প্রিয়াঙ্কা সেন
১
রানু কলেজের গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে সে নীরব একটা উত্তেজনা অনুভব করছিল। আজ থেকে ওর কলেজ শুরু, নতুন জীবন, নতুন মানুষ, নতুন গল্প শুরু হতে যাচ্ছে ঠিক যেন। ছোট শহরের মেয়ে, দীর্ঘদিন পিয়ানো আর বইয়ের মধ্যে বন্দী, জীবনের এই নতুন অধ্যায় ওর মনের অনেক দরজা খুলে দিচ্ছিল। সকালরোদে কলেজের গেটের মার্জিততা, বাগানের গাছগুলো থেকে পড়ছে ঝরঝরে সবুজ রোদ—এই পরিবেশে প্রবেশ করতেই ওর মন হালকা করে উঠছিল। অন্দরনগরের এই কলেজে প্রথম পদার্পণ, মনে হচ্ছিল ও একেবারে নতুন দ্বারে কড়া বাজিয়ে দাঁড়িয়েছে। ওর হাতে একটা ছোট ব্যাকপ্যাক, কিছু বই আর একটা ওভারহেড কন্ডিশনার—সকল কিছুকে মিশিয়ে রানু আত্মবিশ্বাসীভাবে স্টেপ চালাল কলেজের দিকে। ক্লাসরুমে ঢুকে প্রথম কালির তালিকার দিকে তাকাল—রানু খুঁজছিল ওর নাম, খুঁজছিল ওর আসনে বসার উৎসাহ আর ভয়ের মিশ্র অনুভূতি।
প্রথম দিন একটু অস্বস্তি হলো, আমিই কোনো প্রশ্ন করবনি, কারও সাথে বেশি কথা বলিনি, শুধু চুপচাপ বসে ছিলাম—মনে মনে ভাবছিলো। ছেলেমেয়েরা হুড়মুড় করে পরিচিতির চেষ্টা করছে, কেউ হেসে হাত বাড়াচ্ছিল, কেউ কখনো ফোনে ব্যস্ত। রানা, সুশ্মিতা, আর পারুল নাম শুনে গেলো—ওদের সাথে মাঝেমধ্যে চোখ মিলছিল, মাঝে খোঁজে যেমন এক অপরিচিত বন্ধুত্বে আর গল্পে মলিন সৌন্দর্য আছড়ে পড়ছিলো। একসময় ক্লাস শেষ হয়ে গেলো, ছাত্রছাত্রীরা বেরিয়ে গেলো ঘোরাফেরা করে, মধুর আলাপ আর পরিচিতি বাড়ানোর উদ্দেশ্যে। রানু আর একটু দেরি করে বেরোলেন, পেছনে দূর থেকে শিক্ষকের “ধন্যবাদ, প্রথম দিন সুন্দর করে কাটাও” কথা শুনল।
রানু লক্ষ্য করল কলেজের অন্দর থেকে একটা ছোট রাস্তা নিয়ে এগিয়ে গেছে এক বিশাল, স্বচ্ছ ক্যান্টিন—দাঁড়িয়ে আছে নানা ধরনের টেবিল চেয়ারের ভিড়ে, চারপাশে মিষ্টি গন্ধ, রঙিন স্লাইডার, রুটি-পরাঠার গরম ফুটন্ত আতঙ্ক… প্রতিটি টেবিলে বসে আছে মানুষ, কফি, চা, পাস্তা, পিৎজা—যে কোনো কিছুতেই একরকম জীবনের স্পন্দন। ‘আচ্ছা… একবার ঢুঁ মারি’ ভেবে ভিতরে ঢুকল। আকাশের দিকে ঢুকে চেয়ে দেখল, সোজা একটা টেবিলে জায়গা ছিল, সেখানেই গিলে বসলো। পাশেরটা যে কাউকে দাগিয়ে দেখে না, সে টেবিলেই বসে বসল।
টেবিলে বসে কাপড়ে ক্লাস নোট বের করছিলো, তখন একটা কণ্ঠমতো শুনতে পেলো—”তুমি একলা?” এক মিষ্টি স্বর, মানুষের ভিড়ের মধ্যেও উপস্থিত। রানু হঠাৎ থামল, নড়েচড়ে বসল। সামনে বড়ে একটা ছেলে দাঁড়ালো, সোজা চোখে তাকিয়ে হেসে বলল, “জায়গা চাইলে তুমি ভরসা করো এখানে, আমি বন্ধু হতে পারি।” ওর চোখগুলো আনন্দে ঝলসে উঠল—ঢিলেঢালা কোন বেহাদ্র ওর দিকে তাকিয়ে আছে, দয়া মিশিয়ে—আমাকে এসব অনুভব করল। হঠাৎভাবে মনে হলো যেন অচেনা কেউ কাছে এসে গেছে, বলছে ‘এখানে তুমি স্বাগত, আমি আছি’। রানু বাধ্য হয়ে ঝলসানো ভিজে একটি হেসে উত্তর দিল, “ধন্যবাদ। ও আমার নাম রানু।” ছেলেটার কানিকানিকিতে হেসে সেই নাম ধরল। ওর হাত বাড়িয়ে বলা হলো, “আমি রাহুল। অনেকদিন ধরে এখানেই, শুধু চোখে নতুন মানুষের দেখা কম। তুমি আমার আশেপাশেই!” রানু মনে মনে ভাবল—’কত সরল আর ভদ্র! কারো সাথে এমন হতে পারে না জীবনের প্রথম দিনেই!’
রাত্রের সঙ্গে সকালের মতোই ক্লাস গ্রহণের আওয়াজ বন্ধ হয়ে গেল, দুপুরের খাওয়া ও স্লো এলকারমেন্ট—সেখানে চলে গেলো রানু আর রাহুল। অনেকটা অবসর সময় হাতছাড়া না করে, রাহুল তার গিটার বের করে নিজের লেখা কিছু লাইন পড়ে, তারপর চেহারা দেখে হাসে। রানু ভারাক্রান্ত—ও চোখ রাঙিয়ে বলল, “তুমিও কি কবিতা লিখো?” রাহুল উত্তর দিল, “হ্যাঁ, তবে তোমাকে শোনার আগ্রহ পাওয়ার পর বুঝলাম—ভালো লেখা মানেই ভালো শ্রোতাও চাই।” বিকেলের সূর্য যেন একটু শীতল হয়ে আসে রেডিয়েন্ট হিট করে, সেই মূহূর্ত ছিল ক্যান্টিনের আবহাওয়ার সঙ্গে মিশে ওদের প্রথম পরিচয়।
পরের দিন কলেজের লাইব্রেরিতে ওদের দেখা হলো আবার। রানু বসে আছে একটা বড় টেবিলে, বই লিপিবদ্ধ করে, মাথা নীচু করে। হঠাৎ কেউ ওর পাশে বসলো, “তুমি রানু, তাই না?” খুব শান্ত একটি স্বর। রানু মাথা উপরে তুলে তাকায়—সামনে গম্ভীর, উচ্চ কণ্ঠে বাসনায় ভর্তি অথচ মনোহর মানুষ দাঁড়িয়ে। “আমি অরুণ। ডিবেট ক্লাব থেকে। তোমাকে আজ দেখলাম—তোমার চোখের ভেতরে চিন্তার গভীরতা আছে। তুমি কি ডিবেটে ইন্টারেস্ট করো?” রানু একটু অশ্বস্ত—তবে উত্তরে বললো, “আমি একটু মেজাজি, চিন্তাশক্তি তোমাদের মতো না, তারপরও শিখতে আগ্রহ আছে।” অরুণ মাথা হেলে সহযোগিতা করল, তারপর বলল, “শুনো, আমি রবিবার একটা সেশন লাইব্রেরিতে করছি, কথা বলবো অনেক বিষয় নিয়ে—চড়া বিতর্ক, যুক্তির প্রয়োগ—এটা তুমি চাইলে যোগ দিতে পারো।” রানুর চোখ চমকে উঠল—এমন অফার কোনোদিন কেউ দেয়নি। কিন্তো নতুন পরিচয় কিছুটা ভয়ও লাগল।
সে রবিবার যেতে হলো। লাইব্রেরির এক দূরপ্রান্তে বড় টেবিলে অরুণ বসে আড্ডা দিচ্ছে। কিছু চিহ্নিত ল্যাপটপ, কাগজপত্র, যুক্তি খাতায় ভরা। চারপাশে দশ জন মেয়ে–ছেলে, সবাই অস্থির আলোচনায় লিপ্ত। অরুণ সম্মতিতে ও দাঁড়িয়ে সবার দিকে তাকিয়ে বলল, “আসলে বিতর্ক ভালভাবে শেখা মানে এক লিটার তেল দিয়ে গাড়ি চালানোর মতো—যদি বুঝে চালাও, ভালো পারফর্ম করবে, না হলে থেমে যাবে মাঝপথে।” সবাই হেসে হাততালি দিল। তখন অরুণ রানুর দিকে তাকিয়ে হাত দিয়ে আহ্বান করল—’চলো তুমি একটু অংশ নাও’। রানু ভয় পেয়ে নড়ল, তারপর উঠে গিয়ে বিযয়ে অংশ নিল—উল্লেখযোগ্য ভাবে হাসল, সোজা উত্তর দিল। অরুণ হাসল অভিমানী—’ভালো’, ‘চমৎকার’ বলে ওদের উৎসাহ দিল। প্রথম মূলমঞ্চে নিজের উপস্থিতি স্বীকৃতি পেলো—কল্পনায়ও সময় নেয় না, কেবল মনোযোগ দিলো অরুণের দিক। সেই প্রথম দিনই রাহুলের গিটার আর কবিতা যেমন ছিল বিশেষ, ঠিক তেমনি অরুণের যুক্তি আর নেতৃত্ব যেন ম ফলপ্রসূ ছোঁয়া।
পরের সপ্তাহগুলোতে রানুর দিনগুলো যেন নতুন চিত্র ভাঙায় সাজছিল। বিশেষ করে দুপুরে ক্যান্টিনে রাহুলের গল্প আর গান, বিকেলে লাইব্রেরিতে অরুণের সঙ্গে যুক্তিবাদ—এই দুই সঙ্গায় ওর বাস্তা গড়ে উঠলো। কেউ হয়তো প্রথম ভালোবাসা, কেউ দ্বিতীয় ভালোবাসা—এই দুটি ছায়ায় রানুর মন আর মন। ওর মনে ধীরে ধীরে গঠিত হচ্ছিল এক অদ্ভুত দ্বন্দ্ব, এক অজ্ঞাত যজ্ঞ, যেখান থেকে কেউ যদি ওকে উদ্ধার করে—হয়তো শান্তি মিলতো। ও একদিন মুখে এড়িয়ে বলেছেন, “এই দুই মানুষ আমার কাছে খুব স্পেশাল, কিন্তু জানি না আমার মনের কোনটা আগে খোলা উচিত।” বন্ধুদের সান্নিধ্যে কথা বলল—তাদের কেউ বলল, “তোমাকে হৃদয়েই ভাবতে হবে, মাথায় ভাবলে হয় না।” কেউ বলল, “একটা সময়ের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, দুজন একই সঙ্গে রাখা ঠিক না।”
রানু ভালোবাসার এই ভাঙন মেনেছিল। তবে তার প্রথম অধ্যায় থাকে শেষ—“চোখের সামনে রাঙা দিনের দৃশ্য”, “দুটো আলোর ঝলকানি”—এগুলো নিয়ে ওর উপলব্ধি বেড়ে যায়। এভাবেই কলেজের প্রথম অধ্যায় চলছে—নতুন পারিপার্শ্বিকতা, নতুন আবেগ, নতুন দ্বন্দ্ব আর নতুন আনন্দের মিশ্রণ।
২
কলেজের গ্রীষ্মকালীন সেমিস্টারের প্রথম মাস কেটে গেল। রানুর জীবনে অদ্ভুত এক টানাপোড়েনের ছাপ পড়তে শুরু করল। রাহুলের হাসি, গান, কবিতা আর অরুণের যুক্তি, বিতর্ক আর বুদ্ধিদীপ্ত কথাবার্তা—দুটো মেরু যেন ওর হৃদয়কে টানতে লাগল দুইদিকে। প্রতিদিন ক্লাস শেষে ও ক্যান্টিনে গিয়ে বসত রাহুলের সঙ্গ পেতে। রাহুল হাসি হাসি মুখে বলত, “আজ তোমাকে একটা নতুন গান শোনাবো”—আর সেকি গান! কোনোদিন মেঘলা আকাশের কথা, কোনোদিন প্রেমের আকুতি, কোনোদিন জীবনের লড়াই। রানুর মন ভরে যেত, বুকের ভেতর কেমন শূন্যতা মুছে যেত। মনে হতো, এ জীবনের সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্তগুলোতে ওর পাশে রাহুল থাকুক।
কিন্তু এরপরেই লাইব্রেরি, সেই বিতর্ক ক্লাবের সভা। সেখানে অরুণের ঠোঁটে অমোঘ হাসি, যুক্তির ধারালো অস্ত্র, আর নিজের অভিজ্ঞতা—সব মিলিয়ে অরুণ যেন রানুর সামনে এক নতুন দুনিয়া খুলে দিত। রানুর চোখ জ্বলজ্বল করত ওর কথা শুনে। যুক্তি কীভাবে মানুষের জীবন পাল্টাতে পারে, কীভাবে বিতর্কে দাঁড়িয়ে নিজের অস্তিত্বের লড়াই লড়তে হয়—অরুণ ওকে যেন অন্যরকম এক শক্তি জোগাত। রানু ওর নিজের মনের ভেতর অদ্ভুত এক যুদ্ধ টের পেত—কখনো রাহুলের গান, কখনো অরুণের যুক্তি, দুটো মিলে যেন ওকে এক অজানা দ্বন্দ্বের দিকে টেনে নিয়ে যেত।
একদিন দুপুরে রানু ক্যান্টিনের এক কোণে বসে নোটস লিখছিল। হঠাৎ রাহুল পেছন থেকে এসে বলল, “রানু, আজ বিকেলে একটু সময় আছে তোমার? একটা ফেস্টিভ্যালের প্রস্তুতি চলছে, তুমি যদি সাহায্য করতে পারো ভালো হয়।” রানু চমকে তাকাল, “ফেস্টিভ্যালের?” রাহুল মুচকি হেসে বলল, “হ্যাঁ, কলেজ ফেস্ট। গান-বাজনা, নাটক—সব। আমি মিউজিক টিমে কাজ করছি, তোমার কবিতা বা উপস্থাপনা থাকলে আমরা সেটাও রাখতে পারি। তোমার জন্য প্ল্যাটফর্মটা খুব দরকার, রানু!” রাহুলের চোখে একরকম আন্তরিকতা—রানুর মনে হলো ওকে এই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়া উচিত নয়। রানু সায় দিল, “ঠিক আছে, বিকেলে আমি আসছি।” রাহুল খুশি হয়ে বলল, “দারুণ! ঠিক চারটায় মিউজিক রুমে।”
বিকেলে রানু যখন মিউজিক রুমে ঢুকল, রাহুল আগে থেকেই ওর জন্য গিটার রিহার্সাল করছিল। ওর চোখে-মুখে স্বপ্নের মতো একরকম উচ্ছ্বাস, যেন নতুন গান লেখা হয়েছে আর সেটাই শোনাবে। রানুকে দেখেই রাহুল বলল, “তুমি এলে, তাই ভালো লাগছে। শোনো, তোমার জন্য একটা গান লিখেছি—শুধু তোমার জন্য।” রানু অবাক, “আমার জন্য?” রাহুল চোখ নামিয়ে গিটার টিপে টিপে বাজাতে শুরু করল, “তুমি আকাশের রঙ, তুমি জলের ঢেউ, তুমি ভোরের আলো—যেখানেই থাকো, আমি খুঁজে নিই।” রানু স্তব্ধ। এমন করে কেউ ওর জন্য গান লিখবে, ও কল্পনাও করতে পারেনি। ওর চোখে জল এসে গেল। রাহুল থামল, “রানু, তুমি জানো না, তুমি আমার জীবনের অনেকখানি জুড়ে আছো।” রানুর গলা শুকিয়ে গেল। ও জানে, রাহুলকে ও অস্বীকার করতে পারবে না। ওর ভেতর কোনো এক স্থানে রাহুলের জন্য একরকম কোমলতা জেগে উঠেছে।
কিন্তু সেই রাতেই লাইব্রেরির কোণের টেবিলে বসে রানু হঠাৎ অরুণকে দেখতে পেল। অরুণ টেবিলে রাখা কিছু বইয়ের মধ্যে মুখ গুঁজে পড়ছিল, যেন খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু পড়ছে। রানুকে দেখেই অরুণ ওর দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, “তুমি একা বসে আছো? আজ তোমার চোখে কেমন যেন কিছু একটা লুকিয়ে আছে।” রানু চমকে উঠল। অরুণ ওর মনের অবস্থা বুঝে ফেলল! রানু কাঁপা গলায় বলল, “আমি…আমি আসলে একটু কনফিউজড, বুঝতে পারছি না কী ঠিক, কী ভুল।” অরুণ ওর দিকে সোজা তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলল, “রানু, জীবনে ভালোবাসা নিয়ে দ্বন্দ্ব থাকতেই পারে। কিন্তু কখনো কাউকে কষ্ট দিয়ে সিদ্ধান্ত নেবে না। যাকে তোমার মনের গভীর থেকে চাও, তাকেই বেছে নিও। দেখো, সম্পর্ক গড়া খুব কঠিন কাজ। অনেক সময় যুক্তি দিয়ে নয়, মন দিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হয়।” রানু অবাক, অরুণের মুখে এমন সহানুভূতি ওর কল্পনারও বাইরে ছিল।
তারপরের কিছুদিন রানু বুঝে উঠতে পারছিল না, কার দিকে ওর মনটা বেশি টানছে। কলেজ ফেস্টের দিন এসে গেল। মঞ্চে রাহুল গিটার হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে। ওর গান শুরু হলো, সেই গান—যা ওর জন্যই লেখা। সারা হল হাততালি দিয়ে উঠল, রানুর বুকের ভেতর ধুকপুক করে কাঁপতে লাগল। রাহুলের গান শেষে রানুর দিকে তাকিয়ে একটা ছোট্ট হাসি দিল। ঠিক তখনই হলের পেছন থেকে অরুণের কণ্ঠ শোনা গেল—“দারুণ! খুব সুন্দর! কিন্তু গান শেষ হলেই আসল খেলা—বিতর্ক।” অরুণ মাইক্রোফোন হাতে নিল। বিতর্কের মঞ্চে দাঁড়িয়ে ওর কণ্ঠ জোরালো হয়ে উঠল, “আজকের বিতর্ক—প্রেম কি শুধুই আবেগ, নাকি যুক্তি দিয়ে বেছে নেওয়া উচিত?” সারা অডিটোরিয়ামে হাসির গুঞ্জন ছড়াল। রানুর কাঁধে কাঁপুনি ধরল। অরুণের চোখ ওর চোখের সাথে মিলল—এক অদ্ভুত চাহনি, যেন সেই প্রশ্ন ওকেই করা। রানু চোখ নামিয়ে নিল।
সেই রাতে রানুর ঘরে মোমবাতির আলোয় ওর ডায়েরি খোলা। পাতায় পাতায় লেখা—‘আমি কার দিকে যাব? রাহুলের গান, অরুণের যুক্তি—দুটো আলাদা জগত। একজন স্বপ্ন দেখায়, আরেকজন বাঁচতে শেখায়। দুজনেই আমার হৃদয়ের দুটো দিক। কাকে ছেড়ে কাকে ধরব?’ রানু লিখতে লিখতে চোখের পানি ফেলল। ওর মন ভাঙতে ভাঙতে তৈরি হলো—‘হয়তো আমাকে কোনো একদিন বেছে নিতেই হবে।’
রাতে ফোনে হঠাৎ রাহুলের মেসেজ—“তুমি কেমন আছো? তোমার ছাড়া গানগুলো কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগে।” রানু আরেকটি মেসেজ পেলে অরুণের—“কাল সকালে লাইব্রেরিতে দেখা করো, তোমার লেখা কবিতা নিয়ে কথা বলব।” রানুর ভেতরেই এক অদ্ভুত স্রোত বয়ে গেল। এ কোন জীবন! একদিকে ভালোবাসা, অন্যদিকে বুদ্ধি আর যুক্তি। মন দ্বিধা নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল রানু।
৩
রানুর ভেতর দিন দিন সেই দ্বন্দ্ব আরো গভীর হয়ে উঠল। রাহুলের হাসি, ওর গানের সুর, সেই দখিনা বাতাসের মতো নরম মায়া—রানুর মনকে কেমন করে ভিজিয়ে দিত। অন্যদিকে অরুণের যুক্তি, ওর কথার ধার, ওর বাস্তবতার টান—সব মিলিয়ে যেন ওর হৃদয়ের এক অন্য খাত খুঁড়ে বের করে আনত। রানু বুঝতে পারছিল না, এই অনুভূতি কোনদিকে ওকে টেনে নিয়ে যাবে।
কলেজ ফেস্টের পরদিনই রানু ক্লাসে ঢোকে, চোখে অদ্ভুত এক বিষণ্ণতা। ক্লাসরুমের করিডোরে রাহুল ওকে দেখে ছুটে আসে। “রানু, তুমি কেমন আছো? কাল তোমার চেহারায় অদ্ভুত কিছু দেখলাম। কোনো সমস্যা হচ্ছে?” রানু ওর চোখের দিকে তাকিয়ে ম্লান হেসে বলল, “তেমন কিছু নয়, রাহুল। একটু মাথা ধরেছে।” রাহুল দমে না। ওর গলার সুর নরম করে বলল, “তুমি জানো, আমি তোমাকে খুশি দেখতে চাই। সবকিছু ঠিক থাকবে, আমি আছি তোমার জন্য।” রানুর বুকের মধ্যে কেমন করে কেঁপে উঠল। সত্যিই তো, রাহুল কত সহজে ওকে ভালোবাসতে শিখিয়েছে। ওর গান, ওর হাসি—সবই রানুর মনের ভেতর এক অদ্ভুত শান্তি বয়ে আনত।
কিন্তু সেদিন সন্ধ্যায় লাইব্রেরির কোণ ঘেঁষা বেঞ্চে বসে রানু অরুণকে পায়। অরুণের মুখে সেই একই গম্ভীর ভাব। ওর হাতে একটা বই—“যৌক্তিকতা ও প্রেম: মানুষের সম্পর্কের গভীর মনস্তত্ত্ব।” রানু হাসতে হাসতে বলল, “তুমি এসব বই পড়ো কেন?” অরুণ গম্ভীর চোখে ওর দিকে তাকাল, “কারণ সম্পর্ক মানেই শুধু আবেগ নয়, সম্পর্ক মানেই বোঝাপড়া, মানে দায়িত্ব, মানে যুক্তি। তুমি যদি প্রেমকে আবেগ দিয়ে বিচার করো, শেষমেষ হয়তো ভেঙে যাবে। কিন্তু যদি একটু যুক্তি খাটিয়ে বোঝো, তখন সম্পর্কটা বাঁচে।” রানু অবাক হয়ে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকল। অরুণের কথায় যুক্তি ছিল, আবার কোথাও যেন কষ্টও ছিল।
সেই রাতেই রানু নিজের ডায়েরি খুলে বসে। লিখল—“আমি কি সত্যিই প্রেমকে শুধু আবেগ দিয়ে বিচার করছি? নাকি ওর মধ্যে একটা নিরাপত্তা খুঁজছি? রাহুলের হাসি আমাকে বাঁচায়, ওর গান আমাকে আনন্দ দেয়। কিন্তু অরুণ—ওর যুক্তি আমাকে ভাবতে শেখায়, ওর তর্ক আমাকে শক্তি দেয়। এ কোন যুদ্ধ? কাকে বেশি চাই? কাকে বেশি প্রয়োজন?” রানু লিখতে লিখতে ক্লান্ত হয়ে গেল। ডায়েরির পাতা ভিজে উঠল অজান্তেই—দু’চোখের অশ্রুতে।
পরদিন সকালে কলেজের করিডোরে অরুণ রানুর দিকে এগিয়ে এল। ওর চোখে সেই একই দৃষ্টি—কঠিন, আবার কোমলও। “রানু, আজ একটু ফ্রি আছো? আমাদের বিতর্ক ক্লাবের একটা নতুন সেশন শুরু হবে। তোমাকে খুব দরকার। আমি চাই তুমি সেখানে থাকো, নিজের মতামত দাও। তুমি জানো, তোমার যুক্তিগুলো অন্যরকম।” রানু ওর দিকে তাকিয়ে রইল। সত্যিই, বিতর্ক ক্লাবে রানু যেদিন উপস্থিত থাকে, সেদিনের সেশনগুলো অন্যরকম প্রাণ পায়। কিন্তু রাহুল? ও তো ওকে ফেস্টের কাজে সাহায্য করার কথা বলেছিল। রানুর মাথা চক্কর খেতে লাগল। ও বুঝতে পারছিল না—কাকে বেশি গুরুত্ব দেবে, কার ডাকে সাড়া দেবে।
সেদিন দুপুরে ক্যান্টিনে বসে রানু নোটস পড়ছিল। হঠাৎ রাহুল এসে ওর পাশে বসল। “তুমি কি আজ বিতর্ক ক্লাবে যাচ্ছ?” রানু ধরা গলায় বলল, “হ্যাঁ, অরুণ বলেছে, আজ নতুন সেশন।” রাহুলের মুখের হাসি মুছে গেল। “তুমি কি জানো, রানু? বিতর্ক ক্লাব মানেই যুক্তির খেলা। কিন্তু জীবনের সবকিছু যুক্তি দিয়ে হয় না। প্রেম যুক্তি মানে না, রানু।” রানু চুপ করে শুনছিল। রাহুলের চোখে জল ঝিলমিল করছে। “তুমি কি আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছ?” রানুর বুকের মধ্যে একটা কষ্টের ঢেউ বয়ে গেল। ও বলল, “না, রাহুল। তুমি জানো, তুমি আমার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কিন্তু আমি…আমি নিজের জায়গাটা খুঁজছি।” রাহুলের চোখ ভিজে গেল, ওর ঠোঁট কাঁপছিল, “তুমি জানো, আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি?”
রানু কোনো উত্তর দিতে পারল না। ওর নিজের বুকের ভেতরেও দ্বন্দ্বের আগুন জ্বলছিল। জীবনে এমন দ্বন্দ্ব হয়, যেখানে বেছে নেওয়ার রাস্তা এত সহজ নয়। একটা চেনা পৃথিবী, যেখানে রাহুলের গান বেজে চলে, আরেকটা অজানা জগত, যেখানে অরুণের যুক্তি প্রশ্ন তোলে। ওর চোখের সামনে রাহুলের মুখ আর অরুণের মুখ—দুটো ভেসে উঠতে থাকল। রাহুলের মুখে কান্না, অরুণের মুখে সেই দৃঢ় দৃষ্টি।
সেদিন রাতে রানু দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের তারা দেখছিল। ওর কানে যেন ভেসে এল রাহুলের গিটার সুর—“তুমি আকাশের রঙ…” আর ওর মনের ভেতর বাজল অরুণের কণ্ঠ—“সম্পর্ক মানেই বোঝাপড়া, দায়িত্ব…” রানুর চোখ বুঁজে এল। ওর মন চিৎকার করে উঠল—“আমি কি কাউকে হারাতে চাই? আমি কি কাউকে কষ্ট দিতে চাই? নাকি আমার নিজের জন্যই পথ খুঁজছি?” ওর বুকের মধ্যে কেমন তোলপাড় শুরু হলো। জীবন বড় কঠিন, বড় অদ্ভুত!
৪
রানুর ভেতরের দ্বন্দ্ব দিন দিন তীব্র থেকে তীব্রতর হতে লাগল। কলেজ ফেস্ট, লাইব্রেরির সেশন, বিতর্ক ক্লাব—সবকিছুতেই রাহুল আর অরুণের ছায়া মিলে মিশে থাকত। দুই মেরুতে দাঁড়িয়ে থাকা এই দুই মানুষের টানাপোড়েন রানুর হৃদয়কে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছিল।
একদিন ক্লাস শেষে অরুণ এসে রানুর পাশে বসল। ওর চোখে সেই একই দৃঢ়তার আভা। “রানু, আমি জানি তুমি আমাকে এড়িয়ে চলছো, কিন্তু আমি চাই তোমার মনের সব দ্বিধা দূর করতে। ভালোবাসা মানে কি শুধু গান আর কবিতা? নাকি জীবনের কঠিন সময়ে কার কাঁধে ভর করবে, সেটাও তো দেখতে হবে।” রানু কিছু বলল না, মাথা নিচু করে থাকল। ও জানে, অরুণ ঠিকই বলছে। শুধু গান, শুধু হাসি, শুধু সুর—এসব কি জীবনের সবকিছু? ওর বুকের ভেতরে হাহাকার উঠল, “আমি কাকে ভালোবাসি? কাকে ভালোবাসা উচিত?”
ঠিক সেই মুহূর্তে রাহুলের মেসেজ এল—“আজ বিকেলে ছাদে চলে এসো, তোমার জন্য গান রেডি আছে।” রানু অবাক হয়ে তাকাল। রাহুলের গান ওর জীবনে আলাদা অর্থ বহন করে। গান মানেই ওর কাছে মুক্তি, স্বপ্ন, রঙিন পৃথিবী। রানুর মন চাইল, একবার অন্তত রাহুলের সেই সুরের জগতে ডুবে যেতে। ওর চোখ বুজে এল, যেন গানের সুর ওর সমস্ত দুঃখ ভুলিয়ে দিতে পারে।
বিকেলে রানু ছাদে গিয়ে দাঁড়াল। চারপাশে মৃদু বাতাস বইছে, আকাশে লাল রঙের আলো। রাহুল গিটার হাতে নিয়ে হাসি হাসি মুখে বলল, “এই যে! আসবে ভেবেছিলামই!” রানু ওর দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি কী গান গাইবে?” রাহুলের চোখে সজলতা—“তোমার জন্যই লিখেছি।” তারপর গিটার বাজিয়ে গাইতে শুরু করল, “তুমি ছাড়া এই আকাশ কেমন ফাঁকা, তুমি ছাড়া এই জীবন কেমন অজানা…” রানুর বুকের মধ্যে কেমন করে কেঁপে উঠল। ওর চোখের কোণ ভিজে এল, অজান্তেই গড়িয়ে পড়ল অশ্রু। রাহুল থামল না। গিটার থামিয়ে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “রানু, আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচতে পারি না। তুমি জানো না, তুমি আমার জীবনের সবকিছু। আমি চাই, তুমি শুধু আমার হও।” রানু কাঁপা গলায় বলল, “রাহুল, আমি…” ওর গলা ধরে এল, কথা শেষ করতে পারল না।
ঠিক সেই মুহূর্তে অরুণ ওদের ছাদের কোণে এসে দাঁড়াল। ওর চোখে অদ্ভুত এক দৃঢ়তার ঝলক। রাহুল চমকে তাকাল, “তুমি এখানে কেন?” অরুণ গম্ভীর গলায় বলল, “আমি এসেছি রানুকে বুঝিয়ে বলতে, ভালোবাসা মানে শুধু গিটার বাজানো নয়, ভালোবাসা মানে সঙ্গ, বোঝাপড়া, নিরাপত্তা। রানু, তুমি কি জানো, তোমার জীবনের লক্ষ্য কী? তুমি কি জানো, তোমার স্বপ্নগুলোকে কার কাঁধে ভর করে রক্ষা করবে?” রানু থমকে গেল। ওর বুকের মধ্যে ধ্বনি তুলল—“আমি কি জানি? আমি কি জানি কার কাছে থাকলে আমার স্বপ্নগুলো বাঁচবে?” অরুণ আবার বলল, “রানু, গান শোনাতে শোনাতে সবাই প্রেমে পড়াতে পারে। কিন্তু প্রেম মানে জীবনের বাস্তবতা। কষ্ট, দায়িত্ব, ত্যাগ—এইগুলোও প্রেমের অংশ। তুমি কি রাহুলের গানেই বাঁচতে চাও, নাকি বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে প্রেমটাকে লড়াই করে বাঁচিয়ে রাখতে চাও?” রাহুল তীব্র গলায় চিৎকার করে বলল, “তুমি আমাকে অপমান করছো অরুণ! তুমি জানো না, রানু আমাকে কতটা ভালোবাসে!” অরুণ শান্ত গলায় বলল, “আমি জানি রানুর মনের টানাপোড়েন। আমি জানি, রানু কার হাত ধরে জীবনের কঠিন রাস্তা পার হবে। আমি ওকে সেই পথ দেখাতে চাই।”
রানুর বুকের মধ্যে কান্নার ঢেউ উঠল। ওর কাঁধে গিটারধারী রাহুলের হাত, অন্যদিকে অরুণের চোখে বাস্তবতার ছায়া। ওর সমস্ত পৃথিবী যেন এক মুহূর্তে গিলে খেল সেই দ্বন্দ্ব। ওর মনে হচ্ছিল, দুটো হাত ওকে টানছে, দুটো পৃথিবী ওকে ডেকে নিচ্ছে। হঠাৎ ওর গলা দিয়ে অস্ফুটভাবে বেরিয়ে এল, “আমি জানি না! আমি জানি না কার হাত ধরি, কার ছায়ায় বাঁচি! আমি কাকে ভালোবাসি, তাও জানি না!” রানু মাটিতে বসে পড়ল, বুকের মধ্যে কান্না চেপে ধরে ফুঁপিয়ে উঠল। রাহুল ওর পাশে বসে ওর কাঁধে হাত রাখল, “রানু, আমি আছি। তুমি ভয় পেয়ো না।” অরুণও সামনে এসে নিচু হয়ে বলল, “রানু, সিদ্ধান্ত তুমি নেবে। কারো জন্য নয়, নিজের জন্য।” রানু চোখ তুলে ওদের দিকে তাকাল। ও জানে, জীবনের সবচেয়ে কঠিন অধ্যায়ের সামনে দাঁড়িয়ে ও।
রাত নামল। ছাদে তিনজন বসে, আকাশে তারা জ্বলছে। বাতাসে মিশে আছে গানের সুর, বাস্তবতার তর্ক আর অজানা কষ্ট। রানুর চোখের কোণে অশ্রু। ওর কণ্ঠের ভেতরে প্রতিধ্বনি বাজছে—“কাকে ভালোবাসি? কাকে ভালোবাসা উচিত? কাকে ছেড়ে কার হাত ধরি?” এই প্রশ্নের উত্তর ওর মন খুঁজছে—হয়তো আগামীকাল, হয়তো আগামী বছর, হয়তো কখনোই পাবে না। কিন্তু এই রাত ওর জীবনে সেই অধ্যায়ের শুরু—যেখানে ভালোবাসা, বাস্তবতা আর স্বপ্নের ত্রিভুজে ওর জীবনের গল্প বোনা হবে।
৫
রাতের ছাদে সেই কান্না, সেই দ্বন্দ্বের কষ্ট নিয়ে রানু কষ্ট করে ঘরে ফিরে এল। আলো নিভে যাওয়া ঘর যেন ওর মনের অস্থিরতার প্রতিফলন। বিছানায় শুয়ে ওর চোখের পাতা নামছিল না—বারবার ভেসে উঠছিল রাহুলের সেই গান আর অরুণের যুক্তির ঝড়। কারো হাত ধরে ওকে এগোতে হবে—কিন্তু কোনটা বেছে নেবে, ও নিজেও জানে না।
পরের দিন কলেজে ঢুকতেই রানু বুঝতে পারল চারপাশে কেমন যেন অদ্ভুত সাড়া পড়ে গেছে। রাহুলের বন্ধুরা ওকে দেখতে পেয়ে মুচকি হাসি দিল, আবার অরুণের বন্ধুরা ওর দিকে কেমন অবাক দৃষ্টিতে তাকাল। কলেজজুড়ে গুঞ্জন ছড়িয়ে গেছে—রানুর দুজন বন্ধু, দুটো মেরু—দুজনেই রানুর প্রেমে। রানু হাঁটতে হাঁটতে ক্যান্টিনের দিকে এগোল। ওখানে গিয়ে দেখল রাহুল আর অরুণ দুজনেই বসে আছে—মুখোমুখি নয়, কিন্তু দুজনের দৃষ্টি রানুর দিকে।
রাহুল প্রথমে কথা বলল, “রানু, আজও বিতর্ক ক্লাবে যাবে?” রানু কিছু বলতে যাচ্ছিল, অরুণ হঠাৎ বলল, “না, ও আজ আমার সঙ্গে লাইব্রেরিতে যাবে। ওকে একটা বই দেখাবো।” রানু হকচকিয়ে গেল। রাহুল তেড়ে উঠল, “তুমি কে অরুণ? ওকে কী করবে তুমি? ও কি তোমার সম্পত্তি?” অরুণও রাগে গর্জে উঠল, “তুমি তো শুধু গান গেয়ে মিথ্যে স্বপ্ন দেখাও, আমি ওকে বাস্তবের গল্প শোনাতে চাই!” রানু অবাক হয়ে দেখল, চারপাশের বন্ধুরা ওদের দিকে তাকিয়ে। রাহুল আর অরুণের কণ্ঠে ক্ষোভ আর ঈর্ষার ঝড়—সেই ঝড় ওর মনের ভেতরে গিয়ে আঘাত করছিল।
ওর চোখ ফেটে জল বেরিয়ে এল। “তোমরা দুইজনেই কেন আমাকে এইভাবে দোটানায় ফেলছো? আমি কি কোনো পুতুল, না কি কোনো ট্রফি? আমাকে বুঝতে দাও, আমাকে একটু সময় দাও।” ওর কণ্ঠে কাঁপুনি ধরে গেল। রাহুল নরম স্বরে বলল, “রানু, আমি তোমাকে হারাতে চাই না। তুমি জানো, আমি তোমার জন্য কত গান লিখেছি, কত স্বপ্ন বুনেছি।” অরুণ শ্বাস ফেলে বলল, “রানু, গানই সবকিছু নয়। সম্পর্ক মানে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বাঁচা, সুখ-দুঃখ ভাগ করে নেওয়া। তুমি কি সেই পথটা নিতে পারবে?” রানু মাটির দিকে তাকিয়ে থাকল—ওর বুকের ভেতর ঝড় বয়ে যাচ্ছে। ও কি গানকে বেছে নেবে? নাকি সেই কঠিন বাস্তবতাকে?
সেই রাতে রানু আর পড়তে পারল না। ডায়েরি খুলে লিখল—“আমার বুকের ভেতর যুদ্ধ চলছে। রাহুলের গান আমাকে স্বপ্ন দেখায়, অরুণের যুক্তি আমাকে বাঁচতে শেখায়। দুজনের হাত ধরে দুইটা রাস্তা বয়ে চলে—একটা ফুলের, আরেকটা কাঁটার। কোনটা আমার? আমি কি গানকে বেছে নিই? নাকি সেই কাঁটামাখা পথকে?” ওর চোখ ভিজে এল অজান্তেই।
পরের দিন কলেজে যাওয়ার আগে রানু ভাবল, আজ আর কাউকে এড়িয়ে যাবে না। সিদ্ধান্ত নিতে হবে। জীবনে কেউ না কেউ কষ্ট পাবে, কিন্তু ওর নিজের স্বপ্নগুলোকে বাঁচাতে হবে। কলেজের লাইব্রেরির কোণে অরুণকে একা বসে থাকতে দেখল। ওর চোখে চিন্তার ছাপ। রানু ওর সামনে গিয়ে বসে বলল, “অরুণ, তুমি আমাকে বুঝতে শেখাও, সেটা আমি জানি। কিন্তু আমার হৃদয়ে আজও রাহুলের গান বেজে চলে। তুমি কি পারবে সেই সুরগুলোকে মুছে দিতে?” অরুণ চোখ নিচু করে বলল, “আমি তোমার সেই গান মুছতে চাই না, কিন্তু আমি চাই তুমি বোঝো, সেই গান একদিন থেমে যেতে পারে। তখন তোমার পাশে কে থাকবে?” রানুর বুকের মধ্যে কষ্টের ঢেউ উঠল। ও বলল, “অরুণ, তুমি আমাকে সময় দাও, আমি নিজেকে খুঁজে নিতে চাই।”
ঠিক সেই মুহূর্তে রাহুল এসে দাঁড়াল। ওর চোখে লাল রক্তিম উত্তাপ। “রানু, আমি জানি, তুমি আমাকে ভালোবাসো। আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচতে পারব না। তুমি কি আমাকে একবার বলবে—তুমি আমার?” রানুর চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। ওর বুকের মধ্যে দুই পৃথিবীর যুদ্ধ। ওর কণ্ঠ কেঁপে উঠল, “আমি…আমি এখনো জানি না। আমি কাউকে কষ্ট দিতে চাই না। আমি শুধু নিজেকে বুঝতে চাই।” রাহুল ফুঁপিয়ে উঠল, “তুমি জানো না, তোমাকে ছাড়া আমার জীবন থমকে যাবে।” অরুণও ওর হাত ধরে বলল, “রানু, আমি তোমাকে ছাড়া একা নই, কিন্তু আমি চাই তুমি নিজেকে খুঁজে পাও। যদি কখনো মনে করো, আমি তোমার সেই মানুষ, তাহলে আমি থাকব।”
রানুর মাথা চক্কর খেতে লাগল। এ কী যুদ্ধ? ও কি একা এ যুদ্ধের ময়দানে দাঁড়িয়ে লড়তে পারবে? ওর বুকের মধ্যে ঘূর্ণিঝড় বয়ে যাচ্ছিল। অরুণের যুক্তি, রাহুলের গান—সব মিলে এক অদ্ভুত কোলাহল। ওর চোখের কোণ থেকে অশ্রু ঝরে পড়ল। ওর কণ্ঠে চাপা কান্না, “আমি…আমি কাকে ভালোবাসি জানি না, কিন্তু আমি নিজেকে খুঁজতে চাই। আমি যদি কারো হাত ধরি, সেটা হবে নিজের মনের ডাকে সাড়া দিয়ে—দয়া করে আমাকে বুঝতে দাও।”
রাহুল মাথা নিচু করল, গিটারের তারে হাত বোলাল। অরুণ ওর দিকে তাকিয়ে থাকল—চোখে অদ্ভুত মমতা। রানু জানে, এই যুদ্ধের সমাপ্তি আজই নয়। এই যুদ্ধ ওর বুকের ভেতরেই চলতে থাকবে—ততদিন, যতদিন না ওর নিজের মন ওকে পথ দেখায়।
৬
সকাল হতে না হতেই রানুর ঘর আলোয় ভরে গেল। আলোর ঝিলিক ওর মনের জটিলতা আর অশ্রুদের ভিজে দাগগুলোয় পড়ে নতুন করে উজ্জ্বল করে তুলল। কিন্তু রানুর মনে সেই দ্বিধা, সেই টানাপোড়েন এখনো রয়ে গেল—রাহুলের স্বপ্নমাখা গানের জগৎ আর অরুণের বাস্তবমুখী সঙ্গ—দুটোই ওকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে।
কলেজে গিয়ে রানু লক্ষ্য করল, রাহুল আর অরুণ দুজনেই দূর থেকে ওকে দেখছে। রাহুলের চোখে এখনো ভালোবাসার সেই অগ্নিশিখা, আর অরুণের চোখে সেই নরম দৃঢ়তার ছাপ। কিন্তু রানুর চোখে শুধুই অস্থিরতা। ও ঠিক করল, আজ কারো মুখোমুখি হবে না, কারো চোখের দিকে তাকিয়ে নিজের মনের জটিলতা বাড়াবে না।
কিন্তু ইচ্ছে থাকলেও সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। লাঞ্চব্রেকে রাহুল ওর সামনে এসে দাঁড়াল, গিটারের স্ট্র্যাপ কাঁধে ঝুলিয়ে, চোখে সেই মায়াবী হাসি। “রানু,” ওর কণ্ঠে মাধুর্য, “কাল রাতে তোমার জন্য একটা গান লিখেছি, শুনবে?” রানু ওর চোখে তাকিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল, তারপর বলল, “রাহুল, আমার এখন গান শোনার মতো মানসিক অবস্থা নেই।” রাহুল থমকে গেল। ওর চোখের আড়ালে হঠাৎ যেন একটা অজানা অন্ধকার নেমে এল। “রানু, তুমি কি আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছ?” রানু ধীরে মাথা নাড়ল, “না রাহুল, আমি কাউকে ছাড়ছি না, কাউকেই আঁকড়েও ধরছি না। আমি শুধু নিজের মনের ভেতর যাচ্ছি—যেটা আমার হওয়া উচিত, সেটা খুঁজে বের করতে চাই।” রাহুলের চোখে অশ্রু জড়িয়ে এল, গিটারটা ওর কাঁধে দুলে উঠল। ওর ঠোঁট কাঁপল, “তাহলে আমাকে গান গাইতেই হবে, যদি তাতেই তুমি একদিন আমার কাছে ফিরতে পারো।”
ও চলে গেল, ওর গিটারটা বেজে উঠল দূরে কোথাও—একটা বেদনার সুরে। রানু চোখ বন্ধ করে শ্বাস নিল, বুকের ভেতর কষ্টের ঢেউ আছড়ে পড়ল।
ঠিক তখন অরুণও এল, লাইব্রেরির করিডর ধরে। ওর মুখে অদ্ভুত শান্তি, কিন্তু চোখে গভীর চিন্তার রেখা। “রানু, আমি জানি তুমি এখন দ্বিধায় ভুগছো, কিন্তু তুমি যদি কখনো অনুভব করো যে বাস্তবতাই তোমার সবচেয়ে বড় বন্ধু—তাহলে আমি তোমার সেই বন্ধু হতে রাজি।” রানু অবাক হয়ে তাকাল। “অরুণ, তুমি এত শান্তভাবে বললে—কোনো দাবি নেই, কোনো অভিমান নেই?” অরুণ মৃদু হাসল, “প্রেম মানে তো শুধু দাবি নয়, প্রেম মানে বিশ্বাস, প্রেম মানে পাশে থাকা। আমি চাই, তুমি নিজের মতো করে বড় হও। নিজের মতো করে স্বপ্ন দেখো, তারপর যদি মনে হয়, সেই স্বপ্নের পাশে আমি থাকা উচিত—তাহলে আমি থাকব।” রানু ওর কথায় নিজের চোখের জল মুছল। অরুণের কথাগুলো যেন বুকের ভেতর আশ্বাস হয়ে দোলা দিল, যেন অজানা আশ্রয়ের হাতছানি।
সন্ধ্যার দিকে রানু ছাদে গিয়ে দাঁড়াল। আকাশে ঝলমলে তারা, বাতাসে অদ্ভুত শীতলতা। দূর থেকে ভেসে এল রাহুলের গিটারের সুর—হয়তো ওরই জন্য লিখছে ও গান। রানু শিউরে উঠল। ওর মনের মধ্যে সেই গান ভাসতে থাকল—“তুমি ছাড়া এই আকাশ, তুমি ছাড়া এই পৃথিবী…” আরেকদিকে অরুণের কথাগুলো ওর মনে স্পষ্ট হয়ে বাজল—“প্রেম মানে শুধু গান নয়, প্রেম মানে জীবনকে আগলে রাখা।” রানুর বুকের ভেতর দুরুদুরু শব্দ। ওর মনে হলো, দুটো পৃথিবী, দুটো হাত ওকে ডাকছে—একটা সুরের মায়াজাল, আরেকটা বাস্তবতার আলোছায়া।
হঠাৎ রানু আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি কি পারব নিজের মতো করে বাঁচতে? আমি কি পারব এই অস্থিরতা থেকে বেরিয়ে আসতে?” বাতাস ওর চুলে খেলা করল। ওর বুকের ভেতর থেকে কণ্ঠে এল নিঃশব্দে, “আমি পারব, আমাকে পারতে হবে।” ওর চোখে অদ্ভুত এক দৃঢ়তা খেলে গেল। ও জানে, এই সিদ্ধান্ত ওকেই নিতে হবে, আর কাউকে নয়।
রানু সেদিন রাতে ডায়েরিতে লিখল, “আমি এখনো জানি না কাকে ভালোবাসি, কিন্তু আমি জানি—আমি কাউকে কষ্ট দিয়ে প্রেম করতে চাই না। আমি জানি, আমি যেমন সুর ভালোবাসি, তেমনি বাস্তবতাকেও ভয় পাই না। আমি জানি, আমি নিজের মতো করে স্বপ্ন দেখতে চাই, গান শুনতে চাই, আর জীবনের কঠিন পথ পেরোতে চাই। যে আমার সেই যাত্রায় সঙ্গী হবে, তাকেই আমি ভালোবাসব।”
৭
সকালটা কুয়াশাচ্ছন্ন ছিল, কলেজের গেট পেরিয়ে হাঁটার সময় রানুর বুকের মধ্যে কেমন যেন শূন্যতা ছেয়ে গিয়েছিল। রাহুল আর অরুণ—দুজনেই আজ ওকে স্পষ্ট বুঝিয়ে দিয়েছে যে ওর সিদ্ধান্তটাই ওদের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে। রানুর কাঁধে যেন অদৃশ্য কোনো বোঝা চেপে বসেছে। ওর চোখের সামনে ভাসছে রাহুলের সেই গানবোনা দৃষ্টি, অরুণের দৃঢ়চিন্তার শান্ত হাসি। রানু জানে, আজ নয়তো কাল, ওকে নিজের মনকে বোঝাতে হবে—কে ওর হৃদয়ের সবচেয়ে আপন।
কলেজের করিডর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে রানু দেখল, রাহুল ক্যান্টিনের পাশে গিটারের কেসটা নিয়ে বসে আছে। ওর চোখে দুঃখ আর আকুতি। ওর আঙুলের স্পর্শে গিটারটা যেন কান্নার সুর তুলছে। রানুর বুক কেঁপে উঠল। ওর মনে পড়ল সেই প্রথম দিনটার কথা, যখন রাহুল হোস্টেলের বারান্দায় বসে ওর জন্য গান গেয়েছিল, “তুমি এলে, পৃথিবীর রঙ বদলে গেল।” সেই সুর ওকে স্বপ্ন দেখিয়েছিল, ওর মন ছুঁয়ে গিয়েছিল। রানু জানে, ও সেই স্বপ্নটাকে ভালোবেসেছিল—তখন অন্তত তাই ভেবেছিল। কিন্তু এখন? এখন ও জানে, জীবনের স্বপ্নগুলো কেবল গানের সুরে বাঁচে না।
ঠিক তখনই অরুণ লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে এল, ওর চোখে চিন্তার রেখা, কিন্তু মুখে সেই শান্ত ভরসা। ও ওর দিকে তাকিয়ে বলল, “রানু, আমি জানি তুমি কষ্ট পাচ্ছ। আমি চাই না তুমি আর দ্বিধায় থাকো। তুমি যদি আমাকে না চাও, আমি সরে যাব, কিন্তু তুমি যদি চাও—তাহলে আমি আছি, শুধু তোমার জন্য।” রানুর বুকের মধ্যে কেমন যেন কেঁপে উঠল। অরুণের কথায় দায়িত্ববোধ আর ভালোবাসার মধ্যে অদ্ভুত একটা স্থিতি আছে। রানু বুঝতে পারল, অরুণের ভালোবাসা শুধু উড়ন্ত স্বপ্ন নয়, বরং জীবনের কঠিন রাস্তাগুলোতেও ওর পাশে থাকবার প্রতিশ্রুতি।
সন্ধ্যায় ছাদে দাঁড়িয়ে রানু আকাশের তারা দেখছিল। মনের মধ্যে রাহুলের গিটার বেজে উঠল, “তুমি ছাড়া আমি কিছুই বুঝি না…” সেই সুর ওকে শিহরিত করে তুলল, কিন্তু ওর ভেতরেই প্রশ্নের ঢেউ উঠল—এই সুর কি ওর জীবনের সমস্ত দায়িত্বকে নিতে পারবে? ও কি গান দিয়ে বাস্তবের কষ্টগুলোকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারবে? রানু চোখ বন্ধ করল, বাতাসে অরুণের কণ্ঠ ভাসল—“আমি তোমার সেই ছায়া, যে ঝড়ে, রোদে, বৃষ্টিতে সবসময় থাকবে।”
রাত গভীর হল, রানু ডায়েরি খুলল। লিখল—“আমি জানি, প্রেম মানে শুধু গান নয়, শুধু কবিতা নয়। প্রেম মানে বাস্তবতাকে বুকে টেনে নেওয়া, জীবনের ঝড়ঝাপটায় একসাথে দাঁড়িয়ে থাকা। রাহুল আমাকে স্বপ্ন দেখিয়েছে, কিন্তু সেই স্বপ্নের ভেতরে অনেক শূন্যতা। অরুণ আমাকে মাটিতে দাঁড়াতে শিখিয়েছে, জীবনের কষ্টগুলোকে শক্ত করে বুকে নিয়ে হাঁটতে শিখিয়েছে। আমি কাকে চাই—সেই উত্তর হয়তো এখনো পুরোপুরি পাইনি, কিন্তু আমি জানি, যে আমার পাশে থেকে আমার সব অশ্রু মুছে দেবে, যে আমার সবকিছু বুঝে নিয়ে হাসি ফিরিয়ে দেবে, সেই আমার কাছে সবচেয়ে আপন। আমি জানি, এই সিদ্ধান্ত আমাকে নিতে হবে, এবং সেই সিদ্ধান্তই আমার জীবনের গল্প হবে।”
পরের দিন কলেজে গিয়ে রানু দেখল, রাহুল আর অরুণ দুজনেই অপেক্ষা করছে। রানু ধীরে ধীরে ওদের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। দুজনের চোখেই অদ্ভুত উত্তেজনা, কৌতূহল। রানু গভীর শ্বাস নিল, ওর কণ্ঠে দৃঢ়তা, “রাহুল, আমি তোমার গানকে ভালোবেসেছি, কিন্তু আমি চাই না কেবল গানের সুরে বাঁচতে। অরুণ, আমি তোমার বাস্তবতাকে দেখেছি, কিন্তু আমি চাই না শুধু যুক্তির কাঠামোয় থাকতে। আমি চাই এমন একজনকে, যে আমার স্বপ্নগুলোকে ভালোবাসবে, আবার আমার বাস্তবতাকেও আগলে রাখবে। সেই মানুষটা হয়তো তোমাদের মধ্যে একজন, আবার হয়তো না। কিন্তু আজ আমি কাউকে বেছে নিচ্ছি না। আমি নিজেকে খুঁজতে চাই, নিজের মতো করে।” রানুর কণ্ঠে কাঁপুনি এসে গেল, চোখে জল টলমল করল।
রাহুল ধীরে মাথা নিচু করে বলল, “রানু, আমি তোমাকে হারাতে চাইনি, কিন্তু আমি চাই তুমি নিজের মতো করে বাঁচো। আমি আজও তোমাকে ভালোবাসি, এবং সারাজীবন ভালোবাসব।” অরুণও ওর দিকে তাকিয়ে শান্তভাবে বলল, “রানু, আমি তোমার জীবনের সব সিদ্ধান্তে পাশে থাকতে চাই, কিন্তু সিদ্ধান্তটা তোমার। আমি জানি, তুমি ঠিক পথ বেছে নেবে।”
রানু ওদের দুজনের হাত ধরে বলল, “ধন্যবাদ, তোমরা আমাকে বোঝার চেষ্টা করছো। আমার জীবনের গল্প হয়তো এখানেই শেষ নয়—হয়তো এই গল্পের নতুন অধ্যায় শুরু হবে, যখন আমি নিজেকে খুঁজে পাবো। তখন হয়তো তোমাদের মধ্যে একজন আমার পাশে থাকবে, আবার হয়তো নতুন কেউ এসে আমার হাত ধরবে। কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত আমি তখনই নেব—যখন আমার মনের দ্বিধা কেটে যাবে।”
৮
রানুর জীবনে নতুন সকাল। রাতের সমস্ত অশান্তি, দ্বন্দ্ব, কান্না—সব কিছু ভিজে ভিজে মুছে গেছে একরকম। যেন সেইসব অন্ধকারকে সরিয়ে দিয়ে আজকের সকাল তাকে নতুন আলোয় স্নান করিয়ে দিতে এসেছে। আকাশের রোদ হেসে উঠছে, পাখিরা ডেকে চলেছে অবিরাম। রানু ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সেই আলো আর পাখির গান নিজের মধ্যে গ্রহণ করল, বুক ভরে শ্বাস নিল।
কলেজে পৌঁছে সে ভাবল, আজ কারো সাথে বিশেষ কোনো কথা বলবে না—কোনো প্রতিশ্রুতি নয়, কোনো কষ্টের হিসেব-নিকেশ নয়, শুধু নিজের মতো করে কাটাবে দিনটা। কিন্তু ভাগ্যের অদ্ভুত খেলা—রাহুল আর অরুণ দু’জনেই ক্লাসরুমের ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে। ওরা রানুকে দেখেই এগিয়ে এল, যেন দু’জনেই একইসাথে কিছু বলতে চায়। রানুর বুকের ভেতর ধুকপুকিয়ে উঠল—এখনও কি ওর সেই দ্বিধার রেশ কাটেনি?
প্রথমেই রাহুল বলল, “রানু, আমি গান নিয়ে থাকি, স্বপ্ন নিয়ে থাকি। কিন্তু আমার গানগুলো যে কষ্ট নিয়ে লেখা, সেটা তুমি কখনো বুঝতে চাওনি। আমি যে তোমার জন্য কেঁদেছি, সেই কান্নার শব্দটা হয়তো তোমার কানে পৌঁছায়নি। কিন্তু আজও আমার সুরে তোমার নাম লেখা আছে।” ওর চোখে জল চিকচিক করে উঠল।
অরুণ পাশে দাঁড়িয়ে ধীরে বলল, “রানু, আমি জানি, আমি তোমাকে গান দিতে পারি না, কিন্তু আমি তোমাকে ভালোবাসি—একটা নিরাপদ আশ্রয়ের মতো। আমি চাই, তুমি নিজের মতো করে বাঁচো, নিজের মতো করে স্বপ্ন দেখো। যদি কখনো মনে হয়, সেই স্বপ্নে আমার জায়গা আছে—তাহলে আমি আছি, সবসময়।”
রানু ওদের দু’জনের দিকে তাকিয়ে রইল। দুটো মানুষ—দুটো পৃথিবী। রাহুলের সুরেলা দৃষ্টি ওকে মুগ্ধ করেছে, অরুণের শান্ত ভালোবাসা ওকে সান্ত্বনা দিয়েছে। ও বুঝতে পারল, এই গল্পের শেষ ওর সিদ্ধান্তে নয়, বরং ওর জীবনের নতুন পথে লেখা হবে।
সন্ধ্যায় রানু বাড়ি ফিরল। ওর মা ওর চোখে চিন্তার রেখা পড়ে ফিসফিস করে বলল, “রানু, মেয়ে, এভাবে কষ্ট পেয়ে পেয়ে মনটা শক্ত করে ফেলিস না। কারো জন্য তোর মনকে ভাঙিস না। জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষক সময়। সময়ই সব শিখিয়ে দেয়।” রানু মায়ের হাতে হাত রেখে বলল, “মা, আমি জানি, এখনো আমি সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারিনি। কিন্তু আজ থেকে আমার সিদ্ধান্ত হবে—আমি নিজের মতো করে বাঁচব। আমি আমার স্বপ্নকে, আমার বাস্তবতাকে ভালোবাসব, আর সেই ভালোবাসার মধ্যে যে থাকবে—সে-ই আমার আপন।”
রাতের খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে রানু ডায়েরি খুলল। লিখল:
“আজ থেকে আমি কাউকে নিজের জীবনবোধের বেড়াজালে বেঁধে রাখতে চাই না। আমি চাই, আমার গানও থাকবে, আমার স্বপ্নও থাকবে, আবার আমার মাটির বাস্তবতাও থাকবে। আমি চাই না, আমার জীবনের গল্প শেষ হোক কোনো একক মানুষের জন্য। আমি চাই, আমার গল্প প্রতিদিন নতুন করে শুরু হোক, নতুন স্বপ্ন, নতুন আলো নিয়ে। যে সেই স্বপ্নগুলোকে আঁকড়ে ধরে আমার হাত ধরবে—সে-ই আমার আপন। ততদিন পর্যন্ত আমি নিজের ভেতরেই নিজের ভালোবাসা খুঁজে ফিরব।”
সেই লেখা শেষ করে রানু মনে মনে বলল, “আজকের গল্প এখানেই শেষ নয়। এই গল্পের শেষটা আমি লিখব নিজের মতো করে—সময়ের কাছে, জীবনের কাছে, নিজের কাছে। হয়তো রাহুল, হয়তো অরুণ, হয়তো অন্য কেউ—কিন্তু আমার গল্পে থাকবে আমার নিজের ভালোবাসার ছাপ।”
আকাশে তখন জ্যোৎস্না ঝিকমিক করছে। বাতাসে অদ্ভুত সুর—রাহুলের গিটারের, অরুণের কথার, রানুর স্বপ্নের। সেই সুরের ভেতর দিয়ে রানু হেঁটে চলে গেল নিজের গল্পের নতুন অধ্যায়ের দিকে।
—