Bangla - ছোটদের গল্প - রহস্য গল্প

রবীন্দ্র সরোবরে রহস্য

Spread the love

অয়ন চক্রবর্তী


গ্রীষ্মের দুপুর যেন রোদে গলে যাওয়া মিছরি। দক্ষিণ কলকাতার অলি-গলি পেরিয়ে রবীন্দ্র সরোবরের ঘন ছায়ায় আশ্রয় নেওয়া যেন শীতলতার অভিজ্ঞান। আজ ছিল স্কুলের শেষ দিন। আর আজ থেকেই শুরু সেই কাঙ্ক্ষিত ছুটি। তিন বন্ধু—ঋভু, সোহিনী আর আদিত্য—প্রায় রোজের মতোই দেখা করল লেকের কাছে। তাদের তিনজনের ছুটির প্রথম দিনের আড্ডা শুরু হলো পাথরের বেঞ্চে বসে পাঁপড় ভাজা খেতে খেতে। হালকা বাতাসে কদমগাছের পাতা দুলছিল, আর জলের ওপরে সূর্যের আলো রুপোর মাছরাঙার মতো লাফিয়ে পড়ছিল। ঋভু বলল, “এই লেকের নিচে যদি কিছু লুকানো থাকে রে? ধর, কোনো গুপ্তধন বা পুরনো রহস্য?” আদিত্য এক চুমুক দিয়ে বলল, “তোর গোয়েন্দাগিরির শুরু এখন থেকেই?” সোহিনী হেসে বলল, “চুপ কর। ঋভুর মাথায় আবার প্ল্যান ঘুরছে।” যদিও হালকা ঠাট্টার ছলে কথাটা শুরু হয়েছিল, তখনও কেউ বুঝতে পারেনি যে সত্যিই একটা রহস্য তাদের দিকে এগিয়ে আসছে—একটা পুরনো, চাপা, ব্যক্তিগত ধাঁধা যা উন্মোচিত হবে ধীরে ধীরে।

হঠাৎই ঋভুর চোখে পড়ে, লেকের উত্তরপূর্ব কোণে, যেখানে ঘন কদমগাছের ছায়া পড়ে, সেখানে এক মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন। বয়স প্রায় ৪৫-৫০, চুলে কিছুটা পাক ধরা, শাড়ি পরনে, হাতে একটা পুরনো খাতা বা ফাইল ধরা। তিনি যেন কিছু খুঁজছেন। কখনও মাটির দিকে তাকিয়ে কিছু দেখছেন, কখনও ডালে লতাপাতা সরিয়ে যাচ্ছেন। তার চোখে একরকম ব্যাকুলতা, অথচ মুখ শান্ত। ঋভু চোখ সরিয়ে নিতে পারল না। আদিত্যও লক্ষ করল, বলল, “ওই মহিলা রোজ আসে না? আগে কোনোদিন দেখেছিস?” সোহিনী ক্যামেরা বের করে একটা ছবি তুলে নিল দূর থেকে। সে বলল, “কালও যেন দেখেছিলাম ওনাকে, ওই একই গাছের নিচে।” তাদের মধ্যে এক অদ্ভুত আগ্রহ জন্ম নিল। মহিলার আচরণ স্বাভাবিক নয়—এভাবে প্রতিদিন এসে কোনো গাছের নিচে খোঁজাখুঁজি করার অর্থ কিছু আছে। হঠাৎই মনে হলো, এটা কোনো লুকোনো চিহ্নের ইঙ্গিত? না কি তিনি কাউকে খুঁজছেন? সোহিনী বলল, “চলো, একটু কাছে গিয়ে দেখি।” কিন্তু ঋভু থামাল—“না না, এখন নয়। প্রথমে দূর থেকে দেখি উনি ঠিক কী করেন, তারপর ঠিক করব।”

পরের কয়েকটা দিন তিন বন্ধু সেই মহিলার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতে থাকল। প্রতিদিন ঠিক দুপুর একটার সময় তিনি সেই একই কদমগাছের নিচে এসে দাঁড়ান। প্রথমে চারপাশটা খানিকক্ষণ দেখে নেন, তারপর একটা ছোট খাতা বের করে কিছু পড়েন, তারপর মাটি বা গাছের গুঁড়ি খুঁটিয়ে দেখেন। কখনো কাগজের টুকরো হাতে ঘুরে ঘুরে কিছু মেলানোর চেষ্টা করেন। একদিন, তিনি চলে যাওয়ার পরে, ঋভু সেই জায়গায় গিয়ে মাটির একটু নিচে খুঁড়ে পায় একটি আধা-ভেজা কাগজের খাম। তার ভিতরে থাকা চিঠির অংশে লেখা ছিল, “The place where the poet rests, and the lake listens…” তিনজনের গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। কে সেই কবি? রবীন্দ্রনাথ? এই ‘lake’ কি সরোবর? চিঠিটা কার? আর ওই মহিলা কারা? সব প্রশ্ন জড়িয়ে ধরল তাদের তিনজনকে। সেই বিকেল থেকে তাদের ছুটি আর নিছক অবসরের দিন নয়—এটা হয়ে উঠল এক অভিযান। আর সেই অভিযানের সূচনা ঘটেছিল এক সোনাঝরা দুপুরে, ছুটির প্রথম দিনে—যেখানে তিনজন কিশোর জীবনের এক বড় রহস্যের পথে পা রেখেছিল।

পরদিন সকালটা যেন অন্যরকম উত্তেজনায় শুরু হয়েছিল। তিন বন্ধু সকাল থেকেই নিজেদের স্কুলব্যাগে ব্যস্তভাবে পুরে নিয়েছিল জিনিস—সোহিনী তার ছোটো ক্যামেরা আর নোটপ্যাড, আদিত্য একটা ছোট স্পাইগ্লাস আর তার পেন-রেকর্ডার, আর ঋভু ব্যাগে ভরে নিয়েছিল তার প্রিয় “কালকূট গোয়েন্দা সিরিজ” আর আগের দিন পাওয়া চিঠির টুকরোটা। তারা ঠিক করে ফেলেছিল—আজ তারা সেই মহিলাকে কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করবে, এবং প্রয়োজনে তার সঙ্গে কথা বলবে। কিন্তু মুখোমুখি হওয়ার আগে চাই আরও প্রমাণ, আরও পর্যবেক্ষণ। তারা পৌঁছায় আগেভাগেই—রবীন্দ্র সরোবর তখনও জনশূন্য প্রায়, কেবল কয়েকজন বৃদ্ধ হাঁটছেন ছায়ায় ছায়ায়। সকাল গড়িয়ে দুপুর যখন এগোতে লাগল, তারা লুকিয়ে লুকিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল সেই পরিচিত কদমগাছের ছায়ায়। ঠিক একটার খানিক আগে, কদম পাতার মধ্য দিয়ে একজন ধীর পায়ে হেঁটে এলেন—হ্যাঁ, সেই মহিলা, শাড়ি পরনে, কাঁধে পুরনো চামড়ার ব্যাগ, হাতে সেই খাতা। আজ তার চোখে আরও গভীর ব্যাকুলতা, যেন সময় ফুরিয়ে আসছে। গাছের নিচে দাঁড়িয়ে তিনি চারপাশটা দেখে নিয়ে হাঁটু গেঁড়ে বসে পড়লেন। তারপর ব্যাগ থেকে কিছু কাগজ বের করে মিলিয়ে দেখলেন চারপাশের গাছ, শিকড়, ইটের বেড়া। কী খুঁজছেন তিনি? আর এত নিয়মিত কেন? তিন বন্ধুর মন প্রশ্নে প্রশ্নে ভরে উঠল।

ঋভু খুব সাবধানে চিঠির সেই অংশবিশেষটা আরেকবার দেখল—“The place where the poet rests, and the lake listens…” এই সরোবর তো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামেই, তাহলে কি সেই ‘poet’ তিনি? তবে কবি তো এখানে শোয় না, এটি কেবল তার নামাঙ্কিত জায়গা। তবে ‘lake listens’ বলতে কী বোঝাতে চাওয়া হয়েছে? সে তার নোটবুকে কয়েকটি রেফারেন্স নিল—সরোবরের ইতিহাস, আশেপাশের ভাস্কর্য আর গাছের অবস্থান। সোহিনী ওদিকে মহিলার ছবি তুলছিল দূর থেকে, খেয়াল করে তার হাতে ধরা প্যাচানো কাগজটা—যেটি সম্ভবত মানচিত্রের কোনো রুক্ষ স্কেচ। আদিত্য ফিসফিস করে বলল, “ঋভু, ওনার সঙ্গে কথা বলব?” কিন্তু ঋভু হাত তুলে থামিয়ে দিল। “না, আরও দুদিন দেখি। হয়তো উনি খুঁজে পাবেন, কিংবা কোনও সংকেত ফেলবেন। আমরা ধৈর্য রাখি।” ঠিক তখনই মহিলার হাত থেকে পড়ে যায় একটা কাগজের টুকরো, হাওয়া তুলে নিয়ে আসে সেটা তাদের পায়ের কাছে। তারা অবাক হয়ে দেখে, সেটি একটি পুরনো মানচিত্রের অংশ, তাতে কিছু গাছের অবস্থান, একটা গোলচত্বর আর তীরচিহ্ন দিয়ে কিছু ইঙ্গিত দেওয়া। মনে হচ্ছিল যেন এক গোপন স্থানের দিক নির্দেশ করছে—কিন্তু কোথায়? তারা কাগজটা তুলে চুপিচুপি ব্যাগে ভরে ফেলে, মহিলা কিছু টের পান না। এরপর তিনি ধীরে ধীরে উঠে গাছের গায়ে হাত রাখেন, যেন কোনও স্মৃতি ফিরিয়ে আনতে চাইছেন। তারপর সোজা হন, এবং চলে যান পূর্বদিকে সরোবরের ভিতরের পথ ধরে। তিনজন তখন নিঃশব্দে তাকে অনুসরণ করতে শুরু করে।

সন্ধে নামার মুখে তারা ফিরে আসে নিজেদের স্পটে। আজ তারা অনেক কিছু জানল, কিন্তু আরও বেশি কিছু অজানা থেকে গেল। চিঠির সঙ্গে মিলিয়ে মানচিত্রের টুকরো বিশ্লেষণ করতে গিয়ে সোহিনী আবিষ্কার করে—এটি আসলে সরোবরের উত্তর-পূর্ব কোনার একটি বিশেষ বিন্দুর দিক নির্দেশ করছে। সেখানে একটি পুরনো কুয়ো এবং একটা আধাভাঙা বেঞ্চ ছিল, যা এখন ঘাসে ঢাকা। “এই জায়গাটা তো আমরা ছোটবেলায় খেলতাম,” বলল আদিত্য, “ওই জঙ্গলের মতো জায়গায়!” তখনই ঋভু বলল, “তা হলে কাল সোজা সেদিকে যাওয়া হবে আমাদের লক্ষ্য। আরেকটা কথা মনে আছে তো? চিঠিতে ‘poet rests’ কথাটা ছিল… যদি সেটা আসলে কবির কোনো স্মারক হয়? রবীন্দ্রনাথের মূর্তি তো আছে এখানে, তার পাশেই হয়তো কিছু লুকানো…” তিন বন্ধুর চোখে তখন এক অদ্ভুত দীপ্তি—জানি না কী লুকিয়ে আছে, জানি না কোথায় যাবে এই খোঁজ, কিন্তু এটা নিশ্চিত—এই ছুটি আর কেবল গল্পগুজবের জন্য নয়। এই ছুটি তাদের জীবনের প্রথম ‘রহস্য অভিযানে’র সূচনা। অথচ তারা তখনও জানে না, সামনের দিনে এক হারিয়ে যাওয়া ভাই, এক গোপন চিঠি, এক প্রেমিকা, আর এক অমূল্য শিল্পকর্ম—সব মিলিয়ে এক পারিবারিক ধাঁধা অপেক্ষা করে আছে তাদের জন্য। সেই কদমগাছের ছায়া তাদের যে ছায়াপথে ডেকে নিয়েছে, সেটা অন্ধকার নয়—বরং এক অচেনা আলোর দিকে।

পরদিন সকালেই তিন বন্ধু আবার উপস্থিত হলো রবীন্দ্র সরোবরে, এবার আর কেবল কৌতূহলের জন্য নয়—পুরোদস্তুর এক ‘অভিযান’ হিসেবে। আগের রাতটা তারা কাটিয়েছে মানচিত্রের খণ্ড বিশ্লেষণ করে, গুগল ম্যাপ খুলে লেকের প্রতিটি কোণ নোট করে, এমনকি পুরনো কিছু শহরের বই ঘেঁটেও খুঁজেছে সরোবরের ইতিহাস। সোহিনী তার বাবার পুরনো ল্যাপটপে একটা তথ্য খুঁজে পেয়েছে—রবীন্দ্র সরোবরের নির্মাণকাল, যেখানে বলা আছে এই জায়গায় একসময় ছিল একটা ছোটো জলাশয়, আর চারপাশে ছড়িয়ে ছিল কিছু গাছপালার মধ্যে কয়েকটি পাথরের খুঁটি, যা পরে মুছে গেছে আধুনিকীকরণে। এই তথ্য তাদের মানচিত্রের স্কেচের সঙ্গে মিলে যায়—বিশেষ করে যেখানে একটি গোলাকৃতি আকার আর এক রকমের ক্রস-মার্ক করা ছিল, ঠিক যেন ধাঁধার কেন্দ্রে সেই স্থান। আজ তাদের লক্ষ্য সেই জায়গাটায় যাওয়া, এবং চিহ্ন খোঁজা যা হয়তো তাদের আরেক ধাপ এগিয়ে দেবে। তবে তারা জানত—যদি এটা সত্যিই কোনো পারিবারিক রহস্য হয়, তবে হয়তো কেউ চাইবে না এটা উদঘাটিত হোক। মানে বিপদও থাকতে পারে, কিন্তু তাতে কে ভয় পায়?

তারা পৌঁছাল সেই নির্দিষ্ট জায়গায়—উত্তর-পূর্ব দিকের জঙ্গলঘেরা জায়গা, যেখানে এখন আর কেউ তেমন আসে না। কিছুটা আগাছায় ভরা, মাটির নিচে অর্ধেক ঢুকে থাকা ভাঙা বেঞ্চ আর পুরনো ইটের দেওয়াল দেখা যায়। সেখানে গিয়ে আদিত্য একটা গর্তের কাছে ছোট একটা ধাতব বাক্স পায়, যেটা হয়তো বৃষ্টিতে ধুয়ে বেরিয়ে পড়েছে। সেটার ভিতর একাধিক ভেজা কাগজ, আর এক প্রাচীন চিঠি। সেই চিঠিটা তারা খুব সাবধানে তুলে পড়ে—তাতে লেখা রয়েছে,

“শোনো, যদি কেউ এটা খুঁজে পায়, তবে জেনে নিও আমার হারিয়ে যাওয়ার পেছনে আছে এক সত্য, যা এতদিন চাপা ছিল। সরোবরের কদমগাছের নিচে সেই চিহ্ন রেখেছি আমি—যা নির্দেশ করে শেষ ঠিকানা। এক শিল্পের স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে গিয়েই আমি ডুবেছি এই ছায়ার জলে… রোহিণী জানে সব… তাকে খুঁজে পেলে সব জানবে। – অ”

তারা হতবাক হয়ে পড়ে—“অ” মানে কি অরিন্দম বসু? তবে কি এই চিঠির লেখক সেই মহিলার হারিয়ে যাওয়া ভাই? তবে সত্যিই কি তিনি ইচ্ছে করেই উধাও হয়েছিলেন? আর কে এই রোহিণী? সোহিনী বলল, “উনি তো কারও নাম নেননি এখনও পর্যন্ত, তাহলে জানি কী করে?” ঋভু তৎক্ষণাৎ বলে ওঠে, “আজকে আমরা ওই মহিলার সঙ্গে কথা বলব। আর দেরি নয়। সব সূত্র একে একে খুলছে, এখন দরকার বাস্তবের মুখোমুখি হওয়া।” তারা ঠিক করে, আগামীকাল দুপুরেই মহিলাকে সামনে গিয়ে প্রশ্ন করবে। চিঠির অংশ, মানচিত্র, আর তাদের অনুসন্ধানের নথি—সব প্রস্তুত করা হলো। দিন গড়ায় সন্ধের দিকে, আর তিনটি মন উত্তেজনায়, আশঙ্কায় আর রোমাঞ্চে ভরে ওঠে।

রাতে বাড়ি ফিরে ঋভু অনেক ভেবেছিল। তার নিজের পরিবারেও ইতিহাসপ্রিয়তা রয়েছে—তার বাবা জাদুঘরের কিউরেটর হওয়ায় ছোট থেকেই সে পুরনো জিনিস ঘেঁটে বেড়ায়। কিন্তু এই রহস্য যেন কেবল ইতিহাস নয়, যেন জীবন্ত হয়ে তাদের ডেকে নিচ্ছে—প্রায় হাত ধরে। সে চিঠিটা আরও একবার পড়ে, ভাবতে থাকে “শিল্পের স্মৃতি” কথাটার মানে। কি এমন শিল্প যা কেউ বাঁচাতে গিয়ে নিখোঁজ হয়ে যেতে পারে? আদিত্য এদিকে তার দাদুর পুরনো কেস ডায়েরি খুঁজে পায়—যেখানে ২০০২ সালে এক অরিন্দম বসুর নিখোঁজ হওয়ার রিপোর্ট ছিল, পুলিশের কাছে দায়ের করা, কিন্তু পরে ‘স্বেচ্ছায় উধাও’ বলে ফাইল বন্ধ হয়ে যায়। আরও অবাক করার মতো বিষয় ছিল, ফাইলের এক পাতায় লেখা “লেক গার্ডেনস এলাকা থেকে শেষবার দেখা গেছে”—ঠিক যেখানে সেই মহিলা এখন থাকেন! সব মিলিয়ে, এই ছুটি একটা অদ্ভুত সমীকরণে পরিণত হলো—জলের গভীরে ছায়া, গাছের পাতায় লেখা চিহ্ন, আর এক মহিলার অতীত-তাড়িত চেহারা। আগামীকাল তাদের সামনে সেই মহিলার চোখে চোখ রেখে বলতে হবে—আমরা জানি, আপনি কিছু খুঁজছেন… আর আমরা আপনাকে সাহায্য করতে চাই।

পরদিন ঠিক দুপুরের আগে তিন বন্ধু পৌঁছে গেল রবীন্দ্র সরোবরের সেই পরিচিত কদমগাছের নিচে। তাদের তিনজনের মনেই ছিল চাপা উত্তেজনা, অজানা এক সংশয়। হঠাৎ মুখোমুখি প্রশ্ন করে বসে যদি মহিলা কিছু না বলেন? বা উল্টে রেগে গিয়ে চলে যান? অথবা যদি পুরো ঘটনাই তাদের কল্পনা হয়—তাহলে? তবুও আজ আর পিছিয়ে আসার উপায় নেই। যথারীতি সময় মতো সেই মহিলা এলেন। তার চোখেমুখে ছিল আগের মতোই ব্যাকুলতা, কপালের ভাঁজ গভীর, চেহারায় নিঃশব্দ উদ্বেগ। তিনজন এবার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। প্রথমে একটু দ্বিধা, তারপর সাহস করে ঋভু বলল, “ম্যাম… আমরা কয়েকদিন ধরে আপনাকে লক্ষ্য করছি… আমরা জানি আপনি কিছু খুঁজছেন। আপনি যদি অনুমতি দেন, তাহলে হয়তো আমরা সাহায্য করতে পারি।” মহিলা প্রথমে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলেন। তার গালের হাড়দুটি কাঁপছে, চোখ বড় বড় হয়ে গেছে। সে যেন কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। আদিত্য তাড়াতাড়ি ব্যাগ থেকে মানচিত্রের টুকরো আর চিঠির কপি বের করল। মহিলা সেটা দেখেই যেন মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে পড়লেন। অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে ধীরে ধীরে বসে পড়লেন গাছের গুঁড়ির কাছে। তারপর একটি নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “তোমরা কী করে এগুলো পেলে?” সোহিনী বলল, “আমরা খুঁজে পেয়েছি। ঠিক যেখানে আপনি দাঁড়িয়ে খুঁজছিলেন, সেখানেই।”

তারপর শুরু হলো এক দীর্ঘ নীরবতা ভেঙে আসা গল্প—এক মহিলার স্মৃতি ও দুঃখের, এক হারিয়ে যাওয়া মানুষের, এক অসমাপ্ত শিল্পের ইতিহাস। তিনি বললেন তার নাম মীনাক্ষী বসু, বয়স এখন প্রায় ৪৭, থাকেন লেক গার্ডেনসে এক পুরনো ফ্ল্যাটে। তার ছোট ভাই অরিন্দম বসু ছিলেন একজন প্রতিভাবান শিল্পী ও বিরল আর্ট কালেক্টর, যিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পর বিভিন্ন ঐতিহাসিক চিত্র ও শিল্পকর্ম সংগ্রহ করতেন। কিন্তু ২০০২ সালের মে মাসে, তিনি আচমকা নিখোঁজ হয়ে যান। কোনও চিঠি, বার্তা বা ফোনকল—কিছুই রেখে যাননি। পুলিশ অনুসন্ধান করলেও কোনো ক্লু মেলেনি। পরে মামলাটা বন্ধ হয়ে যায়, “স্বেচ্ছায় উধাও” এই মন্তব্য দিয়ে। কিন্তু মীনাক্ষী বিশ্বাস করতে পারেননি যে তার ভাই নিছক উধাও হয়ে যেতে পারেন। কারণ নিখোঁজ হওয়ার আগেই তিনি কয়েকবার বলেছিলেন, “আমি একটা সত্যি খুঁজে পেয়েছি, একটা এমন কিছু, যা কারও হাতে পড়লে ধ্বংস হয়ে যাবে।” এরপর থেকেই মীনাক্ষী বুঝেছিলেন, কিছু একটা আছে—আর সেই ‘কিছু’টা লুকিয়ে আছে রবীন্দ্র সরোবরে, কারণ ছোটবেলায় ভাই-বোন দুজনে এখানে বহুবার এসেছেন, অরিন্দম সবসময় বলতেন, “লেকের পাশে যে কদমগাছটা আছে, ওটা আমার গোপন বন্ধুর মতো।”

এত বছর কেটে গেছে, তবু মীনাক্ষী রোজ এসে দাঁড়ান সেই কদমগাছের নিচে, কোনও ক্লু আছে কি না দেখতে। মাসখানেক আগে তিনি হঠাৎই অরিন্দমের পুরনো ডায়েরির ভেতর একটা চিঠি আর মানচিত্রের অংশ পান—যেটা তিন বন্ধুর কাছে থাকা কাগজেরই বাকি অংশ। মীনাক্ষী চিঠির ভাষা দেখে বুঝেছিলেন, তার ভাই কিছু একটা লুকিয়ে গিয়েছিলেন এখানে। তবে একা সব বোঝা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। সেই মুহূর্তে তার গলায় ভারী কণ্ঠে কৃতজ্ঞতার সুর—“তোমরা না থাকলে, আমি হয়তো কখনও এগুলো খুঁজে পেতাম না… আমি চাই সত্যিটা সামনে আসুক। আমার ভাইয়ের নামটা শুধু ‘হারিয়ে যাওয়া’ বলেই না থাকুক। সে যা কিছু আঁকত বা লিখত, তাতে ইতিহাসের গন্ধ ছিল। ওর শেষ কাজ—যেটার নাম আমি এখনো জানি না—সেটা কোথাও আছে এখানে।” তিন বন্ধু একে অপরের দিকে তাকাল। তারা এত বড় দায়িত্ব একরকম বুঝে না নিয়েই কাঁধে তুলে নিয়েছে। এবার মীনাক্ষী বললেন, “তোমরা যদি সাহায্য কর, আমি সব তথ্য তোমাদের সঙ্গে ভাগ করে নেব। আর একটা নাম আছে, যাকে খুঁজে বের করতে হবে—রোহিণী রায়। সে ছিল অরিন্দমের ঘনিষ্ঠ বান্ধবী, আর শেষ সময়ে সে-ই সবচেয়ে বেশি জানত ওর কাজকর্ম নিয়ে।” ঋভু নোট করে নিল নামটা, আর মনে মনে স্থির করল—এবার রোহিণীর খোঁজেই শুরু হবে পরবর্তী অধ্যায়।

রাতটা তিনজনেরই ঘুম কাড়ল। মীনাক্ষীর মুখে শোনা সেই কথাগুলো যেন ঘুরপাক খাচ্ছিল মাথার ভিতর—এক অদৃশ্য শিল্পকর্ম, হারিয়ে যাওয়া ভাই, আর রোহিণী রায় নামে এক রহস্যময় মহিলা। কিন্তু যতই ভাবছিল ঋভু, তার মনের একটা অংশ বারবার ফিরে যাচ্ছিল সেই মানচিত্রের স্কেচটার দিকে। “The place where the poet rests, and the lake listens”—এই শব্দগুলো কেবল ছন্দ নয়, এ এক ধাঁধার চাবিকাঠি। পরদিন সকালে সে নিজের টেবিল ভরে ফেলল কাগজ, কলম, স্কেল আর নানা রঙের হাইলাইটার দিয়ে। ছবির প্রিন্ট আউট থেকে শুরু করে গুগল ম্যাপে লেকের স্ক্রিনশট—সব কিছু সামনে রেখে সে শুরু করল মিল খোঁজা। এদিকে সোহিনী তার বাবার অফিস থেকে পুরনো শহরের মানচিত্র আনিয়ে দেখে লেকের আশপাশে কোন কোন গঠন এক শতাব্দী আগেও ছিল। আর আদিত্য, তার দাদুর সূত্র ধরে যোগাযোগ করল এক অবসরপ্রাপ্ত থানার ইনস্পেক্টরের সঙ্গে, যিনি ২০০২ সালের নিখোঁজ কেসগুলোর মধ্যে ছিলেন।

দুপুর নাগাদ তারা তিনজন আবার এক জায়গায় মিলিত হলো। সোহিনী বলল, “ঋভু, দেখ, পুরনো ম্যাপে ওই কদমগাছ আর রবীন্দ্রনাথের মূর্তির মাঝখানে একটা গোল জোন চিহ্নিত আছে। এখন ওখানে কিছু নেই, কিন্তু হয়তো আগে ছিল।” ঋভু বলল, “আমি খেয়াল করেছিলাম, মানচিত্রে একটা অদ্ভুত চিহ্ন আছে—দুটি বৃত্তের মধ্যে একটা ছোট্ট ‘x’। এর মানে লুকোনো কোনো স্থান হতে পারে।” আদিত্য বলল, “ওটা সেই পুরনো ভাঙা স্টেজপোডিয়ামের জঙ্গলঘেরা দিকের পাশ হতে পারে, যেটা এখন ঘাসে ঢাকা পড়ে গেছে।” তখনই সোহিনী ব্যাগ থেকে বের করল একটি কম্পাস আর ছোট হাতুড়ি—“ভালো করে খুঁজতে হলে কিছু সরঞ্জাম লাগবে।” বিকেলবেলা তারা তিনজন আবার সেই জায়গায় পৌঁছাল। এখন আর আগের মতো হালকা অনুসন্ধান নয়, এবার সত্যিকারের খোঁজ। তারা সেই চিহ্নিত জোনে গিয়ে জায়গাটা ঘুরে ঘুরে দেখল। হঠাৎ সোহিনী মাটির নিচে কিছুটা উঁচু ঢিবি দেখে হাত দিয়ে খুঁড়তে লাগল। একটু পরেই সেখান থেকে বেরিয়ে এলো একটি ধাতব পাতের আংশিক অংশ—তাতে খোদাই করা ছিল: “R.B. 1941”।

ঋভু চিৎকার করে উঠল, “R.B. মানে কি রবীন্দ্র বলতেই চেয়েছে? আর ১৯৪১ মানে কবির মৃত্যুর বছর!” এটা নিছক কাকতাল নয়, এটা নিশ্চিত। এই পাতটা কোনো সিন্দুক বা বাক্সের ঢাকনা হতে পারে। এবার শুরু হলো তাদের জোরে খোঁড়াখুঁড়ি। আধঘণ্টার মধ্যে তারা মাটির নিচে খুঁজে পেল একটি শক্ত কাঠের বাক্স, চারপাশে লোহা দিয়ে মোড়া, যার তালা এক অদ্ভুত চাবির ছাঁচে বন্ধ। বাক্সটা তুলতে গিয়েই তারা বুঝতে পারল, এ কোনো সাধারণ জিনিস নয়—এর ওজন অনেক, ভিতরে নিশ্চয়ই কিছু গুরুতর গুরুত্বপূর্ণ বস্তু আছে। তখনই আদিত্যর মনে পড়ল, “ঋভু, ওই প্রথম চিঠির সঙ্গে তো একটা ছোট চাবির কথা ছিল, সেটা কই?” ব্যাগ খুঁজে বের করল সেই ছোট্ট ধাতব চাবি। তারা সেটি তালায় ঢোকাতেই ‘ক্লিক’ শব্দে খুলে গেল বাক্সটি।

বাক্সের ভিতরে এক প্রাচীন চিঠি, কিছু শুকনো গোলাপফুল, আর সযত্নে মোড়ানো এক ক্যানভাস। চিঠির লেখক অরিন্দম বসু, লেখা—”যদি কেউ এটা খুঁজে পায়, তাহলে জেনে নিও—এটা আমার শেষ সৃষ্টি নয়, এটা রোহিণীর। আমি কেবল রক্ষা করেছি। আর এই ফুলগুলো আমার অনুতাপের স্মারক…” ক্যানভাস খুলতেই চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল তিন বন্ধুর। এটি একটি দুর্লভ শিল্পকর্ম—নন্দলাল বসুর একটি অদেখা কাব্যময় চিত্র, যা স্বাধীনতার আগে আঁকা হয়েছিল, এবং যা সম্ভবত পরে গোপনে সংরক্ষিত হয়। নিচে লেখা ছিল ছোট করে: “রোহিণী, তুমি জানো—আমি কেন একে আড়াল করেছিলাম।” তিনজন একে অপরের দিকে তাকাল—এবার ধাঁধার একটি চাবিকাঠি মিলল ঠিকই, কিন্তু আরও এক প্রবেশপথ খুলে গেল—কে এই রোহিণী? কীভাবে তার সঙ্গে যুক্ত ছিল এই শিল্পকর্ম? কেনই বা এমন গোপনে লুকানো হয়েছিল? আর এত বছর পর, সেই উত্তর দেবে কে? তিনজন স্থির করল—পরবর্তী অভিযান শুধুই রোহিণী রায়কে ঘিরে।

রাতটা আর পাঁচটা সাধারণ রাতের মতো কাটল না। মীনাক্ষীর ঘরে তিন বন্ধু বসেছিল সেই বাক্স থেকে পাওয়া চিঠি আর ক্যানভাস হাতে। মীনাক্ষী ধীরে ধীরে ছবির ক্যানভাসটা ছুঁয়ে বলছিলেন, “এই ছবিটার নাম ‘ছায়াপথ’। অরিন্দম বলত, এটা শুধু শিল্প নয়, এটা ওর রক্ত, ওর যন্ত্রণার ভাষা… আমি বুঝতে পারিনি কেন ও এটা কাউকে দেখাতে চায়নি। এখন বুঝতে পারছি—এই ছবি ছিল এমন এক প্রেমের স্মৃতি, যা সমাজের চোখে অসম্ভব ছিল।” তিনি থেমে গিয়েছিলেন, যেন অতীতের কোনো দৃশ্য ঘিরে ধরেছে তাকে। সোহিনী বলল, “আপনি বলেছিলেন রোহিণী রায় এই ছবির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন?” মীনাক্ষী মাথা নেড়ে বললেন, “হ্যাঁ। রোহিণী ছিলেন অরিন্দমের কলেজের বন্ধু, পরে প্রেমিকা। কিন্তু রোহিণীর পরিবার ছিল বেশ প্রভাবশালী, তারা এই সম্পর্ক মেনে নেয়নি। তখন থেকেই অরিন্দম ভেঙে পড়ে, অথচ সে এই ছবি আঁকেন, যাতে রোহিণীর স্মৃতি বাঁচিয়ে রাখা যায়। পরে আমি জানতে পারি—ছবিটি নন্দলাল বসুর একটি আদি রচনার প্রতিলিপি থেকে অনুপ্রাণিত হলেও, তার অদৃশ্য আঁচড় দিয়ে ভরা ছিল অরিন্দমের নিজের ব্যথা। হয়তো সে ভেবেছিল—এই ছবি সমাজে এলে শুধু রোহিণীর না, তার নিজের জীবনও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।” তিন বন্ধুর মনে চলতে থাকল প্রশ্ন—তাহলে কি অরিন্দম ইচ্ছে করেই হারিয়ে গিয়েছিলেন, শুধু এই ছবিকে রক্ষা করতে?

ঋভু বলল, “আমরা যদি রোহিণী রায়কে খুঁজে পাই, তাহলে হয়তো ওনার কাছ থেকে জানব অরিন্দমদা কোথায় গিয়েছিলেন, কীভাবে এই ছবিকে বাঁচিয়েছিলেন।” আদিত্য তার দাদুর পুরনো পুলিশ সংযোগ কাজে লাগিয়ে একটি ঠিকানা জোগাড় করে এনেছিল—রোহিণী রায়, বর্তমানে থাকেন দক্ষিণ কলকাতার নবীন পল্লির এক পুরনো বাংলোতে, একা। প্রাক্তন কলেজ অধ্যাপিকা, এখন অবসরপ্রাপ্ত। ঠিক পরদিন সকালে তারা পৌঁছে যায় সেই ঠিকানায়। ছোট একটি লোহার গেট, ভেতরে ফুলগাছের বাগান, আর বারান্দায় বসে থাকা এক বৃদ্ধা মহিলা—হাতে একটি উপন্যাস, মুখে শান্ত হাসি। তারা তার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়, এক দম্পতির মতো সৌজন্যে। ঋভু নাম জিজ্ঞেস করে। মহিলা মাথা তুলে বলেন, “আমি রোহিণী। তোমরা কে?” তারা চিঠি আর ছবির প্রিন্ট কপি এগিয়ে দেয়। রোহিণী স্তব্ধ হয়ে যান। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলেন, “তোমরা ওকে খুঁজে পেয়েছ… তুমি অরিন্দমের ছবির ছায়াপথ খুঁজে পেয়েছ।” সেই বৃদ্ধ কণ্ঠে যেন একটা ঝাঁঝাল ব্যথার সুর ছিল, আর চোখে জল টলটল করছিল।

ঘরে ডেকে নিয়ে গিয়ে রোহিণী খোলসা করলেন সবকিছু। কলেজে থাকাকালীন সময়েই অরিন্দম আর রোহিণী একে অপরকে ভালোবাসতে শুরু করেছিলেন। দুজনেই ছিলেন সাহিত্যপ্রেমী, শিল্পানুরাগী। কিন্তু রোহিণীর পরিবার সেই সম্পর্ক মানতে চায়নি। হুমকি দিয়েছিল, অরিন্দমকে জীবন থেকে মুছে ফেলতে হবে। রোহিণী বাধ্য হয় সম্পর্ক ছিন্ন করতে, কিন্তু তার কাছে অরিন্দম একটা চিঠি রেখে গিয়েছিল—ছবির গল্প, তার রক্ষার দায়িত্ব, আর একটি ইঙ্গিত—“আমি যেখানে কবির ছায়া দেখতে পাই, সেখানে আমি থাকব—জীবনের বাইরে, ছবির ভিতরে।” এই ইঙ্গিতের মানে তখন বুঝতে পারেননি রোহিণী। এরপর অরিন্দম নিখোঁজ হয়ে গেলে তিনিও পিছিয়ে যান জীবনের সমস্ত রঙ থেকে। কিন্তু আজ, এত বছর পর, এই তিন কিশোরের হাত ধরে সেই ধাঁধার উত্তর তার চোখের সামনে। রোহিণী কাঁপা কাঁপা হাতে ছবির প্রিন্টটি ছুঁয়ে বললেন, “এই ছবি শুধুই শিল্প নয়—এটা স্মৃতি, এটা প্রতিবাদ, এটা মমত্ব। তোমরা যা করেছ, তা শুধু ইতিহাসের পাতা উল্টানো নয়, দুটি ভাঙা জীবনের সেলাই।” তিন বন্ধুর চোখে তখন এক অদ্ভুত অনুভূতির মিশ্রণ—তারা যেন কেবল রহস্য ভেদ করেনি, তারা ফিরিয়ে এনেছে দুই মানুষের অতৃপ্ত ভালোবাসার রূপ।

রোহিণীর মুখে শোনা কাহিনি যেন ধীরে ধীরে এক কুয়াশা সরিয়ে সূর্যের আলো এনে দিল তিন বন্ধুর মনে। এতদিন যে কাহিনি ছিল একটি নিখোঁজ মানুষের, এক হারিয়ে যাওয়া ছবির, বা এক নিঃসঙ্গ মহিলার কাঁপা সন্ধ্যার প্রার্থনা—তা আজ হয়ে উঠল একটি অসমাপ্ত প্রেমের, আত্মত্যাগের এবং গভীর মানবিকতার উপাখ্যান। ছবিটির আসল নামই ছিল “ছায়ার পেছনে আলো”—যেটা অরিন্দম রোহিণীর জন্য আঁকেন, আর সেই ছবির পেছনে লুকিয়ে রাখেন নিজের অনুভব, অপমান, ভালোবাসা আর প্রতিজ্ঞা। রোহিণী বললেন, “ছবিটার কেন্দ্রবিন্দুতে আছে একটি নারীমূর্তি, যার চোখ বাঁধা, কিন্তু মুখ উজ্জ্বল। অরিন্দম বলত, এই নারী তার নিজের চিন্তাজগতে আলো নিয়ে হাঁটে—যদিও সমাজ তাকে চোখে দেখাতে দেয় না। আমি বুঝি, সেটাই ছিল আমাদের কথা—একসঙ্গে, অথচ আলাদা।” এমন কথা শুনে সোহিনী নিজেও এক মুহূর্তের জন্য চুপ হয়ে গেল। সে বুঝতে পারছিল—এই রহস্য ভেদটা শুধু গোয়েন্দাগিরি নয়, এটা এক আবেগের পুনর্জন্ম।

ঋভু তখন একটা প্রশ্ন করল, “তাহলে আপনি কি জানতেন, উনি কোথায় চলে গেছেন?” রোহিণী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “জানি না ঠিকানা। কিন্তু শেষ চিঠিতে লিখেছিল, সে কোনো পাহাড়ি গ্রামে চলে যাবে—যেখানে শিল্প আর প্রকৃতি একসঙ্গে থাকে। আমি আন্দাজ করি, হয়তো উত্তরবঙ্গ বা সিকিম। কিন্তু আমি খুঁজিনি। আমি চেয়েছিলাম, সে যদি ফিরে আসে—তবেই আমাদের দেখা হবে।” এরপর মীনাক্ষী ও রোহিণীর এক আবেগঘন সাক্ষাৎ হয়—বহু বছর পরে, দুই নারীর মধ্যে জমে থাকা অভিমান, চুপচাপ অপেক্ষার কুয়াশা এবং এক নিখোঁজ মানুষকে ঘিরে গড়া বেদনার মেলবন্ধন ঘটল। তখনই তারা ঠিক করলেন, ছবিটিকে আর গোপন রাখা হবে না। এই ছবি ইতিহাসের সম্পদ, এবং একজন নিখোঁজ শিল্পীর শেষ চিহ্ন। তারা যোগাযোগ করলেন দক্ষিণ কলকাতার এক ছোট গ্যালারির সঙ্গে, যেখানে স্থানীয় শিল্পীদের কাজ প্রদর্শনের সুযোগ দেওয়া হয়। পরিচালক ছবিটি দেখে প্রথমেই চিনতে পারলেন—এটা নন্দলাল বসুর ভাবনার ধারায় অনুপ্রাণিত, কিন্তু এর মধ্যে যে আবেগ, তা সম্পূর্ণ মৌলিক।

চিত্রপ্রদর্শনী আয়োজনের দিন এগিয়ে আসছিল। সোহিনী তৈরি করছিল একটা ছোট ভিডিও ডকুমেন্টারি—তিন বন্ধুর এই অনুসন্ধান, পুরনো চিঠি, কদমগাছ, রবীন্দ্র সরোবর, মীনাক্ষীর চোখের জল, আর রোহিণীর নিঃশব্দ কবিতা—সব মিলিয়ে এক হৃদয়ছোঁয়া চিত্রনাট্য। আদিত্য আর ঋভু একটি ছোট বুকলেট বানাচ্ছিলেন, যাতে থাকবে ছবির ইতিহাস, অরিন্দম বসুর জীবন ও রহস্যের নেপথ্য কাহিনি। যখন এই সব কাজে তারা জড়িয়ে, তখন হঠাৎই এক চিঠি আসে মীনাক্ষীর ঠিকানায়—একটি অচেনা পাহাড়ি গ্রামের পোস্টমার্ক সহ একটি সাদা খাম। চিঠিতে মাত্র এক লাইন লেখা—“ছবির নিচে আলো রেখো, ছায়া নিজেই সরে যাবে। – অ” মীনাক্ষীর চোখ ছলছল করে উঠল। সে জানল—অরিন্দম এখনো বেঁচে আছেন, দূরে কোথাও, হয়তো পাহাড়ের কোলে, হয়তো কোনো ছোট্ট চিত্রশালার তলায় বসে ছবি আঁকছেন, চুপচাপ। সে ফিরে না এলেও, তার নিঃশব্দ প্রত্যাবর্তন ঘটল এই চিঠিতে, এই ছবিতে, আর তিন কিশোর বন্ধুর সাহসে।

কলকাতার দক্ষিণ প্রান্তের ছোট্ট একটি গ্যালারি—”চিত্রপথ”—সেই দিন ভরে উঠেছিল অচেনা মুখ, পুরোনো বন্ধুরা, সাংবাদিক আর উৎসাহী শিল্পানুরাগীতে। গ্যালারির দেয়ালে সাজানো হয়েছিল বহু চিত্রকর্ম, কিন্তু সব আলো ছিল যেটার উপর—সেটি ‘ছায়ার পেছনে আলো’। কাঠের রঙা এক নিঃশব্দ ক্যানভাস, যার মধ্যে এক নিঃসঙ্গ নারীমূর্তি দাঁড়িয়ে, চোখ বাঁধা, কিন্তু আশেপাশে ছড়ানো উজ্জ্বল রেখা, যেন অন্ধকার তাকে গ্রাস করতে চাইলেও পারছে না। ছবির নিচে ছোট্ট করে লেখা—“রোহিণীর জন্য”। গ্যালারির মেঝেতে বিছানো ছিল বই, বুকলেট আর ভিডিও-স্ক্রিন, যাতে চলছিল সোহিনীর বানানো ডকুমেন্টারি: তিন বন্ধুর গোয়েন্দাগিরির কাহিনি, মীনাক্ষীর অপেক্ষা, রোহিণীর একান্ত কবিতা, আর অরিন্দমের হারিয়ে যাওয়া শিল্প। ছবি দেখে অনেকেই অভিভূত হচ্ছিলেন—কেউ বলছিলেন, “এ তো শুধু ছবি নয়, এক প্রেমের দলিল!”, কেউ বা বললেন, “এই ছবি যেন কথা বলে… নীরবতার ভাষায়…”।

মীনাক্ষী আর রোহিণী গ্যালারির এক কোণে দাঁড়িয়ে চুপচাপ দেখছিলেন সেই মানুষদের যারা অরিন্দমকে চিনতেন না, তবু যেন অনুভব করছিলেন তাঁকে। মীনাক্ষী ফিসফিস করে বললেন, “এটা ওর প্রত্যাবর্তন, না?” রোহিণী মাথা নেড়ে বললেন, “হ্যাঁ। আর এই তিনজন—এই তিন কিশোর না থাকলে, ও হয়তো চিরতরে অন্ধকারেই থেকে যেত।” তখনই ঋভু, সোহিনী আর আদিত্য মঞ্চে ডাকা হলো, সবাই হাততালি দিয়ে স্বাগত জানাল। তিনজন মঞ্চে উঠে মাইকে জানাল তাদের অভিযানের গল্প—কীভাবে এক রহস্যময় মহিলাকে অনুসরণ করতে করতে একটা পারিবারিক ধাঁধার গিঁট খুলে ফেলেছিল তারা। তাদের জড়তা ছিল, কিন্তু চোখে ছিল আত্মবিশ্বাস। সোহিনী বলল, “আমরা শুধু ছবি খুঁজিনি, আমরা একটা হারিয়ে যাওয়া সম্পর্ক, একটা প্রেম, একটা আত্মত্যাগের ইতিহাসকে খুঁজে পেয়েছি।” আদিত্য যোগ করল, “এই শহরের অলি-গলি, লেকের কদমগাছ, ভাঙা বেঞ্চ, সব যেন আমাদের পথ দেখিয়েছিল।” উপস্থিত দর্শকদের মধ্যে কেউ কেউ চোখ মুছছিলেন।

অনুষ্ঠান শেষে রোহিণী হেঁটে এলেন তিন বন্ধুর সামনে। একে একে তিনজনের কপালে হাত রাখলেন। তারপর বললেন, “তোমাদের মধ্যে আমি অরিন্দমকে দেখলাম—ওর কৌতূহল, ওর সাহস, ওর ভালবাসা।” মীনাক্ষী এসে তাদের তিনজনকে জড়িয়ে ধরলেন। “আমার ভাই আর ফিরে না এলেও, তার শিল্প, তার কথা—তোমরা ফিরিয়ে এনেছ। আমি ঋণী হয়ে রইলাম।” সন্ধ্যা নামছিল ধীরে, গ্যালারি থেকে মানুষ কমতে শুরু করল। বাতাসে ভেসে এল শীতল এক প্রশান্তি। আকাশে তখন ধীরে ধীরে উঠে আসছিল এক টুকরো চাঁদ। তিন বন্ধু বাইরে বেরিয়ে দাঁড়াল, রবীন্দ্র সরোবরের দিকে তাকিয়ে সোহিনী বলল, “চল, একদিন আবার যাওয়া যাক, সেই কদমগাছটার নিচে।” আদিত্য বলল, “এইবার আর শুধু রহস্য খুঁজতে নয়—এইবার ইতিহাস ছুঁতে।” আর ঋভু ধীরে বলল, “আরও অনেক গল্প হয়তো লুকিয়ে আছে শহরের কোণে কোণে… কে জানে, আমরা আবার কোনদিন কোন গল্পের পিছনে ছুটে যাবো!”

চিত্রপ্রদর্শনী শেষ হওয়ার কয়েকদিন পর এক শনিবার বিকেলে, তিন বন্ধু আবার ফিরল রবীন্দ্র সরোবর। সেই পুরোনো বেঞ্চ, কদমগাছ, আর পাখির ডাক যেন আজও ঠিক আগের মতোই আছে—তবে তাদের চোখে আজকের দৃশ্যটা একেবারে আলাদা। আজ তারা কিশোর নয়—তারা তিনজন হয়ে উঠেছে তিনজন সত্যিকারের অন্বেষক। সোহিনী ঘাসে বসে ক্যামেরা বের করল, “আজ একটা শেষ রেকর্ড করি না হয়। এই সফরটার একটা নিজস্ব নোট!” ঋভু গাছের নিচে বসে তার নোটবুক খুলল—এই একই জায়গায় বসেই সে প্রথম দিন সেই মহিলাকে দেখেছিল। আজ সেই মহিলা তার জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষক হয়ে উঠেছেন। আদিত্য রোদের দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি খেয়াল করেছ? ওই ছবিটার আলো যেন এই লেকের ছায়ার কথা বলে। আমি বুঝি এখন—ছবি শুধু রঙ আর তুলির খেলা নয়, এটা একেকটা অনুভূতির ছায়াপথ।”

তারা তিনজন আবার একবার ঘুরে দেখল সেই জায়গা, যেখানে পাওয়া গিয়েছিল সেই বাক্সটা। এখন সেখানে ঘাস বাড়ছে, নতুন কিছু ফুলও ফুটেছে। দেখে মনে হচ্ছিল প্রকৃতি যেন নিজে এসে ঢেকে দিয়েছে ইতিহাসের ক্ষতচিহ্ন। তখনই সোহিনী আবিষ্কার করল গাছের গায়ে ছোট করে খোদাই করা অক্ষর—“R + R”। তারা বিস্ময়ে চেয়ে রইল। “রোহিণী আর অরিন্দম?” বলল ঋভু। “তবে কি তারা এখানে একসঙ্গে এসেছিলেন, সেই কিশোর বয়সেই?” ছোট্ট সেই খোদাই এক মুহূর্তেই জীবন্ত করে দিল এক হারানো সন্ধ্যার কথা, যখন দুই যুবক-যুবতী একসাথে দাঁড়িয়েছিল কদম ছায়ায়। হঠাৎ মনে পড়ল আদিত্যর—আজ শনিবার, আর মীনাক্ষী দিদি বলেছিলেন, প্রতি শনিবার বিকেলে তিনি এখানে আসেন, শুধু বসে থাকেন কিছুক্ষণ, নীরবভাবে, ভাইয়ের স্মৃতির পাশে। তারা তিনজন দাঁড়িয়ে থাকল, অপেক্ষায়। ঠিক আধ ঘণ্টা পর, সেই চেনা ছায়ার মাঝে ভেসে উঠল মীনাক্ষীর ধীর পায়ের ছায়া। হাতে একটা ছোট্ট প্যাকেট, মুখে শান্তি আর একরাশ প্রশান্তির ছায়া।

মীনাক্ষী তাদের দেখে একটু অবাক হলেও হেসে বললেন, “তোমরা জানো, আজকের এই জায়গাটা আমার কাছে একটা মন্দিরের মতো হয়ে গেছে। আমি এখানে বসি, যেন ওর সাথে কথা বলি… যেন ও এখনো এখানেই, এই বাতাসে, এই ছায়ায়, এই জলে…” তিনি প্যাকেটটা তাদের হাতে দিয়ে বললেন, “এটা তোমাদের জন্য। ওর রেখে যাওয়া শেষ চিঠির কপি আর কিছু আঁকা, যেগুলো ও করত কলেজে থাকতে।” তারা চুপ করে বসে প্যাকেট খুলে দেখল—অরিন্দমের আঁকা বেশ কিছু পেন্সিল স্কেচ, যার একটিতে রোহিণীর মুখ আঁকা—চোখ বন্ধ, ঠোঁটে একরাশ দ্বিধা। আরেকটিতে কদম গাছের নিচে দুটি হাত একসাথে, রোদের নিচে। সেই মুহূর্তে মনে হলো—এই গোটা গল্পটা আসলে শুধু রহস্য নয়, বরং একটা দীর্ঘ কবিতা, যা তিনটি কিশোর তাদের ছুটির দিনে খুঁজে পেয়েছে। এমন একটি কবিতা, যেখানে ছায়া আর আলো মিশে তৈরি করে স্মৃতি, শিল্প, প্রেম আর প্রতিজ্ঞার নতুন ভাষা।

১০

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সব গল্পই হয়ত ফিকে হয়ে আসে, কিন্তু কিছু কিছু গল্প থাকে—যা মানুষের মনে রয়ে যায় এক রঙহীন জলছবির মতো, যেখানে কেবল অনুভবের রেখাগুলি স্পষ্ট। তিন বন্ধু—সোহিনী, ঋভু আর আদিত্য—রবীন্দ্র সরোবরে কাটানো সেই অদ্ভুত ছুটির গল্পটা ঠিক তেমনই হয়ে রইল তাদের জীবনে। রহস্য উন্মোচিত হয়েছে, ইতিহাসের চাপা পাতা খুলেছে, এক নিখোঁজ শিল্পীর ছবি ফিরে এসেছে আলোয়, আর এক হারানো ভালোবাসার ইতিকথা ছুঁয়েছে তাদের হৃদয়। সময় গড়াতে গড়াতে তারা ফিরে গেল নিজের নিজস্ব জীবনে—সোহিনী শহরের বাইরে চলে গেল ফিল্মের ওপর পড়াশোনা করতে, আদিত্য ভর্তি হলো ইতিহাসে, আর ঋভু শুরু করল একটি ছোট্ট ব্লগ, যেখানে সে লিখতে লাগল “শহরের অলিতে গলিতে লুকোনো গল্প” নিয়ে। কিন্তু প্রতি বছর একবার করে তারা দেখা করে, ঠিক সেই জায়গায়—কদমগাছের নিচে। এটা হয়ে উঠেছে তাদের ‘মিলনস্থান’, যেখানে শুধু গল্পের স্মৃতি নয়, জীবনের গভীর বন্ধনও বাঁচিয়ে রাখা যায়।

একদিন এমনই এক বছরের দেখা করার দিন, তারা হঠাৎ খেয়াল করল—গাছের নিচে একটি ছোট্ট খামে ভাঁজ করা কাগজ পড়ে আছে। খামের ওপরে শুধু লেখা—“ছায়া ফিরে আসবে যেখানে আলো থাকে, খোঁজ রেখো।” সেই হাতের লেখা, সেই স্ট্রোক—তারা চিনতে পারল অরিন্দম বসুরই! সাথে আর কিছু লেখা নেই, শুধু একটি ছোট নকশা—এক পাহাড়ি রাস্তায় দাঁড়িয়ে একজন মানুষের ছবি, পেছনে সূর্যাস্ত, আর এক গাছের ছায়া। তারা তিনজন একে অপরের দিকে তাকাল। “তাহলে কি উনি আবার কোনো ইঙ্গিত দিলেন?” বলল সোহিনী। “হয়তো বললেন, তার শিল্প এখন পাহাড়ে। হয়তো এটা নতুন আরেকটা ধাঁধার শুরু,” বলল ঋভু। “অথবা এটা কেবল একটা কবিতা, শেষ এক ইশারা,” বলল আদিত্য। তারা জানত না, এটা কেবল বিদায়, না কি নতুন এক গল্পের ডাক। তবে এটুকু নিশ্চিত ছিল—এই তিন বন্ধুর জন্য পৃথিবী আর কখনও আগের মতো থাকবে না।

বছর কেটে যায়, জীবন পালটে যায়, কিন্তু ছুটি কাটানো সেই গল্পটা থেকে যায় তাদের জীবনের প্রতিটি বাঁকে। কলেজে, চাকরিতে, সম্পর্কের ভাঙাগড়ায়, একেকটা সন্ধ্যায় তারা মনে পড়ে সেই লেক, সেই কদমগাছ, সেই মীনাক্ষী দি, সেই রোহিণীর চোখ, আর একজন নিঃশব্দ শিল্পীর প্রতিধ্বনি। আর থেকে যায় সেই অদ্ভুত বাক্যটা—”ছায়া ফিরে আসবে যেখানে আলো থাকে”—যা কখনো তাদের সাহস দেয়, কখনো প্রশ্ন তোলে, আবার কখনো অদ্ভুত আশার আলো জ্বালে। ‘রবীন্দ্র সরোবরে রহস্য’ তাদের কাছে আর শুধু এক ছেলেমানুষি রোমাঞ্চ নয়, বরং জীবনের প্রথম অধ্যায়—যেখানে তারা নিজেরাই নিজেদের খুঁজে পেয়েছিল। শেষমেশ, প্রতিটি সন্ধ্যায় যখন লেকের ধারে আলো ছায়া গায়ে মেখে দাঁড়িয়ে থাকে কোনো পুরনো গাছ, তখন হয়তো তার পাতার ফাঁকে ফাঁকে এখনো ভেসে আসে তিন কিশোর-কিশোরীর হাসি… আর হারিয়ে যাওয়া এক শিল্পীর চুপকথা।

সমাপ্ত

 

1000041036.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *