Bangla - ভূতের গল্প - রহস্য গল্প

রহস্যময় অশরীরী কণ্ঠ

Spread the love

অর্জুন দে


গ্রামের প্রান্তে অবস্থিত খোশরুরাজ সরকারের পুরনো বাড়িটি বছরের পর বছর আগের সেই ভাঙাচোরা মেঝে আর ছাদের গাছের ফাঁকফোকর দিয়েই তার কাহিনী বলে চলে। আজও বাড়ির দেয়ালে সোনালী দিনের স্মৃতিগুলো উজ্জ্বল—তবে এখন যেন ম্লান হয়ে এসেছে সময়ের ধুলোয়। খোশরুরাজ, যে এককালে গ্রামের মঞ্চের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কণ্ঠশিল্পী ছিলেন, এখন নির্জনতার মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছেন। সাদা ধোঁড়া চুল আর গভীর রেখাচিত্র তার মুখে সময়ের সাক্ষী, কিন্তু চোখে এখন শুধুই নিস্তব্ধতা। পুরোনো দিনের গান আর সুরের স্মৃতি তার হৃদয়ে বাজে বারবার, যেন এক পুরানো রেকর্ড প্লেয়ারের সিডির মতো। তার একাকীত্ব ঘিরে রেখেছে একটি গভীর শূন্যতা—তাঁর একমাত্র সন্তান অনেক বছর আগেই শহরে চলে গেছে, আর স্ত্রী হারিয়ে গেছেন কেটে যাওয়া বছরের ফাঁকে। গ্রামের লোকজন দূর থেকে তাকিয়ে দেখে, যেন এক ভাঙ্গা সুরের সুরেলা স্মৃতি হয়ে তিনি আছেন এখানে, একাকী, অতীতের খোঁজে।

খোশরুরাজের দিন শুরু হয় সূর্য উঠার আগে। ভোরের মৃদু আলোয় বাড়ির বারান্দায় বসে নিজের অতীতের গানের লাইন গুনে গুনে তিনি একে একে মনে করেন গানগুলো যেন তার জীবনের একটি জীবন্ত অংশ। গ্রামের সকলে তাঁকে দেখে বিস্ময়ে মিশ্রিত শ্রদ্ধায়, কারণ একসময় তাঁর কণ্ঠে মুগ্ধ হয়ে গ্রামছোট থেকে বড় সবাই গান শুনতে ভিড় করত। কিন্তু আজ তিনি আর গান করেন না, মুখে নেই সেই ঝনঝনানি, কেবল নিঃশব্দ শোক আর স্মৃতির মাঝে ডুবে থাকা। রাত নামলেই খোশরুরাজের বাড়ির পুরনো কাঠের জানালা দিয়ে মাঝে মাঝে ভেসে আসে সেই অশরীরী কণ্ঠের প্রথম নরম ছোঁয়া, যা কোনো মানুষের নয়—একটু দূরে থেকে শুনলে মনে হয় যেন প্রেতাত্মার গান, কিন্তু একথা কেউ মুখ খোলে বলে না। খোশরুরাজের মন এ গান শুনে জড়িয়ে পড়ে এক অবর্ণনীয় অদ্ভুত অনুভূতিতে—কখনো তা শান্তির বার্তা দেয়, কখনোবা অতীতের মধুর স্মৃতিকে জীবন্ত করে তোলে। প্রতিদিন রাতের এই কণ্ঠই যেন তার একমাত্র সঙ্গী, যা তাকে একাকীত্বের অতল থেকে টেনে আনে এক রহস্যময় জগতে।

গ্রামের লোকেরা রাতে বাড়ির কাছে গেলে এক অদ্ভুত সুর শোনে, যে সুর যেন কেউ গায় না, তবে বাজে। অনেকেই বলেছে, “এই কণ্ঠ শুনলে রাতের ঘুম ভাঙ্গে, স্বপ্ন আসে ভয়ংকর ও রহস্যময়।” কিন্তু খোশরুরাজ এই সুরকে আতঙ্কের দৃষ্টিতে দেখে না—তার কাছে এটি কোনো প্রেতাত্মার গান নয়, বরং হারানো ভালোবাসার এক সুরেলা স্মৃতি। তিনি জানেন না কে বা কী সে কণ্ঠ, তবে তার মাঝে একটা আশ্চর্য বন্ধন তৈরি হয়েছে।

রিমা মন্ডল গ্রামের প্রান্তে নতুন এসেছে গত কয়েক মাস আগে। তার আগমনের সঙ্গে যেন পুরো গ্রামেই একটা নতুন প্রাণবন্ততা ঢুকে পড়েছে। তার লম্বা, কালো চুল আর গভীর নীল চোখ তাকে অন্যদের থেকে আলাদা করে তোলে। গ্রামের সবাই তাকে ভালোবাসে, কারণ রিমার মধ্যে রয়েছে এক অনবদ্য সাহস আর উৎসাহ, যা সহজেই চোখে পড়ে। রিমা উচ্চমাধ্যমিক পাস করেছে শহরের একটি কলেজ থেকে, কিন্তু তার হৃদয় এখনো গ্রামের নিস্তব্ধ প্রাকৃতিক পরিবেশ আর সুরের জগতে বন্দী। সে ছোটবেলা থেকেই গানের প্রতি অপার ভালোবাসা পোষণ করে আসছে। গ্রামের অনুষ্ঠান কিংবা পূজার সময় রিমা প্রায়ই মঞ্চে গান গেয়ে সবার মন ছুঁয়ে যায়। কিন্তু রাতে একদিন, গ্রামের বাগানের পাশে দাঁড়িয়ে সে শোনে একটি রহস্যময়, অশরীরী কণ্ঠের মৃদু সুর, যা প্রথমে তাকে বিমোহিত করে এবং পরবর্তীতে তার জীবনে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা ঘটায়।

রিমার মন ভরে ওঠে সেই গানের সুরের সঙ্গে, যা এতদিন তার কানে আসেনি। সে গভীর রাতে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এসে শুনতে থাকে সেই অদ্ভুত কণ্ঠ, যা যেন তাকে ডাকে এক অজানা পৃথিবীতে। সে প্রথমবারের মতো বুঝতে পারে যে এই কণ্ঠটি কোনো সাধারণ মানুষের নয়; বরং এটি কোনো অতিপ্রাকৃত শক্তির স্পন্দন, যা মানুষের অন্তর থেকে উঠে আসে। রিমার সাহস ও কৌতূহল তাকে বাধ্য করে সে গানের উৎস সন্ধানে নামতে। সে জানতে চায়, এই কণ্ঠ কার এবং কেন আসে? সে তার নোটবুকে সেই সুরের মৃদু শব্দগুলো নোট করতে থাকে, মাঝে মাঝে নিজের গলার স্বরে সুর মিলিয়ে দেখতে চায়। গান তার জন্য কেবল শব্দ নয়, এটি একটা অনুভূতি, যা জীবনের নানা রঙ ফুটিয়ে তোলে। এই অধ্যায়ে আমরা রিমার চঞ্চলতা, তার গভীর আবেগ এবং গানপ্রেমের সঙ্গে তার বেঁচে থাকার স্পৃহা দেখতে পাই, যা তাকে ধীরে ধীরে গ্রামের গোপন রহস্যের কাছে নিয়ে যায়।

গ্রামের বয়স্করা রিমাকে দেখে অবাক হয়, কারণ সে তাদের ভয় ও সন্দেহকে অগ্রাহ্য করে অজানা জগতের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে। রিমার আগমন শুধু একটা নতুন মুখই নয়, বরং গ্রামের জীবনে একটা নতুন আলো, যা পুরানো রীতিনীতিকে চ্যালেঞ্জ দেয়। সে খোশরুরাজের বাড়ির কাছাকাছি থেকে সেই কণ্ঠ শুনে নতুন করে জীবনের অর্থ খুঁজে পায়। তার আগ্রহ গ্রামের অন্যদের চেয়ে বেশি, যা তাকে এক ধরনের নেত্রীত্ব দেয় এই রহস্যের অনুসন্ধানে।

সুরেন চৌধুরী গ্রামে পরিচিত একজন বাস্তববাদী মানুষ, যিনি জীবনের প্রতিটি বিষয়কে যৌক্তিক ও প্রমাণের আলোকে দেখেন। পোল্ট্রি ব্যবসায় তাঁর ভালো নাম এবং গ্রামে বেশ সম্মানও পেয়েছেন। শরীর গড়নের কিছুটা শক্তিশালী, মুখে গম্ভীর ভাব আর হাতে সদা সিগারেট বা তামাকের প্যাকেট থাকা তার অভ্যাস। জীবনের ছোটবড় সমস্যাগুলো নিয়ে চিন্তা করেন, কিন্তু অতিপ্রাকৃত কিছুকে কখনো গুরুত্ব দেননি। যখন গ্রামের মানুষ রাতের অশরীরী কণ্ঠের কথা বলত, তখন সুরেন হাসিমুখে এদের ‘অন্ধবিশ্বাস’ বলে উড়িয়ে দিতেন। তাঁর কাছে এই কণ্ঠের গল্পগুলো শুধু গুজব, গ্রামের মানুষের অবান্তর কল্পনা। তাই রাতে বাড়ির পাশে গিয়ে বা অন্ধকারে একাকী থাকার সময় তিনি কণ্ঠ শুনবেন, এমন কিছু ভাবতেই পারেননি। এই বাস্তববাদ ও সন্দেহের মাঝে দিয়ে তাঁর দিন কাটে, কিন্তু রাতের অন্ধকারে কিছু অদ্ভুত অনুভূতি ধীরে ধীরে তাঁর ভিতর একটা মানসিক দ্বন্দ্ব জাগিয়ে তোলে।

কিছু রাত পর রাত, সুরেন গভীর ঘুমের মাঝে ভয়ঙ্কর স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন—স্বপ্নগুলো যেন বাস্তবের সীমানা ভেঙে তার মনের গভীরে প্রবেশ করে। স্বপ্নগুলোতে সে শুনতে পায় সেই অশরীরী কণ্ঠের মৃদু সুর, যা তাকে ডেকে নিয়ে যায় এক অজানা জগতে। কখনো স্বপ্নে দেখতে পায় ভাঙা একটি মঞ্চ, যেখানে একবার খোশরুরাজ গান গাইতেন, আর তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে এক তরুণী, যার মুখ কখনো স্পষ্ট হয় না। আরেকবার স্বপ্নে সে দেখেন গ্রামের মানুষের চোখে বিস্ময় আর ভয়, যখন রাতের সেই কণ্ঠ ভেসে আসে বাতাসে। স্বপ্নের মাঝেই সে নিজের সন্দেহ আর বাস্তবতার মধ্যে যুদ্ধ করে, একদিকে তার মন বলে—‘সবই গুজব, ভুল কল্পনা’। অন্যদিকে, সে অনুভব করে কিছু সত্যিই আছে যা সে মেনে নিতে পারেনা। এই দ্বন্দ্বের কারণে সুরেনের ঘুম ভেঙে যায়, রাত কাটে অস্থিরতার মাঝে। দিনে সে চুপ করে থাকেন, কিন্তু গভীরে ভয় এবং অবিশ্বাসের মাঝেই তার মানসিক অবস্থান এক দুর্বিষহ সঙ্কটে আটকে পড়ে।

অধ্যায়ের শেষে আমরা দেখতে পাই সুরেনের মন ক্রমশ পরিবর্তিত হচ্ছে। সে এখন আগের মতো সবকিছু অস্বীকার করতে পারে না। রাতের স্বপ্ন আর অশরীরী কণ্ঠের প্রভাব তার জীবনে অজান্তেই বড় ধরনের পরিবর্তন আনছে। বাস্তববাদী সুরেনের মধ্যে ক্রমশ একটা নতুন ধরণের আগ্রহ ও ভয় জন্ম নিচ্ছে—যা তাকে রিমা ও খোশরুরাজের রহস্য অনুসন্ধানে এক নতুন ভূমিকা নিতে বাধ্য করছে। তাঁর সন্দেহ এবং ভয় তাকে দ্বিধাগ্রস্ত করে তুললেও, এই অধ্যায়ে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে তিনি আর শুধুমাত্র অবজ্ঞার পথে হাঁটবেন না, বরং এই রহস্যের সামনে এসে নিজের সত্য খুঁজতে শুরু করেছেন।

গ্রামের এক শান্ত পরিবেশে প্রিয়া দেবী তাঁর ছোট্ট বাড়িতে বসে ছিলেন, হাতে চা’র পাত্র। পুরু সাদা শাড়ি আর ছোট চশমা পরা তাঁর চেহারায় মমত্ববোধ আর আধ্যাত্মিকতার ছাপ স্পষ্ট। গ্রামের প্রায় সবাই তাঁকে জানে এক যোগী নারী হিসেবে, যিনি তন্ত্র, মন্ত্র ও আধ্যাত্মিক বিষয় নিয়ে গভীর জ্ঞান রাখেন। দীর্ঘ বছরের সাধনার ফলে তাঁর মন এক গভীর স্থিরতা ও বুদ্ধিমত্তায় পূর্ণ। যখন গ্রামের অশরীরী কণ্ঠের ঘটনা গ্রামের মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করল, তখন প্রিয়া দেবী এ বিষয়টি শুধুমাত্র গুজব হিসেবে নেননি। বরং তাঁর দৃষ্টিতে এটি ছিল এক আত্মার বার্তা, এক ধরণের আধ্যাত্মিক সংকেত, যা মানুষের মনে বিশেষ কিছু জাগ্রত করতে চায়। বাড়ির ভেতরে বসে তিনি খোশরুরাজ ও রিমার সঙ্গে সেই কণ্ঠের বিষয়ে কথা বলতেন, তাঁদের উদ্বেগ শুনতেন এবং নিজস্ব দৃষ্টিকোণ তুলে ধরতেন।

প্রিয়া দেবীর কথোপকথন ছিল শান্ত, সরল, কিন্তু গভীর অর্থবহ। তিনি বলতেন, “এই কণ্ঠ কোনো সাধারণ শব্দ নয়, এটি কোনো প্রিয় আত্মার বার্তা, যা এই জগতে কিছু বলতে এসেছে।” তিনি বিশ্বাস করতেন যে কণ্ঠটি হয়তো একজন হারানো প্রাণের আত্মা, যিনি জীবনের শেষ পর্যায়ে এক গুরুত্বপূর্ণ বার্তা রেখে গেছেন। তাঁর মতে, যাদের হৃদয় স্পর্শ করে সেই কণ্ঠ, তারা এক ধরনের পরম সত্যের কাছে পৌঁছানোর সূচনা করছে। তিনি খোশরুরাজকে অনুরোধ করতেন তাঁর অতীত স্মৃতিগুলো খুলে বলতে, কারণ আত্মার কণ্ঠ প্রায়শই তাদের জীবনের আবেগ ও স্মৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত। রিমার সাহসী মনোভাবের প্রশংসা করতেন এবং তাঁকে উৎসাহিত করতেন এই রহস্যের গভীরে যেতে, কারণ প্রকৃত সত্য সবসময় মানুষের অন্ধকার মনের ভেতরে লুকানো থাকে। প্রিয়ার কথায় যেন এক অদৃশ্য জোয়ারের স্রোত বইত গ্রামজুড়ে, যা ধীরে ধীরে অন্ধকার ভেদ করে আলো ছড়িয়ে দিচ্ছিল।

এই অধ্যায়ে আমরা দেখতে পাই প্রিয়ার আধ্যাত্মিক বিশ্বাস শুধু একটি ধর্মীয় ভাবনা নয়, বরং এক গভীর মানবিক ও মানসিক প্রক্রিয়া, যা গ্রামের সকলের মনে নতুন আস্থা ও ভরসার সঞ্চার করে। তাঁর সঙ্গে খোশরুরাজ ও রিমার কথোপকথন থেকে স্পষ্ট হয় যে, এই কণ্ঠের রহস্য কেবল অতিপ্রাকৃত নয়, বরং মানুষের অনুভূতি, স্মৃতি আর ভালবাসার সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে। প্রিয়া দেবীর তন্ত্র সাধনা, মন্ত্রপাঠ আর মনন-মগনের দৃশ্যগুলি গল্পের আবেগ ও রহস্যময়তা বাড়িয়ে তোলে, যা পাঠককে এক অন্য আধ্যাত্মিক জগতে নিয়ে যায়। তাঁর বিশ্বাস এই কণ্ঠের আসল উদ্দেশ্য মানুষকে এক নতুন উপলব্ধির দিকে নিয়ে যাওয়া—একটা এমন জায়গা যেখানে জীবনের শেষ ও শুরু মিলেমিশে যায়, আর অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সীমানা ভেঙে পড়ে।

গ্রামের বুকে তখন এক অদ্ভুত পরিবর্তনের লক্ষণ দেখা দেয়। রাতের সেই রহস্যময় অশরীরী কণ্ঠের মৃদু সুর ভেসে উঠল যখন, গ্রামের কয়েকজন সাধারণ মানুষ প্রথমবারের মতো অচেনা ও অদ্ভুত স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। স্বপ্নগুলো ছিল ঘন ও গভীর, কখনো অতীতের ঝলক, কখনোবা এক অজানা ভবিষ্যতের আভাস। রাত্রির নিঃশব্দে এই কণ্ঠ যেন তাদের মনের অন্তর থেকে চেঁচিয়ে উঠত, কোনো এক অতীন্দ্রিয় সত্যের সন্ধান দিতে। গ্রামের ছোট-বড় সবাই কিছু না কিছু অনুভব করছিল, কিন্তু বলতে পারছিল না। স্বপ্নে আসা এই রহস্যময় মায়াজাল তাদের জীবনের রং পাল্টিয়ে দিতে শুরু করল, যেন অশরীরী কণ্ঠের মন্ত্রমুগ্ধতায় তারা বাধা পড়েছে এক অন্য জগতে।

প্রথম যারা এই অশরীরী কণ্ঠ শুনেছিল, তাদের মধ্যেই ছিল মধ্যবয়সী কৃষক হরিবাবু, যিনি একসময় খুবই কর্মঠ ও জীবনে নির্ভরশীল ছিলেন। কিন্তু স্বপ্ন দেখতে শুরু করার পর তার আচরণে অদ্ভুত পরিবর্তন আসে। স্বপ্নগুলোতে সে বারবার দেখত একটি পুরানো মাঠ যেখানে এক ধূসর আকাশের নিচে একাকী দাঁড়িয়ে একজন কণ্ঠশিল্পী গান গাইছেন। এই দৃশ্য বারবার তার মনকে আঘাত করে, আবার অনেক সময় স্বপ্নে সে শুনতে পেত সেই কণ্ঠের সুর, যা তার হৃদয়কে ছুঁয়ে যায়। ধীরে ধীরে হরিবাবুর মন অস্থির হতে থাকে, সে রাত জাগ্রত হয়ে অশরীরী কণ্ঠের উৎস খুঁজতে শুরু করে। শুধু সে নয়, গ্রামের কয়েকজন তরুণ ও বয়স্ক লোকের মধ্যেও একই রকম এক ধরনের অদ্ভুত বোধ জন্মায়—তাদের মধ্যে কেউ কেউ স্বপ্নে অতীতের ভুলগুলো দেখতে শুরু করে, কেউ আবার জীবনের মর্মস্পর্শী ঘটনা নিয়ে কল্পনা ভ্রমণে লিপ্ত হয়।

স্বপ্ন এবং বাস্তবের এই সূক্ষ্ম রেখার মধ্যে দিয়ে ধীরে ধীরে তাদের দৈনন্দিন জীবনেও পরিবর্তন আসতে থাকে। স্বপ্নের বার্তাগুলো তাদের জীবনকে নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখতে শেখায়। কেউ কেউ স্বপ্নের মাধ্যমে জীবনযুদ্ধের প্রতি নতুন উদ্দীপনা পায়, কেউ আবার নিজের ভুল বোঝাপড়া ও অভিমান ভুলে ক্ষমার পথ খুঁজে পায়। অশরীরী কণ্ঠের মায়াজালে বাধা এই মানুষগুলো ক্রমশ নিজেদের মধ্যে পরিবর্তন অনুভব করে, যার প্রভাব গ্রামেও ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে। তাদের আচরণে বদল আসতে থাকে, মনোজগতের মধ্যে এক আশ্চর্য প্রেরণা কাজ করতে শুরু করে।

বৃদ্ধ খোশরুরাজ সরকারের মন যখন অশরীরী কণ্ঠের মৃদু সুরে মুগ্ধ হয়, তখন তার মনে ভেসে ওঠে পুরনো দিনের স্মৃতির সরণি। এক সময় তার কণ্ঠ ছিল গ্রামের গানে এক অনন্য অলঙ্কার—মঞ্চে উঠলেই তার সুরে মুগ্ধ হতো শ্রোতারা, সুর আর আবেগে ভরে উঠত পুরো পরিবেশ। সেই সময়ে গ্রামের ছোটো বড় মিলিত হতো উৎসবের মঞ্চে, যেখানে খোশরুরাজ নিজের প্রাণ দিয়েছিলেন প্রতিটি গানে। মঞ্চ ছিল তার জীবনের আলোর উৎস, যেখানে সে নিজের সুখ-দুঃখ, ভালোবাসা আর আকাঙ্খা এক সুরে মিলিয়ে ফেলত। কিন্তু সেই জীবনের আনন্দের সঙ্গে ছিল কিছু গভীর দুঃখও—একটি হারানো প্রেমের গল্প, যা আজও তার হৃদয়ের সবচেয়ে নাজুক কোণে লুকিয়ে আছে। তখনের দিনগুলো ছিল জীবনের এক অপরূপ সময়, যা আজকের একাকীত্বকে আরও তীব্র করে তোলে।

প্রেমের স্মৃতিটা ছিল এক অন্যরকম সুন্দর ও বেদনাদায়ক। রূপসী মেঘলা, গ্রামের এক তরুণী, যার সাথে খোশরুরাজের ভালোবাসার সম্পর্ক ছিল গভীর, কিন্তু জীবন ও সমাজের নানা বাধা তাদের আলাদা করে দেয়। তারা অনেকবার গোপনে দেখা করত, গান গাইত একসঙ্গে, স্বপ্নে বিভোর হত একে অপরের ভবিষ্যৎ নিয়ে। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে, মেঘলা শহরে চলে যায়, আর সেই বিদায় হয় ছিল চিরস্থায়ী। সেই স্মৃতি আর মেঘলার কণ্ঠের প্রতিধ্বনি এখনো মাঝে মাঝে রাতে খোশরুরাজের কানে বাজে, যেন মেঘলার আত্মা জীবিত থেকে তাকে ডাকছে। এই স্মৃতিগুলো তাঁর মনের গভীরে তীব্র ভালোবাসা আর নস্টালজিয়ার সুর তুলে ধরে, যা রাতের অশরীরী কণ্ঠের রহস্যের সাথে এক অদ্ভুতভাবে মিশে যায়।

এই অধ্যায়ে আমরা দেখতে পাই, কিভাবে খোশরুরাজের অতীত জীবনের স্মৃতিগুলো ধীরে ধীরে গল্পের গূঢ় রহস্যের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। তার হারানো ভালোবাসা এবং মঞ্চজীবনের সুরেলা দিনগুলো কণ্ঠের আসল উৎসের গোপন চাবিকাঠি হতে পারে। খোশরুরাজ যখন সেই স্মৃতির অতলে ডুবে যায়, তখন তার হৃদয়ে জেগে ওঠে এক অদ্ভুত আশা—হয়তো সেই কণ্ঠের মাধ্যমে মেঘলা এখনো তার সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করছে, আর সে সেই বার্তা বুঝতে চায়।

রিমার মনে কেবল অশরীরী কণ্ঠের মায়াজাল বাঁধা নয়, তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা গভীর রহস্যের জানালা খুলে যাওয়ার তীব্র ইচ্ছা জন্ম নেয়। রাতের নিস্তব্ধতা যখন সেই কণ্ঠের সুরে ভরে উঠে, তখন সে নিজেকে আর থামাতে পারে না—কণ্ঠের উৎস খুঁজে বের করা তার একমাত্র লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। গ্রামের প্রায় সকল পুরনো মানুষকে সে জিজ্ঞেস করতে শুরু করে, খোশরুরাজের জীবন ও অতীত সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে শুরু করে। তার কাগজে নোট করে যায় প্রাপ্ত তথ্যগুলো, কখনো বই থেকে, কখনো গ্রাম্য বয়স্কদের মুখ থেকে। সে শহরের পুরনো গ্রন্থাগারে গিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে গবেষণা করে, যেখানে সে কণ্ঠশিল্পীদের ইতিহাস, লোকগীতি, আর আধ্যাত্মিক কাহিনীর নিদর্শন খুঁজে পায়। এই অনুসন্ধান তাকে গ্রামের গভীরে এক নতুন দিশার সন্ধানে নিয়ে যায়, যেখানে পুরানো গান, স্মৃতি আর আত্মার কাহিনি একাকার হয়ে ওঠে।

রিমা বিভিন্ন উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে করতে খোশরুরাজের মঞ্চজীবনের নানা দিক সম্পর্কে জানে, যেমন তার পুরানো সঙ্গীত সংগঠন, তাঁর প্রিয় সঙ্গীতী ও বন্ধুবৃন্দ, আর সেই হারানো প্রেমের গল্পের সূত্র। সে খোশরুরাজের সঙ্গে আরও বেশি সময় কাটাতে শুরু করে, তার মনোরম কণ্ঠের পিছনের গল্প বোঝার চেষ্টা করে। সেই সাথে, গ্রাম্য বয়স্ক মহিলাদের কাছ থেকে সে শুনে আধ্যাত্মিক বিশ্বাস ও কণ্ঠের আভাস—যা শুধু সঙ্গীত নয়, বরং এক ধরণের বার্তা হিসেবে গৃহীত হয়। রিমার অনুসন্ধান গভীর হয়, যখন সে আবিষ্কার করে যে এই কণ্ঠের সঙ্গে গ্রামের বহু পুরোনো ঘটনা ও আধ্যাত্মিক বিশ্বাস জড়িয়ে আছে, যা সাধারণ মানুষের চোখে অদেখা থেকে গেছে। সে খোশরুরাজ ও প্রিয়ার কথা শুনে বুঝতে পারে, কণ্ঠটি কেবল একটি সঙ্গীত নয়, এটি এক আত্মার বার্তা, যাকে বুঝতে হলে তাকে গ্রাম্য আধ্যাত্মিকতা ও ইতিহাসের ভেতরে প্রবেশ করতে হবে।

এই অধ্যায়ে রিমার অনুসন্ধান তাকে এক নতুন জগতের দরজা খুলে দেয়, যেখানে রহস্য ও বাস্তবতা মিশে এক অনন্য ধাঁধায় পরিণত হয়। রিমার সাহস ও অধ্যবসায় কেবল কণ্ঠের গোপনীয়তা খোলার জন্য নয়, বরং নিজের মনের অজানা অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এসে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি পেতে সাহায্য করে। তার খোঁজখবর গ্রামের অন্যদের মধ্যেও আলো ছড়ায়, যারা এখন আর কেবল ভয়ে বসে নেই, বরং রহস্যের অন্তর্নিহিত সত্য জানার জন্য আগ্রহী।

সুরেন চৌধুরীর মনে এখন আর আগের মতো অবজ্ঞা বা অন্ধকার অগ্রাহ্য করার মনোভাব নেই। রাতের অশরীরী কণ্ঠ এবং বারবার ভয়ঙ্কর স্বপ্ন তার ভিতর একটা অদ্ভুত অস্থিরতা তৈরি করেছে, যা তিনি সহজে লুকিয়ে রাখতে পারছেন না। তার শরীরের মাংসপেশি যেন বারবার কাঁপছে, হাতের তামাক-প্যাকেট এখন অনেক সময় অচেনা এক ধরনের কম্পন অনুভব করে। সে যতই নিজেকে বলুক, ‘সবই শুধু কল্পনা’, হৃদয় জানে অন্য কথা। স্বপ্নগুলো তার মনকে আঘাত করে, যেমন কোনো অদৃশ্য হাত তার হৃদয়ের ওপর চাপ দিচ্ছে। তার মানসিক অবস্থা ধীরে ধীরে দুর্বল হতে শুরু করে, এবং সে অনুভব করে যে সে একা নয়—গ্রামের অন্য মানুষও যেন একই ধরণের পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এই ভয় ও সংশয়ের মাঝে সে নিজেকে দমন করতে চায়, কিন্তু ঘুমের পর ঘুমে সে কণ্ঠের মায়াজালে আটকে পড়ে।

ধীরে ধীরে সুরেনের ভয় তাকে বদলে দিতে শুরু করে। বাস্তববাদী মানুষ হওয়ার কারণে সে কখনোই সহজে বিশ্বাস করত না অশরীরী বা অতিপ্রাকৃত কিছুকে, কিন্তু এখন সে উপলব্ধি করতে শুরু করে যে এই ঘটনাগুলো কেবল তার কল্পনাতেই সীমাবদ্ধ নয়। তার ভেতরে একটা অদ্ভুত ধোঁয়া জমে, যা তাকে এক ধরনের রহস্যময় দৃষ্টিভঙ্গির দিকে ঠেলে দেয়। রাতে যখন সে অশরীরী কণ্ঠের সুর শুনে, তখন সে আর পালিয়ে যাওয়ার পথ খুঁজে পায় না, বরং তার মনোযোগ সেই কণ্ঠের দিকে যায়। সে খোশরুরাজ ও রিমার সঙ্গে কথোপকথনে অংশ নিতে শুরু করে, যেখানে সে তার সন্দেহ ও ভয় প্রকাশ করে। এই পরিবর্তন তাকে এক নতুন ভূমিকায় নিয়ে যায়—সে আর কেবল একজন সন্দেহভাজন নয়, বরং রহস্যের সন্ধানী হিসেবে নিজের অবস্থান তৈরি করতে থাকে।

গ্রামের ছোট্ট মন্দিরের পেছনে, সন্ধ্যার পর প্রিয়া দেবী একাকী বসে ছিলেন। তাঁর হাতে ছিল প্রাচীন মন্ত্রপাঠের বই, চারপাশ ছিল ধূপ ও মোমবাতির আলোয় মাখামাখি। কণ্ঠের রহস্য যে গ্রামের মানুষের মন থেকে উঠে যাচ্ছে না, তা উপলব্ধি করে প্রিয়া সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন গভীর তন্ত্র সাধনার মাধ্যমে তার মূলে পৌঁছানোর। তিনি জানতেন, এই সাধনা এক ধরনের আধ্যাত্মিক যাত্রা, যেখানে শব্দের শক্তি ও মন্ত্রের ছোঁয়া দিয়ে মানুষের অদেখা জগতের দরজা খোলা যায়। রাতের সেই অশরীরী কণ্ঠের আধ্যাত্মিক উপস্থিতি উপলব্ধি করতে তাঁর মন অস্থির হলেও দৃঢ় ছিল। তন্ত্র সাধনার মাধ্যমে তিনি চেষ্টা করছিলেন সেই আত্মার সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে, যার গানের সুর গ্রামজুড়ে রাতের নিঃশব্দে ভেসে উঠেছে।

প্রিয়া দেবীর তন্ত্র সাধনা ছিল এক দীর্ঘ ও জটিল প্রক্রিয়া—শব্দ, ছন্দ আর চিন্তাকে মিলিয়ে একাত্ম হওয়া। তিনি রাত জাগরণে মন্ত্রপাঠ করতেন, শরীর ও মনকে একাগ্র করে বসতেন ধ্যানের মধ্যে। কখনো তিনি হাত তুলে নাচের মতো ভঙ্গিতে আবর্তিত হতেন, যেন মন্ত্রের শক্তি তাঁকে এক অনন্য জগতে নিয়ে যাচ্ছে। তার সাধনার মাঝে এক অদ্ভুত আলো ঝলমল করতে শুরু করে, যা গ্রামবাসীর অনেকের চোখে পড়ে। এই আলো যেন এক আত্মার উপস্থিতি জানাচ্ছিল—সেই আত্মা, যাকে প্রিয়া খুঁজছেন। তন্ত্র সাধনার এক পর্যায়ে প্রিয়া একটি গভীর দর্শনে প্রবেশ করেন, যেখানে তিনি দেখতে পান একটি পুরনো মঞ্চ, আর সেখানে এক নারী কণ্ঠশিল্পী গান গাইছেন—তাকে ঘিরে ছিল সুর, আবেগ এবং একটি নিঃশেষিত ভালোবাসার গল্প। এই দর্শন প্রিয়া বোঝাতে পারেন যে, কণ্ঠটি সেই নারীর আত্মার বার্তা, যিনি জীবনে অনেক কিছু হারিয়ে গেছেন, কিন্তু এখনো তার প্রেম ও বেদনা এই গানের মাধ্যমে গ্রামে পৌঁছাচ্ছেন।

১০

গ্রামের পুরো পরিবেশ যেন এক অদ্ভুত উত্তেজনায় ভরে উঠেছিল। রাতের অশরীরী কণ্ঠের রহস্য একবারে যেন অনেক দূর থেকে স্পষ্ট হতে শুরু করল। খোশরুরাজ, রিমা, সুরেন আর প্রিয়া—all তাঁরা একত্রিত হয়ে সেই রহস্যের চূড়ান্ত ফাঁসের মুখোমুখি হয়েছিলেন। প্রিয়ার তন্ত্র সাধনার মাধ্যমে প্রাপ্ত দর্শন এবং খোশরুরাজের অতীত স্মৃতির মিলনে জানা গেল যে, সেই কণ্ঠ আসলে ছিল এক হারানো কণ্ঠশিল্পীর আত্মার গান—যিনি খোশরুরাজের প্রিয়জন, মেঘলা। মেঘলা ছিলেন গ্রামের এক উজ্জ্বল কণ্ঠশিল্পী, যার গান ছিল প্রাণের গভীরতা আর আবেগের এক অনন্য প্রকাশ। তাঁর আকস্মিক চলে যাওয়া ছিল খোশরুরাজের জীবনের সবচেয়ে বড় ঘা, এবং সেই ব্যথার ছোঁয়া এখনও তাঁর মনে গভীরভাবে লেগে আছে। মেঘলার আত্মা তাঁর শেষ ইচ্ছা ও বার্তা নিয়ে এই অশরীরী কণ্ঠের মাধ্যমে গ্রামে ফিরে এসেছেন, যেন তাদের হারানো ভালোবাসার সুর যেন ফিকে না হয়।

কণ্ঠের বার্তাটি ছিল শুধু এক গান নয়, বরং একটি গভীর প্রেরণা, যা জীবনের ক্ষণস্থায়ী সুখ-দুঃখকে ছাপিয়ে যায়। মেঘলার আত্মা গ্রামবাসীদের উদ্দেশে একটি অনুরোধ পাঠিয়েছিলেন—একসাথে থাকা, ক্ষমা করা এবং জীবনের অর্থ খুঁজে পাওয়া। খোশরুরাজের প্রতি তার ভালোবাসার শেষ ইচ্ছা ছিল এই বার্তা পৌঁছে দেওয়া, যা শুধু সঙ্গীতের মাধ্যমে সম্ভব। সেই বার্তায় ছিল মানুষের অন্তরাত্মার গভীর সংযোগ এবং জীবনের অস্থায়িত্বের প্রতি সম্মান। গ্রামবাসীরা কণ্ঠ শুনে যে স্বপ্ন দেখত, তা মেঘলার আত্মার ভ্রমণ ছিল—একটি আশীর্বাদ, যা তাদের জীবনে নতুন আশা ও শক্তি জোগায়। এই সত্য উদঘাটনের পর গ্রামের সবাই একত্রিত হয়ে জীবনের নতুন অধ্যায়ের দিকে এগিয়ে যায়, যেখানে অতীতের ব্যথা মুছে যায় এবং নতুন সূচনা হয়।

শেষ

 

1000052794.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *