সুদীপ্ত ঘোষাল
১
রবিবার সকালে কলকাতার বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের শেষ প্রান্তে ঘোষ ভিলার ছাদে সূর্যের আলোর ঝলকানি তখনও পুরোপুরি পড়েনি। শীতকালীন সকালের ধোঁয়াটে আলোয় ভরে উঠছিল গৃহপ্রাঙ্গণ, বাতাসে ভাসছিল মোরগের ডাক ও কাজের লোকেদের হাঁকডাক। ঘরের মধ্যে তখন সকালের চায়ের ট্রে নামিয়ে রাখছিল রাঁধুনি বিনোদিনী, যার হাতে কাঁপুনি ছিল অজানা এক উত্তেজনায়। রূপমবাবু বলেছিলেন আজ একটু আগেই চা দিতে, কারণ তাঁকে ব্যবসার কাজে বেরোতে হবে। সুমিত্রাদেবী নিজের প্রার্থনার ঘরে বসে ছিলেন চোখ বন্ধ করে, ঠাকুরঘরে ধূপের গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছিল। তীর্থবাবু বারান্দায় বসে খবরের কাগজ পড়ছিলেন, পাশেই কটাহারের চা নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল কাজের ছেলে মাধব। তবে বাড়ির বড় কর্তা বিজয়চন্দ্র ঘোষ ছিলেন অদৃশ্য, যেটা অস্বাভাবিক। এই বাড়িতে সকাল ৭টার মধ্যে বিজয়চন্দ্রবাবু উঠে পড়তেন, তার পর নিয়মমাফিক নিজের ঘরে এক কাপ গ্রিন টি, একটু রেডিওর খবর, এবং সঙ্গে সকালের পেপার নিয়ে বসতেন নিজস্ব ছন্দে। কিন্তু আজ তার ঘর থেকে কোনো শব্দ বেরোচ্ছে না, কোনো সাড়া নেই।
প্রথম সন্দেহ জাগে ৭টা ৪৫ মিনিট নাগাদ, যখন বিনোদিনী সাহস করে তার ঘরের দরজা ঠেলতে গিয়ে দেখে, ভেতর থেকে বন্ধ। বার বার ডাকাডাকির পরেও সাড়া না পেয়ে রূপমবাবুকে ডেকে আনা হয়। তিনি প্রথমে বিরক্ত হন, ভাবেন ঘুমিয়ে পড়েছেন হয়তো বাবা, কিন্তু দরজার তলায় চোখ রেখে দেখেন আলো জ্বলছে না—এটাও এক অস্বাভাবিকতা। শেষমেশ দরজা ভাঙা হয়। দরজা খুলতেই আবছা আলোয় দেখা যায়, বিজয়চন্দ্রবাবু পড়েছিলেন বিছানার পাশে, ঘাড়ের নিচে পাসপোর্টের মতো ভাঁজ করা কিছু কাগজ, চোখ স্থির, মুখে একরাশ বিস্ময় এবং আতঙ্কের ছাপ। আশ্চর্যজনকভাবে কোনো রক্ত নেই, কোথাও আঘাতের চিহ্ন নেই। ডাক্তার মেঘলা ছুটে আসেন, তিনি তখনও নীচতলার ঘরে ছিলেন। নাড়ি দেখে বলেন, মৃত্যু হয়েছে সম্ভবত এক ঘণ্টার বেশি আগেই—অর্থাৎ প্রায় সকাল ৬:৩০ নাগাদ। পুলিশের খবর দেওয়া হয়, যদিও পরিবারের প্রবীণ সদস্যদের অনুরোধে প্রাক্তন সিআইডি অফিসার সুশান্ত বসুকে ফোন করা হয়—যিনি বিজয়চন্দ্রবাবুর কলেজ জীবনের বন্ধু, এবং আজকাল অবসরে বই পড়ে ও হাঁটতে গিয়ে সময় কাটান। পরিবারের এই আকস্মিক শোক আর সংশয়ের মাঝে কেউ চোখে জল ফেলছে না, বরং সবার চোখে চাপা উত্তেজনা ও গোপন দ্বন্দ্বের ছাপ। সুশান্ত বসু বাড়িতে প্রবেশ করেন সকাল ৯টা নাগাদ, একটি মোটা খাতা আর পুরনো ফাউন্টেন পেন হাতে নিয়ে। তিনি প্রথমেই সবাইকে বসতে বলেন, কারও দিকে না তাকিয়ে বলেন, “যদি সবাই সত্যি কথা বলেন, তাহলে এই রহস্য খুব বেশি সময় লাগবে না খুলতে।”
সুশান্তবাবুর প্রথম পর্যবেক্ষণ ছিল বিজয়চন্দ্রবাবুর ঘর। তার বিছানা অগোছালো নয়, যা বলে দেয় ঘুমের মধ্যে কিছু ঘটেনি। তিনি বালিশের পাশে পানির গ্লাস, অর্ধেক খাওয়া ছিল, তার গন্ধ শুকে বুঝলেন সেখানে কোনও মাদক মেশানো হয়নি। জানালার পর্দা টানা, এবং ঘড়ি থেমে আছে ঠিক ৮:১৫-তে, সম্ভবত হাত থেকে পরে যাওয়ায় বন্ধ হয়েছে, যদিও মৃতদেহের অবস্থা দেখে মৃত্যুর সময় আরও আগে—৬:৩০-৭:০০-র মধ্যে। খাটের পাশের ছোট টেবিলে একটি চিরকুটের অর্ধেক অংশ দেখা যায়, যেখানে লেখা “…আমার নিজের রক্তের মধ্যেই যাকে বিশ্বাস করতে পারিনি…” বাকিটা ছেঁড়া। রূপম, মেঘলা, তীর্থ—তিন ভাইবোনের কারও মুখেই স্পষ্ট কোনো শোক নেই, বরং প্রত্যেকেই নিজেদের অ্যালিবাই তুলে ধরছে। রূপম বলছে লাইব্রেরিতে ছিল, মেঘলা বলছে সে তখন মেডিকেল রিপোর্ট লিখছিল নিজের ঘরে, আর তীর্থ বলছে সে স্নান করছিল বাথরুমে। এমনকি কাজের লোকেরা বলছে তারা কেউ কাউকে সন্দেহজনক কিছু করতে দেখেনি। কিন্তু সুশান্ত জানেন, খুন কখনো শুধু হাত দিয়ে হয় না—মন, সম্পর্ক আর সুযোগ মিলেই আসল অস্ত্র হয়ে ওঠে। বাড়ির প্রত্যেকজনের চোখে আলাদা কথা, প্রত্যেক মুখে কিছু না বলা। এই রবিবার সকালটা কেবল বিজয়চন্দ্র ঘোষের মৃত্যুই নিয়ে আসেনি, বরং খুলে দিয়েছে সেই পরিবারের চাপা ক্ষোভ, লুকোনো ইতিহাস আর প্রতিহিংসার বহু পুরনো বীজ, যা হয়তো একজনের নয়—বরং একাধিক হৃদয়ের মধ্যেই খুনের ইচ্ছা জন্ম দিয়েছিল।
২
সুশান্ত বসু যখন বাড়ির মূল দরজায় পা রাখলেন, তখন সকাল ঠিক ৯টা। তাঁর হাতে একটি পুরনো কাগজের নোটপ্যাড, চোখে ঘোলাটে ফ্রেমের চশমা, আর ঠোঁটে সেই সিগারেটের অবশিষ্ট টান, যেটা বহুদিন আগেই তিনি ত্যাগ করার প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। কিন্তু আজকের সকালটা ছিল ব্যতিক্রম। অনেকদিন পরে আবার যেন সেই পুরনো দিনের গন্ধ পেলেন—জটিলতা, রহস্য, নিঃশব্দ উত্তেজনা, এবং মিথ্যার জাল। বাড়ির পরিবেশ ভারী, যেন ঘরের দেওয়ালও কাঁপছে কারও অজানা অপরাধবোধে। তিনি চুপচাপ বাড়ির ভেতর ঢুকে প্রথমে বিজয়চন্দ্রবাবুর ঘরে যান, তারপর একে একে প্রত্যেক সদস্যকে ছোট ড্রয়িংরুমে ডেকে পাঠান। রূপম, মেঘলা, তীর্থ, সুমিত্রা, বিনোদিনী, এমনকি শ্যামল পর্যন্ত। তারপরে টানা দশ মিনিট তিনি কিছু বলেন না—শুধু প্রত্যেককে পর্যবেক্ষণ করেন, কার চোখ কাকে খুঁজছে, কার আঙুল কাঁপছে, কার কণ্ঠে খুসখুসে কাশি উঠে আসে নিরবতায়। অবশেষে তিনি বলেন, “বিজয়চন্দ্র ঘোষ আমার বন্ধু ছিলেন, কিন্তু সেই সম্পর্ক আমার তদন্তের পথে বাধা হবে না। আজ যে কথা আপনি বলবেন, সেটা আপনার ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে। মনে রাখবেন, খুনি বাড়ির মধ্যেই আছে।” ঘরের ভিতর নিস্তব্ধতা যেন আরও ঘন হয়।
প্রথমে রূপম কথা বলেন। তিনি বললেন, “আমি সকাল সাড়ে ছটা নাগাদ উঠি, তারপর লাইব্রেরিতে গিয়ে আজকের প্রেজেন্টেশনের জন্য কিছু পেপার পড়ছিলাম। বাবার ঘরের দিক দিয়ে যাইনি।” সুশান্ত একবার চোখ সরিয়ে জানালার দিকে তাকান, ঘরের কোণায় রাখা অ্যাটলাসের নিচে পড়েছিল একটি ভাঁজ করা কাগজ। তিনি সেটা তুলে দেখতে থাকেন, চুপচাপ। মেঘলা বলেন, “আমি নিচতলার ঘরে নিজের মেডিকেল রিপোর্ট টাইপ করছিলাম ল্যাপটপে। আমাদের বাবা-মেয়ের সম্পর্ক খুব একটা উষ্ণ ছিল না, কিন্তু আমি চাই না কেউ সন্দেহের আঙুল তুলুক শুধু এই কারণে।” তীর্থ তার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিমায় নিচু গলায় বলেন, “আমি সকাল ৬টা ১৫ নাগাদ বাথরুমে যাই। তারপর আমার ঘরে বসেই পত্রিকা পড়ছিলাম। বাবার সঙ্গে কাল রাতেও খুব বেশি কথা হয়নি।” সুমিত্রা দেবী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলেন, “আমি সকালে ঠাকুরঘরে প্রার্থনা করছিলাম, স্বামীর মৃত্যুর ঠিক কতক্ষণ আগে জানি না… কিন্তু তার ঘর থেকে একটা শব্দ শুনেছিলাম, যেন কিছু ভারী জিনিস পড়ে যাওয়ার শব্দ।” সুশান্ত এবার একে একে সবাইকে কিছু ছোট প্রশ্ন করেন—ঘড়ির সময়, আলো জ্বালানো ছিল কি না, চায়ের কাপ কারা নিয়েছিল। কিন্তু তার সবচেয়ে বেশি মনোযোগ যায় বিনোদিনীর কথার দিকে, যিনি প্রথম থেকেই চোখ নামিয়ে রেখেছিলেন। তিনি বলেন, “বাবু চা খেতেন সবুজ পাতার, সকাল ঠিক ৬টা ৩০-এ দিতাম। আজ উনি বলেছিলেন, একটু দেরি করে দিও, শরীরটা ভালো নেই। তাই আমি ৭টার পরে চা দিতে যাই। তখন দরজা বন্ধ পাই।” সুশান্ত মাথা হেঁট করে চুপ করে থাকেন। তারপর বলেন, “চা দেরি করে দিলে শরীর খারাপ হওয়ার কথা, মৃত্যু নয়।”
এই পর্যায়ে সুশান্ত বাইরে গিয়ে বাড়ির মূল গেট ও ঘরের পথ ঘুরে দেখেন। রাত্রে কারা বাইরে গিয়েছিল, জানালা খোলা ছিল কিনা, এমনকি দেয়ালের পাশে রাখা গাছের টবও খুঁটিয়ে দেখেন। সিঁড়ির ধাপে ধাপে পায়ের চিহ্ন নেই, কিন্তু এক জায়গায় পড়ে ছিল একটা সোনার কলম, যেটার গায়ে খোদাই করা নাম: ‘R.G.’—রূপম ঘোষ। তিনি সেটা কাউকে না দেখিয়ে নিজের পকেটে রাখেন। এবার ডেকে পাঠান বাড়ির চৌকিদার শ্যামলকে। শ্যামল প্রথমে কাঁপতে কাঁপতে বলেন, “স্যার, আমি রাতে বাইরে ছিলাম। একটা আওয়াজ পাই… মনে হল কারা যেন ঝগড়া করছিল দোতলায়। তারপর একটা দরজা জোরে বন্ধ হয়। ভাবলাম হয়তো কিছু নয়… সাহস হয়নি আসতে।” সুশান্ত হঠাৎ মাথা ঘোরান, চোখ সরু করে বলেন, “কিছু নয় ভেবেছিলেন? এই বাড়িতে ঝগড়া খুব স্বাভাবিক ঘটনা?” শ্যামল মাথা নিচু করে বলেন, “না স্যার, কখনোই না… বিজয়বাবু খুব কঠোর মানুষ ছিলেন। সবাই ভয় পেত। এমনকি রাঁধুনীদি পর্যন্ত তাঁর ঘরে ঢুকতে ভয় পেত।” সুশান্ত আর কিছু বলেন না। তিনি শুধু বলেন, “এই বাড়িতে কেউ কারও চোখে চোখ রেখে কথা বলে না। তার মানে হয় ভয় আছে, নয় লজ্জা। কিন্তু খুনির চোখে থাকে আতঙ্ক… ঠিক সেই মুহূর্তে যখন সে বুঝতে পারে—সে ধরা পড়ছে।” তারপর তিনি চলে যান বিজয়চন্দ্র ঘোষের ঘরে, দরজা আবার বন্ধ করে দেন, এবং একা বসে থাকেন প্রায় আধঘণ্টা। খাটের মাথায় ঝুলছে একটি পুরনো পারিবারিক ছবি, যেখানে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে এই পরিবারেরই সাত সদস্য। সুশান্ত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছবির দিকে তাকান, তাঁর চোখ স্থির হয়ে থাকে বিজয়চন্দ্রবাবুর মুখের ওপর। যেন সেই মুখই বলে দিচ্ছে, “আমি জানতাম, রবিবারেই সব শেষ হবে।” বাইরে সূর্য তখন পুরোপুরি উঠে এসেছে, ঘরের মধ্যে আলো গাঢ় হয়েছে, কিন্তু সেই আলোয়ও রহস্যের ছায়া আরও স্পষ্ট—কেউ একজন এই বাড়িতে আজ সকালটা খুব অদ্ভুত করে তুলেছে।
৩
সোমবার সকালে বালিগঞ্জের ঘোষ ভিলার গেটের সামনে যখন একটি সাদা অ্যাম্বাসাডার গাড়ি এসে দাঁড়াল, তখন বাড়ির ভিতরের পরিবেশ আরও বেশি ভারী হয়ে উঠেছে। গাড়ি থেকে নামলেন সুধাংশু মিত্র, একজন প্রখ্যাত আইনজীবী, যিনি বিজয়চন্দ্র ঘোষের বহু বছরের পারিবারিক লিগ্যাল অ্যাডভাইজার ছিলেন। সুশান্ত বসু নিজের নোটপ্যাডে লেখা থামিয়ে বললেন, “এবার সময় এসেছে মূল গোপনীয়তাটাকে প্রকাশ্যে আনার।” সুধাংশুবাবু সবার সামনে ছোট গোল টেবিলে ফাইল খুলে উইলের একটি প্রতিলিপি রাখলেন, এবং বললেন, “এই উইল তৈরি হয়েছিল সাত দিন আগে। পূর্ববর্তী উইল পুরোপুরি বাতিল করা হয়েছে। নতুন উইল অনুযায়ী, বিজয়চন্দ্র ঘোষ তাঁর সম্পত্তি তিন সন্তানের মধ্যে সমানভাবে ভাগ করে দেননি।” সুধাংশু থেমে গিয়ে সবার মুখের প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করলেন। রূপমের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল, মেঘলার চোখ একটু বিস্মিত, কিন্তু তীর্থ নির্বিকার। তারপর আইনজীবী বললেন, “এই উইলে বড় ছেলে রূপম ঘোষকে সংস্থা পরিচালনার নামমাত্র দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, কিন্তু কোনো বড় শেয়ার নয়। ৪৫% সম্পত্তি মেয়ে মেঘলার নামে, বাকি ৫০% ছোট ছেলে তীর্থ ঘোষের নামে। বাড়ির মালিকানাও তীর্থর নামে হস্তান্তরের কথা বলা হয়েছে।” এই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে ঘরের হাওয়াও যেন বদলে গেল।
সুশান্ত চুপচাপ একটা সিগারেট জ্বালালেন, যদিও কেউ কিছু বলেনি, কিন্তু নীরব সম্মতির মতোই অনুমতি ছিল সবার। ধোঁয়ার কুন্ডলির ভিতর দিয়ে তিনি বললেন, “উইল বদলানো বিজয়চন্দ্রবাবুর একান্ত সিদ্ধান্ত, কিন্তু এই সিদ্ধান্তে অনেককে অসন্তুষ্ট করার সম্ভাবনা ছিল। এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার পেছনে নিশ্চয়ই ছিল কোনো গভীর মানসিক বা পারিবারিক টানাপড়েন।” তিনি রূপমের দিকে তাকালেন, যিনি তখন দাঁড়িয়ে জানালার দিকে মুখ করে ছিলেন। “রূপমবাবু, আপনি নিশ্চয়ই জানতেন আপনার বাবা উইল পরিবর্তন করছেন?” রূপম মুখ ফিরিয়ে বললেন, “না। আমি কিছুই জানতাম না। জানলে আজ বাবার সঙ্গে আমার শেষ কথা হত অন্যরকম।” এই কথায় কণ্ঠে যে কান্না নেই, তাও নয়—তবে তাতে দুঃখের তুলনায় অপমানের রেশ বেশি ছিল। মেঘলা এবার বললেন, “আমারও কিছু জানা ছিল না। বাবার সঙ্গে সম্পর্ক অনেক বছর ধরে ছিল না। হঠাৎ ফিরে আসতে বলেন, আমি এলাম। কিন্তু কেন এমন ভাগাভাগি—তা আমিও বুঝতে পারছি না।” তীর্থ তখনও চুপ, কিন্তু সুশান্ত জানেন—চুপ থাকা মানেই নির্দোষতা নয়। অনেক সময় অতিরিক্ত চুপ থাকা আসলে আত্মরক্ষার কৌশল।
সুধাংশু মিত্র এরপর জানান, “উইলে একটি সংযুক্ত চিঠি ছিল, যা বিজয়চন্দ্র ঘোষ নিজ হাতে লিখেছিলেন এবং এটিকে ‘ব্যক্তিগত কারণ’ বলে উল্লেখ করেছিলেন। তবে চিঠিটি এখনও উধাও।” এই নতুন তথ্য সুশান্তকে বেশ চিন্তায় ফেলে। “উধাও মানে?” তিনি প্রশ্ন করেন। সুধাংশু বলেন, “চিঠিটি আমরা লকড চেম্বারে রেখেছিলাম, কিন্তু গতকাল রাতে কেউ যেন প্রবেশ করে তা সরিয়ে ফেলে। কোনও জোর করে ঢোকার চিহ্ন নেই, তাই অনুমান করা হচ্ছে কেউ চাবি ব্যবহার করেই ঢুকেছিল।” সুশান্ত এবার স্পষ্ট অনুভব করেন—খুনের মোটিভ হিসেবে উইল একটি প্রধান কারণ হতে পারে, এবং চিঠির অন্তর্ধান এই খুনের পূর্বপরিকল্পনার অংশ। যে এই উইলের কথা আগে থেকেই জানত, কিংবা অন্তত অনুমান করতে পারত, সে-ই চিঠি চুরি করে ফেলেছে, কারণ সেই চিঠিতেই হয়তো লেখা ছিল খুনের সম্ভাব্য ইঙ্গিত। সুশান্ত এবার নিজের খাতায় কয়েকটি নাম লিখে নেন—রূপম, মেঘলা, তীর্থ—তিনজনই সমানভাবে সন্দেহভাজন, এবং প্রত্যেকেরই নিজের আলাদা অভিমান, ক্ষোভ, আর হতাশা।
উইলের খবর ছড়িয়ে পড়তেই কাজের লোকেরা নিজেদের মধ্যে চুপিসারে ফিসফাস করতে শুরু করে। এমনকি চৌকিদার শ্যামলও এক কোণায় দাঁড়িয়ে কারো ফোনে কিছু বলে যাচ্ছিল। সুশান্ত তা লক্ষ্য করেই বলেন, “শ্যামল, তুমি কাল রাতে বাইরে থেকেও কি কারও আসা-যাওয়া দেখেছ?” শ্যামল অপ্রস্তুত হয়ে বলে, “না… মানে, একটা মানুষকে দেখি সাদা চাদর পরা, কিন্তু মুখ দেখা যায়নি। ভাবলাম বাড়ির পুরনো দুধওয়ালা নাকি।” সুশান্ত বুঝলেন, এই ‘সাদা চাদর’ আসলে অলক্ষ্যে চলাফেরা করা খুনির ছদ্মবেশও হতে পারে। তিনি এরপর ঘরের প্রতিটি জানালা, দরজা ও ফাঁকা স্থান পরিদর্শন করেন, এবং সিঁড়ির ধারে একটা ক্ষীণ ঘষার দাগ খুঁজে পান—যা হয়তো কেউ ছিঁচকে পায়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠার সময় করেছে। তিনি মনে মনে ভাবেন—এই খুন যদি তাৎক্ষণিক রাগ থেকে হয়ে থাকে, তাহলে তার আগে কেউ চিঠি চুরি করে না। এটি ছিল একেবারে সুপরিকল্পিত, এবং পরিকল্পনাটি বানিয়েছিল কেউ খুব ঠান্ডা মাথায়, যার হাতে সময়ও ছিল, এবং ঘরও চেনা ছিল।
৪
সুশান্ত বসুর তীক্ষ্ণ চোখ তখন সারদা ভিলার প্রতিটি ঘরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। একটা খুনের পর বাড়ির লোকজন স্বাভাবিকভাবে আতঙ্কিত থাকে, কিন্তু এখানে সে দেখছে অদ্ভুত এক নিস্তব্ধতা, যেন সবাই যেন এই ঘটনার জন্য আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল। ড্রইংরুমে ফিরে এসে তিনি লক্ষ্য করলেন, বিজনবাবু ব্যালকনির দিকের একটা চেয়ারে বসে ধোঁয়ায় ধোঁয়ায় সিগারেট টানছেন। তার চোখে গভীর এক ক্লান্তির ছাপ, কিন্তু কথা বলার সময় একধরনের আত্মবিশ্বাসও দেখা গেল। সুশান্ত জিজ্ঞেস করলেন, “আপনার পুত্রের মৃত্যুতে আপনি কি কিছু অস্বাভাবিক অনুভব করছেন? হয়তো কেউ আগে হুমকি দিয়েছিল? বা কিছু অশান্তি ছিল পরিবারের মধ্যে?” বিজনবাবু ধীরে মাথা নেড়ে বললেন, “এই পরিবারে অশান্তি লুকিয়ে ছিল অনেকদিন ধরেই। কিন্তু কে যে এতটা দূর যাবে, ভাবতেও পারি না।” তার কথায় হতাশা থাকলেও কোথাও যেন একটা লুকানো ইঙ্গিত ছিল—যেন তিনি জানেন অনেক কিছু, কিন্তু বলছেন না।
এদিকে, সুশান্ত আলাদা করে কথা বললেন গৃহপরিচারিকা সরস্বতী দেবীর সঙ্গে। এই ধরনের কেসে বহু সময় গৃহকর্মীরাই এমন কিছু দেখেন যা পরিবারের কেউ বোঝে না বা বোঝার ভান করে না। সরস্বতী বলল, “সেই সকালে আমি চা দিতে গেছিলাম দীপনের ঘরে, তখন দরজা খোলা ছিল না। কিন্তু ঘরের ভিতর থেকে মৃদু শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। পরে যখন আবার গেলাম, তখন দেখি দরজা হাট করে খোলা আর ওর দেহ পড়ে আছে মেঝেতে। আমি ভয়ে চিৎকার করি।” সুশান্ত জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি কি তখন কাউকে ঘরের আশেপাশে দেখেছিলেন?” সরস্বতী একটু থেমে বলল, “আমি শুধু দিদিমণির (নীলমা) স্যান্ডেলের শব্দ শুনতে পেয়েছিলাম ওপরে ওঠার সিঁড়ির দিক থেকে।” এই বক্তব্যটি এক ঝটকায় ঘটনাটিকে একটি নতুন দিক দেখাল। এখন প্রশ্ন হচ্ছে—এই স্যান্ডেলের শব্দ কি সত্যিই খুনের সঙ্গে যুক্ত, না কি নিছক কাকতালীয়?
তদন্ত আরও জটিল হয়ে উঠল যখন সুশান্ত জানতে পারলেন দীপন সম্প্রতি তার বাবার ব্যবসায় একটি বড়সড় অনিয়ম ধরেছিল, এবং সে তা প্রকাশ করার হুমকি দিয়েছিল। বিজনবাবুর সেক্রেটারি অরিন্দমবাবু বলেন, “দীপন একেবারে ন্যায়পরায়ণ ছেলে ছিল। ওর বাবার কিছু ইনভয়েস ও মিথ্যা কনসাইনমেন্ট নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল।” অর্থাৎ খুনের সম্ভাব্য মোটিভ হিসেবে পারিবারিক আর্থিক কলহ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। অন্যদিকে, সুশান্ত লক্ষ্য করলেন—নীলমার ব্যবহারে এক অস্বাভাবিক ঠান্ডা ভাব। একমাত্র সন্তানকে হারানো মায়ের চোখে যেমন শোক থাকার কথা, তা এখানে অনুপস্থিত। বরং তাঁর চোখে একরকম হিমশীতল নির্লিপ্তি। এইসব পর্যবেক্ষণ নিয়ে তিনি ফিরে এলেন তার নিজের ঘরে, যেখানে তিনি তদন্তের খসড়া সাজিয়ে রাখেন। প্রতিটি চরিত্র যেন এক একটা মুখোশ পরে আছে—কারো মুখে সত্য, কিন্তু অধিকাংশই ছলনা। সুশান্ত জানেন, এই মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে আছে আসল খুনি, আর সেটা খুঁজে বের করাই তার একমাত্র লক্ষ্য।
৫
সুশান্ত বসু রবিবারের ঘটনার চার দিন পর আবার হাজির হন শিল্পপতি মৈত্র পরিবারের বাড়িতে। বারবার ফিরে আসার মধ্যে তার একটি অভ্যাস আছে—ঘটনার চক্রে ঢুকে পড়ে তিনি প্রতিটি স্তরের উপর নতুন করে আলো ফেলেন। বাড়ির ভিতরে পা রেখেই তার চোখ আটকে গেল বসার ঘরের পুরনো কাচের আলমারির দিকে, যেখানে একটা ছবি একটু বেঁকে গেছে আগের দিনের তুলনায়। এসব ছোটখাটো পরিবর্তন সুশান্তর চোখ এড়ায় না। তিনি সামনে গিয়ে ছবিটা ঠিক করতে গিয়ে খেয়াল করলেন, কাঠের ফ্রেমের নিচের দিকে একটুকরো কাগজ আটকে আছে। কাগজখানা টেনে বার করে তিনি বুঝলেন এটা কোনও চিঠির অংশ, সম্ভবত ছেঁড়া। শুধু একটিই লাইন বোঝা যাচ্ছে—“তুমি যদি বলো না, আমি নিজে থেকেই জানিয়ে দেব…”। লাইনটা যথেষ্ট ধাঁধার মতো, তবে পরিষ্কার একটা হুমকির সুর আছে। সুশান্ত সেটাকে নিজের খাতায় নোট করে নিলেন এবং বাড়ির সদস্যদের সঙ্গে আরও এক দফা আলাদা করে কথা বলার সিদ্ধান্ত নিলেন।
প্রথমে তিনি ডেকে নিলেন মিলি মৈত্রকে। এক নিঃশ্বাসে ধূমপান করতে করতে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “আপনার আর অরিন্দমের মধ্যে শেষ এক মাসে কোনও বড় ঝামেলা হয়েছিল?” মিলি কিছুটা থমকে গেলেন, তারপর শান্তভাবে বললেন, “না, অন্তত এমন কিছু না যেটা কাউকে খুন করতে বাধ্য করবে। তবে হ্যাঁ, ওর ব্যবহারে কিছু বদল আমি বুঝেছিলাম।” “কী ধরনের বদল?”—সুশান্তর প্রশ্ন। “ও হঠাৎ করেই বেশ গোপনীয় হয়ে উঠেছিল, ফোনে কথা বলত একা একা, মাঝেমাঝে ঘুম থেকে উঠে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে থাকত। একবার ওর ফোনে একটা মেয়ের মেসেজ দেখেছিলাম, নামটা ছিল—‘P’ দিয়ে, বাকিটা লুকানো ছিল।” সুশান্ত সঙ্গে সঙ্গে খাতায় লিখে নিলেন—“‘P’ নামের নারী? সম্পর্কের বাইরে কেউ?” এর পরে তিনি অরিন্দমের ছোট ভাই অনির্বাণের সঙ্গে কথা বললেন। অনির্বাণ সোজা বলল, “আমি ভাইকে খুব ভালোবাসতাম। তবে শেষ দিকে ওর জীবনে অনেক কিছু পাল্টে যাচ্ছিল। আমি জানতাম না সবটা, কিন্তু বুঝতাম—ও কিছু লুকোচ্ছে।” সুশান্ত জিজ্ঞেস করলেন, “খুনের সকালে আপনি কোথায় ছিলেন?” অনির্বাণ নিশ্চিন্ত গলায় বলল, “আমি আমার ঘরে ছিলাম। সকাল সাড়ে আটটার দিকে কফির কাপ নিয়ে বারান্দায় গিয়েছিলাম। এরপর কিচেনে গেলাম।” কিন্তু সুশান্ত আগেই দেখেছেন যে কিচেনের দরজার পুরনো পাট খুললে এক রকমের শব্দ হয়—একটা গম্ভীর, কড়া কড়া দরজার শব্দ। সে শব্দ শুনেছেন রান্নার বুয়ার কাছ থেকেও, যার মতে, “সকালে কিচেনের দরজা কেউ খোলেনি।”
এই তথ্যগুলি মাথায় রেখেই সুশান্ত রাতের বেলা ফের একবার ওই বাড়িতে এলেন, একেবারে নিঃশব্দে। বাড়ির চারপাশ তখন নিস্তব্ধ, শুধু মাঝে মাঝে গাছের পাতায় বাতাসের শব্দ। তিনি সোজা ঢুকে পড়লেন কিচেনের দরজার দিকে। দরজাটা নিজে একবার খুলে দেখলেন—ঠিকই, একটা জোর শব্দ হয়। এরপর ধীরে ধীরে উঠলেন ওপরতলায়, যেখানে অরিন্দমের ঘর। সেখান থেকে বারান্দা, বারান্দা থেকে মিলির ঘর, মিলির ঘরের পেছনের দেওয়াল ঘেঁষে আছে একটা ছোট্ট কাঠের দরজা, যেটা অনেক পুরনো। সুশান্ত দরজাটা খোলার চেষ্টা করলেন, আর তখনই সেই দরজা থেকে ঠিক সেই একই শব্দ বেরোল, যেটা কিচেনের দরজার মত। একটা সম্ভাবনা মাথায় এল—যদি কেউ এই দরজার শব্দকে কিচেনের দরজার শব্দ বলে চালিয়ে দিতে চায়? এবং তার মানে, কোনও একজন ব্যক্তি আসলে কিচেনে ছিল না, অন্য কোথাও ছিল। এই ছোট্ট দরজার আড়ালে কোনও প্যাসেজ বা গোপন ঘর? দরজার ওপাশটা খোলার জন্য একটু জোর লাগলো, তারপর ধীরে ধীরে খুলে গেল অন্ধকার প্যাসেজ। টর্চ জ্বালিয়ে ভিতরে ঢুকলেন সুশান্ত, আর হাঁটতে শুরু করলেন… এই প্যাসেজ কোথায় নিয়ে যায়, এখন সেটাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। আর এই প্যাসেজই বোধহয় উন্মোচন করতে চলেছে সেই খুনের আসল সূত্র।
৬
বিকেলটা আজ কেমন যেন অস্বস্তিকর, আবহাওয়ায় এক ধরনের ঘন স্নায়ুবিক চাপ জমে রয়েছে। সুশান্ত বসু, কফির কাপ হাতে, ফের পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের আলাদা আলাদা অ্যালিবাই মিলিয়ে দেখছেন। বারান্দার এক কোণায় দাঁড়িয়ে চিন্তামগ্ন মুখে জানালার বাইরে তাকিয়ে তিনি, মনের ভিতরে ঝড় চলছে। হঠাৎই একটি ছোট্ট তথ্য তাঁর মনোযোগ কেড়ে নেয় — সঞ্জীব সিংহর কথায় কিছু অসামঞ্জস্য। সঞ্জীব বলেছিলেন, খুনের সময় তিনি লাইব্রেরিতে ছিলেন এবং একটি পুরনো বিজনেস জার্নাল পড়ছিলেন। কিন্তু লাইব্রেরির পরিচারক বলেছে, ঐ জার্নালে ধুলো জমে ছিল, বহুদিন কেউ হাত দেয়নি। এটা নিছক ভুল, না ইচ্ছাকৃত মিথ্যে? সুশান্ত বসুর চোখে ঘনিয়ে আসে সন্দেহ। তিনি সঞ্জীবের রুমে গিয়ে তাঁকে নিরালায় বসতে বলেন। সঞ্জীবের মুখে আড়ষ্ট হাসি, চোখে লুকোনো উদ্বেগ। সুশান্ত জিজ্ঞেস করেন, “আপনার লাইব্রেরির পাঠ কি তাহলে কল্পনারই অংশ?” সঞ্জীব জবাবে বলে, “আমি একটু বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিলাম… আসলে আমি তখন ঘরে বসেই একটা ক্লায়েন্টের সঙ্গে ফোনে কথা বলছিলাম।” সুশান্তের দৃষ্টি কঠোর হয়ে ওঠে। “তা আপনার ফোনে সেই কলের লগ দেখাতে পারবেন?” সঞ্জীব তখনই কাঁপতে শুরু করে।
এদিকে রান্নাঘরের পরিচারিকা কমলা এক অদ্ভুত তথ্য দেন— খুনের আগের রাতে তিনি মাঝরাতে আওয়াজ শুনেছিলেন, কার যেন চুপিসারে নিচে নামার শব্দ। তিনি মনে করেছিলেন, হয়তো মধুমিতা ম্যাডাম হঠাৎ পিয়ানো বাজাতে গিয়েছিলেন, কারণ নিচের ঘর থেকেই শব্দ এসেছিল। কিন্তু মধুমিতা তো দাবি করেছিলেন, তিনি রাত দশটার পর আর ঘর ছাড়েননি! সুশান্ত বসুর সন্দেহ আরও ঘন হয়। তিনি পিয়ানোর ঘরটা খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করেন। কাঠের নিচে মেঝেতে একটা খোঁচা লেগে থাকা চামড়ার টুকরো পান, মনে হয় কারও জুতো থেকে ছিঁড়ে পড়েছে। বাড়ির সবাইকে ডেকে তিনি বলেন, “এই জুতো কার?” কেউই দাবি করে না। তখন সুশান্ত বলেন, “সন্ধ্যায় আমি আপনাদের প্রত্যেকের জুতোগুলো পরীক্ষা করব, দেখব কারটা খোয়ানো।” একটি মৃতদেহ, আটটি অ্যালিবাই, কিন্তু প্রতিটি অ্যালিবাইতেই লুকিয়ে আছে একটা ফাঁক— সেই ফাঁক দিয়েই যেন বেরিয়ে আসছে সত্যের কণ্ঠস্বর।
তবে সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় ছিল একটি ফোন কল, যেটা খুনের দিন সকাল সাতটায় এসেছিল বিক্রম সিংহর মোবাইলে। কলটা এসেছিল একটি অচেনা নম্বর থেকে, যার লোকেশন ছিল সল্টলেকের এক পুরনো অ্যাপার্টমেন্টে। বিক্রম বলেছিলেন, তিনি ফোন ধরেননি কারণ তিনি তখন শাওয়ারে ছিলেন। কিন্তু মোবাইল তো বাথরুমে ছিল না, তাহলে তিনি জানলেন কীভাবে কে ফোন করেছিল? সুশান্ত সেসব খুঁটিনাটি কাগজে টুকে রাখেন। একটি ছবি ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছে, যেন ধোঁয়ার আড়াল সরছে ধীরে ধীরে। খুনির মুখ এখনও অদৃশ্য, কিন্তু তার ছায়া ঘুরছে চারপাশে। বাড়ির দেয়ালে যেন আঁধার জমছে, আর তারই ফাঁকে ফাঁকে গেঁথে আছে ভয়ঙ্কর এক সত্য। সুশান্ত বসুর কফির কাপ এখন ঠান্ডা হয়ে এসেছে, কিন্তু তাঁর চশমার কাচের আড়ালে জ্বলছে অনুসন্ধানের আগুন।
৭
সুশান্ত বসু সেই সন্ধ্যায় বসেছিলেন বসু বাড়ির পুরনো কাঠের বারান্দায়, যেখানে বসে একসময় বেণীমাধব বসু সন্ধ্যার চা খেতেন। মৃদু বাতাসে শিউলি ফুলের গন্ধ ভেসে আসছিল, কিন্তু সুশান্তের মন এখন অন্য কোথাও। বিগত কয়েকদিনের কথোপকথন, প্রতিটি অ্যালিবাই, প্রতিটি ছলনা যেন মাথায় রিলে প্লেয়ারের মতো ঘুরছিল। তিনি নোটখাতা খুলে শেষবারের মতো গোটা বিষয়টি সাজিয়ে দেখতে লাগলেন। রণজয় বলেছিল, রবিবার সকালে সে ছিল দোতলার লাইব্রেরিতে, অজন্তা বলেছে সে ছিল কিচেনে, পায়েল তার ঘরে, আর পুরনো চাকর মনোহর গিয়েছিল বাজারে। অথচ ডঃ গাঙ্গুলির ময়নাতদন্তে উঠে এসেছে খুনের সময় সকাল ৮টা ৪৫ মিনিট থেকে ৯টার মধ্যে। খুনটা হয়েছে ধারালো কিছু দিয়ে, এবং সুশান্ত জানতেন – এ কাজ বাইরের কেউ করতে পারেনি। বাড়ির প্রতিটি দরজা-জানালা বন্ধ ছিল, সিসিটিভি ফুটেজে বাইরে কেউ ঢোকার চিহ্ন নেই। সব মিলিয়ে এটা নিখুঁত ঘরের ভেতরের খুন – এবং সবচেয়ে বড়ো সমস্যা, প্রত্যেকের অ্যালিবাই সত্যি বলছে—বা অন্তত তাই মনে করাচ্ছে।
পরদিন সকালে সুশান্ত আবার হাজির হন বসু ভিলার স্টাডি রুমে। সবার সামনে বসে একে একে সকলের বয়ান ফের শুনলেন। পায়েলের অস্থির চোখ, রণজয়ের নিস্পৃহ গলা, অজন্তার ঠান্ডা আত্মবিশ্বাস, এমনকি মনোহরের অতিরিক্ত নিরীহ ভাব – সবই আজ সুশান্তের কাছে আলাদা ইঙ্গিত বহন করছিল। হঠাৎ তিনি বলেন, “আপনারা কেউ কি জানেন, বাড়ির স্টোর রুমে একটা পুরনো তলোয়ার রাখা আছে?” সকলে চমকে ওঠে। রণজয় ধীরে মাথা নাড়ে, “হ্যাঁ, সেটা আমার দাদুর সংগ্রহে ছিল, কিন্তু ওটা তো মরিচা পড়ে গেছে, কারো মনেই ছিল না।” সুশান্ত জিজ্ঞেস করেন, “শেষবার কে গিয়েছিল স্টোররুমে?” এবার পায়েল চমকে ওঠে, একটু থেমে বলে, “আমি… মানে, শনিবার সকালে গিয়েছিলাম… একটা পুরনো ম্যানুস্ক্রিপ্ট খুঁজছিলাম।” সুশান্তের চোখ ক্ষীণ ভাবে চমকায়। তিনি জানতেন, ওই তলোয়ারটাই খুনের অস্ত্র—তাতে রক্ত ছিল না, কিন্তু তাতে লেগে থাকা একটি আঙুলের ছাপ ফরেনসিকে মেলানো গেছে—এটা খুনি ভুলেই গেছে। সেই ছাপটি কার, তা তিনি আর জানাতে চান না, কারণ তিনি চাই সত্য নিজেই বেরিয়ে আসুক। তাই এবার তিনি বলেন, “তবে এবার একটা ছোট পরীক্ষা করা যাক।”
সন্ধ্যায় তিনি ড্রয়িংরুমে সকলকে একসাথে ডাকেন। হাতে একটা কালো বাক্স। তিনি বলেন, “এই বাক্সে খুনের অস্ত্র রয়েছে, এবং এতে একমাত্র সেই ব্যক্তির ছাপ আছে, যে এটিকে ব্যবহার করেছে। বাক্সটি খুলে আমি কারো নাম বলব না, বরং যাঁর নাম বলব, সে নিজেই জানবে আমি সব জেনে গেছি।” বাক্সটা খোলেন না, কিন্তু চারপাশের সবাই রীতিমতো বিচলিত হয়ে ওঠে। পায়েল কাঁপতে থাকে, অজন্তার ঠোঁট শুকিয়ে যায়, রণজয় মুখ ঘুরিয়ে থাকে। হঠাৎ মনোহর উঠে দাঁড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে, “সাব, আমি কিছু জানি… আমি ওই রবিবার সকালে রান্নাঘরের পেছনের গোপন দরজা খোলা দেখেছিলাম, যেটা কিচেন স্টোরে যায়, আর সেখানে একটা ছায়া দেখেছিলাম। আমি ভয় পেয়ে কিছু বলিনি!” সুশান্ত ধীরে বলেন, “তুমি যদি এখন সত্যি বলো, হয়তো শাস্তি কমে যাবে।” ঠিক তখনই, পায়েল দাঁড়িয়ে পড়ে। চোখে জল, মুখে আতঙ্ক, গলায় চাপা আর্তনাদ, “আমি করেছিলাম… আমি… আমি বাবার কাছ থেকে জানতে পারি যে তার উইল পরিবর্তন হয়েছে, যেখানে আমার অংশ প্রায় উঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল… আমি… আমি সহ্য করতে পারিনি।” সুশান্ত একনজর পায়েলের দিকে তাকিয়ে বলেন, “আমি জানতাম তুমি করবে… কিন্তু তুমি একা নও। এই খুনের ছকে একজন সহায়ক ছিল—তোমার মা, অজন্তা। আমি তোমাদের দুজনের মধ্যে গোপন কথোপকথন রেকর্ড করেছি শনিবার রাতে।” ঘরে মুহূর্তে মৃত্যু নেমে আসে। মুখোশ খুলে যায়। মুখোশের আড়ালে যে কী গভীর ক্ষত থাকে, তা এবার সকলের সামনে নগ্ন হয়ে দাঁড়ায়।
৮
অবশেষে যখন তদন্ত অষ্টম দিনে এসে পৌঁছলো, তখন সুশান্ত বসুর চোখে ক্লান্তি স্পষ্ট হলেও মনের ভিতরে যেন আরও বেশি দৃঢ়তা। বাগবাজার থানার কনফারেন্স রুমে আজ সকাল থেকে পরিবারের সদস্যদের আবার একবার একত্রিত করা হয়েছে। সকলেই বিরক্ত, ক্লান্ত, কেউ কেউ ক্রুদ্ধ। চৌধুরী পরিবারের সদস্যরা এবার যেন বুঝে গিয়েছে, সুশান্ত হাল ছাড়ার মানুষ নন। বেলা দশটার দিকে তিনি চুপচাপ এক কাপ চা নিয়ে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে রইলেন। বাইরে ঝিরঝিরে বৃষ্টি পড়ছে। চা-এর কাপে ধোঁয়া উঠছে, আর সুশান্ত মনে মনে পুনরাবৃত্তি করছেন – “রবিবারের খুন। সকলে বাড়িতে ছিল, কেউ কিছু দেখেনি, অথচ খুন হয়েছে। খুনটি যেন এমনভাবে হয়েছে, যাতে প্রত্যেকের অ্যালিবাই দাঁড় করানো যায়।” এই চিন্তা করেই তিনি ফিরে তাকালেন — সকলের মুখে একরকম স্নায়বিক চাপ, যদিও তারা তা আড়াল করার চেষ্টা করছে। ঠিক তখনই, একটি নতুন তথ্য এসে হাজির হলো — এক সার্ভেন্ট জানিয়েছে, রবিবার সকালে বাড়ির পুরনো লাইব্রেরি রুম থেকে একটি ধাতব শব্দ শুনেছিল সে, ঠিক খুনের সময়ের কাছাকাছি। কিন্তু সে ভেবেছিল, হয়তো কেউ পুরনো বই পড়ছিল বা কিছু সরাচ্ছিল।
এই তথ্য সুশান্তকে মুহূর্তে চঞ্চল করে তোলে। লাইব্রেরি রুম এখন আর কেউ ব্যবহার করে না, অথচ রবিবার সকালে সেখানে কিছু একটা ঘটেছিল। সুশান্ত ছুটে যান সেই ঘরে। ধুলো জমে থাকা টেবিল, পুরনো বইয়ের স্তূপ, একটা ভাঙা টাইপরাইটার — সবকিছুতেই ইতিহাসের গন্ধ। হঠাৎই তাঁর চোখে পড়ে জানালার ধারে থাকা একটি ছোট্ট ব্রোঞ্জের ঘড়ি, যার একপাশ সামান্য কাত হয়ে পড়ে আছে। ঘড়ির পেছনে রক্তের এক বিন্দু লেগে আছে — এতদিনে শুকিয়ে গিয়ে লালচে হয়ে গেছে। তিনি অবাক হন, ফরেনসিক টিমও কি এটা চোখ এড়িয়ে গেল? না কি ইচ্ছাকৃতভাবে কাউকে চোখ ঘুরিয়ে দেওয়া হয়েছে? ঘড়িটা হাতে নিয়ে খুঁটিয়ে দেখতেই বোঝা গেল, এটি একটি ভারী বস্তু — খুনের অস্ত্র হতে পারে। আবার মনেপড়ে, পোস্টমর্টেম রিপোর্টে মাথায় একধরনের তীব্র আঘাতের উল্লেখ ছিল, কোনো ঘোরা বা তীক্ষ্ণ বস্তু দ্বারা নয়, বরং এমন কিছু যা একঘেয়ে ও ভারী। তিনি তৎক্ষণাৎ ঘড়িটি সিল করে রাখেন ও ফরেনসিক টিমকে জানানো হয়।
চাপা উত্তেজনার মাঝে যখন পরিবারের সদস্যদের সামনে এই নতুন তথ্য তুলে ধরা হয়, তখন অনিন্দ্যর মুখে একরকম অস্থিরতা দেখা যায়। প্রাথমিকভাবে কেউ কিছু বলে না। কিন্তু হঠাৎ করেই অভিজিৎ বলে ওঠে, “ঘড়িটা অনেকদিন আগেই ভেঙে পড়েছিল। আমরা কেউই ওটা ছুঁই না, পুরনো জিনিস।” সুশান্ত হাল্কা হাসেন, “খুব ভালো। তাহলে যদি এর ওপর কারও আঙুলের ছাপ মেলে, সেটি একেবারে সাম্প্রতিক বলেই ধরা যেতে পারে, তাই না?” এই কথার পর ঘরে হঠাৎ করে এক ধরনের ভয়ানক নীরবতা নেমে আসে। কেউ চোখে চোখ রাখতে পারছে না, কেউ আবার শ্বাস নিতে ভুলে যাচ্ছে যেন। ঠিক তখনই সুশান্ত বসু গম্ভীর গলায় বলেন, “আজ থেকে তদন্ত একেবারে অন্য রূপ নেবে। আমি জানি, খুনির ছায়া এখন আমার কাছেই ঘোরাফেরা করছে।”
৯
অন্ধকারে ঢাকা পড়া দুপুরের সেই মুহূর্তে, সুশান্ত বসু আবার ফিরলেন বসাক বাড়িতে, তাঁর মনে তখনো ঘুরপাক খাচ্ছে ছায়ার মতো একটা সন্দেহ। খুনের আগের রাতে যে ‘শব্দ’ কেউ শুনেছে—এই তথ্যটা বারবার তাঁর মাথায় আসছিল। দুপুরের রোদ এখন নরম, ছায়া আরও দীর্ঘ। তিনি একে একে প্রত্যেক পরিবারের সদস্যকে আবার জেরা করতে চাইলেন—এইবার আর প্রশ্ন করার ভঙ্গিটা সোজাসুজি নয়, বরং আবছা কথোপকথনের ভেতর দিয়ে। অবনী বসাক তাঁর সঙ্গে বৈঠকখানায় বসেন, সঙ্গে চা আর স্নায়ুচাপে লেগে থাকা একরাশ বিরক্তি। “আমরা সবাই বাড়িতে ছিলাম, মি. বসু। আপনি তো শুনেইছেন। আমি বুঝতে পারছি না কেন আপনি বারবার এই বিষয়টা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে তুলছেন,”—কঠিন গলায় বললেন অবনী। সুশান্ত ঠাণ্ডা গলায় প্রশ্ন করলেন, “আপনার ঘরে একটা পুরোনো গ্রামোফোন আছে, সেটি কি মাঝে মাঝে চলে?” অবনী খানিক থমকে বললেন, “হ্যাঁ, রবিবার সকালে আমি কখনও কখনও শুনি। কিন্তু খুনের দিন শুনিনি।” সুশান্ত চুপ করে রইলেন কিছুক্ষণ, তারপর ফিসফিস করে বললেন, “আপনার ঘরের পাশেই তো গৌরবের ঘর। আপনি কিছুই শুনলেন না? কাচ ভাঙার আওয়াজ?” অবনী বিরক্ত হয়ে মাথা নেড়ে বললেন, “কোনও আওয়াজ শুনিনি। আমি হয়তো তখন নিজের কাজে ব্যস্ত ছিলাম।”
তারপর তিনি গেলেন ঈশানীর ঘরে। ঈশানী তখন জানালার ধারে বসে ধূসর আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। সুশান্ত বললেন, “গৌরব দাদা আপনার খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন, না?” ঈশানী শান্ত ভাবে বললেন, “হ্যাঁ, তবে সে অনেক দিনের কথা। আমি এখন অতীত ভুলে গেছি।” সুশান্ত হেসে বললেন, “ভোলা যায়, কিন্তু মোছা যায় না। রবিবার সকালে আপনি ঘরে ছিলেন, দরজা বন্ধ ছিল—এটুকু আমরা জানি। কিন্তু কেউ যদি জানে আপনি কোনও চাবি লুকিয়ে রেখেছিলেন, তবে তো…” ঈশানী চোখ সরিয়ে বললেন, “আপনি কি বলতে চাইছেন আমি খুন করেছি?” সুশান্ত মাথা নাড়িয়ে বললেন, “আমি কিছু বলছি না। শুধু জানি যে সত্যের আওয়াজ সবসময় শোনা যায় না, তাকে খুঁজে নিতে হয়।” সেই সন্ধ্যেয় সুশান্ত গোপনে কথা বললেন শর্মিলা বসাকের সঙ্গে। শর্মিলা বললেন, “গৌরব একজন জটিল মানুষ ছিল। ওর সঙ্গে অনেকেরই সমস্যার সম্পর্ক ছিল।” সুশান্ত বললেন, “আপনার স্বামীর সঙ্গে গৌরবের সম্পর্ক কেমন ছিল?” শর্মিলা খানিক থেমে বললেন, “প্রতিযোগিতা ছিল—ব্যবসা নিয়ে, উত্তরাধিকার নিয়ে। অবনী সবসময় চাইত গৌরব দূরে থাকুক।” সুশান্তের চোখ ততক্ষণে কিছু তথ্যের রশি বুনে নিচ্ছে, একটার সঙ্গে একটা যুক্তি মিলছে না। কেউ মিথ্যে বলছে, কিন্তু কে?
রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সুশান্ত তাঁর ঘরে বসে তৈরি করলেন এক মানচিত্র—কে কোথায় ছিলেন, কে কী শুনেছে, কে কী বলেনি। হঠাৎই একটি তথ্য এসে তাঁর চোখে ঝলসে উঠল—সকাল ৯টা ১০ মিনিটে বাগানে থাকা মালী বলেছিল, সে ঈশানীকে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে কাঁদতে দেখেছিল, অথচ ঈশানী বলেছিল সে দরজা বন্ধ করে ছিল! তাহলে জানালার ধারে সে কীভাবে এল? এরপর খেয়াল করলেন, গৌরবের ঘরের জানালা খোলা ছিল, এবং তার পাশেই ছিল ছাদের করিডোর। যদি কেউ ছাদ হয়ে ঘরে ঢোকে? সেই মুহূর্তে একজনের মুখ মনে পড়ল—সঞ্জয়, বাড়ির ড্রাইভার, যে চুপচাপ, কিন্তু পরিবারের অন্দরমহল সম্পর্কে অনেক কিছু জানে। পরদিন সকালে সুশান্ত তাঁকে আলাদা করে ডেকে পাঠালেন। সঞ্জয় একটু কাঁপা গলায় বলল, “আমি কিছু বলিনি, কারণ ভয় পেয়েছিলাম। আমি দেখেছিলাম—রাত দুটো নাগাদ অবনীবাবু ছাদের দিকে যাচ্ছিলেন…” সুশান্ত চুপ করে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে জানালার দিকে তাকালেন। এই খেলাটা এখন শেষের পথে, কিন্তু চূড়ান্ত চালটা মারার আগে দরকার আরও একটা—একটা নিশ্চিত প্রমাণ, যা সবার মুখোশ খুলে দেবে। আর সেই প্রমাণ লুকিয়ে আছে একটা জিনিসে—গৌরবের হাতে পাওয়া সেই পুরোনো চাবির গোছায়, যার একটাও বসাক বাড়ির মূল দরজার সঙ্গে মিলছে না। তাহলে সেটা কোন দরজার?
১০
অবশেষে সত্য উদ্ঘাটনের মুহূর্ত এসে গেল। সুশান্ত বসু সারাদিন ধরে সংগ্রহ করা সমস্ত তথ্য, প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান, আলিবাইয়ের গলদ, আর ঘটনাস্থলের প্রতিটি সামান্য সূত্র মিলিয়ে একটি ছবির মতো স্পষ্টভাবে বুঝে গিয়েছেন আসল খুনিকে। রবিবারের সকালে যে খুনটি হয়েছিল, সেটি একটি ঠাণ্ডা মাথার পূর্বপরিকল্পিত খুন, এবং খুনির মূল উদ্দেশ্য ছিল সম্পত্তির দখল নেওয়া ও পারিবারিক প্রভাব প্রতিষ্ঠা করা। তিনি ড্রইংরুমে পরিবারের সব সদস্যকে বসালেন, তাঁর পুরনো অভ্যেসমতো পেছনে হাত গুঁজে ধীরে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে শুরু করলেন ব্যাখ্যা। তিনি বললেন, “খুনের সময় সকাল ৭টা থেকে ৮টার মধ্যে, এবং খুন হয়েছে একটি কাগজ কাটার ধারালো ব্লেড দিয়ে। এটা কোনো সাধারণ ছিনতাই নয়, এটা একদম ব্যক্তিগত রাগ, প্রতিহিংসা ও ক্ষমতার লোভে সংঘটিত খুন।” প্রত্যেকে চমকে উঠলেও কেউই কিছু বলেনি, শুধু সঞ্জয় মুখুজ্জে মাথা নিচু করে বসে ছিলেন। সেই মুহূর্তে সুশান্ত বসু ঘোষণা করলেন, “খুনি হচ্ছেন আপনি, সঞ্জয়বাবু। আপনি আপনার পিতামহ বিষ্ণু মুখুজ্জেকে খুন করেছেন।”
ঘরের মধ্যে এক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধতা নেমে এল। সঞ্জয়ের মুখ হঠাৎ কাঁচের মতো ফ্যাকাসে হয়ে গেল। চিৎকার করে উঠল তার স্ত্রী রিমা, “না, এটা সত্যি নয়!” কিন্তু সুশান্ত বসু শান্ত গলায় বলে চললেন, “আপনার বাবার উইল অনুযায়ী বিষ্ণু মুখুজ্জে মারা গেলে আপনি সব সম্পত্তির মালিক হতেন। আপনি জানতেন, ওনার মৃত্যু হলে ভাইবোনেরা কিছুই পেত না। তাই আপনি নিজের ঘরে থাকা পুরনো পেপার কাটার থেকে ব্লেড বের করে, ওনার ঘুমন্ত অবস্থায় ওনার গলায় আঘাত করেন। কিন্তু আপনি জানতেন না, একটি ছোট শিশির বোতলের ছিটকে পড়া জল, যেটি ওনার বিছানার পাশে পড়ে ছিল, সেই জলের ছাপ ও আপনার পায়ের চিহ্নই আপনাকে ফাঁসিয়ে দেবে।” তিনি আরো বলেন, “আপনি যেভাবে দরজা লাগিয়ে রাখার গল্প বলেছিলেন, সেটাও মিথ্যে। আলিবাই হিসেবে আপনি বলেছিলেন আপনি তখন বাগানে হাঁটছিলেন, কিন্তু গার্ডের রিপোর্টে লেখা রয়েছে, আপনি সকালে কোথাও যাননি। একজন চৌকস খুনির সবসময় একটা ভুল হয়, আর সেটাই আপনার সর্বনাশ করেছে।”
সঞ্জয় মুখুজ্জে ধীরে ধীরে মাথা তুলে বললেন, “আমি করতে চাইনি, কিন্তু আমাকে বাধ্য করা হয়েছিল। আমি জীবনে কখনো কিছু পাইনি, সব পেয়েছেন দাদু। ভাইবোনেরা কেউ কাজ করে না, আর আমি দিনের পর দিন এই ব্যবসার জন্য ছুটছি। কিন্তু উনি আমার কিছুতেই সন্তুষ্ট হতেন না। আমি শুধু আমার প্রাপ্যটুকু চেয়েছিলাম।” সুশান্ত বসু চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলেন, মুখে কোনো দয়ামায়ার চিহ্ন নেই। পুলিশকে ফোন করা হল, আর সঞ্জয় মুখুজ্জেকে গ্রেপ্তার করা হল তার নিজের বাড়ির মধ্যেই। সেই রবিবারের খুনের রহস্য অবশেষে ভেদ হল, কিন্তু মুখুজ্জে পরিবারের রক্তের দাগ কখনোই মুছে যাবে না। বাড়ির ভেতর সেই দিনকার নিস্তব্ধতা, আর পুরনো প্রাক্তন গোয়েন্দা সুশান্ত বসুর শেষ মন্তব্য আজও বহুদিন পরেও গুনগুন করে শোনা যায়—“সব খুনে রক্ত থাকে না, কিছু খুনে থাকে কেবল লোভ।”
সমাপ্ত




