অয়ন চক্রবর্তী
পর্ব ১: উত্তরাধিকার
কলকাতার ব্যস্ত জীবন থেকে অনেক দূরে, পুরোনো গ্রাম বাড়িটায় পা রাখতেই অর্কের মনে হল যেন সময় থমকে দাঁড়িয়ে আছে। চারদিক নিস্তব্ধ, কেবল বাতাসে খেজুরপাতার শোঁ-শোঁ শব্দ। অর্ক বহু বছর পর ফিরেছে এখানে—তার ঠাকুরদার মৃত্যুর খবর পেয়েই। ছোটবেলা কেটেছিল এই বাড়িতেই, তারপর বাবা-মায়ের সঙ্গে শহরে উঠে যাওয়া। ঠাকুরদা ছিলেন একেবারে গ্রামীণ মানুষ, কিন্তু তার চোখে একটা অদ্ভুত দীপ্তি ছিল, যেন তিনি অনেক অজানা কিছু জানতেন।
বাড়ির ভেতর পা রাখতেই ধুলোমাখা গন্ধ নাকে এল। মাটির দেওয়ালে ফাটল ধরেছে, সিঁড়িতে শেওলা জমেছে। কিন্তু ঠাকুরদার ঘরটা ছিল যেমন ছিল, তেমনই আছে। বাঁশের খাট, একপাশে বইয়ের তাক, আর পুরোনো কাঠের আলমারি। অর্ক দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ, মনে হল এই মাত্র যেন ঠাকুরদা বেরিয়ে যাবেন।
গ্রামের লোকজন বলল—ঠাকুরদা মৃত্যুর আগে বারবার অর্কের নাম করে গিয়েছিলেন। “অর্ককে বলবি, ওর জন্য কিছু রেখে যাচ্ছি।” অর্ক প্রথমে ভেবেছিল হয়তো কোনও পুরোনো বই বা দলিল। কিন্তু আলমারির ভেতর যখন খুঁজতে শুরু করল, তখনই চোখে পড়ল একটা ছোট কাঠের বাক্স। বাক্সটা এতটাই পুরোনো যে তালা প্রায় গলে এসেছে।
অর্ক সাবধানে তালা ভেঙে বাক্স খুলল। ভেতরে কাপড়ে মোড়ানো কিছু একটা রাখা। কাপড় সরাতেই বেরিয়ে এল একটি রুদ্রাক্ষ—গাঢ় বাদামি রঙ, অদ্ভুত দীপ্তি ছড়াচ্ছে। কিন্তু এটাকে দেখে অর্কের মনে কেমন যেন অস্বস্তি হল। সাধারণ রুদ্রাক্ষের চেয়ে যেন অনেক বেশি ভারী, অনেক বেশি তীক্ষ্ণ।
হঠাৎ মনে পড়ল ঠাকুরদার শেষ কথা। মৃত্যুশয্যায় তিনি বলেছিলেন,
“এই জিনিসটাকে অবহেলায় রেখো না। এর ভেতরে যা আছে, তাকে সম্মান করতে শিখো।”
অর্ক তখন বুঝতে পারেনি কথার মানে। কিন্তু হাতে নেওয়া মাত্রই এক শিহরণ তার শরীর বেয়ে গেল। মনে হল কারও ঠান্ডা হাত তার আঙুলে স্পর্শ করছে। বুক ধকধক করতে লাগল।
রুদ্রাক্ষ হাতে নিয়েই তার চোখ ঝাপসা হতে শুরু করল। চারপাশের দেয়াল, আলমারি, খাট সব মিলিয়ে অন্ধকারে ডুবে গেল। আরেকটা জগৎ যেন খুলে গেল তার সামনে। শূন্য অন্ধকার মাঠ, চারদিকে দমবন্ধ করা নিস্তব্ধতা। দূরে মৃদু আগুনের আভা। আর সেই অগ্নিশিখার ভেতর থেকে ভেসে আসছে মন্ত্রোচ্চারণ—অচেনা, অদ্ভুত, ভয়াবহ।
“ॐ… नाहं… कालाय… श्मशानाय…”
অর্কের মনে হল ছায়ার মতো কিছু দাঁড়িয়ে আছে সামনে। তারা অনেক, অস্পষ্ট অবয়ব, যেন মানুষের মতো আবার যেন নয়। তাদের চোখ নেই, মুখ নেই, তবু কোথা থেকে যেন কণ্ঠ ভেসে আসছে।
“এসো… এসো… তুমি এসেছ অবশেষে…”
অর্ক চিৎকার করে উঠতে চাইলো, কিন্তু গলা থেকে কোনও শব্দ বের হল না। রুদ্রাক্ষের দীপ্তি ক্রমশ বাড়ছে, যেন ভেতর থেকে আগুনের শিখা বেরোচ্ছে।
পরের মুহূর্তেই সব মিলিয়ে গেল। অর্ক হাঁপাতে হাঁপাতে জেগে উঠল খাটে বসে। তার হাতে এখনও সেই রুদ্রাক্ষ। কপালে ঘাম জমেছে, শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত নেমে যাচ্ছে।
সে জানল—এটা কেবল স্বপ্ন নয়। কিছু একটা তাকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল অন্য কোথাও।
কিন্তু কেন?
রুদ্রাক্ষের অভিশাপের প্রথম পরশ কি এটাই?
পর্ব ২: ছায়ার মন্ত্র
সকালবেলা গ্রামের উঠোনে পাখির ডাক, নারকেলপাতার ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো এসে পড়েছে। সব কিছু স্বাভাবিক মনে হলেও অর্কের বুকের ভেতরটা যেন কাঁপছে। রাতে যা ঘটেছে, সেটাকে সে শুধু স্বপ্ন বলে উড়িয়ে দিতে পারছে না। রুদ্রাক্ষ এখনও তার বালিশের পাশে রাখা, অথচ সেটা দেখলেই বুকের ভেতর চাপা আতঙ্ক গুমরে ওঠে।
সে আয়নায় নিজের মুখের দিকে তাকাল—চোখ লালচে, ঠোঁট শুকনো, যেন কয়েক রাত ঘুমোয়নি। মনে হল মুখের ওপর কারও অদৃশ্য ছায়া লেগে আছে। হাত ধুতে গিয়ে দেখল আঙুলে হালকা কালি-কালি দাগ। গত রাতে রুদ্রাক্ষ ধরার পরেই কি এভাবে রয়ে গেছে?
অর্ক রুদ্রাক্ষটাকে আবার হাতে নিল। ঠান্ডা, অদ্ভুত এক শিরশিরানি ছড়িয়ে পড়ল শরীরে। সঙ্গে সঙ্গে কানে বাজতে শুরু করল মন্ত্রোচ্চারণ। শব্দটা বাইরের নয়—ভেতর থেকে ভেসে আসছে, যেন তার নিজের মাথার মধ্যে।
“ॐ त्र्यम्बकं… यजामहे… সুগন্ধिं… पुष्टिवर्धनम्…”
অচেনা, তবু কোথাও যেন চেনা। মন্ত্রটা আগে কোথাও শুনেছে মনে হচ্ছে। ঠাকুরদার ঘরে বসে থাকাকালে শৈশবে হয়তো? কিন্তু তখন তো সে কিছু বুঝত না। আজ এই মন্ত্র উচ্চারণ তার মগজে গভীর দাগ কেটে যাচ্ছে।
হঠাৎ দরজায় টোকা পড়ল। পাশের বাড়ির রেণুকাকাকু ঢুকলেন। গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন,
—“শোন, তোর ঠাকুরদা শেষদিকে বারবার বলে গেছেন—অর্ক যেন সাবধানে থাকে। কিছু জিনিস আছে, যেগুলো খুঁজে না দেখলেই ভালো।”
অর্ক চমকে উঠে জিজ্ঞেস করল, “আপনি জানেন কীসের কথা বলছিলেন?”
কাকু চোখ নামিয়ে নিলেন। বললেন,
—“রুদ্রাক্ষের কথা… জানি। তবে এর বেশি বলব না। তোর ঠাকুরদার গুরু একসময় তন্ত্রসাধনা করতেন। সেই সাধনার টুকরো জিনিসপত্র আজও ঘরে ঘরে লুকিয়ে আছে। সাবধানে থাকিস।”
অর্ক কিছু বলতে চাইল, কিন্তু কাকু তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে গেলেন। তার চোখে ভয় ঝলকাচ্ছিল।
সন্ধে নামলেই অর্কের ভেতর অস্থিরতা বাড়তে লাগল। রুদ্রাক্ষ যেন ডাকছে। সে ইচ্ছে করেও হাত থেকে সরাতে পারছে না। অবশেষে রাতে বিছানায় শুয়ে যখন রুদ্রাক্ষ আঁকড়ে ধরল, তখন আবার চারপাশ ঝাপসা হয়ে গেল।
সে পৌঁছে গেল সেই অন্ধকার প্রান্তরে। দূরে আগুন জ্বলছে, আর ছায়ামূর্তিগুলো দাঁড়িয়ে আছে। আজ তারা আরও কাছে এসেছে। তাদের মুখ নেই, চোখ নেই, তবু অস্পষ্ট মুখোশের মতো কিছু একটার আড়ালে ঠোঁট নড়ছে।
“পড়… পড়… মন্ত্র পড়…”
অর্ক হঠাৎ নিজের গলা থেকে শব্দ বের হতে শুনল। সে নিজেই সেই অচেনা মন্ত্র উচ্চারণ করছে—
“ॐ हौं जूं सः…”
কণ্ঠস্বর তার নিজের, অথচ যেন অন্য কেউ বলাচ্ছে। প্রতিটি শব্দ উচ্চারণের সঙ্গে শরীর কাঁপছে, হাত-পা অসাড় হয়ে যাচ্ছে।
ছায়ারা হেসে উঠল। সেই হাসি অর্কের মাথার ভেতর খনखन করে বাজল।
“তুমি আমাদের খুঁজে পেয়েছ… তুমি এসেছ যজ্ঞ পূর্ণ করতে…”
অর্ক ভয়ে চিৎকার করে উঠল, “কে তোমরা? আমি তোমাদের কিছু চাই না!”
কিন্তু ছায়ারা একসঙ্গে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“তুমি চাইলেই আর ছাড়তে পারবে না। তোমার রক্তে আমাদের উত্তরাধিকার। তোমার ঠাকুরদা আমাদের পথ রোধ করেছিলেন, কিন্তু তুমি হবে শেষ সেতু।”
অর্ক হোঁচট খেয়ে মাটিতে পড়ে গেল। চারপাশে আগুনের আভা তীব্র হয়ে উঠল, যেন কোনও যজ্ঞকুণ্ডের সামনে সে বসে আছে। চোখ বন্ধ করতেই হঠাৎ শরীর হালকা হয়ে গেল।
যখন আবার চোখ খুলল, তখন সে নিজের ঘরে। কপাল ঘামে ভিজে গেছে, বুক ওঠানামা করছে। হাতে রুদ্রাক্ষ এখনও আঁকড়ে আছে। কিন্তু এবার তার ঠোঁট থেকে রক্তের হালকা দাগ বেরিয়েছে, যেন অদৃশ্য দাঁত কামড়ে দিয়েছে তাকে।
সে বুঝল—রুদ্রাক্ষ কেবল মন্ত্র শোনাচ্ছে না, ধীরে ধীরে তাকে নিজের দখলে নিচ্ছে।
পর্ব ৩: নিষিদ্ধ যজ্ঞের ইতিহাস
রুদ্রাক্ষ হাতে নেবার পর থেকে দিনগুলো যেন অর্কের জীবনে অদ্ভুত ভার বহন করতে শুরু করল। সকালে উঠেই মনে হচ্ছিল কেউ যেন তার বুকের ওপর বসে আছে। গ্রামের বাড়ির প্রতিটি জিনিসের দিকে তাকালেই মনে হত ঠাকুরদা যেন চোখ মেলে কোথাও থেকে তাকিয়ে আছেন। বিশেষ করে সেই আলমারির ভেতরের পুরোনো কাগজপত্র।
অর্ক একদিন সাহস করে বাক্সের নিচে রাখা হলুদে দাগ ধরা কিছু চিঠি খুলে দেখল। কাগজের গায়ে কালি প্রায় মিলিয়ে গেছে। বেশিরভাগই ছিল ঠাকুরদার হাতের লেখা। তারিখ লেখা—১৯৬২, ১৯৭৪, ১৯৮১… চিঠিগুলোতে কারও উদ্দেশে লেখা হয়নি, যেন নিজের কাছে নিজেরই ডায়েরি।
প্রথম কয়েকটি পাতায় সাধারণ গ্রামের বর্ণনা, চাষবাস, পরিবারের খোঁজখবর। কিন্তু পরে লেখা ক্রমশ বদলাতে শুরু করল। অর্ক পড়তে পড়তে থমকে গেল—
“আজ রাতে আবার গুরুজির ডাকে শ্মশানে যেতে হল। তিনি বললেন—‘মৃত্যুকে জয় করতে চাইলে প্রাণ দাও, রক্ত দাও।’ শ্মশানকুণ্ডে বসে রুদ্রাক্ষ হাতে মন্ত্রপাঠের সময় চারদিক অন্ধকারে ডুবে গেল। হঠাৎ আমি দেখলাম মানুষের ছায়ার মতো কতগুলো অবয়ব এসে দাঁড়িয়ে আছে। গুরুজি বললেন, তারা আমাদের ত্যাগ চায়। কিন্তু আমি ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেলাম। আমি জানি, যজ্ঞ অসমাপ্ত রয়ে গেল। রুদ্রাক্ষ তাই অভিশপ্ত।”
অর্কের হাত কাঁপতে লাগল। ঠাকুরদা যে গোপন সাধনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তা সে কখনও কল্পনাও করেনি।
আরেকটা পাতায় লেখা—
“আমার গুরু অমরত্ব চাইতেন। মৃত্যুর ভয়ে তিনি তন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিলেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে আমি তাকে থামিয়ে দিয়েছিলাম। সেই দিন থেকে রুদ্রাক্ষ আমার ঘাড়ে অভিশাপ হয়ে রইল। আমি জানি, একদিন আমার বংশধরের হাতে এটা যাবে। তখন হয় যজ্ঞ শেষ হবে, নয়তো রক্তে রক্ত মিশে যাবে।”
অর্ক বুক ধড়ফড় করতে করতে চিঠিটা ভাঁজ করল। তার মনে হল ঠাকুরদা যেন অনেক আগেই তার ভাগ্য লিখে গেছেন।
সন্ধে নামতেই আবার ভেতরে অস্থিরতা শুরু হল। রুদ্রাক্ষটা কাপড়ে মুড়ে যতই দূরে রাখতে চায়, ততই যেন সেটা তাকে টানছে।
অর্ক খাওয়ার টেবিলে বসেছিল। হঠাৎ কানে ভেসে এল সেই অচেনা মন্ত্র। চারপাশে কেউ নেই, অথচ শব্দটা যেন দেওয়ালের ফাঁক দিয়ে আসছে।
“ॐ क्षौं… रूद्राय नमः…”
অর্ক থালা ফেলে উঠে দাঁড়াল। মাথার ভেতর ঢং ঢং শব্দ বাজছে। চোখ বন্ধ করতেই আবার দেখতে পেল সেই শ্মশানকুণ্ড, আগুনের লেলিহান শিখা, আর অসংখ্য ছায়ামূর্তি।
এইবার তারা ফিসফিস করে বলল,
“তোমার ঠাকুরদা আমাদের অসমাপ্ত রেখে গিয়েছিল। তুমি এসেছ পূর্ণ করতে। রুদ্রাক্ষ তোমাকে পথ দেখাবে।”
অর্ক আতঙ্কে গলা চেপে ধরল। হঠাৎ মনে পড়ল চিঠির সেই লাইন—“যজ্ঞ অসমাপ্ত রয়ে গেছে।”
মানে কি—যজ্ঞটা শেষ করলেই সে মুক্তি পাবে? নাকি আরও বড় অভিশাপে জড়িয়ে যাবে?
রাত গভীর হল। অর্ক টেবিলের ওপর সব কাগজপত্র ছড়িয়ে রেখে বসে রইল। প্রতিটি লাইন যেন তাকে মৃত্যুর গোপন দরজার সামনে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে।
ঠাকুরদার শেষ লেখা চোখে পড়ল—
“যদি কেউ এই যজ্ঞ পূর্ণ করতে চায়, তবে জেনে রাখুক, তার আত্মা আর তার নিজের থাকবে না।”
অর্ক বুক কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়াল। তার চোখে এখন একটাই প্রশ্ন ঘুরছে—
রুদ্রাক্ষ কি তাকে ধ্বংসের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, নাকি কোনও অজানা মুক্তির দিকে?
পর্ব ৪: দ্বৈত বাস্তবতা
দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল, কিন্তু অর্ক যেন নিজের ভেতরে ভিন্ন এক অচেনা সত্তার জন্ম অনুভব করতে লাগল। সকাল হলে সে গ্রামের উঠোনে হাঁটে, গাছপালার শব্দ শোনে, লোকজনের সঙ্গে কথা বলে—সবকিছু স্বাভাবিক। অথচ সূর্য নামলেই, অন্ধকার নামতে না নামতেই, তার চারপাশ বদলে যায়। যেন দুটো আলাদা জগত একই সঙ্গে তার শরীরে মিশে যাচ্ছে।
শহরে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও, সে নিজেকে আটকে রাখতে পারল না। কলকাতার ব্যস্ত রাস্তায় অফিসের পথে হেঁটে গেলেও কানে বাজত সেই মন্ত্রের আওয়াজ। সহকর্মীরা হাসি-ঠাট্টা করলেও তার চোখে ভেসে উঠত ছায়ামূর্তির নাচ। একদিকে বাস্তব পৃথিবী, অন্যদিকে ছায়াদের দুনিয়া—দুটি মিলে যেন অর্ককে টুকরো টুকরো করে দিচ্ছে।
একদিন মেট্রোতে বসে ছিল সে। সামনের সিটে এক বাচ্চা মেয়েকে দেখল। মেয়েটি মায়ের আঁচলে মুখ লুকিয়ে রেখেছিল। হঠাৎ অর্কের মনে হল সে মেয়েটির ভেতরের কণ্ঠ শুনতে পাচ্ছে—একটা ছোট্ট ভয়, “মা, ওই লোকটার চোখে আগুন কেন জ্বলছে?” অর্ক হকচকিয়ে উঠল। মেয়েটি সরাসরি কিছু বলেনি, তবু তার মনের গোপন কথা কানে বাজল।
অর্ক দ্রুত চোখ নামিয়ে নিল। কিন্তু তারপর থেকে আরও স্পষ্ট হল—লোকজনের মনের ভিতরকার গোপন স্বর সে শুনতে পাচ্ছে। এক সহকর্মী কফি হাতে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, “তুই কেমন আছিস?” আর একই সঙ্গে মাথার ভেতর বাজল সেই লোকটার আসল চিন্তা—“এ কেন এত শুকিয়ে যাচ্ছে? ওর মুখে যেন ছায়া লেগে আছে।”
এই দ্বৈত বাস্তবতা তাকে পাগল করে দিচ্ছিল। চারপাশে সবাই যেমন, তেমনি আছে। অথচ অর্ক জানে তাদের অন্তরের অন্ধকার, তাদের চাপা ভয়, তাদের গোপন কামনা।
