Bangla - রহস্য গল্প

রক্তে লেখা রত্নচিহ্ন

Spread the love

পারমিতা রায়


ছাদের উপর সেই পাথরের বাক্স

কলকাতার উত্তর শহরতলিতে, শ্যামবাজার থেকে একটু ভেতরে ঢুকলেই যে গলিটার মোড়ে বিশাল এক পামগাছ মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, তার ঠিক পাশেই অবস্থিত “দত্ত ভিলা”। দু’শো বছরের পুরনো এক জমিদারবাড়ি, আজ যার অর্ধেকটা পরিণত হয়েছে কুয়াশা ও কালের ক্ষয়ে ধূসর এক ভগ্নদশা স্তূপে। মেঝেতে ফাটল, দেওয়ালে শ্যাওলা, আর কাঠের জানালায় কেবল বাতাসের ছোঁয়ায় গুনগুন শব্দ—সব মিলিয়ে যেন অতীত নিজে এসে বাসা বেঁধেছে এখানে।

এই বাড়ির একমাত্র উত্তরাধিকারী এখন অর্ণব দত্ত—বয়সে প্রায় তিরিশ, ব্রিটিশ মিউজিয়ামের ইতিহাস বিভাগে পিএইচডি শেষ করে সদ্য ফিরে এসেছে লন্ডন থেকে। ঠাকুরদার মৃত্যুর পর এই পুরনো বাড়িটি তার দায়িত্বে পড়েছে। যদিও আধুনিক জীবনের চাকচিক্য থেকে বহু দূরে এই অন্ধকার বাড়ি, অর্ণবের মনে এক অদ্ভুত আকর্ষণ জেগেছে… যেন পুরনো দেয়ালের ভিতরে কিছু একটা ডাকছে তাকে।

বাড়িতে ঢোকার পর প্রথম কয়েকদিন ঘর পরিষ্কার, আসবাবঘর পোকামাকড়মুক্ত করা, পুরনো আলমারি খোঁজাখুঁজি এসবেই কেটে গিয়েছিল। এক বিকেলে, ঠিক সূর্য ডোবার মুখে, অর্ণব উঠেছিল ছাদে। তার ঠাকুরদা বলতেন, “ছাদে এক কোণে একটা ইটের চাতাল আছে, সেটা সরিও না কখনও।” তখন শুনে হেসেছিল অর্ণব, ভেবেছিল—বুড়ো বয়সে হয়ত কুসংস্কারের ঝোঁক বেড়েছিল।

কিন্তু সেই বিকেলেই, কৌতূহল তাকে ছাড়ল না।

ছাদের পশ্চিম কোণে, বটগাছের শেকড়ে আংশিক ঢেকে থাকা চাতালটি দেখতে পেয়েছিল সে। মাটি-জমে-পাথরের আবরণ পরিষ্কার করতে করতে হঠাৎ তার হাত লাগল কিছু একটার সঙ্গে—ধাতব, ভারী, ঠান্ডা। অর্ণব ধীরে ধীরে ইট সরিয়ে ফেলল।

সামনে উঠে এল এক পাথরের বাক্স—বর্গাকার, তিন দিক বন্ধ, চতুর্থদিকে ধাতব হ্যাঁজার সঙ্গে শক্তভাবে আটকানো ঢাকনা। উপরিভাগে একটি চিহ্ন খোদাই করা—দুটি সাপ একে অপরের দিকে মুখ করে, মাঝখানে ত্রিশূল। এক ঝলকে দেখে মনে হয় শিবলিঙ্গ, কিন্তু যতটা না ধর্মীয়, তার চেয়ে বেশি প্রতীকী।

অর্ণব বিস্মিত। এমন কিছু ইতিহাস বইয়ে পড়েনি সে—এই ধরনের চিহ্ন সম্ভবত ব্রিটিশ আমলে বিপ্লবীদের ব্যবহার করা গুপ্ত প্রতীক।

বাক্সটি অনেক পুরনো, সম্ভবত ১৮৫০-এর দশকের। সে ফোন করল কলেজের বন্ধু ও প্রত্নতত্ত্ব বিশারদ শালিনী সেন-কে। শালিনী সদ্য এসেছেন লখনউ থেকে, ভারতের বিপ্লবী গুপ্তচক্র নিয়ে তার গবেষণা চর্চিত হয়েছে আন্তর্জাতিকভাবে।

শালিনী এলেন পরদিনই। ওঁরা দু’জনে একসাথে সাবধানে বাক্সটি খুলতে লাগলেন।

ঢাকনা সরাতেই এক তীব্র, পুরোনো ধাতব গন্ধ নাকে এল—জং ধরা লোহার, কিংবা পুড়ে যাওয়া কাগজের গন্ধ। ভেতরে ছিল একটি লাল কাপড়ে মোড়া চিঠি, একটি ছোট ধাতব চাবি, ও একটি পিতলের নল।

অর্ণব ধীরে ধীরে চিঠিটি খুলল। হাতে লেখা, রক্তচাপড়ার মতো লাল কালি।

যদি স্বাধীনতা চাও, এই রক্ত আমার উত্তরাধিকারীকে পথ দেখাবে।
এই চাবি খুলবে সেই সিন্দুক, যা লুকানো হয়েছে রাজবাড়ির তৃতীয় প্রহরে,
যেখান থেকে সূর্য ডোবে, আর জলধারায় নামে করুণার সুর।
রত্ন আমার নয়, দেশের।
বিপ্লবী জমিদার নীলমাধব দত্ত, ১৮৫৭

১৮৫৭—সিপাহী বিদ্রোহ। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের প্রথম আগুন।
অর্ণব কাঁপছিল। তার পূর্বপুরুষ নীলমাধব দত্ত ছিলেন একজন জমিদার, এইটুকু জানত। কিন্তু তিনি যে একজন বিপ্লবী ছিলেন, তা জানত না কেউ। হয়ত ইচ্ছেকৃতভাবেই চেপে রাখা হয়েছিল সেই ইতিহাস—যতটা সম্মান, তার চেয়ে বেশি বিপদ ছিল ব্রিটিশ আমলে।

শালিনী বলল, “এই ‘তৃতীয় প্রহর’ কি কোনও নির্দিষ্ট সময় নির্দেশ করে, না কি পুরনো বাড়ির কোনও ঘর?”

অর্ণব মাথা নাড়ল, “আমাদের রাজবাড়িতে পশ্চিম দিকে তিনটি তলা আছে। হয়ত সেই তৃতীয় তল?”

শালিনী নলটি খুলে দেখল। এর মধ্যে একটি সঙ্কুচিত মানচিত্র ছিল—দোতলার পুরনো সিঁড়ি, ছাদের পেছনের বারান্দা, আর একটি বড় পাথরের পিলারের চিহ্ন দেখা গেল। এর নিচে লেখা এক লাইন:
পশ্চিমের জলধারাই দেখাবে আসল রত্নের মুখ।

এই মুহূর্তে সব যেন অদ্ভুতভাবে মিলে যাচ্ছে—একটি লুকানো সিন্দুক, একটি চাবি, বিপ্লবী উত্তরাধিকার, ব্রিটিশ শাসনের বিরোধিতা। কিন্তু সবথেকে বড় প্রশ্ন—এই গুপ্তধন আদৌ ধন, না দেশের স্বাধীনতার জন্য লুকিয়ে রাখা কোনও দলিল, কোনও ইতিহাসের সত্য?

অর্ণব জানে, উত্তর লুকিয়ে আছে সেই তৃতীয় প্রহরে।
এবার যাত্রা শুরু করতে হবে অতীতের ধুলো জমা সিঁড়ি ধরে।

 

লাল কালি লোহার সিন্দুক

নীলমাধব দত্তের সেই চিঠি ও রহস্যময় মানচিত্র হাতে নিয়ে শালিনী ও অর্ণব যেন দাঁড়িয়ে পড়ল ইতিহাসের এক অদ্ভুত সিঁড়ির গোড়ায়। চাবিটি ছিল ভারী, লোহার তৈরি, কিনারায় সূক্ষ্ম নকশা। সেদিন রাতেই তারা ঠিক করল—পরদিন সকালে রাজবাড়ির তৃতীয় তলায় খোঁজ শুরু করা হবে।

রাজবাড়ির পশ্চিম প্রান্তে যে অংশটা আজকাল ব্যবহারই হয় না, সেখানেই আছে পুরনো তৃতীয় তলা। সেখানে পৌঁছতে হয় এক সরু কাঠের সিঁড়ি দিয়ে, যেটি অর্ণব ছেলেবেলায় শেষবার উঠেছিল তার ঠাকুমার হাত ধরে। সেই সময়টা ছিল রূপকথার মত—কোন ঘরে ভূত থাকে, কোন ঘরে দেবতা, আর কোন ঘর তালা বন্ধ—এই নিয়েই কল্পনার জগৎ।

এবার কিন্তু সবটাই বাস্তব।

তৃতীয় তলায় পৌঁছেই তারা দেখল এক দীর্ঘ লম্বা করিডোর—দুই পাশে মোট ছয়টি ঘর। কাঠের মেঝে চিৎকার করে ওঠে হাঁটার শব্দে। খোলা জানালা দিয়ে রোদের রেখা মেঝের ওপর পড়ছে একদম কোণাকুণিভাবে, ঠিক যেন কোনও অদৃশ্য চিত্রশিল্পী লাইন এঁকে রেখেছে অনুসরণ করার জন্য।

“চিঠিতে লেখা ছিল—‘রাজবাড়ির তৃতীয় প্রহরে, পশ্চিমে, যেখানে জলধারায় করুণার সুর’… মানে কিছু একটা পশ্চিম প্রান্তের ঘরে আছে,” বলল শালিনী।

তারা সেই দিকেই এগিয়ে গেল।

ঘরটির দরজা ছিল অর্ধেক ভাঙা। ঠেলা দিলে খচ করে শব্দ করে খুলে গেল। ভেতরে পুরনো আলমারি, ছেঁড়া চেয়ার, দেওয়ালে অদ্ভুত চুনের দাগ। এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে একটি খোলা জানালা—যেখান থেকে নিচে দেখা যায় বাড়ির পেছনের পুকুর। রোদ পড়ার সময় পানিতে ঝলসে ওঠে কমলা আলো, একদম যেন “করুণার সুর”।

“এই ঘরটাই হতে পারে সেই প্রহর,” বলল অর্ণব।

তারা ঘরের প্রতিটি ইঞ্চি খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। মেঝে থেকে দেওয়াল—কোথাও কোনও সংকেত, গোপন সুইচ, কিংবা ফাঁপা ইট। হঠাৎ অর্ণবের চোখ গেল দেওয়ালের একটি কাঠের খোপের দিকে—সেখানে লাগানো একটা কাঠের ফলকে ধুলোর নিচে কিছু লেখা ছিল।

শালিনী ঝুঁকে পড়ে ধুলো সরিয়ে পড়ল:

“জীবনের চাবি মেলে যেখানে রক্তে লেখা প্রতিজ্ঞা,
সেখানেই খুলবে সে পথ, যা যক্ষদের চোখে অদৃশ্য।”

চাবি! অর্ণব চাবিটি বের করল পকেট থেকে।

তারা চারদিকে খুঁজতে শুরু করল কোনও তালাবন্ধ বাক্স বা লোহার সিন্দুকের মতো কিছু। ঘরের একপাশে আলমারির পেছনে ঠেলতেই বেরিয়ে এল এক ছোট পাথরের মাচা। তার উপর বসে আছে একটি পুরনো লোহার সিন্দুক। কালচে লাল মরিচে ধরা, কিন্তু তার উপর খোদাই করা আছে সেই একই প্রতীক—দুই সাপ ত্রিশূল

অর্ণব চাবি ঢুকিয়ে ঘুরিয়ে দিল।

টক!” করে খুলে গেল সিন্দুকের ঢাকনা।

ভেতরে একখণ্ড মোটা খাতা—ধুলো ঢাকা, পৃষ্ঠাগুলো প্রায় শুকিয়ে আসছে। অর্ণব ও শালিনী ধীরে ধীরে খাতা খুলল।

প্রথম পাতায় লেখা ছিল:

রক্তে লেখা রত্নচিহ্ন
নীলমাধব দত্তের ব্যক্তিগত নথিপত্র
১৮৫৫–১৮৫৭

“এটা তো একেবারে ব্যক্তিগত ডায়েরি!” উত্তেজনায় বলে উঠল শালিনী।

তারা পড়তে শুরু করল—প্রথম কয়েক পাতায় ছিল জমিদারির হিসাব, জমির পরিমাণ, খাজনা আদায়। এরপর একদিনের দিনলিপিতে লেখা:

