Bangla - সামাজিক গল্প

রঙিন ঘুড়ি

Spread the love

রৌদ্রদীপ লাহা


এক

সকালবেলা হাওড়ার গলি ঘুপচি ভেঙে আস্তে আস্তে সূর্যের আলো ঢুকতে শুরু করে। লোহার রেললাইনের ধারে, টালির ছাউনি দেওয়া ঘরগুলোয় তখনও ঘুমিয়ে থাকা মানুষদের মুখে এক চিলতে আলোর রেখা এসে পড়ে। শহরের কোলাহল তখনও শুরু হয়নি, কিন্তু বস্তির গলিতে গলিতে জীবনের আর্তনাদ যেন ঘুম ভাঙিয়ে দেয় পিন্টুর মতো হাজারো শিশুকে। সেই গলির এক কোণে মায়ের কোল থেকে আলতো করে উঠে দাঁড়ায় পিন্টু। বয়স দশ বছর, গায়ে মলিন ফাটা হাফ প্যান্ট, গায়ের ওপর পাতলা ছেঁড়া জামা। চোখদুটো বড় বড়, মলিন হলেও তার মধ্যে লুকানো থাকে অজস্র স্বপ্নের আভা। পিন্টু ধীরে ধীরে চোখ কচলে জেগে ওঠে। রাতের ঘুম তার স্বপ্নে ভরপুর ছিল, যেখানে সে এক রঙিন ঘুড়ি ওড়াচ্ছিল, আর সেই ঘুড়ি নীল আকাশ চিরে আরও উপরে উঠছিল, তার হাতের টানে।

মা মাটির চুলোয় ফুটন্ত পাতলা চা বানাচ্ছে। কাঠের ধোঁয়ায় ঝাঁপসা সেই ছোট্ট ঘরের ভেতর আলো-অন্ধকারের খেলা। পিন্টুর মা তাকে ডাকে, “পিন্টু, চল রে মুখে দুধ খা। আজ তোকে অনেকদূর যেতে হবে, আজ বেশ কাগজ জোগাড় করে আনতে হবে।” পিন্টু মায়ের কথায় কিছু না বলে মাটির বাটিতে হালকা জল মিশানো দুধ চুমুক দেয়। গলার মধ্যে সেই গরম দুধ নামতে নামতেই সে জানালার বাইরে আকাশের দিকে তাকায়। আকাশের মধ্যে সে দেখে একপলক রঙিন সকাল, যেখানে সে ঘুড়ি ওড়াচ্ছে, এক অজানা মুক্তির আনন্দে ভরে যাচ্ছে তার বুক।

পিন্টু ফাটা ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে বাইরে বেরিয়ে পড়ে। কুয়াশা তখনও পুরোপুরি সরেনি। বস্তির সরু গলিগুলো দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে তার কানে আসে পাশের রেললাইনের শব্দ। দূরে ট্রেন আসছে। জীবনের মতোই ট্রেনও থামে না, ছুটে চলে। পিন্টুও ছুটে চলে। তার গন্তব্য শহরের সেই জায়গাগুলো, যেখানে বড়লোকেরা তাদের অপ্রয়োজনীয় জিনিস ফেলে রাখে, যা পিন্টুর মতো ছেলেদের জীবনের সম্বল। সে হেঁটে যায় ফুটপাথের ধারে ধারে, ডাস্টবিনের পাশে, দোকানের পেছনে। কাগজের টুকরো, পুরোনো খবরের কাগজ, ম্যাগাজিন, প্লাস্টিকের বোতল, টিনের কৌটো — যা পায় তা তুলে নেয় ব্যাগে ভরে।

তার চোখ কিন্তু বারবার ঘুরে যায় আকাশের দিকে। সকালবেলার আকাশে পাখিরা ডানা মেলে উড়ছে, আর এক বাড়ির ছাদ থেকে ছোট্ট লাল ঘুড়ি বাতাসে দুলে দুলে ভেসে যাচ্ছে। পিন্টু হাঁটতে হাঁটতে থেমে যায়, একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে সেই ঘুড়ির দিকে। ঘুড়ির লাল রঙ তার চোখে ঠিকরে পড়ে, মনে হয় সেই রঙ ছড়িয়ে পড়ছে তার হৃদয়ের গভীরে। পিন্টুর বুকের মধ্যে কেমন করে ওঠে। সে ভাবে, কবে সে নিজে এমন ঘুড়ি ওড়াতে পারবে? কবে সেই ঘুড়ির সুতো থাকবে তার হাতে?

কিন্তু বাস্তব তাকে টেনে আনে। পায়ের কাছে পড়ে থাকে ছেঁড়া খবরের কাগজ। সে সেটি কুড়িয়ে ব্যাগে ভরে। হঠাৎ তার চোখে পড়ে একটা পুরোনো ছেঁড়া ম্যাগাজিনের রঙিন পাতা। পাতায় একজন মেয়ের হাসিমুখের ছবি, পাশে নীল আকাশে রঙিন ঘুড়ির ছবি। সেই ছবিটা যেন পিন্টুর স্বপ্নকে আরো উসকে দেয়। সে ছবিটা আলতো করে ছেঁড়া অংশগুলো থেকে আলাদা করে, ভাঁজ করে ব্যাগে রাখে। মনে মনে ভাবে, আজ রাতে সে ছবিটা খুলে দেখবে, হয়তো সেই ছবির ঘুড়িই তাকে ঘুম পাড়িয়ে দেবে।

পথ চলতে চলতে সে পায় তার বন্ধু টুনটুনিকে। টুনটুনি পিন্টুর মতোই কাগজ কুড়ায়। ওর হাতে একটা ভাঙা খেলনা ট্রেন। ওরা দুজনে ফুটপাথের পাশে বসে কিছুক্ষণ কথা বলে। পিন্টু বলে, “টুনটুনি, তুই ঘুড়ি ওড়াতে পারিস?” টুনটুনি হেসে বলে, “আরে পাগল, আমাদের ঘুড়ি কিনে দেওয়ার কে আছে রে? ঘুড়ি তো ওড়ায় ও বড়লোকের ছেলেপুলেরা। আমরা মাটির সঙ্গে মিশে থাকি, আকাশ আমাদের জন্য নয়।” পিন্টু চুপ করে যায়। কিন্তু তার চোখের স্বপ্ন তখনও উজ্জ্বল থাকে।

সারাদিন ধরে রোদে পুড়ে, ধুলোবালি মেখে পিন্টু ঘুরে ঘুরে কাগজ কুড়ায়। দুপুরের রোদ মাথায় চড়ে যায়। হাওড়ার রাস্তায় গাড়ির হর্ন, মানুষের চেঁচামেচি, দোকানের ডাক — সবকিছু একসঙ্গে কানে আসে। পিন্টু সেসব উপেক্ষা করে কাজ করে যায়। কারণ সে জানে, আজ যদি সে ভালো কিছু কাগজ কুড়িয়ে আনতে পারে, তাহলে মা-কে সে হয়তো একটিমাত্র ডিম এনে দিতে পারবে, বা এক গ্লাস ঠান্ডা লেবু জল খেতে পারবে।

সন্ধ্যেবেলা যখন সে ফিরে আসে, তার পায়ে আর চলার শক্তি থাকে না। টালির চালের ছোট্ট ঘরের সামনে এসে সে থামে। মায়ের মুখে ক্লান্তি, তবু সে ছেলের দিকে চেয়ে হালকা হাসে। পিন্টু ব্যাগ খুলে মায়ের হাতে দিনের উপার্জনের টাকা দেয়। মা মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় আর বলে, “তুই তো আমার বীর ছেলে, পিন্টু। তোর স্বপ্ন একদিন পূরণ হবেই।”

রাতে পিন্টু ভাঙা পিঁড়িতে বসে ব্যাগ থেকে সেই রঙিন পাতাটা বের করে। কেরোসিনের বাতির আলোয় ছবির ঘুড়ির দিকে তাকিয়ে থাকে। মনে মনে সে ভাবে, কেমন হয় সেই ঘুড়ি ছুঁতে পারলে? তার হাতের টানে ঘুড়ি আকাশের কোণে উড়ে যাবে, আকাশের নীল রঙে মিশে যাবে লাল, হলুদ, সবুজের রঙ। পিন্টু ঘুমিয়ে পড়ে, কিন্তু তার স্বপ্নে ঘুড়ির সুতো থাকে তার হাতেই। সে দৌড়ায় এক বিশাল মাঠের মধ্যে দিয়ে, আর তার ঘুড়ি বাতাসে ভেসে যায়, উঁচু উঁচু মেঘ ছুঁয়ে যেতে থাকে।

এভাবেই প্রতিদিন পিন্টুর দিন শুরু হয় নতুন স্বপ্ন নিয়ে আর শেষ হয় একরাশ ক্লান্তি আর আরও বড় স্বপ্নের আশায়। শহরের বুকে সে হারিয়ে যেতে যেতে নিজের মতো করে স্বপ্ন আঁকতে থাকে—যে স্বপ্ন একদিন সত্যি হবে বলে সে বিশ্বাস করে।

দুই

পিন্টুর জীবনে প্রতিটা সকাল যেন একইরকম ঘুরে ঘুরে আসে। প্রতিদিনের মতোই সেই ভোরের কুয়াশা ভেদ করে সূর্যের প্রথম আলো যখন বস্তির সরু গলিতে এসে পড়ে, পিন্টুর চোখদুটি খুলে যায় স্বপ্নমাখা সকালে। মায়ের গলার হালকা ডাক শোনে সে—“পিন্টু, ওঠ রে, দিন ডুবছে, তোর কাগজ কুড়ানোর সময় হয়ে গেল।” সে ধীরে ধীরে উঠে বসে, চোখে ঘুমের শেষটুকু মুছে নেয়। ব্যাগ কাঁধে ফেলে সে বেরিয়ে পড়ে অজানা এক টানে, সেই পুরনো গলিগুলো পেরিয়ে, শহরের কোলাহলের দিকে।

আজ তার মন অন্যরকম আলোয় ভরে আছে। গতরাতের স্বপ্ন তার মনে আজও তাজা—সেই স্বপ্নে সে নিজের হাতের ঘুড়ি আকাশে উড়িয়ে দিয়েছে, আর চারদিকের মানুষ বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখছে তার দিকে। সেই স্বপ্ন যেন তাকে নতুন করে সাহস জুগিয়েছে।

ফুটপাথের পাশের কাগজের দোকান, চায়ের ঠেকে ভাঙা কাপ, ডাস্টবিনের পাশে পড়ে থাকা কাগজের গাদা —সবকিছু থেকে সে বেছে বেছে কুড়িয়ে নেয় যা পরে বিক্রি করবে। হঠাৎ একটা পুরনো বেহাল বিল্ডিংয়ের পাশে তার চোখে পড়ে একটা দৃশ্য।

একজন মানুষ, বয়স আনুমানিক পঞ্চাশের কাছাকাছি, একপাশে দাঁড়িয়ে এক কাগজে কিছু আঁকছে। তার পরনে ধুতি আর হালকা সাদা পাঞ্জাবি, কাঁধে একটা ঝোলা ব্যাগ। চুলগুলো পাক ধরে গেছে, কপালে ভাঁজ, কিন্তু চোখে এক অদ্ভুত উজ্জ্বলতা। পিন্টু থেমে যায়, এক দৃষ্টে সেই মানুষটার দিকে তাকিয়ে থাকে।

শিল্পী তার কাগজের খাতায় কি যেন আঁকছে, ঘন ঘন পেন্সিল চালাচ্ছে, আর মাঝে মাঝে চারপাশের দিকে তাকাচ্ছে। হঠাৎ তার চোখ পড়ে পিন্টুর দিকে। মানুষটি মৃদু হেসে বলে, “কী রে, দাঁড়িয়ে আছিস কেন? কিছু চাইছিস?”

পিন্টু একটু লজ্জা পায়, মাথা নিচু করে ফেলে। তারপর আস্তে করে বলে, “আমি দেখছিলাম, তুমি কি ঘুড়ি আঁকছ?”

শিল্পী হেসে ওঠে। বলে, “না, এই গলির ছবি আঁকছি। তবে ঘুড়ি আঁকতে তো মন্দ লাগবে না। তুই ঘুড়ি পছন্দ করিস বুঝি?”

পিন্টুর চোখ বড় হয়ে যায়। সে মুগ্ধ গলায় বলে, “খুব পছন্দ করি! আমি ঘুড়ি ওড়াতে চাই। কিন্তু ঘুড়ি কিনে দেওয়ার মতো কেউ নেই। আমি কাগজ কুড়িয়ে ঘুড়ি বানানোর চেষ্টা করেছি, পারিনি।”

শিল্পী তার দিকে ভালো করে তাকায়। সেই চোখে করুণার ছোঁয়া নেই, আছে একরাশ মমতা আর স্বীকৃতি। সে পিন্টুকে বসতে বলে নিজের পাশে। পিন্টু প্রথমে কিছুটা সংকোচ বোধ করে, তারপর ধীরে ধীরে বসে পড়ে সেই মানুষটার পাশে। শিল্পী তার খাতার এক ফাঁকা পাতায় পেনসিল চালাতে চালাতে বলে, “তুই নাম কী রে?”

“পিন্টু,” মৃদু কণ্ঠে জবাব দেয় সে।

“আমি হরিদাস। সবাই আমাকে হরি দা বলে ডাকে। আমি ছবি আঁকি। জানিস, আমি ছোটবেলায় তোদের মতোই এক বস্তিতে থাকতাম। আমারও ঘুড়ি ওড়ানোর খুব শখ ছিল। আজও আছে। আকাশে ঘুড়ি ওড়ানো মানে শুধু খেলনা নয় রে, এটা একরকম মুক্তি, একরকম স্বপ্ন ছোঁয়া।”

পিন্টু অবাক হয়ে শোনে। হরি দার কথাগুলো তার বুকের গভীরে ঢুকে যায়। সে প্রথমবার মনে করে, তার স্বপ্নটা শুধু তার নয়, অনেকের।

হরি দা আবার বলতে থাকে, “যদি তুই চাইস, আমরা একসঙ্গে ঘুড়ি বানাতে পারি। হাতে ক’টা টাকা থাকলে কিছু জিনিস কিনে আনতে হবে, আর বাকি জোগাড় হয়ে যাবে।”

পিন্টু চমকে ওঠে। সে ভাবে, এ কী স্বপ্ন নাকি সত্যি? কেউ কি সত্যিই তার সঙ্গে ঘুড়ি বানাতে চাইছে?

সে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে, “আমার কাছে টাকা নেই হরি দা, আমি কাগজ কুড়িয়ে যা পাই, তা খেয়ে বাঁচতে হয়।”

হরি দা হেসে বলে, “অরে পাগল, টাকা লাগবে না বেশি। তোর সাহস আর ইচ্ছা থাকলেই হবে। চল, এখনই কিছু জিনিস কুড়িয়ে আনি।”

তারপর দুজনে মিলে বেরিয়ে পড়ে। হরি দা বলে দেয়, কেমন কাগজ দরকার, কেমন বাঁশের কঞ্চি, আর কেমন সুতো হলে ঘুড়ি ভালো উড়বে। পিন্টু দৌড়ে যায়, চেনা দোকানগুলোর পেছনে খোঁজ করে কাগজ পায়, এক পুরনো খবরের কাগজের দোকানের পাশ থেকে পায় লম্বা সুতোর টুকরো। হরি দা নিজে হাতে বাঁশের কঞ্চির জন্য পুরনো ঝুড়ির ভাঙা অংশ থেকে কঞ্চি ভাঙে।

দুপুরের গরমে ঘাম ঝরতে থাকে দুজনেরই, কিন্তু কারও মুখে ক্লান্তি নেই। পিন্টুর মুখে ফুটে ওঠে হাসি, একরাশ আনন্দের হাসি, যা বহুদিন সে হাসেনি।

শেষে তারা হরি দার ছোট্ট ঘরে গিয়ে বসে। হরি দা এক পুরনো টেবিলের ওপর জিনিসগুলো সাজিয়ে বসে যায়। পিন্টু অবাক হয়ে দেখে, কী নিখুঁতভাবে হরি দা কঞ্চি কেটে ঘুড়ির ফ্রেম বানায়, কাগজ মেপে আঠা দিয়ে আটকায়। সে বলে, “দ্যাখ, ঘুড়ি বানানোও একরকম শিল্প। শুধু কাগজ আর কঞ্চি নয়, মনে থাকা দরকার, ঘুড়িটা যেন উড়তে পারে, যেন আকাশ ছুঁতে পারে।”

পিন্টু তার চোখের সামনে দেখতে পায় ঘুড়ির জন্ম। প্রথমে কাঠামো, তারপর কাগজের পোশাক, তারপর সুতোর টান। শেষমেশ হরি দা ঘুড়ির পিঠে লাল কালি দিয়ে ছোট্ট একটা ছবি আঁকে—একটা ছোট্ট ছেলে, যে ঘুড়ির সঙ্গে মিশে আছে। পিন্টু বলে, “এটা আমি তো?” হরি দা হেসে মাথা নাড়ে।

ঘুড়ি তৈরি শেষ হতে হতে সন্ধ্যা নামে। আকাশ লালচে হয়ে যায়। পিন্টু আর হরি দা মিলে ছাদে ওঠে। হাওড়ার সেই বস্তির পেছনের ছাদে তখনও হালকা বাতাস বইছে। পিন্টু প্রথমে ভয়ে ভয়ে ঘুড়ির সুতো ধরে, হরি দা বলে, “ভয় পাবি না, তোর হাতেই থাকবে ঘুড়ির প্রাণ।”

