Bangla - প্রেমের গল্প

রবিবার বৃষ্টির গল্প

Spread the love

সঞ্জয় ধর


সেই প্রথম রবিবার

সকালটা ছিল অদ্ভুত রকমের শান্ত। শিলিগুড়ির একটা নিরিবিলি পাড়া—শিবমন্দিরের একটু উপরে, যেখানে বাড়িগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পাহাড়ের গায়ে মিশে গেছে, চারদিকে সবুজ, আর পাখির ডাক ভেসে আসে হাওয়ার সঙ্গে।

রবিবার সকাল মানেই লম্বা ঘুম, কিন্তু সেদিন নয়। সোহমের ঘুম ভেঙে গিয়েছিল ভোরেই। জানালার বাইরে টুপটাপ করে বৃষ্টি পড়ছিল। ঝিরঝিরে, একদম শান্ত বৃষ্টি—যার মধ্যে কোনো তাড়াহুড়ো নেই, কোনো তাণ্ডব নেই। সে জানে, আজ তাকে টিউশনে যেতে হবে। সকাল আটটার টিউশন—বারো ক্লাসের ফিজিক্স। কিন্তু আজকের দিনটা একটু আলাদা লাগছিল।

একটা ছাতা নিয়ে বেরোল সোহম। ছাতার নিচে দাঁড়িয়ে থাকা হালকা বৃষ্টির শব্দে যেন মাথার ভেতর কবিতা বেজে উঠছিল। পথটা সরু, কাদামাখা, দু’পাশে ধানক্ষেত আর দূরে ধূসর হয়ে আসা পাহাড়ের রেখা। জুতো ভিজে যাচ্ছিল, তবুও তার মন খারাপ হচ্ছিল না।

পৌঁছাল সোজা চ্যাটার্জি স্যারের বাড়িতে। দোতলা পুরনো বাড়ি, ছাদে রেইনওয়াটার হ্যারভেস্টিংয়ের পাইপ থেকে টুপটুপ করে জল পড়ছে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি—সাদা পাঞ্জাবি, চোখে চশমা, হাতে কফির কাপ। মাথা নাড়লেন দেখে।

“আয় সোহম, আজ একটু কম ছাত্র এসেছে বোধহয়।”

সোহম ঘাড় নাড়ল। ভেজা জুতো খুলে সিঁড়ি বেয়ে উঠল। টিউশন রুমে ঢুকতেই হঠাৎ চোখ আটকে গেল। জানলার ধারে একটা মেয়ে বসে আছে, চোখ নামিয়ে খাতায় কী যেন লিখছে। চুল ভেজা, খোলা। হালকা নীল সালোয়ার কামিজ। গায়ে হালকা একটা কাশ্মীরি শাল।

সোহম একটু থমকে গেল। “নতুন?” মুখে না বললেও চোখে বিস্ময়।

মেয়েটা চোখ তুলে তাকাল। চোখদুটো গভীর। হালকা একটা হাসি দিল—একটুও বেশি নয়, একটুও কম নয়। তারপর আবার মাথা নামিয়ে নিল।

“তুই রিমি, না?” স্যার বললেন মেয়েটার দিকে তাকিয়ে। “এটাই সোহম, রিমি। দুজনেই সায়েন্স নিচ্ছে, ও তোদের ব্যাচেই থাকবে।”

মাথা নাড়ল রিমি। সোহম শুধু “হ্যাঁ” বলেই পাশে গিয়ে বসল। ছেলেটা একটু লাজুক, মুখে কথা কম, কিন্তু ভেতরে কী যেন একটা নড়ে উঠেছে। যেন অনেক দিন পর তার পৃথিবীতে নতুন একটা রঙ ঢুকেছে।

বৃষ্টির শব্দ জানলায় টুপটাপ করে পড়ছিল, আর টিউশন রুমে শুধু স্যারের বোর্ডে লেখার আওয়াজ। সেই মাঝখানে দুই চোখ মাঝে মাঝে চোর দৃষ্টিতে মিলিয়ে যাচ্ছিল।

স্যার যখন ওয়েভ থিওরি পড়াচ্ছিলেন, সোহমের মনে হচ্ছিল—এই মেয়েটা যেন এক অদ্ভুত তরঙ্গ হয়ে ঢুকে পড়েছে তার জীবনে। কোন কম্পাঙ্কে ধরা দিচ্ছে বুঝতে পারছে না, শুধু অনুভব করছে।

এক ঘণ্টা টিউশন শেষ হওয়ার পর, স্যার বললেন, “আজ তোমাদের দুজনের হোমওয়ার্ক—একটা ছোট গল্প লিখে আনো। বৃষ্টি নিয়ে, কিন্তু প্রেম নয়। বৃষ্টি নিয়ে অন্য কিছু ভাবো।”

সোহম একটু হেসে ফেলল। প্রেম না! তার মনে চলতে থাকা গল্পটা কি তবে প্রেম নয়?

রিমি বেরিয়ে যাচ্ছিল সিঁড়ি দিয়ে। ছাতা খুলতে গিয়ে আটকে যাচ্ছিল তার হাত। সোহম এগিয়ে গেল।

“দিতে পারি?” সে বলল হালকা স্বরে।

রিমি চমকে তাকাল। তারপর বলল, “আচ্ছা।” ছাতা ধরল সোহম। দুজন একসাথে হাঁটতে লাগল ছোট গলি দিয়ে।

পাশে জলের ধারা, ফার্ন গাছের ছায়া, আর দূরে দার্জিলিং পাহাড়ের রেখা ঝাপসা বৃষ্টিতে মিশে গেছে।

“তুই কী স্কুলে পড়িস?” সোহম জিজ্ঞেস করল।

“মডার্ন হাই স্কুল। তুই?”

“আমি গার্লস স্কুলের পাশের স্কুলটা—নর্থ পয়েন্ট।”

“ও আচ্ছা,” রিমি বলল। তার হাসিতে বৃষ্টির মতোই একটা মৃদু ছোঁয়া।

সেদিন আর কথা হয়নি বেশি। কিন্তু সোহমের মাথার মধ্যে ছায়া হয়ে রয়ে গেল সেই ছাতা, সেই হাঁটা, সেই চোখের গভীরতা।

রবিবার সকালটা বৃষ্টিতে শুরু হয়েছিল। কিন্তু বৃষ্টি নামিয়ে দিয়েছিল তার মনে এক নতুন অনুভব। যা শুধু গল্পের পাতায় নয়, হৃদয়ের কোথাও একটা দাগ কেটে গেল চুপিচুপি।

ছাতার নিচে কথা

সপ্তাহটা কেটে গেল অদ্ভুতভাবে। ক্লাস, অ্যাসাইনমেন্ট, ল্যাব — সবকিছুর মধ্যেই সোহমের মন বারবার ছুটে যাচ্ছিল সেই রবিবারে। সেই ছায়ার মতো হালকা হাসি, সেই ছাতার নিচে হেঁটে যাওয়া, আর রিমির চোখের গভীরতাটা যেন কোনো সমীকরণে মেলানো যায় না।

শনিবার রাতে বৃষ্টির পূর্বাভাস শুনেই মনটা কেমন যেন দুলে উঠেছিল। বারবার মোবাইলে সময় দেখে গিয়েছে — আটটা বাজলেই আবার সেই ছোট গলির ধারে, সেই দোতলা বাড়ি, আর যদি রিমি আসে… যদি আবার একসাথে ফেরা যায়।

সকালবেলা জেগেই দেখল — বৃষ্টি পড়ছে। হালকা, ঝিরঝিরে, একদম প্রথম রবিবারের মতো।

সোহম একটু আগে বেরোলো আজ। রাস্তা প্রায় ফাঁকা। দু’পাশে কাঞ্চন আর কদমগাছের ফাঁকে মাঝে মাঝে বৃষ্টির ছাঁট এসে লাগছিল গায়ে। কানে ইয়ারফোনে বাজছিল অর্ণবের গান — “সে যে বসন্তে এসেছিল, হাওয়া ছুঁয়ে…”

চ্যাটার্জি স্যারের বাড়িতে পৌঁছে দেখে, রিমি এসে গেছে আগেই। আজ সে বসে নেই জানলার ধারে, বরং পেছনের দিকের বেঞ্চে, কাঁধে একটা হালকা হলুদ ব্যাগ। ভেজা চুল পিছনে বাঁধা। চোখে একটা হালকা ঘুমঘুম ভাব, কিন্তু তাতেও মিষ্টি।

সোহম একটু ইতস্তত করে গিয়ে বসল পাশে। চোখাচোখি হতেই রিমি হেসে বলল, “তুই আগেই এসেছিস আজ।”

“হ্যাঁ… আজ বৃষ্টি দেখে বেরিয়ে পড়েছিলাম,” সোহম বলল।

রিমি জানালার দিকে তাকাল। বাইরে অল্প অল্প কুয়াশা। “আমারও বৃষ্টিতে হেঁটে আসতে ভালো লাগে। জানিস, কলকাতায় থাকতাম আগে। ওখানে বৃষ্টি মানেই জল জমে যেত রাস্তায়। এখানে এসে মনে হয়, বৃষ্টি শব্দ করে না—গান গায়।”

সোহম অবাক হয়ে তাকাল। কেউ কী এমন করে বলে? “তুই লিখিস নাকি কিছু?”

“কিছু না… মাঝে মাঝে…,” রিমি চোখ নামিয়ে বলল।

সোহম হাসল, “স্যার তো হোমওয়ার্ক দিয়েছিলেন, লিখেছিস?”

রিমি ব্যাগ থেকে একটা পাতলা নোটবুক বের করে বলল, “হ্যাঁ। কিন্তু ওটা প্রেমের গল্প হয়ে গেছে… স্যার বলেছিলেন না যেন প্রেম না থাকে?”

সোহম হেসে ফেলল, “তবে ঠিকই লিখেছিস মনে হয়। বৃষ্টিতে প্রেম ঢুকেই পড়ে, বাধা দিয়ে কী হবে?”

রিমিও হেসে উঠল এবার, একটু জোরেই। কাঁচে জল পড়ছিল, আর ঘরের ভেতরে কেমন এক উষ্ণ ছায়া।

টিউশন শুরু হতেই স্যার এসে পড়লেন। আজ বোর্ডে কৃত্রিম উপগ্রহ আর কক্ষপথের গল্প। সবাই মনোযোগী, কিন্তু রিমি আর সোহমের মাঝে মাঝে চোখে চোখে খেলা চলছিল—একটা হালকা খেলা, যেটার নিয়ম কেউ শেখায় না।

টিউশন শেষে স্যার বললেন, “বৃষ্টিতে কেউ যদি চা খেতে চায়, ঘরে আজ লেবু-চা বানানো আছে। কেউ থাকবি?”

রিমি আর সোহম একইসাথে একবার একে অপরের দিকে তাকিয়ে আবার স্যারের দিকে তাকাল। দুজনেই যেন বোকার মতো হাসল।

পাঁচ মিনিট পর ছাদের নিচে বসে রিমি আর সোহম, দুজনের হাতে স্টিলের কাপ। ছাদে টিনে বৃষ্টির শব্দ পড়ছে, নিচে দূরে দার্জিলিং মেলের হুইসেল, আর গাছে ভিজে পাখি ডানা ঝাঁকাচ্ছে।

“তুই রোজ এদিকে আসিস?” সোহম জিজ্ঞেস করল।

“না, শুধু এই টিউশনের জন্যেই আসি। বাকি সময় বাড়িতে থাকি। খুব বেশি বন্ধু নেই এখানে এখনো। তুই তো এখানকার ছেলে, তাই তোর বন্ধু নিশ্চয়ই অনেক।”

সোহম মাথা নাড়ল, “নাহ, বেশি না। কিছু পুরোনো বন্ধু ছিল, কেউ কেউ অন্য শহরে চলে গেছে। আমি বইয়ের সঙ্গে বেশি সময় কাটাই।”

রিমি হেসে বলল, “বইয়ের সঙ্গে সময় কাটানোই তো ভালোবাসা। বল তো, তোর প্রিয় বই কোনটা?”

সোহম বলল, “অর্ণবের গানের মতো একটা বই—’ছায়াসঙ্গী’। মেঘলা দিনে পড়তে ভালো লাগে।”

রিমি বলল, “তাহলে একদিন আমায় ধার দিবি?”

সোহম কাপ হাতে চা শেষ করছিল, থেমে গেল। একটু লজ্জা পেলেও বলল, “হ্যাঁ… একদিন আসিস আমাদের বাড়িতে… মা থাকেন, একা থাকি না…”

রিমি হালকা হাসল। “ঠিক আছে। একদিন আসব।”

তাদের মাঝে কথা থেমে গেল। কিন্তু থেমে গেল না সেই অদৃশ্য টান।

পথে নামার সময় আবার সেই ছাতা—আজ সোহম নিজেরটা এগিয়ে দিল।

“একসাথে হাঁটা যাবে তো?” সে বলল।

রিমি বলল, “একটু ভিজলে অসুবিধা নেই।”

সোহম বলল, “তবে ছাতা একটু ছোট… হয়তো একটু কাছাকাছি হাঁটতে হবে।”

রিমি বলল, “তাতে অসুবিধা নেই।”

এই এক লাইনে অনেকটা রবিবার গলে গেল…

নাম না জানা অনুভব

সোহম জানত না, কেন তার প্রতিটা সকাল এখন রবিবারের অপেক্ষায় কাটে। বারো ক্লাসের ছাত্র হয়ে যেখানে তার চরম ব্যস্ততা থাকার কথা, সেখানে সে প্রতিদিন সেই এক ঘণ্টার টিউশন নিয়েই স্বপ্ন দেখে। আর রবিবারগুলো যেন জীবনের সবচেয়ে শান্ত অথচ অস্থির দিন হয়ে উঠছে।

এই সপ্তাহের মাঝে দুবার দেখা হয়েছিল রিমির সঙ্গে—স্কুলে যাওয়া পথে, বইয়ের দোকানে, একবার আবার সামনাসামনি, লাইব্রেরিতে। রিমি তখন ‘নীলাঞ্জনা’র বই খুঁজছিল—পুরোনো কবিতার সংকলন। সোহম কাছে গিয়ে বলেছিল, “ওটা তো দুষ্প্রাপ্য। আমি একবার ‘বুক ফেয়ারে’ দেখেছিলাম।”

রিমি বলেছিল, “তুই যদি আবার কোথাও দেখতে পাস, আমায় জানাস। আমি খুব খুঁজছি।”

সেই ‘তুই’ শব্দটা, হঠাৎ করে আসা, সোহমের ভেতরে ঝাঁপিয়ে ওঠা এক অজানা অনুভব যেন। আর কিছু নয়, শুধু একটা সম্বোধন। কিন্তু তাতে গলে গেল তার বুকের মধ্যে জমে থাকা বহু বছরের শীতলতা।

রবিবার আবার এল। আবার সেই মেঘলা সকাল, কুয়াশার মতন জড়ানো বাতাস। আজ বৃষ্টির শব্দটা একটু ভারি—টিনের ছাদে দাগ পড়ে যাচ্ছে যেন।

সোহম আজ একটু সাহস নিয়ে একটি ছোট বই নিয়ে এল ব্যাগে করে—‘ছায়াসঙ্গী’। পাতলা, কিন্তু তার প্রিয়তম। আজ রিমিকে দেবেই।

চ্যাটার্জি স্যারের বাড়ি ঢুকতেই দেখে, ঘরে কেউ নেই। ঘড়ির কাঁটা বলে সাড়ে সাতটা। সময়ের আগেই পৌঁছে গেছে সে।

দরজা ঠেলে স্যারের স্ত্রী বললেন, “স্যার একটু বাজারে গেছেন, তোমরা বসো।”

‘তোমরা’? সোহম ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখল, পেছনে রিমি দাঁড়িয়ে আছে। সাদা কুর্তি, জলছাঁটা চুল, মুখে সেই চিরপরিচিত শান্ত হাসি।

“আজ একটু আগে এলাম,” রিমি বলল।

সোহম হেসে বলল, “আমি-ও।”

দুজন পাশাপাশি গিয়ে জানলার ধারে বসল। বাইরে ভিজে মাঠ, দূরের গাছে পাখির ঝাঁক বসে আছে। তারা কথা বলছিল না, কিন্তু জানলার ফ্রেমের ভেতরে একসাথে বসে থাকা দুটি মানুষের মধ্যে তৈরি হচ্ছিল এক নতুন দৃশ্য।

সোহম ব্যাগ খুলে বইটা বের করল।

“তোর জন্য এনেছি,” সে বলল।

রিমি চোখ বড় করে তাকাল। বইয়ের নাম দেখে বলল, “এইটা… তুই দেবে আমায়?”

“ধার দিলাম। তবে চাইলে রেখে দিতে পারিস।”

রিমি বইয়ের পাতা উল্টে দেখল। ভেতরে প্রথম পাতায় সোহম নিজের লেখা একটা চার লাইনের কবিতা লিখে রেখেছে—

‘যাকে স্পর্শ করা যায় না, তাকে যদি ছুঁয়ে ফেলা যেত
বৃষ্টির মাঝে শব্দহীন সেই গল্প বলা যেত—
তুই যদি কখনো হেসে বলিস, “হ্যাঁ”
তাহলে এই বইয়ে ছুঁয়ে থাকবি চিরকাল।’

রিমি কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকল, তারপর বলল, “তুই লেখ, না?”

সোহম কিছু বলল না, শুধু হাসল।

টিউশন শুরু হল। আজ স্যার সিম্পল হারমোনিক মোশন পড়াচ্ছেন। কিন্তু এই সময়ের মধ্যেও, একবার খাতায় চোখ নামিয়ে আবার বারবার চোখ তুলে তাকাচ্ছে রিমি। সোহম নিজেও বইয়ের ভাঁজে তার চোখ রাখলেও বুঝতে পারছে—এই ক্লাসরুম এখন আর ক্লাসরুম নেই, এটা এখন এক অলিখিত চিঠির বিনিময়ের জায়গা।

এক ঘণ্টা পর, যখন তারা বেরোচ্ছিল, তখন স্যারের স্ত্রী বললেন, “বৃষ্টি একটু বেড়েছে। কেউ চাইলে দোতলায় বসে একটু অপেক্ষা করো।”

সোহম আর রিমি একে অপরের দিকে তাকাল। আজ আর ছাতাও নেই তাদের কাছে।

দুজনেই দোতলার ছাদে উঠে এল। টিনের ছাদে জলের টুপটাপ, দূরে ধোঁয়া ধোঁয়া পাহাড়, আর মাঝখানে ভিজে ফেলে রাখা একটি কাঠের চেয়ারে বসে রিমি বলল, “আজকের সকালটা আমার মনে থাকবে।”

সোহম ধীরে বলল, “আমারও।”

রিমি বইটা বুকের কাছে ধরে বলল, “তুই জানিস না… এই বইটার পেছনে কি আছে।”

“কি আছে?” সোহম কৌতূহলী।

“তোর গল্প। তুই না থাকলে আমার এই শহরটা কখনো আপন মনে হতো না।”

সোহম এবার কিছু বলল না। শুধু জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখল, বৃষ্টি পড়ছে ঠিকই, কিন্তু যেন সেই বৃষ্টি এবার আর ভিজিয়ে দিচ্ছে না, বরং রোদ্দুর হয়ে উঠছে কোথাও এক জোড়া চোখের মাঝে।

কথার চেয়ে বেশি কিছু

রবিবারগুলোর মধ্যে একটা অভ্যেস ঢুকে পড়েছে। সকাল মানেই বৃষ্টি। আর বৃষ্টি মানেই সোহমের বুকের ভেতর অস্থির কিছু।

আজ একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল রিমির। সোহম এসে বসে ছিল অনেকক্ষণ, জানালার কাঁচে হাত দিয়ে আঙুল দিয়ে দাগ কেটে চলছিল—বৃষ্টির ফোঁটার মতো করে, নাম না জানা প্রতীক্ষার মতো করে।

হঠাৎ পেছন থেকে রিমির গলার আওয়াজ, “সরি… একটু ভিজে গেছি।”

ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখে, রিমির কাঁধে ছোট্ট এক ঝোলা ব্যাগ, চুল থেকে জল পড়ছে। তার সালোয়ারের পাড়ে কাদা লেগে আছে, তবু মুখে হাসি।

“ঠিক আছিস?” সোহম জিজ্ঞেস করল।

“হ্যাঁ… ছাতা উল্টে গিয়েছিল হঠাৎ। রিকশাও পাইনি। হাঁটতে হাঁটতেই এলাম,” রিমি বলল।

সোহম পেছনে তাকাল। রিমির জন্যে তার পকেটে রাখা ছোট তোয়ালেটা এগিয়ে দিল। “এইটা দে… একটু মুছে নে।”

রিমি একটু থমকাল। তারপর বলল, “তুই সবসময় এত বেশি ভাবিস না?”

সোহম হেসে বলল, “তোকে ভিজে দেখলে নিজের মনটাই কেমন ভিজে যায়।”

রিমি এবার চুপ। শুধু হেসে মাথা নামাল।

টিউশন শুরু হল, কিন্তু আজ স্যার বললেন, “আজ শুধু আলোচনা হবে। কোনো বই নয়। সবাই নিজের জীবনের একটা ঘটনা বলবে—যেটা বদলে দিয়েছে কিছু।”

সোহম চুপ করে রইল। রিমিও কিছু বলল না প্রথমে। সবাই যার যার গল্প বলল। এরপর স্যার বললেন, “সোহম, তুই বলবি কিছু?”

সোহম একটু থেমে বলল, “আমি একটা রবিবার নিয়ে বলব।”

সবাই তাকাল তার দিকে।

“রবিবার সকাল… একা হেঁটে যাচ্ছিলাম বৃষ্টির মধ্যে। হঠাৎ একটা ছায়া আমার পাশে এসে দাঁড়াল। তার চোখে ছিল মেঘ, আর ঠোঁটে এক ফোঁটা রোদ। আমি বুঝতে পারলাম, জীবনে কিছু অনুভব হয়—বলতে হয় না। শুধু ছাতার নিচে একটু কাছাকাছি হাঁটলেই হয়।”

রিমি ধীরে চোখ নামিয়ে ফেলল। ক্লাসে একটা নিঃশব্দ ঢেউ ছড়িয়ে গেল। কেউ বলল না কিছু, স্যার শুধু বললেন, “ভালো বলেছিস।”

ক্লাস শেষে রিমি বলল, “তুই সবসময় এত সুন্দর করে বলতে পারিস কী করে?”

সোহম বলল, “সত্যি বললে সুন্দর হয়।”

বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল তারা। বৃষ্টি একটু কমেছে। রিমি বলল, “আজ আমার যেতে দেরি হবে।”

“আমি ছেড়ে দিতে পারি,” সোহম বলল।

“তুই এতবার আমার জন্য হাঁটিস… ক্লান্ত হস না?”

“তুই পাশে থাকলে হাঁটা ক্লান্তি নয়,” সোহম বলল।

তারা হাঁটছিল। মাটির রাস্তা দিয়ে, ছোট ছোট গর্তে জমে থাকা জলে পা ডুবিয়ে। মাঝে মাঝে দুজনের হাত একে অপরের গা ঘেঁষে চলে যাচ্ছে, কিন্তু কেউ সরিয়ে নিচ্ছে না।

একটা জায়গায় এসে রিমি থেমে গেল। ছোট্ট একটা ঝোপের পাশে। হঠাৎ বলল, “তুই জানিস? আমি একা থাকি। মা আছেন, কিন্তু বাবার সঙ্গে অনেক বছর দেখা হয়নি। আর দাদা দিল্লি থাকে। আমার দিনগুলো এতটা শান্ত ছিল না, যতটা তোকে দেখে লাগে।”

সোহম একটু থেমে বলল, “তুই এখন একা নেই।”

রিমি তাকাল তার দিকে। “আমি তো কিছু বলিনি…”

“তুই না বললেও, আমি বুঝি।”

রিমি চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল। তারপর ধীরে সোহমের দিকে এগিয়ে এল। হাত বাড়িয়ে বলল, “তোর হাতে একটু ধরতে পারি?”

সোহম হাত বাড়িয়ে দিল। আর হাত ধরে হাঁটতে থাকল তারা—এক বৃষ্টিভেজা রবিবারে, নাম না জানা রাস্তার ধারে, শব্দহীন এক কথার চেয়েও বেশি কিছু নিয়ে।

পাতা ঝরার আগে

রবিবারের সকালগুলো এখন আর কেবল ‘টিউশন’ নয়। ওগুলো এখন যেন একটা ছোট্ট উৎসব, যার কোনো ব্যানার নেই, শুধু দুটি মানুষের চুপচাপ অপেক্ষার মধ্যেই তার সাজসজ্জা লুকিয়ে থাকে।

সেই সকালেও বৃষ্টি ছিল। তবে এবার ঝিরঝিরে নয়—ধীর, ভারী, গভীর বৃষ্টি। সোহম রেইনকোট পরে বেরিয়েছে, তবু কাঁধ ভিজে যাচ্ছে। কিন্তু তাতে তার কিছুই আসে যায় না। তার চোখে আজও সেই মুহূর্ত ফিরে ফিরে আসছে—যেদিন রিমি বলেছিল, “তুই এখন একা নেই।”

চ্যাটার্জি স্যারের বাড়ি পৌঁছে দেখে, আজ ঘর একটু গরম। স্যারের স্ত্রী কেটলি নামাচ্ছেন, গ্যাসে এলাচ দেওয়া দুধের গন্ধ। সোহম বসতেই রিমি এসে ঢুকল—আজ তার পরনে গাঢ় সবুজ কুর্তি, আর মুখে অদ্ভুত এক প্রশান্তি।

“তুই ঠিকঠাক পৌঁছেছিস?” সোহম জিজ্ঞেস করল।

রিমি মাথা নাড়ল। “বৃষ্টির মধ্যে হাঁটলে আমার মনটা ভালো থাকে।”

সোহম বলল, “আর আমার তুই পাশে থাকলে ভালো থাকে।”

একটু থেমে গেল দুজনেই। যেন শব্দগুলো আজ বেশি জোরে বেজে উঠেছে।

টিউশন শুরু হতেই স্যার বললেন, “আজ আমি থাকব না। তোমরা সবাই যার যার মতো সেলফ স্টাডি করো। এক ঘণ্টা পর খাতা জমা দেবে।”

সবার মধ্যে একটুখানি হইচই, কিন্তু সোহমের মনে যেন উল্টো শান্তি নেমে এল। এই এক ঘণ্টা—রিমির পাশে, চুপচাপ বসে থাকার।

তারা পাশাপাশি বসে বই খুলল। মাঝে মাঝে চোখাচোখি। সোহম খাতার পাশে ছোট্ট একটা কাগজে লিখল—

‘তুই কি জানিস, কোনো কোনো মানুষ পাতা ঝরার আগেও প্রেমে পড়ে যায়?’

রিমি সেই কাগজটা দেখে একটু থেমে বলল, “পাতা ঝরে যাওয়ার আগেও?”

সোহম কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, “মানে এখনো কিছু শুরু হয়নি, কিন্তু মন তো থেমে থাকে না।”

রিমি হেসে বলল, “তাহলে তুই প্রেমে পড়েছিস?”

সোহম চুপ করে থাকল। শুধু জানালার দিকে তাকিয়ে রইল। গাছের ডালে জল জমে আছে, মাঝে মাঝে ফোঁটা ফোঁটা করে পড়ছে।

“হয়তো,” সে বলল, “হয়তো অনেক আগে থেকেই।”

রিমি ধীরে বলল, “তবে একটা শর্ত আছে।”

“কি?”

“যদি প্রেমে পড়িস, তবে ভুল করবি না কখনও। আমার জীবন খুব সরল নয়, তুই জানিস।”

সোহম বলল, “আমি তোর অতীতকে বিচার করব না। আমি শুধু পাশে থাকতে চাই, যখন তুই চুপ করে থাকিস, যখন হাসিস, এমনকি যখন তুই কিছুই না বলিস।”

রিমির চোখে জল ভরে উঠল। সে খাতা বন্ধ করে বলল, “চল, আজ ক্লাস শেষ। একটু বাইরে হাঁটি।”

দুজনেই বেরিয়ে এল। বৃষ্টি তখনও পড়ছে। রিমি ছাতা মেলল না, শুধু সোহমের হাত ধরল।

রাস্তার ধারে এক পুরোনো গাছ, যেটা তারা আগেও দেখেছে—আজ সেই গাছটার নিচে এসে দাঁড়াল তারা। গাছের পাতা থেকে টুপটাপ করে জল পড়ছে।

“তুই কি জানিস,” রিমি বলল, “এই গাছটার ডালে একবার একটা চিঠি বেঁধেছিলাম আমি। সেই সময়, যখন প্রেম মানে ছিল কেবল লেখার ভেতর কিছু লুকিয়ে রাখা।”

সোহম তাকাল তার দিকে। “চিঠিটা এখনো আছে?”

“নাহ, কেউ নিয়ে গেছে… হয়তো হাওয়া… হয়তো কেউ।”

সোহম বলল, “তাহলে চল, আজ আবার একটা চিঠি লেখা যাক।”

সে ব্যাগ থেকে একটা কাগজ বের করল। ছোট্ট একটা পেন্সিলে লিখল—

‘যদি কখনো হারিয়ে যাই, মনে করিস, রবিবার সকালে এক ছাতা তলায় আমরা হাঁটতাম।’

কাগজটা রিমির দিকে বাড়িয়ে দিল।

রিমি কাগজটা নিল, হাসল। তারপর দুজন মিলে সেটা বাঁধল গাছের ভেজা ডালে, সুতোর মতো এক ছেঁড়া কাপড়ে।

সেই পাতাটাও বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছিল, ঠিক যেমন তাদের বুকের ভেতর জমে থাকা কথাগুলো, যা এখন আর শুধু প্রেম নয়—এ যেন একটা প্রতিশ্রুতি।

শব্দহীন সংগীত

রাতের বৃষ্টি ছিল থেমে থেমে। সকালবেলা উঠে সোহম জানালার কাঁচে হাত রেখে দেখল—আজ আকাশ সেভাবে মেঘলা নয়, কিন্তু রোদের তেজও নেই। ঝাপসা, নরম আলোয় ভিজে আছে চারদিক। রবিবারটা যেন একটু ঘুমন্ত আজ।

চা খেতে খেতে সে বারবার খেয়াল করছিল একটা ছোট্ট জিনিস—রিমির দেওয়া কাগজটা। আগের রবিবারে গাছের ডালে তারা দুজন মিলেই বেঁধেছিল, কিন্তু ফিরতি পথে রিমি আরেকটা কাগজ সোহমের হাতে দিয়েছিল। শুধু বলেছিল, “আজ পড়বি না। পরদিন সকালে।”

সেই কাগজটা সোহম আজ সকালে খুলে পড়েছে।

‘যখন তুই বলেছিলি তুই আমার পাশে থাকতে চাস, তখনই আমার ভিতরের ভয়গুলো একটু নরম হয়ে গিয়েছিল। জানিস? আমি কাউকে বলতে পারিনি, কিন্তু তোর সামনে চুপ করেই অনেক কিছু বলে দিতে ইচ্ছে করে। তুই যদি থাকিস, আমি হয়তো আর ভয় পাব না।’

সোহম চুপচাপ কাগজটা বুকের ডায়েরির ভাঁজে রেখে দিয়েছিল। এবার সে জানে, তারা কেবল একসাথে হাঁটছে না, তারা একে অপরকে ভেতর থেকে চিনে ফেলছে—ধীরে ধীরে, মৃদু মৃদু, ঠিক যেমন রবিবারের বৃষ্টি নামে।

চ্যাটার্জি স্যারের বাড়ি পৌঁছে দেখে ঘরটা আজ কিছুটা আলাদা। এক কোনায় হারমোনিয়াম রাখা। স্যার বাইরে যাচ্ছেন, বললেন, “আজ আমার এক পুরোনো বন্ধু এসেছেন। ওর সঙ্গে একটু পরিচিত হও। ও গান শেখান।”

রিমি এসে পৌঁছেছে তখনই। তার চোখে হালকা ক্লান্তি, কিন্তু হাসিটা একদম প্রখর।

“স্যারের বন্ধুকে দেখলি?” রিমি বলল।

“হ্যাঁ… হারমোনিয়াম বাজাতে দেখলাম,” সোহম বলল।

“গান শুনতে ভালো লাগে তোর?” রিমি প্রশ্ন করল।

“ভালো লাগা শব্দটা ছোট হয়ে যায়। আমি শুনি, চোখ বন্ধ করে, মন খুলে,” সোহম বলল।

রিমি একটু চুপ করে থাকল। তারপর বলল, “আমিও গান করি, জানিস? তবে গাই না এখন আর। একটা সময় গাইতাম। দাদার চলে যাওয়ার পর থেমে গেছি।”

“তুই আবার শুরু করিস,” সোহম বলল।

“তুই পাশে থাকলে হয়তো পারি।”

এই কথার মাঝে হারমোনিয়ামের প্রথম সুর বাজল। টানা, ধীর, একরাশ বিষণ্ণতা নিয়ে। সুরটা যেন কাঁচে জমে থাকা বৃষ্টির ফোঁটার মতো—স্বচ্ছ, অথচ ভারী।

রিমি চোখ বন্ধ করল। সোহমও। তাদের মাঝে কোনো কথা নেই, কিন্তু দুজনেই অনুভব করছে—এই সংগীত শুধুই হারমোনিয়ামের নয়, এ হল দুটো হৃদয়ের অজানা তরঙ্গের মিলন।

টিউশন শেষে রিমি বলল, “আজ একটু বসবি আমার সঙ্গে?”

সোহম মাথা নাড়ল।

তারা উঠল দোতলায়, ছাদের নিচে বসে থাকল একটা পুরোনো কাঠের বেঞ্চে। নিচে মাঠে কয়েকজন ছেলেমেয়ে ফুটবল খেলছে, দূরে পাহাড় মেঘে মিশে যাচ্ছে।

“তুই কি জানিস,” রিমি বলল, “গান মানে কেবল সুর নয়, গান মানে কারো জন্য অপেক্ষাও।”

সোহম বলল, “তোর কণ্ঠ শুনিনি এখনো। আজ কি একটা গান গাইবি আমার জন্য?”

রিমি একটু লজ্জা পেল। তারপর ধীরে, খুব ধীরে গলা ছেড়ে গাইতে শুরু করল—

‘রবিবারে রোদ্দুর ছিল না,
তবুও তুই এসেছিলি
চোখে আমার ছায়া ছিল,
তুই আলো বেছেছিলি।’

সোহম চুপ করে শুনছিল। বুকে এক ধরনের অজানা কাঁপুনি।

গানটা থেমে যাওয়ার পর দুজনেই চুপ।

রিমি বলল, “তুই যখন আসিস, তখন আমার সব পুরোনো ভয়গুলো পেছনে পড়ে যায়।”

সোহম বলল, “তোর গান শুনে আমি এবার সত্যি বুঝলাম—তুই শব্দ দিয়ে নয়, সুর দিয়ে ভালোবাসিস।”

রিমি মাথা নিচু করে থাকল। একটু পর ধীরে বলল, “তোর হাতটা ধরতে পারি আরেকবার?”

সোহম এবার কিছু বলল না। শুধু হাত বাড়িয়ে দিল। সেদিন রবিবারের বৃষ্টি না থাকলেও, আকাশটা ছিল ভালোবাসায় সজল।

কুয়াশার ফাঁকে প্রথম ছোঁয়া

সকালটা অন্যরকম। আকাশ মেঘলা নয়, রোদও নেই—কেবল ঘন কুয়াশা। যেন পাহাড় থেকে নেমে এসে সারা শহরটাকে ঢেকে রেখেছে এক মোহনায়। জানালার বাইরে সবকিছু ঝাপসা, রঙহীন অথচ রহস্যময়।

সোহমের ঘুম ভাঙে একটু দেরিতে। কিন্তু আজ আর দেরি করে না। সে জানে, আজকের রবিবারটা একটু বেশি গুরুত্বপূর্ণ। রিমির সঙ্গে কথা হয়েছিল ফোনে আগের রাতেই। খুব ছোট্ট কথা—“কাল একটু আগে আসিস। একটা জায়গা দেখাব।”

সোহমের কল্পনায় দিগন্ত জুড়ে তখন শুধু অনুমান। রিমি কী দেখাবে? কোনো পুরোনো জায়গা? কোনো স্মৃতি? নাকি…

সাইকেল নিয়ে বেরোয় সোহম। রাস্তায় তেমন কেউ নেই। কুয়াশার ভেতর দিয়ে যেতে যেতে তার মনে হয়, আজকের সকালটা শুধু তাদের জন্য তৈরি।

চ্যাটার্জি স্যারের বাড়ি পৌঁছাতেই দেখে, স্যার আজও নেই। রিমি আগে থেকেই দাঁড়িয়ে, গায়ে হালকা নীল শাল, চুল খোলা, কুয়াশায় ভিজে গেছে অল্প। মুখে সেই পুরোনো, চুপচাপ হাসি।

“চল,” রিমি বলল। “আজ ক্লাস নেই। আজ শুধু হাঁটা।”

সোহম একটু অবাক হলেও কিছু বলল না। পাশে গিয়ে দাঁড়াল। তারা হাঁটতে লাগল, পাড়ার পেছনের দিকে—যেখানে মানুষ কম, যেখানে গাছপালা আর পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে ছোট ছোট সরু রাস্তা।

হাঁটতে হাঁটতে তারা পৌঁছাল একটা ছোট্ট জঙ্গলের ধারে। একটা পুরোনো কাঠের ব্রিজ, যার নিচে শুকনো জলধারা, শুধু পাথর পড়ে আছে।

রিমি বলল, “এখানে আমি ছোটবেলায় খেলতাম। কেউ জানত না। আমার একমাত্র জায়গা ছিল এটা।”

সোহম আশেপাশে তাকাল—চারদিকে কুয়াশা, শুধু তাদের দুজনের নিঃশ্বাস চলাফেরা করছে।

“তুই আমায় এখানে আনলি… মানে… এটা তোর জন্য অনেকটা ব্যক্তিগত জায়গা, না?” সোহম বলল।

রিমি ধীরে মাথা নাড়ল। “তুই এখন আমার ব্যক্তিগত অনুভবের অংশ।”

সোহম চুপ করে গেল। বুকের মধ্যে কেমন গুমগুম করতে লাগল।

“তুই কি জানিস,” রিমি বলল, “তোর চোখে একটা শান্তি আছে। আমি সেই শান্তির মধ্যে নিজেকে দেখতে পাই।”

সোহম বলল, “তুই যদি একদিন চলে যাস…?”

“তুই ভাবিস কেন এমন?” রিমি বলল।

“কারণ ভয় হয়,” সোহম স্বীকার করল। “আমি জীবনে এর আগে কাউকে এতটা অনুভব করিনি।”

রিমি একটু এগিয়ে এল, তারপর বলল, “চোখ বন্ধ কর।”

সোহম চোখ বন্ধ করল।

হালকা হাওয়ার শব্দ, কুয়াশায় পাতা ঝরে পড়ার মতন নরম স্পর্শ।

তারপর হঠাৎ ঠোঁটে এক মৃদু চাপ—একটা স্পর্শ, যেটা শব্দহীন, কিন্তু সমস্ত অনুভব দিয়ে বলে দিল যা বলা যায় না।

চোখ খোলার পর রিমি একটুও পিছিয়ে গেল না। বরং একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল।

“ভেব না, এটা কোনো প্রেমিক-প্রেমিকার নিয়মিত গল্প নয়। এটা আমার বিশ্বাসের স্পর্শ। যেটা আমি কাউকে দিইনি এতদিন,” রিমি বলল।

সোহম একটু কাঁপা গলায় বলল, “তুই আমার প্রথম অনুভব, রিমি। কোনো নাম লাগবে না ওতে। কোনো সংজ্ঞাও নয়। শুধু চাই, প্রতিটা রবিবার এমন থাকুক—তোর সঙ্গে, এমন করে।”

রিমি তখন কুয়াশার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুই পাশে থাকলে, কুয়াশার মধ্যেও আমি দিগন্ত দেখতে পাই।”

তারা ফিরে এল ধীরে, পায়ে পায়ে, কোনো কথা না বলে। আর কুয়াশার মধ্যে সেই ছোট্ট ব্রিজের ওপর আজ থেকে লেখা রইল এক নতুন ছোঁয়া—একটা চিরকালীন অনুভব।

দুপুরবেলার দীর্ঘ চিঠি

সেই প্রথম ছোঁয়ার পর, সময় যেন থমকে গিয়েছে। প্রতিটা রবিবারের সকাল এখন আর কেবল প্রতীক্ষা নয়, বরং স্মৃতি হয়ে ওঠে সঙ্গে সঙ্গে—একটা সময়ের ভেতর সময় হারিয়ে যায়।

সোহম সেই রবিবারের পর একটা চিঠি লিখতে শুরু করে। খাতার পেছনের পাতায়, প্রতিদিন একটু করে। কোনো প্রাপক লেখা নেই, কিন্তু প্রতিটা লাইনেই রিমির নাম জড়িয়ে আছে, আড়ালে, স্নেহে, আর কখনও কখনও অশ্রুতে।

এদিকে রিমিও বদলে গেছে। তার চোখে এখন একরকম নিশ্চিন্ত ভরসা। আগের মতো হঠাৎ চুপ করে যাওয়া বা একদৃষ্টে কাচের দিকে তাকিয়ে থাকা—সেসব নেই আর। সে হাসে এখন, অনেক বেশি। আর কথা বলে, ছোট ছোট, অথচ জরুরি বিষয়ের উপর।

এই রবিবারে চ্যাটার্জি স্যারের টিউশন হয়নি। স্যার ফোন করে জানিয়ে দিয়েছেন—অসুস্থ।

রিমি প্রথমে বলেছিল, “তাহলে দেখা হবে না আজ?”

সোহম বলেছিল, “তুই বললেই দেখা হবে।”

রিমি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে শুধু বলেছিল, “আজ দুপুরে আয় আমার বাড়িতে। মা বাড়িতে নেই। তুই আয়, আমি চা করব।”

সোহম দুপুরে পৌঁছাল, বুকের মধ্যে একরকম উথাল-পাথাল নিয়ে। রিমির বাড়িটা ছিমছাম, লতাপাতা ঘেরা বারান্দা, একটা পুরোনো গ্রামোফোন কোণে পড়ে। দেয়ালে কিছু ছবির ফ্রেম, আর মাঝখানে কাঠের দোলনা চেয়ার।

রিমি চুল খোলা রেখেছে, হালকা গন্ধভরা রেশমি ওড়না কাঁধে। সে হাসল, “তুই ঠিক সময়েই এসেছিস।”

সোহম বলল, “দুপুরটা আজ রবিবারের সকাল হয়ে উঠুক।”

রিমি রান্নাঘর থেকে চা নিয়ে এল—প্লাস্টিক কাপ নয়, দুই হাতে ধরা দুটো মাটির ভাঁড়। জানালার ধারে তারা বসল, বারান্দায়।

“তুই কি জানিস,” রিমি বলল, “এই জানালার ধারে বসে আমি আগে কবিতা লিখতাম। তারপর বন্ধ হয়ে গিয়েছিল সব কিছু। সেই আমি আবার ফিরে এসেছি, তোর জন্য।”

সোহম পকেট থেকে খাতাটা বের করল। সেই চিঠির খাতা।

“আমি কিছু লিখেছি… জানি না, ঠিকঠাক কিনা,” সে বলল।

রিমি খাতাটা নিয়ে পাতা উল্টাল। সেখানে লেখা:

‘তুই যখন প্রথম ছাতা ভাগ করেছিলি, তখন বুঝিনি—তুই আমার দুঃখেরও আশ্রয় হয়ে যাবি।
তুই যখন বললি তুই পাশে থাকবি, তখন আমার ভেতরের সমস্ত অন্ধকার আলো পেতে চাইলো।
তুই আমার কাছে কোনো প্রেম নয়—তুই একখণ্ড নির্ভরতা। একটা শব্দহীন সংগীত, যা কেবল অনুভবে বাজে।’

রিমি ধীরে পাতাটা চোখে ছুঁইয়ে বলল, “তুই জানিস, আমি আজকাল কাঁদি না আর। আগে একা থাকলে কাঁদতাম, ভয় পেতাম। এখন শুধু তোর কণ্ঠের কথা মনে হয়।”

সোহম বলল, “তুই আমার জীবনের সেই প্রথম দুপুর—যেখানে সময় থেমে গেছে, শুধু আলো ছুঁয়ে যায় চুপিচুপি।”

দুপুরটা কাটল গল্পে, নীরবে, হাসিতে, আর মাঝে মাঝে নিরবতা। কখনও গান শুনে, কখনও একে অপরকে দেখেই বোঝা গেল—ভালোবাসা শব্দের জন্য তৈরি নয়।

তারা যখন বিদায় নিচ্ছিল, তখন রিমি বলল, “তুই আজ একটা কথা না বলেই চলে যাচ্ছিস।”

সোহম বলল, “কি কথা?”

রিমি হেসে বলল, “এই চিঠিটার শেষ লাইনে কেন লিখিসনি, ‘তুই আমার ভালোবাসা’?”

সোহম কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল তার দিকে। তারপর বলল, “কারণ তুই আমার ভালোবাসার বাইরে… তুই আমার জীবনের ছায়া। আর ছায়া ভালোবাসা চায় না, শুধু পাশে থাকে।”

রিমি কিছু বলল না। শুধু এগিয়ে এসে সোহমের কপালে হালকা করে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিল। সেই চুম্বনে ছিল না উত্তাপ, ছিল আশ্বাস।

আর জানালার বাইরে রোদ ও কুয়াশা মিলে এক অদ্ভুত মৃদু আলো ছড়িয়ে দিয়েছিল দুপুরজুড়ে।

ঝরাপাতা, থেমে যাওয়া হাওয়া

রবিবার ভোরে হঠাৎ একটা হাওয়া বইল। অস্বাভাবিক ঠান্ডা, যেন শীত আগেভাগেই এসে গিয়েছে। জানালার বাইরে গাছের পাতা ঝরে পড়ছিল একটার পর একটা। কিছুটা মায়া, কিছুটা শূন্যতা নিয়ে।

সোহম খুব স্বাভাবিকভাবে উঠল না আজ। গা এলিয়ে রেখেছিল খাটে, মাথার নিচে রিমির দেওয়া সেই সাদা ওড়নাটা, যেটা একবার বৃষ্টিতে ভিজে গিয়ে শুকিয়ে নিয়েছিল, তারপর আর ফেরত চায়নি।

সেদিন সকালে রিমির মেসেজ এল না। এটা বিরল। একটাও “সকাল” লেখা নেই, একটা ফুল ইমোজিও না।

সোহম প্রথমে ভাবল, হয়তো ফোন বন্ধ। কিন্তু পরে যখন দুপুর গড়িয়ে এল, তখন মনটা কেমন করে উঠল। সে ফোন করল—একবার, দুইবার, পাঁচবার। কোনো উত্তর নেই।

শেষে এক সাহস নিয়ে পৌঁছে গেল রিমির বাড়ি। কিন্তু দরজায় তালা। প্রতিবেশী কাকিমা জানালেন, “ওরা তো আজ ভোরেই বেরিয়ে গেছে। মেয়েটার মা নাকি হঠাৎ অসুস্থ হয়েছেন, শিলচরে চলে গেছে মেয়েকে নিয়ে। জরুরি ছিল খুব।”

সোহম কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল ফাঁকা বারান্দার সামনে। কোথাও যেন কানে বাজতে লাগল রিমির কণ্ঠ—“তুই পাশে থাকলে কুয়াশার মধ্যেও আমি দিগন্ত দেখি।”

কিন্তু এখন চারপাশে কুয়াশা নেই, দিগন্ত নেই, শুধু ফাঁকা দরজা আর তালা।

সে ফিরে এল ধীরে ধীরে। হাতে খাতাটা ছিল, যেটার প্রতিটি পাতা রিমিকে লেখা। বাড়ি ফিরে সেই খাতার একেবারে শেষ পাতায় সে লিখল—

‘আজ রবিবার নেই। আজ জানালায় বৃষ্টি নেই। আজ তুই নেই।
তবুও আমি বসে আছি, সেই বারান্দায়।
তোর ছোঁয়া শুকিয়ে গেলেও ওড়নাটায় তোর গন্ধ রয়ে গেছে।
তুই না থাকলেও, তুই আছিস।
আর আমি, সেই সোহমই আছি,
যে তোকে প্রতিদিন একেকটা চিঠি লিখে রেখে যাবে—
এই জানালার কাঁচে, এই কুয়াশার ধারে।’

তারপর অনেকটা সময় পেরিয়ে গেল। সপ্তাহ কাটল, মাসও। রিমি ফিরে এল না। ফোন বন্ধ, ঠিকানা বদলে গেছে, আর কোনো মেসেজও না।

বন্ধুদের কেউ কেউ বলেছিল, “চলে গেছে মানেই শেষ না। আবার ফিরে আসবে।” কেউ বলত, “ভুলে যা। জীবন থেমে থাকে না।”

কিন্তু সোহম থামেনি। সে প্রতি রবিবার সকালে সেই চ্যাটার্জি স্যারের বাড়ির পাশে এসে দাঁড়াত। কেউ থাকত না, শুধু সোহম আর তার ছায়া।

একদিন, একটা রবিবার সকালে, সে দেখে গাছের ডালে বাঁধা সেই কাগজটা এখনো ঝুলছে। ভিজে গেছে, বিবর্ণ হয়ে গিয়েছে, কিন্তু হারায়নি। সে কাগজটা খুলে আবার পড়ল। সেই লাইনটা:

‘যদি কখনো হারিয়ে যাই, মনে করিস, রবিবার সকালে এক ছাতা তলায় আমরা হাঁটতাম।’

সেই মুহূর্তে হঠাৎ তার পেছনে কেউ এসে দাঁড়াল।

চেনা গন্ধ। চেনা নিঃশ্বাস।

সোহম ধীরে ঘুরে দাঁড়াল। কুয়াশার মধ্য থেকে বেরিয়ে এল রিমি।

ভিজে চুল, চোখে ক্লান্তি, মুখে নিঃশব্দ কান্না।

সে বলল না কিছু। সোহমও না।

শুধু হাত বাড়িয়ে দিল।

রিমি চুপচাপ হাত ধরল।

আর এক রবিবার, বহুদিন পর, আবার শুরু হল।

ফিরে আসার গান

রিমিকে দেখে সোহম প্রথমে কিছু বুঝে উঠতে পারেনি। সেই চোখ, সেই চুল, সেই গন্ধ—সব ছিল, কিন্তু তার ভেতরে যেন সময়ের একটা ক্লান্তি জমে বসে আছে।

কোনো আলিঙ্গন হয়নি, কোনো দীর্ঘ বাক্যও না। শুধু হাত ধরা ছিল। কিন্তু সেই হাত ধরার মধ্যে একসাথে অনেক প্রশ্ন, অনেক ক্ষমা চাওয়া, আর একটা নিশ্চুপ ‘তুই ফিরে এসেছিস’ জড়িয়ে ছিল।

পাশের গাছ থেকে পাখি উড়ে গেল। দুজনের মাঝখানে সময় থেমে ছিল কয়েক মুহূর্ত। তারপর সোহম ধীরে বলল, “তুই… কবে এলি?”

রিমি বলল, “গতকাল রাতেই। মা এখনও ভালো নেই, কিন্তু আমি আর থাকতে পারছিলাম না। এই শহর, এই রাস্তাগুলো… তুই না থাকলে যেন সব শূন্য হয়ে যেত।”

সোহম কিছু বলল না। শুধু ওর চোখে তাকিয়ে থাকল। সেখানে সে দেখল ভেসে আসা অনেক অজানা দিন, যেগুলো রিমি একা কেটেছে—সেই চেনা গানগুলো ছাড়া, সেই পুরোনো জানালার পাশে বসে, কোনো ‘সোহম’ ছাড়া।

“তুই ফোন করিসনি,” সোহম বলল।

“চাইনি,” রিমি বলল। “তুই অপেক্ষা করবি কি না, সেটা জানতেই চাইনি। কারণ জানলে হয়তো বিশ্বাসটা হারিয়ে ফেলতাম।”

“আর আমি প্রতিটা রবিবার দাঁড়িয়ে থেকেছি এখানেই,” সোহম বলল। “এই গাছটার নিচে। কারণ আমি জানতাম, তুই না এলেও তুই আছিস। সেই কাগজটা তো আজও ছিল এখানে।”

রিমি বলল, “তোর লেখা প্রতিটা চিঠি আমি অনুভব করতে পারতাম, দূর থেকেও। তুই হয়তো জানিস না, কিন্তু তোর স্পর্শ আমার ভেতরে এত গভীরে গিয়েছিল, যে সেখান থেকে পালানো যায় না।”

তারা হাঁটছিল সেই পুরোনো গলিপথে, যেখানে একদিন ছাতা ভাগ হয়েছিল, তারপর প্রথম ছোঁয়া, তারপর গান, এবং তারপর দীর্ঘ বিরহ।

“তুই ফিরেছিস… এখন কী করবি?” সোহম জিজ্ঞেস করল।

রিমি একটু থেমে বলল, “নিজেকে খুঁজে নেব। তোর পাশে থেকে, আবার নতুন করে গান গাইব, আবার জানালার ধারে কবিতা লিখব, আবার রবিবারগুলোকে আমার করে তুলব।”

সোহম হেসে বলল, “তাহলে শুরু হোক নতুন এক গল্প। শুধু নামটা বদলাব না—তাতে ‘রবিবার’ শব্দটা থেকে যাবে।”

রিমি বলল, “তোর সেই খাতাটা আছে?”

সোহম ব্যাগ থেকে বের করল সেই পুরোনো চিঠিভরা খাতা। পাতা ছেঁড়া, কিছু লেখা মুছে গেছে, তবু তার ঘ্রাণ অমলিন।

রিমি বলল, “আমিও এবার তোর জন্য লিখব। প্রতিটা রবিবারে একটা করে চিঠি। শুধু আমরা দুজন জানব তার অর্থ।”

সোহম বলল, “তাহলে চল, আজ সেই প্রথম পাতায় আবার লিখি—‘রিমি ফিরেছে।’”

তারা একসাথে গাছের নিচে বসল। খাতার এক কোণে রিমি লিখল—

‘আমি ফিরে এসেছি।
তোর অপেক্ষার কাছে মাথা নত করেছি।
তুই যেমন ছিলি, তেমনই আছিস—
একটা শব্দহীন সংগীত হয়ে।
আজ থেকে প্রতিটা রবিবারে,
আমি আবার তোর পাশে থাকব,
ছাতার নিচে, গানের ছায়ায়।’

রবিবারের শেষ বৃষ্টিফোঁটা জানালার কাঁচে এসে পড়ল। আর সেই সাথে, এক নতুন গল্প আবার শুরু হল।

এইবার, কোনো হারিয়ে যাওয়ার ভয় নেই।

গল্পের পাতার মাঝে

সোহম আর রিমির গল্পটা ঠিক বইয়ের মতো নয়—যার শুরু আছে, মাঝখানে মোচড়, আর শেষে সমাপ্তি। বরং ওদের গল্প যেন এক অসমাপ্ত খাতার মতো, প্রতিটা পৃষ্ঠায় শুধু অর্ধেক করে লেখা, বাকিটা হৃদয়ের শব্দে ভরাট।

এই রবিবারে সোহম আর রিমি এসেছে পুরোনো লাইব্রেরিতে—‘পাহাড়তলি পাঠাগার’। একতলা টিনের ছাদে গড়া ছোট্ট লাইব্রেরি, যার ভেতরে ছড়িয়ে আছে ধুলোমাখা বই, পুরোনো কাঠের টেবিল, আর কিছু কিছু মানুষের নিরব উপস্থিতি।

রিমি বলল, “আমি যখন ছোট ছিলাম, এই লাইব্রেরিতেই প্রথম প্রেমের উপন্যাস পড়েছিলাম—তখন ক্লাস সেভেনে। নাম ছিল ‘ছায়ার নিচে এক রোদেলা দিন’। জানিস, সেই গল্পে নায়ক-নায়িকা একে অপরের জন্য চিঠি রেখে যেত লাইব্রেরির বইয়ের পাতার মধ্যে।”

সোহম বলল, “চিঠি রাখার এই পদ্ধতিটা বেশ চমৎকার। ভাবছিস নাকি কিছু রেখে যাওয়া?”

রিমি হেসে বলল, “হয়তো। তুই যদি পরে এসে খুঁজিস, তোর জন্য একটা কবিতা রেখে যাবো।”

তারা পাশাপাশি বসেছিল লাইব্রেরির কাঠের বেঞ্চে। সামনে পাতা উল্টে চলেছে ‘রবীন্দ্ররচনাবলী’। বৃষ্টির আওয়াজ নেই, কিন্তু ছাদে টিনে বাতাসের দোলা।

হঠাৎ সোহম বলল, “তুই জানিস, তোকে ভালোবাসা বলতে আমার কেমন লাগে?”

রিমি তাকাল। “বল তো।”

“তুই যেন আমার প্রথম পড়া কবিতার মতো। তখন আমি বুঝিনি মানে কী, শুধু শব্দগুলো ভালো লেগেছিল। আর এখন, যতই পড়ি, ততই নতুন কিছু খুঁজে পাই।”

রিমি হালকা হেসে বলল, “তাহলে তুই আমার পাঠক?”

“পাঠক নয়… সহলেখক,” সোহম বলল। “আমাদের গল্প আমরা একসাথে লিখছি।”

রিমি হঠাৎ ব্যাগ থেকে একটা ছোট্ট খাম বের করল। তাতে লেখা, “তুই পরে খুলিস, আজ না।”

সোহম চমকে তাকাল।

“কি আছে এখানে?”

“গল্পের শেষ নয়। একটা সম্ভাবনা,” রিমি বলল।

তারা বাইরে বেরিয়ে এল। আকাশে মেঘ জমছে। হাওয়া একটু ঠান্ডা। রিমি বলল, “চল, আজ সেই প্রথম ছাতার নিচে হাঁটা যাক।”

সোহম বলল, “আজ ছাতা এনেছিস?”

রিমি মাথা নাড়ল, “না। আজ ভিজেই হাঁটব। প্রথমবারের মতো, একদম ভিজে।”

তারা দুজনে রওনা দিল সেই পুরোনো পথ ধরে—যেখানে একদিন প্রথম দেখা হয়েছিল, প্রথম চোখের ভাষা কথা বলেছিল। রাস্তার পাশে সেই ছোট্ট গাছটা এখন আর কাগজে ভরা নেই, তবু মনে হয়, ওর পাতাগুলো আজও ফিসফিস করে বলে—“তুই ফিরে এসেছিস।”

সোহম বলল, “এই শহরে, এই রবিবারে, তুই যখন পাশে থাকিস, আমি কোনোদিন একা নই।”

রিমি বলল, “তুই যদি কোনোদিন ভুলেও হাঁটিস অন্য কারো সঙ্গে, আমি জানব, তোর মনের ভেতর আমার জন্য জায়গা ছিল, আছে, থাকবে।”

পিছনে পড়ে রইল ছায়া, সামনে এগিয়ে গেল ভালোবাসার গল্প। নামহীন, নিরবিচারে লেখা এক প্রেম, যার ভাষা শুধুই অনুভব।

রবিবারের শেষ পৃষ্ঠা

বছর ঘুরে গিয়েছে।

পাহাড়ঘেরা শিলিগুড়ির বাতাসে এখন হালকা শীত, আবার বৃষ্টির আভাস। পাতা ঝরছে প্রতিদিন, আর প্রতি রবিবার সোহম আর রিমি একবার করে হাঁটে সেই পথ ধরে—যেটা একসময় ছিল টিউশন যাওয়ার রাস্তা, এখন ভালোবাসার নিঃশব্দ উপাখ্যান।

এই রবিবার সকালটা অন্যরকম। রিমি ফোন করে বলেনি আজ কী পরিকল্পনা। সোহম শুধুই জানে—আজ সে খোলার জন্য নিয়ে যাচ্ছে সেই খামটা, যেটা রিমি বহু আগেই দিয়েছিল।

সকালে বেরিয়ে পড়ল সে। ছাতাও নিল না। রিমি বলেছিল—”আজ ভিজেই হাঁটব”—সেই কথা আজও তার মনে গাঁথা।

পথে হাঁটতে হাঁটতে সোহম পৌঁছাল সেই পুরোনো ব্রিজের কাছে, যেটার নিচে শুকিয়ে যাওয়া নদীটা এখনো পাথর ধরে বসে আছে। আজও সেই ব্রিজের রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রিমি। চুল উড়ছে হাওয়ায়, চোখে গাঢ় কিছু ভাবনা।

“তুই এসেছিস,” রিমি বলল।

“তুইও তো অপেক্ষা করছিলি,” সোহম বলল।

দুজনেই চুপ। বাতাসের মাঝে কিছু শব্দ ছিল—পাতা ঝরার, দূরের কাকের ডাক, আর হৃদয়ের নরম চাওয়ার।

“খামটা এনেছিস?” রিমি জিজ্ঞেস করল।

সোহম ব্যাগ খুলে বের করল খামটা। ধীরে ধীরে ছিঁড়ে খুলল।

ভিতরে একটা ছোট চিঠি—

‘তুই আমার প্রথম সাহস।
তোর সঙ্গে আমি হারিয়েও ঠিক খুঁজে পেয়েছি নিজেকে।
এই শহরের গন্ধে, বৃষ্টির প্রতিটা ফোঁটায়, তোর শব্দহীন ভালোবাসায় আমি নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছি।
তুই যদি চাস, আমি আবার শুরু করতে চাই।
কোনো গন্তব্য ছাড়াই, শুধু রবিবারের পথ ধরে।’

চিঠি পড়া শেষ হওয়ার আগেই রিমি এগিয়ে এসে বলল, “তুই কি আজও পাশে থাকবি?”

সোহম হেসে বলল, “তুই তো কখনো পাশ ছাড়িসনি, আমি কীভাবে যাব?”

রিমি হাত ধরল তার। প্রথমবার নয়, কিন্তু এবার হাতে ছিল অন্যরকম চাপ—যেন বিশ্বাস, বন্ধুত্ব, আর প্রেম একসাথে জড়িয়ে ধরা।

দুজনেই হাঁটতে লাগল। কোনো গন্তব্য নেই, কোনো মানচিত্রও না। শুধু তারা জানে, প্রতিটা রবিবারে তারা একে অপরের পাশে হাঁটবে।

জানালার পাশে একটা খাতা খুলে রইল। তার শেষ পাতায় লেখা—

‘গল্প শেষ নয়।
শুধু এই অধ্যায় শেষ হল।
পরবর্তী রবিবারে,
আবার শুরু হবে…
আমাদের গল্পের নতুন পৃষ্ঠা।’

সমাপ্ত

1000024576.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *