Bangla - ভ্রমণ

রাইভেংয়ের ভিতর আমি

Spread the love

প্রমিতা বাগচী)


পথের মতো আমি

পাহাড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তটা হঠাৎ নয়, আবার পুরোপুরি প্ল্যান করাও ছিল না। অনেকটা ঘুম ভাঙার পর নিজেরই মাথার ভেতর একটা চিৎকার শুনে ওঠার মতো। নাম, পরিচয়, সময়—সব ফেলে রেখে শুধু একটা রেল টিকিট কেটে বেরিয়ে পড়েছিলাম। কোথাও যেতে হবে, যেখানে আমি নেই। একেবারে অচেনা জায়গা, যেখানে আমার ফোন কাজ করবে না, কেউ চিনবে না, আর কেউ খুঁজবেও না।

সেইরকমই এক পাহাড়ি লোকাল ট্রেন ধরে পৌঁছলাম মালবাজার। তারপর সেখান থেকে একটা পুরনো গাড়ি—ম্যাটাডোর টাইপ কিছু—ধরে আরও ভেতরে। গাড়িওয়ালা লোকটা খুব একটা কথা বলেনি, শুধু বলেছিল, “আপনি রাইভেং যাবেন? ওদিকটা এখন কেউ যায় না তেমন। ভালোই আছেন নিশ্চয়?” আমি হেসে বলেছিলাম, “ভালো থাকার চেষ্টায় আছি।”

রাইভেং—এই নামটা প্রথম শুনেছিলাম কলেজে পড়ার সময় এক সিকিমি ছেলের মুখে। বলেছিল, “আমাদের গ্রামে সন্ধ্যা নামলে কুয়াশা কথা বলে।” তখন হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু আজ, এত বছর পর, সেই কথাটাই হঠাৎ মনে পড়ে গিয়েছিল।

পথটা ছিল অসম্ভব নির্জন। গাড়ি চলতে চলতে পাথুরে পথ বেয়ে উপরের দিকে উঠছিল। দুই পাশে অজস্র ঝোপ, নাম না জানা গাছ, পাখির ডাকও যেন কেমন নিস্তব্ধ। একটা জায়গায় এসে গাড়ি থেমে গেল। লোকটা বলল, “এখান থেকে একটু হাঁটা পথ, তিন কিলোমিটার মতন, ওখানেই রাইভেং। আমি আর যেতে পারব না।”

আমি ব্যাগ কাঁধে নিয়ে হাঁটা ধরলাম। মেঘে ঢাকা পাহাড়, কুয়াশায় মিশে থাকা রাস্তা—সবকিছু যেন গল্পের মতো। চলতে চলতে আমার বুকটা হালকা হয়ে যাচ্ছিল। যেন অনেকগুলো ভার ফেলে রেখে চলেছি।

পথে একটা বুড়ো মহিলার সঙ্গে দেখা হল। তিনি এক হাতে লাঠি নিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। আমাকে দেখে একটু থামলেন, তারপর কেমন ঘোলাটে গলায় বললেন, “নতুন এসেছো? এখানে কেউ আসে না আজকাল। তুমি কেন এলে?”

আমি বললাম, “নিজের সঙ্গে একটু একা থাকতে।”
বুড়ি মাথা নাড়লেন, “তবে ঠিক জায়গায় এসেছো। কিন্তু মনে রেখো, রাইভেং কেবল পাহাড় না, রাইভেং অনেক কিছু গিলে ফেলে। সময়, নাম, মানুষ।”

আমি চমকে উঠলাম। তিনি হাঁটতে শুরু করলেন আবার, পিছনে না তাকিয়েই।

সন্ধ্যার ঠিক আগে আমি গ্রামে পৌঁছলাম। একটা পুরনো কাঠের বাড়ি ভাড়া নেওয়ার ব্যবস্থা ছিল—এক মাসের জন্য। দরজা খুলে ঢুকতেই কেমন একটা গন্ধ—সেদ্ধ কাঠের, পুরনো জামাকাপড়ের, আর যেন পুড়তে থাকা কোনো গল্পের।

বাইরে হালকা কুয়াশা নেমে গেছে। রাইভেং নিস্তব্ধ, একটা হাওয়াও যেন শব্দ করে না। আমি জানলার ধারে বসে ছিলাম। দূরে পাহাড়ের ঢালে আলো জ্বলছিল একটা, আবার নিভে যাচ্ছিল। আর তখনই শুনলাম সেই আওয়াজটা—একটা বাঁশি।

নয়টা বাজে প্রায়। সেই বাঁশির আওয়াজ পাহাড় ঘেঁষে নেমে এল আমার জানলা পর্যন্ত। বাঁশির সুরে একটা অদ্ভুত যন্ত্রণা ছিল। যেন কেউ কাউকে বিদায় জানাচ্ছে, অথবা নিজেকেই হারিয়ে ফেলেছে।

আমি চোখ বন্ধ করলাম। মনে হল, আমার ভিতরে কেউ ধীরে ধীরে হাঁটছে—আমার স্মৃতির পাহাড় বেয়ে।

রাইভেংয়ের ভিতর ঢুকে পড়েছি, আর তারাও যেন ধীরে ধীরে আমার ভিতর হাঁটতে শুরু করেছে।

 

রাইভেংয়ের বাঁশির সুর

রাতটা ছিল নিঃশব্দ, এতটাই যে নিজের নিঃশ্বাস শুনতে পাচ্ছিলাম। কাঠের ঘরের ভেতর মাঝে মাঝে চট করে শব্দ হচ্ছিল, যেন পুরনো দেওয়াল নিজের হাড় ঝাঁকিয়ে নিচ্ছে। ঘরের কোণে রাখা আয়নায় নিজের ছায়া দেখতে দেখতে আমি শুয়ে পড়লাম—চোখ বন্ধ করলেই মনে হচ্ছিল বাঁশির সুর যেন মনের ভিতর ঢুকে যাচ্ছে, হিম হয়ে যাচ্ছে স্মৃতি।

ঘুম ভাঙল খুব ভোরে, কিন্তু দিনের আলো ছিল না। পাহাড়ে সকাল আসেও যেন অনেক দেরিতে। বাইরের ঘাসভেজা পাথরের গায়ে বসে এক কাপ কফি নিয়ে চুপ করে বসে থাকলাম। হঠাৎ পাশের গাছের তলায় এক ছেলে এসে দাঁড়াল। মুখে পাহাড়ি টান, বয়সে চব্বিশ-পঁচিশের বেশি নয়।

“আপনি নতুন এসেছেন?”
আমি মাথা নাড়লাম, “হ্যাঁ। একমাসের জন্য এই বাড়িটা ভাড়া নিয়েছি। আপনি এখানকার?”

ছেলেটা বলল, “আমার নাম তোর্জো। আমি কাছেই থাকি। বাড়ির মালিক আমাকে দায়িত্ব দিয়েছেন আপনার প্রয়োজন হলে সাহায্য করতে। আপনি যদি চান, আমি আপনাকে রাইভেংটা একটু ঘুরিয়ে দেখাতে পারি।”

আমি একরকম হাঁপ ছাড়লাম। ভরসা পেলাম যেন। বললাম, “চলুন তবে।”

তোর্জো আমাকে প্রথমে নিয়ে গেল গ্রামমধ্যের ছোট্ট একটা মন্দিরে—একটা পাথরের শিবলিঙ্গ, যার গায়ে জলধারা পড়ছে পাহাড়ি ঝরনার মতো।

“এই মন্দিরেই কেউ বাঁশি বাজায়?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

সে একটু থেমে বলল, “আপনি শুনেছেন?”
আমি বললাম, “প্রথম রাতেই।”

তোর্জো মাথা নাড়ল। “ওটা আমরা বলি—বাঁশিওয়ালা। অনেক বছর আগে রাইভেংয়ের এক লোক ছিল, নাম ছিল চোন্ডা। দুর্দান্ত বাঁশি বাজাত। তার প্রেম ছিল একজন সমতলের মেয়ের সঙ্গে। কিন্তু মেয়েটা কোনো এক বর্ষার রাতে দুর্ঘটনায় মারা যায়। এরপর চোন্ডা নিজের বাঁশি ফেলে দিয়ে উধাও হয়ে যায়। কেউ বলে সে আত্মহত্যা করেছে, কেউ বলে পাহাড় তাকে গিলে নিয়েছে। কিন্তু আপনি জানেন? তারপর থেকে প্রত্যেক রাতে, ওই মেয়েটা মারা যাওয়ার সময়টায়, এখানে বাঁশির আওয়াজ শোনা যায়।”

আমার গা কেমন শিউরে উঠল।
“তুমি বিশ্বাস করো এসব?”

তোর্জো হাসল, “রাইভেংয়ে অনেক কিছু আছে যা দেখলে বিশ্বাস করতে হয়। আপনি কতদিন থাকবেন?”

“এক মাস।”

“তাহলে আপনি বুঝবেন।”

আমরা গ্রামের ছোট্ট স্কুলঘর, ছাউনি দেয়া দোকানগুলো, আর একটা পরিত্যক্ত চায়ের বাগান ঘুরে এলাম। চায়ের বাগানের গাছগুলো যেন চুপচাপ দাঁড়িয়ে—যেন কেউ তাদের ভুলে গেছে।

দুপুরে তোর্জো চলে গেল। আমি বাড়িতে ফিরে এসে পুরনো ডায়েরিটা আবার খুললাম। আগের ভাড়াটিয়া হয়ত রেখে গেছে। ভিতরে কয়েকটা কবিতার মতো লেখা ছিল—তারিখ নেই, নাম নেই। শুধু এক জায়গায় লেখা ছিল:
তুমি না থাকলে, আমি রাইভেংকে চিনি না।
কিন্তু তুমি থাকলেও, পাহাড় তো আমার নয়।”

আমি ভাবছিলাম, কে লিখেছিল এই লাইন? কেন যেন মনে হচ্ছিল, এই জায়গার সঙ্গে আমার এক অদৃশ্য বন্ধন তৈরি হচ্ছে, যা আগে ছিল না, অথচ এখন খুব পুরনো মনে হচ্ছে।

সন্ধ্যে নামার সঙ্গে সঙ্গে আবার সেই বাঁশির আওয়াজ এল। আমি এবার আর জানলা থেকে শুনে থাকলাম না। বেরিয়ে পড়লাম।

কুয়াশার ভিতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছলাম সেই শিবমন্দিরে। আশেপাশে কেউ নেই। বাতাসে সেই সুর ভাসছে—নরম, বিষাদে ভরা। মনে হল, সুরটা আমাকে কোথাও ডাকছে। আমি একটু একটু করে এগিয়ে গেলাম মন্দিরের পিছনের দিকে।

আর ঠিক তখনই, বাঁশির সুর থেমে গেল। এক মুহূর্তে যেন সমস্ত শব্দ হারিয়ে গেল পৃথিবী থেকে। এমনকি বাতাসও দাঁড়িয়ে গেল যেন।

আমি থমকে দাঁড়িয়ে রইলাম। নিজের হৃদস্পন্দন শুনতে পেলাম। আর তখনই গাছের নিচে একটা ছায়া দেখলাম—কেউ বসে আছে।

ছায়ার মুখ

গাছের নিচে বসে থাকা ছায়াটা একরকম স্থির, অথচ তাকে দেখে মনে হচ্ছিল, ওর ভিতরে কোনো কম্পন চলছে। আমি কয়েক কদম এগোতেই বাঁশির শেষ সুরটা যেন বাতাসে হালকা ভেসে গেল—একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাসের মতো। আমি চোখ কুঁচকে দেখলাম—একজন মানুষ, নাকি কেবল পাতার ভাঁজে আলো-ছায়ার খেলা?

“কে আছেন?” আমার গলা আশ্চর্যরকম শান্ত শোনাল।

ছায়াটা একটু নড়ল। তারপর ধীরে ধীরে মাথা তুলল। চাঁদের আলো পড়ল তার গালের ওপর—হ্যাঁ, সে একজন ছেলে, বয়স আমার মতোই কিংবা একটু কম। চোখদুটো অসম্ভব গভীর, যেন সে কোনো এক দীর্ঘ অপেক্ষার ভিতরে থেকে তাকিয়ে আছে।

“আপনি বাঁশি বাজাচ্ছিলেন?”

সে কিছু বলল না, শুধু একটা ভাঙা হাসি খেলল তার ঠোঁটে। তারপর বলল, “আপনি নতুন এসেছেন। গন্ধে বোঝা যায়।”

আমি একটু চমকে গেলাম। “গন্ধে?”

“রাইভেং আপনাদের চেনা লোক নয়। যারা বাইরের, তাদের চেনা যায়। তাদের শরীর থেকে শহরের গন্ধ আসে—চা-পাতা শুকনো, ছাঁটা চুলের গন্ধ, আর অভিমান।”

আমি কিছু বললাম না। ওই ছেলেটির গলার স্বর এমনই ছিল, যেন প্রতিটা শব্দ নিজের ওজনে ঝরে পড়ছে।

“আপনার নাম?”

সে বলল, “নাম দিয়ে কী হবে? রাইভেং নাম মনে রাখে না।”

“তবুও তো জানতে ইচ্ছে করে। আপনি কি চোন্ডা?”

সে একবার তাকিয়ে থাকল আমার দিকে, তারপর মুচকি হাসল। “চোন্ডা একটা গল্প। রাইভেংয়ে সবাই একদিন গল্প হয়ে যায়।”

সে উঠে দাঁড়াল। তার গায়ে একটা পুরনো লাল শাল ছিল, পায়ে স্যান্ডেল না। সে হাঁটতে শুরু করল। আমি বললাম, “আমি আপনার সঙ্গে আসতে পারি?”

সে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল, “তুমি যদি খুঁজে না পাও, তাহলে ফিরে এসো। কিন্তু যদি পেয়ে যাও—তখন আর ফেরার দরকার নেই।”

আমি তাকে অনুসরণ করলাম না। হাঁটুতে কাঁপুনি ধরেছিল। ফিরতি পথে বুঝলাম, রাইভেং শুধু স্থান নয়, সময়ও। এখানে ঘড়ি চলে না। এখানে শব্দের থেকেও বেশি কথা বলে চুপ থাকা।

পরদিন সকালবেলা ঘুম ভাঙল খুব তাড়াতাড়ি। দরজার বাইরে তোর্জো দাঁড়িয়ে ছিল। তার মুখটা অদ্ভুত রকম গম্ভীর।

“আপনি মন্দিরের পেছনে গেছিলেন গতকাল?”

আমি একটু হেসে বললাম, “হ্যাঁ। কারও সঙ্গে দেখা হয়েছিল।”

তোর্জো মাথা নাড়ল। “আপনার হয়তো মনে হচ্ছে, সত্যি কাউকে দেখেছেন। কিন্তু সেই জায়গায় গত পাঁচ বছরে কেউ থাকে না। ওটা… ওটা একটু অন্যরকম।”

আমি বললাম, “যাকে দেখেছিলাম, সে সোজা কথা বলছিল। খুব সাধারণভাবে।”

তোর্জো বলল, “অনেক সময় পাহাড় মুখ নেয়। আপনি জানেন? ওখানে একসময় একটা পাগল থাকত—দিনরাত বাঁশি বাজাত। সে নাকি নিজের প্রেমিকার মৃত্যু মানতে পারেনি। তারপর একদিন সে গায়েব হয়ে যায়। কিন্তু তার জায়গায় অন্য কেউ এসে বসে পড়ে। আর মানুষ আর চেনে না কে আসল, কে ছায়া।”

আমি প্রশ্ন করলাম, “আপনি নিজে কখনো দেখেছেন?”

তোর্জো আমার চোখে চোখ রেখে বলল, “আমি দেখেছি রাইভেং বদলায় না। শুধু যারা আসে, তারাই বদলে যায়।”

সেদিন দুপুরে আমি একা হেঁটে গেলাম পাহাড়ের পেছনের দিকে, একটা পুরনো স্কুলঘর দেখে। ধুলোমাখা বেঞ্চ, কালো হয়ে যাওয়া স্লেট, আর দেয়ালে লেখা—
রাইভেং হাসে না, কেবল দেখে।”

আমি জানতাম, আমি ধীরে ধীরে ঢুকে পড়ছি এমন এক জালে, যেখান থেকে ফিরে আসা হয়ত সম্ভব নয়। কিন্তু তবুও একটা টান ছিল।

রাতে আবার সেই বাঁশির সুর এল। এবার সেটা আরও দূর থেকে। আমি উঠে জানলা খুললাম না। বরং শুয়ে থেকে চোখ বন্ধ করলাম। এবং… ঠিক তখনই কানে এল ফিসফিসে একটা শব্দ—
তুমি খুঁজে পাবে, যদি হারাতে জানো।”

আমি উঠে বসে পড়লাম। ঘরে কেউ নেই। কিন্তু দরজার পাশে রাখা ডায়েরিটার ভেতরে একটা নতুন পাতা খুলে গেছে—যেটা আমি আগে দেখিনি। আর সেখানে লেখা:
রাইভেংয়ের ভিতর আমি ছিলাম, আর এখন তুমিও।”

ডায়েরির পাতার ভেতরে

ডায়েরিটার পাতায় সেই লেখা দেখে আমি মুহূর্তের জন্য নিঃশ্বাস নিতে ভুলে গেলাম।
রাইভেংয়ের ভিতর আমি ছিলাম, আর এখন তুমিও।”
আমি জানি আমি এই লাইনটা লিখিনি। কিন্তু কাগজের কালি একদম নতুন—এমনকি আঙুল ঘষলে একটু ভিজে রঙ উঠে এল।

আমি চট করে বাইরের আলো জ্বালালাম। ঘর খালি। দরজা ভিতর থেকে বন্ধ ছিল। অথচ এই লেখা কে লিখল? কবে? কীভাবে?

আমি ধীরে ধীরে ডায়েরিটা পুরোটা উল্টাতে লাগলাম। সেই পুরনো কবিতাগুলোর মাঝখানে একটা পাতায় হঠাৎ করেই অদ্ভুত এক লিপি চোখে পড়ল—যেটা আমার চেনা কোনও বর্ণমালার নয়। যেন পাহাড়ি কোনো প্রাচীন ভাষা। লিপিটার ঠিক নিচেই ইংরেজিতে ছোট করে লেখা—ওর নাম কেয়ার্ন। পাহাড়ের মুখ।”

আমি ফিসফিস করে বললাম, “কেয়ার্ন?”

সেই রাতটা আমি আর ঘুমোতে পারলাম না। বারবার মনে হচ্ছিল কেউ যেন ঘরের বাইরে হেঁটে যাচ্ছে, জানালার নিচে দাঁড়াচ্ছে। একসময় উঠে গিয়ে পর্দা সরিয়ে দেখলাম—কেউ নেই। কিন্তু ভোররাতে যখন সূর্যর প্রথম আলো পাহাড়ের গায়ে ছুঁলো, আমি দেখতে পেলাম—বাড়ির দরজার সামনে মাটিতে কেউ খোদাই করে লিখে রেখেছে:
যদি দেখতে পাও, তবে জানতে পারো না।”

সকালবেলায় তোর্জো এল, তার মুখে চিন্তার ছায়া। আমি তাকে ডায়েরিটা দেখালাম। সে হাতে নিল, পাতাগুলো উল্টে বলল, “এই লেখাগুলো… আপনি কোথা থেকে পেলেন?”

“ঘরের ভিতরেই ছিল।”

তোর্জো থেমে বলল, “এই লেখাগুলো এক সময়ের স্কুলশিক্ষিকা শাম্বরী দিদির। উনি পাহাড়ে একাই থাকতেন, আর গ্রামের বাচ্চাদের পড়াতেন। ওঁর প্রেম ছিল রাইভেংয়ের এক বাঁশিওয়ালার সঙ্গে। কিন্তু সেই লোকটা উধাও হয়ে যাওয়ার পর উনি পাগল হয়ে যান। একদিন হঠাৎ উনিও নিখোঁজ। কেউ বলে উনি আত্মহত্যা করেননি, বরং পাহাড় তাকে ডেকে নিয়েছিল।”

আমি প্রশ্ন করলাম, “কেয়ার্ন নামটা কি চেনা?”

তোর্জো চুপ করে থাকল। তারপর বলল, “ওটা পাহাড়ি দেবতার নাম, যাকে আমরা চিনি না, কিন্তু অনুভব করি। সে নাকি শব্দে বাস করে। কেউ যদি নিজেকে ভুলে ফেলে, তবে সে কেয়ার্নের আওতায় চলে যায়।”

আমি বুঝতে পারছিলাম, এই ডায়েরিটা শুধু অতীত নয়, একরকম গেটওয়ে। এবং তৃষা, যে আমি ছিলাম, সে ধীরে ধীরে অন্য কিছুতে রূপ নিচ্ছে—যে নামটা হয়ত লেখা নেই কোথাও, কিন্তু পাহাড় জানে।

সেদিন দুপুরে আমি একা বেরিয়ে পড়লাম। পাহাড়ের অন্য প্রান্তে যেখানে একটা পুরনো গুহার মতো জায়গা আছে, যার নাম শুনেছিলাম—বুকছাপ ঝর্ণা

পথে কিছু পাথরের ঢিপি চোখে পড়ল—একটা, দুইটা, তিনটা—সবকটাই মানুষের বানানো, ছোট ছোট পাথর গেঁথে দাঁড় করানো। সেগুলোর একটার পেছনে লেখা ছিল—যারা চলে গেছে, তারা গায়, যারা থাকে, তারা শোনে।”

ঝর্ণার কাছে পৌঁছে আমি দেখতে পেলাম এক অদ্ভুত দৃশ্য—একটা পাথরের দেওয়ালে অনেকগুলো মুখ আঁকা, আর তার মাঝখানে আঁকা হয়েছে একটা বাঁশি।

ঠিক তখনই আমি আবার শুনলাম সেই বাঁশির সুর—এবার আরও পরিষ্কার, আরও গভীর। আমি চোখ বন্ধ করতেই মনে হল, কেয়ার্ন আমার ঠিক পাশে দাঁড়িয়ে।

একটা কণ্ঠস্বর ভেসে এল,
তুমি যা খুঁজছো, তার মানে একটাই—তুমি আর তুমি নেই। এখন তুমিও পাহাড়।”

আমি চোখ খুলে দেখি সামনে কেউ নেই। ঝর্ণা বয়ে চলেছে, আলো ও ছায়ায় খেলে যাচ্ছে একেকটা মুখ। আমি জানতাম, আমি ডায়েরির পাতা পেরিয়ে গেছি—এখন আমি নিজেই সেই লেখার মধ্যে ঢুকে পড়েছি।

যেখানে আমি ছিলাম না

ঝর্ণার ধারে বসে থাকলে সময়ের বোধ হারিয়ে যায়—আর রাইভেং তো নিজেই এক ঘড়িবিহীন দেশ। আমি জানতাম না কতক্ষণ কেটেছে, শুধু জানতাম, আমার শরীরটা হালকা হয়ে গেছে, যেন নিজের ভারও আমি ভুলে গেছি।

যখন ফিরতে শুরু করলাম, আকাশ ধীরে ধীরে রুপোলি হয়ে উঠছিল। রাস্তায় একা হাঁটতে হাঁটতে মনে হল, এই পথটা আমি আগেও কোনোদিন হেঁটেছি—কিন্তু সেই আমি এখন আর নেই।

বাড়িতে ফিরে দেখি দরজা খোলা। আমি নিশ্চিত ছিলাম, আমি তালা মেরে গিয়েছিলাম। ভিতরে ঢুকে দেখি ঘরে কিছুই বদলায়নি, শুধু ডায়েরিটা বিছানার ওপর খোলা পড়ে আছে, এবং এবার পাতার ওপর লেখা—
তুমি সেই জায়গায় গিয়েছিলে, যেখানে আমি আর আমি ছিলাম না। সেখানে গেলে মুখ হারিয়ে যায়। সাবধান।”

আমি চমকে গেলাম। কে এই “আমি”? সেই স্কুলশিক্ষিকা শাম্বরী? নাকি অন্য কেউ?

রাত গভীর হতেই চারপাশের বাতাস ভারি হয়ে উঠল। পাহাড়ের গায়ে লেগে থাকা কুয়াশা যেন জানলার ফাঁক গলে ঘরের ভিতর ঢুকছিল। হঠাৎ করেই বিদ্যুৎ চলে গেল। ঘর অন্ধকার। আমি মোমবাতি জ্বালাতে গিয়ে দেখি, দরজার ফাঁক দিয়ে হাওয়া ধাক্কা দিচ্ছে। কিন্তু তার সঙ্গে যেন একটা ধ্বনি মিশে আছে—একজন নারীর কান্না।

আমি হিমশীতল পায়ে দরজা খুলে বাইরে এলাম। চারদিকে কুয়াশা, কিন্তু একটুকরো আলো পড়ছে—চাঁদের। সেই আলোয় আমি দেখতে পেলাম একজন মহিলা দাঁড়িয়ে, চুল খোলা, সাদা শাড়ি, আর তার চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে।

আমি দাঁড়িয়ে গেলাম, একদম নিঃশব্দে।

তিনি বললেন, “আমি আমার গল্পটা শেষ করতে পারিনি। তুমি কি শেষ করবে?”

আমি বললাম, “আপনি কে?”

তিনি উত্তর দিলেন না। শুধু ডান হাতটা বাড়িয়ে দিলেন, যার তালুতে একটা পুরনো কাঠের বাঁশি রাখা।

“যদি বাজাও, রাইভেং তোমার হয়ে যাবে। যদি না বাজাও, তবে তুমি ফিরতে পারবে।”

আমি বাঁশিটার দিকে তাকালাম। এমন এক মুহূর্ত, যখন মনে হল, আমি ঠিক করে ফেলতে পারি আমি কে হতে চাই—নিজের পুরনো ছায়া, না কি নতুন কোনো কিছু?

ঠিক তখন, এক ঝলক আলো এসে পড়ল মহিলার মুখে—সেই মুখ আমি চিনি।

ডায়েরির পুরনো পাতায় আঁকা এক নারীমুখ—তাঁরই প্রতিরূপ।

তিনি বললেন, “এই পাহাড় কেবল পথ নয়, এই পাহাড় দরজা। অনেকেই এসেছিল, ফিরেও গিয়েছে। কিন্তু কেউ কেউ থেকে যায়, মুখ ফেলে রেখে।”

আমি বাঁশির দিকে হাত বাড়ালাম, কিন্তু ঠিক তার আগে একটা কণ্ঠস্বর পিছন থেকে চিৎকার করে উঠল, “না! ওটা ধরো না!”

আমি ঘুরে দেখি—তোর্জো দাঁড়িয়ে, দৌড়ে আসছে, নিঃশ্বাস ভেঙে যাচ্ছে তার।

“তুমি জানো না, ওই বাঁশি একবার বাজালে কেউ আর নিজের নাম মনে রাখতে পারে না। আমি দেখেছি। আমিও ভুলতে ভুলতে ফিরে এসেছি।”

মহিলা তখন নিঃশব্দে অদৃশ্য হচ্ছেন কুয়াশার মধ্যে। আমি বাঁশির দিকে তাকিয়ে থাকলাম, আর তোর্জোর দিকে।

সে বলল, “তুমি চাইলে এখান থেকে ফিরে যেতে পারো। কিন্তু তার আগে নিজের ভিতরের ছায়ার মুখোমুখি হতে হবে। যে তৃষা এসেছিল, সে কে ছিল? আর যে তৃষা এখন দাঁড়িয়ে আছে, সে কে?”

আমি হাঁপাচ্ছিলাম। কারণ বুঝতে পারছিলাম, আমি এমন এক ক্রসিংয়ে দাঁড়িয়ে আছি, যার দুটো রাস্তাই আমি।

ডায়েরির পাতা আবার খুলে গেল বাতাসে।
লেখা ভেসে উঠল—
হারিয়ে যাওয়া মানেই শেষ নয়। হারিয়ে যাওয়া মানেই শুরুর ঘর।”

ছায়ার চুলে জড়িয়ে থাকা নাম

তোর্জোর মুখে যে ভয় আমি দেখেছিলাম, তা কেবল বর্তমান নয়—তা ছিল অতীতেরও, যা সে হয়তো ফেলে আসেনি, বরং সঙ্গে নিয়ে চলে। আমি বাঁশিটার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। হাতটা অর্ধেক ওঠা, কিন্তু মনটা যেন দুই দিকে ছিঁড়ে যাচ্ছে। একদিকে এক অচেনা আকর্ষণ, অন্যদিকে নিজের নাম ধরে রাখার জেদ।

তোর্জো ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে বলল, “তুমি জানো, আমিও একসময় বাঁশি ধরেছিলাম। ঠিক এইরকম এক রাতে, যখন রাইভেংয়ের কুয়াশা থামে না, আর আকাশে কোনও তারা জ্বলে না। আমি তখন স্কুলে পড়তাম, আর ওই মহিলাকে দেখতাম মন্দিরের পেছনে। কেউ বলত সে মৃত, কেউ বলত সে পাহাড়ের আত্মা। কিন্তু আমার মনে হত, ও আমার গল্প জানে।”

আমি চুপ করে শুনছিলাম।

সে বলল, “তখনই আমি ভুল করেছিলাম। ওর হাতে দেওয়া বাঁশি আমি বাজিয়েছিলাম। তারপর অনেক বছর আমি ছিলাম না। শুধু পাহাড় ছিল। গাছ, কুয়াশা, ছায়া আর আমি—সব এক হয়ে গিয়েছিল। আমার নাম মুছে গিয়েছিল, মা-বাবা হারিয়ে ফেলেছিল আমাকে। তারপর একদিন, হঠাৎ এক পর্যটক এসে একটা বাঁশির ছবি তোলে। সেই ছবি দেখে আমার ভিতরের ঘুম ভাঙে। আমি নামটা মনে করি—তোর্জো।”

সে আমার দিকে তাকাল, চোখে একরাশ অনুরোধ। “তুমি বাজিও না। আমি থাকি এখন এখানে—লোকজনকে পথ দেখাই, শুধু যাতে কেউ ভুল করে না ফেলে। যেন কেউ ফিরে যেতে পারে।”

আমি মৃদু মাথা নাড়লাম। “কিন্তু আমি এসেছি নিজেকে ফেলে আসতে।”

সে বলল, “তবে নিজেকে খুঁজে পাওয়াটাই কি হারানো নয়?”

আমি হাঁটতে শুরু করলাম বাড়ির দিকে। ডায়েরি বিছানায় খোলা। এবার পাতায় একটা নতুন কবিতা—
ছায়ার চুলে জড়িয়ে থাকা নাম,
হাওয়ার মুখে থেমে থাকা সুর,
তুমি যদি ফিরেও যাও,
তবু রাইভেং তোমার ভিতর থাকবে,
নিস্তব্ধতার মতো।”

পরদিন সকালে আমি বেরিয়ে পড়লাম গ্রাম ঘুরতে। এবার আমি আর পর্যটক নই। আমি যেন সেই পুরনো স্কুলঘরের এক ছাত্র, কিংবা শুকনো পাথরের নিচে গুঁজে রাখা কোনো পুরনো চিঠি।

চায়ের দোকানে বসে এক বৃদ্ধর সঙ্গে আলাপ হল। তিনি বললেন, “তোমার চোখে কুয়াশা লেগে আছে। তুমি রাইভেংয়ের মতো হয়ে যাচ্ছো।”

আমি হেসে বললাম, “রাইভেং কি দেখতে পায়?”

তিনি উত্তর দিলেন, “রাইভেং দেখে না, রাইভেং ধরে রাখে।”

সেদিন সন্ধ্যায় আমি আবার সেই গাছের নিচে গিয়ে দাঁড়ালাম—যেখানে সেই মুখহীন ছায়া প্রথম এসেছিল। কিন্তু আজ সে নেই। আজ শুধু আমি, পাহাড়, আর এক ফালি বাঁশির সুর, যেটা বাজে না, তবু বাজে।

আমি জানি, আমি ধীরে ধীরে হয়ে যাচ্ছি সেই শাম্বরী, সেই তোর্জো, সেই চোন্ডা—যারা গল্প হয়ে গেছে, অথচ গল্প এখনও শেষ হয়নি।

রাইভেংয়ের ভিতর আমি ঢুকে গেছি। এখন আমি জানি, আমার চুলেও হয়তো কারও নাম জড়িয়ে আছে—কেউ যে আমাকে লিখেছে, আর আমি তাকে ভুলে গেছি।

একটি নাম, একটি ফেরার রাস্তা

রাইভেংয়ের সকালগুলো নিঃশব্দ। পাখির ডাকও এখানে যেন চাপা দেওয়া, যেন প্রকৃতি কথা বলতে চায় না—শুধু দেখে। আমি ঘুম ভাঙতেই বুঝলাম, আজ কেমন একটা বদল এসেছে। জানলার বাইরে একরাশ রোদ, অথচ বাতাসে হালকা ঠান্ডা।

বিছানায় ডায়েরিটা নেই। আমি চারদিকে খুঁজে পেলাম না। সেই মুহূর্তে যেন বুকটা ফাঁকা হয়ে গেল। ডায়েরিটা কেবল কাগজ ছিল না—তা ছিল আমার ভিতরের ছায়ার সঙ্গে সংলাপ।

আমি তোর্জোকে খুঁজতে বেরোলাম। চায়ের দোকানে তাকে পেলাম না, মন্দিরেও নয়। যেন সে আজ নেই। গ্রামটাও আজ কেমন বদলে গেছে—চেনা পথ অচেনা মনে হচ্ছে, বাঁকের ওপরে বাঁশি নেই, কুয়াশা নেই, এমনকি গাছগুলোর পাতাও ঠান্ডা হয়ে গেছে।

হঠাৎ, গ্রামের এক কোণের গুহার মুখে আমি দেখতে পেলাম—একটা কাগজের টুকরো উড়ছে। ছুটে গিয়ে ধরলাম। সেটা ডায়েরিরই পাতা। লেখা একটাই লাইন:
তোমার নাম ভুলে গেলে, তোমার ফেরার পথ বন্ধ হয়ে যায়।”

আমার মাথার ভিতর ভর করতে শুরু করল হাজারো প্রশ্ন। আমি কি আসলেই তৃষা আছি? আমি যদি এই পাহাড়ে ছড়িয়ে যাই, তাহলে শহরে ফিরে গিয়ে আমি কাকে বলব আমি কে?

আমি সেই স্কুলঘরের দিকে হাঁটলাম। দরজা খোলা। ভিতরে তখন একটা মেয়ে বসে কাঁদছে—চুল খোলা, সাদা পোশাক, হাতে ডায়েরি।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি কে?”

সে বলল, “আমি সেই যে, যার গল্প লেখা হয়নি। আমার নামের জায়গায় কালি শুকিয়ে গেছে।”

আমি কাছে গিয়ে বললাম, “তাহলে আমি তোমার নাম ধরে ডাকি—তুমি শাম্বরী?”

সে মাথা নাড়ল। “আমি সেই ছায়া, যার নাম আর কেউ মনে রাখে না। কিন্তু তুমি পারো। যদি তুমি আমার নাম দিয়ে নিজেকে মনে রাখো।”

আমি অবাক হয়ে বুঝতে পারলাম—এই গল্পে প্রত্যেক নারী একটাই চরিত্রের রূপ। তৃষা, শাম্বরী, পাহাড়ি মেয়ে—সব একসঙ্গে মিশে আছে।

সে আমাকে একটা পাতলা লাল কাপড় দিল। বলল, “যদি ফিরতে চাও, এই কাপড়টুকু পরিধান করো। এটাই তোমার পরিচয়।”

আমি কাপড়টা হাতে নিয়ে ধীরে ধীরে বেরিয়ে এলাম। তখন দেখি তোর্জো ফিরে এসেছে। তার চোখে বিষণ্নতা আর শান্তি একসঙ্গে।

সে বলল, “তুমি পেরেছো। তুমি নাম মনে রাখতে পেরেছো। তাই এখন তুমি ফিরে যেতে পারো।”

আমি প্রশ্ন করলাম, “তাহলে তুমি থেকে গেলে কেন?”

সে হেসে বলল, “আমি সেই পাহাড়ের নাম, যা মানচিত্রে নেই। আমি সেই মুখ, যাকে কেউ আঁকে না, শুধু অনুভব করে। আমার ফিরে যাওয়ার দরকার নেই।”

আমি আবার সেই প্রথম দিনের পথ ধরে হাঁটা ধরলাম—তিন কিলোমিটার, কুয়াশার ভিতর, কিন্তু এবার আমার হাতে লাল কাপড়, মনে নিজের নাম।

দূরে গাড়ির হর্ন শোনা গেল। আমি জানতাম, আমি ফিরছি—কিন্তু সেই “আমি” নয়, যে এসেছিল। আমি ফিরছি সেই আমি হয়ে, যে রাইভেংয়ের ভিতর দিয়ে গেছে।

যা রইল রাইভেংয়ে

গাড়ির জানালার কাঁচে মাথা ঠেকিয়ে বসে ছিলাম। পাহাড় একের পর এক পিছিয়ে যাচ্ছে, অথচ আমার মনে হচ্ছিল আমি এগিয়ে যাচ্ছি না, বরং ফেলে আসছি কিছু—একটা নাম, একটা সুর, একটা ছায়া।

ড্রাইভার জিজ্ঞেস করল, “আপনি একা এসেছিলেন?”
আমি একটু চুপ করে থেকে বললাম, “হ্যাঁ।”
সে হেসে বলল, “একা ফিরছেন তো?”
আমি জানি না কীভাবে উত্তর দেব।

গাড়ি মালবাজার পেরিয়ে আরও নেমে চলল। মোবাইল সিগন্যাল ফিরে এলো, শহরের কোলাহল ধীরে ধীরে ফিরে এল। কিন্তু আমার ভিতরটা থেমে থাকল কোথাও—রাইভেংয়ের বাঁকের ধারে, ঝর্ণার গর্জনের মাঝে, কিংবা সেই মেয়েটির চোখে, যার নাম কেউ জানত না।

ফিরে এসে প্রথম রাতে আমি শহরের ব্যস্ততা সহ্য করতে পারছিলাম না। ট্রাফিক, হর্ন, মোবাইল, সময়ের ঠোকাঠুকি—সব কেমন একটা অচেনা লাগছিল।

আমি ডায়েরিটা খুঁজে পেলাম না ব্যাগে। কোথাও নেই। তবে ব্যাগের এক কোণে সেই লাল কাপড়টা পড়ে ছিল। সেটার গন্ধে এখনও রাইভেংয়ের ভোর লেগে আছে—ভেজা ঘাস, কাঠের ঘরের দেওয়াল, আর বাঁশির ছায়া।

সেই রাতেই আমি জানালার ধারে বসে লিখতে শুরু করলাম। প্রথম লাইনে লিখলাম—
আমি রাইভেংয়ে ছিলাম, আর এখন রাইভেং আমার ভিতরে।”

পরের কয়েকদিন শহরের বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হল। তারা বলল, “তুই খুব চুপচাপ হয়ে গেছিস।”
আমি বললাম, “শব্দে শব্দে ভরছিলাম আগে। এখন বুঝেছি, চুপ থাকা মানেই হারিয়ে যাওয়া নয়।”

একদিন মেট্রোতে এক অচেনা মেয়েকে দেখলাম, চোখে ঠিক সেই অভিব্যক্তি—যে কেউ নিজেকে খুঁজতে চাইছে। আমি হেসে বললাম, “তুমি যদি একা কোথাও যেতে চাও, তাহলে রাইভেং বলেও একটা জায়গা আছে।”

সে জিজ্ঞেস করল, “মানচিত্রে?”
আমি মাথা নাড়লাম, “না। গল্পে।”

অনেক বছর পর আমি আবার রাইভেংয়ে ফিরব—এই শহরের সমস্ত পরিচয় মুছে। হয়তো তখন তোর্জো থাকবে না, সেই স্কুলঘর ভেঙে পড়বে, শাম্বরীর ছায়া মিলিয়ে যাবে।

তবু আমি জানি, রাইভেং থাকবে।
তার ভিতরে থাকবে আমার লেখা, আমার চুপ থাকা, আর সেই বাঁশির সুর—
যা একদিন বলেছিল, “যদি হারাও, তবে তুমি একদিন নিজেকেই পাবে।”

আমি পেয়েছি।

আর এখন, আমি হারিয়ে যেতে পারি।

সমাপ্ত

WhatsApp-Image-2025-06-30-at-4.41.44-PM.jpeg

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *