তথাগত বিশ্বাস
অধ্যায় ১
বর্ধমান শহর থেকে খানিক দূরে, কাঁচা রাস্তা পেরিয়ে সবুজ ধানক্ষেতের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা এক বিশাল পরিত্যক্ত বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল সেই চারজন। অক্টোবর মাসের শেষ সপ্তাহ, হালকা কুয়াশা ভাসছে বাতাসে, আর সন্ধ্যার আলো ধীরে ধীরে মুছে যাচ্ছে। চারদিকে নিস্তব্ধতা, শুধু মাঝে মাঝে দূরের কুয়ো থেকে ভেসে আসা কুকুরের ঘেউঘেউ শব্দ। সৌগত চট্টোপাধ্যায়, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক, চোখে চশমা ঠিক করে বাড়িটার দিকে তাকাল। ইট আর চুনের প্রাচীন কারুকাজ করা বাড়ি, সময়ের থাবায় কালচে হয়ে গেছে। তার পাশে নন্দিতা রায়, প্রত্নতত্ত্ববিদ, ব্যাগ থেকে নোটবুক বের করে কিছু লেখার আগে গা ছমছমে কণ্ঠে ফিসফিস করে বলল, “এই বাড়িটা যেন থেমে আছে কোনও এক ভুলে যাওয়া সময়ে…” ইশান ঘোষ, ডকুমেন্টারি ক্যামেরাম্যান, ইতিমধ্যেই ক্যামেরা বের করে শট নিতে শুরু করেছে—সে বলল, “চমৎকার লোকেশন! ভৌতিক ডকু বানানোর জন্য এর থেকে ভালো জায়গা হয় না!” আর সবশেষে ছিলেন অনুপম ঘোষ, ইতিহাসপিয়াসী লেখক, যিনি নিঃশব্দে খেয়াল করছিলেন পুরনো শালগাছের ছায়া, বাড়ির ধসে পড়া বারান্দা, আর এক কোণে পড়ে থাকা অর্ধভাঙা পালঙ্কের কাঠের ফ্রেম। এমন পরিবেশে কোনো ইতিহাসই নিছক তথ্য নয়, বরং তারা যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে বাতাসে, দেয়ালের ফাটলে, ছাদের ছোপ ছোপ দাগে। এই জমিদারবাড়ি, রুদ্রসিংহদের ঠাকুরবাড়ি, এক সময় ছিল বর্ধমানের গর্ব। কিন্তু এখন শুধু পোকায় খাওয়া ইতিহাস, আর গুজব—যে দোতলার দরজাটা নাকি একবার বন্ধ হওয়ার পর আর খোলা হয়নি।
তাদের জন্য অপেক্ষা করছিল গুপ্তবাবু—বাড়ির কেয়ারটেকার, বছর ষাটেকের এক খাটো গড়নের মানুষ, মাথায় উল্কি দেওয়া গামছা, আর চোখে চিরকালীন ক্লান্তির ছায়া। তিনি তাদের দেখে মাথা নিচু করে নমস্কার করলেন, কিন্তু বাড়ির দরজা খোলার আগে ফিসফিস করে বললেন, “আপনারা দয়া করে ওপরে যাবেন না, বাবুরা… ও দোতলা ঘর আজও ঘুমোয়নি।” ইশান হেসে বলে উঠল, “ঘর আবার ঘুমোয় না জাগে কীভাবে?” কিন্তু সৌগত চোখ মেলে চাইল কেয়ারটেকারের চোখে—সেখানে ছিল একটা অদ্ভুত ভয় আর দীর্ঘকাল ধরে জমে থাকা অভিজ্ঞতার ছাপ। তারা বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করল। মেঝেতে মোটা ধুলোর স্তর, ছাদের কোণায় ঝুলন্ত মাকড়সার জাল, আর দেয়ালের আলগা রঙের নিচে ছোপ ছোপ লাল দাগ—যা হয়তো পুরনো পান, কিংবা… আরও কিছু ভয়ংকর কিছু। প্রথম তলায় ছিল বিশাল বৈঠকখানা, এক কোনে হর্ম্য সদৃশ আয়না, তাতে নিজেদের প্রতিবিম্ব দেখেই কেমন যেন অস্বস্তি লাগল নন্দিতার। “এই আয়নাটার ভেতর কি কেবল মুখ নয়, আরও কিছু লুকিয়ে আছে?”—তার কণ্ঠে হালকা কাঁপন। তারা ব্যাগ রেখে চারপাশ ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল। সৌগতের চোখ পড়ে গেল সেই সিঁড়িটার দিকে, যেটা সরাসরি দোতলায় উঠে গেছে—সিঁড়ির মুখে একটা পুরনো কাঠের দরজা, মজবুত তালা দেওয়া। দরজার গায়ে ছিল গাঢ় রঙের হাতের ছাপ। ইশান ক্যামেরা তুলে এক ঝটকায় স্ন্যাপ নিয়ে নিল—“এই ছবি দিয়েই শুরু করব আমার ডকু।” কিন্তু গুপ্তবাবু পেছন থেকে বলে উঠলেন, “ছবি তোলার আগে অনুমতি নিতে হয়, বাবু। ওই ঘরের মানুষ আজও অভিমানী।”
রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির বাতাবরণ আরও ভারি হতে লাগল। তারা নীচতলার একটা ঘরে বিছানা পাতল, প্রাচীন কাঠের জানালাগুলো বন্ধ করে, মশা তাড়াতে ধূপকাঠি জ্বালানো হল। কিন্তু নিশুতি রাতের নিস্তব্ধতায় তারা স্পষ্ট শুনল—উপরে যেন কেউ ধীরে ধীরে হাঁটছে। মেঝের কাঠের শব্দ ঠিক যেমন হয় কারও ভারী পায়ের চাপে। সৌগত চমকে তাকাল অনুপমের দিকে—সে বলল, “তুমি নিশ্চয়ই শুনলে?” অনুপম ধীরে মাথা নেড়ে বলল, “ওটা হয়তো বাঁদর…” ইশান বলল, “এই পুরনো বাড়িতে তো বাঁদর নেই—তাও যদি হয়, তাহলে সিঁড়ির মুখের তালা ভাঙল কে?” সবাই একসঙ্গে চুপ করে গেল। তারপর সবাই আবার তাকাল আয়নার দিকে—যেটা সেদিন সন্ধ্যায় স্রেফ নিজের প্রতিবিম্ব দেখাচ্ছিল। এখন, তার মাঝে দেখা যাচ্ছে এক ঝাপসা অবয়ব, যেন কেউ জানালার পাশের ছায়া থেকে মুখ বাড়িয়ে বলছে কিছু… ঠোঁট নাড়ছে কিন্তু কোনো শব্দ নেই। চারজনে একে অপরের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল, নিঃশব্দে। নন্দিতা একটুখানি ফিসফিস করে বলল, “ও দোতলা… ওখানে কিছু একটা এখনও আটকে আছে… সময়ের মধ্যে নয়, অনুভূতির মধ্যে।” বাইরে তখন হালকা কুয়াশা নামছে, আর বাড়ির পুরনো পেতলের ঘড়ির কাঁটা ধীরে ধীরে বারোটার দিকে এগোচ্ছে—যেখানে সময় থেমে আছে বহু বছর ধরে। রুদ্রসিংহ এখনও ঘুমোননি—তিনি শুধুই অপেক্ষা করছেন, কারও… অথবা কিছুর জন্য।
অধ্যায় ২
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে একটা ভারি অভিজ্ঞতা যেন চারজনের মধ্যেই জমে রইল, কিন্তু কেউ কিছু বলল না। ইশান চুপচাপ ক্যামেরার ফিড ঘেঁটে দেখছিল, কিছু অস্বাভাবিক ধরা পড়েছে কিনা—কিন্তু রাতের ভিডিওর মাঝখানে আচমকাই কিছু ফ্রেম ব্ল্যাংক হয়ে গেছে। তার একটিতে শুধু দেখা যাচ্ছে, ওপরে সিঁড়ির ছায়া আর নিচের আলো মিশে গিয়ে গাঢ় ধূসর ধোঁয়া তৈরি করেছে—কোনো স্পষ্ট অবয়ব নয়, কিন্তু অস্বস্তিকর। নন্দিতা ভোর হতেই বাড়ির দেয়াল পর্যবেক্ষণ করতে বেরোয়। তিনি প্রত্নতত্ত্ববিদ, চোখের সামান্যতম ধুলোতেও ইতিহাস খুঁজে নিতে পারেন। বাড়ির দক্ষিণ-পূর্ব দিকের করিডোরে, জানালার একপাশে দেয়ালের খোদাই করা কিছু অদ্ভুত প্রতীক দেখে তার কপালে ভাঁজ পড়ে। প্রাচীন ব্রাহ্মীলিপির সঙ্গে মেলে না, আবার ওল্ড বেঙ্গলি স্টাইলেও নয়। একটি প্রতীকের নিচে ধীরে ধীরে আঙুল চালাতে চালাতে তার মনে হল, যেন এই দেওয়াল একসময় কারও কাঁদা হাতে ছোঁয়া হয়েছিল। আশপাশের দেয়ালে অনেক জায়গায় ফাটল, ফাঙ্গাস, আর লালচে ছোপ—মাটির লাল রঙে নয়, বরং কিছু যেন ধুয়ে যাওয়ার পরও রয়ে গেছে। সে জোরে ডাকে, “সৌগত, এখানে এসো!” সৌগত ছুটে আসে, নোটবুক বের করে ছাপগুলোর একটা স্কেচ করে। অনুপম তখন পাশে দাঁড়িয়ে পড়ছিল একটি পুরনো খাতা, যেটি মেঝের কোণে ধুলোর নিচে লুকানো ছিল। তাতে লেখা ছিল অরুণিমা দেবীর হাতে লেখা কিছু গদ্যখণ্ড—ভাঙা, অর্ধেক পৃষ্ঠা, কিন্তু বেশ বোঝা যায় তিনি কারও কথা বলছেন—“সে আজও ফেরেনি… প্রতিটি রাত্রি যেন কাঁটার মুকুট… আমি তাঁর অপেক্ষায় ছায়া হয়ে গেছি… আমি দোতলায় যেতে ভয় পাই… ওখানে কেউ ডাকে।” চারজনের ভেতর এক অজানা স্নায়বিক টান তৈরি হয়। নন্দিতা সেই লেখার মধ্যে নিজের মতো করে একটা কষ্টের সুর টের পায়—এটা শুধুমাত্র ভয় বা পাগলামি নয়, এটা একজন নারীর নিঃসঙ্গতা আর হারানোর আর্তি।
বিকেলের দিকে তারা বাড়ির পেছনের অংশে যায়, যেখানে এক সময় ঘোড়ার আস্তাবল আর কর্মচারীদের কোয়ার্টার ছিল। সেখানে দরজা বন্ধ একটা ছোট ঘর পেয়ে তারা খুলে দেখে, ভিতরে অন্ধকার আর স্যাঁতসেঁতে গন্ধে নাকে ঝাঁঝ লাগে। ইশান টর্চ জ্বালিয়ে দেয়, আর আলো গিয়ে পড়ে এক টেবিলের ওপর, যেখানে একটা আয়না উল্টে রাখা, পাশে কিছু পুরনো আতরের শিশি, শুকনো গোলাপের পাঁপড়ি আর এক মুঠো চুল বাঁধা কাঁসার ডিব্বা। “এটা কোনো মেয়ের সাজঘর ছিল হয়তো,” ফিসফিস করে বলে নন্দিতা। আয়নাটা সোজা করে দেওয়ার মুহূর্তেই এক অদ্ভুত ঠাণ্ডা হাওয়া ঘরের ভিতর দিয়ে ছুটে যায়—একজনেরও কথা বের হয় না। আয়নার কাচটা অদ্ভুতভাবে দাগময়, কিন্তু তার মধ্যে একটা মুহূর্তে সবাই দেখে, যেন তাদের পেছনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। সবাই একসঙ্গে ঘুরে তাকালেও, পেছনে কিছু ছিল না—কেবল ঘরের দরজা খোলা, আর বাইরে ছায়া পড়া বিকেল। অনুপম বলে ওঠে, “এই আয়নাটা দোতলার সেই জানালার বিপরীতে থাকলে কেমন হয় বল তো? তখন ভেতরটা বাইরে এসে দাঁড়ায়।” সৌগত তার খাতায় টুকে নেয় ব্যাপারটা—”পুরনো আয়নাগুলো শুধু আলো নয়, সময়ও ধরে রাখে।” এই ঘরে তারা আরও খুঁজে পায় একটি পিতলের ছোট ঘন্টার, যা হয়তো প্রতিদিন সন্ধ্যায় বাজানো হত। কিন্তু আজ, সেই ঘন্টা নিজে থেকেই একটা নরম ‘টিং’ করে শব্দ করে উঠল, যখন কেউ তাকে স্পর্শও করেনি। কেউ কিছু বলে না, শুধু ইশান তার গলার কাছে ঝোলানো ক্যামেরার লেন্স টিপে দেয়—এই মুহূর্তগুলো রেকর্ড করতে করতে তার হাত কাঁপছে। বাড়ি তখন নিঃশব্দ নয়, অদ্ভুত এক ভারি নিস্তব্ধতা যেন শব্দ ছাপিয়ে কথা বলছে। দেয়াল যেন ফিসফিস করে কিছু বলছে, বাতাস যেন কান্নার ছায়া বয়ে নিয়ে যাচ্ছে বারান্দা ঘুরে।
সন্ধে নামার আগেই তারা ফেরে বৈঠকখানায়, যেখানে দুপুরে পাওয়া পুরনো খাতা, আয়না, আর দেয়ালের খোদাই নিয়ে আলোচনা হয়। সৌগত বলল, “এইসব সব কিছু মিলে একটা ছবিই স্পষ্ট হচ্ছে—রুদ্রসিংহের স্ত্রী অরুণিমা ধীরে ধীরে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছিলেন, এবং হয়তো উনি কিছু এমন দেখতেন যা অন্য কেউ দেখত না। অথবা, সত্যিই কিছু ছিল, যেটা ওদের পেছনে ছিল।” অনুপম তখন বলল, “আমরা যতই বাস্তববাদী হই না কেন, এইসব প্রাচীন ঘরগুলো একটা ইতিহাস ধারণ করে রাখে—যেটা কেবল পড়া বা ব্যাখ্যা করা যায় না, অনুভব করতে হয়।” হঠাৎ করেই বাইরে একটানা বাতাস বয়ে যায়, আর বন্ধ জানালার পর্দা সরে গিয়ে দেখা যায় এক মুহূর্তের জন্য কেউ দাঁড়িয়ে ছিল জানালার ওপারে। নন্দিতা চমকে উঠে বলে, “সেই চেহারাটা… ঠিক অরুণিমার বর্ণনা অনুযায়ী।” কিন্তু কেউ কিছু স্পষ্ট দেখতে পায়নি—শুধু ইশান তার ক্যামেরায় দেখার পর বলল, “দেখেছি… শুধু মুখটা নয়, চোখ দুটো যেন আলো শুষে নিচ্ছিল।” তারা সবাই চুপ হয়ে যায়। সেই রাতে কেউ ঠিকভাবে ঘুমোতে পারে না। সবার মধ্যেই একটা অদ্ভুত বোধ তৈরি হয়—তারা হয়তো শুধু একটা জমিদারবাড়ি নয়, বরং একটা বদ্ধ সময়ের ফাঁদে ঢুকে পড়েছে, যেখানে কান্না এখনও দেয়ালের গায়ে শুকিয়ে ওঠেনি, আর আয়নার মাঝে আটকে আছে এক নারীর অপেক্ষা।
অধ্যায় ৩
সকালে চোখ খুলতেই ইশান যেন নিজের শরীরটা ভারী অনুভব করল, মাথার পেছনে একটা চাপা যন্ত্রণা, যেন রাতভর কেউ তার ঘাড়ের কাছে দাঁড়িয়ে ছিল নিঃশব্দে। সে এক দৌড়ে উঠে বসল, এবং সাথে সাথে মনে পড়ল আগের রাতের সেই মুহূর্ত—জানালার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা সেই চেহারা, যার চোখে ছিল একধরনের নিঃশব্দ আর্তি। ক্যামেরা নিয়ে সে ঘরের এক কোণে বসে ফুটেজ দেখতে শুরু করল, এবং তার শিরদাঁড়া বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে গেল যখন সে দেখল—রাত ৩টা ১২ মিনিটে ক্যামেরা আপনাআপনি চালু হয়ে গিয়েছিল। সে কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল, শুধু সবাইকে ডাকল, “তোমরা একবার এদিকে আসো তো।” সকলে এসে দাঁড়াল তার পেছনে, ফুটেজ চলতে থাকল। দেখা গেল, অন্ধকার ঘরের মধ্যে জানালার বাইরের আলোয় এক নারীমূর্তি দাঁড়িয়ে, তাঁর মাথা কাত করা, চোখ দুটি নিচের দিকে নেমে আছে—আর ঠিক পেছনে, এক ছায়ামূর্তি যার কাঁধে লম্বা চাদর, কিন্তু মুখ দেখা যাচ্ছে না। হঠাৎ ক্যামেরা ঝাঁকুনি খেয়ে বন্ধ হয়ে যায়, স্ক্রিন ব্ল্যাঙ্ক। সৌগত ফিসফিস করে বলল, “আমরা আসলে শুধুমাত্র অতীতের ইতিহাস দেখতে আসিনি—আমরা হয়তো এমন কিছু ছুঁয়ে ফেলেছি, যেটা এখনো থেমে নেই।” অনুপম হালকা কাঁপা গলায় বলল, “তাদের গল্পটা হয়তো আজও শেষ হয়নি। জানালাটা… হয়তো একটা দরজা।”
এরপর সকলে আবার বের হল বৈঠকখানা পেরিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব দিকের সেই জানালাটির দিকে। এই জানালাটিকে ঘিরেই গত দুই দিন ধরে বারবার ঘটছে সবকিছু—তাদের নজর এড়াল না যে জানালার রঙিন কাঁচের একটা প্যানেল যেন ভিতর দিক থেকে হালকা লালচে হয়ে আছে। সৌগত প্রথমে ভেবেছিল ওটা সূর্যের আলোয় এমন দেখাচ্ছে, কিন্তু নন্দিতা নিচু হয়ে যখন কাচটা স্পর্শ করল, তার আঙুলে লেগে গেল কিছু লালচে আঠালো পদার্থ। সে চমকে উঠে বলে, “এটা রং নয়… এটা রক্তের মতো!” কিন্তু সেই পুরনো কাচে এত বছর পরে রক্ত কেমন করে থাকবে? এই প্রশ্ন ঘুরছিল সকলের মনে। তখন অনুপম বলে উঠল, “জানো, লোকগল্পে বলা হয় কিছু কাঁচ সব অনুভব শুষে নেয়, বিশেষ করে যদি তা কোনও আঘাতের সঙ্গে জড়িত থাকে… হয়তো এই জানালাটা এমন কিছু দেখেছে যেটা থেকে এখনও মুক্তি পায়নি।” হঠাৎই জানালার বাইরে ছায়া পড়ে—কেউ যেন দোতলার জানালায় হেঁটে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। কেউ তাকিয়ে নেই, অথচ তাদের সবার মন বুঝতে পারল—এই মুহূর্তে কেউ ওদের উপর নজর রাখছে। ইশান বলল, “চলো, জানালার বাইরে থেকে একবার দেখেই আসি—কোন জানালাটা এমন রক্তরঙের আভা ফেলছে?” তারা বাড়ির চারপাশে ঘুরে যখন জানালাটির ঠিক সামনে দাঁড়াল, তখন দেখা গেল—দোতলার সেই দক্ষিণ জানালাটির নিচে কাঁচ ফেটে গেছে সামান্য, আর তার পাশেই মাটিতে শুকনো পাতার উপর লেগে আছে পায়ের দাগ—নতুন নয়, আবার অতিপ্রাচীনও নয়—যেন এইমাত্র কেউ নেমেছে দোতলা থেকে।
ফিরে এসে তারা সেই জানালার নিচের ঘরটি পরিস্কার করে বসার ব্যবস্থা করল। সৌগত তার নোটবুকে পুরো ঘটনা ধারাবাহিকভাবে লেখার চেষ্টা করছিল, নন্দিতা জানালার পাশেই বসে স্কেচ করে নিচ্ছিল সেই প্যানেলের, আর ইশান আবার ক্যামেরা বসাচ্ছিল সঠিক কোণে। ঠিক সেই সময়, বিকেলের ছায়া লম্বা হয়ে ঘরের ভিতরে ঢুকে পড়ছে, আর ঘড়ির কাঁটা ছুঁয়ে ফেলেছে চারটা পঁয়ত্রিশ। হঠাৎ বাতাস থেমে যায়, বাইরে একরাশ নিস্তব্ধতা। জানালার কাঁচে কেউ যেন ঠুক করে আঙুল দেয়—একবার, তারপর আবার—খট… খট… খট। তিনটি শব্দ, তিনটি টান। সকলেই তাকিয়ে থাকে, নিশ্বাস ফেলে না কেউ। কাঁচের ওপারে, অস্পষ্ট আলোয় তারা দেখে এক জোড়া হাত—দুটি মেহেদি লাগানো মেয়ে হাত, যার একটিতে সোনালি কাঁচের চুড়ি, অন্যটিতে আঙুলে কালো দাগ। হাত দুটি জানালায় ধীরে ধীরে গড়িয়ে পড়ে, যেন জানালার ওপারে কেউ অজ্ঞান হয়ে হেলে পড়েছে। হঠাৎ জানালার ফ্রেম দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা লাল তরল গড়িয়ে পড়ে—ঠিক যেন কেউ ওপরে আবার রক্তাক্ত হয়েছে। এই দেখে নন্দিতা কাঁপা গলায় বলল, “এই বাড়ি শুধু অতীত নয়… এই জানালা কারও মৃত্যু দেখতে দেখতে, নিজেই অভিশপ্ত হয়ে গেছে।” সবাই স্তব্ধ, ইশান ক্যামেরা বন্ধ করেও কিছু বলে না, শুধু বলে, “এটা যেন একটা চিৎকার—কিন্তু সে শোনা যাচ্ছে না, বরং দেখা যাচ্ছে।” সেই রাতে তারা আর আলো নিভিয়ে ঘুমোয় না। জানালার সামনে বসে সৌগত লিখে চলল, “তাদের কেউ আজও বাইরে তাকিয়ে আছে… কেউ আজও জানালার এপারে ফিরতে চায়।”
অধ্যায় ৪
বাড়ির ইতিহাস জানতে হলে তার শিকড় খুঁজতে হয় সময়ের অনেক গভীরে। পরদিন সকাল থেকেই সৌগত আর অনুপম মিলে কুড়িয়ে আনা পুরনো নথি, জমিদার পরিবারের দলিল, এবং পুঞ্জিভূত লেখা খাতা নিয়ে বসে যায় বৈঠকখানার মাঝখানে। গুপ্তবাবু তাদের একটি ছোট সিন্দুক এনে দেন—পুরনো তালা, ভিতরে কিছু শুকনো কাগজ, একটি রৌপ্য কলম, আর একটি ডায়েরি। সেই ডায়েরিটি ছিল রুদ্রপ্রতাপ সিংহের নিজের হাতের লেখা, তার রাজত্বকালের নানা দিনলিপি। লেখা শুরু হয় ১৮৮২ সাল থেকে—যখন তার বাবা ঈশ্বরসিংহ সিংহচৌধুরীর মৃত্যু হয় এবং সে জমিদার পদে বসে। প্রথম দিকে লেখা ছিল প্রশাসনিক ভাষায়—জমিদার বাড়ির চাষবাস, কর আদায়, মোড়লদের বিচারসভা, এমনকি কলকাতা থেকে আগত ব্রিটিশ ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গেও কথোপকথনের বিবরণ। কিন্তু ১৮৯০ এর পর থেকে লেখার ভাষা বদলে যেতে থাকে—আস্তে আস্তে সেই ভাষায় আসে ক্লান্তি, নিঃসঙ্গতা এবং একটা অদ্ভুত হীনমন্যতা। একটা এন্ট্রিতে রুদ্রসিংহ লিখেছে—”অরুণিমার চোখের দিকে তাকালেই আজকাল আমি ভয় পাই। সে যেন আমার আত্মা পড়ে ফেলে… কিংবা আমি যা লুকাতে চাই, তা বার করে আনে তার নিশ্ছিদ্র নীরবতায়।” অনুপম পড়ে শুনাচ্ছিল আর বাকিরা নিঃশব্দে শুনছিল। ডায়রির প্রতিটি পৃষ্ঠায় যেন জমে আছে সময়, যন্ত্রণার কালি আর অব্যক্ত ভালোবাসা—যা ধীরে ধীরে বিষ হয়ে উঠেছিল সেই পরিবারে।
নন্দিতা সেই সময় বাড়ির একটি ছোট্ট গ্যালারিতে দাঁড়িয়ে দেয়ালের ছবি লক্ষ্য করছিল। সেখানে ঝুলছিল রুদ্রসিংহের একমাত্র ছেলের ছবি—অদ্ভুত চোখের দৃষ্টি, যেন সে ছবির বাইরের কাউকে দেখছে। ছবির নিচে লেখা নাম: অরিন্দম সিংহ, জন্ম: ১৮৮৫, মৃত্যু: অজানা। সে মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিল বাবার পাশে, এক অভিজাত কিন্তু শীতল পরিবেশনার মধ্যে। ছবির এক কোণে হালকা আঁচড়, আর তার পাশে যেন ছোপ লেগে আছে কোনো রঙের—যেটা নন্দিতা ভালো করে দেখে বুঝতে পারল, রঙ নয়, বরং পুরনো রক্তের দাগ। সে তৎক্ষণাৎ বাকিদের ডাকে, সবাই এসে দাঁড়ায় ছবির সামনে। সৌগত চুপচাপ ছবি দেখে বলল, “এই ছেলে হারিয়ে গিয়েছিল অমাবস্যার রাতে, বাড়ির দোতলার জানালা খোলা রেখে। আর তারপর থেকেই রুদ্রসিংহ ধীরে ধীরে নিজেকে গুটিয়ে নিতে শুরু করেন। দিনলিপিতে বারবার এসেছে সেই রাতের কথা। তিনি লিখেছিলেন—‘জানালার ওপারে কে যেন ডাকছিল… অরিন্দম সাড়া দিয়ে চলে গেল। আমি শুধু দাঁড়িয়ে দেখছিলাম। আমি তো জানতাম, ওর ফেরা হবে না।’” এই ঘটনার ঠিক কয়েক মাস পরেই অরুণিমা দেবী অসুস্থ হয়ে পড়েন—গল্প অনুযায়ী, এক রাতে তিনি আচমকাই দোতলার জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে, চুড়ির শব্দ তুলে কাঁদছিলেন। এরপরই নিখোঁজ হয়ে যান। বাড়ির ভৃত্যরা কেউ আর মুখ খোলে না, শুধু কেউ কেউ বলে, “বেগমমা নিজেই হারিয়ে গিয়েছিলেন সময়ের কুয়াশায়।” এ বাড়ির প্রতিটি করিডোর, প্রতিটি জানালা যেন সেই কান্নার ধ্বনি আজও বয়ে বেড়ায়।
সন্ধে নামে বাড়িটায়, আলো নিভে গেলে আবারও সেই স্নায়ুচাপ। ইশান চুপচাপ ক্যামেরা সেট করে, এবার স্থির অবস্থানে রেখে দেয় দোতলার সিঁড়ির মুখ বরাবর। রাত্রি এগোতে থাকে, সময় থেমে থাকে এক অদৃশ্য স্তব্ধতায়। রাত ১টা ৩৫ মিনিট—তারা আবার শুনতে পায় সেই পরিচিত ধ্বনি—ধীরে ধীরে পায়ের শব্দ, সিঁড়ির পুরনো কাঠের চাপা কাঁপন, আর বাতাসের ফিসফাস। অনুপম চুপচাপ বলে ওঠে, “এই শব্দ শুধু চলাফেরার নয়—এটা যেন একটা অভ্যেস, বারবার ঘোরাফেরা, অপেক্ষা, আর ফিরে আসার চেষ্টা।” হঠাৎই জানালার কাঁচে আলো পড়ে—কেউ যেন দোতলার জানালায় মোমবাতি হাতে দাঁড়িয়ে আছে। তার আলো ছড়িয়ে পড়ে নিচের করিডোরে, যেখানে ছায়া পড়ে দীর্ঘ হয়ে। তারা ছুটে যায় ক্যামেরা চেক করতে—ফুটেজে দেখা যায় ধূসর আলোয় ভেসে থাকা এক পুরুষ অবয়ব, মুখ আড়ালে, কাঁধে এক লালচে চাদর, এক হাতে ধরা একটি পুরনো বই। তারা নিশ্চিত—এটাই রুদ্রসিংহ, যার আত্মা এই দোতলায় বন্দি, নিজের ভুল, নিজের পাপ আর নিজের অতৃপ্ত ভালোবাসার সঙ্গে। সৌগত ধীরে গলায় বলে, “সে রাজত্ব করেছিল বহু মানুষের ওপর, কিন্তু নিজের জীবনের ওপর হারিয়েছিল অধিকার। আর সেই ব্যর্থ রাজত্বের মধ্যেই সে আজও ঘুরে বেড়াচ্ছে—এই দোতলায়, এই জানালার পাশে, সেই অপেক্ষা নিয়ে যে হয়তো কখনো শেষ হবে না।”
অধ্যায় ৫
বিকেলের পর থেকে বাড়ির ভেতর এক অস্বাভাবিক নিস্তব্ধতা ছায়ার মতো ঘুরে বেড়াতে শুরু করল। পাখিদের কিচিরমিচির, কুকুরের দূর ঘেউঘেউ বা গাছের পাতার স্বাভাবিক সাঁসাঁনি—সব যেন হঠাৎ থেমে গেছে। চারজনের মুখেও চাপা ভয়, অদ্ভুতভাবে কেউ আর জোরে কথা বলছে না। বিকেলবেলা চা খেতে খেতে নন্দিতা হঠাৎই বলে উঠল, “আজ রাতে কিছু একটা হবে। ঠিক যেন বাতাসও থেমে আছে কোনো সংকেতের অপেক্ষায়।” সৌগত মাথা নিচু করে নিজের খাতা বন্ধ করল—তার চোখের সামনে বারবার ভেসে উঠছিল অরুণিমার সেই ডায়েরির পৃষ্ঠা, যেখানে লেখা ছিল—”আমি শুধু শুনি… প্রতিরাতে ওই চুড়ির শব্দ… সে কি ফিরেছে? না কি আমি ভুল দেখছি?” বিকেলেই গুপ্তবাবু তাদের বলেছিলেন, “আজ চতুর্দশীর রাত, এই বাড়িতে সেই রাতে অনেক কিছু ঘটে… সেদিনই বেগমমা শেষবারের মতো জানালার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন।” কথাগুলো যেন এক অশরীরী শীতলতা বইয়ে দিয়েছিল সবার মনের মধ্যে। সেই রাতে তারা সবাই আলাদা আলাদা ঘরে ছিল না। বৈঠকখানার মাঝখানে চারজন নিজেদের ঘুমনোর ব্যবস্থা করল—জানালাগুলো বন্ধ, কিন্তু কাচের ওপারে ছায়া যেন নড়াচড়া করছে।
রাত বারোটা পেরতেই হঠাৎ এক কাঁপা শব্দ—টুং… টুং… টুং… — যেন কাচের চুড়ির শব্দ, নরম অথচ ধারালো, নিঃশব্দ রাতের বুক ছিঁড়ে চলে এল ঘরের ভিতরে। ইশান প্রথম চোখ মেলে তাকিয়ে দেখে—জানালার ঠিক পাশে ছায়া নড়ছে, যেন সাদা শাড়ি পরা একটা নারী অবয়ব হাঁটছে দোতলার জানালার সামনে দিয়ে। সে বাকিদের ডাকে না, শুধুই হাত দিয়ে ক্যামেরা চালু করে। পরক্ষণেই শব্দটা আবার—টুংটাং, টুংটাং—এবার যেন আরও কাছ থেকে। নন্দিতা চোখ খুলে বসে পড়ে, তার শরীর জমে গেছে, ঠোঁট ফাঁকা, কণ্ঠ শুকিয়ে এসেছে। সে দেখে, সেই আয়নাটার কাঁচ ঝাপসা হয়ে আসছে, আর তাতে ফুটে উঠছে এক মুখ—একটি বিষাদময়, ফ্যাকাশে মুখ, যার কপালে সিঁদুরের টান, চোখ দুটি দীর্ঘশ্বাসে পরিণত। সে যেন কিছু বলছে না—শুধু চাইছে, কেউ তার দিকে তাকাক, কেউ তার অপেক্ষা বুঝুক। সৌগত বলল, “এটা সেই রাত… আমরা যেন ঢুকে পড়েছি তাদের অভিশপ্ত দিনলিপির এক খোলা পাতায়।” জানালার ঠিক নিচে মেঝেতে দেখা গেল একজোড়া মেহেদি লাগানো পা—নির্ভুল নারীর গঠন, কিন্তু ছায়াময়, রক্তহীন। এবং ধীরে ধীরে সেই পদক্ষেপ এগিয়ে গেল দরজার দিকে। দরজায় কারও কড়া নাড়ার শব্দ হয় না—কিন্তু সবাই টের পায়, সে যেন সেখানে দাঁড়িয়ে, নিঃশ্বাস নিচ্ছে, উপস্থিত রয়েছে, তবু দৃশ্যমান নয়। আয়নার মধ্যে দিয়ে হঠাৎ তারা সবাই দেখে—এক নারীর পেছনে দাঁড়িয়ে আছে রুদ্রসিংহ—চুপচাপ, নির্জন, অনুতপ্ত।
সকাল হতেই চারজনের মধ্যে এক ধরণের স্তব্ধতা তৈরি হয়। ইশান ক্যামেরা রিভিউ করতে গিয়ে দেখে, রাতের ১টা ৪৮ মিনিটে এক ধূসর ফ্রেম—তাতে শুধু দেখা যাচ্ছে একজোড়া চুড়ির ঝিকিমিকি আলো, আর পিছনে সেই আয়না, যেখানে এক পৃষ্ঠাজুড়ে মেঘলা হয়ে রয়েছে একটি শব্দ: “ফিরে এসো।” এটা কেউ লিখেনি, কেউ স্পর্শ করেনি, কিন্তু আয়নার ভেতর থেকে যেন সময়ের চিহ্ন রেখে গেছে কেউ। সৌগত বলল, “চুড়ির শব্দের অর্থ বোঝা যাচ্ছে—এটা কোনো দৈব ব্যাপার নয়। হয়তো অরুণিমা এখনো খুঁজছেন তার ছেলেকে, তার প্রেমিক স্বামীকে, কিংবা শুধুই নিজের অস্তিত্বকে।” অনুপম বলে, “এই বাড়ির জানালা আর আয়না শুধু সময়ের প্রতিচ্ছবি নয়—এগুলো আত্মার অস্তিত্বের সীমানা। তারা চোখের দেখা নয়, মনে ফেলে যাওয়া কষ্ট।” সন্ধে নাগাদ তারা সেই আয়নাটি জানালার মুখোমুখি দেয়ালে স্থাপন করে, ঠিক যেভাবে সেই সাজঘরে ছিল। এবার দেখা গেল—আয়নার মধ্যেই ফুটে উঠছে দোতলার এক ফ্রেম, তার ভেতরে রক্তরাঙা জানালার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সেই দুই ছায়া। নন্দিতা ধীরে ধীরে বলে উঠল, “এই শব্দগুলো কোনো ভৌতিক কল্পনা নয়। এগুলো এক নারীর অপেক্ষার জৈব স্মৃতি—যা এখনও মুছে যায়নি।”
অধ্যায় ৬
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙতেই সৌগত আর অনুপম নোটবুক নিয়ে বাড়ির নকশা ও স্থাপত্য বিশ্লেষণ করতে বসে। তারা লক্ষ করল—বাড়ির দোতলা থেকে যে বারান্দা বাহিরে দেখা যায়, সেই দিক থেকে একটি ঘরের জানালা বাইরের দিকেই খোলে না। অথচ ভিতর থেকে শব্দ শোনা গেছে ঠিক সেখান থেকেই। বিষয়টি আরও রহস্যময় হয়ে উঠল যখন নন্দিতা বাড়ির পশ্চিম পাশের গোপন করিডোরে পুরনো দেওয়ালে একটা অসম্পূর্ণ খাঁজ লক্ষ্য করল। সেই খাঁজে হাত রেখে চাপ দিতেই দেয়ালের একাংশ নড়ে উঠল, আর খোলে গেল এক সরু লুকোনো দরজা—পেছনে একটি অন্ধকার ঘর, বহুদিন ধরে বন্ধ। ঘরের ভেতরে ঢুকতেই এক গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল—পুরনো, পচা রক্ত আর ধূপকাঠির মতো গন্ধের অদ্ভুত মিশ্রণ। দেয়ালে খোদাই করা আছে বহু চিহ্ন—তিনকোণা ছায়া, সাপের মতো বাঁকা রেখা, এবং মাঝে একটি শব্দ, যা শঙ্খলিপি আর বাংলার মিলিত রূপে লেখা: “অরুণিমা।” ঘরের মেঝেতে ছড়ানো কাঁচের টুকরো, এবং মাঝে একটি কাঠের পাত্র, যার মধ্যে শুকনো সিঁদুর আর রক্তমাখা একজোড়া শিশু চুড়ি। ইশান ক্যামেরা চালু করে, ফ্রেমে ধরে সেই অন্ধকার, আর সেই নাম—যা এখনও সেই অভিশপ্ত বাতাসে লেপ্টে আছে।
ঘরের এক পাশে পাথরের পাটায় রাখা ছিল একটা পুস্তিকা—পাতাগুলি প্রায় ঝুরঝুরে, কিন্তু যতটুকু পড়া গেল, তার ভাষা রুদ্রসিংহের নিজের হাতের লেখা। এই কক্ষটি ছিল তার আত্মগোপনের স্থান, যেখানে সে লিখত যা প্রকাশ্যে বলা যেত না। একটি পাতায় লেখা—“সে রাতে আমি ফিরিনি, আমি সাহস পাইনি। অরিন্দমের কান্না আমি শুনতে পাইনি—আমি শুধু জানালার দিকে তাকিয়ে থাকি। অরুণিমার চোখে আগুন ছিল, আর আমার চোখে ছিল ভয়। আমি রাজা ছিলাম, অথচ আমি কাপুরুষ।” এরপরেই রয়েছে একটি পাতায় শুধু লাল কালিতে লেখা—”আমাকে মাফ করো, অরুণিমা। তুমি ডাকছো… আমি শুনতে পাই… আমি আসছি না, আমি পারছি না।” সেই পৃষ্ঠার নিচে ছড়িয়ে আছে রক্তের ছোপ, আর তার পাশে পড়ে আছে একটি রৌপ্যমুদ্রা—তাতে রুদ্রসিংহের প্রতীক খোদাই করা। হঠাৎ করে ঘরের তাপমাত্রা যেন নেমে এল, বাতাস ভারী হয়ে উঠল, আর চারজনে অনুভব করল—তারা এই ঘরে একা নয়। দেয়ালের ফাটলের ভিতর দিয়ে যেন কেউ ফিসফিস করে বলছে কিছু, কিন্তু শব্দ নয়, অনুভূতির চাপা ঢেউ যেন। জানালার পাশের আয়নাটি যেখানে রাখা, তার কাচে ধীরে ধীরে জমছে কুয়াশা, আর তার মাঝে ফুটে উঠছে অরুণিমার একটি আধা-স্পষ্ট মুখ—চোখ দুটি ভয়ংকর নিঃশব্দে জমে আছে এক বিনাশী যন্ত্রণায়।
ঘরের এক কোণে একটা কাঠের বাক্স খুঁজে পায় ইশান, যার ভিতরে রয়েছে ধাতুর দণ্ডে বাঁধানো একটি লিপি—তাতে লেখা: “যদি জানালার পথে হাঁটো, ফিরে তাকিও না।” বাক্সের নিচে একটা আয়নার টুকরো ছিল, আর তার গায়ে আঁচড় দিয়ে লেখা এক লাইন—”সে এসেছে। জানালায় দাঁড়িয়েছে। এবার সে ডাকবে তোমায়।” সবাই একসাথে বাইরে এসে দাঁড়াল, দোতলার দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। জানালার ওপারে পর্দা নড়ল, কেউ যেন চুপি চুপি কাচ ছুঁয়ে গেল। ইশান বলল, “এই ঘর ছিল তার অপেক্ষার ঘর—অরুণিমার, অথবা রুদ্রসিংহের… অথবা এমন কিছু যা আমাদের চেনা বাস্তবের বাইরে।” সেই রাতে তারা কিছুই পরিকল্পনা করে না—সব কিছু যেন নিয়তির পথে চলতে থাকে। আর বাড়ির প্রতিটি জানালা যেন নিঃশব্দে চোখ খুলে রাখে, কেউ যেন ভিতর থেকে চেয়ে আছে, আবার কেউ যেন বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে—আসার নয়, টানার জন্য। চুপচাপ, অব্যক্ত, অথচ অমোঘ।
অধ্যায় ৭
সেই রাতে চারজনের ঘুম আর ঘুম ছিল না। প্রতিটি মুহূর্ত যেন এক অজানা সংকেতের দিকে ঠেলে নিয়ে চলছিল তাদের—এক অদৃশ্য সময়ের ছায়াপথে। তারা সিদ্ধান্ত নেয়, এবার দোতলায় উঠতে হবে। এতদিন ধরে তারা নিচ থেকে দেখেছে জানালা, আয়না, ছায়া, আর পায়ের শব্দ; এবার উপরে গিয়ে সত্যের মুখোমুখি হওয়া ছাড়া কোনো রাস্তা নেই। সিঁড়ির পুরনো কাঠ মচমচ করে উঠল ইশান যখন প্রথম পা রাখল। বাকিরা একে একে উঠল। দোতলার করিডোরে পৌঁছেই বোঝা গেল—এখানে বাতাস ভারী, নিঃশব্দ অথচ উপস্থিত। করিডোরের শেষ ঘরটি যেটি সবসময় বন্ধ ছিল, তার দরজায় লালচে দাগ—একসময় রক্ত জমে শুকিয়ে গিয়েছিল হয়তো। দরজায় হাত রাখতেই নন্দিতার হাত কেঁপে উঠল। সে বলল, “এখানে কেউ আছে। আমি নিশ্চিত।” সৌগত দরজাটা ধীরে ধীরে ঠেলে খুলল। ভিতরে ঢুকতেই চোখে পড়ল: ঘরের মাঝখানে একটি লাল কার্পেট, তার উপর পাথরের শয্যা, আর শয্যার পেছনে বিরাট একটি আয়না। আয়নার সামনে একটি কাঠের দোলনা চেয়ার, আর তার ওপরে ধুলো জমা একটি সাদা শাড়ি। বাতাস নেই, তবু জানালার পর্দা নড়ে উঠছিল ধীরে ধীরে, যেন কেউ বারবার আসে এই ঘরে, বসে, অপেক্ষা করে।
ইশান ক্যামেরা চালু করল। সে ফ্রেমে ধরতে চাইল সেই শূন্যতাকে, যা এই ঘরের প্রতিটি কোণে জমে রয়েছে। হঠাৎ করেই জানালার কাঁচে ধাক্কা খেল কিছু একটা—ভেতরে আলো পড়ে, আর আয়নায় ভেসে ওঠে এক মুখ। একটি নিঃশব্দ নারী মুখ, চোখে কান্না, ঠোঁটে রক্তের রেখা, কপালে সিঁদুরের টান। সে আয়নার ওপার থেকে যেন তাকিয়ে ছিল অনেকদিন ধরে, বহু বছর ধরে… ঠিক এই সময়ের জন্য। সৌগত ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে গিয়ে আয়নার নিচের কাঠে চোখ রাখল—তাতে খোদাই করা ছিল ছোট ছোট অক্ষরে: “আমি এখনো জানালার ওপারে। তুমি কি এখনো এখানে আছো?” হঠাৎ ঘরের জানালায় এক বিকট শব্দ—পর্দা ছিঁড়ে গেল, বাতাসের ধাক্কায় সেই সাদা শাড়িটা উড়ে গিয়ে পড়ে ইশানের পায়ের পাশে। সে যখন সেটা তুলতে গেল, দেখতে পেল কাপড়ের পেছনে লুকানো ছিল একটি রক্তমাখা ডায়েরি—এই সেই ডায়েরি, যা সম্ভবত অরুণিমা লিখেছিলেন তার মৃত্যুর আগের দিনগুলোতে। প্রথম পৃষ্ঠাতেই লেখা—“আমি ভুল করিনি। আমি জানি, রুদ্র ফিরে আসবে না। কিন্তু আমি যাব… আমি জানালার ওপারে যাব, আর ফিরে তাকাব না।”
ঘর জুড়ে হঠাৎ আলো কমে এলো। ইশান ক্যামেরার স্ক্রিনে যা দেখল, তা বলার আগেই সে দাঁড়িয়ে পড়ল—আয়নার ভিতরে সে দেখতে পাচ্ছে নিজের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে অরুণিমা, অথচ বাস্তবে কেউ নেই। সে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে, “সে এখন এখানে… আমাদের মধ্যে।” আয়নায় হঠাৎ ফাটল ধরে, ছড়িয়ে পড়ে শিসার রেখা, আর মাঝখান থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসে ঠান্ডা হাওয়া। অনুপম চেঁচিয়ে ওঠে, “পেছনে তাকিও না!” কিন্তু ততক্ষণে নন্দিতা ফিরে তাকিয়েছে। সে দেখে, জানালার ঠিক পাশে দাঁড়িয়ে আছে সেই নারীমূর্তি, চুড়ির টুংটাং শব্দে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে, কিন্তু মুখ দেখা যাচ্ছে না—তার বদলে রয়েছে অন্ধকার, শূন্যতা। সৌগত তখন আয়নার গায়ে হাত রাখে, আর বলে ওঠে, “তুমি যেতে চাও? তবে যাও… কিন্তু আমাদের নিয়ে নয়। আমরা শুধু জানতে এসেছি, ছুঁয়ে ফেলেছি অতীত, বুঝে নিয়েছি কান্না। এবার মুক্ত হও।” মুহূর্তেই জানালার বাইরে আলো ফেলে এক ঝলক ঘূর্ণি বাতাস উঠল, আয়নার ফাটলে আলো ঝলসে উঠল, আর সেই ছায়ামূর্তি ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল… আয়নার ফাটলের ভেতর দিয়ে।
অধ্যায় ৮
রাত্রির সেই ভয়াবহ ঘটনার পরে সকালের আলো যেন প্রথমবারের মতো মুক্তির আভাস নিয়ে এলো রুদ্রসিংহের জমিদারবাড়িতে। পাখিরা ডাকছিল, জানালার কাচে আলো পড়ছিল নির্মলভাবে। কিন্তু চারজনের চোখে ঘুম ছিল না, ছিল শুধু বোবা শূন্যতা। তারা সবাই জানত, গত রাতের সেই মুহূর্ত—যেখানে আয়নার ভেতর থেকে অরুণিমার ছায়া নিঃশব্দে মিলিয়ে গেল, তা কোনো বিভ্রম ছিল না। ইশান ক্যামেরায় ফুটেজ দেখতে গিয়েও অবাক হয়ে যায়—সেই নির্দিষ্ট সময়ে সব ভিডিও ব্ল্যাংক, শুধুমাত্র শেষ ফ্রেমে দেখা যায় দোতলার জানালা, খোলা, আর তার পাশে একটি দোলনা চেয়ার ধীরে ধীরে দুলছে। সেই চেয়ারের পাশে পড়ে রয়েছে একটি শাঁখা, অর্ধেক ভাঙা, আর মেঝেতে যেন শুকনো গোলাপের পাপড়ি। সৌগত বলে ওঠে, “সে চলে গেছে… অথবা বলা ভালো, সে ফিরে গেছে। তার শোক, অভিমান, সবকিছু হয়তো এই জানালার ওপারে আটকে ছিল। আর এখন… জানালাটা শূন্য।” কিন্তু শূন্যতার মধ্যেও একটা ভারী অনুভব ছিল—যা এতদিন ধরে ছিল কান্নার, অপেক্ষার, আর অভিশপ্ত ভালোবাসার এক স্মারক।
নন্দিতা জানালার ঠিক সামনে এসে দাঁড়ায়। তার দৃষ্টিতে ছিল এক অন্যরকম নরমতা। সে ফিসফিস করে বলে, “তুমি যদি থেকেও থাকো, আমি জানি, তুমি এখন বন্দি নও। এই জানালাটা আর অভিশপ্ত নয়, এটা এখন এক চুপ করে থাকা দরজা, যার ওপারে কেউ ছিল, আর এখন নেই।” সেই জানালাটার কাচে আর কোনো রক্তরঙের ছাপ নেই, নেই ধোঁয়ার মতো ছায়া। বাড়ির বাতাসে হঠাৎ যেন হালকা চন্দনের গন্ধ ভেসে আসে—ঠিক যেমন গন্ধ থাকে কোনো পুরনো সংসার ভাঙার পরে। ইশান দোলনা চেয়ারের পাশের মেঝেতে একটুকরো কাগজ খুঁজে পায়—হাতে লেখা একটি লাইন: “আমি জানালার ওপারে নয়, এই বাড়ির প্রতিটি ইটের মধ্যে ছিলাম।” বাকিরা অবাক হয়ে চেয়ে থাকে। এই বাক্য যেন অরুণিমার হৃদয়ের শেষ ভাষ্য। তারা চারজন একসঙ্গে দাঁড়িয়ে জানালার বাইরে তাকায়—সামনে খোলা মাঠ, পুকুরের ধারে ছায়া, আর দূরে বিস্তৃত ধানের জমি। তারা বুঝতে পারে—এই বাড়ি শুধুমাত্র ভূতের ছিল না, এই বাড়ি ছিল ভালোবাসার, অসমাপ্ততার, অপরাধবোধ আর মুক্তির এক দীর্ঘ পথের রূপরেখা।
বিকেলে তারা যখন বাড়ির মূল দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বাইরে বেরোতে চায়, তখন দেখা গেল গুপ্তবাবু ধীরে হেঁটে আসছেন হাতে একটি পুরনো চাবি নিয়ে। তিনি বলেন, “এই চাবিটা সেই দোতলার মূল কক্ষের। এতদিন ধরে তালা দিয়েই রেখেছিলাম… কিন্তু আজ দেখলাম দরজাটা খোলা। তোমরাই না?” সৌগত হাসল, চোখ নামিয়ে বলল, “না কাকা, দরজা খুলেছিল কেউ… যে এ বাড়িরই ছিল। আমাদের শুধু পথ দেখিয়েছিল।” গুপ্তবাবু থমকে যান কিছুক্ষণ, তারপর মাথা ঝুঁকিয়ে বলেন, “হয়তো আজ তার শান্তি হলো।” বাড়ির পেছনে গোধূলির আলো ধীরে ধীরে নামছে। তারা চারজন বেরিয়ে পড়ছে বাড়ির চৌকাঠ পেরিয়ে, কিন্তু একবারও কেউ পেছনে তাকায় না। তারা জানে, জানালাটা এখন খোলা, কিন্তু ফাঁকা। জানে, কেউ আর ফিসফিস করে ডাকে না, আর কোনও চুড়ির টুংটাং রাত জেগে ওঠে না। সময় যেন স্তব্ধ হয়ে থেকে গেল সেই জানালার পাশে, যেখানে একদিন দাঁড়িয়ে ছিলেন রুদ্রসিংহ, আর যেখানে আজ… শুধুই বাতাস।
অধ্যায় ৯
তারা বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এল ঠিকই, কিন্তু মন যেন পড়ে রইল সেই শূন্য জানালার কাছে। শহরে ফিরে আসার পরেও প্রত্যেকেই অনুভব করছিল কিছু অসমাপ্ত থেকে গেছে—একটা গল্প, একটা অনুতাপ, কিংবা একটা সম্পর্ক। এক সপ্তাহ কেটে গিয়েছিল। ইশান প্রতিদিন ক্যামেরার ফুটেজ দেখতে বসত, কিন্তু রুদ্রসিংহের ছায়া, অরুণিমার কাঁপা মুখ, কিংবা জানালার গাঢ় দৃষ্টি—এসব এখন আর ফুটেজে ধরা পড়ে না। যেন কিছুই কখনো ছিল না। সৌগত একদিন সন্ধেবেলা হঠাৎ ডাক পেল গুগল ড্রাইভে আপলোড করা একটি ফাইল থেকে—একটি ইমেইলে সংযুক্ত স্ক্যান করা চিঠি, পাঠিয়েছেন গুপ্তবাবু। চিঠিটি পাওয়া গেছে পুরনো কাঠের বাক্সের ভিতর, যখন তারা ঘর পরিষ্কার করছিলেন ঘটনার পরে। সৌগত চিঠিটা খুলেই থমকে গেল—চিঠির ওপরে লেখা ছিল “রুদ্রপ্রতাপ সিংহ, ১৯০১ সালের ১২ই বৈশাখ”, আর নিচে স্বাক্ষর: “অরুণিমা”। অর্থাৎ… চিঠিটি ছিল মৃত্যুর আগের রাতে লেখা, রক্তের দাগযুক্ত, কাগজের পেছনে শুকনো চন্দনের ছোঁয়া।
চিঠির ভাষা ছিল প্রাঞ্জল, অথচ মর্মস্পর্শী—
“রুদ্র,
তুমি কি জানো, প্রতিদিন রাতে আমি জানালার পাশে দাঁড়াই, এই আশায় যে তুমি একবার ফিরে তাকাবে? কিন্তু না, তুমি ব্যস্ত রাজ্য নিয়ে, মান-অভিমান নিয়ে, আর তোমার নিজের ছায়াদের নিয়ে। অরিন্দম চলে গেল, জানালার ডাকে সাড়া দিয়ে, কিন্তু তুমিই তাকে ফিরিয়ে আনোনি। আমি তো চেয়েছিলাম শুধু একবার—আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলো, ‘আমি আছি’। কিন্তু তুমি কাঁধ ফিরিয়ে নিলে। এই ঘরের প্রতিটি কোণে আমি অপেক্ষা করেছি, প্রতিটি আয়নায় আমি নিজেকে খুঁজেছি, আর প্রতিটি জানালায় আমি তোমার মুখ দেখতে চেয়েছি। আজ আমি যাচ্ছি। আমার শরীর থাকবে না, কিন্তু আমার ভালোবাসা জানালার কাঁচে জমে থাকবে রক্তরঙ হয়ে। তুমি যদি কখনো ফিরে তাকাও, যদি কখনো ভয় আর দম্ভ কাটিয়ে আসো, আমি হয়তো তখনও অপেক্ষা করব—জানালার ওপারে।
– অরুণিমা”
চিঠি পড়ে চারজনে যেন আবার নীরব হয়ে গেল। ইশান ধীরে গলায় বলল, “ওটা শুধু এক নারীর প্রেমপত্র নয়… এটা এক আত্মার অনুরোধ। সে শুধু ভালোবাসা চায়নি, সে চেয়েছিল মুক্তি। আর সেটা পায়নি বলেই জানালার কাঁচে তার ছায়া জমে ছিল এতদিন।” অনুপম বলে, “রুদ্রপ্রতাপ সিংহ ক্ষমা চায়নি জীবনে, তাই হয়তো মৃত্যুর পরেও তার আত্মা ছিল অপরাধবোধে ঘেরা। ওদের দু’জনের মধ্যে যে চিঠি পৌঁছনো উচিত ছিল, তা হয়নি। আমরা শুধু তা পড়লাম অনেক পরে।” পরদিন সৌগত সিদ্ধান্ত নেয়—চিঠিটি সেই ঘরের আয়নার নিচে ফেরত রেখে আসবে, যেন সময়ের কাছে সেই শব্দগুলি ফিরিয়ে দেওয়া যায়। এক সপ্তাহের মাথায় তারা আবার গেল সেই জমিদারবাড়িতে। এবার কোনো ভয় নেই, শুধু শ্রদ্ধা আর প্রতিশ্রুতি। আয়নার নিচে চিঠি রাখার সময় নন্দিতা চোখ মেলে চেয়ে দেখল—আয়নার ভিতর থেকে কেউ যেন তাকিয়ে আছে, চোখে জল নেই, কিন্তু একটা স্বস্তি ছড়িয়ে আছে মুখে। জানালার কাচেও এবার শুধু রোদ পড়ছে, আর কোনো ছায়া নেই।
তারা জানে, প্রতিটি পুরনো বাড়ির মতোই, এই বাড়িও একটি চিঠির মতো—যা সময়ের কাছে পাঠানো হয়েছিল, কিন্তু খুলে পড়া হয়নি কখনো। তারা সেই পাঠক যারা ভুল করে না, থেমে যায়, পড়ে নেয় প্রতিটি অক্ষর। সেই রাতে তারা বাড়ির উঠোনে বসে ছিল কিছুক্ষণ, বাতাসে যেন বাজছিল অরিন্দমের পছন্দের বাঁশির সুর—যা হয়তো রুদ্রপ্রতাপ শিখিয়েছিল ছোটবেলায়। তারপর একসময় বাড়ি ছাড়ল তারা। পিছনে তাকিয়ে দেখল—দোতলার জানালার পাশে দোলনা চেয়ার দুলছে না আর, আয়নায় কোনো মুখ নেই, বাতাসে নেই চুড়ির শব্দ। শুধু এক চিঠি পড়ে আছে ভিতরে—যা পৌঁছে গেছে, পাঠ শেষ, অপেক্ষা শেষ।
অধ্যায় ১০
রুদ্রসিংহের জমিদারবাড়ি আর এখন ভূতের বাড়ি নয়—এটা যেন একটা মহাকাব্যের শেষ স্তবক, একটা অপেক্ষার সমাপ্তি। সেই চিঠি, যা অরুণিমা তার মৃত্যুর আগের রাতে লিখেছিলেন, আয়নার নিচে রেখে আসার পর, বাড়ির ভিতরের আবহাওয়াতেই বদল এসেছিল। জানালার কাঁচ থেকে কুয়াশা সরে গেছে, আয়নায় আর কোনো ছায়া ভেসে ওঠে না, আর সেই অভিশপ্ত ঘর, যেখানে কেউ ঢুকত না—সেটা এখন নিঃশব্দ হলেও শূন্য নয়, বরং পূর্ণ এক শান্তিতে। সৌগত, ইশান, অনুপম আর নন্দিতা একদিন বসে ঠিক করল, এই অভিজ্ঞতা শুধু নিজেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে হবে না। তারা এই জমিদারবাড়ির ইতিহাস, তার মধ্যেকার আবেগ, অপরাধবোধ আর আত্মিক প্রেম—সব কিছু নিয়ে লিখবে একটি পূর্ণ গবেষণা, যা শুধু অলৌকিকতা নয়, মানুষের গভীরতম চেতনাকে তুলে ধরবে। আর সেই গবেষণার নাম রাখবে “রুদ্রসিংহের দোতলা: জানালার ওপারে”।
তারা কলকাতায় ফিরে এসে কাজে লেগে পড়ে। পুরনো দলিলপত্র, গুপ্তবাবুর কাছ থেকে সংগ্রহ করা স্মৃতিচিহ্ন, ভিডিও ফুটেজ, চিঠি, এবং ডায়েরির অনুলিপি—সব মিলিয়ে তারা গড়ে তোলে একটি সংরক্ষণাগার। বিভিন্ন জাদুঘর, ইতিহাসবিদ এমনকি মনস্তত্ত্ববিদদেরও আকৃষ্ট করে এই কাজ। ইশান তৈরি করে একটি স্বল্পদৈর্ঘ্যের ডকুমেন্টারি, যেখানে শুধু নয়টি শব্দ বাজে ব্যাকগ্রাউন্ডে: “আমি জানালার ওপারে নয়, আমি অপেক্ষায় ছিলাম।” সেই ডকুমেন্টারি ছড়িয়ে পড়ে নেট দুনিয়ায়—কেউ কেউ এটিকে ভূতের গল্প বলে, কেউ কেউ ট্রাজেডি, কিন্তু যারা হৃদয় দিয়ে পড়ে, তারা বুঝে নেয়—এটা ভালোবাসার অতৃপ্তি, ক্ষমা না পাওয়ার অভিশাপ, আর দেরিতে হলেও একটি সন্ধির ভাষ্য। সেই সন্ধি, যা মানুষের মধ্যে হয় না, হয় সময়ের সঙ্গে, আত্মার সঙ্গে, আর অপেক্ষার সঙ্গে। গল্পটা হঠাৎ করে বিখ্যাত হয়ে ওঠে, কিন্তু সৌগতরা সবসময় একটাই কথা বলেন—“এই গল্পটা আমাদের নয়, আমরা শুধু শ্রোতা। সত্যিকারের কণ্ঠস্বর এসেছিল জানালার ওপার থেকে।”
একদিন সন্ধেয়, কলকাতার এক অনুষ্ঠানে যখন সৌগত বক্তৃতা দিচ্ছিল, পিছনের সারি থেকে এক বৃদ্ধা উঠে এলেন—চুলে রূপোর রেখা, চোখে জলের ছায়া। তিনি হাতে তুলে দিলেন একটি পুরনো ফটো—রুদ্রসিংহ, অরুণিমা ও অরিন্দম—একসঙ্গে পুকুরের পাড়ে দাঁড়িয়ে। ছবির পেছনে লেখা ছিল, “আমরা তিনজন, তখনো কিছু হারাইনি।” তিনি বললেন, “আমি অরিন্দমের নাতনি, এই ছবিটা আমার ঠাকুরমা বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। ওরা কেউই ফিরে আসেনি, কিন্তু তাদের কথা আজও জানালার কাচে জমে থাকে।” সেই মুহূর্তে সৌগত বুঝে গেল, এই গল্প শেষ হয়নি। আত্মা যখন মুক্তি পায়, সময় তখন আর শুধুই ঘড়ির কাঁটা নয়, সেটা তখন হয়ে ওঠে একটা অনুভব—একটা জানালা, যা খোলা থাকলেও কখনো পুরোপুরি ফাঁকা হয় না। সেই সন্ধে ছিল শেষ, আবার শুরু। চূড়ান্ত সন্ধি মানে শুধু বিদায় নয়, সেটা মিলনের পরের স্তর—যেখানে কেউ আর ফিরে তাকায় না, কারণ সে জানে, তার অপেক্ষা আর নেই।
সমাপ্ত