রাতে আবার রুদ্রাক্ষ হাতে নিলে সব সীমারেখা ভেঙে গেল। অন্ধকার প্রান্তর, আগুনের শিখা, আর অসংখ্য ছায়া। এবার তারা আরও কাছে এসে দাঁড়াল। একসঙ্গে গর্জন করে উঠল—
“তুমি এখন আমাদের ভাষা শুনতে পাচ্ছ। ধীরে ধীরে আমাদের চোখ দিয়েই পৃথিবী দেখবে।”
অর্ক মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। তার ঠোঁট কাঁপছে। সে চিৎকার করতে চাইছে, কিন্তু কণ্ঠ বন্ধ হয়ে আছে। মনে হল নিজের শরীরটা যেন অন্য কারও নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে।
ছায়ারা মন্ত্র পাঠ শুরু করল। অর্কও অনিচ্ছা সত্ত্বেও সুর মিলিয়ে দিল।
“ॐ रूद्राय… कालाय… श्मशानाय नमः…”
আগুনের শিখা উঁচু হয়ে উঠল, কুণ্ডলীর মতো তাকে ঘিরে ধরল। এক মুহূর্তে তার সামনে ফুটে উঠল এক বিশাল যজ্ঞকুণ্ড—লালচে আগুনে দপদপ করছে। আর যজ্ঞকুণ্ডের ওপরে ভাসছে সেই রুদ্রাক্ষ।
হঠাৎ চারপাশ ঝাপসা হয়ে গেল। অর্ক নিজের ঘরে পড়ে আছে। কপাল জুড়ে রক্ত জমে গেছে। আয়নায় তাকাতেই দেখল চোখ দুটো অস্বাভাবিক লাল। বুকের ভেতর ভারী চাপা শব্দ বাজছে।
সে বুঝল—দিনের আলোতে সে অর্ক, কিন্তু রাত নামলেই আর কেবল অর্ক নয়। দুটো জগত এখন একসঙ্গে তার শরীরে প্রবেশ করেছে।
এক বাস্তবতা যেখানে মানুষ হেসে কথা বলে। আরেক বাস্তবতা যেখানে ছায়ারা মন্ত্র শোনায়।
দুয়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে অর্কের মনে হল—তার নিজের সত্তাটাই ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে।
পর্ব ৫: মন্ত্রের প্রভাব
অর্ক এখন বুঝে গেছে, রুদ্রাক্ষ কেবল একটা তাবিজ নয়—এটা আসলে এক জীবন্ত বস্তু। দিনে যতই নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করুক, রাতে বা নিঃশব্দ মুহূর্তে মন্ত্রের আওয়াজ মাথার ভেতর ঢুকে যায়। প্রথমদিকে আতঙ্ক লাগলেও, ধীরে ধীরে এক অদ্ভুত আকর্ষণ জন্ম নিচ্ছে তার ভেতরে।
কোনও সহকর্মী চুপচাপ বসে থাকলে অর্ক হঠাৎ শুনতে পায় তার মনের দমিয়ে রাখা দুঃখ। কেউ রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকলে তার ভয় কিংবা লোভ স্পষ্ট হয়ে ওঠে অর্কের কানে। যেন মানুষের মুখোশ ভেদ করে সে ভিতরের কণ্ঠ শুনতে পাচ্ছে।
একবার অফিস থেকে ফেরার পথে, মেট্রো স্টেশনের ভিড়ে দাঁড়িয়ে ছিল। হঠাৎ পাশের ভদ্রলোকের চোখের দিকে তাকাতেই মাথার মধ্যে বাজল—“আজ রাতে আমার স্ত্রীর কাছে ফিরব না। অন্য কারও কাছে যাচ্ছি।” অর্ক ভয়ে কেঁপে উঠল। এত সহজে কি মানুষের গোপন সত্য শোনা যায়? নাকি রুদ্রাক্ষই তাকে এই অভিশপ্ত শক্তি দিচ্ছে?
রাত বাড়তেই অর্কের শরীরে পরিবর্তন স্পষ্ট হতে লাগল। হাতের আঙুলে নীলচে রেখা ফুটে উঠল, চোখে লালচে আভা। আয়নার সামনে দাঁড়ালে নিজেকেই চিনতে পারে না। ঠোঁট শুকনো, গলার স্বর কর্কশ, আর বুকের ভেতর যেন ক্রমাগত ঢং ঢং আওয়াজ বাজছে।
সে ঠিক করল, এ বিষয়ে কারও সঙ্গে কথা বলতে হবে। গ্রামের পুরোনো লাইব্রেরিতে গিয়ে প্রাচীন গ্রন্থ খুঁজতে লাগল। ধুলোমাখা তাক থেকে বের করল তন্ত্রসার সংগ্রহ নামে এক বই। সেখানে স্পষ্ট লেখা—“অসমাপ্ত যজ্ঞের ফল ভয়াবহ। যদি রুদ্রাক্ষ মন্ত্র নিজে থেকে পাঠ শুরু করে, তবে ধারক ধীরে ধীরে তান্ত্রিক শক্তির পাত্র হয়ে ওঠে। মুক্তি কেবল একটাই—যজ্ঞ পূর্ণ করা।”
অর্কের বুক কেঁপে উঠল। যজ্ঞ পূর্ণ করা মানে কী? বইয়ে আরও লেখা ছিল—“যজ্ঞ পূর্ণ হলে আত্মা আর নিজের থাকে না। দেবশক্তি বা ছায়াশক্তি যাকে অধিকার করবে, সে চিরকালের জন্য বিলীন হবে।”
এই সময়েই লাইব্রেরির বৃদ্ধ পণ্ডিত মুকুন্দ বাবু অর্ককে দেখে এগিয়ে এলেন। তার চোখ দুটো শ্বেতশুভ্র, গলায় মন্ত্রমালা। ফিসফিস করে বললেন—
—“তুমি যে বই পড়ছ, সেটা কেবল বই নয়। রুদ্রাক্ষ তোমাকে বেছে নিয়েছে। আমি তোমার ঠাকুরদাকে চিনতাম। উনিও এই অভিশাপে ভুগেছিলেন।”
অর্ক ভয়ার্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, “কীভাবে মুক্তি পাব?”
মুকুন্দ বাবু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন—
—“দুই পথ। হয় যজ্ঞ পূর্ণ করে অভিশাপ শেষ করো, নয়তো রুদ্রাক্ষ ভেঙে ফেলো। কিন্তু শোনো, রুদ্রাক্ষ ভাঙা মানে মৃত্যুর মুখে যাওয়া। সেটা সইতে পারবে?”
অর্ক চুপ করে গেল। সে জানত, কোনওটিই সহজ নয়।
রাতে ঘরে ফিরতেই আবার রুদ্রাক্ষ হাতে নিল। সঙ্গে সঙ্গে কানে বাজল নতুন মন্ত্র—
“ॐ क्षौं… कालविनाशाय…”
অর্ক চমকে উঠল। এবার সে শুধু শুনছে না, নিজের ঠোঁট থেকেও শব্দ বেরোচ্ছে। মন্ত্রের প্রতিটি অক্ষর যেন তার শরীরের ভেতর দাগ কেটে যাচ্ছে। হঠাৎ বুক ভারী হয়ে গেল, কপাল থেকে রক্ত চুঁইয়ে পড়তে লাগল। মনে হল যেন কারও চোখ তার শরীর ভেদ করে তাকিয়ে আছে।
অচেতন হয়ে মেঝেতে পড়ে গেল অর্ক। স্বপ্ন আর বাস্তব মিশে গিয়ে দেখতে পেল—সে আগুনের যজ্ঞকুণ্ডের পাশে বসে, ছায়ারা তাকে ঘিরে মন্ত্র পড়াচ্ছে। আর মাঝখানে রুদ্রাক্ষ ভাসছে, আগুনে লাল হয়ে জ্বলছে।
ছায়ারা গর্জে উঠল—
“তুমি এখন আমাদের পাত্র। তোমার শরীর দিয়ে যজ্ঞ সম্পূর্ণ হবে।”
অর্ক হঠাৎ ঘুম ভেঙে উঠে দেখল বালিশের পাশে রক্তের দাগ। রুদ্রাক্ষ মাটিতে গড়িয়ে আছে, অথচ তাতে লালচে দীপ্তি জ্বলছে।
সে বুঝল—এখন আর সময় নেই। রুদ্রাক্ষ ধীরে ধীরে তার আত্মা গ্রাস করছে। যদি কিছু না করে, শীঘ্রই সে পুরোপুরি হারিয়ে যাবে।
পর্ব ৬: সাধকের বংশধর
অর্কের চোখে তখন আর ঘুম আসে না। প্রতিটি রাত মন্ত্রোচ্চারণে কেটে যায়, প্রতিটি ভোর ভয়ে জেগে ওঠে। রুদ্রাক্ষ যেন তার শরীরে আগুনের মতো ছাপ ফেলছে। বুকের ভেতর চাপা শব্দ, কানে ক্রমাগত মন্ত্রের ধ্বনি—সব মিলিয়ে সে বুঝে গিয়েছে, সময় ফুরিয়ে আসছে।
মুকুন্দ বাবুর কথাগুলো মনে পড়ে। “রুদ্রাক্ষ ভাঙলে মৃত্যু, যজ্ঞ পূর্ণ করলে আত্মা অন্যের।” এই দ্বন্দ্বের মাঝে আটকে গিয়ে অর্ক অনুভব করল, উত্তর খুঁজতে হলে তাকে ঠাকুরদার অতীত খুঁজে বের করতেই হবে।
চিঠিগুলোতে একটা নাম বারবার এসেছে—“সাধক কপিলানন্দ।” ঠাকুরদার গুরু, যিনি মৃত্যুকে জয় করার যজ্ঞ শুরু করেছিলেন। গ্রামের এক বৃদ্ধ জানালেন, কপিলানন্দের এক বংশধর নাকি এখনও পুরুলিয়ার পাহাড়ি অঞ্চলে কোথাও আছেন।
অর্ক আর দেরি করল না। ভোরের ট্রেনে চেপে পুরুলিয়ার পথে রওনা দিল। জানলার বাইরে দ্রুত ছুটে চলা মাঠ, শালবন, টিলা—সব কিছুর মাঝেই সে অনুভব করছিল, যেন অদৃশ্যভাবে কেউ তাকে পথ দেখাচ্ছে।
বিকেলের দিকে পাহাড়ি গ্রামের কাছে পৌঁছল সে। বাতাসে অদ্ভুত গন্ধ—কাঁচা মাটি, শুকনো পাতা, আর কোথাও কোথাও ধূপের ধোঁয়া। গ্রামের মাঝের এক কুঁড়েঘরের দিকে ইশারা করল একজন পথচারী—“ওখানেই থাকেন তন্ত্রসাধকের শেষ বংশধর।”
অর্ক দরজায় কড়া নিতেই এক বৃদ্ধ বেরোলেন। সাদা দাড়ি, কৃশকায় দেহ, কপালে ভস্মের দাগ। তার চোখ দুটো শূন্যের মতো গভীর।
অর্ক কাঁপা গলায় বলল, “আমি অর্ক। আমার ঠাকুরদা আপনার গুরুর শিষ্য ছিলেন। আমি… আমি রুদ্রাক্ষ পেয়েছি।”
বৃদ্ধ এক দৃষ্টিতে অর্ককে মাপলেন। তারপর ধীরে ধীরে বললেন,
—“জানি। তুমি যে উত্তরাধিকার বহন করছ, তা থেকে পালানো যায় না। আমি কপিলানন্দের নাতি। আমার নাম শ্রীধর। বলো, রুদ্রাক্ষ তোমার শরীরে কতটা ঢুকেছে?”
অর্ক হতবাক। সে বলল, “প্রতিদিন মন্ত্র শোনাচ্ছে। আমি অন্যদের মনের কথা শুনতে পাচ্ছি। আয়নায় নিজেকে চিনতে পারি না। কীভাবে মুক্তি পাব?”
শ্রীধর গম্ভীর গলায় বললেন,
—“তোমার ঠাকুরদা যজ্ঞ থামিয়ে দিয়েছিলেন। তাই অভিশাপ অসমাপ্ত থেকে গেছে। রুদ্রাক্ষ চায় যজ্ঞ সম্পূর্ণ হোক। কিন্তু শোনো, যজ্ঞ পূর্ণ মানে অমরত্ব নয়—বরং আত্মাকে ছায়াদের হাতে সমর্পণ। কপিলানন্দ মৃত্যুকে জয় করতে চেয়েছিলেন, আর সেই অহংকারই এই অভিশাপের জন্ম দিয়েছে।”
অর্ক অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “তাহলে আমি কী করব?”
শ্রীধর কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। তারপর মাটির পাত্রে জল ঢেলে মন্ত্র পড়তে লাগলেন। জলে ভেসে উঠল আগুনের কুণ্ড, আর তার মাঝখানে অর্ককে দেখা গেল, রুদ্রাক্ষ হাতে।
বৃদ্ধ বললেন,
—“দেখছ? তোমাকে শিগগিরই শ্মশানের গোপন আস্তানায় যেতে হবে। ওখানেই অসমাপ্ত যজ্ঞকুণ্ড লুকোনো আছে। তুমি যদি সেখানে দাঁড়িয়ে শেষ মন্ত্র উচ্চারণ কর, তবে যজ্ঞ পূর্ণ হবে। তবে জেনে রাখো—তুমি আর নিজের থাকবে না।”
অর্ক চুপ করে রইল। মাথার ভেতর তখনও বাজছে মন্ত্রের ঢং ঢং ধ্বনি।
শ্রীধর শেষে ফিসফিস করে বললেন,
—“অন্য এক পথও আছে। রুদ্রাক্ষ ভাঙতে হবে। কিন্তু সেটা করলে তোমার শরীর সহ্য করবে না। মৃত্যু নিশ্চিত।”
অর্ক আকাশের দিকে তাকাল। সন্ধে নামছে, পাহাড়ের পাদদেশে শালবনের ছায়া ঘন হয়ে এসেছে। তার মনে হল—পালাবার আর কোনও রাস্তা নেই।
সে জানল, সামনে এগোতে হলে তাকে সেই গোপন আস্তানায় পৌঁছতেই হবে।
পর্ব ৭: গোপন আস্তানা
শ্রীধরের কথা শুনে অর্কের বুকের ভেতর ধ্বনি তুলছিল মন্ত্রের মতো। “শ্মশানের গোপন আস্তানা”—শব্দটাই যেন তার রক্তে আগুন ধরাচ্ছিল। ভোরবেলা শ্রীধরের দেওয়া নির্দেশ মেনে সে পাহাড়ি পথ ধরে রওনা দিল। শুকনো পাতার ওপর পা পড়তেই খসখস আওয়াজ হচ্ছিল, কিন্তু চারপাশ অদ্ভুত নিস্তব্ধ। মনে হচ্ছিল জঙ্গল নিজেই শ্বাসরোধ করে আছে।
শ্রীধর একখানা ছেঁড়া মানচিত্র দিয়েছিলেন। তাতে লাল দাগ টেনে দেখানো—জঙ্গলের ভেতর কোথায় সেই আস্তানা। অর্ক মাটির গায়ে তাকিয়ে হাঁটছিল। দুপুরের রোদ ফিল্টার হয়ে পাতার ফাঁক দিয়ে পড়ছিল তার মুখে, অথচ শরীরের ভেতর ঠান্ডা কাঁপুনি।
দু’ঘণ্টা হাঁটার পর পৌঁছল একটা পুরোনো শ্মশানঘাটের কাছে। এখানে বহু বছর ধরে কেউ আসেনি, তা বোঝা যাচ্ছিল। ভাঙা চিতা, ছাই মেশানো মাটি, আর কালো পাথরের বেদি। শ্রীধর বলেছিলেন, এর তলায় গোপন পথ আছে। অর্ক চারদিকে খুঁজে অবশেষে এক ফাটল দেখতে পেল। সরু ইট সরাতেই খুলে গেল একটা অন্ধকার সিঁড়ি।
সাহস করে নামল নিচে। বাতাস ভারী, স্যাঁতসেঁতে গন্ধে ভরে আছে। মাটির নিচে ছোট গুহা সদৃশ জায়গা। মাঝখানে বিশাল যজ্ঞকুণ্ড, কালচে পাথরে ঘেরা। মেঝের ওপর এখনও ছড়ানো শুকনো অশ্বত্থপাতা, ভাঙা কুম্ভ, পুরোনো অর্ঘ্য।
অর্কের চোখ স্থির হয়ে গেল। কুণ্ডের ভেতর থেকে হালকা লাল আভা জ্বলজ্বল করছে। যেন আগুন এখনও নিবেনি।
হঠাৎ রুদ্রাক্ষ তার হাতে নিজে থেকেই জ্বলে উঠল। সেই আলোয় চারপাশ কেঁপে উঠল। আরেক মুহূর্তেই গুহার দেয়ালে ভেসে উঠল অসংখ্য ছায়া। তারা শ্মশানবাতাসে দুলছে, মুখ নেই, চোখ নেই, তবু তাদের শূন্য অবয়ব অর্ককে তাকিয়ে আছে।
তারা একসঙ্গে ফিসফিস করে উঠল—
“এসো… এসো… তুমি এসেছ অবশেষে। অসমাপ্ত মন্ত্র পূর্ণ করো।”
অর্ক হাঁটুতে ভর দিয়ে কুণ্ডের দিকে এগোল। মনে হল তার ঠোঁট কেঁপে উঠছে, মন্ত্র বেরোতে চাইছে। কিন্তু বুকের ভেতর প্রশ্ন জাগল—এটা করলে কি মুক্তি আসবে, নাকি মৃত্যু?
গুহার এক কোণে ভাঙা শিলালিপি পড়ে ছিল। অর্ক হাত বুলিয়ে পড়তে লাগল—
“মৃত্যুর বন্ধন ভাঙতে হলে প্রাণ দাও। রুদ্রাক্ষ রক্ত চাইবে। রক্তে ভিজলেই যজ্ঞ পূর্ণ হবে।”
অর্ক কেঁপে উঠল। মানে তাকে নিজের রক্ত দিতেই হবে।
হঠাৎ ছায়ারা গর্জন করে উঠল। গুহার অন্ধকার জ্বলে উঠল আগুনে। যজ্ঞকুণ্ডে শিখা দপদপ করতে লাগল। রুদ্রাক্ষ অর্কের হাত থেকে ছুটে গিয়ে মাঝখানে ভেসে উঠল।
ছায়ারা গলা মিলিয়ে বলতে লাগল—
“পড় মন্ত্র… শেষ করো… পূর্ণ করো…”
অর্ক কান চেপে ধরল, তবু শব্দ থামল না। মাথার ভেতর ঢং ঢং বাজতে লাগল। সে দেখতে পেল নিজের শরীর থেকে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত ঝরে পড়ছে। গুহার মাটিতে লাল দাগ ছড়িয়ে গেল।
দেয়ালে ভেসে উঠল ঠাকুরদার মুখ। চোখে আতঙ্ক। ঠোঁটে নিঃশব্দ সতর্কতা—“না… শেষ করো না…”
অর্ক কাঁপা হাতে যজ্ঞকুণ্ডের ধারে দাঁড়িয়ে গেল। রুদ্রাক্ষ যেন অদৃশ্য শক্তিতে তাকে ঠেলে দিচ্ছে।
এমন সময় হঠাৎ গুহার দেয়ালে কারও লেখা দেখা গেল, রক্তে লেখা—
“অভিশাপ পূর্ণ হলে মুক্তি নয়, ধ্বংস আসবে।”
অর্ক শ্বাসরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল। তার মনে হল, প্রতিটি মুহূর্ত এখন মৃত্যুর সীমানায় দাঁড়িয়ে আছে।
পর্ব ৮: অভিশাপের সত্য
গুহার ভেতর দাঁড়িয়ে অর্কের মনে হচ্ছিল, সে যেন সময়ের বাইরে চলে এসেছে। চারপাশে আগুনের লেলিহান শিখা, ছায়ামূর্তিরা মন্ত্রোচ্চারণ করছে, আর রুদ্রাক্ষ ভাসছে যজ্ঞকুণ্ডের মাঝখানে। কিন্তু হঠাৎই তার চোখ চলে গেল দেয়ালের সেই রক্তলিপির দিকে—“অভিশাপ পূর্ণ হলে মুক্তি নয়, ধ্বংস আসবে।”
অর্কের মাথায় এক ঝটকা এল। এতদিন সে ভেবেছিল, অসমাপ্ত যজ্ঞ পূর্ণ করলে হয়তো মুক্তি পাবে। কিন্তু এই সতর্কবার্তা বলছে ঠিক উল্টো কথা। যজ্ঞ পূর্ণ মানে ধ্বংস।
মনে পড়ল ঠাকুরদার লেখা চিঠি। “যদি কেউ যজ্ঞ পূর্ণ করে, তবে তার আত্মা আর নিজের থাকবে না।” এটাই কি সেই ধ্বংসের কথা?
ছায়ারা আবার গর্জে উঠল। তারা যেন বুঝতে পেরেছে অর্কের ভিতরে সন্দেহ জেগেছে।
“পড় মন্ত্র… পূর্ণ করো… মৃত্যুর ঊর্ধ্বে উঠে দাঁড়াও…”
অর্ক দাঁত চেপে চোখ বন্ধ করল। কিন্তু মন্ত্র যেন তার নিজের শরীর থেকেই বেরোচ্ছে। ঠোঁট নড়ছে, গলা থেকে শব্দ উঠছে—
“ॐ हौं जूं सः…”
হঠাৎ গুহার এক পাশে আলো ঝলসে উঠল। অর্ক দেখতে পেল এক ক্ষীণ অবয়ব—ঠাকুরদা। তার চোখে ভয়, ঠোঁটে নিঃশব্দ বাক্য—“থাম… ওরা তোমাকে প্রতারণা করছে।”
অর্ক হিমশীতল হয়ে গেল। গলা শুকিয়ে কাঠ। ছায়ারা ক্রমশ উত্তেজিত হচ্ছে, আগুন আরও উঁচু হয়ে উঠছে। রুদ্রাক্ষ থেকে লালচে শিখা বেরিয়ে গুহার দেয়ালে আছড়ে পড়ছে।
এই সময় অর্কের কানে আবার বাজল শ্রীধরের সতর্কবাণী—
“যজ্ঞ পূর্ণ মানে আত্মাকে সমর্পণ। রুদ্রাক্ষ ভাঙা মানে মৃত্যুর মুখে যাওয়া।”
অর্ক বুঝল, দুই পথই ভয়ংকর। কিন্তু অভিশাপের আসল সত্য স্পষ্ট হয়ে গেল—এটা কোনও মুক্তির তন্ত্র নয়, এটা এক ব্যর্থ সাধনার অবশেষ, যেখানে মৃত্যুকে জয় করতে গিয়ে সাধক আসলে মৃত্যু ডেকে এনেছিলেন।
ছায়ারা হাহাকার করে উঠল—
“আমরা অপূর্ণ… আমাদের পূর্ণ করো… তোমার রক্ত দাও…”
অর্ক হঠাৎ দেখল তার হাত থেকে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত ঝরছে। রুদ্রাক্ষ যেন তার শরীর থেকে রক্ত টেনে নিচ্ছে।
সে মাটিতে পড়ে গেল, বুকের ভেতর আগুনের মতো ব্যথা। চোখে ভেসে উঠল অদ্ভুত দৃশ্য—কপিলানন্দ, সেই সাধক, যজ্ঞকুণ্ডের সামনে বসে আছেন। তার মুখে উন্মত্ত হাসি, হাতে রুদ্রাক্ষ। কিন্তু পরমুহূর্তেই আগুনে দগ্ধ হয়ে ধুলো হয়ে যাচ্ছেন।
অর্ক হাহাকার করে উঠল। বুঝতে পারল—অমরত্ব চাওয়ার দামই এই অভিশাপ। কপিলানন্দের ব্যর্থতার ফলেই এই রুদ্রাক্ষ তৈরি হয়েছিল। আর আজ সেটাই তাকে গ্রাস করতে চাইছে।
গুহার ছায়ারা আবার মন্ত্রোচ্চারণ শুরু করল।
“तत् सवितुर्वरेण्यं… भर्गो देवस्य धीमहि…”
অর্কের বুকের ভেতর ধ্বনিত হচ্ছিল একটাই সত্য—
এ যজ্ঞ পূর্ণ করা মানে নিজের অস্তিত্ব বিলীন করা।
সে মাটিতে ভেঙে পড়লেও একটানা ভাবতে লাগল—কীভাবে অভিশাপ ভাঙবে?
পর্ব ৯: চূড়ান্ত সংগ্রাম
অর্কের শরীর তখন আধভাঙা, চোখ লাল, ঠোঁট শুকিয়ে কাঠ। গুহার ভেতরে যজ্ঞকুণ্ডের আগুন আরও তীব্র হয়ে উঠেছে। ছায়ামূর্তিরা ঘিরে ধরেছে তাকে, যেন অদৃশ্য হাত দিয়ে টেনে নিচ্ছে আগুনের কেন্দ্রে। রুদ্রাক্ষ মাঝখানে ভেসে উঠছে—জ্বলন্ত রক্তরঙা সূর্যের মতো।
অর্ক বুঝতে পারল, এটাই শেষ মুহূর্ত। এখন হয় সে ছায়াদের ইচ্ছেমতো যজ্ঞ সম্পূর্ণ করবে, নয়তো প্রতিরোধ করবে। কিন্তু প্রতিরোধ মানেই মৃত্যু। বুকের ভেতর ঢং ঢং শব্দে মনে হচ্ছিল, শরীরের ভেতর কোনও অচেনা ঢাক বাজছে।
ছায়ারা একসঙ্গে গর্জে উঠল—
“শেষ মন্ত্র পড়ো! তোমার রক্ত দাও! যজ্ঞ পূর্ণ হোক!”
অর্ক হাঁটু গেড়ে পড়ে গেল। ঠোঁট অনিচ্ছায় কাঁপছে, মন্ত্র বেরিয়ে আসছে—
“ॐ रूद्राय… कालाय…”
কিন্তু হঠাৎ তার চোখে ভেসে উঠল ঠাকুরদার মুখ। চোখে যন্ত্রণা, ঠোঁটে নিঃশব্দ সতর্কতা—“না!”
অর্ক নিজের বুক থেকে রুদ্রাক্ষ ছিঁড়ে আছড়ে ফেলতে চাইল, কিন্তু সেটা তার হাতে যেন লোহার মতো আটকে আছে। আগুনের তাপে হাত পুড়ে যাচ্ছে, তবু রুদ্রাক্ষ ছাড়ছে না।
সে চিৎকার করে উঠল, “আমি তোমাদের দাস হব না!”
পরমুহূর্তেই ছায়ারা হাহাকার করে উঠল। আগুনের লেলিহান শিখা আরও উঁচু হয়ে তার চারপাশ ঘিরে ধরল। যজ্ঞকুণ্ডের ভেতর থেকে অদ্ভুত ধ্বনি উঠতে লাগল—যেন হাজার মৃতদেহের হাহাকার।
অর্ক নিজের দাঁত চেপে হাত কামড়ে ফেলল। রক্ত গড়িয়ে পড়ল মাটিতে। রুদ্রাক্ষ রক্তের ফোঁটা শুষে নিতে চাইলো, আরও দীপ্ত হয়ে উঠল। কিন্তু অর্ক রক্তে ভেজা হাত দিয়েই রুদ্রাক্ষ আঁকড়ে ধরল।
মাথার ভেতর বজ্রপাতের মতো শব্দ হলো। ছায়ারা কেঁপে উঠল, গর্জন থেমে গেল। রুদ্রাক্ষ তখন লাল হয়ে জ্বলছে, আগুনের গোলকের মতো।
অর্ক সারা শরীরের শেষ শক্তি দিয়ে রুদ্রাক্ষকে যজ্ঞকুণ্ডের আগুনে ছুড়ে মারল।
তীব্র বিস্ফোরণের মতো আলো ছড়িয়ে পড়ল। গুহা কেঁপে উঠল, ছায়ারা হাহাকার করে মিলিয়ে গেল। আগুনের মধ্যে রুদ্রাক্ষ ফেটে টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ল।
অর্ক মাটিতে লুটিয়ে পড়ল, বুক ওঠানামা করছে। কানে তখনও বাজছে হাহাকার—কিন্তু ধীরে ধীরে সব স্তব্ধ হয়ে গেল। গুহার ভেতর অন্ধকার নেমে এল, যেন কোনওদিন এখানে আগুন জ্বলেইনি।
অর্ক অচেতন অবস্থায় পড়ে থাকল অনেকক্ষণ। শরীর থেকে রক্ত গড়িয়ে গিয়েছে, মুখ ফ্যাকাশে। কিন্তু তার চোখে তখনও ঝিলিক দিচ্ছিল এক অদ্ভুত তৃপ্তি—যেন সে ছায়াদের বিরুদ্ধে লড়াই করে শেষ মুহূর্তে নিজের সত্তা রক্ষা করেছে।
তবু তার বুকের গভীরে একটা প্রশ্ন তীব্র হয়ে বাজছিল—
রুদ্রাক্ষ কি সত্যিই ধ্বংস হল? নাকি তার টুকরোগুলো এখনও কোথাও বেঁচে আছে, অন্ধকারে কাঁপতে কাঁপতে আবার নতুন শিকার খুঁজছে?
পর্ব ১০: মুক্তি না মৃত্যু
গুহার অন্ধকারে অর্ক যখন জ্ঞান ফিরল, তখন চারপাশে নিস্তব্ধতা। আগুন নেই, ছায়ামূর্তি নেই, কেবল স্যাঁতসেঁতে বাতাস আর ভাঙা শিলার গন্ধ। যজ্ঞকুণ্ড যেন পুড়ে কালো হয়ে গেছে। কিন্তু মাটির ওপর ছড়িয়ে আছে রুদ্রাক্ষের টুকরো—অদ্ভুত দীপ্তি ছড়াচ্ছে, যেন প্রতিটি টুকরোই জীবন্ত।
অর্ক কাঁপতে কাঁপতে উঠে বসল। শরীর দুর্বল, ঠোঁটে শুকনো রক্ত, তবু বুকের ভেতর একটা স্বস্তি কাজ করছে—সে ছায়াদের দাস হয়নি। কিন্তু সেই সঙ্গে ভয়ও জেগে উঠল—রুদ্রাক্ষের টুকরোগুলো এখনও কাঁপছে, যেন অদৃশ্য শ্বাস নিচ্ছে।
সে টুকরোগুলো হাতে নিতে সাহস করল না। শুধু দূর থেকে দেখতে লাগল। মনে হল মাটির তলায় যেন কম্পন হচ্ছে, যেন পৃথিবী নিজেই সেই টুকরোকে আঁকড়ে নিতে চাইছে।
অর্ক গুহা থেকে বেরিয়ে এল। শালবনের অন্ধকার ভেদ করে বাইরে পা রাখতেই ভোরের প্রথম আলো ঝরে পড়ল। সূর্যের আলোয় চোখ ঝলসে গেল। কতদিন পর সে সূর্যকে এত স্পষ্ট দেখছে!
গ্রামে ফিরে এলে লোকজন অবাক হয়ে তাকাল। তার মুখ ফ্যাকাশে, শরীর কৃশ, তবু চোখে অদ্ভুত দীপ্তি। মুকুন্দ বাবু এগিয়ে এসে ফিসফিস করে বললেন—
—“তুমি পেরেছ?”
অর্ক দুর্বল হাসল। বলল, “আমি যজ্ঞ শেষ করিনি। রুদ্রাক্ষ ভেঙেছি।”
বৃদ্ধের মুখ গম্ভীর হয়ে উঠল। তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন—
—“তাহলে তুমি অভিশাপ ভেঙেছ, কিন্তু পুরোপুরি মুক্তি পাওনি। রুদ্রাক্ষের টুকরো মাটির তলায় রয়ে গেছে। একদিন আবার কেউ খুঁজে পেলে, অভিশাপ ফিরে আসবে।”
অর্ক নীরব হয়ে গেল। তার মনে হল, সে কেবল একটা লড়াই জিতেছে, কিন্তু যুদ্ধ শেষ হয়নি।
দিন কেটে গেল। অর্ক শহরে ফিরে গেলেও আগের মতো আর নেই। লোকজনের ভিড়ে হাঁটলেও মাঝে মাঝে কানে ভেসে আসে মন্ত্রের ক্ষীণ ধ্বনি। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায়, জানলার বাইরে তাকালে মনে হয় ছায়া দাঁড়িয়ে আছে।
একদিন অফিস থেকে ফেরার পথে ফুটপাথে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল। মাটির ধুলো ঝাড়তে গিয়ে দেখল—তার হাতের তালুতে হালকা বাদামি দাগ, রুদ্রাক্ষের মতো রেখা। বুকের ভেতর ধকধক করে উঠল।
সে বুঝল—রুদ্রাক্ষকে সে ভেঙেছে বটে, কিন্তু অভিশাপ পুরোপুরি যায়নি। টুকরোগুলো হয়তো মাটির তলায় কাঁপছে, আবার কোনও একদিন কারও হাতে ধরা দেবে। আর হয়তো তার নিজের শরীরেই রয়ে গেছে সেই ছাপ, সেই ছায়া।
রাতে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চোখের দিকে তাকাল। চোখে ক্লান্তি, তবু কোথাও একটা ঝিলিক—যেন অন্ধকার আর আলো মিশে আছে একসঙ্গে।
অর্ক ধীরে ধীরে ফিসফিস করে বলল—
“আমি মুক্ত হয়েছি কি? নাকি কেবল অপেক্ষায় আছি আবার ডাক শোনার?”
আয়নায় প্রতিফলিত মুখটা চুপ করে রইল। কেবল জানলার বাইরে হাওয়া বইতে লাগল, আর দূরে কোথাও অদৃশ্য কণ্ঠে মন্ত্রের ক্ষীণ প্রতিধ্বনি ভেসে এল—
“ॐ… रूद्राय… नमः…”
অর্ক শিউরে উঠল। বুঝল, তার গল্প শেষ হয়নি।
সে হয়তো ছায়াদের হাত থেকে বেঁচেছে, কিন্তু রুদ্রাক্ষের অভিশাপ এখনও পৃথিবীর বুকের ভেতর কাঁপতে কাঁপতে ঘুমিয়ে আছে।
***