পিন্টু ঘুড়ি ছাড়ে, প্রথমে ঘুড়ি একটু দুলে ওঠে বাতাসে, তারপর ধীরে ধীরে উপরে ওঠে, তারপর হাওয়ায় ভেসে যায়, আরও উঁচু, আরও উঁচু। পিন্টু অবাক হয়ে দেখে, তার ঘুড়ি আজ সত্যিই আকাশ ছুঁয়েছে। বাতাসে ঘুড়ি দুলছে, রঙিন কাগজের ঘুড়ি সূর্যের শেষ আলোয় লাল আর হলুদ রঙে ঝলমল করছে।

হরি দা পিন্টুর কাঁধে হাত রাখে। বলে, “দ্যাখ, স্বপ্নটা খুব সহজ। শুধু একটু সাহস লাগে, আর লাগে কেউ পাশে থাকা। তোর ঘুড়ি তো আকাশে উঠেছে, এবার তুই নিজেও উড়বি, পিন্টু।”

পিন্টু তখন ঘুড়ির দিকে চেয়ে থাকে, তার চোখে জল আসে, কিন্তু সে সেই জল লুকিয়ে ফেলে। সে জানে, আজ তার জীবনের এক নতুন অধ্যায় শুরু হল।

তিন

সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এসেছে শহরের বুকে। কিন্তু বস্তির সেই ছোট্ট ছাদে আলো ছড়াচ্ছে অন্যরকম এক স্বপ্নের দীপ্তি। পিন্টুর রঙিন ঘুড়ি তখনও আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে। চারপাশের হাওয়া যেন তার ঘুড়িকে বারবার উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে আকাশের আরও গভীরে, আরও উচ্চতায়। পিন্টুর মুখে তখন অন্যরকম এক চওড়া হাসি। তার হাতে ঘুড়ির সুতো, কিন্তু তার মন তখন উড়ছে সেই ঘুড়ির সঙ্গেই, আকাশের অসীমে।

হরি দা পাশ থেকে বলে, “দ্যাখ, পিন্টু, ঘুড়ি যত উপরে যাবে, ততই তোর মনও মুক্ত হবে। আর এই মুক্ত মন নিয়ে তুই সব পারবি।”

পিন্টু কিছু বলে না, শুধু মাথা নাড়ে। তার চোখ জলে ভিজে উঠেছে, সেই জল লুকিয়ে রাখতে চায় সে।

এদিকে বস্তির অন্য বাচ্চারা একে একে জড়ো হতে শুরু করেছে ছাদে আর পাশের গলিতে। কারও হাতে ফুটো বেলুন, কারও হাতে ভাঙা খেলনা, কিন্তু সবার চোখে তখন এক আশ্চর্য জ্বলজ্বলে আলো। তারা অবাক হয়ে দেখছে সেই রঙিন ঘুড়ি, যা এতদিন শুধু আকাশে উড়ে বেড়ানো অন্য কারও ঘুড়ি হিসেবে দেখেছে তারা। আজ সেই ঘুড়ি তাদেরই পাড়ার পিন্টুর হাতে।

“ওই দেখ ঘুড়ি! পিন্টুর ঘুড়ি!” কেউ একজন চিৎকার করে ওঠে।

ছোট্ট মেয়ে ঝুমু মুগ্ধ হয়ে বলে, “ওরে, পিন্টু কি সুন্দর ঘুড়ি বানাইছে! আমি ওর মতো ঘুড়ি ওড়াব।”

আরেকটু বড় রবি বলে, “পিন্টু ভাই, আমাকেও শেখাবি না ঘুড়ি বানানো?”

পিন্টু প্রথমে লজ্জা পায়। এতদিন সে তাদের সঙ্গে মিশে থেকেছে সমানভাবে, কেউ তাকে আলাদা করে নজরে নেয়নি। আজ তার ঘুড়ির জন্য সে সবার চোখে নায়ক। সে হেসে বলে, “অবশ্যই শিখাবো। হরি দা শিখিয়েছে, এবার আমিও তোদের শেখাবো।”

হরি দা তখন মৃদু হেসে বলে, “দ্যাখ, স্বপ্নের জিনিসগুলো যখন ভাগ করা যায়, তখন তার মানে অনেক বড় হয়ে যায়। তোর ঘুড়ি শুধু তোর নয়, এখন এই পাড়ার সবার।”

রাত বাড়তে থাকে। আকাশের তারাগুলো জ্বলে ওঠে। পিন্টু ঘুড়ি গুটিয়ে আনে, মায়ের কাছে যায়। মা তার ছেলের মুখের উজ্জ্বলতা দেখে অবাক হয়ে যায়। পিন্টু চুপচাপ ঘুড়িটা মায়ের হাতে দেয়। মা বলল, “এত সুন্দর ঘুড়ি কোথা থেকে পেলি?”

পিন্টু তখন হরি দার গল্প বলে, ঘুড়ি বানানোর গল্প বলে, আর বলে, কেমন করে সে আকাশ ছুঁয়েছে আজ প্রথমবার। মা পিন্টুর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, “তুই আমার গর্ব, পিন্টু। তোকে দেখে অন্য বাচ্চারাও স্বপ্ন দেখতে শিখবে।”

সেই রাতটা পিন্টু আর ঘুড়ির জন্য এক অন্যরকম রাত হয়ে থাকে। পরের দিন সকাল থেকে পাড়ার বাচ্চারা ভিড় করে হরি দার কাছে আর পিন্টুর চারপাশে। কেউ ঘুড়ির কাগজ খুঁজে আনে, কেউ সুতো, কেউ ভাঙা কঞ্চি। হরি দা আর পিন্টু মিলে শুরু করে তাদের শেখানো।

একটা ঘুড়ি তৈরি হয় ঝুমুর জন্য—হালকা নীল কাগজে সাদা তারার নকশা। একটায় রবির জন্য—সবুজ কাগজে লাল চাঁদ আঁকা। বস্তির গলি তখন যেন ঘুড়ি বানানোর কারখানা হয়ে ওঠে।

দুপুরের পর ছাদে গিয়ে একে একে বাচ্চারা তাদের ঘুড়ি ওড়ায়। প্রথমে ঘুড়ি একটু এদিক ওদিক দুলে পড়ে যায়, বাতাসে ঠিকমতো ভাসে না। কিন্তু হরি দা আর পিন্টু তাদের সাহস দেয়। বারবার চেষ্টা করতে থাকে তারা। শেষমেশ একে একে ঘুড়িগুলো উড়তে শুরু করে।

ছোট ছোট ঘুড়ির লেজ বাতাসে দুলতে থাকে, কাগজের রঙে ভরে যায় আকাশ। পাড়ার বড়রা তখন ছাদে উঠে দাঁড়িয়ে দেখে সেই দৃশ্য। কেউ বলে, “এই বাচ্চাগুলো যে এমন ঘুড়ি বানাতে পারবে ভাবিনি!” কেউ বলে, “এই পিন্টু তো আসলেই কম বড় নয়!”

দিন যেতে থাকে, ঘুড়ির গল্প ছড়িয়ে পড়ে পাড়ার গলি থেকে পাশের পাড়ায়। অন্য পাড়ার বাচ্চারাও এসে ঘুড়ি বানাতে চায়। পিন্টু আর হরি দা কারও ফেরায় না। তারা শেখাতে থাকে, ভালোবাসতে শেখায়, স্বপ্ন দেখতে শেখায়।

পিন্টুর নিজের মনেও এক নতুন স্বপ্ন জন্ম নেয়। সে ভাবে, যদি ঘুড়ি বানানোর একটা ছোট্ট দোকান খুলতে পারত! যেখানে পাড়ার বাচ্চাদের জন্য সস্তায় ঘুড়ি মিলত, যেখানে হরি দা থাকতেন, শিখিয়ে দিতেন, আর বাচ্চাদের কেউ আর ঘুড়ি না পেয়ে কাঁদত না।

পিন্টু সেই স্বপ্নটা মায়ের কাছে বলে। মা তাকে আশীর্বাদ করে, বলে, “তুই পারবি রে বাবা। তোর ইচ্ছে আছে, তোর চেষ্টা আছে, ঈশ্বর তোকে পথ দেখাবেই।”

এদিকে হরি দা পিন্টুর কাঁধে হাত রেখে বলে, “তুই আমার থেকে অনেক বড় শিল্পী হবি, পিন্টু। ঘুড়ি তো উড়ছেই, এবার তোর জীবনও উড়বে।”

সন্ধ্যে হলে আবার সেই ঘুড়ির মেলা বসে বস্তির ছাদে। রঙিন কাগজের ঘুড়ি, বাচ্চাদের হাসি, হরি দার সুরে বাঁশির টান—সব মিলিয়ে বস্তি তখন আর বস্তি থাকে না, হয়ে ওঠে এক রঙিন স্বপ্নের গ্রাম।

চার

সকালের প্রথম রোদ এসে পড়েছে বস্তির ছোট্ট গলিতে। পিন্টু ঘুম থেকে উঠে ছাদে যায়। রাতে যে ঘুড়িগুলো আকাশে উড়েছিল, সেগুলোর সুতো গুটিয়ে রেখেছে সে। ঘুড়ির রঙ তখনও টাটকা, যেন আকাশের রঙ তার গায়ে লেগে আছে। হাওয়া একটু বইছে, ঘুড়ির কাগজে সেই হাওয়ার স্পর্শ পেয়ে কাগজের কিনারা কাঁপছে হালকা কাঁপুনিতে। পিন্টু সেই কাঁপুনি দেখতে দেখতে ভাবে, এ কাঁপুনি কাগজের নয়, ওর নিজের মনের, ওর স্বপ্নের।

পিন্টু মায়ের কাছে এসে বলে, “মা, আমি ঘুড়ির দোকান খুলব। বড় দোকান নয়, ছোট্ট একটা ঘরই চলবে। পাড়ার বাচ্চারা ঘুড়ি পাবে, আর কেউ না কাঁদবে ঘুড়ি না পেয়ে।”

মা কাজের মাঝে থমকে দাঁড়ায়। পিন্টুর চোখের দিকে তাকায়। সেই চোখে মায়ের যেন অজিত বাবুর চোখের ছায়া দেখতে পায়, যে চোখে স্বপ্ন থাকত, সাহস থাকত, আর থাকত অন্যের জন্য কিছু করার তাগিদ। মা পিন্টুর গাল স্পর্শ করে বলল, “যা মন চায় কর রে পিন্টু। তোর ইচ্ছে পূরণ হোক। তুই যদি স্বপ্নে বিশ্বাস করিস, তোর ঘুড়ি যেমন আকাশ ছুঁয়েছে, তোর স্বপ্নও তেমনি ছুঁবে।”

পিন্টু সেই দিন থেকেই শুরু করে তার স্বপ্নের দোকানের পরিকল্পনা। হরি দা তাকে সাহস দেয়, বলে, “শোন পিন্টু, দোকান মানে শুধু ঘর নয়। দোকান মানে হলো আশ্রয়, যেখানে বাচ্চাদের স্বপ্ন তৈরি হবে, ঘুড়ির সুতো বোনা হবে, আর আকাশের সঙ্গে মনের বন্ধন হবে। এই কথা মনে রেখ।”

পাড়ার অন্য বড়রাও এগিয়ে আসে। কালীচরণ দা, যে পাশের চায়ের দোকান চালায়, বলে, “পিন্টু, দোকানের জন্য কাঠের টুকরো লাগবে? আমি আমার পুরনো বেঞ্চিটা দিচ্ছি। সেটার কাঠ তোর কাজে লাগবে।”

পাড়ার হাসু কাকু, যে রিকশা চালায়, সে বলে, “আমি তোকে কাগজ আনতে সাহায্য করব। ওয়ার্কশপের ছেঁড়া কাগজ ফেলে দেয় ওরা। আমি সেটা জোগাড় করে দেব।”

এইভাবে পাড়ার মানুষ একে একে পাশে দাঁড়ায়। কেউ সুতো দেয়, কেউ পুরনো কাঁচি দেয়, কেউ আবার দেয় একমুঠো সাহস। পিন্টু আর হরি দা মিলে ছোট্ট একটা পরিত্যক্ত কুঠুরি ঠিক করে দোকান বানায়। ভাঙা টিনের চালের ফাঁক দিয়ে দুপুরের রোদ ঢোকে, আর সেই আলো পড়ে ঘুড়ির কাগজের রঙে। দোকানটার নাম দেয় পিন্টু—“রঙিন স্বপ্ন ঘুড়ির ঘর।”

প্রথম দিন দোকান খুলতেই বাচ্চারা ভিড় করে। কারও হাতে দু-টাকা, কারও হাতে কিছুই নেই। কিন্তু পিন্টু টাকার চেয়ে হাসিকে বড় করে দেখে। সে বলে, “যার কাছে যা আছে দিস। আর যদি কিছুই না থাকে, তাও ঘুড়ি পাবি। স্বপ্নের দাম টাকা দিয়ে হয় না।”

হরি দা ঘুড়ি কাটতে কাটতে বলে, “দ্যাখ পিন্টু, তোরা আজ যা শুরু করলি, সেটা শুধু ঘুড়ির দোকান নয়। এটা স্বপ্নের কারখানা। বস্তির বাচ্চারা স্বপ্ন দেখতে শিখছে, আকাশ ছোঁয়ার সাহস পাচ্ছে।”

সন্ধ্যার দিকে পিন্টু আর হরি দা দোকানের সামনের রাস্তার পাশে বসে থাকে। দোকানের ভেতর তখন কাগজের ঘ্রাণ, সুতোয় জড়িয়ে থাকা ঘুড়ির লেজের নরম স্পর্শ, আর আশার গল্প।

রাতে ঘরে ফিরে পিন্টু মায়ের কাছে বসে বলে, “মা, দোকানটা কেমন হলো?”

মা হেসে বলে, “দোকান তো নয়, তুই স্বপ্ন বেচিস পিন্টু। আর যে স্বপ্ন বেচে, তার ঘর কখনও ফাঁকা হয় না।”

পিন্টু চুপ করে থাকে। চোখ বন্ধ করে ভাবে, একদিন এই দোকান বড় হবে, আরও অনেক ঘুড়ি উড়বে, বস্তির আকাশ ভরে যাবে রঙে রঙে। সেই রঙ শুধু কাগজের নয়, সেই রঙ বাচ্চাদের মনের রঙ।

সেই রাত বস্তির আকাশে নতুন তারা ফুটিয়ে দেয়। আর পিন্টু ঘুমের ঘোরে দেখে তার দোকানের ঘুড়ি একে একে আকাশ পেরিয়ে দূর পাহাড়, নদী আর মাঠ পেরিয়ে উড়ছে—সব বাচ্চাদের জন্য, যারা কখনও স্বপ্ন দেখতে সাহস পায়নি।

পাঁচ

আকাশ ভরে উঠেছে বসন্তের নরম হাওয়ায়। পিন্টুর ঘুড়ির দোকান তখন আর শুধু দোকান নয়, বস্তির সবার প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠেছে। প্রতিদিন বাচ্চারা ভিড় করে, নতুন নতুন ঘুড়ি বানানোর চেষ্টা করে, কেউ নিজের হাতে নকশা আঁকে, কেউ রঙ মেশায় কাগজে। পিন্টু আর হরি দা তাদের সবসময় সাহস দেয়, শিখিয়ে দেয় কিভাবে মনের মতো ঘুড়ি বানানো যায়।

কিন্তু একদিন হঠাৎ পিন্টুর মনে হলো, শুধু ঘুড়ি বিক্রি বা বানানো নয়, কিছু একটা বিশেষ হওয়া উচিত। পাড়ার সব বাচ্চারা একসঙ্গে ঘুড়ি উড়াবে, একসঙ্গে আনন্দ করবে—এই ভাবনা তাকে তাড়িয়ে বেড়াতে লাগল। পিন্টু মায়ের কাছে বসে তার কথা বলল। মা পিন্টুর কথা শুনে মৃদু হেসে বলল, “তুই যা ভাবিস, ভালোই ভাবিস। কর রে বাবা, উৎসব কর। মানুষ যেমন মাটিতে বাঁচে, তেমনি স্বপ্নেও বাঁচে।”

সেই রাতেই পিন্টু হরি দার সঙ্গে বসে পরিকল্পনা শুরু করে। হরি দা তার হাতে ধরে বলে, “যা ভাবছিস, সেটা কর। ঘুড়ির উড়ান শুধু খেলা নয়, এটা আশার উড়ান। তোর ঘুড়ির উৎসব হবে এই পাড়ার গর্ব।”

পিন্টু আর হরি দা পরের দিন থেকে বস্তির প্রতিটি ঘরে গিয়ে সবাইকে খবর দেয়—“আগামী রবিবার ঘুড়ির উৎসব। সবাই আসবে। যার ঘুড়ি নেই, সে দোকানে এলে পাবে। আমরা কেউ ঘুড়ি ছাড়া থাকব না।”

কালীচরণ দা চায়ের দোকান থেকে বলে, “আমি চায়ের বন্দোবস্ত করব।”

হাসু কাকু বলে, “আমি রাস্তাটা ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করে রাখব।”

পাড়ার মায়েরা বলে, “আমরা বাচ্চাদের জন্য মুড়ি-চানাচুর করব।”

সেই এক সপ্তাহ ধরে বস্তি যেন উৎসবের রঙে রঙিন হয়ে যায়। ঘুড়ির দোকান ব্যস্ত থাকে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত। বাচ্চারা রঙ মেশায় কাগজে, কেউ লাল, কেউ হলুদ, কেউ নীল—আকাশ ভরিয়ে দেবে যে সব রঙ, সেই রঙে কাগজ সেজে ওঠে।

অবশেষে সেই প্রতীক্ষিত রবিবার আসে। সকাল থেকে বস্তির আকাশে এক অন্যরকম উত্তেজনা। বাচ্চারা তাদের ঘুড়ি হাতে ছাদে ছাদে ছুটছে। কেউ তার ঘুড়ির লেজ ঠিক করছে, কেউ সুতো গুছিয়ে নিচ্ছে। পিন্টু আর হরি দা ছোট্ট একটা বাঁশি বাজিয়ে উৎসবের শুরু ঘোষণা করে।

ছাদের উপর দাঁড়িয়ে পিন্টু চিৎকার করে বলে, “সবাই একসঙ্গে ঘুড়ি ছাড়ি! তিন… দুই… এক…”

আর তখন একসঙ্গে আকাশে ভেসে ওঠে শত শত ঘুড়ি। লাল, নীল, সবুজ, হলুদ কাগজের ঘুড়ি, কাগজের লেজ বাতাসে নেচে ওঠে। পাড়ার মানুষের মুখে তখন একটাই হাসি। বাচ্চাদের আনন্দ আর গর্বে চোখ চকচক করে ওঠে।

ঘুড়ির লেজে হাওয়ার টানে কেমন করে নাচে তা দেখে পাড়ার বুড়োরা বলে, “এমন দৃশ্য শেষ কবে দেখেছি মনে পড়ে না!”

পিন্টু দাঁড়িয়ে থাকে ছাদের কোণে, সুতো হাতে ধরে তার নিজের ঘুড়িটাকে দেখে। সেই ঘুড়ি আকাশের অনেক ওপরে গিয়ে বাতাসে দুলছে, যেন বলে—“স্বপ্ন দেখে যা, থামিস না।”

হরি দা পাশ থেকে বলে, “তোর ঘুড়ি শুধু তোর নয় পিন্টু। তোর ঘুড়ি হলো এই পাড়ার ঘুড়ি, এই পাড়ার স্বপ্নের ঘুড়ি। দেখ কেমন করে আকাশ ভরিয়ে দিয়েছে।”

সারাদিন সেই ঘুড়ির উৎসব চলে। কেউ কারও সুতো কেটে দেয় না, কেউ কারও ঘুড়ি ফেলায় না। এখানে ঘুড়ির লড়াই নেই, এখানে ঘুড়ির উড়ান একতার উড়ান।

দুপুরে পাড়ার মা-মাসিরা মুড়ি চানাচুর বিতরণ করে। চায়ের কাপ হাতে কালীচরণ দা বলে, “পিন্টু, তুই আজ প্রমাণ করে দিলি, স্বপ্নের দাম টাকা দিয়ে হয় না। ঘুড়ি আজ আশার প্রতীক হয়ে উঠেছে।”

বিকেলের দিকে সূর্য ঢলে পড়ে। ঘুড়িগুলো আস্তে আস্তে নামিয়ে আনা হয়। পিন্টু সবার শেষে নিজের ঘুড়িটা নামায়। তার ঘুড়ির সুতোয় তখন রোদ, হাওয়ার গন্ধ আর শত শত শিশুর স্বপ্নের স্পর্শ লেগে থাকে।

রাতে মায়ের কাছে ফিরে পিন্টু বলে, “মা, আজ আমাদের উৎসব কেমন হলো?”

মা হেসে বলে, “দেখলি তো, আকাশ শুধু তারাদের নয়। আকাশ হলো স্বপ্ন দেখার জায়গা। তুই আজ বস্তির আকাশ ভরিয়ে দিলি স্বপ্নে।”

সেই রাতে বস্তির মানুষ ঘুমোয় অন্যরকম তৃপ্তি নিয়ে। পিন্টু ঘুমের ঘোরে দেখে, তার ঘুড়ি আকাশ পেরিয়ে দূরের শহরে উড়ছে, আরও অনেক বাচ্চার কাছে গিয়ে বলছে, “তোমরা স্বপ্ন দেখো, তোমরাও আকাশ ছুঁতে পারো।”

ছয়

সেই ঘুড়ি উৎসবের পর থেকে বস্তির আকাশ আর আগের মতো নির্লিপ্ত থাকে না। প্রতিটি সকালে শিশির ভেজা বাতাসে ঘুড়ির কাগজের গন্ধ মিশে যায়। পিন্টুর ছোট্ট দোকান তখন শুধু ঘুড়ির ঘর নয়, বস্তির শিশুদের স্বপ্ন দেখার জায়গা হয়ে গেছে। সকাল হতেই বাচ্চারা একে একে দোকানে এসে ভিড় জমায়। কেউ নিজের হাতে কাগজ কেটে ঘুড়ির নকশা আঁকে, কেউ সুতো জোগাড় করে, কেউ কাগজে রঙ লাগায়।

হরি দা, যিনি এখন পিন্টুর সঙ্গী হয়ে উঠেছেন, প্রতিদিন ঘুড়ি তৈরির নতুন নতুন কৌশল শেখান। পিন্টু হরি দার কথাগুলো মন দিয়ে শোনে, আর তার মনের মধ্যে আরও নতুন ঘুড়ির স্বপ্ন জন্ম নেয়। এই দোকান যেন এক স্কুল হয়ে ওঠে, যেখানে পড়ানো হয় কিভাবে আকাশ ছোঁয়া যায়, কিভাবে স্বপ্নকে রঙিন করা যায়।

একদিন পিন্টু ভাবে, শুধু বস্তির বাচ্চারা নয়, বাইরের পাড়ার বাচ্চাদেরও স্বপ্ন দেখানো দরকার। সে হরি দার সঙ্গে পরামর্শ করে। হরি দা বলে, “তুই ঠিক বলেছিস। স্বপ্নের কোনো গণ্ডি হয় না পিন্টু। ঘুড়ির মতো স্বপ্নও সবার, যে চায় সে-ই ধরতে পারবে।”

তারা ঠিক করে পাশের পাড়ার মাঠে একদিন রঙিন আকাশের উৎসব হবে। খবর ছড়িয়ে পড়ে। পাড়ার ছোট বড় সবাই উৎসাহিত হয়। কেউ বলে, “আমরা সুতোর জোগাড় করে দেব।” কেউ বলে, “আমরা মাঠ সাফ করে দেব।” দোকান ভরে যায় রঙিন কাগজে, সুতোয়, বাঁশের কাঠিতে, আর স্বপ্নে।

অবশেষে সেই দিন আসে। সকাল থেকেই আকাশ পরিষ্কার থাকে। দূরে দূরে ছোট ছোট মেঘের দল ভেসে বেড়ায়। যেন মেঘরাও অপেক্ষা করছে, আজ তাদের সঙ্গী হবে শত শত ঘুড়ি। পিন্টু আর হরি দা প্রথম ঘুড়িটা আকাশে ছাড়ে। সেই ঘুড়ি লাল আর সাদা রঙে সাজানো। বাতাসের টানে ঘুড়িটা হাওয়ায় ভেসে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চারা একে একে তাদের ঘুড়ি ছাড়তে শুরু করে।

লাল, নীল, হলুদ, সবুজ, কমলা—সব রঙের ঘুড়ি ভেসে ওঠে একসঙ্গে। আকাশ যেন এক বিশাল ক্যানভাস হয়ে যায়, যেখানে বাচ্চাদের স্বপ্ন রঙ ছড়িয়ে দেয়। দূর থেকে তাকালে মনে হয় আকাশে রঙিন ফুল ফুটে আছে, আর সেই ফুলগুলো হাওয়ায় দোল খাচ্ছে।

ঘুড়ির সুতো টেনে টেনে বাচ্চারা হাসছে, চিৎকার করছে। কেউ কেউ প্রথমবার ঘুড়ি উড়িয়েছে, তাদের চোখে আশ্চর্যের আলো। কেউ কারও সুতো কাটার চেষ্টা করছে না, এখানে লড়াই নেই, আছে একসঙ্গে আকাশ ছোঁয়ার চেষ্টা।

হরি দা পিন্টুর পাশে দাঁড়িয়ে বলে, “দেখ পিন্টু, তুই কী করেছিস! শুধু ঘুড়ি নয়, তুই মানুষের মন একসঙ্গে বেঁধে দিয়েছিস। এই আকাশের মতো তাদের স্বপ্নও সীমাহীন হলো।”

পিন্টু তখন চুপ করে থাকে। তার চোখে জল আসে আনন্দের। সে ভাবে, বাবার কথা, মায়ের কথা, হরি দার কথা। সে ভাবে, এই আকাশে হয়তো তার বাবার আশীর্বাদ লুকিয়ে আছে, সেই আশীর্বাদেই তার ঘুড়ি এত দূর উড়তে পেরেছে।

সারাদিন সেই রঙিন আকাশের উৎসব চলে। বাচ্চারা খেলতে খেলতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। পাড়ার মায়েরা মাঠের পাশে বসে মুড়ি, চানাচুর আর জল বিতরণ করে। কালীচরণ দা চায়ের হাঁড়ি বসিয়ে দিয়েছে। ছোট ছোট চায়ের কাপে গরম ধোঁয়া উঠছে, আর সেই ধোঁয়ার সঙ্গে মিশে যাচ্ছে ঘুড়ির কাগজের ঘ্রাণ।

বিকেল গড়াতে গড়াতে সূর্যের আলো নরম হতে থাকে। আকাশের ঘুড়িগুলো তখনও বাতাসে দুলছে। পিন্টু জানে, এ শুধু ঘুড়ির নাচ নয়, এ স্বপ্নের নাচ।

সন্ধ্যা নামার আগে বাচ্চারা একে একে ঘুড়ি গুটিয়ে নেয়। তারা সবাই পিন্টুর দোকানের দিকে ছুটে যায়। দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে তারা বলে, “পিন্টু দাদা, আবার কবে এমন হবে? আমরা আবার আকাশ ভরাবো না?”

পিন্টু হেসে বলে, “এই আকাশ তো তোমাদেরই। যখন খুশি ঘুড়ি উড়াবে, যখন খুশি স্বপ্ন দেখবে। ঘুড়ির আকাশ আর স্বপ্নের আকাশ এক।”

সেই রাতে পিন্টু বাড়ি ফিরে মায়ের কাছে বসে। মা তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, “তুই আকাশ ভরালি রে পিন্টু। আজ শুধু আকাশ নয়, মানুষের মনও রঙিন হলো।”

পিন্টু জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকায়। রাতের আকাশে তারা জ্বলছে। সে ভাবে, তার ঘুড়িগুলো হয়তো এখনো আকাশে ভাসছে, সেই তারা হয়ে জ্বলছে। তার ঘুড়ি একদিন হয়তো আরও দূর যাবে, আরও অনেক শিশুর কাছে যাবে, আর তাদের স্বপ্ন দেখাবে আকাশ ছোঁয়ার।

সাত

রঙিন আকাশের সেই উৎসব শেষ হওয়ার পরও পিন্টুর মনে এক অদ্ভুত আলোড়ন চলতে থাকে। প্রতিদিন সকালে ঘুম ভেঙে সে মনে মনে ভাবে, আজ আকাশে নতুন কী স্বপ্নের রঙ ছড়িয়ে দেওয়া যায়। দোকানটা এখন আর শুধু দোকান নয়, পাড়ার বাচ্চাদের স্বপ্নের আঁকাবাঁকা রাস্তা, যেখানে তারা ঘুড়ির সুতোয় বাঁধে তাদের আশা, ভালোবাসা আর জীবনের ছোট ছোট আনন্দের মুহূর্ত।

সেই দিনগুলোতে পিন্টুর দোকান ভরে যায় নতুন কাগজের গন্ধে, বাঁশের কাঠির খচখচ শব্দে আর বাচ্চাদের হাসির আওয়াজে। হরি দা দোকানের একপাশে বসে বাঁশ কেটে কাঠি তৈরি করে। পিন্টু আর বাচ্চারা কাগজে রঙ তোলে, নকশা আঁকে, কেউ ফুলের ছবি আঁকে, কেউ তারা-চাঁদ আঁকে, কেউ নিজের নাম লিখে রাখে ঘুড়ির গায়ে। যেন ঘুড়িটা শুধু আকাশে নয়, তাদের মনের কথাও আকাশে পৌঁছে দেয়।

একদিন সকালে দোকানের সামনে এসে দাঁড়ায় পাশের পাড়ার স্কুলের মাস্টার মশাই। তিনি পিন্টুকে ডেকে বলেন, “পিন্টু, তোর ঘুড়ির কথা এখন সবাই জানে। আমাদের স্কুলে আসিস একদিন, বাচ্চাদের শেখাস কীভাবে ঘুড়ি বানাতে হয়, কীভাবে স্বপ্ন দেখা যায়।”

পিন্টুর চোখ জ্বলে ওঠে। তার ঘুড়ি যে এত দূর যাবে, সে কখনও ভাবেনি। সে সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যায়। পরের রবিবার সে হরি দাকে সঙ্গে নিয়ে স্কুলে যায়। স্কুলের মাঠে তখন ভিড় করে আছে ছোট ছোট বাচ্চারা। তাদের চোখে উৎসাহের আলো, যেন ঘুড়ির গল্প শোনার জন্য তারা অপেক্ষা করছে কত দিন ধরে।

পিন্টু একে একে কাগজ কাটা, কাঠি বসানো, সুতো বাঁধা শেখায়। হরি দা তাদের বোঝায় বাতাস বোঝার কৌশল। বাচ্চারা মন দিয়ে শোনে, চেষ্টা করে। আর একটু পরে মাঠে ভেসে ওঠে প্রথম ঘুড়ি। সেই ঘুড়ি শুধু কাগজ নয়, যেন নতুন স্বপ্নের পাখা মেলে দেয়।

মাস্টার মশাই পাশে দাঁড়িয়ে পিন্টুর পিঠ চাপড়ে দেয়। বলেন, “তুই যে কী কাজ করছিস, তা তুই এখন বুঝছিস না। একদিন এই ঘুড়ি এই বাচ্চাদের মন ভরাবে, স্বপ্ন দেখাবে, সাহস দেবে।”

সেই দিনের পর থেকে পিন্টু শুধু নিজের দোকানেই নয়, স্কুলের মাঠে, পাড়ার রাস্তায়, যেখানে যেখানে সুযোগ পায়, ঘুড়ির গল্প বলে, ঘুড়ির স্বপ্ন দেখায়। তার ঘুড়ির দোকান এখন আর শুধু বিক্রির জায়গা নয়। এখানে আসে স্বপ্ন দেখতে ইচ্ছুক মানুষ, আসে যারা আকাশ ছুঁতে চায়।

একদিন সন্ধ্যায় পিন্টু একা ছাদে বসে। তার নিজের তৈরি এক ঘুড়ি হাতে। সেই ঘুড়িতে সে লিখেছে—“স্বপ্ন থামে না।” সে ঘুড়িটা আকাশে ছাড়ে। বাতাসে ভেসে ওঠে ঘুড়ি, ধীরে ধীরে ওপরে ওঠে। সে তাকিয়ে থাকে সেই ঘুড়ির দিকে, যতক্ষণ না ঘুড়িটা এক বিন্দু হয়ে যায়।

পাশে এসে দাঁড়ায় হরি দা। সে বলে, “দেখলি পিন্টু? তোর ঘুড়ি কত দূর গেল! স্বপ্নেরও ঠিকানা নেই, ঘুড়িরও ঠিকানা নেই।”

পিন্টু চুপ করে থাকে। তার চোখে তখন অন্যরকম স্বপ্নের ঝিলিক। সে ভাবে, এই ঘুড়িই তার জীবনের সঙ্গী, এই ঘুড়িই তাকে শিখিয়েছে লড়াই করতে, শিখিয়েছে কিভাবে মানুষের মন জেতা যায়।

সেই রাতে পিন্টু মায়ের কাছে বসে। মা তার চুলে বিলি কেটে দেয়। পিন্টু বলে, “মা, ঘুড়ি কি সত্যিই মানুষের জীবন পাল্টাতে পারে?”

মা মৃদু হেসে বলে, “ঘুড়ি হলো স্বপ্নের প্রতীক। যে স্বপ্ন দেখে, তার জীবন একদিন পাল্টাবেই। তুই তো স্বপ্ন দেখছিস, তোর জীবনও বদলাচ্ছে, দেখছিস না?”

পিন্টু জানে, এ শুধু ঘুড়ির গল্প নয়, এ তার নিজের গল্প, তার লড়াইয়ের গল্প, তার আকাশ ছোঁয়ার গল্প। আর সে জানে, এই স্বপ্ন সে একা দেখে না—সেই স্বপ্ন দেখে তার পাড়া, তার বন্ধু, তার শহর, আর একদিন হয়তো তার দেশও।

রাতের আকাশে তাকিয়ে পিন্টু দেখে, হাজার তারা জ্বলছে। মনে হয় প্রতিটি তারাই তার ঘুড়ির মতো, প্রতিটি তারাই স্বপ্নের আলো হয়ে ঝিকমিক করছে।

আট

ঘুড়ির আকাশে পিন্টুর সেই স্বপ্নের শুরু, আর সেই শুরু যেন প্রতিদিন এক নতুন গল্প লিখতে থাকে। পিন্টু এখন আর শুধুই ঘুড়ি বিক্রেতা নয়; সে হয়ে উঠেছে এক স্বপ্নবিক্রেতা, যার ঘুড়ির দোকান থেকে মানুষ শুধু কাগজ আর সুতো কিনে নেয় না, নিয়ে যায় সাহস, আশা আর নিজের সীমা ছাড়িয়ে যাওয়ার তাগিদ।

অধ্যায় ৮ শুরু হয় এক হালকা মেঘলা সকাল দিয়ে। পিন্টু দোকান খোলার আগেই দেখল, দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে দুটো অজানা মুখ—একজন শহরের বড় স্কুলের শিক্ষক, আর অন্যজন একজন সাংবাদিক। তাদের চোখে আগ্রহের ঝিলিক।

“তুমি পিন্টু?” সাংবাদিক প্রশ্ন করে।

পিন্টু লাজুক হেসে মাথা নাড়ে। “হ্যাঁ, আমি। বলুন না?”

শিক্ষক বললেন, “আমরা তোমার ঘুড়ির গল্প শুনেছি। আমরা চাই, তুমি আমাদের স্কুলের ছেলেমেয়েদের শিখাও, কিভাবে ঘুড়ি তৈরি করতে হয়। শুধু তাই নয়, তুমি তাদের শেখাও কিভাবে স্বপ্ন দেখতে হয়।”

পিন্টুর বুকটা গর্বে ভরে যায়। সে ভাবতে পারে না, তার ছোট দোকান থেকে তার গল্প এত দূর ছড়িয়ে পড়েছে।

পরের রবিবার পিন্টু হরি দাকে নিয়ে যায় সেই বড় স্কুলে। সেখানে সাজানো মাঠ, লাল ইটের দালান আর ছেলেমেয়েদের কোলাহল। পিন্টু অবাক হয়, যখন দেখে, শহরের বড় ঘরের ছেলেমেয়েরা কত আগ্রহ নিয়ে ঘুড়ি বানাতে চাইছে, শিখতে চাইছে সেই কৌশল যা সে রোজ বস্তিতে শিখেছে জীবনের সঙ্গে লড়তে লড়তে।

ঘণ্টার পর ঘণ্টা তারা কাগজ কেটে, কাঠি বসিয়ে, সুতো বেঁধে তৈরি করে ঘুড়ি। কেউ আঁকে লাল সূর্য, কেউ নীল নদী, কেউ হলুদ ফুল। কেউ কেউ নিজের নাম লেখে, যেন আকাশে উড়বে শুধু তার নিজের গল্পের ঘুড়ি।

পিন্টু প্রত্যেকটাকে সাহায্য করে, হাসে, গল্প বলে, বাতাসের দিক বোঝাতে শেখায়। হরি দা মাঝে মাঝে মৃদু হেসে বলে ওঠে, “দেখো, স্বপ্নের কোনো জাত নেই, কোনো বড় ছোট নেই। ঘুড়ির মতো স্বপ্নও সবার।”

সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে, যখন প্রথম ঘুড়ি উড়ে ওঠে। লাল-নীল-হলুদ ঘুড়ির সারি হাওয়ায় ভেসে ওঠে। শহরের আকাশও তখন হয়ে যায় পিন্টুর বস্তির আকাশের মতো রঙিন, স্বপ্নে ভরা।

সাংবাদিক সেই দৃশ্যের ছবি তোলে। লিখে নেয় পিন্টুর কথা—“স্বপ্ন দেখার অধিকার সবার, ঘুড়ির মতো স্বপ্নও উড়তে জানে, ভেসে যেতে জানে, শুধু তাকে ছাড়তে জানতে হয়।”

রাতের দিকে পিন্টু যখন বাড়ি ফেরে, তখন তার মুখে হাসি। মায়ের সামনে বসে সে বলে, “মা, আজ শহরের বড় স্কুলের ছেলেমেয়েরা আমার ঘুড়ি উড়িয়েছে। মা, ঘুড়ি কি মানুষের সব দেওয়াল পেরোতে পারে?”

মা তার চুলে হাত বুলিয়ে বলে, “ঘুড়ি পেরোয় দেয়াল, ঘুড়ি পেরোয় আকাশের সীমা, আর ঘুড়ি পেরোয় মনের ভয়।”

পিন্টু জানালার বাইরে তাকায়। রাতের আকাশে তারা জ্বলছে। সে জানে, এই তারা যেন তার ঘুড়ির মতো, একদিন তার স্বপ্নের গল্পও ছড়িয়ে পড়বে আরও দূর, আরও বড় আকাশে।

পরের দিনগুলোতে পিন্টুর ঘুড়ির দোকান হয়ে ওঠে এক স্বপ্নের ঠিকানা। শুধু বস্তির বাচ্চারা নয়, শহরের নানা প্রান্ত থেকে মানুষ আসে পিন্টুর সঙ্গে দেখা করতে। কেউ ঘুড়ি কিনতে নয়, কেউ আসে গল্প শুনতে, কেউ আসে স্বপ্ন শিখতে।

একদিন বিকেলে পিন্টু দেখে, দোকানের বাইরে দাঁড়িয়ে এক বৃদ্ধ। চোখে তার বয়সের ভাঁজ, কিন্তু মিষ্টি হাসি। তিনি পিন্টুকে বলেন, “ছেলে, তুই আমার নাতনিকে শেখাবি ঘুড়ি উড়াতে? ওর বাবা মা ব্যস্ত থাকে, আমি চাই ওর ছোট্ট শৈশব রঙিন হোক।”

পিন্টু সেদিন সেই ছোট্ট মেয়েটিকে শেখায় ঘুড়ি ছাড়তে। ছোট হাতের কাঁপা কাঁপা আঙুলে সে সুতো ধরে। বাতাসের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সেই ঘুড়ি উঠতে থাকে ওপরে, ওপরে। পিন্টু দেখে, মেয়েটির চোখে তখন আনন্দের আলো, যা কোনো দামি খেলনায় পাওয়া যায় না।

রাত গভীর হলে পিন্টু নিজের ছোট ঘরে বসে ভাবে, তার ঘুড়ি আজ শুধু আকাশে নয়, মানুষের মনের ভেতরেও উড়তে শিখেছে। সে ভাবে, ঘুড়ি তাকে দিয়েছে এক আলাদা শক্তি, এক আলাদা স্বপ্ন।

সেই রাতে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে পিন্টু ভাবে, একদিন সে আরও অনেক দূরে যাবে, আরও অনেক শিশু আর মানুষের মনে স্বপ্নের ঘুড়ি ছাড়বে। আর সেই স্বপ্ন হবে রঙিন, বাতাসে ভেসে চলা, সীমাহীন আকাশের মতো।

নয়

পিন্টুর জীবনের সেই ঘুড়ির গল্প যেন আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়ে সারা শহর জুড়ে। পাড়ার ছোট্ট ঘুড়ির দোকান আজ স্বপ্নের ঠিকানা হয়ে উঠেছে। যে দোকানের সামনে একদিন শুধু বস্তির ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা দাঁড়াত, আজ সেখানে শহরের নামকরা মানুষেরাও আসছে, কেউ বিস্মিত হয়ে, কেউ অনুপ্রাণিত হয়ে।

এখন সকাল শুরু হয় পিন্টুর জন্য এক নতুন আলোয়। দোকান খোলার আগে সে ছাদে উঠে দাঁড়ায়, আকাশের দিকে তাকায়। কখনও মেঘলা, কখনও নীল আকাশ — কিন্তু প্রতিটি আকাশেই পিন্টু যেন দেখে নতুন রঙের ঘুড়ির ছবি।

সেই দিন সকালে দোকানের সামনে এসে দাঁড়ায় এক অপরিচিত গাড়ি। গাড়ি থেকে নামে এক ভদ্রলোক, চোখে চশমা, পরনে পরিচ্ছন্ন পাঞ্জাবি। তিনি এসে বলেন, “তুমি পিন্টু তো? আমি রাজীব স্যার, শিশু অধিকার কমিশন থেকে এসেছি। তোমার ঘুড়ির গল্প আমরা পত্রিকায় পড়েছি। তোমার কাজ আমাদের ছুঁয়ে গেছে। আমরা চাই, তুমি শহরের অন্য বস্তিগুলোতেও ঘুড়ির কর্মশালা করো। আমরা পাশে থাকব।”

পিন্টু প্রথমে বিশ্বাস করতে পারে না। তার চোখে জল এসে যায়। সে ভাবে, তার তৈরি ঘুড়ি সত্যিই মানুষের মনে স্বপ্ন ছড়াতে পেরেছে। সে সানন্দে রাজি হয়।

পরের সপ্তাহ থেকে শুরু হয় সেই নতুন সফর। শহরের নানা প্রান্তের বস্তি, যেখানকার বাচ্চারা কখনও ঘুড়ি ছোঁয়ার সাহস পায়নি, সেখানেই পিন্টু পৌঁছায়। সে শেখায় কাগজ কাটা, কাঠি বাঁধা, সুতো গাঁথা। আর সঙ্গে শেখায় — কীভাবে স্বপ্ন দেখে মানুষ, কীভাবে ছোট ছোট আশা বড় হয়ে যায় আকাশ ছোঁয়ার সাহসে।

বাচ্চারা প্রথমে লাজুক থাকে। কিন্তু ঘুড়ির রঙিন কাগজ আর পিন্টুর হাসি দেখে তারাও মিশে যায়, তাদের চোখে তখন নতুন স্বপ্নের ঝিলিক। কেউ আঁকে মা-বাবার ছবি ঘুড়িতে, কেউ লেখে নিজের নাম, কেউ আঁকে সূর্য, কেউ তারা।

এভাবেই একদিন পিন্টুর কর্মশালায় আসে টেলিভিশনের এক দল। তারা ছবিতে বন্দি করে পিন্টুর ঘুড়ির আকাশ, ছোট ছোট মুখের হাসি, আর সেই বস্তির আকাশে রঙিন ঘুড়ির ঝলকানি।

রাতের দিকে পিন্টু যখন ক্লান্ত হয়ে ফেরে, তখন জানালার ধারে বসে থাকে। মা এসে জিজ্ঞেস করে, “আজও কতো মানুষের মন জিতলি রে পিন্টু?”

পিন্টু হেসে বলে, “মা, আমি কিছুই করিনি। ঘুড়িই সব করছে। ঘুড়ি শুধু কাগজ নয় মা, ঘুড়ি হলো মানুষের মনের সাহস, ঘুড়ি হলো মানুষের ভাঙা স্বপ্নের মেরামত।”

মা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে পিন্টু। দেখে আকাশে তখন অজস্র তারা, আর মনে হয় প্রতিটি তারা যেন তার ঘুড়ির মতোই, দূর আকাশে জ্বলছে, ভেসে চলেছে।

সেই রাতেই সে ভাবে, এবার শুধু শহরের বস্তি নয়, সে যাবে গ্রামের দিকে, আরও দূর দূরান্তে, যেখানে এখনও ঘুড়ি মানে স্বপ্ন নয়, শুধুই এক কল্পনা। সে জানে, এই পথ সহজ নয়। কিন্তু পিন্টু জানে, স্বপ্নের ঘুড়ি কখনও সহজ পথে উড়ে না।

আর সেই দিন থেকেই পিন্টুর ঘুড়ির দোকান হয়ে ওঠে এক কেন্দ্র, যেখানে আসে চিঠি, আসে ফোন, আসে ডাক — “পিন্টু, এসো আমাদের বাচ্চাদের শেখাও, আমাদেরও স্বপ্ন দেখাও।”

পিন্টু ভাবে, তার ঘুড়ি একদিন দেশের সব আকাশ ছুঁবে। আর সে দিন বেশি দূরে নয়।

দশ

সকালের আকাশে নরম আলো। বস্তির সরু গলিগুলো দিয়ে হাওয়া বয়ে যাচ্ছে, যেন আকাশ নিজেই ডাকছে নতুন ঘুড়ির জন্য। পিন্টু দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে, চোখে দূরের আকাশের দিকে তাকিয়ে। তার চোখে আজ অন্যরকম স্বপ্ন।

পিন্টু আজ বেরোবে নতুন সফরে। দেশের নানা প্রান্তের ডাক এসেছে—গ্রাম, পাহাড়ি অঞ্চল, উপকূলবর্তী ছোট ছোট মফস্বল শহর—যেখানে আজও কোনো ঘুড়ি উড়তে দেখা যায়নি। যাদের আকাশ স্বপ্নহীন, পিন্টু সেখানে স্বপ্ন বুনতে চলেছে।

ট্রেনে চেপে, কখনও বাসে, কখনও পায়ে হেঁটে সে পৌঁছায় একেকটি জায়গায়। পিন্টুর হাতের ঘুড়ি নিয়ে যে শিশুরা একবার দেখে, তারা মুগ্ধ হয়ে যায়। গ্রামের মাঠের ধারে দাঁড়িয়ে পিন্টু শিখিয়ে দেয়, কেমন করে কাগজ কেটে কাঠির গায়ে বসাতে হয়, কেমন করে সুতো বেঁধে ঘুড়িকে শক্ত করতে হয়।

প্রতিটি জায়গায় ঘুড়ির আকাশ হয় এক নতুন গল্পের আকাশ। ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চাদের মুখে যে হাসি ফুটে ওঠে, পিন্টু সেই হাসির জন্যই বাঁচতে চায়।

একদিন সে পৌঁছায় সাঁওতাল পাড়ায়। ওখানকার শিশুরা প্রথমে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। ঘুড়ি বানানো শুরু হলে তাদের চোখে লেগে যায় কৌতূহলের দীপ্তি। পিন্টু দেখে, তারা ঘুড়িতে আঁকে তাদের নাচের ছবি, তাদের মায়ের মুখ, আর আঁকে লাল সূর্য।

পিন্টু ভাবে, ঘুড়ি শুধু খেলার বস্তু নয়, ঘুড়ি মানুষের মনের ভাষা। প্রতিটি ঘুড়ি বলছে, “আমি আছি, আমি স্বপ্ন দেখি, আমি উড়তে জানি।”

এভাবেই দিন যায়। পিন্টু ফিরে আসে কলকাতায়। এখন তার দোকানের নাম সবাই জানে—ঘুড়ির দোকান নয়, স্বপ্নের দোকান।

একদিন টিভির সংবাদে পিন্টুকে দেখানো হয়, তার ঘুড়ি কর্মশালার ছবি ছড়িয়ে পড়ে সোশ্যাল মিডিয়ায়। একদিন প্রধানমন্ত্রী দপ্তর থেকে আসে এক ডাক—“তোমার কাজ দেশের বুকে স্বপ্ন ছড়াচ্ছে। তুমি আসো, আমাদের মঞ্চে তোমাকে সম্মান জানানো হবে।”

পিন্টু অবাক হয়ে যায়। সে ভাবে, যে ছেলে একদিন বস্তির ময়লা কুড়াত, তার ঘুড়ি আজ দেশের মঞ্চে নিয়ে গেছে তাকে।

সেই দিন দিল্লির বড় মঞ্চে পিন্টু দাঁড়ায়। চারপাশে হাজার হাজার মানুষ, বিশিষ্ট অতিথি, দেশের নেতা। পিন্টুর হাতে তুলে দেওয়া হয় সম্মাননা। সংবাদপত্রে শিরোনাম হয়—“ঘুড়ির দেশে স্বপ্নের নায়ক পিন্টু।”

পিন্টু মঞ্চে দাঁড়িয়ে শুধু বলে, “ঘুড়ি আমাকে শিখিয়েছে, স্বপ্নের কোনো সীমা নেই। শুধু সাহস লাগে, আর একটুখানি হাওয়া লাগে, উড়তে জানার জন্য।”

সেই রাতের আকাশে পিন্টু আবার জানালার ধারে বসে থাকে। তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে হাজার হাজার ঘুড়ির ছবি—যা সে নিজে বানিয়েছে, যা সে অন্যদের হাতে তুলে দিয়েছে।

সে ভাবে, একদিন এই ঘুড়ি দেশের সীমানা পেরিয়ে যাবে, পৌঁছে যাবে অন্য দেশের আকাশেও। ঘুড়ি বলবে, স্বপ্ন দেখা মানুষের অধিকার। ঘুড়ি হবে সাহসের প্রতীক, হবে মনের স্বাধীনতার প্রতীক।

মা এসে চুপ করে পাশে বসে। বলে, “পিন্টু, তোর ঘুড়ি তোর বাবার স্বপ্নও পূরণ করল রে। বাবাও চাইত তুই বড় হ। তুই তো ঘুড়ির মতোই আকাশ ছুঁলি।”

পিন্টু মায়ের হাত ধরে। ভাবে, স্বপ্নের কোনো শেষ নেই, যেমন আকাশেরও কোনো শেষ নেই। তার ঘুড়ি উড়বে, উড়তেই থাকবে, যত দিন মানুষ স্বপ্ন দেখতে জানবে।

শেষ রাতের আকাশে তখন চাঁদ ওঠে। পিন্টুর চোখে জল টলমল করে, কিন্তু তার ঠোঁটে হাসি। কারণ সে জানে, তার ঘুড়ির মতো স্বপ্নের ডানা আজ সত্যিই আকাশ ছুঁয়েছে।

1000028158.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *