Bangla - সামাজিক গল্প

রঙ বদলানো জানালা

Spread the love

অনির্বাণ চক্রবর্তী


পর্ব ১: আলো এসে পড়ে

নয়নপুর শহরের প্রান্তে, সেই লালচে ইটের পুরনো দোতলা বাড়িটা শহরের কোলাহলের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে বহু বছর ধরে। জংধরা গেট, একপাশে বেঁকে থাকা নারকেল গাছ, ছাদে শুকনো কাপড়ের দুলুনি—সব মিলিয়ে এক ধরনের নিস্তব্ধ নস্টালজিয়া। ওই বাড়ির দোতলায় একা থাকেন সরলা দেবী। বয়স পঁয়ষট্টি পেরিয়েছে, স্বামী মারা গেছেন প্রায় বারো বছর আগে, ছেলেটা থাকে ব্যাঙ্গালোরে। আসা-যাওয়ার ব্যবধানটা বছরে একবারে এসে ঠেকেছে অনেক দিন আগে।

সরলা দেবীর দিন কাটে একঘেয়ে রুটিনে—ভোরে উঠে তুলসী তলায় জল দেওয়া, কাকের ডাক শোনার সঙ্গে সঙ্গে ঘোমটা টেনে প্রার্থনা, তারপর পত্রিকা পড়া, রেডিওতে গানের ক্লাসিক, দুপুরে নিঃশব্দ ভাত খাওয়া, আর বিকেল হলেই সেই জানালার পাশে বসা। জানালাটা দক্ষিণ দিকে খোলে, যেখানে একটা ছোট গলি দিয়ে মাঝে মাঝে সাইকেল চেপে কেউ কেউ পেরিয়ে যায়, কেউ বাজারের থলে হাতে হেঁটে যায়, আবার কেউ কেউ দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলে।

কিন্তু গত সপ্তাহ থেকে একটা নতুন দৃশ্য ধরা পড়ছে সেই জানালা দিয়ে—একটা নতুন মুখ। মায়াময় চোখ, খোলা চুল, সাদা সালোয়ার-কামিজ পরা একটা মেয়ে, যাকে দেখা যায় সামনের বাসাবাড়িটার ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে থাকতে। কখনও ফোনে কথা বলে, কখনও চা খায়, কখনও আবার কোনো বই নিয়ে বসে পড়ে।

প্রথম দিন ভেবেছিলেন, হয়তো কারোর মেয়ে এসেছে কয়েক দিনের জন্য, বেড়াতে। কিন্তু চারদিন ধরে এক রুটিনে তাকে দেখে মনে হচ্ছিল, মেয়েটা এখানেই নতুন ভাড়াটে। তিনি কৌতূহলী হলেও কিছু জিজ্ঞেস করেননি। শুধু জানালার পর্দা সরিয়ে দেখেছেন। পর্দা সরানোতেই তো দেখা, কথোপকথনের কী দরকার?

চতুর্থ দিন সকালে, রোদ যখন ঘরের ভেতর ঢুকছে টুকরো টুকরো রঙের মতো, সরলা দেবী রান্নাঘরের জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখেন—সেই মেয়েটা ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে একটা ছোট বস্তা থেকে কিছু কাপড় বের করে শুকাতে দিচ্ছে। সেই মুহূর্তেই হাওয়ায় একটা কাগজ উড়ে পড়ল রাস্তার দিকে। মেয়েটা খেয়াল করেনি, কিন্তু সরলা দেবীর চোখে ধরা পড়ল।

তিনি নিচে নেমে এলেন ধীরে ধীরে, কাঠের রেলিং ধরে, পায়ে ব্যথা আছে বলে সময় নেন বেশ খানিকটা। রাস্তার দিকে এসে দেখলেন—একটা সাদা খামে কিছু লেখা আছে। সামান্য কুঁচকে গেলেও স্পষ্ট দেখা যায়, খামের উপর নাম লেখা: “রূপা ঘোষ।”

কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে, খামটা হাতে তুলে নিলেন। তারপর ওই নতুন মেয়ের ফ্ল্যাটের দরজা পর্যন্ত যাওয়ার সাহস হলো না। খামটা নিজের ড্রয়ারে রেখে দিলেন।

সন্ধ্যায়, চা খেতে খেতে খামটা খুললেন। ভেতরে একটি হাতে লেখা চিঠি—

“প্রিয় রূপা,

এই শহরটা তোমার অপরিচিত, জানি। কিন্তু এখানে তুমি একা নও। নিজের ওপর ভরসা রেখো।

ভুল সম্পর্কের ভার নিয়ে আর বেঁচো না। তুমি একা নও, কেউ না কেউ সবসময় আমাদের অপেক্ষা করে।

ভালোবাসা নিছক প্রেমিকের বিষয় নয়, নিজের আত্মমর্যাদাকেও ভালোবাসতে শেখো।

— মা”

চিঠির শেষে একটা তারিখ লেখা ছিল—দুই মাস আগের।

সরলা দেবী দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। জানালার ধারে এসে বসলেন। রূপা ঘোষ, এই ছোট শহরের ভেতর কোথা থেকে এসেছে কে জানে। তবে কিছু একটা যেন ভাঙা নিয়ে এসেছে সে। একটা আত্মরক্ষার অদৃশ্য দেয়াল যেন তাকে ঘিরে রেখেছে।

পরদিন সকালে, রূপা নিজেই দরজায় কড়া নাড়লেন। হাতে একটা কাঁচের কাপ, তার ভেতরে ধোঁয়া ওঠা চা। বললেন, “আন্টি, আপনাকে দেখতাম জানালার পাশে বসে থাকেন, তাই ভাবলাম একদিন এসে দেখা করি। এই আমার বানানো আদা-চা। নতুন শহরে নতুন প্রতিবেশী… একটু চিনে নেওয়া দরকার, তাই না?”

সরলা দেবী খানিক হেসে কাপটা হাতে নিলেন। মনে মনে ভাবলেন—এই তো শুরু। জানালার ওপাশে আলো পড়েছে ঠিকই, কিন্তু এই আলো আসলে কার জীবনে পড়ছে—রূপার, না তাঁর নিজের, সেটা বুঝে ওঠা গেল না।

পর্ব ২: চিঠির খামে গল্প

রূপার দেওয়া আদা-চা’টা হাতে নিয়ে সরলা দেবী জানালার পাশে বসে পড়েছিলেন। ধোঁয়া ওঠা কাপের ভেতর যে কেবল চায়ের গন্ধ ছিল না, ছিল একটা নতুন চেনা-অচেনার টানাপোড়েন, সেটি তিনি ঠাহর করতে পারছিলেন। তাঁর জীবনে বহুদিন পর কেউ নিজের ইচ্ছায় চা বানিয়ে এনেছে। এ অভ্যাস তো এক সময় ছেলের ছিল। শারীরিক ক্লান্তি বা পরীক্ষার চাপের দিনগুলোতে চুপিচুপি মায়ের ঘরে এসে বলত, “চা খাবে, মা?” এখন সেই ছেলেই ফোনে কেবল আধা-মিনিটের কথোপকথনে সীমাবদ্ধ। আর রূপা—এই মেয়েটা যেন হঠাৎই পুরনো কোনো বৃত্তের মাঝখানে এসে দাঁড়িয়েছে।

রূপা বসে পড়েছিল মাটিতে, ছোট করে ভাঁজ করে রাখা চাদরের উপর। তার কণ্ঠে ভদ্রতা ছিল, কিন্তু চোখে ছিল আত্মরক্ষার একটা পর্দা। কথোপকথন বেশিক্ষণ হয়নি, কেবল এটুকুই বলেছিল যে সরকারি অফিসে চাকরি পেয়েছে, পোস্টিং হয়েছে নয়নপুরে। বাসা পেয়েছে এই পাড়াতেই। একা থাকে, সকালে অফিস আর রাতে ফিরে রান্নাবান্না, তারপর বই পড়া। “সচরাচর কথা বলি না বেশি,” বলেছিল সে, “কিন্তু আপনার জানালাটা খুব শান্ত লাগে। যেন কিছু বলছে না, শুধু শুনছে।”

এই কথাটার মধ্যে একটা অদ্ভুত প্রশান্তি ছিল। সরলা দেবী সেই জানালার দিকে তাকালেন—তাঁর জীবনের প্রতিটি ভাঙা স্বপ্ন, একাকীত্ব, অপেক্ষা এই জানালার কাছে এসে জমা পড়ে থাকে, আর সে কেবল চুপচাপ শোনে।

কিন্তু চিঠিটার কথা সারাক্ষণ মাথায় ঘুরছে তাঁর। সেই চিঠি, যেটা রূপার মায়ের লেখা বলে মনে হয়, যেখানে একটা সম্পর্ক ভাঙার ইঙ্গিত ছিল। সরলা দেবী সিদ্ধান্ত নিলেন, তাঁকে কিছু বলতে হবে। অন্তত খামটা ফেরত দিতে হবে। তিনি নিজের ড্রয়ার থেকে খামটা বার করে রূপাকে এগিয়ে দিলেন, “এইটা তোমার পড়ে গিয়েছিল সেদিন। মনে হলো এটা কিছু বিশেষ…”

রূপার মুখ থমকে গেল। সে ধীরে খামটা হাতে নিল, তারপরে খুব হালকা গলায় বলল, “আপনি পড়েছেন?”

সরলা দেবী মাথা নিচু করে বললেন, “হ্যাঁ… পড়ে ফেলেছি। আমি জানি, ঠিক হয়নি। কিন্তু একটা কিছু টানছিল। জানি না কেন।”

রূপা এক মুহূর্তের জন্য চুপ করে রইল। তারপর বলল, “ঠিকই করেছেন। মা এই চিঠিটা দিয়েছিল যেদিন আমি কলকাতা ছেড়ে এসেছিলাম। আমি ওকে বলিনি, কোথায় যাচ্ছি। কেবল চাকরি পেয়েছি, ব্যস, ব্যাগ গুছিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম। তখনই দিয়েছিল এই চিঠি—হাতে ধরিয়ে না, ঘরের টেবিলে রেখে দিয়েছিল।”

চায়ের কাপটা রেখে সে জানালার দিকে তাকাল। “একটা সময় ছিল, ভাবতাম ভালোবাসা মানে কাউকে পেয়ে যাওয়া। এখন বুঝি, নিজেকে না-হারানোই বড় বিষয়।”

সরলা দেবী কথাটা শুনে শিউরে উঠলেন। নিজের তারুণ্যের কত ছবি চোখের সামনে ভেসে উঠল। তাঁর বিয়েটাও হয়েছিল অল্প বয়সে, পছন্দ ছিল না তেমন, কিন্তু সমাজ, পরিবার—সব মিলে একরকম চেপে বসেছিল। বিয়ের পর স্বামীর প্রতি প্রেম এসেছিল ধীরে, আবার হারিয়েও গিয়েছিল তার থেকেও দ্রুততায়। তিনি নিজেকে হারিয়েছিলেন সংসারের সাঁকোয় হাঁটতে হাঁটতে। এখন এই মেয়েটির চোখে সেই সাহস দেখেন—ভুল থেকে বেরিয়ে আসার, নিজের জায়গা খোঁজার।

“তোমার মা খুব বুঝিয়ে লিখেছে,” বললেন সরলা দেবী।

“মা শক্ত মেয়ে। ওকে দেখে শেখা যায় কেমন করে নরম থেকেও লড়াই করা যায়,” রূপার গলা নরম হয়ে এল।

একটু চুপচাপ সময় গেল। বাতাসে একটা গন্ধ ভেসে এল—গলির শেষ থেকে কেউ যেন ফুল বিক্রি করে যাচ্ছে।

“তুমি জানো,” বললেন সরলা দেবী, “এই জানালাটা এক সময় ছিল আমার সবচেয়ে বড় সঙ্গী। অনেক কিছু দেখেছি এইখান থেকে—পাশের বাড়ির বিয়ে, স্কুল থেকে ছেলেদের ফেরার সময়, আম গাছ কাটা, কাকের ডাক, এমনকি ছেলের একা একা বেরিয়ে যাওয়া, কোনও কথা না বলে।”

রূপা হঠাৎ করেই জিজ্ঞেস করল, “আপনি কি দুঃখ পান, আন্টি?”

প্রশ্নটা সরলা দেবীকে কাঁপিয়ে দিল। তিনি সোজাসুজি কিছু বললেন না, কেবল জানালার গ্রীলে আঙুল ছুঁইয়ে বললেন, “অভ্যাস হয়ে গেছে। জানালার মতোই—চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা, আর বাইরের হাওয়ায় কিছু খুঁজে ফেরা।”

রূপা আর কিছু বলল না। উঠে দাঁড়াল। “আজ অফিসে যেতে হবে। আবার দেখা হবে, আন্টি।”

চা’র কাপটা নিয়ে চলে গেল। পেছনে পড়ে রইল জানালা—যেখানে কিছু শব্দ নেই, শুধু অনুভব আছে। আর সেই অনুভবেই এক চিরচেনা আর এক অচেনা জীবন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে।

পর্ব ৩: চায়ের কাপের ভেতরে

নয়নপুর শহরে শীত তখন ধীরে ধীরে গায়ে জড়িয়ে বসছে। সকালে জানালা খুললে ঠান্ডা হাওয়ায় পর্দা দুলে ওঠে। সরলা দেবী এমন দিনে এক কাপে চা নিয়ে বসেন জানালার ধারে, লেপ মুড়িয়ে পায়ে মোজা পরে। আগে এসব করতে ভালো লাগত না—ভেতরে একটা হাহাকার কাজ করত, যেন এ জীবন বড্ড শূন্য। এখন যেন সেই শূন্যতায় একফোঁটা শব্দ এসে পড়েছে। রূপার শব্দ। তার হাঁটার আওয়াজ, তার সিঁড়ি বেয়ে ওঠার ধ্বনি, এমনকি তার চায়ের কাপ ধুয়ে রাখার টুংটাং শব্দও।

আজ রবিবার, ছুটি। রূপা সকালেই দরজায় কড়া নেড়ে ঢুকল। হাতে একটা ছোট মাটি কাপ, দুটো আদা-চা, সঙ্গে এক প্যাকেট বিস্কুট। বলল, “আজ একটু সময় আছে, বসে চা খাই একসাথে।”

দুজনেই জানালার পাশে বসলেন। টেবিলে কাপ রাখা, ঠাণ্ডা হাতের তলায় কাপে গরম চায়ের উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়ছে।

“তুমি নিজের শহর ছেড়ে এখানে এলেই বা কেন?” জিজ্ঞেস করলেন সরলা দেবী।

রূপা খানিকক্ষণ চুপ থেকে বলল, “চাইছিলাম একটা নতুন জীবন শুরু করতে। কলকাতায় আর থাকতে পারছিলাম না। অনেক স্মৃতি, অনেক প্রশ্ন, আর নিজের প্রতি একটা ঘৃণা… বুঝলেন তো?”

সরলা দেবী মাথা নাড়লেন। “হ্যাঁ, বুঝি। জায়গা পাল্টালেই সব পাল্টায় না, তবে শুরুটা সহজ হয়।”

রূপা হেসে বলল, “ঠিক তাই। প্রথমে ভাবতাম পালাচ্ছি। এখন মনে হয়, নিজেকে একটু সময় দিচ্ছি।”

চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে রূপা বলল, “কলকাতায় একটা ছেলের সঙ্গে বিয়ের কথা চলছিল। বছর দেড়েক ধরে সম্পর্ক ছিল। ওর মা-বাবা প্রথমে মানেনি, পরে রাজি হলেও আমার চাকরি নিয়ে সমস্যা তুলল। বলল, মেয়ে যদি বাইরে পোস্টিং পায়, তবে মেয়ে নয়, ছেলেই ‘সংসার’ চালাবে, এটা মানা যায় না।”

“অতএব?” জিজ্ঞেস করলেন সরলা দেবী।

“অতএব শেষ। সম্পর্কও, স্বপ্নও। আসলে আমি একটা ভুলে ছিলাম—আমি ভেবেছিলাম ও আমায় সমান ভাবে দেখে। কিন্তু না, ওর চোখে আমি তখনই আদর্শ ছিলাম, যখন ওর অনুগামী ছিলাম।”

চুপচাপ কিছুক্ষণ কেটেছে। সরলা দেবী বললেন, “এই সমাজে মেয়েরা আজও যেন চায়ের কাপ—দেখতে সুন্দর, প্রয়োজন হলে সামনে, না হলে তাকের উপর।”

রূপা তাকিয়ে রইল তাঁর দিকে। এই কথার মধ্যে একটা গভীরতা ছিল, যা সে নিজেও অনুভব করছিল। চায়ের কাপের ভেতরও যেমন শুধু চা থাকে না, থাকে অভ্যেস, অভিমান, আর কিছু না বলা ব্যথা।

“আপনার গল্পটা শুনতে ইচ্ছে করে,” বলল রূপা।

“আমার গল্প?” হালকা হাসলেন সরলা দেবী। “একেবারে সাদামাটা। পঁচিশে বিয়ে, ছাব্বিশে মা, ত্রিশে সংসারের গোলকধাঁধা, তারপর কেবল দিন গোনা।”

“কিন্তু আপনি তো এখনও নিজেকে হারাননি। আমি তা বুঝতে পারি,” রূপা বলল।

“না রে, হারিয়ে গিয়েছিলাম বহুদিন। এখন ধীরে ধীরে ফিরে পাচ্ছি নিজের ছায়াকে,” বললেন তিনি। “তুই তো এখন শুরু করেছিস। তোর সামনে অনেক পথ, আর তুই সাহস নিয়ে শুরু করেছিস, সেটাই তো সবচেয়ে বড়ো কথা।”

রূপা মাথা নোয়াল। “কিন্তু মাঝে মাঝে খুব ভয় করে। রাতে ঘুম ভেঙে গেলে মনে হয়, কেউ নেই। এই চাকরিটা যদি না থাকত, বা অসুস্থ হয়ে পড়তাম, তাহলে কে থাকত পাশে?”

“তুই তো আছিস নিজের পাশে,” সরলা দেবী বললেন ধীরে, “এটাই আজকের দিনের সবচেয়ে সাহসী সঙ্গ।”

একটা পাখি জানালার রেলিংয়ে এসে বসল। রূপা তাকিয়ে রইল পাখিটার দিকে। তার চোখে ছিল অনিশ্চয়তা, আবার সেই অনিশ্চয়তার মধ্যেই খুঁজে পাওয়া ভরসার ছায়া।

“আন্টি, জানেন?” রূপা বলল, “আমি রাতে শুয়ে ভাবি, যদি আমার একটা মেয়ে থাকত… আমি তাকে এই সমাজে কীভাবে বড় করতাম?”

“যেভাবে নিজের আত্মাকে বড় করছিস, ঠিক সেইভাবে।”

দুজনেই চুপ করে গেলেন। বাইরের রাস্তা দিয়ে একটা সাইকেল হেলে দুলে চলে গেল। দূর থেকে কারো রান্নার ঘ্রাণ ভেসে এল। শহরটা তাদের চারপাশে নীরবে বেঁচে ছিল। কিন্তু সেই নীরবতার মধ্যে আজ ছিল দুটি নারীর আলোচনার সুর, এবং এক চায়ের কাপের ভেতর জমে থাকা সাহসের গল্প।

পর্ব ৪: রঙ বদলানো জানালা

সেদিন সন্ধ্যাবেলায়, জানালার পাশে বসে চুপ করে রইলেন সরলা দেবী। রূপা চলে গিয়েছে অনেকক্ষণ। কাপে আধা-ফোঁটা চা পড়ে আছে, ঠান্ডা হয়ে গেছে। জানালার বাইরের আকাশটাও আজ যেন কিছু একটা বোঝাতে চাইছে—রোদ গিয়েছে, কিন্তু সন্ধ্যার রঙটা আজ একটু অন্যরকম। আকাশে গাঢ় বেগুনি আর কমলার মিশেলে এক অদ্ভুত নরম আলো।

এই জানালাটার সামনে বসে থাকতে থাকতে কেটে গেছে জীবনের বহু সময়। কখনো বৃষ্টির দিনে, কখনো দুপুরের তীব্র রোদের মাঝে, কখনো বা শীতের কুয়াশায়। কত মুখ, কত গল্প, কত স্মৃতি এ জানালার বাইরে দিয়ে পেরিয়ে গেছে। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে এই জানালাটা যেন নিজের রঙ বদলাচ্ছে। তার কাঠের গায়ে পুরনো রং খসে পড়ছে না, বরং নতুন কোনো আভা জেগে উঠছে।

রূপার সঙ্গে সম্পর্কটা এখন আর কেবল ‘নতুন প্রতিবেশী’ বা ‘ছোট মেয়েটি’ এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। এখন যেন সে নিজের জীবনের হারিয়ে যাওয়া এক অধ্যায়ের পুনর্জন্ম। রূপার কথায়, চোখে, ছোট ছোট অভ্যেসে সরলা নিজের একরাশ বিস্মৃত আবেগকে খুঁজে পান।

রাতের খাবার খেতে খেতে তিনি পুরনো অ্যালবামের পাতাগুলো উল্টে দেখছিলেন। তাঁর ছোটবেলার ছবি, কলেজের ক্লাসে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দেওয়ার মুহূর্ত, ছেলের প্রথম জন্মদিন, স্বামীর সঙ্গে কোনো দূর পাহাড়ে তোলা হাস্যোজ্জ্বল ফ্রেম—সবই যেন আজ অতীতের ম্লান রঙে আঁকা।

হঠাৎ করে একটি ছবিতে চোখ আটকে গেল—তাঁর কলেজের নাটকের দিনের ছবি। লাল পাড় সাদা শাড়ি পরা, হাতে বই, চোখে আত্মবিশ্বাস। ‘অভিনয়’ ছিল তাঁর প্রাণ, কিন্তু বিয়ের পর সবই ছেড়ে দিতে হয়েছিল।

পরদিন রূপা এল দুপুরবেলায়। আজ তার মুখে একরাশ উত্তেজনা।

“আন্টি, আপনি জানেন? আমি কাল একটা ইভেন্টে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে অংশ নিতে চলেছি। মেয়েদের সেল্ফ-ডিফেন্স নিয়ে একটা কর্মশালা। সরকারি অফিসে কাজ করলেও এরকম কিছু করতে ইচ্ছা করে আমার।”

সরলা দেবী চোখ বড় করে শুনছিলেন। রূপার চোখে আগুনের মতো আলো।

“তুই তো অসাধারণ কাজ করছিস!” তিনি বললেন।

“আর একটা ব্যাপার ভাবছি,” রূপা থেমে বলল, “এই শহরে একটা ছোট্ট নারী-পাঠচক্র শুরু করলে কেমন হয়? যেখানে গল্প বলা যায়, বই পড়া যায়, নিজেদের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নেওয়া যায়?”

এই প্রস্তাবে সরলা দেবীর বুক কেঁপে উঠল। তিনি ধীরে বললেন, “তাহলে আমিও তোমার সঙ্গে থাকবো।”

রূপার চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে গেল। “আপনি? আপনি তো—”

“আমি তো একসময় নাট্যচক্রে ছিলাম। নিজের গলা দিয়ে গল্প বলা, আবৃত্তি, চরিত্র আঁকা—সব জানতাম। কিন্তু তারপর সংসারের জানালায় আটকে গিয়েছিলাম।”

রূপা দাঁড়িয়ে পড়ল। “তাহলে আমরা শুরু করি। জানালাটা তো এখন খুলে গেছে, না আন্টি?”

দুজনেই জানালার দিকে তাকালেন। বাইরের আকাশে সূর্য ডুবে গেলেও জানালার গায়ে লাগছে একরাশ উষ্ণ আলো। এমন আলো, যা হয়তো একদিনের জন্য নয়, একটা নতুন জীবনের আহ্বান।

সেই সন্ধ্যায়, দুজনে মিলে একটা পুরনো খাতা খুলে তালিকা তৈরি করল—কী কী বই রাখা হবে, কতজন আসতে পারে, কোথায় বসা যায়। শহরের অন্য গলির নারীরাও এই গল্পে ঢুকবে খুব শিগগিরই। আর জানালাটা, সে তো এখন কেবল দৃশ্য দেখার নয়—এখন সে নিজেই এক নতুন রঙে রাঙানো চরিত্র।

পর্ব ৫: শহরের গুঞ্জন

নয়নপুর শহরটা ছোট হলেও, তার কান বড়ো। এক পাড়া থেকে অন্য পাড়ায় খবর পৌঁছতে সময় লাগে না। এক বাড়ির বারান্দায় কেউ হাঁচি দিলেও অন্য বাড়ির চৌকাঠে কেউ জিজ্ঞেস করে—”জ্বর হয়েছে নাকি?” আর যদি নতুন কিছু ঘটে, তাহলেই তো কথাই নেই! সে গল্প চায়ের দোকান থেকে শুরু করে বাজারের পাথরঘাটার মোড় পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে, আর তারপর ঢুকে পড়ে কারো না কারো কানে—ফিসফিস করে।

ঠিক এইরকম ফিসফিসানি শুরু হয়েছে সরলা দেবী আর রূপা ঘোষকে ঘিরে।

প্রথমে কেউ খেয়ালই করেনি। একা মহিলা একা মেয়ে—দুজনেই নিজেদের মতো থাকছে, এমনই ভেবেছিল সবাই। কিন্তু যেদিন সরলা দেবীর বাড়ির সামনের উঠোনে সন্ধ্যে ছ’টায় পাঁচটা মেয়ে একসাথে বসে গল্প করতে শুরু করল, সেদিন থেকে শহরের বাতাসে নতুন শব্দ ঢুকল—“ওই জানালার পেছনে কিছু একটা হচ্ছে।”

রাতের দিকে ফুলমতি, সরলার পুরনো গৃহপরিচারিকা, এক ভাড়াটে বাড়ির মালিকের বউকে বলে ফেলল, “ও বুড়ি আর ওই চাকরি করা মেয়েটা মিলেমিশে এক নতুন কিসিমের ক্লাব খুলেছে।”

সেই রাতেই শহরের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপগুলোতে ছবি ঘুরে বেড়াতে লাগল—দু’জন নারী, একটা খোলা জানালা, কাগজপত্র আর বই হাতে। কেউ নাম দিল “ফেমিনিস্ট মঞ্চ,” কেউ বলল “অবাধ্য ক্লাব।” কেউ মজা করে লিখল, “পুরনো বিধবার নতুন নাচ।”

কিন্তু রূপা এসব নিয়ে বিচলিত হয়নি। সে বরং আরও জোর দিয়ে কাজ শুরু করল—পাশের স্কুলে গিয়ে কথা বলল মেয়েদের সচেতনতা নিয়ে, আর সরলা দেবী জানালার ধারে বসে তাদের জন্য পাঠ্যসূচির খসড়া তৈরি করতে লাগলেন। দুই প্রজন্মের দুই নারী যেন একসাথে হাত মিলিয়ে কিছু গড়ে তুলছিলেন—যা এই শহরের চোখে একধরনের অপরাধ!

কিন্তু চাপটা বাড়ছিল আস্তে আস্তে।

একদিন সরলা দেবীর বাড়িতে এসে হাজির হল পাড়ার সাবেক ‘মহিলা সমিতির’ সভানেত্রী বীণা রায়। মুখে মিষ্টি হাসি, হাতে সন্দেশের বক্স।

“দিদি, আজকাল অনেক নতুন মুখ আসছে আপনার বাড়িতে। ভাবলাম, একটু দেখা করি। কিছু বিপদে না পড়েন।”

সরলা দেবী হাসলেন। “বিপদ কিসের, বীণা? একটা গল্প বলার আড্ডা তৈরি করেছি, সেইটুকুই।”

বীণা হালকা গলায় বললেন, “দিদি, এই বয়সে এসব নতুন কিছু শুরু করার ঝুঁকি কি ঠিক? শহরের মানুষ অনেক কিছু ভাবে।”

“তারা ভাবুক,” সরলা ধীর কণ্ঠে বললেন। “আমি তো আর আগের মতো চুপ করে জানালার পাশে বসে থাকি না। এখন জানালার বাইরে শুধু দেখিই না, দরজাও খুলি।”

বীণা একটু থমকে গেল। মিষ্টির বক্সটা রেখে দ্রুত চলে গেল।

রূপা ফিরে এলে সরলা বললেন, “তুই জানিস তো, কী বলেছে ওরা?”

“জানি,” রূপা মাথা নোয়াল, “আজ অফিসেও শুনলাম, স্যার বলেছেন আমি ‘খুব বেশি সোশ্যাল’ হয়ে গেছি।”

“তুই ভয় পাচ্ছিস?”

“না। কিন্তু রাগ হচ্ছে। আমার ব্যক্তিগত জীবন, আমার পরিশ্রম—সবকিছু নিয়ে যেন তারা অধিকারবোধ দেখায়।”

“তাই তো,” সরলা দেবী গভীর গলায় বললেন, “একটা মেয়ে যখন নিজে নিজের রাস্তা তৈরি করে, তখনই সমাজের মাথাব্যথা শুরু হয়। কারণ তারা চায় না আমরা প্রশ্ন করি। তারা চায় আমরা চুপচাপ বসে জানালা দিয়ে দেখি—বাইরের জগৎটা পুরুষেরা কীভাবে চালায়।”

রূপার চোখ ঝলসে উঠল। “তাহলে চলুন, আমরা আর চুপচাপ দেখি না। দরজাটা খুলি। আলো ঢুকতে দিই।”

সেই সন্ধ্যায়, শহরের আলো কমে এসেছিল, কিন্তু সরলার জানালার গায়ে আলো পড়ে ছিল। যেন সেখানে কোনো উৎসব হচ্ছে। এক ধরনের নীরব বিদ্রোহ, যার গন্ধ শহরের বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছিল ধীরে ধীরে।

পর্ব ৬: আলোকিত বিকেল

সেই দিনটা ছিল শনিবার। নয়নপুর শহরের ছোট্ট মিলন মঞ্চে একটা ছিমছাম আয়োজন। স্টেজে বড় কিছু না—একটা গোল টেবিল, কিছু চেয়ার, একপাশে বইয়ের আলমারি আর মাটির তৈরি টুকরো টুকরো প্রদর্শনী। শহরের বিভিন্ন বয়সের প্রায় তিরিশজন নারী এসে জড়ো হয়েছেন, তাদের কেউ স্কুলের ছাত্রী, কেউ গৃহবধূ, কেউ শিক্ষকতা করেন, কেউ বা স্রেফ কৌতূহলী পথচলতি মানুষ।

এই ছিল ‘নবআলো’র প্রথম আনুষ্ঠানিক দিন—রূপা আর সরলা দেবীর গড়া সেই গল্পবাক্স, যেখানে ভয়, ঘৃণা, দুঃখ বা লজ্জা ঢুকতে পারবে না, কিন্তু প্রশ্ন ঢুকবে, অভিজ্ঞতা ঢুকবে, আর সবচেয়ে বড় কথা—আলো ঢুকবে।

রূপা স্টেজে উঠে প্রথম বক্তৃতা দিতে গিয়েই থমকে গিয়েছিল। কাগজে কিছু লিখে এনেছিল বটে, কিন্তু মুখ খোলার সঙ্গে সঙ্গে অনুভব করল—এই কথাগুলো লেখা যায় না, এগুলো বলা যায়। এবং যাদের সামনে বলা হবে, তারা কেউই বিচারক নয়।

“আমি রূপা ঘোষ। সরকারি চাকরি করি, একা থাকি। একসময় ভেবেছিলাম একা থাকাটা দুর্বলতা। এখন বুঝি, একা থাকাও একধরনের ক্ষমতা।”

চারদিক থেকে করতালি ভেসে এল।

“আমার পাশে আজ একজন আছেন, যিনি আমার জীবনের এক বিশেষ জানালা খুলে দিয়েছেন—সরলা আন্টি। বয়সে তিনি বড়, অভিজ্ঞতায় অসীম, আর সাহসে… হয়তো আমার চেয়েও বেশি।”

সেই মুহূর্তে সবাই প্রথমবার দেখল সরলা দেবীকে—শাড়ি পরা, মাথায় সামান্য পাকা চুল, চোখে চশমা, কিন্তু ঠোঁটে এক তৃপ্ত হাসি। তিনি স্টেজে উঠে দাঁড়ালেন, রূপার হাতটা ধরলেন।

“আমি জানি,” তিনি বললেন, “এই সমাজ আমাদের নিয়ে কথা বলবে। বলে এসেছে, বলবেই। কিন্তু এই প্রথমবার মনে হচ্ছে, আমরা যা বলছি, সেটাও কেউ শুনছে।”

এতটা সাহসিকতার সঙ্গে কথাগুলো বলার পর যেন চারপাশ হালকা হয়ে গেল। বাতাসে এমন এক ভারহীনতা এল, যেটা পাওয়া যায় কেবল নিজেকে প্রকাশ করার পর।

অনুষ্ঠান শেষে, এক কিশোরী মেয়ে এগিয়ে এসে সরলার হাত ধরল। “আন্টি, আমি তো ভাবতাম আমার মা কিছু বোঝে না। কিন্তু আজ বুঝলাম, মায়েরাও একসময় রূপা বা আমার মতোই ছিল।”

সরলা মৃদু হাসলেন। “আমরাও সবসময় মা ছিলাম না, মা হতে হতে অনেক কিছু হারিয়েছি। এখন মনে হয়, কিছু ফিরিয়ে নেওয়ার সময় এসেছে।”

সন্ধ্যা গড়িয়ে সন্ধ্যারতির সময়। রূপা আর সরলা বাড়ি ফিরলেন পাশাপাশি হেঁটে। হাঁটার সময় দুজনে চুপ করে ছিলেন বেশ কিছুক্ষণ। তারপর রূপা হঠাৎ বলল, “আন্টি, জানালাটা আজ খুলে রেখে ঘুমাবেন?”

সরলা থেমে তাকালেন। “হ্যাঁ, আজ সে জানালার দরকার নেই শুধু বাইরে দেখার জন্য—আজ আমি চাইলেই জানি, কেউ আমার ভিতরটা দেখবে না, বুঝবে। সেই ভয় কেটে গেছে।”

সেই রাতে জানালার পর্দা সরানো ছিল, বাতাস ঢুকছিল নিঃশব্দে। শহরের অন্য প্রান্তে কে জানে হয়তো কেউ আবার বলাবলি করছিল, কিন্তু এ বাড়ির ভিতরে এখন শব্দ নয়, আলো ঢুকছে।

একটি রঙ বদলানো জানালা—এখন আর শুধু কাঠের নয়, গল্পের, বিশ্বাসের, আর সাহসের প্রতীক।

শেষ

Lipighor_1750472701290.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *