Bangla - রহস্য গল্প

রঙিন চোখের খুনি

Spread the love

অভিরূপ সেন


শহরের এক অভিজাত এলাকায় সকালের শান্ত পরিবেশটা যেন আচমকাই ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল পুলিশের সাইরেনে। পান্থপথের পাশের বহুতল বিল্ডিং—‘সিলভার ওক টাওয়ার’—যার একাদশতলার ১১-বি ফ্ল্যাট থেকে ভেসে এসেছিল এক নারীর ভীতিকর চিৎকার, পরে যা নিস্তব্ধতায় রূপ নেয়। কয়েক মিনিটের মধ্যেই সেখানে হাজির হয় কলকাতা পুলিশের ক্রাইম ব্রাঞ্চের এসিপি নীলাঞ্জনা সরকার। ভিতরে ঢুকেই তার অভিজ্ঞ চোখে ধরা পড়ে অস্বাভাবিক নিস্তব্ধতা। ড্রয়িংরুমে ছড়িয়ে থাকা রক্ত, উল্টে থাকা চেয়ারের ছায়া এবং একটি পড়ে থাকা ওয়াইনগ্লাস। ঘরের মাঝখানে পড়ে আছে তরুণী মেয়েটির নিথর দেহ, যার চোখদুটো যেন অস্বাভাবিকভাবে উজ্জ্বল। নীলাঞ্জনা হাঁটু গেড়ে বসে, লাশের চোখের দিকে তাকায়। কনট্যাক্ট লেন্স—কিন্তু সেগুলি স্বাভাবিক নয়। একটিতে সবুজের ছোঁয়া, অন্যটিতে হালকা বেগুনি। চোখদুটো যেন কথা বলছে, যেন প্রশ্ন করছে—“তুমি কি আমার চোখে নিজেকে দেখতে পাও?” ত্রস্ত কণ্ঠে ফরেনসিক টিমের সদস্য বলে ওঠে, “ম্যাম, এটাই খুনির স্টাইল… ঠিক আগের খুনটার মতো।” নীলাঞ্জনার চোখ স্থির হয়ে যায় লাশের ঠোঁটে—সেখানে ঠোঁট রং করার বদলে আছে একটা হালকা লিপস্টিকের রেখা, আর পাশেই টান দিয়ে লেখা: “Look closer…”

পেছনের দেয়ালে একটি অর্ধেক মুছে যাওয়া আয়না, যার মধ্যে একটা ছায়া দেখতে পান নীলাঞ্জনা। নিজের মুখের সঙ্গে সেই ছায়ার মিল খুঁজে পাওয়া যায় না, বরং মনে হয় কে যেন অন্য কেউ তাকিয়ে আছে। তিনি ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ান। পেছন থেকে অফিসার বিজয় বলেন, “ম্যাম, এই মেয়েটির নাম অরুণা লাহা। বয়স ২৭। এককথায় একজন সফল আর্ট গ্যালারি কিউরেটর। রাত ৯টার সময় শেষবার সিসিটিভিতে দেখা গেছে তাকে লবিতে ঢুকতে। তারপর থেকে এই মৃত্যু।” নীলাঞ্জনা সামনে হাঁটেন, জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ান। নিচে শহরের কোলাহল, অথচ ওপরে, এই উচ্চতায়, যেন এক নিঃশব্দ মৃত্যু তার অস্তিত্ব ছড়িয়েছে। তারপর তার চোখ পড়ে দেয়ালের পাশে রাখা এক ছোট টেবিলে—সেখানে রাখা একটি কার্ড, খুব সাধারণ দেখতে। তুলে নেন তিনি। তাতে লেখা: “Beauty is in the eye of the killer.” লিখনভঙ্গিতে শিশুসুলভ অস্পষ্টতা, কিন্তু বেছে নেওয়া শব্দে আছে গভীর বুদ্ধির ছাপ। হঠাৎ মনে পড়ে যায়—পাঁচ মাস আগে দক্ষিণ কলকাতার এক বৃদ্ধার খুনের পরেও এমন একটি কার্ড পাওয়া গিয়েছিল। সেখানেও ছিল রঙিন কনট্যাক্ট লেন্স। তবে দুই কেসে কোনো সম্পর্ক পাওয়া যায়নি, কারণ টার্গেটের ধরণ ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। এবার, এই মৃত্যু যেন খুনির হাতিয়ারকে প্রকাশ্যে নিয়ে এলো—চোখ।

ফ্ল্যাট ছাড়ার আগে নীলাঞ্জনা একবার ঘরের চতুর্দিকে ভালোভাবে তাকান। তার অভ্যন্তরে একটা অদ্ভুত খটকা লাগছিল। মনে হচ্ছিল কেউ এখনো এই ঘরেরই কোথাও থেকে যাচ্ছে—দেয়ালের মাঝে, ছায়ার ভিতর, অথবা হয়তো আয়নার ওপার থেকে তাকিয়ে আছে তার চোখে। নিচে নামার সময় সাংবাদিকরা হুমড়ি খেয়ে পড়ে—কেউ কেউ আগেই খবর পেয়ে এসেছে। ক্যামেরার আলো ঝলসে উঠতেই তিনি হঠাৎ থেমে গিয়ে বলেন, “এই হত্যাকাণ্ড পূর্বপরিকল্পিত। খুনি শুধু হত্যা করেনি, একটি বার্তা রেখেছে। এবং আমরা তা খুঁজে বের করব।” সেখান থেকে বেরিয়ে নীলাঞ্জনা গাড়িতে উঠে বসেন। চুপচাপ। বাইরের শহরটা যতই নড়ে, তার ভিতরের মন যেন থেমে আছে একটা বিশেষ সময়ের দরজায়। একটি পুরনো স্মৃতি ফিরে আসে—ছোটবেলা, হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে থাকা তার বাবা, শেষবার তাকিয়ে ছিল তার দিকে। বাবার চোখে কী দেখেছিলেন তিনি তখন? ভয়? দুঃখ? নাকি অপরাধ? সেই চোখের স্মৃতি আজ আবার জেগে উঠেছে। তার নিজের চোখে যেন আজ কেউ ঢুকে গেছে—কেউ যে তাকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে বলেছে, “তুমি কি আমার চোখে নিজেকে দেখতে পাও?” নীলাঞ্জনা জানেন, এই খুনি একা নয়, তার চোখের ভিতর হয়তো লুকিয়ে আছে এক ভয়ানক অতীত, যাকে ডিকোড করতে গেলে তাকেও দেখতে হবে নিজের চোখের গভীরে।

বেলা ঠিক দুপুর দুটো। পুলিশ হেডকোয়ার্টারের কনফারেন্স রুমে নীলাঞ্জনা তাকিয়ে আছেন এক টিভি স্ক্রিনের দিকে, যেখানে মেয়র সাহেব সংবাদমাধ্যমকে বলছেন, “এই শহর নিরাপদ। একক-দুটি বিচ্ছিন্ন ঘটনার জন্য আতঙ্ক ছড়ানো অনুচিত।” কিন্তু সেই সময়ই তার টিমে ঢোকেন কনস্টেবল রতন, কানে কানে বলেন, “ম্যাম, নিউ আলিপুরে আরেকটা খুন হয়েছে। আবার চোখ… রঙিন।” নীলাঞ্জনা কোনও কথা না বলে দ্রুত উঠে দাঁড়ান। গাড়িতে বসতেই তাকে ফাইলটি ধরিয়ে দেয় অফিসার বিজয়। ভিতরে লেখা—সৌগত মুখার্জি, বয়স ৪৫, রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী, মৃতদেহ পাওয়া গেছে নিজের ব্যক্তিগত অফিসে। ঠিক আগের খুনের মতোই, লাশের চোখে রঙিন কনট্যাক্ট লেন্স—এইবার একটিতে নীল রঙের মাঝে কালো ছায়া, অন্যটিতে সোনালি ও লাল মিলিয়ে এক অদ্ভুত আভা। ফাইলের সঙ্গে থাকা ছবিতে দেখা যায়, তার মুখ অর্ধেক খোলা, ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি, যেন মৃত্যুর ঠিক আগের মুহূর্তে কেউ তাকে কিছু বলেছিল—অসামান্য, ভয়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা হাসি। দৃশ্যপট এমন, যেন খুনি আবার নিজের নিদর্শন রেখে গেছে, কিন্তু ফিঙ্গারপ্রিন্ট, ডিএনএ, কিছুই নেই। কনট্যাক্ট লেন্স ছাড়া, কোনও ক্লু নেই। পুলিশ এবারও কিছু খুঁজে পায় না, কিন্তু একটা জিনিস ঠিক আগের মতোই—লাশের পেছনে রাখা একটি আয়না। আর আয়নার নিচে সাদা কাগজে লেখা: “Eyes don’t lie. People do.”

মৃতের স্ত্রী, সৌমি মুখার্জি, পুলিশকে জানান—গতরাতে সৌগত বাড়ি ফেরেনি। তিনি ভেবেছিলেন, অফিসেই রাত কাটিয়েছেন। তাদের বৈবাহিক সম্পর্ক অতটা মধুর ছিল না। এমনকি সৌগতের কিছু গোপন সম্পর্ক নিয়েও কানাঘুষো চলত। অফিসের সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, রাত ১১টা ১৪ মিনিটে একটি ছায়ামূর্তি ঢুকছে—ক্যামেরায় মুখ অস্পষ্ট, কিন্তু চলাফেরা আত্মবিশ্বাসে ভরা। কিছু সময় পরেই লাইট নিভে যায়। আর সকালের আগে কেউ বেরোয়নি।
এই ঘটনার পর মিডিয়া উত্তাল হয়ে ওঠে। খবরের কাগজে হেডলাইন ছাপে—“রঙিন চোখে শহরের আতঙ্ক”, “চোখের ভেতর লুকোনো মৃত্যু”, “Who’s next?” নীলাঞ্জনার উপর প্রেসারের পাহাড়। কমিশনার দীনেশ বসু নিজে তাকে ফোন করে বলেন, “এটা যদি সিরিয়াল কিলার হয়, আমরা শহর হারিয়ে ফেলব। সময় কম, নীলাঞ্জনা।”
ঘটনার পেছনের কারণ খুঁজতে গিয়ে নীলাঞ্জনা অর্ক সেনের সঙ্গে কথা বলেন। অর্কের মতে, “খুনির কাছে চোখ একটা প্রতীক—সম্ভবত সত্য আর পরিচয়ের। কেউ হয়তো একসময় তার চোখ নিয়ে ব্যঙ্গ করেছে, অপমান করেছে। এখন সে সেই চোখ দিয়ে প্রতিশোধ নিচ্ছে। রঙিন কনট্যাক্ট লেন্স দিয়ে হয়তো সে নিজেকে নতুন রূপে সৃষ্টি করছে। আর সেই সৃষ্টির মাঝেই সে অন্যদের ধ্বংস করছে।”
এমন সময় সাংবাদিক তানিয়া ঘোষ এক নতুন সূত্র সামনে নিয়ে আসেন। সে খোঁজ পান—দু’জন নিহতই একসময় একই বোর্ডিং স্কুলে পড়েছিল। যদিও বয়সে খানিকটা পার্থক্য ছিল, কিন্তু দু’জনেই রামকৃষ্ণ মিশন বয়েজ হোস্টেলের ছাত্র ছিল, বছর দশেকের ব্যবধানে। এই যোগসূত্রটুকুই যেন প্রথমবার খুনির অতীতের দরজা খুলে দেয়। নীলাঞ্জনা মনে মনে ভাবেন, “একজন খুনি যদি টার্গেট ঠিক করতে শুরু করে স্কুল জীবন থেকে, তাহলে সেই স্মৃতি কত ভয়াবহ ছিল, সেটা কল্পনাও করা যায় না।”

রাত গভীর হতে থাকে, আর শহরের বাতাসে গা ছমছমে চাপা একটা সুর বাজতে থাকে। নিজের কেবিনে বসে নীলাঞ্জনা পুরনো কেস ফাইলগুলো খুঁজে দেখেন। ঠিক ছয় মাস আগে একটা খুনের রিপোর্টে উল্লেখ ছিল—এক বৃদ্ধার চোখে এক অদ্ভুত নীল-সবুজ কনট্যাক্ট লেন্স। সবাই ভেবেছিল ওই মহিলা নিজেই পরে ছিলেন, কিন্তু এখন বোঝা যাচ্ছে, সেটাও ছিল এই একই খুনির কাজ। তার মানে, খুনি অনেক আগে থেকেই খেলাটা শুরু করেছে, শুধু শহর এখন তা বুঝছে।
ঘরের আলো নিভে গেলে আয়নার ছায়ায় নিজের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন নীলাঞ্জনা। তার ভিতরে একটা চাপা প্রশ্ন জমে উঠছে—“এই খুনি যদি চোখ দিয়েই সারা জীবন পরিচয় খুঁজে বেড়ায়, তাহলে আমি নিজে নিজের চোখে কাকে দেখি? একজন পুলিশ? একজন বিচারক? নাকি একজন মানুষ, যার ভিতরেও অন্ধকার জমে আছে?”
আচমকাই তার ডেস্কের ফোনে একটি অজানা নাম্বার থেকে মেসেজ আসে। শুধু একটি লাইন—“তোমার চোখ কি সত্যিই সব কিছু দেখতে পারে, নীলাঞ্জনা?” আর ঠিক নিচে একটি ছবি—নিজের চোখের ক্লোজ-আপ, যা স্পষ্ট বোঝায়, এটি আজ রাতেই কোনোভাবে তোলা হয়েছে। সে চোখে কোনো ভয় নেই, কেবল ছায়ার মতো হাসি। যেন যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে।

বৃষ্টিভেজা শহর যেন নিঃশব্দ হয়ে গেছে। কলকাতার একচিলতে ভোর, স্যাঁতস্যাঁতে গন্ধ, রাস্তার ধারে জমে থাকা জল—সবকিছুই যেন এক নিষ্প্রাণ অবসাদের প্রতিচ্ছবি। নীলাঞ্জনা সরকারের চোখে ক্লান্তি, কিন্তু মন অবিচল। তিনি আজ এক অদ্ভুত ঠিকানার পথে চলেছেন—ড. অর্ক সেন, একসময় পুলিশ একাডেমিতে তার সহপাঠী, আর এখন দেশের নামকরা ক্রিমিনাল সাইকোলজিস্ট। সে এখন থাকে শহরের একটু দূরে, নিজস্ব থেরাপি সেন্টার ‘MindEcho’-তে। গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরের কুয়াশাচ্ছন্ন শহর দেখতে দেখতে তার মনে হচ্ছিল, হয়তো আজই সেই জায়গায় পৌঁছবেন, যেখানে খুনির ছায়া একটু স্পষ্ট হবে।
অর্কের অফিসে ঢুকতেই ঘরের পরিবেশে একধরনের অস্থির নিরবতা। দেওয়ালে বিভিন্ন সিরিয়াল কিলারের মনস্তাত্ত্বিক চিত্র, ছেঁড়া পত্রিকা কাটিংস, আর একটা সাদা বোর্ডে লেখা—“অপরাধ হলো মননশীল বিকৃতি”। অর্ক সামনে এসে দাঁড়ায়। হালকা দাড়ি, অল্প এলোমেলো চুল, কিন্তু চোখে এখনো সেই শান্ত অগ্নিশিখা, যা একসময় নীলাঞ্জনাকে বিস্মিত করত। অর্ক চুপ করে একবার তাকাল তার দিকে, তারপর বলল, “খুনি একজন দেখে—খুব গভীরভাবে দেখে। তার দেখা যেন একটা অস্ত্র। সে নিজের চোখে যেমন নিজেকে দেখতে চায়, অন্যদেরও তেমন করে দেখতে বাধ্য করে।”
নীলাঞ্জনা তাকে বুঝিয়ে বলেন, খুনির প্রতিটি টার্গেটই খুনের আগে হয় আয়নার সামনে দাঁড়িয়েছিল, কিংবা খুনির দিকে তাকিয়েছিল। অর্ক মাথা নাড়ে, তারপর বলেন, “সে চায় লোকেরা তার চোখে তাকাক। কিন্তু আসলে তা নয়। সে চায় লোকেরা নিজের চোখে ‘তাকে’ দেখে ফেলুক। খুনি নিজের অস্তিত্ব অন্যের দৃষ্টিতে খোঁজে। কেউ হয়তো একসময় তার চোখকে অপমান করেছিল, বলেছিল ‘অসুন্দর’, ‘ভয়ংকর’। সেই অপমান তার অস্তিত্বের কেন্দ্র হয়ে গেছে। সে এখন ‘চোখ’ দিয়ে প্রতিশোধ নেয়।” নীলাঞ্জনা তখন নিজের মোবাইল থেকে সেই মেসেজটি দেখায়—খুনি যে তার চোখের ছবি পাঠিয়েছে। অর্ক ঠান্ডা গলায় বলেন, “সে খেলছে, কিন্তু সে কেবল হত্যা করে না—সে পরীক্ষা নেয়। তুমি ভয় পাও কি না, তুমি তাকাতে পারো কি না, সেটা যাচাই করে।”

নীলাঞ্জনা জানতে চান—এই মনস্তত্ত্ব কোথা থেকে আসে? অর্ক একটি পুরনো ফাইল বের করে বলেন, “দেখো, এমন কিছু কেস রয়েছে যেখানে ভিকটিমের চোখে আঘাত করা হয়েছে, কিন্তু তা ছিল সম্পূর্ণ অন্য উদ্দেশ্যে। কিন্তু এই খুনির ক্ষেত্রে, সে চোখ দিয়ে চরিত্র চিহ্নিত করে, বিচার করে। আমি এমন কিছু মডেল তৈরি করেছি যেখানে মনে হয়, সে হয়তো নিজেকে ঈশ্বররূপে কল্পনা করে—যার চোখে তাকালে পাপী ধরা পড়ে। এমন মনস্তত্ত্ব শিশু বয়সে গড়ে ওঠে—সাধারণত দীর্ঘকালীন অপমান, অবহেলা কিংবা ভয়ের মধ্যে বড় হয়ে উঠলে।”
হঠাৎ নীলাঞ্জনার মনে পড়ে যায় একটা ছোট্ট ঘটনা—স্কুলে পড়াকালীন এক ছেলেকে দেখে সে আর তার বন্ধুরা হেসেছিল, কারণ তার এক চোখ ছিল নীল, অন্যটা বাদামী। “ওর চোখ দেখে ভুতের মত লাগছে” — এটা নীলাঞ্জনা নিজেও বলেছিল। ছেলেটির নাম ছিল… মনে পড়ছিল না। কিন্তু তার মনে হচ্ছিল, এই খুনি যদি সেই সময়ের কেউ হয়? যদি এমন কেউ হয়, যে স্কুল জীবন থেকেই গড়ে তুলেছিল ঘৃণা ও প্রতিশোধের নীলচে আয়না?
অর্ক তখন নীলাঞ্জনার দিকে একটু গভীরভাবে তাকিয়ে বলেন, “তোমার অতীতে কেউ কি এমন কাউকে চেনো, যে দৃষ্টি নিয়ে অতিমাত্রায় সংবেদনশীল ছিল?” নীলাঞ্জনা এক মুহূর্ত চুপ থেকে মাথা নাড়ে—“এখনো মনে করতে পারছি না। তবে খুনি আমাকে ব্যক্তিগতভাবে পর্যবেক্ষণ করছে, সেটুকু নিশ্চিত।”
অর্ক হঠাৎ বলে ওঠে, “খুনি এখন আর খেলা খেলছে না, সে নিজেকে তোমার সঙ্গে তুলনা করতে শুরু করেছে। তুমি পুলিশ—যে সত্যের চোখে দেখে। আর সে নিজেকে দেখায় সত্যের নতুন রূপে—রঙিন চোখে। সে চাইবে, তুমি তার চোখে তাকাও, এবং নিজের গভীরতা খুঁজে পাও। এটি আর কেবল অপরাধ নয়, এটি এক জৈবিক, মানসিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা।”

দুপুর গড়িয়ে বিকেল নেমে আসে। বাইরে মেঘ জমেছে। ‘MindEcho’ সেন্টার থেকে বেরিয়ে নীলাঞ্জনা গাড়িতে বসে থাকেন কিছুক্ষণ। অর্কের কথাগুলো ঘুরপাক খায় মনের মধ্যে। খুনি যদি সত্যিই তার অতীতকে জানে, তাহলে সে কি নীলাঞ্জনার ভেতরের অপরাধবোধের সঙ্গেও খেলছে? তার বাবার মৃত্যু, তার নিজের ছোটবেলার ভুল মন্তব্য… সব কিছু কি আজ ফিরে আসছে এই এক জোড়া চোখের মধ্যে দিয়ে?
গাড়ির জানালায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখে নীলাঞ্জনা মনে মনে ভাবেন—এই চোখ দিয়ে সে এত বছর ধরে অপরাধ দেখে এসেছে, বিচার করেছে। কিন্তু যদি এই চোখই কখনো ভুল দেখে? যদি খুনি একদিন তার চোখ দিয়েই তার আত্মাকে ধ্বংস করে দেয়?
ঠিক সেই মুহূর্তে আবার একটা মেসেজ আসে—“তুমি কি জানো, আয়না আসলে কার জন্য থাকে?” সাথে একটি নতুন ছবি—একটি কাটা পুতুল, যার চোখে রঙিন কনট্যাক্ট লেন্স। এই খুনি শুধু খুন করছে না, সে তৈরি করছে একটি গল্প—নীলাঞ্জনার চোখ দিয়েই সে লিখছে তার নিজের ছায়াকাব্য।

এক সন্ধ্যায় নীলাঞ্জনার টেবিলে এসে জমা পড়ে একটি মোটা বাদামি খাম। ভিতরে দুটো অদ্ভুত জিনিস—একটি জলরঙে আঁকা চিত্র, যেখানে কেবল চোখ, বড় বড় চোখ, যার মণিতে প্রতিফলিত হচ্ছে মৃত মুখ। এবং দ্বিতীয়ত, একটি ছোট্ট কাগজে লেখা—“চোখ কখনো মিথ্যে বলে না, শিল্প শুধু তাকে জীবিত রাখে।” ছবির নিচে স্বাক্ষর—“S.D.”। ঠিক সেই মুহূর্তেই তানিয়া ঘোষ ফোন করে জানায়, উত্তর কলকাতার এক পুরনো গ্যালারিতে একজন লোক প্রায় এক বছর ধরে শুধু মানুষের চোখ আঁকছে। শিল্পীর নাম সঞ্জয় দত্ত—কিন্তু স্থানীয়দের মতে, সে নিজের নাম খুব একটা প্রকাশ করে না, কিছুটা কুয়াশার মতো মানুষ। নীলাঞ্জনা, বিজয় ও ফরেনসিক ফটোগ্রাফার নিয়ে পৌঁছে যান সেই গ্যালারিতে। বাইরে থেকে নিরীহ কাঠের দরজা, ভিতরে ঢুকতেই যেন ঢুকে পড়া যায় অন্য এক জগতে। চারদিকে শুধু চোখ—ছবি, মুখবিহীন চোখ, মৃত চোখ, শূন্য দৃষ্টির প্রতিচ্ছবি। গ্যালারির মাঝখানে একটি ছোট টেবিলে বসে থাকা মানুষটি—চুল অগোছালো, মুখে পাতলা দাড়ি, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, আর প্যাচানো গলায় লাল স্কার্ফ। সে নিঃশব্দে তুলিতে আঁকছে আর নিচু গলায় বলছে, “তারা কেউ আমার চোখে তাকাতে পারেনি।”

সঞ্জয় দত্তের প্রাথমিক কথোপকথনে মনে হয় সে মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন নয়, বরং ভীষণভাবে নিয়ন্ত্রিত। সে বলে, “চোখ আসলে মানুষের স্মৃতি ধরে রাখে। যদি তুমি জানো, কীভাবে দেখতে হয়, তুমি কোনো চোখে সব কিছু পড়ে ফেলতে পারো।” নীলাঞ্জনা সরাসরি তাকে প্রশ্ন করেন—সে কি রঙিন কনট্যাক্ট লেন্স ব্যবহার করে? সঞ্জয় কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে, “চোখ শুধু রঙিন হলেই বিশেষ হয় না, যখন তুমি অন্যের দৃষ্টি দিয়ে নিজের ভয়কে দেখতে পারো, তখন তা রঙিন হয়।”
গ্যালারিতে তার তোলা এক ছবিতে দেখা যায়—ঠিক গত খুনের মতো চোখ, লেন্সের গঠন অবিকল মিলে যায় ফরেনসিক রিপোর্টের সঙ্গে। কিন্তু সঞ্জয় অনড়, সে বলে সে শুধু চোখ আঁকে, খুন করে না। “কেউ আমাকে দেখে আমার আঁকা নকল করতে পারে। আমার চোখ কে না জানে?”
ঘর তল্লাশি করে পাওয়া যায় একটি পুরোনো স্কেচবুক, যেখানে পেন্সিলে আঁকা এক কিশোরের মুখ—তার এক চোখে রঙিন ছোপ। নিচে লেখা—“অরণ্য।”
এই নামেই প্রথমবার পরিচিত হয় একটি সম্ভাব্য নতুন নাম—এক যে হয়তো খুনির আসল পরিচয়ের দিকে এগিয়ে দিচ্ছে।

তবে সঞ্জয়কে আটক করা যায় না, কারণ কোনও সরাসরি প্রমাণ নেই। কিন্তু তার আঁকা ছবিগুলোর কিছু স্ক্যান করে পাঠানো হয় অর্ক সেনের কাছে। অর্ক রিপোর্ট দেয়—এই শিল্পীর মধ্যে খুনির ভাবনার প্রতিচ্ছবি আছে, কিন্তু সে নিজে খুনি নয়। বরং এমন কেউ, যাকে খুনি হয়তো ব্যবহার করছে, কিংবা যার সঙ্গে তার একসময় মানসিক বা শিল্পগত সম্পর্ক ছিল।
নীলাঞ্জনা তখন খোঁজ নিতে শুরু করেন—কে এই “অরণ্য”? বিভিন্ন স্কুল রেকর্ড ঘেঁটে তারা মেলে একটি নাম—অরণ্য সাহা, যার চোখে ছিল একধরনের হেটেরোক্রোমিয়া—এক চোখ বাদামী, এক চোখ হালকা নীলাভ। স্কুলে থাকাকালীন তাকে প্রায়ই ‘পিশাচ’, ‘অলৌকিক’ ইত্যাদি নামে ডাকা হতো। সেই মানসিক ট্রমার পর সে স্কুল ছেড়ে দেয়। তারপর থেকে সে নিখোঁজ। কেউ জানে না সে কোথায় গেছে, জীবিত কিনা।
এই সূত্রই যেন প্রথমবার নীলাঞ্জনার সামনে এক ভয়ংকর প্রতিচ্ছবি তোলে—যদি এই অরণ্যই হয় সেই খুনি, যে আজও তার অতীতের অপমান ভুলতে পারেনি? যার কাছে চোখ হয়ে উঠেছে অস্ত্র, আয়না, ন্যায়বিচার?
ঠিক সেই রাতে আবার একটি মেসেজ আসে। শুধু একটি বাক্য: “তারা যখন আমার চোখ দেখে হাসত, কেউ বুঝত না, আমি তখনও দেখতে শিখছিলাম। এখন আমি জানি—কে কী।”
নীলাঞ্জনার মনে হয়, সময় ঘনিয়ে আসছে। চোখের ভিতর জমা হয়েছে শুধু রঙ নয়, প্রতিহিংসাও।

উত্তর কলকাতার ছোট্ট পাড়ায় সেই দিন সকালটা শুরু হয়েছিল একেবারে সাধারণভাবে—চায়ের দোকানে আলোচনায় ক্রিকেট, বাচ্চাদের স্কুলবাসের অপেক্ষা, পাশের বাড়ির বারান্দায় ধোঁয়া ওঠা কফির কাপ। অথচ সকাল ৯টার মধ্যেই গলির ভিতর ভিড় জমে যায়, কারণ পান্নালাল ঘরামির একতলা বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসা একটানা কুকুরের ডাকে লোকজনের সন্দেহ হয়। দরজা বন্ধ, কিন্তু ভিতর থেকে পচা গন্ধ। পুলিশ এসে দরজা ভেঙে ভিতরে ঢুকতেই যা দেখা গেল, তা যেন গত সব কেসকে ছাপিয়ে গেল—একজন বৃদ্ধ, গলায় গামছা প্যাঁচানো, মৃত, আর তার চোখদুটো খোলা, কিন্তু ভেতরে কিছুই নেই—উঠে গেছে, ফাঁকা গহ্বর। দেয়ালের এক কোণে অদ্ভুত একটা চশমা—এক চোখের কাচ সবুজাভ, অন্যটি বেগুনি। এবং তার পাশে সেই পরিচিত লাইন, এবারের ভাষায়—“তুমি কি এখনো দেখতে পারো, নীলাঞ্জনা?”
খবর পৌঁছাতেই এসিপি নীলাঞ্জনা ঘটনাস্থলে পৌঁছান। চারপাশে কৌতূহলী জনতা, মিডিয়া, ক্যামেরা, আতঙ্কিত মুখ। খুনের ধরণ এবার যেন আরও নির্মম। চোখদুটো যেন তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
ফরেনসিক রিপোর্ট বলছে, পেশাদার হাতে চোখ তুলে নেওয়া হয়েছে—অসাধারণ নিখুঁতভাবে। কিন্তু আশ্চর্য, মুখে কোনও ভয়ের চিহ্ন নেই—বরং ঠোঁটে অদ্ভুত এক প্রশান্তির রেখা।
এই খুনের পরিপ্রেক্ষিতে ক্রাইম ব্রাঞ্চ বুঝে যায়, খুনি এবার তার খেলা অন্য স্তরে নিয়ে গেছে। সে এবার কেবল রঙিন চোখ পরিয়ে দিচ্ছে না, সে চোখকেই সরিয়ে নিচ্ছে।
আর এই বৃদ্ধ—পান্নালাল—তার অতীত খুঁজতে গিয়ে সামনে আসে এক বিস্ময়কর তথ্য—সে ছিলেন রামকৃষ্ণ মিশন স্কুলের একজন রাগী হোস্টেল সুপারিনটেনডেন্ট। কিশোরদের উপর চূড়ান্ত শৃঙ্খলা আর অপমানমূলক আচরণ চালাতেন বলেই পরিচিত ছিলেন।
নীলাঞ্জনা এবার নিশ্চিত হন—খুনি তার পুরনো শত্রুদের উপরেই আঘাত হানছে। এবং একে একে একটি নির্দিষ্ট অতীতকে মুছে দিচ্ছে।

পুলিশ হেডকোয়ার্টারে রাতের বেলা একটি বিশেষ মিটিং ডাকা হয়। খুনির শিকারদের জীবনের যোগসূত্র তুলে ধরা হয়—তিনজনই কোনও না কোনওভাবে সেই স্কুল ও হোস্টেলের সঙ্গে যুক্ত। অর্ক সেন উপস্থিত থেকে বলেন, “খুনি তার অতীতকে নির্মাণ করছে নতুন করে। সে যা হারিয়েছিল, এখন তা প্রতিস্থাপন করছে—চোখ দিয়ে, প্রতিশোধ দিয়ে, শিল্প দিয়ে। আর সে জানে, নীলাঞ্জনা একমাত্র ব্যক্তি, যে তাকে দেখতে পাবে।”
সেই সময় সাংবাদিক তানিয়া ঘোষ, যার নিজস্ব ব্লগ ‘কলকাতার ছায়া’ এখন শহরের চোখ হয়ে উঠেছে, সে নীলাঞ্জনার কাছে এক চাঞ্চল্যকর তথ্য নিয়ে আসে।
সে খুঁজে বের করেছে—রামকৃষ্ণ মিশনের পুরনো একটি গ্রুপ ফটো, যেখানে ১৯৯৯ সালের একদল কিশোর—তাদের মধ্যে একজনের চোখে এক অদ্ভুত বিকৃতি, ঠিক যেন দৃষ্টিকে এড়িয়ে থাকা ছায়া। সেই ছবির নিচে একটি অর্ধেক নাম লেখা—“Aru—”
তানিয়া ব্লগে বিষয়টি নিয়ে লেখে, এবং রাতারাতি সেই নাম ‘অরণ্য সাহা’ আবার শহরের আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসে।
নীলাঞ্জনা সেই গ্রুপ ফটো নিজের ডেস্কে বসিয়ে রাখেন। প্রতিদিন তার চোখ পড়ে সেই চোখে, সেই পিচ্ছিল দৃষ্টিতে, যে তাকিয়ে থাকে, কিন্তু কখনো সম্পূর্ণ প্রকাশ পায় না।

ঠিক তখনই একটা নতুন মোড় আসে কেসে। কাশীপুর থানা থেকে ফোন আসে—এক ছেলেকে গ্রেফতার করা হয়েছে, কারণ সে এক ফ্লাইওভারের নিচে লোকজনের ছবি আঁকছিল, যার সব ছবিতেই চোখ ছিল রঙিন। পুলিশ তাকে ধরে আনে। ছেলেটি নির্বিকার, নাম বলে—“আদি সাহা।” বয়স আনুমানিক ২২। কিন্তু তার আঁকার স্টাইল, রঙের ব্যবহার—সব মিলিয়ে মনে হয়, সে হয়তো খুনির অনুরাগী বা শিষ্য।
আদির ঘরে পাওয়া যায় এক ডায়েরি, যেখানে সে লিখেছে—“আমার গুরু চোখ দিয়েই দুনিয়া বদলায়। রঙিন চোখে সত্যি ধরা পড়ে। একদিন আমিও তার মতো হব।”
এই শিষ্যধর্মিতার মাধ্যমে স্পষ্ট হয়—খুনি তার একক খেলা থেকে বেরিয়ে এসেছে, সে ছড়িয়ে দিচ্ছে তার দর্শন, তার চিহ্ন।
নীলাঞ্জনা বুঝতে পারেন, এই কেস এখন ব্যক্তিগত নয়, সামাজিক আতঙ্কে রূপ নিচ্ছে। খুনি যদি একা না থাকে? যদি সে তৈরি করে চলেছে তার মতো আরও ‘চোখ’?
রাত গভীর হয়, শহরের আলো নিভে আসে, শুধু জ্বলতে থাকে কয়েকটি রঙিন চোখ—যেগুলো জানে, কারা একসময় তাদের দৃষ্টি অপমান করেছিল।

বিকেল পাঁচটা। থানার কনফারেন্স রুমে শুধু একটা সাদা বোর্ড, তাতে ছয়টি চোখের ছবি—ছয়টি মৃত মানুষের। নীলাঞ্জনা একে একে তাকিয়ে থাকেন তাদের দিকে, যেন প্রতিটি চোখের ভিতরে খুঁজে পান এক ছায়াময় বার্তা। সবার ভিতরে একটা মিল আছে—ভয়ের আগে শান্তি, মৃত্যুর আগে বিস্ময়। ফরেনসিক রিপোর্ট অনুযায়ী সব কনট্যাক্ট লেন্স ছিল কাস্টম ডিজাইন করা—এমন লেন্স, যা সাধারণ দোকানে পাওয়া যায় না। তদন্তে জানা যায়, মাত্র একটি ডিজাইনার কাজ করেন এমন রঙিন লেন্স নিয়ে—ঋভু দত্ত, দক্ষিণ কলকাতার একজন একাকী অপটিক্যাল আর্টিস্ট, যিনি চোখকে ‘ক্যানভাস’ হিসেবে ব্যবহার করেন।
ঋভু নিজেই পুলিশের কাছে আসে। তার কথায়, গত এক বছরে এক “নামহীন ক্লায়েন্ট” তার কাছ থেকে সাত জোড়া কাস্টম লেন্স বানিয়েছেন—সবই চোখের মাধ্যমে ‘অভ্যন্তরীণ আত্মপ্রকাশ’ ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছে। ক্লায়েন্ট সবসময় অনলাইন যোগাযোগ রাখতেন, মুখ দেখাননি কখনও। শুধু একটি বার্তা বারবার দিয়েছেন—“চোখের ভিতরে মুখ থাকে।”
ঋভু তার কাছে যে ঠিকানায় লেন্স পাঠাতেন, তা ছিল একটি নির্জন পরিত্যক্ত স্টুডিওর—৪৭বি, ভবানী দত্ত লেন।
ঠিকানা অনুসরণ করে সেখানে যায় নীলাঞ্জনা। বাইরে থেকে জায়গাটা একটি ধ্বংসপ্রায় গ্যারেজের মতো, কিন্তু ভিতরে ঢুকতেই দেখা যায়—চিত্রপট, রঙ, ছেঁড়া আয়না, কাঁচের টুকরো, আর দেয়ালে অদ্ভুত বাক্যে ভর্তি গড়াগড়ি খাওয়া কাগজ—
“চোখই চিত্রশিল্পের ঈশ্বর।”
“যার চোখে রঙ নেই, তার জীবনে আলো নেই।”
“তুমি কি আমার চোখে নিজেকে দেখেছ?”

ঘরের এক কোণে পড়ে থাকা পুরনো ফাইলের পাতায় চোখে পড়ে—এক স্কুল সার্টিফিকেট, নামের এক অংশ জলে মুছে গেছে, শুধু দেখা যাচ্ছে—”অরণ্য—” আর পাশে হাতে লেখা একটি লাইন—“তুমি কি আমায় চিনতে পারো?”
নীলাঞ্জনা পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা বিজয়ের দিকে তাকিয়ে বলে, “এই প্রশ্নটা শুধু ভিকটিমদের জন্য নয়… এটা আমার জন্যও।”
পরক্ষণেই তার মনে পড়ে যায় সেই দিন—দশম শ্রেণির পিকনিক, বন্ধুরা মজা করছিল। এক লাজুক ছেলেকে ঘিরে কৌতুক চলছিল—তার চোখ দুটি ছিল আলাদা রঙের। আর সেই সময় তিনিও, এক অপমানজনক রসিকতা করেছিলেন—“তোর চোখ দেখে মনে হচ্ছে একটা ভুত ছবি আঁকে।”
সেই ছেলেটির মুখ আজ আর স্পষ্ট মনে নেই, কিন্তু চোখের রঙ মনে আছে—একটি ধূসর সবুজ, অন্যটি ফ্যাকাশে নীল।
নীলাঞ্জনা জানেন, তিনি হয়তো সেই ভুলের মধ্যে দিয়ে কাউকে গড়ে তুলেছিলেন, যার হাত আজ রক্তে রাঙা।

ঠিক সেই রাতেই তার বাসায় আসে একটি পার্সেল—বিভিন্ন কাগজে মোড়া। খুলে দেখা যায় একটি পোর্ট্রেট, জলরঙে আঁকা—একজন নারী, যার চোখে ভয়, তবু শান্তি। মুখটা পরিষ্কার, এবং কুৎসিতভাবে নীলাঞ্জনার মুখের অনুরূপ। নীচে লেখা—“তুমি কি আমায় চিনতে পারো?”
ছবির পিছনে একটা ছোট চিরকুট:

> “তুমি আমায় প্রথম মানুষ করেছিলে। তারপর ফেলে দিলে আয়নার ভিতর।
এবার আমি তোমায় দেখাব—কীভাবে চোখ দিয়েই জন্ম হয় দ্বিতীয় জীবনের।”
চিরকুটটা হাতে নিয়েই নীলাঞ্জনার ভিতর কেঁপে ওঠে স্মৃতির ঝাঁপি।
কেউ যে তাকে চোখ দিয়ে দেখেছে, অনেক বছর ধরে, চুপচাপ, হয়তো তার কাছেই প্রতিশোধের ভাষা শিখেছে।

 

সেই মুহূর্তে আবার ফোনে আসে একটি ভিডিও কল। স্ক্রিন জুড়ে এক জোড়া চোখ, এবার কনট্যাক্ট লেন্স ছাড়া—একটি নীল, একটি বাদামী। নিচু গলায় বলা হয়—“আমি জানি, তুমি আমায় চিনতে পারো। আমি সেই ভুলের ফল, যাকে কেউ ভুলে যেতে চায়। আর তুমি সেই আয়নার পেছনের মুখ, যে সত্য দেখতে ভয় পায়।”
কণ্ঠস্বর নরম, মেলোডিক, কিন্তু তাতে চাপা প্রতিশোধের ছায়া।
ভিডিও ফিড হঠাৎ কেটে যায়। কিন্তু তার আগে একটি বইয়ের স্পাইন দেখা যায়—“The Eye Theory: Vision and Trauma”
অর্ক সেনকে ফোন করতেই তিনি জানান—এই বই কেবল একজন ছাত্রকে তিনি দিয়েছিলেন, নাম—অরণ্য সাহা।

নীলাঞ্জনা এবার নিশ্চিত, খুনি তারই ছায়া, তার অতীত থেকে উঠে আসা এক অবদমিত দৃষ্টি।
এবং সেই চোখ এখন তাকে নিজেই দেখে ফেলেছে।
এই যুদ্ধ আর খুনির সঙ্গে নয়, এবার নিজের মধ্যেকার অপরাধবোধের সঙ্গেও।

কলকাতা পুলিশের অপরাধ মানচিত্রে এই মুহূর্তে সবচেয়ে আলোচিত বিন্দু হয়ে উঠেছে ভবানী দত্ত লেন। স্টুডিওর খোঁজ পাওয়ার পর নীলাঞ্জনা সেই পুরোনো স্কুল রেকর্ড খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকেন। সব সূত্র মিলে স্পষ্ট হয়—অরণ্য সাহা, অদৃশ্য এক নাম, এক দৃষ্টি, যে তার অস্তিত্ব তৈরি করেছে অপমানের ভিতর দিয়ে। স্কুল জীবনে অবজ্ঞার, চোখ নিয়ে কটূক্তির, সহপাঠীদের তাচ্ছিল্যের সেই তীব্র অভিজ্ঞতা আজ তার অস্ত্র হয়ে উঠেছে। এবং এই অস্ত্র একদিকে রঙিন কনট্যাক্ট লেন্স, অন্যদিকে আয়না।
ঠিক তখনই পুলিশ হেডকোয়ার্টারে একটি অদ্ভুত চিঠি এসে পৌঁছায়—হাতে লেখা, অতি নিখুঁত হস্তাক্ষরে:

“আমার চোখ রঙিন নয়, তোমাদের মনই অন্ধ। আমি আয়নার পাশে দাঁড়িয়ে দেখি, কে সত্য আর কে মুখোশধারী। এই শহরটা আয়নার মতো—ভেঙে দিলে প্রতিচ্ছবি ছড়ায়, তবু চেহারা বদলায় না। এবার আয়, নীলাঞ্জনা, একবার আমার চোখে নিজেকে দেখো।”
সাথে একটি অদ্ভুত মানচিত্র—পুরনো কলকাতার আঁকাবাঁকা গলির, যেখানে কয়েকটি জায়গা লাল কালিতে চিহ্নিত করা।
নীলাঞ্জনা বুঝে যান—এটি একটা খেলা, এক ধরণের ‘মাইন্ড ট্র্যাকিং’। এবং সে-ই সেই শেষ টার্গেট, অথবা প্রথম—এই প্রশ্নটাই এখন সত্যিকারের লড়াই।

এই চিহ্নিত স্থানগুলোকে ঘিরে তদন্ত চালাতে গিয়ে বেরিয়ে আসে একটি ভয়াবহ সত্য। প্রতিটি লাল বৃত্ত চিহ্নিত জায়গার ঠিক মাঝখানে রয়েছে আয়না—পুরনো বাড়ির দেয়ালে ঝোলানো, ফেলে দেওয়া ঘরে হেলান দেওয়া, কিংবা দোকানের শোরুমে ফেটে যাওয়া। ফরেনসিক দল আবিষ্কার করে—এই আয়নাগুলোর কিছুতে রয়েছে ছোট ক্যামেরা, মিনি রেকর্ডিং চিপ, যেগুলোতে মানুষের মুখ, চোখ ও অভিব্যক্তি রেকর্ড করা হয়েছিল—তাদের অজ্ঞাতে।
অরণ্য তার ‘শিকার’ নির্বাচন করত শুধু তাদের চেহারা দেখে নয়, তাদের চোখের অভিব্যক্তির ভিতর লুকোনো আসল রূপ দেখে। সে বিশ্বাস করত—চোখ দেখে পাপ বোঝা যায়।
এই তথ্যগুলো সামনে আসতেই সাইবার বিভাগের মাধ্যমে একটি ক্লিপ উদ্ধার হয়—একটি মিউজিক ভিডিও স্টাইলে কেটে বসানো, যেখানে একে একে পাঁচটি ভিকটিমের মুখ, এবং তাদের মৃত্যুর আগে আয়নায় মুখ দেখা যাচ্ছে। তারপর শেষ লাইনে কণ্ঠস্বর—“তোমাদের প্রতিচ্ছবি, আমার অস্ত্র। আমি নই খুনি—আমি শুধুই দৃষ্টি।”
সেই ফুটেজেই প্রথমবার দেখা যায় খুনির পর্দা আঁচড়ানো ছায়া—একটি আয়নার ওপাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক ছায়ামূর্তি, যার চোখে দুটি স্পষ্ট রঙিন চশমা।

নীলাঞ্জনা এবার সিদ্ধান্ত নেন—তিনি স্বেচ্ছায় প্রবেশ করবেন খুনির খেলার ভেতর। মানচিত্রে চিহ্নিত একটি নির্দিষ্ট পয়েন্ট—কলকাতার দক্ষিণ শহরতলির এক পুরনো সিনেমা হল—“রূপবাণী টকিজ”। আজ বন্ধ, কিন্তু সত্তরের দশকে এটি ছিল পরিচিত এক আর্ট-ফিল্ম প্রেক্ষাগৃহ।
সন্ধ্যা ৭টায়, নির্ধারিত সময়ে পৌঁছন তিনি। বিজয় ও তার টিম কয়েক কদম দূরে প্রস্তুত, গোপনে নজরদারি চালাচ্ছে।
হলটার ভিতরে নীরবতা কাঁপছে। পুরনো সিটগুলো ছেঁড়া, স্ক্রিন ফাটা, একপাশে আলো কমে আসা এক আয়না। ঠিক তখনই মঞ্চের পেছন দিক থেকে এক ছায়া উঠে দাঁড়ায়—সাদা শার্ট, কালো ট্রাউজার, মাথায় কোনো ক্যাপ নেই, কিন্তু চোখে দুটি অদ্ভুত কনট্যাক্ট লেন্স—একটি নীল, অন্যটি ফিকে সবুজ। মুখ আবছা।
কণ্ঠস্বর ধীরে বলে ওঠে—“তুমি চিনতে পারো, তাই তো এসেছ? এখন আমার চোখে দেখো।”
নীলাঞ্জনা গাঢ় গলায় বলেন, “তুমি অরণ্য সাহা। তুমি সেই শিশু, যাকে ঠাট্টা করে ভীতু বানিয়ে দিয়েছিল স্কুল।”
ছায়ামূর্তি হাসে—“আমি শুধু আয়নার পেছনে দাঁড়ানো একটা প্রতিবিম্ব। তোমরা সবাই মুখোশ, শুধু আমি জানি—কে কবে কাকে সত্যি দেখেছিল।”
নীলাঞ্জনা ধীরে ধীরে এগিয়ে যান, তার চোখে নির্ভীক দৃষ্টি—“তুমি নিজেকে ঈশ্বর ভাবতে পারো। কিন্তু প্রতিটি ঈশ্বরেরও আয়নায় নিজের মুখ দেখা উচিত।”
ছায়াটি এবার চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে, একহাতে আয়নার দিকে ইঙ্গিত করে—“দেখো, ওটা শুধু আয়না নয়, ওটা একটা প্রবেশপথ।”
ঠিক তখনই আলোর ঝলক, বিজয় ও টিম প্রবেশ করে। কিন্তু ছায়াটি আর নেই। আয়নার পাশের দেয়াল খালি—একটা সিক্রেট প্যাসেজ!
তারা ভিতরে ঢোকে, কিন্তু খুনি চলে গেছে—তবে রেখে গেছে একটি কাগজে আঁকা চোখ, যার নিচে লেখা—“শেষ খেলা আয়নায় হবে।”

রাত তিনটে। কেস অফিসের বড় টেবিল জুড়ে ছড়িয়ে আছে আয়না, চোখের ছবি, নিহতদের রেকর্ড, পুরনো স্কুল রিপোর্ট, এবং এক রহস্যময় প্রতিচ্ছবির ফটোকপি—যেটি রূপবাণী টকিজের গোপন ক্যামেরা তুলেছিল। সিআইডির সাইবার টিম সেই ফ্রেমগুলিকে বিশ্লেষণ করে জানায়, ছায়ামূর্তির মুখের ওপর একটি ফেস-মাস্ক ছিল, যার নীচে তাপমাত্রা-নির্ভর প্রযুক্তি প্রয়োগ করা হয়েছিল—তাই মুখ শনাক্ত করা অসম্ভব। অথচ তার চোখের রঙ সুনির্দিষ্ট। অর্ক সেন বলেন, “খুনি চায়, আমরা তার মুখ চিনতে না পারি, কিন্তু তার চোখ আমাদের ভেতরের মুখ চিনে ফেলুক।”
এমন সময় HQ-এর CCTV বিভাগ থেকে একটি নতুন ক্লিপ আসে—গতকাল দুপুর ২:৪৫-এ নীলাঞ্জনার নিজের গাড়ির সামনে, একটি ছোট বাচ্চা দাঁড়িয়ে ছিল কিছুক্ষণ, তারপর গাড়ির বনেটে একটি আয়না রেখে যায়। নীলাঞ্জনা অবাক হয়ে গিয়ে সেটা দেখতে যান। আয়নার পিছনে ছোট্ট চিরকুট—“এই আয়না আর তোমার নয়। এবার সময় হয়েছে আমার দৃষ্টি ধার করার।”
এক ধরণের খেলায় ফেলা হয়েছে তাকে, যেখানে সে আর কেবল একজন অফিসার নয়—সে নিজেই প্রতিচ্ছবির অংশ।

অর্ক তখন তাকে বলেন—“এই মুহূর্তে খুনি তোমার দৃষ্টি দখল করতে চাইছে। সে জানে, তুমি ভয় পাও না, তাই এবার সে চাইছে তুমি তার মতো ভাবো। চোখের মাধ্যমে সে তোমার অভ্যন্তরীণ বাস্তবতা তৈরি করছে।”
নীলাঞ্জনা সিদ্ধান্ত নেন—সে আর শুধু অনুসন্ধান করবে না, এবার সে খেলবে। তার পুরনো ব্যক্তিগত ডায়েরি, স্কুলের নোটবুক, এমনকি তার বাবার মৃত্যু-সংক্রান্ত কাগজপত্র সব সে সাজিয়ে রাখে। কেস টেবিলের মাঝখানে সে নিজের পুরনো স্কুলের একটি ছোট ছবি রাখে—যেখানে পেছনের সারিতে সেই ‘অরণ্য’র অর্ধেক মুখ দেখা যায়। সে জানে, এই খুনি তাকে সবসময় দেখেছে, এমনকি সেই সময়েও যখন সে নিজেকে দেখতে শিখছিল।
এমন সময় তানিয়া ঘোষ, সাংবাদিক, এসে জানায়—একটি নতুন ভিডিও ব্লগে কেউ অদ্ভুতভাবে এই কেস নিয়ে ‘সীমান্ত-রেখার ভেতরে’ নামে সিরিজ শুরু করেছে। ভিডিওতে শুধু একটি চোখ দেখা যাচ্ছে, আর কণ্ঠস্বর বলছে:

“তোমরা যারা দেখো না, তাদের জন্য আমি দেখছি। তোমরা যারা আয়নায় মুখে আলো ফেলো, আমি তাদের ছায়া রক্ষা করি।”
ভিডিওর শেষে, সেই বিখ্যাত প্রশ্ন—“তুমি কি আমায় চিনতে পারো?”
এই ভিডিও মাত্র কয়েক ঘণ্টায় ভাইরাল হয়ে যায়, মানুষের মনে জন্ম নেয় নতুন আতঙ্ক—আয়নার পাশে দাঁড়ানো যে কেউই এখন হতে পারে ‘রঙিন চোখের খুনি’।

নীলাঞ্জনা এরপর সিদ্ধান্ত নেন—তিনি আয়নার ভেতর ঢুকবেন। মানে, মেটাফোরিক্যালি নয়, বাস্তবেই। তিনি যান সেই পুরনো রামকৃষ্ণ মিশন স্কুলে, যেটি এখন অর্ধেক পরিত্যক্ত। সে জায়গার অফিস ঘরের ভিতরে এখনও পড়ে রয়েছে পুরনো একটি আয়না—যেখানে একসময় ছাত্রদের দাঁড় করিয়ে তাদের চোখ দেখা হতো, চুল কেটে দেওয়ার সময় কিংবা ‘শৃঙ্খলা পরীক্ষা’ করার জন্য।
তিনি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখেন। দীর্ঘক্ষণ চুপচাপ। তারপর নিজের চোখের দিকে তাকিয়ে বলেন—“অরণ্য, যদি তুমি এখানে থেকো, আমি চাই তুমি এবার আসো সামনে। আমি ভয় পাই না।”
কোনো শব্দ হয় না। শুধু ঘরের এক কোণে পড়ে থাকা একটি কাঠের বাক্স খুলে যাওয়া আওয়াজ শোনা যায়। সেখানে একটি নোট: “তুমি ভয় পাও না বলেই ভয়ংকর।
তুমি দেখতে শিখেছ, কিন্তু বুঝতে পারোনি।
এবার আমি তোমাকে বোঝাব—চোখ দিয়ে নয়, আয়নার ভিতর দিয়ে।”
নীলাঞ্জনা আবার বুঝে ফেলেন—পরবর্তী খুন বা মিথ্যা মৃত্যু এবার হবে এমনভাবে, যেখানে ভিকটিম নিজেই তার মুখ ভুল বুঝবে। আত্মপরিচয়ের বিরুদ্ধে আঘাত হানবে খুনি।

এখানে প্রথমবার তিনি বলেন—“আমি একা নই। আমার ভেতরের নীলাঞ্জনা, যে একসময় এক ছেলেকে অপমান করেছিল, সেও আজ আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। খুনি শুধু অরণ্য নয়, খুনি হলো সেই ভুল স্মৃতি, সেই ফেলে দেওয়া বাক্য, যার প্রতিশোধ আজ রঙিন হয়ে উঠেছে।”
এই অধ্যায়ের শেষে, শহরের একটি পার্কে, আয়নার পাশ থেকে পাওয়া যায় একটি পুতুলের চোখ। এবং তার সঙ্গে একটি শব্দহীন ভিডিও—যেখানে দেখা যাচ্ছে, একজন নারী আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তার চোখে কনট্যাক্ট লেন্স পরাচ্ছেন—একটি নীল, একটি বেগুনি।
নীলাঞ্জনা জানেন, এবার সময় এসেছে ‘খেলা শেষ’ বলার।

আলো নিভে আসা শীতল একটা সকাল। কলকাতার রাস্তা তখনো কুয়াশায় ঢাকা। ঠিক এমন সময়েই HQ-এর মেইল সার্ভারে ঢোকে একটি অদ্ভুত ইমেইল—সাবজেক্ট লাইনে লেখা: “The Endgame Begins.” মেইলের মধ্যে একটি একক বাক্য: “নীলাঞ্জনা, এবার আয়নার মধ্যে ঢোকো।” সাথে একটি ক্লিপ—কয়েক সেকেন্ডের ভিডিও, যেখানে দেখা যাচ্ছে একটি বিশাল হলঘর, যার এক দেওয়াল জুড়ে ঝুলছে শতাধিক আয়না, প্রতিটির ওপর লাল কালি দিয়ে লেখা একটি নাম। ঠিক মাঝে একটি চেয়ার, সামনে রাখা একটি আয়না। সেই আয়নায় শুধু একজোড়া চোখ প্রতিফলিত—একটি নীল, একটি সবুজ। ক্যামেরা যত কাছে আসে, চোখদুটি তত স্পষ্ট হয়—এবং শেষে ভিডিও কেটে যায় শব্দ করে, যেন আয়না ভেঙে পড়ল।
ফরেনসিক ট্রেসে জানা যায় ভিডিওটি আপলোড করা হয়েছিল একটি অদ্ভুত জায়গা থেকে—আলিপুর জেলের পেছনের পরিত্যক্ত ‘মানসিক পুনর্বাসন ভবন’ থেকে, যা গত দশ বছর ধরে বন্ধ।
একটি অতীতকে সযত্নে সাজিয়ে রেখে যেন সেই ভবনটাই ছিল অরণ্য সাহার শেষ নাট্যশালার প্রস্তুতি।
নীলাঞ্জনা জানেন, এটাই সেই ফাইনাল ডাক। খুনি তাকে ডাকছে এক প্রতীকী মৃত্যু ও জন্মের খেলায়—যেখানে তাকে নিজের মুখোমুখি হতে হবে, আক্ষরিক ও রূপক অর্থে।

বিকেল পাঁচটার মধ্যে পুরো ভবন ঘিরে ফেলে সিআইডি এবং কলকাতা পুলিশ। কিন্তু খুনি জানে—নীলাঞ্জনা ছাড়া কেউ তাকে ধরতে পারবে না। তাই সে একাই ঢোকেন ভবনের ভিতরে। ভিতরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে মৃত পুতুল, কাগজের চোখ, আয়নার কাঁচ, আর দেয়ালের কোণে অদ্ভুত ছন্দে লেখা:

“তুমি কি এখনো নিজের চোখে নিজেকে দেখতে পারো?”
হলঘরের ভিতরে ঢোকার মুহূর্তে সেই অজানা ভয় আর কুয়াশার মতো দৃষ্টিবিভ্রম একসঙ্গে আক্রমণ করে। দেয়াল জুড়ে একের পর এক আয়নায় নিজেরই মুখ ঘুরেফিরে দেখতে থাকেন নীলাঞ্জনা—কখনো শিশু, কখনো কিশোরী, কখনো কাঁদতে থাকা এক কিশোরের চোখের ভিতর সে নিজেকে আবিষ্কার করেন।
হঠাৎ এক সময়, মাঝের চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ায় একজন—হুডিতে মুখ ঢাকা, চোখদুটি খোলা, এবং সেগুলি একবার নীল রঙে, একবার সবুজ রঙে ঝলসে ওঠে।
কণ্ঠস্বর শান্ত, বিষণ্ণ—
“আমি জানতাম তুমি আসবে। আমি তোমায় ডাকিনি—তুমি নিজেই এখানে এসেছ। কারণ আমি তোমারই প্রতিচ্ছবি। তুমি হয়তো সেদিন ভুলে গিয়েছিলে, কিন্তু আমি ভুলিনি। তোমার একটা কথা আমাকে বদলে দিয়েছিল।”
নীলাঞ্জনা চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকেন। তাঁর কাছে এখন আর কোনো অস্ত্র নেই, শুধু চোখ।
তিনি বলেন—“তুই খুন করেছিস, কারণ তোকে একদিন কেউ অপমান করেছিল। কিন্তু এখন তুই নিজেই সেই অপমানের প্রতিচ্ছবি তৈরি করেছিস।”
ছায়ামূর্তি বলে—“আমি কাউকে খুন করিনি। আমি শুধু তাদের চোখ ফিরিয়ে দিয়েছি, যারা দেখতে ভুলে গিয়েছিল—তোমাদের মতো।”
নীলাঞ্জনা এবার ধীরে ধীরে আয়নার দিকে এগিয়ে যান, এবং নিজের প্রতিচ্ছবির পাশে দেখতে পান ছেলেটির মুখ—অরণ্য সাহা, স্পষ্ট, পাথরের মতো দৃঢ়, কিন্তু তার চোখে জল।

হঠাৎ সেই মুহূর্তে জানালার বাইরে থেকে টর্চের আলো এসে পড়ে। অরণ্য চমকে ওঠে। সে চেয়ার থেকে উঠে যায় অন্য দিকে। নীলাঞ্জনা পেছন থেকে ধীরে বলেন—“অরণ্য, শেষ খেলা থামাতে পারিস তুই নিজেই। তুই যাদের হত্যা করেছিস, তারা হয়তো অপরাধী ছিল। কিন্তু তুই আজ আর নিপীড়িত না—তুই নিজেই এখন ভয়।”
অরণ্য ধীরে ধীরে দাঁড়িয়ে আয়নার দিকে মুখ ফেরায়। তার হাত থেকে পড়ে যায় দুটি কনট্যাক্ট লেন্স। সে ফিসফিসিয়ে বলে—“তুমি কি জানো, প্রতিটি চোখ একটা গল্প? আমার চোখ তোমাদের গল্প বোঝেনি, তাই আমি নিজেরটা লিখলাম। এবার তুমি সেটা শেষ করো।”
ঠিক সেই সময় পুলিশ টিম ভিতরে ঢুকে পড়ে। কিন্তু অরণ্য কিছু বলেনা। সে আয়নার দিকে পেছন ফিরে দাঁড়ায়, এবং ধীরে ধীরে পেছনের একটি প্যানেল খুলে মিলিয়ে যায় অন্ধকার টানেলে।
তারা তাকে ধরতে পারে না।
কিন্তু সে রেখে যায় একটি শেষ আয়না—নীলাঞ্জনার জন্য। আয়নার পেছনে লেখা— “তুমি যদি একদিন নিজের চোখে নিজেকে দেখতে পাও, আমাকে মনে কোরো। আমি কখনো যাইনি।”

১০

তিন সপ্তাহ কেটে গেছে। অরণ্য সাহা উধাও। দক্ষিণ কলকাতা থেকে উত্তরের গলি, বস্তি থেকে ইলেকট্রনিক সিগনাল ট্রেস—কোথাও তার অস্তিত্ব নেই। সিআইডি তার নামে রেড অ্যালার্ট জারি করেছে, অথচ কেউ তাকে কখনো দেখেনি। তবে সবথেকে অদ্ভুত বিষয়—হত্যা বন্ধ হয়ে গেছে। নতুন কোনো চোখ রঙিন হয়ে ওঠেনি, নতুন কোনো খুন হয়নি। শহর ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে শুরু করে, কিন্তু আতঙ্ক নেই—তার বদলে আছে এক অদ্ভুত উপলব্ধি। যেন সবাই কেউ একজনকে ফেলে এসেছে আয়নার ভেতরে, কিন্তু তার ছায়া এখনও হেঁটে বেড়ায়।
নীলাঞ্জনা এখন নিজেকে আগের চেয়ে আরও নিঃসঙ্গ ভাবেন। রাতের ঘুমের মধ্যে মাঝে মাঝে উঠে বসেন, যেন কেউ তার চোখের সামনে দাঁড়িয়ে বলে—“তুমি কি আমায় চিনতে পারো?”
সে আয়নার সামনে দাঁড়ালে, মাঝে মাঝে তার নিজের প্রতিচ্ছবি স্থির থাকে না—একবার ছোট্ট মেয়ের মতো লাগে, একবার কিশোরী, আবার কখনো সেই দিনের ক্লাসরুমে দাঁড়িয়ে থাকা এক অনাঘ্রাত বালক, যার চোখে চরম অপমানের বিষ।
এইসব স্বপ্ন তাকে ধীরে ধীরে গড়ে তুলছে এক নতুন মানুষ হিসেবে—যে আর শুধু পুলিশ নয়, একজন শ্রোতা, একজন আয়নার মুখোমুখি হওয়া মানুষ।

তানিয়া ঘোষ তার নতুন সিরিজ শুরু করেছেন—“চোখের ওপারে” নামে, যেখানে তিনি খুনির চরিত্র বিশ্লেষণ করেন, কেবল একজন অপরাধী হিসেবে নয়, একজন প্রতিবাদী প্রতিচ্ছবি হিসেবে। ভিডিওতে তিনি বলেন—

“আমরা সবাই একটু করে খুনি তৈরি করি—কখনো ভাষায়, কখনো দৃষ্টিতে, কখনো নীরবতায়। অরণ্য সাহা তার চোখ দিয়ে যা বলেছিল, তা হয়তো আমরা আয়নার সামনে দাঁড়ালে বুঝতে পারতাম।”
এই কথাগুলো শহরের তরুণদের মধ্যে আলোড়ন তোলে। অনেকেই নিজের ভুল নিয়ে মুখ খোলে, ক্ষমা চায় তাদের স্কুলজীবনের কিছু আচরণের জন্য।
আলোচনার মাঝে নীলাঞ্জনা সিদ্ধান্ত নেন—তিনি আবার ফিরে যাবেন সেই স্কুলে, সেই আয়নার সামনে, যেখানে অরণ্য প্রথমবার নিজেকে হারিয়েছিল।
তিনি একটি পুরনো আয়না নিয়ে যান, সেই আয়না যেখানে এখনো খানিকটা আঁকা আছে সেই বিখ্যাত লাইন—“তুমি কি আমায় চিনতে পারো?”
স্কুলের ক্লাসরুমে দাঁড়িয়ে তিনি সেটি দেয়ালে ঝোলান। আয়নায় নিজের চোখে তিনি স্পষ্ট বলেন—“আমি এখন তোমায় দেখতে পাই, অরণ্য। কারণ আমি নিজের চোখে নিজেকেও দেখতে শিখেছি।”

তবে গল্প এখানেই থেমে যায় না। ঠিক সাতদিন পর, কলকাতা বইমেলায় একটি নির্জন বুকস্টলে পড়ে থাকে একটি খোলা বই—“The Eye Theory”—প্রথম পাতায় হাতে লেখা একটি বার্তা: “এই বইটা আমি শেষ করিনি, কারণ শেষ মানেই সত্য নয়। তুমি কি এবার চোখ বন্ধ করে সত্যি দেখতে পারো?”
নীলাঞ্জনা খবর পেয়ে বইটা নিয়ে আসেন। পাতা উল্টাতে উল্টাতে তিনি দেখেন, প্রতিটি অধ্যায়ের নিচে একটি করে প্রতিকৃতি—কোনোটা অঙ্কিত চোখ, কোনোটা গলিত মুখ, কোনোটা কেবল একটি দৃষ্টিবদ্ধ আয়না।
সেই রাতেই তার বাসার দরজার নিচে গড়িয়ে পড়ে একটি খাম। খুলে দেখা যায় একটি ছোট কাঁচের টুকরো—ঠিক আয়নার মতো—but convex, বক্র। সেই কাঁচে তাকিয়ে নিজের মুখ বিকৃত হয়ে উঠে আসে, চোখ দুটি বিশাল, প্রায় বিকলাঙ্গ, কিন্তু গভীর।
সাথে একটি পোষ্টকার্ডে লেখা—
“তুমি যে আমায় চিনতে পারো, সেটাই আমার মুক্তি। এখন থেকে তুমি দেখবে, আমি চলে যাব।”
সেই দিন প্রথমবার, অনেক রাতে, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চোখ বন্ধ করেন নীলাঞ্জনা। ভয়ের পরিবর্তে তার চোখ বেয়ে নামে অশ্রু। সে জানে, সেই ছেলেটি আর কাউকে খুন করবে না। কারণ সে এখন চোখের ওপারে।

সমাপ্ত

1000040320.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *