সোনালী সরকার
এক
রবিবারের সকালটা কলকাতার বাকি দিনের থেকে আলাদা। শহর যেন একটু দেরিতে জেগে ওঠে, রাস্তায় গাড়ির ভিড় কম, বাতাসে থাকে একধরনের অলস নরমতা। চৌরঙ্গির পথ ধরে চলা পুরোনো নীল ট্রামটাও যেন সেই শান্তির সুরে বাজতে থাকে। জানলার ধারে বসে প্রিয়া ট্রামের ধাতব শব্দ শুনতে শুনতে শহরের ভোরের সৌন্দর্য উপভোগ করে। আকাশে হালকা মেঘের ছায়া, সূর্যের কুঁচকানো আলো নীলচে ধূসর রঙের সঙ্গে মিশে তৈরি করছে এক অদ্ভুত রঙপট। কলেজ স্ট্রিটের বইয়ের গন্ধ, পুরনো বাড়ির ছায়া, রাস্তার ধারে অল্প ক’জন চা-ওয়ালার ডাক—সব মিলিয়ে এই সকাল যেন অন্য দিনের চেয়ে বেশি ব্যক্তিগত। প্রিয়ার চোখে প্রতিফলিত হয় এই শহরের ধীর ছন্দ, তার কানে আসে ট্রামের বৈদ্যুতিক ঝংকার, আর মনে হয় এই যাত্রাটা শুধু শহরের নয়, তার নিজের ভেতরেরও এক নিঃশব্দ ভ্রমণ। সাদা সুতির জামা আর খোলা চুলে প্রিয়া যেন শহরের রঙের সঙ্গে মিশে গিয়ে এক অচেনা অথচ চেনা দৃশ্যের অংশ হয়ে ওঠে।
সামনের সিটে বসা এক যুবকের দিকে তার চোখ এক মুহূর্তের জন্য আটকে যায়। যুবকটির গায়ের রঙে আছে মধ্যবিত্ত শহুরে উষ্ণতা, গাঢ় সবুজ শার্টের হাতা গুটিয়ে রেখেছে, আর হাতে ধরা নোটবুকের দিকে মাঝে মাঝে চোখ রাখছে। তার দৃষ্টি জানলার বাইরের পথে, কিন্তু তার আঙুলের নড়াচড়া বোঝায় সে হয়তো কিছু লিখছে বা লিখতে চাইছে। প্রিয়া অনিচ্ছা সত্ত্বেও খেয়াল করে, নোটবুকের মলাটটা খানিকটা ছেঁড়া, যেন বহুদিন ধরে ব্যবহার করা। ছেলেটির ঠোঁটের কোণে একরকম একাকিত্বের ছাপ, যা শহরের নিস্তব্ধ রবিবারের সঙ্গে আশ্চর্যভাবে মানিয়ে যায়। এক মুহূর্তের জন্য দুজনের চোখের দেখা হয়। কোনো কথা নয়, কোনো সম্ভাষণ নয়, তবু সেই ক্ষণিকের মিলন যেন অদৃশ্যভাবে দুজনের চারপাশের সময়কে থামিয়ে দেয়। ট্রামের ধীর শব্দ, চৌরঙ্গির পুরনো গাছের ছায়া, আর দুজন অচেনা মানুষের নীরব চোখাচোখি—সবকিছু মিলে এক অদ্ভুত আবহ তৈরি করে, যেখানে শব্দের চেয়ে দৃষ্টির ভাষা বেশি বলিষ্ঠ।
ট্রাম এগিয়ে চলে ধীরে ধীরে—ধাতব চাকার ছন্দে, তারের টানটান শব্দে। প্রিয়া জানলার ধারে হাত রেখে বাইরে তাকিয়ে দেখে পুরনো লালবাজারের দেয়াল, বইয়ের দোকান, কফিহাউসের সামনের ভিড়হীনতা। ছেলেটি—সৌমিক—এখনও নোটবুকে কিছু লিখছে, কিন্তু শব্দগুলো প্রিয়ার কাছে অদৃশ্য। তাদের মধ্যে কোনো পরিচয় নেই, নামের আদানপ্রদান নেই, তবু একটা অদ্ভুত টান অনুভব করা যায়। প্রিয়া হালকা নিঃশ্বাস ফেলে মনে মনে ভাবে, রবিবারের এই ট্রামযাত্রা যদি সবসময় এমনই নীরবতায় ভরে থাকে, তবে হয়তো প্রতিটি রবিবারই একটা গোপন প্রতীক্ষা হয়ে উঠবে। ট্রামের ভিতরের ম্লান আলো, জানলার কাঁচে লেগে থাকা বৃষ্টির ফোঁটার মতো ধুলো, আর দুই অচেনা মানুষের নীরব উপস্থিতি—সব মিলে প্রথম রবিবারের সকালকে এমন এক মুহূর্তে পরিণত করে যা হয়তো তাদের জীবনে অনামী অথচ অবিস্মরণীয় থেকে যাবে।
দুই
দ্বিতীয় রবিবারের সকালটা যেন প্রথম রবিবারেরই নীরব প্রতিধ্বনি। কলকাতার রাস্তায় এখনও অলসতার ছাপ, ট্রামের ধীরগতির ঝংকারে শহরের পুরনো হৃদস্পন্দন বাজছে। চৌরঙ্গির পথে আজও মৃদু কুয়াশার মতো এক ধূসর আলো ছড়িয়ে আছে। প্রিয়া হাঁটতে হাঁটতে যখন ট্রামের প্ল্যাটফর্মে পৌঁছাল, তখন আকাশের হালকা রোদে রাস্তার ওপর জমে থাকা রাতের শিশির ঝিলমিল করে উঠছিল। ঠিক সেই একই সময়, আগের রবিবারের মতোই, পুরনো নীল ট্রামটা ধীরে ধীরে থেমে দাঁড়াল। যেন শহরের এই যানও জানে, রবিবার মানেই কিছু অপেক্ষার গল্প। প্রিয়া ট্রামে পা রাখতেই তার মনে হল, এই সকালটা তার নিজেরও অজানা কোনো অভ্যেসের শুরু হয়ে গেছে। ভেতরের কাঠের সিটগুলো এখনও ফাঁকা, ছাতার ডগা থেকে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ার শব্দ মিলিয়ে গেছে, আর বৈদ্যুতিক তারের ঝনঝনানি আজও এক অচেনা সুর তুলছে।
প্রিয়া চুপচাপ আগের সিটটাতেই গিয়ে বসে, মনে এক অদ্ভুত প্রত্যাশা নিয়ে। চোখ ঘুরিয়ে সামনে তাকাতেই পরিচিত দৃশ্য—সেই যুবক, একই সিটে বসে আছে। সৌমিকের মুখে আগের মতোই শান্ত একাগ্রতা, হাতে সেই নোটবুক, যেটির ছেঁড়া মলাট যেন তার নীরব গল্প বলে। তবে আজ একটি পার্থক্য চোখে পড়ে। নোটবুকের পাতা খানিকটা খোলা, আর সেখানে অক্ষরগুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। প্রিয়া প্রথমে তাকাতে সংকোচ বোধ করলেও কৌতূহল তাকে আটকে রাখতে পারে না। পাতার উপরের দিকে ছড়িয়ে আছে কিছু কবিতার লাইন—
“রোদ্দুরের নীল আকাশে মেঘের ভাঁজে জমে থাকা গল্প,
অচেনা চোখে খুঁজে ফিরি নীরবতার মর্ম।”
এই অল্প কয়েকটি লাইনেই শহরের সকাল, অপেক্ষা, আর অজানা আবেগের নিখুঁত প্রতিফলন যেন ফুটে উঠেছে। প্রিয়ার বুকের ভেতর হালকা একটা আলোড়ন জাগে। সে বুঝতে পারে, এই লাইনগুলো কেবল কাগজের লেখা নয়, বরং সেই নীরব অনুভূতি যা প্রথম রবিবারের চোখাচোখির পর থেকে তাদের দুজনের মাঝেই নিঃশব্দে বেড়ে উঠছে।
সৌমিক হয়তো প্রিয়ার দৃষ্টি টের পায়, কারণ হঠাৎ সে মাথা তুলে তাকায়। দুজনের চোখের মিলন হয় আবার, এবার আগের চেয়ে গভীরতর। সেই দৃষ্টির ভেতর নেই কোনো অস্বস্তি, নেই কোনো অচেনা দূরত্ব; বরং যেন এক অদ্ভুত পরিচিতির উষ্ণতা। প্রিয়া দ্রুত চোখ সরিয়ে নেয়, কিন্তু ঠোঁটের কোণে অজান্তেই ফুটে ওঠে একটি হালকা হাসি। সৌমিকও মৃদু হাসে, যেন নীরব সম্মতির সাড়া দিচ্ছে। এই ছোট্ট হাসিটাই যেন তাদের দুজনের মাঝের অদৃশ্য সেতুর প্রথম ইট, যেখানে পরিচয়ের প্রয়োজন নেই, নামের দরকার নেই। ট্রামের ধাতব চাকা এসময় ধীরে ধীরে গড়াতে থাকে, কলেজ স্ট্রিটের বইয়ের দোকান, কফিহাউসের মোড়, গঙ্গার হাওয়ার ছোঁয়া—সবকিছু যেন তাদের নীরব সংলাপের সাক্ষী হয়ে ওঠে। শব্দহীন এই রবিবারের যাত্রা আজও কোনো নতুন কথোপকথন আনে না, কিন্তু সেই নীরব হাসির ভেতর লুকিয়ে থাকে এক গভীর প্রতিশ্রুতি—আগামী রবিবারও তারা এই ট্রামে ফিরবে, অচেনা অথচ ক্রমশ পরিচিত হয়ে ওঠা এই নীরব জগতের টানে।
তিন
তৃতীয় রবিবারের সকালটা যেন আগের দুই রবিবারের নীরব অপেক্ষাকে আরও ঘন করে তুলল। কলকাতার আকাশে সেদিন হালকা রোদ মিশে ছিল ধূসর মেঘের ছায়ায়, যেন শহরও জানে আজকের যাত্রা কেবল গন্তব্য নয়, এক ধীর আবিষ্কার। চৌরঙ্গির মোড়ে দাঁড়িয়ে প্রিয়া যখন ট্রামের জন্য অপেক্ষা করছিল, তখন বাতাসে বইছিল একরকম মিষ্টি শীতলতা, রাস্তার ধুলো কম, চারপাশে অলসতার আবহ। পুরনো নীল ট্রামটি দূর থেকে দেখা মাত্রই প্রিয়ার মনে এক অদ্ভুত স্রোত বয়ে গেল—যেন সে নিশ্চিত ছিল, এই রবিবারও কিছু অনুচ্চারিত শব্দ তাকে ছুঁয়ে যাবে। ট্রামে পা রাখতেই পুরোনো কাঠের মেঝের কড়িকাঠের শব্দ তাকে আগের রবিবারগুলির স্মৃতি মনে করিয়ে দিল। সে নিঃশব্দে নিজের সিটে বসে, জানলার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ভোরের আলোয় শহরের চেহারায় এক অচেনা কবিতার রেখা খুঁজে নিতে থাকে। আজ ট্রামের ভেতর যাত্রী কম, আরাম করে বসে পড়া যায়, আর সেই নীরবতার ভেতর দিয়ে শোনা যায় বৈদ্যুতিক তারের টানটান সুর ও চাকার ঘষাটানা ছন্দ।
সামনের সিটে আজও সৌমিক উপস্থিত। তার মুখে একাগ্রতার ছাপ, কিন্তু চোখে এক ঝলক অস্থিরতা, যেন সে কিছু লুকিয়ে রাখতে চেয়েও পারছে না। আজ নোটবুকটা খোলা অবস্থায় তার হাঁটুর ওপর রাখা। পাতার কিনারায় বাতাস লাগতেই হালকা দুলে ওঠে, আর হঠাৎ এক মুহূর্তে বাতাসের ঝাপটা এসে পাতাটা উল্টে দেয়। প্রিয়া অপ্রস্তুত হয়ে তাকিয়ে থাকে, আর সেই উল্টে যাওয়া পাতার ওপর হঠাৎ তার চোখে ধরা দেয় একটি লাইন—
“অচেনা পথের জানলায় যে চোখ দুটো থেমে যায়।”
লাইনটা যেন সরাসরি প্রিয়ার অন্তরের ভেতর গিয়ে বাজে। সে বুঝতে পারে না এই কবিতা সৌমিক নিজের মনের জন্য লিখেছে নাকি অদৃশ্যভাবে তার জন্য। নোটবুকের শব্দগুলোর মধ্যে যে গভীর সংবেদন লুকিয়ে আছে তা প্রিয়ার নিঃশ্বাসকে থমকে দেয়। তার ঠোঁটে অজান্তেই এক মৃদু হাসি ফুটে ওঠে—একটি হাসি যেখানে রয়েছে বিস্ময়, আনন্দ, আর অজানা উত্তেজনা। সৌমিক প্রিয়ার এই মৃদু প্রতিক্রিয়া চোখ এড়ায় না। সে একবার তাকিয়ে নিঃশব্দে হালকা মাথা নোয়ায়, যেন স্বীকার করছে যে শব্দের ভেতর লুকোনো বার্তাটি প্রিয়া পড়তে পেরেছে। কিন্তু সে কিছু বলে না, কোনো প্রশ্ন করে না, শুধু চোখে এক ঝলক কোমলতা রেখে আবার দৃষ্টি নামিয়ে নেয় নোটবুকে।
ট্রামের ধাতব শব্দ এসময় আরও স্পষ্ট শোনায়, যেন শহরের প্রতিটি মোড় এই নীরব সংলাপের সাক্ষী। প্রিয়া জানলার দিকে তাকিয়ে দেখতে থাকে কলেজ স্ট্রিটের পুরনো বইয়ের দোকান, শ্যামবাজারের গলি, আর দূরে ভেসে থাকা গঙ্গার আভা। এই মুহূর্তে সে বুঝতে পারে, কবিতার ভাষাই তাদের একমাত্র যোগাযোগ। কোনো পরিচয় নয়, কোনো নাম নয়, শুধু শব্দের মাধ্যমে গড়ে ওঠা এক অদৃশ্য সেতু। নোটবুকের পাতায় লেখা লাইনগুলো যেন ধীরে ধীরে তাদের দুজনের হৃদয়ের গভীরে এক অভ্যন্তরীণ কথোপকথনের জন্ম দিচ্ছে। প্রিয়া অনুভব করে, এই ট্রামযাত্রা এখন কেবল এক রবিবারের সময় কাটানো নয়; এটি হয়ে উঠছে এক ধীর প্রেমের অঙ্কুরোদ্গম, যেখানে শব্দের নীরবতা ও চোখের দৃষ্টিই যথেষ্ট। সৌমিকও বোঝে, তাদের মধ্যে তৈরি হওয়া এই নিঃশব্দ কবিতা কোনো একদিন হয়তো নতুন ভাষা খুঁজে পাবে, কিন্তু এই মুহূর্তে নীরবতাই সবচেয়ে প্রগাঢ় কবিতা। ট্রাম গড়িয়ে চলতে থাকে, কলকাতার রোদ্দুর কাঁচের জানলা ভেদ করে ভেতরে এসে মিশে যায় সেই অনুচ্চারিত অনুভূতিতে, আর প্রিয়া অনুভব করে—কবিতার ভাষাই হয়তো অচেনা দুজনের সবচেয়ে আন্তরিক পরিচয়।
চার
চতুর্থ রবিবারের সকালটা যেন কলকাতার হৃদস্পন্দনে নতুন এক ছন্দ বয়ে আনে। আকাশে আজ মেঘের পর্দা পাতলা, তবু আলো ছড়িয়ে আছে নরম সোনালি আভায়। শহরের রাস্তাগুলো এখনও অর্ধেক ঘুমন্ত—চা-ওয়ালাদের হাঁক ধীরে ধীরে গড়ে তুলছে দিনের তাল, গলি থেকে আসছে পুরনো সিনেমার গান, আর ট্রামের বৈদ্যুতিক টানটান শব্দে শোনা যাচ্ছে অলস রবিবারের পরিচিত সুর। প্রিয়া হাঁটতে হাঁটতে চৌরঙ্গির প্ল্যাটফর্মে দাঁড়াল, হাতে আজ একটি ছোট ডায়েরি। তিনটি রবিবারের নীরব সংযোগ তার মনে এক অদ্ভুত আলোড়ন তুলেছে। প্রথম রবিবারের চোখাচোখি, দ্বিতীয় রবিবারের কবিতার লাইন, তৃতীয় রবিবারের সেই অচেনা পথের জানলা—সবকিছুর মধ্যে যেন এক অনুচ্চারিত প্রতিশ্রুতি জমে আছে। প্রিয়া জানে না ঠিক কী করতে চায়, কিন্তু ডায়েরির পাতায় লিখে আনা কয়েকটি লাইন তার ভেতরের অস্থিরতাকে যেন দমিয়ে রেখেছে। পুরনো নীল ট্রামটি দূর থেকে দেখা মাত্রই তার বুকের ভেতর অজানা উত্তেজনা খেলে যায়। আজ সে শুধু যাত্রী নয়, আজ সে নিজের হৃদয়ের প্রথম উত্তর দিতে এসেছে।
ট্রামের ভেতরের কাঠের সিটে বসে প্রিয়া চোখ ঘুরিয়ে খুঁজে নেয় সেই পরিচিত মুখটিকে। সৌমিক আজও আগের মতো সামনের সিটে বসে, হাতে নোটবুক। তার ভঙ্গিতে একধরনের শান্ত একাগ্রতা, কিন্তু চোখে লুকানো এক হালকা কৌতূহল, যেন সে জানে আজ কিছু আলাদা ঘটতে চলেছে। প্রিয়া বুকের ভেতরের কাঁপন সামলে ছোট ডায়েরির পাতাটা আলতো করে ছিঁড়ে নেয়। পাতায় লেখা—
“রবিবারের সকাল মানেই এক অদ্ভুত অপেক্ষা।”
শব্দগুলোকে সে গুছিয়ে লিখেছে, কিন্তু ভেতরের অনুভূতিগুলো যেন অগোছালোই রয়ে গেছে। ট্রাম গড়িয়ে চলার সাথে সাথে প্রিয়া এক নিঃশব্দ মুহূর্তের অপেক্ষা করে, যখন সৌমিকের দৃষ্টি অন্যদিকে থাকবে। ঠিক সেই সময়, একটি হালকা মোড়ে ট্রাম যখন খানিকটা দুলে ওঠে, প্রিয়া দ্রুত উঠে সৌমিকের নোটবুকের পাতার ভেতর কাগজটি গুঁজে দেয়। তার হাত কাঁপছিল, কিন্তু সে চেষ্টা করে যেন সবকিছু স্বাভাবিক মনে হয়। কাজটা শেষ হতেই সে আবার নিজের সিটে ফিরে আসে, চোখ জানলার বাইরের দিকে স্থির করে। কলকাতার পুরনো রাস্তার ধূসর দেয়াল, শ্যামবাজারের গলি, কফিহাউসের ছায়া—সব মিলিয়ে তার বুকের ভেতরের ধুকপুকানি যেন আরও জোরে বাজতে থাকে।
সৌমিক প্রথমে কিছু বুঝতে পারে না। কয়েক মুহূর্ত পরে নোটবুকের পাতার ভেতর ঢুকে থাকা কাগজের কোণ দেখে সে থমকে যায়। সে আলতো করে কাগজটি বের করে আনে, আর পড়তে শুরু করে। শব্দগুলো চোখে পড়তেই তার ঠোঁটে এক নিঃশব্দ হাসি খেলে যায়—একটা হাসি যেখানে স্বীকৃতি আছে, বিস্ময় আছে, আর এক নতুন সূচনার উচ্ছ্বাস আছে। সে চোখ তুলে প্রিয়ার দিকে তাকায়। প্রিয়া জানলার দিকে মুখ ফিরিয়ে রেখেছে, কিন্তু তার গালের লালচে আভা আর হালকা হাসি সব প্রকাশ করে দেয়। কোনো কথা উচ্চারিত হয় না, তবু সেই মুহূর্তে দুজনের মাঝে এক অদ্ভুত উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়ে। যেন কাগজের কয়েকটি শব্দই যথেষ্ট ছিল সমস্ত পরিচয়, সম্ভাষণ ও জিজ্ঞাসাকে অপ্রয়োজনীয় করে দিতে। ট্রামের ধীর লয়ে বাজতে থাকা ধাতব সুর, জানলার বাইরের আলোছায়ার খেলা, আর দুজনের নীরব উপস্থিতি মিলে এই চতুর্থ রবিবারকে এক নতুন সংযোগের দিন করে তোলে। এখন থেকে তাদের রবিবারের ট্রামযাত্রা শুধু চোখের ভাষায় সীমাবদ্ধ নয়, লিখিত শব্দের মাধ্যমে শুরু হয়েছে এক নতুন কথোপকথন—যেখানে নীরবতা আর অক্ষর মিলেমিশে সৃষ্টি করছে এক নিঃশব্দ প্রেমকাব্য।
পাঁচ
প্রথম রবিবারের অচেনা হাসি আর পরের কয়েকটি রবিবারের নীরব বিনিময় যেন ধীরে ধীরে এক অদৃশ্য বন্ধনে জড়িয়ে ফেলেছে সৌমিক আর প্রিয়াকে। পঞ্চম রবিবারে শহর কলকাতা নিজের বিশেষ এক রূপে তাদের সামনে উপস্থিত হল—ট্রামের নরম গতি, ঝকঝকে লোহার ট্র্যাক, শ্যামবাজার থেকে কলেজ স্ট্রিটের পুরোনো গলি পার হওয়ার মৃদু শব্দ। সকালটা ছিল একেবারেই অন্যরকম। আকাশে হালকা মেঘের ভেলা, বাতাসে একরকম তাজা শীতলতা। সৌমিক ট্রামের জানালার ধারে বসে দেখছিল বাইরের শহরটা কীভাবে ধীরে ধীরে খুলে দিচ্ছে নিজের গল্প। ট্রামের গায়ে আঁকা পুরোনো বিজ্ঞাপনগুলো, রাস্তার দু’ধারে শীতের বইমেলার পোস্টার, আর কফিহাউসের ভেতর থেকে ভেসে আসা কফির গন্ধ—সবকিছু যেন অতীত আর বর্তমানকে এক সুতোয় গেঁথে ফেলেছে। প্রিয়া চুপচাপ সৌমিকের সামনের সিটে বসে নিজের ছোট্ট ডায়েরিটা কোলে নিয়ে খেলছিল, মাঝে মাঝে জানালার বাইরে তাকাচ্ছিল। দুজনের চোখ একবারও মুখোমুখি হয়নি, তবু যেন এক অদ্ভুত স্রোত ধীরে ধীরে তাদের সংযোগের রেখা আঁকছিল। এই শহর, এই ট্রাম, এই ধীরগতি যেন তাদের সম্পর্কেরও নিঃশব্দ সাক্ষী হয়ে উঠল—কোনো তাড়াহুড়ো নেই, শুধু ধীরে ধীরে কাছে আসার মৃদু সঙ্গীত।
শ্যামবাজার পার হতেই রাস্তার পাশের বইয়ের দোকানগুলো ধীরে ধীরে চোখে পড়তে শুরু করল। কলেজ স্ট্রিটের চেনা গন্ধ, পুরোনো বইয়ের মলাট থেকে ভেসে আসা ধুলোর মিষ্টি গন্ধ, আর অজস্র অক্ষরের ভিড় যেন এই গল্পের প্রেক্ষাপটকে আরও ঘন করে তুলল। সৌমিকের চোখে পড়ে গেল এক কোণে ছোট্ট চায়ের দোকান, যেখানে কিছু ছাত্র রাজনীতির গরম আলোচনা চালাচ্ছে। কলকাতার ট্রাম যেন শুধু এক যানবাহন নয়, সময়ের এক চলমান আর্কাইভ—প্রতিটি মোড়েই লুকিয়ে আছে গল্প, স্মৃতি, আর নীরব প্রেমের ছায়া। ঠিক এই সময় সৌমিক নিজের নোটবুক খুলে প্রিয়ার আগের রবিবারের লাইনগুলির জবাব লিখতে শুরু করল। কলমের খসখস শব্দ যেন তাদের নীরবতার মধ্যে একমাত্র সুর হয়ে উঠল। সে লিখল—“রবিবারের সকাল মানেই তোমার সেই অদ্ভুত অপেক্ষাকে খুঁজে পাওয়া। ট্রামের ধীর গতি যেন সেই অপেক্ষাকেই দীর্ঘ করে, তবু এই ধীরতাই ভালো লাগে।” প্রিয়া শব্দ না করেই সৌমিকের দিকে তাকাল, তার চোখে মৃদু বিস্ময়। সে নিজের ডায়েরি খুলে কয়েকটি শব্দ লিখে একটি পাতাকে অর্ধেক ভাঁজ করে সৌমিকের নোটের ওপর রাখল। ট্রামের হালকা দুলুনি, চাকার ঘর্ষণের শব্দ আর বাইরের জনারণ্য মিলেমিশে এই নিঃশব্দ কথোপকথনকে এক বিশেষ মাত্রা দিল। তাদের মধ্যে কোনো উচ্চারিত বাক্য নেই, তবু লেখা যেন তাদের হৃদয়ের একমাত্র ভাষা হয়ে উঠল—একটি ভাষা যা নীরবতাকেও গভীর করে তোলে।
ট্রাম যখন কলেজ স্ট্রিটের মোড়ে এসে থামল, সূর্য তখন আরও উজ্জ্বল। প্রিয়া জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখল বইয়ের দোকানের সামনে ভিড় জমেছে, নতুন বইয়ের পাতা ওলটানোর শব্দ বাতাসে মিশে আছে। তার মনে হল, এই শহরটাই যেন তাদের নীরব লেখালেখির মঞ্চ, যেখানে প্রতিটি অক্ষর, প্রতিটি দৃষ্টি এক অদ্ভুত কবিতার জন্ম দিচ্ছে। সৌমিক ধীরে ধীরে প্রিয়ার দিকে তাকাল, দুজনের চোখ মুহূর্তের জন্য মিলিত হল, কিন্তু কোনো কথা এল না। সেই ছোট্ট নীরব মুহূর্তেই যেন বহু কথার জন্ম হল, যা লিখিত শব্দেও ধরা যায় না। ট্রাম আবার ধীরে ধীরে চলতে শুরু করল—কফিহাউসের পাশ দিয়ে, বইয়ের দোকানগুলোর সারি পেরিয়ে। সৌমিক নিজের মনে ভাবল, এই শহর, এই ট্রামের ধীর ছন্দই হয়তো তাদের গল্পের প্রকৃত গতি; এমন এক গতি যা সময়কে থামিয়ে দেয়, অপেক্ষাকে দীর্ঘ করে, অথচ দুই হৃদয়কে অদৃশ্যভাবে একসঙ্গে বেঁধে রাখে। প্রিয়া নীরবে নিজের ডায়েরি বন্ধ করল, ঠোঁটের কোণে এক অচেনা হাসি খেলল। ট্রামের জানালা দিয়ে ঢুকে আসা শীতল বাতাসের সঙ্গে মিশে গেল সেই নীরবতার উষ্ণতা—যেন কলকাতা শহর নিজেই তাদের অপ্রকাশিত অনুভূতিকে নিজের কোলে আগলে রাখল।
ছয়
ষষ্ঠ রবিবারের সকালটা যেন আলাদা এক আবহ নিয়ে এল। ভোর থেকেই আকাশে মেঘের জমাট ভিড়, রোদ যেন ইচ্ছে করেই লুকিয়ে আছে। শহরের অলিগলিতে রাতের বৃষ্টির গন্ধ ছড়িয়ে আছে, আর গাছের পাতায় ঝুলে থাকা জলকণাগুলো সকালের আলোয় হালকা ঝিলিক দিচ্ছে। সৌমিক আগের মতোই ট্রামের শেষ সিটের পাশে জানালার ধারে বসেছে, হাতে নোটবুক। প্রিয়া আজ একটু দেরি করে উঠল ট্রামে, তবু সৌমিকের দিকে তাকাতেই তার চোখে সেই চেনা নিশ্চুপ স্বীকৃতি। বাইরে বৃষ্টি থেমে থেমে পড়ছে, রাস্তায় জমে থাকা জল আর ভেজা পিচের ওপর ট্রামের লোহার চাকা টুং টাং শব্দ তুলছে। প্রিয়া জানালার কাঁচ সরিয়ে ধীরে হাত বাড়িয়ে দিল। ঠান্ডা বাতাসের সঙ্গে বৃষ্টির ফোঁটার মিষ্টি স্পর্শ তাকে এক অদ্ভুত শিহরণ দিল। তার হাতের আঙুলে জমা হল কিছু কণামাত্র জল, যেন শহরের সমস্ত নীরবতা আর আনন্দ সেই ছোট্ট ফোঁটাগুলোর মধ্যে জমে আছে। সৌমিক একচোখে তাকিয়ে সেই মুহূর্তকে মনে মনে ধরে রাখল, কিন্তু মুখে কোনো শব্দ এল না। সে শুধু নিজের নোটবুকের সাদা পাতায় লিখল—“নীরবতাও কখনও শব্দ হয়ে বেজে ওঠে।” এই একটি লাইন যেন তার সমস্ত অনুভূতিকে ধারণ করে নিল, যা সে মুখে বলতে পারছিল না।
প্রিয়া সেই লেখা পড়তেই মৃদু মাথা নাড়ল, ঠোঁটের কোণে এক চেনা হাসি খেলে গেল। সেই হাসি ছিল না স্রেফ আনন্দের, ছিল একরকম স্বীকৃতির আলো। যেন তারা দুজনেই বুঝতে পারছে, কথার বাইরে যে নীরবতা আছে, সেই নীরবতারও একটা সঙ্গীত আছে, যা শুধুমাত্র অনুভব করা যায়। ট্রামের গায়ে বৃষ্টির ফোঁটা টুপটাপ শব্দ তুলছিল, যেন শহর নিজেই তাদের গল্পের সঙ্গীত তৈরি করছে। কলেজ স্ট্রিটের পুরোনো গলি পেরোতে পেরোতে সৌমিকের মনে হল, এই নীরব সম্পর্কটাও ঠিক এই শহরের মতো—কখনও তাড়াহুড়ো নেই, আবার কখনও অদৃশ্য এক ছন্দে এগিয়ে চলা। প্রিয়া জানালার ধারে হেলান দিয়ে বাইরের ভিজে রাস্তাগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল। মাঝে মাঝে তার চোখ সৌমিকের নোটবুকের দিকে চলে যাচ্ছিল, যেন সেই এক লাইনের ভেতরে লুকিয়ে থাকা অজস্র অনুভূতি পড়তে চাইছে। কিন্তু কেউই কারও নাম জানতে চাইল না, কোনো প্রশ্ন করল না। নামহীন এই বন্ধন যেন তাদের আরও কাছাকাছি টেনে আনছিল—নাম না থাকায় সম্পর্কের সমস্ত সীমাবদ্ধতাও যেন মিলিয়ে যাচ্ছিল।
ট্রাম ধীরে ধীরে ময়দান পেরোতে পেরোতে শহরের বৃষ্টিস্নাত দৃশ্য তাদের দুজনকেই অন্যরকম করে তুলল। প্রিয়া অনুভব করল, তার মনের অজানা এক জানালা যেন খুলে যাচ্ছে—যে জানালা এতদিন বন্ধ ছিল, যেখানে কারও প্রবেশাধিকার ছিল না। সেই জানালা দিয়ে ঢুকে আসছে নতুন বাতাস, নতুন আলো, নতুন এক বোঝাপড়া। সৌমিকও অনুভব করল, এই নীরব লেখা আর চোরাগোপ্তা হাসির মধ্যেই এমন এক পরিসর তৈরি হয়েছে, যেখানে শব্দের প্রয়োজন নেই। ট্রামের ভেতর অন্য যাত্রীরা নিজেদের কথাবার্তায় ব্যস্ত, কিন্তু প্রিয়া আর সৌমিকের জগৎ যেন সম্পূর্ণ আলাদা। বৃষ্টিভেজা বাতাসের সঙ্গে মিশে তাদের নিঃশব্দ উপস্থিতি হয়ে উঠল এক অদ্ভুত কবিতা—যেখানে প্রতিটি ফোঁটা, প্রতিটি দৃষ্টি, প্রতিটি নীরবতা শব্দের চেয়েও বেশি বলছে। ট্রাম যখন শেষ স্টপেজের দিকে এগোতে লাগল, প্রিয়া হাতের আঙুল থেকে গড়িয়ে পড়া শেষ ফোঁটাটাকে দেখে নরম স্বরে হেসে উঠল। সেই হাসিতে ছিল মনের জানালা খোলার আনন্দ, আর এক অজানা প্রত্যাশা যে পরের রবিবারও এই নীরবতার গল্প চলতেই থাকবে।
সাত
সপ্তম রবিবার। ট্রামের ধীর গতিতে চলা চাকচিক্যপূর্ণ রেলপথের আওয়াজ আজ যেন সৌমিকের কানেই অনুরণন করছে না। প্রতিটি বাঁক, প্রতিটি সিগন্যালের শব্দ যেন তাকে আরও গভীর নিস্তব্ধতার দিকে টেনে নিচ্ছে। প্রিয়ার খালি আসন, যার পাশে সে সাত সপ্তাহ ধরে নিজের জগৎ খুঁজে পেত, আজ শূন্য এবং নিস্তব। সূর্য তার স্বাভাবিক উষ্ণতা হারিয়ে ফেলেছে মনে হয়, এবং ট্রামের জানালা দিয়ে ছড়িয়ে পড়া আলোও যেন অস্থির। সৌমিক তার নোটবুকটি খুলে বসে, হাতের কলম ঝাপসা হয়ে আছে; কাগজে লিখতে চায়, কিন্তু শব্দগুলো ঘরে ঢোকার মতোই অচেনা। তার চোখ বারবার সেই খালি আসনের দিকে ফিরে যায়, যেখানে প্রিয়ার হাসি, কথা, ছায়াময় দৃষ্টি—সব মিলিয়ে যেন নিঃশেষ হয়ে গেছে। আশেপাশের যাত্রীরা ব্যস্ত, তাদের কথাবার্তায় হাসি-মজা, কিন্তু সৌমিকের মন অন্য জগতে। সে ভাবছে, প্রিয়া না আসার এই অজানা কারণটি কি তার কাছে কোনো সংকেত বহন করছে? নাকি শুধু সৌম্যের অভ্যস্ত দিনের একটি অল্প দৈর্ঘ্যের শূন্যতা? ট্রামের প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি কম্পন যেন তার হৃদয়ে অনুরণন করছে—একটি নীরব প্রশ্ন, একটি চুপচাপ প্রত্যাশা, যা সে শব্দে প্রকাশ করতে পারছে না।
নোটবুকের খাতায় লেখা লাইনগুলো আজ যেন নিজের মধ্যে খুন হয়ে গেছে। তার কলমের নরম ছোঁয়ায়ও কাগজে শব্দ জমছে না। তার হাতের নিচে রেখা, লেখা, ভ্রান্তি—সব মিলিয়ে এক ধরণের নিঃশব্দ কাব্য সৃষ্টি করছে। সে প্রতিবার প্রিয়ার হাসি মনে করার চেষ্টা করছে, সেই ছোট ছোট অভিব্যক্তি, চোখের কোণে খুনসুটি, এবং ট্রামের জানালায় ছায়া ফেলার সেই অদ্ভুত খেলায় মন যেন আটকে যাচ্ছে। কিন্তু সব স্মৃতি মিলিয়ে এখন যেন শূন্যতায় মিলেমিশে গেছে। সৌমিক মনে মনে নিজেকে প্রশ্ন করছে, এই শূন্যতা কি শুধু প্রিয়ার অনুপস্থিতি, নাকি তার নিজের মধ্যে নিহিত এক ধরনের অভাবের আভাস? ট্রামের কাতর শব্দের সঙ্গে তার নিঃশব্দ মননের মেলবন্ধন যেন এক অনাবিষ্কৃত ছন্দ তৈরি করছে, যা শুধু তার নিজের জন্যই গোপন। সে লক্ষ্য করে, জানালার বাইরে নদীর ধীর গতিতে চলা জলও আজ যেন তার ধ্যানের সঙ্গে সমান্তরাল, প্রতিটি ঢেউ যেন তার ভেতরের উত্তেজনা আর নীরবতার এক প্রতিফলন।
সন্ধ্যার দিকে, ট্রামের ধীর গতির সঙ্গে সঙ্গে সৌমিকের মনেও এক ধরনের অস্বাভাবিক শান্তি নেমে আসে। যদিও প্রিয়া অনুপস্থিত, তার শূন্য আসন তাকে এক ধরনের একাকীত্বের সঙ্গে পরিচয় করায়, যা আগে কখনো অনুভব হয়নি। সে লিখতে শুরু করে, কাগজে শব্দগুলো যেন ধীরে ধীরে জেগে ওঠে—প্রিয়ার অনুপস্থিতি, নিজের একা থাকা, আর এই ধীর রূপকথার মতো রবিবারের ট্রাম যাত্রার সব অনুভূতি। আশেপাশের মানুষগুলোকে সে আর চোখে রাখে না, তাদের কথাবার্তার শব্দগুলো তার কাছে দূরের একটি ধূসর সিম্ফনি মনে হচ্ছে। কিন্তু এই শূন্যতা, এই নিঃশব্দ প্রত্যাশা, সৌমিককে এক নতুন গভীরতা শেখায়—মানুষের উপস্থিতি ছাড়া, অনুভূতি কিভাবে নিজের ভিতর থেকে বিকশিত হতে পারে। রাত নামার সঙ্গে সঙ্গে ট্রাম ধীরে ধীরে শেষ স্টেশনে পৌঁছায়, কিন্তু সৌমিকের মনের ট্রাম এখনও চলমান। প্রিয়ার অনুপস্থিতি, এই শূন্য আসন, এবং নীরব ট্রামের প্রতিটি কম্পন—সব মিলিয়ে তার মনে এক ধরনের স্থায়ী ছাপ ফেলে, যা শুধু রবিবারের জন্য নয়, বরং জীবনের দীর্ঘ যাত্রায় তার সঙ্গে চলবে।
আট
অষ্টম রবিবার। ট্রামের দরজা খুলতেই প্রিয়ার ছায়া ধীরে ধীরে সৌমিকের দিকে এগিয়ে আসে। আজ তার উপস্থিতি শুধুই স্বাভাবিক আনন্দের নয়, বরং চোখ-মুখে অজানা কষ্টের ছাপ তার প্রতিটি অঙ্গভঙ্গিতে স্পষ্ট। সৌমিক খালি চোখে তা লক্ষ্য করলেও, নিজের নোটবুকে হাত গরম রাখে, যেন কথাগুলো লিখে তা আরও সত্যিকারের হয়ে উঠুক। সে কেবল একটি লাইন লিখে বসে—“ফিরে আসার গল্পই জীবনের সবচেয়ে সুন্দর অধ্যায়।” এই লাইনটি কেবল শব্দ নয়, বরং তার মনস্তাত্ত্বিক অনুভূতির সঙ্গেও মিশে যায়। প্রিয়া তার নীরব উপস্থিতি নিয়ে আসন গ্রহণ করে, কিন্তু চোখে সেই অদ্ভুত দুঃখ, যা বোঝার চেষ্টায় সৌমিকের মন উড়ে বেড়ায়। ট্রামের চমকপ্রদ ধীর চাকার আওয়াজ আজ যেন আরও কোমল, আরও মৃদু, যেন সমস্ত শহরের শব্দগুলো তাদের চারপাশে মৃদু সুরের মতো মিশে গেছে। সৌমিকের কলম আজ যেন তার নিজের অনুভূতির অনুবাদ, প্রতিটি শব্দের সঙ্গে প্রিয়ার নীরবতা এক অদ্ভুত সমন্বয় সৃষ্টি করছে।
নোটবুকের পাতায় লেখা সেই লাইনটি প্রিয়া চোখে পড়ে, এবং তার চোখের আর্দ্রতা সৌমিকের দিকে নীরবভাবে আভাস দেয়। সে কোনো প্রশ্ন করে না, কোনো ব্যাখ্যা দেয় না, শুধু লাইনটি মৃদু ছোঁয়ায় অনুভব করে। তার ঠোঁটে একটুখানি হাসি ফোটে, যা অল্প হলেও সমস্ত দুঃখকে অর্ধেক ম্লান করে দেয়। ট্রামের জানালার বাইরে ধীরে ধীরে দুপুরের আলো ছড়িয়ে পড়ছে, কিন্তু সৌমিক এবং প্রিয়ার এই ক্ষণিকের মিলন যেন সময়ের গতিকেও থামিয়ে দিয়েছে। শহরের আঙিনায় মানুষজন ব্যস্ত, কিন্তু তাদের আওয়াজ যেন এক অদৃশ্য পর্দার মধ্যে ধোঁয়া হয়ে মিলেমিশে গেছে। সৌমিক লক্ষ্য করে, প্রিয়ার চোখের গভীরে সেই গল্পের ছায়া—যা অনুপস্থিতির দিনগুলোতে তার অভ্যন্তরীণ শূন্যতাকে আরও প্রকট করেছিল—এবার নীরবভাবে তার সঙ্গে সংযুক্ত হচ্ছে। ট্রামের প্রতিটি কম্পন, জানালার রোদ, এবং নোটবুকের প্রতিটি লাইন মিলেমিশে এক ধরণের শান্তি এবং পুনরায় সংযোগের অনুভূতি জাগায়।
সন্ধ্যার দিকে, ট্রাম চলতে থাকে, কিন্তু সৌমিকের মন আজ ভিন্ন। প্রিয়ার উপস্থিতি, তার নীরব হাসি, এবং চোখে অজানা কষ্টের ছাপ—সব মিলিয়ে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা। তিনি নীরবে নোটবুকের পাতা ছুঁয়ে রাখে, যেন সেই শব্দগুলো তার মনের অনুভূতিকে বহন করতে পারে। সৌমিক নিজেও কোনো কথা বলে না, শুধু কলমের নরম ছোঁয়ায় অনুভূতির গতি ধরে রাখে। বাইরে নদীর জল কিঞ্চিৎ ঝলমলে, কিন্তু তার প্রতিফলন প্রিয়ার চোখের আর্দ্রতার সঙ্গে মিলেমিশে এক অদ্ভুত জ্যোতি সৃষ্টি করছে। ট্রামের আসন, জানালা, ধীর চাকার শব্দ—সব কিছু মিলিয়ে একটি শান্ত, নীরব, এবং পুনর্জীবনের অনুভূতি তৈরি করছে। প্রিয়ার ফিরে আসা শুধুই শারীরিক উপস্থিতি নয়; এটি সৌমিকের মনকে একটি নতুন সমাধান, নতুন আবিষ্কার, এবং গভীর সংযোগের উপলব্ধিতে নিয়ে যাচ্ছে। রবিবারের এই ট্রাম যাত্রা কেবল একটি যাত্রা নয়, বরং জীবনের সেই মুহূর্তের প্রতিফলন যেখানে অনুপস্থিতি শেষ হয় এবং ফিরে আসার গল্প জীবনের সবচেয়ে সুন্দর অধ্যায়ে পরিণত হয়।
নয়
নবম রবিবার। ট্রামের ধীর গতির আওয়াজ আজ যেন আরও মধুর, আরও চিন্তাশীল। সৌমিক এবং প্রিয়ার নোটবুকগুলো ভরা—কবিতা, অনুভূতি, ছোট গল্প, হেসে-খেলে লেখা অদ্ভুত ছোটখাটো লাইন, যেগুলো কোনো শব্দের সীমার মধ্যে আটকে নেই। কিন্তু তবুও, প্রতিটি পাতায় নেই নাম, নেই পরিচয়, যেন এই রবিবারের যাত্রাগুলো কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তির জন্য নয়, বরং তাদের অভ্যন্তরীণ জগৎ, অনুভূতি, এবং একে অপরের নীরব সংযোগের জন্য লেখা হয়েছে। ট্রামের জানালা দিয়ে বাইরে দেখা শহরের আলো, কফির দোকানের দূরের আলো, এবং রাস্তার চুপচাপ অচেনা মানুষের ভিড়—সব কিছু মিলেমিশে একটি নীরব, রহস্যময় অনুভূতি তৈরি করছে। সৌমিক লক্ষ্য করে, প্রিয়ার চোখের আভাসে সেই অজানা প্রেম ও সংযোগের ছাপ রয়েছে, যা কোনো শব্দে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। তারা জানে, এই রবিবারগুলো সীমাহীন নয়; একদিন এই ট্রাম যাত্রা থেমে যাবে, কিন্তু সেই থেমে যাওয়ার সম্ভাবনা আজকে তাদের মনকে অতিরিক্ত সংবেদনশীল করে তুলেছে।
নোটবুকের পাতায় প্রতিটি লাইন যেন তাদের অজানা আবেগ, একাকিত্বের মিলন, এবং একটি নিঃশব্দ বন্ধনের গল্প বলছে। কখনও তারা হাসে, কখনও চুপচাপ চোখ মেলে ভাবতে থাকে। কোনো প্রশ্ন করা হয় না, কোনো ব্যাখ্যা চাওয়া হয় না; সমস্ত অনুভূতি শুধু কলমের ছোঁয়ায়, কাগজে ঝরে পড়ে। প্রিয়ার হালকা হাসি, সৌমিকের নীরব দৃষ্টিতে প্রতিফলিত হয়, যেন তারা একে অপরের মনকে স্পর্শ করছে, নামের বা পরিচয়ের বাইরেও। ট্রামের ধীর চাকার আওয়াজ, জানালার বাইরে নেমে আসা সূর্যের সোনালি আলো, এবং শহরের ব্যস্ততা—সব মিলিয়ে একটি মৃদু, কিন্তু স্থির ছন্দ তৈরি করছে। তাদের একান্ত এই ক্ষণিকের সংযোগে রয়েছে এক ধরনের পরিপূর্ণতা, যা কোনো শব্দে বোঝানো সম্ভব নয়। নবম রবিবারের এই যাত্রা যেন তাদের আবিষ্কার করে দিয়েছে—যে সম্পর্ক কেবল সময় বা পরিচয় দ্বারা সীমাবদ্ধ নয়, বরং অনুভূতি, নীরবতা, এবং অভ্যন্তরীণ জগৎ দ্বারা গড়ে উঠতে পারে।
শেষের দিকে, তারা দুজনেই জানে যে একদিন এই রবিবারের যাত্রা থেমে যাবে। তবে কেউ মুখে বিদায়ের কথা তোলে না। প্রিয়ার চোখে অল্প হাসি, সৌমিকের নোটবুকের পাতায় নীরব কবিতা—সব মিলিয়ে একটি চুপচাপ বিদায়ের প্রস্তুতি তৈরি হচ্ছে। কিন্তু আজকের মুহূর্তে, এই অজানা পরিচয়হীন বন্ধন, এই নীরব সাহিত্য, এবং একে অপরের সাথে কাটানো সময়ের গভীরতা সবকিছুকে আরও মূল্যবান করে তুলেছে। ট্রামের প্রতিটি কম্পন, জানালার বাইরে ছায়াময় আলো, এবং নোটবুকের প্রতিটি শব্দ মিলেমিশে একটি নিরব, কিন্তু গভীর সমাপ্তি সংকেত দিচ্ছে—যে সম্পর্ক শেষের দিকে হলেও তার অনুভূতি চিরকাল টিকে থাকবে। রবিবারের এই যাত্রা শুধুই একটি ট্রাম যাত্রা নয়, বরং একটি অভ্যন্তরীণ যাত্রা—একটি আবিষ্কার, একটি সংযোগ, এবং শেষ পর্যন্ত একটি নিঃশব্দ বিদায়ের মহিমা, যা কোনো নাম বা পরিচয়ের অপেক্ষা করে না।
দশ
দশম রবিবার। সকাল থেকে ট্রামের চাকার ধীর শব্দে শহর যেন নীরব হয়ে গেছে। প্রিয়া জানলার দিকে তাকিয়ে নোটবুকের শেষ লাইন লিখে দেয়—“পরিচয় জানলে হয়তো এই জাদুটা ভেঙে যাবে।” সেই লাইন, যা কেবল কাগজের উপরে লেখা একটি শব্দের সমষ্টি নয়, বরং তাদের অচেনা বন্ধনের রহস্যময় অনুভূতির প্রতিফলন। সৌমিক নীরবে তাকিয়ে থাকে, চোখে মৃদু হাসি, মনে সেই অনবদ্য অনুভূতি—যা কেবল তাদের মধ্যে প্রবাহিত হচ্ছে, কোনো ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। ট্রামের জানালার বাইরে কলকাতার রোদ্দুর ধীরে ধীরে ভেসে ওঠে, শহরের রঙিন জীবনের ছায়া তাদের উপর পড়ছে, কিন্তু তারা যেন সেই দৃশ্যের বাইরে। প্রতিটি রেল, প্রতিটি বাঁক, প্রতিটি চাকার আওয়াজ তাদের মনের অদ্ভুত ছন্দের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে, যেন রবিবারের এই যাত্রা শুধু সময়ের মধ্যে আটকে নেই, বরং অনুভূতির গভীরে প্রবাহিত হচ্ছে। নোটবুকের পাতায় লেখা শব্দগুলো যেন এখন জীবন্ত হয়ে উঠেছে—নীরবতা, প্রত্যাশা, আনন্দ, এবং অচেনা সংযোগের জাদু একত্রে প্রবাহিত হচ্ছে।
সৌমিক মৃদু হাসি দিয়ে মাথা নেড়ে প্রতিফলন দেখায়, যেন প্রিয়ার লেখা লাইনটি তার মনকে এক অদ্ভুত প্রশান্তিতে ভরে দিয়েছে। তারা দুজন জানে, এই বন্ধন, এই অচেনাত্ব, একটি জাদুর মতো, যা পরিচয় বা নামের সীমাবদ্ধতায় ভেঙে যেতে পারে। ট্রামের ধীর গতি, জানালার রোদ, শহরের দূরের শব্দ—সব মিলিয়ে একটি সম্পূর্ণ অভিজ্ঞতা তৈরি করছে। তারা একে অপরের দিকে কথা না বলেও অনুভব করতে পারছে, কেবল দৃষ্টিতে, দৃষ্টিভঙ্গিতে, এবং নোটবুকের পাতায় ছুঁয়ে থাকা শব্দে। প্রিয়ার চোখের গভীরতা সৌমিকের মনকে স্পর্শ করছে, সৌমিকের নোটবুকের শব্দ প্রিয়ার মনের অনুভূতির প্রতিফলন দিচ্ছে। তাদের মধ্যে কোনো পরিচয় নেই, কোনো ব্যাখ্যা নেই, তবু তারা একে অপরকে পুরোপুরি বোঝে—একটি নিঃশব্দ, কিন্তু শক্তিশালী সমঝোতার মাধ্যমে। শহরের আলো এবং ট্রামের কম্পন মিলেমিশে তাদের মনের অচেনা বন্ধনকে আরও দৃঢ় করে তুলছে, যেন পুরো রবিবারটি এক নিরব জাদুর অভিজ্ঞতা।
ট্রাম ধীরে ধীরে এগোচ্ছে, কলকাতার রোদ জানালা ভরিয়ে দিচ্ছে, এবং তারা দুজন অচেনা থেকেই থেকে যাচ্ছে—কিন্তু সেই অচেনাত্বে রয়েছে পূর্ণতা। নোটবুকের প্রতিটি লাইন, প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি কবিতা, ছোট গল্প, অনুভূতি—সব মিলিয়ে তাদের মনের অদ্ভুত বন্ধনের প্রতিফলন ঘটাচ্ছে। কেউ কিছু বলেনি, কেউ কিছু চায়নি, তবু প্রতিটি মুহূর্তের মধ্যে পূর্ণতা বিরাজ করছে। ট্রামের চাকার ধীর আওয়াজ, জানালার বাইরে সূর্যের আলোকরশ্মি, শহরের দূরের শব্দ, এবং নোটবুকের পাতায় লেখা প্রতিটি শব্দ—সব মিলিয়ে এই রবিবারকে একটি জাদুময়, অচেনা কিন্তু সম্পূর্ণ অভিজ্ঞতায় পরিণত করছে। পরিচয়হীন, নামহীন এই সংযোগ তাদেরকে শেখাচ্ছে, কখনো কখনো অচেনাত্বই সবচেয়ে গভীর বন্ধনের সূত্র হতে পারে। এবং দশম রবিবারের এই ট্রাম যাত্রা কেবল সময়ের মধ্যে নয়, বরং অনুভূতির এক চিরন্তন যাত্রায় পরিণত হয়েছে, যেখানে তারা অচেনা থেকে পুরোপুরি পূর্ণতা অনুভব করছে।
***