নবনীতা বসু
পর্ব ১: “যে চিঠি লেখা হয়নি কখনও”
কলকাতার গলিগুলো রাত বারোটার পর অন্যরকম হয়ে যায়। আলো কমে আসে, ট্রামলাইনের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ছায়াগুলো যেন একটু লম্বা হয়, আর পুরনো বাড়িগুলোর জানালায় সময় দাঁড়িয়ে থাকে। ঠিক যেমন দাঁড়িয়ে থাকে ৩৫, বেণীপুর লেনের পুরনো দোতলা বাড়িটা, যার একতলায় ভাড়া থাকে অনুরাধা। সদ্য চাকরি পেয়েছে, একটা ডিজাইনিং এজেন্সিতে ক্রিয়েটিভ অ্যাসিস্ট্যান্ট। কলেজ স্ট্রিট থেকে বেশি দূরে নয় এই ফ্ল্যাট, আর বাড়িটাও সস্তায় মিলে গেছে বলে না ভাবলেও চলে।
বাড়ির ভেতর ঢুকতেই একটা পলকা গন্ধ এসে লাগে তার নাকে—পুরোনো কাপড়, একটু ভ্যাপসা, আর কোথাও ধুলো মাখা কাঠের। অনুরাধা যদিও গন্ধ নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামায় না, সে বরং মুগ্ধ হয় এই বাড়ির কাঠের সিঁড়ি আর খোলা ব্যালকনিতে, যেটা দিয়ে সন্ধ্যেবেলা কলাপাতার মতো আলো ঢোকে।
তবে একটা জিনিস অদ্ভুত লাগতো—সেই পুরনো রেডিওটা, যার পাশে একটা ছোট টেবিলে রাখা ছবির ফ্রেম, যার কাঁচ ফেটে গেছে। রেডিওটা চালানোর উপায় নেই, কর্ড নেই, সুইচও নষ্ট। কিন্তু তবুও প্রতিদিন রাত ঠিক ১২টা ৫ মিনিটে সেটা জেগে ওঠে।
প্রথম দিন বিষয়টা অনুরাধা ঠিক বুঝতেই পারেনি। অনেক কাজ করে ঘুমিয়ে পড়েছিল। হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায়, মনে হয় যেন কেউ কবিতা পড়ছে। গলা একটু থমথমে, করুণ আর ভীষণ নারীবাচক। চোখ মেলেই দেখে, আলো নিভে আছে, রুম হালকা ঝাপসা। আর টেবিলের ওপর রেডিওটার ছোট্ট লাল আলো জ্বলছে। ভেসে আসছে কণ্ঠস্বর—
“এই চিঠিটা যদি পেয়ে যেতে… যদি কখনও ডাকনামটা ভুলে না যেতে…”
অনুরাধা চমকে ওঠে। প্লাগহীন রেডিও চালু হয় কী করে? সে উঠে গিয়ে সুইচ ঘোরায়, কিছু হয় না। আবার তাকায় ঘড়ির দিকে—১২টা ৮। আর তখনই গলা থেমে যায়।
পরের দিন সকালবেলা বিষয়টা মনে পড়তেই সে হাসে, ভাবে হয়তো স্বপ্ন দেখেছে। অফিসে বলতেও চায়, কিন্তু ভাবে, কেউ হয়তো পাগল ভাববে। তবুও রাতে শোওয়ার আগে মোবাইল ক্যামেরা সেট করে রাখে, রেডিওর দিকে তাক করে।
ঠিক ১২টা ৫। ঘড়ি টিকটিক করে ওঠে। ক্যামেরার রেকর্ডিং শুরু হয়। আর তার সামনে রেডিও আবার জ্বলে ওঠে। এবার কণ্ঠটা একটু ক্লিয়ার—
“আমার নাম রাখিনি তুমি, তাই কোনো চিঠিতে নিজেকে লেখা হয়নি…”
রাতের নিস্তব্ধতায় গলার ধ্বনি যেন কানের ভেতর ঢুকে মগজের ঘরগুলো ঘুরে বেড়ায়। অনুরাধা স্থির হয়ে বসে থাকে। ঠান্ডা ঘাম গড়িয়ে পড়ে কপাল বেয়ে।
পরদিন সকালে ভিডিওটা খোলার পর সে অবাক হয়ে যায়—কোনো শব্দ নেই। রেডিওটা নিঃশব্দ। লাল আলোটাও নেই ভিডিওতে। শুধু ঘরটায় হালকা কুয়াশা-মতো ঝাপসা একটা আবরণ দেখা যায়, ঠিক যেমনটা স্বপ্নে হয়।
দিন যায়, রাত হয়। রেডিও প্রতিদিন চালু হয়, গলা প্রতিদিন বলে এক একটা লাইন—সবই চিঠির টুকরো, যেন কোনো হারিয়ে যাওয়া প্রেমের গল্প, যেটা আজও শেষ হয়নি।
“তুমি বলেছিলে, চিঠিতে চোখ রেখে কাঁদো না। অথচ আজ আমি কাঁদি প্রতিটি লাইনে…”
“যেদিন চলে গেলে, টেবিলের ওপর রইল না কোনো শব্দ—শুধু বাতাসে ঝুলে থাকা চুম্বন…”
অনুরাধার ঘুম আর আসে না। সে শুনে যায় প্রতিদিন। কণ্ঠটা কেমন যেন পরিচিত ঠেকে, যেন কোথাও শুনেছে এই গলার কান্না। হয়তো কোনো থিয়েটারে? না কি কারও মুখে?
অষ্টম দিন, অফিস থেকে ফিরে সে টেবিল পরিষ্কার করতে গিয়ে খেয়াল করে, ফ্রেমের ভাঙা কাঁচের নিচে একটা ছেঁড়া চিঠি গুঁজে আছে। আঁচড়ে আঁচড়ে লেখা—
“যদি কখনও কেউ এই রেডিও চালায়, তাকে বলে দিও, আমি শুধু আমার গল্পটা শেষ করতে চাই। যতক্ষণ না শেষ হয়, আমায় যেতে দিও না।”
নামের জায়গাটা ছেঁড়া, শুধু প্রথম অক্ষরটা দেখা যায়—”রা”।
সে রাতে কণ্ঠটা বলে—
“তুমি কি জানো, প্রতিটি চিঠির শেষে একটা মৃত্যু থাকে? আমি শুধু অপেক্ষা করছি, কে শেষ পত্রখানা পড়বে…”
অনুরাধার বুকটা ধক করে ওঠে। এই কণ্ঠ কি কারও আত্মা? কোনো অপূর্ণ প্রেমিকা? কিন্তু মৃত্যু কেন? কে মরবে?
আরও ভয়াবহ বিষয়, পরের দিন পাড়ার মোড়ের দোকানদার অনিল কাকু মারা যান হার্ট অ্যাটাকে। রেডিওয় আগের রাতেই শেষ হয়েছিল একটা চিঠি।
তখনই প্রথমবার অনুরাধার মনে হয়—এই রেডিওটা শুধু গল্প বলে না, মৃত্যু ডেকে আনে। প্রতি চিঠির শেষ মানে একটা প্রাণের শেষ।
আর সে জানে না, তার শুনে ফেলা চিঠিগুলো শেষ হতে আর কটা দিন বাকি আছে।
পর্ব ২: “যে ছবিতে আমি ছিলাম না”
রাতের শহর ঘুমিয়ে পড়েছে। জানালার বাইরের ল্যাম্পপোস্ট ঝিমোয়। আর ভেতরে, অনুরাধা বিছানায় বসে রেডিওর দিকে তাকিয়ে থাকে। প্রতিদিন ঠিক ১২টা ৫ মিনিটে তার ঘরে ঢুকে পড়ে একটা অদৃশ্য উপস্থিতি। সেই গলা—স্তব্ধ অথচ সাবলীল, বিষণ্ন অথচ সাহসী। আজ নয়দিন। নয়টি চিঠির লাইন। নয়টি মৃত্যুর সংবাদ পাড়ায়, পত্রিকায়, ফেসবুকে।
তবু কিছুতেই রেডিও থেকে চোখ সরাতে পারে না অনুরাধা। কেমন একটা চৌম্বক টান।
আজ সে জানালায় একটা মোমবাতি জ্বেলে রেখেছে। মনে হয়, যেন আলো থাকলে ভয়টা একটু কম লাগে।
১২টা বেজে ৫ মিনিট।
রেডিওটা নিজে থেকেই ঝিমিয়ে উঠে প্রাণ ফিরে পায়। লাল আলোটা জ্বলে ওঠে। আবার সেই কণ্ঠ—
“আমরা ছবিটা তুলেছিলাম সাতজন। ছয়জন হাসছিল, একজন খালি জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিল… আমি ছিলাম না। অথচ ক্যামেরাটা আমার ছিল।”
অনুরাধার গা ছমছম করে ওঠে। এই প্রথম চিঠির মধ্যে অন্য মানুষদের কথা উঠল। সাতজন, তার মধ্যে কেউ নেই—কিন্তু ছিল। এই গলা কি নিজেকে হারিয়ে ফেলার গল্প বলছে? না কি কাউকে হারানোর?
সে খেয়াল করে, রেডিওর পাশে আজ একটু অন্যরকম গন্ধ। যেন পুরনো ক্যামেরা রিলের কেমিক্যাল, অথবা ধুলোর ভেতর পুরনো অ্যালবামের গন্ধ। একটু উঠে গিয়ে টেবিলের ড্রয়ারটা টেনে খোলে। কৌতূহল আর অস্বস্তির মধ্যে কিছু একটা খোঁজার তাগিদ।
ড্রয়ারের একেবারে পিছনে পুরোনো একটা ছোট্ট অ্যালবাম—ধুলো জমে আছে। সে খুলে দেখে, একগুচ্ছ ব্ল্যাক-অ্যান্ড-হোয়াইট ছবি, সেপিয়া রঙে পরিণত হয়ে গেছে।
প্রথম ছবিতে সাতজন তরুণ-তরুণী। কেউ হাসছে, কেউ তাকিয়ে আছে ক্যামেরার দিকে, কারও চোখে দুঃখ। কিন্তু একটা জায়গা ফাঁকা। ছবির একপাশে স্পষ্ট দাঁড়ানোর জায়গা—কিন্তু কেউ নেই।
অনুরাধা ভেবে পায় না—কেন একটা শূন্যতা ছবি ভর্তি মানুষের মধ্যে এমন করে চোখে লাগে? সে পেছনে ঘোরে, দেয়ালে নিজের ছায়া পড়ে, কিন্তু মনে হয় যেন কারও আরও একটুকরো ছায়া তার পাশে নড়ে ওঠে।
রেডিও আবার বলে—
“ছবিতে যে অনুপস্থিত, তাকেই সবচেয়ে বেশি মনে রাখা হয়। আমি চাইনি কেউ আমায় মনে রাখুক। শুধু চাইনি আরেকবার হারিয়ে যেতে।”
কণ্ঠটা যেন এবার একটু কাঁপে, কান্না টের পাওয়া যায়, কিন্তু সংবরণ করা কান্না। অনুরাধা আবিষ্ট হয়ে শোনে। তার মাথায় একটার পর একটা প্রশ্ন ঘুরতে থাকে—
এই কণ্ঠ কি মৃতের? কার? কেন এভাবে চিঠি পাঠাচ্ছে?
আর সবচেয়ে বড় প্রশ্ন—এই চিঠি কি তার জন্যই?
তখনই সে স্মরণ করে—আজ সকালে তার সঙ্গে লিফটে এক বৃদ্ধ উঠেছিলেন। চোখ ছিল ভরা জল, মুখে বলেছিলেন, “তুমি কি ৩৫ নম্বরে থাকো? অনেক আগে এই বাড়িতে এক মেয়ে থাকত, চুপচাপ ছিল… কিন্তু তার কবিতা ছিল আগুনের মতো।”
অনুরাধা ভেবেছিল ভুল করছেন, তবে আজ মনে হচ্ছে, হয়তো কিছু জানেন উনি।
সে ঠিক করে, পরদিন সন্ধ্যাবেলা ওই বৃদ্ধকে খুঁজবে।
কিন্তু সে ভাবেনি, সেই রাতেই আসবে এক নতুন চিঠির শেষ লাইন—
“যে ছবিতে আমি ছিলাম না, সেটাই তোমার দেয়ালে ঝোলানো থাকবে মৃত্যুর পরেও…”
রেডিও নিঃশব্দ হয়ে যায়। আলো নিভে যায়। আর পরদিন খবর আসে—আশেপাশের আরেক বাড়ির তরুণ ফটোগ্রাফার রাহুল আত্মহত্যা করেছে।
তার ক্যামেরার ভেতর শেষ ফ্রেমে পাওয়া গেছে সেই একই সাতজনের ছবি। এবং সেই ফাঁকা জায়গা।
অনুরাধার চোখে ঘাম নেমে আসে। রাহুল কি ছিল সেই ছবির একজন?
তবে সে তো বলেছিল…
“ছয়জন ছিল, একজন নেই… আমিও ছিলাম না।”
তা হলে… সপ্তম জন কে?
পর্ব ৩: “জানালার ওপাশে একটা গলা”
পিছনে ফিসফিস করে সময় বয়ে যায়, জানালার কাঁচে জমে ওঠে অদৃশ্য আঙুলের ছাপ। অনুরাধা এখন আর ভয় পায় না ঠিক, কিন্তু এক অদ্ভুত অভ্যেস হয়ে গেছে তার—প্রতিদিন ১২টা ৫ মিনিটে রেডিওর দিকে তাকিয়ে থাকা, প্রতিটি শব্দ ধরে ফেলা, যেন সেই অচেনা কণ্ঠটিকে সে চিনে ফেলবে। চিনে ফেললেই সব থেমে যাবে।
কিন্তু থামে না।
আজ সকালেই সে খুঁজে পেয়েছিল সেই বৃদ্ধকে, যিনি লিফটে তাকে কথাটা বলেছিলেন। নাম নাকি গৌরহরি দাস। আগে শিক্ষক ছিলেন। এখন থাকেন ওই গলিরই অন্যপ্রান্তে।
“তুমি বলেছিলে সেই ঘরে থাকো যেটা আগে রানুর ছিল,” গৌরহরি কাকু বলেছিলেন।
“রানু?”
“হ্যাঁ, আমাদের পাড়ার কবি। একা থাকত, কিচ্ছু বলত না। কিন্তু জানালার পাশে বসে কবিতা আওড়াত। হঠাৎ একদিন হারিয়ে গেল। কারও চিঠিতে নাম ছিল না তার, কেউ খোঁজও নেয়নি।”
অনুরাধা যেন বরফে ঢেকে যায়। রানু। সেই কণ্ঠ কি রানুর? সেই কবিতা, সেই গলা?
রাতে সে ব্যালকনির দরজা খুলে রাখে। জানালার কাঁচ মোছে। আজ সে শোনার পাশাপাশি দেখা চাই।
১২টা ৫।
রেডিও শুরু হয়—
“আমি জানালার ওপাশে থাকি। শুধু তাকিয়ে থাকি, যদি কেউ শুনে ফেলে আমার গলা। একদিন কেউ বলেছিল, কণ্ঠগুলো হারিয়ে যায় না। আমি কি হারিয়েছি নিজেকে?”
আর ঠিক তখনই অনুরাধা টের পায়—জানালার কাঁচের ওপাশে এক ঝলক ধূসর মুখ। এক মুহূর্তের জন্য, খুব কাছ থেকে কেউ তাকিয়ে ছিল।
চোখে স্রেফ জল, কিন্তু ঠোঁটে নেই কোনো কাঁপন।
সে ছুটে গিয়ে জানালা খুলে বাইরে তাকায়—শুধু শূন্য রাস্তাঘাট, কুকুরের দূর সুর আর ঘড়ির টিকটিক।
কিন্তু ঘরে ঢুকে দেখে তার ডেস্কের ওপরে একটা কাগজ রাখা।
লেখা আছে—
“চিঠির চতুর্থ লাইন তুমি শুনেছিলে, এবার পঞ্চম তোমার নামে। কেউ যেন ভুলে না যায়।”
কাগজে নাম নেই, ছাপা হরফ, কিন্তু কাগজটা জ্যান্ত, যেন কোনো স্পন্দন লেগে আছে।
তার গলা শুকিয়ে আসে। এই চিঠি কি তার জন্যই? তার নাম কি যুক্ত হয়ে গেছে এই গল্পে?
রেডিও তখনও চলছে—
“তুমি যদি শোনো, তবে তুমি-ও লিখছো এই গল্প। একবার কেউ শুনে ফেললেই, সে আর শ্রোতা থাকে না—সে হয়ে যায় চরিত্র।”
অনুরাধা হঠাৎ টের পায়, বুকের ভিতর কোনো চেনা শব্দ বাজছে। সে কি সত্যিই শুনতে চাইছিল? না কি টানটা আরও গভীর কিছু?
আর তখনই বারান্দা দিয়ে হাওয়ার ঝাপটায় রেডিওর পাশে রাখা সেই পুরোনো ছবিগুলো ছিটকে পড়ে।
সাতজনের ছবির একটায় এবার আরেকটা মুখ স্পষ্ট। আগে যে ছিল না।
কিন্তু ভয়ঙ্কর কথা হল—
সেই মুখটা অনুরাধার নিজের মুখ।
পর্ব ৪: “চিঠির ষষ্ঠ লাইন লিখবে কে?”
ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে যায়। অনুরাধার ঘরটা এখন আর কেবল তার নয়। দেওয়ালে ঝোলানো ঘড়ির আওয়াজের ফাঁকে, সে যেন অন্য কারও শ্বাস টের পায়। প্রতিদিন রাত ১২টা ৫ মিনিটে রেডিওর সঙ্গে সঙ্গে একটা গল্প না, একটা সত্যি ঢুকে পড়ে তার ঘরে। এবং এখন, সেই সত্যিতে সে নিজেকে খুঁজে পাচ্ছে।
ছবিটা তার নিজের মুখে বদলে গেছে। প্রথমে সে বিশ্বাসই করতে পারেনি। ক্যামেরায় তুলেছিল, বন্ধুদের দেখিয়েছিল—সবার চোখে শুধু বিস্ময়।
“তুই কি এটা এডিট করেছিস?”
“না… আমি কিছু করিনি।”
“কিন্তু এটা তো তোর মুখ!”
কেউ যেন ধীরে ধীরে অনুরাধাকে টেনে নিচ্ছে এক গল্পের ভিতরে, যেখানে প্রতিটি চিঠির লাইন শুধু কবিতা নয়, সাবধানবাণীও।
সে চেষ্টা করেছিল রেডিওটাকে ঘর থেকে বার করে দিতে। কিন্তু যতবার সেটা স্পর্শ করে, মনে হয় গায়ে বিদ্যুৎ বয়ে যায়। একরকম চুম্বকত্ব, যেন তার আঙুলের চামড়ার নিচে গল্প ঢুকে পড়ছে।
আজ আবার সেই সময়।
১২টা ৫ মিনিট।
রেডিওর লাল আলো জ্বলে ওঠে।
গলা আজ কেমন কর্কশ, যেন ক্লান্ত, যেন কাঁদতে কাঁদতে গলার তার ছিঁড়ে গেছে—
“তোমরা কি জানো, চিঠির ষষ্ঠ লাইন কেউ লেখেনি আজ পর্যন্ত? যেই লিখবে, সেই হবে গল্পের পরবর্তী চরিত্র। মৃত্যু তখনই ফিরে আসে…”
অনুরাধা হঠাৎ অনুভব করে, ঘরে আর একা নেই সে। বিছানার পাশে রাখা চেয়ারটায় কারও বসার শব্দ, ঘরের হাওয়ায় কারও চুলের গন্ধ, বাতাসে ভাসে হালকা কপালের ঘাম।
রেডিও আবার বলে—
“যদি তুমি লেখো, তবে মনে রেখো—একবার নাম লেখা হলে, চিঠি কখনও ফেরত যায় না।”
অনুরাধা উঠে দাঁড়ায়, ধীরে ধীরে ডেস্কে গিয়ে বসে। সামনে একটা খাতা, একটা কলম। অবচেতনেই কলমটা তুলে নেয়।
তখনই দরজার বাইরে টুক করে শব্দ। সে ছুটে গিয়ে দেখে, কেউ একটা খাম গুঁজে দিয়ে চলে গেছে। খামের ওপরে লেখা:
“চিঠির ষষ্ঠ লাইন লিখে ফেলো, নইলে গল্প থেমে যাবে… আর তার বদলে তুমি।”
ভেতরে একটুখানি পাতলা কাগজ—
“আমি অপেক্ষা করছি, অনুরাধা।”
এবার সে আর আতঙ্কে জমে যায় না। ধীরে ধীরে বোঝে, সে শুধু শ্রোতা ছিল না কোনওদিন। হয়তো প্রথম দিন থেকেই চরিত্র ছিল।
সে খাতা খুলে, কলম ছুঁইয়ে লিখে ফেলে—
“যদি তুমি ফিরে এসে বলো, আমি অপেক্ষা করেছি—তবে আমার মৃত্যু হবে না, শুধু একটা গল্প শেষ হবে।”
ঠিক তখনই রেডিও বন্ধ হয়ে যায়। আলো নিভে যায়।
পরদিন সকালে খবর আসে—সন্ধ্যেবেলায় পাশের ফ্ল্যাটের বৃদ্ধা কমলাদেবী ঘুমের মধ্যে মারা গেছেন। হৃদরোগ।
আর অনুরাধার দরজার নিচে দিয়ে গড়িয়ে আসে আরেকটা কাগজ।
এইবার শুধু একটা লাইন—
“সাত নম্বর চিঠি শুরু হবে আজ রাতে। তুমি কি শোনার জন্য তৈরি?”
পর্ব ৫: “রেডিওর ভেতরে একটা দরজা”
অনুরাধা এখন আর রাতের অপেক্ষা করে না—রাত তার ভেতরে ঢুকে গেছে। সময় একটানা বয়ে যায়, অথচ কোথাও একটা থেমে থাকে—একটা নির্দিষ্ট মিনিট, একটা নির্দিষ্ট শব্দ, একটা নারী কণ্ঠের ফিসফাস, যা কানে ঢুকে মনকে ধুয়ে দিয়ে যায়।
ছয় নম্বর চিঠির লাইন লিখে ফেলার পর, সে ভেবেছিল সব শেষ হবে। রেডিও থেমে যাবে, কণ্ঠ নিশ্চুপ হবে। কিন্তু তা হয়নি। শুধু বদলে গেছে নিয়ম—এবার রেডিও তাকে শুধু শুনতে নয়, দেখতে ডাকে।
আজ সন্ধ্যেবেলা থেকেই কেমন অস্বস্তি লাগছিল তার। কানের ভেতর হালকা একটা গুঞ্জন, যেন কেউ চুপচাপ ফিসফিস করছে। বাসার বাতি বারবার ঝাপসা হয়ে আসছিল। ব্যালকনির বাইরে কাকের ডাক, নিচের রাস্তা ফাঁকা—সবই ছিল, অথচ সবই ছিল না।
১১টা ৫৭।
সে এবার রেডিওর সামনে বসে, যেন কেউ আসবে। সামনে এক কাপ ঠান্ডা চা, পাশে সেই পুরোনো অ্যালবাম।
১২টা ৫।
রেডিও জ্বলে ওঠে। গলা আসে না সঙ্গে সঙ্গে—প্রথমে একটা ঘন নিঃশ্বাস। তারপর…
“রেডিওটা আসলে একটা দরজা। কেউ খোলেনি কোনওদিন। শুধু শোনে গেছে। কিন্তু যে খুলে ফেলবে, সে আর ফিরে আসবে না।”
অনুরাধা চমকে ওঠে। দরজা? রেডিওর ভেতর কি একটা প্রবেশপথ আছে?
সে ধীরে ধীরে রেডিওর কাছে যায়। আজ প্রথমবার সাহসে হাত রাখে সেই পুরোনো কাঠের শরীরের ওপর। স্পর্শে মনে হয় যেন শরীরটা নড়ে উঠেছে।
রেডিওর নিচে একটা পুরনো হ্যাচের মতো কভার পাওয়া যায়। আগে চোখে পড়েনি। এবার চাপ দিতেই সেটা খুলে যায়।
ভেতরে একটা চিঠি। হলুদ হয়ে যাওয়া পাতায় লেখা—
“আমি লিখেছিলাম সপ্তম চিঠি। তারপর আর কেউ আসেনি। যদি তুমি এই চিঠি খুঁজে পাও, জেনে নিও—তুমি পরবর্তী। রেডিওর গায়ে হাত দাও, দরজাটা খুলবে। ভিতরে আমি আছি।”
রেডিওর গায়ে এবার একটা অদ্ভুত আলোর রেখা দেখা যায়—যেন সত্যি একটা দরজার আকার ফুটে উঠছে।
অনুরাধা চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। গলার ভেতর কাঁটা, চোখে জল। মনে হয়, জীবনটা খুব হালকা—এক চাপ দিলেই ভেঙে যাবে।
রেডিও আবার বলে—
“সাত নম্বর চিঠি শুরু হল—তুমি যে দিন নিজের মুখে শুনবে নিজের নাম, সে দিন থেকেই দরজা খুলে যাবে। শুধু প্রশ্ন একটাই—তুমি যেতে চাও তো?”
আর তখনই ঘরজোড়া আলো নিভে যায়। শুধু রেডিওর লাল আলো জ্বলে থাকে, আর তার ভিতর থেকে যেন কারও মুখ দেখা যায়—অস্পষ্ট, কিন্তু নিশ্চয়।
অনুরাধা ধীরে ধীরে বলে ওঠে—
“আমি শুনব, আমি লিখব… কিন্তু আমি ফিরে আসব। কারণ গল্পটা এখনও আমার নয়, আমি তো শুধু শ্রোতা ছিলাম… তাই তো?”
রেডিও তখন নিঃশব্দ।
কিন্তু পরদিন সকালে, সে দেখে—তার নিজের লেখা খাতার এক পাতায়, অচেনা হাতে লেখা এক লাইন যোগ হয়েছে—
“তুমি শুধু শ্রোতা ছিলে না, অনুরাধা। কখনও ছিলে না।”
পর্ব ৬: “চিঠির নিচে লুকিয়ে থাকা নাম”
অনুরাধার ঘরটা যেন পাল্টে গেছে। প্রতিটি জিনিস তার দিকে তাকিয়ে থাকে। চেয়ার, টেবিল, আয়না—সব যেন জানে, সে একটা গল্পের ভেতর আটকে গেছে, যে গল্পের শুরু ছিল একটুকরো কণ্ঠে, আর শেষ… কে জানে কোথায়?
সকালে খাতার পাতায় পাওয়া সেই অচেনা লেখার পর সে আর অফিস যায়নি। মন পড়ে থাকে রেডিওর ভেতর। দরজাটা যে আজ নয় কাল খুলবেই, সে জানে।
দিনভর সে রেডিওর চারপাশ ঘেঁটে বের করে আরও দুটো ছেঁড়া চিঠির টুকরো। কালি মুছে গেলেও কিছু শব্দ পড়া যায়—
“…আমার নাম কেউ জানত না, তবু প্রতিটি কবিতা আমায় ডাকে।”
আরেকটায় লেখা—
“আমি নামহীন বলেই হয়তো হারিয়ে যেতে পারি…”
কিন্তু তখনই তার খেয়াল হয়, এত চিঠি, এত গল্প—কিন্তু একটাও চিঠিতে পুরো নাম নেই! শুধু প্রথম অক্ষর, বা ডাকনাম, বা কখনও কোনো নামই না। যেন সবাই ইচ্ছা করে নাম মুছে দিয়েছে।
রাতে ১২টার আগে থেকেই সে বসে পড়ে রেডিওর সামনে। হাতে সেই ছেঁড়া কাগজের টুকরোগুলো, পাশে টেপড হেডফোন।
১২টা ৫।
রেডিও জ্বলে ওঠে। গলা আজ বেশ গভীর, যেন অনেকটা পথ হেঁটে এসেছে—
“আমার নাম কেউ রাখেনি, তাই আমিও কারও নাম রাখিনি। চিঠির নিচে শুধু ভালোবাসা ছিল, নাম ছিল না। কিন্তু তুমি তো লিখেছিলে তোমার নাম… তোমার খাতায়… সেই নাম দিয়েই শুরু হবে এবার চিঠির অষ্টম লাইন।”
অনুরাধার বুক কেঁপে ওঠে। তার খাতা? সে তো নিজেই লিখেছিল ষষ্ঠ লাইন। কিন্তু সেখানে তো নাম দেয়নি?
সে দৌড়ে যায়, খাতা খুলে দেখে—ষষ্ঠ লাইনের নিচে সত্যিই লেখা আছে—
“—অনুরাধা।”
তবে সেই লেখাটা তার নিজের নয়। অক্ষরের বাঁক, হাতের ভঙ্গিমা—অচেনা।
সে ঠিক করে, নামটাই যদি গল্পের চাবিকাঠি হয়, তবে খুঁজে বার করতে হবে সেই প্রথম নাম, যে নাম দিয়ে চিঠি শুরু হয়েছিল।
সে আবার ঘাঁটে সেই অ্যালবাম, পুরোনো নোটবুক, দেয়ালের ফাঁকে গুঁজে থাকা কাগজ।
এবং ঠিক তখনই, একটা পুরোনো ট্র্যাঙ্কের ভেতর থেকে সে পায় ছোট্ট একটা খামে লেখা চিঠি—
“প্রিয় রানু,”
রানু। সেই নাম! সেই কণ্ঠের উৎস? সেই কবি, যার কথা গৌরহরি কাকু বলেছিলেন?
চিঠিটা লেখা ছিল কারও ভালোবাসার কণ্ঠে—
“তুই বলেছিলি, চিঠিতে নাম লিখে রাখলে মনে রাখে সবাই। আমি তাই তোর নামটাই লিখে রাখলাম, যাতে কখনও ভুলে না যাই। যদি তুই চলে যাস, রেডিওটা চালু করে নিস—আমি তোর নাম আবার শুনতে চাই।”
অনুরাধার চোখ ভিজে আসে। রেডিও কি তবে প্রেমের অপেক্ষা? একটা হারিয়ে যাওয়া প্রেমিকা, যে চায় তার নাম কেউ উচ্চারণ করুক?
ঠিক তখনই রেডিও আবার বলে—
“তুমি যদি শুনে ফেলো সেই নাম—রানু—তবে সাবধান থেকো, কারণ যে নাম একবার উচ্চারিত হয়, সে ফিরে আসে।”
ঘরের বাতাস ঘন হয়ে আসে, জানালায় ভিজে হাওয়া, আয়নায় ছায়া কাঁপে।
আর রেডিও থেকে ভেসে আসে সেই চেনা গলা, এবার আর চিঠি নয়, সোজাসুজি ডাক—
“অনুরাধা… তুই কি আমার নাম শুনতে চাস?”
পর্ব ৭: “তুই কি আমায় ডাকলি?”
রেডিওর সেই প্রশ্নটা যেন দেয়াল পেরিয়ে, দেয়ালের পেছনের দেয়াল ভেদ করে ঢুকে পড়ে অনুরাধার ভেতর।
“তুই কি আমায় ডাকলি?”
এটা কি রানুর প্রশ্ন? না কি চিঠির? না কি সেই কণ্ঠ, যে রাতের শেষ অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকে শুধুই শোনা হয়ে ওঠার অপেক্ষায়?
অনুরাধা কিছু বলে না। ঠোঁট শুকিয়ে আসে। কিন্তু ভিতরে ভিতরে একটা শব্দ ক্রমশ জেগে ওঠে—ভয় আর উৎসাহ মিলিয়ে একটা অদ্ভুত নেশার মতো টান।
সে জানে, এই প্রশ্নের উত্তর দিলে কিছু বদলে যাবে। সে না বললে গল্পটা থেমে যেতে পারে। কিন্তু সে বললে… গল্পটা তাকে ছেঁকে নেবে।
তবু সে চুপ করে থাকতে পারে না। কণ্ঠের ভেতর দিয়ে একটা শব্দ বেরিয়ে আসে, কাঁপা গলায়—
“হ্যাঁ।”
সেই মুহূর্তেই ঘরটা কেঁপে ওঠে, ঠিক যেন কেউ পুরনো কাঠের দরজা ধাক্কা মারছে ভিতর থেকে। জানালার কাঁচে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে। বাতাস গাঢ় হয়, আর রেডিওর লাল আলো তীব্র হয়ে জ্বলে ওঠে।
রেডিও এবার বলে না, শুধু বাজে এক অদ্ভুত শব্দ—জলের তলায় কারও হাঁটার শব্দ, দূরে কে যেন দৌড়চ্ছে, আর তার মাঝখানে কণ্ঠটা আবার আসে, এবার অনেক নরম, কিন্তু অনেক কাছ থেকে—
“তুই ডাকলি বলে আমি এলাম। কিন্তু আমি একা আসিনি।”
অনুরাধা হঠাৎ টের পায়, বিছানার চাদরে কারও হাতের স্পর্শ। উষ্ণ নয়, বরং ঠান্ডা—জলেভেজা চুলের গন্ধ পাওয়া যায় আশপাশে।
সে উঠে দাঁড়ায়, চারপাশে তাকায়—কেউ নেই। কিন্তু টেবিলের ওপর সেই অ্যালবামটা এবার উলটে পড়ে আছে। খোলার পরে দেখা যায় সেই একই সাতজনের ছবি। কিন্তু এবার ফাঁকা জায়গাটা নেই।
সাতজন পূর্ণ।
অর্থাৎ, সেই অনুপস্থিত কেউ—ফিরে এসেছে?
অনুরাধা এবার আয়নার সামনে দাঁড়ায়। নিজের চোখের দিকে তাকায়। কিন্তু আয়নার প্রতিচ্ছবি কেমন অচেনা। চোখে একই ক্লান্তি, কিন্তু ঠোঁটে অন্য হাসি। সেই হাসি, যা সে কোনোদিন নিজে দেয়নি।
রেডিও আবার বলে—
“তুই ডাকলি। এখন তোর শরীরে আমি ফিরব। গল্পটা আবার নতুন করে শুরু হবে, কিন্তু নামটা এবার তোর।”
হাত কাঁপে, গলা শুকিয়ে যায়। কিন্তু মাথায় একটা কথা বাজতে থাকে—
“একবার নাম লেখা হয়ে গেলে, আর মোছা যায় না…”
ঠিক তখনই ঘরের বাইরের করিডোর থেকে এক নারীকণ্ঠের ডাক—
“অনুরাধা… তুই ঘুমিয়ে পড়িস না। আজ চিঠির অষ্টম লাইন শোনার দিন।”
অনুরাধা জানে, এই ডাক বাস্তব নয়। কিন্তু তার শরীর চলতে থাকে সেই ডাকে টেনে, দরজার দিকে, যেন কারও পুরোনো কথা তার রক্তে গেথে গেছে।
আর ঠিক সেই মুহূর্তে রেডিওতে বাজে সেই চিঠির অষ্টম লাইন—
“আমি তোকে চেয়েছিলাম নামহীন, তুই আমায় ডাক দিয়ে ছিন্ন করলি আমার বিস্মৃতি…”
পর্ব ৮: “যেখানে চিঠি শেষ হয়”
চিঠির প্রতিটি লাইন যেন এক একটা সিঁড়ি, নিচের দিকে নামা সিঁড়ি—যার শেষ নেই, শুধু অন্ধকারে মিশে যাওয়া দরজার মতো এক সীমান্ত আছে। অনুরাধা জানে, সে এখন ঠিক সেই সীমান্তের কিনারায় দাঁড়িয়ে আছে। আর এক পা ফেললেই, গল্পটা তাকে গিলে নেবে।
রাত ঠিক ১২টা ৫।
রেডিও নিঃশব্দে জ্বলে ওঠে। আজ প্রথমবার কণ্ঠটা আসেনি সাথে সাথে। শুধু একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস—মনে হয়, কণ্ঠটাও এবার ক্লান্ত। কিংবা প্রস্তুত কিছু চূড়ান্ত বলার জন্য।
অবশেষে সেই ধ্বনি ভেসে আসে—
“এই চিঠিটা শেষ করার পর, আমি চলে যাব। কিন্তু তার আগে তোমায় একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে—তুমি কি ফিরে যেতে চাও, অনুরাধা? নাকি থেকে যেতে চাও, আমার মতো, কণ্ঠ হয়ে?”
অনুরাধার বুক ধড়ফড় করতে থাকে। সে ঘাড় ঘুরিয়ে রেডিওর দিকে তাকায়, মনে হয় সেই কাঠের শরীরটার ভেতরে কাঁপছে বাতাস।
তার খেয়াল হয়—ড্রয়ারে রাখা খাতাটা আজ সকাল থেকেই খুঁজে পাচ্ছিল না। এখন গিয়ে দেখল, খাতাটা ঠিক রেডিওর নিচে রাখা আছে, খোলা, তাতে লেখা—
“চিঠির শেষ পৃষ্ঠা। নামটা এবার তুই লেখ।”
সে জানে, গল্প শেষ করতে হলে তাকে কিছু লিখতে হবে। কিন্তু সেই লেখায় তার নিজের নাম দিলে কি গল্প থামবে? না কি নামটাই হয়ে উঠবে নতুন গল্পের সূচনা?
রেডিও আবার বলে—
“চিঠি যেখানে শেষ হয়, সেখানে একটা নাম রেখে যাওয়া দরকার, নইলে গল্পের দরজা খোলা থেকে যায়।”
অনুরাধা ধীরে ধীরে কলম তোলে। কিন্তু ঠিক তখনই দরজায় তিনটে ঠক ঠক শব্দ।
সে চমকে ওঠে। এই রাতে কে?
দরজা খুলে দেখে, কেউ নেই। শুধু একটা সাদা খাম। ভেতরে একটুকরো কাগজ—
“আমার নাম রানু। এখন তোর নাম কী?”
ঘরে ফিরে এসে সে রেডিওর সামনে বসে। জানে, কিছু একটা আজ বন্ধ করতে হবে, কিছু শেষ করতে হবে—নইলে শেষ হবে না কারও।
সে খাতায় লিখে—
“আমি অনুরাধা। কিন্তু আমার গল্প এখনই শেষ নয়।”
রেডিও নিভে যায়।
এক মুহূর্ত নীরবতা। তারপর… কোথাও খুব দূরে বাজে বৃষ্টির শব্দ। এক নারীকণ্ঠ হাসে—হালকা, কৃতজ্ঞতা মেশানো এক নিঃশব্দ হাসি।
আর তার ঠিক পাশে রাখা অ্যালবামের পাতায়, ফাঁকা জায়গায় ফিরে আসে শূন্যতা। সাতজনের ছবি আবার হয়ে যায় ছয়জন।
অনুরাধা জানে, রানু চলে গেছে।
কিন্তু তখনই টেবিলের ওপর রাখা খাতায়, অনুরাধার নামের নিচে অদ্ভুত হস্তাক্ষরে যোগ হয় এক লাইন—
“তুমি এখন জানো কোথায় চিঠি শেষ হয়। কিন্তু যদি কেউ আবার রেডিও চালায়… গল্পটা আবার শুরু হবে।”
পর্ব ৯: “যদি কেউ আবার রেডিও চালায়…”
অনুরাধা জানত গল্পটা শেষ হয়েছে। সে নিজের নাম লিখেছে, রানুর চিঠি শেষ হয়েছে, রেডিও নিভে গেছে। কিন্তু যেটা সে জানত না, সেটা হল—গল্পের মৃত্যু মানেই গল্পের অন্ত নয়। কিছু কিছু গল্প, ঠিক রেডিওর ফ্রিকোয়েন্সির মতো, বাতাসে ঘুরে বেড়ায়, অপেক্ষা করে নতুন শ্রোতার।
সাত দিন কেটে গেছে। রাতগুলো নীরব, রেডিও নিস্তব্ধ, ঘরে শব্দ নেই।
অনুরাধা অফিসে যেতে শুরু করেছে আবার। চা বানায়, গান শোনে, এমনকি বন্ধুদের সঙ্গেও দেখা করে। কিন্তু তার ভিতরে কোথাও একটা জায়গা ফাঁকা পড়ে আছে, ঠিক যেমন রেডিওর ভেতরের সেই ছোট্ট ফাঁকা ঘরটা।
সেদিন বিকেলবেলা, বাড়ির নিচে ডাকবাক্সে একটা খাম পায় সে। প্রেরক অচেনা, কিন্তু অক্ষরের বাঁক খুব পরিচিত।
চিঠিতে লেখা—
“তুমি জানো গল্পটা শেষ হয়নি। কেউ আবার রেডিও চালাবে। তখন তুমি কী করবে, অনুরাধা?”
সে চমকে ওঠে। কে লিখল এটা? রানু তো চলে গেছে।
হয়তো কেউ নতুন করে ডাকা শুরু করেছে। হয়তো অনুরাধা শুধু সেতু ছিল, রানু থেকে পরবর্তী কণ্ঠে পৌঁছোনোর মাঝের একটা লাইন।
রাত ১১টা ৫৫।
সে আর নিজেকে আটকে রাখতে পারে না। রেডিওটা আবার টেনে আনে টেবিলের ওপর।
ডাস্টিং করে, কর্ডহীন যন্ত্রটাকে জড়িয়ে ধরে বসে।
১২টা ৫।
রেডিও এবার জ্বলে ওঠে, কিন্তু কোনো কণ্ঠ আসে না। শুধু বাজে একটি শিশুর হাসির আওয়াজ।
তারপর ধীরে ধীরে এক নতুন গলা—
নতুন, কিন্তু কেমন যেন চেনা।
“আমি তো কিছুই লিখিনি, শুধু শুনেছিলাম। তবু আমার নাম লেখা হয়ে গেল। এখন কী করব?”
অনুরাধা বুঝে যায়—গল্পের বৃত্ত আবার শুরু হয়েছে।
শ্রোতা এবার নতুন কেউ।
সে চুপচাপ দাঁড়ায়। জানালার কাঁচে চোখ রাখে। নিচের রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে একটা মেয়ে। বয়স হয়তো বাইশ-তেইশ। কানে হেডফোন, হাতে চিঠির খাম।
আর তার জানালার রেলিংয়ে রাখা খাতাটার ওপর হাওয়া ওল্টে দেয় এক নতুন পাতা। তাতে লেখা—
“পরবর্তী গল্প শুরু হল। সময়: ১২.০৫। চরিত্র: তুমি।”
পর্ব ১০: “শেষ লাইনে মৃত্যুর বানান”
রেডিওর শব্দ অনেকটা স্বপ্নের মতো—যখন থাকে, মনে হয় সত্যি কিছু; আর যখন থেমে যায়, মনে হয় সত্যিই কিছু ছিল কি?
অনুরাধা সেই স্বপ্ন থেকে জেগে উঠেছিল। বা হয়তো জাগা বলাটা ভুল।
সে এখনো ঘুম আর জেগে ওঠার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। কারণ গল্পটা শেষ হয়নি—রেডিও আবার বেঁচে উঠেছে।
শুধু এবার কণ্ঠটা তার নয়।
নতুন মেয়েটিকে সে প্রথম দেখে ছাদের রেলিংয়ে বসে থাকতে—একদিন সকালবেলা। মেয়েটির চোখে ক্লান্তি, কানে হেডফোন, গলায় নেমে আসা একটা চিঠির মতো দৃষ্টি।
অনুরাধা তাকিয়েছিল তার দিকে ঠিক যেভাবে একসময় রানু তাকিয়ে থাকত তার দিকে।
তখনই বুঝেছিল, চক্রটা ঘুরছে।
এবং একদিন রাত ১২টা ৫-এ, নতুন কণ্ঠ শোনা যায়—
“তুমি কি জানো, শেষ লাইনে মৃত্যুর বানান লুকিয়ে থাকে?”
অনুরাধা জানে, সময় এসে গেছে। সে এবার আর শ্রোতা নয়। এবার সে শুধু এক পাতা, যাকে পড়ে কেউ অন্য গল্প শুরু করবে।
সে উঠে দাঁড়ায়, টেবিলে রাখা খাতাটায় শেষ একটা লাইন লেখে—
“শেষ লাইনের বানান: ম-ৃ-ত্যু। আর তার ঠিক নিচেই লেখা থাকে নাম—যার আর কোনো গল্প থাকবে না।”
রেডিও তখন কাঁপতে থাকে। লাল আলো দপ করে জ্বলে ওঠে।
কণ্ঠটা আবার আসে, এবার একেবারে ফিসফিসিয়ে—
“তুমি জানো তো, একেকটা চিঠি আসলে একটা আত্মা। যতদিন কেউ পড়ে না, সে ঘুমিয়ে থাকে। আর একবার পড়ে ফেললেই, সে চায় মুক্তি। কিন্তু মুক্তির বানানও যে মৃত্যু…”
অনুরাধা জানে, এটা তার শেষ রাত।
সে রেডিওর পাশে বসে, একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে। হালকা আলোয় তার ছায়া পড়ে দেয়ালে—আর সেই ছায়ায়, যেন কে বসে আছে।
রেডিও থেমে যায়।
আর পরদিন সকালবেলা, খবরের কাগজে একটা ছোট্ট হেডলাইন—
“৩৫ বেণীপুর লেনের ভাড়াটে অনুরাধা সেন নিখোঁজ। ঘর খালি, জানালা খোলা, রেডিওতে বাজছিল শুধুই বাতাসের শব্দ।”
তবে সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার ছিল খাতার শেষ পাতায় লেখা লাইন:
“শ্রোতা পরিবর্তন করা হল। পরবর্তী চরিত্র—তুমি।”
আর হ্যাঁ—সেই পুরনো রেডিওটা পাওয়া যায় এক নতুন ভাড়াটের ঘরে, সম্পূর্ণ অচল, কিন্তু মাঝরাতে কারা যেন ফিসফিস করে শোনে—
“১২টা ৫ বাজে… শুনে নাও, কে ডাকছে!”
—সমাপ্ত—