“আজ ইংরেজ অফিসার গর্ডন এসেছেন। আমার উপর নজর বাড়ছে। আমি তাঁদের বিশ্বাসে রাখতে চাই, কিন্তু তাদের শোষণের বিরুদ্ধে আমার রক্ত ফেটে যাচ্ছে। আমার যে রত্ন আছে, তা শুধু মায়ের গয়না নয়—আমাদের গোপন বিপ্লবী চিঠিপত্র, ফান্ড, যোগাযোগের মানচিত্রও।”

এরপর এক পাতায় লেখা ছিল একটি গোপন গুহার বিবরণ—যেখানে সিন্দুকটি স্থানান্তর করা হয়েছিল বিপ্লবী দল “অগ্নিবীণা”র নির্দেশে। সেই গুহাটি কোনও প্রাচীন গির্জার নীচে।

“অগ্নিবীণা!” শালিনী প্রায় চেঁচিয়ে উঠল। “এই দলটির নাম আমি পড়েছি! বাংলার দক্ষিণাঞ্চলে ১৮৫৬-৫৭ সালের মধ্যেই গোপনে এক বিপ্লবী নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছিল। তারা ইংরেজদের হাতে ধরা পড়েনি, কারণ তারা কাজ করত পুরনো ধর্মস্থানগুলোর গোপন পথ ধরে।”

সঙ্গে ছিল একটি ম্যাপ—যেখানে চিহ্নিত ছিল মেদিনীপুর জেলার ঘাটাল অঞ্চল, আর সেখানে একটি পুরনো ইংরেজ গির্জা।

অর্ণব তাকিয়ে রইল ম্যাপটির দিকে। “আমাদের গন্তব্য এবার ওখানে—ঘাটাল।”

সন্ধ্যা তখন নামছে কলকাতায়। পেছনের পুকুরে স্নিগ্ধ আলো পড়েছে, যেন কেউ অতীত থেকে মুখ বাড়িয়ে বলছে—“আরও এগিয়ে যাও। স্বাধীনতার ইতিহাসের শেষ পাতাটি এখনো লেখা হয়নি।”

 

মফস্বলের মানচিত্রে মৃত্যু

ঘাটাল। মেদিনীপুর জেলার অন্তর্গত এক শান্ত মফস্বল শহর। ইতিহাসের পাতায় যার উপস্থিতি খুব বেশি না হলেও, স্থানীয় লোককথায় বারবার ফিরে আসে তার গুপ্ত অতীতের কথা—বিশেষ করে ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের সময় এই অঞ্চল যে গোপন বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের আখড়া ছিল, তা আজ আর খুব বেশি লোক জানে না।

শালিনী ও অর্ণব, কলকাতা থেকে গাড়ি করে পৌঁছাল এই ঘুমন্ত শহরে। মানচিত্রে চিহ্নিত স্থান অনুযায়ী, তাদের গন্তব্য ছিল শহরের প্রান্তে অবস্থিত একটি পরিত্যক্ত গির্জা—সেন্ট লিউকস চার্চ, ব্রিটিশ আমলে নির্মিত, বহু বছর বন্ধ।

কিন্তু ঘাটালের এক অদ্ভুত রীতি আছে—বাইরের লোকেরা যতবারই এই গির্জা খুঁজতে যায়, কিছু না কিছু দুর্ঘটনা ঘটে। কারও গাড়ি খারাপ, কেউ অসুস্থ, কেউ পথ হারিয়ে ফিরে আসে। শালিনী হেসে বলল, “দেখো, গুজব সব জায়গাতেই আছে।”

তারা স্থানীয় হোটেলে উঠল। রাতে অর্ণব বসেছিল ডায়েরিটি নিয়ে, আবার পড়ে দেখতে। সেখানে লেখা ছিল—

“ব্রিটিশরা বুঝতে পারছে কিছু একটা চলছে। গর্ডন সাহেব গত সপ্তাহে গির্জার সন্নিকটে রাত কাটিয়েছে। আমি রত্নচিহ্ন সিন্দুকটি ওদের নজর এড়িয়ে গির্জার নিচে নিয়ে গেছি, যেখানে পুরোহিত থমাস আমায় সাহায্য করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘যে পথ মৃত্যুকে ভয় পায় না, সে-ই দেখতে পাবে সত্যের দরজা।’”

অর্ণব ভাবল, “গির্জার নিচে তাহলে কিছু একটা আছে। গোপন চেম্বার?”

পরদিন সকালে তারা রওনা দিল সেই পরিত্যক্ত চার্চের দিকে।

পথে একটি ছোট দোকানে দাঁড়িয়ে জল নিচ্ছিল অর্ণব। দোকানদার লোকটি তাকিয়ে বলল, “গির্জার দিকে যাচ্ছেন বাবু?”

অর্ণব কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করল, “হ্যাঁ, কিছু সমস্যা আছে?”

লোকটি নিচু গলায় বলল, “এই গ্রামে গির্জার নিচে নাকি ভূতের বসবাস। আগে এক শহুরে লোক ঢুকেছিল, তাকে নাকি সাপে কেটেছিল। ওর মুখ থেকে বেরিয়েছিল ‘ত্রিশূল আর সাপ’, ঠিক আপনি যেমন বললেন…”

অর্ণব থমকে গেল।

“আপনি কি জানেন, এখানে ১৮৫৭-র সময় কোনও জমিদার এসেছিলেন?” জিজ্ঞেস করল শালিনী।

লোকটি বলল, “জানি না, তবে শুনেছি এক দত্তবাবু এসেছিলেন ব্রিটিশদের সঙ্গে। কিন্তু তার আসল পরিচয় কেউ জানত না। তারপর গির্জায় আগুন লাগে। বহু বছর কেউ ঢোকেনি।”

সেন্ট লিউকস চার্চ।

একদম ব্রিটিশ স্থাপত্যের নিদর্শন—উঁচু গম্বুজ, পাথরের ক্রুশ, ভাঙা জানালা। দরজায় তালা, কিন্তু পাশের একটি ভাঙা জানালা দিয়ে তারা ভেতরে প্রবেশ করল।

চোখের সামনে ধুলো আর ছাঁকনির ঝুলে থাকা রোদে ছায়া তৈরি করছে কবরফলক আর মূর্তির ওপর।

শালিনী এগিয়ে গেল মূল বেদীর দিকে। সেখানে ছিল একটি বড় পাথরের ক্রস, যেটি ভাঙা। নিচে লেখা:

“Here lies Father Thomas, 1857. Killed in fire.”

অর্ণবের মনে পড়ল ডায়েরির কথা। তিনিই তো ছিলেন সেই পুরোহিত।

হঠাৎ বেদীর নিচে কাঠের মেঝের উপর কিছু অদ্ভুত দাগ চোখে পড়ল। তারা ধুলো সরিয়ে দেখল—তিনটি ত্রিশূল চিহ্ন পাশাপাশি আঁকা।

“এটা একটা সংকেত,” বলল শালিনী।

তারা চাপ দিতে শুরু করল কাঠের উপর। হঠাৎ এক জায়গায় চাপ দিতেই শব্দ হল খচ!” — কাঠ সরে গেল। নিচে পাথরের সিঁড়ি।

তারা ব্যাগ থেকে টর্চ বের করে নামতে শুরু করল। নিচে নেমে আসতেই বোঝা গেল এটি ছিল গির্জার এক গুপ্ত কক্ষ—পুরনো সময়ে গোপনে কিছু রাখার জন্য নির্মিত।

কিন্তু তখনই এক শব্দ… পেছনে যেন কারও পায়ের আওয়াজ।

অর্ণব টর্চ ঘুরিয়ে তাকাল। কেউ নেই।

কিন্তু মাটিতে পড়ে আছে একটা নতুন পদচিহ্ন… কাদা লেগে থাকা।

“আমরা একা নই,” বলল শালিনী ধীরে।

হঠাৎ পেছন থেকে ঝড়ের মতো এক আওয়াজ!
ফিরে যাও! মৃত্যুর পথ এটা!”

এক মুহূর্তের জন্য আলো নিভে গেল।

শুধু সেই ত্রিশূল চিহ্ন, অন্ধকারে জ্বলজ্বল করে উঠল।

গির্জার নীচে গোপন পথ

আলো নিভে যাওয়ার পর এক মুহূর্ত যেন চিরকাল স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। অর্ণব আর শালিনী দাঁড়িয়ে ছিল গির্জার নিচের সেই গোপন ঘরে, সামনে ত্রিশূল চিহ্নের পাশে কাদা-ভেজা পদচিহ্ন। হাওয়ার দমকা ঘূর্ণি যেন ফিসফিস করে কিছু বলছে, কিন্তু ভাষাটা বোঝা যায় না।

টর্চ আবার জ্বলে উঠল।

অর্ণব চারপাশে তাকাল—ঘরের এক প্রান্তে পাথরের দেওয়ালে কিছু খোদাই রয়েছে। অনেকটা গ্রীক বা রোমান লিপির মতো, কিন্তু তার মধ্যে বাংলা ও ল্যাটিনের এক অদ্ভুত মিশেল। পাশে একটি ত্রিশূলের মতো আকৃতি—উপর থেকে নিচ পর্যন্ত একটি রেখা, দুই পাশে দুটি সাপ একে অপরকে জড়িয়ে।

“এটা সেই রত্নচিহ্ন,” বলল শালিনী।

তারা কাছাকাছি গিয়ে দেখল—চিহ্নটির নিচে পাথরের একটি খাঁজ। অর্ণব ডায়েরি থেকে পড়েছিল, “জীবনের চাবি মেলে যেখানে রক্তে লেখা প্রতিজ্ঞা।” সে পকেট থেকে সেই লোহার চাবিটি বের করে খাঁজে ঢুকিয়ে ঘোরাল।

ঘরঘর ঘরর…” করে শব্দ হল। পাথরের দেয়াল সরতে লাগল। আস্তে আস্তে খুলে গেল এক অন্ধকার সুড়ঙ্গ।

সুড়ঙ্গের ভেতর বাতাস ঠান্ডা ও আর্দ্র। মাটির গন্ধ, শ্যাওলা ধরা দেয়াল, আর দূর থেকে ভেসে আসা জলের টুপটাপ শব্দ।

“তুমি তো জানো না, ইতিহাসে কতগুলো গির্জা বা মঠের নিচে গুপ্ত সুড়ঙ্গ ছিল, যেগুলো ব্যবহার হত পালানোর পথ বা গুপ্ত মিটিং করার জন্য,” বলল শালিনী।

তারা অগ্রসর হল।

দেয়ালের পাশে মাঝে মাঝে ছোট ছোট আলো রাখার খোপ, যার কিছুতে মোমবাতির পুরনো অবশিষ্ট রয়ে গেছে। কিছু জায়গায় অদ্ভুত প্রতীক—আগুন, চোখ, পাখি, বা কোনো অদ্ভুত মুখোশ আঁকা।

হঠাৎ অর্ণব থমকে দাঁড়াল।

“তুমি শব্দ শুনলে?” সে ফিসফিস করে বলল।

পেছনে স্পষ্ট কিছু ছায়ামূর্তি—কেউ যেন অনুসরণ করছে। কিন্তু আলো ফেললে কিছুই দেখা যায় না।

তারা দ্রুত এগিয়ে চলল। সুড়ঙ্গ এবার দু’ভাগে বিভক্ত হয়েছে—একটি বাঁ দিকে, অপরটি ডান দিকে। কিন্তু কোনও দিকেই কোনও চিহ্ন নেই।

“বাঁ দিকে যাওয়া উচিত,” বলল শালিনী। “কারণ চিহ্নগুলোর দিক সেদিকেই মুখ করে।”

তারা বাঁ দিকে হাঁটতে লাগল।

হঠাৎ একটি কোণে এসে তারা পৌঁছাল এক গোলাকার কক্ষে—মাঝখানে একটি লোহার ঘেরাটোপ, ঠিক যেন কোনও জেলখানার গেট। তার ভিতরে মাটির মধ্যে কিছু একটা উঁকি মারছে।

টর্চের আলোতে স্পষ্ট হল—একটি ছোট লোহা মোড়া কফিন!

কফিনটির গায়ে খোদাই:

For the silent soldiers of fire. Here lies the keeper.

“অগ্নিবীণা!” শালিনী প্রায় চিৎকার করে উঠল।

কফিনের ঢাকনা খুলতে গিয়ে দেখা গেল, এটি একটি ফাঁপা বাক্স। এর ভিতরে নেই কোনও মৃতদেহ—আছে ছোট ছোট ধাতব সিলিন্ডার, কিছু কাগজের মোড়ানো জিনিস, একটি পুরনো অস্ত্র—যেটি দেখতে অনেকটা ত্রিশূল-আকৃতির, কিন্তু আসলে একটি বিপ্লবী পতাকার দণ্ড।

এবং… একটি খাতার পাতার মধ্যে প্যাঁচানো রক্তাক্ত ছোট কাপড়—সঙ্গে একটি বাক্য:

“এই রক্ত রত্ন নয়—এই রক্ত ইতিহাস।”

ঠিক তখনই কক্ষের বাইরে পায়ের শব্দ—জুতোর ঠুকঠুক আওয়াজ। কেউ বা কারা ঢুকছে সুড়ঙ্গ পথে। অনেকগুলো পায়ের শব্দ।

“আমাদের খুঁজে পেয়েছে কেউ,” ফিসফিস করল অর্ণব।

তারা দ্রুত সব জিনিস ব্যাগে ভরে নিল। শালিনী দেয়ালের একপাশে হাত বুলিয়ে খুঁজতে লাগল কোনও লুকনো দরজা বা গোপন পথ। হঠাৎ এক অংশে চাপ দিতেই পাথরের দেয়াল ফাঁক হয়ে গেল—একটি সরু বক্র গলি।

আর দেরি না করে তারা ঢুকে পড়ল সেই পথে। পেছনে আবার সেই আওয়াজ—এইবার অনেক জোরে।

গির্জার নীচে গোপন পথ তাদের নিয়ে চলল ইতিহাসের অন্য দরজার দিকে, কিন্তু এখন সামনে শুধু অন্ধকার আর ছায়া।

ছায়ার শহর বিশ্বাসঘাতকতা

সেই সরু বক্র পথ দিয়ে অর্ণব ও শালিনী দৌড়ে চলেছে। গা-ঘেঁষা দেয়ালের মধ্যে কোথাও আলো নেই, শুধু সামনে পিছলে পড়া জলের শব্দ আর পেছনে ধাওয়াকারীদের ক্রমবর্ধমান পায়ের ধ্বনি।

“দরজা বন্ধ কর!” শালিনী ফিসফিস করে চিৎকার করল।

অর্ণব পথের প্রবেশমুখে চাপ দিয়ে পাথর সরিয়ে দিল। ভারী পাথরের ঠাস শব্দে দৃষ্টি ঝাঁপসা হয়ে এল, কিন্তু শত্রুরা যেন আর একটু পেছনে।

তারা থামল না। সুড়ঙ্গ যেন ক্রমশ চওড়া হতে লাগল। কয়েক মিনিট পরে তারা পৌঁছাল একটি বিশাল প্রাচীন কক্ষে—মাটির নিচের সভাকক্ষ বললে ভুল হবে না। ছাদের গম্বুজের মতো স্থাপনা এখনও মজবুত, চারদিকে ভাঙা মাটির প্রদীপের দাগ।

এই কক্ষের একপাশে ঝুলে আছে একটি বিশাল ছাপা কাপড়—যেটা অনেকটা রাজা বা নেতাদের উপবিষ্ট থাকার পটচিত্রের মতো। আর তাতে আঁকা একটি বড় ছায়ামূর্তি—ত্রিশূল হাতে, মুখ অর্ধেক ঢাকা, আর পায়ের নিচে ইংরেজদের পতাকা ছিঁড়ে পড়ে আছে।

“এটা একটা বিপ্লবী আখড়া ছিল!” শালিনী বিস্মিত।

চারদিকে খুঁজতে খুঁজতে তারা এক কোণে পেল ছোট চেম্বারের মতো একটি ঘর, যাতে ছিল পুরনো কিছু দলিল, ছেঁড়া চিঠি, আর একটি সিন্দুক।

সিন্দুক খুলতেই বেরোল—চামড়ার মোড়া একটি নথি। উপরে লেখা:

“City of Shadows – Final instructions, 1857.”
প্রদত্ত চিহ্নগুলি ছাড়া ভেতরে প্রবেশ নিষেধ। বিশ্বাসঘাতক যেন চিহ্নহীন হয়।

সাথে ছিল এক টুকরো রক্তে লেখা ছেঁড়া কাগজ:

“হেমেন বিশ্বাস, গোপন খবর জানিয়ে দিয়েছে ইংরেজদের। সে আজও বেঁচে আছে, নতুন নামে…”

অর্ণব থমকে গেল।

“হেমেন বিশ্বাস… এটা তো আমার ঠাকুরদার নাম!”

শালিনী তাকিয়ে রইল।

“তুমি আগে বলোনি…?”

“না… কারণ আমি জানতাম না উনি এইভাবে যুক্ত ছিলেন…”

ঠিক তখনই ওপাশ থেকে আওয়াজ।

“আর লুকিয়ে লাভ নেই। দরজাটা খুলতেই হবে।”

একটা ঠাস শব্দে তারা বুঝল—ধাওয়াকারীরা দরজা ভেঙে ফেলেছে।

অর্ণব আর শালিনী একে অপরের দিকে তাকাল। এরপর শালিনী চট করে ব্যাগ থেকে একটি পুরনো কাগজ বের করে বলল, “এই মানচিত্রটা দেখ। এখানে অন্য একটা সুড়ঙ্গ চিহ্নিত আছে, যা বেরিয়ে যায় মন্দিরের ভেতর দিয়ে।”

তারা দ্রুত সেই দিকেই এগোতে লাগল।

কিন্তু পেছনে শব্দটা যেন কাছাকাছি। হঠাৎ একটি ছায়া গিয়ে পড়ল তাদের পথ রুদ্ধ করে।

একজন দাঁড়িয়ে—চোখে চশমা, হাতে রিভলভার। কণ্ঠস্বর ঠান্ডা।

“খুব খুঁজেছি তোদের। এবার চল, সময় শেষ। গুপ্তধন আমাদের প্রাপ্য, দেশের না।”

শালিনী ফিসফিস করে বলল, “ও-ই লোকটা আমাদের হোটেলেই ছিল, রাতে যিনি জিজ্ঞেস করছিল গির্জার দিক।”

অর্ণব ধীরে ব্যাগের চেন খুলল।

তাদের চারপাশ ঘিরে ফেলল আরও তিনজন—হাতভর্তি অস্ত্র।

“তোমরা বিশ্বাসঘাতকদের বংশধর,” বলল ছায়ামূর্তি।

ঠিক তখনই সুড়ঙ্গের ছাদ থেকে খসে পড়ল এক পাথরের চাঙড়, এক ছায়ামূর্তিকে চাপা দিল। হঠাৎ টর্চের আলোতে দেখা গেল—চাঙড়ের গায়ে খোদাই:

“যে বিশ্বাসঘাতক, তার উপরই পড়ে অতীতের ভার।”

এই সুযোগে শালিনী টেনে ধরল অর্ণবকে, আর তারা পাশের গোপন দরজা ঠেলে ঢুকে পড়ল।

পেছনে শুধু শোনা গেল সেই কণ্ঠস্বর:

“আমরা আবার আসব। এই খেলা শেষ হয়নি…”

তারা গুহার অন্য দিক দিয়ে বেরোল এক প্রাচীন মন্দিরের মূলচত্বরে। ভোরের আলো পড়ছে গাঁয়ের গা ঘেঁষে। কিন্তু তাদের পেছনে পড়ে আছে রক্ত, ধ্বংসস্তূপ, আর এক গুপ্ত চিহ্ন—যেটা হয়তো পরবর্তী পথের দিশা।

 

মন্দিরের রহস্য শতাব্দীর দাগ

ভোরের প্রথম আলো যখন অন্ধকার সুড়ঙ্গের শেষে এসে পড়ে, তখন সেটা মুক্তির মতো মনে হয়। অর্ণব ও শালিনী হাঁপাতে হাঁপাতে গুহার অপর প্রান্ত দিয়ে বেরিয়ে এল। তারা দাঁড়িয়ে আছে এক পুরনো, ছেয়ে যাওয়া মন্দির চত্বরে—ভাঙা ভগ্নপ্রায়, কুঁচকে যাওয়া স্তম্ভ আর অর্ধেক ধ্বংসপ্রাপ্ত গর্ভগৃহ।

মন্দিরের দরজায় বড় করে লেখা —

গুপ্তেশ্বর নাথ মন্দির, স্থাপিত ১৭৬৫

“এত পুরনো মন্দির! ইতিহাসের পাতায় তো নেই…” অর্ণব বিস্ময়ে বলল।

শালিনী বলল, “এই ধরণের মন্দিরই তো ইতিহাসের বাইরে বেঁচে থাকে। লোকমুখে, ধ্বংসস্তূপে, আর রহস্যে।”

তারা চত্বরে হাঁটতে লাগল। মাটিতে ছড়ানো অজস্র ভাঙা পাথরখণ্ড, কিছুতে অলংকরণ, কিছুতে খোদাই, আর কিছুতে পুরাতন গন্ধক।

অর্ণব হঠাৎ থমকে গেল।

একটি খোদাই চোখে পড়ল—ত্রিশূল, আর তার নিচে লেখা:

যারা প্রতিজ্ঞা রাখে, তারাই দেখবে আলোকপথ।

তারা গর্ভগৃহে প্রবেশ করল। ভেতরে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। চারদিকে পুরনো প্রস্তর মূর্তি, ধুলোয় ঢাকা, যেন শতাব্দীর ঘুমে।

কিন্তু কেন্দ্রে থাকা কালো পাথরের শিবলিঙ্গের নিচে আবার সেই চিহ্ন—ত্রিশূল আর দু’টি সাপ। শিবলিঙ্গের বেসমেন্টে ছোট একটি কাঠের ঢাকনা।

শালিনী বলল, “এটা খুলে দেখি।”

ঢাকনাটি সরাতেই নিচে ছোট একটি গর্ত—সেখানে একটি তাম্রলিপি রাখা, আর একটি রক্তে লাল হওয়া কাপড়ে মোড়ানো সোনালি বালা।

তাম্রলিপিতে লেখা—

“তুমি যদি সত্যিই উত্তরসূরি হও, তবে লোহিত প্রবেশদ্বারের কাছে এসো। রক্ত দিয়ে মেলে পথ, হৃদয় দিয়ে আসে উত্তর। বিশ্বাসঘাতকের পথ নয়, সত্যপথ খুঁজো।”

তাদের মনে পড়ল সেই ছেঁড়া নোট, যেখানে বলা হয়েছিল — “City of Shadows”

“লাল প্রবেশদ্বার?” অর্ণব ভ্রু কুঁচকে বলল।

ঠিক তখনই বাইরের দিক থেকে আওয়াজ।

“তোমরা মন্দিরেই এসেছো! খুব ভালো করেছো। এখানেই তোমাদের শেষ হবে।”

চেনা কণ্ঠ। সেই শত্রুরা এসে গেছে। এইবার আরও সংগঠিত, অস্ত্রধারী।

“আরও কেউ আছে!” শালিনী ফিসফিস করে বলল। “ওরা একা নয়।”

অর্ণব চারপাশে তাকাল। মন্দিরের একটি পাশের দেওয়ালে পুরনো একটি গুহা-প্রবেশদ্বার দেখা গেল, অদ্ভুতভাবে লালচে পাথরে তৈরি।

“ওটাই তো লাল প্রবেশদ্বার!”

তারা দৌড়ে ঢুকে পড়ল সেই গুহায়।

গুহা যেন আরেক পৃথিবী—সারি সারি খোদাই, কিছু জায়গায় রক্তের দাগের মতো গাঢ় ছোপ, আর বাতাসে পুরাতন ধূপ-ঘ্রাণ। দেয়ালে একটি অংশে লেখা—

যে উত্তরসূরি শত্রুর হাত থেকে সত্য রক্ষা করতে পারে, তার রক্তেই খুলবে শেষ দ্বার।

শালিনী ভাবল, “ডায়েরির লেখাগুলোর সঙ্গে মিলে যাচ্ছে সবকিছু।”

কিন্তু তখন হঠাৎ একটি ছায়া গুহার মুখে দাঁড়াল। হাতে বন্দুক।

সেই শত্রু।

“তোমরা খুঁজে পেয়েছো যা আমরাও চেয়েছিলাম বহু বছর ধরে,” সে বলল। “তোমার ঠাকুরদা আমাদের দলের লোক ছিলেন, পরে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন। আমরা সেই উত্তরাধিকার চাই।”

অর্ণব ধীরে নিজের হাত কেটে দিল পাথরের ধারালো কিনারায়। রক্ত ফোঁটা পড়ল মাটির উপর।

সেই মুহূর্তে গুহার ভিতরের প্রাচীন দরজায় এক বিকট শব্দ—“খচ খচ”—দরজা খুলে গেল।

তার পেছনে অন্ধকার নয়—একদম স্বর্ণালী আলোয় ঝলমল, প্রাচীন ধাতুর দেয়াল, পাথরের মূর্তি, আর এক বিশাল ধাতব সিন্দুক।

সেই ছিল প্রকৃত রত্নচিহ্নের ঘর।

শত্রু হতবাক। সে বন্দুক উঠাতে যাচ্ছিল।

ঠিক তখনই গুহার ছাদ থেকে ছিঁড়ে পড়ল একটি চাঙড়—দরজা বন্ধ হয়ে গেল ভিতর থেকে।

অর্ণব ও শালিনী বন্দী, কিন্তু নিরাপদ।

তারা তাকাল একে অপরের দিকে।

“আমরা এক শতাব্দীর রহস্য উন্মোচন করেছি,” বলল শালিনী।

অর্ণব বলল, “কিন্তু এই যাত্রা এখনও শেষ হয়নি…”

রত্নচিহ্নের নীচে প্রেতাত্মার পাথর

গুহার দরজা সশব্দে বন্ধ হয়েছে। বাইরের শত্রুরা ধাক্কা দিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু এই গোপন প্রকোষ্ঠ তাদের নাগালের বাইরে। অর্ণব আর শালিনী ধীরে ধীরে সামনে এগোচ্ছে।

ভেতরটা যেন অন্য জগত—চারদিকে ঘন ধাতুর দেয়াল, শিলালিপি দিয়ে মোড়া স্তম্ভ, আর কেন্দ্রে একটি বিশাল সিন্দুক। সেটি পুরোপুরি সোনালি নয়, বরং তামা আর রুপোর মিশেলে তৈরি, যার গায়ে ত্রিশূল ও দুই সাপের সেই পুরনো চিহ্ন।

সিন্দুকের পাশে একটি খোদাই করা ফলক:

এখানে রত্ন নয়, রক্ত আছে। যা দেশের নয়, তার হাতে গেলে নেমে আসবে অভিশাপ।

শালিনী মুখে হাত দিল। “অর্ণব… যদি এই রত্নচিহ্ন আসলে অভিশপ্ত কিছু হয়?”

অর্ণব ধীরে কাছে এগোল। সিন্দুকের চাবি দেওয়ার মতো কোনও গর্ত নেই। কিন্তু মাঝখানে একটি পাথরের খাঁজ, অনেকটা হাত রাখার মতো।

“হয়তো এটা রক্তের মাধ্যমে খোলে,” বলল সে।

হাত বাড়িয়ে পাথরে ছুঁতেই অদ্ভুত শীতলতা। তারপর হঠাৎ চারপাশ কেঁপে উঠল।

সিন্দুক নিজে থেকেই খুলে গেল।

ভেতরে কী আছে?

না, কোনও মণি-মাণিক্য নয়।

ভেতরে একটি পুরনো, কালো কাপড়ে মোড়া মূর্তি—মানবাকৃতি, চোখ নেই, মুখভঙ্গি নিঃশব্দ চিৎকারের মতো।

তার গায়ে লেখা:

আমি সেই আত্মা, যে প্রহরা দিই বিশ্বাসঘাতকদের রক্তের গন্ধে।

আর নিচে রাখা একটি পাথরের ফলক, তাতে এক মৃতদেহের খণ্ডিত ছবি—জীবন্ত নয়, কিন্তু মনে হচ্ছে কিছু একটা বলছে।

অর্ণব পড়ল সেই ফলক:

“আমি রাজেন্দ্রনাথ। আমি বিশ্বাসঘাতক ছিলাম। আমার আত্মা মন্দির পাহারা দেয়, যতক্ষণ না সত্য উত্তরসূরি আসে।”

ঠিক তখনই গুহার ভিতরের বাতাস জমে উঠল।

এক ঠান্ডা শ্বাস—যেন কারো উপস্থিতি আছে, অদৃশ্য, কিন্তু গভীর।

“অর্ণব…” শালিনী কাঁপা গলায় বলল, “ওটা… নড়ছে!”

মূর্তির চোখদুটো খুলে গেল—নয়নহীন, তবু দু’টি গহ্বর থেকে বেরোল কালো ধোঁয়া।

চারদিকে অন্ধকার ছেয়ে গেল।

এক নিঃশব্দ কণ্ঠ ভেসে এল—

তুমি কি সত্যিকারের উত্তরসূরি?”

অর্ণব কাঁপা গলায় বলল, “আমি রক্তে আসিনি, আমি এসেছি সত্যের খোঁজে।”

অদৃশ্য কণ্ঠ উত্তর দিল—

তবে তুমি মুক্ত। কিন্তু মনে রেখোপ্রত্যেক উত্তরসূরি যদি সত্য ভুলে যায়, অভিশাপ আবার ফিরে আসবে।

গুহা আবার আলোয় উদ্ভাসিত হল।

মূর্তিটি নিস্তেজ, কিন্তু পাশে একটি ছোট বাক্স খুলে গেছে—তার ভিতরে আছে একটি সোনালি মানচিত্র, যা ইঙ্গিত করছে ব্রিটিশ আমলের আরও এক গোপন জায়গা… হয়তো চূড়ান্ত রত্ন যেখানে আছে।

“এটাই শেষ নয়,” শালিনী বলল। “এই মানচিত্র আমাদের আরও গভীরে নিয়ে যাবে।”

অর্ণব মাথা নাড়ল।

“এটা শুধু গুপ্তধনের খোঁজ নয়—এটা ইতিহাসের ন্যায় ফেরানোর লড়াই।”

পেছনে আবার কড়া শব্দ। শত্রুরা বুঝে গেছে—তারা এবার বড় হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

শালিনী বলল, “আমাদের এখনই এখান থেকে পালাতে হবে। কিন্তু কোথায়?”

অর্ণব হাতের মানচিত্র খুলে বলল, “এই গুহার এক গোপন পথ আছে—যেটা যায় কুচবিহার রাজবাড়ি পর্যন্ত।”

“আরেকটা গুপ্তচিহ্ন?” শালিনী চোখ মেলে তাকাল।

“না,” অর্ণব বলল, “এটা চূড়ান্ত পরীক্ষা। আমরা এবার পৌঁছবো শেষ অধ্যায়ে।”

কুচবিহারের চূড়ান্ত খেলা সত্যের মুকুট

গুহার ভিতর থেকে খোলা সেই সংকীর্ণ সুড়ঙ্গ দিয়ে অর্ণব ও শালিনী এগিয়ে চলেছে। পিছনে শত্রুরা মরিয়া হয়ে খোঁজ করছে, কিন্তু এই পথ কারও জানা নয়—এটা সেই ‘নির্বাক পথ’ যা শুধুমাত্র প্রহরীর অনুমতিতে খুলে।

তারা পৌঁছল একটি কুয়োর মুখে, বহুদিনের ধুলা আর মাকড়সার জালে ঢাকা। সেটা ঠেলে ওপরে উঠতেই চোখে পড়ল—এক বিশাল প্রাচীন প্রাসাদ, ভাঙা বারান্দা, আর জমে থাকা জল।

তারা পৌঁছে গেছে কুচবিহার রাজবাড়ির প্রাচীন অংশে, যা সাধারণ পর্যটকদের জন্য বন্ধ।

শালিনী নিচু গলায় বলল, “এই রাজবাড়ি ব্রিটিশদের সঙ্গে দীর্ঘদিন মিত্র ছিল, কিন্তু ১৮৫৭-র বিপ্লবের সময় এখানেই অনেক বিপ্লবী আশ্রয় পেয়েছিল। সেই ইতিহাস লুকিয়ে গেছে এই দেয়ালের ভিতর।”

অর্ণব মানচিত্র দেখে বলল, “দেখো, এখানে আছে ‘সিংহদরজার নিচে গোপন প্রকোষ্ঠ’। সেটা খুঁজতে হবে।”

দু’জনে ছুটে চলল ধ্বংসস্তূপের ভিতর দিয়ে। সিংহদরজার নিচে পাথরের মেঝেতে খোদাই করা—একটি ঘোড়া, তার পিঠে তলোয়ারধারী সৈনিক।

একটি ইট চাপা দিয়ে রাখা খাঁজে হাত রাখতেই মেঝে ফাটল। সিঁড়ি নামল নিচের দিকে।

তারা নামল, পায়ের শব্দ প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল পাথরের দেয়ালে। নিচে পৌঁছে চোখে পড়ল—এক বিশাল কক্ষ, যার দেয়ালে ব্রিটিশদের সময়ের চিহ্ন, রক্তের ছোপ, আর প্রাচীন ব্রাহ্মী লিপিতে লেখা—

সত্য যারা বহন করে, তারাই পাবে রাজমুকুট। কিন্তু যে নিজের রক্ত ইতিহাসে লিখতে পারে, সে প্রকৃত উত্তরসূরি।

ঘরের একপাশে একটি বিশাল সিন্দুক। তার সামনে একটা পাথরের টেবিল, আর তাতে রক্ষিত ছোট একটা রক্তমাখা চাবি।

ঠিক তখনই পেছন থেকে আওয়াজ—“শেষমেশ পেয়ে গেলাম!”

তিনজন অস্ত্রধারী প্রবেশ করল কক্ষে। তাদের মুখে বিজয়ী হাসি।

নেতা বলল, “চাবি দাও, আর সরে দাঁড়াও। আমরা জানি রত্নচিহ্ন এখানেই আছে।”

অর্ণব পিছিয়ে গেল, কিন্তু হঠাৎ ব্যাগ থেকে আগের রক্তমাখা কাপড় বের করে বলল, “তোমরা জানো না, এটা শুধু ধন নয়, অভিশাপও বহন করে। চাবি বসানো মাত্র সত্য বিচার করবে—কে উত্তরসূরি, আর কে বিশ্বাসঘাতক।”

নেতা হেসে উঠল, “আমরা ভয় পাই না। চাবি দাও!”

অর্ণব চাবি দিল, কিন্তু তার আগেই সে একটা ঘূর্ণি চেপে ধরল সিন্দুকের পেছনের বোতাম। সেই সঙ্গে এক বিকট শব্দে মেঝে ফেটে গেল, আর শত্রুদের দুইজন নিচে পড়ে গেল এক অন্ধকার গহ্বরে।

নেতা বন্দুক উঠাল। কিন্তু শালিনী ততক্ষণে পেছন থেকে এক পাথরের মূর্তি ঠেলে তাকে ধাক্কা দিল—নেতা মাটিতে পড়ে জ্ঞান হারাল।

অর্ণব ধীরে ধীরে চাবি বসাল সিন্দুকে।

এক ঝলক আলোর সঙ্গে সিন্দুক খুলে গেল।

ভেতরে ছিল—

  • এক স্বর্ণখচিত রাজমুকুট, যাতে খোদাই: জনতার জন্য, ক্ষমতার নয়।
  • একটি পুরনো পাণ্ডুলিপি: ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ছায়াবাহিনীর নথিপত্র।
  • আর একটি ছোট বাক্স, যাতে রক্ষিত রত্নচিহ্নের প্রকৃত ইতিহাস।

অর্ণব বলল, “এটাই সেই প্রমাণ যা দেখাবে—আমাদের পূর্বপুরুষরা বিশ্বাসঘাতক ছিল না, বরং তারা দেশের জন্য জীবন দিয়েছিল।”

শালিনী বলল, “এই চিহ্ন আমাদের পরিচয়, গর্ব আর দায়িত্ব।”

তারা সমস্ত নিদর্শন নিয়ে বেরিয়ে এলো রাজবাড়ি থেকে। বাইরে তখন সূর্য উঠছে, আকাশে লালচে আভা।

এক সপ্তাহ পর

পত্রিকায় শিরোনাম—

কুচবিহারে আবিষ্কৃত বিপ্লবীদের গুপ্তচিহ্নইতিহাসের নতুন অধ্যায় শুরু

অর্ণব ও শালিনী দাঁড়িয়ে আছে একটি ছোট মিউজিয়ামে, যেখানে রাজমুকুট, তাম্রলিপি আর সেই রক্তে লেখা কাপড় স্থান পেয়েছে ‘জাতীয় উত্তরাধিকার’ অংশে।

এক সাংবাদিক প্রশ্ন করল, “আপনারা এই গুপ্তধন নিজেদের রাখতে পারতেন। কেন তা সরকারকে দিলেন?”

অর্ণব বলল, “কারণ এটা কেবল ধন নয়, এটা উত্তরাধিকারের পরীক্ষা। ইতিহাসে নাম লেখানো মানে উত্তরাধিকার নিয়ে চলা—সত্যের পথে।”

শালিনী বলল, “আমরা শুধু পথ খুলে দিয়েছি। আর কে জানে—এর নিচে আরও কত অজানা ইতিহাস লুকিয়ে আছে…”

শেষ

WhatsApp-Image-2025-06-10-at-11.52.19-AM.jpeg

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *