Bangla - প্রেমের গল্প

রেনকোটে কফি

Spread the love

ঐশী সেনগুপ্ত


পর্ব ১: বৃষ্টির ব্রেক

কলকাতার জুলাই মাসের বৃষ্টি ঠিক যেন কাকেই বা কখন চমকে দেবে বোঝা যায় না। সকালে রোদ, দুপুরে গুমোট, আর বিকেল গড়াতেই যেন মেঘ ভিজিয়ে দিয়ে যায় ব্যস্ত মানুষগুলোর অবসরের ফাঁকফোকর।
তিথি সিংহরায় ঠিক সাড়ে তিনটে নাগাদ নামল গেটস টেক পার্কের সামনে। তার ল্যাপটপ ব্যাগটা আজ অদ্ভুত ভারি লাগছে, হয়তো বা ভেতরের টেনশনটাই বেশি। আজ যে প্রেজেন্টেশনটা দিতে হবে, সেটা হেড অফিস থেকে সরাসরি এসেছে—এবং সঙ্গে এসেছে তিনটি কোম্পানির সিনিয়র এক্সিকিউটিভ।
পা রেখেই সে বুঝল, মেঘ জমছে।
“দুপুরের পরে এমন আবহাওয়ায় বরাবরই কিছু একটা হয়,” নিজের মনেই বলে উঠল তিথি।
অফিস ক্যান্টিনটা প্রায় ফাঁকা। আরেকটা কোম্পানির মিটিং চলছে তিনতলায়, তাই সবাই ওপরে। তিথি একটু সময় নিতে চাইল—এক কাপ কফি হলে মন্দ হয় না।
পেছন থেকে সেই পরিচিত গলা—যেটা বহুদিন ধরে কেবল স্বপ্নেই শোনা যেত।
“তুমি এখনো কফিতে এক চামচ চিনি দাও?”
তিথি চমকে পেছনে ঘুরল।
অর্ণব।
একটা ধূসর রেনকোট গায়ে, চুলগুলো একটু ভেজা, চোখে সেই চেনা খুশি-গম্ভীর ছায়া। যেন হঠাৎ পুরোনো কোনো পাতা খুলে গেল।
দুটো সেকেন্ডের নীরবতা।
তারপর তিথি হেসে উঠল—একটা হালকা, দ্বিধাগ্রস্ত হাসি।
“তুমিও এখনো ক্যান্টিনের কফি খাও?” পাল্টা জবাব।
অর্ণব কাঁধ ঝাঁকাল, “আজ বৃষ্টিতে গাড়ি লেট করে দিল, তাই এক কাপ খেয়েই নিই ভাবলাম।”
একটা টেবিল বেছে নিল তারা। তিথি চুপচাপ বসে পড়ল, আর অর্ণব দুটো কফি অর্ডার দিল।
কয়েক মিনিট চুপচাপ।
তারপর কফির কাপ সামনে আসতেই তিথি একটু এগিয়ে বলল, “শোনো, এতদিন পর… এমনভাবে হঠাৎ দেখা হবে ভাবিনি।”
“আমি তো তোমার অফিসেই যাচ্ছিলাম প্রেজেন্টেশনের জন্য,” অর্ণব বলল। “কিন্তু আজ এখানে মিটিং ফিক্স হয়েছে। তুমি যখন ঢুকলে… আমি বুঝতেই পারিনি প্রথমে… তারপর চোখাচোখি। যেন… পুরোনো শহরে ফিরে এসেছি। জানো?”
তিথি চোখ নামিয়ে ফেলে। তার হৃদপিণ্ড যেন একটু জোরে ধুকপুক করছে।
“তুমি কেমন আছ?” তিথি জিজ্ঞাসা করে।
“ভালো,” অর্ণব উত্তর দেয়। “ব্যস্ততা আছে, কাজ আছে… কিন্তু তুমি?”
“ব্যস্ত। একা।” তারপর একটু থেমে আবার বলে, “আসলে… বাঁচতে শিখেছি।”
অর্ণব ধীরে মাথা নেড়ে। বাইরে হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকালো, জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা দুজন অপরিচিত লোক একবারে তাকিয়ে গেল। তিথি জানত, এই মুহূর্তে কোনো শব্দই যথেষ্ট নয়।
“তুমি আর আমি,” অর্ণব বলে, “সেই দিনটায় থেমে গিয়েছিলাম।”
“তুমি ফোন না করে চলে গেলে,” তিথি চোখ তুলে বলে।
“তুমি বলেছিলে ‘যা খুশি করো’—আমি ভেবেছিলাম সেটাই চাও।”
“আমি তো চাইনি, তুমি চলে যাও।”
চোখে জল এসে গিয়েছিল তিথির, কিন্তু ওটা সে লুকিয়ে রাখল কফির কাপের পেছনে।
অর্ণব নিচু গলায় বলে, “আমরা শুধু ইগোর জন্য হেরে গেছিলাম। সম্পর্কটাকে কেউই ঠিকভাবে ধরতে পারিনি।”
“হয়তো বা আমাদের সময়টা ঠিক ছিল না,” তিথি বলে।
অর্ণব এবার একটু হেসে বলে, “আবার যদি সময়টা আসে?”
বাইরে তখন টুপটাপ বৃষ্টি নামছে। রেনকোটে ভিজে থাকা মানুষেরা ক্যান্টিনে আশ্রয় নিচ্ছে। অচেনা মুখ, অচেনা গল্প—তাদের মাঝে দুটো পুরোনো আত্মা আবার কফির গন্ধে নতুন কিছু খুঁজছে।
“এখন তো দুটো কোম্পানির মিটিং আছে,” তিথি বলল। “বেশি কথা বললে কনফ্লিক্ট অফ ইন্টারেস্ট হয়ে যাবে।”
অর্ণব হাসল। সেই পুরোনো হাসি, যেটা তিথির ভিতরটা কাঁপিয়ে দেয়।
“তাহলে প্রেজেন্টেশনের পর এক কাপ কফি, আবার? আবার বৃষ্টি হলে?” অর্ণব জিজ্ঞেস করল।
তিথি মাথা নেড়ে বলল, “শর্ত একটাই… এবার কফিতে চিনি দেবে তুমিই।”
অর্ণব এক মুহূর্ত দেখে, বলে উঠল, “ডিল!”
জানালার পাশে তখন এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ছে। ঠিক যেমন করে কোনও পুরোনো ভুল একদিন ধুয়ে যায় একটা নতুন সম্ভাবনায়।
পর্ব ২: “একটা মিটিং, দুটো চোখ”

তিথি বোর্ডরুমে ঢুকতেই তার চোখ সোজা গিয়ে পড়ল অর্ণবের দিকে। ঘরটা আধুনিক, কাচের দেওয়াল আর কালো লেদার চেয়ার ঘেরা। তিনটে কোম্পানির রিজিওনাল ম্যানেজার, দুজন ডেভেলপমেন্ট হেড, আর তার পাশে—অর্ণব বসে আছে রোদচশমা খুলে রাখা এক ফোল্ডারে চোখ রেখে। সে জানে তিথির প্রবেশদ্বার কোনটা, তাই সেই মুহূর্তে না তাকিয়ে শুধু অপেক্ষা করছে।
তিথি হালকা মাথা নাড়ল। ভিতরে ভিতরে জানে, আজকের মিটিং কেবল প্রেজেন্টেশন বা রিসোর্স অ্যালোকেশনের ব্যাপার না, আজ যেন একটা পুরোনো অধ্যায়ের দ্বিতীয় খণ্ড।
“গুড আফটারনুন, অল অফ ইউ,” তিথির গলা কনফারেন্স রুমের নিস্তব্ধতাকে কেটে দিল।
চোখাচোখি।
তিথি এবং অর্ণব—এই দুই নাম ছিল এক সময় শহরের এক অজানা গল্পের কেন্দ্রবিন্দু। কলেজ ফেস্ট, হোস্টেল লাইন, বইমেলা, পার্কস্ট্রিটের কফি হাউজ—সব জায়গায় তাদের ছায়া ছিল। কিন্তু সময় এসে রুক্ষ হয়ে বলেছিল, ‘তোমাদের গল্প শেষ।’
তিথি স্ক্রিন শেয়ার করে প্রেজেন্টেশন চালু করল। চোখ নামিয়ে রাখল ফাইলে, ঠিক যেন কিছুই হয়নি। কিন্তু ভেতরে তার বুকের মধ্যে একটা ছেলেমানুষি দ্বন্দ্ব—যেমনটা হয় অজানা প্রেমপত্রের শেষে প্রশ্নচিহ্ন রেখে যাওয়ার পর।
অর্ণব খেয়াল করছিল। তিথি ঠিক আগের মতোই শার্প, আত্মবিশ্বাসী, আর কাঁধে চাপা ব্যথার মতো একরোখা। ওভাবে কথা বললে কেউ বুঝবেই না যে ভেতরে কতটা টানাপোড়েন চলছে।
“আমরা যদি এই Q4-এর প্রজেক্টটায় জয়েন্টলি ইনভেস্ট করি,” তিথি বলতে লাগল, “তাহলে শুধু ফান্ডিংই নয়, কাস্টমার রিটেনশন রেটও ১৭ শতাংশ বাড়বে। আমরা দেখছি পারস্পরিক ডেটা অ্যানালিটিক্স ও ইনোভেটিভ স্ট্র্যাটেজির সম্ভাবনা।”
একজন ডিরেক্টর হালকা ঘাড় ঘোরাল, “মিস সিংহরায়, আপনি বলতে চাইছেন দুটি সংস্থা একই প্ল্যাটফর্মে কাজ করবে?”
“হ্যাঁ,” তিথি শান্ত গলায় বলল। “অবশ্যই নির্দিষ্ট টার্মস অ্যান্ড কন্ডিশনের আওতায়।”
সবার দৃষ্টি এবার অর্ণবের দিকে। এবার তাকাতে হল ওকে। কয়েক সেকেন্ড নীরবতা।
“আমরা তিথির প্রস্তাব নিয়ে আগ্রহী,” অর্ণব বলল। “এবং আমি পার্সোনালি মনে করি এই পার্টনারশিপ মার্কেটে নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে।”
তিথির বুকের মধ্যে যেন একটা ঢেউ উঠল।
‘পার্সোনালি মনে করি’—এই লাইনটার মধ্যে কি কোনো ইঙ্গিত আছে?
“তবে আমাদের টিম আলাদা করে সব পয়েন্ট যাচাই করে পরে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাবে,” অর্ণব সংযোজন করল।
তিথি মাথা নাড়ল। “অবশ্যই। আমি আমার প্রেজেন্টেশন শেষে ডকুমেন্টেশন পাঠিয়ে দেব।”
মিটিং শেষ হল।
লোকজন উঠে গেল, কেউ কেউ ফোনে ব্যস্ত, কেউবা এস্কেলেটরের দিকে। শুধু তিথি তার ল্যাপটপ গুছিয়ে নিচ্ছিল—তখন আবার সেই পরিচিত গলা—
“তুমি জানো, তুমি আগের থেকেও বেশি প্রফেশনাল হয়ে গেছ।”
তিথি এক ঝলকে তাকাল।
“তুমি কিন্তু আগের চেয়েও বেশি কনফিউজিং,” সে মুচকি হেসে বলল।
অর্ণব একটু থেমে বলে, “আজকের প্রেজেন্টেশন দারুণ ছিল। একদম ইনসাইটফুল। আই অ্যাম ইমপ্রেসড।”
“প্রফেশনালি না পার্সোনালি?”—তিথি হঠাৎ জিজ্ঞেস করল।
অর্ণব এবার একটু হাসল। “দুটোই। তবে পার্সোনালি বেশি।”
সেই হাসিটা, যেটা একসময় তিথিকে ঘুম পাড়াত।
“তুমি বদলে গেছ, অর্ণব,” তিথি বলল।
“হ্যাঁ,” অর্ণব বলল, “একটা ভুল সম্পর্ক শেষ করে মানুষ না বদলে উপায় থাকে?”
তিথির কণ্ঠ নরম হল, “তুমি এটাকে ভুল সম্পর্ক ভাবো?”
“না,” অর্ণব এবার সোজা চোখে তাকাল, “ভুল সময়ে তৈরি সম্পর্ক, যেটা ঠিক করে সময় বুঝে নিতে পারিনি।”
বাইরে তখন মেঘে চাঁদ ঢাকা পড়ে আছে। কাঁচের দেওয়াল দিয়ে দেখা যাচ্ছে, আবার বৃষ্টি নামছে। টুপটাপ করে বিন্দু বিন্দু জল জমছে।
তিথি তার ফোল্ডার তুলে নিয়ে বলল, “আমার একটা ইমপ্লিমেন্টেশন কল আছে। যেতে হবে।”
“আমি নিচে যাচ্ছি ক্যান্টিনে,” অর্ণব বলল, “আবার এক কাপ কফি… বৃষ্টির সাথে?”
তিথি দাঁড়িয়ে রইল কয়েক সেকেন্ড। জানালার বাইরের ভিজে রোড, গাড়ির হেডলাইট, ছাতার নিচে আশ্রয় খোঁজা মুখ—সব একসাথে যেন বলে উঠল—
‘আবার শুরু হোক… যদি সাহস থাকে।’
“দশ মিনিটের জন্য আসতে পারি,” তিথি বলল। “তবে এবার কফিতে চিনি আমি দেব।”
অর্ণব মুচকি হেসে বলল, “ডিল। আবার।”

পর্ব ৩: সাবেকি ছাতা, নতুন গল্প
অফিস ক্যান্টিনের জানালার কাঁচ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছিল ধীরে ধীরে, যেন কোনো পুরোনো চিঠির অক্ষর গলে যাচ্ছে সময়ের ভেতর। দু’টো কফির কাপের মাঝে তিথি আর অর্ণব বসে, মুখোমুখি নয়—একটু আড়াআড়ি, যেন তাদের মাঝে একটা অলিখিত দূরত্ব আছে, যা একদম অচেনা নয়।
অর্ণব ছাতাটা নামিয়ে রাখল পাশে। কালো কাপড়ের পুরোনো ছাতা, রিমগুলো একটু বেঁকে গেছে।
তিথি তাকিয়ে বলল, “এখনো তুমি এই ছাতাটা ব্যবহার করো?”
অর্ণব হেসে ফেলল, “এইটা তো আমাদের কলেজের সময়কার… মনে নেই? তুমিই বলেছিলে এটা আমার ওপর বেশি মানায়।”
তিথির মুখে হালকা বিস্ময়—“তুমি রেখেছ?”
“রাখা হয়নি… থেকে গেছে,” অর্ণব গলার নিচে কিছুটা ভার চাপিয়ে বলে। “আমার স্টাডি টেবিলের পাশে একটা খুঁটি আছে, যেখানে এই ছাতাটা লেগে ছিল এতদিন। আজ হঠাৎ বের হওয়ার সময় হাতের কাছে পেলাম, তাই নিয়ে নিলাম। কে জানত আজ তোমার সাথেই আবার কফি ভাগ হবে।”
তিথি চুপ করে রইল কয়েক মুহূর্ত। বাইরে বৃষ্টি একটু বেড়েছে। ভিতরে ক্যান্টিনের আলো-ছায়া খেলায় মুখগুলো জ্বলজ্বল করছে।
“আজকের প্রেজেন্টেশনে তুমি খুব ভাল করেছ,” অর্ণব বলল। “তোমার ভয়েস, সেই কনফিডেন্স—ঠিক যেটা আমি প্রথমে ভালোবেসেছিলাম।”
তিথি একটু নড়ে বসল। এই প্রশংসা যেন গায়ে লেগে থাকা পুরোনো একটা গান, যেটা শোনা যায় বৃষ্টির দিনে।
“তুমি যদি এত ভালো বোঝো আমাকে, তাহলে তখন কেন ভুল বুঝেছিলে?” হঠাৎ প্রশ্নটা ছুঁড়ে দেয় তিথি।
অর্ণব একটু থমকে যায়। তার চোখেমুখে একটা দৃশ্য স্পষ্ট—তাদের শেষ ঝগড়ার দিন।
“তুমি বলেছিলে, তুমি একা থাকতে চাও। আমি ভেবেছিলাম, তুমি চাইছো আমি চলে যাই।” অর্ণব নিচু গলায় বলল।
“আমি চাইছিলাম তুমি একবার থেকো, বলো, বোঝো। আমি রাগ করেছিলাম, ভালোবাসা ছেড়ে দিইনি,” তিথির গলা কাঁপে।
“ভুল ছিল আমার,” অর্ণব স্বীকার করল। “আমার ইগো তখন আমার চেয়ে বড় ছিল। আর আমি তোমার মধ্যে ভাঙনের চিহ্ন দেখেও মুখ ফিরিয়েছিলাম।”
কিছুক্ষণ কোনো কথা নেই। বাইরে গাড়ির হর্ন, বৃষ্টির শব্দ, আর ক্যান্টিনের চায়ের চামচে কাপে টুংটাং আওয়াজ ছাড়া সব চুপ।
“তুমি… এখন একা?” তিথি জিজ্ঞেস করল।
অর্ণব হালকা হাসল। “হ্যাঁ। একবার একটা সম্পর্ক হয়েছিল… কিন্তু জানো, তাতে তেমন কিছুই ছিল না। কিছু সম্পর্ক শুধু নিঃশব্দে চলে আসে, আর নিঃশব্দেই চলে যায়।”
তিথি তাকিয়ে থাকে তার কফির কাপের দিকে। তলায় একটু চিনি জমে গেছে, হালকা তেতো-মিষ্টি স্বাদ।
“আমি ভেবেছিলাম তুমি হয়তো বিয়েও করে ফেলেছ,” তিথি বলল।
“তুমি তো সেই দিন বলেছিলে, ‘আমরা কেউ কারও জন্য নই’। ওই একটা লাইন আমাকে ভেঙে দিয়েছিল, জানো?” অর্ণব এবার সরাসরি তার চোখে তাকাল।
“আমি রেগে গিয়ে বলেছিলাম,” তিথি ফিসফিস করে বলে, “কিন্তু মনে মনে চাইছিলাম তুমি বলো—‘তাহলে কে হবে?’”
অর্ণব তখন একটানা তাকিয়ে রইল তিথির চোখে। সেই চোখের ভিতর আজও আগুন আছে, কিন্তু সেটা এখন আর পোড়ায় না—উষ্ণ করে।
“আমরা যদি একটু বুঝে নিতাম… একটু সময় নিতাম…” অর্ণব বলতে গিয়ে থেমে যায়।
“তাহলে এই কফিটা হতো না,” তিথি মুচকি হেসে বলল।
“হ্যাঁ, তখন হয়তো আমরা কফি খেতাম কোনো ফ্ল্যাটের বারান্দায়… আর এখন খাচ্ছি এক কোম্পানির ক্যান্টিনে, ছাতার পাশে বসে।”
তিথি একটু হাসল, সেই আগের মতো। অর্ণব জানে, এই হাসির মধ্যে এখনও সেই পুরোনো বইয়ের গন্ধ আছে, বৃষ্টির ভেজা কাগজের পাতার মতো।
“তুমি কি এবার চলে যাবে?” তিথি হঠাৎ জিজ্ঞেস করল।
অর্ণব মাথা নাড়ল। “এই শহরে আবার পোস্টিং হয়েছে। অন্তত ছয় মাস এখানে থাকব।”
তিথি চুপচাপ বসে থাকল।
“তোমার যদি সমস্যা না হয়,” অর্ণব বলল, “তাহলে মাঝে মাঝে দেখা হলে কেমন হয়? বন্ধুর মতো? কফির মতো? ঝরঝরে, তেতো-মিষ্টি?”
তিথি হাসল।
“কিন্তু বন্ধুরা কি ছাতার গল্প এতদিন মনে রাখে, অর্ণব?”
অর্ণব এবার কফির কাপটা এগিয়ে দিয়ে বলল, “বন্ধুরা নয়… আমি রাখি। কারণ, কিছু মানুষ হারিয়ে গেলেও তাদের ছায়া থেকে যায়।”
“তাহলে আজ যেহেতু ছাতা আর কফি দুটোই আছে, দেখা যাক ছায়াটা আরেকটু বাড়ে কি না,” তিথি বলল।
বাইরে তখনও বৃষ্টি থামেনি, কিন্তু ক্যান্টিনের কোণে দুটো মন হালকা হয়ে উঠেছে। ছাতার ফাঁকে, কফির কাপে, আর বলা না-বলা কথার ভিতর দিয়ে যে সম্পর্কটা একদিন থেমে গেছিল, সে আবার হাঁটতে চাইছে।
ধীরে ধীরে, সাবধানে, নতুন গল্পের পথে।
পর্ব ৪: “চুপকথা আর চেনা রাস্তা”

বসন্তের মাঝামাঝি দুপুরের একটু খামোশ বিকেল। অফিসের চিত্রাভাস যেন কোনো এক চেনা রাস্তার মতো—যেখানে প্রত্যেক কোণে লুকিয়ে থাকে অজানা গল্প, পুরোনো সুরের ছোঁয়া, আর নীরব কথোপকথনের অনাবিল গাঁথা। আজকের দিনের ক্যান্টিনের জানালা দিয়ে যে দৃশ্য দেখার মতো, তা যেন সময়ের সাথে সাথে অতীতের স্মৃতিগুলোকে আবার জাগিয়ে তুলতে শুরু করেছে।
তিথি আর অর্ণব দু’জনেই অফিসের পরিসরে নিজেদের থামিয়ে নিয়েছিলেন এক অপূর্ব বিরতির জন্য। আজকের মিটিংয়ের চাপে, ব্যস্ততার মাঝে ছোট এক স্ফুলিঙ্গ খুঁজে বের করার জন্য তারা দুজনেই নিরবচ্ছিন্ন কথোপকথনের মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলেন। দু’জনের চোখে আজ আর সেই আগের রোমাঞ্চ নেই, বরং এক নিস্তব্ধ নিঃশব্দতা, যা জানায়—কিছু কথা আজ আর না বলা, শুধু অনুভবে বলা।
তিথি চুপচাপ জানালার পাশে বসে দেখছিল বাইরে সূর্যের মৃদু আলো ছড়িয়ে পড়ছে ধীরে ধীরে, আর পাতার ওপর দিয়ে নরম বাতাস শিহরণে সঙ্গীত গাইতে থাকছে। হাতে কফির কাপ, মুখে এক নরম হাসি, মনে একটি প্রশ্ন: “কতদিন পর এই চেনা রাস্তা আবার আমাকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে?”
একদিকে, অর্ণব অফিসের প্রিলব্ধি ঘরের এক কোণে বসে ছিল, খোলামেলা কাগজের নোটবুকে কিছু লিখতে লিখতে, কখনোই নিজের চোখে চোখ রাখেনি। কিন্তু আজ, তাঁর চোখের মধ্যে এক অদ্ভুত স্বস্তি ছিল। মাঝেমধ্যে তিথির দিকে তাকিয়ে তিনি মনে মনে ভাবেন, “সময়ও কী হাসির পথে হাঁটে, আবার ছিঁড়ে নেয় পুরোনো বন্ধনের পাতাগুলো।”
মিটিংয়ের পরবর্তী বিরতির সময়, দু’জন ঠিক করলেন—আজ দু’জন একসাথে শহরের বাইরে একটু হাঁটাহাঁটি করবে, যেন অফিসের নিষ্ঠুরতা থেকে পালিয়ে ছোট্ট একটা বিনোদনের খোঁজে। ক্যান্টিনের বাইরে এক শান্ত, চেনা রাস্তা, যেখানে পুরোনো গাছের ছায়া আর ছোট ছোট দোকানের শব্দ, মনে করিয়ে দেয় অতীতের দিনগুলোর স্মৃতি।
হাঁটার সময়, দু’জনের মধ্যে কথাগুলো যেন নিজেরাই নিজেরা বলে উঠছে, কোনো নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য ছাড়া, শুধু মনের গভীরে লুকানো চুপকথা প্রকাশ পাচ্ছে। অর্ণব হালকা মুচকি হাসলেন, “তুই তো ভাবিস, এই রাস্তা আমাদের কতদিন ধরে ছেড়ে গেছে? আজ দেখলাম, এই গাছটার তলায় বসে কথা বলার মধ্যেই আছে কত গভীরতা।”
তিথি চোখে চোখ রেখে বললেন, “এতদিনে বুঝলাম, কথাটা আসলে শুধু শব্দের খেলা নয়; এ তো ছিলো হৃদয়ের আঙ্গিনা, যেখানে দিনগুলোর বেদনাকে আর মুহূর্তের স্নিগ্ধতাকে একসাথে ভেসে নিয়ে যায়।”
তাদের কথোপকথন শুধু ব্যবসায়িক মিটিংয়ের পেছনের কালো দিক নয়, বরং এক সময়ের অতীতের গল্প বলছিল—যখন প্রাথমিক প্রেম ছিলো নির্ভীক, ভুল বোঝাবুঝি ছিলো শুধু দুই হৃদয়ের মাঝে দুরত্ব, আর প্রতিটি আলাপ ছিলো নতুন স্বপ্নের সূচনা। সেই দিনগুলো মনে পড়ে গেল যখন তারা একে অপরের চোখে চোখ রেখে বলতো, “ভালোবেসে যাবো, ভুলেও যাবো না।”
দু’জন যখন নিজেদের জীবনকে ধীরে ধীরে ফিরে দেখছিল, তখন অর্ণব বললেন, “তুই কি মনে করিস, আমাদের মাঝে সেই পুরোনো তালে কি আবার নতুন করে কোনো সুর বাজবে?”
তিথির মাথা নেড়েছিল, যেন ঐ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে তার মনের পাতায় নীড় ছিলো। “সম্ভবত,” তিনি বললেন, “যদি আমরা বুঝে উঠতে পারি, কোন শব্দ কখন ও কোথায় ব্যবহার করবো। কখনটা ছিলো শুধু চুপ থাকা, আর কখনটা উচিত কথা বলা।”
রাস্তার ধারে একটি ছোট্ট বইদোকান ছিলো, যেখানে পুরোনো বইগুলো আর ফটোগ্রাফগুলো সুশৃঙ্খলভাবে সাজানো ছিলো। দু’জন ঐ দোকানের সামনে থেমে গেলেন, এবং দোকানের জানালা দিয়ে ভেদাভেদ করতে করতে দেখলেন, কতদিনের স্মৃতিতে এই বইগুলো আজও জাগ্রত। “প্রায় যেন প্রতিটি বইই আমাদের গল্পের অংশ,” অর্ণব হালকাভাবে বললেন।
“একটু থাম,” তিথি বললেন, “এখানে আসলেই আছে ইতিহাস—জীবনের সেরা অধ্যায়গুলো। যারা সেইসব মুহূর্ত ভুলে গেছে, তাদের জন্য মনে হয় নতুন করে কিছু স্পন্দন আছে।”
দু’জন দোকানের ভেতরে ঢুকলেন, আর একটি পুরাতন ছবি নিয়ে দাঁড়ালেন যেখানে দুজন একে অপরের দিকে হাসছেন, দিনের আলোয় ভিজে। “এই ছবিটা মনে করিয়ে দেয়, আমাদের শুরুটা কেমন ছিল,” তিথি বললেন।
আসবাবপত্রের কোণে রাখা সেই ছবি যেন সজাগ করে দিল অতীতের সেই দিনগুলোর স্মৃতি, যখন কোনো ভুল বোঝাবুঝি ছিলো শুধু অল্পক্ষণের জন্য।
আবার পথচলার সময়, দু’জনের কথাবার্তায় বেড়ে উঠলো এক নতুন উত্তেজনা, যেন পুরোনো বিপদের মাঝে পথচলা আর তাদের অনুভূতির মাঝে এখনো আছে এক শক্তিশালী বন্ধন। “আজকের দিনটা যেন আমাদের কাছে একটা নতুন অধ্যায়।”
রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে, অর্ণব হঠাৎ করে বললেন, “তুই জানিস, কখনো কখনো আমি ভাবি—আমরা কি সত্যিই বুঝতে পারি, সময় কত দ্রুত চলে যায়?”
তিথি মৃদু সাড়া দিলেন, “সময় নিজেই যেন এক নদী; আমরা যা কিছু ধারণ করি, সব ফিকে হয়ে যায়—কিন্তু সেই নদীর ধারা আর সুর কখনোই বদলে না।”
এই কথায় দু’জনের মনের মাঝে এক শান্ত অনুভূতি জাগ্রত হলো। তারা বুঝতে পারছিলেন, যে জীবন যেমন সময়ের সাথে সাথে বদলে যায়, তেমনি পুরোনো ভালোবাসার সুরও থাকতেই পারে, যদি ভুলগুলোকে ছেড়ে দিয়ে নতুন করে কথা বলা যায়।
হাঁটার পথে মাঝেমধ্যে দু’জন থেমে দাঁড়ালেন, ছোট ছোট কথোপকথনে নিজেদের মন খুলে দিলেন। আকাশে সূর্য নিচে নামার রঙগুলো আর রাস্তায় ছড়িয়ে থাকা আলো, যেন স্মৃতি রাঙিয়ে তুলছিল পুরোনো দিনের হাসি আর কান্না।
এখানে, কোনো উষ্ণ আলো, কোনো গর্জন, নেই—শুধু ছিলো নীরবতা, আর সেই নীরবতার মধ্যেই শোনা যাচ্ছিল দু’জনের হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন। “আমরা কি আবার একসাথে নতুন করে শুরু করবো?” অর্ণব জিজ্ঞেস করলেন, যেন প্রশ্নের প্রতিটি শব্দে বেদনাও লুকিয়ে থাকে।
তিথি কিছুক্ষণের জন্য চুপ থাকলেন, তারপর বললেন, “আমরা কি জানি, নতুন শুরু মানেই সব ভুলকে ভুলে যাওয়া নয়; বরং, এটা হলো সেই ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে আগামি পথচলার এক অঙ্গীকার।”
“হয়তো আমরা তখন ভালোই বুঝতে পারতাম, যখন আমরা পারতাম শুধু একে অপরকে ক্ষমা করে নিতে,” অর্ণব মর্মস্পর্শী স্বরে বললেন। “ক্ষমা। আর সেই ক্ষমাই হয়তো আমাদেরকে আবার একত্রিত করতে পারে, যদি আমরা সত্যিই চাই।”
তিথি চোখে নিঃশ্বাস নিলেন, মনে মনে ভাবলেন—“ক্ষমার মাঝে আর ভালোবাসার মাঝে কতটা সাদৃশ্য আছে।”
“হ্যাঁ,” অর্ণব জবাব দিলেন, “কারণ, আমরা সবাই মানুষ, আর মানুষ ভুল করে, কিন্তু ভুল থেকে ওঠার সাহস দেখায়।”
পথ চলতে চলতে, সেই চেনা রাস্তা তক্তার মতো শব্দহীন হয়ে ওঠে। প্রতিটি মোড়ে, প্রতিটি ধাপে মনে পড়ে গেল তাদের সেই পুরোনো স্মৃতি, যেখানে প্রতিটা চুপকথায় ছিলো অজানা ভালোবাসার পরশ।
কিছুক্ষণের জন্য, দু’জন মিলে দাঁড়ালেন রাস্তার এক কোণে, যেখানে পুরোনো মাটির বাড়ির ঢাল, আর ঘন গাছপালার মাঝে একটু শান্তিপূর্ণ আবহ তৈরি হয়েছিলো। অর্ণব ঢোকেন বললেন, “তুমি কি মনে করো, আমাদের জীবন আবার ঐ চেনা রাস্তায় ফিরে আসতে পারে?”
তিথি হালকা হেসে বললেন, “হয়তো না ঠিক আগের মতো, কিন্তু নতুন করে আমরা নিজেরা তৈরি করবো—তাই এই পথটা চেনা থাকবো, আর প্রতিটি পদক্ষেপে থাকবে সেই চুপকথার সুর।”
শহরের হাট-বাজারের কোলাহল থেকে একটু দূরে, সেই নীরব রাস্তা যেন তাদের একান্ত জায়গা হয়ে উঠেছিলো—সেখানে শুধু দুইজনের কথা ছিল, সেসব ভুল আর ভুল বোঝাবুঝি ধীরে ধীরে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা, আর সেই চুপকথার মাঝে পাওয়া একটি নিরবচ্ছিন্ন আশার বিনিময়।
যখন তারা আবার নিজেদের অফিসের দিকে ফিরতে লাগলেন, দু’জনের চেহারায় একটা সরল শিথিলতা—পরের দিন, পরের সভায়, এই ছোট্ট বিরতির স্মৃতিই তাদের জীবনকে নতুন করে রঙিন করে তুলবে।
“আজকের এই হাঁটা, এই চুপচাপ কথা, হয়তো এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা,” অর্ণব বলে রাস্তায় এক নিস্তব্ধ মূহুর্ত বয়ে গেলেন।
“হ্যাঁ,” তিথি নিজেও নিশ্চিত মনে বললেন, “ভালোবাসা কখনোই নিঃশব্দ নয়। কিছু কিছু কথা, শুধু অনুভবে বলা যায়; আর সেই অনুভবই আমাদেরকে একসাথে নিয়ে আসে।”
তাদের হাসি, তাদের চোখের প্রতিফলন, আর ঐ চেনা রাস্তার প্রতিটি কোণে একটা করে নতুন সুর লেখা হলো। বেশ কিছু পুরোনো ভুল, বেশ কিছু অমীমাংসিত ব্যথা—সব মিলিয়ে আজকের দিন তারা খুলে দিলেন, যেন নতুন করে কথা বলা শুরু হলো।
অফিসে ফেরার পথে, রাস্তার ধারে ধীরে ধীরে বৃষ্টি থামতে শুরু করল। কিন্তু সেই শান্তির মাঝে, দু’জনের মনে এক নতুন প্রত্যয় জাগ্রত হলো—যে পুরোনো যে কোনো সম্পর্ক, যদি সত্যিকার ভালোবাসার ছোঁয়া থাকে, তবে তা আবার ফুটে উঠতে পারে।
“আগামীকাল দেখা হবে,” অর্ণব বললেন, আর তিথি মৃদু হাসলেন, “কথার মাঝে তুমি থাকলে, প্রতিটা দিনটা হবে চিরকালীন।”
এভাবেই, ঐ চেনা রাস্তা দু’জনকে আবার একত্রে এনে দিল, যেখানে শুধু পুরোনো স্মৃতিই নয়, বরং নতুন স্বপ্ন, নতুন আশার আলো। তাদের মধ্যে যেন নিঃশব্দে বয়ে গেল এক নতুন অধ্যায়ের প্রতিশ্রুতি, যেখানে শুধু সময় আর সত্যিকার ভালোবাসারই আছে কোনো শেষ নেই।
পর্ব ৫: “নতুন শুরু, পুরোনো স্বপ্ন”

সন্ধ্যা নামার মুখে শহরের আলো ধীরে ধীরে জ্বলে উঠছে। গাড়ির হেডলাইট, রাস্তার ল্যাম্প, আর কাঁচের জানালায় প্রতিফলিত আলোগুলো এক অদ্ভুত রকমের উষ্ণতা ছড়িয়ে দিচ্ছে। তিথি এখনো অফিসেই। সবার অফিস ছেড়ে যাওয়ার পরেও সে নিজের ডেস্কে বসে আছে, ল্যাপটপের স্ক্রিনে এক দৃষ্টে তাকিয়ে, অথচ মন কোথাও একেবারে অন্যখানে।
আজ সারাটা দিন যেন অলৌকিকভাবে বদলে গেছে। অর্ণবের সঙ্গে এই হঠাৎ দেখা, কফির সেই দুটি কাপ, পুরোনো কথা, ভাঙা-গড়া সব স্মৃতি আবার ফিরে আসা—সব যেন একটা সিনেমার মত মনে হচ্ছে, যার ক্লাইম্যাক্স এখনও আসেনি।
তিথি জানত, তারা যে মিষ্টি স্মৃতিগুলোর মধ্যে হাঁটল আজ, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। বাস্তব এমন একটা জিনিস, যা খুব দ্রুত মানুষকে টেনে নামিয়ে দেয়। তবুও, আজ অর্ণবের চোখে একটা আলাদা রকমের দৃঢ়তা ছিল। যেন সে নিজের ভুল বোঝাবুঝির বোঝা ঝেড়ে এসে একটা নতুন ভাষায় কথা বলতে চায়।
হঠাৎ অর্ণবের মেসেজ এল।
অর্ণব: “তুই এখনো অফিসে?”
তিথি: “হ্যাঁ, ফাইনাল ইমেলটা পাঠাচ্ছিলাম। তুই?”
অর্ণব: “আমি তোকে নিচে নিয়ে যেতে পারি… যদি তুই চাস। বৃষ্টি থেমেছে, কিন্তু আমার রেনকোট আজও সঙ্গে আছে।”
তিথি: 🙂 “আসছি।”
নিচে নেমে অর্ণবকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এক মুহূর্তের জন্য মনে হল, এই ছবিটা তার বহুদিন আগের স্বপ্নে দেখা। অন্ধকারে তার চোখে সেই পুরোনো উষ্ণতা, হাতে সেই রেনকোট, পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সেই চেনা ছায়া।
“তুই একটু হাঁটবি?” অর্ণব বলল।
তিথি কাঁধ ঝাঁকাল, “বৃষ্টি নেই, হাঁটা তো যেতেই পারে।”
ওরা দু’জনে গেট পার হয়ে রাস্তায় হাঁটা শুরু করল। চারপাশে অফিসফেরত মানুষের ভিড়, গাড়ির শব্দ, ফুচকার ঠেলা—সবকিছুর মধ্যেও তাদের হাঁটা যেন আলাদা। যেন অনেকগুলো বছরের দূরত্ব হেঁটে পার করছে দু’জন।
“তুই এখনো কেমন কাজ করিস?” তিথি জিজ্ঞেস করল।
“আমার টিমটা বড় হয়েছে,” অর্ণব বলল। “তবে কাজের চাপে খুব একটা কিছু অনুভব করার সময় পাই না।”
“তবে আজ মনে হচ্ছে, তুই অনেক কিছু অনুভব করেছিস।”
অর্ণব একরাশ চুপ করে রইল। তারপর বলল, “আসলে তোর চোখে চোখ রাখলে এখনো বুকটা একটু ধক করে ওঠে।”
তিথির মুখে একটুকরো হাসি খেলে গেল। “আমি ভেবেছিলাম তুই সব ভুলে গেছিস।”
“কিছু জিনিস ভোলা যায় না, তিথি,” অর্ণব বলল। “আমরা একে অপরকে যেভাবে জানতাম, সেটা আর কেউ জানবে না। তোর ফোনের রিংটোন, তোর রাগ হবার অভ্যেস, কিংবা বৃষ্টির দিনে কফির স্বাদ—সব আমার মনে আছে।”
তিথি একটু থেমে বলল, “আমরা শুধু ভুল সময়ে একসাথে ছিলাম, অর্ণব। হয়তো এখন সেই ভুল সময় ঠিক সময়ে এসে দাঁড়িয়েছে।”
“হয়তো,” অর্ণব বলল। “তবে আমি এবার আর কোনো সুযোগ হারাতে চাই না।”
দুজনেই থেমে দাঁড়াল একটা ছোট চা দোকানের সামনে। দোকানদার ভাঁজে চা বানাচ্ছিল। বৃষ্টির পরের ভিজে গন্ধ, কাঁচের ভাঁজে জমে থাকা জল, আর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা দুই চুপচাপ মানুষের চোখে আজ আর কিছু লুকোনো নেই।
“তুই জানিস?” অর্ণব হঠাৎ বলল, “আমি একবার ভেবেছিলাম, তোর সঙ্গে আবার যদি দেখা হয়, তাহলে আমি একটা প্রশ্ন করব।”
“কি প্রশ্ন?”
“তুই কি আজও একা থাকিস, কারণ তোর ভালোবাসা শেষ হয়ে গিয়েছিল… না কি আমি শেষ হয়ে গিয়েছিলাম?”
তিথির মুখটা একটু থেমে গেল। চোখে জল এলেও সে সেটা লুকোল না।
“তুই কখনোই শেষ হয়ে যাসনি, অর্ণব। আমি শুধু মনে করিয়ে দিইনি, যে ভালোবাসা অনেক সময় নিজে থেকেও বাঁচে না… তাকে বাঁচাতে হয়।”
অর্ণব চুপ করে কাগজের কাপটা এগিয়ে দিল। চায়ের গরম ভাপ উঠছে। কাপের ফাঁকে ওদের আঙুল ছুঁয়ে গেল।
তিথি বলল, “তুই যদি চাইস, আমরা আবার শুরু করতে পারি। ধীরে ধীরে। কোনো তাড়া নেই। শুধু একটু সাহস লাগে।”
অর্ণব মাথা নাড়ল। “এই সাহসটাই তো চাইছিলাম তোর থেকে। শুধু একটা কথা চাই, তুই আর পালিয়ে যাস না। রাগ করলেও থেকো, বোঝো, বলো।”
“আর তুই,” তিথি বলল, “আমার কন্ঠস্বরের পেছনে সত্যি খুঁজবি। চুপ করলেই যেন বুঝিস, আমি ভালো নেই।”
চা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে, কিন্তু দুজনের বুকের মধ্যে শুরু হয়েছে নতুন এক উত্তাপ।
“তুই কি কাল রাতে ফাঁকা আছিস?” অর্ণব হঠাৎ জিজ্ঞেস করল।
“আছি। কেন?”
“দেখতে ইচ্ছে করছে—পুরোনো সেই ‘চিকেন চিলি-মোমো’ রেস্টুরেন্টটা এখনো আছে কি না।”
তিথি হেসে ফেলল। “তখন তুই খেতিস পাঁচ প্লেট। এখন তোর কি গ্যাস্ট্রিক নেই?”
“তুই থাকলে গ্যাস্ট্রিকও পালিয়ে যায়,” অর্ণব মুচকি হেসে বলল।
হেসে উঠল দু’জনেই। শহরের রাত তখন মৃদু আলোয় মোড়ানো, আর তাদের বুকের মধ্যে একটাই প্রশ্ন বাজছে—এবার কি তারা সত্যিই পারবে পুরোনো স্বপ্নটাকে নতুন করে বুনে নিতে?
চা শেষ। ছাতাটা এবার তিথির হাতে। রেনকোটটা এবার দু’জনেই ভাগ করে নিতে পারত, যদি দরকার হতো। কিন্তু আজ আর বৃষ্টি নেই। শুধু বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে এক পুরোনো, খুব পুরোনো গল্পের নতুন করে লেখা শুরুর গন্ধ।

পর্ব ৬: “চিকেন চিলি আর চশমার ভেতর চোখ”

রাত সাড়ে আটটা। শহরটা তখনও জেগে, তবে ব্যস্ততা একটু ধীর হয়েছে। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় রাস্তা সোনালি দেখাচ্ছে, আর সেই আলোর নিচে তিথি দাঁড়িয়ে আছে—হাতের ফোনে অর্ণবের মেসেজ পড়ছে:
অর্ণব: “আমি পৌঁছে গেছি। তোকে দেখে তারপর ঢুকব।”
তিথি মুচকি হাসল। অর্ণব আগেও এমনই ছিল—প্রথম দেখা, প্রথম সিনেমা, প্রথম প্রেজেন্টেশন—সব সময় দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করত যতক্ষণ না তিথি আসে। যেন তার সমস্ত শুরুতে তিথির উপস্থিতিই আবশ্যিক।
তিথি এলোমেলো করে চুল গুছিয়ে নিল। আজ সে লাল-কালো ছাপার একটা কুর্তি পরেছে, আর চোখে হালকা কাজলের রেখা। বাইরে থেকে যতটা নির্লিপ্ত মনে হচ্ছিল, ভিতরে ততটাই উদ্বেল। আজ যে তার সেই প্রথম প্রেম তাকে আবার রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছে—একটা সাধারণ রাতকে একটু ‘বিশেষ’ করে তোলার জন্য।
রেস্টুরেন্টটা এখনও আছে—পেছনের গলির ধারে, যেখানে আগে তাদের কলেজ ফ্রেন্ডরা টিউশন শেষ করে জমত। তখন দামি রেস্টোরেন্ট নয়, টেবিল প্লাস্টিকের, ভেতরটা একটু গরম, কিন্তু চিকেন চিলির টেস্ট ছিল অনবদ্য।
তিথি একবার জানালার ভেতর তাকিয়ে দেখল—রান্নার ধোঁয়া, কাচের গায়ে ঘাম জমেছে। হঠাৎ পেছন থেকে গলা এল—”চলবি?”
অর্ণব দাঁড়িয়ে, গাঢ় নীল শার্টে। চোখে চশমা, যেটা আগে সে পরত না। কিন্তু তিথি দেখল, সেই চোখ—যেটা দেখে সে একদিন রিকশা থেকে নামতে ভুলে গেছিল—এখনও আগের মতোই গভীর।
“চশমা পড়িস এখন?” তিথি হাসল।
“বয়স বাড়ছে,” অর্ণব বলল। “তুই তো আগের মতোই আছিস।”
“এটাই তোর সমস্যা,” তিথি বলল। “তুই সবকিছুকে আগের মতো ভাবিস। আর তাই হারিয়ে ফেলিস।”
অর্ণব থামল। “তুই কি বলছিস আমি তোকে হারিয়েছি?”
তিথি চুপ করে গেল।
“না,” সে বলল। “তুই হয়তো আমাকে হারাওনি। আমি নিজেই সরে গেছিলাম। আমার রাগ, আমার ভয়, আমার অবিশ্বাস—সব মিলিয়ে একটা দেয়াল তৈরি করেছিলাম। এখন ভাবি, সেই দেয়ালের ওদিকে তুই হয়তো হাত বাড়িয়ে ছিলি।”
অর্ণব একটু এগিয়ে এসে বলল, “আজ তো আমরা দু’জনেই সেই দেয়ালটা ভেঙে ফেলছি, তাই না?”
তিথি মাথা নাড়ল। তারপর দু’জনে ঢুকল রেস্টুরেন্টে।
ভেতরটা আগের মতোই। দেয়ালে সেই একই পুরোনো ফটো—ক্যালেন্ডার ঝুলছে ২০২১ সালের, কেউ হয়তো নতুনটা লাগায়নি। একটি ওয়েটার এসে হাসিমুখে বলল, “চিকেন চিলি? একই অর্ডার তো?”
তিথি চমকে বলল, “তুমি চিনলে?”
“আপনারা তো আসতেন অনেক আগে। একসাথে বসতেন ঐ কোণার টেবিলে,” ওয়েটার হেসে বলল। “আমি তখন নতুন ছিলাম। কিন্তু আপনাদের মতো কাপল খুব কম আসত। খুব চুপচাপ, কিন্তু খুব মিষ্টি।”
তিথির মুখ হালকা লাল হল। অর্ণব মুচকি হেসে বলল, “আমরা আবার আসছি এখন। পুরোনো স্মৃতি ঝালাই করতে।”
চিকেন চিলি এল। গরম ধোঁয়ায় জিভে জল এসে গেল। অর্ণব কাঁটা চামচে তুলে এক টুকরো মুখে নিল—“সেই স্বাদ,” সে বলল। “অবিকল আগের মতো।”
“আর কিছু তো বদলায়নি,” তিথি বলল। “শুধু আমরা বদলে গেছি।”
“না, আমি বদলাইনি,” অর্ণব বলল। “তুই ছাড়া আজও কারো সঙ্গে এমন খোলামেলা কথা বলতে পারিনি।”
তিথি এবার সরাসরি তার চোখে তাকাল। “তুই কি সত্যিই আবার শুরু করতে চাস?”
অর্ণব বলল, “হ্যাঁ। আমি চাই… তবে এইবার তুই আমাকে থামতে বলবি না। আমি থাকতে চাই, শুনতে চাই, ধৈর্য রাখতে চাই। আগে পারিনি। এবার পারব।”
“আর যদি আমরা আবারও ভুল করি?” তিথির গলা কাঁপল।
“তাহলে এবার ভুলটা আমরা একসাথে করব,” অর্ণব বলল। “যেন একা কাউকে দোষ দিতে না হয়।”
তিথির চোখে জল জমল। সে মুখ ফিরিয়ে বাইরে তাকাল—বৃষ্টি পড়ছে না, কিন্তু গাড়ির হেডলাইটে ভেজা রাস্তাগুলো চকচক করছে। সেই আলোয় যেন দেখা যাচ্ছে—একটা নতুন সম্ভাবনা, একটা নতুন স্বপ্ন।
“তুই তো জানিস, আমি গল্প ভালোবাসি,” তিথি বলল।
“হ্যাঁ, তোর লেখা পড়েছি অনেক,” অর্ণব বলল। “তুই যে একটা গল্পের মতো নিজেই।”
“তাহলে চল,” তিথি হাসল। “এই গল্পটাও লিখি। আমি আর তুই। রেনকোটে, কফিতে, আর একটু সাহসে।”
অর্ণব হাতটা বাড়াল টেবিলের ওপর দিয়ে। তিথির আঙুলগুলো থরথর করছিল, কিন্তু এবার সে পিছু হটল না।
দু’জনে হাত ধরল—প্রথমবার নয়, আবারও একবার।
রেস্টুরেন্টের ভিতর তখন হালকা রব উঠেছে, কিছু কলেজ পড়ুয়া হাসছে, কেউ ভিডিও কল করছে। কিন্তু কোণার সেই টেবিলে, অদ্ভুত শান্তি। দুটো চশমার কাচে, দুটো চোখে, আর একটা খোলা মনে—পুরোনো ভালোবাসা আবার ফিরে এল।
বাইরে তখন বাতাস বইছে। রেনকোট হয়তো আর লাগবে না।
কিন্তু আজকের রাতে, তার দরকার নেই।
কারণ বৃষ্টি নয়, এবার ভালোবাসাই তাদের ভিজিয়ে দিচ্ছে।
পর্ব ৭: “ভোরের মেসেজ আর মন খারাপের রোদ”

ভোর পাঁচটা।
তিথির ফোনটা বিছানার পাশে কাঁপতে কাঁপতে একটানা শব্দ করে চলেছে। চোখ আধখোলা অবস্থায় সে ফোনটা হাতে নিল। নোটিফিকেশন স্ক্রিনে অর্ণবের নাম ঝলমল করছে।
অর্ণব: “তুই জেগেছিস?”
অর্ণব (১ মিনিট পরে): “বোধহয় না। ঘুমো। কেবল ভোরের আলো দেখে তোকে মিস করলাম।”
তিথি চোখের পাতা কচলাতে কচলাতে উঠে বসল। জানালার ফাঁক দিয়ে আসছে গোলাপি আলো—সেই রকম একটা সকাল, যেটা আগেও দু’জনে একসাথে দেখেছে কলেজের শেষবেলার প্রেজেন্টেশন বানাতে বানাতে, যখন ঘুম ছাড়া জীবন ছিল কফি আর স্বপ্নে ভরা।
একটু থেমে সে উত্তর দিল।
তিথি: “জেগে গেছি। তোর এই মেসেজটা আজকের প্রথম রোদ।”
অর্ণব: “ভাল লাগছে?”
তিথি: “ভয়ও লাগছে।”
অর্ণব: “কেন?”
তিথি: “ভালবাসা যখন ফিরে আসে, তখন মনটা অদ্ভুত রকমের শান্ত-অশান্ত হয়ে যায়। আগের ভুলগুলো মনে পড়ে।”
অর্ণব: “এইবার আমি আর তুই, দু’জনেই জানি—ভুল না করে থাকার চেয়ে, ভুল করলে একসাথে থাকা ভাল।”
তিথি: “আজকে দেখা হবে?”
অর্ণব: “লাঞ্চ টাইমে, তোর অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে থাকব। ঠিক আগের মতো।”
তিথির ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটে উঠল। সে জানত, এই ফিরে আসাটা গল্পের মতো হলেও বাস্তবের অনেক জটিলতা থাকবে। কিন্তু আজকের আলোটা একটু আলাদা। এই সকালটা শুধুই তার।
________________________________________
দুপুর বারোটা।
তিথি জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ফোনে তাকিয়ে রইল। অফিসের নিচে রিকশা, গাড়ি, মানুষজনের গমনাগমন—সবকিছু ছাপিয়ে তার চোখ একটানা খুঁজে চলেছে একটি মুখ, একটি রেনকোট, একটি চোখজোড়া, যেগুলো হঠাৎ ভিড়ের মাঝে উঠে আসবে বলে সে জানে।
অবশেষে অর্ণব এল। রোদ্দুরে চোখ কুঁচকে হাঁটছে, হাতে একটা প্যাকেট। ছায়ার নিচে এসে দাঁড়িয়ে বলল, “তোর জন্য lunch নিয়ে এসেছি—প্লাস্টিক বক্সে নয়, নিজের হাতে বানানো।”
তিথি অবাক, “তুই রান্না করিস? এটা তো ব্রেকিং নিউজ!”
“আসলে তোর জন্যই শিখেছি,” অর্ণব বলল। “তুই যেদিন বলেছিলি, একজন পুরুষ তখনই পরিপূর্ণ হয় যখন সে নিজের খিদেটা মেটাতে পারে নিজে হাতে… মনে আছে?”
তিথি হেসে ফেলল। “মনে আছে, কিন্তু আমি তখন সেটা মজার ছলে বলেছিলাম।”
“আমি সিরিয়াসলি নিয়েছিলাম,” অর্ণব বলল। “কারণ তোর বলা মজাগুলোও একধরনের সত্যি ছিল।”
ওরা কাছের একটা ছোট পার্কে বসল। অফিসের আশেপাশে এরকম জায়গা পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। কিছু গাছ, কয়েকটা বেঞ্চ আর দূরে পুকুর। একসময় যেখানে সিগারেট খেতে গিয়ে কথা বলত, আজ সেখানে বসে খাচ্ছে পনির পরোটা আর দই, নিজের হাতে বানানো।
“ভালো বানিয়েছিস,” তিথি বলল। “একদম খাবারের মধ্যে গল্প আছে।”
“আমাদের গল্পটা কী নামে চালানো যেতে পারে বল তো?” অর্ণব বলল।
“রেনকোটে কফি?” তিথি বলল।
“আর পরোটায় প্যাচ?” অর্ণব হাসল।
“আর দইয়ে দ্বিধা,” তিথি যোগ করল।
ওরা হাসল। সেই কলেজ দিনের মতো। কোনো ছুতো ছাড়া হাসতে পারা, কোনো কারণ ছাড়া মনের মধ্যে রং লাগা—এই অনুভূতিগুলো খুব চেনা।
তবে এই আনন্দের মধ্যেও ছিল একটা অদ্ভুত গাম্ভীর্য। তিথি জানে, এত সহজে ফিরে আসা যায় না। জীবন থেমে থাকেনি তাদের কারো জন্যই। দুজনেরই আলাদা পথ হয়েছে, আলাদা ব্যথা হয়েছে, আর তবুও আজ আবার একসাথে বসে থাকা মানে শুধুই ‘ভালো লাগা’ নয়—এ এক ধরনের সাহস।
“তুই কখনো ভাবিসনি যে আমি আবার তোর জীবনে আসব?” অর্ণব জিজ্ঞেস করল।
“অনেকবার ভেবেছি,” তিথি বলল। “তোর ফেসবুক প্রোফাইল দেখতাম, তোর ছবিতে ‘লাইক’ করতাম না কিন্তু সব পড়তাম। ভেবেছিলাম, একদিন না একদিন তুই ফোন করবি। করিসনি। ভাবলাম, শেষ হয়ে গেছে।”
“তুই তো বলেছিলি, ‘আর ফোন কোরো না’,” অর্ণব বলল। “তখন ভয় পেয়ে গেছিলাম। ভাবছিলাম, তুই বোধহয় আর চাইছিস না।”
“আমরা কেউই বলতে পারিনি, ‘আমার এখনও প্রয়োজন আছে’,” তিথি বলল।
“তাহলে এবার যদি আমি বলি—‘আমার তুই দরকার’, তুই ফিরবি?” অর্ণব ধীরে বলল।
তিথি একটু থেমে বলল, “আমি কখনোই যাইনি। শুধু চুপ করে গেছিলাম।”
অর্ণব তার হাত ছুঁয়ে বলল, “তাহলে আর চুপ না। এবার কথা হোক—প্রতিদিন, একটু করে। ঝগড়া হলেও বোঝাব, দূরত্ব হলেও ছুঁয়ে থাকব। ভালোবাসা এবার হারালে আর নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না।”
তিথির চোখে জল আসতে চাইল, কিন্তু সে তা ঠেকাল।
“তোর এই ভয়টুকুই আমাকে ফিরিয়ে আনছে, জানিস?” সে বলল। “ভালোবাসা শুধু রোমান্স না, ভয়টাও ভালোবাসা।”
“তোর ভয় কি?”
“তুই আবার হারিয়ে যাবি,” তিথি বলল। “এইবার সাহস করে বলছি—তুই হারাস না, প্লিজ।”
অর্ণব তিথির কাঁধে হালকা হাত রাখল।
“তুই এই কথাটা বললিস, মানে এই গল্পটা এবার সত্যি হতে শুরু করেছে।”
ওদের চারপাশে তখনো অফিসের শব্দ, গাড়ির হর্ন, কেউ কেউ ফোনে কথা বলছে। কিন্তু পার্কের এই কোণটা হয়ে উঠেছে এক টুকরো নির্জনতা, যেখানে ‘ভালোবাসা ফিরে আসা’ আর ‘ভুলগুলোকে ক্ষমা করতে পারা’—এই দুই অনুভূতি চুপচাপ পাশাপাশি বসে আছে।
তিথি জানে, অর্ণব এখন অনেকটা বদলে গেছে। সে আর সেই একরোখা, জেদি ছেলেটা নেই। তার চোখে এখন ধৈর্য, তার কথায় এখন ব্যথার ভার, আর তার আচরণে একরকম স্নিগ্ধ অনুশোচনা।
আর সে নিজেও পালটে গেছে। আগে সবকিছু জিততে চাইত, এখন বোঝে—হারেও একধরনের শান্তি আছে যদি সেটা প্রিয় মানুষের হাত ধরে হয়।
“আজ তোকে দেখে একটা জিনিস বুঝলাম,” তিথি বলল।
“কি?”
“তুই আমার পুরোনো অর্ণব নোস না, তুই আমার নতুন সাহস।”
অর্ণব চোখ বন্ধ করল এক মুহূর্ত।
এই লাঞ্চটাইমে, এই আধঘণ্টা, এই আধপেট ভাত আর কথার মধ্যে দিয়েই একটা নতুন সম্পর্ক জন্ম নিল—যেটা হয়তো শুরু হয়েছিল অনেক আগেই, কিন্তু এবার ঠিক করে ফিরে এসেছে।
প্যাকেটটা গুছিয়ে তিথি বলল, “আবার দেখা হবে তো?”
“রোজ,” অর্ণব বলল। “এই শহর যতদিন জেগে থাকবে, আমি তোর পাশে থাকব।”
তারা দু’জনে পার্ক থেকে বেরিয়ে এলো। এবার আর কেউ চুপচাপ থাকল না। মুখে হয়তো কোনো কথা ছিল না, কিন্তু চোখে ছিল এক অব্যক্ত ভাষা—যেটা শুধু সেই মানুষটা পড়তে পারে, যে একদিন ছেড়ে গেছিল… আর আজ ঠিক করে ফিরে এসেছে।

পর্ব ৮: “মেঘলা ছাদ, বন্ধ জানালা”

বিকেল পাঁচটা বাজে। অফিসের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে তিথি দেখে, আকাশটা ধূসর হয়ে এসেছে। আবারও বৃষ্টি নামবে বোধহয়। সে জানালার কাঁচে হালকা হাত ছোঁয়ায়, ভেতরের কাচ ঠান্ডা। এমন দিনে এক কাপ কফির চেয়ে বেশি প্রিয় কিছু হয় না—আর এখন সেই কফির সঙ্গে একটা মুখও আছে যার কথা মনে পড়লেই গাল থেকে কানের কোণে হালকা হাসি খেলে যায়।
আজ ওদের দেখা হয়নি। কাজের চাপ, টিম মিটিং, সারাদিন ছুটোছুটি। তবুও একটা অপেক্ষা বুকের মধ্যে রয়ে যায়। যেভাবে বৃষ্টির আগে মেঘ জমে, ঠিক সেভাবেই একটা ঘন নীরবতা জমেছে তিথির চারপাশে।
হঠাৎ ফোনটা ভাইব্রেট করে উঠল।
অর্ণব:
“আজকের দিনটা ভীষণ গোলমেলে হয়ে গেল। প্ল্যান করে কিছুই হলো না। তোকে একবার দেখলে সব ঠিক হয়ে যেত।”
“তুই ব্যস্ত?”
তিথি এক মুহূর্তে রিপ্লাই দিল না। বুকের ভেতরে একরকম অবসন্নতা, একরকম ইচ্ছা ও অনিচ্ছার লড়াই। আজকে তার মনটা অদ্ভুত রকমের গুছিয়ে নেই—যেন সবকিছু এলোমেলো, আবার যেন কোথাও কিছু গেঁথে গেছে।
সে ধীরে ধীরে টাইপ করল—
“না, আমি ব্যস্ত না। কিন্তু আজ একটু একা থাকতে ইচ্ছে করছে।”
অর্ণব রিপ্লাই দিল না। এক মিনিট… দুই মিনিট… পাঁচ মিনিট…
অদ্ভুত এক চুপচাপ সময় দাঁড়িয়ে থাকল তিথির পাশে। সে জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখল, ছাদের ধারে দুটো কাক বসে আছে, ঠোঁট নিচু করে, মাথা কাঁপিয়ে কাঁপিয়ে কিছু বলছে নিজেদের মধ্যে। হয়তো বৃষ্টি নিয়ে, হয়তো অপেক্ষা নিয়ে।
ঠিক তখনই মেসেজ এল—
“চাইলে আমি চুপচাপ পাশে বসে থাকতে পারি। কথা বলব না। তুই যদি শুধু একটু জানালাটা খোলাস।”
তিথির বুকটা ধক করে উঠল।
তাদের প্রেমে যতটা শব্দ ছিল, তার চেয়েও বেশি ছিল নীরবতা। একসাথে হেঁটে চলা, একসাথে ট্রামে বসে চুপচাপ জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকা—তিথি জানে, অর্ণব মুখে যত কম বলত, তার ভালোবাসা ঠিক তত গভীর ছিল।
সেই চুপচাপ পাশে থাকা ভালোবাসারও তো একটা ভাষা থাকে।
হঠাৎ মেইলের সাউন্ড এল। মনটা কাজের মধ্যে ফেলার চেষ্টা করল সে। কিন্তু অর্ণবের ওই মেসেজটা তাকে এলোমেলো করে দিয়ে গেছে।
তিথি নিজের ডেস্ক ছেড়ে বারান্দার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। অফিস বিল্ডিংয়ের ছাদটা স্পষ্ট দেখা যায় এখান থেকে। আশ্চর্য, এক মিনিটের মধ্যে অর্ণব সত্যিই সেখানে দাঁড়িয়ে।
ছাতাহীন, ধোঁয়াটে আকাশের নিচে দাঁড়ানো ছেলেটার মুখে কোন অভিমান নেই, নেই কোনো অভিপ্রায়ও—শুধু চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। যেন সে বলছে, “তুই যদি দরজা না খোলিস, আমি ছাদে থাকব। শুধু যেন জানালাটা খোলা থাকে।”
তিথির মনে পড়ল, একবার খুব রেগে গিয়ে সে অর্ণবকে বলেছিল, “আমার জীবনে তুই জানালার মতো—খুলে দিলেই আলো, বন্ধ করলেই অন্ধকার।”
অর্ণব মুচকি হেসে বলেছিল, “তবে আমি চেষ্টা করব, জানালাটা যেন আর কখনও বন্ধ না হয়।”
তিথি জানে না, চোখের কোনটায় হঠাৎ জল এসে গেল। হয়তো এতটুকু চুপচাপ ভালোবাসার সামনে দাঁড়িয়ে থেকে কার না গলা ভারী হয়?
সে ব্যাগটা গুছিয়ে অফিস থেকে বেরোল। লিফটে চেপে ছাদে গেল। ছাদটা বেশ ফাঁকা, কেবল কয়েকটা AC ইউনিটের ফ্যান ঘুরছে, আর হাওয়ায় চুল উড়ছে।
অর্ণব তাকিয়ে বলল, “তুই জানিস, তোর অফিসের ছাদটা এত চেনা লাগছে কেন?”
তিথি তাকিয়ে বলল, “কেন?”
“কারণ, তোকে আমি সবসময় এইরকম ওপর থেকে দেখি। ভেবে নিই, তুই আকাশের একটা অংশ।”
তিথি এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, “তুই কি জানিস, আমি সবসময় তোকে ছায়ার মতো পাই। সামনে থাকিস না, তবু আমার সাথে থাকিস।”
দু’জনেই একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইল। তিথির চোখে আজ আর কোনো কষ্ট নেই, নেই কোনো অভিমান। আছে শুধু কুয়াশা ভেজা ক্লান্তি, আর একরকম অদ্ভুত মুক্তি।
“তুই কি আজ সত্যি বলতে এসেছিস, না চুপ থাকতে?” তিথি জিজ্ঞেস করল।
“আমি চাই, তুই যা বলবি, তাই শুনব। যদি চুপ থাকতে চাস, আমি চুপ থাকব।”
তিথি একটু এগিয়ে এসে হাতটা অর্ণবের হাতে রাখল। “তুই আজ চুপ করে থেকেও যা বলছিস, তা সবকিছুর চেয়ে বেশি সত্যি।”
বৃষ্টি পড়ল না। তবু ছাদটা ভিজে উঠল। হয়তো ওদের দু’জনের চোখের ভেজা জলেই।
তারা দু’জনে ছাদে দাঁড়িয়ে রইল। কেউ কিছু বলল না। জানালার বাইরে থেকে দেখা যাবে না, কিন্তু ওই ছাদের কোণায় দু’টো মানুষ নিজেদের জীবনের সবচেয়ে সুন্দর নীরব কথোপকথনে জড়িয়ে থাকল।
তিথি জানাল, সম্পর্ক শুধু একে অপরকে জিতে নেওয়ার নয়, কখনও কখনও একে অপরকে চুপচাপ বোঝারও।
অর্ণব জানাল, ভালোবাসা শব্দে নয়, উপস্থিতিতে টিকে থাকে।
আর জানালাটা… ওটা আজও খোলা। ঠিক যেমন ওদের প্রেম, অনেক ঝড়, অনেক দোটানার পরেও… এখনও খোলা।

পর্ব ৯: “ভাঙা গান, ভেজা সন্ধ্যে”

সন্ধ্যা নামার আগেই শহরের গায়ে জড়িয়ে বসেছে একরকম হালকা হাওয়া। গড়িয়াহাট থেকে রবীন্দ্র সদন পর্যন্ত রাস্তার আলোগুলো জ্বলছে, কিন্তু এখনও পুরোপুরি অন্ধকার নামেনি। একটা সময় যেন থমকে আছে, ঠিক যেমন থেমে ছিল তিথির মন গত কিছুদিন।
তিথি আজ হঠাৎ একা হাঁটছে। অফিস থেকে বেরিয়েই সে হেঁটে চলেছে, কোনো গন্তব্য নেই। ফোনটা সাইলেন্টে রাখা, অর্ণবের কোনো মেসেজ দেখেনি সারাদিন। কিন্তু আজ কোনো ব্যস্ততা ছিল না, কোনো রাগও নয়। বরং মন চেয়েছিল একটা নিজের মতো সময়, যেন ভিতরের গোলমালগুলোকে একা চুপ করে শোনে।
তিথির মনে পড়ছে একটা গান, যেটা তারা একসাথে শুনত—
“তুমি রবে নীরবে, হৃদয়ে মম…”
শব্দগুলো আজ যেন বুকের ভিতর ভাঙতে ভাঙতে বাজছে।
এই যে সম্পর্ক আবার আসছে, ধীরে ধীরে, কুয়াশার মতো, এটাকে কি আবারও ছুঁয়ে দেখা সম্ভব? নাকি আবার হারিয়ে যাবে—একটা ভেজা পৃষ্ঠায় লেখা অপূর্ণ কবিতার মতো?
একটা সময় ছিল, যখন অর্ণবের হাত ধরা মানেই নিশ্চিন্ত এক ভরসা। এখন সেই হাত আবার বাড়িয়ে দিয়েছে ছায়ার মতো। কিন্তু এবার তিথির ভয় হচ্ছে—এই নতুন বাঁধনে যদি পুরোনো ব্যথাগুলো জেগে ওঠে?
ওর মনে পড়ল সেই সন্ধ্যাটা, বছর তিনেক আগে—যেদিন অর্ণব চুপচাপ চলে গেছিল। কোনও শব্দ ছাড়া, কোনও কারণ না জানিয়ে, শুধু একটা মেসেজ রেখে—
“তুই যেভাবে চাস, আমি সেভাবে থাকতে পারি না।”
সেই মেসেজটার স্ক্রিনশট আজও তিথির ফোনে আছে, মুছতে পারেনি। অনেকদিন পর আবার সেই অনুভূতি আজ সন্ধ্যাবেলায় ফিরে এলো—একটা হালকা কষ্ট, যা চোখে জল আনে না, কিন্তু বুক ভার করে।
পেছন থেকে একটা গলা এলো—
“তুই জানিস, তুই হাঁটতে হাঁটতে নিজেই একটা গান হয়ে যাচ্ছিস?”
তিথি থেমে তাকাল—অর্ণব।
ধূসর শার্ট, হাওয়ায় ওড়ানো চুল, আর চোখে সেই পুরোনো শান্তি। সে হাসল না, তিথির মতোই গম্ভীর মুখে বলল, “সারাদিন কোনো মেসেজ করিসনি। ভয় পেয়েছিলাম।”
তিথি ধীরে বলল, “আমি ভেবেছিলাম, যদি চুপ করে থাকি, তুই নিজে থেকে বোঝার চেষ্টা করবি। আর তুই করেছিস।”
“আমি এখন আর আগের মতো নেই,” অর্ণব বলল। “আগে যদি তুই চুপ করতি, আমি অভিমান করতাম। এখন শুধু ভাবি, কেন চুপ করলি? কি বলছিস না?”
তিথি তার দিকে তাকিয়ে বলল, “আজকের সন্ধ্যাটা অদ্ভুত, অর্ণব। মনে হচ্ছে আমরা ঠিক যেমন একটা গান গাইতে পারি, তেমনই গানের মধ্যেই হারিয়ে যেতে পারি।”
“তুই কি হারিয়ে যেতে চাস?” অর্ণব জিজ্ঞেস করল।
“না,” তিথি বলল। “আমি হারিয়ে যেতে চাই না। আমি চেয়ে আছি—আমরা যেন গানটা শেষ করতে পারি। আগের বার যেটা অসমাপ্ত ছিল।”
তারা দুজনে হাঁটতে শুরু করল—শান্ত রাস্তায়, যেখানে কেবল গাড়ির ধীর শব্দ আর দূরের বৃষ্টির গন্ধ। বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে কিসের যেন অপেক্ষা—একটা নতুন অধ্যায়ের, অথবা পুরোনো কোনো ব্যথার নিঃশেষের।
“তুই জানিস, গতকাল রাতে একটা কবিতা লিখেছিলাম,” অর্ণব হঠাৎ বলল। “তোর জন্য।”
তিথি চমকে তাকাল, “কবিতা? তুই তো আগে লিখতিস না।”
“তুই তো আগে আমায় ছেড়ে যেতে বলতিস না,” অর্ণব হেসে ফেলল।
“শোনাবি?” তিথি জিজ্ঞেস করল।
অর্ণব মুখে ধীরে উচ্চারণ করল—
“তুই ফিরে আসিস রোজ একটুখানি করে—
কখনও চায়ের কাপে, কখনও কপালের রেখায়।
আমি ভাবি, প্রেম বুঝি এমনই—
ভাঙা গান, তবু প্রতিদিন গাওয়ার ইচ্ছে।”
তিথি থেমে গেল। চোখে জল আসেনি ঠিক, কিন্তু তার ভেতরের কোনটা যেন আচমকা ভিজে উঠল।
“তুই এখন অনেক বেশি বড় হয়েছিস,” সে বলল।
“বড় হইনি,” অর্ণব বলল। “শুধু বুঝতে শিখেছি—ভালোবাসা কখনোই নিখুঁত হয় না। বরং সেটা ভাঙা জায়গাগুলোতেই সবচেয়ে বেশি সত্যি।”
ওরা দুজন বসে পড়ল রাস্তার ধারে এক পাথরের বেঞ্চে। সামনে গোল ল্যাম্পপোস্ট, রোদের আলো নেই, শুধু একটা গাঢ় হলুদ আলো তাদের মাথার ওপর ঝুলছে, ঠিক যেন কোনো থিয়েটারের মঞ্চ আলো।
“তুই জানিস,” তিথি বলল, “আজকের এই সন্ধ্যাটা এতদিন পর আমার মনে শান্তি দিল। কিছু না বলেও, তুই পাশে আছিস… এটা আমি যেন খুব করে চাইছিলাম।”
“আমারও,” অর্ণব বলল। “আমি চাই, তুই রোজ সন্ধ্যায় আমার গল্প হ, আর আমি তোর চুপ থাকা।”
“তুই কি আমায় ভালোবাসিস, অর্ণব?” হঠাৎ তিথি প্রশ্ন করল।
অর্ণব সোজা চোখে তাকাল। “তোর যদি মনে হয়, তুই আমায় ভালোবাসিস, তাহলে জানবি—আমি তার চেয়েও বেশি ভালোবাসি।”
তিথি হাত বাড়িয়ে অর্ণবের হাত ধরল। ভেজা সন্ধ্যাতে, ভাঙা গানের মতন তার মনটা আবার ছুঁয়ে গেল সেই প্রিয় শব্দ—ভালোবাসা।
আজ আর কোনো ঝড় নেই। শুধু একটা শান্ত ব্যথা, আর সেই ব্যথার মধ্যেই সুর।
তারা দু’জনে মিলে আবার হাঁটতে লাগল—বৃষ্টির ধারে, স্মৃতির রেখায়, আর প্রেমের নতুন পংক্তিতে।

পর্ব ১০: “তোমার চোখে বৃষ্টি ছিল”

সকাল ছ’টা। আকাশ মেঘলা নয়, কিন্তু পুরোপুরি পরিষ্কারও নয়। তিথি বারান্দায় বসে কফির কাপটা হাতে নিয়ে চুপচাপ তাকিয়ে আছে সামনের রাস্তার দিকে। রাতের বৃষ্টি শুকিয়ে গেছে, কেবল রাস্তায় একটু চকচকে ভাব। পেঁচানো গাছপালা, সাইকেল নিয়ে যাচ্ছেন দুধওয়ালা, নিচে গাড়ির শব্দ—সব মিলিয়ে শহরটা আবার নতুন করে জেগে উঠছে।
তিথির মনের মধ্যে আজও একটা অদ্ভুত প্রশান্তি। কাল রাতে অর্ণবের কবিতা, তার কথা, আর রাস্তার ধারে বসে থাকা সেই নিঃশব্দ সন্ধ্যে—সবকিছু মিলে মনে হচ্ছিল, যেন একটা অধ্যায় শেষ হচ্ছে না, বরং দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা বইটা আবার খুলে গেছে।
তিথি স্মরণ করছিল—
“তুই যদি মনে করিস, ভালোবাসা আবার শুরু করা যায়, তবে আমি আছি—রোজ সকালে, এক কাপ কফির পাশে, জানালার বাইরের মেঘের ভেতর।”
অর্ণব বলেছিল ওকে… আর তিথি সে কথায় বিশ্বাস করতে শুরু করেছে।
হঠাৎ ফোনটা ভাইব্রেট করল।
অর্ণব:
“ভোরে ঘুম ভাঙতেই কেমন যেন একটা শান্তি পেলাম। জানি না, তোকে ছাড়া ঘুমের মধ্যেও এত আরাম কখনও পাইনি। তুই যদি চাস, আজ একটা পাগলামি করি?”
“চল কোথাও যাই। একদিনের ছুটি নিয়ে। শহর থেকে বেরিয়ে। কোথাও, যেখানে কেউ আমাদের চিনবে না। আমরা শুধু আমরা থাকব।”
তিথির ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল। কফির কাপ থেকে ধোঁয়া উঠছে, আর সেই ধোঁয়ার ফাঁকে যেন একটা ছোট্ট স্বপ্ন দেখা যাচ্ছে।
তিথি: “চল। এক কাপ কফির মতো যদি দিনটাকে ভাগ করে নেওয়া যায়, আমি রাজি।”
দুপুরবেলা তারা দু’জনে চলে গেল নিউ টাউন-এর বাইরের দিকে, একটা শান্ত জায়গায়—বাঁধানো রাস্তা, ছায়ায় ঢাকা ছোট্ট এক কফি শপ, যেখানে বাইরের লোকজন খুব একটা আসেও না। শহরের ভেতর থেকেও শহরের বাইরে থাকার মতো অনুভব।
কফি শপের জানালার ধারে একটা টেবিল বেছে নিয়ে বসে তিথি আর অর্ণব।
ওয়েটার এসে জিজ্ঞেস করল, “কী আনব?”
তিথি বলল, “একটা কফি—এক কাপ, দুটো কাপ চাই।”
ওয়েটার একটু অবাক হলেও মুচকি হাসল।
অর্ণব বলল, “এইভাবেই তুই সবকিছু ভাগ করিস, তাই না?”
তিথি বলল, “ভাগ না করলে তো ভালোবাসা অসম্পূর্ণ থেকে যায়।”
কফির কাপ আসতেই দু’জনেই নিঃশব্দে তাকিয়ে রইল। বাইরে সূর্যের আলো কাচে পড়ে, এক অদ্ভুত দোলা তৈরি করছে।
“তুই জানিস,” অর্ণব বলল, “তোর চোখে এখনো বৃষ্টি রয়ে গেছে।”
তিথি চমকে তাকাল। “মানে?”
“সেই চোখ, যেটা একদিন বৃষ্টির দিনে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল, যখন তুই বলেছিলি—‘যা খুশি করো’। আমি ওই চোখের দৃষ্টি আজও ভুলি না। ওই চোখে আমি ভাঙন দেখেছি। কিন্তু আজ ওই একই চোখে আমি ভালোবাসা দেখি।”
তিথি হেসে ফেলল। “তুই এত নাটুকে কবে হলি?”
“যেদিন তোকে হারিয়েছিলাম,” অর্ণব বলল শান্ত স্বরে।
“তাহলে এবার নাট্যশালায় ভর্তি হয়ে যা,” তিথি বলল। “নয়তো আমি তোকে রোজ নাটকে ফেলব। প্রথম অঙ্কে রাগ, দ্বিতীয় অঙ্কে চোখ রাঙানি, তৃতীয় অঙ্কে চুপচাপ অভিমান—শেষ অঙ্কে একটা চুমু।”
অর্ণব হাসল। “চুমুটা যদি আগে দিয়ে দিস, তাহলে বাকিগুলো সহ্য করতে পারব।”
তিথির গাল লাল হয়ে উঠল, কিন্তু সে মুখ নামিয়ে চুমুক দিল কফিতে। এক কাপের মধ্যে ভাগ করা ভালোবাসার সেই পুরোনো স্বাদ।
বাইরে বৃষ্টি নামল হঠাৎ করেই—একদম হালকা, নিরব। অর্ণব উঠে দাঁড়াল।
“চল, বাইরে দাঁড়াই। আজ রেনকোট আনিনি। ভিজে যাই।”
তিথি বলল, “ভিজতে আমি ভয় পাই না। ভয় পাই, যদি তুই আবার ভিজে পালিয়ে যাস।”
অর্ণব তিথির মুখে হাত রাখল। “আমি কোথাও যাব না। তোকে ছেড়ে আর না।”
তারা দুজন দাঁড়িয়ে গেল বৃষ্টির নিচে। কেউ ছাতা ধরল না, কেউ লুকোলো না। কেবল হাত ধরল—একটু শক্ত করে, যেন এই হাত আর কোনও দিন না ছাড়ে।
তিথির মনে হল, এই যে রেনকোট ছাড়া বৃষ্টি, এক কাপ ভাগ করা কফি, চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা জানালার পাশে, আর একটা মন খুলে নেওয়া বিকেল—এসব নিয়েই ভালোবাসা তৈরি হয়।
ভালোবাসা মানে আরাম নয়, মানে ছুঁয়ে থাকার সাহস। মানে—একটা ভুলের পরেও বলে ফেলা, “আমরা আবার পারব।”
তারা দাঁড়িয়ে ছিল—হয়তো মিনিট দশেক। এরপর কফি শপের ছাতার নিচে ফিরে এল। গায়ে জল, চোখে আলো।
অর্ণব বলল, “তুই কি মনে করিস, আমাদের গল্পটা এবার শেষ?”
তিথি বলল, “শেষ মানে তো সবসময় শেষ না। শেষ মানে একরকম শুরু।”
অর্ণব চুপ করে মাথা ঝাঁকাল।
“তুই কি এবার আমাকে তোর পাশে রাখবি? রোজ? ভালোমন্দ, ঝড়-বাদল, কফি-চিনি সব মিলিয়ে?”
তিথি বলল, “আমার পাশে যদি কেউ থাকে, আমি আর রেনকোট চাই না। আমি কেবল একটা হাত চাই। তোর হাতটা।”
অর্ণব আবার হাতে হাত রাখল।
বৃষ্টির ফোঁটা দুজনের চোখের পাতায় পড়ল। কে বলবে এটা বৃষ্টি, কে বলবে ভালোবাসা?
তিথির চোখে সত্যিই সেই পুরোনো বৃষ্টিটা ছিল—কিন্তু এবার, ভিজে যাওয়ার ভয় ছিল না। কারণ তার পাশে ছিল একজন, যে বলেছিল,
“তুই জানালাটা খুলে দিলেই আমি আসব।”
আর আজ—সে সত্যিই এসেছে।

সমাপ্ত

WhatsApp-Image-2025-07-14-at-12.47.49-PM.jpeg

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *