Bangla - রহস্য গল্প

রাজবাড়ির নীচে রুদ্রনাথের খোঁজ

Spread the love

স্বপ্না বসাক


অধ্যায় ১: রুদ্রনাথের ছায়া

কলকাতার প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস বিভাগে এক টানা ক্লাস নিয়ে ক্লান্ত অধ্যাপক অরিন্দম মুখার্জি সেদিন সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে পেলেন এক অদ্ভুত মোড়া খাম—কোনো প্রেরকের নাম নেই, শুধু ছাপা হরফে লেখা “রুদ্রনাথ জীবিত!” খামের ভেতরে ছিল একটি ভাঁজ করা কাগজ, তাতে একটি সুস্পষ্ট নকশা—উত্তরবঙ্গের রায়গঞ্জের এক রাজবাড়ির তলায় সুড়ঙ্গের মানচিত্র। কৌতূহলে আঁচ করলেন, এটি সেই কিংবদন্তির সঙ্গে সম্পর্কিত, যা তিনি ছাত্রজীবন থেকে শুনে এসেছেন—একটি দেবমূর্তি, যার নাম “রুদ্রনাথ”, যা সেন রাজবংশের আমলে তৈরি এবং বলা হয়, এটি যার হাতে থাকবে, তার জীবন থেকে চিরতরে দারিদ্র্য সরে যাবে। যদিও তিনি একে লোককথা বলে এড়িয়ে গিয়েছেন, কিন্তু এই মানচিত্র এবং চিঠির ভাষা যেন তাঁর গবেষণার পাণ্ডুলিপির পাতায় নতুন আলো ফেলল। সেই মুহূর্তে দরজায় কড়া নাড়ল মৃণালিনী ঘোষ—তার প্রিয় ছাত্রী, মাস্টার্সে থিসিস করছে ভারতের লোককথার পুরাতাত্ত্বিক প্রভাব নিয়ে। অরিন্দম তার হাতে চিঠিটি তুলে দিলেন, এবং দুজনের মধ্যে শুরু হলো আলোচনা—যদি সত্যিই কিছু থাকে, তবে কীভাবে গবেষণামূলক একটি অভিযানের নামে তারা রাজবাড়ি পর্যন্ত যেতে পারে।

পরদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতত্ত্ব দপ্তরে একটি গবেষণা প্রস্তাব তৈরি করে উত্তরবঙ্গে যাওয়ার অনুমতি নেওয়া হয়। অরিন্দম ও মৃণালিনী রওনা হলেন ট্রেনে করে রায়গঞ্জের দিকে। পথে রেলগাড়ির জানালার পাশে বসে মৃণালিনী তার নোটবুকে ‘রুদ্রনাথ’ নিয়ে সম্ভাব্য তথ্য লিখে নিচ্ছিল—তাঁর অনুমান, এই মূর্তির শৈলী সম্ভবত পাল বা সেন যুগের মাঝামাঝি, এবং এটি শিবরূপী কোনও আঞ্চলিক দেবতার প্রতিরূপ। অরিন্দম চুপচাপ বাইরে তাকিয়ে ছিলেন, তবে তাঁর চোখে যেন এক আশ্চর্য আলো—এমন কিছু কি সত্যিই আছে যা ইতিহাস হারিয়ে দিয়েছে? রায়গঞ্জ স্টেশনে নেমে তারা চুপচাপ রিকশায় উঠলেন। শহর পেরিয়ে ধুলোবালির পথ, দু’পাশে সর্ষে খেত, ধীরে ধীরে পথ আরও নির্জন। ঘণ্টাখানেক পর এক বৃদ্ধ চালক বলল, “সাবধান বাবু, ওই রাজবাড়ির পেছনের কুয়োর ধারে গেলেই আজও কান্নার শব্দ শোনা যায়। কেউ খোঁজ করতে এলে ফেরে না।” এই কথা শুনে মৃণালিনী থমকে গেলেও অরিন্দম তাঁর কৌতূহলে অনড় রইলেন।

রাজবাড়ির সামনে পৌঁছেই এক গা ছমছমে অনুভূতি জাগল। গেট জংলা গাছপালায় ঢাকা, মূল ফটক প্রাচীন পাথরে তৈরি—জীর্ণ, কিন্তু তার ভেতরে যেন অতীতের গৌরব আজও ঘুমিয়ে আছে। সেখানে তাদের অভ্যর্থনা জানাল এক চুপচাপ যুবক—প্রতাপেশ্বর রায়, বর্তমান রাজপরিবারের উত্তরসূরি। তিনি জানালেন, সরকারীভাবে রাজবাড়ি তালাবদ্ধ, তবে তাদের গবেষণার উদ্দেশ্যে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। প্রতাপ তাঁদের দেখাল রাজবাড়ির ভেতরকার লাইব্রেরি, যেখানে পুরোনো বইয়ের মাঝে একটি ধূলিধুসর রেকর্ড পাওয়া গেল—একটি ‘রুদ্রনাথ দেবতা উৎসব’-এর উল্লেখ আছে, যার শেষে লেখা, “শেষ উৎসবে রক্তপাত ঘটেছিল, তারপর দেবতাকে মাটির নিচে শয়ন করানো হয়।” এটি পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘরের বাতাস যেন ভারী হয়ে এল। মৃণালিনী ফিসফিস করে বলল, “স্যার, আপনি কি মনে করেন দেবমূর্তিকে সত্যিই লুকানো হয়েছিল?” অরিন্দম জবাবে কিছু বললেন না, শুধু চোখে ছিল সেই রহস্যভরা হাসি।

রাতে তাঁরা থাকলেন রাজবাড়ির পুরোনো অতিথিশালায়। ঘরটির জানালায় বুনো লতা ঢুকে পড়েছে, মেঝেতে বাতাসে উড়ে আসা শুকনো পাতার স্তূপ। হঠাৎ রাত একটা নাগাদ মৃণালিনী শুনল দূর থেকে কুয়োর দিক থেকে কারও পদধ্বনি, যেন কেউ ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে সে দেখতে পেল এক ছায়ামূর্তি—কালো চাদরে মোড়া, মাথা নিচু করে এগিয়ে আসছে। কিন্তু যখন চোখ ঘষে আবার দেখল, তখন আর কেউ নেই। সেই রাতে তার ঘুম আর হয়নি। ভোরে সে অধ্যাপককে বলল ঘটনাটা, কিন্তু অরিন্দম বলেন, “মৃণু, রাতের কুয়াশা আর ভয় একসঙ্গে এসে মনকে বিভ্রান্ত করে। ইতিহাসের সত্যি অনেক সময় কল্পনার ছায়া হয়ে আসে।” কিন্তু মৃণালিনীর মনে প্রশ্ন দানা বাঁধতে শুরু করল—এটা কি নিছক কাকতালীয়, না কি তাদের যাত্রার শুরুতেই কেউ সতর্ক করে দিল?

অধ্যায় ২: রাজবাড়ির নীরবতা

পরদিন সকালবেলা মৃদু কুয়াশার মধ্যে রাজবাড়ির চত্বর যেন অতীতের ধুলোতে ঢাকা পড়ে ছিল। প্রতাপেশ্বর রায়, সাদাসিধে পোশাকে, অরিন্দম ও মৃণালিনীকে নিয়ে গেলেন রাজবাড়ির মূল প্রাঙ্গণে—যেখানে একসময় নাচ, গান আর সভার ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হত। এখন কেবল ছায়া, নিস্তব্ধতা আর পাখির ডাক। মৃণালিনী অনুভব করল, এই বাড়ির দেয়ালে যেন দৃষ্টিহীন কিছু চোখ আজও ঘুরে বেড়ায়। প্রতাপ বললেন, “আপনারা এসেছেন গবেষণার কাজে, আমি আপনাদের সবরকম সাহায্য করব, কিন্তু একটা কথা মনে রাখবেন—এই বাড়িতে কিছু জিনিস স্পর্শ করা ঠিক নয়।” সেই কথায় যেন অদৃশ্য সংকেত ছিল। অরিন্দম বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে লাইব্রেরির দিকে এগোলেন। প্রাচীন কাঠের তাকভর্তি হাতে লেখা ডায়েরি, রেকর্ড আর পুথি। মৃণালিনী একটি পুরাতন খাতা দেখতে পেল যেখানে লেখা ছিল: “১২৯৮ বঙ্গাব্দ। দেবতা আজ রক্ত চায়। দুঃস্বপ্নের রাত ঘনিয়ে আসছে।” খাতার পাতা রক্তের ছোপে ছাপা, যেন তখনকার কোনো দুর্ঘটনার স্মৃতি ধরে রেখেছে। অধ্যাপক সেই পাতা সাবধানে মোবাইল ক্যামেরায় ধারণ করলেন।

দুপুরে রাজবাড়ির পেছনের বাগানে হাঁটতে গিয়ে তারা এক অদ্ভুত জায়গায় পৌঁছায়—একটি মরা শালগাছ, তার গুঁড়ির পাশে বিশাল একটি কুয়া, যার পাড়ে পাথরের বেদি। প্রতাপ চুপচাপ দাঁড়িয়ে বলেন, “এখানে নাকি শেষ উৎসবের রাতে কিছু অঘটন ঘটেছিল। তারপর এই জায়গা বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিছু গুজব আছে, কেউ কুয়োর ধারে রাতে এলে তার নাকি স্বপ্নে এক দেবতা এসে বলে—‘আমাকে মুক্ত করো।’” অরিন্দম গম্ভীরভাবে মাথা নাড়লেন, কিন্তু মৃণালিনী অনুভব করল, কুয়োর ভেতর অন্ধকার যেন তাকিয়েই আছে তাদের দিকে। কুয়োর একপাশে তারা একটি প্রাচীন শিলালিপি দেখতে পেল—ধূলিমলিন কিন্তু তাতে স্পষ্ট লেখা “রুদ্রস্থল”—অর্থাৎ, রুদ্রনাথের অবস্থান। সেই সন্ধ্যায় মৃণালিনী তার নোটবুকে লেখে, “কুয়া, বেদি, শালগাছ—সব যেন এক বৃত্ত তৈরি করছে। ইতিহাস শুধু চোখে নয়, হৃদয়ে টের পেতে হয়।”

বিকেলের দিকে তাঁরা প্রথমবারের মতো দেখা পেলেন রাজবাড়ির পুরোনো কেয়ারটেকার গোবিন্দ হাজরার সঙ্গে—এক বৃদ্ধ, চুল-দাড়িতে সাদা ঝড়, হাতে বাঁশের লাঠি। তিনি এসে মৃদু কণ্ঠে বললেন, “আপনারা যারা রুদ্রনাথের নাম নেন, তারা কি জানেন তার চোখ কীভাবে তৈরি?” মৃণালিনী বিস্মিত হয়ে জানতে চায়, “কীভাবে?” গোবিন্দ ফিসফিস করে বললেন, “মানুষের অগ্নিপিণ্ড গলিয়ে—শোনা যায়। রুদ্রনাথ দেবতা রক্ত ভালোবাসে।” সেই কণ্ঠস্বরে কেবল গল্প নয়, এক অজানা আতঙ্ক ঢুকে যায়। কিন্তু অধ্যাপক চুপচাপ বলেন, “লোককথা ইতিহাসের ছায়া বহন করে। কিন্তু সত্য খুঁজে পেতে হলে সাহস লাগে।” গোবিন্দ যেন আর কিছু বলতে গিয়ে থেমে যান, বলেন শুধু, “রাত্রে শব্দ শুনবেন, ভয় পাবেন না। কিন্তু দরজা খুলবেন না।”

রাতে রাজবাড়ির বাতাস ভারী হয়ে এল। জানালার বাইরে জ্যোৎস্নায় কুয়াশার ভেতর ছায়ারা যেন হেঁটে বেড়াচ্ছে। মৃণালিনী বারবার খেয়াল করছিল জানালার ধারে ছায়ার চলাফেরা। ঠিক রাত তিনটের সময় হঠাৎ সে শুনতে পেল তিনটি মৃদু ঠকঠক শব্দ দরজার বাইরে। সাহস করে দরজার ফুটো দিয়ে উঁকি দিতেই সে দেখে, এক চাদরে মোড়া ব্যক্তি নিচু হয়ে রাজবাড়ির বারান্দায় বসে আছে, যেন তার নাম ধরে ডাকছে। মৃণালিনী ঘাবড়ে উঠে দরজা বন্ধ করে দেয়। ভোরে সমস্ত ঘটনা সে অধ্যাপককে জানায়। অরিন্দম আবারও বলেন, “তোমার অভিজ্ঞতা যদি সত্যিও হয়, সেটার ব্যাখ্যা আমরা হয়ত এখনই পাব না। তবে এটুকু নিশ্চিত, আমাদের অভিযানে কেউ বা কিছু বাধা দিচ্ছে।” অধ্যায়ের শেষ দৃশ্যে দেখা যায়—রাজবাড়ির পেছনে কুয়োর ধারে জমা জলকাদার উপর কোনও পায়ের ছাপ—তাজা, বড়, কিন্তু মানুষের নয়…

অধ্যায় ৩: মৃত শালগাছের নিচে

পরদিন সকালবেলা সূর্যের আলো রাজবাড়ির ভেতরে ঢুকতেই পারছিল না—দেয়ালের ফাটল আর জংলার পর্দা তার পথ রোধ করেছে। মৃণালিনী চুপচাপ বসে নিজের নোটবুকে আগের রাতের ছায়ামূর্তির কথা লিখছিল। অধ্যাপক অরিন্দম তখন লাইব্রেরির প্রাচীন দলিলগুলো ঘাঁটছিলেন। একটি দলিলে তিনি একটি ব্যতিক্রমী প্রতীক দেখতে পেলেন—এক রুদ্রমূর্তি, যার কপালে ত্রিনয়ন, হাতে ত্রিশূল, এবং পায়ের নিচে কয়েকটি দেহ—কিন্তু যা সবচেয়ে ভয়ঙ্কর, তা ছিল মূর্তির চোখ—রক্তবিন্দুতে রঞ্জিত। নিচে লিপিতে লেখা ছিল—“জাগ্রত রুদ্রনাথ, ত্যাগ ছাড়া শান্ত নয়।” অরিন্দম মুখ গম্ভীর করে বললেন, “এই মূর্তি শুধু পূজার নয়, এটা হয়ত কোনো তান্ত্রিক প্রক্রিয়ার কেন্দ্রবিন্দু ছিল।” মৃণালিনী প্রশ্ন করল, “স্যার, তাহলে কি এই মূর্তি কেবল প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন নয়, এর পেছনে ভয়ঙ্কর ইতিহাসও আছে?” অরিন্দম কোন জবাব দিলেন না, শুধু বললেন, “চলো, আজ কুয়োর দিকে গিয়ে দেখি, মৃত শালগাছের নিচে কিছু লুকানো আছে কিনা।”

বিকেল নাগাদ তাঁরা পৌঁছালেন সেই মৃত শালগাছের কাছে। গোবিন্দ হাজরা দূর থেকে তাকিয়ে থাকলেন, কিন্তু এগোলেন না। শালগাছটির গোড়ায় খুঁড়ে খুঁড়ে উঠল কিছু অদ্ভুত বস্তু—একটি ভাঙা রুদ্রাক্ষ মালা, কিছু পোড়া কাঠের টুকরো, এবং একটি ক্ষয়িষ্ণু কপার প্লেট। কপার প্লেটটির উপরের লেখাগুলো ছিল ভীষণ অস্পষ্ট, কিন্তু মৃণালিনী তার মোবাইলে ছবি তুলে পরে স্পষ্ট করার চেষ্টা করল। শালগাছের পাশে মাটি একটু নরম মনে হচ্ছিল, আর একটু খোঁড়ার পর উঠে এল একটি আধাফাঁটা মাটির পাত্র, যার মধ্যে ছিল—একটি ক্ষুদ্র মূর্তির খণ্ডিত অংশ। মূর্তিটির চোখ ছিল গর্তের মতো খালি, আর এক হাতে ত্রিশূল। অধ্যাপক উত্তেজিত হয়ে বললেন, “এটাই রুদ্রনাথ নয়, তবে এর কোনও উপাঙ্গ! আমরা ঠিক পথে এগোচ্ছি।” মৃণালিনী দেখতে পেল গাছের গায়ে ধারালো কিছু দিয়ে খোদাই করা কয়েকটি শব্দ—“শান্তির বিনিময়ে রক্ত। দৃষ্টির বিনিময়ে জ্ঞান।” সেই মুহূর্তে হঠাৎ এক হাওয়া বইল, যেন চারপাশে ছায়া ঘিরে ধরল তাদের।

সন্ধ্যা নামতেই রাজবাড়ির পরিবেশ একেবারে পালটে গেল। গোবিন্দ হাজরা তাদের জন্য কেরোসিন ল্যাম্প জ্বালিয়ে রেখে বললেন, “আজ রাতে কেউ বাইরে যাবেন না। মৃত শালগাছ জাগে পূর্ণিমার রাতে।” তাঁর কথায় যেন ভয় ঢুকে পড়ে মৃণালিনীর চোখে। রাত দশটার পর অরিন্দম তার ঘরে পুরনো কপার প্লেটের লেখা বিশ্লেষণ করছিলেন, আর মৃণালিনী বারবার জানালার দিকে তাকাচ্ছিল। হঠাৎ তার চোখে পড়ল—কুয়োর দিক থেকে এক মৃদু আলো আসছে, যেন কেউ ল্যাম্প হাতে আসছে সেই মৃত শালগাছের কাছে। মৃণালিনী কৌতূহলে জানালা খুলতেই চমকে উঠল—এক অন্ধকারময় শাখার মতো হাত জানালার গ্রিলে পড়ল, যেন কোনও অদৃশ্য ছায়া তার ঘাড় ছুঁয়ে দিয়ে সরে গেল। সে চিৎকার করে উঠে দাঁড়াল, কিন্তু বাইরে তাকিয়ে আর কিছুই দেখতে পেল না। অরিন্দম ছুটে এসে তাকে শান্ত করলেন। পরদিন সেই জায়গা থেকে একটি পুঁথির খণ্ড উঠে এলো—তাতে লেখা ছিল, “যে সন্ধ্যায় রুদ্রনাথের চোখ খুলে, সে রাত চিরকালের।”

পরদিন সকালে গোবিন্দ হাজরার মুখে এক পুরনো কাহিনি উঠে আসে—”বহু বছর আগে, রাজবাড়ির পুরোনো রক্ষকরা এক দেবমূর্তি লুকিয়ে ফেলেছিল এই শালগাছের নিচে, কারণ শেষ উৎসবে রাজবংশের কনিষ্ঠ রাজপুত্র ‘অগ্নিস্নানে’ নিহত হয়। বলা হয়, সেই মূর্তি মাঝে মাঝে রাতে চিৎকার করে ওঠে, ‘আমাকে মুক্ত করো’। তারপরে বহুবার কেউ সেই জায়গায় খোঁড়ার চেষ্টা করেছে, কিন্তু কেউ জীবিত ফেরেনি।” গোবিন্দ আরও বলেন, “রুদ্রনাথ যদি সত্যিই এই রাজবাড়ির নিচে থাকে, তবে তাকে শুধু খোঁজার সাহস নয়, ত্যাগের ক্ষমতাও চাই। কারণ সে দেবতা নয়, এক শক্তি—যার নিয়ন্ত্রণ হারালেই মৃত্যু নিশ্চিত।” অধ্যাপক এসব কথা শুনেও থামলেন না। বরং গভীর আত্মবিশ্বাসে বললেন, “এই ইতিহাসের গভীরে সত্যি যদি অন্ধকার থাকে, তবে তাও তুলে আনতে হবে আলোয়। কারণ সত্য চেপে রাখা যায় না। ইতিহাস যদি নীরব থাকে, আমাদেরই তাকে ভাষা দিতে হয়।”
আর তখনই ফোনে আসে এক সংবাদ—রাজবাড়ির কাছের জমিতে এক খননের সময় সন্ধান পাওয়া গেছে রক্তমাখা একটি চাঁদির রুদ্রমুদ্রা।

অধ্যায় ৪: প্রথম মৃত্যু

পরদিন সকালবেলা রাজবাড়িতে এক চাঞ্চল্যকর দৃশ্যের আবির্ভাব হয়। প্রতাপেশ্বরের কর্মচারীদের মধ্যে এক যুবক, নাম বিকাশ সাহা, অদ্ভুতভাবে নিখোঁজ হয়ে যায়। সে গতরাতে কুয়োর কাছে কাঠ সংগ্রহ করতে গিয়েছিল বলে জানিয়েছিল অন্য কর্মচারীদের। প্রথমে সকলে ভেবেছিল সে হয়তো মদ খেয়ে কোথাও ঘুমিয়ে পড়েছে, কিন্তু বেলা বাড়তেই রাজবাড়ির পেছনের ঝোপের পাশে তার নিথর দেহ পাওয়া গেল। মুখজুড়ে আতঙ্কের ছাপ, চোখ খোলা, আর গলার চারপাশে ছিল নখের আঁচড়ের মতো গভীর দাগ। তার ডান হাতটি কিছু ধরে রেখেছিল—খুলে দেখা গেল আধা-ধূসর, চাঁদির মতো ধাতুর তৈরি একটি মুদ্রা, যার এক পাশে লেখা “রু” আর অন্য পাশে আঁকা ত্রিনয়ন। মূর্তির অস্তিত্বের সম্ভাবনা এই প্রথম বাস্তবে প্রকাশ পেল, কিন্তু সেই সঙ্গে এলো মৃত্যু। গোবিন্দ হাজরা কাঁপা গলায় বললেন, “ওই তো বলেছিলাম, রুদ্রনাথ যার ডাক শোনে, তার জীবন নেয় বা নেয় মন!” অরিন্দম আর মৃণালিনী স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকলেন—যা শুরু হয়েছিল গবেষণার উদ্দেশ্যে, তা এবার মৃত্যু নিয়ে এসেছে।

স্থানীয় থানায় খবর দিলে এসে পৌঁছান ইন্সপেক্টর মানসী চক্রবর্তী—তীব্র যুক্তিবাদী, শহরের ব্যস্ত অফিসারদের মতো চোখে সন্দেহ, হাতে খাতা। প্রথমেই তিনি অধ্যাপক এবং মৃণালিনীকে জেরা করলেন—কেন তাঁরা এখানে, কাদের অনুমতি নিয়ে রাজবাড়িতে রয়েছেন, এবং মৃত যুবকের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক কী? অরিন্দম ঠান্ডা গলায় নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করলেন, কিন্তু মানসী বুঝতে পারছিলেন, এ কেবল ইতিহাসের খোঁজ নয়—এতে আছে কিছু লোভ, কিছু ভয়, আর অনেক গোপন কথা। রাজবাড়ির ভিতর ঘুরে ঘুরে তিনি খেয়াল করলেন দেওয়ালে কয়েক জায়গায় তাজা আঁচড়ের দাগ, এবং লাইব্রেরির টেবিলে একটি ছেঁড়া কাগজ, যেখানে লেখা—“রুদ্রনাথ জেগে উঠছে।” ওই দেহের পাশে পাওয়া রুদ্রমুদ্রাটি বিশেষজ্ঞদের পাঠানো হল বিশ্লেষণের জন্য। মানসী বললেন, “আমি অতিপ্রাকৃত বিশ্বাস করি না, কিন্তু কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে এসব ছড়াচ্ছে। আপনি যদি সত্যিই অধ্যাপক হন, তাহলে এমন মৃত্যুর মাঝে কীসের ইতিহাস খুঁজছেন, বলুন তো?”

বিকাশের মৃত্যুর খবর রাজবাড়ির আশেপাশের গ্রামে ছড়িয়ে পড়লে মানুষ ভয়ে রাজবাড়ির কাছেও আসা বন্ধ করে দেয়। বাজার থেকে সবজি আনা, জল নেওয়া—সব কিছুতে সমস্যা হতে শুরু করে। প্রতাপেশ্বর নিজের গাম্ভীর্য ভেঙে কিছুটা অস্থির হয়ে পড়েন। এক সন্ধ্যায় তিনি আলাদাভাবে অধ্যাপককে ডেকে বললেন, “রুদ্রনাথ আমাদের পরিবারে বহু বছর আগেও বিপদ এনেছিল। আমার ঠাকুরদার ভাই হঠাৎ একদিন এই কুয়োর ধারে খোঁজাখুঁজি করতে গিয়ে নিখোঁজ হন। কেউ বলে তিনি আত্মহত্যা করেন, কেউ বলে তিনি কিছু জিনিস দেখে পাগল হয়ে যান। আমি এই নিয়ে কিছুই জানাতে চাইনি আপনাদের, কিন্তু এখন যা ঘটছে, তাতে মনে হচ্ছে অতীত ফিরে আসছে।” অধ্যাপক বলেন, “প্রতাপবাবু, ইতিহাস যদি সত্য হয়, তাহলে আপনার অতীত আমাদের সাহায্য করতে পারে। আপনি আমাদের সাহায্য না করলে হয়ত আরও মৃত্যুর মুখে পড়তে হবে।” প্রতাপ অবশেষে মেনে নেন—রাজবাড়ির তলার সুড়ঙ্গপথের কথা, যা বহুদিন আগে বন্ধ করে দেওয়া হয়।

রাত্রি গভীর হতেই রাজবাড়ির দেয়ালে যেন শব্দের ধাক্কা লাগে—কেউ যেন সুড়ঙ্গের ভেতর ধাতব কিছু ঠুকছে বারবার। মৃণালিনী ভয় আর উত্তেজনায় জেগে ওঠে। সে জানালার ফাঁক দিয়ে দেখে, এক লোক কুয়োর কাছে দাঁড়িয়ে হাত তুলে কিছু বলছে, যেন প্রাচীন মন্ত্র উচ্চারণ করছে। তার গায়ে একটি চাদর, মাথা নিচু, মুখ দেখা যাচ্ছে না। হঠাৎ লোকটি অদৃশ্য হয়ে যায়। সেই রাতেই অধ্যাপক একটি পুরাতন মানচিত্রের অংশ আবিষ্কার করেন লাইব্রেরির ফাইল থেকে, যেখানে “রুদ্রস্থান”—এই শব্দটি চিহ্নিত করা হয়েছে কুয়া, বেদি ও লাইব্রেরির নিচে একটি কেন্দ্রবিন্দুর মতো। তিনি বললেন, “এই মানচিত্র আমাদের আরও কাছে নিয়ে যাবে।” অধ্যায়ের শেষ দৃশ্যে, এক বৃষ্টিভেজা সকালের আলোয়, রাজবাড়ির পেছনের কুয়োর পাড়ে পাওয়া গেল একটি রক্তমাখা কাগজ—তাতে অদ্ভুত লিপিতে লেখা ছিল:
“রুদ্র জাগ্রত। আর একটি আত্মা চাই।”

অধ্যায় ৫: সুড়ঙ্গের দরজা

বিকাশ সাহার মৃত্যুর একদিন পরেই রাজবাড়িতে এক ভারী নৈঃশব্দ্য নেমে আসে। প্রতাপেশ্বর রায় সকালবেলা একটি পুরনো লোহার চাবির গুচ্ছ অধ্যাপক অরিন্দমের হাতে তুলে দেন, বলেই ফেলেন, “আমার ঠাকুরদার কক্ষে রাখা এই চাবিগুলো অনেক বছর ধরে তালাবদ্ধ ছিল। আপনাদের খোঁজ চলুক, কিন্তু সাবধান থাকবেন। রাজবাড়ির নিচে যা আছে, তা আমাদের পরিবারকেও ক্ষমা করেনি।” অধ্যাপক চাবিগুলো হাতে নিয়ে বুঝতে পারলেন, এগুলো যেন সময়ের খোলা গুহার মুখ—যে পথে হয়তো এগিয়ে গেলেই অন্ধকার ভেদ করে ওঠে রুদ্রনাথের সত্যি। এরপর অরিন্দম ও মৃণালিনী লাইব্রেরির ভেতর খোঁজাখুঁজি করে একটি কাঠের তাকের পেছনে প্রাচীন ইটের প্রাচীর পায়, যার কিছুটা জায়গায় ইটগুলো আলগা। ধীরে ধীরে চাপ দিতে শুরু করতেই ধুলোর ঝড় তুলে খুলে গেল একটি গোপন দরজা—একটি সংকীর্ণ ও অন্ধকার সিঁড়ি নেমে যাচ্ছে নিচের দিকে। তাদের মোবাইলের আলোয় দেখা গেল সেই সিঁড়ির দেয়ালে পাথরে খোদাই করা একটি রুদ্ররূপ—চতুর্মুখী, চতুর্ভুজ, এবং তার চারদিকে মাথার খুলির মালা। মৃণালিনী ফিসফিস করে বলল, “স্যার, এটা তো স্পষ্টতই কোনও তান্ত্রিক রীতির দেবতা।”

সুড়ঙ্গের প্রবেশপথে তারা প্রথমে নামল না, বরং অধ্যাপক সেখানকার বায়ু পরিমাপ, কাঠামোর শক্তি ও ধ্বংসের আশঙ্কা বুঝতে চাইলেন। তিনি একটি ছোট ক্যামেরা যুক্ত ড্রোন নামিয়ে পাঠান সেই নিচের দিকে, যার লাইভ ফুটেজ মোবাইলে দেখা গেল—একটি দীর্ঘ পাথরের করিডোর, দু’পাশে পোড়ামাটির পাত্র, মাঝে মাঝে ধাতব স্তম্ভ, এবং করিডোরের শেষে বন্ধ দরজা যার গায়ে কিছু লিপি। লিপিগুলি পালি ভাষার একটি তান্ত্রিক শাখার। অধ্যাপক বললেন, “এটা একটা সম্পূর্ণ উপাসনাগৃহ ছিল, হয়ত গোপনে গঠিত, রাজবাড়ির চক্ষু এড়িয়ে। এই ধরণের মন্দিরে সাধারণত ত্যাগ, নির্জনতা ও তন্ত্রসাধনার ছায়া থাকে।” এই সন্ধ্যাবেলা গোবিন্দ হাজরা এলেন হেঁচকি তুলে, বললেন, “আপনারা নিচে নামবেন না। আমার বাবাও একবার এই সিঁড়ি দেখেছিলেন, তারপর তিনি একরকম পাগল হয়ে গিয়েছিলেন। চোখে শুধু আগুন দেখতেন। বলতেন—‘সে ডাকে, সে চায় আমাকে।’” মৃণালিনীর মুখ বিবর্ণ হয়ে গেল, কিন্তু অধ্যাপক শান্ত স্বরে বললেন, “ভয়ের ভিতরে যদি সত্যি থাকে, তাহলে সেখানেই আমাদের যেতে হবে।”

পরদিন রাতে, প্রতাপ, অরিন্দম ও মৃণালিনী একত্রে পরিকল্পনা করলেন সুড়ঙ্গে নামার। ইন্সপেক্টর মানসী চক্রবর্তী অনুমতি না দিলেও, অধ্যাপক জানালেন, “আমরা যদি এখন না নামি, তবে যা লুকিয়ে আছে, তা হয়তো আমাদের ওপর হামলা করবে।” গভীর রাতে তিনজনেই ছোট লাইট, রোপ ও ডেটা রেকর্ডার নিয়ে নামলেন সেই পাথরের সিঁড়ি ধরে নিচে। সুড়ঙ্গের ভিতর দমবন্ধ করা পরিবেশ—আদ্রতা, ছত্রাকের গন্ধ, আর মাঝেমাঝে অদ্ভুত মৃদু শব্দ। করিডোরের প্রাচীরের গায়ে ছিল বিভিন্ন সময়ের আঁকা চিত্র: এক পুরোহিত রক্ত দিচ্ছেন, এক মূর্তি আগুনের মধ্যে স্থাপিত, আর মানুষ কুয়োর দিকে হাঁটছে চোখ বন্ধ করে। এগিয়ে গিয়ে দরজায় যখন হাত দিলেন অধ্যাপক, তখন সে নিজে থেকেই কাঁপতে কাঁপতে খুলে গেল। তার ওপাশে এক অদ্ভুত বৃত্তাকার ঘর, যেটি একটি ভগ্ন উপাসনাগৃহ। ঘরের মাঝে এক খালি বেদি—মাঝখানে শূন্যতা। বেদির পাশে একটি পাথরের ফলকে লেখা—“রুদ্রনাথ স্থানান্তরিত। শক্তি এখনও বর্তমান।” চারদিকে ছড়ানো রক্তমাখা কাপড়, ধাতব বাটি, এবং এক কোণায় পড়ে থাকা আধা-পোড়া একটি চিঠি, যাতে ইংরেজিতে লেখা ছিল:
“We hid Him where fire doesn’t reach, and wind doesn’t whisper.”

তারা যখন উপরের দিকে ফেরার চেষ্টা করছিল, তখন হঠাৎ সুড়ঙ্গের শেষপ্রান্ত থেকে শোনা গেল একধরনের কর্কশ গর্জন। প্রতাপ ভয় পেয়ে পড়ে যান, মৃণালিনী সাহায্য করতে এগিয়ে গেলে দেখে দেওয়ালের গায়ে হাতের ছাপ ফুটে উঠছে—তাজা, লাল রঙে। সে ভয় পেয়ে চিৎকার করে ওঠে। তারা উপরে উঠে দরজা বন্ধ করতে না করতেই নিচ থেকে যেন কারা গায়ে হাত ঠুকছে দরজায়, যেন ছুটে আসছে কিছু। অধ্যাপক রুদ্ধ কণ্ঠে বলেন, “সেই বেদি খালি, কিন্তু কিছু একটা এখনও সক্রিয়—যা ‘তাকে’ রক্ষা করে।” অধ্যায়ের শেষ মুহূর্তে, রাতের অন্ধকারে রাজবাড়ির ছাদ থেকে নিচে তাকিয়ে দেখা যায় সেই ছায়ামূর্তি, কালো চাদরে মোড়া, হাতে রুদ্রাক্ষ ঝোলানো মালা, মুখহীন, কিন্তু দৃষ্টি যেন গেঁথে যাচ্ছে… আর রাজবাড়ির নিচে তখন বাতাস থমকে যায়। যেন রুদ্রনাথ আবার হাঁপিয়ে উঠছে জেগে ওঠার জন্য।

অধ্যায় ৬: ইতিহাসের রক্তপাত

পরদিন সকালবেলা রাজবাড়ির চারপাশে পরিবেশ কেমন যেন রুক্ষ হয়ে উঠল। পাখিরা ডাকছে না, বাতাসে যেন কোনো অদৃশ্য ভার। অধ্যাপক অরিন্দম, রাতের সেই সুড়ঙ্গযাত্রার পর এখনও স্তব্ধ, কিন্তু তার চোখে আজ এক অদ্ভুত তীব্রতা। মৃণালিনী পুরো রাত না ঘুমিয়ে সেই পোড়া চিঠির বাক্য নিয়ে ভাবছিল—“We hid Him where fire doesn’t reach, and wind doesn’t whisper.” মানে কোথায় লুকানো হয়েছে রুদ্রনাথকে? অগ্নি যেখানে পৌঁছায় না, বাতাস যেখানে নেই—এমন জায়গা রাজবাড়ির কোথায় থাকতে পারে? লাইব্রেরির সেই পুরাতন নকশাটি ফের বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তারা লক্ষ করল, কুয়োর নিচে একটা গোপন প্রকোষ্ঠ দেখানো হয়েছে, যেটি আগুন বা আলোয় পৌঁছায় না। এই জায়গাটিকেই হয়তো বোঝানো হয়েছে। আর তখনই গোবিন্দ হাজরা এসে জানালেন এক বিস্ময়কর তথ্য—“রাজবাড়ির সবচেয়ে পুরোনো কুয়োটির নিচে একটা শিলাখণ্ড আছে। আমার বাবা বলেছিলেন, একবার সেটা সরানোর চেষ্টা হয়েছিল, কিন্তু চারদিকে অদ্ভুত শব্দ হতে থাকে।” অরিন্দম তখন দৃঢ়ভাবে সিদ্ধান্ত নিলেন, “আজ রাতেই আমরা সেই কুয়োর নিচে যাব।”

তবে তার আগে এক ভিন্ন খোঁজে নেমে পড়লেন ইন্সপেক্টর মানসী চক্রবর্তী। স্থানীয় থানা ও জেলা রেকর্ড অফিস থেকে সন্ধান করে পেলেন ১৯৭১ সালের একটি মামলা—রাজবাড়ির এক কর্মচারী নিখোঁজ হয়, যার নাম শম্ভু হাজরা—গোবিন্দ হাজরার বাবা। অভিযোগ দায়ের হয়েছিল “প্রেতসংক্রান্ত আতঙ্কে আত্মগোপন” বলে, কিন্তু তদন্ত রিপোর্টে লেখা ছিল, “তিনি শেষবার লাইব্রেরির নিচের সুড়ঙ্গে ঢুকতে দেখা গিয়েছিলেন।” এর পাশাপাশি তিনি খুঁজে পেলেন আরও এক বিস্ময়কর দলিল—১৯৪০ সালের ব্রিটিশ শাসনকালীন রিপোর্ট, যেখানে বলা আছে রাজবাড়ির তলায় “Unexplored Temple Structure of pre-Sena period with Tantric Symbols.” মানসী বুঝতে পারলেন, শুধু মৃত্যুর কারণ খুঁজলেই হবে না, ইতিহাসকেও বুঝতে হবে। সেই মুহূর্তে খবর এলো, রাজবাড়ির কুয়োর পাশের পুরাতন ঘরে রক্তের দাগ পাওয়া গেছে—তার পাশে পড়ে থাকা একটি আধা-জ্বলা মোমবাতি ও একটি পুরনো কাঠের বাক্স। খুলতেই বেরিয়ে এলো একটি লোকাল মুদ্রা ও একটি রক্তমাখা কাপড়। মুদ্রাটি ছিল সেই একই রুদ্রনাথ রুদ্রাক্ষ-ছাপ যুক্ত চাঁদির কয়েন, এবং কাপড়ের কোণায় খোদাই করে লেখা: “দ্বার খোলো, তিনি প্রতীক্ষায়।”

রাত নামতেই প্রতাপেশ্বর, অরিন্দম ও মৃণালিনী পৌঁছালেন কুয়োর ধারে। এইবার গোবিন্দ হাজরাও সাথে ছিলেন, গলায় পীতধারে রুদ্রাক্ষের মালা, হাতে কাঠের টর্চ। সবাই মিলে ধীরে ধীরে কুয়োর পাড়ে পাথর সরাতে লাগলেন। অর্ধেক পাথর সরাতেই দেখা গেল একটি কাঠের ঢাকনা, যার ওপর খোদাই করা রয়েছে রুদ্রনাথের প্রতীক—ত্রিনয়ন আর ত্রিশূল। সেই ঢাকনা খুলতেই উপরে উঠে এল একধরনের পচা বাতাস, যেন বহু শতাব্দীর ঘুমন্ত আত্মা আজ জেগে উঠেছে। নিচে একটি কুঠুরির মতো শূন্যতা, যেখানে সিঁড়ি নেই, কেবল একটি দড়ির মই নেমে গেছে অন্ধকারে। অরিন্দম বললেন, “আমরা একে অপমান করতে পারি না, আমাদের শ্রদ্ধা ও সতর্কতা দুটোই রাখতে হবে।” মই বেয়ে নামলেন অধ্যাপক, তারপর মৃণালিনী। নিচে নেমেই দেখা গেল, এটি একটি পাথরের কক্ষ—দেয়ালে খোদাই করা ত্রিকোণ, শঙ্খ, ও উল্টানো শিবলিঙ্গের চিহ্ন। মেঝেতে ছড়ানো রয়েছে পোড়া ধূপ, ছাই, আর একটি পাথরের পাত্র, যার ভেতরে ছিল কেবল রক্তমাখা এক বালুকণা। সেখানে একপাশে পড়ে ছিল আরও একটি চিঠি—“শুধু ত্যাগ নয়, ত্যাজ্য হওয়াটাও এখানে প্রয়োজন।”

তারা যখন সেই চিঠি পাঠ করছিল, তখন হঠাৎ চারপাশ কেঁপে উঠল, কক্ষের ছাদে ধুলো ঝরতে শুরু করল। গোবিন্দ চিৎকার করে বললেন, “এই কক্ষটি আর জেগে উঠতে চাইছে না, আমরা চলে যাই!” তখনই ঘটল অপ্রত্যাশিত ঘটনা—দরজার মুখে আলোয় ভেসে উঠল এক মুখোশপরা মানুষ, মুখ ঢাকা, হাতে রামদা, এবং চোখজোড়া ভয়ংকর রক্তবর্ণ। সে কিছু না বলে শুধু এগিয়ে আসে, কিন্তু মৃণালিনীর চিৎকারে সে থেমে যায়। পরক্ষণেই সে পালিয়ে যায় সুড়ঙ্গের অন্যপ্রান্ত দিয়ে। অধ্যাপক বুঝে গেলেন—এখানে শুধু অতিপ্রাকৃত নয়, একজন মানুষও আছে, যে রুদ্রনাথের নামকে ব্যবহার করে হত্যা করছে। কিন্তু কেন? কীভাবে সে এই সমস্ত জায়গার গোপন পথ চিনে রেখেছে?
অধ্যায়ের শেষ দৃশ্য—সেই রাতের বৃষ্টির শব্দের মধ্যেই এক অদৃশ্য কণ্ঠ শোনা যায় সুড়ঙ্গের গভীর থেকে:
“আমাকে ফিরিয়ে দাও আলোয়, নয়তো নেব আরও রক্ত।”

অধ্যায় ৭: মুখোশ খুলে পড়ে

রাতটা ছিল বিদ্যুৎহীন, বৃষ্টিতে রাজবাড়ি যেন এক অপার্থিব স্তব্ধতায় মিশে গিয়েছিল। নিচের সুড়ঙ্গে যে অজানা মুখোশধারীর আবির্ভাব ঘটেছে, তা নিয়ে আলোচনার সময় নেই—কারণ আজ সেই শ্বাসরুদ্ধকর সন্ধ্যার পর গোবিন্দ হাজরা নিখোঁজ। প্রতাপ, মৃণালিনী ও অধ্যাপক যখন সকালের আলোয় তাঁকে খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন, তখন দেখতে পেলেন রাজবাড়ির ভিতরের মন্দিরঘরের দরজাটি খোলা—যা বহু বছর ধরে বন্ধ ছিল। ভিতরে একটি প্রদীপ জ্বলছে, আর তার পাশে পাথরের তক্তায় বসে আছে গোবিন্দ—নিঃসাড়, নির্বাক, স্থির। কাছে গিয়ে দেখা গেল সে মৃত। মাথার পেছনে গুরুতর আঘাতের চিহ্ন, আর তার মুখে আঁকা এক অদ্ভুত বিভীষিকাময় শান্তির ছাপ। তার মুঠোয় একটা চিরকুট—“সে আমাকে ডাকছিল, আমি সাড়া দিলাম। তার চোখ, তার শ্বাস, সব সত্যি। আমি মুক্ত।” মৃণালিনী হাঁপিয়ে উঠল, যেন বুঝতেই পারছিল না, মৃত মানুষের হাতে কেন এমন আত্মসমর্পণের ভাষা? পুলিশ এসে দেহ তুলে নিয়ে গেল, কিন্তু মানসী এবার আর কেবল যুক্তিতে বিশ্বাস করলেন না। তিনি বললেন, “এখানে শুধু খুন নয়, মানসিক নিয়ন্ত্রণের কিছু চলছে। এই রহস্য কোনো এক আধিভৌতিক ধর্মীয় ক্রিয়া-কলাপের ছায়ায় লুকিয়ে আছে।”

সেই মুহূর্তেই অধ্যাপক লাইব্রেরির সিলিংয়ের ধুলো সরাতে গিয়ে পেলেন এক কাঠের বাক্স। ভিতরে পুরনো এক রাজচিকিৎসকের নথিপত্র, এবং তার সঙ্গে রাখা এক চিত্রলিপির অনুলিপি। এতে দেখা গেল এক রহস্যময় উৎসবের বিবরণ—রাজপরিবারের একজন শিষ্যকে ‘রুদ্রশিষ্য’ হিসেবে নিযুক্ত করা হত, এবং সেই শিষ্য বছরের এক বিশেষ রাত্রে রাজবাড়ির গোপন প্রকোষ্ঠে বসে তন্ত্রসাধনা করত, রুদ্রনাথকে ‘জাগ্রত’ করার জন্য। কিন্তু ১৯০৫ সালে সেই শিষ্য পাগল হয়ে ওঠে, রাজপুত্রকে হত্যা করে এবং আত্মহত্যা করে বলে রেকর্ডে লেখা আছে। তবে একটি বাক্য অধ্যাপককে থমকে দিল—“তাঁর দেহ কোথাও পাওয়া যায়নি।” অধ্যাপক বুঝলেন, ইতিহাস কেবল অতীত নয়, কখনও কখনও জীবিতও হয়ে ওঠে। মৃণালিনী বিশ্লেষণ করে বলেন, “এই যে মুখোশধারী, সে হয়ত সেই চক্রের পুনর্জন্ম। অথবা তার উত্তরাধিকারী। মুখোশ একটি প্রতীক—রুদ্রশিষ্যের প্রতীক।” প্রতাপ কাঁপা গলায় বলেন, “আমাদের পরিবারেরই কেউ হয়তো এই চক্রে জড়িত ছিল, বা এখনও আছে।”

তদন্তের এই জটিল পর্যায়ে ইন্সপেক্টর মানসী এক রাতে গোপনে সিসিটিভি ক্যামেরা বসান রাজবাড়ির বিভিন্ন অংশে, যদিও অনেক জায়গায় বিদ্যুৎ নেই বলে সীমাবদ্ধতা ছিল। সেই রাতে ক্যামেরায় ধরা পড়ে মুখোশধারী সেই ছায়া—সে লাইব্রেরিতে আসে, একটি বইয়ের পেছনে চেম্বার খোলে এবং ধীরে ধীরে নিচে নেমে যায়। পরদিন, ক্যামেরা ফুটেজ দেখে তারা সেই পথ অনুসরণ করে পৌঁছায় রাজবাড়ির এক অদ্ভুত গুদামঘরে। সেখানে পাওয়া যায় একটি খাতা, যার পাতায় পাতায় রক্তলিপির মতো লেখা—“রুদ্র জাগ্রত। আমি তার মুখ। আমি তার হাত। আমি তার মৃত্যু।” আর ঠিক তখনই, প্রতাপ আচমকা চিৎকার করে ওঠেন—একটি পুরোনো পারিবারিক ছবিতে দেখা যায় তাঁর কাকাকে মুখোশ পরে দাঁড়িয়ে থাকতে, সেই একই মুখোশ যা মুখোশধারীর ছিল! প্রতাপ স্তম্ভিত হয়ে বলেন, “আমার কাকা ১৯৬৫ সালে নিখোঁজ হয়েছিলেন… তখন সবাই বলেছিল তিনি নেপালে চলে গেছেন… কিন্তু যদি না যান?” অধ্যাপক বলেন, “তবে তিনি–ই ছিলেন রুদ্রশিষ্য। আর আজকের মুখোশধারী—হয়তো তাঁরই ছায়া, তাঁরই বংশধর।”

সন্ধ্যা গড়াতেই এক ভয়াবহ ঘটনা ঘটল—লাইব্রেরির দরজা ভেঙে পড়ল, বইগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেল, আর তার মধ্যে পাওয়া গেল সেই মুখোশ—ভাঙা। মানসী দ্রুত এসে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করলেন। মুখোশের নিচে পাওয়া গেল একটি চিঠি—“আমি ছিলাম তাদেরই মধ্যে। আমি প্রতীক্ষায় ছিলাম সত্য প্রকাশের। কিন্তু এখন সময় শেষ। রুদ্র আবার আসবে।” অধ্যাপক চিঠিটি পড়ে বুঝলেন, মুখোশধারী তার অস্তিত্ব ফেলে রেখে কোথাও চলে গেছে, হয়তো স্থায়ীভাবে নয়, বরং আবার ফিরে আসার জন্য। কিন্তু এখন প্রশ্ন একটাই—রুদ্রনাথের মূর্তি কোথায়? এত মৃত্যু, এত ছায়া—সবকিছুর পিছনে যদি এক বস্তু থাকে, তবে সেটা নিশ্চয় এখনও আছে।
অধ্যায়ের শেষ দৃশ্যে, মৃণালিনী লাইব্রেরির ছিন্ন কাগজের নিচে একটি চুনোপাথরের টুকরো খুঁজে পায়—তাতে খোদাই করা:
“রুদ্রনাথ, যার চোখ খুললেই শুরু হয় ইতিহাসের রক্তপাত।”

অধ্যায় ৮: রুদ্রনাথের আরাধ্য ঘর

রাজবাড়ির দেয়ালজুড়ে যেন এখন ইতিহাসের নয়, ভয়ের ছায়া গাঢ় হয়ে উঠেছে। মুখোশ পড়ে গেছে ঠিক, কিন্তু যার ছায়া এতদিন মুখোশের আড়ালে ছিল, সে এখনও অধরা। লাইব্রেরির সেই চুনোপাথরের খণ্ডটির গায়ে যে শব্দ ছিল—“রুদ্রনাথ, যার চোখ খুললেই শুরু হয় ইতিহাসের রক্তপাত”—তা নিয়ে অধ্যাপক আর মৃণালিনী রাতভর গবেষণা করেন। রাজবাড়ির সমস্ত নকশা ছড়িয়ে দিয়ে তাঁরা হিসাব মেলাতে থাকেন। এবং একসময় অধ্যাপক চুপচাপ দাঁড়িয়ে বলেন, “আমরা সবসময় কুয়োর নিচে খুঁজেছি, কিন্তু রাজবাড়ির উত্তর-পূর্ব কোণটা—পুরনো গোদাম, সেটা পুরোপুরি অদেখা থেকে গেছে।” প্রতাপ জানালেন, “ও ঘর বহু আগে পাথর দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, শুনেছি সেখানে কেউ আত্মহত্যা করেছিল।” এইবার আর সময় নষ্ট না করে তারা সেই প্রাচীন ঘরের কাছে পৌঁছালেন। পাথরের দেয়াল ধাক্কা দিয়ে ভাঙতেই দেখা গেল ভিতরে একটি গন্ধভরা চতুষ্কোণ কক্ষ—মেঝেতে ত্রিকোণ, পঞ্চকোণ আঁকা, আর ঠিক মাঝখানে এক বিশাল কালো কাপড় মোড়া কিছু—মোটা শিকল দিয়ে বাঁধা। এক অদ্ভুত পবিত্রতা আর বিভীষিকার মিশ্র গন্ধে ঘরটা ঘিরে আছে, যেন বহু শতাব্দী ধরে ঘুমিয়ে থাকা কিছু জেগে উঠতে চাইছে।

তারা প্রথমে ভাবল, এটি হয়তো শুধুই একটি প্রতীকী কাঠামো, কিন্তু অরিন্দম কাপড়টা খুলতেই তারা দাঁড়িয়ে গেল স্তব্ধ হয়ে—একটি তাম্রধাতুর মূর্তি, প্রাচীন রুদ্রমূর্তি—দু’চোখে রত্নের জায়গায় গাঢ় কালো কাচ বসানো, পায়ের নিচে চারটি মুখ, এক হাতে ত্রিশূল, অন্য হাতে পিণ্ডধারণ। মুখে এক নিষ্ঠুর তৃপ্তির ছাপ। প্রতাপ এক ঝটকায় পেছনে সরে গেলেন, বললেন, “এটাই রুদ্রনাথ!” কিন্তু সেই মুহূর্তে মৃণালিনী দেখতে পেল মূর্তির পায়ের কাছে একটি কাঠের বাক্স—তাতে রাখা একটি চিঠি, যার গায়ে লেখা, “পাঠকের চোখে ইতিহাস, শিষ্যের চোখে শক্তি।” চিঠির ভেতরে ছিল একটি মানচিত্র—রাজবাড়ির নিচ দিয়ে ছড়িয়ে থাকা সুড়ঙ্গগুলোর সংযোগচিত্র। অধ্যাপক বুঝতে পারলেন, এই আরাধ্য ঘর ছিল মূল কেন্দ্র। মুখোশধারীর শেষ চিঠির কথার মানে পরিষ্কার—সে এই মূর্তির পাহারাদার, একজন সার্থক রুদ্রশিষ্য, যে নিজের অস্তিত্ব ঢেকে রেখেছে রুদ্রনাথের উদ্দেশ্যে।

রাতের নির্জনতায় অধ্যাপক সিদ্ধান্ত নিলেন—মূর্তির অস্তিত্ব এখন পুলিশের হাতে তুলে দিতে হবে। মানসী চক্রবর্তী এলেন, তদন্ত শুরু হল। কিন্তু সেই রাতে কিছু অদ্ভুত ঘটনার সূত্রপাত ঘটে—ঘরের ভিতরে আলো জ্বলে নিভে যেতে থাকে, ক্যামেরা বন্ধ হয়ে যায়, আর মূর্তির চোখে যেন ধীরে ধীরে আলোর রেখা দেখা যায়। মৃণালিনী ভয়ে অরিন্দমের হাত চেপে ধরে। অধ্যাপক বলেন, “এই মূর্তিকে স্থানচ্যুত করা যাবে না, এটা কেবল ধাতু নয়, এটা এক সঞ্চিত শক্তি।” আর ঠিক তখনই কক্ষের এক কোণ থেকে বেরিয়ে আসে মুখোশধারী—তবে এবার মুখোশ পরা নয়, মুখ উন্মোচিত—এক পরিচিত মুখ, রাজবাড়ির পরিচারক হরিপদ, যে এতদিন নীরবে তাদের জন্য চা-নাশতা এনে দিত। প্রতাপ বিস্ময়ে চিৎকার করে ওঠেন, “হরিপদ! তুই?” হরিপদ চোখ বন্ধ করে বলল, “আমার দাদু ছিলেন শেষ রুদ্রশিষ্য। আমি শুধু তার উত্তরসূরি। আমার কাজ ছিল তাঁকে রক্ষা করা, জাগতে না দেওয়া। কিন্তু আপনারা এসেছেন—ভুল প্রশ্ন নিয়ে।” মানসী বন্দুক তুলতেই হরিপদ চিৎকার করে বলে, “তোমরা জানো না, মূর্তির চোখ খুললে কী ঘটে!” এরপরেই ঘরজুড়ে ভয়ানক শব্দ—দেয়ালে ফাটল, বাতাসে ধুলো, আর সেই মুহূর্তে রুদ্রনাথ মূর্তির চোখ থেকে আলো বিচ্ছুরিত হয়।

রাত্রি কাটে এক যুদ্ধের মধ্যে। মূর্তিকে ঘিরে পাগলের মতো ঘুরতে থাকে হরিপদ, আর বলে, “আমি তাঁকে ঘুম পাড়িয়েছিলাম, আবার জেগে উঠলে তোমাদের কেউ বাঁচবে না!” অধ্যাপক অরিন্দম তখন স্পষ্ট উচ্চারণে বলেন, “তুমি ভেবেছিলে সত্যকে আড়াল করলেই শক্তি নিয়ন্ত্রণে থাকে? ইতিহাস তো শেষ হয় না। তাকে স্বীকার করেই মুক্তি সম্ভব।” এই বাক্যের ধাক্কায় যেন হরিপদ স্তব্ধ হয়ে যায়। সে মূর্তির পায়ের কাছে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে। আর ঠিক তখনই মূর্তির চোখের আলো নিভে আসে, হাওয়া স্তব্ধ হয়ে যায়, আর রাজবাড়ির দেয়াল যেন দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
অধ্যায়ের শেষ দৃশ্যে, মানসী চক্রবর্তী মূর্তিকে সিল করে নিয়ে যান রাজ্য পুরাতত্ত্ব দপ্তরের অধীনে। আর মৃণালিনী, ক্লান্ত চোখে চেয়ে থাকে সেই দরজার দিকে, যেখানে লেখা হল—
“এই ঘর আরাধনার নয়, আত্মসমর্পণের। ইতিহাসের চোখ বন্ধ নয়, খোলা।”

অধ্যায় ৯: চিহ্ন রেখে যাওয়া

রুদ্রনাথের মূর্তি যখন পুলিশের হেফাজতে সিল করে নিয়ে যাওয়া হল, তখন রাজবাড়ির বাতাসে যেন কিছুটা হালকা ভাব ফিরে এল। দীর্ঘদিনের চাপা আতঙ্কের পর প্রতাপেশ্বর প্রথমবার একটু হাসলেন, যদিও সে হাসির নিচে ছিল বিষণ্নতা। হরিপদকে গ্রেফতার করে মানসী থানায় নিয়ে গেলেও, সে শান্তভাবে বলেছিল, “আমাকে সাজা দাও, কিন্তু ‘তাঁকে’ সঠিক স্থানে রেখেছ তো?” মৃণালিনী ও অধ্যাপক বুঝলেন, এই প্রশ্ন কেবল এক ধর্মান্ধ চেতনার নয়—এ এক ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গিরও অভিব্যক্তি। সেই রাতে অধ্যাপক তার ডায়েরিতে লেখেন—“রুদ্রনাথ কেবল একটি মূর্তি নয়, এ এক দীর্ঘকালীন আস্থা ও ভয় মিশ্রিত প্রতীক, যার ছায়ায় বহু ইতিহাস দগ্ধ হয়েছে। হয়তো আজ তাকে ঘুম পাড়ানো সম্ভব, কিন্তু তার চিহ্ন থাকবে মানুষের ভিতরে।” রাজবাড়ির পুরনো ঘরগুলো আবার ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার হতে লাগল। সুড়ঙ্গগুলো বন্ধ করে দেওয়া হল, যাতে ভবিষ্যতে কেউ সে অন্ধকারে না নামে।

তবে মৃণালিনীর মনে শান্তি নেই। সে বারবার ভাবছিল—রুদ্রনাথের মূর্তিটি কেন পাথরের ঘরে ত্রিকোণ চিহ্নের মধ্যে রাখা ছিল? কে বা কারা সেই চিহ্ন এঁকেছিল? লাইব্রেরির এক প্রাচীন পাণ্ডুলিপি ঘাঁটতে ঘাঁটতে সে খুঁজে পায় “অগ্নিবিন্দু তন্ত্র” নামের একটি হস্তলিপি, যেখানে বলা আছে—এক বিশেষ শক্তির মূর্তি ‘জাগ্রত’ হলে তার চারপাশে পাঁচটি রক্তচিহ্নের রেখা সৃষ্টি হয়, এবং প্রতি রেখা নির্দিষ্ট স্থানে একেকটি ঘটনা ঘটায়—“মৃত্যু, দেহত্যাগ, বিশ্বাসঘাতকতা, আত্মসমর্পণ ও পুনর্জন্ম।” মৃণালিনী গুনে দেখে, বিকাশ সাহা, গোবিন্দ হাজরা, হরিপদের কাহিনি মিলছে। অধ্যাপক বলেন, “শেষ দুটি কি এখনও ঘটেনি?” এই প্রশ্নেই নতুন দুশ্চিন্তার জন্ম হয়। রাজবাড়ির আঙিনায় সেই রাতে আবার অদ্ভুত বাতাস বয়ে যায়, যেন কিছু ফিসফিস করে বলে—“আমি ছিলাম, আমি থাকব, আমি চিহ্ন হব।”

সেই সময়েই রাজ্য পুরাতত্ত্ব দপ্তর থেকে খবর আসে—মূর্তিটির ধাতব গঠন বিশ্লেষণে জানা গেছে, এটি সাধারণ তামা নয়, বরং একটি হারিয়ে যাওয়া ধাতু মিশ্রণ, যেখানে লোহা, সীসা, পারদ ও একটি অনির্ধারিত তত্ত্ব ছিল। বিশেষজ্ঞরা বলেন, এটি “সায়ন্ধ্র ধাতু”—যা কেবল তন্ত্রসাধনায় ব্যবহৃত হত। সেই সঙ্গে পাওয়া গেছে মূর্তির ভিতরে রাখা একটি ক্ষুদ্র তালপত্র, যাতে লেখা ছিল:
“আমি নই ঈশ্বর, আমি চেতনার সংহতি। যার চোখ খোলে, সে জাগে না—সে স্মরণ করে।”
এই আবিষ্কার অধ্যাপক ও মৃণালিনীর গবেষণায় নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। তাদের গবেষণাপত্র ‘Tantric Iconography and the Rudranath Enigma’ নামে প্রকাশের প্রস্তুতি নেয়। মানসী চক্রবর্তী শেষ জবানবন্দিতে লেখেন, “এটি শুধু হত্যার নয়, ভাবনার মামলা। অনেক অপরাধ প্রমাণযোগ্য নয়, কারণ তারা প্রতীকের আড়ালে বসবাস করে।” রাজবাড়ির দেয়ালে সেই প্রতীক এখনও গেঁথে আছে—একটি ছায়ার মতো।

রাজবাড়ি এখন পর্যটনের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে, তবে সুড়ঙ্গ ও ‘রুদ্রঘর’ স্থায়ীভাবে সিল করে রাখা। একদিন, বহু সময় পর মৃণালিনী একা ফিরে এল রাজবাড়িতে, একটি রাত্রির জন্য। বসন্তের বাতাস বইছে, কিন্তু বাড়ির ভিতরে পা রাখতেই তার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। সে লাইব্রেরিতে গিয়ে বসে, নিজের হাতে আঁকা নোটখাতাটা খুলে, যেখানে সে লিখেছিল—“রুদ্রনাথ হয়তো মূর্তি নয়, এক প্রশ্ন—আমরা ভয়কে পূজা করি কেন?” হঠাৎ জানালার ফাঁক দিয়ে দেখা গেল দূরে, বাগানের ধারে, একটা ছায়া দাঁড়িয়ে আছে—না একেবারে স্পষ্ট নয়, কিন্তু যেন পরিচিত। সে ছায়া একবার মাথা নোয়ায়, আর ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে যায় গাছের আড়ালে।
অধ্যায়ের শেষ লাইন—
“রুদ্রনাথ ঘুমায়, কিন্তু তার চোখ—চিরকাল খোলা।”

অধ্যায় ১০: শেষ দর্শন

সময় পেরিয়ে গেছে এক বছর। উত্তরবঙ্গের সেই রাজবাড়ি এখন সরকারি প্রত্নতাত্ত্বিক সংরক্ষণের অধীন, প্রবেশ নিয়ন্ত্রিত, কেবল গবেষক ও অনুমতিপ্রাপ্ত পর্যটকদের জন্য সীমিত খোলা। তবু রাজবাড়ির চারপাশের গ্রামের মানুষরা এখনো সূর্যাস্তের পরে তার দিকে তাকায় না। তারা জানে, কিছু ঘুমায় না কখনো, শুধু অপেক্ষা করে। অধ্যাপক অরিন্দম সরকার ও মৃণালিনী সেন এখন দেশের দুই পরিচিত গবেষক—তাঁদের যুগ্ম গবেষণাপত্র ‘Rudranath: Icon, Shadow & Power’ লন্ডন ও জার্মানির প্রত্নতত্ত্ব জার্নালে স্থান পেয়েছে। কিন্তু অধ্যাপকের মুখে এখনো সেই রাত্রির আতঙ্কের স্তব্ধতা লেগে আছে। এক সন্ধ্যায় মৃণালিনী তাঁর দক্ষিণ কলকাতার বাড়িতে এসে চুপ করে বসে বলে, “স্যার, আপনি কি জানেন, আমরা আসলে কী জিনিসকে খোঁজ করছিলাম?” অধ্যাপক উত্তর দেন না, শুধু বলেন, “আমরা খুঁজেছিলাম মূর্তি, কিন্তু পেয়েছিলাম প্রতিফলন। আমাদের ভিতরের। ইতিহাস তো শুধু বাইরের রক্ত নয়, ভিতরের রক্তপাতেরও দলিল।”

ঠিক সেই সময় আসে একটি চিঠি—পোস্টমার্ক রাজবাড়ির কাছাকাছি একটি গ্রাম, প্রেরকের নাম নেই। চিঠির ভিতরে একটি ছবির কপি—ধূসর আলোকচিত্র, যেখানে দেখা যায়, রুদ্রঘরের পাথরের বেদিতে রাখা একটি নতুন চিহ্ন—এক পঞ্চভুজ ঘেরা চোখ। তার নিচে লেখা—“আমরা কেউই সত্যি ঘুমাই না। শুধু সময় বুঝে সরে যাই।” অধ্যাপক বুঝলেন, কেউ আবার নিচে গিয়েছিল। হয়তো প্রশাসনেরই কেউ, হয়তো অন্য কেউ। মৃণালিনী বলল, “স্যার, আমরা ওটাকে রেখে এসেছিলাম সময়ের পাহারায়, কিন্তু কেউ হয়তো আবার সেই সময়কে ডেকে তুলেছে।” সিদ্ধান্ত হল, তাঁরা আবার একবার রাজবাড়িতে যাবেন—শেষবারের মতো, শুধু নিশ্চিত হওয়ার জন্য। তারা মানসী চক্রবর্তীর সহায়তা নিয়ে পুনরায় রাজবাড়ির ঘরে প্রবেশের অনুমতি নিলেন। প্রতাপেশ্বর রায়, যিনি এখন বার্ধক্যে একদম নীরব, তাঁকে জানালে শুধু বললেন, “আপনারা শেষ সত্য খুঁজে ফিরুন, আর এ বাড়িটাকে দয়া করে চুপ করিয়ে দিন।”

সন্ধ্যাবেলা তারা পৌঁছান রাজবাড়ির সেই বিখ্যাত রুদ্রঘরে। সিল ভাঙা হয়নি, তবে ভিতরে প্রবেশ করতেই দেখা গেল বাতাস ভারী, স্থিরতা অস্বস্তিকর। বেদির গায়ে সত্যিই নতুন চিহ্ন—চোখের প্রতীক। অধ্যাপক চুপচাপ দাঁড়িয়ে, কিছুই বলেন না। মৃণালিনী হঠাৎ বলে ওঠে, “এই ঘরটা একটা আয়নার মতো। যে এখানে ঢোকে, সে নিজেকে দেখতে পায়। ভয়, লোভ, বিশ্বাস—সব। তাই এখানে রুদ্রনাথ নয়, প্রতিটি মানুষ নিজেই নিজেকে জাগ্রত করে।” অধ্যাপক হঠাৎ পাথরের দেয়ালে হাত রাখেন, আর খুলে যায় একটি গোপন খোপ—ভেতরে রাখা একটি কপর্দকহীন ধাতব আয়না। আয়নাটিতে তারা একে অপরকে স্পষ্ট দেখতে পায় না, শুধু নিজেদের ছায়া। মানসী বলেন, “এই আয়না, হয়তো সেই মূল ‘আরাধ্য’—রুদ্রনাথ নয়, বরং প্রতিচ্ছবি, যেটা মানুষের ভেতরের শক্তি ও আতঙ্ককে জাগায়।” তারা একে প্রশাসনের হাতে তুলে দেন, কিন্তু অধ্যাপক তার রেকর্ডে লেখেন—“যা দেখা যায় না, তা-ই সবচেয়ে বিপজ্জনক। কারণ তা ব্যাখ্যার ঊর্ধ্বে।”

বেরিয়ে আসার সময়, রাত তখন গভীর, হালকা বাতাস বইছে। অধ্যাপক পেছনে তাকিয়ে দেখেন, রাজবাড়ির ছাদে এক ছায়া দাঁড়িয়ে আছে—চেনা, মুখহীন, কিন্তু শান্ত। সে কোনো শব্দ করে না, শুধু মাথা নোয়ায়। মৃণালিনী জানালার কাঁচে ধরা পড়ে থাকা কুয়াশার মধ্যে লিখে দেয়—“শেষ নয়।”
আর তারপর হাঁটতে হাঁটতে তারা চলে যায় অন্ধকার গলি পেরিয়ে ভোরের দিকে। অধ্যায়ের শেষ লাইন, এবং গল্পের শেষ পংক্তি—
“রুদ্রনাথ ছিল এক প্রতীক, কিন্তু সেই প্রতীকই প্রমাণ করে, কিছু রহস্যের উত্তর প্রশ্নের মধ্যে নয়—নীরবতার ভিতরেই লুকিয়ে থাকে।”

বছরখানেক পর, ‘রুদ্রনাথ ফাইল’ রাজ্য আর্কাইভে একটি ‘প্রতীকি ঐতিহ্যিক রহস্য’ হিসেবে চিহ্নিত হলো—একটি মূর্তির গা-ছমছমে ইতিহাস, খুন, তন্ত্রসাধনার ছায়া ও প্রশ্নবিদ্ধ বিশ্বাসের শিকড় গাঁথা এক প্রাসাদভিত্তিক কাহিনি। কিন্তু মৃণালিনী ও অধ্যাপক অরিন্দম জানতেন—এটি কেবল ইতিহাসের দলিল নয়, এক অভিজ্ঞতা। তারা একসাথে লিখলেন: “রুদ্রনাথের অস্তিত্ব ধাতুতে ছিল না, ছিল মানুষের ভয় ও আশার সন্ধিক্ষণে। রাজবাড়ির দেয়াল আর সুড়ঙ্গের অন্ধকারে যা লুকিয়ে ছিল, তা ছিল আমাদের ভেতরের এক প্রশ্ন: আমরা কাকে শক্তি বলি—ঈশ্বরকে, না নিজের ভয়ের প্রতিচ্ছবিকে?” হরিপদ, গোবিন্দ, বিকাশ সাহা—তারা সবাই ছিল এই গল্পের প্রতীক, কেউ কল্পনার বন্দি, কেউ ইতিহাসের উপাসক। আর রাজবাড়ি? তা আজও দাঁড়িয়ে আছে—অপরিচিত বাতাসে, রাতের নিস্তব্ধতায়, সেই একটাই প্রতিধ্বনি করে: “তাঁকে ডেকো না, যদি ফিরিয়ে আনার সাহস না থাকে।”

আর এভাবেই ইতিহাস নিজের চোখ খুলে, রক্তপাত নয়—চিহ্ন রেখে দেয় মানুষের মনোলোকের এক গোপন দরজায়।

___

 

 

1000031946.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *