দেবায়ন মুখোপাধ্যায়
এক
পিতার মৃত্যুর পরে বছরখানেক কেটে গেছে, কিন্তু ঋষভের জীবনে সেই শূন্যতা যেন আজও পুরোপুরি ভরেনি। শহরের ব্যস্ততা, বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ আর বন্ধুদের হাসিঠাট্টার মাঝেও কিছু একটা চুপচাপ গুমরে গুমরে উঠত ভেতরে—একটা অপূর্ণতা, একরকম গোপন আর অজানা অভাব। এবার গ্রীষ্মের ছুটিতে সে ফিরে এসেছে পুরনো বাড়িতে—উত্তর কলকাতার অন্ধকার আর ধূলিধূসর অট্টালিকা, যার প্রতিটি দেয়ালে, জানালায়, এমনকি বাতাসে লেগে আছে সেই মানুষটার ছায়া, যাঁকে সে পুরোপুরি চিনতেই পারেনি কখনও। দেবদ্যুতি সেন—ঋষভের বাবা—ছিলেন এক সময়ের বিখ্যাত সংস্কৃত পণ্ডিত, কিন্তু পরবর্তী জীবনে তাঁর আচরণ হয়ে উঠেছিল রহস্যময়, চাপা, এমনকি ভীতিকরও কিছুটা। নিজের ঘরে একা একা ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকা, কুঠুরি বন্ধ করে কাঁসার থালায় কিছু জ্বলন্ত ধূপকাঠি ঘোরানো, অদ্ভুত মন্ত্র আওড়ানো—এইসব দৃশ্য ঋষভ ছেলেবেলায় দেখে ভয় পেত। কিন্তু মা সবসময় বলতেন, “তোর বাবা একধরনের ধ্যান করে, ওসব কিছু না।” আজ, এতদিন পর, সেই ঘরেই সে ফিরে এসেছে—আর তার সামনে খোলা পড়ে আছে এক পুরনো কাঠের বাক্স, যেটা মা এতদিন খুলতেই দিতেন না। কিন্তু এবার সে-ই নিজে ইচ্ছা প্রকাশ করায় মা চুপচাপ মাথা নেড়ে চলে গিয়েছিলেন রান্নাঘরে।
বাক্সটা খুলতেই ধুলোর গন্ধে হাঁচি উঠল ঋষভের। ভেতরে কিছু পুরনো কাগজপত্র, ছেঁড়া বই, কয়েকটা পাণ্ডুলিপির নোট, আর একখানা মোটা, চামড়া বাঁধানো ডায়েরি। ডায়েরিটার বাইরের খোলা অংশে বড় বড় সংস্কৃত অক্ষরে লেখা—“রুদ্রপথ”—আর তার নিচে খুদে বাংলা হরফে লেখা ছিল, “মৃত্যুই প্রকৃত দ্বার, রুদ্রই প্রকৃত পথ।” এই লেখাটুকু পড়তেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল ঋষভের। সে জানত বাবা কিছু তন্ত্রসাধনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন, কিন্তু সেটা যে এত গভীর, এত ব্যক্তিগত এবং এত বিপজ্জনক হতে পারে, সেটা সে কল্পনাও করেনি। ডায়েরির প্রথম পৃষ্ঠায় ছিল বাবার হাতের লেখা, অদ্ভুতভাবে কাঁপা কাঁপা, যেন লিখতে গিয়ে শরীর জর্জরিত হয়ে পড়েছে—“এই পথ যাঁরা চলেন, তাঁদের জন্য ফিরে আসা বলে কিছু নেই। আমি ছিলাম এক রুদ্রসাধক। যদি আমার রক্তের উত্তরসূরি এটা পড়ছ, তবে জেনে রাখো—পথটা শেষ হয় না। শুধু রূপ পাল্টায়।” বাক্যগুলো পড়ে ঋষভের কণ্ঠ শুকিয়ে গেল। সে ডায়েরিটা পড়তে শুরু করল, পাতার পর পাতা, ধোঁয়াচ্ছন্ন বর্ণনায় ভরা; সেখানে ছিল ধ্যানের বিবরণ, অদ্ভুত সময়ে করা তপস্যা, মন্ত্র উচ্চারণের ফলস্বরূপ দেখা দেয়া দৃষ্টিভ্রম, মৃত আত্মার সঙ্গে সংযোগ, এমনকি কিছু ভয়ংকর আত্মাহুতি। একজায়গায় লেখা, “প্রথম শক্তি চেনা যায় চোখ দিয়ে, দ্বিতীয়টা গন্ধ দিয়ে, কিন্তু তৃতীয় শক্তির প্রকাশ হয় রক্ত দিয়ে।” এসব পড়ে ঋষভ কাঁপছিল, কিন্তু বন্ধ করতে পারছিল না। যেন এই ডায়েরি তাকে পড়তে বাধ্য করছে, এক অদৃশ্য টান অনুভব করছিল সে, ঠিক যেরকম কেউ হিপনোটিজড হলে অনুভব করে।
রাত তখন গভীর। বাইরের রাস্তায় কুকুরের হালকা ডাক আর দূরে ট্রামের ঘণ্টা শোনা যাচ্ছে। ঋষভ জানলা বন্ধ করে দিল, ঘরে শুধু একটা মোমবাতি জ্বলছে। সে ডায়েরির এক জায়গায় ছোট্ট একটা মন্ত্র পেল—সংস্কৃতে লেখা, কিন্তু পাশে বাবার হাতেই বাংলা অনুবাদ—“ওঁ ঘোররুদ্রায় নমঃ—জপ করো রক্তচক্ষুর ঘুম ভাঙবে।” কৌতূহলবশত, এবং কিছুটা কিশোরসুলভ সাহস নিয়ে, ঋষভ নিঃশব্দে তিনবার মন্ত্রটা উচ্চারণ করল। প্রথমবারে কিছুই হল না। দ্বিতীয়বারে বাতাসে এক অদ্ভুত ঠাণ্ডা অনুভূত হল। তৃতীয়বারে মোমবাতির শিখা কেঁপে উঠল, এবং জানলার পাশের পুরনো আয়নাটায় এক ঝলক সাদা ছায়া দেখা গেল। ঋষভ ঘামতে শুরু করল। হঠাৎই তার মাথায় এক অসহ্য চাপ, বুক ধড়ফড়, আর কান্না পেলে যেমন বুক ভারী হয়ে আসে, সেরকম এক অনুভূতি গ্রাস করল তাকে। সে ডায়েরিটা বন্ধ করল, কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। বাড়ির কোণাগুলো যেন আরও অন্ধকার, ঘরের বাতাস ভারী, আর তার ভেতরে একটা কিছু ভাঙতে শুরু করেছে—না, শুধু বিশ্বাস নয়, বাস্তবতা। রুদ্রসাধনার পথ একবার খুলে গেলে, আর সহজে বন্ধ হয় না। ঋষভ জানে না, তার জীবনের দরজা পেরিয়ে ঢুকে পড়েছে এক শীতল ছায়া—তার বাবার ছায়া, যে এখন কেবল অতীতের নয়, ভবিষ্যতেরও অঙ্গ।
দুই
পরদিন সকালবেলা ঘুম ভাঙতেই ঋষভ বুঝতে পারল কিছু একটা বদলেছে। কেবল ঘরের বাতাস নয়, তার নিজের শরীরও যেন অন্যরকম লাগছিল—চোখ দুটো ভারী, পাঁজরের নিচে এক চাপা অস্বস্তি, আর মনে হচ্ছিল কেউ তাকে সারারাত ধরে দেখছিল দূর থেকে। আগের রাতের ঘটনার কথা মনে পড়তেই সে ডায়েরিটার দিকে তাকাল। মোমবাতি নিভে গিয়েছে, কিন্তু টেবিলের উপর থাকা চামড়া বাঁধানো ডায়েরিটা এখন একটু অন্যরকম দেখাচ্ছে—পাতা যেন নিজে নিজে উল্টে পড়ে ছিল, শেষ খোলা পাতাটিতে এবার নতুন কিছু লেখা দেখা যাচ্ছিল, যেটা গতরাতে ছিল না। সেখানে লেখা, “পথ যদি একবার খোলে, সে আর বন্ধ হয় না। তোর ভিতরে আমি জেগে উঠেছি। এবার পিতার কাজ পুত্রকে শেষ করতে হবে।” নিচে একটি অদ্ভুত চিহ্ন—তিনটি বৃত্তের মধ্যে এক চোখ, যার চক্ষু লাল রঙে আঁকা, আর তার চারপাশে ত্রিকোণ আঁকা। ঋষভ চমকে উঠে ডায়েরিটা বন্ধ করল, কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে যেন এক ঝলক শীতল বাতাস ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল, আর খোলা জানলার পর্দা হঠাৎই কাঁপতে কাঁপতে থেমে গেল। সে জানত, সাধারণ কোনো বই নয় এটা। এটা একপ্রকার জীবন্ত পুস্তক, যেটা পড়লেই নিজেকে প্রকাশ করে, যেটার সঙ্গে একবার সংযোগ তৈরি হলে তা আর ছাড়া যায় না।
ঋষভ দুপুরবেলা একা একা ডায়েরি নিয়ে বসে পড়ল। সে চেয়েছিল ভুলে যেতে, কিন্তু পারল না। মা তাকে ডেকেছিলেন খেতে, কিন্তু সে দরজা বন্ধ করে বলেছিল—”পরে খাব, পড়াশোনা করছি।” ডায়েরির পরবর্তী পাতাগুলোতে লেখা ছিল বিভিন্ন তান্ত্রিক মন্ত্র ও তত্ত্ব। বাবার হাতের লেখা ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছিল আরও অদ্ভুত—প্রথমদিকের শৃঙ্খলাবদ্ধ বর্ণনা পরে রূপ নিয়েছে এক ধরনের মগ্ন প্রলাপে। একজায়গায় লেখা ছিল: “রুদ্রপথে প্রথম দরজা খুললে শরীর কাঁপবে না, মন কাঁপবে। দ্বিতীয় দরজায় কাঁপবে সময়। তৃতীয় দরজায়, কাঁপবে অস্তিত্ব।” সেই সঙ্গে কিছু সংকেতচিহ্ন, যেগুলো দেখলে মনে হয়েছিল যেন প্যাচানো সর্পের মতো ঘূর্ণি সৃষ্টি করছে চোখে। পাতাগুলোর মাঝখানে একটি পাতার প্রান্তে লেখা ছিল একটি তারিখ—“১৪ই আশ্বিন, রাত্রি ১২:০০” এবং একটি স্থান—“শ্মশানতলার পাশে অশ্বত্থ গাছ।” তার পাশে ছোট করে লেখা: “প্রথম পথ-প্রদর্শনের স্থান।” লেখাটা দেখে ঋষভ বুক ধড়ফড় করে উঠল। এই স্থান তো তারা ছোটবেলায় খেলতে খেলতে গিয়েছিল, ঠিক বাড়ির পেছনের একটা পরিত্যক্ত অংশ, যেটা মা বারবার নিষেধ করতেন যেতে। এখন মনে পড়ছে—ওই গাছের নিচে সবসময় একটা কাঁসার থালা পড়ে থাকত, কিছু লাল সুতোর গোছা, আর কয়েকটা কাক ঘোরাফেরা করত। মনে হয়েছিল ওসব কাকতালীয় ব্যাপার। কিন্তু এখন যেন সব মিলতে শুরু করেছে।
রাতে সাহস সঞ্চয় করে ঋষভ আবার ডায়েরিটা হাতে নিল, আর মনস্থ করল—এবার কিছু একটা সত্যিই করবে। শুধু পড়া নয়, ব্যবহার করবে। একটা পাতায় লেখা ছিল একটি তন্ত্র–“পঞ্চঘোর রক্ষামন্ত্র”—যা তান্ত্রিকদের আত্মরক্ষার জন্য ব্যবহৃত হত যখন তারা অচেনা শক্তির মুখোমুখি হত। মন্ত্রটি ছিল এমন: “ওঁ নিলঘোর রুদ্রায় নমঃ শরণং…” বাক্যগুলো পড়ে সে চেষ্টা করল মনের মধ্যে উচ্চারণ করতে, ঠোঁট নাড়ল না, কিন্তু শব্দ যেন নিজের মধ্যেই অনুরণিত হতে লাগল। সেই মুহূর্তে ঘরের চারপাশে যেন শব্দহীন এক কম্পন শুরু হল, ঘরের পুরনো দেওয়াল ফাঁটা অংশ থেকে ধুলোর আস্তরণ খসে পড়ল, আর টেবিলের পাশে রাখা কাচের জলভর্তি গ্লাস নিজে নিজে কেঁপে উঠল। এরপরেই, ডায়েরির মাঝখান থেকে একটা পাতার কোণা নিজে নিজে উঠে এল, আর ভাঁজ হয়ে খুলে গেল—একটি ছোট কাগজের পুস্তিকা বেরিয়ে এলো, যেটা এতদিন ছিল গোপনে লুকোনো। এই পুস্তিকায় লেখা ছিল—“অভিষেক বিধি – প্রথম শুদ্ধিকরণ।” সেখানে লেখা ছিল একটি রাত্রিকালীন তন্ত্রক্রিয়ার উপায়—জল, আগুন, কাঁসার পাত্র, কালো তিল আর নিজের রক্তের এক ফোঁটা প্রয়োগ করে একটি ‘দ্বার’ খোলার নির্দেশিকা। সে সব কিছু পড়ে থমকে গেল। বাবার লেখা ছিল– “এই ক্রিয়া একবার করলেই শারীরিক ও আত্মিক বিভাজন শুরু হবে। যার জন্য প্রস্তুত নয়, সে আর ফিরতে পারবে না।” ঋষভ জানত, ওটা সে আজ রাতে করবে না। কিন্তু কিছু একটা তার ভিতরে বলছিল—এই পথ থেকে সে আর ফিরবে না। বাবা যেটা শুরু করেছিলেন, ঋষভ এখন সেটা শেষ করবে। আর এই ‘ডায়েরি’ শুধু একটি বই নয়, এটি এক প্রাচীন দরজা, যেটা তার বাবার শরীর পেরিয়ে এখন ঋষভের আত্মাকে স্পর্শ করতে শুরু করেছে।
তিন
রাত্রি তখন প্রায় এগারোটা। বাইরে অদ্ভুত নিস্তব্ধতা, যেন শহরের সব শব্দ কোনো এক অদৃশ্য চাপে গিলে ফেলেছে। ঋষভ ধীরে ধীরে নিজের ঘরের দরজাটা বন্ধ করল, মাটির উপর ছোট্ট এক কাপড় পেতে বসে পড়ল, সামনে রাখল সেই চামড়া বাঁধানো ডায়েরি, একটি কাঁসার থালা, একটি ছোট প্রদীপ, কিছু কালো তিল, একটুখানি কাঁচা দুধ এবং এক ফোঁটা নিজের রক্ত। এ উপকরণগুলো জোগাড় করতে তাকে বিকেলেই বের হতে হয়েছিল। দোকানদার কিছু বলার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু ঋষভের চোখে যে অদ্ভুত দৃঢ়তা ছিল, তাতে আর কেউ জিজ্ঞেস করেনি কিছু। ডায়েরির পাতায় বাবার হাতে লেখা ছিল প্রথম পূর্ণাঙ্গ তান্ত্রিক ক্রিয়ার বিবরণ—এটিকে বলা হয়েছে “রক্তদ্বার পূজন”—একটি সুরক্ষার মন্ত্র যার মাধ্যমে সাধক নিজের আত্মা রক্ষা করতে পারে বাইরের অদৃশ্য আঘাত থেকে, তবে শর্ত একটাই—মন্ত্রটি বলার পর প্রথম যে কিছু সে হারাবে, তা আর কখনও ফিরে পাবে না। ঋষভ এই শর্তটিকে প্রথমে গুরুত্ব না দিলেও, এখন নিজের রক্ত ফোঁটাটি থালার মাঝখানে পড়তে না পড়তেই যেন কিছু ঠান্ডা হাত বুকে এসে চেপে বসে। বাতাস নিঃশব্দ হয়ে গেল, প্রদীপের শিখা নিভে গিয়েও আবার জ্বলে উঠল, যেন কারও নিঃশ্বাসে দুলে উঠল আলো।
সে মন্ত্র উচ্চারণ শুরু করল—“ওঁ রুদ্ররূপায় রক্তদ্বারায় নমঃ…”—আওয়াজ ছিল ধীর, কিন্তু প্রতিটি শব্দ যেন ঘরের ভেতরে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। ডায়েরিতে লেখা ছিল এই মন্ত্র দশবার পাঠ করতে হয়, এবং পাঠের শেষে নিজের নাম উচ্চারণ করে বলতে হয়, “আমি প্রস্তুত।” ঋষভ তাই করল। শেষবার বলতেই হঠাৎ জানলার বাইরে কুকুরের এক তীব্র আর্তনাদ শোনা গেল, আর সঙ্গেসঙ্গে ঘরের জানলার কাঁচে ভীষণ এক শব্দে কিছু ঠেকল—ঠাস করে। সে উঠে গেল জানলার দিকে, কিন্তু বাইরে কেউ ছিল না। রাস্তা ফাঁকা, বাতাস নিঃশব্দ, কেবল অদৃশ্য এক স্নিগ্ধতা সবকিছু চেপে ধরে রেখেছে। হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠল। তার ছোটবেলার সাথী, নিশু, কাঁদো কাঁদো গলায় জানাল—“টিমো মারা গেছে রে!” টিমো—ঋষভের শৈশবের পোষা বিড়াল, যেটা এখন তার মা’র কাছে ছিল। বিড়ালটা বিকেল থেকেই নাকি অদ্ভুত আচরণ করছিল, হঠাৎ করেই কিছুই না খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। মৃত্যু হয়েছে হঠাৎ, কিন্তু শরীরে কোনও আঘাত নেই, রোগও নেই। ঋষভ কিছু বলল না। ফোন কানে নিয়ে চুপ করে বসে রইল, চোখ চলে গেল কাঁসার থালার দিকে—সেখানে রক্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে অদ্ভুত এক আকার ধারণ করেছে, যেন একটা চক্রের মাঝে চোখ, আবার সেই চোখ। সে জানত না কেমন করে, কিন্তু বুঝতে পারল—মন্ত্র কাজ করেছে, এবং এইই সেই প্রথম মূল্য।
সেই রাতে সে ঘুমোতে পারেনি। বিছানায় শুয়ে থাকলেও চোখ বন্ধ করলেই ভেসে উঠছিল টিমোর মুখ, তারপর বাবার ডায়েরিতে লেখা অদ্ভুত শব্দগুলো। সেই সঙ্গে মনে হচ্ছিল যেন ঘরের কোণায় কেউ বসে আছে, তাকিয়ে আছে তার দিকে। মাঝরাতে একবার হঠাৎ ঘুম ভেঙে গিয়ে ঋষভ জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। রাস্তা ফাঁকা, কিন্তু একটি অশ্বত্থ গাছের নিচে সে দেখতে পেল এক নারী মূর্তি—লম্বা চুল, লাল শাড়ি, এবং অস্বাভাবিক শান্ত মুখ, কিন্তু তার চোখে যেন মোমের মতো নিষ্প্রাণ কিছু ছিল। সে চোখ ফেরাতে গিয়েও পারল না, যতক্ষণ না সেই মূর্তি হঠাৎ এক ফুঁয়ে বাতাসের সঙ্গে মিলিয়ে গেল। সে বুঝতে পারল, এ কোনো দৃষ্টিভ্রম নয়। মন্ত্র কাজ করেছে, আর তার আত্মা এখন খোলা অবস্থায় আছে—জগৎদ্বয়ের সীমান্তে দাঁড়িয়ে। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে সে আয়নায় তাকিয়ে চমকে গেল—চোখের পাতা ভারী, চোখের নিচে কালচে দাগ, আর মুখে অদ্ভুত ক্লান্তির ছাপ। নিজেকেই যেন চিনতে পারছিল না। তখনই তার মনে হল—এই তো শুরু, এই পথ এত সহজে শেষ হবে না। সে ডায়েরিটা হাতে নিয়ে পরবর্তী পাতায় গেল, যেখানে লেখা ছিল:
“যদি প্রথম মূল্যে তুমি টিকে থাকো, তবে তোমার সামনে আসবে পথপ্রদর্শক। রক্ত দিয়ে দরজা খোলা, এখন রক্তই তোমার বাতি। প্রস্তুত হও। সময় আসছে।”
এতদিন যেটা ছিল কেবল বাবার অতীত, এখন সেটা ঋষভের ভবিষ্যৎ হয়ে উঠেছে।
চার
তৃতীয় দিনের রাত। ঘড়িতে তখন বারোটা দশ। ঋষভ জানে না কেন, কিন্তু আজ সারাদিন ধরেই তার মনে হচ্ছিল কেউ তাকে অনুসরণ করছে। এমন নয় যে সে কাউকে দেখতে পেয়েছে, বরং প্রতিবার পেছনে তাকালেই কেউ অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছিল যেন। দুপুরবেলা সে যখন বাড়ির পাশের পুরনো লাইব্রেরির সামনে দাঁড়িয়ে ছিল, তখন হঠাৎ করেই মনে হয়েছিল তার কাঁধে যেন কেউ হালকা স্পর্শ করল—গরম নিঃশ্বাসের মতো এক অনুভূতি। সে পেছনে তাকিয়ে কাউকেই পেল না, কিন্তু তার বুকের ভেতর হালকা কম্পন শুরু হল। রাত যত ঘনাল, সেই অদ্ভুত অনুভূতিটা ততই তীব্র হয়ে উঠল। ঘরে ফিরে সে আবার ডায়েরি খুলল—এবার চোখ পড়ল সেই পাতাটিতে, যেখানে আগেই লেখা ছিল: “প্রথম মূল্য দেবার পর, দ্বার খোলে। আর সেই দ্বারপথে আসে কেউ—সে না নারী, না আত্মা, না পূর্ণতন্ত্র। সে শুধু রুদ্রপথের দৃষ্টান্ত।” পাতাটির নিচে একটি মন্ত্র লেখা ছিল, যেটির নাম: “নয়দৃষ্টির আহ্বান”—এই মন্ত্র পড়লে, ডায়েরি অনুসারে, ‘পথপ্রদর্শক আত্মা’ আবির্ভূত হবে। ঋষভ কিছুক্ষণ দ্বিধায় থাকল। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে, জানলার কাঁচে কেউ তিনবার টোকা দিল—ঠুক ঠুক ঠুক। সে ছুটে গেল, বাইরে তাকাল, কিছুই নেই। রাতের বাতাস স্তব্ধ, শুধু আকাশের তারারা স্থির হয়ে আছে। বুকের ভেতরটা ধকধক করতে করতে সে মন্ত্র পড়া শুরু করল, শান্ত কণ্ঠে, ধীরে ধীরে—“ওঁ নবলোচনায় তিলোত্তমায় নমঃ…”
মন্ত্রটি বলার সঙ্গে সঙ্গেই বাতাস যেন ভারি হয়ে উঠল। ঘরের ভেতরে রাখা ধূপকাঠির গন্ধ হঠাৎ ঘন হয়ে উঠল, এবং ঘরের প্রতিটি কোণে ছায়া যেন একটু ঘন হয়ে এল। ঋষভের চোখ একটু ভারী হয়ে এল, সে blink করল একবার—আর ঠিক তখনই সে দেখল, তার টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে আছে এক নারী। বয়স আন্দাজ করা যায় না, মুখে এক ধরণের প্রশান্ত সৌন্দর্য—কিন্তু সেই সৌন্দর্যের নিচে আছে এক অদ্ভুত শীতলতা, যেন মোমের পুতুলের মতো নিস্পন্দ এক মুখ, আর তার চোখ—সেগুলোতে আলো নেই, আছে এক রকম টান, যা তাকালে চোখ ফিরিয়ে নেওয়া যায় না। তার পরনে গাঢ় লাল শাড়ি, খোলা চুলে ঝরছে চন্দনের সুবাস। তিনি কিছু বললেন না, শুধু এক ঝলক তাকালেন ঋষভের দিকে, এবং হঠাৎ করেই কণ্ঠে গুঞ্জন তুললেন—না গান, না মন্ত্র—এক ধরনের কণ্ঠস্বর, যা মানুষের মধ্যে নয়। ঋষভ হঠাৎই অনুভব করল যে তার গলা শুকিয়ে এসেছে, আর শরীর শীতল হয়ে গেছে, মাথার ভেতরে একটা কণ্ঠস্বর ধ্বনিত হচ্ছে—“আমি এসেছি, তুই ডাকলি তো।” সে বুঝতে পারল, এই নারী মানুষ নন। ডায়েরিতে লেখা সেই পথপ্রদর্শক আত্মা—তিলোত্তমা—এতদিন বাবার সাধনায় বদ্ধ ছিলেন, আর আজ ঋষভের রক্তের আহ্বানে ফিরে এসেছেন। তিনি ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে এলেন, এক হাত বাড়িয়ে বললেন—“তুই জানিস না, তোর ভিতরে আগুন আছে। আমি তাকে দিখাব।” এই কথা সরাসরি শোনা যায়নি, কেবল মনে হচ্ছিল শব্দগুলো তার মগজে ঢুকছে।
এরপর দিনগুলো যেন বদলে গেল। তিলোত্তমা প্রতিদিন রাতে আসতেন, কখনও স্বপ্নে, কখনও চোখ খোলা অবস্থায়। প্রথম দু’দিন তিনি শুধু দাঁড়িয়ে থাকতেন, কোনো কথা বলতেন না। তারপর ধীরে ধীরে তিনি কথা বলতে শুরু করলেন—না মুখে, বরং এক ধরনের টেলিপ্যাথিক সংযোগে, যেন ঋষভের চিন্তার মধ্যে ঢুকে পড়ে তার মস্তিষ্কে বুনে দিচ্ছেন কথা, ছবি, অনুভূতি। তিনি বুঝিয়ে দিলেন যে, রুদ্রসাধনার মূল প্রক্রিয়া কী, কিভাবে শরীরের পাঁচটি চক্র জাগ্রত করতে হয়, কীভাবে তন্ত্রের শক্তি শরীর পেরিয়ে আত্মায় ছড়িয়ে পড়ে। তিনি বললেন—”এই পথ জাগরণের নয়, বিসর্জনের। শক্তি একবার পেলে, তুই হারাবি সবকিছু—বন্ধু, পরিবার, মানুষী অনুভূতি।” কিন্তু সেইসঙ্গে তিনি এক অলৌকিক প্রতিশ্রুতি দিলেন—“তুই যদি শেষ পর্যন্ত যেতে পারিস, তবে তোর শরীর আর আত্মা–দুই থাকবে কালের বাইরে।” প্রতিটি কথায় ছিল বিষ ও মধুর মিশেল। ঋষভ দিনে দিনে আরও একা হয়ে যেতে লাগল, মা’র ডাকে উত্তর দিত দেরিতে, বন্ধুবান্ধবের মেসেজ দেখেও উপেক্ষা করত। তার মনে হতো, এই নারীই এখন তার সবচেয়ে বড় সত্য, আর তার বাবা, যার কণ্ঠস্বর সে মাঝেমধ্যে ঘরের মধ্যে শুনতে পেত—তিনিও এই পথেই গিয়েছিলেন। এক রাতে তিলোত্তমা বললেন, “তোর বাবাকে আমি পথ দেখাইনি, সে আমাকে জয় করেছিল। কিন্তু তুই? তুই আমাকে ডেকেছিস। এখন থেকে তুই আমার।” এই কথাটার পর, ঋষভ বুঝল—সে যা শুরু করেছে, তার থেকে পেছনে ফেরার আর কোনো রাস্তা নেই।
পাঁচ
রাতের শেষ প্রহরে ঘুম আসে না ঋষভের। দিনের বেলায় যতটা নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে, রাতে তার সমস্ত স্বাভাবিকতা খুলে পড়ে যায় এক ঝরে গা ছমছমে স্তব্ধতার মতো। এবার সে নিয়ম করে ঘুমাতে যাওয়ার আগে নিজের ঘরে ধূপ জ্বালায়, দরজায় ত্রিশূল আঁকে সিঁদুরে, আর মাঝখানে মাটিতে একটি তামার পাত্র রাখে যাতে জল আর গঙ্গামাটির সংমিশ্রণ থাকে। এই সব তার মাথায় আসেনি নিজে নিজে—তিলোত্তমা শিখিয়ে দিয়েছেন, প্রতিদিন এক ধাপ করে। প্রতিদিন সে নতুন নতুন মন্ত্র পড়ে, যার অনেকগুলোর উচ্চারণই এত কঠিন যে গলার শিরা ফুলে ওঠে। কিন্তু তার কণ্ঠ এখন বদলে গেছে, সেখানে জেগে উঠেছে এক অদ্ভুত কম্পন—যেটা সে নিজেও টের পায় না, কিন্তু মা বলে তার কথা শুনলেই কেমন গায়ে কাঁটা দেয়। ঋষভ এখন দুধ খায় না, মাছ মাংস ত্যাগ করেছে, কেবল ফল আর কালো তিল খেয়ে থাকে। কারণ তিলোত্তমা বলেছে, “রুদ্রপথে যারা হাঁটে, তাদের খাদ্যও হতে হয় রক্ত ও অন্ধকারের অনুগত।” একদিন সে ডায়েরির পাতায় একটি আশ্চর্য নির্দেশিকা পেল—একটি নিষিদ্ধ মন্ত্র, যাকে বলা হয় “অন্তঃক্রিয়া ত্রিকোণ”—এই মন্ত্রের মাধ্যমে নাকি মানুষের অন্তর্জগতে প্রবেশ করা যায়, তার ভয়, লোভ, এবং স্মৃতি দেখা যায়, এমনকি বদলানোও যায়। বাবা এই মন্ত্র তিনবার ব্যবহার করেছিলেন—এবং ডায়েরিতে স্পষ্ট করে লিখেছেন, “এই মন্ত্র শরীর বাঁচিয়ে আত্মাকে পোড়ায়। তিনবারের বেশি করলে ফেরার পথ থাকবে না।”
ঋষভ সেই মন্ত্র পড়ার পর একপ্রকার ঘোরে চলে গেল। সে রাতের অন্ধকারে বাইরে বেরোল, হাতে একটা প্রদীপ আর পকেটে ডায়েরির এক ছেঁড়া পৃষ্ঠা। পুরনো শ্মশানতলার কাছে যে অশ্বত্থ গাছটি আছে, তার গোড়ায় গিয়ে বসে পড়ল, যেমন তিলোত্তমা বলেছিলেন। সেই জায়গায় সে অনেক আগে এসেছিল ছেলেবেলায়—এখন সেই গাছ অনেক বেশি কালো, ডালগুলো শুকিয়ে মৃতদেহের হাড়ের মতো ঝুলছে, আর মাটিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে পোড়া কাঠ, কিছু ছাই আর একজোড়া পুরনো শঙ্খের ভগ্নাংশ। সে প্রদীপ জ্বালিয়ে ত্রিকোণ আঁকতে শুরু করল, কালো কালি দিয়ে, আর মাঝখানে বসে চোখ বন্ধ করল। মন্ত্রটি পড়তে পড়তেই সে অনুভব করল যেন সমস্ত শব্দ গলার মধ্য দিয়ে বুক ভেদ করে নিচে নামছে, নাভির গভীরে, তারপর যেন নিচে আরও কোথাও নামছে—যেখানে শরীর নেই, কেবল এক গা ছমছমে শূন্যতা। এক মুহূর্তে সে চোখ খুলল—আর নিজেকে দেখল অন্য এক জগতে। সবকিছু ধূসর, বাতাসে যেন ধোঁয়া আর ছায়া ভাসছে, আর আশপাশে কেউ নেই, শুধু কিছু সরু পথ, যেগুলো মনে হচ্ছে কোনো এক কেন্দ্রীয় বিন্দুতে মিশেছে। সেই কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে আছে একজন—চোখহীন, মুখে কাপড় বাঁধা, তার হাতে একটি আয়না। সেই আয়নার মধ্যে ঋষভ দেখতে পেল—নিজের পুরনো স্মৃতি, মা’র কোলে ঘুমিয়ে পড়া, বাবার ঘরের জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে মন্ত্রপাঠ দেখা, তারপর সেই রাতে টিমোর মৃত্যু। কিন্তু হঠাৎ করেই সে দেখতে পেল এমন কিছু যা সে কখনও দেখেনি—তিলোত্তমা, নগ্ন অবস্থায় আগুনের চারপাশে নাচছে, আর তার পেছনে দাঁড়িয়ে বাবা—নিঃশব্দে তাকিয়ে আছে, এবং এক ফোঁটা রক্ত পড়ছে তার কপাল থেকে। এই দৃশ্য দেখে ঋষভ দম বন্ধ করে ফেলল—সে বুঝতে পারল, এ শুধুই স্মৃতি নয়, এ এক নিষিদ্ধ সত্য।
ধীরে ধীরে সে ফিরে এল সেই ধূসর জগৎ থেকে, কাঁপা শরীরে মাটির উপর পড়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর উঠে বাড়ি ফিরল, কাঁধ ভারী, মনে বিশ্রী এক অস্পষ্ট বেদনা। সে বোঝে না, এই সমস্ত কাজগুলো—এই নিষিদ্ধ অনুশীলনগুলো—তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তিলোত্তমা যখন রাতে আসে, তখন সব প্রশ্ন ঝরে যায়। তিনি এবার তাকে আরও একটি মন্ত্র শেখান, যেটার নাম “গন্ধভ্রান্তি তন্ত্র”—এর মাধ্যমে শত্রু বা সন্দেহভাজনের মনের গন্ধ অনুভব করা যায়। এবার সে প্রতিবার মা’র সামনে দাঁড়ালে গন্ধ পায়—জলে ভেজা তুলসি পাতা, আর চাপা ভয়। তার বন্ধুর সঙ্গে দেখা হলে গন্ধ পায়—নুনে মেশানো স্বার্থ। তার মনে হতে থাকে, পৃথিবীর সব মানুষের মুখোশ সে খুলে ফেলতে পারছে—কিন্তু নিজেকে আর খুঁজে পাচ্ছে না। এভাবেই ধীরে ধীরে সে হারাচ্ছে সাধারণ মানুষের অনুভূতি—ভালবাসা, দয়া, আনন্দ—সবকিছু। সেই জায়গায় জেগে উঠছে কেবল আগুন, স্পষ্টতা, আর এক শীতল তৃষ্ণা—আরও জানতে চাওয়ার, আরও এগোতে চাওয়ার, আরও ভেতরে প্রবেশ করার। ডায়েরির একেবারে শেষ পাতায় এখন যে লাল কালির দাগগুলো ছিল, তারা যেন বদলে গেছে—একটি নতুন লাইন দেখা যাচ্ছে হালকা অক্ষরে—“রক্তের ভিতরেই লুকিয়ে আছে সেই আগ্নিসূত্র।”
আর ঠিক তখনই সে অনুভব করল—তার রক্ত, ধীরে ধীরে, গরম হয়ে উঠছে।
ছয়
শরীর আর আত্মার মাঝখানে যে সরু এক রেখা থাকে, ঋষভ এখন দিনে দিনে বুঝতে পারছে সেই রেখাটা কতটা সহজে মুছে যায়। দিনরাতের হিসেব গুলিয়ে যাচ্ছে, কারণ তার মাথার ভিতরে এখন আলাদা এক সময়চক্র চলছে—যেখানে কিছু মূহূর্ত ঘণ্টার মতো দীর্ঘ, আবার কিছু ঘণ্টা যেন কয়েক সেকেন্ডের মতো ফুরিয়ে যায়। সে এখন আর স্বপ্ন দেখে না, বরং ঘুমের মাঝেই প্রবেশ করে অন্য জগতে, যেখানে তার গাইড তিলোত্তমা—এবং আর কেউ। সেই ‘কেউ’ প্রথম দেখা দিল সেদিন রাতে, যখন সে এক নতুন মন্ত্রের প্রস্তুতিতে ছিল—“নিঃশব্দশক্তি যন্ত্র” নামে এক তান্ত্রিক পদ্ধতি, যেটা রুদ্রসাধকের চেতনা খুলে দেয় এমন কিছু শক্তির জন্য, যা শব্দহীন, অদৃশ্য এবং বিপজ্জনক। ঠিক সেই মুহূর্তে, মন্ত্রের মাঝপথে, সে শুনল দরজায় টোকা পড়ল—না খুব জোরে নয়, কিন্তু অস্বাভাবিক ছন্দে। তিনবার। তারপর এক বিরতি, আবার একবার। ঋষভ থেমে গেল। দরজা খুলতেই সে দেখল—এক বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে আছেন, গায়ে ধুতি, পরনে পুরনো এক কোঁচানো রেশমের চাদর, কপালে সিঁদুরের টিপ, আর হাতে একটা কাঠের জপমালা। বৃদ্ধ কিছু না বলে তার দিকে তাকিয়ে রইলেন, আর সেই চোখে ছিল এমন কিছু, যা ঋষভ আগে কখনও দেখেনি—না দয়া, না রাগ—এক ধরনের নিঃশব্দ শূন্যতা। বৃদ্ধ শুধু বললেন, “তুই রক্ত খুলেছিস, এবার আগুন দেখতে হবে। আমি ছিলাম তোর বাবার প্রতিদ্বন্দ্বী, এখন তোর পথরক্ষক।” নাম বললেন—মানিকান্ত নাথ। তারপর নিজের পকেট থেকে একটি অদ্ভুত আকৃতির ধাতব বস্তু বের করে ঋষভের হাতে দিলেন—এক ধরনের ত্রিশূল-আকৃতির তালা, যার গায়ে ছিল খোদাই করা কিছু অক্ষর: “অগ্নিসূত্র”।
ঋষভ বসে পড়ল। এই নামটা সে আগেই পড়েছে বাবার ডায়েরিতে। কিন্তু কোনো বিস্তারিত ব্যাখ্যা ছিল না, শুধু লেখা ছিল—“অগ্নিসূত্র এক প্রবেশদ্বার, এক সতর্কবার্তা, এক প্রলয়। যার রক্ত এটি খোলে, তার আত্মা আর খুঁজে পাওয়া যায় না।” মানিকান্ত নাথ চুপ করে বসে থেকে বললেন, “তোর বাবার মতো আমিও রুদ্রসাধক ছিলাম। কিন্তু সে একটা ভুল করেছিল—তোর জন্মের আগে। তিলোত্তমাকে সে বাঁধতে চেয়েছিল, মুক্ত করতে নয়। আর সেই কারণে সে শেষপর্যন্ত পথের বাইরে পড়ে গিয়েছিল। ডায়েরিতে যা লেখা আছে, সবটা সত্য নয়। সে নিজেই অনেক কিছু লুকিয়ে রেখেছিল। তুই জানিস না, তোর ভেতরে যে আগুন জ্বলছে, সেটা কেবল তোর একার নয়—দুই পুরনো রক্তের মিলন। তুই পথের শেষ প্রহরী।” এইসব কথা শুনে ঋষভের মাথা ঘুরে উঠল। সে তখনো পুরো বিশ্বাস করতে পারছিল না, এই লোকটা আসলে কে, কী উদ্দেশ্যে এসেছে। কিন্তু বৃদ্ধ তখন তার চোখের সামনে হাত তুলে মন্ত্র পড়া শুরু করলেন—কোনো শব্দ নেই, ঠোঁট নড়ছে, কিন্তু কোনো আওয়াজ আসছে না। অথচ ঋষভ অনুভব করল চারপাশের বাতাস ভারী হয়ে যাচ্ছে, দেয়ালে থাকা তার বাবার একটা ছবির কাঁচে ফাটল ধরেছে, আর বুকের ভিতরটা যেন আগুনে জ্বলতে শুরু করেছে। মন্ত্র শেষ হতেই মানিকান্ত বললেন, “এই হল নিঃশব্দতন্ত্র। আমি যা পারি, তোর বাবা পারত না। কিন্তু তুই পারবি, যদি তুই চাইস।”
এরপরের কয়েকদিন ঋষভ ও মানিকান্তের মধ্যে শুরু হয় এক ধরণের গুরু-শিষ্য সম্পর্ক, কিন্তু তা কখনোই সহজ বা পরিষ্কার নয়। বৃদ্ধ কখনো সহানুভূতিশীল, আবার কখনো অসম্ভব কঠোর, এমনকি নির্দয়। তিনি তাকে শেখাতে থাকেন সেই তন্ত্রগুলো, যেগুলো ডায়েরিতে ছিল না—যেগুলো দেবদ্যুতি সেন চেপে গিয়েছিলেন। একদিন মানিকান্ত বললেন, “রুদ্রসাধনা একটা পথ নয়, একটা ফাঁদ। কিন্তু কিছু লোক জন্ম থেকেই বাঁধা এই ফাঁদে পড়ার জন্য। তুই তাদের একজন।” তিনি তাকে একটা বিশেষ ক্রিয়া শিখালেন—“ভয়মূর্তিধ্যান”—যেখানে সাধক নিজের ভয়ের সর্বোচ্চ রূপ কল্পনা করে, এবং তা গ্রহণ করে নিজের শক্তির উৎস হিসেবে। এই ধ্যান করতে গিয়ে ঋষভ দেখতে পেল একটি অদ্ভুত মূর্তি—চোখবিহীন, ছায়ার তৈরি, যার মাথার উপর আগুন জ্বলছে। সে বুঝতে পারল এটাই তার “ভয়মূর্তি”—তিলোত্তমা নয়, তার ভেতরের সেই সত্তা, যা সমস্ত মানুষী অনুভব পেরিয়ে এখন একান্ত রুদ্রময়। ধ্যান শেষ হলে মানিকান্ত বললেন, “তোর আগ্নিসূত্র এখন জেগে উঠছে। তুই চাইলেও আর ফিরতে পারবি না। আমি তোকে সাহায্য করতে পারি, যদি তুই পথ শেষ করতে চাস। কিন্তু তুই যদি পিছু হটিস, আমি নিজে তোকে শেষ করে দেব। কারণ অর্ধেক জাগ্রত রুদ্রসাধক এই পৃথিবীর জন্য অভিশাপ।” এই কথাগুলো শোনার পর ঋষভ বুঝতে পারল, সে এখন আর কেবল অনুসন্ধানকারী নয়—সে নিজেই এক অস্ত্র, এক সিঁদুরমাখা আগুন, যা হয় ধ্বংস করবে সবকিছু, নয়তো নিজেকে ছাই করে দেবে পথের শেষ প্রান্তে।
সাত
ঋষভ ধীরে ধীরে বুঝে ফেলছিল, মানিকান্ত নাথের আগমনের পর তার জীবন কেবল রহস্যে নয়, ভয়েও নতুন মাত্রা পেয়েছে। কিন্তু এই ভয় আর তাকে দুর্বল করে না, বরং তার রক্তে এক নতুন উত্তেজনা ছড়িয়ে দেয়, যেন প্রতিটি ধমনী মন্ত্রের মতো ধ্বনিত হচ্ছে। তার দিনরাত্রি এখন মানিকান্তের শিষ্যত্বে কাটে—মন্ত্র, ধ্যান, নিষিদ্ধ অঙ্গসংস্থান আর রক্তের ওপর পরীক্ষা। একরাতে সে একটি স্বপ্ন দেখে, যেটা ঠিক স্বপ্ন নয়, বরং এক ডাক। সে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল এক শূন্য মন্দিরের সামনে, যেখানে ছাদের কোনো অস্তিত্ব নেই, কিন্তু আকাশ নেই বলেও মনে হয় না। ভিতরে ঢুকতেই তার পায়ের নিচে ছাইয়ের স্তূপ, চারপাশে ছায়ার মতো নড়ছে কিছু অবয়ব, যাদের মুখ নেই। হঠাৎ সে দেখে, এক বিশাল পাথরের সিংহাসনে বসে আছে এক অদ্ভুত সত্তা—তার অর্ধেক দেহ মানুষ, অর্ধেক গরু, কপালে ত্রিনয়ন, আর গলায় সাপ। সে কিছু বলে না, শুধু দুই হাত তুলে আশীর্বাদ দেয়, আর চোখের মধ্যে এক তীব্র নীল আলো জ্বলে ওঠে। ঋষভ কিছু একটা বুঝে ওঠার আগেই পেছন থেকে এক মৃদু গম্ভীর আওয়াজ—“আমি নন্দী। প্রহরী, বাহক ও সাক্ষী। তোমার আগমনের অপেক্ষায় ছিলাম অনেক কাল।” তারপর সেই স্বর আর ধ্বনি মিলেমিশে চারপাশের শূন্যতায় ছড়িয়ে পড়ে—“আগুন জেগেছে, রুদ্র ঘুমোচ্ছে না আর। তুমি যদি প্রস্তুত হও, তবে দরজা খুলবে।” সেই মুহূর্তে ঋষভের হাতে কিছু একটা গরম হয়ে ওঠে—অগ্নিসূত্র। ঘুম ভেঙে গিয়ে সে দেখে হাতটা জ্বলছে না, কিন্তু তালুর মাঝে তিনটি নতুন চিহ্ন ফুটে উঠেছে—ত্রিকোণ, বক্রচন্দ্র এবং ত্রিনয়ন। সে বুঝে যায়, এই স্বপ্ন ছিল না—এ ছিল ডাক।
সেইদিন সন্ধ্যায় মানিকান্ত তাকে নিয়ে যায় একটি পুরনো পাথরের গুহায়, যেটা শহরের উপকণ্ঠে, পরিত্যক্ত পাহাড়ের নিচে চাপা পড়ে ছিল বহু বছর। প্রবেশপথ ছিল ঢাকা শ্যাওলা আর ঝোপে, কিন্তু ভিতরে ঢুকতেই ঋষভ বুঝে যায়, এই জায়গা বহু আগে প্রস্তুত করা হয়েছিল কোনো বিশেষ উদ্দেশ্যে। গুহার দেয়ালে খোদাই করা রয়েছে রুদ্ররূপের বিভিন্ন রূপ, যাদের কোনোটা উন্মত্ত, কোনোটা ধ্যানস্থ, আবার কোনোটা ভয়ংকর রক্তপিপাসু। এক জায়গায় সে দেখে, রুদ্রের পায়ের নিচে চাপা একজন নারী, যার মুখ দেখে আঁতকে উঠে সে বুঝে যায়—তিলোত্তমার অবিকল মুখাবয়ব! তার শরীর কেঁপে ওঠে, কিন্তু মানিকান্ত কেবল বলে, “এই গুহা তোমার পিতারও জানা ছিল না। এটি কেবল সেই রুদ্রসাধকের জন্য, যার মধ্যে ‘নন্দীচিহ্ন’ ফুটে ওঠে। তুই সেই বাহক, তোর জন্য গুহা জেগেছে।” গুহার গভীরে রয়েছে একটি তাম্রস্তম্ভ, যার উপরে খোদাই করা রয়েছে হাজার বছরের পুরনো মন্ত্র—কেবল চোখ দিয়ে পড়া যায়, মুখে উচ্চারণ করলেই জিভ কালো হয়ে যায়, এবং মানিকান্ত সতর্ক করে, “এই মন্ত্রের নাম ‘নন্দী আহ্বান’। একবার পড়লে পেছনে ফেরার উপায় নেই। এই মন্ত্র আত্মার বন্ধ দরজা খুলে দেয়, এবং সেই পথে যা ঢোকে, তা রক্ত ও যন্ত্রণার বিনিময়ে আসে।” ঋষভ কিছু না বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে পড়ে স্তম্ভের সামনে, এবং তার চোখ আপনাআপনি শব্দগুলো পড়তে শুরু করে—সেই মুহূর্তে স্তম্ভ থেকে বেরিয়ে আসে গরম ধোঁয়া, আর আশপাশের পাথর ফাটতে শুরু করে। হঠাৎ যেন গুহার ছাদ কেঁপে ওঠে, এবং বাতাস ভারী হয়ে আসে এক অদ্ভুত গন্ধে—জ্বলন্ত কাঠ, সিঁদুর আর রক্তের গন্ধ।
পরদিন থেকেই ঋষভের চারপাশ বদলে যেতে থাকে। সে যেখানে যায়, অচেনা কাকেরা তার আশেপাশে ঘুরে বেড়ায়, মাটিতে তার ছায়া অন্যদের তুলনায় গাঢ় হয়, এবং আয়নার সামনে দাঁড়ালে মাঝে মাঝে সে দেখতে পায় নিজের পেছনে আরেকটা অবয়ব—একটা ছায়ার মতো, কিন্তু স্থির নয়। ঘরের জিনিসপত্র নিজের ইচ্ছেমতো নড়ে ওঠে, আর মা যেন এখন তাকে দেখতে ভয় পায়, বলেও না কিছু। তিলোত্তমা আর সশরীরে আসে না, কিন্তু ধূপ জ্বালালেই তার গন্ধ চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে। এক রাতে সে দেখতে পায়—তার কপালে তিলো করে রক্ত জমে আছে, এবং তা শুকোতে শুকোতে গঠিত হচ্ছে এক নতুন চিহ্ন—নন্দীর তৃতীয় দৃষ্টি। সে বুঝে যায়, এখন সে আর মানুষ নয়, কিন্তু দেবতাও নয়—একটি সেতু, এক বাহক, এক অদ্ভুত পরিবর্তনের আধার। মানিকান্ত তাকে জানায়, “তুই এখন সেই পর্যায়ে পৌঁছেছিস যেখানে রুদ্র আর তোকে স্বপ্নে নয়, সত্যের ভিতর ডাকে। এই দৃষ্টির মাধ্যমে তুই শীঘ্রই শুনতে পাবি সেই পুরনো প্রহরীর নাম, যে মৃত নয়, কিন্তু জাগ্রত নয় এখনো।” আর তখনই ঋষভের শরীরের ভিতর দিয়ে এক শীতল স্রোত বয়ে যায়, আর মনে হয়, যেন আকাশের এক অজানা দিক থেকে ভেসে এলো এক স্বর—অস্পষ্ট, ধ্বনি, কিন্তু তীব্র…
“আত্মানম বিদ্ধি। রুদ্রম চ নন্দী।”
ঋষভ জানে, আর ফিরে যাওয়ার কোনো পথ নেই।
আট
রাত্রি যেন স্থির হয়ে গেছে সেই রাতে। আকাশে চাঁদ ছিল না, বাতাসে ছিল না কোনো গতি, এমনকি কুকুরের ঘেউ-ঘেউ শব্দও যেন ভুলে গিয়েছিল এই পৃথিবীকে। ঋষভ জানত, এই রাত্রি আর পাঁচটা রাতের মতো নয়। এই রাতেই তাকে প্রস্তুত হতে হবে আত্মাহুতির জন্য—রুদ্রসাধনার চূড়ান্ত ক্রিয়ার এক পূর্বশর্ত, যেখানে নিজের অন্তরাত্মা একবার ছুঁয়ে আসে মৃত্যুকে, এবং বেঁচে ফিরলে তবেই মন্ত্র সত্য হয়। মানিকান্ত তাকে আগেই বলে দিয়েছিলেন, “এই আত্মাহুতি এক প্রতীক নয়, এ সত্য। তোকে নিজেকেই পোড়াতে হবে—কিন্তু শরীর নয়, সত্তা।” সেদিন বিকেল থেকে সে উপবাসে ছিল, কণ্ঠে একটিও শব্দ ওঠেনি, চোখে ছিল না ঘুম। কেবল মনে মনে পড়ছিল সেই তন্ত্রমন্ত্রগুলো, যেগুলো দেহকে প্রস্তুত করে এক অন্তর্দৃষ্টির জন্য। তিলোত্তমা সে দিন আর এল না, তবে তার গন্ধ, তার উপস্থিতির এক ধোঁয়াটে ছায়া যেন ঘরজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল। ঋষভ একটি ছোট মাটির ঘরে বসে, চারপাশে জ্বালানো ছিল আটটি প্রদীপ—প্রতিটি একটি দিকের রক্ষক। মাটিতে আঁকা একটি বৃহৎ বৃত্ত, তার মাঝখানে একটি সরু শয্যা—তাঁর বাবার ব্যবহৃত আসন, যা কেবল রুদ্রসাধনার শেষপর্যায়েই ব্যবহৃত হতো। ঘরের ঠিক মাঝখানে সে শুয়ে পড়ে, চোখ বন্ধ করে, হৃদস্পন্দনের দিকে মন দেয়। তার নিশ্বাস যেন ধীরে ধীরে থেমে যাচ্ছে, আর অনুভূতি বিচ্ছিন্ন হচ্ছে—প্রথমে হাত, তারপর পা, তারপর বুকের ভার—সব মিলিয়ে শরীর যেন কুয়াশার মধ্যে মিশে যেতে চাইছে।
হঠাৎ করেই চোখের সামনে এক তীব্র আলো বিস্ফোরণের মতো ফুটে ওঠে, কিন্তু সেটা কোনো আলোকচ্ছটা নয়—বরং এক অনুভব, এক ছায়ার প্রতিচ্ছবি। সে দেখতে পায়, সে দাঁড়িয়ে আছে এক বিশাল চক্রের মাঝখানে, যেটা আগুনে জ্বলছে, কিন্তু পোড়াচ্ছে না তাকে। চারপাশে অন্ধকার, কিন্তু তার ভেতর ঘুরছে অসংখ্য মুখ—সব মুখ তারই, কিন্তু প্রতিটা একেকটা আবেগে পূর্ণ—রাগ, ক্রোধ, লোভ, দয়া, লজ্জা, ঈর্ষা, এবং সবচেয়ে তীব্রভাবে—ভয়। এই মুখগুলো একসাথে চিৎকার করে উঠছে, যেন তার আত্মাকে ছিঁড়ে টানতে চাইছে তাদের দিকে। তখনই সে শুনতে পায় সেই পুরনো স্বর—নন্দীর গম্ভীর, ছায়াসম কণ্ঠ, “তুমি যদি নিজেকে চেনো, তবে ওদের চোখে তাকাও।” ঋষভ বুঝে যায়, এই আত্মাহুতি মানে তার নিজেকেই পরিপূর্ণভাবে প্রত্যক্ষ করা, এমনভাবে যা কখনো কোনো আয়নাও দেখাতে পারে না। সে একে একে এগিয়ে যায় প্রতিটি মুখের কাছে, তাদের অনুভব করতে থাকে, এবং হঠাৎ তার শরীরের ভেতরে তীব্র ব্যথা শুরু হয়—প্রতিটি আবেগ যেন ছুরি হয়ে তাকে বিঁধছে। রাগ তাকে ফোঁড়ে পেছন থেকে, লোভ তাকে টেনে আনে গুহার মত এক শূন্যতায়, দয়া তাকে ভাসিয়ে দেয় নরম আলোর বুকে, আর ভয়? ভয় তাকে তিলোত্তমার মুখে নিয়ে যায়—কিন্তু এবার তার মুখ পোড়া, চোখে রক্ত, আর ঠোঁটে এক বিভৎস হাসি। সে চিৎকার করে উঠে বলে, “তুই যা তন্ত্র জানিস, তা কিছু নয়। আমি তোর ভিতরের তিলোত্তমা—আমি তোকে ছাড়ব না।” কিন্তু ঋষভ এবার ভয় পায় না, সে এগিয়ে যায় মুখোমুখি হতে—এবং মুখে মুখ রাখতেই সেই বিকৃত মুখটি মিলিয়ে যায় আগুনের মধ্যে।
তারপরেই সে দেখতে পায় এক দরজা খুলে যাচ্ছে—নিঃশব্দে, ধীরে ধীরে। দরজার ওপারে কেবল ছায়া, কিন্তু ছায়ার ভিতর থেকে কেউ ডাকছে—একটা না, অনেকগুলো কণ্ঠ একসাথে, যেন প্রাচীন মন্ত্রপাঠের ছায়াস্বর। সেখানে কোনো রুদ্র নেই, কিন্তু রুদ্রের প্রতিধ্বনি আছে। মানিকান্তের বলা কথাগুলো মনে পড়ে যায়: “আত্মাহুতি মানে তুমি নিজেকে ভেঙে পুনরায় গড়া। যতক্ষণ না তুমি পুরনো ‘তুমি’কে ছাড়ো, নতুন রুদ্রসাধক জন্ম নেয় না।” ঋষভ ধীরে ধীরে দরজার ভিতরে পা রাখে। মুহূর্তেই তার শরীরে আগুন জ্বলে ওঠে—বাস্তব নয়, তবে ব্যথা সত্যিকারের। সে দগ্ধ হচ্ছে, পোড়াচ্ছে তার গর্ব, তার পুরনো বিশ্বাস, তার ঈশ্বর-ভাবনা, এমনকি তার ভালোবাসা পর্যন্ত। সব মিলিয়ে এক ধ্বংসস্তূপ তৈরি হয় তার অস্তিত্বের। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে, যখন ব্যথা অসহ্য, সে অনুভব করে নিজের ভিতর থেকে উঠছে এক নতুন তাপ—এবার পোড়াচ্ছে না, বরং জাগিয়ে তুলছে কিছু। সে দেখতে পায় নিজের মাথার ওপরে জ্বলছে একটি আগুনের ত্রিনয়ন—চলছে না, কাঁপছে না—শুধু আছে, জ্বলছে। দরজার ভিতর সে দেখতে পায়—নিজেকেই। নগ্ন, শান্ত, চোখে তীব্র এক সিদ্ধান্ত, আর পেছনে জ্বলছে ছাইচাপা এক রুদ্ররূপ। ঋষভ হাঁপাতে হাঁপাতে জেগে ওঠে সেই ঘরের মাটিতে—শরীর ভেজা ঘামে, আশপাশে জ্বলছে না কোনো প্রদীপ, কিন্তু তার কপালে তিলো করে ফুটে উঠেছে সেই ত্রিকোণ চিহ্ন—এবার স্থায়ীভাবে। আত্মাহুতি সম্পন্ন।
নয়
ঋষভের আত্মাহুতি শেষ হয়েছে সাতদিন। সাতদিন সে কোনো মানুষের মুখ দেখেনি, কোনো শব্দ শোনেনি, এমনকি নিজেকে আয়নাতেও দেখেনি। তার ভিতরে এখন এক অদ্ভুত নিঃস্তব্ধতা—যেখানে ভয় নেই, লোভ নেই, ভালোবাসাও নয়—শুধু লক্ষ্য আছে। এই সাতদিনে প্রতিটি রাত্রিতে সে অনুভব করেছে নিজের শরীরের ভেতরে কিছু গঠিত হচ্ছে—কোনো চেতনা, যেটা তার নিজের নয়, কিন্তু সে-ই তার বাহক। তামসিক শক্তির সঙ্গে এক গভীর বন্ধনে জড়িয়েছে সে। তন্ত্রের পঁচা ধূপ, কাঁচা মাটির স্তব্ধতা, অচেনা ভাষার গুঞ্জন—সব মিলিয়ে ঋষভ যেন আর এই জগতের মানুষ নয়। মানিকান্ত আবার ফিরে আসে সপ্তম দিন সকালে, কপালে চূর্ণ লেপা, হাতে রক্তরঞ্জিত পুঁথি। সে কেবল বলে, “সময় হয়েছে। রক্তসূত্র খুলবে আজ, যেখানে তোর বাবাও থেমে গেছিল।” ঋষভ কিছু বলে না, শুধু মাথা নেড়ে উঠে দাঁড়ায়। আজ তারা যাবে এক গোপন স্থানে—যেখানে পিতার ডায়েরিতে ‘রুদ্রবিন্দু’ নামে উল্লিখিত সেই শেষ তন্ত্রানুষ্ঠান সম্পন্ন করার চেষ্টা করেছিলেন কিশোরিশ্বর বাগচী, আর যেখানে তিনি নিখোঁজ হন, শুধু রেখে যান পুঁথি, ছাই ও রক্তমাখা কাপড়।
সেই স্থান শহরের সীমান্ত ছাড়িয়ে, একটি পরিত্যক্ত শ্মশানের ভেতরে। বটগাছ আর শূলের গন্ধে ভারী করে তোলা সেই জায়গায় পৌঁছানো মাত্রই ঋষভ বুঝে যায়—এই মাটি রক্ত চেনে। এখানকার বাতাসে এমন কিছু আছে, যা মনের গভীরতম স্তর ছুঁয়ে কাঁপিয়ে দেয়। তারা একটি পুরনো স্তূপমন্দিরে ঢোকে, যার ছাদ নেই, কিন্তু প্রতিটি দেয়াল গহীন লাল-কালো চিহ্নে ভরা। এই চিহ্নগুলো কোনও ভাষা নয়, তবে এক ছন্দে লেখা—যা চোখে পড়লে শরীর কেঁপে ওঠে। মন্দিরের ঠিক মাঝখানে একটি চক্র আঁকা—সাতটি রক্তচিহ্নে যুক্ত, যার প্রতিটি বিন্দুতে পড়ে আছে হাড়ের টুকরো। মানিকান্ত কণ্ঠে গম্ভীর স্বরে বলে, “এই হল রক্তসূত্র। তোর পিতা এই চক্রে বসেই ডেকেছিল ‘রুদ্রবিন্দু’—রুদ্রতত্ত্বের জীবন্ত ছায়া, যাকে দেখা মানে নিজের অস্তিত্ব বিসর্জন দেওয়া। তিনি থেমে গিয়েছিলেন। এবার তোকে শেষ করতে হবে।” ঋষভ চক্রের একপ্রান্তে বসে, চোখ বন্ধ করে ধ্যানস্থ হয়। মন্ত্র ওঠে তার মুখে—কোনো পুঁথি থেকে নয়, ভেতর থেকে। সে বুঝে যায়, এই শব্দগুলো কোনো গ্রন্থ নয়, বরং রক্তের মধ্যেই লেখা ছিল—তার পিতার, তার পূর্বপুরুষদের, যারা কেউই পূর্ণ সাধক হয়ে ওঠেনি।
মন্ত্র পাঠের সময়েই শুরু হয় প্রকৃতির প্রতিক্রিয়া। আকাশ কালো হতে থাকে, কিন্তু বৃষ্টি নামে না। বাতাস থেমে যায়, তবে পাতা নড়ে ওঠে নিজের মতো করে। চারদিক থেকে কুকুরের ডাকে ভরে যায়, আর মন্দিরের ভিতর জমে ওঠে এক গন্ধ—কাঁচা রক্তের, পুরনো আগুনের, আর অপ্রকাশিত মৃত্যুর গন্ধ। চক্রের ভেতরে হাড়গুলো নিজেরাই নড়ে ওঠে, যেন কোনো অদৃশ্য হাত তাদের একত্র করছে। হঠাৎ করেই এক দমকা হাওয়া উঠে চক্রের মাঝখানে জাগিয়ে তোলে আগুন, এবং সেই আগুনের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসে এক অবয়ব—না পুরুষ, না নারী—এক ছায়ার মতো দেহ, যার মাথার জায়গায় কেবল একটি চোখ, এবং শরীর পাথরের মতো। সেই দৃষ্টি ঋষভের দিকে তাকানো মাত্রই সে অনুভব করে, যেন তার সমস্ত স্মৃতি খুলে যাচ্ছে—তিলোত্তমার ছায়া, পিতার মৃত্যু, প্রথম মন্ত্রপাঠ, আত্মাহুতি—সবকিছু এক এক করে ফিরে আসছে চোখের সামনে। কিন্তু তার চেতনা ভেঙে না পড়ে, বরং জেগে ওঠে। সেই সময়েই, আগুনের ছায়ার পেছনে সে দেখতে পায় এক ম্লান অবয়ব—তার পিতা। নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে, চোখে প্রশান্তি আর অপরাধবোধের মিশ্র দৃষ্টি। তিনি কিছু বলেন না, কেবল একবার মাথা নেড়ে দূরে মিলিয়ে যান, এবং ছায়াদেহটি রক্তসূত্রের মাঝখানে বসে পড়ে, ঋষভের মুখের মন্ত্রের ছন্দে নিজের শরীর গলিয়ে দেয় চক্রে। সেই রক্ত, সেই আগুন, সেই কণ্ঠ—সব একসাথে মিশে তৈরি করে এক অদ্ভুত স্পন্দন, যা কেবল একবারই শোনা যায়—যখন রুদ্র নিজে শ্বাস ফেলে, সৃষ্টি ও ধ্বংসের মাঝে।
ঋষভ চক্রের মাঝখানে উঠে দাঁড়ায়—তার দেহে আগুন জ্বলছে না, কিন্তু পায়ের নিচে প্রতিটি হাড় গলে যাচ্ছে। তার মুখে না আছে হাসি, না ব্যথা—শুধু আছে শূন্যতা। মানিকান্ত দূর থেকে তার দিকে তাকিয়ে থাকে, এবং মনে মনে উচ্চারণ করে, “সে ফিরেছে। এবার সত্য রুদ্রসাধক জেগেছে।” সেই মুহূর্তে ঋষভের কপাল থেকে একটি ফোঁটা রক্ত পড়ে চক্রের ঠিক কেন্দ্রে। সাথে সাথেই চারপাশের বাতাস স্তব্ধ হয়ে যায়, এবং দূরে কোনো গাছ থেকে ঝরে পড়ে একটি পাতা—নিঃশব্দে। রক্তসূত্র পূর্ণ হয়েছে। রুদ্রবিন্দু গ্রহণ করেছে তার বাহককে। এবার ঋষভ যা দেখবে, তা কোনো গ্রন্থে নেই, কোনো স্মৃতিতে নেই—কেবল অস্তিত্বের বাইরে, যেখানে ঈশ্বরও প্রবেশ করেন না।
দশ
রক্তসূত্র পূর্ণ হওয়ার পর সময় যেন পিছু হটেছিল। ঋষভের মনে হয়েছিল, সে আর এই জগতের অংশ নয়—তার হৃদস্পন্দন, শ্বাসপ্রশ্বাস, দৃষ্টিও যেন ঘুরে গেছে অন্য এক বৃত্তে, যেখানে সময় আর রেখায় চলে না, চলে অভিজ্ঞতায়। সে জানত, চক্র সম্পূর্ণ হয়েছে, কিন্তু সাধনা এখনো অসম্পূর্ণ—কারণ রুদ্রবিন্দুর প্রকাশ মানেই মুক্তি নয়। বরং তা এক পরীক্ষা, এক সর্বোচ্চ ধ্বংস। সাতদিন ধরে সে সেই স্তব্ধ মন্দিরে থেকেছে—কথা বলেনি মানিকান্ত, আসেনি তিলোত্তমা, এমনকি পাখিও উড়ে যায়নি মাথার উপর দিয়ে। বাতাস ভারী, গাছ স্থির, আকাশে কেবল ধূসর রং। সপ্তম রাতে, ঠিক মধ্যরাত্রির মুহূর্তে, মন্দিরের ভিতরে আগুন জ্বলে ওঠে আপনাতেই। চক্রের কেন্দ্রে সেই ছায়ামূর্তি—রুদ্রবিন্দু—আবার রূপ নেয়। তবে এবার সে ছায়া নয়, আগুন নয়, রক্ত নয়—বরং এক নিখুঁত শূন্যতা, যাকে দেখা যায় না, কিন্তু অনুভব করা যায় সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে। ঋষভ নিজেই উঠে দাঁড়ায়—কোনো দ্বিধা নেই, ভয় নেই, এমনকি বিস্ময়ও নেই। সে জানে, আজই শেষ দিন। হয় সে নিজের শরীর ছেড়ে রুদ্রসত্তার বাহক হয়ে উঠবে, নয়তো বিলীন হবে সেই চক্রের ভেতর, ঠিক তার পিতার মতো।
রুদ্রবিন্দু এবার কথা বলে—না শব্দে, না কণ্ঠে—মনে। তার কণ্ঠ একসাথে হাজারো কণ্ঠ, আবার কেবল একটিই। সে বলে, “তুই আমাকে ডেকেছিস, কিন্তু তুই প্রস্তুত কি না, আমি তা পরীক্ষা করব না। আমি শুধু পথ খুলে দেব। পারলে পেরো—না পারলে মুছে যা।” এই কথার সাথে সাথেই চক্রের চারদিক থেকে উঠে আসে ছায়ামূর্তি—সব ঋষভের নিজের রূপে। একেকটা একেক সময়ের সে—শৈশবের ভীতু ঋষভ, কৈশোরের অবুঝ ঋষভ, প্রেমিক ঋষভ, ঘৃণা-করা ঋষভ, এবং একটি—যা সবচেয়ে অন্ধকার, রক্তাক্ত চোখে তাকিয়ে থাকা এক ‘ঋষভ’—যার গলায় তিলোত্তমার হাতভরা পুড়ন্ত ক্ষতচিহ্ন। এই ছায়ারা একে একে বলে ওঠে তার পিছু ফেলে আসা পাপের কথা, ভুলের কথা, তার দম্ভ, তার লোভ, তার তৃষ্ণা। এইসব ছিল তার তন্ত্রের মূল বাধা। কিন্তু এবার ঋষভ পালায় না, সে তাদের দিকে তাকায়, এবং কেবল বলে, “আমি তোকে চিনি। আমি তোরা প্রত্যেককে গ্রহণ করি। আমি তোদেরই তৈরি।” সেই মুহূর্তে ছায়ারা একে একে ভেঙে পড়ে, এবং তাদের ধ্বংসস্তূপ মিশে যায় তার পায়ের নিচে। রুদ্রবিন্দু আবার বলে, “এটাই প্রথম রুদ্রমুক্তি—নিজেকে চিনে নেওয়া, নিজের সকল ছায়াকে গ্রহণ করা। কিন্তু সামনে যা আসছে, তা আর নিজের নয়। তা হলো অস্তিত্বের সীমান্ত।”
আকাশ বিদীর্ণ হয়। মন্দির ভেঙে পড়ে। পৃথিবী যেন সরে যায় ঋষভের পায়ের নিচ থেকে। সে নিজেকে দেখে—সে আর দেহধারী নয়। কেবল এক সত্তা, যার চারপাশে সময়ের রেখাগুলো ঘুরছে। সে দেখতে পায়, ভবিষ্যতের সবকিছু—তিলোত্তমার মৃত্যু, মানিকান্তের দৃষ্টি হারানো, শহরের মাঝে এক ভয়ংকর তন্ত্রদুর্ঘটনা, যেখানে মানুষের আত্মা গলে যাচ্ছে। সে দেখতে পায় নিজের মুখেও আগুন জ্বলছে, এবং সেই মুখে কোনো বিকার নেই। সে অনুভব করে—এই রুদ্রসাধক আর সে নয়, বরং সে নিজেই এই সব ঘটনার বাহক। তখনই আবার সেই চেনা কণ্ঠ—এইবার নিজের ভেতর থেকে—“তুই চাইলেই এখন থেমে যেতে পারিস। আবার ফিরে যেতে পারিস এক সাধারণ জীবনে। তিলোত্তমা তোর জন্য অপেক্ষা করছে। মানিকান্ত তোকে ক্ষমা করে দেবে। তোর মা তোকে স্বপ্নে খুঁজছে।” কিন্তু ঋষভ জানে, এই মুহূর্তে থামা মানে সমস্ত রুদ্রজ্ঞান বিলুপ্ত করা—not শুধু নিজের, বরং পিতার পথ, তার আত্মাহুতি, রক্তসূত্র—সব ভুলে যাওয়া। সে বলে, “না। আমি রুদ্রসাধক হয়েছি শেষ অবধি যেতে। আমাকে রক্ষা কর না, পথ দেখাও না। আমি হই ছায়ার বাহক।”
তখনই তার কপালে, যেখান থেকে রক্ত বেরিয়ে এসেছিল, সেখানে জ্বলে ওঠে এক ত্রিনয়ন—বাস্তব নয়, তবে অনুভবযোগ্য। সেই চোখ খোলে আর সাথে সাথেই সময়, মৃত্যু, ভয়—সব মিলিয়ে গলে যায় এক মহাশূন্যতায়। ঋষভ নিজের অস্তিত্ব হারায় না, বরং বিস্তৃত হয়। সে পৃথিবীর সীমা ছাড়িয়ে এক উপরে উঠে, যেখানে সে দেখছে—তন্ত্রের সমস্ত পথ, সমস্ত ভুল, সমস্ত রক্ত। সে বুঝে যায়, রুদ্রসাধনা শুধু শক্তির নয়, এটি এক চূড়ান্ত দায়িত্ব—কারণ এই শক্তি চাইলে সৃষ্টি করতে পারে, চাইলে ধ্বংস। তখনই সে মনে করে পিতার সেই ডায়েরির শেষ শব্দগুলি—“আমার সাধনা অসম্পূর্ণ ছিল, কারণ আমি ক্ষমতা চেয়েছিলাম। তুই যদি পাস, তাহলে ক্ষমতা নয়, করুণা নিয়েই ফিরে আয়।” ঋষভ একবার চোখ বন্ধ করে, আর যখন খোলে, সে আবার ফিরে আসে মাটিতে। শ্মশানের পাশে পড়ে আছে মানিকান্ত, অচেতন। দূরে বসে কাঁদছে তিলোত্তমা। ঋষভ হাঁটে তাদের দিকে—তার চোখে এখন আর আগুন নেই, কিন্তু গভীরতা আছে, যেন কোনো প্রাচীন নদীর। তার কপাল থেকে আলো আর বের হয় না, তবে মাঝেমাঝে বাতাস থেমে যায় তার পাশে। সে আবার মানুষ হয়েছে, কিন্তু আর একমাত্র মানুষ নয়—সে রুদ্রসাধক, এবং সে মুক্ত।
সমাপ্ত