Bangla - সামাজিক গল্প

রূপের পেছনের মানুষ

Spread the love

অরিত্র পাল


পর্ব ১

মাধবপুর নামের একটা ছোট্ট গ্রাম। স্টেশন পেরিয়ে একটু ভেতরে গেলে এই গ্রামটা দেখা যায়। খুব চুপচাপ, গাছপালা ঘেরা, পাখির ডাক ভরা একটা জায়গা।

এই গ্রামে থাকে গণেশ। সবাই বলে, গণেশ একজন “বহুরূপী”। মানে, সে নানা রকম সেজে গ্রামের লোকেদের সামনে গল্প বলে, নাটক করে। কখনো সেজে যায় শিব, কখনো হনুমান, আবার কখনো সুভাষচন্দ্র। শুধু সাজ নয়, তার মুখের কথা, চোখের চাহনি—সব যেন বদলে যায়।

পুজোর আগে থেকেই গণেশ খুব ব্যস্ত। কারণ, সে পুজোর মেলায় নাচে, অভিনয় করে। এবার সে ঠিক করেছে নতুন কিছু করবে। সে সেজে উঠবে ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাই। অনেকেই হাসাহাসি করে, বলে, “তুই মেয়ে সেজে অভিনয় করবি?” কিন্তু গণেশ থামে না।

সে বলে, “আমি রূপ দেখাই না, গল্প বলি।”

গণেশর একটা ছোট ঘর আছে। সেই ঘরে রাখা তার রঙের কৌটো, পুরোনো কাপড়, ছোট আয়না। সেখানেই বসে সে রোজ নিজেকে সাজায়। সে খুব শান্ত মানুষ। মুখে সব সময় একরকম হাসি লেগে থাকে।

এই গ্রামে এসেছে নতুন এক মেয়ে, নাম চন্দনা। শহর থেকে এসেছে, এখন গ্রামের স্কুলে পড়ে। চুপচাপ স্বভাব, কারো সঙ্গে তেমন কথা বলে না।

একদিন চন্দনা দেখল, রেলগেটের পাশে এক লোক শিব সেজে দাঁড়িয়ে আছে—সাদা ভস্ম মাখা গা, কপালে ত্রিপুণ্ড, হাতে ডমরু। সে একদম মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ সে কোমর দুলিয়ে নাচতে লাগল। লোকেরা থেমে গেল, দেখল অবাক হয়ে।

চন্দনা প্রথমবার এমন কিছু দেখল। খুব অবাক হল। মাকে কিছু না বলে চুপচাপ বাড়ি ফিরে এল। সেদিন রাতে সে একটা ছবি আঁকল—একজন মানুষের মুখ, যার একপাশ রঙে ঢাকা, আরেক পাশ খালি।

পরদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে চন্দনা হেঁটে হেঁটে গেল গণেশর বাড়ির সামনে। দরজাটা আধখোলা ছিল। সে দেখল, গণেশ আয়নার সামনে বসে মুখে রঙ লাগাচ্ছে।

চন্দনা আস্তে বলল, “তুমি কি সত্যিই রানির মতো সেজে যেতে পারো?”

গণেশ হেসে বলল, “হ্যাঁ, পারি। তুই চাইলে তোকে দেখাব।”

চন্দনা মাথা নাড়ল। তার চোখে তখন আগ্রহ।

তারপর থেকে চন্দনা প্রায় রোজই বিকেলে যায় গণেশর ঘরে। বসে দেখে, গণেশ কেমন করে রঙ লাগায়, কাপড় জড়ায়। গণেশ তাকে নানা গল্প শোনায়—রাম, সীতা, শিব, রানি লক্ষ্মীবাই… সব।

একদিন চন্দনা জিজ্ঞেস করল, “তোমার নিজের কোনো গল্প নেই?”

গণেশ একটু চুপ করে থাকল। তারপর বলল, “আছে। তবে সে গল্পে রঙ নেই, মুখোশ নেই। শুনবি একদিন?”

চন্দনা চুপচাপ বসে থাকল। তার চোখে তখন অনেক প্রশ্ন।

গণেশ শুধু বলল, “আমি একদিন বলব… আমার নিজের কথা। আমি কীভাবে বহুরূপী হলাম।”

চন্দনার মনে হল, গণেশ শুধু সাজে না। সে নিজের ভেতরের কথাও লুকিয়ে রাখে। আর সেই কথাগুলিই সে জানত চায়।

পর্ব ২

গণেশের ঘরটা ছোট হলেও বড় সাজঘরের মতো। একটা বাঁশের খাট, পাশে লোহা দেওয়া একটা আয়না, পুরোনো টিনের বাক্সে ভরা রঙ, কাপড় আর টুকটাক জিনিস। ঘরের দেয়ালে ঝুলছে কিছু ছবি—রাম, সীতা, শিব, রানি লক্ষ্মীবাই।

চন্দনা এখন প্রায় রোজ আসে বিকেলে। স্কুল থেকে ফিরে জামা পাল্টে ছোট্ট খাতা আর পেনসিল নিয়ে চলে আসে গণেশের ঘরে। ওখানে বসে সে দেখে—কীভাবে গণেশ ধীরে ধীরে বদলে যায়।

একদিন গণেশ সেজে উঠছিল রাম। মাথায় সোনালি মুকুট, হাতে ধনুক। মুখে একধরনের শান্ত ভাব। চন্দনা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল।

গণেশ বলল, “এই রামটা করতে গেলে মনটা আগে শান্ত করতে হয়। কারণ রাম রাগ করে না, কাঁদেও না, কেবল ভালোবাসে।”

চন্দনা মাথা নাড়ল, “তুমি আগে রাগ করতে?”

গণেশ একটু হেসে বলল, “অনেক রাগ ছিল। ছোটবেলায় তো খুব ঝগড়া করতাম। এখন রঙ মেখে চরিত্রে ঢুকলে সব রাগ চলে যায়।”

চন্দনার ভালো লেগে গেল কথা শুনে।

সে আবার জিজ্ঞেস করল, “তুমি রোজ রোজ এত সব সাজো কেন?”

গণেশ উত্তর দিল, “কারণ আমি চাই, যারা আমার নাটক দেখে, তারা গল্পটা বুঝুক। রূপ দেখে না থেমে, গল্পটা মনে রাখুক।”

চন্দনা চুপ করে গেল। তার মনেও অনেক কথা ঘুরছিল। সে ভাবছিল, স্কুলে তো কেউ এভাবে গল্প বলে না! এখানে গণেশ যা শেখায়, তা যেন বইয়ের থেকেও বেশি।

একদিন গণেশ একটা পুরোনো ছবি বার করল। ছবিটাতে তিনজন মানুষ—একটা ছোট ছেলে, একটা মেয়ে আর একজন বুড়ো লোক। চন্দনা বলল, “এরা কারা?”

গণেশ মুখটা একটু গম্ভীর করে ফেলল।

“ছেলেটা আমি,”—সে বলল আস্তে।
“মেয়েটা আমার বোন, নাম ছিল রাধা। আর বুড়ো লোকটা আমার ঠাকুরদা।”

“তোমার মা-বাবা?”—চন্দনা কৌতূহলে জিজ্ঞেস করল।

গণেশ বলল, “ওরা খুব ছোটবেলায় চলে গিয়েছিল। ট্রেন দুর্ঘটনা। তারপর এই ঠাকুরদা আমাদের মানুষ করেছিল। তিনিই আমাকে মুখোশ, সাজ, রঙ শেখান।”

চন্দনা অবাক হয়ে বলল, “তোমার ঠাকুরদাও কি বহুরূপী ছিলেন?”

গণেশ হেসে মাথা নাড়ল। “তিনি ছিলেন পথ নাটকের মানুষ। গ্রামে গ্রামে ঘুরে গল্প বলতেন। আমি তখন হাত ধরে বসে শুনতাম। তারপর একদিন বললেন, ‘তুইও গল্প বলবি, তবে মুখোশ পরে।’ তখন থেকেই শুরু।”

চন্দনা একটু চুপ করে থাকল। তারপর মুচকি হেসে বলল, “তোমার গল্পটা তো সিনেমার মতো!”

গণেশ হেসে ফেলল। “না রে, এ গল্প সিনেমা নয়, জীবন। তবে হ্যাঁ, রঙে ঢেকে রাখা থাকে অনেক কিছু।”

সেদিন তারা অনেকক্ষণ কথা বলল। চন্দনা সেদিন প্রথম বুঝল, গণেশ শুধু সাজে না, সে আসলে বাঁচে—প্রতিদিন নতুন রূপে।

চন্দনা ভাবল, তার ডায়েরিতে আজ লিখবে—
“গল্পের লোকজন শুধু বইতে থাকে না, তারা আমাদের পাশেও থাকে। তাদের মুখে রঙ, কিন্তু চোখে সত্যি গল্প।”

পর্ব ৩

সকাল থেকে মেঘলা আকাশ। হালকা হাওয়া বইছে। মাধবপুরে এখন পুজোর প্রস্তুতি চলছে জোরকদমে। গাছের ডালে ডালে আলো ঝুলছে। মাঠে চলছে মঞ্চ বানানোর কাজ।

গণেশ এখন খুব ব্যস্ত। এবার সে পুজোর মেলায় এক নতুন রূপে আসবে। সে এবার ঝাঁসির রানি সেজে অভিনয় করবে। সবাই অবাক হয়েছে এই কথা শুনে।

কেউ কেউ হেসেছে, কেউ আবার বলেছে, “ছেলে হয়ে মেয়ে সেজে অভিনয়! মানায়?”

কিন্তু গণেশ কারো কথায় কান দেয় না। সে শুধু বলে, “গল্প বড়, রূপ নয়। রানি লক্ষ্মীবাই একজন সাহসী মানুষ ছিলেন। আমি শুধু ওর গল্পটা বলব।”

চন্দনা পাশে বসে সব শুনছিল। তার খুব ভালো লাগছিল এই আত্মবিশ্বাস। সে চুপচাপ গণেশর কাজ দেখছিল—সে কীভাবে পরচুলা বানাচ্ছে, কীভাবে লাল শাড়ি কাটছাঁট করে সাজাতে হচ্ছে, কেমন করে চোখে কাজল দিতে হবে।

“আমি সাহায্য করব?”—চন্দনা জিজ্ঞেস করল।

গণেশ মুচকি হেসে বলল, “অবশ্যই। তুই তো আমার এখন ছোট্ট সহকারী।”

চন্দনার মুখে হাসি ফুটল। সে আঙুলে রঙ লাগিয়ে পরচুলার মধ্যে ফুল আঁকতে লাগল। তার খুব ভালো লাগছিল এই কাজ করতে।

হঠাৎ চন্দনা বলল, “তুমি কি কখনো শহরে গিয়ে অভিনয় করেছো?”

গণেশ একটু চুপ করে বলল, “একবার গিয়েছিলাম কলকাতায়। এক নাট্যগোষ্ঠী ডাক দিয়েছিল। কিন্তু বেশি দিন থাকতে পারিনি।”

“কেন?”—চন্দনা জিজ্ঞেস করল।

গণেশ বলল, “ওখানে মানুষ রূপ দেখে, গল্পটা বোঝে না। আমি গল্প শোনাতে ভালোবাসি। তাই ফিরে এসেছিলাম।”

চন্দনা ভাবল, কী অদ্ভুত মানুষ! শহরের চাকচিক্য ছেড়ে ফিরে এসেছে নিজের ছোট্ট গ্রামে, শুধু গল্প বলার জন্য!

সেদিন সন্ধ্যায় চন্দনা তার ডায়েরিতে লিখল—
“গণেশ দাদার মতো মানুষ হয়তো খুব কম দেখা যায়। যিনি নিজের জীবন দিয়ে গল্প বানান।”

পরদিন স্কুলে চন্দনার বাংলা শিক্ষক বললেন, “পুজোর অনুষ্ঠানে তোমরা কেউ কেউ নাটক করবে তো?”

কেউ কেউ হাত তুলল। চন্দনা একটু ভাবল, তারপর আস্তে করে হাত তুলল।

সবার চোখ কপালে! চুপচাপ মেয়েটা নাটক করবে?

শিক্ষক হেসে বললেন, “তুমি কি চরিত্র ভেবেছো?”

চন্দনা বলল, “আমি গণেশ দাদার কাছ থেকে শিখেছি রানি লক্ষ্মীবাইয়ের গল্প। আমি সেটা করব।”

সবার মুখে বিস্ময়। কিন্তু চন্দনার চোখে ভরসা।

সন্ধ্যায় সে গিয়ে গণেশকে সব বলল। গণেশ একটু চুপ করে থাকল। তারপর ধীরে ধীরে বলল, “তুই পারবি, আমি জানি।”

চন্দনা বলল, “তুমি আমাকে রানি সাজতে শেখাবে?”

গণেশ হেসে বলল, “তুই শুধু মন দিয়ে কর, আমি রূপ ঠিক করে দেব।”

সেই দিন থেকেই শুরু হল নতুন এক পথ। এক মেয়ে আর এক বহুরূপী—একসাথে তৈরি হচ্ছে এক নতুন গল্প।

পর্ব ৪

সকাল সকাল চন্দনা গণেশর ঘরে এল। হাতে খাতা আর ছোট একটা থলি। খাতায় সে রোজ লিখে রাখছে কী কী শিখছে। আর থলিতে নিয়ে এসেছে একটা লাল রুমাল—সাজের সময় কাজে লাগবে।

গণেশ তখন কাঁধে একটা কাপড় নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। মুখে হালকা হাসি, চোখে মনোযোগ।

“আজ থেকে শুরু,” গণেশ বলল, “রানির সাজ শুধু রঙ নয়, মনেও সাহস আনতে হয়।”

চন্দনা বসে পড়ল খাটের ধারে। গণেশ প্রথমে তাকে দেখাল কেমন করে চোখে কাজল দিতে হয়। তারপর বলল, “রানির চোখে থাকত জেদ, কিন্তু মুখে থাকত শান্তি। দুইটাই দরকার।”

চন্দনা চেষ্টা করল। কিন্তু প্রথমবারেই চোখে কাজল দিতে গিয়ে হেঁচকি খেল। চোখ জ্বালা করে উঠল। জল এসে গেল।

গণেশ সঙ্গে সঙ্গে জল দিল চোখে। তারপর হেসে বলল, “রানি হতে গেলে একটু জল, একটু জ্বালা সহ্য করতেই হয়।”

চন্দনা হেসে ফেলল। তারপর আবার চেষ্টা করল।

একটু একটু করে শেখা শুরু হল—কীভাবে হাঁটতে হয়, কেমন করে ডায়লগ বলতে হয়, কেমন করে তলোয়ার ধরা যায়। গণেশ একটা কাঠের তলোয়ার বানিয়ে দিল, বলল, “এই নিয়ে চালাবে, ওজনও কম, ভাঙবেও না।”

চন্দনার খুশি দেখে বোঝা যায়—সে যেন রানি হয়ে উঠছে আস্তে আস্তে।

সন্ধের দিকে গণেশ তার একটা পুরোনো পোশাকের বাক্স থেকে একটা লাল-সোনালি জামদানি শাড়ি বের করল। বলল, “এটা আমার বোন রাধার। পুজোর নাটকে সে পরত। এবার তুই পরবি।”

চন্দনা অবাক হয়ে বলল, “তুমি দিচ্ছো আমায়?”

গণেশ বলল, “রাধা যেখানেই থাক, নিশ্চয় খুশি হবে তোকে দেখে। তুই তার মতই সাহসী।”

চন্দনা হাতে শাড়িটা নিয়ে খুব যত্ন করে রাখল।

সেই রাতে সে ঘুমোতে পারল না। বার বার মনে পড়ছিল গণেশ দাদার কথা, রাধার কথা, রঙের কথা, আর সেই লাল শাড়ির কথা।

পরদিন সকাল থেকে আবার রিহার্সাল শুরু হল।

গণেশ বলল, “চোখে দেখে নয়, মনে করে অভিনয় করবি। যেমন ধর, যুদ্ধের সময় রানি কী ভাবত? ভয় পেত না, বরং বলত, ‘আমি আমার ঝাঁসিকে ছেড়ে যাব না।’”

চন্দনা বারবার সেই লাইনটা বলছিল—“আমি আমার ঝাঁসিকে ছেড়ে যাব না!”

একসময় বলার সময় তার চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল। গণেশ চুপ করে তাকিয়ে রইল।

সে বুঝল—চন্দনা এখন আর শুধু সাজছে না, সে বুঝে ফেলেছে রূপের মানে।

সন্ধ্যায় মাঠে অনুষ্ঠান মঞ্চে সাজ সাজ রব। প্যান্ডেল তোলা হয়ে গেছে। আলো ঝলমলে।

চন্দনা মঞ্চের পেছনে বসে আছে। পাশে গণেশ।

গণেশ বলল, “তুই পারবি রে। শুধু মনে রাখিস—রূপটা বাইরের, কিন্তু সাহসটা ভেতরের।”

চন্দনা মাথা নাড়ল।

হঠাৎ মাইকে ডাক এল—“চন্দনা মিত্র, প্রস্তুত হন, আপনার দৃশ্য শুরু হচ্ছে।”

চন্দনার বুকটা দপদপ করছে, কিন্তু মুখে একরকম শান্ত ভাব।

সে উঠে দাঁড়াল, তলোয়ারটা হাতে নিল, চোখে কাজল ঠিক করল, আর ধীরে ধীরে মঞ্চের দিকে হাঁটতে লাগল।

আলো পড়ল তার মুখে। আর সামনে বসে থাকা সব মানুষ নিঃশব্দে চেয়ে রইল।

একটা ছোট মেয়ে—আজ রানি হয়ে উঠল।

পর্ব ৫

চন্দনা ধীরে ধীরে মঞ্চে উঠল। তার গায়ে লাল-সোনালি শাড়ি, চোখে গাढ़ কাজল, হাতে কাঠের তলোয়ার। পেছনে বাজছে দেশাত্মবোধক সঙ্গীত। সামনে বসে শত শত মানুষ—গ্রামের লোক, ছোট বড় সবাই।

গণেশ পাশে দাঁড়িয়ে ছিল পর্দার আড়ালে। তার চোখে তখন মায়া, গর্ব আর শান্তি একসঙ্গে।

চন্দনা প্রথম ডায়লগ বলল—“আমি রানি লক্ষ্মীবাই। আমি মেয়েমানুষ, তবু আমি সৈনিক। আমি আমার দেশ ছেড়ে পালাব না!”

শুনে পুরো মাঠে নীরবতা নেমে এল। যেন কেউ নিঃশ্বাস ফেলছেও না।

তারপর চন্দনা হাঁটতে লাগল এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। গলা জোরে জোরে বলছে, চোখে আগুন, মুখে দৃঢ়তা। নাটকে তার বিপরীতে যারা ছিল, তারাও হতবাক হয়ে গেছিল—এত সাহস, এত বিশ্বাস ছোট্ট একটা মেয়ের!

চন্দনা তখন আর শুধু চন্দনা নয়—সে হয়ে গেছে ঝাঁসির রানি।

নাটক শেষ হতে না হতেই হাততালির শব্দে মঞ্চ কেঁপে উঠল। দর্শকরা উঠে দাঁড়িয়ে তালি দিচ্ছে। কেউ কেউ সিটি বাজাচ্ছে, কেউ আবার চোখ মুছছে।

চন্দনা মাথা নিচু করে নমস্কার করল। তারপর ধীরে ধীরে নেমে এল মঞ্চ থেকে।

গণেশ তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর একটাও কথা না বলে এগিয়ে এসে তার কপালে একটা ছোট্ট টিপ পরিয়ে দিল—লাল রঙের।

চন্দনা ফিসফিস করে বলল, “আমি পারলাম, দাদা?”

গণেশ মাথা নাড়ল, “তুই শুধু পারিস না, তুই আজ ইতিহাস লিখেছিস। তোকে দেখে আজকের ছোটরা সাহস শিখবে।”

চন্দনার মুখে একরকম শান্ত হাসি।

সেই রাতে গ্রামের লোকেরা গণেশকে অনেক সাধুবাদ জানাল। কিন্তু সে শুধু বলল, “ও সব চন্দনার কৃতিত্ব। আমি শুধু একটা পথ দেখিয়েছি।”

চন্দনা বাড়ি ফিরেই ডায়েরি খুলল। লিখল—

“আজ আমি প্রথম বুঝলাম, সাজ মানে শুধু রঙ নয়। সেটা সাহস, বিশ্বাস আর গল্প বলার ইচ্ছা। গণেশ দাদা আমার রং নয়, চোখে সাহস দেখিয়ে দিয়েছেন।”

পরদিন সকালবেলা, চন্দনা যখন স্কুলে এল, তখন সবাই তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল। যেসব ছেলেমেয়েরা আগে কথা বলত না, তারাও এসে বলছে—“তুই তো দারুণ করেছিস!”

চন্দনার গাল লাল হয়ে উঠল লজ্জায়। সে শুধু হেসে বলল, “গণেশ দাদার জন্যই পেরেছি।”

একজন শিক্ষক এসে বললেন, “তুমি আমাদের স্কুলের গর্ব।”

সেদিন বিকেলে চন্দনা আবার গেল গণেশের ঘরে।

গণেশ তখন একটা ছবি আঁকছিল। ছবিটাতে সে এঁকেছে দুই মুখ—একটা মুখে রঙ, মুখোশ; আরেকটা মুখ খালি, কিন্তু চোখে আলো।

চন্দনা বলল, “এটা কার ছবি?”

গণেশ মুচকি হেসে বলল, “তুই আর আমি।”

চন্দনা কিছু বলল না, শুধু বসে রইল চুপচাপ।

মাঠে বাতাস বইছে। আকাশে হালকা রোদ। আর ছোট্ট ঘরের ভেতর, দুই মানুষ—একজন রূপ বদলে গল্প বলে, আর একজন সেই গল্পে সাহস খোঁজে।

পর্ব ৬

পুজো পেরিয়ে গেছে। গ্রাম এখন আবার আগের মতো শান্ত। আলো ঝলমলে প্যান্ডেল গ dismantle হয়ে গেছে, মাঠটা ফাঁকা। কিন্তু চন্দনার মনে রয়ে গেছে সেই মঞ্চের আলো, তালি আর গণেশ দাদার মুখ।

সে এখন প্রতিদিন স্কুলের পড়া শেষে কিছু সময় কাটায় গণেশর সঙ্গে। কিন্তু আজ বিকেলটা একটু আলাদা ছিল।

চন্দনা এসে দেখে, গণেশর ঘরের দরজা বন্ধ। সে একটু ঘাবরে গেল। দরজার গায়ে টোকা দিল।

ভেতর থেকে কোনো সাড়া নেই।

কিছুক্ষণ পরে ধীরে ধীরে দরজা খুলে গেল। গণেশর মুখে কোনো রঙ নেই, চোখে কালি, চুল এলোমেলো।

“তুমি অসুস্থ?”—চন্দনা জিজ্ঞেস করল।

গণেশ মাথা নাড়ল, “না, শুধু একটু পুরোনো কথা মনে পড়ছিল।”

চন্দনা ভিতরে ঢুকে বসল। দেখল, এক পাশে একটা পুরোনো থলে খোলা, তার ভেতরে অনেক চিঠি, ছবি আর একটা পুরোনো রুমাল।

গণেশ একটা চিঠি তুলে বলল, “এটা রাধার লেখা… আমার ছোট বোন।”

চন্দনা চুপ করে শুনছিল।

গণেশ আস্তে বলল, “ও খুব ভালো নাটক করত। আমি তখনও তেমন কিছু শিখিনি। ও-ই আমার প্রথম শিক্ষক ছিল। পুজোর মেলায় আমরা দুজন সেজে মঞ্চে উঠতাম—একজন রাম, একজন সীতা। মানুষ দেখে খুব খুশি হতো।”

“তারপর?”—চন্দনা আস্তে জিজ্ঞেস করল।

“একবার শহর থেকে একটা লোক এলো। বলল, ওকে বড় নাট্যদলে নিতে চায়। আমি খুশি হলাম। কিন্তু রাধা বলল, সে যাবে না। সে শুধু গ্রামের লোকের জন্য অভিনয় করতে চায়।”

“একদিন, এক সন্ধ্যায়, ও স্টেশন পার হতে গিয়ে দুর্ঘটনায়… আর ফিরল না।”

গণেশ চুপ করে গেল। চোখে জল। চন্দনা তার হাত ধরল।

গণেশ বলল, “তুই জানিস? আমি বহুরূপী হইনি রঙের জন্য, বা খ্যাতির জন্য। আমি হইছি রাধার অসম্পূর্ণ গল্প শেষ করতে।”

চন্দনা আস্তে বলল, “তুমি তো একা নও। আমি আছি। আমরা মিলে ওর গল্পটা শেষ করব।”

গণেশ তাকিয়ে থাকল চন্দনার দিকে। সে যেন নিজের ছোট বোনকেই দেখল।

সেদিন সন্ধ্যায় তারা একসঙ্গে বসল। গণেশ তার রঙের কৌটো বার করল, মুখে একটুখানি সাদা রঙ লাগাল।

চন্দনা বলল, “আজ কে হবে তুমি?”

গণেশ বলল, “আজ নিজেকে সাজাবো না। আজ শুধু একটা গল্প বলব—রাধার গল্প। তুই শোনবি?”

চন্দনা মাথা নাড়ল। ঘরের ভেতর তখন বাতাসও থেমে আছে যেন।

গল্পের শুরু হল—একটা মেয়ে, যার স্বপ্ন ছিল অভিনয়, আর একটা ভাই, যে তার স্বপ্নকে জীবন্ত করে রাখে।

পর্ব ৭

পুজোর পর আবার শুরু হল গ্রামের বার্ষিক মেলা। স্কুল মাঠের এক কোণ জুড়ে বসেছে পুতুলের দোকান, মাটির বাঁশির ডাক, জিলিপির ঘ্রাণ, আর ছোট ছোট খেলার স্টল।

চন্দনার স্কুল বন্ধ, তাই সে সকাল থেকেই ঘোরাঘুরি করছে। কিন্তু তার মন পড়ে আছে এক জায়গাতেই—গণেশ দাদার নাটকের তাঁবু।

এবার গণেশ এক নতুন নাটক করবে ঠিক করেছে—নাম “রূপ বদলের গল্প”। এই নাটকে সে দেখাবে কীভাবে মানুষ মুখোশ পরে, আবার কখনো কখনো মুখোশ খুলে নিজেদের খোঁজে।

চন্দনা এবার শুধু দর্শক নয়—সে নাটকে একটা ছোট চরিত্রে অভিনয় করবে। একজন ছোট্ট মেয়ের, যে মুখোশ খুলে বলে, “আমি নিজে হতে চাই।”

সন্ধ্যায় মেলা জমে উঠেছে। আলো, গান, মানুষের কোলাহল—সব মিলে একটা উৎসবের মতন।

নাটকের জন্য একটা ছোট মঞ্চ বানানো হয়েছে তাঁবুর ভিতরে। চারদিকে মানুষের ভিড়। চেয়ার পেতে বসেছে কেউ, কেউ আবার মাটিতে।

চন্দনা মঞ্চের পাশে দাঁড়িয়ে আছে সাজপোশাক পরে। হাতে একটা ছোট মুখোশ। তার বুক ধড়ফড় করছে, কিন্তু মুখে শান্ত হাসি।

গণেশ এসে বলল, “ভয় পাস না। গল্প যদি তোর নিজের হয়, তাহলে কেউ তোকে থামাতে পারবে না।”

চন্দনা মাথা নাড়ল।

নাটক শুরু হল। প্রথম দৃশ্যেই গণেশ উঠল মঞ্চে—এক অদ্ভুত চরিত্রে। তার মুখে অর্ধেক সাদা, অর্ধেক লাল রঙ। সে বলছে, “আমি রূপ বদলাই, কারণ আমি সব হতে চাই, কিন্তু আমি নিজে কে, জানি না।”

এরপর একে একে নানা চরিত্র আসে—কেউ রাজা, কেউ ভিখারি, কেউ দেবতা, কেউ আবার একেবারে সাধারণ মানুষ।

শেষ দৃশ্য চন্দনার। সে মুখে মুখোশ পরে ওঠে মঞ্চে। তারপর ধীরে ধীরে মুখোশ খুলে ফেলে।

সে বলে, “আমি রূপ বদলাতে চাই না। আমি নিজে হতে চাই। আমি ছোট, আমি মেয়ে, তবু আমি নিজের কথা বলব।”

সেই কথা বলার সময় চন্দনার গলা কাঁপছিল, কিন্তু চোখে ছিল একরকম আলো।

গণেশ মঞ্চের কোণে দাঁড়িয়ে কাঁপা গলায় বলল, “এই হল আসল রূপ। এই হল সত্যি মুখ।”

সবাই তালি দিল।

নাটক শেষে এক বৃদ্ধ এসে গণেশকে বললেন, “তোমার নাটক শুধু চোখ নয়, মনকেও ছুঁয়ে গেল।”

গণেশ হেসে বলল, “এই নাটক আমার না। এটা রাধার, এটা চন্দনার, এটা আমাদের মতো সবার—যারা মুখোশ পরে বাঁচে, কিন্তু ভিতরে কোথাও সত্যি মুখ লুকিয়ে রাখে।”

চন্দনা সেই রাতে ডায়েরিতে লিখল—

“আজ আমি বুঝলাম, মঞ্চের আলো শেষ হয়ে গেলেও সত্যি কথা কখনো নিভে যায় না। গণেশ দাদা আমাকে শুধু নাটক শেখাননি, আমাকে নিজের মুখ খুঁজে পেতে সাহায্য করেছেন।”

পর্ব ৮

মেলা শেষ হয়েছে। মাঠ এখন ফাঁকা। আলো নেই, গান নেই। শুধু কিছু শুকনো ফুল আর ছেঁড়া কাগজ উড়ছে বাতাসে। কিন্তু চন্দনার মনে যেন রয়ে গেছে সেই সন্ধের শব্দ, আলো আর গণেশ দাদার চোখ।

আজ গণেশ দাদার ঘরে কোনো রঙ নেই। না মুখে, না কাপড়ে। খাটে বসে আয়নার সামনে তাকিয়ে আছে। কিন্তু সে নিজের মুখে নয়, চোখের ভেতরে কিছু খুঁজছে।

চন্দনা এসে ঢুকল। সে বলল, “আজ তুমি সাজো না?”

গণেশ মাথা নেড়ে বলল, “না রে। আজ আমি কেবল নিজের সঙ্গে বসে আছি। অনেকদিন শুধু রূপ পরে থেকেছি। আজ একটু নিজেকে দেখতে চাই।”

চন্দনা চুপ করে রইল। তারপর বলল, “তুমি কাঁদছো?”

গণেশ আস্তে বলল, “না। শুধু ভাবছি, রাধা থাকলে আজ কী বলত!”

চন্দনা বলল, “রাধা থাকলে গর্ব করত। আর বলত—‘তুমি একজনকে শুধু সাজিয়ে দাওনি, তুমি তাকে নিজের মুখ চিনতে সাহায্য করেছো।’”

গণেশ তাকাল চন্দনার দিকে। বলল, “তুই জানিস, রাধা মারা যাওয়ার পর আমি অনেকদিন রঙ ছুঁইনি। মুখোশও পরিনি। শুধু চুপ করে বসে থাকতাম। তারপর একদিন স্বপ্নে দেখলাম, রাধা বলছে—‘দাদা, গল্প থামাবি না। বল, তোর মতো করে বল।’ তখন থেকেই শুরু।”

চন্দনা বলল, “তুমি তো শুধু নিজের গল্প বলোনি, এখন তো আর একগুচ্ছ মানুষের গল্প বলছো।”

গণেশ হেসে ফেলল, “আমার রঙে যদি কেউ নিজের সাহস খুঁজে পায়, তাহলে সেটাই তো সবচেয়ে বড় কথা।”

চন্দনা একটা ছোট খাতা বার করল। খুলে দেখাল একটা পাতায় আঁকা দুই মুখ—একটা মুখে রঙ, আরেকটা খালি। নিচে লেখা—

“রঙ কেবল বাহির নয়, ভেতর থেকেও আলো ফোটে।”

গণেশ ওই পাতা হাতে নিয়ে বলল, “তুই শুধু লেখ, আঁকিস না—তুই তো গল্প আঁকিস।”

সেদিন বিকেলে তারা মিলে ঠিক করল—এবার একটা নতুন নাটক হবে। যেখানে গ্রামের ছেলেমেয়েরা, যারা কখনো মঞ্চে ওঠেনি, তারাও থাকবে। কেউ দেবতা হবে না, রাজাও নয়—তারা হবে নিজেদের মতো সাধারণ মানুষ।

নাটকের নাম ঠিক হল—“আমি আমি”।

চন্দনা বলল, “এইবার আমি শুধু অভিনয় করব না, বন্ধুদেরও নিয়ে আসব।”

গণেশ মাথা নাড়ল, “তোর মতো একজন থাকলে, রঙ ছাড়াও নাটক হয়।”

সেই রাতে, চন্দনা ঘুমোতে যাওয়ার আগে জানলার ধারে দাঁড়িয়ে চাঁদের আলোয় মুখ ধুয়ে নিয়ে ভাবল—
“গণেশ দাদার চোখে রঙ নেই, তবু সেই চোখেই আমি আমার সাহস খুঁজে পাই।”

পর্ব ৯

নতুন নাটকের রিহার্সাল শুরু হয়েছে। নাম—“আমি আমি”। মঞ্চে দেবতা, রাজা বা রানির সাজ নেই। সবাই নিজের মতো করে থাকবে, নিজের গল্প বলবে।

গণেশ বলেছে, “এই নাটকে কেউ সাজবে না, শুধু নিজের জীবন বলবে। যেমন তুই বলবি, তোর স্কুলে কীভাবে তোকে প্রথমে কেউ পাত্তা দিত না, কিন্তু তুই নাটকে কীভাবে নিজেকে চিনলি।”

চন্দনা প্রথমে একটু লজ্জা পেল। কিন্তু পরে ভাবল—এটাই তো সত্যি। এটাই সে।

নাটকে গ্রামের আরও কিছু ছেলেমেয়ে এসেছে—রফিক, যে পড়তে ভালোবাসে কিন্তু মাঠে কাজ করে; তানিয়া, যে গান গায় কিন্তু মঞ্চে কখনো ওঠেনি; আর ছোট্ট শিবা, যে মুখে কম কথা বলে কিন্তু চোখে অনেক কথা জমে থাকে।

গণেশ সবাইকে বলছে, “তোমরা কারো মতো হোও না। তোমাদের রূপ নিজেরাই হও।”

সবার rehearsal চলছে, কেউ নিজের গল্প লিখে বলছে, কেউ গান গাইছে, কেউ ছবি আঁকছে। মঞ্চে একেকটা মানুষ যেন একেকটা আলাদা গল্প।

চন্দনা নিজের জন্য একটা ডায়লগ ঠিক করেছে—
“আমি সবার মতো নই। আমি চুপচাপ, কিন্তু ভেতরে অনেক কথা জমে আছে। আমি ভয় পাই, কিন্তু তবু দাঁড়িয়ে থাকি। কারণ আমি নিজের মতো আমি।”

গণেশ বলল, “তুই যখন বলবি, মনে করে বলবি নিজের কথাই বলছিস। আর তখনই লোকেরা শুনবে মন দিয়ে।”

চন্দনা রোজ rehearsal-এর শেষে বাড়ি ফিরে মায়ের কাছে বলে, “মা, আমি এবার নিজে হচ্ছি। কেউ হয়ে দেখানোর দরকার নেই।”

মা মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে। সেই চুপচাপ মেয়েটা এখন কত কথা বলে!

গণেশ একদিন rehearsal শেষে সবাইকে বলল, “তোমরা জানো, আমি বহুরূপী, মানে আমি নানা রকম সাজি। কিন্তু এই প্রথমবার আমি নিজেকে সাজাচ্ছি না। তোমাদের মতো করে, নিজের মতো করে দাঁড়াচ্ছি।”

সবার চোখে তখন একটা আলাদা আলো। যেন তারা বুঝে গেছে—রূপ মানে শুধু বাইরে সাজা নয়, নিজের সত্যিটাও বলা।

চন্দনা ডায়েরিতে লিখল—

“আজ আমি আর কারো চরিত্রে অভিনয় করছি না। আমি নিজেকে বলছি, নিজের কথা বলছি। এটা শুধু নাটক নয়, এটা নিজেকে খুঁজে পাওয়া।”

গণেশ ঘরে ফিরে একটি নতুন পেইন্টিং শুরু করল। ছবিটাতে কারো মুখ নেই—শুধু অনেকগুলো চোখ। সব চোখ আলাদা, কিন্তু সব চোখেই আলো।

চন্দনা ছবিটা দেখে বলল, “এটা কারা?”

গণেশ মুচকি হেসে বলল, “এই তো—আমাদের মঞ্চের সব চরিত্র। মুখ না থাকলেও, চোখেই সব গল্প লেখা।”

পর্ব ১০

মাধবপুরের স্কুলে আজ ভীষণ ভিড়। মাঠে বড় মঞ্চ হয়েছে। পাশে কাগজে আঁকা পোস্টার—নাটকের নাম “আমি আমি”।

লোকজন ভোর থেকেই আসতে শুরু করেছে। কেউ স্কুলের বেঞ্চে বসেছে, কেউ মাটিতে পাটি পেতে। সবার মুখে একরকম আগ্রহ—আজ যে গণেশ দাদার নাটক!

চন্দনা আর তার বন্ধুরা মঞ্চের পেছনে সাজপোশাক ছাড়াই দাঁড়িয়ে। কারো হাতে শুধু একটা বই, কারো একটা ছবি, কারো গলায় নিজের লেখা গান।

কেউ কাউকে অনুকরণ করছে না। সবাই নিজেকে বলবে, নিজের মতো।

গণেশ আজ মঞ্চে উঠবে না। সে আজ পেছনে দাঁড়িয়ে থাকবে, ছায়ার মতো।

সে চন্দনার কাঁধে হাত রাখল। বলল, “আজ তুই শুধু তুই হ। তোর কথা বল। কারণ তোর জীবনের গল্পও একটা বড় নাটক।”

চন্দনা মাথা নাড়ল। তার বুক ধড়ফড় করছে, কিন্তু চোখে ভয় নেই।

নাটক শুরু হল।

প্রথম উঠল রফিক। বলল, “আমি মাঠে কাজ করি, কিন্তু আমি কবিতা ভালোবাসি।”

তারপর উঠল তানিয়া। গাইল নিজের লেখা গান—

“আমি মেয়ে, আমি গান, আমি স্বপ্ন—আমি নিজের নামে বাঁচতে চাই।”

চন্দনা উঠল মঞ্চে সবার শেষে।

সে একটুও সাজেনি, শুধু পরেছে সাদা সালোয়ার কামিজ, মুখে হালকা হাসি।

সে বলল—

“আমি অনেকদিন নিজের কথা বলিনি। চুপচাপ থেকেছি। ভাবতাম, আমি ছোট, আমি কি বলার মতো কিছু জানি?
কিন্তু গণেশ দাদা বলেছে—নিজের কথা বলাই সবচেয়ে বড় শক্তি।
আজ আমি বলছি—আমি আমি। আমি রঙ ছাড়া একটা গল্প।
যে গল্প শোনে, সে নিজের মুখ খুঁজে পায়।”

মাঠে নীরবতা।

তারপর শুরু হল হাততালি। শুধু হাততালি নয়—অনেকের চোখে জল।

গণেশ দাঁড়িয়ে রইল দূরে, অন্ধকার কোণে। সে কিছু বলল না, শুধু মুচকি হেসে কাঁধে একটা গামছা রাখল।

সন্ধ্যায় সবাই একসঙ্গে বসে চা খাচ্ছিল। চন্দনা বলল, “গণেশ দাদা, আজ তুমি কিছু বললে না কেন?”

গণেশ হেসে বলল, “আমি তো আজ বলিনি, আমি শুনেছি। আর আজ আমি বুঝেছি, আমার সাজে রঙ ছিল, আর তোমাদের মুখে আলো। সেই আলো জ্বলেই থাকবে।”

চন্দনা বলল, “তুমি কি এবার আর মুখোশ পরবে না?”

গণেশ বলল, “হয়তো পরব, কিন্তু শুধু নাটকের জন্য। নিজের জীবনে আমি এখন শুধু গণেশ—একজন মানুষ, যার রঙ হল ভালোবাসা, আর মুখোশ হল গল্পের বাহানা।”

রাতে চন্দনা তার ডায়েরির শেষ পাতায় লিখল—

“রূপ বদলালেও মন বদলায় না। মুখোশ খুলে, যে নিজের চোখে নিজের মুখ দেখে—সেই তো সত্যিকারের মানুষ।”

নাটকের আলো নিভে যায়, মঞ্চ ফাঁকা হয়।
কিন্তু সেই মানুষটা, যে রূপ বদলাতে বদলাতে অন্যদের মুখ খুঁজতে সাহায্য করে—সে থেকে যায় গল্পের মতো, আলো হয়ে।

সমাপ্ত

1000024454.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *