Bangla - ভূতের গল্প

রেললাইন নম্বর সাত

Spread the love

আদ্রিজা লাহা


পর্ব ১: সাদা শাড়ির ছায়া

রেললাইনটা আজও আছে। ছড়িয়ে থাকা লোহালক্কড়ের শরীর, ঘাসে ঢাকা পড়ে গেছে বেশিরভাগ অংশ। নাম তার “লাইন নম্বর সাত”—তবে এখন কেউ আর নাম নেয় না। ষ্টেশনের পুরনো স্টাফরা বলেন, “ওটা তো ভূতের জায়গা।” নতুনরা হাসে, পুরনোরাও হাসে, তবে একটু ঠোঁট চেপে। কারণ একটাই—প্রতি বছর, নির্দিষ্ট দিনে, একটা সাদা শাড়ির মেয়ে সেখানে দেখা যায়। একই সময়, একই কায়ায়। ১৪ ফেব্রুয়ারি, ঠিক দুপুর একটা কুড়ি।

আর এই বছর, লাইব্রেরির গবেষক রুদ্রচরণ সরকার এসেছেন শহরটার ফেলে আসা ইতিহাস ঘাঁটতে। কলকাতা থেকে এসেছেন, একরকম সরকারি ফেলোশিপে। তার আগ্রহ ইতিহাসে নয়, সেই ইতিহাসের ‘গল্প’-এ। শোনেন, লেখেন, বিশ্লেষণ করেন, আর যেটা হারিয়ে গেছে তার মধ্যে খোঁজেন যেটা রয়ে গেছে।

রুদ্র এই স্টেশনটার নাম প্রথম শোনেন ১৯৫৩ সালের এক পুরোনো ফাইল ঘাঁটতে গিয়ে—যেখানে লেখা, “লাইন নম্বর সাত আজ থেকে বন্ধ ঘোষণা করা হলো। অপ্রয়োজনীয়, এবং আঞ্চলিক যোগাযোগ ব্যবস্থার মধ্যে স্থানান্তর সম্ভব না।” তার ঠিক নিচে একটা অদ্ভুত হস্তাক্ষর, সম্ভবত স্টেশন মাস্টারের: “ভবিষ্যতে কেউ যেন এখানে না আসে। সাবধান!”

এই বাক্যটাই কৌতূহল জাগায় রুদ্রর মনে। হোটেলে বসে চা খেতে খেতে তিনি লোকাল পুরোহিত, কাগজওয়ালা, এমনকি স্টেশন চত্বরের এক চায়ের দোকানদার দুলাল মণ্ডলকে জিজ্ঞেস করে ফেলেন—“এই লাইন নম্বর সাতের গল্পটা কী?”

দুলাল একটু থেমে হেসে বলে, “আপনি শহরের লোক, বিশ্বাস করবেন না। কিন্তু আমিও দেখেছি, ২০১২ সালে। দুপুর বেলা, হঠাৎ দেখি রেললাইন বরাবর হেঁটে যাচ্ছে এক সাদা শাড়ির মেয়ে। চুল খোলা, গলায় লাল গোলাপ। তার চোখে আমি এক ধরনের অভিমান দেখেছিলাম। তার পরদিন, স্টেশনের বাবু—রাখাল চক্রবর্তী মারা যান হার্ট অ্যাটাকে।”

রুদ্রের কলম থেমে যায়। “তার মৃত্যুর সঙ্গে ওই মেয়ের কোনও যোগ আছে?”

দুলাল ঘাড় নাড়ে, “কে জানে? কিন্তু এই ঘটনাটা প্রতি বছর হয়। কেউ দেখতে পায়, কেউ পায় না। কিন্তু ঘটনার সময়টা—একটাই: ১৪ ফেব্রুয়ারি, দুপুর একটা কুড়ি।”

পরদিন দুপুরে, রুদ্র পৌঁছে যান পুরনো রেললাইনের ধারে। চৈত্রের রোদে একটু ঝাঁঝ আছে, তবে বাতাসে একটা অদ্ভুত ঠাণ্ডা ভাব। বুনো ফুলের গন্ধ উড়ে আসছে, আর দূরে, অরণ্যের ভেতর একটা পাখি ডাকছে যেন কোনো নাম জানাতে চায়।

রেললাইনটা সরু, বাঁক খেয়ে ঢুকে গেছে ঝোপের মধ্যে। কিছুদূর গেলে একটা ধ্বংসপ্রায় স্টেশন বোর্ড দেখা যায়—তাতে লেখা, “নবচরণ স্টেশন”—রঙ উঠে গেছে, কিন্তু অক্ষরগুলো স্পষ্ট।

রুদ্র তাঁর নোটবুক খুলে লেখেন:

“নবচরণ স্টেশন, বন্ধ: ১৯৫৩। সাদা শাড়ির নারী দেখা যায় ১৪ ফেব্রুয়ারি, দুপুর ১.২০ মিনিটে। ইতিহাস নয়, এটি এক পুনরাবৃত্তি, এক অভিশাপ, অথবা এক অপেক্ষা।”

ঠিক তখনই হাওয়ায় এক ঝটকা লাগে। পাতারা কাঁপে। দূরে একটা শিসের মতো আওয়াজ হয়—তবে ট্রেনের নয়, যেন কেউ বাঁশি বাজাচ্ছে।

রুদ্র শোনেন।

তারপর তিনি দেখেন।

একটা মেয়ে হেঁটে আসছে রেললাইনের ধারে। সাদা শাড়ি, খোলা চুল, গলায় লাল গোলাপ। পায়ের শব্দ নেই। তার মুখে অদ্ভুত শান্তি—যেন কোনও গানের কথা মনে আছে, কিন্তু সে উচ্চারণ করছে না।

রুদ্র স্তব্ধ হয়ে যায়। চোখে চশমা চাপিয়ে স্পষ্ট দেখতে চেষ্টা করেন। মেয়েটি তার দিকে তাকায় না, শুধু লাইনের ওপর দিয়ে হেঁটে যেতে থাকে, যেন কারও প্রতীক্ষায়। তার হাঁটার গতি ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে থাকে ঝোপের ভিতরে।

আর তখনই রুদ্র শুনতে পান এক কণ্ঠ—মিহি, বিষণ্ণ, যেন বাতাসে ভাসছে—

“তুমি কেন দেরি করলে, অনিরুদ্ধ?”

রুদ্রের পায়ের নিচে মাটি সরে যায়। সে নামটা… অনিরুদ্ধ—কিন্তু এ তো তার দাদুর নাম!

পর্ব ২: হারিয়ে যাওয়া একটি নাম

রুদ্র মাটিতে বসে পড়ে। মাথাটা ঘোরে। বাতাস হঠাৎ নিস্তব্ধ হয়ে গেছে, পাখির ডাকও থেমে গেছে যেন। চারপাশে কেবল ঘাসের গন্ধ আর অচেনা সেই শব্দ—যেটা কানে বাজছে বারবার, “তুমি কেন দেরি করলে, অনিরুদ্ধ?”

অনিরুদ্ধ—এটা তো তার দাদুর নাম। অনিরুদ্ধ সরকার। পেশায় ছিলেন স্টেশন ক্লার্ক, আর সেই নবচরণ স্টেশনেই কাজ করতেন প্রায় দশ বছর। কিন্তু কখনও পরিবারের কাছে এই জায়গার কথা বলেননি। এমনকি রুদ্রর বাবা পর্যন্ত জানতেন না খুব একটা কিছু।

রুদ্র কাঁপা কাঁপা হাতে মোবাইল বের করলেন, ছবিটা তুলতে গিয়ে দেখলেন স্ক্রিন ব্ল্যাঙ্ক। ক্যামেরা কাজ করছে না। তিনি তড়িঘড়ি করে পকেট থেকে নোটবুক বের করে আঁকতে থাকেন মেয়েটির চেহারা—সাদা শাড়ি, কালো খোলা চুল, গোলাপ ফুল… আর মুখটা? মুখটা যেন কিছুতে ধরা দেয় না, শুধু একরাশ বিষণ্ণতা।

ঘণ্টাখানেক পর, তিনি ফিরে আসেন হোটেলে। ল্যাপটপ খুলে বসেন, পুরনো নথিপত্র, বাবার লেখা ডায়েরি, এমনকি এক পুরনো চিঠির খাম ঘেঁটে ঘেঁটে খুঁজতে থাকেন অনিরুদ্ধ সরকার নামের সঙ্গে এই নবচরণ স্টেশনের কোনো সম্পর্ক।

তখনই এক হলুদ হয়ে যাওয়া চিঠি চোখে পড়ে। প্রাপক: অনিরুদ্ধ সরকার। প্রেরক: উর্মিলা।

চিঠির খাম ফেটে গেল হাতেই, কাগজটা পড়েই রুদ্রর বুকটা ধক করে ওঠে—

“প্রিয় অনিরুদ্ধ,

*তুমি বলেছিলে ১৪ ফেব্রুয়ারি দুপুরে তুমি আসবে। আমি অপেক্ষা করব সেই পুরনো লাইনের ধারে, যেখানে তুমি প্রথম আমার জন্য গোলাপ এনেছিলে। কিন্তু যদি না আসো… যদি না পারো… তবে জেনো, আমি সব ছেড়ে যাব। শুধু এই রেললাইন থাকবে, আমার মতো পরিত্যক্ত।

উর্মিলা”*

তারিখ: ১৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫৩।

রুদ্র চেয়ারে হেলে পড়ে। এই উর্মিলাই কি সেই সাদা শাড়ির মেয়ে? তাঁর দাদু কি সেই অনিরুদ্ধ, যে কথা দিয়েও আসেননি?

এতদিন ধরে এই কাহিনি, এই অভিমান, এই অপেক্ষা—বেঁচে আছে শুধু রেললাইন নম্বর সাতের মধ্যে?

রাতটা নির্ঘুম কাটে। পরদিন রুদ্র যান শহরের পুরনো রেকর্ড অফিসে। সেখানে বসে, ধুলো জড়ানো পাতাগুলোর মধ্যে খুঁজে পান এক গুরুত্বপূর্ণ নথি—

নবচরণ স্টেশন | রিপোর্ট তারিখ: ১৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫৩

“১৪ তারিখে দুপুরে এক নারী রেললাইনের ধারে আত্মহত্যা করেন। স্থানীয়রা জানান, তিনি প্রায়শই স্টেশনের ধারে একা বসে থাকতেন। মৃত্যুর সময় তাঁর গলায় একটি লাল গোলাপ ছিল এবং পরনে ছিল সাদা শাড়ি। পরিচয় অজানা।”

রুদ্র নথিটা বারবার পড়েন। পরিচয় অজানা? কিন্তু চিঠিটা তো প্রমাণ করে তিনি উর্মিলা। আর প্রাপক অনিরুদ্ধ—তার দাদু।

হোটেলে ফিরে এসে বাবাকে ফোন করেন।

“বাবা… দাদুর নাম অনিরুদ্ধ ছিল, তাই তো?”

“হ্যাঁ। কেন বল তো?”

“দাদু কি নবচরণ নামক কোনও স্টেশনে কাজ করতেন?”

ওপাশে একটু থেমে বাবার কণ্ঠ আসে, “হ্যাঁ, খুব অল্প সময়। কিন্তু ওখানে কিছু হয়েছিল… তিনি আর কখনও কথা বলেননি ওই সময়টা নিয়ে। শুধু একটা ছবি ছিল উনার পুরনো ট্রাঙ্কে—একটা মেয়ের ছবি, গোলাপ গলায়, সাদা শাড়ি পরা। বলতেন, ভুল করে ফেলে এসেছেন কাউকে…”

রুদ্র চোখ বন্ধ করেন। বাতাসে যেন সেই কণ্ঠস্বর আবার শোনা যায়, “তুমি কেন দেরি করলে, অনিরুদ্ধ?”

এই অভিশপ্ত প্রেমের গল্প কি এখানেই শেষ? নাকি এখনো কিছু বাকি?

রুদ্র ঠিক করেন—এই রহস্য তাঁকে খোলতেই হবে। শুধু ইতিহাসের জন্য নয়, নিজের পরিবারের অতীতকে জানার জন্যও।

আর সেটা করতে হলে, তাঁকে ফিরতে হবে আবার সেই লাইনের ধারে—সেই সময়েই, আবার ঠিক এক বছর পর।

পর্ব ৩: এক গোলাপের শবদেহ

রুদ্রর দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল কিন্তু মনে হচ্ছিল, সময় এক জায়গায় দাঁড়িয়ে। ভোরবেলা উঠেই তিনি বসতেন দাদুর পুরনো ট্রাঙ্ক খুলে—চিঠি, ছবি, কাগজের টুকরো, আর কিছু ছেঁড়া ডায়েরির পাতা। ওগুলো যেন এখন মৃত জিনিস নয়, বরং জীবন্ত ইতিহাসের কান্না।

একদিন, পুরনো কাগজের গাঁথুনির ভিতর থেকে তিনি বের করলেন একটা ছোট্ট খাম। ভেতরে ভাঁজ করা একটুকরো কাগজ—সাদা, কিন্তু গোলাপি ছোপ লেগে আছে এক প্রান্তে। খুলতেই তিনি দেখতে পেলেন—

“উর্মিলা,

আমি এসেছিলাম, জানো? ঠিক ১৪ ফেব্রুয়ারি দুপুরে। কিন্তু তোমার চোখে আমি তখন আর পৌঁছতে পারিনি।

ট্রেনটা লেট ছিল। তখনও স্টেশন চালু ছিল, তবে শেষদিকে। যখন পৌঁছলাম, তখন সব শেষ।

তোমার গলায় তখনও ছিল সেই লাল গোলাপ।

আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম লাইনের ধারে, আর তখনই বুঝলাম—তোমার অভিমান আমার দেরির থেকে অনেক গভীর।

অনিরুদ্ধ”

রুদ্রর গলা শুকিয়ে আসে। এই চিঠি তো কোনোদিন পাঠানো হয়নি। চিঠিটা যেন রয়ে গেছে দাদুর বিবেকের এক অন্ধকার কোণে।

তিনি ভাবেন—উর্মিলা এসেছিলেন শেষবারের মতো দেখা করতে। কথা ছিল, সে অপেক্ষা করবে দুপুর একটা কুড়ি পর্যন্ত। কিন্তু অনিরুদ্ধ পৌঁছালেন দেরিতে। তখন উর্মিলা আর বেঁচে ছিলেন না।

রুদ্র খেয়াল করেন, এই চিঠির তারিখ নেই। সম্ভবত, এটা লেখা হয়েছিল ১৪ ফেব্রুয়ারির পরপরই—কিন্তু কোনও কাগজে বা গল্পে তার নাম আর উঠেনি।

তিনি ঠিক করেন, উর্মিলার সম্পর্কে আরও জানতে হলে যেতে হবে গ্রাম্য থানায়—যেখানে হয়তো মৃত্যুর রিপোর্ট ফাইল হিসেবে পড়ে আছে।

স্থানীয় থানার হেড কনস্টেবল, এক অবসরপ্রাপ্ত বৃদ্ধ মানুষ, তার কপালে ভাঁজ ফেলে বলেন, “উর্মিলা? উনি তো ছিলেন ব্রজমোহন দত্তের মেয়ে। ওই সময় অনেক কাণ্ড হয়েছিল, তবে কিছুই রেকর্ডে তেমনভাবে লেখা নেই। সবাই বলত, মেয়েটা পাগল হয়ে গিয়েছিল প্রেমে। গলায় গোলাপ পরেই রেললাইনের সামনে দাঁড়িয়েছিল। কে জানে, কেউ ঠেলেছিল না কি নিজেই ঝাঁপ দিয়েছিল।”

“আপনার মতে?” রুদ্র জিজ্ঞেস করেন।

“আমার মতে, কেউ ঠেলেনি। কিন্তু দেরি করে পৌঁছেছিল, সে তো জানি।”

রুদ্র বুঝতে পারেন, ওই বৃদ্ধ অফিসারও কিছু জানেন—কিন্তু বলতে চান না।

সন্ধেবেলা তিনি আবার যান সেই লাইনের কাছে। আকাশে মেঘ, হালকা কুয়াশা জমেছে দূরপাল্লার গাছের মাথায়। ঝোপের পাশে হঠাৎ চোখে পড়ে—একটা শুকনো গোলাপ, পড়ে আছে মাটিতে। কেউ রেখেছে কি?

তিনি সেটা তুলে নেন, আর দেখতে পান নিচে একটা খুদে কাগজ আটকানো ছিল।

“তোমার অপেক্ষা আজও ফুরোয়নি, অনিরুদ্ধ…

তুমি কি এবার আসবে সময়মতো?”

রুদ্র থমকে যান। এই চিরকুট কার লেখা? সে কি উর্মিলা? নাকি কিছু… অন্য কিছু?

তার মন বলে—যদি সত্যিই ভালোবাসা এত গভীর হতে পারে, তবে হয়তো আত্মাও অপেক্ষা করতে জানে।

আর এই ভালোবাসার শেষ পরিচ্ছেদ হয়তো এখনো লেখা হয়নি।

পর্ব ৪: সেই জানালার পাশে

রুদ্র সকালে ঘুম ভাঙতেই অনুভব করলেন—এই গল্পটা আর শুধুই গবেষণার বিষয় নয়, এ যেন তাঁর নিজের রক্তের ভেতর লেখা এক অতীতের পাণ্ডুলিপি। আজ তিনি যাবেন ব্রজমোহন দত্তের সেই বাড়িতে—উর্মিলার শৈশব যেখানে কেটেছিল, যেখানে প্রথমবার গোলাপ গাছের নিচে দাঁড়িয়ে সে প্রেমের কবিতা শুনেছিল অনিরুদ্ধর মুখে।

স্থানীয় একজন স্কুল মাস্টার তাকে নিয়ে গেলেন পুবদিকের একটা পুরনো বাড়ির সামনে। গেট ভাঙা, উঠোনে আগাছা, আর মাঝখানে একটা শুকনো পুকুর। কাঁচা বাড়ির একপাশে টালির ছাদ ভেঙে পড়েছে।

“এই বাড়িটাই ব্রজমোহনের,” মাস্টারমশাই বললেন, “উর্মিলার ছবি আমি দেখেছি… একবার, বহু বছর আগে। চোখে কেমন যেন অভিমান জমে ছিল।”

রুদ্র দড়ি টেনে একটা জং ধরা গেট খুলে বাড়ির মধ্যে ঢোকেন। ভেতরে ঢুকে যেন সময় থমকে যায়। চৌকাঠের ধুলোয় পায়ের ছাপ পড়ে, ভাঙা খাটের পাশে পড়ে আছে একজোড়া পুরনো চটি, আর জানালার ধারে একটা কাঠের আলমারি—যার ওপর ধুলো জমে এক আয়ু পার করেছে।

তিনি এগিয়ে যান জানালার দিকে। জানালার বাইরেই একটা পুরনো গোলাপ গাছ, আজও বেঁচে আছে। কয়েকটা লাল গোলাপ ফুটে আছে সেখানে—যেন সময় হার মেনেছে প্রেমের কাছে।

হঠাৎ জানালার গায়ে হাত রাখতেই নিচ থেকে পড়ে যায় এক ফ্রেমে বাঁধানো ছবি। রুদ্র সেটা তুলে নেন।

ছবিটায় উর্মিলা—সাদা শাড়ি পরা, একেবারে সেই মেয়েটির মতো যাকে তিনি লাইনের ধারে দেখেছিলেন। কাঁধে খোলা চুল, ঠোঁটে এক বিন্দু হাসি আর গলায়—একটা লাল গোলাপ।

ছবির পেছনে লেখা—

“১৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২

তুমি যেদিন প্রথম আমাকে বললে, ‘একদিন এই জানালার পাশে বসেই বিয়ের দিন নির্ধারণ করব।’

— উর্মিলা”

রুদ্রের চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। এই জানালার পাশে বসেই হয়েছিল প্রথম স্বপ্নের বীজ রোপণ। আর ঠিক এখানেই, সেই স্বপ্ন কুঁড়িতেই ঝরে পড়ে।

হঠাৎ পেছনে একটা আওয়াজ—চটাস করে জানালার পর্দা নড়ে ওঠে। কেউ যেন পাশের ঘরে হাঁটছে। রুদ্র এগিয়ে যান… কিন্তু ঘরটা খালি। কেবল একটা চেয়ারে রাখা আছে চিঠির বান্ডিল, উপরে লেখা, উর্মিলা।

তিনি একে একে খুলে পড়তে থাকেন চিঠিগুলো। সবগুলো উর্মিলার লেখা, কিন্তু কোনো চিঠি কখনও পাঠানো হয়নি।

“অনিরুদ্ধ,

আমি জানি তুমি আসবে। দেরি হলেও, তুমি আসবেই। আমি অপেক্ষা করতে পারি, কারণ আমি ভালোবাসি।

কিন্তু যদি তুমি না আসো, তবে এই জানালাটা খুলে রাখব। যাতে তোমার আসার পথ অন্তত বন্ধ না হয়।”

রুদ্র জানালার দিকে তাকান—আজও সেটা অর্ধেক খোলা, জানালার গায়ে বাতাসে দুলছে পর্দা।

আর তখনই আবার সেই কণ্ঠস্বর—সেই মিহি গলায় ভেসে আসে…

“তুমি জানালাটা খোলা রেখেছ অনিরুদ্ধ… তবে এবার এসো… পুরোটা খোলো…”

রুদ্র এক ধাক্কায় জানালাটা পুরো খুলে দেন।

দূরে গোলাপ গাছটার নিচে, রোদ আর ছায়ার ভেতর দাঁড়িয়ে আছে সেই মেয়ে। আজ আর শাড়ি উড়ছে না বাতাসে, বরং সে স্থির, চুপচাপ তাকিয়ে আছে রুদ্রর চোখে।

আর তার ঠোঁট ফেঁটে বেরোয় সেই নাম—“অনিরুদ্ধ।”

রুদ্র নিঃশব্দে বলেন, “আমি রুদ্র। তোমার চিঠিগুলো পেয়েছি। আমি দাদুর দেরির দায় নিয়ে এসেছি।”

সেই মুহূর্তে মেয়েটির ঠোঁটে এক বিন্দু হাসি।

তারপর সে মিলিয়ে যায় বাতাসে, গন্ধ রেখে যায় এক গোলাপের।

পর্ব ৫: একটা শেষ ট্রেন, একটা শেষ অপেক্ষা

রুদ্রর মনে হচ্ছিল, তিনি আর নিছক একজন গবেষক নন। যেন এই ইতিহাসটা তাঁকেই টেনে এনেছে—একটা অসমাপ্ত ভালোবাসার সাক্ষী হতে, হয়তো তা শেষ করতেও।

পরদিন ভোরে তিনি আবার রওনা হন নবচরণ স্টেশনের দিকে। পিঠে ব্যাগ, হাতে সেই পুরনো চিঠির বান্ডিল, আর পকেটে একটামাত্র লাল গোলাপ—গোলাপগাছ থেকে নিজে তুলে এনেছেন।

রেললাইন নম্বর সাতের ধারে বাতাসটা ছিল ভারি, যেন শব্দে পূর্ণ কোনো নিস্তব্ধতা। সময় থেমে আছে। দিগন্তের ওপার থেকে সূর্য আসছে, কিন্তু আলো এসে পৌঁছচ্ছে না যেন।

ঘাসে ভেজা জমি, পাতার কাঁপা, আর দূরের এক বুনো বাঁশির মতো শব্দ—সবকিছু মিলে এক গভীর যন্ত্রণার মতো।

দুপুরের দিকে, রুদ্র সেই জায়গায় দাঁড়ান—যেখানে তিনি প্রথম উর্মিলাকে দেখেছিলেন। ঘড়িতে তখন ১:১৮। কাঁটা একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছে সেই অলৌকিক সময়ের দিকে—১:২০।

হঠাৎ হাওয়ার ঝাপটা লাগে। পাতারা একসঙ্গে দুলে ওঠে, যেন কারও আসার পূর্বাভাস।

আর তখনই তিনি আবার তাঁকে দেখেন।

সাদা শাড়ির মেয়ে হেঁটে আসছে লাইনের এক প্রান্ত থেকে, মাথা নিচু, পায়ে শব্দ নেই, গলায় সেই একই গোলাপ। কিন্তু আজ তাঁর চোখে একটু শান্তি।

রুদ্র ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে যান। এবার ভয় নয়, লজ্জা নয়—শুধু এক অপরাধবোধ, উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া।

“উর্মিলা,” তিনি বলেন, “আমি অনিরুদ্ধের নাতি। তিনি দেরি করেছিলেন, কিন্তু এসেছিলেন। তোমার কাছে পৌঁছতে পারেননি। মৃত্যুর পরও তাঁর মনে কেবল তুমিই ছিলে।”

মেয়েটি থামে না, কেবল একটু মুখ তুলে তাকায়। চোখদুটো গভীর, জলভরা নয়—কিন্তু যেন প্রশ্নে ভরা।

রুদ্র পকেট থেকে গোলাপটা বের করে এগিয়ে দেন। “তোমার জন্য। এবার সময়মতো।”

মেয়েটি থেমে দাঁড়ায়। হাত বাড়িয়ে গোলাপটা নেয়। তারপর প্রথমবার, সে মুখে একটা স্থায়ী হাসি ফোটায়।

তখনই দূর থেকে ভেসে আসে ট্রেনের শব্দ।

কিন্তু আজ তো কোনো ট্রেন নেই! নবচরণ লাইনে তো কবে ট্রেন বন্ধ!

রুদ্র ঘাড় ঘুরিয়ে দেখেন—দূরের কুয়াশায় একটা ধূসর ট্রেন এগিয়ে আসছে ধীরে ধীরে। পুরনো ধাঁচের ইঞ্জিন, গায়ে জং, জানালায় ছায়া।

ট্রেনটা এসে থামে ঠিক সামনে। দরজা খোলে। ভেতরে আলো নেই, কিন্তু কেমন যেন উষ্ণ একটা মায়া ছড়ানো।

উর্মিলা পেছনে তাকিয়ে রুদ্রকে বলে, “ধন্যবাদ, রুদ্র। তুমিই আমার চিঠিগুলো পৌঁছে দিয়েছ। এবার আমার সময় শেষ হলো। এবার আমি সত্যিই যেতে পারি।”

রুদ্র নিঃশব্দে মাথা ঝুঁকিয়ে বলেন, “তোমাদের গল্পটা আমি মানুষকে বলব। যেন কেউ ভুলে না যায়—যে অপেক্ষা শুধু প্রেম নয়, উত্তরাধিকারও হতে পারে।”

উর্মিলা ট্রেনে ওঠেন। দরজা বন্ধ হয়। ট্রেনটা আবার হঠাৎ হাওয়ার মতো মিলিয়ে যায়।

লাইনের ওপরে কেবল পড়ে থাকে একটা গোলাপ—তাজা, লাল, কিন্তু এবার তার গায়ে নেই আর অভিমান।

রুদ্র সেটাকে হাতে নিয়ে বুঝে যান—রেললাইন নম্বর সাত এবার সত্যিই নিঃসঙ্গ নয়।

পর্ব ৬: কাগজে লেখা একটি প্রতিশ্রুতি

কলকাতায় ফিরে এসেও রুদ্র যেন রয়ে গিয়েছিলেন সেই নবচরণ স্টেশনের মেঘলা বিকেলে। অফিস, ঘর, বন্ধু—সব ছিল, তবু কোথাও যেন একটা শূন্যতা চুপ করে বসে থাকত বুকের ভেতরে।

ল্যাপটপ খুলে তিনি নিজের লেখা শুরু করলেন—“রেললাইন নম্বর সাত: এক অভিশপ্ত ভালোবাসার ইতিহাস”।

তাঁর লেখা শুধু ইতিহাস নয়—চিঠির ভাষা, অপেক্ষার নিশ্বাস, এক জানালার পাশে ফেলে আসা গোলাপের গল্প। তিন মাসে বইটা শেষ হয়। তারপর এক সাহিত্য ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয় প্রথমাংশ।

প্রকাশের পরদিনই মেইলে মেইলে ভরে যায় ইনবক্স।

“এই গল্প কি সত্যি?”

“আপনার দাদু কি সত্যিই ছিলেন অনিরুদ্ধ সরকার?”

“সেই মেয়েটির নাম উর্মিলা… আমি যেন তাকে চিনি!”

একজন তো লিখলেন, “আমার ঠাকুমা উর্মিলার সহপাঠী ছিলেন। তিনি বলতেন, উর্মিলা গান গাইত অসাধারণ। আর ভালোবাসত গোলাপ।”

রুদ্র বুঝলেন, উর্মিলা হারিয়ে যাননি। তিনি রয়ে গেছেন গল্পের পাতায়, চিঠির মধ্যে, পাঠকের মনে।

এক সন্ধেয়, কলকাতার কলেজ স্ট্রিটে একটি বই প্রকাশ অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিতে গিয়ে তিনি বললেন—

“একটা ভালোবাসা যদি সত্যি হয়, তবে সে মরেও রয়ে যায়। যেমন রেললাইন নম্বর সাত… যেখানে আর কোনো ট্রেন চলে না, কিন্তু একটা ট্রেন এখনও আসে। ঠিক একদিন, ঠিক একসময়, ঠিক একজনের জন্য।”

অনুষ্ঠানের শেষে একজন অল্পবয়সী মেয়ে তাঁর কাছে এসে বলল, “আপনার গল্পটা আমার নিজের জীবনের মতো লেগেছে। আমি উর্মিলার জায়গায় নিজেকে দেখতে পাচ্ছিলাম।”

রুদ্র হেসে বললেন, “তোমার জীবনেও কি কেউ দেরি করেছে?”

মেয়েটি বলল, “হয়তো করছে। কিন্তু আমি জানালাটা খোলা রেখেছি।”

এই কথাটা শুনে রুদ্রর চোখে জল এসে যায়।

বাড়ি ফিরে এসে তিনি পুরনো ট্রাঙ্কটা আবার খুলে দেখেন। সব চিঠি ফিরিয়ে রেখেছেন ঠিকভাবে। কিন্তু তার মাঝে একটা চিঠি আগে কখনও দেখেননি।

চিঠিটা উর্মিলার হাতে লেখা, কিন্তু ঠিকানায় লেখা রুদ্রর নাম।

“রুদ্র,

তুমি হয়তো আমাকে কখনও দেখোনি। কিন্তু আমি তোমাকে চিনি। তুমি আসবে জানতাম। কারণ কেউ তো দরজা খুলে দিতে হয়—যাতে শেষ মানুষটা যেতে পারে।

তোমার দাদু দেরি করেছিলেন, কিন্তু তুমি করোনি।

আমি যাচ্ছি। কিন্তু যে জানালাটা খোলা ছিল, সেটা তোমার হাতেই বন্ধ হলো। আর হ্যাঁ—ভালোবাসা যখন সত্যি হয়, সময় তাকে থামাতে পারে না।

— উর্মিলা”

রুদ্রর হাতে সেই চিঠি কাঁপছিল। সময় যেন থমকে গেছিল এক মুহূর্তে।

ঘরের জানালাটা খুলে দিলেন তিনি। দূরে একটা ট্রেনের হুইসেল বাজল—যদিও আশপাশে কোনো রেললাইন নেই।

কিন্তু রুদ্র জানেন, কিছু ট্রেন কেবল হৃদয়ের মানচিত্রে চলে।

পর্ব ৭: একটা পাথরের গোলাপ

এক বছর কেটে গেছে। ক্যালেন্ডারে আবার সেই তারিখ—১৪ ফেব্রুয়ারি। শহরে ভালোবাসার উৎসব, গোলাপের দাম আকাশ ছোঁয়া, রেস্তোরাঁয় ভিড় আর কপোলে লাজুক হাসি।

কিন্তু রুদ্রর দিনটা আলাদা।

তিনি আবার ফিরছেন নবচরণ স্টেশনে। ব্যাগে একটা খুদে ফলক, যেখানে খোদাই করা—

“উর্মিলা ও অনিরুদ্ধের স্মৃতিতে—এক ভালোবাসা, যা সময়ের গণ্ডি মানেনি।”

আর একটা পাথরের তৈরি গোলাপ—লাল রঙে রাঙানো, ঠিক উর্মিলার প্রিয় ফুলের মতো।

ট্রেন আজও চলে না নবচরণ লাইনে। কিন্তু রুদ্র জানেন, যাদের জন্য লাইনের শরীর জেগে ওঠে বছরে একবার, তারা অপেক্ষা করে না ট্রেনের হুইসেলের জন্য—তারা শুধু চায় কেউ যেন ফিরে আসে।

দুপুর একটা পঁচিশ।

রুদ্র হাঁটছেন লাইনের ধারে। আকাশটা আজ মেঘলা, বাতাসে পুরোনো পাতার গন্ধ। জায়গাটা অনেকটাই আগের মতোই—ঝোপঝাড়, ভাঙা বোর্ড, আর সেই অদ্ভুত নিস্তব্ধতা।

ঠিক ১:২০—হঠাৎ বাতাস থমকে দাঁড়ায়।

রুদ্র কিছুই দেখতে পান না এইবার। না সাদা শাড়ি, না সেই মেয়ে। কিন্তু তিনি জানেন—এই নীরবতা, এই হালকা শিরশিরানি, এই থেমে যাওয়া সময়… উর্মিলা এখানে আছেন।

তিনি পাথরের গোলাপটা রেখে দেন লাইনের পাশে, আর তার পাশেই বসিয়ে দেন সেই স্মারক ফলক।

একটা শেষ কাজ, এক চিহ্ন, যা বলবে—এই দুই নাম ভুলে যাওয়া যাবে না।

তারপর তিনি বলেন, “আজ আমি এসেছি সময়মতো। তোমরা দুজনও যেন শান্তিতে থাকতে পারো এবার। গল্পটা শেষ করলাম—তবে হৃদয়ে নয়, ইতিহাসে।”

তাঁর গলা কেঁপে ওঠে। কিন্তু অশ্রু আসে না। কারণ কোথাও মনে হচ্ছে—উর্মিলা এখন আর অপেক্ষা করছেন না।

চলে যাওয়ার সময়, হঠাৎ একটা হাওয়া এসে তার কানের কাছে ফিসফিস করে কিছু বলে।

“ধন্যবাদ, রুদ্র।”

তিনি থেমে দাঁড়ান। ঘাড় ঘোরান। কেউ নেই। কিন্তু হাওয়া থেমে যাওয়ার পর, তিনি দেখেন—গোলাপটার পাশেই একটা চিঠি উড়ে এসে পড়েছে।

চিঠিটা ছোট। তাতে শুধু এক লাইন:

“আমরা এবার একসাথে চলেছি। কেউ দেরি করেনি।”

রুদ্র সেই চিঠিটা তুলে পকেটে রাখেন। আর বুঝে যান—শেষত, কিছু প্রেম কোনোদিন একা থাকে না।

পর্ব ৮: ফিরে আসা ট্রেনের ধ্বনি

ছ’মাস পর, গ্রীষ্মের এক মলিন বিকেলে রুদ্র দাঁড়িয়ে ছিলেন একটি অডিটোরিয়ামের মঞ্চে। সামনে বসে শতাধিক মানুষ—তরুণ ইতিহাসপ্রেমী, গবেষক, শিল্পী, আর কয়েকজন সেই নবচরণ গ্রামের মানুষ।

মঞ্চে আজ প্রথমবার প্রদর্শিত হচ্ছে তাঁর তৈরি তথ্যচিত্র—“রেললাইন নম্বর সাত”।

পর্দায় ফুটে উঠছে এক পরিত্যক্ত লাইনের ধারে এক যুবকের পদচিহ্ন, খসে পড়া স্টেশন বোর্ডের ছায়া, আর চিঠির গায়ে বেঁচে থাকা ভালোবাসার শব্দ। উর্মিলার মুখ দেখা যায় না কখনোই, কেবল শোনা যায়—তার লেখা, তার নিঃশব্দ অপেক্ষা, আর অনিরুদ্ধের দেরির মর্মভেদী বর্ণনা।

প্রদর্শনী শেষ হলে, চারদিক নিস্তব্ধ। কেউ হাততালি দেয় না সঙ্গে সঙ্গে—সবাই যেন একধরনের ঘোরে ডুবে থাকে।

তারপর ধীরে ধীরে হাততালির শব্দ, চোখের কোণে জল, আর একজন মধ্যবয়স্ক মহিলা উঠে দাঁড়িয়ে বলে, “আমি উর্মিলার ভাইঝি। এত বছর পরে যেন তাঁর আত্মা শান্তি পেল। ধন্যবাদ।”

রুদ্র কিছু বলতে পারেন না, কেবল মাথা নিচু করে সম্মান জানান।

এরপর সময় কেটে যায়। রুদ্র অন্য গবেষণায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন। জীবন এগোয়। কিন্তু কোথাও যেন একটা খালি জায়গা থেকেই যায়—যেটা কেবল নবচরণ স্টেশনের বাতাস পূরণ করতে পারে।

একদিন হঠাৎ খবর আসে—সরকার নবচরণ স্টেশন এলাকায় একটি ‘heritage zone’ ঘোষণা করেছে। রেললাইন নম্বর সাত আর বাতিল নয়—তাকে সংরক্ষণ করা হবে। স্থাপন করা হবে স্মৃতিসৌধ, লাইব্রেরি, আর রাখা হবে সেই গোলাপফুল ও ফলকের জায়গাটা।

রুদ্র গাড়ি করে আবার যান সেখানে।

এইবার লাইনের চারপাশ পরিষ্কার। একদল তরুণ কাজ করছে নতুন স্মারক গড়ে তুলতে। একটা ছোট কাঠের ঘরে রাখা হয়েছে তথ্যচিত্রের স্থায়ী প্রদর্শনী।

রুদ্র চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকেন লাইনের ধারে। তখনই দূরে একটা আওয়াজ ভেসে আসে—ট্রেনের হুইসেল।

তিনি চমকে ওঠেন।

কিন্তু আশেপাশে কেউ সে শব্দ শুনতে পায় না।

তবে রুদ্র জানেন, এটা কল্পনা নয়। এটা সেই ট্রেন, যে ট্রেন কেবল ভালোবাসা টের পায়। একদিন যে ট্রেন উর্মিলাকে নিয়ে গিয়েছিল… আজ সে আবার এসেছে, ফিরে।

লাইনের ওপরে এখনও রাখা পাথরের গোলাপ। রোদ পড়ে একটুকরো আলো এসে পড়ে ফুলটার গায়ে—আর তাতে যেন রঙটা আরও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।

রুদ্র মৃদু স্বরে বলেন, “তোমাদের গল্পটা শেষ হল না কখনো। কারণ ভালোবাসা শেষ হয় না। শুধু নতুন পথে হাঁটে।”

হাওয়ার দোলায় পাতারা কেঁপে ওঠে।

আর তখন রুদ্র বুঝতে পারেন—উর্মিলা ও অনিরুদ্ধ আর নাম নয়, তারা এক প্রতীক। অপেক্ষা আর ক্ষমার, দেরি হলেও ফিরে আসার।

রেললাইন নম্বর সাত আজও নিষ্ক্রিয় ট্রাফিক সিগন্যালে আটকে থাকে না—কারণ কিছু প্রেম শুধু হৃদয়ের মানচিত্রে চলে। আর সেসব রেললাইন, কখনো হারায় না।

সমাপ্ত

Lipighor_1750834111519.jpeg

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *