Bangla - রহস্য গল্প - স্মৃতিকথা

রাত্রির ডাক

Spread the love

অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়


১. মহুয়ার গন্ধে ডুবে

মধ্যরাতের সোঁদা গন্ধটা যেন গায়ে লেগে আছে। মহুয়া গাছের তলায় দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছিল, আমি কোন শহরের বাসিন্দা ছিলাম না কোনোদিনই। লাল মাটির রাস্তা, অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া একটানা বাঁক, আর সেই বাঁকের ওপারে যেন অপেক্ষা করে আছে কোন অচেনা কিছু, এক রহস্য—জঙ্গলের রহস্য।

আমি নেহাতই এক নগরপ্রেমী মানুষ। কলকাতার ট্র্যাফিক, অফিসের তাড়া, বইপত্র আর রাত্রির ঘুমহীনতা নিয়ে আমার জীবন। তবু বছর খানেক আগে এক বন্ধুর পাল্লায় পড়ে ঝাড়খণ্ডের দালমা পাহাড়ের ধার ঘেঁষে এক জঙ্গলসাফারিতে গেছিলাম, আর সেখানেই আমার জীবনের গল্পটা একটু বদলে যায়।

সে রাতে আমরা ছিলাম “চিলমারি কটেজ” নামে এক ছিমছাম, কাঠের ঘরের মতো জায়গায়। দালমার একেবারে প্রান্তে, বাঘ চলাচলের এলাকা থেকে খানিক দূরে হলেও, রাতে মাঝে মাঝে গজারির পাতা কাঁপিয়ে কোন বিশাল কিছু হেঁটে যায়—এইরকম গুঞ্জন থাকেই।

চাঁদের আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল আমাদের সামনের জঙ্গলটা। বনদপ্তরের গাইড বলেছিল, “স্যার, রাত দুটো নাগাদ যদি মহুয়ার গন্ধ পেতে থাকেন, বুঝবেন কেউ ওখানে দাঁড়িয়ে আছে।” আমি হেসেছিলাম। বলেছিলাম, “গন্ধ থেকে কেউ দাঁড়িয়ে আছে বোঝা যায়?” সে বলেছিল, “জায়। মানুষ নয়, বাঘ। ওদের চলাফেরা, ওদের থাকার সময়, গন্ধ থেকে বোঝা যায়।”

সে রাতে আমি একা ছিলাম না। ছিল অনিরুদ্ধ—আমার কলেজ জীবনের বন্ধু। ও বরাবরই পাগল প্রকৃতির জন্য। আর ছিল কাকু—রঞ্জন সেন, প্রাক্তন বনাধিকারিক। ওনার সঙ্গেই আমরা বেরিয়েছিলাম।

চিলমারি কটেজে পৌঁছনোর সময় সন্ধ্যা নামছিল। জঙ্গল তার আলোর শেষ রশ্মি গিলছিল, গাছের পাতারা নিঃশব্দে নুয়ে পড়ছিল, যেন বিদায় জানাচ্ছিল সূর্যকে। আমরা তিনজন লটবহর নামিয়ে একটু বিশ্রাম নিলাম। তারপর রঞ্জন কাকু বের করল একটা পুরোনো মানচিত্র, বলল, “কাল সকালে আমরা যাব পাথরকোট ব্লকে। ওখানে একটা পুরনো পাহাড়ি রাস্তা আছে। শোনা যায়, ওখান দিয়েই এককালে হাতি চলাচল করত। এখনও মাঝেমধ্যে দেখা মেলে।”

আমি তখনও শহুরে মানসিকতা ছাড়তে পারিনি। ভাবছিলাম, এই সব কি অন্ধবিশ্বাস? প্রফেশনাল বনকর্মী হয়েও উনি এমন কথা বলেন?

রাত বাড়ছিল। আমরা ভাত আর ডাল খেয়ে কটেজের সামনের লনে বসেছিলাম। গাছপালার গায়ে হালকা বাতাস বয়ে যাচ্ছিল। দূরে কোথাও একটা রাতচরা ডাকছিল। তখনই সেই গন্ধটা পেলাম—মহুয়ার গন্ধ। গন্ধটা এমন, যেন মাটির গায়ে মদ ঢেলে দিয়েছে কেউ। ঘন, টানটান, আর মোহময়। আমি চুপ করে বসে রইলাম। অনিরুদ্ধ ফিসফিস করে বলল, “তুই পাচ্ছিস?” আমি মাথা নাড়ালাম।

রঞ্জন কাকু চশমা খুলে বলল, “এখন যদি কথা বলিস, তোরা হারিয়ে যাবি। বসে থাক, নড়বি না।”

আমি কথা বললাম না, এমনকি নিশ্বাসও যেন বন্ধ করে ফেলেছিলাম। মিনিট কুড়ি আমরা তিনজন একদম নিঃশব্দে বসে রইলাম। দূরে কোথাও শুকনো পাতার ওপর হালকা চাপের শব্দ হচ্ছিল। না, সেটা হরিণ বা শেয়াল নয়। সে শব্দে ছিল ভারী ওজন, ধীরচালিতা।

তারপর একটা ছায়া দেখা গেল—চাঁদের আলোয় গাছের ছায়াগুলোর মাঝে একটু ঘন, একটু নিচু হয়ে হাঁটা এক আকৃতি। খুব দূর থেকে, তবুও আমি নিশ্চিত হলাম—ওটা বাঘ।

আমার বুকের ভেতরটা কাঁপছিল, কিন্তু এক অদ্ভুত ভালোলাগা হচ্ছিল। যেন শহরের ধুলো, কর্পোরেটের ক্লান্তি, কনক্রিটের আবরণ খুলে গিয়ে আমি নিজেকে নতুন করে চিনছি।

রাত্রির সেই মুহূর্তে মহুয়ার গন্ধ আমাকে কিছু শিখিয়ে দিয়েছিল—জঙ্গলে শব্দ নেই, কিন্তু গল্প আছে। আর সেই গল্প যদি একবার শুনে ফেলো, তা হলে ফিরে যাওয়ার আর উপায় থাকে না।

সেই মুহূর্তের পর থেকে আমি বুঝতে পারি, এই বন আমায় ডাকছে। এই পাতা, গন্ধ, নিশব্দতা—সব কিছু যেন বলছে, “ফিরে এসো।” আমি জানতাম না, ওই সাফারিই একটা গহিন রহস্যের শুরু হবে, যেখানে হারিয়ে যাবে অনিরুদ্ধ, আর আমি… আমি হয়ে উঠব সেই জঙ্গলেরই এক খণ্ড।

২. পাথরকোটের পাথর

ভোরের জঙ্গলের শব্দটা একদম আলাদা। এটা কোলাহল নয়, আবার নীরবতাও নয়। যেন প্রকৃতি নিজে উঠে বসে ধীরে ধীরে গলা খাঁকারি দিয়ে জানিয়ে দিচ্ছে, “শুরু করছি।” সেই শব্দের ভিতর দিয়ে আমরা তিনজন হাঁটছিলাম—আমি, অনিরুদ্ধ আর রঞ্জন কাকু।

চিলমারি কটেজ থেকে আমরা রওনা দিয়েছিলাম সকাল ছ’টা নাগাদ। কাঠের বাঙ্কারের গায়ে গায়ে জড়ানো লতা আর ধোঁয়াটে কুয়াশা আমাদের শরীরে লেপ্টে যাচ্ছিল। বনদপ্তরের একটা পুরোনো জিপ আমাদের নামিয়ে দিয়ে বলেছিল, “এর পরের পথ আপনাদেরই খুঁজে নিতে হবে, স্যার।”

আমরা হেঁটে চলেছি দালমা পাহাড়ের একদম দক্ষিণ দিক বরাবর। গন্তব্য—পাথরকোট। নামটা শুনেই যেন একটা ভারী ইতিহাসের গন্ধ পাই, কাকু বলেছিল, “এই নামটা এসেছে এক ধরণের স্তম্ভের মতো পাথরের গঠন থেকে। জায়গাটা পুরনো। লোকাল গাইডরাও এড়িয়ে চলে।” অনিরুদ্ধ মুচকি হেসেছিল, “তাই তো মজাটা!”

পথটা সহজ ছিল না। কাঁটা জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে আমাদের হাঁটতে হচ্ছিল। কোথাও কোথাও শুকনো বাঁশের গোছা, কোথাও পুরনো স্যাল কাঠের গুঁড়ি, আর কিছু কিছু জায়গায় এমনকি হাতির পদচিহ্ন পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছিল। রঞ্জন কাকু মাঝে মাঝে থেমে থেমে বলছিলেন, “দেখ, এইটা ছয় মাস পুরোনো, ওটা গত বর্ষার সময়কার।”

আমি মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম। এই মানুষটা গাছের ছাল ছুঁয়ে বলে দিতে পারছে কোন গাছে গন্ধ বেশি, কোনটার ছায়ায় চিতা বসে থাকে। আমি বুঝলাম, বই পড়ে যা শিখি, তার চেয়েও অনেক গভীর কিছু এই জঙ্গলবিজ্ঞান। চোখ দিয়ে নয়, মন দিয়ে দেখতে হয়।

হঠাৎ করে একটা জায়গায় পৌঁছে কাকু থেমে গেল। সামনে পাথরের একটা বিশাল গঠন—ঠিক যেন কেউ দুটো স্তম্ভ দাঁড় করিয়েছে দুপাশে, আর মাঝখানে একটা খালি গলি। গাছের ফাঁক দিয়ে আলো এসে পড়ছিল গায়ে, ছায়াগুলোর মাঝে যেন একটা চিত্রকথা ফুটে উঠেছিল। অনিরুদ্ধ বলল, “এটা বুঝি পাথরকোট?”

কাকু মৃদু হেসে বললেন, “এটাই। কিন্তু এখানেই থেমে গেলে চলবে না। ভেতরে যেতে হবে।”

আমরা পাথরের ফাঁক গলে ভিতরে প্রবেশ করলাম। আশেপাশে পাথরের দেয়াল, যেগুলোর গায়ে মহিষের শিং ঘষার দাগ, পুরনো মসৃণতা, আর কিছু অদ্ভুত চিহ্ন ছিল। মনে হচ্ছিল, কেউ এখানে ছিল। বহু বছর আগে, কিন্তু তার ছায়া রয়ে গেছে।

হঠাৎ করেই এক জায়গায় এসে আমি থমকে গেলাম। সামনে একটা ছোট্ট মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের মতো কিছু দাঁড়িয়ে ছিল। খোলামেলা জায়গা, চারপাশে জঙ্গল ঘিরে আছে। কাঠ আর পাথরের কিছু ভাঙা কাঠামো, আর মাঝখানে একটা কালো পাথরের চৌকো বেদী।

কাকু বললেন, “এটা একটা আদিবাসী সাধকের আসন ছিল বলে জানা যায়। ওরা একে বলে ‘ছায়াবেদী’। এখানে নাকি কোনো এক ঋষি তপস্যা করতেন, জঙ্গলের প্রাণীদের সঙ্গে কথা বলতেন।”

আমার তখন মনে হচ্ছিল যেন শিরদাঁড়ার ভিতর দিয়ে হাওয়া বইছে। ছায়াবেদী—এই শব্দটাই অদ্ভুত, অচেনা, অথচ যেন কোথাও শোনা।

অনিরুদ্ধ কাছে এসে বসে পড়ল পাথরের ওপর। বলল, “তুই কখনও দেখেছিস, কোন জায়গায় দাঁড়িয়ে মনে হয়, এই জায়গাটা তোর নিজের? আমি আজ সেটা অনুভব করছি।”

আমি কিছু বললাম না। চারপাশে একটা অস্বাভাবিক শান্তি। এমনকি পাখির ডাকার শব্দটাও যেন একটু বেশি গভীর হয়ে উঠেছিল।

হঠাৎ করে ঝোপের ভেতর থেকে একটা শব্দ হল। খুব হালকা, কিন্তু স্পষ্ট। আমরা তিনজনেই চুপ করে গেলাম। কাকু হাত তুলে বললেন, “নড়বি না কেউ।”

পাঁচ সেকেন্ড, দশ সেকেন্ড, তারপর দেখি ঝোপের ফাঁক দিয়ে একটা ছোট্ট চিতা ছানা আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। ভয় না পেয়ে, কৌতূহলে ভরা চোখ। সে তাকিয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত, তারপর ধীরে ধীরে সরে গেল।

কাকু বললেন, “এমন মুহূর্তই আমাদের সমস্ত শহুরে অহং ভেঙে দেয়। বুঝিয়ে দেয়, আমরা অতিথি মাত্র। ওদের রাজ্যে আমরা শুধু দেখতে এসেছি।”

আমার ভিতরটা কেমন যেন কেঁপে উঠল। আমি ভাবলাম, শহরে ফেরা সম্ভব হবে তো? এই অনুভব তো আর ফেলে আসা যায় না।

অনিরুদ্ধ তখন পাথরের গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে বলল, “তুই বুঝতে পারছিস তো, এসব আমাদের শুধু দেখার জন্য নয়। ডাক আছে। কেউ ডেকেছে, তাই আমরা এসেছি।”

আমি চমকে তাকালাম ওর দিকে। অনিরুদ্ধের মুখে একরকম আলো লেগেছে যেন। এই পাহাড়, এই বেদী, এই ছায়া—সব যেন তাকে আপন করে নিয়েছে।

কাকু বললেন, “সাবধানে থাকিস। যে জঙ্গল একবার ডাকে, সে সহজে ছাড়ে না।”

আমরা আরও কিছুক্ষণ বসে থাকলাম ছায়াবেদীর পাশে। সূর্য তখন উপরে উঠেছে, আলো ছায়ার সঙ্গে খেলছে গাছের গায়ে। কোথাও একটা মৌমাছি গুনগুন করছে, কোথাও পাতার ভাঁজে লুকিয়ে আছে গল্প।

আমরা জানতাম না, এই জঙ্গলের গল্প এখানেই শেষ নয়। বরং এটাই শুরু। কারণ সেই ছায়াবেদী থেকে ফেরার সময় আমরা যা দেখেছিলাম, তা আমাদের ভিতরটা চিরকালের জন্য বদলে দেবে।

৩. ছায়াবেদীর ছায়া

ছায়াবেদীর ধারে বসে থাকতে থাকতে কখন যে সময় পেরিয়ে গিয়েছিল, বুঝতেই পারিনি। জঙ্গল যেন একটা ঘড়ির মতো—কিন্তু এখানে সময় চলাচল করে অন্যভাবে। ঘড়ির কাঁটার মতো টিকটিক করে কিছু না বেজে, এখানে পাতার নড়াচড়া, ছায়ার লম্বা হওয়া, আর বাতাসের গন্ধই বলে দেয় কখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়।

সেই সময়, ছায়াবেদীর পেছনে একটা অদ্ভুত ছায়া পড়ে ছিল। ঠিক যেন কোনো মানুষ দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু সামনে কেউ নেই। আমি প্রথমে ভেবেছিলাম, চোখের ভুল। কাকু একটা কপালে ভাঁজ ফেলে বললেন, “এটা মাঝেমধ্যে পড়ে এখানে। সূর্যের অদ্ভুত কোণ আর গাছের পাতার ফাঁকে এমন ছায়া হয়। কিন্তু…”

“কিন্তু?” আমি জিজ্ঞাসা করলাম।

“অনেক সময়, গাইডেরা বলে, এখানে আসলে কেউ ছিল। বহু আগে, সেই সাধু। আর তার ছায়া এখনো এখানে রয়ে গেছে। সে ছায়া মাঝে মাঝে নিজেদের গল্প বলে।”

অনিরুদ্ধ তখন থেমে গিয়ে বলল, “কাকু, আপনি জানেন তো, আমি এসব বিশ্বাস করি না। কিন্তু আজ… জানি না কেন, যেন আমার নিজের ভেতর কেউ কথা বলছে। সেই ছায়ার মতোই, অদৃশ্য।”

আমি দেখলাম অনিরুদ্ধের চোখে জল টলমল করছে। ও এমন না। বরাবরই যুক্তির পক্ষে ছিল, বিজ্ঞান, তথ্য, প্রমাণ। কিন্তু আজ যেন সেই ছায়ার ভাষায় ওর মনের দেয়ালে কিছু লেখা হচ্ছে।

রঞ্জন কাকু চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলেন। উনি কিছু বলেননি, কিন্তু ওনার চোখে যে ভাব, তা বলছিল—এই জায়গাটা শুধু জায়গা নয়। এটা একটা প্রবেশদ্বার।

ছায়াবেদীর গা ঘেঁষে হালকা হাওয়া বইছিল। সেই হাওয়ার মধ্যে যেন কান পাতলে শোনা যাচ্ছিল ফিসফিস শব্দ। আমি একবার পেছন ফিরে তাকালাম, কিছু দেখলাম না। আবার ছায়ার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। ঠিক তখনই ছায়াটা নড়ল। এক মুহূর্তে সে যেন সরল, গড়িয়েও গেল না, শুধু নিজের জায়গা একটু বদলে নিল। আমরা কেউ কিছু বললাম না। গা ছমছম করে উঠল। রৌদ্র, হাওয়া, ছায়া—সব মিলিয়ে যেন একটা অশরীরী উপস্থিতি।

অনিরুদ্ধ ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। ওর মুখে কেমন একটা উদ্ভ্রান্ত ভাব। বলল, “আমাকে একটু একা থাকতে দাও। আমি একটু ভিতরে যাব। ওই পাথরের গহ্বরে।”

কাকু বললেন, “সাবধানে যাস। ঐ জায়গাটা খানিকটা বিপজ্জনক। আর একা গেলে গাছপালা মাঝে মাঝে পথ ভুলিয়ে দেয়।”

অনিরুদ্ধ কিছু বলল না। শুধু হেঁটে চলে গেল পাথরের গহ্বরের দিকে, যেখান থেকে একটা সরু গলিপথ জঙ্গলের গভীরে ঢুকে পড়েছিল। আমি বলতে চেয়েছিলাম—“থাম, একসাথে যাই”—কিন্তু যেন গলা দিয়ে শব্দ বেরোল না।

আমরা অপেক্ষা করছিলাম। মিনিট পনেরো। কুড়ি। আধঘণ্টা। কোনো শব্দ নেই, কোনো আওয়াজ নেই। কাকু একটু অস্থির হয়ে উঠলেন। বললেন, “চল, এবার খুঁজে দেখি ওকে।”

আমরা পাথরের ফাঁক গলে ঢুকলাম। গাছের পাতা ঘন হয়ে এসেছে। সূর্যের আলো একদম কম। হঠাৎ মনে হল, জঙ্গল ঘুমিয়ে পড়েছে, আর আমরা সেই নিদ্রার মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি।

একটা জায়গায় গিয়ে আমি থেমে গেলাম। সামনে একটা ভাঙা বটগাছ। গাছটা এমন ভাবে পড়ে আছে, যেন ইচ্ছা করে কেউ ফেলে দিয়েছে। সেই গাছের গায়ে খোদাই করা দাগ, যেন নখ দিয়ে আঁচড় কাটা। আর গাছের পাশে পড়ে ছিল অনিরুদ্ধের খাকি ক্যাপটা।

আমি ছুটে গিয়ে তুলে নিলাম। মুখ শুকিয়ে এল। “কাকু! ওর ক্যাপ!” চিৎকার করলাম।

কাকু ঘাড় ঘুরিয়ে বললেন, “ও এখানেই ছিল। খুঁজে দেখি আশপাশটা। কোনো চিহ্ন থাকলে হয়ত বোঝা যাবে।”

আমরা চারপাশ খুঁজতে লাগলাম। কিন্তু কিছুই নেই। শুধু একদিকে একটা গাছের গায়ে যেন লেখা—

“সে ফিরে আসবে না, কারণ সে ফিরে যেতে চায় না।”

আমি সেই লাইনটা পড়ে কেঁপে উঠলাম। হালকা, নখের আঁচড়ে লেখা। কিন্তু সোজা বাংলা ভাষায় লেখা এই বাক্যটা যেন আমার কানে গুলি চালাল।

কাকু এসে দাঁড়ালেন পাশে। বললেন, “এই জায়গা অনেক কিছু লুকিয়ে রাখে। কেউ কেউ হারিয়ে যায় এখানে। ইচ্ছে করে। ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা থাকে না, কারণ তারা এখানে নিজের সত্যিকে খুঁজে পায়।”

আমি চুপ করে ছিলাম। পেছনে ছায়াবেদীর দিকে তাকালাম। ছায়াটা এখন আরেকটু দীর্ঘ হয়ে উঠেছে। যেন ডেকে বলছে—“তোমার বন্ধুকে চাইলে, আমায় বোঝো।”

আমরা সারাদিন ধরে খুঁজলাম অনিরুদ্ধকে। কোনো চিহ্ন নেই, কোনো ডাকে সাড়া নেই, শুধু সেই গন্ধ—মহুয়ার, মাটির, পাতার, আর অচেনা এক অভিমানী নিঃশ্বাসের।

সন্ধ্যে নামতে আমরা ফিরে এলাম ছায়াবেদীর পাশে। আমি জানতাম, সে হারিয়ে গেছে। কিন্তু কোথায়, কীভাবে, কেন—সেই প্রশ্নের কোনো জবাব নেই। শুধু একটা অনুভব, যা হৃদয়ের গভীরে ঢুকে বসে আছে।

সেই রাতেই আমি প্রথমবার বুঝেছিলাম, ছায়া কেবল আলোর অভাব নয়। ছায়া অনেক সময় কারও উপস্থিতি, যাকে চোখে দেখা যায় না, কিন্তু যার গল্প শোনা যায় বাতাসে।

৪. গন্ধ ও গোপন কথকতা

সেই রাতটা আমি কখনও ভুলতে পারব না। ছায়াবেদীর সামনে বসে আমি আর রঞ্জন কাকু নিরুত্তর, স্তব্ধ। আমাদের চারপাশে গাঢ় জঙ্গল, নিঃশব্দ, অথচ কান পেতে থাকলে শোনা যায় পাতার ফিসফাস, অদৃশ্য প্রাণীদের নিঃশ্বাস, আর বাতাসে মিশে থাকা এক গোপন কথকতা। যাকে চোখে দেখা যায় না, কিন্তু সে কথা বলে—গন্ধ দিয়ে, ছায়া দিয়ে, সময় দিয়ে।

আমি মাথা গুঁজে বসে আছি। অনিরুদ্ধের হদিস নেই। কোথাও যেন গিলে নিয়েছে ওকে এই জঙ্গল, নিঃশব্দে, নিঃশর্তে। অথচ আমি কেমন ঠান্ডা হয়ে বসে আছি। কাঁদতে পারছি না, চিৎকারও করতে পারছি না। কাকু বলেছিলেন, “এইসব জায়গায় কান্না আসে না। শুধু অভ্যন্তরীণ চিৎকার হয়। ওটা বাইরের কেউ শুনতে পায় না।”

আমার মনে হচ্ছিল, কিছু একটা খুব গভীর স্তরে বদলে যাচ্ছে। ঠিক যেভাবে ঘুমের মধ্যে হঠাৎ করে স্বপ্ন বদলে যায়, অথচ তুমি কিছু করতে পারো না। ছায়াবেদীর চারপাশে তখনো হালকা গন্ধ—মহুয়ার, ধূপের, আর একটা অদ্ভুত সুগন্ধী যেটা আমি আগে কখনও পাইনি। সেটা যেন ধোঁয়া নয়, আবার হাওয়া নয়, কোথাও মধ্যবর্তী এক অস্তিত্ব।

রঞ্জন কাকু হঠাৎ বললেন, “তুই শুনতে পাচ্ছিস?”

আমি বললাম, “কি?”

“গন্ধটা কি বলছে, শুনতে পাচ্ছিস না?”

আমি মাথা ঘুরিয়ে কাকুর দিকে তাকালাম। উনি খুব শান্তভাবে বসে আছেন, চোখ বন্ধ, যেন কান পেতে শুনছেন কোনো পুরনো রেকর্ড।

“এই গন্ধগুলোর একটা ভাষা আছে। অনেকেই বোঝে না, কিন্তু আমি বুঝি। তোদের মতো কয়েকজনও বোঝে, যারা ভেতর থেকে তৈরি হয়ে আসে। অনিরুদ্ধ… হয়তো সে শুনে ফেলেছিল কোনো কথা, যা ওকে টেনে নিয়েছে।”

আমি বললাম, “কিন্তু কোথায় গেল ও?”

“জঙ্গলে কিছুই হারায় না। জঙ্গল যা নেয়, সে তার নিজের নিয়মে রাখে। আর যদি ফেরায়, তাও হয় তার ইচ্ছায়।”

সেই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে পড়ল—ছোটবেলায় একবার আমি মেদিনীপুরে এক আত্মীয়র বাড়ি গিয়েছিলাম। সেখানে এক রাতে একটা পাখির ডাক শুনেছিলাম—“কাউ…কাউ…” তখন বলেছিল ওদের কাজের লোক, “এই ডাকে কেউ সাড়া দিলে, জঙ্গল তাকে নিয়ে যায়।” আমি সাড়া দিইনি। কিন্তু সেদিন থেকেই এমন একটা টান অনুভব করতাম, যা শহর কাটিয়ে উঠতে দেয় না।

আমার মনে হলো, হয়তো আজ সেই ডাকেই আমি সত্যি সাড়া দিয়েছি।

কাকু একটা মোটা খাতা বার করলেন ব্যাগ থেকে। ধুলো ধরা, পাতাগুলো বাদামি হয়ে যাওয়া। বললেন, “এইখানে আমি লিখে রাখি সব। যাদের হারিয়েছি, যাদের পেয়েছি, যাদের পেয়েও হারিয়েছি। আজ তোর বন্ধুর নামটাও লিখতে হবে বোধহয়।”

আমি বললাম, “না কাকু। আমি এখনও বিশ্বাস করি, ও ফেরাবে।”

“তুই যদি সত্যিই চাস, তবে তোকে যেতে হবে গভীরে। জঙ্গলের ভেতরে, যেখানে শব্দও চুপ থাকে, সেখানে। কিন্তু সাবধান—সেখানে যা শুনবি, তা হয়তো তোর সারা জীবনের অভ্যন্তরকে বদলে দেবে।”

আমি কিছু না বলে ঘাড় নেড়ে সম্মতি দিলাম।

সেই রাতের কথা আমার আজও মনে পড়ে। আমি ঘুমোতে পারিনি। চোখ বন্ধ করলেই মনে হচ্ছিল, কেউ আমার পাশে বসে আছে, নিঃশব্দে। কে যেন নিঃশ্বাস নিচ্ছে আমার কানের পাশে, আবার কখনও মনে হচ্ছিল, গাছের ছায়া নড়ে উঠছে আমার দিকে।

ভোরবেলায় যখন আলো ফুঁটে উঠছিল, কাকু বললেন, “চল, আজ আমরা যাব জঙ্গলের ভেতরকার সেই জায়গায়, যেটা আদিবাসীরা বলে ‘চুপকথার বনে’।”

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “ওটা কোথায়?”

কাকু বললেন, “যেখানে পাখিরাও ডাকে না। যেখানে পাতারাও শব্দ করে না। যেখানে গন্ধ একমাত্র বার্তা।”

আমরা দুজন বেরিয়ে পড়লাম। পথ ছিল কাঁটাযুক্ত, ছোট ছোট ঝোপঝাড়ে ভরা। গাছের গুঁড়ির ওপর মশা বসে আছে, কাঁধের উপর দিয়ে উড়ছে নাম না জানা পতঙ্গ। হঠাৎ কোথাও একটা ছোট নদী পেরোলাম, জলটা কাচের মতো স্বচ্ছ। পায়ের ছোঁয়ায় ছোট মাছ ছুটে গেল। মনে হচ্ছিল, আমরা যেন কোনো বাস্তবের মধ্যে নেই, যেন স্বপ্নে হাঁটছি।

চুপকথার বন শুরু হয় একটা পাথরের বৃত্ত দিয়ে। সেখানে কিছু পুরনো কাঠি দাঁড় করানো, আর মাটির গায়ে ছাই ছাই রঙের দাগ। কাকু থেমে বললেন, “এখান থেকে আর কথাবার্তা না বলা ভালো। জঙ্গলের ভাষায় কথা বলা মানে চুপ থাকা। শুনতে শেখ।”

আমি মুখ বন্ধ করলাম। শুধু নাক দিয়ে শ্বাস নিচ্ছিলাম। তখনই আবার সেই গন্ধ। মহুয়ার মতো, আবার নয়। যেন সোঁদা মাটির সাথে মিশে গেছে কারও নোনতা স্মৃতি।

ঠিক তখনই হঠাৎ মনে হল—কেউ আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। আমি তাকালাম। কেউ নেই।

কিন্তু গন্ধটা বেড়ে উঠছে। একসময় মনে হলো, সেই গন্ধ দিয়ে একটা মুখ আঁকা যাচ্ছে। সেই মুখ… সেই চোখ… ওটা অনিরুদ্ধ!

কিন্তু আমি হাত বাড়ানোর আগেই সেই গন্ধটা মিলিয়ে গেল। শুধু রয়ে গেল একটা পাথরের গায়ে লেখা—

“আমার গল্প শুনতে এলে, তোমাকেও শোনাতে হবে তোমার গল্প।”

আমি স্তব্ধ হয়ে রইলাম। তখন বুঝলাম, শুধু খুঁজে পাওয়া নয়, জঙ্গল চায় বিনিময়। সে যা দেয়, তার জন্য সে কিছু নেয়।

আমি কি প্রস্তুত ছিলাম আমার গল্প শোনাতে? আমি কি তৈরি ছিলাম সেই বিনিময়ের জন্য?

কান পাতলে গন্ধের ভেতর দিয়ে তখনও যেন একটা কণ্ঠস্বর বলছিল, “এসো। সময় কম।”

৫. হারিয়ে যাওয়া শব্দের মানচিত্র

পাথরের গায়ে সেই লাইনটা পড়ে আমি দাঁড়িয়ে রইলাম বেশ কিছুক্ষণ—“আমার গল্প শুনতে এলে, তোমাকেও শোনাতে হবে তোমার গল্প।” জঙ্গলে যে কথার দাম আছে, সেটা এবার পরিষ্কার হল। শুধু শরীর নিয়ে আসা যায় না, সাথে আনতে হয় আত্মার কণ্ঠস্বর, যেটা এতদিন আমি চেপে রেখেছিলাম শহরের কোলাহলে।

রঞ্জন কাকু তখন কিছু বলছেন না। ওনার মুখে এমন এক রকম নিঃশব্দ সতর্কতা, যেন জঙ্গলের হাওয়ার গতিও বুঝে ফেলেছেন। আমি জানতাম, এবার আমার পালা। আমি যদি সত্যি অনিরুদ্ধকে ফেরাতে চাই, তবে আমার নিজের ভেতরের সেই অজানা দরজাটা খুলতেই হবে। যে গল্প আমি কাউকে কোনোদিন বলিনি, সেই স্মৃতির ভূগোলটা এবার বের করে আনতে হবে।

চুপকথার বনটা এক ধরনের ম্যাপ বা মানচিত্রের মতো সাজানো। কাকু বলেছিলেন, “এই জঙ্গলে কেউ হারায় না, যদি সে জানে কোন শব্দে কোন গন্ধ মিশে থাকে। এই মানচিত্র চোখে দেখা যায় না, শোনা যায়।”

সেই পাথরের বৃত্ত পেরিয়ে আমরা আরও ভিতরে গেলাম। সেখানে গাছের গায়ে সাদা ছাই দিয়ে আঁকা ছিল গোলক ধাঁধার মতো নকশা। প্রতিটা রেখার ভেতর ছিল শুকনো পাতার গন্ধ, কোথাও কোথাও ফুলের ছায়া, আর অনেকখানি নিঃশব্দতা।

হঠাৎ করেই মনে হল, আমি যেন একটা গানের মধ্যে হাঁটছি। যে গান শুনতে পাই না, কিন্তু যার তালে তালে আমার পা মুভ করছে। আমার শিরদাঁড়া ঠাণ্ডা হয়ে এল। আমি চোখ বন্ধ করলাম। কান পেতে রইলাম।

সেই মুহূর্তে আমার ভেতরে বাজতে শুরু করল এক পুরনো দৃশ্য—একটা জানলার ধারে বসে আমি, হাতে ছবি আঁকার খাতা, মা আমার পিঠে হাত বোলাচ্ছেন আর বলছেন, “তোর মধ্যে একটা জঙ্গল আছে রে। সে জঙ্গলকে আঁক। সেখানে কেউ কেউ হারিয়ে যাবে, কেউ কেউ ফিরবে।”

আমি ভুলেই গিয়েছিলাম এই স্মৃতিটা। কত বছর হয়ে গেছে মাকে হারিয়ে, সেই ছবির খাতা কখন কোথায় ফেলে এসেছি জানি না। কিন্তু আজ মনে পড়ল।

আমি চোখ খুললাম। গন্ধ আরও তীব্র হয়ে উঠেছে। যেন মাটির গায়ে ঝরাপাতার ঘ্রাণ, পুরনো কাগজ, ভিজে গাছের বাকল।

আমার চারপাশটা এখন ধূসর আলোয় ভরা। সূর্য এখানে পৌঁছয় না, অথচ আলো আছে। কেমন যেন গোধূলির চেনা আলো, কিন্তু সূর্যাস্ত হয়নি। গাছের ডালে বসে আছে একটা নিশীথ পাখি, চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে।

তখনই শুনতে পেলাম একটা খুব মৃদু ফিসফাস। প্রথমে মনে হল, বাতাস। কিন্তু মন দিয়ে শুনতে গেলে বোঝা গেল—এটা কারও কণ্ঠস্বর।

“তুমি কি সত্যি খুঁজতে এসেছ? নাকি কেবল দেখে যেতে?”

আমি জবাব দিলাম না। জানতাম, উত্তর এখানে মুখে নয়, ভেতর থেকে আসে।

আমি হাঁটতে লাগলাম সেই শব্দের পেছনে। একটা গাছের গুঁড়ির পাশে এসে থামলাম। সেখানে শিকড়ের গায়ে গন্ধের সঙ্গে এক ধরনের শব্দ—আবারও সেই গন্ধের ভাষা। সেই একই বার্তা, কিন্তু অন্য রকম ছন্দে—যেন কেউ অনুরোধ করছে, “শোনাও তোমার দুঃখ, তাহলে আমি তোমার বন্ধুকে ফেরাবো।”

আমি হাঁটু মুড়ে বসে পড়লাম। চোখ বন্ধ করে বললাম, “আমার দুঃখ কী? কাকে বলব?”

তখনই ভেতর থেকে বেরিয়ে এল সেই চাপা দেওয়া গল্প। ছোটবেলায় বাবা চলে গিয়েছিল চুপচাপ। কোনো চিঠি, কোনো বিদায় নয়। মা মুখে কিছু বলত না, শুধু রাতে বালিশ চাপা দিয়ে কাঁদত। আমি জানতাম, কিছু একটা ভেঙে গেছে।

সেই সময়, ক্লাস টুয়ে পড়া আমি, একদিন বইয়ের পেছনের পাতায় একটা জঙ্গল এঁকেছিলাম। বিশাল গাছ, সাদা হাতি, লাল পাখি, আর একটা ছায়ামূর্তি। আমি বুঝিনি, কেন এইসব আঁকছি। এখন বুঝি—আমার অবচেতন তখনই বুঝেছিল, আমাকে কোথায় যেতে হবে।

আমি এই গল্পটা চুপকথার বনকে বললাম। নিঃশব্দে। শব্দ ব্যবহার করলাম না, শুধু ভাবনায় ভরিয়ে দিলাম পরিবেশ।

সেই মুহূর্তে গাছগুলো কাঁপল না, পাখিরা ডাকল না, কিন্তু বাতাস হালকা উষ্ণ হয়ে উঠল। যেন কেউ একটা হাত রাখল আমার কাঁধে। আশ্বস্ত করল।

তখনই সামনে দেখা গেল অনিরুদ্ধকে।

একটি গাছের পাশে দাঁড়িয়ে আছে সে। চুপচাপ, নিশ্চল। চোখ দুটো বন্ধ। জামাকাপড় ধুলোয় ভরা। আমি দৌড়ে গিয়ে ওকে ছুঁয়ে ফেললাম। ও চোখ খুলল না। ঠোঁটের কোণে এক ফোঁটা হাসি।

“তুই ঠিক আছিস?” আমি ফিসফিস করে বললাম।

ও মৃদু গলায় বলল, “আমি গল্প শুনছিলাম। জঙ্গলের গল্প। নিজের গল্প। আর একটা কথা—তুই যে এসেছিস, জানতাম।”

আমি আঁকড়ে ধরলাম ওকে। শরীরটা গরম, ধ্বংস নয়, ফিরে আসার সম্ভাবনা।

ঠিক তখন কাকু এসে দাঁড়ালেন পেছনে। বললেন, “তোমরা নিজেদের গল্প শোনাতে পেরেছ। জঙ্গল এখন তোমাদের ফিরতে দেবে।”

আমরা ধীরে ধীরে পেছন ফিরলাম। চুপকথার বন পেছনে পড়ে থাকল। কিন্তু মনে হল, সে আমাদের একটা মানচিত্র দিয়ে দিয়েছে—যেটা শুধু অনুভব করা যায়।

যতদিন বাঁচব, সেই মানচিত্র থাকবে হৃদয়ের কোথাও। আর সেই গন্ধের ভাষা, সেই নিঃশব্দ কথকতা—আমার জীবনের গভীরতম কথোপকথন হয়ে থেকে যাবে।

৬. দালমার উত্তরপত্র

জীবনে কিছু কিছু মুহূর্ত থাকে, যেগুলো ঠিক ‘মুহূর্ত’ নয়—তারা একেকটা উত্তরপত্র, যা সময় আমাদের দিকে এগিয়ে দেয়। সেই চুপকথার বন থেকে যখন আমরা ফিরছিলাম, তখন আমাদের শরীর ক্লান্ত ছিল, কিন্তু মন অদ্ভুতভাবে হালকা। মনে হচ্ছিল, দালমা যেন আমাদের একটা খোলা চিঠি দিয়ে দিয়েছে—যার প্রতিটা লাইনে ছড়িয়ে আছে ছায়া, গন্ধ আর ফিরে পাওয়ার আশ্বাস।

অনিরুদ্ধ চুপচাপ হেঁটে চলেছে আমার পাশে। মাঝেমধ্যে চোখ বন্ধ করে শ্বাস নিচ্ছে গভীরভাবে, যেন বাতাসের মধ্যে কিছু খুঁজে নিচ্ছে। ওর মুখে সেই অস্থিরতা নেই, যা ছিল চিলমারিতে পৌঁছনোর প্রথম দিনটায়। বদলে গেছে ও। কিছুটা নরম, কিছুটা স্থির, আর অনেকটাই জঙ্গলের মতো—নীরব কিন্তু গল্পে ভরা।

রঞ্জন কাকু হেঁটে চলেছেন আমাদের একটু আগে। তাঁর মুখে কোনও কথা নেই, কিন্তু পায়ের চলনে এক ধরনের দৃঢ়তা। তিনি জানেন, এই সফর কেবল সাফারির নয়, আত্মার ভেতরকার একটা অভিযানের। আর সেই অভিযানের পথ আমরা তিনজনই অতিক্রম করেছি।

হেঁটে ফিরছিলাম আমরা ছায়াবেদীর দিক দিয়ে, কারণ পাথরকোট পেরিয়ে অন্য দিকের রাস্তা অনেক বেশি দুর্গম। তার চেয়ে এটাই ছিল পরিচিত, যদিও এখন আর কিছুই সত্যিকার অর্থে ‘পরিচিত’ মনে হচ্ছিল না। গাছের গায়ে গায়ে যেন দালমার নিজস্ব চিহ্ন, এবং সেই চিহ্ন আমরা সবাই বহন করে ফিরছিলাম।

হঠাৎ, অনিরুদ্ধ থেমে গেল। বলল, “দেখ, ওই গাছটা।” আমি তাকিয়ে দেখি, একটা বিশাল শালগাছ, গায়ে নখের মতো আঁচড় কাটা দাগ। কাকু বললেন, “এটা হল চিতা বাঘের চিহ্ন। এলাকা মার্ক করে গেছে। কাল রাতে এসেছে মনে হয়।”

অনিরুদ্ধ কিছুক্ষণ চুপ করে তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, “জানিস, আমার মনে হচ্ছে এই জায়গাটা আমাকে চিনে রেখেছে। এই গাছ, এই গন্ধ, এই আলো—সব যেন অনেক আগে কোথাও ছিলাম এমন বলে যাচ্ছে।”

আমি বললাম, “হয়তো তুই এখানেই ছিলিস কোনো জন্মে। হয়তো এই গাছটা তোকে দেখেছে, তুই দেখেছিস ওকে।”

কাকু হেসে বললেন, “কোনো কথা অতীত নয়। জঙ্গলের কথাগুলো সময় ছাড়িয়ে চলে। মানুষ ভাবে সে সময়ের দাস, কিন্তু প্রকৃতি জানে সময় একটা বাঁক—চাইলেই ফেরা যায়।”

চিলমারি পৌঁছতেই বিকেল নামল। লাল সূর্যের আলো কটেজের কাঠের গায়ে এক অদ্ভুত ছায়া ফেলছিল। সব কিছু একই রকম, কিন্তু তবুও অন্য রকম। যেন আমরা কটেজে ফিরিনি, কটেজই আমাদের মধ্যে চলে এসেছে।

আমি উঠে গিয়ে বারান্দায় বসলাম। সামনে দূরে পাহাড়ের রেখা, তার ওপর একটা একরঙা ধোঁয়া জড়ানো আলো। অনিরুদ্ধ পাশে এসে বসলো। বলল, “তোকে একটা কথা বলি?”

আমি মাথা নাড়লাম।

“যখন আমি হারিয়ে গেলাম, আসলে সেটা কোনো হঠাৎ ঘটনা ছিল না। আমার মন আগে থেকেই টানছিল সেই বনের দিকে। ছায়াবেদীর পেছনের সেই পথটা আমার মনে হচ্ছিল যেন পরিচিত। আমি ভেবেছিলাম, ওটা কেবল কৌতূহল। কিন্তু ওখানে পৌঁছে বুঝলাম, আমি একটা অপেক্ষার মধ্যে ছিলাম। যেন কেউ ডেকে বলছে, ‘তুমি তো আসবে, তাই তো গল্পটা বাঁচিয়ে রেখেছি।’”

আমি চুপ করেই থাকলাম।

“কিন্তু তুই এলে। তুই আমার গল্পের ভিতরে ঢুকলি। সেইজন্যই আমি ফিরতে পেরেছি।”

আমি বললাম, “আমরাও তো সেই গল্পে ছিলাম, হয়তো জানতাম না।”

সন্ধে নামার আগে রঞ্জন কাকু আমাদের ডেকে পাঠালেন। বারান্দার এক কোণে কাঠের পুরনো পেটিকেসের ভিতর থেকে তিনি বার করলেন একটা নীল খাম। বললেন, “জানি না বিশ্বাস করবে কিনা, কিন্তু এই খামটা আমি পেয়েছিলাম বহু বছর আগে পাথরকোট থেকে ফেরার সময়। তাতে কিছু লেখা নেই। কিন্তু ভিতরে একটা পার্চমেন্ট কাগজে হাতের লেখা। কে লিখেছে জানি না। আমি এই কাগজটা অনেককে দেখিয়েছি, কেউ বোঝে না, কেউ ভাবে বাজে কথা। আজ মনে হল, তোমাদের এটা দেখানো উচিত।”

আমরা খামটা খুলে কাগজটা বের করলাম। এক ধরনের ঝাপসা হরফে লেখা—

“যদি তুমি খুঁজে পাও, জানবে তোমাকেই খোঁজা হচ্ছিল। দালমা কাউকে ডাকে না, সে শুধু ফেরে তাদের কাছে যারা ফিরে আসতে জানে।”

এই লাইনগুলো পড়েই আমার সমস্ত শরীর কাঁপতে লাগল। অনিরুদ্ধ মুখ তুলে বলল, “এটা… এ যেন আমার মনের কথা।”

কাকু হেসে বললেন, “তোমরা হয়তো এই পাহাড়ে বারবার আসবে না। কিন্তু এই চিঠিটা তোমাদের হৃদয়ে থেকে যাবে। মনে রেখো, এই জায়গাটা শুধু গাছ-পাথর নয়। এটা একটা প্রতিস্মৃতি—তোমার নিজের, যা তুমি ভুলে গিয়েছিলে। দালমা তা ফিরিয়ে দেয়। তার জন্যই ওর ডাক ফিরে আসে। বারবার।”

রাতের খাওয়া শেষ করে আমি একা কটেজের পেছনের দিকে হাঁটতে গেলাম। চারপাশে রাতের গন্ধ, পোকামাকড়ের অল্প আওয়াজ, আর মাথার ওপর তারাভরা আকাশ। সেখানে দাঁড়িয়ে মনে হল, জীবনে বহুবার ঘুরে ঘুরে আবার নিজের কাছে ফিরে আসাই আসল সাফারি।

পেছন থেকে অনিরুদ্ধ এসে দাঁড়াল পাশে। ধীরে বলল, “তোকে একটা কথা বলি?”

আমি তাকালাম।

“আগামী বছরও আসবি তো?”

আমি বললাম, “তুই থাকলেই আসব। আর যদি না থাকিস, তাহলেও আসব। কারণ এই জঙ্গলে তোরা ছাড়া আর কিছুই আমার নয়, আর তোদের ছায়ার ভেতরেই আমি নিজের গল্পটা খুঁজে পেয়েছি।”

অনিরুদ্ধ চোখ বন্ধ করল। তারপর বলল, “তাহলে তো তুই নিজেরই উত্তরপত্র লিখে ফেলেছিস।”

আমি জানলাম, দালমা আজ আমায় ফিরিয়ে দিচ্ছে। শুধু একটা জঙ্গলসাফারি নয়, আমার জীবনের হারিয়ে যাওয়া মানচিত্র ফিরিয়ে দিচ্ছে।

৭. পাথরের ভাষা

পাহাড় মানে কেবল উঁচু-নিচু ভূমি নয়। পাহাড়ের শরীরে জড়িয়ে থাকে এক ধরনের পুরনো নীরবতা—যেটা শুনতে না পেলেও টের পাওয়া যায়। সেই নীরবতা ভাঙে না শব্দে, তা ফেটে পড়ে আলোয়, গন্ধে আর পাথরের ভাষায়। দালমায় কাটানো একদিনে আমরা শিখে গিয়েছিলাম, প্রতিটা পাথর আসলে একটা বাক্য, একটা ইতিহাস, একটা দীর্ঘশ্বাস।

পরের দিন ভোরবেলা রঞ্জন কাকু আমাদের ডেকে তুললেন। বললেন, “আজ এক জায়গায় নিয়ে যাব—সেখানে আমি আগে একবার গিয়েছিলাম, তারপর আর কখনও যাইনি। জায়গাটার নাম কেউ রাখেনি, কিন্তু আমি বলি ‘চুপ পাথরের গলি’। ওখানে গাছ কম, আলো বেশি, কিন্তু শব্দ নেই। কেউ নেই, তবু কেউ আছেও।”

আমরা চুপচাপ তৈরি হয়ে নিলাম। শরীরের ক্লান্তি থাকলেও মনে ছিল অদ্ভুত উৎসাহ। যেন এক অদৃশ্য হাত টেনে নিয়ে চলেছে। আমরা হাঁটছিলাম কাঁটা গাছের মাঝে দিয়ে, হালকা কুয়াশার ভেতর। অনিরুদ্ধ মাঝে মাঝে থেমে পড়ছে, কোনো পাথরের গায়ে হাত রেখে দাঁড়িয়ে থাকছে। আমি বুঝলাম, ওর ভেতরে একটা নতুন সংযোগ তৈরি হয়ে গেছে—কোনো গাছ বা প্রাণীর সঙ্গে নয়, পাথরের সঙ্গেই।

চুপ পাথরের গলিতে পৌঁছনোর আগে একটা শুকনো নদীখাত পেরোতে হয়েছিল। নদী ছিল না, কেবল বালি আর কিছু ভাঙা পাথরের টুকরো। কিন্তু সেই পাথরগুলো যেন গুঞ্জন করছিল—স্মৃতির ঢেউয়ে ভিজে উঠছিল কিছু অদৃশ্য বাক্য।

আমরা যখন গলিতে ঢুকলাম, তখন প্রথমেই লক্ষ্য করলাম—এখানে বাতাসের গতিও বদলে গেছে। না হাওয়া বন্ধ, না জোরালো, কিন্তু তাতে যেন শব্দের চলাচল নেই। যেন শব্দগুলো গিলে নিচ্ছে দেয়াল, পাথর।

দুই পাশে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল পাথরের গায়ে অদ্ভুত খোদাই। সরল রেখা, ত্রিভুজ, বৃত্ত, আর কিছু অচেনা প্রতীকের মতো দেখতে হরফ। রঞ্জন কাকু থেমে গেলেন একটা জায়গায়। বললেন, “এই পাথরটা আমার বহুদিনের বন্ধু। ১৯৮৯ সালে প্রথম এখানে এসেছিলাম। সেইদিনও এটা আমাকে কিছু বলেছিল।”

আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “পাথর কি কথা বলে?”

“সবাই শোনে না। কিন্তু যদি মন শোনে, তাহলে শব্দ লাগে না। পাথর শুধু তার শরীরের মধ্য দিয়ে একটা ভাষা পাঠায়। যার ভেতর সেই ভাষার ছন্দ আছে, সে বুঝে যায়।”

অনিরুদ্ধ তখন এক পাথরের সামনে বসে আছে। পাথরের গায়ে হাত রেখে বলছে, “এই জায়গাটা যেন চেনা লাগছে। আমি ছোটবেলায় এমন কিছু একটা দেখেছিলাম স্বপ্নে। এমন একটা গলি, পাথরের গায়ে খোদাই, আর আমি একা হাঁটছি…”

আমি পাশে গিয়ে বসলাম। বললাম, “হয়তো স্বপ্ন নয়, হয়তো স্মৃতি। জন্মের আগে বা জন্মের ফাঁকে কোথাও আমরা এগুলো দেখি। আর সেই দেখাগুলো ফিরে আসে যখন প্রকৃতি আমাদের ডাকে।”

আমরা বসে রইলাম অনেকক্ষণ। কিছু বলিনি। পাথর, আলো আর নীরবতা—তিনে মিলে যেন একটা শব্দহীন কবিতা রচনা হচ্ছিল। মাথার ওপর দিয়ে কয়েকটা ধবধবে সাদা প্রজাপতি উড়ে গেল। পাথরের ছায়ায় পড়ে তারা বসে রইল, যেন ওই অচেনা হরফগুলো পড়তে চাইছে।

রঞ্জন কাকু হঠাৎ ব্যাগ থেকে একটা ছোট্ট কাঁচের বাক্স বার করলেন। ভিতরে একটুকরো পাথর। গাঢ় ধূসর, অথচ একধরনের আলোর রেখা খেলে গেছে তার শরীরে। বললেন, “এটা আমি পেয়েছিলাম অনেক বছর আগে এখান থেকেই। বুঝিনি, কী এটা। পরে একজন নৃতত্ত্ববিদ বললেন, এটা একধরনের ‘মৃত কথার পাথর’। যারা কিছু না বলে চলে যায়, তাদের স্মৃতির আঁচর জমে এইরকম পাথরে।”

অনিরুদ্ধ বাক্সটা হাতে নিয়ে তাকিয়ে রইল। বলল, “কিন্তু এই পাথর কথা বলছে না। কেমন যেন চুপ…”

“সে চুপই তো ভাষা। সব শব্দ উচ্চারণ হয় না। কিছু শব্দ শুধু টের পাওয়া যায়। তোর ভেতর যদি প্রস্তুত থাকে, তবে তুই শুনতে পাবি।”

আমি একটু পিছিয়ে এলাম। গলির শেষপ্রান্তে একটা উঁচু পাথর দাঁড়িয়ে। তার গায়ে একটুকরো সূর্যের আলো এসে পড়েছে। মনে হল, ওটাই কেন্দ্র। ওটাই জঙ্গলের কবিতা।

আমি এগিয়ে গিয়ে হাত রাখলাম সেই পাথরের গায়ে। ঠান্ডা, স্থির, কিন্তু পলকের মধ্যেই আমার আঙুলের ছোঁয়া যেন কিছু খুলে দিল। চোখ বুজতেই মনে হল—আমি আর আমি নেই। আমি হয়ে গেছি এক কিশোর, যার হাতে কাগজ আর পেন্সিল, যার চোখে শালগাছের ছায়া, যার কানে শোনা যায় শীতের দুপুরের পাতাঝরা শব্দ।

আমি তখন আঁকছি—এই গলি, এই পাথর, এই প্রতীক। কিন্তু সে আঁকা শুধু কাগজে নয়, মনে, স্বপ্নে।

হঠাৎ পিছনে অনিরুদ্ধ বলল, “আমি বুঝতে পারছি। এই জায়গাটা আমায় বলছে—তুই ভুলে গেছিস, তোর একটা গল্প ছিল। সেই গল্প লিখতে হবে, না হলে তুই ফিরে যেতে পারবি না।”

আমি বললাম, “তাহলে লিখ। এখানেই বসে লিখ।”

আমরা দু’জন দু’দিকে বসে গেলাম পাথরের পাশে। অনিরুদ্ধ খাতা খুলে লিখতে শুরু করল। আমি শুধু চোখ বন্ধ করে শুনছিলাম—তার কলমের চলার শব্দ, পাতার ফিসফিস, আর পাথরের ভিতর দিয়ে আসা অতীতের কান্না।

এই চুপ পাথরের গলিই যেন আমাদের জীবনের উত্তরাধিকার। এখানে সময় নেই, আছে অনুভব। এখানে শব্দ নেই, কিন্তু আছে অর্থ।

অনেকক্ষণ পরে রঞ্জন কাকু বললেন, “চলো এবার। জঙ্গল যা বলার, বলেছে। এবার সে চুপ থাকবে। ওর চুপটাই আমাদের বহন করে।”

আমরা হাঁটতে শুরু করলাম পেছন দিকে। পেছনে রয়ে গেল গলি, পাথর আর এক ধরনের আলো যা চোখে নয়, মনে পড়ে।

আমি জানতাম, এই জায়গাটা আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। হয়তো জিপিএসে নেই, মানচিত্রেও নেই। কিন্তু আমাদের ভিতরে, ঠিক হৃদয়ের বাঁ দিকে, একটা কোণে, পাথরের গায়ে খোদাই হয়ে রইল সেই জঙ্গলের গল্প।

৮. অরণ্যের শোকগাথা

জঙ্গল শুধু রোমাঞ্চ নয়, ভয় নয়, বিস্ময় নয়—জঙ্গল এক শোকগাথা। সেই শোক না পাথরের মতো কঠিন, না নদীর মতো বহমান। সে শোক ঘাসের গায়ে জমে থাকে শিশির হয়ে, শুকনো পাতার ফাঁকে কান্না হয়ে, আর কিছু কিছু গাছে তার ছায়া লেগে থাকে চিরকাল। সেই দিন, চুপ পাথরের গলি থেকে ফেরার সময়, আমরা সেই অরণ্যের শোক প্রথমবার গায়ে মেখে অনুভব করেছিলাম।

সন্ধ্যা তখন নামছিল ধীরে ধীরে। আমরা হাঁটছিলাম সেই পুরনো পথ ধরে, যা ফিরে যাচ্ছিল চিলমারির দিকে। পেছনে পড়ে থাকছিল পাথরের প্রতীক, গাছের গায়ে লেখা সময়, আর কিছু না বলা অনুভব। রঞ্জন কাকু আমাদের বারবার বলছিলেন, “পেছনে তাকাস না। এ পথ শুধু সামনের। জঙ্গল যতটা দেয়, ঠিক ততটাই রাখে নিজের কাছে।”

আমরা চুপচাপ। অনিরুদ্ধ যেন আরও শান্ত হয়ে উঠেছে। ওর চোখে আর প্রশ্ন নেই, শুধু গভীর দর্শনের ছাপ। যেন এক অজানা শোক ওকে নিজের মতো করে গড়ে নিচ্ছে। আমি পাশে থেকে অনুভব করছিলাম, আমার বন্ধুটি আর আগের সেই শহুরে, রসিক অনিরুদ্ধ নেই। এখন ও যেন দালমারই সন্তান—গন্ধে, ঘামে, স্মৃতিতে।

ঠিক তখনই আচমকা বাতাস থেমে গেল। এমন এক নিস্তব্ধতা নেমে এল, যা আমরা গত কয়েকদিনেও পাইনি। পাখির ডাক নেই, গাছের পাতা কাঁপছে না, এমনকি বাতাসও যেন নিশ্বাস বন্ধ করেছে।

আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম। রঞ্জন কাকু থেমে বললেন, “এইখানেই একসময় একটা গ্রাম ছিল। অনেক আগে, হয়তো একশো বছরের বেশি। গ্রাম উঠে গেছে, লোক চলে গেছে, কিন্তু অরণ্যের কান্না রয়ে গেছে। এই জায়গাটা আমি বলি—‘শোকছায়া বন’। কারণ এখানকার ছায়ায় কান্না জমে থাকে।”

আমার গা শিউরে উঠল। বললাম, “গ্রামটা কি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে?”

কাকু বললেন, “না। কিছু চিহ্ন এখনও আছে। বিশেষত একটা গাছ, পুরনো মহুয়া। তার নিচে দাঁড়ালে এখনও কান্নার শব্দ শোনা যায়। তবে সেটা কান দিয়ে নয়, মন দিয়ে।”

আমরা তিনজনে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম সেই গাছের দিকে। সূর্য তখন আরেকটু নামছে, গাছের ছায়া লম্বা হয়ে পড়ছে আমাদের পায়ের তলায়। দূরে একটা ধোঁয়াটে সাদা আলো পড়ছিল পাতার ফাঁকে, যেন কেউ মশাল জ্বালিয়ে রেখেছে অন্ধকারের মুখোমুখি।

মহুয়া গাছটা এল একসময়। বিশাল, ছড়িয়ে পড়া শিকড়, গায়ে গেরুয়া ছোপ। তার গায়ে ঝুলছিল কিছু পুরনো কাপড়, কিছু পাথর বাঁধা দড়ি। রঞ্জন কাকু বললেন, “এই গাছটা ছিল গ্রামের কেন্দ্রে। এখানেই পূজা হত, এখানেই বিচার বসত। এখানেই একবার এক কিশোরীকে আত্মবলিদান দিতে হয়। কারণ, তার কথা কেউ শুনতে পায়নি।”

আমি চমকে উঠলাম। “কি বলছেন কাকু? আত্মবলিদান?”

“হ্যাঁ। ওরা বিশ্বাস করত, প্রতি শতাব্দীতে একবার জঙ্গলের কোনো আত্মা কাউকে ডাক দেবে। যার ডাক শোনা যাবে, তাকে সেই ডাকে সাড়া দিতে হবে। সেই মেয়েটি এক রাতে বলেছিল—সে স্বপ্নে শুনেছে ডাক। কেউ বিশ্বাস করেনি। শেষে সে নিজেই এক রাতে এখানেই গলায় দড়ি দেয়। পরদিন তার শরীর পাওয়া যায়নি। শুধু এই গাছের গায়ে লেখা ছিল—‘আমি শুনেছিলাম, তোমরা শোনোনি।’”

আমার মুখ শুকিয়ে গেল। আমি সেই গাছের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। মনে হল, সত্যিই গাছটার গায়ে ফিসফিস করে কিছু লেখা আছে। হাওয়ার সঙ্গে পাতাগুলোর নড়াচড়ায় সেই শব্দেরা যেন জীবন্ত হয়ে উঠছে।

অনিরুদ্ধ সামনে গিয়ে দাঁড়াল। ওর চোখ বন্ধ। তারপর ও গলা ছেড়ে বলে উঠল, “আমি শুনতে পাচ্ছি!”

আমি চমকে তাকালাম। ও বলল, “কে যেন বলছে—‘তোমরা যারা আসো, তারা কেন চলে যাও? আমি তো এখনও এখানে, অপেক্ষায়।’”

রঞ্জন কাকু সামনে এসে বললেন, “অনেক সময়, কিছু আত্মা সময় পেরিয়ে যায় না। তারা আটকে পড়ে কোথাও, কোনো শব্দে, কোনো গন্ধে, কোনো ছায়ায়। এই জায়গাটা সেইসব বঞ্চিত আত্মাদের জমে থাকা ঘর।”

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তাহলে কি আমরা ওদের মুক্ত করতে পারি?”

“না। আমরা কেবল শ্রোতা হতে পারি। ওদের কথা কেউ শুনলে, কিছুটা হালকা হয়। কিন্তু পুরোটাই মুক্তি নয়। অরণ্য কারও দুঃখ সম্পূর্ণ খালি করে না। শুধু ভাগ করে নেয়। তার জন্যই এখানে ছায়া এত ঘন।”

আমার মনে হল, এই জঙ্গল একটা বিশাল বুক, যার ভিতরে কোটি কোটি মানুষের না বলা কথা জমে আছে। কেউ নিজের গল্প কাউকে বলতে পারেনি, কেউ কাউকে ডাকতে পারেনি, কেউ কোনো অপেক্ষার শেষ দেখতে পারেনি। সেইসব অতৃপ্ততা জমে জমে শোক হয়ে রয়ে গেছে পাতার কোণে।

অনিরুদ্ধ একটা ছোট্ট পাথর তুলে নিয়ে গাছের গোড়ায় রাখল। বলল, “আমি জানি না, আমি কাকে বলছি। কিন্তু যদি তুমি থেকো, আমি তোমার কথা শুনছি। আমি ফিরে গিয়ে তোমার গল্প লিখব।”

আমার চোখ ঝাপসা হয়ে এল। ওর কাঁধে হাত রাখলাম।

রঞ্জন কাকু তখন বললেন, “চলো, আলো কমছে। শোক কখনও চিরকাল ধরে রাখে না, যেমন অরণ্যও করে না। সে নিজে থেকেই আলো ফেরায়। এখন ফেরার পালা।”

আমরা হাঁটতে শুরু করলাম। পেছনে পড়ে রইল মহুয়া গাছ, তার গায়ে লেখা সেই শব্দ—“আমি শুনেছিলাম।”

আর আমি জানলাম, আমরা শুধু জঙ্গলের দেখা দেখতে আসিনি। আমরা এসেছি শোনা কথা ফিরে নিয়ে যেতে। যেন গল্পের কারও একান্ত শ্রোতা হতে, আর অরণ্যের সেই শোকের মাঝে একটু আলো জ্বালাতে।

৯. শালগাছের নিচে স্বপ্ন

জঙ্গলে হাঁটতে হাঁটতে একসময় মানুষ বুঝে ফেলে—পথ আসলে একটা বাহানা, আসল গন্তব্য হচ্ছে নিজেকে খুঁজে পাওয়ার সেই মুহূর্ত, যেটা কোনও দিকচিহ্নে থাকে না। দালমা আমাদের কাছে ক্রমশ এক মানচিত্রে রূপ নিচ্ছিল, যেটা গাছের পাতায় লেখা, বাতাসে গুঞ্জন করা, আর স্বপ্নে আঁকা। সেই স্বপ্নই আজ আমাদের নিয়ে গেল এক শালগাছের নিচে—যেখানে ঘুম আর জেগে থাকার মাঝখানে এক চিলতে আলো পড়ে থাকে।

সেদিন আমরা খুব বেশি পথ হাঁটিনি। আগের রাতের শোকগাথার অভিজ্ঞতা শরীর ও মনে এমন ছায়া ফেলে গিয়েছিল, যে সকালের আলোতেও কেমন যেন একটা কুয়াশা লেগে ছিল আমাদের চারপাশে। অনিরুদ্ধ অনেকক্ষণ চুপ করে ছিল, মুখে কথা কম, চোখে অন্য জগতের ছায়া।

রঞ্জন কাকু বললেন, “আজ আমি তোদের এমন একটা জায়গায় নিয়ে যাব, যেখানে আমার জীবনের প্রথম স্বপ্ন আমি দেখেছিলাম—জেগে থাকতে। শালগাছের নিচে দাঁড়িয়ে হঠাৎ করে আমি বুঝেছিলাম, আমি কে। অনেক মানুষ বাঁচে, কাজ করে, ঘুমোয়… কিন্তু জানে না নিজের প্রকৃত পরিচয়। সেই গাছ আমায় বলেছিল—‘তুই শুধু কাকু না, তুই এক পুরনো গল্পের ধারক।’ সেই অভিজ্ঞতা আমার পেশার থেকেও বড়।”

আমরা হাঁটতে লাগলাম পুবদিকের ঢাল বেয়ে। জঙ্গল এখানে অন্যরকম—গাছগুলো অনেক উঁচু, পাতার ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো ফোঁটা ফোঁটা পড়ে মাটির উপর। দূরে কাঠবেড়ালির ছুটোছুটি, মাঝে মাঝে পাখির ডাক। কিন্তু সব কিছুই যেন আবছা, যেন স্বপ্নের মতো ফিকে।

কিছুক্ষণ পরেই আমরা এক শালবনের মধ্যে ঢুকে পড়লাম। পাতা পড়ে আছে গালিচার মতো, হালকা হলুদে-বাদামি রঙের ছোপ ছোপ মেঝে। বাতাসে একধরনের মাটি-ঘাম-মধুর মিশ্র গন্ধ। সেখানে দাঁড়িয়ে থাকলেই মনে হয়, সময় থেমে গেছে।

“এই গাছটা।” কাকু দেখালেন ডানদিকের একটা শালগাছকে। গায়ে মোটা ছাল, গাছের গোড়ায় মাটি একটু উঁচু হয়ে গোল হয়ে আছে। “এইখানেই আমি দাঁড়িয়েছিলাম। অনেক বছর আগে। তখন আমি নতুন চাকরিতে যোগ দিয়েছি, তরুণ, আত্মবিশ্বাসী, কিন্তু কিচ্ছু জানি না আসলে। একদিন সাফারির পর রাতে ঘুরতে ঘুরতে চলে আসি এখানে। এই গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে হঠাৎ আমার মনে হল—কারো চোখে আমি নিজেকে দেখছি। সেই চোখ আমার না, বাইরেরও না। একধরনের পুরনো স্মৃতি, যেটা আমি ভুলে গেছি, সেটা আমাকে দেখছিল। তোরাই বুঝবি, এই অভিজ্ঞতা বোঝানো যায় না।”

অনিরুদ্ধ হঠাৎ এসে গাছের গোড়ায় বসে পড়ল। বলল, “আমি এখানে ঘুমাতে চাই। জানি না কেন, মনে হচ্ছে এখানে ঘুমোলেই আমি কিছু দেখব। হয়তো আমার নিজের স্বপ্ন।”

কাকু কিছু বললেন না। আমি একটু দোটানায় ছিলাম, কিন্তু ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম, ও জানে ও কী করছে।

অনিরুদ্ধ শুয়ে পড়ল শালপাতার ওপর। গাছের গায়ে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করল। আমি ওর পাশে বসলাম। ওর নিঃশ্বাস ভারী হয়ে উঠছে, মুখের অভিব্যক্তি যেন ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে—চিন্তিত থেকে প্রশান্তির দিকে।

হঠাৎ কাকু নিচু গলায় বললেন, “অনেক সময় মানুষ জেগে জেগে যে স্বপ্ন দেখে, সেটাই আসল। ঘুমের মধ্যে যেগুলো আসে, সেগুলো শুধু জানলা খোলে। কিন্তু আজ ও হয়তো সেই জানলা দিয়ে ঢুকে যাবে ভেতরের এক ঘরে।”

আমি চুপ করে রইলাম। বাতাস তখন একেবারে নিস্তব্ধ, কেবল কয়েকটা শুকনো পাতার মৃদু নড়াচড়া।

সময় কেটে যাচ্ছিল, কেউ কিছু বলছে না। হঠাৎ, অনিরুদ্ধের ঠোঁটে একটুকরো হাসি ফুটল। ও চোখ খোলেনি, কিন্তু মুখে স্পষ্ট এক ধরনের শান্তি।

আমি ফিসফিস করে বললাম, “দেখছে ও কিছু?”

কাকু বললেন, “হয়তো। কেউ কেউ ঘুমের মধ্যে দিয়ে পুরনো জন্মের কোনো অংশে ফিরে যায়। দালমার মতো জায়গায় সেই পথ খুলে যায় সহজে।”

প্রায় তিরিশ মিনিট পর, অনিরুদ্ধ চোখ খুলল। আমি ওর দিকে ঝুঁকে বললাম, “কী দেখলি?”

ও ধীরে বলল, “আমি একজন চিত্রকর। আমি গুহার দেয়ালে আঁকছি—বাঘ, শিকার, আগুন। আমি একা, কিন্তু আমার পাশে এক মেয়ে দাঁড়িয়ে। তার চোখে ভয় নয়, কৌতূহল। সে বলে, ‘তুমি যদি হারাও, আমি তোমাকে খুঁজে পাব। কারণ তুমি গল্প আঁকো।’ তারপর আমি নিজেকে দেখি… এই আমি না, অনেক পুরনো আমি। আর আশ্চর্যের কথা—সেই গুহার পাশেই ছিল একটা গাছ। এই গাছটাই।”

আমরা থমকে গেলাম। কাকু বললেন, “দালমা অনেক সময় আত্মার প্রাচীন স্মৃতি খুলে দেয়। ও বলছে, তোরা দু’জনে পুরনো কাহিনির ধারক। ওর কাজ হচ্ছে আঁকা, তোর কাজ সেই গল্পকে শব্দে বেঁধে রাখা।”

আমি বললাম, “তাহলে তো আমাদের আবার আসতেই হবে। এই গাছ আমাদের ডাকছে।”

অনিরুদ্ধ উঠে বসে বলল, “এখানে আসার আগে আমি যা ছিলাম, তা একটা খোলস। এখন আমি জানি, আমার ভিতরে একজন ‘গল্পকার’ ঘুমিয়ে ছিল। আজ সে জেগে উঠেছে।”

আমি কাঁধে হাত রাখলাম ওর। বললাম, “তাহলে লিখি, ছবি আঁকি, শোনাই সেই সব গল্প, যেগুলো গাছের পাতা ফিসফিস করে বলে আমাদের কানে।”

কাকু হেসে বললেন, “তোমরা ফিরবে। কিন্তু মনে রেখো, যেখান থেকে ফিরছ, সেটা আর শুধুই দালমা নয়—এটা এখন তোমাদের অরণ্য। শালগাছের নিচে যে স্বপ্ন দেখা হয়, তা শুধু দেখা নয়, সেটা প্রতিশ্রুতি।”

আমরা চুপ করে রইলাম। আর সেই মুহূর্তে জানলাম, আমরা ঘুম থেকে জেগেছি।

১০. বনফেরা

ফেরার সময় এসেছিল। শালগাছের নিচে সেই স্বপ্ন, চুপকথার বন, মহুয়া গাছের কান্না—সব যেন আমাদের ভেতরে ঢুকে গিয়েছে এক একটি অধ্যায়ের মতো। এখন আর সেই রকম মনে হচ্ছিল না যে, আমরা কোনও জঙ্গল ঘুরে এলাম। বরং মনে হচ্ছিল, জঙ্গল আমাদের মধ্যে ঘুরে গেছে। আমাদের মন, আমাদের স্মৃতি, আমাদের শরীর—সবকিছুতে দালমা তার অরণ্য রেখে গেছে।

চিলমারি কটেজে ফিরে শেষ রাত কাটাতে গিয়ে অদ্ভুত এক নির্জনতা ঘিরে ধরল চারদিক। আমরা তিনজন, বারান্দায় বসে, শেষবারের মতো সেই দূরের পাহাড় দেখছিলাম। জঙ্গল তখন নিঃশব্দে নিশ্বাস নিচ্ছে। মাঝেমধ্যে শেয়ালের ডাক ভেসে আসছে, দূরে রাতচরা পাখিরা ডানা ঝাপটাচ্ছে। কিন্তু এসব শব্দ আর ভয় জাগাচ্ছিল না—তারা হয়ে উঠেছিল এক ধরনের সঙ্গীত, এক আত্মার ঘরবসতি।

অনিরুদ্ধ বলল, “কাল সকালে ফিরব… কিন্তু জানিস, ফিরে যাব কোথায় সেটা বুঝতে পারছি না। কলকাতা ফিরব, ঠিক আছে, কিন্তু আমি আর আগের আমি নেই। আমি সেই অনিরুদ্ধ নই যে এসে বলেছিল—‘বাঘ দেখব, ছবি তুলব’। এখন তো মনে হচ্ছে, বাঘ নয়, আমি নিজেকে দেখেছি।”

আমি বললাম, “তুই তো নিজেকে আঁকলি, আর আমি তোকে দেখে নিজের গল্পটা খুঁজে পেলাম। এমন বন্ধুত্ব বোধহয় আগেও ছিল, অনেক জন্ম আগে।”

রঞ্জন কাকু একটু হেসে বললেন, “তোমরা এখন গল্পকার আর শিল্পী নও শুধু। তোমরা হয়ে গেছ অরণ্যের দূত। এবার ফিরে গিয়ে যদি এই গল্পগুলো না শোনাও, তাহলে দালমা ব্যথা পাবে। এই জঙ্গলের সবথেকে বড় দুঃখ হল, তার কথা কেউ শোনে না। তার দেখা কেউ বয়ে নিয়ে যায় না।”

আমি গম্ভীর হয়ে বললাম, “লিখব। শোনাবো। কিন্তু এই পাহাড়টা যে আমাকে যে ভয় পেতেও শেখাল…”

“ভয়? কেন?” কাকু প্রশ্ন করলেন।

“ভয়—এই যে এতখানি অনুভব নিয়ে ফিরে যাচ্ছি, যদি আর ফিরতে না পারি! যদি ভুলে যাই এই গন্ধ, এই গাছের ছায়া, এই পাথরের ভাষা?”

রঞ্জন কাকু চুপ করে গেলেন। তারপর মৃদু গলায় বললেন, “জঙ্গল কখনও তোমাকে ভুলতে দেবে না। একবার যদি তার ভাষা শোনো, সে তোমার স্বপ্নে ফিরে আসবেই। শালপাতার ফাঁকে, রাতের নিস্তব্ধতায়, বইয়ের পাতার নিচে, কাগজে আঁকা ছায়ায়—সে থাকবে। ও নিজের কথা কখনও ছেড়ে দেয় না।”

রাতটা আমরা তিনজন খুব বেশি কথা না বলেই কাটালাম। ঘরের আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়লেও জানলার ফাঁক দিয়ে জ্যোৎস্নার মতো ঢুকে পড়ছিল সেই সব দেখা-না-দেখা অনুভব। আমি জানতাম, আমি আর কখনও শহরে ফিরে যেতে পারব না একেবারে। আমার হৃদয়ে দালমা ঢুকে পড়েছে—গভীর, গোপন, এবং চিরস্থায়ীভাবে।

সকালবেলা আমাদের গাইড এসেছিল জিপ নিয়ে। কাকু আমাদের আলাদা করে ডেকে বললেন, “তোমাদের দুজনের জন্য একটা উপহার রেখেছি।” তিনি আমাদের হাতে তুলে দিলেন দুটি ছোট চামড়ার বাঁধাই খাতা। বললেন, “এগুলো খালি। এগুলো ভরাবে তোমরা—তোমাদের শোনা গল্প দিয়ে। যখন লেখা শেষ হবে, জানবে তোমরা ফিরতে প্রস্তুত।”

আমি খাতা হাতে নিয়ে কাকুর দিকে তাকালাম। “আপনি কি আমাদের সঙ্গে আসবেন না?”

“আমার কাজ এখানেই শেষ। আমি তো কেবল পথ দেখাই। পথ শেষ হলে আমি ফিরে যাই। তোমরা এবার নিজেরাই পথ তৈরি করবে।”

গাড়িতে চেপে যখন নিচের দিকে নামছি, পেছনের গাছপালা সরে সরে যাচ্ছিল, ঠিক যেন কোনও চেনা মুখ আমাদের আড়াল থেকে তাকিয়ে বিদায় জানাচ্ছে। দূরে পাহাড়ের রেখা ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে যাচ্ছে, যেন এক স্বপ্ন চোখের সামনে থেকে সরে যাচ্ছে।

অনিরুদ্ধ পাশের সিটে বসে চুপচাপ খাতাটা খুলে বসে আঁকছিল। আমি ওর দিকে তাকিয়ে বুঝলাম, ওর ভিতর দিয়ে দালমা এখন কলম হয়ে বেরোচ্ছে। আর আমি জানি, ফিরে গিয়ে আমিও লিখব—ছায়ার ভাষা, গন্ধের উচ্চারণ, জঙ্গলের চোখ।

স্টেশনে পৌঁছে যখন ট্রেনের অপেক্ষায় বসে ছিলাম, তখনই হঠাৎ একটা ছায়া পড়ল আমাদের সামনে। আমরা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি, একজন আদিবাসী বুড়ো, মুখে গভীর রেখা, হাতে একগাছি মহুয়ার মালা। তিনি এগিয়ে এসে বললেন, “তুমি শালগাছের ঘুমে ঘুমিয়েছিলে?”

আমরা চমকে তাকালাম। অনিরুদ্ধ ধীরে মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ।”

বুড়োটি বললেন, “তুমি ফিরে এসেছ। ভালো। সবাই ফিরে আসে না। কিন্তু যারা ফেরে, তারা কখনও একা থাকে না। এই নাও, এই মালা রেখো। এটা ওখানকার গন্ধ রাখে। হারাবে না।”

তিনি চলে গেলেন, অদ্ভুত এক গতি আর নিঃশব্দতায়। যেন রেলস্টেশনে না, তিনি জঙ্গলেরই প্রতিনিধি।

আমরা মালাটা হাতে নিয়ে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। সেই গন্ধ—মহুয়ার, পাতার, ঘুমের, কান্নার, আঁকার আর লেখার—সব মিশে এক হয়ে আমাদের বুকের কাছে এসে গেঁথে গেল।

ট্রেন এল। জানলার ধারে বসে আমি খাতা খুললাম। প্রথম লাইনে লিখলাম—

“এই গল্প আমি বলছি না, আমাকে দিয়ে বলা হচ্ছে। জঙ্গলের কথা কেবল শব্দ নয়, সে আত্মার অনুবাদ।”

দালমা আমাদের ছেড়ে গেল না। সে আমাদের ভিতরে থেকে যাবে। যতদিন আমরা লিখি, আঁকি, দেখি আর স্বপ্ন দেখি।

আর বনফেরা?
তা আসলে কখনই শেষ হয় না।

সমাপ্ত

1000024708.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *