ভালোবাসতে শিখে যাচ্ছিল।

ঐশী বসেছিল ব্যালকনির চেয়ারে। মেঘলা আকাশের নিচে যেন তার চোখদুটো আরও ধূসর হয়ে উঠেছে। ওর সামনে রাখা মাটির কাপটা আধখালি, আর তাতে চায়ের গন্ধ প্রায় উবে গেছে। অরুনাভের ঠিকিয়ে দেওয়া সানফ্লাওয়ারটা জানালার ধারে পড়ে আছে—জল ছাড়া, যত্ন ছাড়া। অফিস থেকে ফিরেই অরুনাভ চুপচাপ এসে দাঁড়িয়েছিল ঐশীর পেছনে, কিন্তু কিছু বলেনি। ও জানত, আজ ঐশীর এমনই দিন—যে দিনগুলোতে সে আলো সহ্য করতে পারে না। এমন দিনে ওর চোখে নিজের মুখ দেখলে মনে হয় যেন শতাব্দীর পুরনো বিষণ্নতা একত্রিত হয়ে শুয়ে আছে নিঃশব্দে। অথচ সেই চোখেই অরুনাভ একদিন দেখেছিল কোমল একটা ভোর, যেখানে ছায়ার মধ্যেও লুকিয়ে ছিল আলো। “চা ঠান্ডা হয়ে গেছে,” অরুনাভ বলেছিল খুব আস্তে। ঐশী উত্তর দেয়নি। কেবল বলেছিল, “আজ কিছু বলো না, প্লিজ।”

অরুনাভ জানে, একেকটা বিষণ্নতা ব্যক্তিগত—অলিখিত, অদৃশ্য, অথচ ভারী। কিন্তু সে জানে না, ঐশীর মনের ভিতরে ঠিক কী যুদ্ধ চলে। সে কেবল বোঝে, কখন ঐশীর হাতটা ধরে কিছু না বলে পাশে বসে থাকাই ভালো, আর কখন তাকে একা থাকতে দেওয়া উচিত। আজ ছিল দ্বিতীয়টা। সে জানে না ঐশী কখন ছোটবেলায় ভয় পেয়েছিল প্রথম বার, কখন সে আয়নায় নিজের চোখ দেখে কেঁদেছিল, কিংবা কবে থেকে সে তার অনুভূতিগুলো বাক্য ছাড়া প্রকাশ করতে শিখে গেছে। কিন্তু অরুনাভ বুঝতে শিখেছে—ঐশীর ছায়ার ভেতরেও থাকে একরকম উষ্ণতা, যেটা সবসময় দেখা যায় না। তারা একই অফিসে কাজ করে, একসঙ্গে ফেরে, এক ক্যান্টিনে বসে চা খায়, কিন্তু তাদের ভেতরের শহরগুলো একেবারেই আলাদা। অরুনাভ আলোয় ভিজে থাকা একজন মানুষ, সে রোদ ভালোবাসে, কথা বলে অবিরাম, গান শোনে সকালবেলা। আর ঐশী—সে যেন গভীর সন্ধ্যা, নিঃশব্দ বারান্দা, কিংবা কবিতার একটা বিরামচিহ্ন।

দিন শেষের আলো মুছে গিয়ে আস্তে আস্তে সন্ধ্যা নামছে। অরুনাভের মনে হলো, “এই ছায়ার মেয়েটার জন্য আমি বদলে গেছি। হয়তো সেটাই ভালোবাসা।” সে জানে, ঐশী মাঝে মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেলে, অতীতের ফাঁদে আটকে পড়ে, কিন্তু সে এটাও জানে, তার হাতটা ঐশীর হাতের পাশে রাখলে ঐশী কখনও সরিয়ে নেয় না। ঐশী বলেছিল একদিন, “তুমি আলো, অরু… আর আলোয় আমি গলে যাই। আমি চাই কেউ থাকুক আমার পাশে, ছায়ার মতো। কিন্তু তুমি তো আলো!” তখন অরুনাভ বলেছিল, “আলো ছায়াকে ভয় পায় না, ঐশু। বরং ছায়া না থাকলে আলো বুঝতই না সে জ্বলছে।” আজ, সেই কথাটা আবার মনে পড়ে গেল। সে চুপচাপ ঐশীর পাশে গিয়ে বসলো, কিছু না বলে। ঐশী কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না, কেবল চোখ বন্ধ করে মাথাটা হালকা করে ওর কাঁধে রেখে দিল। অনেকটা সময় কেটে গেল —কোনো কথা নেই, শব্দ নেই, কেবল দুটো বিপরীত মানুষ একই ব্যালকনিতে বসে আছে, যেন ছায়া আর রোদ্দুর একসঙ্গে একটু একটু করে সন্ধ্যায় মিশে যাচ্ছে।

কফির কাপটা হাতে নিয়ে ঐশী জানালার পাশে বসে ছিল, বাইরে তখন সন্ধ্যা গাঢ় হচ্ছে। অন্ধকার নামছে ধীরে, সেই অন্ধকারে যেন তার নিজের ছায়াও হারিয়ে যাচ্ছে। অফিসে আজ সবার চোখেই কেমন একটা কৌতূহল ছিল—অরুনাভ আর ঐশীকে নিয়ে গুঞ্জনও শোনা গিয়েছিল করিডোরে। অথচ তারা কেউই কিছু বলেনি, কিছু বোঝায়নি। কিন্তু নিজেকে বোঝানোটা ছিল সবচেয়ে কঠিন। অরুনাভের প্রতিটি মেসেজ, প্রতিটি অপ্রত্যাশিত ফোনকল তাকে এক আশ্রয়ের অনুভব দিত—কিন্তু সেই আশ্রয় কি চিরস্থায়ী? নাকি এটাও এক ক্ষণস্থায়ী আলো, যা ছায়াকে ছুঁয়ে আবার মিলিয়ে যায়? ঐশী জানে, তার জীবনে কোনো সহজ রাস্তা নেই। তার মনের দেয়ালে প্রতিটি কথা প্রতিধ্বনিত হয়—সন্দেহ, সংশয়, অস্থিরতা। কিন্তু তার মাঝেও আজ সে যেন একটু বেশি হালকা বোধ করছে। অরুনাভ যখন তাকে দুপুরে বলেছিল, “তুই জানিস না, আমি তোর চুপচাপ থাকাটাও ভালোবাসি”—তখন ঐশীর মুখে কোনো উত্তর ছিল না। কিন্তু তার চোখের কোণ ভিজে উঠেছিল। কোনো কিছু না বলে, শুধু মাথা নুইয়ে সে যেন বুঝিয়ে দিয়েছিল—“আমিও”।

অফিস শেষে অরুনাভ আজ আর গাড়ি নিয়ে ঐশীকে ড্রপ করেনি। বদলে দিয়েছিল একটা বই—পুরনো মলাটের ভেতরে রাখা একটা ছোট চিরকুট। “আজ তোকে কিছু বলব না, শুধু তোর সঙ্গে বসতে চাই—একটা বইয়ের ভেতরে, এক কাপ চা নিয়ে।” ঐশী বইটা খুলে সেই লাইনটুকু পড়ে বারবার হাসছিল, আবার থেমে যাচ্ছিল। তাকে যে কেউ বুঝতে চায়, সময় দিতে চায়, চাপ না দিয়ে পাশে থাকতে চায়—এই অনুভূতিটা তার কাছে এক নতুন সূর্যোদয়ের মতো। জীবনে এতদিন কেবল নিজেকে লুকিয়ে চলেছে সে—নিজের কষ্ট, নিজের মানসিক যন্ত্রণাগুলো নিজের ভেতরে গুমরে রেখে দিনের পর দিন বাঁচা। অথচ আজ সেই নিজেকে একটু একটু করে খুলে ফেলতে ইচ্ছে করছে। সেই মানুষটার জন্য, যে নিজের রোদের মতো উজ্জ্বলতা দিয়ে তাকে গরম রাখতে চায়, কিন্তু পোড়াতে চায় না। ঐশীর মা একবার বলেছিলেন—“আলোকে ভালোবাসতে গেলে অন্ধকারকেও আপন করে নিতে শেখো”—তখন সে বুঝতে পারেনি, আজ যেন সে কথাগুলো তার নিজের ভেতরেই প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। জানালার বাইরের আলো নিভে গেছে, কিন্তু ঐশীর মনে একটা নতুন আলো জ্বলছে—নিভু নিভু, কিন্তু ন্যায্য।

অরুনাভ তখনো তার টেরেসে বসে, আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল। তার চোখে আজ একটু দার্শনিকতা, একটু অস্থিরতা, আর একটু ভালোবাসা। ঐশী তাকে পাল্টে দিচ্ছে, না—উল্টোটা—সে নিজেকে খুলে ফেলছে ঐশীর জন্য। একটা সময় সে খুব সহজে সব বলে ফেলত, আজ সে থেমে যায়, ভেবে নেয়—ঐশী কীভাবে নেবে কথা গুলো। আগে সে মানুষকে হাসাতে চাইত, এখন সে শুধু একজন মানুষকে বোঝাতে চায়—সে একা নয়। রোদের ছেলে হয়েও সে আজ ছায়ার কাছে মাথা নিচু করছে, কারণ এই ছায়ার গভীরতা তাকে নিজের মধ্যেও আলো খুঁজতে শিখিয়েছে। প্রথমবারের মতো সে বুঝতে পারছে—ভালোবাসা শুধু উচ্ছ্বাস নয়, ভালোবাসা হলো অপেক্ষা, বোঝাপড়া আর অনেক সময় নীরবতার মধ্যেও একটা স্পষ্ট ভাষা। সে জানে, সব কথা আজ বলা যাবে না, সব প্রশ্নের উত্তর আজ মেলেনি—তবু আজ সে ঐশীর জন্য একটা গান চালিয়ে দিয়েছে, তার পুরনো সিডি প্লেয়ারে—“তুমি রবে নীরবে, হৃদয়ে মম”—একটা গান, যা শুধু কানে নয়, হৃদয়ে বাজে।

ঐশীর ঘরে বসে ছিল এক অদ্ভুত নীরবতা। জানলার ধারে রাখা সাদা ফুলদানি থেকে শুকিয়ে যাওয়া ল্যাভেন্ডার ফুলগুলো হালকা গন্ধ ছড়াচ্ছিল, যেন অতীতের কোনো স্মৃতি বাতাসে মিশে আছে। দিনের আলো জানলা ছুঁয়ে ভেতরে ঢুকলেও ঘরের পরিবেশে ছিল কেমন একটা ক্লান্ত ছায়া। অরুনাভর দেওয়া বইগুলো বিছানার পাশে রাখা — তার পছন্দের কবিতা, নীরেন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, কিছু রবীন্দ্রনাথ — আর এককোনে রাখা ছিল সেই চিঠিটা, যেটা সে লিখে শেষ করতে পারেনি। ঐশীর মনের ভিতরে যেন একরকম যুদ্ধ চলছিল। অরুনাভ তাকে বদলে দিয়েছে, নিঃসন্দেহে, কিন্তু সেই বদলটা তার ভিতরের ছায়াকে কি মেনে নিচ্ছে? নাকি ছায়া শুধু একটা সময়ের আলোয় একটু গলে গিয়েছিল? ও বুঝতে পারছিল, অরুনাভর প্রতি তার অনুভবটা আর শুধু স্নেহ বা কৃতজ্ঞতা নয় — এটা অনেক গভীর কিছু। কিন্তু তার ভয় ছিল সেই অনুভবটা সে যদি মুখে আনে, তবে সেই আলোর ছেলেটা হয়তো দূরে সরে যাবে। যে ছেলেটা সবসময় হাসে, মজা করে, খোলা মনে বাঁচে — তার সঙ্গে ঐশীর ভেতরের সমস্ত দ্বিধা, বিষণ্ণতা আর সংকোচের জায়গাগুলো মানিয়ে যাবে তো?

অফিসে সেই দিনটায় অরুনাভ কিছুটা গম্ভীর ছিল। সে ঐশীর সামনে এসে দাঁড়িয়ে একটা নীল খামে ভরা ইনভাইটেশন দিল — তার দিদির বিয়ের কার্ড। “আসবেই কিন্তু, সবার সঙ্গে তোর পরিচয় করিয়ে দেব,” বলে হেসে উঠল সে। ঐশী হাসল, মাথা নোয়াল, কিন্তু তার ভিতরে কেমন যেন এক অস্থিরতা দানা বাঁধছিল। সেদিন সন্ধেয় বাড়ি ফিরে ঐশী বসে রইল বারান্দায়। চারদিকে শহরের শব্দ, দূরের বাসের হর্ণ, পাখির ডাকে মিশে যাচ্ছিল তার মনের ধ্বনি। তার মা এসে পাশে বসলেন, বললেন, “তোকে অনেক দিন ধরে একটা কথা বলতে চাইছি। তোকে আমি এত ছোট থেকে দেখে আসছি — সব সময় নিজের খোলসে আটকে থাকিস। কিন্তু আমি জানি, তোর ভিতরে কত আলো আছে। সেই ছেলেটা, অরুনাভ, তোকে সেই আলোর মুখোমুখি করে রেখেছে, না?” ঐশী একমুহূর্ত চুপ করে থাকল। তারপর প্রথমবারের মতো তার মায়ের কাঁধে মাথা রাখল, বলল, “ভয় হয় মা… যেই না বলব ভালোবাসি, অন্ধকারটা আবার ফিরে আসবে।” তার মা শান্ত গলায় বললেন, “ভালোবাসা অন্ধকার নিয়ে আসে না মা, ও শুধু আলোকে জায়গা করে দেয়।” ঐশীর চোখে অশ্রু, কিন্তু সেই অশ্রুর ভিতরেও একটা সিদ্ধান্ত জন্ম নিচ্ছিল।

বিয়ের দিন সন্ধ্যায়, অরুনাভ যখন তার বোনের সঙ্গে হাসতে হাসতে ফটোর পোজ দিচ্ছিল, তখন হঠাৎ পিছন থেকে ঐশীর কণ্ঠস্বর ভেসে এল — “অরু!” সে ঘুরে দাঁড়াল, আর তাকে দেখে যেন সময় থেমে গেল। ঐশী আজ প্রথমবারের মতো খোলা চুলে, হালকা নীল শাড়ি পরে এসেছিল। চোখে ছিল না অতিরিক্ত সাজ, কিন্তু তার চাহনিতে ছিল একরকম স্থিরতা, যা আগে কখনো দেখা যায়নি। “তুই আসবি জানতাম,” বলল অরুনাভ, চোখে একটা আলোর ঝলক। ঐশী সামনে এগিয়ে এসে বলল, “তুই জানিস, আমি অন্ধকার ভালোবাসি। কিন্তু তুই আমার সেই অন্ধকারে রোদ্দুর হয়ে ঢুকে গেছিস… আর আমি সেটা তাড়াতে পারছি না। বরং প্রতিদিন একটু করে ভালো লাগছে তোর আলোয় বসে থাকতে।” অরুনাভ তার হাতটা ধরল — নরমভাবে, যেন বলছে, ‘আমি থাকব’। ঐশী প্রথমবারের মতো তার চোখে চোখ রেখে বলল, “ভালোবাসি, অরুনাভ।” আর সেই মুহূর্তে যেন শহরের সমস্ত আলো ঝলমলে হয়ে উঠল, আর অন্ধকারেও দেখা গেল একটুকরো রোদ্দুর — ঠিক ঐশীর ভিতরে।

অফিস থেকে বেরিয়ে অরুনাভ এক মুহূর্ত থমকে দাঁড়াল—আজ ঐশী নিজের হাতে বানানো কফির কাপটা তুলে দিয়ে হঠাৎ বলেছিল, “তুমি জানো, আমি আগে এমন ছিলাম না।” কথাটা খুব হালকা ভঙ্গিতে বলা হলেও, তার গলায় ছিল অতল গম্ভীরতা। সে আর হাসেনি, এমনকি চোখের কোণেও দেখা যায়নি সেই পরিচিত নরম অভিব্যক্তি। পুরো রাস্তা ধরে হেঁটে যাওয়ার সময় অরুনাভের মনে বারবার ঘুরপাক খেতে থাকে ঐশীর সেই কথাটা। গলির মোড়ে পৌঁছে সে হঠাৎ করে সোজা পেছনে ঘুরে দাঁড়ায়। রাতের বাতাসে শীতের পরশ, অথচ তার বুকের ভেতর যেন গলন্ত রোদ্দুর। পেছনের দিকের পথেই ঐশীর ফ্ল্যাট, আর আজ আর অপেক্ষা করতে ইচ্ছা করছে না। বুকের ভেতর জমা হওয়া হাজারটা প্রশ্ন নিয়ে সে পৌঁছে যায় ঐশীর বারান্দার নীচে। ভেতরে আলো জ্বলছে না, কিন্তু ব্যালকনিতে বসে আছে ঐশী—একটা ছোট নীল বাতির আলোয় তার মুখটা যেন কোনো দুর্বোধ্য চিত্রকর্মের মতো। অরুনাভ কিছু বলার আগেই ঐশী নিচের দিকে তাকিয়ে বলে, “তুমি এসেছো?”

ঐশীর কণ্ঠে কোনো অবাক হওয়ার সুর নেই, যেন সে জানত অরুনাভ আসবেই। সে বারান্দা থেকে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসে, পরনে স্রেফ একটা হালকা নীল কুর্তা আর সাদা চুড়িদার। চুল খোলা, চোখে ক্লান্তির ছাপ। কিন্তু অরুনাভ তার মুখে খুঁজে পায় এমন এক গভীরতা, যেটা সে কোনোদিন অনুধাবন করেনি। ঐশী বলে, “তুমি জানতে চাও আমি আগে কেমন ছিলাম, তাই না?” অরুনাভ কিছু না বলে মাথা নাড়ে। ঐশী ধীরে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে বলে, “আমি আগে খুব হাসতাম, খুব গল্প করতাম। মানুষের সঙ্গে সহজে মিশে যেতাম। আমার মা বলতেন আমি নাকি তাদের ‘রোদ্দুর বাচ্চা’। কিন্তু তারপর এক এক করে সব বন্ধ হয়ে গেল… মা মারা গেলেন, বাবা কাজ ছেড়ে দিলেন, একা একটা শহরে পড়াশোনা করতে এলে বুঝলাম, পৃথিবীটা এতটা আলোকিত নয়। ছায়া আসে, আর সেই ছায়া ধীরে ধীরে গিলে খায় আলোর চিহ্নগুলো।” ওর কণ্ঠস্বর কাঁপছিল না, বরং এক অদ্ভুত স্থিরতায় ভরা। “তোমার কাছে হয়তো আমি একটা রহস্য… কিন্তু আমি নিজেও জানি না, আমি কে হয়ে উঠেছি।” অরুনাভ চুপ করে ওর পাশ দিয়ে হাঁটে, দুজন একসঙ্গে গলির মাথা পর্যন্ত যায়, কিন্তু কারো মুখে আর কোনো শব্দ উঠে আসে না।

তবে নীরবতার ভেতরও অনেক কথা বলা যায়—এ কথা তারা দুজনেই বোঝে। ফেরার সময় ঐশী হঠাৎ দাঁড়িয়ে বলে, “তুমি এত আলো নিয়ে হাঁটো, আর আমি ছায়া। আমরা কি একসঙ্গে থাকতে পারব?” অরুনাভ তার দিকে ফিরে বলে, “রোদ না থাকলে ছায়া বোঝা যায় না, আর ছায়া না থাকলে রোদ অতটা মূল্যবান নয়। আমি থাকতে চাই তোমার পাশে, ঐশী।” এই প্রথম সে ঐশীর হাত ধরে, হালকা স্পর্শে, যেন কোনো সুর বাজে তাদের মাঝখানে। ঐশী কিছু বলে না, শুধু খুব মৃদু এক হাসি তার মুখে খেলে যায়—যেটা অরুনাভ আগেও দেখেছে, কিন্তু আজ সেটা যেন অনেক বেশি সত্যি। গলির মোড়ে পৌঁছে তারা আলাদা হয়, কিন্তু মনে মনে জানে, তাদের ভেতর চলতে থাকা আলো-ছায়ার দ্বন্দ্বটাই তাদের সম্পর্ককে সত্যি করে তোলে। হৃদয়ের গভীরে একটা বোধ জন্ম নেয়—এ সম্পর্ক শুধু প্রেম নয়, একে অপরকে বোঝার নীরব প্রয়াস। আর তাতেই তারা ধীরে ধীরে জড়িয়ে পড়ছে এক গভীর ও অনিবার্য সংলাপে—বিপরীতের সংলাপ।

—–

1000042706.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *