Bangla - প্রেমের গল্প

রাতজাগা সুর

Spread the love

রূপক হালদার


কোলাহল ভরা শহরের এক কোণে, কলেজস্ট্রিটের কাছের ছোট্ট একটি ক্যাফে রাতের অন্ধকারে আলোয় ঝলমল করে উঠেছিল। ক্যাফেটির দেয়ালজুড়ে ঝুলছিল পুরোনো ভিনাইল রেকর্ড, অচেনা বিদেশি ব্যান্ডের পোস্টার, আর এক কোণে রাখা ছিল ধুলো জমা পিয়ানো। আজকের রাতটা ছিল বিশেষ—ওপেন-মাইক নাইট। শহরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তরুণ-তরুণীরা তাদের গান, কবিতা বা গল্প নিয়ে আসে এখানে। দর্শকের ভিড় খুব বড় নয়, তবে উপস্থিত প্রত্যেকেই শিল্পের প্রতি টান অনুভব করে। ইশানি সেন, কালো শাড়ি পরা, মোটা ফ্রেমের চশমা চোখে, চুল খোলা, সেদিন ক্যাফেতে প্রথমবার অংশ নিতে এসেছে। কলেজ থেকে বেরোনোর পর থেকে নিয়মিত গান গেয়ে আসছে সে, কিন্তু এই ক্যাফের মঞ্চে ওঠা তার কাছে ছিল এক নতুন অভিজ্ঞতা। তার কণ্ঠে শাস্ত্রীয় সুরের আভাস থাকলেও আজকের জন্য বেছে নিয়েছিল এক আধুনিক ফিউশন—একটা পুরোনো রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুরের সঙ্গে হালকা জ্যাজ ছন্দের মিশ্রণ। মঞ্চে উঠেই সে চোখ বন্ধ করল, মাইক্রোফোনে ঠোঁট ছুঁইয়ে প্রথম সুর তুলল—শব্দটা ছড়িয়ে পড়ল যেন পুরো ঘরে আলো হয়ে। দর্শকেরা চুপ করে শুনছিল, আর ক্যাফের ম্লান আলোতে ইশানির গলার গভীরতা যেন এক অদ্ভুত আবেশ তৈরি করছিল। তার কণ্ঠের ভেতরে এক অচেনা টান ছিল—যেন অতীতের কোথাও থেকে ভেসে আসা সুর, যা বর্তমানকে কাঁপিয়ে দিচ্ছে।

এই সময়েই প্রবেশ করল অভীক রায়। বয়সে ইশানির থেকে সামান্য বড়, ছিমছাম গড়ন, এলোমেলো চুল আর কাঁধে ঝোলানো পুরোনো বাদামি গিটার—এই ছিল তার পরিচয়। ক্যাফের অনেকেই ওকে চিনত—অভীক প্রায়শই এখানে বাজাতে আসে, কিন্তু সেদিন সে প্রথমবার ওপেন-মাইক সেশনে অংশ নিতে মনস্থ করেছিল। নিজের নাম ঘোষণার আগেই, ইশানির গান শুনতে শুনতে, হঠাৎ তার মনে হল এই সুরের সঙ্গে তার গিটারকে মেলানো দরকার। সে এক মুহূর্ত থেমে গেল, তারপর সাহস সঞ্চয় করে সংগঠকের কাছে গিয়ে মাইক্রোফোনের পাশে দাঁড়াল। ইশানির চোখ তখনও বন্ধ, কণ্ঠে সুরের ঢেউ। অভীক গিটার হাতে নিল, প্রথমে আস্তে, তারপর ধীরে ধীরে তাল মিলিয়ে দিল ইশানির সুরের সঙ্গে। প্রথমে সবাই চমকে উঠল—হঠাৎ গিটারের এই যোগ হয়তো এক অচেনা হস্তক্ষেপ মনে হতে পারত, কিন্তু মুহূর্তের মধ্যেই তা হয়ে উঠল জাদুকরী। ইশানির কণ্ঠ আর অভীকের আঙুলের ছোঁয়ায় গিটারের তার যেন একে অপরকে খুঁজে পেল। গান এগোতে থাকল, একসময় যেন পুরো ক্যাফে নিস্তব্ধ হয়ে গেল। চায়ের কাপ ঠোঁটে থেমে রইল, মোবাইল ফোনের স্ক্রল বন্ধ হল, কেবল সুরের ঢেউ বাতাসে ভাসতে থাকল। আর তখনই ইশানি প্রথমবার চোখ খুলল—মঞ্চের আলোয় গিটারের তারের ওপারে তাকিয়ে দেখল অভীকের চোখ। এক মুহূর্তের জন্য সময় যেন থেমে গেল। গলা থেকে বেরোনো সুর আর আঙুলের ঝংকারে বাঁধা পড়ল এক নতুন সম্পর্ক, যা আগে কোনোদিনই ঘটেনি।

গান শেষ হওয়ার পর মুহূর্তের মধ্যে ক্যাফেতে হাততালির ঝড় উঠল। সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে—এতটা নিখুঁত ইম্প্রোভাইজেশন ক’জন করতে পারে? ইশানি প্রথমে অবাক হয়ে গেল, কারণ গান শুরু করার সময় সে একা ছিল, অথচ শেষে দাঁড়িয়ে আছে দু’জন—সে আর অভীক। মঞ্চ থেকে নামার পর ওদের মাঝে প্রথমবার কথোপকথন শুরু হল। অভীক হেসে বলল, “তোমার কণ্ঠে যেন অন্য এক পৃথিবী আছে, আমি নিজেকে আটকাতে পারিনি।” ইশানি একটু লজ্জা পেয়ে চোখ নামাল, বলল, “তুমি বাজাচ্ছিলে বলেই গানটা এত সুন্দর লাগছিল।” কথাগুলো ছিল ছোট্ট, কিন্তু ভেতরে ভেতরে দু’জনেই বুঝে গেল—এটা কোনো সাধারণ আলাপ নয়। তাদের সুরের মিলন কেবল সংগীতের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, এর গভীরে আরও কিছু আছে। চারপাশে যখন দর্শকেরা হাততালি দিয়ে প্রশংসা করছে, তখনও তাদের চোখে-চোখে একটা নীরব আলাপ চলছিল। শহরের রাতজাগা আলোয়, এক ক্যাফের কোণে, অচেনা দু’জন মানুষের প্রথম দেখা যেন হয়ে উঠল এক অদ্ভুত মেলবন্ধনের শুরু—একটি সম্পর্ক, যা সুর থেকে শুরু হয়ে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়বে জীবনের প্রতিটি ছন্দে।

***

ক্যাফের হাততালি, আলো, মঞ্চের জাদুকরী মুহূর্ত—সবকিছু ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল। ওপেন-মাইক শেষ হওয়ার পর দর্শকেরা একে একে বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছিল, আর সেই ভিড়ের মাঝেই ইশানি দরজা পেরোল। রাত তখন প্রায় সাড়ে দশটা। শহরের অন্ধকার রাস্তাগুলো হালকা হলুদ আলোয় ঢাকা, চারদিকে কেবল ট্যাক্সির হর্ন আর দূরের ট্রামলাইনের ঝংকার। ইশানি ব্যাগ কাঁধে নিয়ে ধীরে ধীরে হাঁটছিল, এখনও মনের ভেতর কাঁপছিল ক্যাফের মঞ্চের সেই মুহূর্ত। ঠিক তখনই অভীক দরজা ঠেলে বেরিয়ে এল, গিটার কাঁধে, চোখেমুখে একটা অবলীলার হাসি। “একটু হেঁটে যাবেন?”—খুব সহজভাবেই প্রশ্ন করল সে, যেন বহুদিনের পরিচিত। ইশানি প্রথমে অবাক হলেও সায় দিল। তারা পাশাপাশি হাঁটতে লাগল, চারপাশে শহরের কোলাহল ধীরে ধীরে কমে আসছিল, কেবল বাতাসে ভেসে আসছিল নরম রাতজাগা হাওয়া। দু’জনেই কিছুক্ষণ চুপ ছিল, কিন্তু সেই নীরবতাটা অস্বস্তিকর ছিল না, বরং আরামদায়ক, যেন তাদের অচেনাতেও একটা অলিখিত বোঝাপড়া তৈরি হয়ে গেছে। প্রথম কথা বলল অভীকই—“তুমি কি সবসময় এভাবে গান গাও? মনে হচ্ছিল, তোমার গলায় যেন একটা গল্প লুকিয়ে আছে।” ইশানি মৃদু হেসে উত্তর দিল, “গল্প হয়তো আছে, কিন্তু সবটা প্রকাশ করা যায় না।” কথাগুলো যেন রাতের অন্ধকার ভেদ করে বাতাসে ভেসে রইল।

তাদের আলাপ ধীরে ধীরে গভীর হতে লাগল। ইশানি জানতে পারল, অভীক ছোটবেলা থেকেই গিটার বাজায়। একসময় ব্যান্ড করতে চেয়েছিল, কিন্তু নানা কারণে সেটা আর এগোয়নি। এখন সে শহরের বিভিন্ন ক্যাফে, রাস্তায় বা বন্ধুদের সঙ্গে বসে সঙ্গীত চর্চা করে। ইশানি অবাক হয়ে দেখল, অভীক কতটা স্বাধীনচেতা—কোনো বাঁধন মানে না, সংসারের বা ভবিষ্যতের চিন্তা করে না, শুধু সঙ্গীত আর এই রাতজাগা শহরই যেন তার জীবনের পথপ্রদর্শক। অথচ ইশানির জীবন একেবারে আলাদা—পরিবারের চাপ, শাস্ত্রীয় গানের নিয়মকানুন, শিক্ষকের শাসন—সব মিলিয়ে সে এক বাঁধা নিয়মের ভেতরে বড় হয়েছে। অভীকের অবলীলার হাসি আর অগোছালো চুলে সে একরকম অদ্ভুত স্বাধীনতার ছাপ খুঁজে পায়। অভীক হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ বলল, “তুমি জানো, আমি মনে করি সঙ্গীত কোনো নিয়মে বাঁধা থাকতে পারে না। গিটার বাজানোর সময় আমি চাই আঙুলগুলো যেন নিজের ইচ্ছেমতো ছুটে বেড়ায়, ঠিক যেমন এই শহরের রাত।” ইশানি চুপ করে শুনছিল, মনে মনে ভেবেছিল—তার গানের জগতও কি এমন হতে পারত? হয়তো তার ভেতর লুকিয়ে থাকা টানাপোড়েনটাই আজকের এই রাতে অভীকের কথায় ধরা দিল। অভীকের চোখে সেই বেপরোয়া উজ্জ্বলতা ইশানিকে আকৃষ্ট করছিল, আর সে নিজেও অবাক হচ্ছিল এই দ্রুত টান অনুভব করে।

অন্যদিকে অভীকও ইশানিকে নতুনভাবে দেখছিল। মঞ্চে তার কণ্ঠ ছিল গভীর, যেন কোনো অদৃশ্য শক্তির সঙ্গে যুক্ত। এখন রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে তার সংযমী, শান্ত মাধুর্য আরও স্পষ্ট হচ্ছিল। অভীক লক্ষ্য করল—ইশানি কম কথা বলে, কিন্তু তার প্রতিটি কথার মধ্যে একরকম ভার আছে, যেন গানের মতো তার ভাষাতেও ছন্দ লুকানো। হাওয়ার দোলায় ইশানির চুল উড়ছিল, চশমার ভেতর থেকে চোখ মাঝে মাঝে আলোয় ধরা পড়ছিল—সব মিলিয়ে অভীকের মনে হচ্ছিল, সে যেন এক নতুন পৃথিবীতে ঢুকে পড়েছে। কিছুক্ষণ পরে তারা কলেজস্ট্রিটের এক ফাঁকা মোড়ে থামল, সেখানে একটা পুরোনো বুকস্টল বন্ধ হয়ে পড়ে ছিল। অভীক হেসে বলল, “এই শহরটা আমার কাছে অনেকটা গানের মতো। রাতে এর আলাদা ছন্দ বের হয়।” ইশানি তাকিয়ে রইল, আস্তে বলল, “তোমার গিটারের মতোই।” মুহূর্তটা ছিল অদ্ভুত—কোনো ঘোষণা নেই, কোনো প্রতিশ্রুতি নেই, কেবল দু’জন মানুষের ভেতরে জমে ওঠা এক নতুন সুরের শুরু। রাত গভীর হচ্ছিল, শহর তখনও জেগে ছিল, আর সেই রাতজাগা শহরের বুকেই জন্ম নিচ্ছিল এক অচেনা সম্পর্কের প্রাথমিক ছন্দ—যা কেবল সঙ্গীতে নয়, হয়তো তাদের জীবনেও একদিন বাঁধন হয়ে থাকবে।

***

দিন গড়িয়ে সপ্তাহ পেরোতে লাগল, আর ইশানি ও অভীকের সাক্ষাৎ যেন শহরের রাতের মতোই অভ্যাসে পরিণত হল। ক্যাফের ওপেন-মাইক-এর পর তারা প্রায় নিয়মিত জ্যাম সেশন শুরু করল—কখনও অভীকের ছোট্ট ফ্ল্যাটে, কখনও বন্ধুর স্টুডিওর কোণে। অভীকের গিটার-রুমটা ছিল অদ্ভুত এক জায়গা। চারপাশে দেয়ালে ঝোলানো নানা ধরনের গিটার—কেউ পুরোনো, কেউ আধুনিক; একপাশে খোলা জানালা, যেখান দিয়ে রাতের হাওয়া ঢুকে সুরের সঙ্গে মিশে যেত। ছাদ থেকে ঝুলছিল ছোট ছোট লাইট, যা নরম আলো ফেলত, যেন পরিবেশটা নিজেই সংগীতের জন্য তৈরি। ইশানি প্রথমবার যখন ওখানে গিয়েছিল, ভেবেছিল কেবল প্র্যাকটিস হবে, কিন্তু ধীরে ধীরে এই জায়গাটাই হয়ে উঠল তাদের দু’জনের গোপন আশ্রয়। গানের শুরু হত পরিশ্রম দিয়ে—রবীন্দ্রসঙ্গীতের ফিউশন, পুরোনো লোকগান নতুন ছন্দে, কখনও নিছক জ্যাজ—আর শেষ হত নিখাদ আনন্দে। মাঝেমধ্যে হঠাৎই গলা বসে যেত, গিটারের তার ছিঁড়ে যেত, হাসাহাসি চলত, আবার নতুন করে শুরু হত। ইশানি বুঝতে পারছিল, এই ঘরটায় এসে অভীক তার সমস্ত বাঁধন ভেঙে দিয়ে কেবল সুরে বেঁচে থাকে। আর সেই মুক্তির স্বাদ ধীরে ধীরে তাকেও টানছিল।

কিন্তু সুরের ভেতরেই জন্ম নিল অন্যরকম টান। এক রাতে গানের শেষে, যখন তারা দু’জন চুপ করে বসেছিল, ঘরে কেবল গিটারের ঝংকার ধ্বনিত হচ্ছিল, হঠাৎ এক অদ্ভুত নীরবতা নেমে এল। ইশানি মাইক্রোফোন সরিয়ে রেখেছিল, গলার ঘাম মুছছিল। অভীক তখন গিটারটা পাশে রেখে শুধু তাকিয়ে ছিল ওর দিকে। সেই দৃষ্টি ইশানির ভেতরে যেন অন্য এক অচেনা স্রোত বইয়ে দিল। এতদিন তারা শুধু সুরের ভেতরে মিশেছিল, কিন্তু সেদিন মনে হল সুরের ফাঁকে শরীরেরও টান আছে, যা তারা কেউই আর অস্বীকার করতে পারল না। অভীক ধীরে ধীরে কাছে এগিয়ে এল, যেন আঙুলের ছোঁয়ার মতোই হালকা একটা মুহূর্ত তৈরি করতে চাইছে। ইশানি প্রথমে একটু দ্বিধায় ছিল, কিন্তু তার শরীরও যেন অনিচ্ছায় সাড়া দিচ্ছিল। তাদের চোখে-চোখে ধরা পড়ছিল লুকোনো আকাঙ্ক্ষা। সঙ্গীতের মতোই সেই মুহূর্তে কোনো স্কোর লেখা ছিল না, সবই ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। বাইরে রাতের শহর নীরব হয়ে ছিল, ভেতরে শুধু নিঃশ্বাসের শব্দ আর অদ্ভুত এক ছন্দ বাজছিল, যা গানের থেকেও আলাদা, আবার গানের মতোই মুক্ত।

তারপর থেকে রাতগুলো দীর্ঘ হতে লাগল। গান এখনও থাকত, কিন্তু তার ফাঁকেই তৈরি হত শরীরের আর আবেগের মেলবন্ধন। ইশানি বুঝতে পারছিল, এই সম্পর্কটা তাকে অন্য এক অভিজ্ঞতার দিকে নিয়ে যাচ্ছে—যেখানে কেবল শিল্পী নয়, নারী হিসেবেও সে নিজের নতুন পরিচয় খুঁজে পাচ্ছে। অভীকও দেখছিল, ইশানি শুধু তার কণ্ঠ নয়, তার অস্তিত্বকেই ধীরে ধীরে নিজের ভেতর টেনে নিচ্ছে। কিন্তু এর মধ্যেই জন্ম নিল সূক্ষ্ম এক দ্বন্দ্ব—এটা কি নিছক আবেগ, নাকি সত্যিকারের প্রেম? তাদের মধ্যে শব্দের বিনিময় কম, বরং সুর আর শরীরের ভাষায় বেশি কিছু বলা হচ্ছিল। প্রতিটি রাত যেন তাদের আরও গভীর করে বাঁধছিল, কিন্তু সেই বাঁধনের ভিতরেই অনিশ্চয়তার সুরও বাজছিল। তবু, তারা থামেনি—কারণ দু’জনেই জানত, সুর আর শরীরের এই মিলনই তাদের একমাত্র সত্য। আর সেই সত্যের ঝংকার শহরের রাতজাগা আকাশের নিচে ধীরে ধীরে আরও প্রবল হয়ে উঠছিল।

***

দিনগুলো যতই এগোতে থাকল, ততই সুর আর সম্পর্ক একসাথে জটিল হয়ে উঠছিল। ইশানির জীবনে পরিবার ছিল এক অদৃশ্য অথচ প্রবল নিয়ন্ত্রক শক্তি। বাবা-মা দু’জনেই সঙ্গীতপ্রেমী, কিন্তু তাদের বিশ্বাস—সঙ্গীত মানে শাস্ত্রীয় সংগীত, গুরুজনদের পথেই হাঁটা, পরীক্ষায় নাম তোলা, আর ক্লাসিক্যালের রেওয়াজকে অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলা। ইশানি ছোটবেলা থেকে সেই রেওয়াজের মধ্যেই বড় হয়েছে, তাই তার গানের মধ্যে মাধুর্য আর শৃঙ্খলা এত স্পষ্ট। কিন্তু রাতের সেই গিটার-ঘর, অভীকের মুক্তির ছোঁয়া, আর তাদের একসাথে করা ফিউশন জ্যাম—সবকিছু মিলিয়ে ইশানির ভেতরে এক অদ্ভুত দ্বন্দ্ব তৈরি হচ্ছিল। তার গান এখন আর কেবল গুরুজনদের শিখিয়ে দেওয়া স্বরলিপির মধ্যে আটকে থাকতে চাইছিল না, নতুন এক মুক্তির পথ খুঁজছিল। অথচ এই মুক্তির খোঁজ পরিবারকে জানানো মানেই অস্বস্তি, মানেই কড়া আপত্তি। অনেক সময় রাতবিরেতে রিহার্সাল থেকে ফিরলে মা জিজ্ঞেস করতেন—“কোথায় এত রাত করছিস? এইসব ক্যাফে-সংস্কৃতি তো গানের শৃঙ্খলা নষ্ট করে।” ইশানি চুপ করে যেত, কারণ তার ভেতরে একদিকে পারিবারিক দায়বদ্ধতা, অন্যদিকে নিজের শিল্পীসত্তা—দুটোর মধ্যে টানাপোড়েন চলত প্রতিদিন।

অভীক এই দিক থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন জগতের মানুষ। তার কাছে সঙ্গীত মানে কোনো বাঁধন নয়—সে বিশ্বাস করত, নতুনের সঙ্গে পুরোনোর মেলবন্ধনেই সৃষ্টি হয় আসল সুর। তাই সে স্বপ্ন দেখত একটা ফিউশন ব্যান্ড গড়ার—যেখানে থাকবে গিটার, ড্রাম, বেস, সঙ্গে ইশানির কণ্ঠ; যেখানে রবীন্দ্রসঙ্গীত মিলবে রক-এর সঙ্গে, লোকসঙ্গীত মিশবে ব্লুজ-এর তালে। অভীক প্রায়ই রাতের আড্ডায় বলত, “দেখো, আমরা যদি একসাথে করি, তাহলে বাংলা সঙ্গীতের ভুবনটা বদলে দিতে পারি।” ইশানি তার কথায় মুগ্ধ হত, কিন্তু গভীরে গিয়ে ভাবলেই ভয় পেত। পরিবারের সামনে দাঁড়িয়ে সে কি বলতে পারবে, সে ক্লাসিক্যালের বাইরে বেরোতে চায়? সেই দ্বিধাই ধীরে ধীরে ছায়ার মতো তাদের সম্পর্কের ভেতর ঢুকে পড়তে লাগল। প্রথমদিকে ইশানি এড়িয়ে যেত, বিষয় পাল্টাত, কিংবা নীরবে অভীকের স্বপ্ন শুনত। কিন্তু এক রাতে, অভীক পরিকল্পনার খাতা মেলে ধরে বলল—“আমাদের এখনই শুরু করা উচিত, আমি already কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে কথা বলেছি। তুমি শুধু হ্যাঁ বললেই হবে।” ইশানি অবাক হয়ে তাকাল, বলল, “তুমি কি বুঝতে পারছো না, আমার পরিবার এটা কখনো মেনে নেবে না? আমার গুরুজিও আমাকে ত্যাগ করবেন। আমি এখনই সব ছেড়ে ফিউশন ব্যান্ডে নামতে পারব না।”

সেই মুহূর্তেই প্রথমবার ঝগড়া বাঁধল। অভীকের মুখ শক্ত হয়ে গেল, বলল, “তুমি কি সবসময় এভাবেই অন্যের কথায় চলবে? তুমি নিজে কি কিছু চাও না?” ইশানির গলায় কাঁপুনি এসেছিল, সে ফিসফিস করে বলল, “আমি চাই, কিন্তু আমি একা নই… আমার দায়বদ্ধতা আছে।” কথাগুলো যেন ঘরের নরম আলোকে মুহূর্তে ভারী করে দিল। অভীক রাগে উঠে দাঁড়াল, জানলার পাশে গিয়ে গিটার বাজাতে শুরু করল, কিন্তু সেই সুরে আগের মতো মুক্তি ছিল না—ছিল হতাশা আর চাপা ক্ষোভ। ইশানি চেয়ার থেকে নাড়াচাড়া করল না, শুধু তাকিয়ে রইল, মনে হচ্ছিল তাদের মধ্যে হঠাৎ করেই এক অদৃশ্য দেয়াল উঠে গেছে। এতদিন যে ঘরটা ছিল হাসি, সুর আর শরীরের মিলনস্থল, সেই ঘরেই প্রথমবার দ্বন্দ্বের ছায়া ঘনীভূত হল। বাইরে শহর তখনও জেগে ছিল, কিন্তু ভেতরে তাদের সম্পর্কের ছন্দে বেজে উঠেছিল অসামঞ্জস্যের সুর। সেই রাত থেকে তাদের দু’জনেই বুঝে গেল—সঙ্গীত শুধু মিলনের পথ দেখায় না, কখনও কখনও ভিন্ন পথে টেনে নিয়ে যায়, যেখানে প্রেম আর স্বপ্নের লড়াই এড়িয়ে যাওয়া অসম্ভব।

***

ইশানির জীবনে মায়া ছিল সেই বন্ধু, যাকে সে সবকিছু খুলে বলতে পারে। কলেজ জীবনের দিন থেকেই তাদের বন্ধুত্ব, একসাথে ক্লাস, একসাথে সঙ্গীতচর্চা, আর একে অপরের ভরসা হয়ে ওঠা। ইশানি যখন অভীকের সঙ্গে রাতজাগা শহরে ঘুরে বেড়াতে শুরু করল, গিটার রুমে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটাতে লাগল, মায়াই প্রথম টের পেল এই নতুন টান। এক বিকেলে, যখন দু’জন বসেছিল ক্যাম্পাসের পুরোনো ক্যান্টিনে, মায়া চুপ করে ইশানির মুখের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, “তুই অনেক বদলে গেছিস। আগের মতো গুরুজির ক্লাস, প্রতিযোগিতার প্রস্তুতি নিয়ে এত ভাবছিস না। অভীক কি তোকে অন্য দিকে টেনে নিচ্ছে?” ইশানি প্রথমে হেসে উড়িয়ে দিলেও মায়ার চোখে উদ্বেগ স্পষ্ট ছিল। মায়া জানত, অভীক প্রতিভাবান, কিন্তু তার ভেতরে একরকম দায়িত্বহীন স্বাধীনচেতা ভাব আছে। সে নিয়ম মানতে চায় না, ভবিষ্যতের পরিকল্পনায় আটকে থাকতে চায় না। আর ইশানি, যে সবসময় নিয়ম-শৃঙ্খলা মেনে চলেছে, সে যদি হঠাৎ সেই স্বাধীনতার ঘূর্ণিতে ভেসে যায়, তাহলে ভেঙে পড়ার সম্ভাবনাও প্রবল। সেই কারণেই মায়া ধীরে ধীরে সতর্ক করতে শুরু করল।

এক সন্ধ্যায়, যখন ইশানি রিহার্সাল শেষ করে মায়ার সঙ্গে ফিরছিল, মায়া সরাসরি বলে ফেলল, “দেখ, আমি তোকে আটকাতে চাই না। কিন্তু অভীককে আমি যতটা চিনেছি, ওর ভেতরে স্থায়িত্ব নেই। ওর কাছে প্রেমও একটা এক্সপেরিমেন্ট, যেমন সুরের মধ্যে মিশিয়ে দেয় নানা নতুন যন্ত্র। কিন্তু জীবন তো এক্সপেরিমেন্ট নয়, এখানে দায়বদ্ধতা লাগে। তোকে আমি কেবল এটাই বলতে চাই—সাবধানে থাকিস।” ইশানি কথাগুলো শুনে চুপ করে গেল। সে জানত, মায়া ভুল বলছে না। অভীক সত্যিই এমন, যে কাল কী করবে, আজ সে নিজেও জানে না। তার গিটার, তার সঙ্গীত, তার স্বপ্ন—সবই চলমান, অচেনা পথে হাঁটার মতো। অথচ ইশানির মনে হচ্ছিল, এই অনিশ্চয়তার ভেতরেই একটা অন্যরকম টান আছে। অভীকের সঙ্গ তাকে মুক্তির স্বাদ দেয়, নিজের ভেতরের অচেনা আবেগকে চিনতে সাহায্য করে। ইশানি বুঝতে পারছিল, মায়ার সতর্কতার পরও সে ইতিমধ্যেই প্রেমের গভীরে ডুবে গেছে। হয়তো দায়িত্বজ্ঞানহীনতা আছে, হয়তো ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত, কিন্তু এই মুহূর্তে তার হৃদয় অভীককেই বেছে নিয়েছে।

তবুও মায়ার সতর্কতার প্রভাব এড়িয়ে যাওয়া গেল না। রাতে যখন ইশানি একা ঘরে ফিরত, জানালার পাশে বসে শহরের আলো দেখত, তার মনে দ্বিধার স্রোত বইতে লাগত। একদিকে অভীকের সঙ্গে কাটানো রাতের সুরভরা মুহূর্ত, শরীর আর আবেগের অদ্ভুত জটিলতা, অন্যদিকে মায়ার চোখে ভেসে ওঠা শঙ্কা। ইশানি মাঝে মাঝে ভাবত, যদি সত্যিই মায়া ঠিক হয়? যদি অভীক একদিন হঠাৎই সরে যায়, কিংবা নতুন কোনো স্বপ্নে ভেসে যায়, তখন সে কোথায় দাঁড়াবে? কিন্তু এই প্রশ্নগুলো টিকত না বেশিক্ষণ—অভীকের হাসি, তার অবাধ স্বভাব, তার আঙুলের ছোঁয়ায় সৃষ্ট সুর, সবকিছু আবার ইশানিকে আবিষ্ট করে ফেলত। ফলে ইশানি নিজেকে এক অদ্ভুত দ্বন্দ্বের মধ্যে আবিষ্কার করল—যেখানে সতর্কতা আর প্রেমের টানাপোড়েন ক্রমশ তীব্র হয়ে উঠছে। সে জানত, প্রেমে পড়া মানেই সবসময় নিরাপদ পথ বেছে নেওয়া নয়; বরং অনেক সময় প্রেম মানে ঝুঁকি নেওয়া। আর সেই ঝুঁকিই কি এখন তার জন্য সবচেয়ে সত্যি হয়ে উঠছে না? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতেই ইশানি ধীরে ধীরে নিজের ভেতরে আরও গভীর এক যাত্রায় পা দিল।

***

শহরের সঙ্গীতমহলে অর্ণব চট্টোপাধ্যায়ের নাম নতুন নয়। তার প্রযোজনা করা অ্যালবামগুলো ইতিমধ্যেই একাধিকবার হিট হয়েছে, আর আধুনিক ফিউশন মিউজিকের জগতে তাকে একরকম পথপ্রদর্শক বলা চলে। অভীকের কাছে তাই সুযোগটা ছিল স্বপ্নপূরণের মতো। এক সন্ধ্যায় তারা দেখা করল—ক্যাফের অল্প আলো, চারদিকে ধোঁয়া আর কোলাহল, মাঝখানে অর্ণব বসে আছেন গম্ভীর মুখে। তার কণ্ঠস্বর ছিল স্থির, কিন্তু ভেতরে যেন এক ধরনের কর্তৃত্ব লুকিয়ে ছিল। তিনি অভীককে বললেন, “আমি তোমার বাজনা শুনেছি। তোমার মধ্যে আলাদা কিছু আছে। তুমি চাইলে আমি তোমাকে আমার নতুন প্রোজেক্টে নিতে পারি। বড় স্টেজ, নাম, পরিচিতি—সব পাবে।” অভীক শোনার পর মনে মনে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছিল। এতদিন ধরে যে স্বপ্ন সে বুনেছে, সেটা যেন হঠাৎ হাতের কাছে চলে আসছে। কিন্তু ঠিক তখনই অর্ণব শর্তটা স্পষ্ট করে দিলেন—“তবে একটা ব্যাপার আছে। তোমার ব্যান্ডে যদি কোনো ব্যক্তিগত সম্পর্ক জড়িয়ে থাকে, সেটা সমস্যা তৈরি করবে। আমি স্পষ্ট বলছি, ইশানির সঙ্গে যদি তোমার এত ঘনিষ্ঠতা থাকে, সেটা দূরে রাখতে হবে। না হলে এই প্রোজেক্ট সম্ভব নয়।”

অভীক যেন মুহূর্তে থমকে গেল। এতদিন ধরে সে আর ইশানি একসাথে রাত কাটিয়েছে সুরের খোঁজে, শরীরের টানে, আর অনিশ্চিত কিন্তু গভীর এক প্রেমে। এখন সেই সম্পর্ককে ত্যাগ করলেই কি স্বপ্নপূরণ হবে? অভীকের মাথায় দ্বিধা ঘুরপাক খেতে লাগল। একদিকে অর্ণবের দেওয়া প্ল্যাটফর্ম—যা হয়তো তার জীবনের সবচেয়ে বড় সুযোগ, অন্যদিকে ইশানির ভালোবাসা—যা তার সমস্ত সুরকে প্রাণ দিয়েছে। সেই রাতে বাড়ি ফিরে অভীক গিটার হাতে নিয়েছিল, কিন্তু আঙুলের সুরে কেবল অস্থিরতা ধরা পড়ল। ইশানিকে কিছু না বললেও তার ভেতরে দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে গিয়েছিল। পরদিন যখন তারা দেখা করল, অভীক দ্বিধার স্বরে বলল, “অর্ণবদা আমাকে সুযোগ দিতে চাইছে… কিন্তু…” বাক্যটা শেষ করার আগেই ইশানি অনুভব করল কিছু একটা বদলে গেছে। সে চোখ মেলে তাকাল, আর অভীকের চুপচাপ মুখ দেখে বুঝে গেল, এখানে একটা শর্ত আছে। অভীক কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর সত্যি জানাল। ইশানির বুকের ভেতরটা হঠাৎ করে চাপা যন্ত্রণায় ভরে গেল।

ইশানি তৎক্ষণাৎ কিছু বলল না, কিন্তু তার চোখে যে কষ্ট ফুটে উঠল, তা অভীক এড়িয়ে যেতে পারল না। কতদিন ধরে তারা একসাথে সুরের ভেতর দিয়ে স্বপ্ন দেখেছে, নিজেদের আলাদা জগত বানিয়েছে, আর আজ হঠাৎ করে সেই সম্পর্কই যদি অভীকের স্বপ্নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়? ইশানির কণ্ঠ কাঁপছিল, “তাহলে আমি কী? তোমার জীবনে শুধু একটা অস্থায়ী ছায়া?” অভীক প্রতিবাদ করতে চাইল, বলতে চাইল যে তা নয়, কিন্তু কথাগুলো গলায় আটকে গেল। সে নিজেও জানত না কোন পথ বেছে নেবে। তার ভেতরে এক অদ্ভুত অপরাধবোধ কাজ করছিল, অথচ স্বপ্ন হাতছাড়া করার ভয়ও সমান জোরে তাকে টানছিল। ইশানি চুপ করে ছিল অনেকক্ষণ, তারপর ধীরে ধীরে বলল, “আমি ভেবেছিলাম সঙ্গীত আমাদের আরও কাছে আনবে। কিন্তু দেখছি, এটাই আমাদের আলাদা করছে।” এই কথায় অভীকের বুকের ভেতরে হাহাকার উঠল, কিন্তু সে চুপ করে গেল। সেদিন রাতে ইশানি যখন বাড়ি ফিরল, তার মনে হচ্ছিল শহরের সমস্ত আলো হঠাৎ নিভে গেছে। প্রেম আর স্বপ্নের এই সংঘাত যেন তাকে ছিঁড়ে ফেলছে ভেতর থেকে। আর অভীক—সে বসে রইল তার গিটার হাতে, অথচ কোনো সুর খুঁজে পেল না, যেন তার আঙুলের সমস্ত শক্তি নিঃশেষ হয়ে গেছে। অর্ণবের আগমন তাদের জীবনে আলো নিয়ে এলেও, সেই আলোর সঙ্গে এসে পড়ল গভীর ছায়া, যা তাদের সম্পর্কের ভেতরে ফাটল ধরিয়ে দিল।

***

অর্ণবের আগমনের পর থেকেই অভীকের জীবন যেন এক নতুন গতিতে ছুটতে শুরু করল। রেকর্ডিং স্টুডিওর ভেতরে দিন-রাত কাটানো, নামী শিল্পীদের সঙ্গে মহড়া, বড় বড় মঞ্চের পরিকল্পনা—সবকিছুতে সে ব্যস্ত হয়ে উঠল। ইশানির সঙ্গে দেখা হওয়ার সময় কমতে লাগল, আর দেখা হলেও সেই উচ্ছ্বাস আর রইল না। আগে যেখানে রাতভর তারা সুরের ভেতর হারিয়ে যেত, এখন সেসব রাত কেবল ফাঁকা হয়ে গেল। অভীক বুঝতে পারছিল, সে ইশানিকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে, তবু নিজেকে আটকাতে পারছিল না। তার চোখে তখন কেবল সাফল্যের ঝলকানি, নাম আর পরিচিতির প্রতিশ্রুতি। অথচ ইশানি প্রতিটি মুহূর্তে সেই শূন্যতাকে আরও গভীরভাবে অনুভব করতে লাগল। ক্যাফের রাতগুলো, গিটার রুমের অন্ধকার আলো, একসাথে বানানো সুর—সব যেন হঠাৎ ফিকে হয়ে আসতে লাগল। অভীকের ব্যস্ততা ইশানির কাছে অচেনা দূরত্বে পরিণত হল। সে ভাবত, এই কি তবে প্রেমের শেষ? যে সুরে তাদের মিলন হয়েছিল, সেই সুরই কি আজ ভাঙনের আঘাত বয়ে আনছে?

ইশানি ক্রমশ ভেঙে পড়তে শুরু করল। তার ভেতরে জমে থাকা যন্ত্রণা তাকে কষ্ট দিচ্ছিল, কিন্তু বাইরে থেকে সে নীরব রইল। অভীকের সঙ্গে দেখা হলে সে হাসার চেষ্টা করত, কিন্তু চোখের ভেতরের অন্ধকার লুকোনো যেত না। সে অনুভব করছিল, যাকে ভালোবেসে সে নিজের স্বপ্নকে নতুন রূপ দিতে চেয়েছিল, সেই মানুষই তাকে অদ্ভুতভাবে ফেলে দিচ্ছে একা। মায়া মাঝে মাঝে পাশে এসে তাকে সাহস জুগাতো, বলত, “তুই পারবি, তুই আলাদা পথে হাঁটবি।” প্রথমে ইশানি বিশ্বাস করতে পারত না, কারণ তার ভেতরটা তখনও অভীকের স্মৃতিতে ভরা। কিন্তু ধীরে ধীরে সে বুঝতে শুরু করল, ভাঙন মানেই শেষ নয়। ভাঙন কখনও কখনও নতুন শুরুরও ইঙ্গিত দেয়। এক রাতে নিজের ঘরে বসে, গিটার হাতে নিয়ে যখন সে গান গাইল, তখন প্রথমবার মনে হল—সে একা হলেও অসম্পূর্ণ নয়। তার কণ্ঠে যে গভীরতা আছে, তা নিজেই তার পথ তৈরি করতে পারে। অভীককে হারানোর যন্ত্রণা তার গলার স্বরে আরও এক ধরনের শক্তি এনে দিল।

এই শক্তিই ইশানিকে এক নতুন পথে এগিয়ে নিয়ে গেল। সে এককভাবে গান গাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল, নিজের লেখা কথা আর সুর নিয়ে স্টেজে দাঁড়াল। প্রথম একক কনসার্টে যখন মঞ্চে উঠল, আলো তার মুখে পড়তেই তার বুক কেঁপে উঠল। তবে এবার আর পাশে অভীক ছিল না, ছিল না কারও গিটার, কেবল তার নিজের কণ্ঠস্বর আর মাইক্রোফোন। শ্রোতারা চুপ করে শুনছিল, আর ইশানি বুঝতে পারল, তার গানেই তার মুক্তি। প্রতিটি লাইনে, প্রতিটি সুরে সে যেন নিজের ভাঙা হৃদয়ের কথা বলে যাচ্ছিল। গান শেষ হতেই করতালিতে ভরে উঠল হল। সে প্রথমবার অনুভব করল, অভীক থেকে দূরে সরে গেলেও তার জীবন থেমে যায়নি। বরং এই ভাঙনই তাকে নতুন রূপ দিয়েছে, নতুন শক্তি দিয়েছে। শহরের রাতগুলো আবার জেগে উঠল, তবে এবার একা ইশানির কণ্ঠে। প্রেম ভেঙেছে, কিন্তু সুর ভাঙেনি—বরং সেই সুরই ইশানিকে আরও দৃঢ় করেছে। তার ভেতরে এক অদ্ভুত শান্তি এসে ভর করল, যেন সে অবশেষে বুঝতে পারল, ভালোবাসা হারালেও শিল্প হারায় না। আর সেই শিল্পই তাকে বাঁচিয়ে রাখবে, পথ দেখাবে, এগিয়ে নিয়ে যাবে এক নতুন ভোরের দিকে।

***

শহরের কোলাহলমাখা এক সন্ধ্যায়, ইশানির প্রথম বড় একক কনসার্ট শেষ হলো বজ্রধ্বনির মতো করতালির মাঝে। মঞ্চে আলো নিভে আসছিল, কিন্তু তার কণ্ঠস্বরের প্রতিধ্বনি এখনও ভাসছিল হলের দেয়ালে, মানুষের মনে। সে ব্যাকস্টেজে এসে বসেছিল, ক্লান্ত শরীর কিন্তু মন ভরে গেছে এক অদ্ভুত তৃপ্তিতে। হঠাৎই করিডরের ভিড় ভেদ করে এক পরিচিত ছায়া এগিয়ে এল—অভীক। অনেকদিন পরে তাকে দেখে ইশানির বুক কেঁপে উঠল। অভীক দাঁড়িয়ে ছিল অস্থির চোখে, যেন কিছু বলতে চাইছে কিন্তু ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। ইশানি এক মুহূর্তের জন্য স্থির হয়ে তাকিয়ে রইল, তারপর ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল। সেই চোখে এখনও একই আগুন, একই টান, যেটা প্রথম রাতের জ্যাম সেশনে সে দেখেছিল। অভীক মৃদু স্বরে বলল, “তুই আজ অন্যরকম হয়ে গেছিস, ইশানি। তোর গলায় আমি আগের সেই সুরই খুঁজে পেলাম, শুধু আরও গভীর, আরও তীক্ষ্ণ।” ইশানি কিছু বলল না, কিন্তু তার চোখে এক অদ্ভুত আভা ফুটে উঠল—ভালোবাসা আর কষ্টের মিশ্রণ।

তাদের মাঝে নীরবতা নেমে এলো, কিন্তু সেই নীরবতাই অনেক কথা বলে ফেলল। তারা দুজনেই জানত, সময় তাদের আলাদা করে দিয়েছে, কিন্তু আলাদা থেকেও ভেতরে ভেতরে তাদের সম্পর্ক বেঁচে আছে। ইশানি ধীরে বলল, “তুই চলে গেছিলি নিজের স্বপ্নের পেছনে। আমি ভেবেছিলাম, হয়তো সব শেষ।” অভীক মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল, গলায় অনুতাপের ভার, “আমি ভুল করেছিলাম। সাফল্য পেয়েছি, স্টেজ পেয়েছি, কিন্তু সেই সুর পাইনি যা তোকে ছাড়া তৈরি হয় না।” ইশানি শুনে অনুভব করল বুকের ভেতর জমে থাকা বরফ ধীরে গলছে। এতদিনের যন্ত্রণা, অভিমান, রাগ—সবকিছু সরে গিয়ে জায়গা করে দিল কেবল এক অনির্বচনীয় মমতা। বাইরে শহরের আলো টিমটিম করছিল, রাতের হাওয়া ভেসে আসছিল ব্যাকস্টেজের জানালা দিয়ে, আর তাদের দুজনকে এক অদ্ভুত আবেশে বেঁধে ফেলছিল। তারা বুঝতে পারছিল, এ প্রেম হয়তো অসম্পূর্ণ, হয়তো নিষিদ্ধ—কিন্তু সত্যিকার প্রেম তো এমনই হয়, নিয়মের বাইরে, পথের বাঁকে, যেখানে সমস্ত কিছুর বিরুদ্ধে থেকেও হৃদয়ের সুর বেঁচে থাকে।

সেদিন রাতে তারা আবার একসাথে বেরোল শহরের রাস্তায়। অচেনা আলো, ট্যাক্সির হর্ণ, ক্যাফের ভাঙা সুর, সবকিছুর মাঝেও তারা নিজেদের খুঁজে পেল। অভীক হাত বাড়িয়ে ধরল ইশানির হাত, আর সেই ছোঁয়ায় যেন দুজনের সব দূরত্ব মুছে গেল। কিন্তু ভেতরে ভেতরে একটা প্রশ্ন রয়ে গেল—এটাই কি তাদের শেষ রাত? নাকি এটাই নতুন যাত্রার শুরু? উত্তর কেউ জানত না। হয়তো আগামীকাল আবার দ্বন্দ্ব আসবে, হয়তো সমাজের নিয়ম তাদের আলাদা করে দেবে, কিংবা হয়তো তারা একসাথে নতুন সুরের জন্ম দেবে, যেটা আর কোনো ভাঙনে ভাঙবে না। ইশানি তার কণ্ঠে, অভীক তার গিটারে—রাতের শহর জুড়ে আবার জন্ম নিল এক নতুন সুর। কিন্তু সেই সুরের গন্তব্য কোথায়, কেউ জানে না। গল্প থেমে গেল এই প্রশ্নে—শেষ রাত, নাকি এক নতুন শুরুর প্রতিশ্রুতি? শহরের রাতজাগা হাওয়া শুধু সেই সুরটুকুই বহন করে নিয়ে গেল দূরে, অজানার দিকে।

****

1000059275.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *